Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

অহরকণ্ডল

Written by বদরুজ্জামান আলমগীর.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

    বন্নচিন না ছিলো না ছিলো রেখারূপ
    একের ভিতরে না ছিলো দোঁহা, দুইয়ের অন্তরে এক
    না ছিলো আলোর রেখা, না তমিশ্রাবয়ন
    না চন্দ্রিমা, না বহ্নিপা, কী এমন মেঘডম্বুর
    তা-ও না; স্বয়ম্ভূ বিরচি প্রভু নিরঞ্জন
    সচকিত বিকশি বুদ্বুদ ফেনা, নিরাকার তাহায় করেন বিহার।
    ওম লক্ষীপেঁচা পঙ্খ মেলায়, ওম রাজহংস সন্তরণ করে
    ওম অন্ধপুরুষ রাত্রি, ওম ডিম্ববতী রমণী জাগে
    ওম পুনর্জন্ম জীবনাধিক রিষে ওম কামবতী নৈরালা কাঁপে।
    তথা নিরঞ্জনিরাকার রঙের হাটে বন্দনা করি
    মাতৃচন্দনে বিলিখি মহাকাল ও নদী এক তিতকুমারী।
    নিরঞ্জনের অধিক কৌমের পুত্র বিদ্ধ হয় পাপের ফলায়
    এ-দৃশ্যকাব্য অহরকগুল দিবস ও রাত্রিভর থাকে ও হারায়।

তখন সারা প্রকৃতি ভিজে যায় কাক জ্যাৎস্নায়। এই জ্যোৎস্নার ভিতরে কোরালিয়া বাজার, বাজারের অগ্নিকোণে এক সুপ্রাচীন বৌদ্ধ কেয়াং। বাজারের পূবমাথা থেকে বেশ কিছুটা আকিস্মিক ঢালু পেরিয়ে খোলা জায়গা, তারপর কেয়াং। কেয়াং-এ এখন শুদ্ধোদনের পুত্র গৌতমের মূর্তি নেই। কিন্তু মনে হয়, পুরো এলাকাটায় গাছপালা খানিকটা বেশি নুয়ে থাকে। তারা কী জানে নির্বাণের গুঢ়? আজ রাতের জ্যাৎস্না যে-মত উড্ডয়নশীল, তাতে আকাশলীন ফেরেশতার ডানার গন্ধ এসে নাকে লাগে।

কেয়াং- এর পাশে যে খোলা জায়গা সেখানে পাঁচ, ছয়, আটটি শেয়াল এসে জড়ো হয়। শেয়াল কী নাচের মুদ্রা জানে? প্রণয়ের ভিতরে যে নাচের অনুপ্রেরণা থাকে, বিস্ময়ে নৃত্যমুখের অঙ্কুরোদ্গম করে। সহসা বিকাশ রায়চৌধুরীর পোড়ো বাড়িতে সুদীর্ঘ কণ্ঠে কুকুর ডাকে: কুউ! কুউ!

কুকুর কাঁদে আর আত্মার ভিতরে নোতুন করে মরে জরিনা, কী নূরচান, ইব্রাহিম, বাজান, ও বাজান। কুকুরের বিলাপের সাথে সাথে বড় বড় হাওয়া আসে। কোরালিয়া বাজার, দেবীপুর, ধুলাউড়ি, নলী, ছোট টেংরা গ্রাম, আর ঘোপা নদীতে ভাতের মাড়সদৃশ নামে চাঁদের পাখ, আর শীৎকারের নিঃসঙ্গতার মতো শীত। কুকুরের ডাকে শেয়ালমণ্ডল উদ্বেলিত বোধ করে; কেয়াং-এর পাশে খোলা চত্বরে ছোটাছুটি করে। এসবের ভিতরে ও বাইরে আবছা চৈতন্যে দাঁড়ায় ওরা তিনজন লোক- দানিউল, আকমল ও বাহার। তারা সংঘবদ্ধ শেয়ালের উন্মুখরতা দ্যাখে। তাদের চোখে আস্তে— এক মায়াবী কিংখাব দুলতে দুলতে থাকে। শেয়ালের দৌড়ঝাপ তাদের মনে হয় সকৌতুক লীলালাস্য, না-কী শেয়ালের বল্কলপরা একদল কিশোর ওরা? তাদের সামনে অভ্যন্তরীণ দৈবলোকে ছেলেরা, না হয় হতে পারে শেয়ালের হৈ চৈ করে গোল্লাছুট খেলে:

    ডুক্কু ডুক্কু মনগুড়া
    হাত্তি মারলাম গুডাগুডা
    বইশ মারলাম লাফে
    তরোয়াল কাঁফে।

    উতিনারে ধুতিনা
    তিনদিন ধইরা মুতিনা
    তিনদিনের জ্বরে
    মাথা বিষ করে।

    আমি গেছলাম গৌরীপুর
    দেইখা আইলাম দুই চোর
    দুই চোরে বারা বানে
    ধাপ্পুর ধুপ্পুর।।

গোল্লাছুটের দৌড়ের শব্দে তারা, বিশেষ করে দানিউল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। যদিও তার সামগ্রিক বাসনা বেশ কতকটা অবলুপ্ত। কেননা  তারা মেথর সুনয়নীর ঘরে বাংলা চোলাই টেনে এসেছে। এখন চোলাই মদের ব্যারিষ্টারিতে তাদের পা কিছুটা টলে বটে, গোল্লাছুট খেলার গন্ধে বরং মাথা আমূল চক্কর দিয়ে ওঠে। দানিউল কথা বললে তিনজনই পরস্পর কথা বলে। বারবারই ওদের তিনজনের মধ্যে পারস্পরিক কথা হয়। প্রথমবারের কথা নিুরূপ:

এই চল।
কোথায়?
আন্তির পাড়।
বাড়ি চলে চাই। শীত করে। জ্বর আসতে পারে।
প্যারাসিটামল মাইরা দিস।
দুপুরে খাই নাই। বাজারের পুরি-সিঙ্গারায় মেজাজ গরম হইছে।
অতো নাগরামি করস ক্যান? অণ্ডকোষে লাথি মারবো। চল।
খালে পানি। পার হওয়া যাবে না।
হাঁটু পানির বেশি না। কাপড় তুইলা মুততে মুততে যাবো।
হাসির কী হইলো?
হঠাৎ হাসি উইঠা গ্যাছে। আর থামাইতে পারতেছি না।
আমারও এই রকম হয়। প্রথম দিন সুনয়নীর ঘর থেকে বাইর হইছি- দেখি সামনে খালি ফুল বাগিচা- সতীগো বাড়ির গোলাপ কুসুম।
আর সতী মারাইও না- কামালি গাঙ্গে জব্বর পানি- সতী মারাইও না। আন্তির পাড়ে বমি করবো- তাড়াতাড়ি হাঁট।
এখানে বমি করেন।
না। পানির মধ্যে বমি করবো। পানিতে বমি করলে নিজের মুখ দেখা যায়।
আন্তির পাড়ে বমি করে দানিউল। দানিউলের মাথায় হাত দিয়ে রাখে বাহার। দূরে দাঁড়িয়ে থাকে আকমল। কিছুদিন ধরে আকমলের এই রকম হয়- সে এক সঙ্গেই চলে কিন্তু ঠিক মিশে যেতে পারে না, কোথায় যেন একটি শক্ত প্রাচীর দাঁড়িয়ে থাকে। ওই প্রাচীর ভেঙে সে সহজ হতে পারে না। দিনে যা-ই হোক, রাতে বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। বাড়ি গেলে বাইরে আসতে তড়পায়। কাউকে সে বলতেও পারে না।

মাস তিনেক আগে একদিন অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে আকমল। গিয়ে দ্যাখে ঘরের দরজা খোলা-ভিতরে বাতি নেই। ঘরে ঢোকে বাতি জ্বালে। তার পেরিমা নিজের খাটের ওপরে শয়ান। সে ডাকতে যাবে পেরিমা, পেরিমা, কিন্তু এক মুহূর্তেরও কম সময়ে তার সমস্ত শরীরে পেরেক ঠোকে। পেরিমার সম্পূর্ণ হলুদ শরীর বিবসনা-শরীরে একসুতা কাপড়ও নেই।
সে দরজার আড়াল থেকে ডাকে: পেরিমা! পেরিমা!
পেরিমা নিসর্গের কোন অতল সিন্দুকের ভিতর থেকে বলেন, কে! আকমল?

