Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

এক পালায় বন্দী করি তিন কাল

Written by সাক্ষাৎকার : গোলাম শফিক.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

‘আলকাপ’ বাংলাদেশের একটি বহুল চর্চিত ও জনপ্রিয় লোকনাট্য রীতি। উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী এলাকা এখনও এ নাট্যরীতির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সাধারণভাবে আলকাপ অর্থ ‘আল’, ‘কন্টক’, ‘হুল’। আর কাপ হচ্ছে ‘কাপট্য’, ‘কৌতূককারী’। ‘আলকাপ’ শব্দের সাথে দেবতা শিবের নাম জড়িয়ে আাছে। কেউ কেউ আলকাপকে ‘আলকাটাকাপ’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ মনে করে থাকেন। সে বিচারে ‘আল’ মানে সীমানা (জমির আল), আর ‘আলকাটাকাপ’ অর্থ সীমাহীন হাসি-তামাশা বা অসংযত রঙ্গ-রসিকতা।

গত ২২-২৮ ফেব্রুয়ারি (২০০৭) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত লোকনাট্য সপ্তাহে আলকাপ গান পরিবেশন করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রখ্যাত আলকাপ শিল্পী শফিকুল ইসলাম সরকার ও তার দল। তাতে পরিবেশন করা হয় স্বদেশী আলকাপ দেওর-ভাবী। উক্ত লোকনাট্য সপ্তাহে নগরবাসী প্রথমবারের মতো উপভোগ করেন বাঙালির নিজস্ব ঘরানার বিভিন্ন লোকনাট্যের উপস্থাপনা রীতি। দলটি দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আসে ১লা বৈশাখ (১৪১৪) পালাকার-এর পাঁচ বছর পূর্তি উৎসবে। এতে পরিবেশন করে ঠগের আলকাপ লিয়া দি না। দুটি অনুষ্ঠানেই শফিকুল ইসলাম সরকারের ব্যক্তিগত অভিনয় নৈপুণ্য ও দলীয় দক্ষতায় দর্শক চমৎকৃত হয়েছেন। দ্বিতীয়বার এ শিকড় সন্ধানী শিল্পীকে কাছে পেয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাট্যকার গোলাম শফিক।

