Full premium theme for CMS
এই বাজারে কী নিয়ে কেন কীভাবে নাটক-প্রসঙ্গে
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
এই দেশে কতো বিষয় নিয়েইতো আলোচনা হয়। কতো সিদ্ধান্তও বেরিয়ে আসে। তারপর কী হয়? যা ছিলো তাই। নাটকের ক্ষেত্রেও কথাটা সম্ভবত বাদ পড়ে না। আমাদের দেশে বর্তমান ধারার নাট্যচর্চার শুরু স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে। দেশব্যাপী নাট্য আন্দোলনের স্রোতধারা এক সময় জন্ম দিয়েছিল বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের। বাংলাদেশের নাট্য জমিনে তখন কতো ভালো ভালো কথা, কতো স্বপ্ন। নাট্যজনদের মাঝে তখন একটা আস্থা ছিলো যে- গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান এদেশের নাট্য-আন্দোলনকে একটি পরিশীলিত পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু আড়াই দশকের বেশি সময়ের পথ চলায় বিষয়টি সেভাবে ঘটে নি। এদেশে অনেক কিছুই প্রত্যাশা মতো হয় না। অনেক কিছুই অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে না। তারপরও এই বাজারে কী নিয়ে কেন কীভাবে নাটক- প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা কেন? শুধু কথা দিয়ে থিয়েটারওয়ালা’র পাতা ভরানো, না কথা মতো কাজ করবার জন্য এই সব প্রসঙ্গে কথাবার্তার শুরু? যারা এই বিষয় নিয়ে কথাবার্তার সূত্রপাত করেছেন তাঁরা কী বুঝতে পেরেছেন যে-দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের পথ পরিক্রমায় এখন সময় এসেছে নির্ণয় করবার- পথের প্রতিবন্ধকতা কোথায়? কীভাবে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়? পরিত্রাণ পাবার জন্য কি বর্তমান প্রজন্মের নাট্য-যোদ্ধারা মাঠে নামবেন? আমাদের পূর্ব যোদ্ধারা যেমন নেমেছিলেন স্বাধীনতার পরে এবং মাঝ পথে খেই হারিয়েও ফেলেছেন। এখন কি উত্তর-প্রজন্মের নাট্য-যোদ্ধারা ভাবছেন খেইটা যেন না হারাই, গতিটা যেন অটুট থাকে পরিশীলিত নাট্যচর্চার?
পৃথিবীর সব কিছুই গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল। আমাদের নাটক মাঝ পথে খেই হারিয়ে ফেলেছে সত্যি, তাই বলে আমরা সঠিক পথটা খুঁজবো না, তা তো হয় না। সময় এবং পরিবর্তনের স্রোতধারা থেকে ব্যক্তি অথবা সংগঠন বিচ্ছিন্ন থাকলেতো অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। সে জন্যই এই বাজারে বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার আছে। বিষয়টির সাথে একাত্ম হওয়ারও দরকার আছে। তবে বিষয়টি জটিল এবং সময় উপযোগী। প্রথমত, খুব স্বচ্ছভাবে বাজারটাকে বোঝার ব্যাপার আছে। বাজারের পণ্যসামগ্রী কেমন? এ-সব পণ্যসামগ্রীর প্রভাবে আমাদের সমাজ এবং সংস্কৃতির রূপটাই বা কেমন হয়েছে? এ-সব বিষয় খুঁজবার পর আসে আমাদের নাট্যসম্ভারের অনুসন্ধান, নাট্য-প্রয়োগ-কৌশল, কারণ, বিষয়বস্তু নির্ধারণ ইত্যাদি প্রসঙ্গ। সম্ভবত এই বাজারে কী নিয়ে কেন কীভাবে নাটক- শিরোনামের বৈঠকী আলোচনা এই সব