Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক নাট্যোৎসব ২০০৭

Written by রবাব রসাঁ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

বাংলাদেশের মঞ্চে পাশ্চাত্যের নাটক উপস্থাপন করা সত্যিই, এক দূরূহ কাজ। বিশেষ করে, ধ্রুপদী ইউরোপীয় বা আমেরিকান নাটক। এসব নাটক দর্শকদের সামনে সমকালীন করে উপস্থাপন করা যেমন কঠিন, কষ্টসাধ্য, তেমনি দুঃসাহসিক ও ঝুঁকিপূর্ণ। দর্শকদের কথা ভেবেই যেহেতু নাটক করা তাই দর্শকদের ভালো লাগা বা মন্দ লাগার ওপর গুরুত্ব দিতে হয়। একথা প্রায় সব নাট্যকার, নিদের্শকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যে, দর্শকদের তৃপ্তি তাদের পরিতৃপ্ত করে। সে বিবেচনায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের দ্বিতীয় বার্ষিক নাট্যসপ্তাহ দর্শকদের আকৃষ্ট করেছিল, আনন্দ দিয়েছিল এবং তুষ্ট করেছিল।

১০ দিন ব্যাপীএই নাটোৎসবে মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৩টি দেশি-বিদেশি নাটক। এদের অধিকাংশই ধ্রুপদী ইউরোপীয় বা আমেরিকান। প্রায় সবগুলোই বিয়োগান্তক। বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নির্দেশনায়, অভিনয়ে ও কারিগরি ভাবনায় পরিবেশিত এ-সব নাটক দেশের নাট্যান্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করল। ভুবনজোড়া খ্যাতি যেসব নাট্যকারদের, যাদের নাটক যুগ যুগ ধরে মঞ্চস্থ হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, তাদের নাটকগুলো যে স্বাচ্ছন্দ্যে এদেশের মঞ্চেও পরিবেশিত হতে পারে, আপন হতে পারে নাটকের চরিত্রগুলো, গেল উৎসবে তার প্রমাণ মিলল। শুরু হয়েছিল নভেম্বরের ১৮, উইলিয়াম শেক্সপীয়রের ওথেলো-র মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। আর শেষ হল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘কবি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ পরিবেশনের মাধ্যমে, ২৭ নভেম্বর।

মাঝের দিনগুলোতে ছিল সুরেন্দ্র ভার্মা’র কয়েদ-ই-হায়াৎ, ইউজীন ও’নীল-এর ডিজায়ার আন্ডার দ্য এলমস, ইউজিন আয়েনেস্কো’র দ্য চেয়ার্স ও দ্য লেসন, নূরুল মোমেন-এর নেমেসিস, স্যামুয়েল বেকেট-এর ওয়েটিং ফর গডো। দর্শক আরো উপভোগ করেছিলেন নিকোলাই কালিয়াদা’র ব্রাত্য, জ্যঁ রাসিন-এর ফেইড্রা, ফার্নান্দ আরাবল-এর দ্য টু এক্সিকিউশনারস, হেরল্ড পিন্টার-এর নো ম্যান’স ল্যান্ড এবং জন অসবর্ণ-এর লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার। এসব নাটকের নির্দেশকদের সাফল্য এই যে, তারা পাশ্চাত্যের নাটকগুলোকে স্বদেশী দর্শকদের জন্যে দেশীয়করণ করে বা বিষয়গুলোকে সমকালীন করে উপস্থাপন করেন নি বরং সমকালীন দর্শকদের সামনে সাবলীল উপস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই দর্শকদের কাছে বিষয়গুলোকে বা চরিত্রগুলোকে ভিনদেশি অথবা অচেনা মনে হয় নি। দর্শক বিষয়গুলোর সর্বজনীনতা এবং চরিত্রগুলোর চারিত্রিক গুণ-দোষের ভিতর একটা আত্মিক মিল খুঁজে পেয়েছিলেন।

