Full premium theme for CMS
কাঠগড়ায় সম্পাদক, সম্পাদকের জবানবন্দি
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
সমালোচনায় আমরা সবাই বিশ্বাসী, সমালোচনার প্রতি আমরা সবাই শ্রদ্ধাশীল।
বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা না করলে পাছে সমালোচিত হতে হয়, এই ভয়েও অনেকে সমালোচনা বিশ্বাস করি। তবে এ-ও ঠিক, সমালোচনার ভালো অংশটুকু ভালো লাগে, খারাপটুকুতে, মনে মনে, সমালোচককেই সমালোচনা করতে থাকি। এই যে বলা হলো, ‘মনে মনে’, এটাও সবসময় ‘মনে মনে’ থাকে না। কখনো কখনো প্রকাশ্যরূপেই প্রকাশ পায়। নাটক শেষেই জানতে চাই- কেমন লাগলো? যদি বলে বেশ লেগেছে, তাহলে নিজেরও ‘বেশ’ লাগে- ওনার মতো নাট্যবোদ্ধা বলছে ভালো লেগেছে- আর কী লাগে! কিন্তু যদি বলে- ভালোই, তবে ... তখনই লাগে খটকা, মনে মনে বলি- ভালোই এর পর আবার ‘তবে' মানে!- ব্যাটা তুই নাটকের বুঝিস কী?
‘এদেশে নাট্য সমালোচনা ঠিক ওভাবে তৈরি হয়নি’- কথাটার বেশ চল আছে। কথাটাতে সত্য-মিথ্যার মিশেল আছে। আমাদের থিয়েটারে নাট্যসমালোচনা হচ্ছে, এটাও কম কথা না। অনেকেরই ধারণা, আগে বেশ ভালো ভালো নাট্যসমালোচনা হতো, এখনকার সবাই গবেট, নাটক বোঝে না, অথচ কলম ধরে- স্পর্ধা আছে বটে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, আগেও যেসব সমালোচনা হয়েছে, সেগুলোর ‘ভালোচনা’টুকুই ভালো লেগেছে সবার, সমালোচনাটুকু না। এখনও তাই। সমালোচক কারো নাটক নিয়ে ভালো কিছু লিখলে, ভালোর অংশীদরীদের ভালোই লাগে, মনে মনে, বা এক্ষেত্রে প্রকাশ্যেই বলে- ব্যাটা নাটক বোঝে বটে। কিন্তু যখনই ঐ একই সমালোচক অন্য নাটক নিয়ে ‘ভালোচনা’ না করে ‘সমালোচনা’ই করে, তখনই মাথায় বাজ পড়ে, বলে- ব্যাটা পারলে করে দেখা। দর্শক নাটকের লক্ষ্মী, দর্শকের সমালোচনা তাই শুনতে ইচ্ছা করে সবারই। আশ-পাশ থেকে ফিসফিস শব্দে যখন শোনা যায় দর্শক বেশ ভালোই বলছে নতুন নাটকটিকে, তখন আনন্দ যেনো বাধ সাথে না, জায়গা-বেজায়গায় বলে বেড়ানো হয়, সমালোচক কী বললো না বললো তাতে কী আসে যায়, দর্শকতো ভালোভাবে নিচ্ছে। তারপরই হয়তো শোনা গেলো দর্শক, কেউ কেউ, ঠিক যুৎ মনে করছে না নাটকটিকে, তখনই বের হয় আসল চেহারা- দর্শকের কথা বাদ দে, দর্শক ব্যাটা বোঝে কী?
