Full premium theme for CMS
‘এখন আমরা হয়ে উঠেছি ওরা’- আর কত বদল চাও তুমি বাজার?
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
‘আর কত ছোট হব প্রভু, আমি কি
আমারও সমান সদরে অন্দরে
বাহিরে?- শঙ্খ ঘোষ
সত্যিই তো বদল ঘটছে বিশ্বজোড়া- ‘বিশ্বজুড়ে ফাঁদ পেতেছো কেমনে দেই ফাঁকি?’ পৃথিবীটা বদলানোর সেই মার্কসীয় স্বপ্নকল্পন ঘোষণা আজ উলটপুরাণে নাস্তানাবুদ, উদভ্রান্তিতে দিশেহারা। শুরু হয়ে গেছে বাজারের সুশীল শপথনামা- ‘বদলে যাও বদলে ফেলো’। সবার আগে মোবাইল কোম্পানি হাঁক দিয়েছিল- ‘আমরা দিন বদলে বিশ্বাস করি’।
তারপর মার্কিনী ওবামা হয়ে বাংলাদেশে নির্বাচনী দিনবদলের অঙ্গীকার। এই কি সেই negation of the negation- এর একুশশতকীয়- বদলেরও বদল ঘটার নব্যতত্ত্ব?
ছাপোষা মঞ্চনাট্যজন আর কী করে তাই! তাদেরও তো টিকে থাকতে হবে এই বাজারবিশ্বে। এমনিতেই উজাড় হয়ে গেছে মঞ্চ- দলে দলে নাম লেখাচ্ছে সবে মিডিয়ায় মিডিয়ায়। জীবিকার প্রশ্নও তো আছেই- নামযশ মালকড়ি ছাড়া চলবে কেন- তারাও তো রক্তমাংসের মানুষ, না-কি? যদিও সবাই আমরা একদিন বাস্তব এইসকল বৃত্তি-প্রবৃত্তি চেপে রেখে কত কত সব নীতি রাজনীতি শিল্পের, মঞ্চপ্রেমের উচ্চনিনাদ তুলেছি। তবু তাদের সফল একাংশ মঞ্চেও হাজিরা দেয় নিয়মিত কী অনিয়মিত। দল চালাতেও তো কর্মীদের মিডিয়ায় একটু আধটু সুযোগ করে দিতে হয়। এ না করে আজ আর উপায় নাই বুঝি! কী আর করা তাহলে? ইহাও তো বাস্তবতা। তার বিপরীতে গিয়ে কিছু করা সম্ভব কি?- তাই ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’!- এসব নিয়ে কোনো সংকটবোধ আজ তাই নেইও , তা বড়ই অপ্রাসঙ্গিক বলেই হয় তো।
তবুও তো বন্ধ্যা নয় মঞ্চ আজো! নতুন নতুন নিরীক্ষাকর্মও চলছে। সেটা বড় কম কথা নয়, বরং অনেক বড় কথাই।
ঢাকা থিয়েটার সেলিম আল দীনের পুরাণপ্রতিম প্রতীককল্প আখ্যান ‘ধাবমান’ রূপায়ণ করেছে। নির্দেশক আর নন স্বয়ং নাসির উদ্দীন ইউসুফ। মঞ্চের আমূল-সংলগ্ন ধীমতি অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ রূপকার বহুস্তরসম্পন্ন এ রচনার। এটা নিশ্চয় তাঁর দীর্ঘ প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতারই নন্দনিক সম্প্রসারণ। দর্শক-সাধারণের তাই কোনো দ্বিধা হবার কথা নয় তার এই নবীণ ভূমিকায়। অভিনয়ে যুক্ত হবেন কিনা সে নিয়ে হয়তো সংশয় ছিল কারে কারো। সঙ্গত প্রত্যাশাও পূরণ করেন তিনি- বিবেক হিসেবে অভিনয় করেন ‘ধাবমান’-এ।