পেরিমা তার মা। ছোট বেলা থেকে আকমল তার মা-কে পেরিমা ডাকে। তার বাবা তাকে নাম ধরে ডাকতো পিয়ারি! পিয়ারি! সে দুষ্টুমি করে ডাকতো পিয়ারিমা। পিয়ারিমা শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় পেরিমা। আকমলের বয়স যখন পাঁচ তখন তার বাবা আলী আব্বাস মারা যান। চাকরি করতেন খুলনায়। এখন আকমলের বয়স চব্বিশ, পেরিমা আটত্রিশ। সেই রাতের পরে আকমল দিনের বেলায় ছটফট করে। নানাবিধ দার্শনিকতা তার মধ্যে ক্রিয়া করে: না কোনো কিছুরই স্থায়ী কোনো অর্থ নেই, সব মিথ্যা কুহক মাত্র! ঠিক শাড়ি পরে পেরিমা আগের মতোই সংসারের কাজকর্ম করেন, ছোট্ট জানলার পাশে দাঁড়ান, পুকুর থেকে জল আনতে গিয়ে জলের ওপরকার ভাসমান শ্যাওলায় তার পা আটকে যায়। সবই দ্যাখে আকমল। কিন্তু চোখ তুলে তাকাতে পারে না। আকমলের মনে হয়, পেরিমার কোনো শাড়িপরা নেই-সম্পূর্ণ নগ্ন এক রমণী। রাতে ঘুমের ভিতরে শ্যাওলার ওপর দিয়ে হেঁটে পেরিমা আকমলের মাথায় হাত দিয়ে স্নেহ করতে আসে, তখন নিটোল নিয়মে পেরিমা শাড়িপরা। কিন্তু তার মুখমণ্ডলে উদ্বেগের সরিষাদানা টলমল করে। আকমল বলে, পেরিমা, পেরিমা বলো কী কষ্ট তোমার! পেরিমা ব্যাকুলতার ভিতরে হাসেন। আকমলের কাছে সব পিছলে পিছলে যায়, পুরনো দালান বুঝি খসেখসে পড়ে-পেরিমার মৎস্যগন্ধা হাসি আর সাদা শাড়ির চিরায়ত রঙে হলুদ পাড় সমান্তরাল সত্যে উপনীত হয়। এ-দুই রঙের সত্য ছাড়া আকমল যেন আর কিছুই ধরে রাখতে পারে না।

পেরিমার সাদা শাড়ির হলুদ পড়ে গুণে গুণে দশটি বাসুকির ফণা। পেরিমার শাড়ির পাড়ে যে বাসুকির ছোপ তার ফণায় আকমল ডিম্বাকৃতি পৃথিবীর মতো প্রতিষ্ঠায়মান। যদি ফণা দোলে- দুলে দুলে ওঠে। আকমল ছিটকে পড়ে যাবে কোথায়। দিকচিহ্নহীন অসীম শূন্যে। আহ্! এভাবে আকমল কিছু ভাবে, অথবা ভাবে না, কিন্তু শঙ্কিত বোধ করে।

পারতপক্ষে রাতের বেলায় কেউ বুরুঙ্গিচরের পথে যায় না। বিলের নাম বুরুঙ্গিবিল, আর তার পাড়ে যে চর তার নাম বুরুঙ্গিচর। যারা রাতের ট্রেনে এসে কাশিনগর স্টেশনে নামে, তাদের মধ্যে যাদের বাড়ি দেবীপুর, ধুলাউড়ি, চামোপাড়া, নলী আর আঞ্জিলা কেবল তারা-ই বুরুঙ্গিচরের ওপর দিয়ে বাড়ি যায়। এ মুহূর্তে দানিউল, আকমল আর বাহারের চরে কোনো কাজ নেই-দানিউলের পা তবু টলতে টলতে ওদিকেই যায়। তার সঙ্গে যায় আকমল আর বাহার। কামালি খাল পার হবার সময় বাহার দ্যাখে একটা উদবিড়াল। বাহার বেখাপ্পা চিৎকার করে: ওই, ওই ধর শালাকো! ধর! খপ্ খপ্ করে উদবিড়াল পালায়। চিৎকার করার আগে বোঝা যায় নি কী ভারি এক নৈঃশব্দ সারা চরাচর জুড়ে কৌমার্য তৈরি করে রেখেছিলো। চিৎকারধ্বনির উৎকণ্ঠায় উপর্যুক্ত কৌমার্য ভেঙে ভেঙে পড়ে। আশেপাশে পেঁচা ছিল বুঝি, এতোক্ষণ টের পাওয়া যায় নি-পক্ষ বিস্তারের আওয়াজ ওঠে : চাঁই চাঁই চাঁই। আরো, ছোট বড় মাঝারি ধ্বনিরা বিনাশের নির্মাণ রচনা করে। নানা বর্ণের শব্দ শোনা যায় : কুক্কি কুক্কি! টিট্টি টিট্টি! চিরি চিরি! চিরি চিরি।

ধন্দে পড়ে- এতোদিন ওরা বধির ছিল, না-কী আজ শ্রবণের ইন্দ্রিয় হঠাৎ বসে পড়ে? বুঝে উঠতে পারে না। রাত্রির বিচ্ছিন্ন ধ্বনিরা কোনো অচিনলোক থেকে নামে। মহাকাল যেন চড়ুইয়ের ঠোঁটে আমাদের আত্মা খুঁটে খায়, এ তার-ই ধ্বনি, ধ্বনিরা বহে! দূরে ওই শ্যাওলায়মান চাঁদের নিচে রাত্রি তার বসন খুলে আলগোছে বিনগ্ন হয়। দেখা যায় না, কিন্তু ধীরে তিনি নাচের বিন্যাস মেলে ধরেন:

    ঝিনিক রিনিক।
    ঝুমঝুম। ঝুমাঝুম।
    আহা! ওহো।
    রিনিক। ঝিনিক।
    টপাটপ। টপাটপ।
    টপ্পাটপ। টপ্পাটপ।
    ঝিনিক। রিনিক।।

যে-নাচ কেউ দেখতে পায় না, কোনো এক গহনান্তে শুনতে পায়। আকমলের সামনে সত্যিই একটি নাচের ফণা দোলে। আকমল দিগন্তলীন মাঠের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, যেমন একটি ক্ষীপ্র ষাঁড় বা পেঁচাটি আছে, কী আছে বুরুঙ্গিবিলের তিতপুঁটি, পানোখী, সিএন্ডবি রোডের রেইনট্রি, চরের দানিউল কী বাহার, না হয় পায়ের তলে ঝিঝি পোকা। কিন্তু তার অণু-পরমাণুর শরীর মৃত্যুহীন দূরগামী কোলাহল বুদ্বুদের সঙ্গে ভেঙে যায়। সে নিজে বুরুঙ্গিচরে থাকেও যদিবা, প্রারম্ভদিনের আদিতম তরঙ্গমালার সঙ্গে মেশে।

সর্বময়-হীনতা থেকে প্রভু নিরঞ্জন আবির্ভূত হন। তিনি এক আলোর পরিসর অথবা স্রোতস্য প্রবাহে ব্যাপ্তি।

প্রভু নিরঞ্জন সর্বব্যাপী বাতাসের বুদ্বুদ তৈরি করেন। বুদ্বুদ বিকাশমান ও গতিশীল। নিরাকার প্রভূ নিরাকার বাতাসের হেয়ালিতে আসীন হন।

প্রভু, তিনি নিরঞ্জন আলোর চাকা। তিনি নিজের কায়া সৃষ্টি করেন। তাঁর কায়া হয় পুরুষপ্রকৃতি-নিরাকার নিরঞ্জন পুরুষ। তিনি থাকেন নৈঃদেহ আর অন্ধ। অন্ধ নিরাকার পুরুষ ধ্যান করেন। ১৬৮ বছর ধ্যান করে তিনি ক্লান্তিতে হাই তোলেন। তাঁর হাই-এর ভিতর থেকে পাখা মেলে, উড্ডয়ন করে পেঁচা। কেহ নাই, কিছু নাই, এক পেঁচা উড্ডয়ন করে।

প্রভু বলেন, দাঁড়াও। পেঁচা দাঁড়ায়। পেঁচার পিঠে প্রভু আসীন হন।
প্রভু নিঃসঙ্গতার ভিতরে থাকেন।
একদা পেঁচা বলেন, আমার ক্ষুধা পায়।
প্রভু বলেন, কিছুইতো বানানো হয় নি। তোমাকে কী খেতে দেবো? পেঁচা বলেন, আপনার মুখে অমৃত আছে। আমাকে অমৃত থেতে দিন। পভু তাঁর মুখ থেকে পেঁচাকে অমৃত খাওয়াতে যান। টুপ করে অমৃতের কয়েক ফোঁটা নিচে পড়ে যায়- তাতেই জলরাশি হয়। মুহূর্তে সমুদ্র উত্থাল পাতাল করে। সমুদ্র টলমল করে।
সমুদ্রের জলে পেঁচা সাঁতার কাটে।

    সাঁতার কাটে সাঁতার কাটে
    পেঁচা সাঁতার কাটে
    প্রভু তাহার পৃষ্ঠদেশে
    চুপটি বসে থাকে।
    সাঁতার কাটে সাঁতার কাটে
    পেঁচা সাঁতার কাটে।

কিন্তু পেঁচা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। জলের অতলে ডুবে যেতে চায়। পেঁচার শরীর থেকে একটি পালক খসে পড়ে জলের ওপরে। আর তাতেই হয় রাজহংস-দীঘল গলার হাঁস। প্রথম রাজহাঁস ডাকে, প্যাঁক প্যাঁক। প্যাঁক প্যাঁক।
পেঁচা বলেন, প্রভু, এবার পৃথিবী তৈরি করুন।
কীভাবে?
আপনার কন্ঠ থেকে সোনার পৈতা জলে ফেলে দিন।
প্রভু তাই করেন।
সোনার পৈতা থেকে হয় বাসুকি-বাসুকি নাগ। ইনার এক সহস্র্র ফণা।
বাসুকিনাগ ফণা তুলে প্রভুকেই খেতে আসে।
পেঁচা বলেন, প্রভু, আপনার কানের বালা জলে ফেলে দিন। জলদি ফেলুন।
প্রভু তাই করেন।
প্রভুর কানের বালা থেকে হয় অতঃপর ব্যাঙ। বাসুকির আহার। বাসুকি এবার সহস্র ফণা মেলে প্রভুর মাথার ওপর বিস্তার দেখায়। প্রভু তার শরীর থেকে এক দানা মাটি বাসুকির ফণার ওপর রাখেন। বাসুকির ফণার ওপর একদানা মৃত্তিকা বড় হতে থাকে।
ছোটবেলায় পেরিমা বলেছিলেন, জাতিসাপকে দুধ খেতে দিবি আকমল। দুনিয়া বাসুকিনাগের ফণার ওপরে বসা।

কিন্তু আকমল কী দ্যাখে? সে দ্যাখে, পেরিমার শাড়ির হলুদ পাড়ে যে বাসুকির ছোপ তারা আস্তেআস্তে তার মাকে পেঁচায়। বাসুকি পেরিমাকে পেঁচায়, পেঁচাতে থাকে, পেঁচাতে থাকে।

