Full premium theme for CMS
তোমাকে অভিবাদন
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[প্রথমে স্বেচ্ছা নির্বাসনে বিদেশ-বিভূঁইয়ে, তারপর দেশে ফেরার তীব্র আকুলতা থাকা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে দেশে ফিরতে না পারার এক বুক বেদনা নিয়ে সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর প্রবাস জীবন পাড়ি দিয়েছেন তিনি! নাম তাঁর শহীদ কাদরী। আশির দশকে বন্ধুদের প্রতি অভিমান করে (তাঁর ভাষায়) দেশ ছেড়ে ছিলেন। আমেরিকার জ্যামাইকায় তাঁর বাসভবনে বসে কবি আলফ্রেড খোকনের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার এই বিশেষ অংশ তাঁরই স্মরণে কবি বন্ধু আলফ্রেড খোকনের অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত হলো, থিয়েটারওয়ালা’র বর্তমান সংখ্যায়। কবি শহীদ কাদরীকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন- সম্পাদক]
শুরুর কাহিনী
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪, স্থানীয় সময় দুপুর ১টা। আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু জামান তার গাড়ি চালিয়ে আমাকে নিয়ে পৌঁছলেন জ্যামাইকার একটি বহুতল ভবনের অভ্যর্থনা কক্ষে। আমার মতো কালো চামড়ার আগন্তুক অভ্যর্থনাকারীকে বললাম- I will meet Bengali poet Sahid Kadri, He is living here. অভ্যর্থনাকারী ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন- whats your name? আমি বললাম- my name is Alfred khokon. সে একটু মুচকি হেসে বলল- Oh you are Bengali poet also! Please go to the 2nd floor. (তার মুচকি হাসির অর্থ কবি শহীদ কাদরী আগেই আমার আসার কথা তাকে বলে রেখেছিলেন) লিফট থেকে নেমে হাতের বামে একটু এগিয়ে দরজার কলিং বেল চাপতেই দীর্ঘাঙ্গী মোটাসোটা ভিনদেশি এক তরুণী দরজা খুলে জানতে চাইলেন- Hello, You are Mr Khokon, right? বললাম- Yes, you are absolutely right. সে বলল- please come in. ভিতরে ঢুকে ঘরের দক্ষিণে তাকাতেই দেখলাম মাথায় সামান্য চুল, গোলগাল মুখের অসুস্থ কবি ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ সোফায় বসে আছেন যেন। কিন্তু না, তিনি কবি শহীদ কাদরী, বাংলা ভাষার তুমুল জনপ্রিয় কবি। শহীদ ভাই তাঁর দরাজ গলায় ডাক দিলেন, এইদিকে আসো ভাই। আমি কাছে গিয়ে বসলাম তাঁর কাছাকাছি। এটাই আমার প্রথম দেখা! সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর প্রবাসে জীবন পার করছেন তিনি! আশির দশকে বন্ধুদের প্রতি অভিমান করে (তাঁর ভাষায়) দেশ ছেড়েছিলেন তিনি।
এভাবে আমাদের কথাবার্তার শুরুর প্রায় আধ ঘন্টা পর অনুমতি নিয়ে বন্ধু জামান তার ভিডিও ক্যামেরায় আমাদের দু’জনের কথাবার্তা ধারণ করা শুরু করলেন। রেকর্ডে পাওয়া আমাদের আলাপচারিতার শুরুটা ছিল এভাবে-
শহীদ কাদরী
সকাল সাড়ে ন’টায় উঠেছি, তুমি আসবে বলে।
আলফ্রেড খোকন
কিন্তু নীরা ভাবী ফোনে বললেন, আপনি নাকি ১১টার আগে ওঠেন না, তাই আমিও দেরি করেছি, যদিও পথে আজ কিছুটা ট্রাফিক ছিল, তাছাড়া জামান তার গাড়ি পার্কিয়ের জন্যে প্রায় ১ ঘন্টা ঘুরেছে আশে-পাশে!
শহীদ কাদরী
বলো, কেমন ছিলে? কবে এসেছ আমেরিকা?
আলফ্রেড খোকন
এসেছি ২০ দিন হলো, যাবার সময় হয়ে গেছে, ৩ দিন বাদেই চলে যাব।
শহীদ কাদরী
বলো কী! আমি তো হুইল চেয়ার ছাড়া চলতে ফিরতে পারি না, সপ্তাহে তিনদিন চলে ডায়ালিসিসের উপর। না হয় তোমাকে কবেই নিজে নিয়ে আসতে পারতাম। নীরাকে বলেছি, ছেলেটি কবে আসছে, কোথায় থাকছে, কে জানে।
আলফ্রেড খোকন
হ্যাঁ, নীরা ভাবীই তো আমাকে ফোন করলেন।
এভাবে আমাদের কথাবার্তার শুরুর প্রায় আধঘন্টা পর অনুমতি নিয়ে বন্ধু জামান তার ভিডিও ক্যামেরায় আমাদের দু’জনের কথাবার্তা ধারণ করা শুরু করলেন। রেকর্ডে পাওয়া আমাদের আলাপচারিতার শুরুটা ছিল এভাবে-
শহীদ কাদরী
বই এনেছো? তোমার বই দরকার। তারপর তোমার দশকের বই দরকার। আমি একটা কাজ করার চেষ্টা করছি। যদিও আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দুই বাংলার মোটামুটি একই, তবুও আমার এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, দু’টো আলাদা রাষ্ট্র হওয়ায় এবং দু’টো আলাদা রাষ্ট্রের ইতিহাস ভিন্ন হওয়ার কারণে আমাদের গল্প, উপন্যাস এবং কবিতা সবই পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ফলে আমাদের আলাদা বৈশিষ্ট্যকে শনাক্ত করা দরকার। আমি চেষ্টা করছি বাংলাদেশের আধুনিক কবিতা- এই নামে একটা সংকলন গ্রন্থ সম্পাদনা করার।
আলফ্রেড খোকন
হুমায়ুন আজাদ যেটা করেছেন আপনি দেখেছেন?
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ, উনি শুরু করেছেন ৩০ এর দশকের কবিদের দিয়ে। ওতে দুই বাংলার কবিদের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন আবার বাংলাদেশের কোনো কোনো কবিকে নেননি।
আলফ্রেড খোকন
বুদ্ধদেব বসু প্রসঙ্গে আপনি বলছিলেন যে, আপনার কবিতা ছেপে ছিলেন প্রথমে- তাই না? মনে আছে?