নাটকের মুদ্রিত পুস্তিকায় তিনি জানান- ‘সেলিমভাই তোমার মৃত্যুশোককে পরাজিত করবো বলেই ‘ধাবমান’-এর নির্দেশনার কাজে হাত দিয়েছিলাম।’ অন্যত্র লেখেন, এ নাট্যের রূপায়ণ-পদ্ধতি নিয়ে- ‘তাই এই বিস্তারিত ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির চারণভূমি থেকে তুলে নিলাম মাদারপীরের গীত, পদ্মার নাচন, মহররমের জারী, নটপালা, লাঠি খেলা, কাছনৃত্য। নাসির উদ্দীন ইউসুফও জানান- ‘দীর্ঘ তিনযুগ সেলিমের শিল্পদর্শনরীতি, প্রয়োগ কৌশল আত্মস্থ করে শিমূল নির্দেশনায় হাত দিয়েছেন। শিমূল কৃত্যনাট্য (Ritual theatre)-এর আঙ্গিকে ‘ধাবমান’ মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন। এ রীতিতে যেমন ব্যবহার করেছেন আদিবাসী গারোদের কৃত্য তেমনি ব্যবহার করেছেন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নাট্য আঙ্গিকে ‘মাদার পীরের গীত’, মহররমের জারি, পদ্মার নাচন, কাছনৃত্য, লাঠি খেলা, নটপালা। এমনকি যাত্রার বিবেকের সাক্ষাৎ পেয়ে যাই আমরা। ঢাকা থিয়েটার, গ্রাম থিয়েটার এবং সেলিম আল দীনের যে দীর্ঘযাত্রা জাতীয় নাট্য আঙ্গিকের আলোকে, চেতনায় বাংলার নিজস্ব আধুনিক নাট্যক্রিয়া, আঙ্গিক, তার একটা প্রায় পরিপূর্ণ রূপ হয়ত পেয়ে যাবো আমরা ‘ধাবমান’- এ। ... দীর্ঘ সময় আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজ একটি রূপ পেতে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা এবং তা যদি সত্যি সত্যি ঘটে যায় তা হলে আমরা বলতে পারবো ঔপনিবেশিক শিল্পরীতি সম্পূর্ণ ত্যাজ্য করে বাঙলা নাটক দাঁড়িয়েছে তার পায়ে। এখন সম্মুখে চলার সময়।’
অথচ নাটকটি কিন্তু ঔপনিবেশিক শিল্পরীতির প্রসেনিয়াম মঞ্চেই হল- তার কোনো সম্প্রসারণ ব্যতিরেকেই। পূর্ববর্তী নিরীক্ষা পর্বে কিন্তু নানা ভিন্ন মঞ্চ গড়ে নিয়েছিলেন তারা। সেসব মঞ্চ-ব্যবস্থাপনা কি অভিনেতৃ-দর্শকের অন্যতর কোনো সম্পর্ক স্থাপনে করা হয় নি? মঞ্চস্থল দেশীয় আঙ্গিকের মৌল একটি ভিত্তিভূমি নয় কি? না কি নিত্য নতুন নিরীক্ষার উপাদান মাত্র- ‘আধুনিক’ ইউরোপীয় থিয়েটারে যেমন করা হয়? দর্শকের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো নন্দন নিহিত নেই কি পারস্পরিক পরিসর স্থাপনা বা বিভাজনে? ‘বিনোদিনী’ থেকেই দেখছি তাদের এই প্রসেনিয়ামে ফেরা। বাঙলা রীতিতে অন্তর্ভুক্ত হল কি