Full premium theme for CMS
ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি এবং তারাভান যেনো আমাদের ক্ষমা না করে
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
তারাভানের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২০০৫ এর শেষ সময়ে। সাভারের পলাশবাড়িতে যখন স্পেকট্রাম ফ্যাক্টরির ভবনটি ধ্বসে পড়ে, এবং তারপর যখন আমাদের মাথা ভো ভো করতে থাকে, এবং ক্ষোভে, রাগে, হতাশায় আমরা তড়পাতে থাকি, ঠিক তখন এক নাট্যকার তার করোটির জ্বালা-যন্ত্রণার ভাষারূপ দেন। সেই রূপায়ণে সাভারের পলাশবাড়ির অসহায় গার্মেন্টসকর্মী তারাভানের, অথবা বলা যায়, কেবল তারাভানের না, ‘তারাভানদের’ জীবনচিত্র ও জীবনের ভয়াবহতা ফুটে ওঠে। তখন নাট্যকারকে বিনীত অনুরোধ করি, তার যন্ত্রণার ভাষারূপটি থিয়েটারওয়ালায় ছাপবার অনুমতি দেয়ার জন্য। তখন তিনি তা পাঠকের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্বটা আমাকে দেন। যদিও জানি, এর চূড়ান্ত প্রকাশ মঞ্চেই পাবো, মঞ্চই এর ভাষা প্রকাশের আসল পাটাতন। সেই থেকে অপেক্ষায় থাকি, আর, নির্দেশকও আমাদের অপেক্ষায় রাখেন, এইসব জ্বালা-যন্ত্রণার মঞ্চভাষা দেখার জন্য।
‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি’ নাটকটি ছাপবার পরপরই তা পাঠকের মননে অসাধারণ এক চিত্রকল্প তৈরি করে। সম্ভবত ঐ প্রথম, কোনো নাটক নিয়ে থিয়েটারওয়ালার পাঠক তাদের (ইতিবাচক) প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলো এবং নাটকটির মঞ্চায়নের অপেক্ষায় থাকার ব্যাপারটি জানিয়েছিলো। অতঃপর অপেক্ষা শেষ হয়, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যায়, জাতীয় নাট্যশালার (শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা) মূল হলে আমরা বসে পড়ি আজাদ আবুল কালামের রচনা ও নির্দেশনায় প্রাচ্যনাটের ৩০ তম প্রযোজনা ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি দেখার জন্য।
নাটকটিতে আমরা সমান্তরালভাবে এক ঘটনার দু-ধরনের চিত্রকল্প দেখতে পাই। বহুতল ফ্যাক্টরির নিচে চাপা-পড়া শ্রমিকদের কষ্ট-যন্ত্রণা, তারাভান হয় সেই কষ্ট প্রকাশের প্রতিনিধি আর অন্যদিকে প্রজেক্টরে দেখতে পাই ঘটনাচক্রে (নাকি দুর্ঘটনাচক্রে) সরেজমিনে দেখে যাওয়া ভিনদেশি আউটসোর্সিং পারসন মি. ওয়েস্টের প্রজেক্ট কমপ্লিশন রিপোর্ট পাঠ। যদিও বলা হলো ‘ভিনদেশি’ কিন্তু ‘মি.