Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

‘না-মানুষি জমিন’- যন্ত্রণাক্লিষ্ট সংকটের দলিল

Written by বিপ্লব দে.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

একটা বিষয় নিয়ে হামেশায় তর্ক ওঠে ‘যা আইনসঙ্গত, তা ন্যায়সঙ্গত নাও হতে পারে’ অথবা ‘যা ন্যায়সঙ্গত তা আইনসঙ্গত নাও হতে পারে’। এটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। এই রকম চেনা তর্কের ছায়ায় এবং পারিবারিক গণ্ডির বাইরে দেশ-কাল ও সময়ের চলমান আবর্তে কোনো কোনো সংকট বা প্রেক্ষিত আমাদের বেদনার্ত করে তোলে। ‘না-মানুষি জমিন’ সেরকমই এক সংকট-দলিল যা দগদগে লাল ক্ষত, আর তাতে নিহিত আছে বিষম যন্ত্রণা।

‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’-এর সুন্দর বাংলা প্রতিশব্দ ‘না-মানুষি জমিন’। আনিসুল হকের এক মর্মস্পর্শী আখ্যান, যাকে তিনি নিজে কল্পকাহিনী বলে উল্লেখ করেছেন। আবার এও স্বীকার করেছেন, এই কল্পকাহিনী থেকে বাস্তব ঘটনা ঘটে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার নয় এবং সে সম্পর্কে কিছু উদাহরণও তিনি অকপটে জানিয়েছেন। কল্পকথা হলেও এই আখ্যানের গভীরে লুকিয়ে আছে যে আর্তনাদ, নিষ্পত্তিহীন প্রশ্ন যা বাস্তব থেকে কখনই দূরে অবস্থান করে না। কাহিনীর কেন্দ্রে সীমু নামক এক কন্যা চরিত্র। সীমানা থেকে সীমু। যে এসেছে এই পৃথিবীতে। দেখতে পায়নি তার দুঃখিনি মাকে, যাকে কোনো দেশ জায়গা দেয়নি। দুই রাষ্ট্রের প্রত্যাখ্যানে যার জীবন ছিলো অবিন্যস্ত আর দুর্দশার পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত।

‘মানসে করে বান্দরের কাম, আর বান্দরে করে মানসের কাম’। সীমুর কণ্ঠ থেকে কি উচ্চারিত হবে- ‘কেউ যায় চলে বাঁকা দৃষ্টি ছুঁড়ে/কেউ দেয় শিস/ যেন যাদুকরের বানর আমি, আছি অহর্নিশ...। আনিসুল হকের এই উপন্যাসটিকে নাট্যে রূপান্তর করেছেন থিয়েটার আর্ট ইউনিটের তরুণ নির্দেশক সাইফ সুমন। চমৎকার মুন্সিয়ানা। সুচারু নির্দেশনায়, খণ্ড খণ্ড চিত্রে যেভাবে কাহিনীর পাতাকে মঞ্চে মেলে ধরেছেন তা প্রেক্ষাগৃহ থেকে অনায়াসেই আমাদের বিবেককে পৌঁছে দেয় সেই চেনা সংকটের বৃত্তে। আর আমরা বিচলিত বোধ করি।