এই ঔপনিবেশিক শিল্পরীতির প্রবর্তনা? কী তার নন্দনযুক্তি, আখ্যান-বর্ণনের কোনো নব্যন্যায় কি এর পিছনে আছে? কৃত্যনাট্য বা Ritual theatre কথাটার মানেই বা কি? এরকম কোনো আঙ্গিকরীতি আদিবাসী বা বাঙলা নাট্যধারায় ছিল বা আছে কি? এই মিশ্র-সমন্বয়ের নবসৃষ্ট নাম-পরিচয় তাহলে কৃত্যনাট্য? কেবলি আঙ্গিক ব্যবহার নাগরিক থিয়েটারে? কৃত্য কেবল বুঝি আঙ্গিক? তা বিশিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর বিষয়-দর্শনজাত অঙ্গাঙ্গী কোনো ভাবরূপায়ণ নয়? নবনিরীক্ষা ভিন্ন আর কোনো শিল্পনন্দন দর্শনের ন্যায় নিশ্চয় তার আছে। তাতে নাগরিক দর্শকের সঙ্গে সম্বন্ধপাতের বিবেচনাও তো থাকার কথা। স্বদেশীয় জনসমাজ আর তার ভাবমানসলোকের সঙ্গে বিদেশীর ন্যায় সম্পর্কহীন অপরিচিতা নাগরিকজনের মনে কী অভিঘাত হয় তাহলে এই মিশ্র থিয়েটারি রূপায়ণে? সর্বপ্রাণবাদিতার সঞ্চার ঘটাতে কি অবলম্বিত এহেন আঙ্গিক-রীতি? নাগরিকজনের যৌথমানস স্মৃতিভাণ্ডারে এর কোনো সংলগ্নতা আছে তো?- এই নবভাব-ভাষায় দর্শকের সঙ্গে নান্দনিক সংযোগসূত্রের সন্ধানই তো অন্বিষ্ট। তাহলে বলা যায় কি ঔপনিবেশিক শিল্পরীতি সম্পূর্ণ ত্যাজ্য করে বাঙলা নাটক দাঁড়িয়েছে তার পায়ে?
‘ধাবমান’ প্রযোজনা নানা মিশ্র আঙ্গিক আত্মস্থ করে অভিনব এক নাট্য হয়ে উঠেছে- সঙ্গীত-নৃত্য-বাদ্য-বর্ণনা-অভিনয়ের অদ্বৈতে। ‘চারদশকেরও অধিক সময় শিল্পের যে জমিনে শিমূলের বিচরণ সে পরিভ্রমণে রয়েছে ধ্রুপদ ও ঐতিহ্যবাহী নাট্য ও সঙ্গীত রীতির অভিজ্ঞতা’- নির্দেশক বিষয়ে নাসির উদ্দীন ইউসুফের এই অভিমত সঙ্গত মনে হয়। নৃত্য-সঙ্গীতময় গতিছন্দে, ব্যালেপ্রতিম স্বাচ্ছন্দ্যে এই নাট্য রূপায়িত। এ আখ্যানের ভাষাও তার অলংকারভার ছেড়ে নির্ভার শ্রুতিসম্মত হয়েছে। যেন তা নতুন এক নাট্যভাষা সকল কাব্যভাবদর্শন ধারণ করেও। বর্ণনা-সংলাপ-কথার এই ভাষার প্রতীক্ষাই তো করেছিলাম। অবশেষে তার সাক্ষাৎ মিললো। কথক-অভিনেতৃবর্গ অনায়াস স্বাচ্ছন্দে কথ্য বাকস্পন্দে তা বলে গেছেন। আখ্যানের জটিলতার সঙ্গে দর্শকের তাল মেলাতেও আরাম লেগেছে। শারীরমুদ্রাদিও ছন্দোময় হয়ে অঙ্গাঙ্গী নৃত্যলাবণ্যে পাখা মেলেছে।