শহীদ কাদরী
প্রথমে পাঠাইছিলাম কিন্তু বুদ্ধদেব না, প্রথমে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায়। তখন সঞ্জয় ভট্টাচার্যের একটা বই বেরিয়েছিল ‘তিন কবি’ নামে- বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ দাশ আর প্রেমেন্দ্র মিত্র’র উপরে। তাঁর ছিল অসাধারণ কাব্য বোধ, তাঁর উপন্যাসের ভিতরেও কাব্যবোধ পাইছি। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের উপন্যাস আমার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। তিনটা উপন্যাস- ‘কুসমিত বায়ু’, ‘সৃষ্টি’ এবং ‘রাত্রি’। চমৎকার কিছু লিরিক কবিতা ছিল তাঁর, অসাধারণ! তো প্রথমে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে কবিতা পাঠাইছি। শামসুল হকও একই কাজ করছেন, আমরা ‘পূর্বাশা’তেই প্রথমে পাঠাই। ‘পূর্বাশা’তে উনি ছাপার পর পর ভাবলাম- এবার তাহলে ‘কবিতা’ পত্রিকায় হিট করা যায়। ‘কবিতা’ পত্রিকায় যদি ছাপা না হতো, তাহলে বোধহয় আমি আর লিখতাম-টিকতাম না, ধুর! (হাসি) ঢাকাতে তখন ‘সওগাত’-এ আব্দুল গাফফার চৌধুরী, সংবাদে সৈয়দ নুরুদ্দীন। শামসুর রাহমান কিভাবে প্রথম পাঠাল ‘কবিতা’ পত্রিকায় জানো? তার কবিতা ‘রূপালি স্নান’ প্রথমে ফেরৎ দিয়া দিছিল ‘সংবাদ’। রূপালি স্নানে একটা লাইন আছে ‘যেশাসের মত সত্ত্বা সূর্যে ক্ষমা মেখে নিয়ে গড়ি উজ্জ্বল কথার মিছিল।’ দেখো, মুখস্থ আছে! যেশাস শব্দটা ওরা ওমিট করতে চেয়েছিলেন। শামসুর রাহমান তা করবেন না তাই ফেরৎ নিয়ে নিলেন। বুদ্ধদেব বসু ওটা ছেপেেেছন এবং শামসুর রাহমানকে চিঠিও লিখলেন। চিঠিতে লিখলেন, ‘তোমার কবিতা যখন পেলাম আমি তখন দিল্লীতে চলে যাচ্ছি, ছাপার আর কোন জায়গা ছিল না শুধু শেষে একটা পাতা বাকি ছিল আমি ছাপার অর্ডার দিয়ে দিল্লী চলে গেছি। যারা প্রথম আমলের বাইবেলের অনুবাদক তারা যিশুকে যেশাস লিখেছিলেন, যেশাস বলতে তুমি নিশ্চয়ই সে অর্থেই যেশাস ব্যবহার করেছো।’ শুধু এইটুকুই চিঠিতে লিখলেন।
সেই সময়ে যখন লেখা শুরু করি, তখন আমাদের এমন ছিল যে আমার লেখাটা হচ্ছে কী হচ্ছে না, এটা বোঝার একমাত্র উপায় ছিল বুদ্ধদেব বসুর কাছে লেখা পাঠানো। আমার বয়স তখন ১৪।
আলফ্রেড খোকন
আমি একটু বিস্মিত, ১৪ বছর বয়সে একজন কবি কী করে একটি ম্যাচিউর কবিতা লেখেন!
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ, আমি বোধহয় একটু ইঁচড়ে পাকা ছিলাম। আমার মনে হয় সব কবিরাই ইঁচড়ে পাকা থাকে। সে সময় কলকাতার এক বন্ধুর মাধ্যমে শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। কলকাতায় আমার বন্ধু খোকনের বোনের হাজব্যান্ড ছিল শামসুর রাহমানের একেবারে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। খোকন আমাকে বলল, কী রে তুই বাচ্চু ভাইয়ের কবিতা পড়েছিস? (শামসুর রাহমানের ডাকনাম ছিল বাচ্চু)। আমি বললাম- না। ও বলল তার কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত ছাপা হয়, তুই ‘দেশ’ পড়িস? আমি বললাম- না। সে বলল, চল এখনই তোকে শামসুর রাহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এইভাবে, খোকনের মাধ্যমে জানি যে, শামসুর রাহমান একজন বড় কবি। এইভাবে ওর মাধ্যমে তার সঙ্গে আমার পরিচয়।
আলফ্রেড খোকন
এবং পরবর্তীকালে আপনাদের মধ্যে অনেক ঘনিষ্ঠতা।
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ। তো সেই সময় একদিন, শামসুর রাহমানের বাসা ইসলামপুর থেকে আড্ডা দিয়ে ফিরে আল মাহমুদের বাসায় যাই। সে তখন নবাবপুর থাকতো। তার বাসায় যেয়ে বললাম কী করো আল মাহমুদ? মাহমুদ বলল- এই তো কবিতা কপি করতেছি। শামসুর রাহমানের কাছ থিকা ‘কবিতা’ পত্রিকার ঠিকানা নিয়া আসলাম। এইভাবে কিছু কথাবার্তার পর আমি মাহমুদের বাসা থেকেও চলে আসি। পরদিন দুপুর বেলায় শামসুর রাহমান আমার বাসায় এলেন । খাওয়া-দাওয়া করে নানান কথাবার্তার মাঝে এক ফাঁকে বললাম- আল মাহমুদকে আপনি ‘কবিতা’ পত্রিকার ঠিকানা দিয়েছেন, ও কি কবিতা পাঠালো? তিনি বললেন হ্যাঁ। তো আমি বললাম, আমার আগেই ওর লেখা ছাপা হয়ে যাবে ‘কবিতা’ পত্রিকায়! শামসুর রাহমান বললেন, হ্যাঁ তাই তো! আপনি খাতা বার করেন দেখি। আমি খাতা বার করে দিলাম সে দেখে বলল, ঠিক আছে, এই দুইটা পাঠায়া দেন। ওই দুপুরেই কবিতা দুটি পাঠিয়ে দিলাম। তো পরে ওই ‘কবিতা’ সংখ্যা যখন আসলো, ওই সংখ্যায় শামসুর রাহমানের কবিতা, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা, আল মাহমুদের কবিতা, শহীদ কাদরীর কবিতা একসঙ্গে ছাপা হলো। এর বেশ কিছুদনি পরে আলাউদ্দিন আল আজাদের কবিতা, ফজল শাহাবুদ্দিনের কবিতাও ছাপা হয়েছে। ওমর আলী’র চার লাইনের একটি ছোট্ট কবিতা ছাপা হয়েছিল।
আলফ্রেড খোকন
শহীদ ভাই, আধুনিক বাংলা কবিতার যে সংকলন আপনি করতে যাচ্ছেন..
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ, বাংলাদেশের-
আলফ্রেড খোকন
এইটা, এইসময়ে এসে আপনার মতো একজন কবি কেনো করতে চাচ্ছেন- সিম্পলি, আমার জানতে ইচ্ছে করছে।
শহীদ কাদরী
এইটা করা দরকার এই কারণে, যাকে বলে To put our house in order, ৪৭ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত আমাদের কাব্যে কী অর্জন হলো- এটাকে সুস্পষ্টভাবে দেখার জন্য। আমাদের কবিদের রচনার বেশ খানিকটা অংশ নিয়ে বা তাদের রচনার শ্রেষ্ঠ অংশ নিয়ে একটা সংকলন করা খ্বু জরুরি হয়ে গেছে।
আলফ্রেড খোকন
আপনি কাজ শুরু করেছেন?
শহীদ কাদরী
কাজ শুরু করিনি, বই জোগাড় করার চেষ্টা করছি আর অন্যান্য কাজ গোছানোর চেষ্টা করছি। হুমায়ুন আজাদ যেটা করেছেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামে বুদ্ধদেব বসুর যে সংকলনটা আছে, ওটাকে সামনে রেখে আধুনিক কবিদের কবিতা একটু বেশি করে নিয়ে ত্রিশের কবিদের কবিতা, পশ্চিমবঙ্গের চল্লিশের এবং পঞ্চাশের কবিদের কবিতা বেশ খানিকটা কমিয়ে ঢাকার পঞ্চাশ এবং ষাটের কবিদের কবিতা নিয়েছেন। মোটামুটি এই ষাটের এখানেই তিনি থেমে গেছেন। কিন্তু ষাটের পরেও অনেক ভালো ভালো কবি এসেছেন, সত্তরে এসেছেন, যারা আজ বৃদ্ধও হয়ে গেছে। সত্তর গেল, আশি গেল। নব্বই চলছে।
আলফ্রেড খোকন
আপনাদের ষাটের পরে সর্বশেষ সত্তর ও আশি পর্যন্ত যে বাংলা কবিতা আমরা পাই, তার ধারাবাহিক সুর প্রায় একই তারে বাধা। যদিও উজ্জ্বল ষাটের অনেক কবি বা কবিতার মতো মিথে পরিণত হওয়ার যে বাস্তবতা বাংলা কবিতায় আমরা পাই, তার কোনো অস্থিচিহ্ন সত্তর-আশিতে পাই না। আপনি কি খেয়াল করেছেন যে, নব্বইয়ে এসে আধুনিক বাংলা কবিতার একটা পরিবর্তন, বাঁক বদল হয়েছে?