ওয়েস্ট’ নামের ব্যক্তিরা ‘কোনদেশি’ বা ‘কোন-মহাদেশি’, তা সহজেই অনুমেয়। তো মঞ্চে একদিকে চলে তারাভানের স্মৃতিচক্র, স্বপ্নচক্র আর জীবনচক্রের বেদনা-বিদূর রোমন্থন, অন্যদিকে মি. ওয়েস্টের রিপোর্টে ভেসে ওঠে এই ধ্বংসলীলার পরিসংখ্যানগত সচিত্র ক্ষয়ক্ষতি। শুরুতেই বহুতল ফ্যাক্টরির কোনো এক তলায় চাপা পড়ে থাকা তারাভানের আর্তি শুনতে পাই আমরা। সে তাকে উদ্ধার করার জন্য চিৎকার করে তার অবস্থান জানান দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কে এই তারাভান?-
খোদা তুমি একবার শুধু
দুই ছাদের মাঝখানে নামিয়া আসি
হুঙ্কার কর না কেনে-
“এই সইরে যাও ছাদ দূরে
অর কাইল বিহা সন্ধ্যার পরে।”
তারাভান যেনো খোদার হুঙ্কারের অপেক্ষায় থাকে। কাল সন্ধ্যার পর তারাভানের বিয়ে, অথচ সে আজ পড়ে আছে দুই ছাদের মধ্যখানে, পিষ্ট হয়ে। আবারও তার মুখ থেকে আমরা কথা শুনতে পাই-
কই তিনি-
নাই- কোনো গায়েবী আওয়াজ তো নাই।
কি কুক্ষণে আজ রাইত সিফট নিলোম
কি এমন হইল হেয় ছুটির দরখাস্তখান
না দিতাম- যদি না আসতাম-
মাত্র কয়েকদিনের বেতনের
আর কয়েকদিনের ছুটির কারণ
তারাভান অথবা তারাভানরা বিয়ের আগের রাতেও কাজ করে, তাদের কাজ করতে হয়। এ-সবই তারা মেনে নিয়েছিলো। অসহনীয় খাটুনির মধ্যেও ওরা স্বপ্ন বোনার নেশায় ডুবে ছিলো সারাক্ষণ, ডুবে থাকে আজীবন। তারাভানের স্বপ্নের শুরুটা কবে ছিলো?-
সেই কবে মোর জন্ম হছিল এক বৈশাখে
গাইবান্ধায় এক আছে পলাশবাড়ি
তার অন্তর ছিড়ি
পা জোড়া থামে সেইখেনে
পাড়াগাঁয়ের ঠিক যেইখেনে।
বাপের ছিল গরুর গাড়ি একখেন
আর ধান কাটার মৌসুম হলিই
অনেক দূর ধু ধু পার হয়া খিয়ারোত-
দিন যায় মাস যায় ভিটার কোনে ফরিং-এর সাথে
নচেত সকলে মিলি থানকুনি আহরণে-
আর তাকি থাকো অপেক্ষায়
উই ধু ধুর পরের ধু ধুর পানে।
একদিন ফিরি আসে বাবা
গাড়ি খান ভরি সোনালী ধান
যেন ফিলিমের গাড়িয়াল ভাই।
তারাভান সোনালী ধানের ঘ্রাণ নেয়। শুধু ঘ্রাণেই যদি পেট ভরে যেতো, তাহলে আর ফুরোতো না সেই ধান, দেখতে হতো না আর আকাল কোনো। কিন্তু তাতো হবার নয়। ধান থেকে চাল হয়, সেই চাল ভাত হতে না হতেই উবে যায়। ঘুমের ভেতর স্বপ্নে দেখা ভাতের থালায়ও যেনো এর চেয়ে দীর্ঘক্ষণ থাকে ভাত আর তকাই-ছালন-
দুই মাস তিন মাস-
বড় আদরে প্যাট পুরি ভাত খাও
আর রাত ভর আবদার স্বপ্নে নিদ যাও-
আর নয় মাস শুধু মংগা আকাল
মাটি খুড়ি কচুঘেচু আধপ্যাট খাও-
দিনে দিনে বয়স বাড়াও।
মেয়েদের বয়স-
যেমন লাউয়ের বিচিখান পুতি দাও
দুই দিন বাদে দুই পাতা উদ্ভিদ
মাস গেলি পড়ে লাউয়ের ডগা
বেড়া বায়া চালে উঠি ফুল পাও
বয়স বাড়ে আমারো।
কী অসাধারণ উপমা! কী অদ্ভুত এক চিত্রকল্প ফুটে ওঠে চোখের সামনে!