বিরাট এক বাস্তবোত্তর পুরাণপ্রতীক এ আখ্যানের। তার কেন্দ্রে তো নগদি-গারোদের ‘হাজার বছরের সংঘাত-যুদ্ধ-ধর্মান্তর প্রক্রিয়ার বাস্তব। তাই তো পাহাড়ি গয়াল কর্তৃক হামেলার ‘গর্ভধারণ’ নিয়ে যে নাট্য-বীজ তার প্রতীককল্প মাহাত্ম্য। অথচ এই পটভূমি সেই মর্যাদায় গৃহীত হয় না প্রযোজনায়। আখ্যানের নানা ঘটনার ভিড়ে একটি মাত্র প্রায় নগণ্য হয়ে পড়ে। তাই কেবলি জাতি-ধর্ম-বর্ণ সমন্বয়ের সর্বপ্রাণবাদী ইচ্ছাপূরণের কল্পকথায় ভেসে যায় প্রযোজিত আখ্যান। সেলিম আল দীনের রচনায় ক্রমে যে রাজনীতিহীনতার অভিযোগ ওঠে সেটাই গ্রহণযোগ্য, ন্যায্য হয়ে যায় যেন। ঢাকা থিয়েটার আর নির্দেশক শিমূল ইউসূফ ভাববেন কি এই বিপদটি নিয়ে? নইলে যে এহেন মহাকাব্যিক সমগ্রতা সম্পন্ন নান্দনিক আখ্যান খণ্ডিত হয়ে তার মাহাত্ম্য হারায়।
তবে অভিনেতৃবর্গ একটি যূথ ভাব-অভিনয়-নৃত্য-সঙ্গীত ছন্দে অদ্বৈত কুশীলব হয়ে উঠেছে এ নাট্যে। এষা যে প্রধান চরিত্রে নবাগতা কখনোই তা মনে হয় না। সোহরাবের মতো এক বয়ার বা ষণ্ডমহিষের মানব-মানবোত্তর রূপায়ণ সহজ কথা নয়। হামেলা চরিত্রটি তো আদি এক যুগপৎ মানব-প্রাণী হয়ে উঠেছে। তাতে নারীর অন্তঃস্থ ঋজু দার্ঢ্য পৌরাণিক শক্তিমত্তা লাভ করেছে। জয়শ্রী বন্দোপাধ্যায়ের মঞ্চ-অভিজ্ঞতা আছে জানি, কিন্তু সে তো প্রথাগত প্রচলিত চরিত্রাভিনয়ের। ‘ধাবমান’ নাট্যের অভিনয়ে তার পুরাণপ্রতিম হয়ে ওঠা বাংলাদেশের মঞ্চে এক ঘটনাই বটে।
সব মিলে শিমূল ইউসুফের নন্দনসিদ্ধি বিস্ময়-সম্ভ্রম জাগায়। এই অকালে ঢাকা থিয়েটার তার অর্জিত মহিমায় নব-উদ্ভাসনে ভাস্বর।
রতন সিদ্দিকী রচিত আর আজাদ আবুল কালাম নির্দেশিত উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর ‘হাফ আখড়াই’ ভালো প্রযোজনা। বাংলা নাগরিক গানের প্রবাদপুরুষ নিধুবাবু প্রধান চরিত্র এ নাট্যে। তৎকালীন বাস্তবতায় তাঁর সঙ্গীত রুচিমনের ভিন্ন প্রবর্তনা নিয়ে গঠিত আখ্যান। এরিনা মঞ্চরীতিতে এ রূপায়ণ সঙ্গত এ মঞ্চভাষায় বেশ লাগসই লাগে। মঞ্চ ব্যবহার ও অভিনেতৃ সংস্থাপনা নাট্যে গতিসঞ্চার করে ভালোই। চরিত্রাভিনয়ও আতিশয্য ব্যতিরেকে সংযত মাত্রায় সম্পন্ন। তাতে পরিমিত স্টালাইজড বা রূপারোপ মেলানো হয়েছে। মৌল নাট্যদ্বন্দ্বক্রিয়াটিই কেবল গোলমেলে, অনৈতিহাসিক। নিধুবাবু এ নট্যে উচ্চশ্রেণীর বাবুবিলাসী রক্ষণশীল সঙ্গীতকার। অথচ ঘটনা হলো, তিনি বাংলা ধর্মীয় ভাবগানের প্রথা থেকে মানবিক বাস্তব প্রেমভাবরসে মুক্তি দিয়ে অভিনব নাগরিক গানের প্রবর্তনা ঘটিয়েছেন। তাকেই কিনা ভিলেন বানিয়ে রচিত হয়েছে আখ্যান। হাফ আখড়াইয়ের চটুলতা কলকাত্তাই নাগরিক নিম্নরুচির স্বল্পস্থায়ী