কিন্তু এ-ও তো বিবেচনায় নেয়ার মতো কথা, সমালোচক যা বলে তা-ই কি সত্য? এ-তো দর্শক হিসেবে একজন নাট্যবোদ্ধার প্রকাশমাত্র। তিনি নিজে কি মনে করেন, নাটক নিয়ে তিনি যা বলছেন, তা-ই স্বতঃসিদ্ধ? যদি তাই মনে করেন, তবে বিষয়টা বেশ ভয়াবহ। আর যদি মনে না করে থাকেন, তাহলে বলতে হয়, তার সমালোচনারও যদি সমালোচনা হয়, সেটাও তিনি গ্রহণ করবেন বিনয়ের সঙ্গে। অর্থাৎ কেবল নাট্য-নির্মাতারাই নন, নাট্যসমালোচককেও সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড়াবার মতো মেরুদ-ওয়ালা হতে হবে। তা নাহলে বিপত্তি ঘটে তার, যে কিনা এই সমালোচনা ছাপবার দায় নেয়। বেশ ভালো বোঝা যাচ্ছে, এখানে আরেক ‘আসামী’ হাজির হচ্ছে- পত্রিকার সম্পাদক। অন্য কোনো সম্পাদকের কী অবস্থা, তার বিশেষ কিছু আমার জানা নাই, কিন্তু বক্ষমাণ সম্পাদকীয়র সম্পাদক বেশ বিপাকে পড়ে মাঝে মাঝে, এটা সহজ-অনুমেয়।
ঐ যে বলা হলো, এদেশে নাট্যসমালোচনা ঠিক ওভাবে তৈরি হয়নি- তার সত্যতা ধরেই থিয়েটারওয়ালা বেশ কিছু নাট্য সমালোচনা তৈরির প্রয়াশ নিয়েছিলো। দেশের প্রধান নাট্যকার-নির্দেশক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে মঞ্চে আসা নাটকের নির্দেশক-নাট্যকার-ডিজাইনারদের মুখোমুখি করিয়েছিলো দর্শকের সামনে, এই দর্শকের কাতারে নাট্যসমালোচকেরাও ছিলেন নিঃসন্দেহে। বেশ আগ্রহের সাথেই সবাই অংশ নিয়েছিলো ঐ আয়োজনগুলোতে। নাটক নির্মাতাদের সাথে দর্শকের মিথষ্ক্রিয়া বেশ ফলপ্রসূও হয়েছিলো। সবাই সবার কাজের ব্যাখ্যা দিয়েছে, আলোচনা করেছে, করেছে সমালোচনাও। তার কিছুটা গ্রহণ করা হয়েছে, বর্জনও করা হয়েছে অনেক কিছু। এ-ই স্বাভাবিক, দর্শক বুঝেছে, সে যা বলছে তা-ই চরম সত্য না, নাটকনির্মাতারাও বুঝেছে, কিছু কিছু জায়গায় তাদের আরও কিছু করার আছে। ফলে এক আনন্দঘন পরিবেশে শেষ হয়েছে ঐ আয়োজনগুলো। সেই আয়োজনগুলোর কথাবার্তা পরবর্তী সময়ে থিয়েটারওয়ালায় প্রকাশ পেয়েছে, ওগুলো নাট্যসমালোচনার পদমর্যাদা পেয়েছে কিনা জানি না, তবে ওসব নিয়ে সম্পাদককে কোনো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
কিন্তু সমস্যা হয় যখন কেউ এককভাবে নাট্যসমালোচনা লেখেন আর সেগুলো প্রকাশ পায় পত্রিকায়। নাট্যসমালোচনার সংস্কৃতি যেহেতু কম, তাই এই নিয়ে লেখার মানুষজনও কম। তবুও নিজ উদ্যোগে, জানা-শোনা মানুষজনের কাছে গিয়ে, তাদের নাটক দেখিয়ে একটা সমালোচনা উদ্ধার করার প্রবণতা নিজের মধ্যেই তৈরি হয়েছে। তাদের, কেউ কেউ, বেশ জোর দিয়েই জানান দেন, লেখার ব্যাপারে লেখকের স্বাধীনতার বিষয়টা। লেখার ব্যাপারে লেখককে স্বাধীনতা দেয়া যাবে না, এমন কথা কোনো পরাধীন সম্পাদকও বলবেন না। কিন্তু কথা থাকে, যিনি স্বাধীনতা চান, তিনি স্বাধীনতার কতটুকু মর্যাদা রাখতে পারবেন সেটা নিয়ে। একটি নাটকের