Full premium theme for CMS
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চণ্ডালিকা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘ডাকঘর’র বুনন খুলে শাহমান মৈশানের নয়া বুনন ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ মোকাবিলা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ প্রযোজনাটি রবীন্দ্রনাথকে ভর করে আবার রবীন্দ্রনাথ থেকে মুক্ত হয়ে, শূন্য আয়তন থেকে উৎসারিত অভিনেতার দেহভঙ্গি,স্বরভঙ্গি,শব্দের উচ্চারণ, ইমেজ, রং, রেখা, আলোর মধ্যে থাকা অর্থের একটি নৈর্ব্যক্তিক কাঠামো। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের একটি প্রযোজনা। এটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা এবং ভারতের কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে মঞ্চস্থ হয়েছে। প্রযোজনাটি স্পষ্ট করে, এটি নির্দেশক ও অভিনেতার অবচেতনের সত্তা সন্ধানী নিমগ্ন ধ্যান। একই সাথে প্রযোজনাটি সময় সনাক্তকারী হুলও (পিন্স) বটে।
‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ টেক্সটির ও প্রযোজনাটির একটি পাঠ-উত্তর ফলাফলস্বরূপ আমার এই রচনা। এখানে জ্যাক দেরিদাকে দোহাই করে একটি কথা শুরুতে বলে রাখা ভালো- ‘একটি টেক্সটের ব্যাখ্যা কখনো শেষ হয়ে যায় না, কারণ টেক্সট সকল প্রতিটি পাঠেই নতুন একটি বিন্যাসে সাজে। সকল পঠন সেজন্য একটি নতুন অথবা ভ্রান্ত পাঠ।’১ একথা যেমন আলোচ্য প্রযোজনার নির্মাতা শাহমান মৈশানের বেলায় সত্য, তেমনি আমার এই লেখার বেলায়ও প্রযোজ্য। অতএব, আমার এই পাঠটি হয় নতুন অথবা ভ্রান্ত।
‘বাউন্ডেড টেক্সট’ এবং ‘ইন্টারটেক্সচুয়াল টেক্সট এর ডিসকোর্স’ যেভাবে ক্রিসটিভা করেছেন সেই ডিসকোর্সের দোহাই দিয়ে এই প্রযোজনাটিকে বলা যায় ইন্টারটেক্সচুয়াল নন-লিটারারি শিল্প। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে (বাউন্ডেড টেক্সটে) এবং প্রথাগত কোনো নাটকের ঢঙে আটকে না থেকে ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ স্থানিক ও কালিক পাঠ হয়ে ওঠে। সমাজে বিরাজমান চিহ্নগুলো অভিনেতার দেহের, রঙের, রূপের, আলোর প্রকাশে ভাষা হয়ে ওঠে।২
আবার একই সাথে এই নাটকটি সমাজ সম্পর্কিত কোনো ফিকশনাল গল্প নয়, যে গল্পগুলো আমাদের হেজিমোনাইজ করে। বরং বলা যায় এই হেজিমোনাইজ করার অপর পিঠ এই প্রযোজনাটি। নাটকটি কোনো ফিকশনাল বা doxa টাইপ প্রেজেনটেশন নয় বরং নাটকের মধ্যে যে ফিকশন থাকে সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে। এই ফড়ীধ সম্পর্কে বুঝবার জন্য রোলাঁ বার্থ যা বলেছেন সেটি একটু খোলসা করা যাক।- ‘ডক্সা হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক স্টেরিওটাইপ বা ছাঁচ। আর এভাবেই এটা একটা ফিকশন হয়ে ওঠে এবং একটি জারগন বা পরিভাষা হিসেবে কার্যকর থাকে। পাশাপাশি এক অজ্ঞান অথবা এমনকি এক অকর্মণ্য ডিসকোর্সেও পরিণত হয়।’৩ (Barthes, ১৯৭৫:২৮)
এই প্রযোজনার প্রতিটি পরতে পরতে বরং এই ডক্সা’র প্যারাডক্স তৈরি হয়। ফলে এর খোল-নলচে পালটে যায়। সর্বোপরি এই প্রযোজনাটিকে আমি বিনির্মাণবাদী হাইব্রিড প্রযোজনা হিসেবে বুঝতে চাই।
‘রিডাকশন’, ‘কনস্ট্রাকশন’ ও ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর মধ্যদিয়ে ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ হয়ে ওঠে একটি বিনির্মাণবাদী প্রযোজনা। নাট্যকার ও নির্দেশক শাহমান মৈশান সময়, প্রেক্ষাপট ও রবীন্দ্রনাথকে ‘পর্যবসিত’ করেছেন ‘রূপান্তরিত’ করেছেন এবং ‘ধ্বংস’ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ হয়ে ওঠে একটি সৃষ্টি, একটি বিনির্মাণবাদী প্রযোজনা।
‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’ ও ‘ডাকঘর’ নাটকের একটি কোলাজ অথবা এর মোকাবিলা। রবীন্দ্রনাথের এই তিনটি নাটকের যে প্রধান সুরটি আমাদের অনুরণন করে তা হলো ‘মুক্তি’। রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তি’র উন্মুক্ত চেতনকে যে রীতিতে, যে রূপে ধরতে চেয়েছেন এবং যে সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণ করেছেন তার একটি ভিন্ন পাঠ বা এনকাউন্টার মূলক প্রযোজনা ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’। রবীন্দ্রনাথের আঁকা যে বিশাল উন্মুক্ত ক্যানভাস সেটিকে দুরবিন দিয়ে ‘ক্লোজে’ দেখেছেন আবার উল্টো করে ‘লং’-এ দেখেছেন এর নির্দেশক। রবীন্দ্রনাথের গ্রান্ড ন্যারেটিভ ক্যানভাস শাহমানের কাছে ধরা দেয় জীবনের ছোট ছোট ইমেজে, ছোট কোনো বস্তু বা দেহভঙ্গি বা শব্দ উচ্চারণে। নিত্যকার ক্ষণকালের মুহূর্তের মধ্যে দেখা দেয় বিশাল উন্মুক্ত ভাবনা।
আমি এই প্রযোজনাটি থেকে যে প্রশ্নগুলো উত্থাপন ও বুঝবার চেষ্টা করব তা হলো- ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ কিভাবে একটি সৃষ্টি বা বিনির্মাণ? পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথের তিনটি টেক্সটের সাথে কিভাবে মোকাবেলা করে একটি পারফরমেন্স টেক্সট ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’র নির্মাণ হলো? আর এর তাৎপর্য কী এবং শৈল্পিক তৎপরতা হিসেবেই-বা এটি কী?