প্রশ্ন    
‘আলকাপ’ শব্দটির অর্থ আমাদের একটু জানান।
উত্তর    
‘আল’ হচ্ছে আলগা কথা, নিত্য নতুন কথা, অযৌক্তিক কথা। ‘কাপ’ মানে কৌতুক। দুটো শব্দ নিয়েই ‘আলকাপ’। ‘আল’ বলতে খোঁচাও বোঝানো হয়। আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে ‘ঘোচা’ বলে। তবে শুদ্ধ বাংলার ‘খোঁচা’ বলতে কাউকে দৈহিকভাবে পিন কাঠি ইত্যাদি দিয়ে খোঁচা দেয়া বোঝায় যা দৃশ্যমান। আর ‘ঘোচা’ হলো অদৃশ্যভাবে কাউকে খোঁচা দেয়া বা আঘাত করা।  
প্রশ্ন    
এর উৎপত্তি?  
উত্তর
এটি দুইশ-আড়াইশ বছরের পুরনো। আমার জানা মতে, বোনাকানা নামের একজন শিল্পী এতদাঞ্চলে এটি প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি একজন অশিক্ষিত মুসলমান ছিলেন যিনি ভারত থেকে এসেছিলেন। তবে হিন্দুরাই ছিলেন এ শিল্পরীতির বাহক।
প্রশ্ন    
আলকাপে আপনারা সাধারণত কি ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করেন?
উত্তর    
অবশ্যই একটি কাহিনী। তবে একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন এসব কাহিনীতে অতীত ঐতিহ্য আছে, যা বর্তমান প্রেক্ষিতে স্থাপন করে পরিবেশন করা হয়। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতের একটি ইঙ্গিতও আপনি এতে খুঁজে পাবেন।   
প্রশ্ন    
আলকাপের বিশেষত্ব কি?
উত্তর    
যেসব ঘটনা আমরা চারপাশে দেখি তার উপর ভিত্তি করেই তৈরি করি নাটকের কাহিনী। এটি বেশির ভাগই উপস্থিত বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল। এর কোনো লিখিত পাণ্ডুলিপি নেই। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এটি চলে যুগ থেকে যুগে।
প্রশ্ন    
আপনার গুরু কে?
উত্তর    
আমার গুরু মরহুম জাকারিয়া সরকার। তিনি আমার স্বগ্রাম কাশ্মীরপাড়ারই বাসিন্দা ছিলেন।
প্রশ্ন    
সেটি কোথায়?
উত্তর    
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলায়।
প্রশ্ন    
আপনি নিজে কখন দল গঠন করেন?
উত্তর    
১৯৮৭ সালে।
প্রশ্ন    
উত্তরাঞ্চলের শিল্পীরা কি এটিকে একটি পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছেন?
উত্তর    
হ্যাঁ। এখন এ গানের উপরই অনেকে নির্ভরশীল।
প্রশ্ন    
তাতে কি সংসারের চাকাটা চলমান রাখা যায়?
উত্তর    
পুরোপুরি চলমান রাখা মুস্কিল। কেউ কেউ অন্য কাজও করে। যেমন-কৃষি, দোকানদারী, আমবাগান কেনা-বেচার ব্যবসা ইত্যাদি।
প্রশ্ন    
আপনি নিজে আলকাপকে কি হিসেবে নিয়েছেন?
উত্তর    
নেশা হিসেবে। মানুষকে আনন্দ দিয়ে নিজে আনন্দ পাই। পূর্ব পুরুষের এ পেশা কিম্বা নেশাকে টিকিয়ে রাখা আমি আমার দায়িত্বের অংশ হিসেবে মনে করি।
প্রশ্ন    
আপনার ভবিষ্যত বংশধররা কি করবে?    
উত্তর    
দেখুন, আমার দাদা আলকাপ করতেন। আমিও করি। আমার ছোটভাই ইতোমধ্যেই আমার সাথে যুক্ত হয়েছে। আমার ছেলেমেয়েরাও আশা করি এ বিদ্যাটি শিখে নিবে।
প্রশ্ন    
আলকাপে কি মেয়েদের সম্পৃক্তি আছে?
উত্তর    
আলকাপ-যাত্রার সময় থাকে যা রাতব্যাপী চলে। স্বদেশী-আলকাপেও আছে।
প্রশ্ন    
সাধারণ দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের জন্য এর উপস্থাপনা কৌশলটি একটু খুলে বলুন?
উত্তর    
দলের মালিককে বলা হয় সরকার। সাধারণত তিনিই মূল গায়েন। সুর-সংগীত-বাদ্য এগুলো নির্ধারণ করার পর উন্মুক্ত স্থানে একটি কাহিনী উপস্থাপন করা হয়। এতে প্রচুর হাস্যরসের উপাদান থাকে, থাকে অদ্ভূত দৈহিক অঙ্গভঙ্গি। আর আছে নৃত্য, যা ছেলেরাই মেয়ে সেজে করে থাকে।  
প্রশ্ন    
এ যাবৎ কয়টি পালা রচনা করেছেন?
উত্তর    
প্রায় চল্লিশটি।
প্রশ্ন    