ওথেলো’র বিষয়বস্তু বাঙালি দর্শকের কাছে নতুন করে পরিচয় করে দেয়ার কিছু নেই। তার বিয়োগান্তক পরিনতির কথা কারোরই অজানা নয়। কিন্তু, এই পরিনতির পেছনের ঘটনাগুলো, বিশেষ করে, ইয়াগোর কুট-কৌশল, ওথেলোর মানসিক যন্ত্রণা আর ডেসডিমোনার সরলতা, যারা তাদের সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে যত বেশি ফুটিয়ে তুলতে পারেন দর্শক-মনে তাদের আসন ততই স্থায়ী হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় মঞ্চ, পোশাক আর রূপসজ্জার দক্ষতা। সত্যিই এ এক অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ ঝুঁকি সব কলাকুশলীদের। যেদিন নাটকটি মঞ্চায়ন করার ভাবনা মাথায় আনেন এর নির্দেশক, অদিতি আরজু, অনুমান করা যায় যে, সেদিন থেকেই তাকে ভাবতে হয়েছে অনেক কিছু। নাটকটির পরিবেশনায় যদি কোনো কারিগরী ভুল-ক্রটি থাকে তা নিয়ে বিজ্ঞজনেরা বলবেন। তবে এর পরিবেশনা সাধারণ দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। ওথেলো’র ভূমিকায় ছিলেন আশিকুর রহমান লিয়ন। ওথেলোর অর্ন্তদহন, রহমানের সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক উপলব্ধি করেছিলেন। এক্ষেত্রে রহমানের রূপসজ্জা যোগ দিয়েছিল আলাদা মাত্রা। তার কৃষ্ণাঙ্গ রূপসজ্জা তাকে ঘনিষ্ঠ করেছিল দর্শকের সঙ্গে। ইয়াগো’র চরিত্রকে তুলে ধরেছিলেন আতিকুর রহমান। তার চপল-চঞ্চল চলাফেরা খুব একটা বিরক্তিকর মনে হয় নি। এক্ষেত্রে নীলা সাহা অর্থাৎ, ডেসডিমোন’কে অনেকটা ম্রিয়মান মনে হয়েছিল। তার চপলতা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল তার সারল্যের আড়ালে।

মঞ্চ ও পোশাকের জন্যে নওশীন লায়লা ও তামান্না হাসান বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে। শেক্সপীয়রের নাটকের ভেনিস শহর ও ভেনিসীয়দের চিত্রিত করতে তারা খুব জমকালো মঞ্চ ও পোশাকের আশ্রয় নেন নি। বরং সাধারণ থাম ও কাঠের সিঁড়ির ধাপ দিয়ে তারা শহরের অবকাঠমোকে বোধগম্য করেছিলেন। পোশাকও ছিল সাধারণ। ছেলেদের গায়ে সেন্টো গেঞ্জি ও মেয়েদের ঘরের সাধারণ পোশাকেও যে ওথেলো’র চরিত্রগুলোকে প্রকাশ করতে দৃষ্টিকটু দেখায় না, এ নাটকের পোশাক-সজ্জায় তাই মনে হল। আশিকুর রহমান, বেলায়েত হোসেন ও আমিনল হক’দের যৌথ আলোর কাজও আকর্ষণীয় ছিল। নাটকের ‘মুড’ তৈরিতে আলোর সঙ্গে সঙ্গীতও বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। নাটকটি মঞ্চায়নে মুনীর চেীধুরী ও কবীর চেীধুরী’র অনুবাদ অনুসরণ করা হয়েছিল।

সুরেন্দ্র ভার্মা’র কয়েদ-ই-হায়াৎ মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯ নভেম্বর। নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন ফারজানা কবির। এই নাটকটিতে নাট্যকার উর্দূ কবি মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব এর জীবনের অভিজ্ঞতা, জাগতিক জটিলতা, মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অস্থিরতার মাধ্যমে শিল্পীর সর্বজনীন সংকট আর সংগ্রামকে চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন। এটি কোনো ঐতিহাসিক দলিল নয় কেননা, নাটকের অনেক চরিত্রই কাল্পনিক।