রবীন্দ্রনাথের তিনটি নাটকের মূল উপজীব্য হলো আপন সত্তা আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে মানবের মুক্তি বা ফ্রিডম। এই প্রযোজনাটির মূল উপজীব্যও তাই। এখন দেখবার বা ভাববার বিষয় হলো এই মূল লক্ষ্যে বা সুপার অবজেকটিভে পৌঁছবার পথটি রবীন্দ্রনাথ কিভাবে নির্মাণ করেছেন আর নির্দেশক শাহমান কিভাবে তার সাথে মোকাবেলা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মুক্তি ভাবনাটি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কনটেক্সটে হাজির করেছেন। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কালে ও চরিত্রে রূপায়ণ করেছেন। আর আলোচ্য প্রযোজনায় কোনো নির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্রের ধারাবাহিক সূত্রে গ্রথিত হয় না। একটি শব্দ, একটু আলো, একটি নিঃশব্দ, একটু অন্ধকার, একটি চলন, একটি বলন আর আনস্টেরিওটাইপ এক্সপ্রেশন আমাদের কাছে গ্রান্ড ন্যারেটিভ কনটেক্সট এর ইমেজ আকারে ধরা দেয়।
চণ্ডালিকার আপন ঘরের দর্শন
রবীন্দ্রনাথ ‘চণ্ডালিকা’য় শ্রেণী-গোত্র-লিঙ্গ পরিচয় অতিক্রান্ত মানবের মুক্তির ক্যানভাস এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য ‘চণ্ডালিকা’য় প্রকৃতি নামের এক অচ্ছুত নারীর দেহ-মনের চেতন লাভের গল্প দেখা যায়। এই অচ্ছুত চণ্ডালিনী নারীর নাম প্রকৃতি। প্রকৃতির কাছে এক বৌদ্ধ শিষ্য আনন্দ জলপান করতে চায় আর তাতেই প্রকৃতির সমস্ত অবগুণ্ঠন খুলে যায়। নিজেকে অচ্ছুত চণ্ডাল নারী থেকে মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করে। প্রকৃতি নিজের ভিতরকার ভগবানকে দেখতে পায়। আপন সত্তার স্বরূপ তার কাছে আবিষ্কৃত হয়।
দেহকেন্দ্রিক আধ্যাত্মিক দর্শন এই নাটকের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রবল করে তোলেন, যা প্রাচ্য দর্শনের মূল ভিত হিসেবে বিবেচ্য। শেষ দৃশ্যে মন্দিরে নৃত্যরত প্রকৃতি আর মন্ত্র উচ্চারণে নিমগ্ন তার মা মায়া। এই দৃশ্যটি ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যের বিশেষ দৃশ্য। দেহ আর মনের যুক্তযুক্তির মধ্য দিয়ে পরমে পৌঁছবার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় ‘চণ্ডালিকা’য়। দেহের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ড আবিষ্কার করে প্রকৃতি। প্রকৃতির সেই নৃত্য কোনো ট্র্যাডিশনাল নৃত্য নয়। সমস্ত ফর্মকে ভেঙ্গে সাবকনশাস বডির আন-কনশাস উচ্চারণ। সময়কে অতিক্রম করে মহাজাগতিক অংশ হয়ে ওঠে প্রকৃতি। সমাজ, রাজনীতির যে নিয়ম বা রুল হাজির আছে সমস্ত কিছুর অবগুণ্ঠন খুলে পরম-আনন্দের দেখা পায় প্রকৃতি। ইন্দ্রনাথ চৌধুরীর মতে রবীন্দ্রনাথের এই নাটকের মূল ভাবনাটি হলো:
‘বর্তমানকে বন্ধনমুক্ত করে দেওয়া, তারপর একে চিরায়ত সময়ের অংশ করা। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনে নাচ হয়ে উঠেছিল পরমানন্দের প্রতি সংবেদনার প্রকাশ, নাচকে তিনি করেছিলেন আধ্যাত্মিকতার বাহন, যার মাধ্যমে এক নিয়ত প্রবাহ তৈরি হবে। আর এই অবিরত প্রবাহে মহাজগতের সময়হীন ও শাশ্বত শৃঙ্খলা ধরা পড়বে।’৪
এখন দেখা যাক, শাহমান মৈশান তাঁর প্রযোজনায় কিভাবে চণ্ডালিকার চিত্র এঁকেছেন।
শুরুতেই ভাষার প্রশ্নটি হাজির করা যাক। রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’য় যে ভাষা আমরা দেখতে পাই তা মধ্যবিত্তের ‘সাংস্কৃতিক’ প্রমিত ভাষা। ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’য় সেই ভাষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নবর্গের ভোজপুরী ভাষা। রবীন্দ্রনাথ যদিও ‘চণ্ডালিকা’য় মানবের মুক্তির কথা বলেছেন এবং গোত্র-শ্রেণী-লিঙ্গ পরিচয়কে অস্বীকার করে মানব পরিচয়কে উচ্চকিত করেছেন। কিন্তু তবুও চণ্ডালের মুখনিঃসৃত ভাষা কেনো প্রমিত বাবুদের মুখনিঃসৃত সাংস্কৃতিক ভাষা? রবীন্দ্রনাথের এই ভাষাকেন্দ্রিক মনোভাব, ভাষাকেন্দ্রিক ক্ষমতা চর্চারই পরিচায়ক। আপামর জনতার ভাষাকে নিম্নজ্ঞান করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সত্যতার প্রমাণ আমরা নানাভাবেই করতে পারি। ভাষাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন আপামর জনতাকে এবং তাদের সংস্কৃতিকে। যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে একালের চণ্ডাল শ্রেণী এবং সভ্য প্রমিত সংস্কৃতিবান বাবু শ্রেণী। এই শ্রেণীকরণ বা বর্গীকরণের দায় রবীন্দ্রনাথ এড়াতে পারেন না।
তাঁর দেখানো পথের চোরাগলির তালাশ না করে অথবা রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মূলগত ভাবকে উপলব্ধি না করে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রচর্চার নামে সাংস্কৃতিক বুর্জোয়া বা বাবুশ্রেণী যারা জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ক্লিষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃতি ব্যাপারটা কিভাবে দেখেছেন তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক- বাংলা শব্দতত্ত্ব বইয়ে দেখতে পাই culture শব্দের অনুবাদ ‘কৃষ্টি’ তিনি মানতে পারেননি। তিনি এর সমস্যা বলতে বুঝতে চেয়েছেন ‘কৃষ্টি’ শব্দের সাথে কৃষির যোগ আছে তা সংস্কৃতি হয়ে উঠতে পারে না। সংস্কৃতি একটু উচ্চকিত কিছু।