সমালোচনার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, ভালো-মন্দ মিলিয়ে নাটকটি যা দাঁড়ালো, তাতে দর্শক যেনো নাটকটি দেখতে আসে। সমালোচনার উদ্দেশ্য মোটেই তা না যে,- এটি এমন এক ‘ভয়াবহ’ নাটক, যেটি কোনোভাবেই দর্শকের দেখা উচিত না। মোদ্দা কথা, নাটকটি দেখে এর শিল্পগুণ সমালোচককে এতটুকু নিশ্চয়ই আকৃষ্ট করেছে যে, নাটকটি নিয়ে তিনি ভালো-মন্দ কিছু বলতে চান। এবং এ-ও চান, তার দেয়া ‘আলোচনায়’ নাটকটি আরও সমৃদ্ধ হবে, এবং নিশ্চিতভাবেই দর্শকপ্রিয়তা পাবে। এভাবেই অনেক নাট্যসমালোচনা প্রকাশের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে থিয়েটারওয়ালার পক্ষ থেকে। যেসব সমালোচনার পুরো দায়ভার সম্পাদককেই নিতে হয়। সেই দায় থেকেই সমালোচনা পড়ে অদৃশ্য খড়গ পড়ে সম্পাদকের কাঁধে। অনেকেরই ধারণা জন্মায় সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে নাটকটির সমালোচনা লিখিয়ে সম্পাদক নাটকটির বারোটা বাজাতে চাচ্ছেন। গাঁটের পয়সায় পত্রিকা ছাপিয়ে নিজের বারোটা বাজিয়ে কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অন্যের ‘বারোটা বাজাবো’ সেটি বোধগম্য না হলেও, এটা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও থাকে না। উপায় থাকে না, কারণ, লেখাটি ছাপাবার আগে নিজে দর্শক হিসেবে নাটকটি যেভাবে দেখেছি, সমালোচনা দেখে নিজেও নিজেকে মানাতে পারিনি যে, এটি একটি ভালো সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তারপরও ছাপতে হয়, কেননা, লেখকের স্বাধীনতা বলে কথা। কোনো কোনো রবীন্দ্রনাটকের সমালোচনায় সমালোচক এমনও উপসংহারে উপনীত হন যে, নির্দেশক ও কলাকুশলীদের রবীন্দ্রসাহিত্য স্বল্প হলেও পড়াশোনা করে নাটক করা উচিত। ‘পড়াশোনা করা উচিত’ কথাটা ভাবার আগে নিজে একবারও ভেবে দেখছেন না যে, ওদের রবীন্দ্রসাহিত্য পড়া থাকতেই পারে। পড়া যে আছে তার প্রমাণ তো এই যে, অন্য সমালোচক একই নাটক নিয়ে বলেন- এটি হচ্ছে একালের রূপকথা, রবীন্দ্রনাথের নবায়ন, এক স্মরণীয় প্রযোজনা।
আবার কারো কোনো নাট্যসমালোচনায় এমন কিছু প্রশংসা, যা কিনা নাটক দেখার পর দীর্ঘ আড্ডায় উনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন- কেনো ঐ নাটক আসলে কোনো নাটকই না। যেটি আসলেই কোনো নাটক হিসেবে দাঁড়ায়নি (তার ভাষায়), সেটির নাট্যসমালোচনা কেনো লিখতে হবে তা বোধগম্য না, আর যদি লিখতেই হয় সেটি আবার ঐ নির্দেশকের সেরা অর্জনগুলোর একটি-ই বা হয় কী করে (নাট্যসমালোচনায় উপসংহারটা অনেকটা এভাবেই টানা হয়েছিলো)? এতসব কিছুর স্বাক্ষী হয়েও লেখা না ছাপিয়ে উপায় থাকে না- লেখকের স্বাধীনতা বলে কথা! লেখকের আরও স্বাধীনতা আছে, সবার নাটক নিয়ে তারা লিখতে চান না। অনেক অনুরোধ করেও তাদের কাছ থেকে সব নাটকের, সবার নাটকের সমালোচনা আদায় করা যায় না। কারণ, বাংলাদেশের থিয়েটার জগতের