এর পরদিন মঞ্চস্থ হল কবীর চৌধুরী’র অনুবাদে ইউজিন ও’নীল এর বিখ্যাত ট্রাজি-কমেডি ডিজায়ার আন্ডার দ্য এলমস। নিদের্শনায় ছিলেন শাকিলা সুমী। আমেরিকার এই ধ্র“পদি নাটক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই সময়ের দর্শকের উপযোগী করে উপস্থাপন করা হয়েছিল। দৈনন্দিন ব্যবহার্য ভাষা ব্যবহার করে নাটকটিকে সবার বোধগম্য করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে নিদের্শক স্বাধীনতা নিয়েছিলেন অনুবাদকের অনুবাদ হুবহু অনুসরণ না করার। নাকটটির কাহিনীতে পঁচাত্তর বছর বয়সী এফরায়েম ক্যাবট আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের শুষ্ক কঠিন একটি কৃষি খামারের মালিক। শক্তসামর্থ, কর্মঠ ও কর্তৃত্বপরায়ণ। পিউরিটান মূল্যবোধ ও অনমনীয় ধর্মীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী এই মানুষটি বিয়ে করে দুটি। মমতাহীন কঠোর আচরণ, স্ত্রী-পুত্রের প্রতি অবহেলা এবং বিষয় সম্পত্তির প্রতি তীব্র আকর্ষণের কারণে একে একে তার দুই স্ত্রীই মৃত্যুবরণ করে। প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান দুটি সাইমন ও পিটার। দ্বিতীয় স্ত্রীর একটি পুত্র সন্তানÑ এবেন। ক্যাবেটের বিশাল সম্পত্তি দেখা-শুনা করে তারা। এদের তিনজনের ভিতর এবেনের বৈষয়িক জ্ঞান-বুদ্ধি প্রখর। এদিকে এফরায়েম ক্যাবেট বার্ধক্যে উপনীত হয়েও তৃতীয়বার বিয়ে করে এক দরিদ্র ঘরের অল্প বয়সী সুন্দরী এবং কামনা-তাড়িত অ্যাবি পুটনামকে। অ্যাবির প্ররোচণায় একসময় এবেন তার সৎ মার প্রতি আর্কষণ বোধ করে। তাদের দৈহিক মিলনে জন্ম নেয় এক সন্তান। এফরায়েম ভাবে এই সন্তান তার ঔরসজাত। এমনি এক সন্ধিক্ষণে এবেন অভিযোগ আনে অ্যাবি’র বিরুদ্ধে। সে লোভী, সম্পত্তি কুক্ষিগত করার বাসনায় সে ভালোবাসার ভান করেছিল। অ্যাবি সংসারে নতুন সন্তান এনেছে তাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার করতে। কিন্তু অ্যাবি প্রমাণ করে দেয় সে সম্পত্তির লোভে নয় বরং এবেন’কে কাছে পাওয়ার বাসনা নিয়েই এই সংসারে এসেছে। আর এটা প্রমাণ করতে সে হত্যা করে নবজাতক শিশুটিকে। বিয়োগান্তক এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা আবার উভয়ের কাছাকাছি হয়। তাদের কামনা-তাড়িত আবেগ প্রেমময় হয়।

অ্যাবি পুটনাম-এর চরিত্রে ইসরাত কবির নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছিলেন। এবেন অর্থাৎ মোহাম্মদ ইসমাঈল হোসাইন ছিলেন একটু বেশি অস্থির। এফরামের চরিত্রে রাজিব চন্দ্র দাশ ছিলেন অনেক সাবলীল। রাজিব আরো ধন্যবাদের দাবি রাখে তার মঞ্চ শৈলীর জন্যে। খামার বাড়িটিকে সে দেখিয়েছে কাছ থেকে। অ্যাবির শোবার ঘর, এবেনের মা’র ঘর এক মঞ্চেই ছিল। প্রপস ও আলো দিয়ে অনেক পরিষ্কারভাবে আলাদা করা হয়েছিল। আলোকসম্পতেও রাজিব কাজ করেছিল মির্জা শাকিবের সঙ্গে যৌথভাবে। ইসমাঈল হোসাইন জুয়েল এর পোশাক ছিল সাধারণ অথচ সফল। নাসিরুল ইসলাম এর সঙ্গীত ও শাকিলা সুমী’র প্রপস নাটকটির সফল প্রযোজনায় সহযোগী হয়েছিল।