একসময় তার সম্পূর্ণ পেরিমা বাসুকি সাপ হয়ে যায়। ফণা তোলে। তার ফণার ওপরে মাছরাঙার ডিমের মতো সামান্য আকমল। বাসুকি ফণা দোলায়। হঠাৎ অস—হীন শুন্যের ভিতরে সে পড়তে থাকে। পড়তে থাকে,
পড়তে থাকে
পড়তে থাকে
পড়তে থাকে
পড়তে থাকে
বুরুঙ্গিচরের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা আকমল চিৎকার করে: পেরিমা! পেরিমা!
কী হইছে আকমল! কী হইছে!
কে, কে!
আমি, আমি! কী হইছে?
আর কোনো কথা বলে নি আকমল। তার শরীর কাঁপতে থাকে।

খড়কুটো দিয়ে এতো দূরের বিজন ভয়াবহ বুরুঙ্গির চরে বাহার আগুন জ্বালে। পৌষ মাসের শীতে আগুন তিরতির করে। আর দীঘল আকাশমন্ডলে নাগ দেখা দেয়। লক্ষনিযুত গ্রামীণগণ হাজার বছর ধরে তাদের বাস্তুবসতি ওই আকাশাকীর্ণ নাগের সঙ্গে মিলিয়ে দ্যাখে। আজ রাত্রির নাগ-উত্তরে মুখ, দক্ষিণে লেজ। আকাশের নাগ বলে দেন বসতবাড়ির ঘর কীভাবে তুলতে হবে।

আকাশের নাগ উত্তর-দক্ষিণ লম্বা, তাহলে এবার কৃষিজীবীর ধান ভালো হবে- তারা পুর্বমুখী ঘর তুলবে। নাগের ডান কোলে, না হয় বাম দিকে। আকাশ ও নক্ষত্রপুঞ্জের ভাষা অনেকটা বোঝে বাহার। কিন্তু এ-বেলায় নৈঃশব্দের ধুলা সবার ইহলোক অচেনা করে ফেলে। এখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে আগুন জ্বলে। আগুনের এই এক স্বভাব: যতোবার জ্বলে ততোবারই কারো না কারো মুখাকৃতি নির্মাণ করে। সে-মানুষের হাত নেই, পা থাকে না-কেবল মুখমণ্ডল আর মাথাভর্তি লম্বা চুল। ক্যালেন্ডারে ঝোলানো ছবিতে বুরাক উড়ে যায়, তার মাথায় মুকুট আর লম্বাচুল পিছনে ওড়ে। এখানে আগুনে পুড়ে এ মুখ ভাইয়ের ব্যাকুল ছায়ার আশ্রয়ে আসে। আগুনের মধ্যে দানিউল তার বোন নুন্নাহারের মুখ দ্যাখে। দুই মাস হয় নুন্নাহারের স্বামী মারা গ্যাছে। নুন্নাহার দুই মাসও টিকতে পারলো না। ভাইয়ের কাছে চলে এসেছে। গর্ভে ডিম নিয়ে এখন সে সাবধানে হাঁটাচলা করে, দুশ্চিন্তায় ুান হয়ে থাকে।

বুরুঙ্গিবিলের পাড়ে আগুন দেখে কয়েকটা মাছ এসে পানির ভিতর থেকে মুখ বাড়ায়। দুইটা চাপিলা, দুইটা পাবদা আর একটা গজাল মাছ। এ-গজাল বৈশাখ মাসে বর্ষার নয়াপানিতে নারীগজালকে হারিয়ে ফেলেছে। তাই একাএকা রাত্রি জাগে। বৈশাখ মাসের নয়াপানিতে সবাই হাত-পা নেড়ে নেড়ে একটু জলকেলি করে-চান্দা, বঁইচা, বোজোরি, চিরকা, ঘাউরা আর দুজন গজাল মাছ।

গজালবউ ভারি পেট নিয়ে এখানে যায়, ওখানে থামে। বসে পড়ে। কর্তাগজাল বলে, ছিঃ! এ-জায়গাটা নোংরা, দেখো না। আরেকটু ওদিকটায় চলো, ওইতো ওদিকটায়!

তোমার কী! আমার জান বেরিয়ে যায়। এদিক ওদিক ঘুরতে লজ্জাও করে! তুমি ওদিক যাও। ডিম পাড়ার সময় সামনে থেকো না যেনো। লজ্জা করে।

আরেকটু কষ্ট করে সামনে যাও-যাও না। আচ্ছা, আমি সামনে থাকবো না।

না গো তুমি যে কী!

শোন, ওদিকটায় একটা এই টিট্টো, এমন ছোটোমোটো একটা গর্ত দেখে এসেছি। চলো।

চলো।

আস্তে লেজ নেড়ে ভারি আনন্দ দেখিয়ে রমনী গজাল সামনে যায়। পুরুষ গজালটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছটফট করে।
ডিমপাড়ার জন্য নারীগজাল ছোট গর্তের মধ্যে একটু একটু বুক ঘষে। এমন সময় একজন শিকারি ডিম্ববতী গজাল মাছ ধরে নিয়ে যায়।

লোকে বলে, গজাল মাছ আগে মানুষ ছিলো।

ক্রমশ বুরুঙ্গিচরে এতোটাই নৈঃশব্দ ঘিরে আসে যে, তারা কানের ভিতরে একটানা ভোঁভোঁ ভোঁভোঁ আওয়াজ শুনতে পায়। কুয়ার ভিতরে যে নীরবতা, সে-রকম শব্দহীনতা দানিউল, আকমল ও বাহার শোনে, ও স্পর্শ করে। হঠাৎ বাহার কুয়ার ভিতরে নুয়ে মুখে থাপড় দিয়ে শব্দ বানায়:  আব আবার আব। আবা বা বা। আ বা বা বা। বা বা বা বা। বা বা বা বা। দূরে তার প্রতিধ্বনি হয় টা টা টা টা! টা টা টা টা!
আবা বাহার বানায়,
আ বা বা বা।
আ বা বা বা।

তার উত্তর আসে:
ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ।
ভ্যাঁ বা বা বা।
ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ।
ভ্যাঁ বা বা বা।

ওই গরু ভেমায়!
ভ্যাঁ ভ্যাঁ! ভ্যাঁ ভ্যাঁ!
এতো রাইতে বুরুঙ্গিচরে গরু কোত্থেকে আসে?
চুপ থাক।
ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ!
কেডা, কেডা?
ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ!
চল।
না
চল। ভয় পাবার কিছু নাই। চল।
দানিউল দৌড়ে যায়। আকমল-বাহারও সাথে সাথে দৌড়ায়।

কেডা! কেডা! এই চরে দৌড়ে পালায় কেডা? কেডা তুই?
আমি আমি সাব।
আমি কেডা।
আমি মালোর বাচ্চা, উপেন্ড। উপেণ্ড চামার।
এইদিকে আসছস ক্যান? আগুন দেখস নাই?
দেখছি। মন কইলো, পেত্নীর আগুন। পেতœীর কাছে মনিষ্যি আহে না। এই আশা করি চরে আইনু।
কয়জন তোরা?
তিনজন ছিলাম সাব। জগদীশ আর মহিণ্ড পলাই গিছে।
গরু ভেমায় কই?
গরু চিলাই করছি।
কী করছস?
গরুর চামড়া খুলে নিছি। গরুডি অখন চরে ভেমায়, ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে।
শুয়র। জেতা গরুর চামড়া খুলছস?
হ সাব। পায়ে ধরি সাব। পায়ে ধরি। মা কালী রক্ষা কর।
কার গরু?
কেউয়াটখালির মকবুল ব্যাপারীর সাব। বলদ গরু।
হা আল্লা। জেতা গরু চিলায় কেমনে?
সাব। সাব। আমার চামড়া নেন-বদলা করেন-খুলি নেন সাব। গরুডা কেমনি দৌড়ে, যুদি দ্যাখন সাব। শরীলে চামড়া নাই- চিলা বলদ গরু। আমার দেবতা। গরু আমাগো দেবতা সাব। আমি নিজের হাতে চামড়া খুলি নিছি। ভগমান, এমুন মনিষ্যি ক্যান বানাইছো, ভগমান?

আমার মাইয়া সাব, আমার মাইয়া কল্পনা। বমি করে, বমির লগে রক্ত আই। বেলগাছির সোনালি মিয়া জিন নামাতি পারে। জিনের বৈঠকে টাকা দিতে অয়। আমি কাই: সোনালি ভাই, আমার ঘরে জিনের একটা বৈঠক দ্যাও- আমার কল্পনা রক্ত বমি করে- চিকিচ্চা দ্যাও। সোনালি গাইল দেয়, মরা গরুখাওরা চামার কী কয়? জিন চামার হাটি যায় না। আমি কই, তোমার ঘরেই দ্যাও বৈঠক। আমি বাইরে খাড়াই থাকমু-শিন্নর পয়সা দিমু। জামগাছের আগা থাকি জিন নামবে, সাব। আমি তোমার ঘরে যামু না, বাইরে থাকমু। কল্পনা রক্তবমি করে সাব। শিন্নি দিমু, ভগমান গো, ও ভগমান।
তুই যা উপন্দ্রে।
ও সাব। মারবেন না। আমাক মারবেন না।
শুয়োরের বাচ্চা, সর।
আমাদের চিনছস?
না।
এক দৌড়ে পালা।
উপন্দ্রে শীত রাত্রির আবছায়ার ভিতরে হারায়।
এ-দিকে চামড়াখোলা গরু এক অসীম যুদ্ধে লিপ্ত হয়। নিজের শরীর পোড়ায় বলে প্রবল ক্ষোভে ধারালো শিঙ্গে নিজের দেহে আক্রমণ চালাতে আসে। এতোটা অসহায় সে তার আগে আর কোনোদিন বোধ করে নি। কিন্তু গরুর দুর্ভাগ্য নিজে জানে না, নিজেকে আক্রমণ করার, ফুটো করার প্রকৌশল তাকে দেওয়া হয় নি। সুপ্রাচীন কালে এক গরু প্রভুকে আক্রমণ করতে যায়, তার সামান্য এক দাবি: আমাকে এক জোড়া হাত দেওয়া হোক।
তাকে হাত দেওয়া হয় নি, বলা হয়: হাত অতি সামান্য, তোমাকে দেবত্ব দেওয়া হলো।
দেবতার হাত থাকে না। হাতের মতো মনে হয়, কিন্তু আসলে হাত নয়, সামনের দুটি পা।
শুধু মানুষের হাত থাকে, তাই মানুষ দেবতা নয়। মানুষ নিজেকে হত্যা করে ফেলতে পারে, দেবতা পারে না। এ-গরু দেবতা।