নাটক শুরু হয় এক উদাসী বৃদ্ধের অদ্ভূত উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে। যে-কিনা চিন্তাক্লিষ্ট। তার স্মৃতির সারণি বেয়ে মঞ্চ পেছনে পর্দায় ভাসতে থাকে অনাগত এক আগন্তুকের দৌড়। হাতে লাল মলাটে বাঁধা খাতা। সে ছুটে চলেছে সীমান্ত সন্নিহিত হলদিবাড়ী-নলচেপাড়া অঞ্চলে এক ধূসর সীমান্তে। সীমু নামক মেয়েটির জন্মবৃত্তান্তর অমোঘ টানে। এলাকার জনমণ্ডলীর মধ্যে মিশে গিয়ে সেই আগন্তুকের বাঁধাইখাতার পাতা উল্টাতে থাকে আর উন্মোচিত হয় ঘটনার অভিঘাতগুলো, যা দর্শককে আকৃষ্ট করে। এ নাটক পুশব্যাক আর পুশইন-এর সমস্যাকে তুলে ধরেছে। ঘুমহীন রাত্রি যাপনে আর ক্ষুধায় এরা ক্লান্ত এবং জীর্ণ। এরা কারা! যাদের ধরে আনা হয়েছে সীমান্তের ফাঁড়িতে? আছে নারীপুরুষ, শিশু এমনকি গর্ভবতীও। সুযোগ বুঝে গভীর রাতে এদের পাঠাবার ব্যবস্থা করে ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’-এ এবং আশ্বস্ত করা হয় ওপারে গেলে তারা ভালো থাকবে এবং যথেষ্ট খাবারও মিলবে তাদের। কিন্তু ওপারের সীমান্তরক্ষীরাও তো প্রস্তুত। কিছুতেই তারা ঢুকতে দেয় না তাদের। শীত আর ঘন কুয়াশার মধ্যে পড়ে থাকলো একদল মানবজীব। আইনের কোপে বলিপ্রদত্ত এদের জীবন। বিপন্ন মানবিকতা। ‘মানুষ কেইবা নদীবক্ষে থাকে, থাকে পাহাড় চূড়ায়, কারাবন্দীদেরও একটা ঠিকানা আছে, আছে গন্তব্য, আছে নিশ্চয়তা। পশু-পাখিও স্বজন-সান্নিধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। কিন্তু এই ক’জনের কোনো আশ্রয় নাই’ ছন্নছাড়া জীবন এদের। বি.এস.এফ আর বি.জি.বি-র শ্যেন দৃষ্টি। কড়া অনুশাসন, একটু পিছলে গেলেই সঙ্গীন উঁচিয়ে ‘না মানুষের গ্রহে’ স্থানান্তরের হুমকি। অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশান্যল অনেক কিছু বলেছে কিন্তু তার প্রয়োগ কোথায়? নাটকে রিপোর্টার পরিমল মজুমদার তর্ক তুলেছে বিস্তর, পরিণতিতে কমান্ডারের নির্দেশে ক্যামেরা খোয়াতে হয়েছে তাকে। টেবিল বৈঠক হয়। ‘প্রতিবেশীর বন্ধুত্ব’ বেশি করে উচ্চারিত হয়। চলে চাপনউতর কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুর সেখানে কখনই বেজে উঠলো না। সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করে যখন সেই ‘না-মানুষি জমিনে’ ঘন কুয়াশার চাদরের নিচে গর্ভবতী মা সন্তান প্রসব করেই মারা যায় আর ততক্ষণে অন্যান্য সঙ্গিরা দুই সীমান্তের মধ্যে কে কোথায় অন্ধকারে উধাও হয়ে যায়। পড়ে থাকে এক মানবশিশু আর মৃত মা। এই তো সেই সীমু। কোন আইনে-কে গ্রহণ করবে তাকে?

একেবারে নিরাভরণ মঞ্চ। দুই কাঁটাতারের বেড়া প্রয়োজন অনুযায়ী ঘুরে বেড়ায়। মঞ্চ পেছনে উঁচু দুই ওয়াচ টাওয়ারে দুই পারের রক্ষাকর্তাদের দুরবিন-সহ চোখ এবং দৃষ্টি ঘোরে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। দৃশ্যগুলোও যেনো তার সঙ্গে সমতা রেখেই পরিবর্তিত হয়। আলো-আঁধারী সময়, কুয়াশাঘন মুহূর্তগুলো সুন্দর আলোক পরিকল্পনায় ও পর্দার আঁকিবুকিতে ধরা হয়েছে। একই ব্যক্তির বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান, চরিত্র ভাঙাগড়ার যে খেলা চলে, তা খুব দক্ষতার সঙ্গে এবং চরিত্রানুযায়ী সহজাত ভঙ্গিমায় থিয়েটার আর্ট ইউনিটের শিল্পীরা পরিবেশন করে গেলেন। পল্টুর কাওয়ালী বা ধ্রুপদী সংগীতের ব্যবহারে যে আবহ তৈরী হয়, তা নাটকের বিশেষ মুহূর্তকে বাঙময় করে তোলে। প্রয়োজন ব্যতিরেকে অযথা আবহের কোনো বাড়াবাড়ি নেই। নিয়মের বেড়াজালে বন্ধ অথচ সম্পৃক্ত চরিত্ররা ভীষণভাবে মানবিক হওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে কি তবু রাষ্ট্রের আইন দিয়ে মানবিকতা রোধ করা যায়? এ-প্রশ্ন চরিত্ররা বারবার উচ্চারণ করেছে। একটি ছোট দৃশ্যে বোঝা যায় ভয়েস অব জেনারেল পিপল্, যেখানে রসিকলাল ধারালো ছোরা বের করে সদ্যজাত রক্তে স্নাত শিশুর নাড়ি কাটতে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে। কিন্তু পারে না। না পারার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে সে। বুকফাটা আর্তনাদে সীমান্ত রক্ষীদের তাক্ করে বলে ওঠে যেন- কী রক্ষা করো তোমরা? এই খুঁটিগুলোকে? মানুষ মেরে তোমরা খুঁটি বাঁচাও? নাটকে আমরা আরও দেখি এক হৃদয়বান সহানুভূতিশীল সঙ্গী মর্জিনাকে। সব থেকেও যে মা হতে পারেনি। গভীর প্রত্যয়ে আর তীব্র আকাঙ্ক্ষায় অকৃত্রিম স্নেহের চোখে কাঁটাতারের গায়ে পরিত্যক্ত শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকে একরাশ বেদনা নিয়ে। উপায় নেই তাকে গ্রহণ করার। শিশুটির কান্না ভারী করে গোটা পরিবেশকে।
    