সাঈদ আহমদ-এর অনুবাদে ও নাহিদ জাহানের নির্দেশনায় মঞ্চে এল ইউজিন আয়েনেস্কা’র দ্য চেয়ারস। নাটকের নতুন গুরু হিসেবে ফরাসি নাট্যকার ইউজিন আয়োনেস্কোর খ্যাতি আজ দুনিয়াজোড়া। আর সব নাটকের মত দ্য চেয়ারস-ও বেশ জনপ্রিয়। নাটকটি বিকশিত হয়েছে এক নিঃসন্তান বৃদ্ধ দম্পত্তিকে ঘিরে। জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে তারা অথচ উল্লেখ করার মত তেমন কোনো অর্জন নেই তাদের এই দীর্ঘ জীবনে। চরম এক হতাশার ভিতর থাকতে থাকতে তারা হয়ে উঠে কল্পনাপ্রবণ। কল্পনার ভেলায় ভেসে ভেসে তারা কখনো বা পৌঁছে যান সুদূর অতীতে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও এই দম্পত্তি দেখেন এক উজ্জল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। ৯৫ বছর বয়সী বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ফারহানা খানম আর ৯৪ বয়সী বৃদ্ধার ভূমিকায় নুসরাত ফারহানা লিসা। তাদের সাবলীল অভিনয়ে কখনোই মনে হয় নি তারা অতটা বয়স্ক নন। রেহেনুমা খানম রিংকি’র সাধারণ মঞ্চ ও ফারহানা খানম এবং নুসরাত ফারহানা লিসা’র যৌথ পোশাক সজ্জা নাটকটিকে সরলীকরণে সহায়তা করেছিল।

বাংলার এক ধ্র“পদী নাটক নূরুল মোমেন-এর নেমেসিস। এই দীর্ঘ একাঙ্কিকা নাটকটি তেমন মঞ্চায়ন হয় নি বলে সাধারণ দর্শকদের কাছে তেমন পরিচিত না। নূরুল মোমেনের খ্যাতি আধুনিক বাংলা নাটকের ধারায় বিষয়বস্তু নির্মাণ, গঠনশৈলীর স্বাতন্ত্র্য ও উপস্থাপনা রীতির সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে। নাটকে দরিদ্র স্কুল মাস্টার সুরজিত নন্দী ভালোবেসে বিয়ে করে ধনী কালোবাজারী নৃপেন বোসের মেয়ে সুলতা’কে। কিন্তু সুযোগ সন্ধানী নৃপেন বোস সরল প্রকৃতির সুরজিত’কে কুচক্রে ফেলে তিনমাসে পাঁচ লক্ষ টাকা জোগাড় করার শর্ত জুড়ে দেয়। হুমকি দেয় এই বিয়ে অস্বীকৃত করে দেবার। বাধ্য হয়ে দেশে দুর্ভিক্ষ চলাকালীন সময়ে এই বিরাট অঙ্কের টাকা জোগাড় করতে নানা রকম গ্লানিকর, অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে সুরজিত। পরে বিবেকের তাড়নায় সে অন্ধকার জগত থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও প্রতিহিংসার গ্রিক দেবি নেমেসিস তাকে ফিরে আসতে দেয় না। সুরজিতের মন্দ কাজের প্রতিশোধ নেয়। ফলে মৃত্যুই হয় তার চরম পরিনতি। একাঙ্কিকায় একক অভিনয়ে ফরিদুল ইসলাম ফারদিন সুরজিতের অর্ন্তদহন তুলে ধরতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছিল। তার ব্যস্ততা ও অস্থিরতার ভিতর সুরজিত’কে খুঁজে পাওয়া যায় নি। উল্টো এই অস্থিরতা যে তার অভিনয়ের কারণে সৃষ্ট তাই প্রকটভাবে ধরা পড়েছিল। তবে ফরিদুল ইসলাম ফারদিন ও মোহাম্মদ বাবুল আক্তার এর যৌথ প্রচেষ্টায় যে মঞ্চ সাজানো হয়েছিল তা সত্যিই অসাধারণ। তারা শহরের ভূ-চিত্র বেশ সার্থতকার সঙ্গে জ্যামিতিক আকারের কাঠ-বোর্ড দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। তাদের আলোক প্রক্ষেপণও ছিল চমৎকার।

এই দীর্ঘ নাট্যোৎসবে দুটি সফল নাটকের অসফল মঞ্চায়ন হয়েছিল। একটি স্যামুয়েল বেকেট-এর ওয়েটিং ফর গডো, অপরটি ইউজিন আয়েনেস্কোর দ্য লেসন। বেকেটের নাটকের নির্দেশক খন্দকার রবিউল আরাফাত লেনিন ব্যবহার করেছিলেন কবীর চৌধুরীর অনুবাদ আর আয়েনেস্কো’র নাটকের অনুবাদক ছিলেন সাইদুস সাকলায়েন। এর নির্দেশক ছিলেন রেহানা হক। নাটক দুটির অভিনয়ের দুর্বলতা ছিল প্রকট। বিশেষ করে যারা দ্য লেসন নাটকে কামালউদ্দীন নিলু-র অভিনয় দেখেছেন তাদের কাছে এই নাটকের পরিবেশনাটি নেহায়েত শিশু-সুলভ মনে হয়েছিল।

