Full premium theme for CMS
নাট্যগ্রন্থ সমালোচনা- ‘থিয়েটার পত্রিকার চল্লিশ বছর’
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের মত আমাদের এই অভাজন ঢাকাতেও শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ছোট সাময়িকী বা যা জনপ্রিয় প্রকরণে ‘লিটল ম্যাগ’ হিসেবে বেশি পরিচিত, তার প্রকাশনার একটা পুরনো ঐতিহ্য আছে। এমন সব ছোট কাগজের একটা স্বীকৃত বৈশিষ্ট্য হল, এগুলির জন্মকথা এবং প্রাথমিক বিকাশ ও প্রসারের মধ্যে একটা প্রায় বুনো উত্তেজনা থাকে, কখনও কখনও আত্মরতিরও চর্চা থাকে, কিন্তু সাধারণত এসব কাগজের ললাট লিখনে দীর্ঘায়ুর কোনো চিহ্ন থাকে না।
হয়ত বেশ কয়েকটা সংখ্যা নিয়মিত বিরতিতে বেরোল, দু’একটা সংখ্যায় প্রকাশিত বেশ নাড়া দেয়া কোনো রচনা নিয়ে চায়ের টেবিলে তুমুল আলোচনা চলল, কপাল খুললে অথবা পরিচিত কোনো শুভানুধ্যায়ীর প্রার্থিত আনুকূল্যে দু’চারবার ভালো অঙ্কের টাকার বিজ্ঞাপনও ছাপা হল, প্রথিতযশা ক’জন লেখক সাগ্রহে অথবা কৃপাপরবশ হয়ে তাঁদের রচনা পত্রস্থ করতে দিলেন, তবুও চোদ্দ আনার বেশি লিটল ম্যাগ কালপরিক্রমায় সোচ্চারে তাদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে গেছে, এমন দৃষ্টান্ত নিতান্তই বিরল। কিন্তু আমাদের দৃষ্টির সমুখেই, হয়ত-বা মনোযোগের কিঞ্চিৎ অগোচরে আমাদেরই প্রিয় একটি নাট্য ত্রৈমাসিক, যেটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে আবশ্যিকভাবেই লিটল ম্যাগের অন্তর্ভুক্ত, রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ পত্রিকা বিগত ২০১২ শেষাশেষি তার প্রকাশনার চল্লিশ বছর পার করেছে এবং ইহাই সত্য যে, এই ২০১৬ সালেও সেটির ‘স্বাস্থ্যোজ্জ্বল’ অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা পুরোপুরিই ওয়াকিবহাল।
‘থিয়েটার’পত্রিকার সঙ্গে আমার মতো যাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে, তারা এক একটা সংখ্যা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখেছি। নিজের লেখা ছাড়া অন্য কারো লেখার বিষয় পছন্দ হলে সেটা পড়ি। তারপর আর একটা সংখ্যার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। বিরতিটা দীর্ঘ হলে সম্পাদক রামেন্দু মজুমদার মহোদয়কে হয়ত ফোন করে জিজ্ঞেস করি, ‘কী হল? ‘থিয়েটার’বেরোবে কবে?’ সম্ভাব্য উত্তর আমাদের সবার জানা। এরকম একটা ঘরোয়া ও আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবার ফলে আমাদের ঘরের বা পাড়ার ছেলের বড় হয়ে ওঠার মত একটা আটপৌরে অভিজ্ঞতা তৈরি হয়, মনের মধ্যে বাড়তি কোনো উৎসুক্য সৃষ্টি করে না। ছেলেটা যে বড় হয়ে উঠল উচ্চতায়, ওজনে এবং স্কুলের পরীক্ষায় খুব প্রশংসনীয় ফলাফল করল, সেসব সংবাদ নিত্যনৈমিত্তিক আমাদের কানে পৌঁছাচ্ছে বলে, আমরা আর আলাদা করে খেয়াল করি না। অথচ এই পাড়ারই আমাদের সমবয়সী আর একজন, যিনি প্রবাসী, চার-পাঁচ বছর পর পর দেশে আসেন, তিনি কিন্তু ঠিকই খেয়াল করেন, ‘আরে গতবার যেমনটি দেখে গেছি, সে তুলনায় তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছো... কি বলছো, তুমি এখন ক্লাস টেনে, ফার্স্ট বয়, দারুণ তো’।