সূচকের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। যে-কোনো জিনিসের সূত্রপাত ঘটানো সহজ। কিন্তু সূত্রের পথে চলা সহজ নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি অথবা উন্নয়ননীতি অথবা রাষ্ট্রনীতিও সূত্রের পথে চলে না। সেজন্যই এতো অনাচার, এতো অনভিপ্রেত ঘটনার স্বীকার সমগ্র জাতি। তারপরও এ দেশে থিয়েটার চর্চার শুরুটা ছিলো জ্বলন্ত নক্ষত্রের মতো, এর অনেকটা পথ-পরিক্রমাও ছিলো দেশের সুস্থ্য সংস্কৃতি বিকাশে আশাব্যঞ্জক দিক। কিন্তু হঠাৎ করেই নাটক তার পথ হারাতে শুরু করলো। পথ হারিয়ে নাটক আজ যেখানে এসে স্থিত হয়েছে সেখানে যেমন নাটক আছে, ভালো নাটক আছে; তার চেয়ে বেশি আছে আগাছা অথবা অ-নাটক। ‘থিয়েটারওয়ালা’ তাহলে এই বিষয়বস্তুর মধ্য দিয়ে কী সংকট নিরূপনের পথে চলতে চায়? সময়ের সাথে ক্রমাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নাট্যচর্চার আগাছাগুলো পরিষ্কার করে পরিশীলিত করতে চায় আমাদের নাট্যশিল্পকে? এ বড়ই কঠিন কাজ- সর্বদাই থিয়েটারকে নিয়ে একটা যুক্তিনির্ভর পথে আগানো। বিশ্ববাজারের চাকচিক্য, মোহ, নেশা আর পর্ণের বিপরীতে নাটককে দাঁড় করানোর প্রয়াস। কতটুকু সৃজন, কারণ আর নিষ্ঠা থাকলে এ পথে চলা যেতে পারে সেটা ভাবাও কষ্টকর। তবুও নাটককে বাঁচাতে, নিজস্ব নাট্য-সংস্কৃতিকে বাঁচাতে এবং এর বিকাশ ঘটাতে এ পথে চলারতো কোনো বিকল্প নেই। সেই কঠিন পথে কি পা বাড়াতে চায় থিয়েটারওয়ালা’ সম্প্রদায়? বিষয়টি কিন্তু এতোটা সহজ নয় যে, থিয়েটারওয়ালা’য় যাঁরা লেখেন অথবা থিয়েটারওয়ালা’র ডাকে যে ৩-৪’শ নাট্যজন জড়ো হন- শুধু তাদের নিয়েই নির্ণিত পথে চলা সম্ভব হবে। এদের নিয়ে হয়তো নির্ণিত পথে যাত্রা শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে এই যাত্রায়তো সামিল হতে হবে দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক নাট্যজনদের। এরা কি এতোটা যৌক্তিক পথে পথ চলেছে ৩৫ বছর ? এই বাজারটা দেখবার আগে আমাদের কিছু জাতীয় চরিত্রের দিকে চোখ ফেরানো খুবই প্রাসঙ্গিক। বাঙালি সমাজকে নিয়ে যৌক্তিক এবং সংগঠিত কোনো আন্দোলন করাটা কিন্তু এ পর্যন্তও সম্ভব হয় নি। আমরা হুজুগে জেগে উঠি আবার ঘুমিয়ে পরি। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি, কিন্তু স্বাধীনতার মর্যাদা ধরে রাখতে পারি নি। ফলে ৩৫ বছরে দেশটি ভরে গেছে আগাছায়, জঞ্জালে। দেশটি পরিণত হয়েছে লুটেরাদের লুটের খনিতে। এরও একটা কারণ আছে। সমস্ত যুদ্ধটাই হয়েছিলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এর সঙ্গে ছিল মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা আর ছিল চিহ্নিত শত্রু। আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি, বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। কিন্তু শুধুমাত্র শত্রুমুক্ত করে তো কোনো লাভ হয় নি। শুধুই আবেগনির্ভর আন্দোলনগুলো বিজয় অর্জনের পর থেমে যায়। সেজন্যই এই দেশে বিজয়ের পথ ধরে কালে কালে সৃষ্টি হয়েছে