নিকোলাই কালিয়াদা’র ব্রাত্য’কে এই নাট্যোৎসবের সবচেয়ে সফল প্রযোজনা বলা যেতে পারে। নাটকটির অনুবাদক সঞ্জয় ঘোষ দস্তিদার বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন তার আকর্ষণীয় অনুবাদের জন্যে। এমন ঝরঝরে অনুবাদ বাংলা নাট্য-সাহিত্যে সত্যিই বিরল। ভাষার গতিশীলতার এক অনন্য উধাহরণ এই অনুবাদ কর্মটি। দস্তিদার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন সাবলীল ‘স্ল্যাং’। আর এর কুশীলবদের র্দুদান্ত অভিনয় ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছিল দর্শকের। রাশিয়ান নাট্যকার নিকোলাই কালিয়াদা বিচিত্র মানব জীবনের নানারকম সর্ম্পক নিয়ে রচনা করেন নাটক ব্রাত্য। সেই সর্ম্পকের কানা-গলি ধরে গড়ে উঠেছে ইলিয়া ও আন্তনের মধ্যে প্রেম। ভাগ্যচক্রে ইলিয়া পঙ্গু ও নিম্নশ্রেণীর মানুষে পরিণত হয়েছে। আর ইলিয়ার বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আন্তন। সে ইলিয়াকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। যে কারণে এক পর্যায়ে দুজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। আন্তন চায় সয়েটার মতো কোনো এক নারীর প্রেমে আবদ্ধ হতে। যার ফলে সে ইলিয়াকে ছেড়ে চলে যায়। অন্যদিকে ইলিয়া আন্তনকে ছাড়া ল্যারিসার মতো মেয়েকে ভালোবাসতে পারে না। নেমে আসে ইলিয়ার জীবনে শূন্যতা। সে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। ছয় মাস পর আন্তন ফিরে আসে ইলিয়ার কাছে, কোনো এক সর্ম্পকের টানে। ইলিয়ার চরিত্রে সায়েম খান যে অভিনয় করেছিলেন তা সত্যিই বেশ উপভোগ্য। পঙ্কজ কান্তি আইচ বা আন্তন-ও ছিলেন বেশ প্রাণবন্ত। এদের দুজনের সাফল্যের চিহ্ন রয়েছে মঞ্চ ও আলোকসম্পাতেও। মঞ্চে, আলোয় তাদের সহযোগিতা করেছিলেন যথাক্রমে ফারজানা নিপা ও সুমী কাওছার।

ফরাসি নাট্যকার জ্যঁ রাসিন-এর ফেইড্রা মঞ্চে এসেছিল অসিত কুমারের অনুবাদে এবং কোয়েলা শারমীনের নির্দেশনায়। রাসিন’কে চেনা যায় নাটকের ভাষা, ঘটনার বিনির্মাণ ও চরিত্র চিত্রণে। তাঁর নাটকে চরিত্রের মানসিক টানাপোড়েন ও জটিলতাই মুখ্য বিচার্য হয়ে উঠে। তাঁর চরিত্রগুলো কেবল যুক্তি সঙ্গতভাবেই সৃষ্টি হয় না, তাদেরকে দেখে অনিবার্যও মনে হয়। রোমান পৌরাণিক কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা এই নাটকটিতে ফেইড্রা তার সৎপুত্র হিপোলিটাসের প্রেমে পড়ে। যদিও সে জানে এটা অন্যায়। কিন্ত এ যে তার ভাগ্যলিখন। প্রেমের দেবী ভেনাসের নির্দেশ সে অমান্য করবে কোন শক্তিতে? সে তার কামনাকে কোনোভাবেই দমন করতে পারে না। হিপোলিটাসকে সে তার প্রেমের কথা জানায়। প্রত্যাখাত হয়ে নৈতিক সংকটে পড়ে শেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এর আগে ভৃত্যা ইনোনের প্ররোচণায় ফেইড্রা হিপোলিটাসের বিরুদ্ধেই কামনা প্রকাশের মিথ্যা অভিযোগ আনে রাজা থিসিয়াসের কাছে। সাগর দেবতা নেপচুনের কাছে থিসিয়াস প্রার্থনা করে হিপোলিটাসের বিরুদ্ধে এই অন্যায় আচরণের প্রতিশোধ নিতে। নেপচুন তা কবুল করে এবং হিপোলিটাসকে গ্রাস করে।