‘থিয়েটার’ পত্রিকার চল্লিশ বছরে পদার্পণ এবং তার এই অতিক্রমণকে আমাদের কাছে এ ধরনের একটি অবাক করার মতো বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন কলকাতার নাট্যগবেষক প্রভাতকুমার দাস। কলকাতার এই নাট্যবন্ধু যেন একটা বড় মাপের প্রদর্শনী উদ্বোধন করলেন। রামেন্দু মজুমদার, আমাদের রামেন্দুদা, তাঁর সঙ্গে শিল্পকলার নাটকের অনুষ্ঠানে দেখা হয়, আই-টি-আই বাংলাদেশের সভায় দেখা হয়, মিছিলে হাঁটি একসঙ্গে, মানববন্ধনে পাশে দাঁড়াই, কেউ কেউ তার সঙ্গে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণও করেছেন। অনেক কাজের কাজী, ব্যক্তিগত সম্পর্কে এবং সামষ্টিক যূথবদ্ধতায়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, নাট্য উৎসব ইত্যাদি সবকিছুর পরও সেই ১৯৭২ সাল থেকে আমাদের চেনা, অষ্টপ্রহর মনের সঙ্গে লেপ্টে থাকা রামেন্দু মজুমদার যে নিরবচ্ছিন্নভাবে চার দশক সময় পেরিয়ে ‘থিয়েটার’ নামীয় একটা বিশেষায়িত পত্রিকা সম্পাদনা করে চলেছেন নিরলস একাগ্রতায়, এমন একটা সত্য প্রভাতকুমার দাস আমাদের সামনে একটা গবেষণা গ্রন্থের অবয়বে হাজির না করলে আমরা হয়ত নড়েচড়ে বসতাম না। মঞ্চে নাটক দেখার অতিরিক্ত যারা এ বিষয়ে লেখাপড়ায়ও কিছুটা আগ্রহী, বিশেষভাবে বাংলা ভাষায় রচিত বই-পত্রের কথা বলছি, তাদের কাছে প্রভাতকুমার দাস একটা সুপরিচিত নাম। নাট্যবিষয়ে গবেষণাধর্মী কাজকর্মের জন্য তার সুনাম আছে। যারা একটু বাড়তি খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন যে, তিনি বাংলাদেশের নাটক বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী। যাক, সেই তিনিই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, আমাদের ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘থিয়েটার’চল্লিশ পেরিয়েছে।
বাংলাদেশের নাট্য অঙ্গনে এখনও সক্রিয় আছেন এমন অনেকেই ‘থিয়েটার’পত্রিকার এই বেড়ে ওঠার সাক্ষী। যারা এই পত্রিকার অথবা সম্পাদক রামেন্দু মজুমদারের অপেক্ষাকৃত আপনজন, তারা হয়ত স্মৃতিতে আনার চেষ্টা করবেন, আচ্ছা প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদটা কেমন যেনো ছিল? স্মৃতিতে তো ধুলো পড়ার কথাই। একবার শুধু উসকে দেবার চেষ্টা করা যাক প্রভাতকুমার দাসের কাজের সহায়তায়। জানা যাচ্ছে, ‘থিয়েটার’পত্রিকার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছিল ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে।
সাথে সাথেই একটা ভাবনা এসে চোখ ডাগর করে দেয়। যুদ্ধজয়ের হিসেবে বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সত্তার আবির্ভাব তখনও এক বছর পেরোয়নি। মনে পড়ে যাবে, দেশ স্বাধীন হলেও দুঃসহ অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক চিত্রনাট্যের মধ্য দিয়ে আমাদের তখনকার জীবনযাপন। জীবনের অনিবার্য চাহিদাগুলো মেটানোর নানা শ্রমশীলতায় আমরা যখন ব্যস্ত, তার মধ্যেই রামেন্দু মজুমদার একটা পত্রিকা বের করলেন, তা-ও যার এলাকা খুবই সুনির্দিষ্ট- মঞ্চনাটক। স্বাধীনতার মধ্যে যে প্রাপ্তি আছে, মুক্তির কী ধরনের অনাবিল স্বাদ আছে, সেটা পরিমাণ করে নেয়া যায় এই পত্রিকার আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। ‘থিয়েটার’-এর প্রথম সংখ্যাই বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হল। সাধারণত