অনুষঙ্গ হয়েই ছিল। বাংলা গানের ঐতিহ্যধারায় তার পরিচয় ক্ষতিষ্ণুতায় চিহ্নিত। সেটা জনসমাজের কোনো সম্প্রসারিত সঙ্গীতধারার মর্যাদা পায় নি। ঔপনিবেশিক বিকারের অঙ্গাঙ্গিকতায় তার জন্ম ও বিলয়। বাংলা গানের দীর্ঘ ঐতিহ্যে তার তেমন কোনো সাঙ্গীতিক নবভাবমূল্যও ছিল না। নাট্যকার তার সরল ইচ্ছাপূরণের এক গণঝোঁক আরোপ করেছে কাহিনীতে। নিদের্শকও এই ভুল, অনৈতিহাসিক ছদ্ম বিপ্লবীপনার ফাঁদে পড়েছেন। নাটক শুরুই করেন তিনি অপূর্ব রাগালাপের সঙ্গীতমূর্ছনা চিৎকৃত বেসুরো খিস্তিখেউড়ে ভেঙেচুরে। রচিত নাটকের ধরতাই থিমমিউজিক এমত নাটকীয়তায় সম্পন্ন করেন। ভুল এই ব্যাখ্যা-ঝোঁক প্রযোজনার সমস্ত কৃতিত্বকে অন্যায্য ম্লান করে দেয়। ডিরোজিওর মৃত্যুর বছর দুই পরের সময়কাল এ নাটকের। ইয়াং বেঙ্গলদের বিপ্লবী ভাষা, লম্ফঝম্ফও শোনা যায়। স্বাধীনতার পতাকাও নাকি ওড়ায় তারা। তবে কোন দেশের কাদের সে স্বাধীনতার পাতাকা? সম্ভবত ফরাসী বিপ্লবের সমর্থনসূচক সাম্যমৈত্রীর আন্তর্জাতিক পতাকা সেটি। কলকাতার মনুমেন্টে না কি ফরাসী উপনিবেশ চন্দন নগরে তা ওড়ানো হয়? কিছুই তা বোঝা যায় না- ডিরোজিওর নামটিও নেয় না তার ভক্তশিষ্য ইয়ং বেঙ্গলেরা। এই বিপ্লবীয়ানার সঙ্গে মেলানো হয় আফ আখড়াই সঙ্গীতকে- যেন তা এক গণজাগরণের গণসঙ্গীত। সেই সঙ্গে নিধুবাবুর প্রতিক্রিয়াশীলতা নিয়ে কাল্পনিক কাহিনী ফাঁদা হয়। আখ্যানের সমস্তটাই আজকের দিনের সরল রাজনীতি-সংস্কৃতির সম্পর্কের বানানো বয়ান। তারই রোখে নাটক শেষ হয় নিধুবাবুর আশ্চর্য স্বদেশী ভাষাপ্রীতির অমর পঙক্তি- ‘বিনে স্বদেশীয় ভাষা মিটে কি আশা’- বদলে গণসঙ্গীতের ভাষায়। তাতে মধুর এই সুর-ভাষার গান প্যারডি-জিঙ্গেল হয়ে ওঠে। নাগরিক মনে মিথতুল্য এই গান এভাবে রূপান্তর করা হয়- বিপ্লবীপনার ছেলেমানুষী হঠকারিতায়। খুব মন খারাপ লাগে। কবে যে সাবালক হবে সংস্কৃতির এই রাজনৈতিক নন্দন-বিবেচনা। রূশ ঝদানভের ভূত এতটাই শিকড় গেড়েছে- একুশ শতকেও তা চেপে আছে মাথায়। অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি যা বাতিল ত্যাজ্য করেছিল গতশতকের ৬০- এর দশকেই।
নিধুবাবুর ভুল চরিত্রে তবু ভালো অভিনয় করেছে রতন দেব, তার প্রতিবাদী শিষ্যের ভূমিকায় আনোয়ারও। অনেকেই ভালো করেছে।