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ।
আলফ্রেড খোকন
এই পরিবর্তন হয়েছে অনেকটা নিঃশব্দে, যা এই সময়ের কবিতার একটা অনবদ্য বৈশিষ্ট্যও বটে। আমি বলছি ষাটের যেমন উজ্জ্বল উত্থান, তেমনি উজ্জ্বল নব্বইয়ের। ষাটের পরে নব্বইয়ে এসে বাংলা কবিতার স্বর, সুর, পরিক্ষণ, বোধের সূক্ষ্ম নিক্তি এসবের ষ্পষ্ট পরিবর্র্তন ঘটেছে, ফলে পরিবর্তনের এই নতুন আবহ বাংলা কবিতার পাঠককে যেমন দিয়েছে চড়ায় আটকে যাওয়া থেকে মুক্তির আস্বাদ, তেমনি বাংলা কবিতাও পেয়েছে নতুন গতিপথ, এসেছে সমকালীন অনুসঙ্গ। পাঠকরাও তাই নব্বইয়ের কবিতা আন্তরিকভাবেই যেন গ্রহণ করেছে।
শহীদ কাদরী
তা তো করবেই। এ নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি মনে করি সব সময়ে সমকালীন কবিদেরকে, সমকালীন লেখকদেরকে সমকালীন পাঠকেরা বেশি করে পড়েন। এখন ধর কালিদাসকে কে পড়ে, কয়জনে পড়ে? কালিদাস বাদ দেও। রবীন্দ্রনাথ কয়জনে পড়ে, বুদ্ধদেব বসুকে কে পড়ে?
আলফ্রেড খোকন
রবীন্দ্রনাথকে ঠেকেও পড়তে হয়। কারণ পাঠ্যতালিকা।
শহীদ কাদরী
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে যারা পড়েন তাদেরকে পড়তে হয়। মাইকেল-বঙ্কিম ক’জনে পড়ে? সমকালীন লেখকদেরকেই সমকালীন পাঠকরা বেশি করে পড়ে। কারণ সমকালীনতা বলে একটা বিষয় রয়েছে।
আলফ্রেড খোকন
সমকালীনতা বলতে কি আপনি সমসাময়িক বোঝাচ্ছেন?
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ, সমসাময়িক।
আলফ্রেড খোকন
কিন্তু আপনারাও তো সমসাময়িক?
শহীদ কাদরী
এটা তো ধর জীবনানন্দ’র একটা কবিতা আছে কে আধুনিক, সাফো এখনো আধুনিক, মহাভারতের কোনো কোনো অংশ এখনও আধুনিক। এটা তো একটা ব্যাপার আছে যে, আধুনিক মনের কাছে যার আবেদন রয়েছে। কেউ আজকে সমকালীন হয়েও একেবারে পৌরাণিক। তৎসত্ত্বেও একজন জীবনানন্দ দাশ, একজন অমিয় চক্রবর্তী বা একজন সুধীন দত্ত যত বেশি না পঠিত হচ্ছে বাংলাদেশে তার চেয়ে বেশি পঠিত হচ্ছো তোমরা।
আলফ্রেড খোকন
আপনার ভাষায় আমরা সমসাময়িকতার কারণে পাঠকের কাছে একটু বেশি পঠিত হচ্ছি। কিন্তু একজন শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান- আবুল হাসান আর জীবনানন্দ দাশের কথা তো না বললেও চলে- আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখছি এই নামগুলি কিন্তু ইতিহাস ছাকতে ছাকতে এসে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, শহীদ কাদরী বললেই কয়েকটি কবিতা চলে আসে, আল মাহমুদ বললেও কবিতা চলে আসে। আলফ্রেড খোকনের নাম বললেই যে কয়েকটি কবিতা চলে আসছে এখনও তা কিন্তু নয়।
শহীদ কাদরী
কিন্তু এটা অতিক্রান্ত সময় বলবে।
আলফ্রেড খোকন
শহীদ কাদরী বলতেই ৪/৫টা কবিতা মুখস্থ আছে এমন হাজার বাঙালি পাঠক পাওয়া যাবে। যেমন আছে জীবনানন্দ দাশের, আল মাহমুদের, শামসুর রাহমানের, নির্মলেন্দু গুণ। আবার আবুল হাসান, বাংলাদেশে যে তরুণ কবিতা লিখতে আসে কিভাবে কেনো জানি আবুল হাসান খেয়ে বসে থাকে।
শহীদ কাদরী
খুব পছন্দ করে তাই...
আলফ্রেড খোকন
বাংলাদেশে আরেকটি বিষয়, এখানকার কবিদের জন্ম আসলে গ্রামে। পরবর্তী সময়ে গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন বা উদবাস্তু হয়েই নগরে আসা।
শহীদ কাদরী
ত্রিশের দশকের আধুনিক কবিরা- গ্রামেই তো তাদের জন্ম। বুদ্ধদেব বসুর জন্ম নোয়াখালীতে। এবং নোয়াখালীতে তিনি অনেকদিন থেকেছেন তারপর ঢাকায় আসেন। তখনকার শহর তো আর কিইবা শহর!
আলফ্রেড খোকন
আপনার সমসাময়িক সব কবিদের মধ্য থেকেও আপনি কিভাবে আলাদা হলেন?
শহীদ কাদরী
আমার তো ব্যাকগ্রাউন্ড একটু আলাদা। আমার জন্ম তো কলকাতাতে। আমার পটভূমিতে গ্রাম নেই। যেটুকু আসছে তা বই পড়া।... আমি আসলে বলতে পারব না। (আবেগে তার চোখ ছল ছল করছে!) দেশভাগের কারণেই তো কিছু লোক পশ্চিমবঙ্গে গেল আবার ওখান থেকে কিছু লোক পূর্ববঙ্গে এলো। তখনও শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার ঐরকম আলাপ হয়নি। কলকাতা থেকে একটা ‘কবিতা’ সংখ্যা এলো শামসুর রাহমানকে দিয়ে শুরু। পরে নরেশ গুহ’র মুখে গল্প শুনলাম যে, ঐ সংখ্যা সঞ্জয় ভট্টাচার্যর লেখা দিয়ে শুরু করার কথা। এর আগে তার বই বেরোল ‘পদাবলী’। শামসুর রাহমান কবিতা পাঠিয়েছিলেন ‘মনে মনে’ আর ‘তার শয্যার পাশে’। ওনারা দু’জনে পড়লেন শামসুর রহমানের কবিতা। তখন সঞ্জয় বল্লেন যে, আমি তো এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছি আমাকে দিয়ে শুরু করে কী হবে- শামসুরকে দিয়া শুরু কর। ওই সংখ্যা শামসুর রাহমানের দু’টো কবিতা দিয়ে শুরু হল। তার পরে বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত অমিয় চক্রবর্তী Every body was there এবং বুদ্ধদেব শামসুর রাহমানকে চিঠিতে লিখলেন- ‘তার শয্যার পাশে’ কবিতাটা এতো ম্যাচিউর একটি কবিতা যে, গত ৫/৬ বছরের মধ্যে বাংলা ভাষাতে এমন কবিতা লেখা হয় নাই। এসব চিঠি আমি নিজে পড়েছি। সেই বুদ্ধদেব তাঁর সম্পাদনায় আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলন বের করলেন। কিন্তু শামসুর রাহমানের একটি কবিতাও নিলেন না! যখন তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলনে শামসুর রহমানকেও নিলেন না, তখন আমরা খুব ক্ষুণœ হয়েছিলাম। না নেয়ার কারণ কি জানো? আমরা তো তখন পূর্ব পাকিস্তান। উনি পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যকে বাংলা সাহিত্যর সঙ্গে মেলাতে চাননি। এবং সেটা এখনও চলতেছে। মুখে বলতেছে তারা দুই বাংলা এক, দুই বাংলার সংস্কৃতি এক কিন্তু They didn’t care. আমাদের বই ওখানে...