৫ এই যে উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষদের কাছ থেকে সংস্কৃতি বিষয়টাকে তুলে আনবার ব্যাপারটি শ্রেণীমুক্তি ভাবনার পরিপন্থি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চণ্ডালিকা’য় যে চরিত্রের চিত্রায়ন করেছেন তারা সেই নিম্নবর্গ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কিন্তু তাদের মুখনিঃসৃত ভাষা প্রমিত কাব্যকলায় উচ্চকিত। রবীন্দ্রনাথ-সৃষ্ট ভাষার সাথে শাহমান কিভাবে এনকাউন্টার করল সেটি বুঝবার ব্যাপার এবং ভাববার ব্যাপার। কাব্যকলায় উচ্চকিত ভাষাকে পাত্র-পাত্রীর দেহভাষায় রূপান্তর করে মঞ্চে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠার মতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে এই প্রযোজনার অভিনেতা সকল। এদিকে শাহমান যাদের দিয়ে চরিত্র চিত্রায়ন করেছেন তারা ঢাবি থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী। তাঁরা রূপায়ণ করেছেন চণ্ডালদের জীবন, রপ্ত করেছেন চণ্ডালদের মুখের ভাষা ভোজপুরি ও দেহভাষা। মধ্যবিত্তের দেহভাষা যখন নিম্নবিত্তে মিশে যায় এবং ঢাকা শহরের দর্শকের কাছে যখন উপস্থাপন করা হয় তখন কী অভিঘাত তৈরি হয় এটি নির্দেশকের নিরীক্ষা এবং রবীন্দ্রনাথের ভাষা বিষয়ক একটি এনকাউন্টার এবং একই সাথে রবীন্দ্রকেন্দ্রিক যে বুর্জোয়া সাংস্কৃতিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে তার বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জও বটে।
এই প্রযোজনায় চণ্ডালিকা পার্টটি আসে ১ম দৃশ্য, ২য় দৃশ্য, ৫ম দৃশ্য ও ৮ম দৃশ্যে। প্রযোজনায় প্রথম দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই দুই চণ্ডাল দেহ ঝাপটায়- দেখে মনে হয় ওদের দেহের মধ্যে অব্যক্ত ভাষা আছে। সামাজিক দেহের মধ্যে জড়িয়ে থাকা অবদমনকে ঝেড়ে ফেলতে চায়, অব্যক্ততা সন্ধানী দৈহিক ইমেজ স্পষ্ট হয়। সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী অখণ্ড কোরানদর্শনে উল্লেখ করেছেন- জান্নাতে অবস্থিত মানবদেহ হলো ‘সিদরাত’।৬ যা আমাদের নিত্যকার সামাজিক দেহ। আর লা মোকামে স্থিত মানবদেহ হলো ‘তুয়াগাছ’।৭ যে দেহ সংস্কার-মুক্ত। সমগ্র প্রযোজনাটির মধ্যে অভিনেতাদের দেহভঙ্গি এবং চিন্তাভঙ্গি সেই সিদরাতি দেহ অতিক্রম করার বাসনা স্পষ্ট করে, এমনকি পরিশেষে তুয়াগাছরূপী দেহের সন্ধান করে। প্রযোজনায় অংশগ্রহণকারী সমস্ত কুশীলব যেন ‘কাহাফের’ যুবক। নিজের প্রতিক্ষণের বিশ্লেষণে বা ‘ফানা’য়৮ রত বা অনুদর্শনের মধ্যে দিয়ে সত্য আবিষ্কারে রত। ‘কাহাফে’৯ থাকা মানে হলো অপন দেহের মধ্যে সমাধিস্থ থাকা। সমগ্র প্রযোজনার পাত্র-পাত্রীর দেহভাষা আমাদের বলে দেয় তারা আপন দেহের মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে আপন সত্তার সন্ধানে রত।
প্রযোজনার ১ম দৃশ্যেই বৌদ্ধ ভিক্ষুর প্রবেশ হয়। তবে এই বৌদ্ধ ভিক্ষু রবীন্দ্রনাথের চণ্ডালিকার আনন্দ নয়, একেবারেই তার বিপরীত রূপ। বলা যায় রবীন্দ্রনাথের আনন্দ চরিত্রের প্যারাডক্সিক্যাল রূপ। রবীন্দ্রনাথের বৌদ্ধ ভিক্ষু হলো পরমানন্দ বা মুক্তির রূপক তাই তার নাম আনন্দ। আর শাহমানের নির্মিত বৌদ্ধ ভিক্ষু বাস্তবতা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির মেটাফর। ‘চণ্ডালিকা’য় বৌদ্ধ ভিক্ষু আনন্দের যে রূপ রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করেছেন সেটি কেবল দেখতে পাওয়া যায় ২য় দৃশ্যে। ক্ষণকালের জন্য হ্যালোসিনেশনের মতন প্রকৃতির অন্তরলোকে দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। গৌতম বুদ্ধের স্বরূপগত প্রেরণা হলো ‘মহানন্দ’ বা ‘পরমানন্দ’ যা ‘মুক্তি’ ধারণাকে প্রকাশ করে। তাইতো তার নাম ‘চণ্ডালিকা’য় রবীন্দ্রনাথ করেছেন- আনন্দ।
পক্ষান্তরে, নির্দেশক এই প্রযোজনায় বৌদ্ধ ভিক্ষু চরিত্রের মধ্যদিয়ে ধর্মের রাজনীতিকে স্পষ্ট করেন। ধর্মকারী হলেই বুদ্ধের ‘করুণাময় ভাব’-কে উপলব্ধি করা যায় না। ধর্ম প্রচার আর প্রসারের মধ্যে একালে বুদ্ধের করুণাময় ভাব যে সকল ধর্ম থেকে উধাও হয়ে গেছে এবং এর অন্তরালে রাজনীতি বড় হয়ে উঠেছে সেটি আমাদের আর একবার হুল ফুটিয়ে দেখিয়ে দেয় এই প্রযোজনা। ‘বুদ্ধং শরণাং গচ্ছামি সংঘং শরণাং গচ্ছামি’- এই সংঘ বা জমায়েত নীতি রাষ্ট্র, ধর্ম সমান্তরালে চালিয়ে যাচ্ছে । এই জমায়েত নীতির অন্তর্গত আড়ালে যে হিংসা নিমজ্জিত আছে, যে রাজনীতি প্রবিষ্ট আছে, সেটিকে স্পষ্ট করে তোলে প্রযোজনাটি এবং আমাদের বিবেকে হুল ফুটায়। প্রযোজনায় ধর্মকারী মুক্তি আর অবমুক্তির অবস্থানে দোল খায়। আবার বুদ্ধ সন্ন্যাসিকে জলপান করালেই সব চণ্ডালের আত্মমুক্তি যে হয় না, এই সত্যকে ‘চণ্ডালিকা’য় এড়িয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যে সরল ও প্রতীকী সত্যকে আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ, সেই সত্যেও জটিলতাপূর্ণ অপর পিঠ খুঁজেছেন শাহমান।
প্রযোজনাটিতে কোনো চরিত্রেরই ধারাবাহিক অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় না বরং চরিত্রগুলো কোনো বক্তব্যের বা চিন্তার রিপ্রেজেন্ট করে। সেটি ইমেজ আকারে গ্রথিত হয়, আবার ইমেজটি ভেঙে যায়। সুতরাং, ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ প্রযোজনা নিয়ে আমাদের আলোচনার ক্ষেত্রে ওই ক্ষণকালের ইমেজটিকেই বুঝতে হবে।