পালাকার স্টুডিও থিয়েটার করে কামালউদ্দিন নীলুর নির্দেশনায় ‘রিকোয়েস্ট কনসার্ট’। সংলাপ-হীন নির্বাক একক অভিনয়ে রোকেয়া রফিক বেবী। নীলুর প্রযোজনায় চমক থাকে কোনো না কোনো। এবারও তাই। ছোট স্টুডিও জুড়ে হাল ফ্যাশনের গ্যাজেটসহ সিঙ্গেল রুম- বাইরে তার জানলা থেকে দর্শক দেখবে ঘরের ভিতরের একলা মধ্য-বয়স্কা নারীটি কী কী সব করে। বেশ একটা ফুটো দিয়ে ঘরের গোপন কায়-কারবার দেখার অবৈধ পুলক জাগে বুঝি দর্শকের- সেটাই কি চাওয়া হয়েছিল? ইউরোপীয় কত যে ফন্দিফিকির আছে অভিনবত্বে চমকে দেবার। বাইরে থেকে ঘরে ঢুকতেই বেশ চেনা লাগে নারীটিকে- তার বয়স, শাড়ি, মেক-আপ আর তার রুমের চেহারা সুরত দেখে। টিপিক্যাল এক নারীবাদী এনজিও উচ্চ কর্মকর্তার আদলে আমাদের চেনাজানার চরিত্র হয় সে শুরুতেই। ঘরে ফিরে তার ক্রিয়াকলাপ, রকম-সকমও পরিচিত লাগে কী কী ভাবে যেন- মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের কল্যাণেই বুঝি। বাজারি স্বাচ্ছন্দ্যের হরেক চেহারা রোজই তো দেখতে হয় আমাদের। তারপর নারীটির টিভি ক্যাসেটের বিচিত্র চয়েজ, ওয়াশ রুমে যাওয়া, পোশাক পাল্টানোর শূচিবায়ুগ্রস্ততা থেকেই তার যাপনের আত্মরতির পুলক বিকার, নিজের থেকে পালিয়ে কল্পমত্ত ঘোর তৈরির বাস্তবতাও বেশ যথা অনুপুঙ্খে নির্দেশক-অভিনেত্রী করে চলেন। এই বানানো ছদ্ম বিভ্রাম-মায়া ভেঙে যখন খানখান হয় একটি ফোনের সংবাদে- তখন গানের নির্বাচন ক্রমে পাল্টাতে থাকে- তরী আমার হঠাৎ ভেসে যায়; যে প্রক্রিয়ায় পৌঁছে যায় সে তার সত্তার এমন কেন্দ্রে, যার থেকে অনিবার্য হয়ে ওঠে আত্মহনন। সম্পর্করহিত অমানব নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে। সবটা বেশ লাগসই নির্বাচনে সম্পন্ন করেন নির্দেশক ও অভিনেত্রী। এমনকি জানালায় মুখ লুকিয়ে অন্য দর্শকের মুহুর্মুহু প্রতিক্রিয়া অভিব্যক্তি, তার রূপ-রঙ-ভঙ্গি বদলও যেন অন্তর্ভুক্ত হয় এ নাট্যে। এভাবে প্রতি দর্শকও যেন অন্য দর্শকের কাছে নাট্যক্রিয়ার চরিত্র হয়ে যায়- যেন আমরা অজান্তে মাঝে মধ্যে অন্য দর্শকদেরও দেখি নাট্যদর্শনের নিবিষ্টতায়। অদ্ভুত এক অঙ্গাঙ্গী, সম্মিলিত নাট্যক্রিয়ার যুগপৎ যৌথ ও এককতার মজা তৈরি হয়। জানতে ইচ্ছে করে এই সৃজনকল্পনা-বুদ্ধি কে প্রথম করেন কোন দেশ-কালে, সে কে? তা যারই হোক, কামালউদ্দিন নীলু আর রোকেয়া রফিক বেবী জম্পেশ এক থিয়েটার তৈরি করেছেন- আমাদের অভিনব এক অভিজ্ঞতা হোল। এই নাট্যের অভিনেত্রী সম্ভবত এই চরিত্রের সঙ্গে আত্মশনাক্ত করেছেন এমনই - যা আগে কখনো এতটা