আলফ্রেড খোকন
নেয়ই না তো...
শহীদ কাদরী
নেয় না, একটা প্রবন্ধ লিখল সমরেশ মজুমদার ‘কালি কলম’-এ। বাংলা উপন্যাস তারা পশ্চিমবঙ্গে পড়ে না এই কারণে যে, বাংলা উপন্যাসের চাচা, ফুফু, নানা, দাদা, দাদী পশ্চিমবঙ্গের লোক বোঝে না!
আলফ্রেড খোকন
আবুল বাশার? অবশ্য আবুল বাশারকে ওইখানে ওভাবেই লিখতে হয়েছে।
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ, তিনি ব্র্যাকেটে আবার লিখে দিয়েছেন...
আলফ্রেড খোকন
হুম- ফুফু মানে পিসি [এ মুহূর্তে তার দ্বিতীয় স্ত্রী নীরার তাড়া দেয়া, নার্সের তাড়া ইত্যাদি] আচ্ছা আপনি টেলিভিশনে কয়বছর চাকরি করেছিলেন?
শহীদ কাদরী
টেলিভিশনে আমি ৪ বছর চাকরি করেছি। আমরা যখন প্রোডিউস করতাম- কন্ট্রোল রুমে গিয়ে ক্যামেরার মনিটর দেইখ্যা অন এয়ারে বলতাম যে ক্যামেরা A জুম ইন। ক্যামেরা B রেডি ফর প্যানিং। কাট টু ক্যামেরা B। এইভাবে অন এয়ারে ডিরেকশন করতে হতো। প্রথম প্রথম তো এইভাবে (হাত দেখিয়ে) কাঁপতাম। পুরো প্রোগ্রামটা স্ক্রিপ্ট কইর্যা বলতে থাকতাম- কাট টু ক্যামেরা A, ডিজলভ ক্যামেরা A। গো টু মিড ক্লোজ টু ক্লোজ। পরে এমন রপ্ত হয়ে গেছিল যে প্রোগ্রাম দেখেই বলতে পারতাম, কতগুলি শট হবে। কাট টু ডিজলভ, ডিজলভ টু কাট। ক্লোজ, মিড ক্লোজ। এভাবেই টিভির কাজটা করতাম সেই ১৯৬৫ সালের কথা। তারপর দেখলাম টেলিভিশনে রক্ত খেয়ে ফেলছে। কাজটা যখন রপ্ত হয়ে গেল, তখন চাকরি ছেড়ে দিলাম।
আলফ্রেড খোকন
শহীদ ভাই মিলান কুন্ডেরা, মার্কেস- এরাও তো টেলিভিশনে চাকরি করেছে। অবশ্য ওরা গদ্যশিল্পী। কবিদের মধ্যে আপনি আছেন। আমাকেও নানা জনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে, ফোন করে জানতে চায় আমার কবিতার ক্ষতি হয় কিনা।
শহীদ কাদরী
কিছু ক্ষতি কিন্তু হয়।
আলফ্রেড খোকন
তা হয়তো হয়। কিন্তু আমি যদি সংবাদপত্রে চাকরি করতাম, তাহলে কি ক্ষতি হতো না?
শহীদ কাদরী
তাহলে আরও বেশি ক্ষতি হতো।
আলফ্রেড খোকন
কিংবা হাসপাতালে কাজ করলে কি হতো?
শহীদ কাদরী
আমেরিকার একজন মেজর পোয়েট সারাজীবন ডাক্তারি করছে। উইলিয়াম, কার্লোস উইলিয়ামস।
আলফ্রেড খোকন
রবার্ট ব্লাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হইছে আপনার?
শহীদ কাদরী
না, আমি এদের সঙ্গে যোগাযোগ করি না। আমাদের লেখা-জোখার উপর ওদের কোনো কৌতূহল নেই। যদি তুমি ইংরেজিতে লিখ তবেই ওদের আগ্রহ।
আলফ্রেড খোকন
আমি ওর একটা বই পেয়েছিলাম খালীকুজ্জামান ইলিয়াস ভাইয়ের কারণে। তার কাছ থেকে এনে বইটা দিয়েছিল সম্ভবত সাইমন জাকারিয়া। তার কয়েকটি কবিতা আমি বাংলায় অনুবাদ করি। তার কবিতা আমার ভালো লেগেছিল। ছোট্ট ভূমিকাসহ তা ভোরের কাগজে ছেপেছিলাম।
শহীদ কাদরী
ব্লাই মডার্ন কবি। হি ইজ এ গুড পোয়েট। সে বেশ কিছু অনুবাদ করেছে। পাবলো নেরুদা...
আলফ্রেড খোকন
গালিবের শের অনুবাদ করছে।
শহীদ কাদরী
সে কিছু ইন্ডিয়ান কবিতা, তামিল কবিতা অনুবাদ করছে। সে অনেক কাজ করছে। তবে আমেরিকান কবি টেড হিউজের সঙ্গে আমার কিছু এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল। টেড হিউজ জানতো আমি তার কবিতা পড়ি। একটা রেস্তরায় মাঝে মাঝে আড্ডাও হতো। যে ভদ্রলোক আমাকে ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, তার কারণে একদিন টেড হিউজ জানলো যে আমি কবি। তখন টেড হিউজ আমাকে জিজ্ঞেস করল- ‘হোয়াট ল্যাগুয়েজ ডু ইউ রাইট?’ আমি বললাম- বেঙ্গলি। হিউজ বলল- ও! এবং এরপর আর কোনো আগ্রহ দেখাল না। বাংলা ভাষায় আমরা কে কি লিখি, কোন ধরনের কবিতা কিচ্ছুই সে জানতে চায় না। ভাষা বাংলা শুনেই তারা আর জানতে চায় না। আমরাই ওদের সম্বন্ধে জানতে চাই, আগ্রহী হয়ে উঠি।
আলফ্রেড খোকন
আমাদের মধ্যে তো এটা আছেই। আমাদের গ্রামের একজন চা-দোকনদারও বিশ্বের অনেক কিছুর খবর রাখে। তেমনি আমাদের একজন পাঠক বা লেখক বিদেশের শিল্প মাধ্যমগুলির অনেক কিছুই জেনে নেয়, যেটা ওরাও অনেকসময় আমাদের মতো জানে না! আর আমাদের বেলায় ওরা তো মূর্খ। আমরা আরও করি কী, বিদেশে কোথায় কে কী করল, কোন বই বের হল- ট্রান্সলেট করে মারো ছাপা। এটা খুব চলে এখানে। কিন্তু নিজ দেশের লেখক-শিল্পীর ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ মেলা ভার! গেয়ো যোগী ভিখ পায় না অবস্থা। আমাদের দাস-মনোবৃত্তি যায়নি।
শহীদ কাদরী
মনোবৃত্তি যাবে না এবং এখনও এটা চলছে। একটা জিনিস জানো তো, জাপানে আমাদের অনেক কবিতা অনুবাদ হচ্ছে।
আলফ্রেড খোকন
জাপানে বাংলাভাষার অনেক কিছু অনুবাদ হচ্ছে, ওরা আমাদের সাহিত্য নিয়ে কাজ করছে।
শহীদ কাদরী
কয়েকদিন আগে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা মেয়ে চিঠি দিয়েছে আমাকে। আমার কবিতা অনুবাদ করতে চায়। কী পরিমান টাকা দিতে পারবে তাও জানাল। আমি রাজি হয়ে গেছি। ও ওখানকার লাংগুয়েজ ডিপার্টমেন্টে পড়ায়। নাম ভুলে গেছি। ও বললো- আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ সে অনুবাদ করছে। সে বহুত পরে আমার খবর পাইছে আর কী। তিন চার মাস আগের ঘটনা। তো এই জাপানের একটু আগ্রহ হইছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পর রাশাতে, রাশিয়ানরা আমাদের সাহিত্যে ইন্টারেস্টড ছিল। সেভেনটি টু অর সেভেনটি থ্রিতে তারা বাংলা কবিতার এনথ্রোলোজি বার করছিল। কিন্তু আমি যেটা মনে করি ইউরোপের দিকে আমাদের তাকানো উচিত নয়। আমাদের তাকানো উচিত এশিয়ায়। এশিয়ান আলাদা জগত বলয় তৈরি করা উচিত। ওরা যেমন নোবেল প্রাইজ দেয় তেমনি জাপান বা ভারতবর্ষের উচিত বেশ ভালো এমাউন্ট দিয়ে বড় কোনো সাহিত্যের সত্যিকারের এওয়ার্ড দেয়া। আমাদের বলয়টাকে চেঞ্জ করে ফেরা উচিত। ওদের বলয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। কারণ, ওদের ক্রাইটারিয়া এবং জাজমেন্ট আমাদের থেকে ডিফারেন্ট।
আলফ্রেড খোকন
যেটার সঙ্গে আমাদের মিলবে না কখনো।
শহীদ কাদরী
এই যে ইউরোসেন্ট্রিক ব্যাপারটা আছে এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। এর বিরুদ্ধে এডওয়ার্ড সাইদ লিখল না? আমাদের মনোগঠন তো এখনও ইউরোসেন্ট্রিক। আমাদের অবস্থা কী দেখো, পশ্চিমবঙ্গের বাহবা পাইতে চায়। শামসুর রাহমান এটা আমদানি করল। সেই তো প্রথম আনন্দ পুরস্কার গ্রহণ করল। তারপর যে-ই আসল পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাকে খাওয়ানো দাওয়ানো, এই করা সেই করা...
