Full premium theme for CMS
‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’: স্মৃতিবিধুরতার শিল্পরূপ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
কয়েক-সুতো অগ্রজ নাট্যবন্ধু মোহাম্মদ বারী’র সুযোগ হয়েছিল গ্রিস পরিভ্রমণ করার। তা-ও অনেক বছর আগের কথা। গ্রিসে সে অনেক কিছু দেখেছে। বর্ণনা শুনছিলাম ডেলফির সেই এ্যাপোলোর মন্দিরের, পুরাণে আছে, সেখান থেকে ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারিত হতো। সে দেখেছে সেই ‘তেমাথা’, যেখানে ইডিপাস নিজ হাতে হত্যা করেছিল পিতা লেয়াসকে। সক্রেটিসকে বিশেষভাবে আপন করে নিয়েছিলাম ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’ নাটক করার সুবাদে। শুনলাম সক্রেটিস যেখানে তাঁর শিষ্যদের নিয়ে আড্ডা দিতেন, সেই জায়গাটিও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল নাট্যবন্ধুর। এমন অনেক কিছু নিয়ে কথা চলছিল তার সাথে, ‘কথা’ তো নয় যেনো স্মৃতিবিধুরতায় ডুব দিয়েছিলাম।
এমন নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে যখন কৈশোর কাটানো জায়গায় যাবার সুযোগ ঘটে। পানি-মাটি-ইট-পাথর কিংবা পিচ-ঢালা ঐ পথগুলো থেকে কী অসাধারণ ঘ্রাণ বের হয়ে আসে! খুব চেনা সেই ঘ্রাণ, খুব আপন সেই ছোঁয়া। শুধু তাই না, অনেক বছর পর ফেলে আসা স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ফিরে গেলেও প্রায় সবাই নস্টালজিয়ায় ভোগে। আবার এ-ও না যে সেইসব জায়গায় সশরীরে উপস্থিত হলেই কেবল অতীতবিধুরতায় পেয়ে বসে। পড়া-জানা ইতিহাসের গল্প অন্যের কাছে শুনলেও অমনটি হয়, যেমনটি আমার হয়েছিল গ্রিসে না গিয়েও কেবল ওখানকার গল্প শুনেই। এইসব নস্টালজিয়ায় ভুগে আমরা অনেকেই কিছুক্ষণের জন্য চুপ থাকি, রোমন্থন করি একা একা, নির্জনে বসে। কিন্তু এই স্মৃতিবিধুরতা বা নস্টালজিয়ার শিল্পরূপ দেয়ার ভাবনা আমাদের করোটিতে খুব একটা খেলে না।
হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম, নূনা আফরোজ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি ঘুরে এসে একটি নাটক লেখায় হাত দিয়েছে। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কিংবা কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে যে গেছে, সে-ই কবিগুরুর সাক্ষাৎ পেয়েছে। এইখানে, ঠিক এই জায়গাটিতে বসে রবিঠাকুর ঐ কবিতাটি লিখেছিলেন, কিংবা বিকেলে এইখানটিতে দাঁড়িয়ে ‘জমিদারবাবু’ নদী দেখতেন, গ্রামীণ মানুষের বাড়ি ফেরা দেখতেন, অথবা এই ঘাসের উপর হাঁটতে হাঁটতেই একদিন গগন হরকরার সুর শুনতে পেয়েছিলেন শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- এমন ভাবনা কে না ভেবেছে! তাঁর খাট-পালঙ্ক আর ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্রের ঘ্রাণ নিতে নিতে বিড়বিড় করে তাঁর সাথে দু’চারটা কথা কে না বলেছে! কিন্তু কে কী কথা বলেছে কবিগুরুর সাথে, অন্যরা তা জানতে পারি নি। নূনা আফরোজ ঠিক করেছে, সে সবাইকে জানাবে, কী কী কথা-বার্তা, হাসি-ঠাট্টা হয়েছে তার আর রবীন্দ্রনাথের সাথে। ফলাফল, মঞ্চে এলো তার রচনা-নির্দেশনায় ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’।