আজ সে বুঝি আবার হাত প্রার্থনা করে, দৌড়ে গিয়ে বার বার এক অসীমের আলো-ছায়া পর্দা ছিড়ে ফেলে। শিঙের এ আঘাত লাগে বুরুঙ্গিচরের উঁচু জমিতে। মাটি তার প্রতিপক্ষ হয়। বধির মাটি আর নির্বাক দেবতার লড়াই। অসহায়, নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ গরুটি অক্ষমতার সাকল্য ক্রোধে আক্রমণ করে। এবার দুটি শিঙও ভেঙে যায়।

বুরুঙ্গিচর চামড়াখোলা গরু অতঃপর আকাশের দিকে চার পা তুলে অনন্ত চরাচর থেকে একফোটা নিঃশ্বাস নেবার প্রাণান্ত চেষ্টা করে।

ফলে দেবতা গরু একটি হুট্টিটিটি পাখিতে পরিণত হয়। রাতে এ-রকম হুট্টিটিটি আকাশের দিকে পা তুলে ঘুমায়। তারা ভাবে, আকাশ যদি ভেঙে পড়ে তাহলে তার ডিম ভেঙে যাবে। ভেঙেপড়া আকাশ আটকাবার জন্য হুট্টিটিটি ওপরের দিকে পা তুলে ঘুমায়।

দানিউল বলে, গরুটা জবাই করে মাংস নিয়ে যাই।
বাহার বিস্মিত হয়। সে বলে, কী কন।
ক্যান, অসুবিধা কী? গরুডা আপনা আপনি মারা যাবে।
না, মাংস নেওয়া যাবে না।
যাবে না ক্যান?
আমি গরুর মাংস খাই না।
গরুর মাংস খাস না! দাড়ির পোলা গোরুর মাংস খায় না, বলে কী।
আমি হিন্দু হইয়া গ্যাছি।

হিন্দু!
হ । গালি গালাজ কইরেন না। সতীরে ভালোবেসে আমি হিন্দু হইছি, দানিউল ভাই । হ।
সতীরে ভালোবাসছো? ও। সতী যে মুখে হিশু করে চলে গ্যাছে?
যাক।
পাছায় তেল লাগায়ে গলায় দড়ি দে।
আমি একদিন গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরি। সীতার সামনে গিয়ে গলায় হাত দিয়ে বলি: সতী, দেখো আমি হিন্দু হইছি।
সতী হাসে, ছিঃ।
আমি বলি, তুমি গরুর মাংস খাও।
এ রাম। গরু যে দেবতা গো।
তুমি ধর্ম ছাড়ো, আমিও ধর্ম ছাড়ি।
গরু খেলে যে গিরস্তের গোয়াল গালি হয়ে যায়। গরুর জন্য গিরস্ত নিজের বউকে হত্যা দিয়েছিলো। হ্যাঁ গো। তবে তো গরু গিরস্তের গোয়ালে আসে। কপিলা গরুকে বলেন:

    তুমি যদি না যাও মা রবণী মণ্ডলে
    নরলোক পবিত্র হইবে গো কেমনে।
    ভগবতী গাভী গিরস্তকে জানায়:
    তোমার বড় বউ আনবরনা বড়
    মেরেছে ঝাঁটার বাড়ি ভেঙেছে পাঁজর।
    পান খায় পিক ফেলে গোহালে ভিতর
    রাত্র প্রভাত হলে পরে দেয় না ঘর ঝাঁট
    সন্ধ্যা নাগিলে পরে দেখায় না বাতি
    ভাদ্র মাসের দিনে যে জন গোয়ালে মাটি দেয়
    ডাংরা পিলুই হয়ে তার গরু মারা যায়।
    বরিবারের দিনে যেজন মৎস্য ভেজে খায়
    উকুন এঁঁটোলি মা তার গরুর গায়ে হয়॥

গৃহস্ত অতঃপর আদ্যাশক্তি ভগবতীর সম্মানে তার স্ত্রীর মাথার চুল কর্তন করে, হাতের আঙুল কাটে, জিহবা কেটে কলা পাতায় রাখে, হাঁটু ভেঙে খুঁড়িয়ে দেয়, এ -মত পরিণামেও তা শেষ হয় না।

আদ্যাশক্তি ভগবতীর পাশের কাছে গিরস্ত তার বউয়ের মস্তক ছিন্ন করে।

নরবলির রক্তে ভগবতীর খুরচতুষ্টয় রক্তবর্ণ ধারণ করে, কপালে পরানো হয় রক্ততিলক এভাবে ভগবতী ঘরে আসেন।

    একলক্ষ ছিল গাভী সওয়া লক্ষ হইল
    বছর বছর পাল বাড়িতে লাগিল।
    আদ্যাশক্তি ভগবতী আছেন যার ঘরে
    গোহালে পরমসুখ, তাঁ^র যম কাঁপে ডরে॥

তারপর আমি আর কোনোদিন বলি নাই: সতী গরুর মাংস খাও।
সতী আগরতলা চলে গ্যাছে।
জানি।
তুইও যা।

না।
ক্যান?
এইটা বড় কঠিন অভিশাপ আকমল - আমি সতীরে ভালো না বাইসা থাকতে পারি না।
দানিউল উপর্যুক্ত বেদনার গাম্ভীর্য ভাঙার জন্য এলোপাথারি চিৎকার করে:
আবে হৈ লাগছে গুল্লি পুলের ঘাট।

    এলেন গাছে ঢেলান দিয়া
    ময়না গোসল করে
    কালা জামাই দেইখা ময়না
    অতর নতর করে
    লাল জামই দেইখা ময়না
    ফুলের বিছনা করে।

আর কী করে?

    পারভীনে যে ধান লাড়ে
    মাথায় ঘোমটা দিয়া
    কামাল ভাইয়ে ইডা মারে
    লাক সাবান দিয়া ॥

ইডাইডি কইরা ফল নাই। কাউরি দিয়া ধরতে হবে। হেহ।
বাহার, চল চাইত্যান গাছের তলে যাই। আকমল হাঁট।
না। ওই গাছে বাত্তিবুত্তি জ্বলে, ভয় লাগে।
ভয় লাগলে কী হয়?
হয়। সমস্যা হয়। হুঁশ থাকে না। উত্তর দিকে দৌড় দিলে দক্ষিণে চলে যাই।
উত্তর-দক্ষিণের আছে কী-সব দিক সমান। সব দিক বন্ধ-কোনো দিকে যাবার নাই। রাত তিনটার সময় চাইত্যান গাছের নিচে অবস্থান নিবো। দরকার আছে।
ডর ডর লাগে।
ডরে ডর কাটে। রাতের পরে যেমন দিন আসে -ডরের পরে সাহস। জানি, চাইত্যান গাছে আঙ্গুর কাকুর সাথে দেখা হয়ে যাবার পারে, তাও যাবো। এই চাইত্যান গাছের আগডালে গলায় দড়ি দিছিলো আমার কাকু- আমার আঙ্গুর কাকু। বিয়ার রাইতে আত্মহত্যা। সাপে কাটে নাই। লখিন্দরকে সাপে কাটে, সুতানলি সাপ। আকমল, আমার মনে হয়, কে যেন এই রকম করায়। লখিন্দরের বেহুলা ছিা- বেউলা সুন্দরী । আমার কাকুর বাসর ঘরে বেহুলা ছিল না। কাকু বুঝি জানতো -তারে যদি সাপে কাটে তা হইলে তারে নিয়া কেউ গাঙ্গুড় নদীর জলে ভেলা বাসাবে না। তার যে মরণের স্বাদ পাইতে ইচ্ছা করে।

সেদনিও এমন ভাঙাভাঙা চান্নি ছিল। ঘর থেকে বাহির হয়ে আসে যেমন এক নিমাই সন্ন্যাসী। চাইত্যান গাছের তলে আসে। বাড়ি থেকে এতো দূরে তবু। গলায় সুতানালি সাপ পেঁচায়। তারপর ঝুলে পড়ো কাকু, ঝুলে পড়ো?