আলফ্রেড খোকন
পশ্চিমবঙ্গের লেখকদেরকে তোয়াজ করা এখন আমাদের সামাজিকভাবেই সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে! কী বলবো আর! এটা হয়তো অনেকদিন পর্যন্ত থাকবে আরও। তবে এটা চেঞ্জ হবে।
শহীদ কাদরী
এটা চেঞ্জ হতে বাধ্য।
আলফ্রেড খোকন
আপনি তো দুইটা কবিতার ভিতর দিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়? আচ্ছা, সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ দেখা হয়েছিল। সুমন যখন ভয়েস অব আমেরিকাতে কাজ করত, তখন সে আমার এখানে একবার এসেছিল। তারপর কোলকাতাতে যেয়ে সুদীপ্ত চ্যাটার্জীকে দিয়ে আমার সঙ্গে একবার যোগাযোগ করেছিল, আমার ওই গানটা করতে আমি রাজি কিনা। কবিতা গান হোক এটাতে আমি রাজি না। কিন্তু আমি তখন মনে মনে ভাবলাম রাজি হয়ে যাই, দেখি কী হয়। সুমনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল যে, আধুনিক বাংলা গান গ্রো করতেছে না এর কারণ কবিরা লিখছে না। আধুনিক বাংলা গান করতে হবে। সলিল চৌধুরী কিছু এক্সপেরিমেন্ট করেছিল। ‘যখন প্রশ্ন ওঠে ধ্বংশ না সৃৃষ্টি, আমাদের চোখে আসে আগুনের দৃষ্টি/আমরা জবাব দেই সৃষ্টি সৃষ্টি সৃষ্টি।’ এধরনের কবিতা, সুকান্ত’র কবিতাকে সে গান করেছে। তো ওর সঙ্গে কথা হলো বব ডিলানের গান, জোয়ান বায়েস এদের নিয়ে। সুমন যখন চলে যাচ্ছে এখান থেকে, আমাকে ফোন করে বলেছিল, আমি যা টাকা পয়সা পেয়েছিলাম এখান থিকা তা দিয়ে একধরনের যন্ত্র কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছি কলকাতাতে। গিয়ে শহীদ আমি একবার চেষ্টা করব আপনার কবিতা নিয়ে। এরপর যখন ওই প্রপোজালটা আমার কাছে এসছে তখন আমি না তো করতে পারি না। বিকস আমি ওর সঙ্গে এটা নিয়ে আলাপ করেছিলাম।
আলফ্রেড খোকন
সেটা তো সমস্যার কিছু দেখি না। আপনার কোনো একটা কবিতা যদি কেউ নেয়, গান করে তা তো সমস্যার কিছু নয়। জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার গানও একজনে করেছে।
শহীদ কাদরী
তবে জীবনানন্দ দাশের কবিতার গানের সুর সুবিধের হয় নাই। পছন্দ হয় নাই।
আলফ্রেড খোকন
আপনার ‘তোমাকে অভিবাদন’ সে ভালোই করেছে। সুমন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে হয়তো-বা।
শহীদ কাদরী
এখন তো আবার কলকাতাতেও সে আউট। সাবিনার সঙ্গে বোধহয় সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেছে। সুমন কলকাতায়, সাবিনা ঢাকায়। তাছাড়া ওর চরিত্রের ব্যাপারটা আলাদা। অনেক সম্পর্ক সে গড়েছিল। আর কলকাতাতে প্রলোভনও অনেক বেশি।
আলফ্রেড খোকন
জনপ্রিয়তা নিয়ে শহীদ ভাই, আপনার যে তুমুল জনপ্রিয় কবিতা সন্তুতি-
শহীদ কাদরী
এটা অমন জনপ্রিয় হওয়ার কিন্তু কথা না, কেনো হলো আমি খুব বিস্মত কিন্তু!
আলফ্রেড খোকন
তবে ভেবে দেখলে কিন্তু আপনার ঐ কবিতার শেষ যে...
শহীদ কাদরী
দু’টো পঙতি, ওইটা লাগে...
আলফ্রেড খোকন
ওটা থেকে মানুষের কোনো মুক্তি নাই, এটা কিন্তু ভয়াবহ জনপ্রিয়।
শহীদ কাদরী
ভয়াবহভাবে সত্য কথাও কিন্তু।
আলফ্রেড খোকন
তবে ‘তোমাকে অভিবাদন’ যে আপনি লিখলেন, সেনাবাহিনীর বন্দুক না দিয়ে আপনি গোলাপ দিতে চাইলেন, অথচ দেখেন আপনি এখন যে শহরে আছেন চাইলেই আপনাকে দেয়ার একটি উপযুক্ত গোলাপ এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপর এই যে নাগরিক মানুষের বোধ... এটা কি ঢাকায় বসে লিখছিলেন না?