নূনা আফরোজ ‘ওরফে’ অথৈ যখন কুঠিবাড়িতে ঢোকে, তখন বেলা যায় যায়। সবার যখন সারা, অথৈ’র তখন শুরু। রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত কুঠিবাড়ির কোনটা ফেলে কোনটা দেখবে তা যেনো ঠিক করে উঠতে পারে না অথৈ। তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে যায়। হাতে যে সময় নেই বললেই চলে। ঠিক এমন সময় তার সামনে হাজির হন ‘স্বয়ং’ রবীন্দ্রনাথ। মেঘ না চাইতেই মুষলধারায় বৃষ্টি নেমে আসে অথৈ’র মনে। একে একে চার বয়সী রবীন্দ্রাথের দেখা পায় সে। ২৯, ৬৯, ২১ আর ৮০ বছরের রবীন্দ্রনাথকে পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত অথৈ যেনো এক নিশ্বাসে তার ভেতরে জমে থাকা তাবৎ অজানারে জেনে নিতে তৎপর হয়। হাতে সময় কম, তাই প্রশ্নগুলোকে এমনভাবে বেছে নেয়, যেসব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে জানতে পারলেই পরাণ জুড়ায়। গভীর সাহিত্যালোচনায় না গিয়ে একেবারেই ব্যক্তিগত কিন্তু রহস্যঘেরা ঘটনাগুলোকে রহস্যমুক্ত করতে উৎসুক হয় অথৈ। বৌঠান কাদম্বরীর সাথে রবিঠাকুরের সম্পর্ক, মৈত্রেয়ী দেবী বা ইন্দিরা দেবীর ব্যাপারে কিছু জেনে নেয়া, এমনকি ঠাকুর পদবীর ঐতিহাসিক পটভূমিটাও জানা হয়ে গেলো দ্রুত সময়ের মধ্যেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনটা কাদম্বরীর চেয়ে মেঝ বৌঠানের দিকেই যে বেশি ঝুঁকে থাকতো, তা-ও কৌশলে রবিঠাকুরের মুখ থেকে বের করে আনে অথৈ।
নাটকটির পরতে পরতে তথ্য-পরিসংখ্যান আর দিন-তারিখের উল্লেখ রয়েছে, যা থেকে মনে হতে পারে জোর করে রবীন্দ্র-ইতিহাস শেখানো হচ্ছে দর্শককে। কিন্তু বাস্তব প্রতিক্রিয়া হয়েছে উল্টো। দর্শকও যেনো অথৈ আর রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রশ্নোত্তর পর্বে ঢুকে পড়ে। এর মূল কারণ হলো, নাট্যরচনাকৌশল। প্রায় প্রতিটি প্রশ্ন এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে, উত্তরের পিঠে প্রশ্ন করার ফাঁক থাকাতে। ধরা যাক, কাদম্বরীর (নতুন বৌঠান) সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা আসলে কতটা গভীর ছিল বা ছিল না তা নিয়ে এন্তার লেখা-টেখা আছে, আবার এ-ও আমরা কমবেশি জানি যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আর মেঝ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনীর পরস্পরের প্রতি দুর্বলতার কথা। কিন্তু নাটক দেখার সময় দর্শকের মনে হয় না যে, এই তথ্যগুলো চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে অথবা জানা কথাই অযথা জানাচ্ছে। যেমন-
[...]
অথৈ
রবি আমার যে ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে কাদম্বরী দেবী কেনো সুইসাইড করলো। তুমি ছাড়া সত্যি কথাটা কীভাবে জানবো বলো? [...] বলো না রবি কাদম্বরী দেবী কেনো আত্মহত্যা করলো?