২টি তো দেখলাম। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পালার করুন তো।  
উত্তর    
চাষা-ভদ্র, ডোম-ধোপা, চামার-কামার, হিন্দু-মুসলমান, রাধা-কৃষ্ণ, গোষ্ঠ-বৃন্দা, আম-যোগার, শাশুড়ী-বহুর ঝগড়া, ননদ পূজা, ব্রাক্ষ্মণের পূজা, রাজা হরিশচন্দ্রের আলকাপ,     গোলাবাজ মেলার আলকাপ, লক্ষ্মীর হাতে ভিক্ষার ঝুলি, সতী নারীর বনবাস ইত্যাদি।
প্রশ্ন    
দর্শকের সাথে আপনাদের সম্পর্ক কী দাঁড়ায়?
উত্তর    
মনে রাখবেন দর্শকের সাথে সুসম্পর্ক না থাকলে আমার দলটি ৫,০০০ রাত আলকাপ গান শোনাতে পারতো না। এটি সম্পূর্ণ দর্শক-নির্ভর একটি পালারীতি।
প্রশ্ন    
ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করুন, মানে আমরা নাগরিক মানুষ যেটাকে ইন্টারঅ্যাকটিভ ড্রামা বলতে চাই সেটা কি এ রকম?
উত্তর    
আমরা অভিনয়ের সময় দর্শকদের সাথে কথা বলি। কোনো কোনো ঘটনা বা নাট্যাংশে তাদের সাক্ষী রাখা হয়, তাদের উপর বিচারের ভার দেয়া হয়। এভাবে পুরো পালাব্যাপী তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে করে আমরা রাত পার করে দিই, যদিও এটা দর্শককে ধরে রাখার একটা কৌশল। তবে আমরা বিশ্বাস করি দর্শকই এ গানের প্রাণ। তাই কম দর্শকে আমাদের মন ভরে না।
প্রশ্ন    
নাটক, গান, নৃত্যসহ সকল শিল্পই মহড়া-নির্ভর। কোনো কোনো শিল্পচর্চায় ব্যাপক পড়াশুনার প্রয়োজন হয়। আলকাপে মহড়া ছাড়া অন্য কোনোপ্রকার পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন হয় কিনা? আলকাপ নাটক বা পালায় সাধনার গুরুত্ব কতোটুকু?
উত্তর    
আলকাপে পাল্টাপাল্টি গান বা কবির লড়াইয়ের প্রচলন আছে, যা ২ অঞ্চলের ২টি দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রশ্নোত্তর পর্ব দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলে। এমন কি ১৫ দিনও চলে। দর্শকরা টিকেট কেটে এ নাটক দেখে থাকেন। সাধারণত ধর্মীয় বিষয় এর উপজীব্য। যেমন- রাধাকৃষ্ণে পালা। তাতে কবির লড়াইয়ে নামবার আগে আমাদের ব্যাপকভাবে পুরাণ ঘাটাঘাটি করতে হয়।  
প্রশ্ন    
এসব পালায় প্রপ্স বা সাজ-সরঞ্জামের কী ব্যবহার আছে?
উত্তর    
সরঞ্জাম বলতে একটি চেয়ার ও প্লাস্টিকের লাঠি। কাহিনীর প্রয়োজনে অন্যান্য দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয়। যেমন- শাশুড়ী বহুর ঝগড়া পালায় হাড়ি-পাতিল এ-সব ব্যবহার করতে হয়।  
প্রশ্ন    
অভিযোগ উঠেছে যে, শিকড়েও অনেক পঁচা জিনিস আছে। অর্থাৎ অশ্লীলতার প্রসঙ্গ। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্যের সংলাপ ও নৃত্যে যে অশ্লীলতার স্পর্শ দেখা যায় সে বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?  
উত্তর    
এটি আসলে যুগের দাবী। ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্যগুলো আধুনিকায়নের স্পর্শে তাদের আগের আবেদন হারিয়েছে। তাই বর্তমানের দর্শকদের এর প্রতি আগ্রহী করার জন্য অতিরিক্ত কিছুটা করি, কিছুটা শুড়শুড়ি দিতে বাধ্য হই। কিন্তু আমাদের মনে কোনো অশ্লীলতা নেই।
প্রশ্ন    
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং আবার আসবার আমন্ত্রণ।
উত্তর    
আপনাকেও ধন্যবাদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসবেন।
প্রশ্ন    
অবশ্যই আসবো। কখন আসলে ভালো হয়?
উত্তর    
আমের সময়।
প্রশ্ন    
চাঁপাইয়ের আম তো ঢাকায় বসে পাই।
উত্তর    
তারপরও নিজ হাতে গাছ থেকে পেড়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। যেন নিজ হাতে গাই দোইয়ে দুধ পান।

গোলাম শফিক : নাট্যকার, নাটক বিষয়ক প্রবন্ধ লেখক। সদস্য- পালাকার