আকাশে তখন ছোটবোনের মতো শুচিশ্রী ছাঁদ, আহারে চাঁদ জেগে থাকে।

সকালে আমিও লুকিয়ে চাপিয়ে চাইত্যান তলায় আসি। কতো মানুষের ভিড়। সবার সঙ্গে আমিও দেখি।

রাতে বাবা থাপ্পড় মেরে বলেন, একশোবার মানা করলাম, চাইত্যান তলায় যাবি না। বাঁদরামি করো-আমার সাথে ইয়ার্কি মারো। এক টানে নিয়া যাবে।
কই নিয়া যাবে?
মামার বাড়ি নিয়া যাবে, হারামজাদা।

আমার তখন কতো আর বয়স-আট। রাতে ঘুম আসে না। মৃত্যু বিনাশ করে না - নোতুন পায়ে আরম্ভ করে। তার আগে আমি জানতাম না, পুরনো যে আলমারি সে-ও শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে। গায়ের ওপরে চাদর শুধু, কাপড় থাকে না তারো বেশি কিছু হয়ে শরীর জড়িয়ে ধরে। রাতে নানা জাতের পোকামাকড় কিটকিট কিটকিট করে- আগে কোনোদিন কানে আসে নি। আমার মনে হলো, সবাই জেগে আছে- তাদের পাহারায় আমি একটু ঘুমাই। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। দেখি, আমাদের বাড়ি থেকে পুরের দিকে যে আকাশ- সে আকাশ ধোপরাপাশা গ্রামের ওপরে। আকাশের বর্ণ সাদা- সাদার ওপরে নীল। আরো নীল । সাদা ও নীল আবছা ওড়াউড়ি করে। সাদা নীলেদের নিচে চাইত্যান গাছের মাথায় একটি বাতি জ্বলে। বাতির শিখার ভিতরে ফুল হয়- কালো গুটিগুটি বাতির ফুল। বাতির ফুল থেকে বেরোয় চোট একটি মুখ। আমি এতো দূর থেকে চিনতে পারি- আঙ্গুর কাকু। আঙ্গুর কাকুর মুখে একটি পাখির মুখ বসে। দুই হাত থেকে দুটি ডানা বেরোয়। রংধনুলি মধুর পুচ্ছ- মাথায় লম্বা চুল, ও তার ওপরে সোনার মুকুট অহরকণ্ডল পক্ষী। অহরকণ্ডল ওড়ে- উড়তে থাকে। উড়ে একদম আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি কোনো কথা বলি না। পিঠে চড়ে বসি।

অহরকণ্ডল আমাকে নিয়ে আবার ওড়ে।
প্রথমে কালো।
তারপর ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
নীরবে দ্রিম দ্রিম শব্দ হয়।
অহরকণ্ডল আরো ওপরে যায়। ওখানে হলুদ মেয়েরা নাচে। ঘুরে ঘুরে, উড়ে উড়ে নাচ দেখি।
আরো ওপরে যাই। অথৈ নীল সুমদ্র। সাগরের পানির ভিতর দিয়ে যাই। কতো মাছ। লাল, কালো, বেগুনি, হলুদ, নীল, সবুজ, কমলা কতো রঙের মাছ সাঁতার কাটে।
হঠাৎ হাঙর! আমি ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠি।

নীরবতা ভেঙে আকমল কথা বলে:

রাত অনেক হইছে দানিউল ভাই। চলেন বাড়ি যাই।
কয়টা বাজে?
একটার কম না।
রাত তিনটা পর্যন্ত থাকবো। একটা প্রোগ্রাম করবো।
কী প্রোগ্রাম?
একটা, মাত্র একটা লোককে ফেলে দিবো। চাইত্যান গাছের তলে যাই চল।
কারে ফেলে দিবো?
এক লাখ টাকার প্রোগ্রাম। তিনজনে ভাগ করে নিবো।
কে দিবো?
যে-ই দেওক। টাকা লাগবে না? তোর আমার চলতে হবে না?
ঢাকা তো গেছিলে, কাজ পাইলে?
আমি ভাবছি আবার ঢাকা যাবো।
কোনো লাভ নাই।
ডাকাতি করা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। সেইদিন বেশি দূরে না। কাজ কে দিবে? হাল্লা হই নাই, জাল্লাও হই নাই।
কারে মেরে ফেলবো?
চাইত্যান গাছের তলায় চল। নাম বলবো।

সৌন্দর্য বরাবর নির্মমতার ছকে বাঁধা। যে সৌন্দর্যে অবগাহন করে সে নিঃসঙ্গ হয়। পানিতে ডুবতে থাকা বালকের চোখ থেকে, কান ও মর্মের মুল থেকে যাবতীয় চিত্র ও চিত্রকল্প অন্তর্হিত হয়, চিত্র যদিও বা থাকে, অলঙ্কারহীন বস্তুতে তা ঘনীভূত ডুবন্ত বালক নিরলঙ্কার একবিন্দু বাতাসের জন্য সকল আর্তি পুঞ্জিীভূত করে। দানিউলের নির্মম আয়োজন তাই বাহার ও আকমলকে শৈশব থেকে, বোনের পায়ের দাগ থেকে, কোরোসিন বাতির ফুল থেকে, গাভীর হাম্বা থেকে , মাছরাঙ্গার গর্তথেকে, বালুভাত থেকে, মেলার ঘোড়া ও নাগরদোলা থেকে, প্রিন্টের জামা থেকে মাতৃগর্ভের ডিম থেকে, বাবার সুরা ইউনুস থেকে , সকল শুভৈষা ও অভিসম্পাত থেকে খুলে এনে জড়ো  করে ফ্যালে তিনটি ছোরার উদ্যমের সামনে।
চাইত্যান গাছের তলে এস দানিউল জিজ্ঞেস করে:

ভয় পাইছস?
রাত কয়টা বাজে?
দুইটা মনে হয়। আদমসুরত পশ্চিম দিকে হেইলা পড়ে।
কারে ফেলবো?
নিয়ামুল।
নিয়ামুল কে?
হামিদ মিয়ার ভাজিতা।
আপন ভাতিজা?
না।
মাইরা ফেললে কেইস হবে না?
হবে। আমাদের নামে হবে না।
আমরা মেরে ফেলবো-আমাদের নামে কেইস হবে না?
না। হামিদ মিয়ার কাছে গিয়া বলি, আমারে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। দেশে থাকবো না। বোনটা ফেরত আসছে। পেটে বাচ্চা। কী করবো দিশা পাই না। হামিদ মিয়া কয়, তুমি বড় বিশ্বাসী ছেলে, ইমান-আমান পোক্ত, অপদার্থ। তোমারে চাকরি দিয়ে আমার ভবিষ্যৎ কী? লেবেণ্ডিশ। কুষ্টিয়ায় আমার উইভিং ফ্যাক্টরিতে চাকরি আছে একটা-করবা? যে কাজ দেন করবো। তুমি বলদ মানুষ। পারবা না। পোস্ট ভ্যাকেন্সি করে নিতে হবে। আমি কীভাবে ভ্যাকেন্সি করে নিবো? তুমি চরিত্রবান ছেলে-ইন্নোসেন্ট। কাউরে বিশ্বাস করতে পারি না- একটা কাজ করতে পারবা? কী কাজ? আমার উইভিং ফ্যাক্টরির ছোট তরফের সুপারিনটেনডেন্ট নিয়ামুল, আমার দূর সম্পর্কের ভাতিজা, কাউকে বলতে পারি না, আমার নিজের ঘর নষ্ট করে ফেলেছে। ওরে সরাইয়া দিতে হবে। কী? সরাইয়া দিতে হবে। জানি, তুমি ইন্নোসেন্ট ছেলে, পারবা না। যারা পারবে তাদের বিশ্বাস করতে পারি না, এই হলো সমস্যা। তিনটা চাকরি দিবেন। চাকরির চিন্তা কইরো না। তিনটা চাকরি। দিবো। টাকা দিবেন তিন লাখ। না একলাখ। টাকা নগদ। না কাজের পরে। তোমার ঠ্যাং কাঁপে? না। এই পৌষ মাসের ১৫ তারিখ রাতের মেইলে নিয়ামুল বাড়ি আসবে। পারবা দানিউল মিয়া?
আকমল জিজ্ঞেস করে: আর কী কয়?
গাড়ি আসার সময় হইয়া গ্যাছে?
বেশি দেরি নাই।
সাথে যদি লোক থাকে?

কুষ্টিয়া থেকে সাথে কেউ আসবে না।

এ-মর্মভেদী সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পর থেকে তাদের শরীর ও মানসে এমন কিছু তাৎক্ষণিক পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে যার ওপর তাদের কোনো হাত থাকে না। তারা নিজেদের কাছে অসহায় ও অচেনা বোধ করতে থাকে। দানিউল তিনটি ছোরা নিয়ে এসেছিলো। ছোরা হাতে আকমল ও বাহার নিজেদের ভাঙন প্রতিরোধ করার জন্য শক্ত করে ছোরা ধরে নিজেদের অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে যেন পরিস্থিতিরি অন্তর্গত ভঙ্গুরতা আরো শতধায় বিকশিত হয়। ছোরা ও আকমল, বাহার ও ছোরা এই সম্পর্কের যৌগ পৃথক হয়ে বিপরীত সত্তায় রূপলাভ করে। আকমল ও বাহারের কাছে এরূপ মনে হতে থাকে যে, তাদের হাতের ছোরা বিচূর্ণ হতে হতে আকমল ও বাহারে পরিণত হয়। ছোরার পরিচালকদ্বয় নিজেরা দুটি অক্ষম তীক্ষè ছোরায় রূপান্তর লাভ করে। দানিউল কী এই প্রক্রিয়ার খুব বেশি বাইরে থাকতে পারে? সাধারণত ছোরা থাকে হন্তারকের হাতে, কিন্তু এখানে হয়েছে যায় বিপরীত হেয়ালি। পৌষ মাসের এই ভর রাত্রিকালে এক দৌড় বাতাস এসে দানিউল, আকমল ও বাহারকে নিষিক্ত করে। বাতাসও হারায়।

এই নিখিল চরাচরে তখন কিছুই থাকে না। কালের আঙুল তাদের পিঠ স্পর্শ করে।

    তারা চরাচরের অনন্তে দ্যাখে অক্ষমতার ক্ষুরের আওয়াজ
    আলোর শেষ বিন্দু নির্বাণের অধিক
    প্রদক্ষিণ করে অন্ধকারের ঘন বলয়ে
    আরো জন্মের বাসনা নিরাবলম্ব অবস্থিতি পায়
    নাই নিখিল বিরাট, পুনরাবর্তন থাকে শুধু
    নিজেরই কায়াহীন ছায়াহীন কায়া ও ছায়ায়।