হয় নি তার কোনো অভিনয়ে। এই আত্মপ্রকাশটা ঘটাতে না পারলে কেন তবে করা অভিনয়? মিথ্যা মিথ্যা কতকগুলো অভিনয় করা কেবল? জীবনে সবসময়ই তো তা করতে হয় আমাদের। তার জন্য আবার এত আয়োজন কেন? নাটক করা বা দেখা কেন তবে, কী পেতে? মঞ্চ তো কিছু সত্যি দেখা, করা, আর উদঘাটন, উন্মেচনের জায়গা। তবেই তো শিল্প হয়ে উঠবে নাটক- চাপাপড়া নিহিত, না বলা না জানা সত্যিগুলো কেমন করে সত্যিকারে তুলে ধরা যায় অভিনয়ে, নাটকে- টেকনিক, ফর্ম তো তারই খোঁজ করে চলে।
মাইমোড্রামা প্রথম দেখি ফ্রান্স-প্রবাসী পার্থপ্রতিমের নির্দেশনায় গত শতকের শেষ দশকে। জগৎবিখ্যাত মূকাভিনেতা মার্সেল মাসোঁর কাছে শিখেছেন তিনি এ বিদ্যা। বাংলাদেশে উৎসাহীজনকে কর্মশালা করিয়ে নির্মাণ করেন তিনি তার সেই মাইমোড্রামা। জাহিদ রিপন সেখানে অংশ নিয়েছিলেন। এবার তিনি তার প্রয়োগ করেন। জিল্লুর রহমান জনও অনেক আগে থেকে করে আসছিলেন মূকাভিনয়। দলীয়ভাবেও করেছেন বেশ কিছু মাইম-শো। তবে রিপন এটি বড় করে মঞ্চে নিয়মিত করার কথা বলছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্বের শিক্ষার্থীকাল থেকেই তিনি ফরিদপুর থিয়েটারে নানা ধরনের নাট্যক্রিয়া করেছেন। পরিবেশ থিয়েটারও করেছেন। উদযোগী নাট্যজন রিপন নিয়মিত নানাধরনের নাট্যচর্চার লেগে আছেন। বাদল সরকারের ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ থার্ড থিয়েটার রীতিতে সফলভাবেই করেন। নাগরিক এক বর্ণনাত্মক রীতিতে ‘কাজলরেখা’, রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, নজরুলে’র ‘পদ্মগোখরা’ করেন। এসব ছিল সেলিম আল দীনের তাত্ত্বিক প্রয়োগ। সবগুলো তত লাগসই হয় নি যদিও। ‘কাজলরেখা’ বুঝি খাপ খেয়েছিল লোকরীতির এই আধুনিক মঞ্চায়ন কল্পনায়।
মাইমোড্রামা ‘জাদুর প্রদীপ’ আরব্য রজনীর কাহিনী। একজন সূত্রধারের মতো কথা গানে বর্ণনায় কাহিনীর সূত্র ধরে। তাতে একটু জগাখিচুড়ি লাগে। এর ব্যবহার কমানো দরকার। মূকাভিনয়ের রীতিতেই বর্ণনা করা যায় কীভাবে তা বের করতে পারলে ভালো হয়। সূত্রধারের অত ব্যাখ্যা বাদ দিতেই হবে। বাংলা নানা প্রচলিত কথা-কাহিনী একালের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে মেলাতে পারলে মাইমোড্রামা নিয়মিত করার একটা অবলম্বন পাওয়া যায়। মূকাভিনয়ের দেশীয় উৎস-সূত্র কী কী ছিল বা আছে তা নাগরিক মঞ্চে কীভাবে প্রাসঙ্গিক করা যায় ভাবতে