দেশীয় শত্রুর, দেশীয় লুটেরা। এরা লুটে পুটে খাচ্ছে দেশটাকে। আসলে দেশটাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজন একটি সুসংঠিত, পরিকল্পিত গণসংগ্রাম বা গণবিপ্লব। যেখানে সত্যিকার অর্থেই মানুষ এবং সমাজের মুক্তির সম্ভাবনা প্রত্যাশা করা যায়। সেটা কিন্তু হয় নি এই দেশে। যেসব দেশে এভাবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে, সেসব দেশে সূচক অনুযায়ী সাফল্য এসেছে। আবার যুক্তিনির্ভর পথে জনবিপ্লবকে যেখানে কাজে লাগানো যায় নি সেখানে পরাজয় ঘটেছে। আমাদের স্বাধীনতার পর যতটুকু দেশ গঠন অথবা মানুষ গঠনের কাজ হয়েছে তার চেয়ে ঢের বেশি হয়েছে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, রাজনীতিবিদদের কেনা বেচা আর বাম রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যহীন পথ চলা। ফলে রাষ্ট্র যন্ত্রটা গিয়েছে রসাতলে। পুঁজিবাদ আর মৌলবাদের বিকাশ ঘটেছে লাগামহীনভাবে। রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলা বেড়েছে দেশগঠন হয় নি; মানুষের মুক্তিও আসে নি।
একইভাবে থিয়েটারের ডাকে স্বাধীন বাংলাদেশে নাট্যচর্চার শুরু হয়েছিল। নাটক একটা গুণগত পরিবর্তনের সাড়াও জাগিয়েছিল এই দেশে। কিন্তু মাঝপথে এসে নাট্য-আন্দোলন খেই হারিয়েছে। নাটকের জমিন ভরতে শুরু করেছে আগাছায়, জঞ্জালে। আজ এসব জঞ্জাল পরিষ্কার করবার প্রয়োজন বোধ হয়। কিন্তু ‘থিয়েটারওয়ালা’ সম্প্রদায় কি পারবেন কঠিন যাত্রায় হাল ধরে থাকতে ? না কি স্বাধীনতা অর্জন অথবা গ্রুপ থিয়েটার চর্চার মতো খেই হারিয়ে ফেলবেন এবং পূর্ব পুরুষদের মতো বলবেন ‘চেষ্ট তো করেছি’। ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীনতার সবচেয়ে উর্বর ফসল ছিল আমাদের নাটক। আজ তার বেহাল দশা। শুধুমাত্র ঢাকার আরণ্যক, থিয়েটার, নাগরিক অথবা ঢাকা থিয়েটারের নাটক দিয়েতো পূরো দেশের নাট্য চর্চার অবস্থাকে বিচার করা যাবে না। পূরো দেশের নাট্য-আন্দোলনের অবস্থা আসলেই করুণ, নাজুক এবং জঞ্জালে ভরা। এই পরিস্থিতি থেকে পরিবর্তন প্রয়োজন।এই পরিবর্তনের জন্যই আমাদের নির্ণয় করতে হবে বর্তমান বাজারটা কী এবং কেমন? এই বাজারে টিকতে হলে অথবা নাটককে টেকাতে চাইলে কী নিয়ে নাটক করতে হবে এবং যৌক্তিকতা কী এবং এর প্রয়োগ কৌশলটাইবা কী ইত্যাদি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক।
এবার দেখা যাক এই বাজারে-র বাজারের অবস্থাটা কেমন? এই বাজারতো এই সময়েরই একটা বাজার। সময়টা বিশ্বায়নের সময়। আর এই সময়ের বাজারটা মুক্তবাজার বা বিশ্ববাজার। সুতরাং এই বাজারে কেবল দেশজ পণ্যের সমাহার নেই আর। দেশ-বিদেশের বাহারি পণ্যের সমাহার এই বাজারে। এই বাজারের একটা চরিত্র হচ্ছে দ্রুতগতি। সেটা পণ্য হোক আর তথ্য হোক। যা কিছু ঘটে তা দ্রুত ঘটে এই বাজারে। বলা যেতে পারে নীল ছবি এক সময় আমদানী করতে হতো, তারপর তা দেখবার জন্য রঙীন টিভি, ভিসিআর, ভিসিপি ইত্যাদির আমদানী করতে হতো। তারপর সেটার প্রদর্শনী ভোক্তার কাছে। এটা ২/৩ দশক আগের কথা। ২/৩ দশক আগের মতো বাজার এখন এতো অগোছালো নয় আর; নয় এতো ধীরগতি। এখন বাজার সংগঠিত এবং দ্রুত গতিশীল। এখন মানুষের ঘরে কম্পিউটার, ডিস, সাইবার নেট, মোবাইল এবং ডিজুস। সুতরাং বাজার এখন বাটনে। বাটন চাপলেই বাজার। এই বাজারকে তথ্য প্রযুক্তির বাজার বলা হয়। সুতরাং তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে যেমন প্রয়োজনীয় তথ্যের আদান প্রদান হচ্ছে এই বাজারে, তেমনি পুঁজি বাণিজ্যের অনন্য পণ্য- পর্ণ ছবি ঢুকছে এই বাজারে সাইবার পথ দিয়ে। আজকের বাজারে দেশি এবং বিদেশি পণ্যের বিচিত্র সমাহার। বিশ্বায়নের মিশ্রণ আমাদের নিজস্ব পণ্য, সংস্কৃতির সম্ভার আর মানুষের চালচলনে বিচিত্র রকমের পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। এসবের পরিণতি ভয়াবহ। আজকে বাউল গানকে কী বোর্ডের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়ে বিশ্বায়নের ফিউশন করা হচ্ছে। যন্ত্র সভ্যতার এমন আগ্রাসনে বাউল গানের ভবিষ্যৎটা কী একবার ভাবা যায়? একইভাবে আমাদের দেশজ, লোকজ সংস্কৃতির সকল মুল্যবান সম্ভারে আজ চলছে বিশ্বায়নের ফিউশন। কিছু দিন পর আমাদের নিজস্ব বলে আর কী থাকবে বিষয়টি এখনই ভেবে দেখা দরকার। বিশ্ব বাজারের ফিউশন অথবা মিশ্রণ আমাদের যুব সম্প্রদায়সহ প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝেই কিছু আচরণগত এবং চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এটা আগামী দিনের জন্য ভয়াবহ। মানুষ যদি তার স্বকীয়তা হারায়, শেকড়ের সাথে তার সম্পর্ক হারায় তবে তার থাকে কী? বিশ্বায়ন মানব সম্পদের এই জায়গায় হাত দিয়েছে। ধ্বংশটা হচ্ছে এক্কেবারে শেকড় থেকে। বিশ্বায়ন আজ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে ফিউশন ঘটিয়ে সংস্কৃতির আদি চরিত্রটা নষ্ট করে দিচ্ছে। এটা ঘটছে নাটকে, সংগীতে, চলচ্চিত্রে, নৃত্যে এবং শিল্পকলার সব অংশে।
এই বাজার সবচেয়ে বেশি ধ্বংশ করছে যুব সম্প্রদায়কে। এই বাজারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পণ্য হচ্ছে মোবাইল ফোন। বোতাম চাপলেই ডিজুস। সাইবার পথে নীল ছবি, মোবাইলে ডিজুস আর মওকামতো সঙ্গী পেলে ইয়াবা। এসব বিশ্বপণ্যের প্রভাবে ভোক্তাদের চাল চলনে একটা পরিবর্তন এসেছে। একে অনেকটা খচ্চর জাতীয় পরিবর্তন বলা যেতে পারে। খচ্চর স্বাভাবিকভাবে জন্মানো কোনো প্রাণী নয়। ঠিক তেমনি এই বাজারে ডিজুস অথবা ইয়াবা সংস্কৃতির মিশ্রণে তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশের বেড়ে ওঠাটা সঠিক নয়। বৈজ্ঞানিক অর্থে খচ্চর হচ্ছে ঘোড়া আর গাধার সংগমের মাধ্যমে প্রজনন প্রাপ্ত জাতহীন একটা প্রাণী। খচ্চরকে ঘোড়াও বলা যায় না, গাধাও বলা যায় না। ঠিক তেমনি আমাদের দেশে এই বাজারে বিশ্বায়নের সংকরায়নে যে মানব চরিত্র দেখা যাচ্ছে- এর ভেতর দেশজ চরিত্রও নেই আবার বিদেশি চরিত্রও নেই। বিশ্বায়ন এভাবে খচ্চর বানাচ্ছে মানুষের চরিত্রকে। এই মানুষদের কাছ থেকে কী আশা করা যায়?