রবি
(খুব অসহিষ্ণুভাবে) আমি... আমি জানি না।
অথৈ
অবাক করলে। তুমিইতো কাদম্বরী দেবীর সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলে।
রবি
(রবি ধৈর্য ধরে রাখতে পারছে না) হ্যাঁ আমি ওর কাছের মানুষ ছিলাম, ওর নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী ছিলাম। তার মানেতো এই নয় ওর আত্মহত্যার কারণ আমি জানি?
অথৈ
কিন্তু কাদম্বরী দেবী তো তোমার বিয়ের ৪ মাস পর আত্মহত্যা করেছিল। তোমার বিয়েটা কি ওর আত্মহত্যার কারণ নয় বলো?
রবি
হতে পারে, হতে পারে অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটিও একটি কারণ। কারণ, আমার বিয়ের পর ও অনেকটা একা হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের আগে বৌঠানকে যেভাবে সময় দিতে পারতাম, বিয়ের পর স্বাভাবিকভাবে সেটা সম্ভব ছিল না।
অথৈ
(খুব নরম করে বলে) খুব ভালোবেসেছিল তোমাকে বেচারা, হ্যাঁ তুমিও বেসেছিলে...
রবি
নতুন বৌঠান আমাদের কর্মচারী শ্যামগাঙ্গুলীর মেয়ে, তাই আমাদের ঠাকুরবাড়ির মহিলামহলে অনেক গঞ্জনা শুনতে হয়েছে ওকে। কথা শুনতে হয়েছে গায়ের রং কালো বলেও। অথচ ওর লাবণ্যময় শ্যামলবর্ণ আর কালো হরিণ চোখ আমার কী ভীষণ প্রিয় ছিল। ও নিঃসন্তান বলেও অনেকেই খোঁটা দিতে ছাড়তো না। জ্যোতি দাদার ব্যস্ততা তো ছিলই, সময় দিতে পারতো না খুব একটা। [...]
রবিঠাকুর যেই না অথৈকে জ্যোতি দাদার ব্যস্ততার কথা শোনালো, নাট্যকার যেনো তখনই আরেকটা প্রশ্ন করার ফাঁক খুঁজে পেলো।
[...]
অথৈ
তোমার জ্যোতি দাদার তোমার মেজো বৌঠাকুরণ জ্ঞানদানন্দিনীর প্রতি একটু বেশিই টান ছিল, তাই না?
রবি
জ্যোতি দাদা বিয়ে করেছিলেন বাবা মশায়ের আদেশে। বাবা মশায়ের আদেশতো জানোই চাপা হুঙ্কার। বলতে পারো বাধ্য হয়েছেন। তাই জ্যোতি দাদা আর নুতন বৌঠানের সম্পর্কটা কোনোদিন সহজ হয়ে ওঠে নি।
অথৈ
রবি, আমি জানতে চেয়েছিলাম জ্যোতি দাদার মেজো বৌঠানের প্রতি একটু বেশিই টান ছিল।
রবি
হুম ছিল। মেজো ঠাকুরণ ছিল বিলেতি শিক্ষায় শিক্ষিত। তার রুচি, তার মেধা, তার শিক্ষা জ্যোতি দাদা পছন্দ করতো।
তার একটু আগেই অথৈ ঈর্ষার একটা প্রসঙ্গ টানে। প্রথমেই বুঝে নিয়েছিলাম, এই ঈর্ষা শেষ পর্যন্ত বোধকরি সৈয়দ শামসুল হকে এসে ঠেকবে। শেষাবধি ঠেকেছেও, কিন্তু তা হঠাৎ লাফ দিয়ে নয়, সুর-লয়-তাল কেটে নয়, নাট্যকার নাটাই হাতে ঘুড়ির সুতো ছেড়েছে অতি-সাবধানে, যেনো সুতো ছিঁড়ে না যায়-
[...]
