Full premium theme for CMS
‘রিজওয়ান’: সংশয়ের সেতু বেয়ে নাট্য-অভিযাত্রা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি বলেছিলেন, তোমার যদি প্রতিভা, তারুণ্য আর স্বপ্ন থাকে, তবে জেনে রেখো তোমার উড়বার দু’টো ডানা আছে।
সৈয়দ জামিল আহমেদের প্রতিভা, স্বপ্ন দু’টোই আছে, কিন্তু তারুণ্য? ষাটোর্ধ্ব একটা মানুষ তরুণ হয় নাকি?
কেনো হবে না!
রবীন্দ্রনাথ যে প্রায় সত্তরের কোঠায় গিয়ে বহুবিধ বিস্তারিত তার আপন শিল্প-আঙ্গিক থেকে উত্তুঙ্গে গিয়ে আঁকার তুলিকে প্রবল গতি দিলেন, প্রাচ্যের মানুষের মুখ আর রূপ এঁকে এঁকে পাশ্চাত্যের সামনে রূপের মধ্যে অরূপরতন খোঁজার সহজিয়া একটা মস্ত ক্যানভাস গড়ে দিলেন, সেটা কী করে!
সৈয়দ জামিল আহমেদের ‘রিজওয়ান’ একবার দর্শনে যে অন্তঃসারশূন্য কৃৎকৌশলের ভার বুকে বয়ে, চোখে জাদু দেখার চমক ও খানিক ঘোর নিয়ে বেরিয়েছিলাম, দ্বিতীয়বার দর্শনে সেই সব চমক-ঘোর কিবা বিবমিষার মিশ্র যন্ত্রণাকে যোজন যোজন দূর হটিয়ে অনুভব করলাম উপলব্ধির নয়া জমিন। যে জমিনে তিনি এমন ফসল ফলিয়েছেন তাকে আপনার করে তুলে নেবার আগে বারবার ভাবতে হয়, কোন ভাণ্ডে তাকে রাখব। আমাদের ফসলের ভাঁড়ারে সে কি ধরবে, নাকি সে অপরিচয়ের জীবাণুতে আগাছায় রোগ ধরাবে সেইখানে! সেই ভাবনাকে যাচাই করে নিতে ইতিহাস বা অতীত কেনো হবে না দাঁড়ানোর ভর।
একদা অধুনার নাট্যমঞ্চে সহসাই রবীন্দ্রনাথ যখন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নিয়ে উদয় হলেন, গানে গানে নাট্যরচনা আর পরিবেশনের হিম্মত দেখালেন, তখনও বাংলার নাট্যমঞ্চ অতিকথন আর মেলোড্রামাটিক যাত্রা এবং শহুরে মধ্যবিত্তের পারস্পরিক কথোপকথনের চর্ব্যশিল্পেই আটকে ছিল। তরুণ রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য ভ্রমণে গিয়ে পাওয়া ‘আইরিশ মেলোডিজ’ থেকে মুগ্ধতা আর চমকের অভিযোজনে বুনেছিলেন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। বাংলা নাট্যকে গীতসুরপ্রধান বাংলা ও ভারতবর্ষীয় কথা-আখ্যানের নবায়নে তার ভূমিকা ছিল ম্যাজিক্যাল।
সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেই হয়তো-বা সে বিপদের তোয়াক্কা করেন না। দেশে দেশে সব শিল্পের মতো নাট্যক্রিয়ারও এক একটি বিধি আছে, সেই ‘বিধি’র বাঁধন কাটবে’ সে কি এমনি শক্তিমান? আমাদের হালের জামিল আহমেদ বিশ্বনাট্যের আপন পরিভ্রমণ আর অন্তর্যাপনের নির্যাস থেকেই তৈয়ার করেছেন ‘রিজওয়ান’। এবং অবশ্যই তার নির্মাণজীবনের প্রান্তকালে। ফলে একটা অদ্ভুত, বিপর্যস্ত ও দ্বান্দ্বিক লড়াই তাকে করতে হয়েছে কহতব্য আর কথিতের হিশাব মেলাতে। বাংলা এবং বৃহদার্থে ভারতবর্ষের বাখানবয়ানমুখর প্রকাশবাদী বা এক্সপ্রেসিভ পরিবেশনআঙ্গিকের সতর্ক নাগরিকায়নের অন্যতম পুরোধা জামিল এবার পথ ধরলেন উলটোদিকে। ‘সব সংগীত ইঙ্গিতে’ যেখানে থেমে যায়, বোধহয় সেখানেই খুঁজে নিতে চাইলেন বয়ানের সুর ও স্বর।