এই বাজারে সংস্কৃতি যখন হারাচ্ছে তার নিজস্ব স্বকীয়তা, মানুষ পাল্টে হচ্ছে শেকড়হীন মানুষ- সেই মুহূর্তে কী নিয়ে কেন কীভাবে নাটক- বিষয়টি সম্ভবত ফিরিয়ে নিতে পারে আমাদের শেকড়ের কাছে। এই বাজার যখন শেকড় উপড়ে ফেলার আয়োজন করেছে তখন নাটকের মানুষেরাতো শেকড়ের কাছেই ফিরে যাবেন। আঁকড়ে ধরবেন শেকড়টাকে। শেকড় নিয়েইতো শেকড় ছেঁড়ার বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে। এই বাজারে কী নিয়ে নাটকতো তা হলে হাজার বছরের বাঙলায় যে নাটক মানুষের সাথে মাখামাখি করে ডালপালা ছড়িয়েছে নানান দিকে আজতো সেই সব শেকড়ের সাংস্কৃতিক সম্ভার নিয়েই দাঁড়াতে হবে শেকড় ছেড়ার বিরুদ্ধে, আমাদের নাটকের মঞ্চে। সত্যিকার অর্থেই যখন সঠিকভাবে শেকড়ের বিষয়টি বিবৃত হয় মঞ্চে- মানুষ কিন্তু সেখান থেকে মুখ ফেরাতে পারে না। বিশ্বায়নের বাজরে ধ্বংশের পথে যেমন পা দিচ্ছে মানুষ, তেমনি জীবনের পথেও চলছে অনেক মানুষ। জীবনমুখি এসব মানুষদের জাগাবার প্রয়োজন, শেকড়ের নির্যাস থেকে নাটকের পসরা সাজানো প্রয়োজন মঞ্চে- তাঁদের জন্য। বিশ্বায়নের ফিউশনের মোকাবেলায় নিজস্ব সম্পদই হাতিয়ার হওয়া প্রয়োজন। এদেশের আনাচে কানাচে নাটকের মঞ্চে যখন কমলারাণীর সাগর দীঘি হয়েছে, মহুয়া হয়েছে, সোনাই মাধব হয়েছে, কাজল রেখা হয়েছে- মানুষ কিন্তু নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নি। এ দেশের লোক সংস্কৃতির সম্ভার এতো বিশাল এবং এতো বিচিত্র স্বাদে ভরপুর যে, সেই বিশালত্ব আর স্বাদ টুকু নিয়ে আসতে পারলেই- কী নিয়ে নাটক প্রশ্নের অনেকটা মীমাংসা হয়। যুদ্ধ বিগ্রহও কম কিছু ঘটে নি এই বাংলায়। সেজন্যই এই বাংলায় যখন নুরলদীন (নূরলদীনের সারাজীবন) হয়েছে, নানকার পালা হয়েছে, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় হয়েছে, মানগুলা হয়েছে, রাঢ়াঙ হয়েছে অথবা নীল দর্পন হয়েছে- বিষয়বস্তু আমাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে নি। এসব বিষয় নিয়ে দর্শক আনন্দের সাথে নাটক দেখেছে। কারণ এসব নিয়েইতো কালে কালে বাংলাদেশ। বিষয়বস্তু হিসেবে সমসামায়িক প্রসঙ্গও কিন্তু মঞ্চ বিমুখ করে নি মানুষকে। সৃজনশীল কাজকে সসমৃদ্ধ করতে, চর্চার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পৃথিবীব্যাপী মানুষ দেশ বিদেশের ভালো ভালো সৃজনের চর্চা করে আসছে। আমাদের দেশেও ভালোকে আরো ভালো