জীবন বলে যে একটি অভিলাস নিসর্গের অবিরাম বস্তুনিচয়ে সংযুক্ত পরাগসকলকে বোঝায় তা মুহূর্তকালের ধাঁধায় প্রকারান্তরিত হয়। মৃত্যু বহুকালের পুরনো উপমা, আধুনিক কাব্যকলায় সঙ্গীতের মতোই তা পরিত্যাজ্য মনে হয়। জীবন অবিরাম স্রোতস্বিনী, মৃত্তিকার নিবিড়ে কান পাতলে শোনা যায় বীজ ও বীজাণু, পরাগ আর পরাগাণু বিন্দু বিন্দু জীবন অঙ্কুরিত করে। যদিচ দিবস ও রাত্রিভর এক ইঁদুর কুটকুট করে কালের রচিত পৃষ্ঠা ছিদ্র করে, তাতে তার দাঁতে সঞ্চিত বিষের বিলয় হতে থাকে শুধু, কালের পাতা ছিদ্র হয় না। বরং আরো তার প্রবাহ গতিমান হয়।

দানিউল, আকমল ও বাহার খুঁজে পায় না ঠিক এই লোকটা যে-লোকাটা কিছুক্ষণের মধ্যে মেইলট্রেনে কাশিনগর স্টেশনে নেমে অনেকখানি পথ হেঁটে এসে বুরুঙ্গিবিলের পাড় দিয়ে চরে এসে পৌঁছাবে-সে নিয়ামুল, এই নিয়ামুলের প্রতি তাদের ক্রোধ কোথায়? নিয়ামুল যদি বলে বসে আমাকে হত্যা করো না তোমাদের পাঁচ লাখ টাকা দেবো-তাহলে?

তাকে হত্যা করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রোধ খুঁজে পেতে তারা আরো নিরাশ্রয় বোধ করে।

এ-তারা কেমন হন্তারক যে শরীরে, শরীরাধিক চৈতন্যের কোথাও ক্রোধের বীজাণু খুঁজে পায় না? ক্রোধবিহীন মানুষের আকার লুপ্ত হয়ে যাবার কথা, মানুষের যে শরীরিক কাঠামো তা ভালোবাসা ও ক্রোধের দৃশ্যমানতা। যা প্রাণ সে-তো একবিন্দু অদৃশ্যমানতায় অবস্থিতি করে। বাহার হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর আকস্মিকতায় শেষ পর্যন্ত ভয় পেতে সম হয়, সে অতঃপর সকল স্তব্ধতার ভিতরে চিৎকার করে ওঠে:
আমি কী দেবতা হয়ে গেছি দানিউল ভাই?
চুপ কর।
না হয় ধ্বজভঙ্গের মতোন লাগে ক্যান!
আমারও শরীর কাঁটা দেয়।
গামছা আছে?
আছে?
আকমল।
কন।
গামছা দিয়া বাহারের চোখ বাইন্ধা দে।
ক্যান। বাহারের চোখ বানবো ক্যান? আমরা কী বাহারকে খুন করবো?
আকমল দানিউলে কথা মোতাবেক বাহারের চোখ বেঁধে ফেলে। চোখ বেঁধে দিলে সে দেবতা না হয়ে মানুষের মতো আতস্কিত হয়। বাহার শব্দের বুদ্বুদের মতো বলে:
দানিউল ভাই, আমার চোখ বাইন্ধা দিছেন। আমি কী নিয়ামুল? আমারে মেরে ফেলবেন?
তোমার চোখ যদি না বান্ধি তা হইলে ছোরা চালাইতে পারবা না।
পারবো।
না, পারবা না। চোখ খোলা থাকলে নিয়ামুলকে দেখতে পাবা- ছোরা মারতে পারবা না।
নিয়ামুলের চোখ বেন্ধে দিবো।
কোনো লাভ নাই। চোখা বান্ধা নিয়ামুলকে দেখলে তোমার হাতে ছোরা লাইগা যাবে- আঙ্গুলের সাথে ছোরা লাইগা যাবে- পারবা না। আর বেশি সময় নাই। রেডি হইয়া যাইতে হবে।
না দেখে মারবা। দেখলে পারবা না। প্রেকটিস করো।
কীভাবে?
ছোরাটা শক্ত করে ধরো।
ধরছি।
এইবার এক পা দুই পা করে সামনে হাঁটো।
কিচ্ছুতো দেখি না।
দেখতে হবে না। দেখলে হবে না- পারবা না। কিন্তু আজ পারতে হবে। আমরা ইস্টুপিড না, বলদ না- বুঝাইতে হবে। বাহার।
বলেন।
আমি এক দুই তিন করে দশ বলবো। দশ বলার সাথে সাথে নিয়ামুল তোমার ছোরার নিচে আইসা যাবে।
আইসা যাবে।
বললামতো আইসা যাবে। দশ বলার সাথে সাথে ছোরা মারবা। হাত কাাঁপলে চলবে না। তোমার মুখে ফিনকি দিয়া রক্ত আইসা পড়বে-অচেনা হইয়া যাবা। স্টার্ট।
এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ। বাহার। বাহার। ছোরা মারো।

বাহার তার হাতের ছোরা উদ্ধত করে, কিন্তু মারতে পারে না। তার দেহ কুঞ্চিত হয়। উদ্ধত ছোরা সংকুচিত হয়ে আসে। দানিউল চিৎকার করে ওঠে।
বাহার। বাহার।
দানিউল ভাই, আমার চোখ খুলে দেন। চোখ খুলে দিলে পারবো।

আকমল, চোখ খুলে দাও।
আকমল। বাহার।
কী
একটা মানুষের ছায়া দেখা যায় না?
কতো দূরে?
ওই পাইকানি টিলার কাছে আসে মনে হয়।
আসে?
হ্যাঁ।
একজন?
একজন। আসতেছে। রেডি হও। ছায়ার নিচে চলে আসো। শক্ত করে লুঙ্গি বান্ধো। দৌড়াদৌড়ি করবা না। আমদের সম্মুখ বরাবর আসলে আগে আমি যাবো- পিছন দিক থেকে।
আমি।
তুমি সামনে দিয়ে ঘুরে যাবা। তুমি সামনে-আমি পিছনে।
আমি
তুমি যাইবা এখান থেকে সোজা। আমি উত্তর দিক, তুমি দক্ষিণে, আর পূবদিকে বিল।
পালাতে পারবে না।
বিলে লাফাইয়া পড়বার পারে।
বিলে নামলে, আমি নামবো বিলে। কথা বন্ধ।
আসতেছে।
হ্যাঁ। চুপ।
আগায় না ক্যান?
বসে গ্যাছে?
উঠবে।
আসে না ক্যান?
নিয়ামুল আসে নাই।
তাইলে কী দেখছি এতোক্ষণ?
কিছু না।
কিছু না।
না।
এখন আমার শরীর কাঁপে। কাটা দেয়।
রাত কয়টা বাজে?
এখনও আসার সময় আছে।
ডর করে। চলেন বাড়ি যাই।
আজ খালি হাতে বাড়ি গেলে চলবে না। একবার জিততে চাই বাহার, একাবার। আমারও ডর করে আকমল। কিন্তু একবার, মাত্র একবার জিতে চাই। এই চাইত্যান গাছের মগডালে অহরকণ্ডল থাকে। অহরকণ্ডল সব পারে- আজ নিয়ামুলকে আইনা দেবে।

দানিউল, আকমল, বাহার যেন মরুভূমির এক উটপাখির ডিম হারিয়ে ফেলে। অকস্মাৎ ঝড় এসে একমাত্র ডিম বালুর আঘাতে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। হারানো ডিম কীভাবে পাবে উটপাখি জানে না। ডিম পাবার আশায় আবার বাসা তৈরি করে। তার বুঝি ধারণা হয়, বাসা পাওয়া গেলেই তাতে রক্ষিত পাওয়া যাবে ডিম। তাই উটপাখি ঠোঁটে করে বালু সরায়, এক জায়গার বালু অন্য জায়গায় জমা করে পরম নৈপুণ্যে বাসা বানায়। যে-কোনো ক্ষতি মানুষকে দিয়েও সে-রকম পুনরাবৃত্তি করায়। দানিউল, আকমল ও বাহারের মধ্যে মরুভূমির বালুকণার মতো দানাদানা ক্রোধ জমা হয়েছিলো তা পুনরার্জন করার আশায় আবার হত্যাযজ্ঞের উপকরণ জড় করে।
বাহার বলে, আজ চলেন দানিউল ভাই। অনীতি লাগছে।
দানিউল বলে, এখনও সময় শেষ হয় নাই। আসবে।

চলেন বাড়ি যাই। শীতে হাড্ডি বইসা যায়।

বাড়ির কথা মনে পড়ে যায় ক্যান? নাই, বাড়ি-ঘর নাই।
দানিউল, আকমল ও বাহারের অন্তর্লোকে সারারাত্রির আবছা কুহক সরে সরে যাবার উপক্রম হয়। তারা যেন টের পায়, অচেনা একটি পুরু বাকল তাদের শরীর থেকে খসে পড়ে যেতে থাকে। সবটুকু বাকল পড়ে গেলে আসতে পারে ক্রোধবিহীন, সক্ষমতাবিহীন চূর্ণ-বিচূর্ণ আকমল, বাহার ও দানিউল। সবচেয়ে বেশি ভয় তাদের নিজেদের জন্য বুরুঙ্গিচরে চাইত্যান গাছের নিচে দাড়ানো তিনজন নিজেদেরই প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে থাকে। প্রকৃত আকমল, দানিউল ও বাহার- এর বল্কলের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসার আতঙ্ক যেন সবার আগে টের পার দানিউল। সে প্রাণিকুলের সর্বোপর আসন থেকে নিজেকে নামিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