চণ্ডালের দেয়া জল যখন বৌদ্ধ ভিক্ষু তার মাথার সদৃশ পাত্রে পান করে তখন আল্লাহ প্রেরিত ‘মাউন’১০ এর অর্থ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমস্ত সৃষ্টির মূলে জল এবং এই জল পান করার মুহূর্তটিতে চণ্ডাল জল দান করে আর বৌদ্ধ ভিক্ষু জল পান করে এই দৃশ্যের ভাব দর্শককে অনুভূতি দেয় , এ যেন জাহান্নাম হইতে জান্নাতে প্রবেশের মুহূর্ত।
ধ্যনস্থ বৌদ্ধ ভিক্ষুর থলে থেকে যখন আর্মির বুট বেরিয়ে আসে এই ইমেজটি আমাদের সময়কে উপলব্ধি করায়- যে সময়টিতে আমরা বেঁচে আছি, যে সময়ে রোহিঙ্গাদের মতো হাজারও জাতি-গোষ্ঠী আইডিন্টিক্যাল ক্রাইসিস নিয়ে বেঁচে আছি। এ কালে ক্ষমতার মেটাফর বুট জুতা সার্বক্ষণিক দৃশ্য-অদৃশ্য হয়ে আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। আবার ৭ম দৃশ্যে মন্দিরে প্রার্থনারত জনতার বুক বরাবর যখন তলোয়ার ভেসে ওঠে তখন উপরিতলের ধর্মাচারের অন্তরতলে যে হিংসা লুকায়িত আছে সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং তলোয়ার অবজেক্টটি এই প্রযোজনায় রিপিটিটিভ ব্যবহারে ‘মটিফ’ এর ভূমিকা পালন করে। এবং তলোয়ার অবজেক্টটি ধর্ম এবং ইসলামের নামে যে অপরাজনীতিটি প্রচলিত আছে, সেই রাজনীতির দিকে দর্শককে চিন্তায় লিপ্ত হতে নির্দেশ করে।
এই প্রযোজনার বৌদ্ধ ভিক্ষুর চরিত্রটি নির্দেশক শাহমানের এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলেই আমার কাছে মনে হয়। এরকম একটি অরৈখিক গল্পকে প্রচ্ছন্নভাবে এই চরিত্রটি গ্রথিত করে সমগ্রের সাথে। ধর্মতাত্ত্বিক ক্রিয়া-কর্মের মধ্যে যে রাজনীতি, ক্ষমতা, ভণ্ডামি ও হিংস্রতা বিদ্যমান সেই বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই বৌদ্ধ ভিক্ষু চরিত্রটি- অপরপক্ষে জগত জীবনের মুক্তির আধ্যাত্মিক ভাবকে বলিষ্ঠ করে এই চরিত্রটি।
৫ম দৃশ্যে সমাজের বিভিন্ন পেশা ও রাজনীতির রূপক হিসেবে চরিত্রগুলো প্রবেশ করে। সবার কাছে চণ্ডালিকা মুক্তির দিশা খোঁজে। কিন্তু প্রত্যেকেই চণ্ডালিকাকে প্রত্যাখান করে, এমনকি সমগোত্রীয় চণ্ডালও তাকে প্রহার করে। সুতরাং গোত্র-ভাবনা বা শ্রেণীসংগ্রাম বা সমষ্টির মধ্যদিয়ে মুক্তির একরৈখিক ভাবনাটি নির্দেশক নাকচ করে দেন। বরং শাহমান স্পষ্ট করেন ব্যক্তির আপন সত্তার চৈতন্য লাভ ও মহাজগতের সাথে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই মুক্তির একপ্রকার সম্ভাবনা নিহিত আছে।
চণ্ডালিকাকে চণ্ডাল দ্বারা প্রত্যাখ্যান এবং চণ্ডাল নামকরণের মধ্য দিয়ে অচ্ছুতকরণের মূলগত রাজনীতিটি হলো ‘শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব’- যা কার্ল মার্কস বলেছেন। মার্কসের সেই তত্ত্বকে কেবল ছায়া হিসেবে নিয়ে নির্দেশক এই দৃশ্যটি নির্মাণ করেছেন। কারণ, শাহমান একই সাথে কার্ল মার্কসের তত্ত্বকে খারিজও করেছেন। মার্কস বলেন, ‘মানবিক চৈতন্য, প্রবৃত্তি এবং মনন সবসময় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এবং এই ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ শেষ দৃশ্যে দেখা যায় চণ্ডালিকা নিজেই নিজের মুক্তির সোপান নির্মাণ করেছে। আদি ধ্বনি ‘ওম’ উচ্চারিত ছন্দে নৃত্যরত চণ্ডালিকার নিজের ভিতরকার বৌদ্ধসত্তা দর্শন করে। এভাবে চণ্ডাল কন্যার প্রকৃতির আত্মচেতন লাভ হয়। বস্তুজগতের বন্ধন হইতে তথা দুনিয়া হইতে মুক্ত হয়ে ‘নশর’ লাভ করে। স্রষ্টা ও সৃষ্টির পার্থক্য ঘুচে যায় চণ্ডালিকার। স্রষ্টা ও সৃষ্টি চণ্ডালিকার অঙ্গে একীভূতকরণ হয়ে যায়। দেহ ও মনকে একসূত্রে গ্রথিত করে চণ্ডালিকা। সুফি সদর উদ্দিন চিশতীর কোরানদর্শন অনুযায়ী যাকে বলা যায় তৌহিদ লাভ করা, তৌহিদ মানে একাঙ্গীভূতকরণ। সৃষ্টিকর্তা যে বাতেন রূপে মানুষের মধ্যে অবস্থিত, সেই বাতেনের দেখা পায় চণ্ডালিকা, এমনকি এই প্রযোজনার অপর উল্লেখযোগ্য চরিত্র চিত্রাঙ্গদাও।
প্রযোজনার শেষ দৃশ্যটিও ‘চণ্ডালিকা’ অবলম্বনে। রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’র শেষ দৃশ্য মন্দিরে আর ‘চাড়ালনামা’র শেষ দৃশ্যটিতে দেখতে পাই একটি ছোট পাত্রে জলে ভাসে কতগুলো নানা রঙের কাগজের নৌকা, যা প্রকৃতির বাসনার নানা রঙ হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। এই দৃশ্যের শুরুতেই একজন রবীন্দ্রনাথের একটি বই হাতে আরেকজনকে বলে ওঠে- ‘এই উৎপাত শান্ত হবে কবে?’ প্রকৃতি প্রতিউত্তর করে- ‘আমি যদি মুক্তি না পাই তা হলে তিনি মুক্তি পাবেন কী করে।’ এখানে, লক্ষণীয় বিষয় হলো সংলাপগুলো রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’ থেকেই গৃহীত। কিন্তু শাহমান তাঁর বিনির্মাণমূলক নাট্যরচনার দক্ষতা ও শিল্পভাষাকে এমনভাবে প্রয়োগ করেছেন যাতে সংলাপগুলো আদি টেক্সটের পাঠার্থ হারিয়ে একেবারেই অন্য পাঠার্থ গ্রহণ করে। তাছাড়া, এই সংলাপটি গুরুত্ব বহন করে একারণেও যে, রবীন্দ্রনাথ কেবল পাঠ আর তত্ত্ব তাত্ত্বিকের বিষয় নয়, সেটি উপলব্ধি করার এবং দেহ ও আত্মার সংশ্লেষণ যোগে চর্চারও ব্যাপার। পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথকে সাংস্কৃতিক উৎপাত হিসেবে সমালোচনা করেন, শুধু তাই নয়, রবীন্দ্র-সংস্কৃতির ভোক্তা সমাজকেও ব্যঙ্গ করা হয় এই চিহ্নের মাধ্যমে। প্রকৃতি চরিত্র রূপায়ণকারী অভিনেত্রী এই সংলাপ শেষ করেই যুক্ত হয় মুক্তি লাভের ধ্যানস্থ সাধনায়। আর তাই প্রকৃতি মায়ের আঁচলে নিজের আঁচলটি বেঁধে নিজের প্রতিরূপ তৈরি করে গেয়ে ওঠে-