হবে। ‘বহুরূপী’ বলে গ্রামদেশে একদা এক রীতি ছিল- তা বুঝি লুপ্ত হয়েছে- কোনো অবশেষ কোথাও আছে কিনা তার খোঁজ করা যায়। রিপন এ নিরীক্ষা শুরু করে ভালো করেছে- প্রকাশের আরেক সম্ভাবনা আছে মনে হয়। মুস্তাফা মনোয়ার যেমন পাপেট নিয়ে করেছেন। যদিও তার নিয়মিত চর্চা করা হয় নি। টেলিভিশনে তার বরং নানা বিজ্ঞাপনী ব্যবহার হয়েছে। মঞ্চে এটা বিশিষ্ট এক মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হতে পারেতো- কেবল ছোটদের জন্যই নয়।
রিপন ও তার স্বপ্নদল মাইমোড্রামা নিয়ে যদি সৃজন-সাহস নিয়মিত চর্চা হিসেবে করতে পারে তাহলে একটা নতুন মাধ্যমের সূচনা হতে পারে।
এবার একটি নাট্যঘটনার কথা বলা যাক।
শিল্পকলা একডেমী ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য উৎসব ও কর্মশালা আয়োজন করে। তাতে কয়েক অঞ্চলের কটি রীতি প্রদর্শিত হয়। তার কিছু অল্প দিনের ফরমায়েশে অদক্ষদের দ্বারা নির্মিত মনে হয়। সেগুলোতে বাংলা সিনেমার এমন সংক্রমণ, বোঝা যায় এরা দীর্ঘদিন সে রীতির স্বভাব-শক্তির চর্চাকারী নয়। যেগুলো রীতির স্বকীয়তা শক্তি অক্ষুন্ন রেখেছে, তাদের পাশে এগুলোর দিনকয়েকে তৈরি করা ভগ্নদশা বড়ই বেমানান হয়েছে। নড়াইলের ‘অষ্টক’, নেত্রকোণার ‘মনসা’-র অন্যতর পাঠ বা হাজংদের নিজস্ব নাচগানে স্বকীয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নির্বাচনে তাই আরও সাবধান হতে হবে। অভিজ্ঞ লোক দেখে যেন তা করেন। না হলে নাগরিকজনের কাছে ছোট হয়ে যাবে বাংলারীতি। বদনাম হবে তার।
কর্মশালায় ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগরের নাট্যকলা শিক্ষার্থীরা ও গ্রুপ থিয়েটারের উৎসাহী নবীন নাট্যজন অংশ নেয়। তারা দেশীয় নানা রীতির নানা কিছু নিয়ে এ কদিন প্রশিক্ষণ নিয়েছে আর সন্ধ্যায় মঞ্চে পরিবেশনা দেখেছে। এই দুই অভিজ্ঞতা মিলে একেকটি দল একেকটি লেখা দাঁড় করিয়েছে। সেটা উৎসব শেষে সেমিনার করে পড়া হয়েছে, আলোচনা হয়েছে। নবীন নাট্যজনের ভাবনা-চিন্তা-লেখন আশা জাগায়। নিজস্ব, দেশজ, বর্ণানাত্মক প্রভৃতি শব্দের মধ্যে ঘুরপাক না খেয়ে নানাভাবে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা হয়েছে। তর্ক-বিতর্কও হয়েছে। বেশ জীবন্ত মনখোলা বাহাস যাকে বলে। চর্বিত চর্বণ ঠিক নয়।
তাই বলা যায় ‘তবু আশা, যেন মাতৃভাষা, চিরায়ূস্মতী তন্বী’।
ড. বিপ্লব বালা : নাট্যশিক্ষক, নাট্য-সমালোচক