দানিউল ভালুক নাচের উদ্দাম তৈরি করার প্রচেষ্টা চালায়।
নাচো। হল্লা করো। আকমল। বাহার। নাচো। হৈ। হৈ।
এইভাবে। এইভাবে। চিৎকার কর। তিনজন হয়ে যাবো অগুণতি- বহুজন।

    ভালুক। ভালুক।
    ভালুক। ভালুক।
    ভালুক। ভালুক।
    হৈ। হৈ।
    হৈ। হৈ।    
    হৈ। 
    হৈ। হৈ।
    হৈ। হৈ।
    হৈ। 
    হৈ। হৈ।
    হৈ। হৈ।
    হৈ। 

    ম্যাঁও।
    ম্যাঁও। ম্যাঁও।
    বিলাই সরাত করিয়া আয়
    কি ওরে বিলাই ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও
    ম্যাঁও
    দুঙ্গরে আছে তুষের আগুন বিলাই
    আস্তে ফেলেন পাও।
 
    কি ওরে বিলাই ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও
    ম্যাঁও।
    ছিকিয়ায় আছে ভাজামাছ বিলাই
    পাড়িয়া নিয়া খাও।
    কি ওরে বিলাই ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও
    ম্যাঁও।
    পইথানে আছে বান্ধা হুক্কা বিলাই
    পানি ফ্যালায়া খাও
    কি ওরে বিলাই ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও
    ম্যাঁও

    ঘরে আছে ননদিনী বিলাই
    আস্তে করেন রাও
    কি ওরে বিলাই ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও
    ম্যাঁও

ভালুক নাচের পরিধি তাদের স্মৃতি কিছুটা দখল করে নিতে পারে, যে-মত ডিমের পুরু সাদার বাকল ঢেকে দিতে পারে তার ভিতরকার হলুদ কুসুম, ফলত কুসুম যেমন অসত্য সাময়িক কালের বিবেচনায়, সে-মত রাত্রির ঘনায়মান প্রাচীর ভেদ করে যে বাহার বাড়ি যেতে চায়, কী আকমল শনাক্তকরণের অক্ষমতায় বিবমিষা বোধ করে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় দানিউল নিজে পতনশীল দুই দেওয়ালের মধ্যে পড়ে বিনষ্ট হয়, তার সবকিছু ঢাকা পড়ে। ফলে দূর সাইবেরিয়া থেকে বরফের কণা নিয়ে এ বুরুঙ্গিচলের কলমিশাক ও ফুটকির ভিড়ে এসে চড়ো হয় যে অডা পাখি, বালি হাঁস- এক সঙ্গে পাখ মেলে জলের শাখা প্রশাখায়, ওড়ে শাঁৎ শাঁৎ; মাটির খোঁড়লে থাকে মাছরাঙা, ডোরাসাপ বিনাশী-বিশ্বাসে ক্ষেতের পিঠেপিঠে ঘোরে, কালো কুটকুটে পোকা ফুলপরী ধান খেয়ে ফেলে, ভুতুম পেঁচা বিষওয়ালা দাঁতের ইঁদুর খেতে আসে, ইঁদুর দৌড়ে কিট কিট কিট, হুতুমপেঁচা বলে: ভুতুম, বাঁকাশিঙ মহিষের পিঠে এই এতোটুকু তিলের সমান বালক রাজকুমার হয়ে চড়ে বসে, বলে, এই হাঁট হাঁট হাঁট বেটা- টাট, টাট, টাট; গরু আসে দলে দলে তার শিঙে বসা ফেঙে- কাক খুঁটে খায় শোরর ঘাড়ের ঘা, মহিষ জানে না হারজিৎ কী, তবু লড়াই করে - উপরিউক্ত সবকিছু অধিকতর সত্য হয়। আরো অক্ষয় হয় এই যে, ভালুকনৃত্য-করা অচেনা হিংস্রতার স্বভার এ বুরুঙ্গিচরের নৃশংস নির্জনতায় পৌষ মাসের দুধসর রাতে আবির্ভূত হলো।

আকমল বলে, দানিউল ভাই, রাত শেষ হইয়া যায় নিয়ামুল আসে না ক্যান?
অন্য পথে গ্যাছে।
অন্য পথ কই?
আসে না?
দেখা যায় না।
সামনে আগাইয়া দেখ।
ছায়াটা যে দেখছিলাম।
লুকাইয়া যাইতে পারে।

লুকানোর জায়গা কই?
খুঁজে দেখ। পাইতেই হবে বাহার। কতোক্ষণ পরে আজান পইড়া যাবে- পাইতেই হবে।

তারা কিছুটা ধন্দে পড়ে। এ-প্রাগৈতিহাসিককালের রাত অন্ধকার দিয়ে সকল বাতাবরণ ঢেকে রাখে নি; সব দেখা যায়, কিন্তু এ মৃদু আলোর মেলায় কিছু পাওয়া যায় না, সবকিছু খসে খসে হারিয়ে যায়। এ যেন এক নগ্নতারই প্রাকৃতিক রহস্য। আকাশে চাঁদ রয়েছে, ঘোড়ার কেশরের মতো রাত্রি বহমান, তার ভিতরেই ধাঁধা লেগে থাকে, চাইত্যানগাছ চেনা গাছটি থাকে না, তার প্রতিকল্পে রূপান্তরিত হয়, জোড়মল্লিকা গ্রামের উত্তর মাথা থেকে একটি কেরোসিন বাতির আগুন দেখা যায় কিন্তু কেরোসিন বাতির লৌকিক আকৃতি লুপ্ত হয়ে বরং মনে হয় কুণ্ঠাহীন আকাশ উপুড় হয়ে পড়ে, কেরোসিন বাতি যেন একখণ্ড তারকার ইঙ্গিত। চারপাশের নৈঃশব্দ নকশাকাটা, কুয়াশা উড্ডয়নশীন ও নিবিড়। কারা যেন নিঃশব্দে কোলাহল করে, প্রতিসৃয়মান প্রার্থনার গাথা শ্রবণে আসে, বুরুঙ্গিচরে নামহীন সংখ্যাহীন শিশুরা- যে শিশুর কোনো আকৃতি পায় নি, মন্ত্রসদৃশ ছোটাছুটি করে, বুদ্বুদ তোলে, কলহাস্য করে নীরবে, খেলে।

    গিঙ্গুরে গিঙ্গু
    কিরে গিঙ্গু
    গাছে ক্যারে উঠছস?
    বাঘের ডরে
    বাঘ কই?
    মাডির তলে।
    মাডির তলে কি খা?
    ছোডে ছোডো ঘুঙ্গুর খা।

    তোর কয়ডা ভাই?
    সাতটা ভাই
    একটা ভাই দিবে?
    ছুইতে পারলে কানা ভাইডা নিবে।

    কী দিয়া যাইবে?
    গিঙ্গু কইরা যাইয়াম।

    চেনে নেনে চেনে নেনে চেনে নেনে
    চেনে নেনে চেনে নেনে চেনে নেনে

    কোন গাঙ্গে পড়বে?
    চিনির গাঙ্গে পড়বে, না তেঁতুইয়ের গাঙ্গে পড়বে?
    চিনির গাঙ্গে পড়রাম।
    ধুপ্পুস।

এ-খেলা নিঃশব্দ কলহাস্যে বার বার হতে থাকে; একবার তারা যে বিভ্রমে এ-খেলা দ্যাখে তা অন্য সংশয়ে হারায়, অতঃপর হাওয়া, কুয়াশা আর নির্মম অন্তরীক্ষ সত্য হয় যদিবা, আবার অসীম রেখার ধ্বনিময়তা ও দৃশ্যাতীত বিলয়ের শ্রবণ তাদের সামনে ও চারপাশে অধরা ক্রীড়ানুষ্ঠান সংরচিত হতে দ্যাখে:

অনেক ছেলের ভিতর থেকে একজন নাউট্যা চড়–ই সাজে। সে হাঁটু এবং হাতের পাঞ্জার ওপর ভর করে হামাগুড়ি দিতে দিতে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। কখনো মনে হয় নাউট্যা চডুই একজন, আবার একসময় মনে হয় অনেকে নাউট্যা চডুই সাজে, এবং খেলাটি এক সঙ্গে কয়েক দিকে হতে থাকে। নাউট্যা চডুই যখন হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে তখন চতুষ্পদ জন্তুসদৃশ লাগে।

কিন্তু এ-চতুষ্পদ জন্তুর চডুই পাখিতে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় লাগে না। অন্য খেলোয়াড়দের একজন এসে তার দুই পা এবং অন্য আরেক জনের কোমরে ধরে চতুষ্পদকে ওপরে তুলে ধরে। সে তখন বাদুড়ের মতো ঝোলে, আর হাত থাকে বুকের সাথে সংলগ্ন। ছেলে-মেয়ে নাউট্যা চড়–ইকে প্রশ্ন করে, চড়–ইও তার উত্তর দেয়। এ যেন এক স্বর্গ অথবা দোজখ লোকের ভাষা।

ছেলেমেয়ে    :    ও চড়–ই তোর পোদকা মরা?
চড়–ই    :    ভাতে মরা।
ছেলেমেয়ে    :    ভাত কনে ন দে?
চড়–ই    :    বউয়ে ন দে।
ছেলেমেয়ে    :    বউয়ের ধরি মারিত ন পারছ?
চড়–ই    :    পোয়া ছার কাঁদে।
ছেলেমেয়ে    :    পোয়া ছার নাম কি?
চড়–ই    :    কড়ই মরই।
ছেলেমেয়ে    :    তোর নাম কি?
চড়–ই    :    নাউট্যা চড়–ই।
ছেলেমেয়ে    :    তা হলে চড়–ই নাচ দেখা