বিয়ের ফুল ফোটে তারাভানের। বিয়ে হয়-ও তার। কিন্তু তারাভানদের বিয়ে মানে তো পুতুল খেলা- ‘বিয়ে বিয়ে খেলা’। স্বামী পাগল, কোনো চিকিৎসায়ই যখন তার আরোগ্যলাভ হয় না, তখন বিয়ে ‘করিয়ে’ দেয়াই ‘একমাত্র চিকিৎসা’ হয়ে দাঁড়ায়। তারাভান আর পাগল দুজনই ‘বিয়ে বসে’ দুজনকে। ঠিক ঐ সময় তারাভানের জীবন কি, এই এখন, দুই ছাদের মধ্যে লেপ্টে থাকা যে জীবন, তার চেয়ে সুখের ছিলো? নাকি তখনও তার মাথার উপর এমনি কোনো ছাদ ধ্বসে পড়েছিলো?-
“বৌ-মাগো- মোর ছাওয়াল পাগল-
একেবারে নোয়ায়- সময় সময়
বছরে দুই চারবার- সগলে কয়-
বিহা দিলি ব্যাটা ঠিক বুঝি হয়-
বৌ-মাগো হাত দুইখান ধরি
মাফ করি দেন যেন মোরে-
এই আবদার শুধু করি
সব ঠিক হয়া যাবে নিশ্চই ক’দিন পরে।”
এরপরই আমরা তারাভানের সংলাপ শুনি- ‘আসমান ভাঙ্গী পরে বুকের পাখিটার কলিজায়’- হ্যাঁ, তারাভান কিংবা তারাভানদের মাথার উপর সব সময়ই ছাদ ধ্বসে পড়তে থাকে, আসমান ভেঙে পড়তে থাকে। ধ্বসে পড়া ছাদ সরিয়ে তারপরও ওরা কেবলি জীবনের স্বপ্নবীজ বুনতেই থাকে।
মঞ্চে, ধ্বসে-পড়া ফ্যাক্টরির নিচে চ্যাপ্টা হওয়া শ্রমিকের আর্ত-চিৎকারে, তাদের শেষ স্বপ্নও যেনো খান খান হতে থাকে। বিকট ও ভীতিকর শব্দে দর্শকসারিতে আমরাও যেনো নড়েচড়ে বসি।
তারাভান, গাইবান্ধার পলাশবাড়ির স্বপ্ন, সাভারের পলাশবাড়িতেও দেখেছিলো। প্রথমে আমরা এ-ও বুঝতে পারি যে, ‘পলাশবাড়ি’ নামে কোনো জায়গা, তার জন্মভূমি ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারে, তা-ও ছিলো তারাভানের কাছে অবিশ্বাস্য। ঠিকই তো, তারাভান-নামে নাম জগতে আরও থাকতে পারে, কামাল, সালাম, রহমত, খায়ের আরও শত-নাম জগতে আরও আরও থাকতেই পারে। তাই বলে নিজের বেড়েওঠা গাঁয়ের নামে নাম থাকবে খোদ রাজধানীর আশপাশ এলাকায়! এ-তো এক মহা বিস্ময়!-
পাশের ঘরের এক বুজান
অংপুরোর নীলফামারীত বাড়ি
ইশারায় ডাকি কয়-
‘এট্টি আয় ছেড়ি
কার অপেক্ষায় শোকে গড়াগড়ি
আয় হাত ধর
মোর সাথে কাম কর ’
‘কাম করিম ? কুণ্ঠে, কোন কাম?’
আবার ইশারায় কয়-
‘পলাশবাড়ির বস্তি থাকি দেখা যায়- দেখেন
এট্টুখানি দূরে ঐ নতুন নয়তলা দালান’
পলাশবাড়ি- মোর বাড়ি
তায়ওকি ঢাকা আছে
ঘুরি ঘুরি ঢাকা আসে?
বাকবাকুম করি ওঠে
বুকের পাখিটার ওম
কাটি যায় ধুক ধুক- মুই বাঁচোম
বাঁচোম মুই দুই পায়ে খারায়া-
এক কথায় রাজি হয়া যাই
উপায় যে নাই-
গাইবান্ধার পলাশবাড়িতে তারাভানের ‘বুকের পাখিটার কলিজায়’ ‘আসমান ভাঙ্গী’ পড়েছিলো- আর ঢাকার পলাশবাড়িতে, সেই ‘বুকের পাখিটা’ একসময় ‘বাকবাকুম’ করে ওঠে। তারাভান যেনো ‘নিয়তি’র খপ্পরে পড়ে যায়। সে আবারও স্বপ্নের জাল বোনে। আর সেই স্বপ্নই বাস্তবরূপ নিতে যাচ্ছিলো এক্ষণে। আমরাতো শুনেছিই- ‘অর কাইল বিহা সন্ধ্যার পরে’। কিন্তু ‘অর বিহা’ আমরা আর দেখতে পাই না। লাইন সুপারভাইজার ওসমানের উপর কত না ভরসা ছিলো, কিন্তু জীবনের বাঁকে বাঁকে, মাথার উপর বারবার ছাদ ধ্বসে পড়া তারাভানের (তারাভানদের) যেনো ‘নিয়তি’। বড় অদ্ভুত-সুন্দর-ভয়ঙ্করভাবে নাটকের পরতে পরতে সেসব বর্ণনা আমরা দেখতে পাই মঞ্চে। কিন্তু সেই বর্ণনায় বুঁদ হতে নিলেই আমাদের ধ্যান ভাঙে ফ্যাক্টরি ধ্বসে পড়ার বিকট শব্দে। আমরা তখন বুঝতে পারি, এই ‘বিহা’ আর হবার নয়।