করতে, সমৃদ্ধিকে আরো বেশিমাত্রীক সমৃদ্ধ করতে আমরাও বিদেশি সাহিত্য, শিল্পকলা থেকে সম্ভার সংগ্রহ করেছি। এখানেও মানুষ সমৃদ্ধ শিল্পকে প্রত্যাখান করে নি। আর প্রত্যাখান করে নি বলেই এদেশেও শেক্সপীয়র, ব্রেশট, বেকেট মঞ্চস্থ হয়েছে। এদের নাটক সমাদৃতও হয়েছে প্রচুর। সুতরাং পৃথিবীর যতো কিছু ভালো সবকিছুই বিষয়বস্তু হতে পারে এই বাজারে নাটকের আকালের কালে।
বিষয়বস্তুর যৌক্তিকতা সর্বদাই দর্শককে নাট্যমুখি করে। সুতরাং এই বাজারে নাটকের বিষয়বস্তু চাঁদ বনিকের পালা হবে নাকি মার্চেন্ট অফ ভেনিস হবে তার একটি যুক্তি নির্ভর কারণতো থাকতেই হবে। বিষয়বস্তু হিসেবে সাম্প্রতিককালে যখন সক্রেটিসের জবানবন্দী হয়েছে অথবা লেবেদেফ হয়েছে, অথবা চে’র সাইকেল হয়েছে- মানুষ কিন্তু গ্রহণ করেছে সমানে সমান; যতটুকু সিরাজদৌলা ততটুকুই সক্রেটিস অথবা চে’র সাইকেল। বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে দার্শনিক এরিষ্টটল বলেছেন- ‘লৌকিক বিষয়বস্তুতে মানুষ আকর্ষণ বোধ করে’। লৌকিক অর্থ, সমাজে ঘটে যাওয়া বিষয়বস্তু যা মানুষ শুনেছে অথবা দেখেছে। এই বিচারে ইতিহাস লৌকিক, পুরাণ লৌকিক, রূপকথা লৌকিক এবং এই লৌকিক বিষয়ের অনুস্মৃতি করবার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এরিষ্টটল। সুতরাং তাঁর গুরুত্বটুকু মেনে চললে তো এই বাজারে কী নিয়ে কেন নাটক-র প্রসঙ্গটি মীমাংসিত হতে পারে। বিষয়বস্তু লৌকিক হলে কী হয়? তার গ্রহণযোগ্যতা এবং দর্শকপ্রিয়তা কতখানি হয় তার আরও একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে নবান্ন নাটক প্রযোজনার মধ্য দিয়ে এই নাটক সংশ্লিষ্ট নানা-জনের অভিব্যক্তি ও অভিমত প্রকাশের মধ্য থেকে। নবান্ন নাটকের অভিনেত্রী মণিকুন্তলা সেন বলেছিলেন- ‘যে মানুষেরা রাস্তার দুর্ভিক্ষের মড়া দেখে মুখ ফিরিয়ে গেছে নবান্ন নাটক দেখিয়ে আমরা সেই মানুষদের চোখে জল ঝরাতে পেরেছি। এটা ছিল আমাদের কৃতিত্ব। এই কৃতিত্ব নাটকের বিষয়বস্তুর, নাটকের কালে, নাট্য -নির্মাণের এবং এর লৌকিক অবস্থান। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। কোলকাতা শহরে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ না খেয়ে কংকাল হয়ে পড়ে থেকেছে, মৃত্যুবরণ করেছে। ডাস্টবিনের পঁচা খাবারের জন্য মানুষ আর কুকুরের যুদ্ধ হয়েছে। বিত্তবানদের বাড়ির সামনে মানুষের একটু খানি ‘মাড় দাও’ আকুতি ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক দৃশ্য। নবান্ন’র বিষয়বস্তু সেখান থেকে নেয়া। সেজন্যই এই নাটক মানুষের মননে এবং রুচিতে স্থান করে নেয়। মানুষের বিবেচনায় ঠেকে- এ-তো আমাদেরই গল্প, দুর্ভিক্ষ হলে মানুষের সামনে যা দৃশ্যত হয়। বিষয়বস্তু সম্পর্কে আরও একটি বিবেচ্য বিষয় হতে পারে কাল বা সময়। সময়ের সাথে ঘটে যাওয়া সমাজের ঘটনাকেই প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে। সম্ভবত এ কারণেই নবান্ন অথবা নীলদর্পণ অথবা নূরলদীনের সারাজীবন-এর মধ্যে মানুষ তার অতীতের খোঁজ পায়- এই অতীত মানুষকে আঁকড়ে ধরে মঞ্চে।
কীভাবে নাটক? নাটকের ভাবে নাটক। অর্থাৎ যেভাবে নাটক প্রকৃত অর্থেই নাটক হয় সেভাবে নাটক। এখানে অভিনয়, মঞ্চ, আলোক, সেট, লাইট, কসটিউম- নাটকের সাথে যেভাবে মানায় অথবা যায় সেভাবে সংমিশ্রনটাই কীভাবে নাটক প্রশ্নের সমাধান হয়। শেক্সপীয়র প্রায় ৪’শ বছরেরও বেশি কালব্যাপী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মঞ্চস্থ হচ্ছে, চর্চা হচ্ছে, পড়ানো হচ্ছে- এ নিয়ে যারা গবেষক তারা অনেক বিষয় নির্ণয় করতে সক্ষম হচ্ছেন এবং হবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু খুব সাদামাটাভাবে বলা যায় মাত্র দু’টি বিশেষ কারণ সম্ভবত শেক্সপীয়রকে বাঁচিয়ে রেখেছে শতকের পর শতক মঞ্চে এবং নাটকে। কারণ দু’টির একটি হচ্ছে ‘বিষয়বস্তু’ যা সর্বদাই লোক সমাজে ঘটে যাওয়া অথবা ইতিহাসে ঘটে যাওয়া, যাকে এরিষ্টটল বলেছেন ‘লৌকিক’। শেক্সপীয়রের বিষয়বস্তু সর্বদাই লৌকিক। ম্যাকবেথ-র ভূতও তো লৌকিক। কারণ, মানুষ এই ভূত- প্রেতের কথা শুনে শুনেই বড় হয়। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে নাটকের গঠন বা লিখবার কৌশল। নাটক যদি তার নাটকীয় উপাদন নিয়ে ঠিকমতো লিখে ফেলা যায় তবে তাকে কোনো ফিউশন মুছে ফেলতে পারে না। শেক্সপীয়রকে পারে নি ৪’শ বছরব্যাপী। সুতরাং কীভাবে নাটক প্রশ্নের মীমাংসায় যদি শেক্সপীয়রের নাট্যগঠনকে মাথায় রাখা যায়, তাহলে বিষয়টা অনেকাংশেই মীমাংসিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের লোকনাট্য যেমন পালাগান, কবিগান, গাজীরগান অথবা ময়মনসিংহ গীতিকায় নাটকের গঠনশৈলী নিঃসন্দেহে শেক্সপীয়রের নাটকের গঠনশৈলীর মতো হবে না। এসব নাট্যের গঠনশৈলী আমাদের নিজস্ব আঙ্গিকে গঠিত। সুতরাং এসব আমাদের লোকজ নাট্যরীতিতেই হবে চিরকাল। এই বাজারে কী নিয়ে কেন কীভাবে নাটক-র বিষয়ে এই হচ্ছে মোদ্দা কথা।