মঞ্চ সজ্জা মোটমিুটি ভালোই ছিল। প্রাসাদের বর্হিভাগ বোঝানো হয়েছিল লম্বা থাম ব্যবহার করে। নাটকটিতে ফেইড্রা’র চরিত্রে মহসিনা আক্তার-এর অভিনয় মধ্যমানের হলেও হিপোলিটাসের চরিত্রে বেলায়েত হোসেনকে তেমন মানায় নি।

ফার্নান্দ আরাবলের দ্য টু এক্সিকিউশনারস-এর অুনবাদ ও নির্দেশনায় ছিলেন মোহাম্মদ আমিনুল হক শিবলী। নাটকটিতে একজন স্ত্রী ফ্রাঁসোয়াজ বিগত কোনো অপরাধের জন্যে তার স্বামী জ্যঁ’র বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে স্বামীর ওপর নির্মম অত্যাচার করান। ফলে তিনি মারা যান। এই নির্মম অত্যাচারের প্রত্যক্ষদর্শী মা ও দুই সন্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে নাটকটির শরীর। ফ্রাঁসোয়াজ এর চরিত্রে সোনিয়া রহমানের অভিনয় বেশ বলিষ্ঠ ছিল। যেমনটি দরকার ছিল তার চরিত্র চিত্রণে। তবে দুই ছেলে বেনোয়া ও মরিসের চরিত্রে মেহেদী তানজীব ও মাহবুবুর রহমান আরো প্রাণবন্ত হতে পারতেন।

হ্যারল্ড পিন্টারের বিখ্যাত নাটক নো ম্যানস ল্যান্ড মঞ্চস্থ হয়েছিল এই উৎসবে। নাটকটির অনুবাদ, পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন মানব সরকার। ১৯৭৪ সালে রচিত এই নাটকটিতে পিন্টার মানুষের শূন্যতাবোধ, একাকীত্ব ও স্মৃতিকাতরতা তুলে ধরেছেন। নাটকে হার্স্ট একজন সফল কবি। কিন্তু সে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ও অতিমাত্রায় মদ্যপায়ী। অন্যদিকে স্পুনার একজন ব্যর্থ কবি। হার্স্ট ও স্পুনারের আলোচনায় যোগ দেয় হার্স্টের ছেলে ও তার বন্ধু। নাটকটিতে স্পুনারের চরিত্রে সৈয়দ মামুন রেজা’র অভিনয় বেশ সাবলীল ছিল। নাটকটির মঞ্চ ও আলোকসজ্জা ছিল সাধারণ কিন্তু আকর্ষণীয়।

বৃটিশ নাট্যকার জন অসবর্ণ এর লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার ছিল এই উৎসবের একটি অন্যতম সফল মঞ্চয়িত নাটক। অশোক দাশগুপ্তের ঝরঝরে অনুবাদ, শান্তনু হালদারের দক্ষ নির্দেশনা আর মঞ্চ কুশীলবদের প্রাণবন্ত অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার লিখে জন অসবর্ণ নিজ দেশে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকে উত্থিত এ্যাংরি ইয়াং জেনারেশনের দার্শনিক পটভূমির ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল এই নাটক। নাটকটিতে জিমি পোর্টার তার স্ত্রী এলিসন ও বন্ধু কিফ’কে নিয়ে মিডল্যান্ডের একটি ফ্লাটে বসবাস করে। জিমি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে একটি মিষ্টির দোকান পরিচালনা করে। এলিসন উচ্চবিত্তের মানুষ। বন্ধু কিফের সঙ্গে এলিসনের রহস্যময় সর্ম্পকের কারণে ধীরে ধীরে অবিশ্বাস আর সন্দেহ দানা বাঁধে জিমির মনে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের সংঘাতময় শ্রেণী বৈষম্য উঠে আসে এই নাটকের চরিত্রগুলোর মাধ্যমে। সর্ম্পকের নাজুক অবস্থায় এলিসনের বন্ধু অভিনেত্রী হেলেনা আসে সেই ফ্ল্যাটে এবং তার পরামর্শে এলিসন জিমিকে ছেড়ে তার বাবার সঙ্গে চলে যায় বাপের বাড়ি। নিঃসঙ্গ জিমি এবার জড়িয়ে পড়ে হেলেনার সঙ্গে। একদিন এলিসন ফিরে এলে আবার তাদের পুরোনো সর্ম্পকের তিক্ততায় মধুর প্রলেপ পড়ে।