একেবারেই আধুনিক কবিতার ডিটাচমেন্ট বা বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে ঐক্যসূত্র বুঝে নেবার একটা চ্যালেঞ্জ তিনি নিলেন (রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’ কিংবা কাফকা/ বোর্হেসের প্যারাবল/ অনুগল্পগুলোর নাট্যায়ন এমন রূপ নিতে পারে, বোধ হয়)। কিন্তু নামতা বা অঙ্কের কষা হিশাব শিশুকে শেখাতেও যেদেশে সুর করে করে পড়তে হয়, সেখানে এই ভাঙাচোরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন বয়ানের টুকরো-দানা দিয়ে গল্পের পূর্ণমালা কি বোধিকণ্ঠে পরানো যাবে? উপর্যুপরি সংগীতের প্রবহমানতা দিয়ে সেই অন্তঃসুর কি তৈয়ার করা যাবে শ্রোতাদর্শকের মধ্যে? ‘রিজওয়ান’ দেখতে দেখতেই এ-সকল বোঝাপড়া হয়ে যায়, আশা রাখি। তবু কষ্টিপাথরে ঠুকে ঠুকে আওয়াজ না তুললে ভাবুক-নিন্দুকের শান্তি-স্বস্তি মেলে নাকো।
আমাদের গল্প বলার শৈল্পিক কৌশলের আখর রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’। অমল আর দইওয়ালার সহজ শিশুতোষ গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে খুব বড় কিছু বলে ফেলা। গৃহে বন্দি ‘অসুস্থ’ শিশুর বাইরে যাবার আকুতিকে বুুঝতে বুঝতে বড়দেরও বুঝে ফেলা নিজের বন্দিদশা আর তার থেকে মুক্তির চোখ-বোঁজা আকাঙ্ক্ষা।
‘রিজওয়ান’ তার উলটো। দেখা-চেনা থেকে অদেখা-অচেনাকে বোঝার খেলা এ নয়, এ হলো অদেখা-অচেনার রাশভার থেকে দেখা আর চেনাকে বুঝে নেয়া। সাবজেকটিভ থেকে অবজেকটিভ হওয়া নয়, অবজেকটিভ থেকে সাবজেকটিভ হয়ে ওঠা।
কিন্তু, এখনো অল্পসময়ের ব্যবধানে গ্রাম যেখানে শহরে ঢুকে যায়, শহর চলে যায় গ্রামে, একটি একটি নিতান্ত ব্যক্তিক ঘটনাও চর্চায় হয়ে ওঠে দারুণ সামষ্টিক, সেখানে ভাবনার একটি প্রকাশমাধ্যম, থিয়েটার যার নাম, চিত্তবিনোদন অন্তিমে এখনও যার সারকথা, সেইখানে এমন বিপরীত চলন বিপদের বৈকি! কিন্তু তিনি সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেই হয়তো-বা সে বিপদের তোয়াক্কা করেন না। দেশে দেশে সব শিল্পের মতো নাট্যক্রিয়ারও এক একটি বিধি আছে, সেই ‘বিধি’র বাঁধন কাটবে’ সে কি এমনি শক্তিমান? কহতব্য যখন অন্তর্লোকে গুঞ্জরণ করে, কথিত তখন সর্বশক্তি নিয়েই প্রকাশ পায়। যেন তা কহতব্যের ব্যক্তিকতাকে, তার সর্বজনস্বীকৃতি বা সর্বপ্রেমগ্রহণের সকল ঘাটতি কিবা সংশয়কে মোকাবেলা করবে কথিতের রূপের প্রবল টানে। তখন সে এমনও প্রতিকণ্ঠে গেয়ে উঠতে পারে, ‘আমি ভালোবাসায় ভোলাব না, রূপে তোমায় ভোলাব’! জামিল আহমেদ কি আদতে তা-ই করতে চেয়েছেন?