কিন্তু এই মোদ্দা কথাইতো সমাধান নয় বা শেষ নয়। বিশ্ববাজার ছাড়াই আমাদের দেশে নাট্য অঙ্গনে একধরনের ফিউশন ঘটেছে প্রায় ২ দশক কাল যাবৎ। এ ফিউশন হচ্ছে খারাপের সঙ্গে খারাপ ফিউশন। যা নাটকের সর্বনাশ করেছে। দর্শকের সর্বনাশ করেছে। দেশের ঐতিহ্যের সর্বনাশ করেছে। মধ্য আশিতে গজিয়ে ওঠা কিছু নাট্যগোষ্ঠী- যারা ভেবেছে মঞ্চে দাঁড়ালেই অভিনয় হয় আর সংলাপ বল্লেই নাটক হয়- এই সর্বনাশী শক্তি এখনো এই বাজারে নাট্য জমিনে সংকট সৃষ্টি করে যাচ্ছে। কী নিয়ে কেন কীভাবে নাটক নিয়ে যুদ্ধটা এদের বিরুদ্ধেও বটে। এই বাজারে নাটক নিয়ে সবচেয়ে বড় সংকট নাটকের দর্শক এবং নাট্যকর্মীদের মাঝে। ক্রমাগত সামাজিক সংকট মানুষের জীবনযাত্রাকে জীবনবিমুখী করে তুলছে। নাট্যদর্শক এবং নাট্যকর্মী কেউই এর বাইরে বসবাস করেন না। এই বাজারে বিশ্বায়ন মানুষের ঘরের মধ্যে পৌছে দিয়েছে জৌলুসে ভরা আকাশ সংস্কৃতি। এই আকাশ সংস্কৃতির মধ্যেও কিন্তু ভালো এবং মন্দ উপকরণ আছে। মানুষ মন্দটা দেখেই মজা পায় বেশি। সে-জন্যই মন্দ সংস্কৃতির পসরা আকাশ সংস্কৃতির বাজারে বেশি। মানুষের ঘরের মধ্যে অথবা হাতের মধ্যে বিনোদনের উপকরণ। কেন এই মানুষ টিকিট কেটে মঞ্চে নাটক দেখতে আসবে? ঘরমুখী এসব মানুষকে, সংস্কৃতিবিমুখী এসব মানুষকে, বিনোদনবিমুখী এসব মানুষকে ফিরিয়ে আনতে হবে নাটকের পাদ প্রদীপে। এ বড়ই কঠিন কাজ। সব সময় যুক্তি নির্ভর থাকতে হবে, পথের খেই হারালে চলবে না। আমাদের সবারই এই বাজারে চলার পথে ভরসা একটা, সব কিছুই পরিবর্তনশীল। চরম নৈরাজ্যের পর সুন্দর সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, মানুষ খারাপ গ্রহণ করতে করতে একসময় খারাপকে প্রত্যাখান করে। আজ যতো খারাপ জিনিস মানুষ আনন্দভরে গ্রহণ করছে, সময় আসবে মানুষকে বাঁচবার সংস্কৃতি, নাটক আর রাজনীতির কাছে মানুষ ফিরবেই। কারণ মানুষের মধ্যে ভাল মন্দের দ্বান্দ্বিক মানসিক অবস্থা বিরাজমান সর্বদা। সুতরাং অপসংস্কৃতির রমরমা বাজার যাই থাকুক, এর ভোক্তারা একদিন মুখ ফেরাবেন এ থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্যই। তখন প্রয়োজন হবে নাটকের। যদি এখন থেকেই নাটকের জঞ্জাল পরিস্কার করে যুক্তি নির্ভর একটি নাট্য আন্দোলন শুরু করা যায় আবারো, তবে নিশ্চয়ই নাটকের পাদ প্রদীপে দর্শক আসবেই।
এম এ সবুর : নাট্যকার ও নাট্য বিষয়ক প্রবন্ধ লেখক