আখ্যানকার আনিসুল হক এরকম এক পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন এক নিদারুণ জাদুবাস্তবতায়। এবং যেটি আকর্ষণীয়ও বটে। সেই মানবশিশুর জন্য একটা পথ তিনি গড়ে দিয়েছেন। ‘মানসে করে বান্দরের কাম আর বান্দরে করে মানসের কাম’। এ ঘটনা যে খুব অচেনা তাও নয়। আমরা অনেক সময় খবরে দেখেছি, পরিত্যাক্ত শিশুকে রক্ষা করছে কোনো ‘মা কুকুর’, নিজের দুগ্ধ পান করিয়ে। অন্যদিকে মঞ্চে যিনি থিয়েটারকে জ্যান্ত করে তুললেন, সাইফ সুমন এবং কলাকুশলীরা, তারা সেই নিদারুণ পরিস্থিতি বা বাস্তব যন্ত্রণাটুকু মঞ্চে ধরে রেখেই সমাপ্তি টানলেন। আর এগোলেন না। রাষ্ট্রনীতি বা তাতে অন্তর্নিহিত যে রাজনীতি আছে, সেদিকে কোনো রকম দৃষ্টি নিক্ষেপ করেননি। কমান্ডান্ট বা হাবিলদার- তারাতো নিয়ম-রক্ষক মাত্র। এদের করার কী আছে? সবটাই আসে ওপর থেকে। তবুও আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, নাট্যকার-নির্দেশক ঠিক কোন জায়গায় আঘাত হানতে চেয়েছেন। নাট্য নামক কাননে নির্দেশক হলো বেড়া- যা তিনি মঞ্চচিত্রে, রূপায়ণে সুচারুরূপে করার চেষ্টা করেছেন। মধ্যিখানের বটগাছ হল টেক্সট এবং অভিনয়। এখানে আমার সামান্যতম আবেদন হলো, কিছু কিছু দৃশ্যে অভিনয় যদি আরও স্বকীয়তায় গড়ে ওঠে, তাহলে সবদিক দিয়ে ভালোর মাত্রা বৃদ্ধি পাবে বৈকি। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘না-মানুষি জমিন’ হয়তো বা একটি ‘না-ভালোলাগার’ নাটক- কারণ, এতে আছে যন্ত্রণা- যা আমাদেরই সৃষ্টি, আমাদেরই অমানবিকতা, আমাদেরই নিশ্চুপ থাকার ‘ফসল’- যা আমাদের হৃদয়ভূমিকে ধূসর করে তোলে। যার জন্য অতি-অবশ্যই দায়ী আমাদের ‘ক্ষমাহীন নীরবতা’। নিজের অপারগতার চিত্র দেখতে কার-ইবা ভালো লাগে!   

ধন্যবাদ থিয়েটার আর্ট ইউনিটকে।

বিপ্লব দে : নির্দেশক, অভিনেতা, নাট্যসমালোচক- ঋত্বিক, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, ভারত