চড়–ই অতঃপর মনের সব রঙ মিশিয়ে নৃত্যপ্রয়াসী হয়। গীত হয়। আর চড়–ই নাচতে থাকে।

    না টুন টুন নাউট্যা চড়–ই
    না টুন টুন নাউট্যা চড়–ই

    না টুন টুন নাউট্যা চড়–ই
    না টুন টুন নাউট্যা চড়–ই

    না টুন টুন নাউট্যা চড়–ই
    না টুন টুন নাউট্যা চড়–ই
এসবের ভিতরে সহসা বরফলাগা হাওয়া আসে। হাওয়া শনশন করে। আগুন পুড়লে হাওয়া তীব্র হয়। আজ রাতে এখানে আগুন পুড়োছিল সেই টান ও আবেশে হাওয়া সুতীক্ষè হয় কী-না কে জানে। চারদিক থেকে হাওয়া এসে যেন আগুনের মধ্যে গোল হয়ে পড়ে। তেমন একটি হাওয়ার ঘূর্ণি তাদের সামনে দিয়ে বাওকুড়ানিমতো পাক তোলে।

আকস্মিক তারা হাওয়ার সঙ্গে দৌড়পাক খেতে শুরু করে।
বাওকুড়ানি।
বাওকুড়ানি।
বাহুনিতে লাফাইয়া পড়ি। হোই বাউকুড়ানি।
বাহুনি।

হোই বাওকুড়ানি।
বাওকুড়ানি। বাওকাড়ানি।
পাইছি। পাইছি দানিউল ভাই।
কই?
লুকাইয়া পইড়া আছে। আমার চোখ বান্ধেন দানিউল ভাই। আমি মারবো।

আতঙ্কে, অচেনায়, অদৃশ্য বিদ্যুচ্চমকে তারা মানুষ ও মুর্তির ভেদাভেদ লুপ্ত হয়। খড়ের একটি মূর্তি বা কাকতাডুয়া তার দুদিকে বাহু প্রসারিত; মাথা, গলা, শরীর যা হাত নয়, মাথা নয়, গলা বা শরীর নয়-শরীরের, বাহুর ও মস্তকের সঙ্কেত। সঙ্কেত ও বস্তুর চিত্রকল্প জীবনের প্রতীকে দৃশ্যমানতা লাভ করে, কেননা, যারা এ-চিত্র আবিস্কার করে তারা ভালুক নৃত্যে সমবেত হয়-নিজের অস্তিত্ব বিলোপ করতে চাইলেও অক্ষমতা, ক্রোধ ও কল্পনা তাদের নিজেকে অতিক্রম করার বাসনা রুদ্ধ করে। তারা তিনজন খড়ের মূর্তিকে বেড় দিয়ে দাঁড়ায়।

আকমল, আমার চোখ বাইন্ধা দে।
আমার চোখ বান্ধেন তাড়াতাড়ি।
আমার চোখ বান্ধ। আমি আগে মারবো।
না আমি ।
আমি।

চোখবাঁধা দানিউল, আকমল ও বাহার অতঃপর নিয়ামুলকে- একটি খড়ের প্রতিমা- ছোরাবিদ্ধ করে।
ফলে, তরা একবার, অন্তত একবার জিততে পারে-এ উদ্দীপনায় চোখের বাঁধন খোলে।

চোখ খোলার পর তার দ্যাখে নিয়ামুল। সত্যিকার নিয়ামুল।

মূহূর্তকালের বিদ্যুচ্চমকে এক দুর্বিনীত ঘূর্ণায়মান সংহারচক্র তাদের তিনজনের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে। বাহার যদি ভাবে তারা হত্যা করে ফেলেছে দানিউলকে, দানিউলের মধ্যে ঝাঁকি দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সেই বোধ- তারা যেন ছুরিকাঘাতে ছিন্ন করছে আকমলকে, আকমল হয়তো ভাবে তারা সংহার করছে বাহারকে।

বাহার।
দানিউল ভাই।
আকমল।
বাহার।

আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কেউ কি আমার চোখ তুলে নিয়েছে? আকস্মিক কিছু নাই- না রাত্রি , না দিবস, না মুক্তার দানা, না তালগাছের শীর্ষ, বেতলাজঙ্গলের নাকি ভূত কেউ না।

    ঝিক ঝিক! ঝিক ঝিক!
    ঝিক ঝিক! ঝিক ঝিক!

কেউ জানে না কীভাবে একদূরন্ত ট্রেন তীব্র হুইসেল বাজিয়ে সবার ভিতর ঢুকে পড়ে। কেবল এক হুইসেল- পাঁ- পাঁ

    ঝিক ঝিক! ঝিক ঝিক!

আবার কি তারা মায়ের নিবিড় নীল নীলিমাপূর্ণ সামান্য এক তলপেটে প্রথম বিন্দু থেকে শুরু করে? যেখানে আগুনের নির্লিপ্ত আঁচে কোনো কালিমা পড়ে নি, মক্তবের শীতল মেঝের মতো শীতার্ত এক চুম্বনের মধ্যদিয়ে আবার শুরু করে। কিন্তু পারে না। এই যে নিঃশঙ্কা নিকষ কালো রাত্রির ফালির ভেতরে একান্ত মুখোমুখি সম্পূর্ণ এক আর সম্মিলিত তিনজন-একজন আরেকজনের কাছ থেকে পালাতে চায়, কিন্তু পরস্পরকে ঘিরে ফেলে।

ছোরার আটাশটি আঘাতে তার দেহ ছিন্নভিন্ন। তারা দৌড়ে পালতে চায় কিন্তু পারে না। সমস্ত শরীরে কাঁটা গজিয়ে ওঠে। টেউ খেলে দৃশ্যমান প্রকৃতরি অবস্থিতি লুপ্ত হয়। কিন্তু মানুষ ও প্রকৃতির সর্ম্পকের মধ্যে রঙ তার মৌলিক।

বেগুনি, নীল, হুলদ, সবুজ, কমলা, লাল ও অকাশি রঙের প্রবাহে খণ্ডিত ও মুহূর্তকালীন সাপের মাথা, চাঁদের আলো, গজাল মাছ, মৌলভি, ঘোড়ার পা, নৌকার গলুই, টিকটিকির লেজ, মড়াখোলা, কিরিচ, টুপিপরা মুণ্ডু, মাছের দাঁত, মহিষের শিঙ, সড়ক, তালগাছ, বাঁশঝাড়, ইলেকট্রিকের খাম্বা, চামোপাড়া, ঝগড়ি, জোড়মল্লিকা, সিংহের মাথা, ভেড়ার দৌড়, বেতবুনিয়া, পুকুরঘাট, ভাঙা দালান, ঘন্টাধ্বনি ঢং ঢং ঢং। ঢং ঢং ঢং।

ঘন্টাধ্বনির বেগুনি রঙের ওপর নিয়ামুলের মৃতদেহ ভাসে। মৃতদেহ যেন শরীর নয়, একটি রঙের রেখা। এ-রেখা হারিয়ে যায় না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আরো তিনটি রঙের রেখা- দানিউল, আকমল ও বাহার। মৃতদেহ নির্দিষ্ট দূরত্বে তাদের শরীরের সঙ্গে কী জোড়া লেগে যায়?

তারা ভুলে যায় মৃতদেহ সৎকারের পথ ও কৌশল।
কী করবো।

কী করে। কী করতে হয়?
কী করবো, দানিউল ভাই।
কী করবো?

নিসর্গে যখন কিছু থাকে না-সকল দৃশ্যমানতা কালের কররেখায় রেখায় হারায়, বস্তু ও মৃতদেহের আকার থাকে রঙের চিহ্নে তখন পৌষ রাত্রির ঠাণ্ডা হাওয়া শনশন করে। যে-কালের রাত্রিমর্মর এক ফোঁটা আলোর অভিলাসে পৃথিবীর পূবদিগন্তে ধাবমান তখন শূন্য বিলয় থেকে কাক ডাকে:

    কা। কা।
    কা। কা।
    কা। কা।
    কা। কা।

ধরাপৃষ্ঠে এ-মত দুটি কাক নামে।
দুটি কাক লড়াই করে-অনতিক্রান্ত লড়াই।

    কা। কা।
    কা। কা।
    কা। কা।

দানিউল, আকমল, বাহার দ্যাখে একটি কাক আরেকটি কাককে ঠোকরায়। হত্যা করে।

ঠোঁট দিয়ে মাটি খোঁড়ে।
মৃতদেহ গর্তের ভিতরে রাখে। মাটি চাপা দেয়।
একটি কাক শূন্যে হারায়।

    কা। কা।
    কা। কা।

উন্মাদের মতো দানিউল, আকমল ও বাহার মাটি খোঁড়ে।
গর্ত বানায়।
মাটির ভিতরে মৃতদেহ রাখে। মাটি চাপা দেয়।

এবার পালাতে হবে। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ তাদের পা যেতে পারে যে-কোনো দিকে। যখন দ্যাখে, তারা যে-কোনো দিকে চলে যেতে পারে, তখন আর পা চলে না। কেন পা চলে না কেন? তারাতো জেনে গেলো, কীভাবে হত্যাউত্তর মৃতদেহ লুকাতে হয়। ওরা যা করে, তা- কে কান্না বলে। ওরা তখন না হেঁটে, না পালিয়ে:

হুহু করে কাঁদে।
প্রকৃতি বুঝি এই প্রথম পৃথিবীতে কান্নার ধ্বনি শ্রবণ করে।
রাত্রি শেষ হবার আগে আবার অন্ধকারে নামে।

প্রিয় দর্শক, আমরা প্রার্থনা করি, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উদিত হোক, বা শিমুলপ্রতিমা বোনের মুখ-তার চৌদিকে পশর, তারা যে ভাবে, কপালের বলিরেখার মতো ভাঁজে ভাঁজে আরো রাত্রি নামুক- এ মত তারা রাত্রি ও দিবসের সংরাগে দাঁড়িয়ে ভাবে।

Badruzzaman Alamgir বদরুজ্জামান আলমগীর : নাট্যকার