অথৈ
[কারণ] তোমার পুরো ৬৯ জুড়ে ছিল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ও-কে আমি জেলাস ফিল করি... আবার ভালোওবাসি। কারণ ’ও অনেক অর্থব্যয় করেছে বলেই ১৯৩০ সালের ২ মে ১২৫ টি চিত্র নিয়ে প্যারিসে তোমার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়।
দিন-তারিখসহ কিছু তথ্য পাওয়া গেলো। তারপর...
রবি
হুম তা ঠিক।
অথৈ
আচ্ছা ওকে তুমি ভালোবেসেছো, না?
রবি
বেসেছিতো [...] তুমিতো আমার লেখা প্রতিটি নারী চরিত্রকে ঈর্ষা করো। নন্দিনী, লাবণ্য, এলা, বিনোদিনী... কি করো না?
অথৈ
করিতো... আবার প্রতিটি চরিত্রকে ভালোওবাসি, তা-ও বলো।
রবি
তা ঠিক, তা ঠিক।
অথৈ
আমি ইন্দিরা দেবীকেও জেলাস ফিল করি।
রবি
ওকে কেনো? ও তো আমার দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে।
অথৈ
জানি, কিন্তু ভেবে দেখো ‘ছিন্নপত্রাবলী’র ২৫২টি পত্রের মধ্যে ২১৬ খানাই তুমি ইন্দিরা দেবীকে লিখেছো। তুমি যখন ৩৪ তখনই। ইন্দিরার কী সৌভাগ্য বলো!
অবলীলায় আরো তথ্য মিলে গেল, কিন্তু নাটকীয়তায় বাধ সাধলো না। এরপর...
[...]
অথৈ
জানো মৈত্রেয়ী দেবীকেও আমি জেলাস ফিল করি। ওর লেখা ‘ণ হণ্যতে’ বইটি আমি পড়েছি। ও তোমার এতো সান্নিধ্য পেয়েছিল! তোমার উপদেশেই ওর জীবনটা ও নুতন ভাবে সাজাতে পেরেছিলো। মির্চা ইউক্লিডের যখন মৈত্রেয়ী দেবীকে ছেড়ে চলে যেতে হ’লো তখন তোমার বাণীই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিল সেকি আমি জানি না মনে করেছো?
[...]
অথৈ
আচ্ছা অমৃতা একদিন তার বাবা এবং মির্চা ইউক্লিডকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সেদিন কি তুমি মনে মনে মির্চাকে ঈর্ষা করেছিলে?
(রবি একটু দুষ্টু হাসি হাসে)
রবি
তোমার কী মনে হয়?
অথৈ
আমার তো মনে হয় করেছিলে।
[...]
অথৈ
ঈর্ষা হচ্ছে আমার, ঈর্ষা... মৈত্রেয়ী দেবী তোমার এতো সান্নিধ্য পেয়েছে... আমি কেনো সে সময়ে জন্মালাম না। (রবি হাসে) আচ্ছা তুমি তো বললে না মির্চাকে তোমার ঈর্ষা হয়েছিল কিনা।
রবি
(একটু দুষ্টু হাসি হেসে) তা একটু আধটুতো হয়েছিলই।
অথৈ
জানো বাংলাদেশের একজন লেখক তার নাটকে একটা সংলাপ লিখেছিল। নাটকটির নাম ‘ঈর্ষা’। খুব শক্তিশালী লেখক কিন্তু। ধরো তোমার থেকে যোজন যোজন পরে বাংলা সাহিত্যে কয়েকজনের মধ্যে যার নামটা অনায়াসে উচ্চারণ করা যায়- সৈয়দ শামসুল হক।
রবি
হুম বুঝলাম। কিন্তু তার নাটকে কী সংলাপ ছিল সেটা বলো।
অথৈ
সংলাপটা ছিল- ‘প্রেমিকের হৃদয় যদি পোড়ে একমাত্র ঈর্ষার আগুনেই পোড়ে। ঈর্ষায় যে পোড়ে নি, প্রেম সে হৃদয়ে ধরে নি। ঈর্ষা এক ঠাণ্ডা নীল আগুন’। (অথৈ হঠাৎ রবির দিকে তাকায়, রবি অন্যমনস্ক) কী হলো রবি? কী ভাবছো?