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ, ঢাকায় স্বাধীনতার পর পর লেখা। কলকাতা থেকে ওরা, শক্তি-সুনীলরা আসলো, ঠিক তার আগেই লিখলাম। ঘরে বসা, তখন চাকরি-বাকরি করছি না। রফিক আজাদ বললো, ওস্তাদ আমরা তো উত্তরাধিকারে ভালো পয়সা দিই। তখন তো আমার সিগারেট খাওয়ার পয়সা দরকার। কিন্তু হয় কী, আমি তোমাকে বলি- আমাদের বাংলা কবিতার মধ্যে টুকরো টুকরোভাবে... যেমন বুদ্ধদেবের একটা কবিতা আছে- ‘বৃষ্টির দিনে বাড়ি ফিরছি ট্রাম লাইনে ঘাস, মগজে এই ঘাস।’ তো এই যে ট্রাম লাইনে ঘাস আছে। তারপর অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা আছে- ‘সমুদ্র যেন কারখানার মত অসংখ্য ঢেউ ম্যানুফেকচার করছে।’ এই যে দেখার দৃষ্টিটা, প্রথম থেকেই আমি একটা জিনিস চেষ্টা করছিলাম যে... একটা হচ্ছে আমার পটভূেিমত গ্রাম নেই... সহজে আসে না। যা আসছে তা বই পড়া। আমি চেয়েছিলাম এই যে পাখিগুলো, এরোপ্লেনটা পাখির মতো... স্টিফেন স্পেন্ডারের কবিতায় আছে.. পাখির মত ডানা মেলে প্লেন নামতেছে। আমি বললাম, দূর থেকে অনেক উঁচু থেকে যখন দেখা যায় প্লেনগুলো নামছে তখন প্লেনগুলো পাখির মতো না হয়ে পাখিগুলোকে প্লেনের মতো করে দিই, উল্টে দেই। পারেসপেক্টিভকে উল্টে দিই। যে পারেসপেক্টিভটাকে আমি চিনি। কিন্তু আরেকটি সমস্যাও আছে। ধরো কোনো কবির যদি দুই একটি কবিতা জনপ্রিয় হয়, সেটা কিন্তু অন্যান্য ভালো কবিতাকে ম্লান করে দেয়, ক্ষতি করে। যেমন জীবনানন্দ দাশের ‘অ›ধকার’ কবিতাটা পড়াই হয় না আজকাল। তার ‘সাতটি তারার তিমির’ কবিতা তেমন পড়া হয় না। ওই আছে না, ‘অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ নেই/অপরের মুখ ম্লান করে দেয়া ছাড়া প্রিয় স্বাদ নেই মানুষের।’ এই হলো মানুষ! তবে এটা হলো মানুষের একটা দিক। অবশ্যই কবিতা অর্ধ সত্য নিয়ে ডিল করে।
আলফ্রেড খোকন
পুরো সত্য নিয়ে তো মানুষ নিজেই নিজেকে ডিল করে না। পারে না।
শহীদ কাদরী
পারে না, তাহলে কবিতায় কি করে আসবে? যখন বিনয় মজুমদার বলতেছে যে- ‘মানুষ যতই পুষ্পের কাছে যাক সে বস্তুত রন্ধনকালীন মাংশের ঘ্রাণ ভালবাসে।’
আলফ্রেড খোকন
আপনার সঙ্গে কি কখানো বিনয়ের দেখা হয়েছিল?
শহীদ কাদরী
না না, আমার সঙ্গে সুনীলের দেখা হয় কলকাতাতে। কিভাবে দেখা হলো? বেলাল (বেলাল চৌধুরী) তো আগে থেকেই কলকাতাতে ছিল। সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। বেলালের সঙ্গে সুনীলের খুব ঘনিষ্ঠতা হয়। আমরা যখন কলকাতায় গেলাম স্বাধীনতার পর, বেগম সুফিয়া কামাল আমাদের সেই টিমের লিডার। আমরা সবাই গেলাম। একটা হোটেলে উঠলাম। ছয়/সাতদিন প্রোগ্রাম হল। শেষে যখন আমরা চলে আসব। সুনীল আসলো আমাদের হোটেলে। আমাকে বলল, কী অবস্থা? আমি বললাম, চলে যাচ্ছি। তো সে বললো, সবাই যাক, তুমি যাবে কেনো? তুমি থাকো। বললাম, আমার হোটেলের তো মেয়াদ শেষ? সে বললো তুমি আমার এখানে এসে ওঠো। মাসখানেক থাকো। এইভাবে সুনীলের সঙ্গে দেখা হয়।
আলফ্রেড খোকন
একটা প্রশ্ন আপনাকে অনেকেই করে না? আমার ধারণা আপনি এই প্রশ্নের মুখোমুখি সবচেয়ে বেশি হইছেন? কী এমন অভিমান যে আপনি দেশে ফিরলেন না?
শহীদ কাদরী
না, আমি অভিমানে দেশে ফিরিনি সেটা তো ঠিক না। দেশ এবং বাংলা সাহিত্য দুটোই ছেড়ে দিয়েছিলাম। যখন দেখলাম যথেষ্ট পরিমাণে কাদা ছোঁড়াছুড়ি চলছে। তখন আমার খুব বিবমিষা পেয়েছিল। ইংরেজি ভাষাতে একটা কথা আছে, কন্সপ্রেসি অব সাইলেন্স (এই কথাটি নাটকের ‘খ্যাপা পাগলা’ খ্যাত এস এম সোলায়মানের ব্যাপারেও ঘটেছিল, আমি আমার কিছু লেখায় তা উল্লেখ করেছিলাম- সম্পাদক, থিয়েটাওয়ালা)।... একটা সময় আসবে, তোমার সব বন্ধুরা তোমার সম্বন্ধে জানে কিন্তু কাউকে, কোথাও কিচ্ছু বলবে না। তাতে কখনো ক্ষতি হতে পারে, কখনো ক্ষতি নাও হতে পারে।
আমাকে রশীদ করীম বললো, ‘তোমার কবিতা তো আবুল হোসেনের খুব পছন্দ হয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল যে, ছেলেটা কে? এই শহীদ কাদরী কে? তো তুমি একটু আবুল হোসেনের সঙ্গে দেখা কর। ‘সংলাপ’ পত্রিকা বার করেছে, লিখলে বেশ টাকা-টোকা দেয়।’ তো তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, এখন যখন তোমাকে চিনে ফেললাম, এখন আর কোনো অসুবিধে হবে না। তখন আমি ভাবলাম যে, এতদিন ধরে শামসুর রাহমানের সঙ্গে জানা-শোনা, তার সঙ্গে বছরের পর বছর পার করে দিছি, তবু তার কাছে একবারও উচ্চারণ করে নাই আমার নাম! (হাসি)।
একরাতে আমার বড় ভাইকে বললাম এসব চলছে। উনি বললেন যে, এদের সঙ্গে পারবি না। বাইরের দেশে চলে যা। তখন প্রতিজ্ঞা করলাম- আমি বাংলা কবিতা পড়ব না, বাংলা বই পড়ব না। কবিতার ধার কাছ দিয়েও যাব না। যখন আমার একেবারে পিক পিরিয়ড, তখনই কিন্তু দেশ ছেড়েছি, সেভেনটি এইটে!
বিদেশে এসে প্রথম বই বার করলাম ৩০ বছর পরে- ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দিও’।
আলফ্রেড খোকন
এই বইটা ত্রিশ বছর পর, খুব কি জরুরি ছিল?
শহীদ কাদরী
তা তো জ্যোতিপ্রকাশের চাপাচাপিতে। হলো কী, জ্যোতিপ্রকাশ এলো, বললো, আমি আলমগীরকে একটা বই দিয়েছি, তোমাকে একটা বই দিতেই হবে। তখন নীরাকে বললাম। নীরা একটা ঝোলা বের করল। ঝোলার মধ্যে পুরনো লেখা ছিল তার সঙ্গে দু’টো তিনটে নতুন কবিতা দিয়ে বার করে দিলাম। এখন আমার ইচ্ছে আছে আরেকটা বই করার। কিছুদিন আগে কাইয়ূম চৌধুরী ফোন করেছিল বেঙল ফাউন্ডেশন একটা বই করতে চায়। আমি বললাম নির্বাচন-টির্বাচন... মানে নির্বাচিত কবিতা বার করতে চাচ্ছি না। একটু অপেক্ষা করলে আমি একটা নতুন বই দিবো। হিসাব করে দেখলাম, সুধীন দত্তের পাঁচটা বই আছে, পাঁচটা কবিতার বই। আমার বিরলপ্রজ দুর্নাম আছে তো, তাই পাঁচটা বই বার করে এই দুর্নাম ঘুচাই। হা হা হা।
আলফ্রেড খোকন
তারপর আর দেশে গেলেনই না!