জিমির খিটখিটে মেজাজ ফুটে উঠেছিল শাহমান মৈশান এর অভিনয়ে। কিফের চঞ্চলতা, এলিসনের ব্যক্তিত্বও বিকশিত হয়েছিল রাব্বী ইবনে সিদ্দিকী ও তাসলিমা জাহানের ভিতর। তবে হেলেনার চরিত্রে সানজিদা রহমান শ্রাবনী’র প্রয়োজন ছিল আরো সাবলীল হবার। শাহমান মৈশান আরো প্রশংসার দাবি রাখেন মঞ্চ শৈলীর জন্যে। রাব্বী ইবনে সিদ্দিকী’র পোশাক ও নাদিয়া আফরিনের দ্রব্যসম্ভার নাটকটিকে আর্ষণীয় করতে অবদান রেখেছিল।

উৎসবের পর্দা পড়েছিল ‘কবি’ নাটকটির মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘কবি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন সাইমন জাকারিয়া। নির্দেশনায় ছিলেন শামীম হাসান। নিজেদের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে বিপুল সংখ্যক দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন শিক্ষার্থী অভিনেতৃরা। কবিয়াল থেকে কবিতে উত্তীর্ণ হওয়ার বাসনা নিয়ে ডোম বংশের সন্তান নিতাই বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেয় গান পাগল রাজা’র বাড়িতে। পাশের গ্রামের বউ রাজার শ্যালিকা ‘ঠাকুরঝি’ প্রতিদিন দুধ বিক্রি করতে আসে এ গ্রামে। নিতাইয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয় রাজার বাড়িতে। ধীরে ধীরে এক স্বার্থহীন ও অকৃত্রিম প্রেম গড়ে উঠে তাদের ভিতর। এই প্রেম নিতাইকে দেয় নতুন প্রেরণা। তার কাব্য চর্চায় আসে নতুন মাত্রা। এরপর ঘটনার এক পর্যায়ে নিতাই যখন এক ঝুমুরের দলের প্রধান নাচিয়ে ‘বসন্ত’র সঙ্গে পরিচিত হল, তখন তাদের ভিতর সৃষ্টি হল এক নতুন সর্ম্পক। নতুন প্রেমে নিতাই পেল নতুন কাব্য-জোয়ার। ক্ষীণধারা হল ঠাকুরঝির প্রেম, বেগবান হল বসন্তের ভালোবাসা। একদিকে ঠাকুরঝি যখন হতাশার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে বসন্তের পল্লীতে দর্শক নিতাইকে পায় একজন সুখী ও খ্যাতিলব্ধ কবিয়াল হিসেবে। কিন্তু সেখানেও বাজে বিরহের সুর। কালরোগে আক্রান্ত হয়ে বসন্ত পাড়ি জমায় অনন্তের পথে।

নাটকটিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অভিনয় করেছিলেন বসন্ত চরিত্রের অভিনেত্রী তামান্না হক। তার নাচ, গান ও ‘ছলা-কলা’য় দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছিল। এছাড়াও ‘ঠাকুরঝি’র চরিত্রে সান্দ্রা নন্দিনী ছিলেন চমৎকার। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিতাই চরিত্রের অভিনয়টি আরো বলিষ্ঠ হবার প্রয়োজন ছিল।

নাটকটির প্রাণ ছিল সঙ্গীত। লোকগানের মায়াবী জাল বিছিয়ে কুশীলবগণ দক্ষতার সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন দর্শককে। সঙ্গীতে সহযোগিতা করেছিলেন মোহাম্মদ রবিউল আলম।

দেশীয় পালাগানের ঢংয়ে মঞ্চ সাজিয়ে নাটকটি পরিবেশন করা হয়েছিল। আলো ও পোশাক-সজ্জাও ছিল প্রশংসাযোগ্য। এই কাজ তিনটি যৌথভাবে করেছিলেন শরীফুল ইসলাম খান, কাইসার রাহমানী ও তামান্না হক। তাদের প্রচেষ্টা নাটকটির সাফল্যে অবদান রেখেছিল।

রবাব রসাঁ : সাংবাদিক- নিউ এজ