পরিসর বেশ ছোট, ঢাকার থিয়েটারের কথা বললে তা আরও সংকীর্ণ। এখানে সবাই সবার চেনা-জানা মানুষ। কোনো বিষয় নিয়ে কারো ব্যাপারে লেখাটা বেশ সমস্যাই বটে (যেহেতু সমালোচনাগ্রহণপ্রবণতা প্রায় শূন্যের কোটায়)। সেজন্যই বোধহয় কোনো কোনো নাটক নিয়ে জোর তদ্বির করেও অনেককে দিয়ে লেখানো যায় না। তাদের সাফ কথা- নাটকটি ভালো, তবে কিছু কথা আছে যা ওরা (নির্মাতারা) গ্রহণ করবেন না। শুধু শুধু বন্ধুত্ব নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। ভালো কথা, বন্ধুত্ব নষ্টের ভয়ে বন্ধুর সৃজনশীলতা নষ্ট হোক, সেটা ‘বন্ধু’ হিসেবে তিনি চাইতেই পারেন! কিন্তু এটাওতো মেনে নেয়া উচিত, সম্পাদক হিসেবে আমার সাথে অন্যদের বন্ধুত্বটাও কম জোড়ালো না, আমারও তো বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে ইচ্ছা হয়।
ছাপবার আগে কোনো কোনো নাটকের সমালোচনায় যদি আপত্তি তুলি, এটির এভাবে সমালোচনা ঠিক শৈল্পীক হচ্ছে না, ব্যাপারটা নিজেই একটু এডিট করে দিন, সাথে সাথেই আক্রমণ আসে- ভয় পান ছাপতে? বন্ধুত্ব নষ্টের ভয়? তখন হয়তো বলি, ঠিক তা না, সম্পাদক হিসেবে বলছি, বাক্যটি ঠিক সৃষ্টিশীল হয়নি। একই কথা অন্যভাবেও বলা যায়, সেভাবে লিখুন। তাতেও আপত্তি ওঠে- লেখক হিসেবে আমার স্বাধীনতা আছে, ছাপবার মুরোদ থাকলে ছাপুন, নাহলে বাদ দিন। কী আর করা, ‘হ্যাডোম ’ নিয়ে কথা উঠেছে, তাই ছাপতেই হয়। কিন্তু কোনো নাটক নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা না লিখে কেবল একটি বাক্য- ‘ওমুক দলের ওমুক নাটক নিয়ে লিখতে বিব্রতবোধ করছি’- জাতীয় এক লাইনের বাক্য দিয়ে যে কোনো নাট্যসমালোচনা হয় না, সেটি এই ‘হ্যাডোমহীন’ সম্পাদক নাট্যসমালোচকে বোঝাতেই পারিনি। যে নাটক নিয়ে আপনি বিব্রত, সেই নাটক যে শত শত দর্শক এখনও দেখছে, সেই দর্শক কি তবে মূর্খের হাড্ডি? তারপরও কথা একটাই- লেখকের স্বাধীনতা বলে কথা। হুবহু ছাপিয়েছি, ‘হ্যাডোম’ দেখিয়েছি, আর গাল-মন্দ খেয়েছি নাটকনির্মাতাদের কাছ থেকে।
কিন্তু বিষয়টি যেহেতু বন্ধুর কাজকে আরও সৃজনশীল করার প্রয়াস, সেখানে সাময়িক চুলকানিতে না খাউজাইয়া মলম লাগিয়ে চরম-অর্থে বন্ধুর ভালো করাটাও আমার কাছে জরুরি। তাই অনেকটা জোর করেই নাট্যসমালোচনা জোগাড় করা হয়, প্রকাশের আয়োজন করা হয়। সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাতে তাৎক্ষণিকভাবে শত্রু মনে হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘসময়ে বন্ধুর সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটবে নিঃসন্দেহে। আর একটি কথা, যে সম্পাদকের কাছে লেখার বিষয়ে স্বাধীনতা চাওয়া হচ্ছে, সেই সম্পাদকের স্বাধীনতার দিকটাও যেনো বিবেচনা করা হয়। নিজে স্বাধীন না হয়ে অন্যকে স্বাধীনতা দেবো কীভাবে?
ইতি
হাসান শাহরিয়ার
এপ্রিল ২০১০, সোবহানবাগ, ঢাকা