রবি
কিছু না।
অথৈ
কিছুতো বটেই, তোমাকে অন্যরকম লাগছে।
রবি
(অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয়) তুমি যখন সৈয়দ শামসুল হকের কথা বলছিলে তোমার চোখটা ভীষণ চকচক করছিল।
অথৈ
তো?
রবি
(উঠে দাঁড়ায়) নাহ্ কিছু না।
অথৈ
একে ঈর্ষা বলে। জানো আমার ভীষণ ভালো লাগছে ভী-ষ-ণ, আমার জন্য তোমার মনে ঈর্ষার জন্ম নিয়েছে। উহঃ কী যে ভালো লাগছে আমার। ঈর্ষায় যে পোড়ে নি, প্রেম সে হৃদয়ে ধরে নি... ঈর্ষায় যে পোড়ে নি, প্রেম সে হৃদয়ে ধরে নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিন-সাল কিংবা মৃত্যুর আগের অসুস্থতার খবর কে না জানে! তারপরও নাট্যকার যেনো গল্পচ্ছলেই ঢুকে পড়ে তথ্য-উপাত্তে-
[...]
(দু’জন হঠাৎ হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে রবি কাশতে শুরু করে। রবিকে খুব অসুস্থ মনে হবে। রবি কিছু বলতে চায়, অথৈ থামিয়ে দিয়ে বলে)
অথৈ
একটি কথাও বলবে না তুমি রবি। এই অসুুস্থ শরীরে তোমার এতো ঘুরে বেড়ানোর কী দরকার? ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে তুমি কালিম্পং গেলে। কী হ’লো তারপর? ১০ দিন যেতে না যেতেই প্রচণ্ড অসুস্থতার জন্য কলকাতায় ফিরে আসতে হ’লো। তারপর তো দু’মাস বিছানায় পরে রইলে।
(রবির কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। রবি দম নিয়ে নিয়ে কথা বলছে)
রবি
অথৈ আমার শেষ কবিতাটি তোমার মনে আছে?
অথৈ
আছে রবি আছে, তুমি কথা বলো না রবি। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না!
রবি
আমি চাই নি অথৈ, আমার শরীরে কোনো অস্ত্রপোচার হোক, কোনো কাটাছেঁড়া হোক। কিন্তু ডাক্তার মানলে না।
অথৈ
আমি জানি রবি সব জানি।
রবি
বলো না আমার শেষ কবিতাটি, যা আমি লিখতে পারি নি, মুখে মুখে বলেছিলাম।
অথৈ
(অথৈর চোখ দিয়ে জল পড়ছে) তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে ৭ অগাষ্ট ১৯৪১ বেলা ১২:৩০ মিনিটে। আর তুমি তোমার শেষ কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ মুখে মুখে বলেছিলে ৩০ জুলাই সকাল সাড়ে ন’টায়।
তারপর অথৈ আর রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি আবৃত্তি করে। যদিও এ সময়ে ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ উল্লেখ করলে শুনতে হয়তো আরো আরাম লাগতো।
নাটকটিতে বিষয় ও প্রকাশে নতুনত্বের স্বাদ মেলে। কিন্তু দু’একটি জায়গায় একটু খামতি রয়ে গেছে বোধ করি। নাটকে অথৈ সুযোগ পেয়ে রবিঠাকুরের কাছ থেকে তার অজানাকে জানার চেষ্টা করে। ফলে রবিঠাকুরকে এমন কোনো প্রশ্ন করা ঠিক না, যার উত্তর তাঁর কাছে নেই। আমরা জানি, ২৯ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘বিসর্জন’ নাটকে রঘুপতি চরিত্রে অভিনয় করেছে এবং ৬৮ বছর বয়সে করেছে জয়সিংহ চরিত্রে। এটার পেছনে কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। থাকতে পারেও না। কারণ, এই দুই বয়সে দুটি উল্টো চরিত্রে (বয়সের দিক থেকে) অভিনয় করাটা মোটেই পূর্বপরিকল্পিত না। এবং সঙ্গত কারণেই রবিঠাকুরও এ প্রসঙ্গে কোনো উত্তর দিতে পারেন নি। এক্ষেত্রে নাট্যকার-নির্দেশককে মনে হয়েছে জোর করে একটি তথ্য যেনো দর্শককে জানিয়ে দিলো যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘বিসর্জন’ নাটকের কিছু অংশ অভিনয় করে দেখানো।
আরেকটি জায়গাও বেশ চোখে লেগেছে, তা হলো কাদম্বরী প্রসঙ্গ। ৬৯ বয়সী রবীন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরী দেবীর ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা করে ফেলে অথৈ। নতুন বৌঠানের সাথে সম্পর্ক, নিঃসঙ্গ অবস্থায় সঙ্গ দেয়া, কাদম্বরীর প্রতি স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অবহেলা ইত্যাদি ইত্যাদি কথার পর কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ নিয়েও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, কাটা-ছেঁড়া হয় অনেকক্ষণ। তারপর রবি-কাদম্বরীর গল্পের কী আর বাকি থাকে? ঠিক তখনই মঞ্চে আসে ২১ বছর বয়সী রবিঠাকুর। এবং সম্ভবত পুরো সময়টাতেই অথৈ আর অথৈ থাকে না, কাদম্বরী হয়ে দর্শককে দু’জনার তথ্যরস দিতে থাকে। এটা একসময় যেনো রিপিটেশন মনে হতে থাকে, মনে হয় এই আলাপগুলোই তো বোধহয় একটু আগে ৬৯ বয়সী রবীন্দ্রনাথ আর অথৈর মুখ থেকে শুনলাম। আমার মনে হয় ২১ বছরের রবীন্দ্রনাথের দৃশ্যটা আগে আনলে হয়তো এমনটা হতো না। কিন্তু তাতে আবার ২৯-৬৯-২১-৮০ বছরে রবীন্দ্রনাথের আগমনের নাটকীয়তা (ছোটরবি-বড়রবি-ছোটরবি-বড়রবি) হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
আমরা এর আগে মঞ্চে মধূসুদনকে দেখেছি, বিদ্যাসাগরকে দেখেছি, সক্রেটিসকে দেখেছি, নজরুলকে দেখেছি। রবীন্দ্রনাথকেও দেখেছি, তবে এত বড় ক্যানভাসে, এত বৈচিত্র্য নিয়ে দেখি নি। মঞ্চনাটকে কখনো রূপসজ্জাকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি, যতটা ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’-এ মনে হয়েছে। প্রথমেই মঞ্চে বড় বড় বোর্ডে চার বয়সী চার রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখে কিছুটা সংশয় জেগেছিল, চরিত্রাভিনেতাদের দেখতে যদি ঐ বয়সী রবিঠাকুরের মতো না লাগে, তাহলে তো মুশকিল হয়ে যাবে। কিন্তু না, প্রত্যেক রবীন্দ্রনাথের গেট-আপ যার পর নাই, আমাদের কল্পনার ইমেজের কাছাকাছি হয়েছে। অভিনন্দন রূপসজ্জাকর জনি সেনকে। মঞ্চ পরিকল্পনায় শিলাইদহের কুঠিবাড়ির কোনো ছাপ থাকলে মন্দ হতো না। নাটকের শুরুতেই কুঠিবাড়ির কথাটা এতটাই স্পষ্ট করা হয়েছে যে, অথৈ আর নেহাল কুঠিবাড়িতে ঢোকার পর যদি দর্শক কুঠিবাড়ির ন্যূনতম একটা সাজেশনও পেতো, তাহলে ভালো হতো। বাড়ির চারিদিকের ঢেউ খেলানো দেয়ালের সাজেশন দিয়েও তা করা যেতো।