‘মম রুদ্ধ মুকুলও দলে
এসো সৌরভ অমৃতে
মম অখ্যাত তিমির তলে
এসো এসো...।।’
বাংলা ভাষার ‘মা’ ভোজপুরী ভাষায় ‘মায়ি’। রবীন্দ্রকৃত ‘চণ্ডালিকা’য় প্রকৃতির মা মন্ত্র উচ্চারণ করে আর শাহমানকৃত প্রযোজনায় প্রকৃতির মায়ি আদি ধ্বনি ‘ওঁ’ উচ্চারণ করে। উপনিষদে মন্ত্রের যে অর্থ সেই অর্থ এখানে মন্ত্রের প্রয়োগ। উপনিষদে বলা আছে ওঁ ধ্বনিই পূর্ণব্রহ্ম অবিনাশী পরমাত্মা-
‘ওমিত্যেতদক্ষরমিদ্ঁ সর্বং তস্যোপব্যাখ্যানং ভূতংভবদ্ভ- বিষ্যদিতি সর্বমোঙ্কার এব। যচ্চান্যৎ ত্রিকালাতীতং তদপ্যোঙ্কার এব।।’ মাণ্ডুক্যেপনিষদ্ ১১
অ-উ-ম = ওঁ এই তিন ধ্বনির মধ্যে পূর্ণব্রহ্ম, স্থূল ও সুক্ষ্ম জগতের সমগ্র রূপ লুকিয়ে আছে। বর্তমান ভবিষ্যত অতীত এই সমগ্রের চাইতে অতিক্রান্ত কিছু নিহিত আছে ‘ওঁ’ ধ্বনির মধ্যে। ‘ওঁ’ ধ্বনিই পরমব্রহ্ম, পরম আত্মা, মহাবিশ্ব ও মুক্তি।
প্রকৃতি নৃত্যরত অবস্থায় সেই পরমব্রহ্ম অবস্থা পরিগ্রহ করে বা লা মোকামে উপনীত হয়। এ নৃত্য কোনো নিত্যকার ছন্দে ছন্দায়িত নয়। কনশাস বডির আনকনশাস উচ্চারণ। রবীন্দ্রনাথ এই অবস্থাকে বলেছেন জীবনমৃত্যুর সীমানা। অর্থাৎ জীবনমৃত্যুর সীমানা মানে নোম্যানস ল্যান্ড। যেখানে কোনো কামনা, বাসনা, অহম থাকে না, করুণাময় ভাব কেবল আপ্লুত করে রাখে। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি তাই বলে ওঠে-
‘আনছে আমার জন্মান্তর,
মরণের সিংহদ্বার ওই খুলছে।
ভাঙল দ্বার, ভাঙল প্রাচীর,
ভাঙল এ জন্মের মিথ্যা।’ (‘চণ্ডালিকা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এই উক্তি আনন্দকে দর্শনের পর প্রকৃতি উচ্চারণ করে। প্রকৃতির জন্মান্তর হয়। জীবিত দশার সমস্ত মিথ্যা তার কাছে উন্মোচিত হয়। দশাগ্রস্ত জীবনের সমস্ত বাঁধন সেই মুহূর্তে টুটে যায়। ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’য় বৌদ্ধ ভিক্ষু সকলের পিঠ মাড়িয়ে হেঁটে চলে পথের সন্ধানে আর গাইতে থাকে-
‘পথের শেষ কোথায়
কি আছে শেষে পথের
এত কামনা এত সাধনা
কোথায় মেশে
কি আছে শেষে পথের... ’
(‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ প্রযোজনা)
প্রযোজনায় মায়ের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে প্রকৃতির জন্মান্তর হয়। প্রকৃতির বাসনা-কামনা-লব্ধ জীবনের অবসান হয়। তৎক্ষণাৎ তার কাছে আনন্দ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই দৃশ্যে যখন প্রকৃতি তার মায়ের মৃত্যুতে বা তার বাসনা-লব্ধ জীবনের মৃত্যুতে যখন সে চিৎকার করে, আহাজারি করে, তখন দ্বিধান্বিত হই আসলেই কি তার আনন্দ দর্শন হয়েছে? অভিনেতা প্রকৃতিও তখন দ্বিধান্বিত। এই দ্বিধাগ্রস্থ অবস্থা আনন্দের মার্গ হতে পারে কিনা তা ধর্মতত্ত্বীয় প্রশ্ন। এ সময় অভিনেতা প্রকৃতিও অস্পষ্ট দ্বিধান্বিত স্বরে উচ্চারণ করে- ‘ভিক্ষু...’। এর পরই প্রযোজনার যবনিকা। আলো নিভে যায়, দর্শকের সম্মুখে কেবল অন্ধকার...। দর্শক হিসেবে আমি ভাবি অপরাপর দর্শক তখন কী ভাবে? এই ভাবান্তর আর অর্থান্তরের মুহূর্তের পর মুহূর্ত সৃজনের স্নায়বিক প্রক্রিয়া রচনা এই প্রযোজনার এক বিশিষ্ট দিক।
চিত্রাঙ্গদা: নারী, প্রেম, পরম
রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রাঙ্গদা’ লিখেছিলেন চৈত্রের দুপুরে বাগানের ফোটাফুল দেখে। কিছুকাল পরে ফল ধরবে বাগানের ফুলগুলো মিলিয়ে যাবে, এটাই তরুপ্রকৃতির নিগূঢ় রসসঞ্চয়ের স্থায়ী পরিচয়- ‘ফলসম্ভারে’। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব-প্রকৃতির এই রূপের রূপক হিসেবে দেখেছেন নারীর রূপকে। চিত্রাঙ্গদা চরিত্রটি হিমাচল প্রদেশের মিথলজিক চরিত্র হিড়িম্বা ও মহাভারতের সংশ্লেষজাত। এই পিছনকার কথাটি উল্লেখের কারণ এই যে, বিনির্মাণের প্রচেষ্টা নির্দেশক শাহমানের নতুন কিছু নয় এবং অচ্ছুত কিছুও নয়। ‘সূযের্র নিচে নতুন বলে কোনো কিছু নেই।’১২ বহুকাল পূর্বেই রবীন্দ্রনাথের বিনির্মাণ প্রচেষ্টায় সৃষ্টি হয়েছে ‘চিত্রাঙ্গদা’। মহাভারতের চিত্রা আর হিমাচল প্রদেশের লোক চরিত্রের মিলিত রূপ চিত্রাঙ্গদা। চিত্রাঙ্গদা আজও মডার্ন নারীর আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটিকে প্রবল করে তোলে এবং যৌনতা, প্রেম ও পরমের বাণী মর্মরিত করে তোলে।
‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ প্রযোজনায় চিত্রাঙ্গদা আসে ৩য় দৃশ্যে। দৃশ্যটি শুরু হয় মিলনের মুহূর্ত অবতারণার মধ্য দিয়ে। একটি বালতিতে হাত ডুবিয়ে ফ্যানা উত্তোলনে ক্রিয়ারত চিত্রা ও অর্জুন। বিরাজমান ভাব আদি রসক্রিয়ায় রত চিত্রা ও অর্জুন। বালতিতে হাত ডুবিয়ে রতিক্রিয়ায় রত দৃশ্যটি একটি বিশেষ দৃশ্যকল্পের নির্মাণ হিসেবে প্রশংসার দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথ যৌবনের এই ব্যাপারটিকে ঘাসের শিশির বিন্দুর মতন দেখেছেন যা ক্ষণকাল পরে মিলিয়ে যায়। নির্দেশক শাহমান ফেনায় তৈরি বুদবুদের সাথে মন্তাজ করেছেন। অর্জুন যখন জলে মাথা ডুবিয়ে শুদ্ধ হতে চায় তখন ফেনায় মাথা ভর্তি কামনার বুদবুদ জেগে থাকে। মিলন, যৌনতা জীবনেরই ধর্ম, পরম সত্য। মিলনের পরম মুহূর্তটিও যে ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতির বাইরে না, যার সাথে জড়িত ক্ষমতা ও খ্যাতি সে বিষয়টি চলমান ইমেজে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চিত্রাঙ্গদা চরিত্রের দ্বৈত ভাবনার ইমেজটি প্রকাশের জন্য চিত্রাঙ্গদার পিঠে তার ভিতরকার সত্তার একটি মূর্তি ঝুলতে থাকে যা আসলে দর্শকের মনে তেমন কোনো অভিঘাত তৈরি করে না। বরং দর্শক এই থিয়েটার থেকে প্রত্যাশা করে, দেখতে চায় চিত্রাঙ্গদা বা নারীর এই দ্বৈত ভাবটির সাথে একজন অভিনেতা কিরূপে মোকাবেলা করে। সেই মোকাবেলার মধ্যদিয়ে একজন অভিনেতার পরিশোধন ঘটে, বিমোক্ষণ লাভ হয়।
এই প্রযোজনায় নারীর এই দ্বৈত রূপটি প্রকাশের জন্য এবং অর্জুনের ডায়ালেক্টিক্যাল রূপটি প্রকাশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাত্র পাত্রীর সংযোগ করেেছন নির্দেশক শাহমান। যা মূলত অভিনেতার পরিশোধন হবার পথটি রূদ্ধ করে তোলে। চিন্তা ও ইমেজ নির্মাণের প্রতি অধিক গুরুত্ব থিয়েটারের ক্রিয়াশীলতা রুদ্ধ করে, একই সাথে অভিনেতা শুধুমাত্র আর্টের এলিমেন্ট হিসেবে নির্দেশকের দ্বারা ট্রিটেড হবার সম্ভবনা থেকে যায়।
এক্ষেত্রে চলচ্চিত্র পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির কথাটি মনে পরে যায়- ‘কখনোই তোমার আইডিয়াকে দর্শকের কাছে উপস্থাপন করো না, এটা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক এবং ধন্যবাদের অযোগ্য। দর্শককে জীবন দেখাও, দর্শক সেখান থেকে মূলগত ভাব খুঁজে নেবে।’১৩ নাটকটি দেখতে দেখতে তারকোভস্কির এই অমূল্য বাণীটি বারবার মনে পড়ছিল। সমগ্র নাটক জুড়েই আইডিয়ার আধিক্য, যার কারণে চরিত্রগুলো হয়ে ওঠে না, পূর্ণতা পায় না। একটা সমগ্র রূপ পরিগ্রহ হবার পরিবর্তে দর্শক বিচ্ছন্ন দৃশ্যকল্প পরিদর্শন করে।
এই দৃশ্যেই চিত্রাঙ্গদা এবং অর্জুনের সাথে পপ ডান্স করতে করতে প্রবেশ করে একালের পপকালচারের আরেক চিত্রাঙ্গদা এবং আরেক অর্জুন। এই কনট্রাস্ট চরিত্রায়নে নারীর আত্মমুক্তির প্রশ্নটি যে একালে পাল্টে গেছে সেই আইডিয়াটি মূর্ত হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘চিত্রাঙ্গদা’য় প্রকৃতির নিগূঢ় স্থায়ী রসসঞ্চারি ভাব- ‘ফলসম্ভার’ অর্থাৎ নারীর ‘মা’ হয়ে উঠবার বা ‘সৃষ্টিকারী’ হয়ে উঠবার বা ‘ধরণী’ হয়ে উঠবার যে মহান ও চিরন্তন বাণীটিকে স্পষ্ট করেন, সেটিকে শাহমান এড়িয়ে গেছেন। তাহলে কি আমরা বুঝে নেব নারীর মা হয়ে উঠবার মধ্য দিয়ে নারীর আত্মমুক্তির সম্ভাবনাকে নাকচ করতে চেয়েছেন নির্দেশক শাহমান মৈশান? ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’য় চিত্রার শেষ সংলাপ- ‘আমি চিত্রা...।’ তখন দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- তুমি কোন চিত্রা? তুমি কি কেবলি নারী? তুমি কি কেবলি মানবী?
পক্ষান্তরে, রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’য় নারী মা হয়ে উঠবার মধ্য দিয়ে, নারীর স্রষ্টা হয়ে ওঠার মধ্যদিয়ে, মহাজাগতিক অংশ হয়ে ওঠার যে মহান বাণীটি আমাদের মর্মরিত করে সেই মহান বাণী অস্পষ্ট হয়ে যায় ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’য়।
প্রজ্ঞা নয় প্রাণ
ÔCritiquing is biting- কামড় দিলে রক্ত পড়ে’ এটি নাটকের এক প্রক্ষিপ্ত চরিত্র রনি দাস এর সংলাপ। জানি না রনি দাসের রক্ত ঝরবে কিনা কারণ এটিও একটি Critique. এই নাটকের সবচাইতে এবং আপাত অসংগতিপূর্ণ দৃশ্য, রনি দাসের বক্তৃতা পরিবেশনের দৃশ্য- যা প্রযোজনার ৪র্থ দৃশ্য। অভিনেতা রনি দাসই রনি দাসের চরিত্রে অভিনয় করে। অভিনয় শব্দটি বোল্ড করে বলছি কারণ এটি অভিনেতা রনি দাসের জীবন-আলেখ্য নয় মোটেই। রনি দসের পরিচয়ের ফাঁক গলে নির্দেশক শাহমান মৈশান নিজেই এখানে হাজির হন। কোট টাই পরিহিত জ্ঞানের ক্ষমতা-কাঠামোর উপরে দাঁড়ানো একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। যিনি নিজেই তার জ্ঞানক্ষমতা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। এটি একটি প্রক্ষেপণ। প্রক্ষেপণ বলছি এই কারণে যে, দৃশ্যখানা জোর করে চাপিয়ে দেয়া মনে হয়। নিশ্চিতভাবে নির্দেশক পরিকল্পিত চিন্তায় দৃশ্যখানা যুক্ত করেছেন। কিন্তু এই দৃশ্যটি কী অভিঘাত তৈরি করে বা কী তাৎপর্য বহন করে, সেটিই দেখবার বিষয়।
‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’, ও ‘ডাকঘর’-এর সাথে এই দৃশ্যের কোনো সম্পর্ক প্রাথমিকভাবে পাওয়া যায় না। হঠাৎ রনি দাস চরিত্রটি প্রবেশ করে সমস্ত আবহ ভেঙে দিয়ে কিছু সময় দর্শককে মাতিয়ে রাখে মাত্র। এটিকে ব্রেখটের এ্যালিয়েনেশন ভাবলে ভুল হবে। বরং একদিক থেকে বলা যায় নির্দেশক দর্শকের প্রতি যে আস্থাহীনতায় ভোগেন সেটির নিদর্শন। নির্দেশক এই দৃশ্যটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিতে চান প্রযোজনাটি তিনি কোনো কোনো তত্ত্ব-তথ্যের উপর ভর করে নির্মাণ করেছেন। এই তত্ত্ব-তথ্যের কপচানি এবং তা আবার খারিজ করবার যে কৌশল সেটি দর্শকের প্রতি আস্থাহীনতার চাতুর্যপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। ‘টেক্সট ও পারফরমেন্সের মধ্যে যে একটি গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছেন এবং পারফমেন্সের উৎপত্তি হয় স্পেস থেকে’- সেটি রনি দাসকে দিয়ে বলিয়ে নেবার কোনো মানে তৈরি করে কি? সেটি দর্শকের প্রযোজনা দেখেই যা বুঝবার বুঝে নেবার কথা।