তারাভান এই ফ্যাক্টরিতে, আজ রাতের নাইট শিফট ডিউটির কাল পর্যন্ত, তার আর আর-সবার হৃদয়ে সঞ্চয় করা স্বপ্নমুষ্টির কথা বলে। সেই বলার মধ্যদিয়েই আমরা বুঝতে পারি, এই একটা রাতের পর কতজনের কত রকমের স্বপ্ন, পূরণ হওয়ার অপেক্ষাতেই থেকে যাবে চিরকাল। কাল ভোরেই কত কত আলোকচ্ছ্বটা পড়তে পারতো তাদের জীবনে। কেউ কাল সকালে ছুটিতে বাড়ি যাবে বলে আনন্দচিত্তে কাজ করছিলো, কেউ ভোরে সন্তানের বাবা হবে বলে উৎসাহে শ্রম-ঘাম বিলিয়ে দিচ্ছিলো, কাল বিকালে হলুদ বরণ কন্যা সেজে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে বলে লাজুক লাজুক শিহরণে নাইট শিফট করে যাচ্ছিলো তারাভান-সহ আরও কেউ কেউ। একটাই তো রাত, রাত পোহালেই ভোরের আলো, স্বপ্নের সাথে মোলাকাত।
কিন্তু তারাভানরা এই একটা রাত আর পার করতে পারে না। জলাভূমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা অনুমোদনহীন নয়তলা ভবনটি ধ্বসে পড়ে। খসে পড়ে কিছু মানুষের স্বপ্নযাত্রার সব আয়োজন।
এভাবে যখন মঞ্চে তারাভানের অন্তিম মুহূর্ত ফুটে ওঠে, ঠিক তখন প্রজেক্টরে দেখা যায় মি. ওয়েস্ট তার পলাশবাড়ি ট্র্যাজেডির প্রজেক্ট কমপ্লিশন রিপোর্ট পাঠ শেষ করে। মুহূর্মুহূ করতালি দিয়ে মি. ওয়েস্টকে এমন একটা ‘জ্বালময়ী’ রিপোর্ট পেশ করার জন্য অভিনন্দন জানানো হয়। আমরা বুঝতে পারি, তারাভানদের জীবনদান পরিবারকে নিঃস্ব করে দিলেও তাদের জীবনদানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তৈরি হয় শত শত প্রজেক্ট, তাদের শবদেহের উপর দিয়ে চলতে থাকে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের কাজকারবার। পুঁজি বড় ‘গণতান্ত্রিক’, সে জীবন কিনে স্ফীত হয়, মরণেও তার স্ফীতি কমে না।
নাটক দেখার পর কে-ইবা মনে রাখতে পারে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি? কতক্ষণই-বা মনে থাকে এসব? এসব ভেবেই কিনা জানি না, প্রাচ্যনাট যেনো হাল ছাড়ে না। সে আমাদেরকে সচেতন করতে প্রয়াস পায়। নাটক শেষে আমরা বাধ্য হই স্পেকট্রাম ফ্যাক্টরির ধ্বংসাবশেষ ও নিহতদের রক্ত (ইনস্টলেশন) পায়ে দলিয়ে মিলনায়তন ত্যাগ করতে।
তারপরও তো তারাভানদের হত্যার বিচার হয় না, তাদের বিচারে আমরা উদ্যোগী হই না। সব সয়ে থাকার এক অদ্ভুত নীরবতায় আমরা ওম নেই। এই ওম নেয়া আমাদেরকে, তারাভান যেনো ক্ষমা না করে।
মঞ্চ আর নেপথ্যের সবাই বেশ ভালো করেছে। ভুলত্রুটি যদি কিছু হয়েই থাকে, তা মঞ্চায়ন বাড়ার সাথে সাথে কেটে যাবে আশা করি। একটি কথা মনে রাখতে হবে, যেহেতু এটি একটি কাব্য নাটক, সেহেতু সংলাপ ঠিক ঠিক ভাবে দর্শকের কাছে পৌছানোর জন্য অভিনেতৃগণকে সব সময়ই একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর একটা বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে, আবহসংগীত যেনো সংলাপকে গিলে না ফেলে।
২০১৪ সালে বেশ ক’টি সমৃদ্ধ মঞ্চনাটক আমরা পেয়েছি। ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ি এই তালিকার সর্বশেষ কিন্তু সবচেয়ে উজ্জ্বল সদস্য। প্রাচ্যনাটকে ধন্যবাদ।
হাসান শাহরিয়ার : নাট্যজন। সম্পাদক- থিয়েটারওয়ালা