Full premium theme for CMS
সাম্প্রতিক মঞ্চনাটকের বিষয়-আশয়
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
‘সাম্প্রতিক সময়’ আসলে কোন সময় থেকে ধরা যেতে পারে!
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে মঞ্চনাটক যখন নিয়মিত চর্চার একটা শিল্প-মাধ্যম হয়ে ওঠে- তখন বছরান্তেই মনে হতো যেনো তীব্রগতিতে ছুটে চলেছে মঞ্চনাট্যচর্চা। সত্তরের দশকেই প্রবলভাবে ঢাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য শহরগুলোতে নিজের শক্ত-স্বচ্ছ অবস্থানের জানান দেয় মঞ্চনাটক। পরবর্তী সময়ে, অন্তত নব্বই দশকের শুরু পর্যন্ত, যেসব নাট্যকার মঞ্চ-অধিপতি ছিলেন, তাঁরা সবাই সত্তর বা আশির দশকের শুরুতেই নাট্যরচনায় নিজেদের অবস্থান সফলভাবে পাকাপোক্ত করেছিলেন। সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল্লাহ আল-মামুন, মমতাজউদদীন আহমদ, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, এস এম সোলায়মান, আব্দুল্লাহেল মাহমুদ, মান্নান হীরাসহ অনেকের নামই এখানে উল্লেখ করা যায়। এছাড়াও স্বাধীনতা-পূর্বের কয়েকজন নাট্যকার ও অনেক বিদেশি নাট্যকারও পরিচিত হন ঐ সময় থেকেই।
মঞ্চনাটকের পূর্ণতা তার মঞ্চায়নে, দর্শকসমুখে আগমনে। এই পূর্ণতা-আনয়নে নির্দেশক রাখেন প্রধান ভূমিকা। কেউ কেউ মঞ্চনাটককে ‘ডিরেক্টরস মিডিয়া’ও বলে থাকেন। নির্দেশক নাটকের বিষয়-বক্তব্যকে দৃশ্যকাব্যে রূপ দেন অভিনেতৃর অভিনয়গুণ কাজে লাগিয়ে। সুতরাং বলা যায়, একজন নির্দেশকের কাছে একটি সার্থক মঞ্চনাটক রূপায়ণে প্রধানত প্রয়োজন যুৎসই পাণ্ডুলিপি আর এক বা একাধিক গুণী অভিনেতৃ।
নাটকের বিষয় নির্ধারণ করে নাট্যকারের করোটি আর তার নির্মাণের রূপকার নির্দেশক। দুজনই শিল্পী- দুই অধ্যায়ের, দুই ধাপের। স্বাধীন বাংলাদেশের মঞ্চনাট্যচর্চার শুরুর দিকে দেখা গেছে অনেক নাটকের নাট্যকার ও নির্দেশক মোটাদাগে বলতে গেলে এক-সত্তায় একাকার। দলের প্রয়োজনে নাট্যরচনা ও একই তাগিদে নির্দেশনা- দুটি কাজই করেছেন অভিন্ন এক শিল্পী। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল বা বলতে গেলে ব্যতিক্রমটাই বেশি ছিল- বিদেশি কিংবা মঞ্চচর্চার বাইরে থাকা নাট্যকারদের নাটকও মঞ্চরূপ পেয়েছে অন্যের হাতে, অন্য শিল্পীর হাতে। এক সময় অনেক নাট্যকার নিজেদের রচিত নাটকের নির্দেশনার হাত থেকে ‘রেহাই’ পেয়েছেন এবং আমরা আমাদের মঞ্চে গুণী অনেক নাট্যনির্দেশক পেয়েছি, যারা মূলত নাট্যকার নন।