এবার তবে ‘রিজওয়ান’-এ যাই। ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করি।
‘রিজওয়ান’ হলো মরা মানুষের গল্প। সেখানে একটা মাত্র জীবিত মানুষ, রিজওয়ান। যার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা পরিষ্কার হবো, এখানে সকল মৃত্যুই আদতে মৃত্যু না, হত্যা। অর্থাৎ অমোঘ নিয়তি কিবা প্রকৃতি নয়, মানুষই মানুষের মৃত্যুর কারণ। কিন্তু গল্পের চরিত্ররা এই শ্লেষ আর পরিহাস করে, ভান করে, স্বাভাবিক ‘প্রাকৃতিক’ মৃত্যুই তারা বরণ করেছে; কেউ বলে, মৃত্যুই সহজ, বেঁচে থাকা কঠিন, কষ্টের; কেউ অপার্থিব নৌকায় করে এসে রিজওয়ান ও জীবিতদের উদ্দেশে শ্লেষভরে প্রশ্ন করে, আপনারা কেমন আছেন? আমরা সবাই ভালো আছি। অর্থাৎ মৃতরাই ভালো আছে, সুখে আছে, জীবন-আনন্দে আছে। এই মরণসংকুল পরিহাসের বিরুদ্ধে জৈবনিক অস্তিত্বের ধ্বজা নিয়ে শেষাবধি লড়াই করে যায় একা রিজওয়ান। সে লড়াই প্রতিস্পর্ধী নয়, প্রত্যক্ষ প্রতিরোধের নয়, সশস্ত্র বিপ্লবেরও নয়; সে বাঁধভাঙা শোকের, যন্ত্রণার, আর্তনাদের, সংক্ষুব্ধ অভিমানের। পুরো নাটক জুড়েই রিজওয়ান এ-সকল মৃত্যুকে মেনে-না-নেয়ার আবেগী, অভিমানী, অন্তর্বিপর্যস্ত, মৃত্যুবেষ্টিত জীবন্ত অস্তিত্ব, অসহায় পরাজয়ই যার নিয়তি, জীবন আর বেঁচে থাকার অপর-নির্ণিত অঙ্ক যার ললাটলিখন (স্মর্তব্য মোহাম্মদ রফিকের কবিতা: এ জীবন অন্য কারো, আমি শুধু যাপন করেছি।)
সমকালের বিশ্বব্যাপী ‘মানবিক’ পরাজয়ের যৌথনিয়তির বুক ভরা দীর্ঘশ্বাসই ‘রিজওয়ান’-এর শ্বাসবায়ু, চিতার অঙ্গার কিবা কবরের মাটি তার বিপ্রতীপ শৈল্পিক হৃদয়চন্দন। এই বিপর্যাস, এই আদি-অন্ত সারেন্ডার-করা মর্মবেদনা এবং জীবনাভিমান জামিল আহমেদের ‘রিজওয়ান’ নাট্যের অন্তদুর্গ। একবার যেখানে প্রবেশ করতে পারলে প্রতিরোধের উলটোভাষা পেয়ে যেতে পারে প্রাচ্যের মন ও মনন।
এখন এমন অমৃতদুর্গের বাইরের রূপ আর কাঠামোটা কেমন, অন্তরের কোঠায় যাবার জন্য প্রবেশককে সে কেমন আহ্বান জানায়, কিবা আকর্ষণ করে। সেখানেও এক বিপর্যাস। ‘ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে না থেকে বরং ভবিষ্যৎকেই তুমি নির্মাণ করো মঞ্চে’, এ কি তবে বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চে সেই ভবিতব্যের ইশারা?