শহীদ কাদরী
তারপর আমি যখন ফিরব ঠিক করলাম, অফিসকেও বলে দিছি- দিস ইজ মাই লাস্ট ইয়ার। ডিসেম্বর, টু থাউজেন্ট টু আই উইল বি ব্যাক মাই হোম। বড় ভাইকেও ফোন করলাম। বড় ভাইকেও ফোন করছি আফটার থার্টি ইয়ার্স। কারো সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। ফোন করে বলছি আমি চলে আসতেছি, উনি বললেন ঠিক আছে, চলে আয়। টু থাউজেন্ট টু এর অক্টোবরে আমি অসুস্থ হলাম। একদম আমি টু থাউজেন্ট টুতে এক পায়ে খাড়া দেশে ফিরব। কিন্তু Man propose God disposes বলে একটা কথা আছে না! আমি তো এই দেশে সিটিজেনশিপ নেই নাই। গ্রীনকার্ড রিনিউ করে থাকি। নাইনটিন এইটি থ্রি-তে আমি এই দেশে আসছি। সিটিজেন নিলেই মনে হবে আমি আমেরিকান হয়ে গেছি। এটা তো লোকে জানেই না, আমি বলিও না। বললে বিশ্বাসও করবে না।
আলফ্রেড খোকন
আমার মনে হয় যা হয়েছে একজন কবির জন্য শেষ পর্যন্ত ঠিকই আছে। আমরা মিস করি সত্য। কিন্তু সেই কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি থেকে আপনি অনেক মুক্ত। দূরে বসে স্বদেশের সঙ্গে যে নৈকট্য অনুভব করেন, কাছে থাকলে উল্টাটাও হতে পারত?
শহীদ কাদরী
আমি তো এখন সবার উপরে। যখন দেখি সবাইকে, প্রত্যেকের যেন আরেকটা মুখ রয়েছে পেছন দিকে, ঐ যে জেলাস। যাদেরকে আমি আইডিয়ালাইস করছি তারা যখন দেখলাম এরকম- আমার চোখের সামনে আবুল হোসেনকে দেখিছি শামসুর রাহমানকে প্রশংসা করতে। তার অনেক বাদে দেখলাম সে বলছে শামসুর রাহমান কিছু লিখতেই পারে নাই- একদম তিরিশের নকল, ভোগাস। এটা জেলাসি। দেখো কী অবস্থা ছিল তখন! তবে আমাদের মধ্যে বেস্ট অগ্রজ দেখছি, বুঝছ বেস্ট অগ্রজ- আহসান হাবীবকে। বেস্ট অগ্রজ।
আলফ্রেড খোকন
তাঁর নাম কিন্তু এখনকার তরুণরা ওই মর্যাদায়ই উচ্চারণ করে।
শহীদ কাদরী
আচ্ছা শামসুর রাহমানকে কিন্তু দেখেছি একটা জিনিশ... মানে... শামসুর রাহমান ‘মর্নিং নিউজ’-এ চাকরি করতো যখন ‘দৈনিক পাকিস্তান’ হলো। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ তো সরকারি পত্রিকা। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ এবং ‘পাকিস্তান টাইমস’ বের করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসলেন আহসান আহম্মেদ আশক। উনি ছিলেন ঊর্দু পোয়েট। কিন্তু বাংলা জানতেন। কলকাতায়ও ছিলেন কিছুদিন। উনি এসেই বললেন- আই ওয়ান্ট টু মিট উইথ শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমান তার ফেভারিট ছিল। এবং আশক প্রথমেই শামসুর রাহমানকে নিলেন। তারপর শামসুর রাহমান যাকে যাকে বলছেন, উনি তাকে তাকেই নিলেন। শামসুর রাহমানই আহসান আহম্মেদ আশক-কে আহসান হাবীবের কথা বলেছেন। কারণ, আহসান হাবীবের তখন কোনো চাকরি নাই। আজ এখানে, কাল ফ্রাঙ্কলিন পাবলিশাসের্র কোনো অনুবাদের কাজ করছেন, রেগুলার কোনো জব ছিল না তার। শামসুর রাহমানই ব্রট আহসান হাবীব, সাহিত্য সম্পাদক করে। শামসুর রাহমান ব্রট ফজল শাহবুদ্দীন টু ‘দৈনিক পাকিস্তান’, শামসুর রাহমান ব্রট আফলাতুন, বাচ্চাদের জন্য। অল অফ দেম ইনক্লোডিং প্রথম এডিটর আবুল কালাম শামসুদ্দিন। শামসুর রাহমানকে ঠিক ওইটা দেখেছি। তবে আবার তার একটা প্রবন্ধে ফররুখ আহমদকে কমপ্লিটলি চেপে গেল! সে একজন আধুনিক কবি।
আলফ্রেড খোকন
হ্যাঁ তার ডাহুক তো দুর্দান্ত এক আধুনিক কবিতা!
শহীদ কাদরী
আরও কিছু কবিতা আছে তার যেটাকে ফেলা যাবে না। কিছু সনেটও আছে তার। ঈদের চাঁদের উপরে তার একটা চমৎকার সনেট আছে। কালচারালি আল মাহমুদের যে লাইনটা ’বধূ বরণের জন্যে কুলায় ধান্য হাতে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল/ গাঙের ঢেউয়ের লাহান বল কন্যা কবুল কবুল।’ এসব তো অস্বীকারের প্রয়োজন নেই।
আলফ্রেড খোকন
আল মাহমুদ অবশ্য তার একটা কবিতার বই প্রসঙ্গে আপনাকে জড়িয়ে একধরনের গল্প বলেন...
শহীদ কাদরী
শোনো তবে, তখন সিকান্দার আবু জাফর থাকে দোতলায় আমরা থাকি একতলায়। কী গার্ডেন যেন, নামও ভুলে গেছি। ওইখানে বাথরুম যেটা ছিল, দরজায় একটা স্লিট ছিল। ওই স্লিটের মধ্যে সম্ভবত চিঠিপত্র রাখত। তো আমি যখন বাথরুমে যাইতাম বই নিয়া যাইতাম। পাশে বই রাখার জায়গা ছিল। আল মাহমুদ এসছে দুপুর বেলায়। তখন ভীষণ আগুন গরম ছিল। বললো চলো দোস্ত যাই বাইরে ঘুরে আসি। আমি বললাম দোস্ত আমি গায়ে একটু ঠা-া পানি না লাগালে পারতাছি না। যাই একটু গোসল করে আসি। তো বাথরুমে ঢুকছি। বাথরুমে তার ‘লোক লোকান্তর’ কবিতার বই রাখা। দরজা বন্ধ। আমি বাথরুমের ভিতর থেকে তাকে বললাম- দোস্ত, তোমার একমাত্র ভক্ত কিন্তু আমি, তুমি সেটা জানো না। সে বলল- ধুর মিয়া রঙবাজি রাখো। তাড়াতাড়ি শেষ করো। আমি বললাম বিশ্বাস করতাছ না, এই দেখো আমি তোমার কবিতা মুখস্থ কই। এই বলে একটা কবিতা পড়লাম। আবার বললাম তুমি একটা শুনলা। এই দেখো তোমার পুরা বই আমার মুখস্থ। সে বলল- পুরা বই! ইয়ার্কি মারো! আমি বললাম ইয়ার্কি মারতাছি না শোনো- এই বলে ওর বই গড় গড় করে পুরা পইড়্যা দিলাম। ও তো পাগলের মতো পাইচারি করতাছে এদিক ওদিক। তারপর তো আমি গোসল করছি। গোসল শেষে দুইজনে মিলা চা চো খাইয়া বারাইয়া যাব যখন, ভাবলাম আল মাহমুদ এই ধারণা নিয়া যাইব যে ওর পুরা বই আমার মুখস্থ- মানুষ তো আমি, এইটা তো হইতে পারে না! (হাসি)। তখন আমি কইলাম যে আসো তোমারে একটা জিনিস দেখাই। বাথরুমে চলো। ও বললো বাথরুমে ক্যা! আমি বললাম আরে চলো না মিয়া। বাথরুমে উঁকি দিতেই কমোটের পাশে টেবিল ছিল একটা, সেখানে অনেকগুলি বই ছিল। উপরের বইটা ছিল মাহমুদের। ওর বই দেখাইয়া বললাম, ওই দেখো তোমার ‘লোক লোকান্তর’। ও তো তখন বুঝল যে ওর বই থিকা পড়ছি, মুখস্থ পড়ি নাই।
আরেকদিন ওরে তো চা খাইতেও পাঠাইছি। গলা বদলাইয়া টেলিফোন কইর্যা বলছি- আমি ভাই একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মানুষ। কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ার, ইট-কাঠ নিয়া কারবার, আমি তো অত কবিতা বুঝি না। আমার স্ত্রী আপনার খুব ভক্ত। আপনি তো কবিতা লেখেন, আমার স্ত্রীও কবিতা লেখে। আপনি যদি ওর কবিতা একটু দেইখ্যা দেন- আমি খুব খুশি হবো। আমি তো ভাই ট্যুরে চলে যাবো, দেশে তো থাকব না। বললাম আগামী অমুক তারিখে আসেন। তখন সে (মাহমুদ) হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার বলতাছে তাকে। তারপরে সে জানতে চাইল কোথায় আছেন? আমি বললাম ৩৪ নম্বর নিউ ইস্কাটনে চলে আসেন (গড নোজ ৩৪ নম্বর!)। এরপর দুই তিন সপ্তাহ ওর সঙ্গে দেখা নাই। একদিন গেছি ‘দৈনিক পাকিস্তান’ অফিসে। দেখি আল মাহমুদ বইস্যা আছে মুখ বেজাড় কইর্যা। তো অনেকক্ষণ আড্ডা-ওড্ডা মারতে মারতে বললাম কী দোস্ত ৩৪ নম্বর নিউ ইস্কাটনে চা কেমন খাইলা? (তুমুল হাসি)। তখন সে লাফ দিয়া উঠছে। লাফ দিয়া উঠছে সে। লাফ দিয়া উইঠ্যা কয়- শালা তুমি আমার লগে সবসময় এই হারামিপনা কর। আমি বললাম দোস্ত ঘটনা কী ঘটল ওইটা কও। ওটা আর কয় না। হাসতে হাসতে ৩৪ নম্বরে কড়া নাইরা কী হইছে সেটা আর কয় না। (হাসি ) কিন্তু আমরা তখন এতো ইয়াং বুঝছো... একটু ক্রুয়েল জোক তো এইট্যা, আমরা তো হাসাহাসি করতাছি-হা হা হা। জোক তো এইটা। এখন হয়তো ক্রুয়েল না। কিন্তু এখন ভাবি, ছি ছি কিভাবে ওর সঙ্গে এই কাজটা করলাম!
আলফ্রেড খোকন
ওটাকে সে সিরিয়াস নিছে। তবে আমাদেরকে সে একটু আপনার বিরুদ্ধাভাব দিয়েই বলে।
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ আমি জানি। তবে আমি কিন্তু একটা ইন্টারভিউতে বলছি ’ও আমাদের প্রধান কবি। খুব ভালো মতো বলছি আমি। তারপর আরেকজন তাকে ওই ইন্টারভিউটা রেফার করছে। এবং মাহমুদ তখন বলছে, না না শহীদ আমার সঙ্গে এই ঠাট্টা করছে কিন্তু ’ও আমার বন্ধুও বটে। বন্ধু ছিলাম তো। ও যখন ডিকলারেশন দিছে ওর বাইরের ঘরে বইস্যা যে, এশিয়ার মধ্যে আমার বউয়ের উরু শ্রেষ্ঠ। লাফ দিয়া উইঠ্যা টেবিলের উপর একটা পা রাইখ্যা পাজামাটা খুইলা নিজের উরুটা দেখাইয়া বললো যে, এশিয়ার মধ্যে আমার বউয়ের উরু শ্রেষ্ঠ। আমি বসা, নিয়ামত হোসেন, ছড়া লেখে, সেও বসা। আমি বললাম- ও আচ্ছা তাই নাকি! তাইলে না দেইখ্যা কেমনে বুঝি? ওঠার একটা ভান করছি যেই। সঙ্গে সঙ্গে বললো নাদিরা নাদিরা পালাও! পালাও! পালাও! শহীদ আসতাছে! (হাসি) ভাবী তো উইঠ্যা দৌড় দিছে পাশের বাড়িতে। আমি তো আর যাইতাম না। ’ও মনে করে যে শহীদের পক্ষে সবকিছু সম্ভব। তারপরে এইটি থ্রিতে যখন গিয়েছি ওর বাড়িতে। তখন মাহমুদ ওর ছেলেকে বলছে তোর চাচা আইছে মুরগা কাট। ছেলে অনেক বড় হইছে। তারপর ভাবী আইছে ট্রে-তে করে চা নিয়া। আমি কইলাম ভাবী আপনি এইটা কী কাজ করলেন বলেন তো! ভাবী বললেন- ক্যান ভাই? বললাম- আপনি এই বুড়া হইয়া আমার সামনে আইলেন ! আল মাহমুদ কতো কী কইল, গোড়ালি পর্যন্ত চুল (অন্য কথাগুলা কই নাই আমি) সেইরকম ধবধবে চেহারা! ওইটা তো দেখতে দিলো না। নেকাব পইড়্যা থাকলেন সারাজীবন। এখন এই বুড়া হইয়া সামনে আইছেন- এখন কী দেখমু আর!
আলফ্রেড খোকন
তখন সে কিছু বলছিল?
শহীদ কাদরী: ভাবী হাসছিল, আমি তখন বললাম চিন্তা কইরেন না- আমিও বুড়া হইয়া গেছি। আল মাহমুদ কয়- খা শালা খা, কী কয় এইগুলা, খা। (হাসি) এছাড়া আমরা কিন্তু জীবনে অনেক কিছু করছি একসঙ্গে (অকথ্য) কহতব্য নয়। আল মাহমুদ জানে আমার ওই লিমিটটুকু আছে, কোনটা বলা যায় আর কোনটা যায় না। শামসুর রাহমানেরও অনেক কিছু আমরা দেখছি। সবকিছু বলি নাই, বলবও না। শোনো, সাড়ে তিনটা বাজে, আমাকে উঠতে হবে। নিচে কবিতার অনুষ্ঠান আছে, লোকজন অপেক্ষা করছে...
আলফ্রেড খোকন
না, পৌনে চারটা বাজাইয়া দিছি।
শহীদ কাদরী
চল তবে-
উঠতে উঠতে গৃহ সেবিকাকে (আমেরিকান) বললেন- take my phone and keep it. Don’t forget my phone okay? Let me go there… হুইল চেয়ারে উঠতে তাঁকে সহায়তা দিতে বললেন গৃহ সেবিকাকে। আর বিড়বিড় করে বাংলায় আবার আমাকে বললেন- এ বেটি নতুন এসেছে, বুঝতেই পারে না কী করতে হবে।
আলফ্রেড খোকন
তবে দেইখা ভালোই মনে হইছে?
শহীদ কাদরী
হ্যাঁ মেয়ে ভালো, কিন্তু খুব অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড। অনেক ওষুধ-টষুধ মিস করছি ওর জন্য। ওষুধ শেষ হইয়া গেছে, কয় না। জানায় না।
এরমধ্যে তাঁর স্ত্রী নীরা পাশের ঘর থেকে জানালো- শহীদ ভাই আড্ডাতে ১০ হাজার টাকার প্রাইজ পাইছে বিউটি বোর্ডিং থেকে। আমি তাঁকে বললাম কিন্তু আপনার তাড়ায় তো আর আড্ডা দেয়া যাচ্ছে না? নীরা ভাবী বললেন- এই জন্যেই তো পুরস্কারের কথাটা তোমায় বললাম। ওটা আমার মাথায় আছে না? আমাদের আলাপকালে সে একটু পরপর তাড়া দিচ্ছিল কবিতা সন্ধ্যায় যাবার জন্য।
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪, জ্যামাইকা, ন্যূয়র্ক, আমেরিকা
আলফ্রেড খোকন: কবি