এরকমটি ঘটে না। পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল মুনীর চৌধুরী স্মারক সংখ্যা হিসেবে। ওয়াকিবহাল পাঠকের কাছে এখন বিষয়টি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুনীর চৌধুরী বিভাগ-উত্তর বঙ্গদেশের পূর্ব অংশের প্রধান উল্লেখযোগ্য নাট্যকার। তাছাড়া তিনি নাট্যরচনা ও সমালোচনা এবং অনুবাদের মাধ্যমে এপার বাংলার নাট্যচর্চায় আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনিই আমাদের অগ্রপথিক। নাটকের ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরীর অবদান শুধু অনস্বীকার্য নয়, তিনি পূর্ববঙ্গে সাংস্কৃতিক সুরুচি নির্মাণের পথিকৃৎ। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতাবাদী সরকারও অবহিত ছিল যে, পাকিস্তানের পূর্ব অংশে যে প্রগতিপন্থী ও উদারপন্থী রাষ্ট্র এবং সমাজচেতনা ক্রমেই সম্প্রসারিত হয়ে উঠছিল, তিনি ছিলেন সেই আন্দোলনের সাংস্কৃতিক অভিভাবক ও সংগঠকদের অন্যতম। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবার ঠিক দু’দিন আগে তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নাট্য পত্রিকার প্রথম সংখ্যা যে তাঁকে নিয়েই গ্রন্থিত হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এভাবে প্রথম প্রকাশের দিন থেকেই ‘থিয়েটার’পত্রিকা এদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এই তথ্য ও সত্যটাকে অনুধাবন করতে হবে। আজকের দিনে যারা মুনীর চৌধুরী বিষয়ে গবেষণা করতে চান, তাদের জন্য এই প্রথম সংখ্যা খুবই মূল্যবান এক ভা-ার।
সূচিপত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ‘থিয়েটার’নাট্যগোষ্ঠী সম্পর্কে প্রাথমিক পরিচিতি দিয়ে আরম্ভ। তারপর রয়েছে রামেন্দু মুজমদারের নাতিদীর্ঘ সম্পাদকীয়। তার একটি অংশে সম্পাদক জানাচ্ছেন, ‘অদ্যাবধি আমাদের সাহিত্যে মুনীর চৌধুরী সর্বাপেক্ষা প্রতিভাবান নাট্যকার। সঙ্গত কারণেই ‘থিয়েটার’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা মুনীর চৌধুরী স্মারক সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হলো। তা ছাড়া এ পত্রিকার উদ্যোক্তাদের এটি একটি নৈতিক দায়িত্বও। কারণ তাদের অভিনয় জীবনের প্রায় সবটা শিক্ষাই মুনীর চৌধুরীর।’ উদ্ধৃতির শেষ বাক্যটি বিশেষভাবে আমাদের মনোযোগ দাবি করে।
এই সংখ্যায় পত্রস্থ হয়েছে মুনীর চৌধুরী অনূদিত শেক্সপীয়রের নাটক ‘ওথেলো’। মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে যারা লিখেছেন, তাদের মধ্যে আছেন কবীর চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত, লায়লা সামাদ, হায়াৎ সাইফ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, রফিকুল ইসলাম, জিয়া হায়দার, আনিসুজ্জামান, রশীদ হায়দার, রাজিউল হাসান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, রামেন্দু মজুমদার এবং শামসুর রাহমান। যেকোনো সাম্প্রতিককালের পাঠক এই সংখ্যার বিভিন্ন রচনা পাঠ করলে মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা পাবেন। সবশেষে সংযোজিত হয়েছে মুনীর চৌধুরীর জীবনের ঘটনাপঞ্জি। প্রভাতকুমার দাসের বই থেকেই জানতে পারি, প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন নিতুন