২৯ বয়সী রবিঠাকুর তৌহিদ বিপ্লব আর ৬৯ বয়সী অনন্ত হিরার অভিনয় যথাযথ বলা যায়। ৮০ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে আউয়াল রেজা বেশ ভালো অভিনয় করেছে। সত্যি বলতে, এর আগে আউয়াল রেজার তেমন একটা ভালো অভিনয় দর্শক বোধহয় দেখে নি। ২১ বছরের রবি’র ভূমিকায় রামিজ রাজু ‘যা করার তাই করেছে’! প্রাঙ্গণে মোরের প্রথম নাটক থেকেই রামিজ রাজুর অভিনয় দর্শকের দৃষ্টি কেড়েছে। সেই ‘শ্যামাপ্রেম’ থেকে আজকের ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’- এরই মধ্যে কত কত নাটক, কত কত চরিত্র। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন মেজাজের চরিত্রে অবলীলায় অভিনয় করে যাচ্ছে রামিজ রাজু। তার অভিনয় ক্ষমতার তারিফ এখন প্রায় সব দর্শকই করে থাকে। মঞ্চে এতটা প্যাশন আর দক্ষতা নিয়ে অভিনয় চালিয়ে যাওয়াটা চাট্টিখানি কথা না। নূনা আফরোজের অভিনয় দেখার অভিজ্ঞতা আমার সম্ভবত ‘স্বপ্নবাজ’ থেকে। তারপর প্রাঙ্গণে মোরের সব নাটকেই সে অভিনয় করেছে। তার অভিনয় ক্ষমতা জানার কারণেই বোধ হয়, ‘অথৈ’র অভিনয়টা আমাকে অতটা টানতে পারে নি। বিশেষ করে ৬৯ আর ৮০ বয়সী রবীন্দ্রনাথের সাথে আলাপকালে অথৈর বয়স যেনো কমে যায়, আহ্লাদটা বেড়ে যায়, ব্যক্তিত্বে টান পড়ে। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এত পড়াশোনা-জানাশোনা অথৈর ব্যক্তিত্ব মাঝে মাঝেই যেনো আলগা হয়ে যায়, একটু অতিঅভিনয়ের ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। ‘ভালো’র কাছ থেকে ‘ভালোতর’ কিছু পাওয়ার আশাতেই এ-কথাগুলো বলা। ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ রচনা-নির্দেশানায় সফল নূনা আফরোজ ‘অথৈ’ চরিত্রেও সফল হবে এটুকু প্রত্যাশা করতেই পারি।
‘প্রাঙ্গণে মোর’-এর মঞ্চচর্চা সবাইকে মুগ্ধ করছে। মঞ্চে নিয়মিত নতুন নাটকের অভিষেক ঘটানো সবাইকে দিয়ে সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু ‘প্রাঙ্গণে মোর’ এর ব্যতিক্রম। তারুণ্য-চঞ্চল এই দলটি নিয়মিতভাবে একবছর অন্তর অন্তর খুব বড় পরিসরে নাটকের উৎসবও করে থাকে। কেবল ঢাকার মঞ্চে না, দেশের বিভিন্ন মঞ্চে ও দেশের বাইরের মঞ্চে বেশ সরব এই দলটি। আজকের বাস্তবতায় তা বিস্ময় জাগায় বৈকি! বাস্তবতার এহেন বৈরি পরিবেশের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আরো এগিয়ে যাক ‘প্রাঙ্গণে মোর’, এই প্রত্যাশা রইলো।
‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ নাটকের মঞ্চায়ন দীর্ঘকাল বজায় থাকুক।
এপ্রিল ২০১৬। ঢাকা
হাসান শাহরিয়ার: সম্পাদক, থিয়েটারওয়ালা