তবে শেষমেশ সমস্ত মেথডকে ব্যঙ্গ করে জ্ঞানতত্ত্ব আওড়াতে আওড়াতে তার মৃত্যু হয় এবং তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়- who are you? Who am I? I am nothing- nothing is more real than nothing. ‘Nothingness’-এর ভাবনাটি কেবল প্রযোজনাটির সাথে সঙ্গতি তৈরি করে। একেই আধ্যত্মিক গুরু ওজোনিশী ওশো বলেছেন- মানবের পরম লাভের সর্বোচ্চ স্তর। গৌতম বুদ্ধ একে বলেছেন ‘নির্বাণ’। শেষ অবধি রনি দাসের মৃত্যুই কেবল আমাদের চিন্তার তরিকা যোগায়। জ্ঞানের চেয়ে প্রাণের স্বধর্মকেই মূর্ত করে তোলে। তবে এই দৃশ্য প্রসঙ্গে নির্দেশক শাহমান মৈশান প্রযোজনার ব্রশিওরে লিখেছেন, ‘[এই প্রযোজনায়] মনোলগরূপে একটি মধ্যবর্তী দৃশ্য পরিকল্পিত হয়েছে। পারফরমেন্সের অরৈখিক ও ভগ্নাংশমূলক গঠনের দৃষ্টান্ত হিসেবে একে বিবেচনা করা যেতে পারে। দৃশ্যটি সৃজন, বিনির্মাণ ও শিল্পের স্বত্বাধিকার প্রসঙ্গ নিয়ে দর্শকের উদ্দেশে অভিনেতার এই মনোলগ একই সাথে পারফরমেন্সের কাহিনীমূলক চরিত্রগুলোর আবেগিক উপস্থাপনাকেও চ্যালেঞ্জ করে, পাশাপাশি, চরিত্র নির্মাণ ও এমনকি নাটকীয়তার ধারণাকেও সমস্যাগ্রস্ত করে।’ ১৪
‘ডাকঘর’: মৃত্যু ও মুক্তি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে দেখা যায় অমল নামের একটি সাত-আট বছরের ছেলের ক্ষয়, অবসন্নতা ও ‘মৃত্যু’র ঘটনা নিয়ে এই নাটক। যার মনটা দূরে কোথাও দূরে-দূরে ভেসে বেড়ায়। আর রোগাক্রান্ত শরীরটা জানালার গরাদে আটকা পড়ে থাকে। আর অমলের মুক্তির কথাটি ধরা দেয় রূপক হয়ে। রাজার ডাকঘর আর ডাকহরকরা এবং তার বয়ে নিয়ে আসা চিঠি সবই মুক্তির মেটাফর হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ প্রযোজনায় ৬ষ্ঠ দৃশ্যে ‘ডাকঘর’র সাথে গেরিলাযুদ্ধ চালায় নাট্যকার ও নির্দেশক শাহমান মৈশান। এখানে অমলকে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্পেসে ফেলেননি শাহমান, ইনফিনিট স্পেসে কালাতিক্রান্ত অমল। অমল যে প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে অন্তরের বাহিরের দাসত্বের রজ্জু অতিক্রান্ত হয়, সেই প্রক্রিয়ার নানা রঙের চিত্র এঁকেছেন নির্দেশক। একটি অনির্দিষ্ট স্পেসে একটি দোলনায় শুয়ে থাকে অসুস্থ অমল। এই দোলনা শিশুর ভিতরকার রূপক হিসেবে দেখা যায়, পক্ষান্তরে রাষ্ট্রসমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-ক্ষমতা সকলি যে তাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে অসুস্থ করে রেখেছে তার রূপক হিসেবে তার সমস্ত দেহ ঢাকা থাকে নানা স্তরের পোশাকে। সামাজিক নিয়ম-কানুনে, শাসন-ত্রাসনে বেড়ে ওঠা আমাদের সকলের প্রতীকী রূপ এই অমল। এই অমল যখন তার পোশাকি আচ্ছাদন একে একে খুলে ফেলে মনে হয় সমস্ত সামাজিক আচ্ছাদন খোলে। সে খুঁজে পায় প্রকৃত অমলকে। তার আপন সত্ত্বাকে- যে অমলের মন চায় ঘুড়ি উড়াতে, উড়ে বেড়াতে।
মঞ্চে অমল যখন দোলনায় দুলতে থাকে তখন একালের বাচ্চাদের মেটাফর হয়ে অনেকগুলো বাচ্চা প্রবেশ করে আধুনিক খেলনা অস্ত্র নিয়ে। তারা অমলকে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলবার আহ্বান করে কিন্তু অমলের মন সে খেলায় বসে না। অমলের মন দূর পাহাড়ে যেতে চায়, ঝর্ণার প্রস্রবণ দেখতে চায়। কিন্তু অবশেষে অমল দোলনায় বসে চিরতরে চোখ বন্ধ করে। সামাজিক নিয়ম কানুনের মৃত্যু হয়। আর তখনি অমলের আরেক চোখ খুলে যায়, অমলের ইচ্ছা পূরণ হয়।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, মৃত্যুই কি কেবল মাত্র মুক্তি? প্রকৃতি-চিত্রাঙ্গদা জীবতকালেই সেই মুক্তির দেখা পায় কিন্তু অমলের বেলায় দেখা যায় তার উল্টো। এখানেই প্রযোজনাটির আধ্যাত্মিক ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। পঞ্চভূতে তৈরি দেহ ত্যাগ করে অমল জীবাত্মা থেকে পরম আত্মায় রূপান্তর লাভ করে। জীবিত দশায় অমলের যে দেহ রোগ-শোক, জরা-ব্যধিতে ক্লিষ্ট সেই দেহ থেকে আত্মা পরমাত্মায় রূপান্তরিত হয়। আত্মা ব্রহ্মাণ্ডের সমগ্রের অংশ হয়ে ওঠে। জীবন-মৃত্যুর এই পরম সত্য আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে জীবন আনন্দময় হয়ে ওঠে। সময়-মৃত্যু অতিক্রান্ত এক অমলকে দেখতে পাই এই প্রযোজনায়। মৃত্যু সম্পর্কে বোঝবার জন্য ঋষি-দার্শনিক ওশোর দোহাই দেওয়া যেতে পারে। ওশো বলেন, ‘সময়ই মন। সময়ই মরণ। সময়ের বাইরে চলে যাওয়া মানে মনের বাইরে চলে যাওয়া এবং মরণকে অতিক্রম করা। মৃত্যুই শেষ কথা নয়, বরং এটা হলো নতুন এক জীবনের আরম্ভ। [...] এই জীবনে চরম অভিজ্ঞতা হলো মৃত্যু এবং এই অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে অন্য এক অভিজ্ঞতারি আরম্ভ হয়। মৃত্যু হলো দুই জীবনের মধ্যবর্তী দুয়ার। একটি হলো ফেলে আসা জীবন, অন্যটি হলো সামনে আসছে যে জীবন। এ এক মহাপরিভ্রমণ।’১৫