কুণ্ড এবং প্রচ্ছদ লিপি এঁকেছিলেন গোলাম সারওয়ার। সচেতন পাঠক অনুভব করবেন যে, এই সংখ্যার লেখকদের সিংহভাগ ও প্রচ্ছদ অঙ্কনের যৌথ দায়িত্ব পালন করেছিলেন যে দু’জন খ্যাতিমান শিল্পী, আজ তাঁদের কেউ বেঁচে নেই, কিন্তু‘থিয়েটার’ পত্রিকা বেঁচে আছে তাঁদের এবং অন্য আরো অনেককে স্মরণ করে। আর একটা বিষয় নিশ্চয়ই আনন্দদায়ক, মোট ১৮৭ পৃষ্ঠার এই সংখ্যার দাম ছিল মাত্র দু’টাকা। চল্লিশ বছরের ইতিহাস ধরে রাখা এই বইটি থেকে আরও মজার বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যাবে। বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপন ছিল এই সংখ্যায়, তার মধ্যে সাতটি বিজ্ঞাপন ছিল চলচ্চিত্রের, দু’টি করে বিজ্ঞাপন ছিল বিমান সংস্থা, বিজ্ঞাপনী সংস্থা এবং লিটল ম্যাগের; প্রকাশক, বিস্কুট, অষুধ কোম্পানি ও ব্যাংকের একটি করে; এক পাতা বিজ্ঞাপন ছিল ‘থিয়েটার’ নাট্যগোষ্ঠীর। অনিসন্ধিৎসু পাঠক বুঝে নিতে পারবেন যে, লিটল ম্যাগের বিজ্ঞাপন ছিল সৌজন্যমূলক।
প্রতিনিধিত্বমূলক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রথম সংখ্যাটি এমন ব্যাপক পরিসরে আলোচনা করলাম ইচ্ছাকৃতভাবেই। এ থেকে অন্যান্য সংখ্যা সম্পর্কে একটা আন্দাজ করা যাবে। পাঠক, প্রভাতকুমার দাসের বইটা দেখে নিন। বোঝাতে চাইছি, লিটল ম্যাগের মতো প্রকাশনাকে সাধারণত আড় চোখে দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু একজন গবেষক যখন তথ্যের সমাহার ও বিশ্লেষণ করেন, তখন বোঝা যায়, ‘থিয়েটার’-এর মতো পত্রিকার যেমন একটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা আছে, তেমনি তার মধ্যেও সমাজ ইতিহাসের খুঁটিনাটি আবিষ্কার করা যায়, তা দেখিয়ে দেন শ্রমশীল পাঠক ও গবেষক। প্রভাতকুমার দাস তার সনিষ্ঠ অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের চেনা সত্যটাকে আরো প্রখর করে হাজির করেছেন। এখানেই এই গ্রন্থ এবং এ ধরনের কাজের বিশিষ্টতা।
সাধারণভাবে যদিও এ ধরনের নির্জলা তথ্য-ভারাক্রান্ত গ্রন্থ সাধারণ মানুষের জন্য তেমন সুখপাঠ্য নয়, কিন্তু যারা কোনো একটি বিষয়ে অণ্বেষায় নিবেদিত, তারা এমন গ্রন্থকেই সম্পদের খনি হিসেবে বিবেচনা করবেন। প্রভাতকুমার দাসের ভূমিকাংশ থেকে জানা যায়, তিনি প্রাথমিকভাবে ‘থিয়েটার’ পত্রিকার বিশ বছরকে ভিত্তি ধরে একটা গবেষণালব্ধ তথ্যভা-ার তৈরি করবেন বলে ভেবেছিলেন, কিন্তু বিবিধ কারণে তিনি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারেননি। এই না-পারার সুবাদে আমরা চল্লিশ বছরের একটা সুবিস্তৃত তথ্য-তালাশ পেয়ে যাই। ‘থিয়েটার’-এর এই চার দশকের পথ পরিক্রমার নানা দালিলিক খুঁটিনাটি আমাদের সামনে হাজির করার জন্য লেখক ‘আত্মপক্ষ’ শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ সবিনয় ভূমিকা রচনার পর একটা ৪২ পৃষ্ঠাব্যাপী পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন পেশ করেছেন। তার মধ্যে দিয়ে শুধু এই পত্রিকার বেড়ে ওঠার ঘটনাক্রমই বোঝা যায় না, নানা মন্তব্যের মাধ্যমে গ্রন্থকার প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চার একটা আবেগ-নিরপেক্ষ চিত্রও রচনা করেছেন। তিনি প্রচুর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন প্রধানত সম্পাদকের কথা থেকে, কিন্তু সেসব কথা পরিবেশনার মধ্যে একটা স্বেচ্ছাসংগঠিত পরিকল্পনা আছে। এই দীর্ঘ প্রতিবেদন পড়তে গিয়ে আমরা বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের বিবর্তনের একটা ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হই।
প্রভাতকুমার দাস প্রথমেই চল্লিশ বছরে ‘থিয়েটার’ পত্রিকার একটা সুবিন্যস্ত সংখ্যানুক্রমিক বিবরণ ও সূচি যুক্ত করেছেন। বিন্যাসটা এরকম: বর্ষ-সংখ্যা-প্রকাশকাল-বিশেষ সংখ্যা-প্রচ্ছদ-দাম-পৃষ্ঠাসংখ্যা। এ থেকে একটা সামগ্রিক চিত্র এঁকে নেয়া সম্ভবপর। সবচেয়ে তথ্যনিষ্ঠ অংশটি হল বিভিন্ন সংখ্যার সুনির্দিষ্ট সংখ্যানুক্রমিক সূচি। সেটাকে তিনি সাজিয়েছেন যথারীতি পৃষ্ঠাসংখ্যা অনুসরণে। কিন্তু পাঠকদের সহায়তায় তিনি যে শ্রমশীল নির্দেশনা দিয়েছেন, তা থেকে ‘থিয়েটার’ পত্রিকায় কী কী ধরনের বিষয় ছাপা হত তার একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। বিষয়সূচি বিশ্লেষণ করে তিনি যেভাবে ভাগ করেছেন, তা এরকম: নিবন্ধ, পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, অনূদিত নাটক, জীবনপঞ্জিকা, নাট্য পর্যালোচনা, অনূদিত নিবন্ধ, নাট্য সমালোচনা, সাক্ষাৎকার, স্মরণ, মন্তব্য প্রতিবেদন, নাট্যরূপ, আলোচনা, পথনাটক, পুনর্মুুদ্রণ, ভাষণ, গ্রন্থ সমালোচনা, নাট্য ভ্রমণ, কবিতা এবং সম্পাদকীয়।
তার এই বিভক্তির বিচার আমাকে বিস্মিত করেছে। ‘থিয়েটার’-এর নিয়মিত ও বিশ্বস্ত পাঠক হিসেবে আমি পর্যবেক্ষণ এবং মন্তব্য অথবা নাট্য সমালোচনা এবং গ্রন্থ সমালোচনার মধ্যে পৃথকার্থ অনুসন্ধানে বিশেষভাবে ব্রতী হয়েছি বলে মনে পড়ে না। এরপর প্রভাতকুমার দাস আবার আলাদাভাবে যুক্ত করেছেন বর্ণনাক্রমিক লেখক ও রচনাসূচি। যেখান থেকে আমরা বিশেষভাবে অবহিত হই বিভিন্ন জেলায় গ্রুপ থিয়েটার সংগঠন ও নাট্যোৎসব আয়োজন সম্পর্কে। তারপর সংযোজন করেছেন সংখ্যানুক্রমিক সম্পাদকের নিবেদন। এই অংশটাই একটা আলাদা পুস্তিকা হতে পারত, তা থেকেই বাংলাদেশের নাট্যচর্চার লৈখিক ও ব্যবহারিক একটা ঐতিহাসিক বিবরণী পাওয়া যায়। একটি সম্পাদকীয়তে রামেন্দু মজুমদার বাজারের ফর্দের মতো করে কাগজের দাম, ছাপা খরচ, বাঁধাই, প্রুফ দেখা, যাতায়াত, বন্টক, পিয়ন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ জানিয়ে দিয়েছেন। পরিশিষ্ট অংশে আছে: পত্রিকার সাংগঠনিক বিবরণ, সংখ্যানুক্রমিক বিজ্ঞাপনদাতাদের তালিকা এবং সংখ্যানুক্রমিক চিত্রসূচি।
প্রভাতকুমার দাস, আপনার কাছে পেন্নাম হই। যে শ্রমসাধ্য কাজটা আমরা ঢাকায় কেউ করলাম না, আপনি কলকাতায় বসে তা সাধন করে আমাদের যুগপৎ কৃতজ্ঞ ও লজ্জিত করলেন।
বইটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বোধ করি, রামেন্দু মজুমদার মুদ্রণের কাজ কিছুটা হলেও তত্ত্বাবধান করেছেন। তিনি বা প্রকাশক কেনো যে নির্বাচিত কিছু সংখ্যার প্রচ্ছদের ছবি মুদ্রণ করলেন, তা বোধগম্য নয়।
থিয়েটার পত্রিকার চল্লিশ বছর
লেখক: প্রভাতকুমার দাস।
প্রকাশক : সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
প্রচ্ছদ: প্রদীপ চক্রবর্তী।
প্রকাশকাল: ২০১২। পৃষ্ঠা: ২৭২। মূল্য: ৪০০ টাকা।
শফি আহমেদ: নাট্য সমালোচক। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক