Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

নতুনের কেতন ওড়াবার সময় যে চলে যায় ...

Written by হাসান শাহরিয়ার.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

স ম্পা দ কী য়

‘৬ টা মানে কিন্তু ৫ টা ৬০ মিনিট- কথাটা বোঝা গেলো?’
এমন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিলো থিয়েটারজীবনের। কিন্তু এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য ছিলাম না- কেননা, আমিতো থিয়েটারে নিজের ইচ্ছায় আসিনি। আমাকে জোর করে খেলার মাঠ থেকে ধরে আনা হয়েছিলো। এই নাট্যদলের কর্তাব্যক্তির ছেলে ছিলো আমার ক্লাসমেট- বন্ধু। আমাকে প্রত্যেকদিন বিকালে মাঠে খেলতে দেখে সেই বন্ধুর সাহিত্যবোধ আর নান্দনিকতায় ‘আঘাত’ লেগেছিলো। আমাকে বুঝিয়েছিলো- এভাবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না বরং শিল্প-সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হলে- সমাজটাকে বুঝতে পারবো। ভেতরে একটা নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি হবে- এমন ধরনের কথাও বলেছিলো বোধহয়- ‘বোধহয়’ বলছি একারণে যে, তখনকার সব কথাতো ঠিক ঠিক মনে নেই- কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছি, এমন কিছু নিশ্চয়ই বলেছিলো, যা শুনে নিজের ‘ইজ্জতে’ ঘা লেগেছিলো।

মধ্যবিত্তের ‘ইজ্জত’ হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। ‘ইজ্জত’ গেলো তো সব গেলো, আমিও যেনো একেবারে ‘বেপর্দা’ আর ‘উলঙ্গ’ হয়ে গেলাম। এটাতো মেনে নেয়া যায় না। ‘ইজ্জত’ বাঁচাতেই যেনো তখন বন্ধুর কথাগুলো শুনে মনে হয়েছিলো- ফুটবল আর ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টন আর ক্যারামবোর্ড-দাবা-গুল্লি আর ডাইগ্যা আর তাস-ডাংগুলি-সাতচাড়া আর পিঠ-ফুটান্তি খেলে বা বকাইট্টা ঘুড্ডির পিছনে দৌড়াদৌড়ি করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না- তারচে বরং যাই- সমাজের জন্য কিছু করা যায় কিনা দেখে আসি।

আশৈশব ভালোলাগার সব খেলাধুলায় খ্যামা দিয়ে যে-ই না বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে থিয়েটারে আসলাম, শুরুতেই এমন একটা প্রশ্ন- ‘৬ টা মানে কিন্তু ৫ টা ৬০ মিনিট- কথাটা বোঝা গেলো?’ প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ নীরব ছিলাম- কেননা সত্যি সত্যিই আমি কথাটা বুঝতে পারিনি। ৬ টা মানে তো ৬ টাই, সেটাকে ৫ টা ৬০ মিনিট বলার মাজেজা কী! তাছাড়া জীবনের ভয়ংকরতম যে জায়গাটি তখনও ছিলো- যেখানে না গেলে ‘জীবন’ তৈরি হয় না, অথচ গেলে ‘জীবন’ ‘আজীবনের’ জন্য পর্বতসম বোঝা হয়ে দাঁড়ায়- সেই ‘স্কুল’-এর স্যারও যেখানে বলতেন- ‘৯ টা মানে কিন্তু ঠিক ৯ টা। এর পর স্কুলে এলে সারাদিন বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখবো।’- শাস্তিটা মারাত্মক হলেও, শাস্তির কারণটা খুব সহজ-সরলভাবে বুঝেছিলাম- ‘৯ টা মানে ৯ টা’ অর্থাৎ স্যার তাঁর ‘সংলাপের’ মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য আমার সাথে ‘কমিউনিকেট’ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু যার আজন্ম সাধনা হচ্ছে সংলাপের মাধ্যমে অন্যকে ‘কমিউনিকেট’ করা, সেই নাট্যকর্মীই কিনা এমনভাবে প্রশ্ন ছুঁড়লো যে, আমি ‘কমিউনিকেট’ করতে পারলাম না। তারপরও সুবোধ বালকের মতো ‘বোধহয়’ বলেছিলাম- জ্বি, বুঝেছি। ঠিক ৬ টার মধ্যেই মহড়ায় আসতে হবে।

‘এসে কায়েসকে নোটিশ করবে, কায়েস না থাকলে ওর সাবস্টিটিউট থাকবে, তার সাথে দেখা করবে।’

‘জ্বি করবো। করেই আপনাকে জানাবো।’

‘আমাকে না-ও পেতে পারো, কখন না কখন আসি। আমার তো আরও কাজ আছে নাকি? ওসব সেরে আমাকে আসতে হয়। তুমি কায়েসের সাথে দেখা করলেই হবে।’

সাথে সাথে এটুকু বুঝে ফেললাম যে, আমি এক ‘অকাজের ছোকরা’ থিয়েটার করতে এসেছি, ‘কাজের মানুষটা’-র সাথে আমার দেখা হওয়া না হওয়া নির্ভর করছে, তার সময়ের উপর। এরপর নাটকটির পুরো মহড়াকালীন সময়ে, তা প্রায় ৩ মাসে,  আমার মতো আরও কিছু ‘অকর্মার ঢেঁকি’ ছাড়া অন্য কাউকেই তথাকথিত ‘৬ টা মানে কিন্তু ৫ টা ৬০ মিনিট’- এর মধ্যে মহড়া কক্ষে উপস্থিত হতে দেখিনি। নাটকের প্রধান প্রধান চরিত্রের অভিনেতৃদের অন্যত্র প্রচুর ব্যস্ততার কারণেই যে এই অনুপস্থিতি তা আর বুঝতে বাকি ছিলো না।

মফস্বলে ঐ একটি নাটকে কাজ করার পরই, রাজধানীতে উদ্বাস্তু হয়ে এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি, পরাণের গহীন ভিতরের কোনো এক তাগিদ থেকে কয়েকটি নাট্যদলের কিছু ওয়ার্কশপেও অংশ নিয়েছিলাম। সেই ওয়ার্কশপগুলো করতে গিয়ে বুঝেছিলাম, মফস্বল থিয়েটারে যে ‘কথার ফুলঝুরি’ ছড়ানোর প্র্যাকটিস চালু হয়েছে, সেটা খোদ রাজধানীর নাট্যকর্মকাণ্ড থেকে রপ্তানীকৃত। তবে রাজধানীর অবস্থা আরও ভয়ানক, এখানে যে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম সেটা আরেক কাঠি সরেস-

‘ধরো, তোমার বাবা আজ মারা গেছেন, অথচ আজই নাটকের ’শো আছে- তাহলে তুমি কী করবে? বাবাকে দাফন করতে যাবে, নাকি মঞ্চে নাটকটার প্রদর্শনী করবে?’

টানা ২ মাসের ওয়ার্কশপে প্রতিদিন ঠিক ঠিক সময়ে উপস্থিতির জন্য অভিনন্দন পাওয়া এই আমি, প্রায় প্রতিদিন দেরি করে আসা, এবং প্রায়শই অনুপস্থিত থাকা ‘সিনিয়র নাট্যকর্মী’র এমন প্রশ্নে যার পর নাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই। একটু সময় নিয়ে বলি- আমাকে নিয়ে এমন সমস্যা হবে না।

‘সিনিয়র ভাইয়া’ রেগে ফেটে পড়লো- কেনো সমস্যা হবে না শুনি? দু’মাস ওয়ার্কশপ করেই ভেবে নিয়েছো, থিয়েটারকর্মী হয়ে গেছো? থিয়েটার বোঝ? থিয়েটার করতে হলে অন্য সবকিছু বাদ দিতে হবে। প্রাইভেট লাইফ, ফ্যামিলি লাইফ বলে কিছু থাকা চলবে না। প্রথম দুই বছর চেয়ার টানতে হবে, সেট আনা-নেওয়া করতে হবে, মঞ্চে সেট লাগাতে হবে। প্রত্যেক দিন সবার আগে এসে রিহার্সেল রুম ঝাড়ু দিতে হবে। সিনিয়ররা চা-টা চাইলে সাথে সাথে এনে দিতে হবে। ‘সিনিয়র’ কাকে বলে বোঝ? সিনিয়রিটি মেধা দিয়ে হয় না, দলে তোমার দশ মিনিট আগেও যে জয়েন করেছে, সে-ই তোমার সিনিয়র। (গর্ব করে বলে) বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক হাওয়ায় ভেসে এদ্দূর আসেনি। এসেছে আমাদের শ্রম, ঘাম আর মেধার কারণে। তোমার মেধার খবর নেবো দুই বছর পর, আগে তো শ্রম আর ঘামের পরীক্ষা দিতে হবে নাকি?

অন্য অনেকেই তখন হা করে তার দিকে তাকিয়েছিলো। আমিও তাকিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, কথাগুলোর মর্ম যাই হোক না কেনো, এত বড় সংলাপ মুখস্ত রাখে কীভাবে আর তা এক নিঃশ্বাসে বলেই বা কীভাবে! সিনিয়র ভাইয়ার তেতে ওঠা কণ্ঠে আমার সম্বিৎ ফেরে-

‘কী হলো, তাকিয়ে আছো কেনো? আমার প্রশ্নের জবাব দাও।’

‘কোন প্রশ্নের জবাব চাচ্ছেন?’

সে-ও দ্রুত প্রশ্নটা মনে করে নেয়, এবং আমাকে চমকে দিয়ে হুবহু প্রশ্নটা আবার করে, এবার যেনো প্রতিটা শব্দেই অতিরিক্ত প্রেশার দিয়ে দিয়ে বলে- ‘ধরো, তোমার বাবা আজ মারা গেছেন, অথচ আজই নাটকের ’শো আছে- তাহলে তুমি কী করবে? বাবাকে দাফন করতে যাবে, নাকি মঞ্চে নাটকটার প্রদর্শনী করবে?’

‘এই প্রশ্নের উত্তর তো দিয়েছি- বললামতো আমাকে নিয়ে ওসব ঝামেলা হবে না।’

‘কেনো হবে না সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। এমন কনফিডেন্স তুমি পেলে কোত্থেকে শুনি?’

আমার ভেতরে তখন মফস্বলী গোঁয়ার্তুমী কিছুটা যেনো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো। কিন্তু ভেতরের গোঁয়ার্তুমী বহিঃপ্রকাশের প্র্যাকটিস না থাকায় শান্তভাবেই বললাম- আমার বাবা ছ’মাস আগে মারা গেছে। সুতরাং আমার বাবার মৃত্যু আপনার কোনো ’শো-র দিন আমার উপস্থিতিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

আমার শান্তস্বর তাকে আরও অশান্ত করে দিলো। তারপর কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি এবং অতঃপর জানতে পারলাম, থিয়েটার হচ্ছে একাধারে ডিসিপ্লিন এবং স্যাকরিফাইসের জায়গা। এখানে কোনো অজুহাত দেয়া চলবে না। বাপ-মা-চৌদ্দগোষ্ঠী মারা গেলেও থিয়েটারে ‘কল’ থাকলে আসতেই হবে। একমাত্র যদি নিজে মারা যাই তবে নিস্তার আছে। অসুস্থ হলেও নিস্তার নেই- অসুস্থতার সত্যতা ও সততা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যাবে। তার মানে, মরার আগ পর্যন্ত আর শান্তি নাই!

পরে ধীরে ধীরে জানতে পেরেছি, থিয়েটারে এধরনের ‘সিনিয়র নাট্যকর্মী’ বা ‘সিনিয়র ভাইয়া’রা হচ্ছে দলের জন্য বিষফোঁড়। থিয়েটারে যারা সৃজনশীলতা দিয়ে জায়গা করে নিতে চায়, তাদেরকে তারা মোটেও সহ্য করতে পারে না। সেজন্যই দলে নতুন ছেলে-পুলে আসলেই তাদের প্রথম কাজ হয় ধমক-ধামক দিয়ে ভয় পাইয়ে দেয়া। এরা দলের প্রধান ব্যক্তিদের, যাদের সৃজনশীল মনন দিয়ে দলটি তৈরি হয়েছে, তাদের ধারে-কাছে নতুনদের যেতে দেয় না। দলের প্রধান ব্যক্তিরাই নাকি চায়, সিনিয়র কাউকে পাশ কাটিয়ে ‘নতুন’ কেউ যেনো তাদের সাথে কথা বলতে না আসে, এতে দলের ‘ডিসিপ্লিন’ নষ্ট হওয়ার ‘আশঙ্কা’ থাকে। দলের ‘ডিসিপ্লিন’ রক্ষা করতে গিয়ে দলীয় প্রধানরা একটা ‘তাবেদার শ্রেণী’ তৈরি করেছে, যা ধীরে ধীরে থিয়েটারের সম্মুখ পদযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তাবেদার শ্রেণী, দলের প্রধান ব্যক্তিদের কাছ থেকে যা শোনে, যেরকম বকুনি খায়- ঠিক তা তাই সাপ্লাই দেয় নতুনদের কাছে। তারা এমন ‘ভাব’ নিয়ে কথা বলে, যেনো এসব তাদের মৌলিক ভাবনা বা তাদের নিজস্ব ফিলজফি। আসলে পুরো ব্যাপারটাই নকল, অনুকরণে ভরা। নতুন নাট্যকর্মীদের সাথে ‘সিনিয়র ভাইয়া’-রা কীভাবে কথা বলে, তার আরেকটা নমুনা দেখা যাক-

‘শম্ভু মিত্রের নাম শুনেছো?’

‘জ্বি, শুনেছি।’

‘শম্ভু মিত্রের ‘রক্তকরবী’ দেখেছো?’ উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’? কী দেখেছো?

নতুন কর্মীটি যেনো এবার পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পায় না। কেবল এই প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার ভয়ে মাটি খুঁজে পাচ্ছে না, তা না। তারপর আর কী কী প্রশ্ন আসতে পারে সেই ভাবনাও তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। সে শুনেছে রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মঞ্চ বানিয়ে নাটক করতো। দর্শকও কম-বেশি আসতো সেখানে, তা-ও সে দেখেছে কিনা এমন প্রশ্ন আসার আগাম উত্তর খোঁজার জন্যই যেনো সে অন্যদিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, দেখেছে কিনা মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। আরও ভাবতে থাকে গিরিশ ঘোষ বা শিশির ভাদুড়ী- কী কী নামের যে নির্দেশক-অভিনেতা ছিলো (তারা এখনও আছে কিনা মনে করতে পারে না), বা ঐ যে... হ্যাঁ হ্যাঁ... (মনে পড়ে যেনো) ... বিজন ভট্টাচার্য্য ... মানে... ওদের সাথেও তার দেখা হয়েছে কিনা, এখনও সাক্ষাৎ আছে কিনা, এসবও জানতে চাইবে হয়তো এই ‘সিনিয়র ভাইয়া’- এসব ভাবতে ভাবতে সে কেবলি ঘামতে থাকে। সে ঘামতে থাকে কারণ, সেই মুহূর্তে তার ঠিক মনে পড়ে না, কেবলি নাম জানা এই বড় বড় মানুষগুলোর জন্ম সময়, জন্ম কাল কবে ছিলো, কী কী কাজ তারা করেছে। অথবা এমনও ভাবে, ‘হ্যাডম’ নিয়ে বলে ফেলবে কিনা যে, তাদের সাথেও তার দেখা-শোনা হয়েছে, বা এখনও আলাপ-সালাপ আছে- ইত্যাদি। এসব ভাবতে ভাবতে নতুন নাট্যকর্মীটি এবার নিজের অজান্তেই ঘেমে ওঠার পাশাপাশি হাঁপাতেও থাকে।

প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে থিয়েটার করতে আসা কোনো নাট্যকর্মীকে ‘সিনিয়র ভাইয়া’-দের কাছে প্রথমেই এমনসব ‘বাক্য-প্যাদানী’ খেতে হয় যে, সে শিল্পী হওয়ার আশা বাদ দিয়ে, নাট্যকর্মী হওয়ার আশা বাদ দিয়ে, একজন ‘নাট্য-কামলা’ হওয়ার পথে ধাবিত হয়। দু’দিন পর সে-ও ‘সিনিয়র ভাইয়া’ হয় এবং একই আচরণ নতুনদের প্রতি করতে থাকে।

খুব সুচারু ও সতর্কভাবেই অথবা বলা যায় খুব ‘ঠাণ্ডা মাথায়’ বাংলাদেশের থিয়েটারে এধরনের ‘নাট্য-কামলা’র একটা দল তৈরি করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত একটা শ্রেণী (যারা থিয়েটারে ‘প্রথম প্রজন্ম’ হিসেবে খ্যাত) বাংলাদেশে নাগরিক থিয়েটারের নিয়মিত চর্চা শুরু করে। এই চর্চা স্বাধীন দেশে একেবারেই নতুন ধারণা নিয়ে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশে (তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানেও) নিয়মিতভাবে শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চা ছিলো না। সে হিসেবে এটা ছিলো এক চমকপ্রদ ও নান্দনিক উদ্ভাবন। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখতেই হবে, ‘নতুন ধারণা’ সর্বকালের জন্য ‘নতুন’ থাকে না। ‘নতুন’-এর বয়স বাড়ে, ‘পুরাতন’ হয়। পুরাতনের কাজ হলো আরেক ‘নতুন’কে আহ্বান করা, মেনে নেয়া। যে ‘পুরাতন’ যত বেশি ‘নতুন’কে স্বীকৃতি দেয়, সেই ‘পুরাতন’ ততো বেশি স্থায়ী আর উজ্জ্বল আর টেকসই হয়। কিন্তু আমাদের প্রথম প্রজন্মের থিয়েটারওয়ালারা সব সময় নিজেদের ভাবনাকেই ‘নবীন’ ভেবেছে, ‘নবীনের’ ভাবনাকে কখনো আমলে নেয়নি। কেননা, তাদের ভাবনায় ছিলো, তারাই কেবল ‘শিল্পী’ হবে, অন্যরা হবে তাদের ‘তাবেদার’, ‘নপুংসক’, এবং তারা চেয়েছে, এবং চাচ্ছে, ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ হিসেবে বেঁচে থাকতে। ‘নপুংসক’-এর বাপ-মা হওয়া ‘লজ্জার’ না ‘গৌরবের’, তা-ও তাদের মাথায় ছিলো না, এখনও নেই। কেনো না, এদের প্রায় সবাই ‘বাজার সর্বস্ব শিক্ষিত’। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে শেক্সপীয়রসহ বিশ্বসাহিত্যের তাবৎ সাহিত্য তাদের নখদর্পণে। চোস্ত ইংরেজি বলা-জানা প্রত্যেকে। ‘ঢাকা ক্লাব’-এর সদস্যও প্রায় সবাই। তার মানে, সমাজের ‘এলিট’ ক্লাসের সদস্য তারা। কিন্তু সমস্যা একটাই। তারা যা জানে, তা বাজারে টিকে থাকার জন্যই জানে। তাই, তারা এখনও ‘বাজারের বাবা’। তাদের পেছনেই ছুটছে সব ‘নটপাগল’ ‘হাভাতের’ দল। সেজন্যই কেবল এখনই না, বহু বছর ধরেই থিয়েটার হয়ে গেছে এক নিরানন্দের জায়গা। এখানে কোনো ‘কাজের কাজ’ হয় না, কেবলি যেনো বংশ গৌরব- ‘আমি থিয়েটার করি’। এ যেনো এমন যে, ছেঁড়া লুঙ্গি কাঁধে নিয়েও চিৎকার করে- আমি ‘চৌধুরী’ বংশের পোলা। ছেঁড়া লুঙ্গি কাঁধে নেয়ার ফলে যে ‘চৌধুরী’ বংশের পোলার ‘শিশ্ন’ উন্মুক্ত হয়ে গেছে, সেদিকে তার কোনো হুঁশ নেই। আগে শুনতাম টিভি মিডিয়াতে ‘থিয়েটার করা’ লোকজনকে খুব সমীহ করতো এই ভেবে যে, ‘ফেইস ভ্যালু’ না থাকুক, শিক্ষা আর ডিসিপ্লিনটা তো আছে। এখন নাকি এদের দেখলে মিডিয়ার লোকজন ভয় পায়। ‘থিয়েটার করা’ লোকজনরা স্পটে যায় দেরিতে এবং আগে আগে ফিরতে চায়- দেরিতে যাওয়াটা ‘পুষিয়ে’ দেবে বলে।- তাই মিডিয়াতেও আজ এই ‘চৌধুরী’ বংশের পোলাপাইনের কোনো ইজ্জত নেই।

থিয়েটার চর্চায় নতুনভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিলো ‘বাঙলা থিয়েটার’, নব্বুই দশকের একেবারে শুরুতে। প্রথম প্রজন্মের ‘নতুন ভাবুক’ মামুনুর রশীদ এর উদ্যোক্তা। ভাবনা ছিলো, গতানুগতিক গ্রুপ থিয়েটার চর্চার পাশাপাশি ‘রেপাটরি’ থিয়েটার চর্চার প্রবর্তন করা। বিভিন্ন নাট্যদল কিংবা মিডিয়ার সৃজনশীল লোক নিয়ে প্রফেশনাল থিয়েটার চর্চার চেষ্টা। তারই লেখা প্রথম প্রযোজনা ‘মানুষ’ নাটকটা বেশ দাপটের সাথে সারাদেশ ঘুরেছিলো। নির্দেশকও ছিলো ‘নতুন ভাবুক’- ফয়েজ জহির। নতুনের ছোঁয়ায় বেশ তেজদ্দীপ্ত হয়েছিলো সবাই। কিন্তু তাতেও বাধ সাধা হলো। ‘বাঙলা থিয়েটার’-এর পরবর্তী প্রযোজনায় যখন অন্যান্য দলের নাট্যকর্মীর কাজের সুযোগ হলো- তখনই ঐসব দল থেকে খড়গ ওঠানো হলো- ‘নিজের দলের বাইরে গিয়ে কাজ করা যাবে না।’ ‘নতুন চিন্তা’-র প্রথম খৎনার ‘পরশ' পড়লো ঐ প্রথম প্রজন্মের ঘাড়েই।

অথচ নব্বুয়ের শুরুতে চালু হওয়া রেপাটরি চর্চাটা যদি নিয়মিত করা যেতো, আজ থিয়েটারের খোমাটাই হয়তো পাল্টে যেতো। কিন্তু থিয়েটারে যে নতুন ভাবনার ‘প্রবেশ নিষেধ’। বাহাত্তরে যেভাবে ভাবা হয়েছে, সেটাই শেষ কথা। এ যেনো সংবিধান। প্রথম প্রজন্মের বাইরে আর কেউ কিছু ভাবতে পারবে না। ভাবলেই বলবে ‘কইরা দেখাও’।

‘কোথায় করে দেখাবো? মঞ্চ কৈ?’

‘যা আছে তার মধ্যে যা করা যায়, তাই করো। আমরা তো গোডাউন ঝাড়ু দিয়া নাটক করছি।’

ঐ এক গীত শুনতে শুনতে ‘নতুনের’ মাথা ধরে যায়। কিছু হলেই নিজেদের গৌরব আর স্যাকরিফাইজের বয়ান শোনায় বুড়োরা।

ইদানিং দেখা যাচ্ছে রেপাটরি থিয়েটার চর্চার বেশ প্রচল। যারা নব্বুয়ে বাধ সেধেছিলো, তারাও বেশ মজা পেয়ে গেছে রেপাটরি চর্চায়। কেউ কেউ এখন স্বীকার করে বলে- ‘গ্রুপ থিয়েটার চর্চাটা আসলে আর রান (run) করানো যাবে না। দল থাকবে, কিন্তু দু-চার-পাঁচজনই দল চালাবে। অন্যরা অস্থায়ী হিসেবে কাজ করবে। নানা জনের নানা মত শুনে থিয়েটার করা যাবে না।’ এটা উপলব্ধি করতে এতদিন লাগলো! প্রায় সব নাট্যদলই তো এখন অনেকটাই ‘রেপাটরি থিয়েটার’। থিয়েটারে ‘তাবেদার শ্রেণী’ বানিয়ে এখন নিজেরাই বিপদে পড়েছে। কোনো ক্রিয়েটিভ এবং এ্যাক্টিভ নাট্যকর্মী খুঁজে পাচ্ছে না। ‘নাট্য-কামলারা’ও কেবল নামটা লিখিয়ে রেখেছে, দলের সাথে কোনো সংযোগ বা সম্পর্ক নেই। গ্রুপ থিয়েটার হয়ে গেছে এখন কুটির শিল্প। বাপ-মা-ভাই-বোনই মালিক-শ্রমিক। সেজন্যই রেপাটরি থিয়েটার চর্চাটা এখন তাদের মনে ধরেছে।

কিন্তু যে ‘নতুন ভাবুক’ এখন রেপাটরি করছে তাকে ভাবতে হবে নতুন করে। এই যে রেপাটরি চর্চা, এটা কিন্তু নব্বুই সালের আইডিয়া। তখন ‘নতুন আইডিয়া’-র কারণে থিয়েটারের ‘মুরুব্বি’-রা তার কোমর ভেঙ্গে দিয়েছিলো। আজ ২০১৫ সালে ঐ আইডিয়া ঠিক ঐভাবে করে কোনো কাজ হবে না। কাজ যে হবে না তার প্রমাণ বুড়োদেরও এখন এটা পছন্দ হচ্ছে। তাদের পছন্দ হওয়া মানে ‘মালডার এক্সপায়রিটি ডেট’ শেষ- সেটা বুঝতে হবে। তারা গরম গরম কিছু নিতে পারে না। ঠাণ্ডা হয়ে গলে-পচে গেলে তারপর সেটার উপর তাদের ভরসা আসে। নতুন ভাবুকদের একটা কথা মনে রাখতে হবে- ‘হিট দ্য আয়রন হোয়েন ইট ইজ হট’। লোহাকে তপ্ত-লাল অবস্থাতে আঘাত করলে তার shape বা form পরিবর্তন হয়। ঠাণ্ডা লোহায় আঘাত করলে পরিশ্রম বাড়ে, কিন্তু shape চেইঞ্জ হয় না। ‘নতুন ভাবনা’র প্রয়োগ সাথে সাথেই করতে হয়। সময় নষ্ট করলে তা ‘পুরাতন আইডিয়া’ হয়ে যায়।

তাই ’৯০ এর রেপাটরি ফর্ম এখন কাজ করবে না। কীভাবে কী করলে কাজ করবে সেটা ভাবতে হবে ‘নতুন ভাবুক’দের। মঞ্চের মোস্ট ট্যালেন্টদের নিয়ে কাজ করতে হবে। ‘আমলা’ আর ‘কামলা’ থেকে দশ হাত দূরে থাকতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতার সন্ধান করতে হবে- নিজেকেই। মাসে কমপক্ষে টানা ১০/১২ টা শো করার মতো ক্ষমতা তার থাকতে হবে। পুরাতন নিয়মে গিজগিজ করা নাট্যদলের হল বুকিং দিতে হিমসিম খাওয়া ‘গণতান্ত্রিক’ হল বুকিংওয়ালাদের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা আর তাদেরকে গালমন্দ করাটাও পুরনো চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং নতুন ভাবনার সফল বাস্তবায়নের কৌশলও ‘নতুন ভাবুক’-দেরকেই ঠিক করতে হবে। থিয়েটারে যদি মেধার বিকাশ ঘটানো না যায়, সৃজনশীলতা প্রকাশ করা না যায়, তাহলে থিয়েটার চর্চায় ‘খ্যামা’ দেয়াই উত্তম। যে কাজে কোনো আনন্দ নেই, গর্ব নেই- তার চেয়ে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজ আর কী হতে পারে!

ইতি
হাসান শাহরিয়ার
বৈশাখ ১৪২২, এপ্রিল ২০১৫
মোহাম্মদপুর, ঢাকা