অমলের মতো সকলেই যদি জগতের সমগ্রের অংশ অনুভব করে তবেই কেবল জগত আনন্দময় হয়ে ওঠে।
অমল যখন দোলনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, তখন তার কাছে সমস্ত জগৎ উন্মুক্ত হয়ে যায়। মুক্তির রূপক একটি ঘুড়ি নিয়ে উড়ে বেড়ায় অমল আর সাইক্লোরামা নীল আকাশ হয়ে খুলে যাবার মধ্যদিয়ে সমগ্র জগৎ উন্মোচনের ভাবটি স্পর্শ করে মিলনায়তন জুড়ে থাকা দর্শককে।
প্রযোজনাটির তৎপরতার তাৎপর্য
দেশজ নাট্যকলার নামে এবং রবীন্দ্রচর্চার নামে বাঙালি মধ্যবিত্ত শিল্পীগোষ্ঠী যে লোগোসেন্ট্রিকতা, যে হেজিমনি, যে চক্রব্যুহ রচনা করেছেন, সেই চক্রব্যুহকে ভেঙে দিয়েছেন একালের নির্দেশক ও নাট্যকার শাহমান মৈশান। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বাঙালি মধ্যবিত্তের যে ধারণা, যে মৌলবাদিতা, যে রক্ষণশীলতা, এর বিরুদ্ধে এই প্রযোজনাটি একটি এনকাউন্টারমূলক প্রযোজনা। নির্দেশক রবীন্দ্রনাথের তিনটি নাটক অবলম্বন করে বিনির্মাণ করেছেন ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’। শাহমান মধ্যবিত্ত বাবুদের মতোন রবীন্দ্রনাথের প্রতি একতেদা প্রকাশ করেননি বরং এনকাউন্ট করেছেন। যেহেতু এই প্রযোজনাটিকে আমি অবিনির্মাণ বা বিনির্মাণ বলছি, কেন বলছি সেটি দেরিদার বিনির্মাণ সম্পর্কে নিম্নোক্ত কোটেশনটি স্পষ্ট করে-
‘অবিনির্মাণ টেকসই বস্তুর তাপ্পি খোলে, জ্ঞানের আপাত দৃষ্টিতে সুপ্রতিষ্ঠিত ভূমিতে অন্তহীন কম্প লাগায়, কিন্তু কর্মক্ষেত্র বজায় রাখে’।১৬
সবশেষে আমার বক্তব্য এই যে, ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ প্রযোজনাটি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মৌলবাদীদের তাপ্পি খুলে দিয়েছে এবং জ্ঞানের আপাত ভূমিতে এটি একটি ভূমিকম্প। একই সাথে কর্মক্ষেত্র বজায় রেখে এটি তৎপর। তৎপরতার কথা বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশে থিয়েটার চর্চার যে আঙ্গিকগুলো গড়ে উঠেছে, সেই আঙ্গিকজনিত ক্লিশে আধিপত্যকে এই প্রযোজনাটি প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং নতুন আঙ্গিকের স্ব-রূপ সন্ধানে প্রযোজনাটি ক্রিয়াশীল ও তৎপর হয়ে ওঠে। থিয়েটার আর্টকে কিভাবে সীমারেখার বাইরে অসীম রেখায় ভাবা যায় তার মুখ উন্মোচন করে এই প্রযোজনাটি। একই সাথে জাতীয়তাবাদী আর্টের বৈকল্যকে ধিক্কার জানায়। সে কারণেই হয়তো প্রযোজনাটির উপস্থাপন রীতি হাইব্রিড।
এই প্রযোজনা দেশীয় নাট্য আঙ্গিকের অনুকরণ নয়। সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এই আর্ট আমাদের এক অসম্ভব অসীম কল্পনার ক্ষেত্র উন্মোচন করে দেয়, যে কল্পনা দেশ-কালে সীমায়িত নয়।
অভিনেতা-দর্শক-আলো-সঙ্গীতের মিথস্ক্রিয়ায়, প্রযোজনাটি নিত্যকার জীবন ভুলে অনিত্যের পানে উড়াল দেয়। শাহমান মৈশানের ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ প্রযোজনাটি দেখে আমার উপলব্ধি পল ভালেরির একটি কবিতার পঙতি উচ্চারণের মধ্যদিয়ে শেষ করছি-
‘ততক্ষণ তৃষ্ণাস্ফীত আমি,
না যোগায় সত্তা যতক্ষণ।’১৭
দোহাই:
জ্যাক দেরিদা, বিনির্মাণবাদকে হ্যাঁ বলুন- সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। জ্যাক দেরিদা পাঠ ও বিবেচনা, পৃষ্ঠা-৩৩ , (সম্পাদনা) পারভেজ হোসেন ও ফয়েজ আলম। ২. ORIGINS: Saussure, Bakhtin,Kristeva . POSTMORDEN CONCLUSIONS INTERTEXTUALITY– Graham Allen Page 35-46, 199-208. ৩. THE TEXT UNBOUND : Barthes , INTERTEXTUALITY – Graham Allen page– 92. ৪. Rupkatha Journal on Interdisciplinary Studies in Humanities (ISSN 0975-2935), Vol 2, No 4, 2010. ৫. Special Issue on Rabindranath Tagore,edited by Amrit Sen, URL of the Issue: http://rupkatha.com/v2n. ৫. কালচার ও সংস্কৃতি, বাংলা শব্দতত্ত্ব- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলিকাতা পৃষ্ঠা- ২০৭। ৬.৭.৮.৯.১০. সুফি সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশতী, অখণ্ড কোরানদর্শন, রচনাসমগ্র-১, সঙ্কলন ও সম্পাদনা- আবদেল মাননান। ১১. মাণ্ডুক্যেপনিষদ্ , উপনিষদ্, (অনুবাদ) হরিকৃষ্ণদাস গোয়েন্দকা পৃষ্ঠা- ২৪০। ১২. সোলায়মান নবির কালাম।। জবুর, লালনভাষা অনুসন্ধান ১ : আবদেল মাননান , পৃষ্ঠা-২৭। ১৩. Andrei Tarkovsky Quotes, https://www.goodreads.com. ১৪. শাহমান মৈশান, ‘প্রকৃতি চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা’ শীর্ষক লেখা (প্রযোজনার ব্রুশিওরে মুদ্রিত)। ১৫. Osho Quotes on Death . www.osho.com-on-death-quotes. ১৬. অবিনির্মাণ, অনুবাদ: গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, জ্যাক দেরিদা পাঠ ও বিবেচনা, (সম্পাদনা) পারভেজ হোসেন ও ফয়েজ আলম, পৃ.১৪। ১৭. পল ভালেরি, অনুবাদ: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, উদ্ধৃত হয়েছে অমল বন্দ্যোপাধ্যায়, “জ্যাক দেরিদা বা দর্শনের আত্মহত্যা”, জ্যাক দেরিদা পাঠ ও বিবেচনা, (সম্পাদনা) পারভেজ হোসেন ও ফয়েজ আলম, পৃ. ৯৮। ১৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্রাঙ্গদা ডাকঘর চণ্ডালিকা (নাট্যত্রয়)
শান্তনু হালদার: নাট্য ও চলচ্চিত্র নির্মাতা