মৃত্যু আর অভিমান-বেদনার কান্না এখানে বাঁশি আর বেহালায় বাজে নি, যেনবা বেজেছে তুমুল অর্কেস্ট্রায়। সেই অর্কেস্ট্রা বাজনায় নয়, মানুষের (অভিনেতার) বেপরোয়া গতিতে, চলনে, ছন্দে, নাচনে এবং মধ্যবর্তী নৈঃশব্দ্যের সিনথেসিসে। মৃত্যুপুরী জীবনের চেয়েও সক্রিয় যেনবা। ফলে মৃতের পরাজিতের সিমপ্যাথি বা অনুকম্পা প্রচলধরনে সঞ্চরণ করে না, মুহুর্মুহু তাকে ভেঙে দেয় নাট্যভূমের অবাধ্য ডি-স্পেসিফিকেশন কিবা তলবিচ্যুতিকরণ। রূপের টানে ভুলে যেতে থাকি অন্তরের ঘা, কথনমোহ ভুলিয়ে দিতে থাকে কহতব্যের সত্য নরক। আলো ও ছায়ার ঘেরে, রঙের খেলায়, শরীরের উন্মাতাল ছন্দে, উচ্চ উচ্চ নাদে পথভোলা পথিকেরে ফেরাতে পারবে কি তার মূল ঠিকানায়, সব আয়োজন যেইখানে গিয়ে মঙ্গল-আরতি করে!
সুর, ছন্দ, দৃশ্যমধু, শব্দ ও নৈঃশব্দ্য যতটা এ ভাবযজ্ঞে ঘৃতাহুতি দেয়, কথনদর্শন তাকে ততটাই নিভু নিভু করে, রূপকারিগর যত প্রতিমার অঙ্গে অঙ্গে বোলান জাদুর অঙ্গুলি, প্রতিমার প্রাণব্যঞ্জনা জাগানোর অভিব্যক্তিদানকারী নট-নটীগণ যেন হাঁপিয়ে ওঠেন সেই মতো আপন-উদ্ভাসে কী সঞ্চারে। একটা লড়াই চলে নির্মাণের আন্তঃউপচারম-লে। অবশেষে সে লড়াইয়ে জয়ী হন কারিগর। রূপ দিয়ে ভালোবাসা জাগানোর নতুন খেলায় তিনি জিতে যান। কৃৎকৌশলের জটিল প্রতিমার মুখে মানুষের মমতার বোধিরঙ ছড়িয়ে পড়ে, চোখে তার আবিশ্ব সর্বহারার অশ্রু ছলছল, বুকে অন্তহীন হাহাকার। এমন দীর্ঘ অচেনার পথে পরিভ্রমণ করে শেষে (হয়তো-বা) ভাবুকরসিক তার গন্তব্যে পৌঁছায়, পিছে তার পড়ে থাকে ঝুঁকিপূর্ণ সংশয়ের সেতু।
সেই সেতু দিয়ে পথ হাঁটলেন, হাঁটালেন জামিল আহমেদ। সহজের রাস্তা ছেড়ে কেনো সেই ঝুঁকি আর বিপদের পথ নিল বাংলার নাট্যপদ, সহজের সমস্ত নির্যাস সৌন্দর্য শক্তিকে ঐতিহ্যের নাভিমূল থেকে উৎসারিত করা নাট্যকারিগর কেনো এইবেলা জটিলের, আপাত অপরিচয়ের নন্দনকে বিন্যস্ত করলেন, সে কি কেবলই সৃষ্টিশীলের সীমাহীন প্রাজ্ঞ ‘স্বেচ্ছাচার’, নাকি তার অন্তরেরও অন্তরে নাট্য কিবা শিল্প-অভিযাত্রায় ম্যানিপুলেশন বা বহুন্যাসের অবাধ স্বাধীনতার নতুন অশ্বখুরের চিহ্ন? সমকালের নাট্যদুনিয়ার (বিপ্লবী) তাত্ত্বিক অগাস্তো বোয়াল যে বলেন, ‘ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে না থেকে বরং ভবিষ্যৎকেই তুমি নির্মাণ করো মঞ্চে’, এ কি তবে বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চে সেই ভবিতব্যের ইশারা?
আগামীর জন্য এ সকল প্রশ্ন আর সংশয়ের ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে ‘রিজওয়ান’ আপাতত বঙ্গনাট্যভূমে এক অনুপম, বিস্ময়জাগানিয়া রূপবৃক্ষ। সেই বৃক্ষের চারারোপণসমেত বিকাশের কারিগর সৈয়দ জামিল আহমেদ এবং তার পরিচর্যাকারী নাটবাঙলা’কে (শর)পুষ্পের অভিনন্দন।
শুভাশিস সিনহা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার-নাট্যনির্দেশক। প্রতিষ্ঠাতাসদস্য- মণিপুরি থিয়েটার, সিলেট।