আশির দশকের শুরুতেই অনেক নির্দেশক নাটক নিয়ে নতুন ভাবনায় অবতীর্ন হন এবং নাট্যনির্দেশনায় বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপস্থিতি ঘটান। এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বেশিরভাগটা ছিল ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা বা এনএসডি’র শিক্ষা থেকে এবং বাকিগুলো ছিল দেশের বাইরের নাটক দেখার অভিজ্ঞতা থেকে। সেসব নাটক হঠাৎ করেই মঞ্চনাটকের রূপ যেনো অনেকটাই পাল্টে দিল। নাটকের বিষয়-বক্তব্য আর সু-অভিনয়ের বাইরেও দর্শক নতুনতর আরও অনেক কিছুর স্বাদ পেতে থাকলো। মঞ্চ-আলো-পোশাক-কোরিওগ্রাফি-আবহসংগীত- এই নতুনতর স্বাদের উপাদান। এসব উপাদান আগেও ছিল কিন্তু এদের উপস্থিতি অতটা তীব্রভাবে দৃষ্টি কাড়তো না, যতটা দৃষ্টি কাড়া শুরু করেছে নিরীক্ষাকালীন সময়ে। সব কিছু মিলিয়ে আর সব কিছুর সংযোজনে বাংলাদেশের মঞ্চনাটক হয়ে উঠলো এক পরিপূর্ণ প্রযোজনা।
কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নাট্যকারের করোটিতে যে বিষয়-ভাবনা জাগ্রত হয়, এবং তা রচনার জন্য তিনি ভেতর থেকে যে তাড়না অনুভব করেন, তার ফলেই আমরা পেয়ে যাই একটা নতুন নাটক। রচনাকালে নাট্যকারের সামনে তখন কোনো দর্শক থাকে না, পাঠক থাকে না- এমনকি ‘সময়ও’ থাকে না। থাকে কেবলই লেখাটির প্রতি তার ভেতরকার নিজস্ব তাগিদ। লেখাটিকে কালোত্তীর্ণ করার কোনো মানসিকতাও নাট্যকারের থাকে না, যদি কিছু থেকে থাকে তাহলো একটি মহৎ-সৃষ্টির তৃষ্ণা ও প্রচেষ্টা। কিন্তু কোনো নাট্যদল এবং অতি অবশ্যই একজন নির্দেশক যখন কোনো নাটক মঞ্চে আনার জন্য মনস্থির করেন, তখন প্রথমেই নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে- ‘এই সময়ে, এই নাটক কেনো?’। যখন দর্শককুল মঞ্চে নাটক দেখে, তখন তারা ‘সময়ের’ উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তার কাছে মঞ্চায়িত নাটকটির প্রাসঙ্গিতা তৈরি হয়- কোনো এক ভাবনার যোগসূত্র সে আবিষ্কার করে নির্দেশক ও নাট্যদলের সাথে। কিন্তু নাটকের বিষয়-আশয় যখন সময়কে প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হয়- তখন দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেয়। এর দায় কিন্তু নাট্যকারের না, সম্পূর্ণভাবে নির্দেশকের (এবং নাট্যদলের)। আগেই বলেছি, নাট্যকারের ভাবনা সময়োত্তীর্ণ না-ই হতে পারে। এটা তার অক্ষমতা (অথবা ঐটুকুই তার ক্ষমতা)। অক্ষমতা দোষের কিছু না। কিন্তু নির্দেশক (এবং নাট্যদল) এমন নাটক বেছে নেবে কেনো যে নাটক তাকে ঐ নির্দিষ্ট সময়ে আলোড়িত বা তাড়িত করে না?
বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে নাট্য-বিষয়কে সময়ের সাথে মেলানোর ব্যাপারটা শুরু থেকেই ছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নাটকে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর দুর্নীতি, অবক্ষয়, দুঃশাসন, দুর্ভিক্ষ, বন্যা প্রভৃতি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। যারা বিদেশি নাটক রূপান্তর বা অনুবাদ করে মঞ্চে এনেছেন তারাও ঐসব নাটকের তখনকার সময়ের প্রাসঙ্গিকতাকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন। আশির দশকে এই প্রাসঙ্গিতার প্রয়োগ প্রায় ‘মাত্রা ছাড়িয়ে’ যায়। স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক নাটকের মঞ্চায়ন হয় যেগুলোর শিল্পমান প্রশ্ন সাপেক্ষ ছিল- ফলে অনেক নাটকই তখন পোস্টার ড্রামায় রূপ নিয়েছিল। এর কুফল মঞ্চনাটকে পড়ে নব্বয়ের দশকে। ঐ সময়ে কিছু কিছু নাট্যদল নাটকের বিষয়-ভাবনাকে জরুরি ভাবলেও, বেশিরভাগ নাট্যদল ‘হাসির নাটক’ মঞ্চায়নের দিকে মনোযোগ দিতে থাকে। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে মঞ্চনাটককে তারা কেবলই হাসির-মঞ্চ হিসেবে দেখেছে (এটাও তেমন দোষের কিছু হতো না যদি ঐসব নাটকের প্রয়োগ ও অভিনয়- মোদ্দাকথা প্রযোজনার মান আশাব্যঞ্জক হতো। ঐ সময়ের বেশিরভাগ ‘হাসির নাটক’ স্রেফ ভাঁড়ামী ছাড়া আর কিছুই হয়নি)। সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান-অর্থনীতির সাথে মানুষের সম্পর্ক ও দ্বান্দ্বিকতাও যে বিনোদন হয়ে মঞ্চরূপ পেতে পারে, সেই জ্ঞান অনেকেরই তখনও হয়নি (যদিও বাংলাদেশের মঞ্চ এমন অনেক ঋদ্ধ নাটকের সাক্ষাৎ ততদিনে পেয়ে গেছে)। বাংলাদেশের মঞ্চনাটক নব্বই দশকটা কাটিয়েছে বেশ সংকটের মধ্য দিয়ে, পাড়ি দিয়েছে এক বন্ধুর পথ।
বর্তমান শতকে বাংলাদেশের মঞ্চনাটক অনেক ভাবনা-চিন্তার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে। এই দেড়দশকের মঞ্চনাটকের বিষয়ই মূলত ‘সাম্প্রতিক মঞ্চনাটকের বিষয়বস্তু’ হিসেবে দেখতে পারি। এই সময়ে মধ্যআশিতে মঞ্চনাটকে যুক্ত হওয়া প্রজন্ম ‘সাবালক’ হয়েছে। নতুন সৃষ্ট নাট্যদলগুলোও পরিপক্ক হয়েছে, স্বৈরশাসনকালের সহজ-সস্তা বিষয়ভাবনার ভূত আর হাসিয়ে দম ফাটানোর চেষ্টাও ইতোমধ্যে নিভে গেছে। প্রায় সব নাট্যদলই তাদের নাটকের বিষয় নির্বাচনকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে আসছে। সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে গিয়ে কেবল মৌলিক নাটকেই নিজেদের নিমগ্ন করেনি, মগ্ন হয়েছে বিদেশি নাটক অনুবাদে, রূপান্তরে কিংবা গল্প-উপন্যাসের মঞ্চরূপায়ণে। মুক্তিযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্ব-রাজনীতি, প্রেম, নারীর অবস্থান, সংখ্যালঘুদের সংকট, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, গণতন্ত্রহীনতা, লুটেরাদের দৌরাত্ম, রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা অনিয়ম-শোষণ- এসব প্রাসঙ্গিক বিষয় স্থান পাচ্ছে নাটকে। মৌলিকনাটক, সংস্কৃৃতনাটক, মিথ-আশ্রয়ীনাটক কিংবা কালজয়ী বিশ্বনাটককে সময়ের সাথে মিলিয়ে, নিজেদের অবস্থানের সাথে মিলিয়ে আমাদের মঞ্চনাটক এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সংকট এখনও আছে। আগেই বলেছি, একটি নাটকের সফল নির্মাণ নির্ভর করে দক্ষ নির্দেশকের উপর, যে কিনা যুৎসই পাণ্ডুলিপি আর দক্ষ অভিনেতৃর সমন্বয়ে নাটকের মূল বিষয়-ভাবনা দর্শকের সামনে তুলে ধরবেন। আমাদের দেশে দক্ষ নির্দেশক এখনো হাতেগোনা। আর কুশলী নাট্যকার এবং অভিনয় বিশারদের অভাব তো অভাবনীয়। এর মূল কারণ হচ্ছে- আগাছার মতো নাট্যদলের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং মঞ্চনাটকের গুণগত মান উপলব্ধির অক্ষমতা। যারা ভালো নাটক ভালোভাবে মঞ্চে আনছে, তারা নিয়মিত মঞ্চায়নের সুযোগ কম পাচ্ছে। বিষয়-ভাবনাহীন সাদামাটা দর্শক-বিমুখ নাটকের সাথে ‘গণতান্ত্রিক উপায়ে’ মঞ্চ বরাদ্দ পাওয়ার সংগ্রামে নষ্ট হচ্ছে উৎকৃষ্ট প্রযোজনার বহুল মঞ্চায়ন। বিষয়-বৈচিত্র্যে দর্শকপ্রিয় নাটকের যদি বহুল মঞ্চায়ন ব্যহত হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের মঞ্চনাটকেরই ক্ষতি হবে।
তবে সাম্প্রতিক মঞ্চনাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে আরেকটা আক্ষেপ থেকে যাচ্ছে। কোনো বিষয়কে নাটকে রূপ দেয়ার মতো সৃজনশীলতা সবার থাকে না। আমরা এখনো মৌলিক নাটকের উপর তেমন নির্ভরশীল হতে পারিনি। বিষয়-ভাবনা উন্নত হলেও নাট্যকারের সৃজনশীলতার সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি ভালো নাটক না-ও হয়ে উঠতে পারে। আমাদের দেশে হয়েছেও তাই। এজন্যই নাম উল্লেখ না করেও বলা যায়, নাট্যকারের সংখ্যা আমাদের দেশে নিতান্তই স্বল্প। এদেশে যারা সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখছেন, তারা নাট্যরচনায় কেনো যেনো নিজেদেরকে নিবেদন করছেন না। বংলাদেশের মঞ্চনাটক সৈয়দ শামসুল হক বা সেলিম আল দীনকে পেলেও, তাঁদের পরবর্তী সময়ের কোনো কবি-সাহিত্যিককে নাট্যকার হিসেবে পায়নি (নাসরিন জাহান একটু উঁকি মেরেও সরে গেছেন)। এটা আমাদের একটা মস্তবড় অপ্রাপ্তি। এর একটা কারণ হতে পারে, সৃষ্ট নাটকের মঞ্চরূপ পাওয়ার অনিশ্চয়তা। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, নাট্যরচনাকে সাহিত্যের একটা অংশ হিসেবেই ধরতে হবে- এর মঞ্চরূপ পাওয়ার ‘ভাগ্য’ নির্ভর করবে নির্দেশকের তাড়িত হওয়ার উপর। আমরা দেখেছি বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সাঈদ আহমদ, আবুল হাসানসহ অনেকেই নাট্যরচনায় নিবেদিত হলেও এবং অসাধারণ নাটক উপহার দেয়ার পরও তাঁদের নাটক তেমন একটা মঞ্চরূপ পায়নি। বর্তমান কবি-সাহিত্যিকদের সেখানেই বোধকরি একটা সংশয় থেকে থাকতে পারে। কিন্তু এই সংশয় অবশ্যই বর্জনীয়। সৈয়দ শামসুল হক প্রায়শই বলতেন, তাঁর করোটিতে যে বিষয়-ভাবনা উপস্থিত হতো, প্রথমেই তিনি স্থির করতেন সেটা প্রকাশের মাধ্যম কবিতা?, গল্প?, উপন্যাস?, প্রবন্ধ?, নাকি নাটক? তাঁর এই প্রকাশ-মাধ্যমের ভিন্নতার কারণেই আমরা কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের বাইরেও অসাধারণ কিছু নাটক পেয়েছি। সেই নাটকে ঋদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের মঞ্চ। এমনটা যদি বর্তমান সময়ের কবি-সাহিত্যিকের কাছে প্রত্যাশা করি তা নিশ্চয়ই অপ্রত্যাশিত হবে না।
বিষয়-ভাবনায় ‘সব কালে সমকালীন’ নাটক রচিত হোক। মঞ্চনাটক দর্শককে আনন্দ দিক, ভাবনায় তাড়িত করুক- এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
ইতি
হাসান শাহরিয়ার
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
ভাদ্র ১৪২৪। অগাস্ট ২০১৭