Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

আলাপনে আবদুল্লাহ আল-মামুন

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

[স্বাধীনতার পর নাট্যচর্চাটা আমাদেরকে বেশ এগিয়ে নিয়ে গেছে, সুস্থ ভাবনা-চিন্তার আগ্রহ তৈরি করেছে। আমরা শিল্পের এক বড় কর্মকাণ্ড, কর্মযজ্ঞ- মঞ্চনাটকের নিয়মিত সাক্ষাৎ পেয়েছি। আমরা বেশি বেশি নাট্যকার পেয়েছি, পেয়েছি সৃজনশীল প্রতিভাসম্পন্ন নাট্যনির্দেশক, অনেক ভালো অভিনেতৃ। আর পেয়েছি অনেক সংগঠক, যারা ক্রমশই মঞ্চনাটকের পরিধি বিস্তৃৃত করেই চলেছেন। এক কথায় এঁরা সবাই আমাদের মঞ্চনাটকের পুরোধা। আমরা মনে করি আমরা এঁদের সব ভালো কাজের উত্তরাধিকারী। তাই আমরা এঁদের কাজ এবং কাজের প্রক্রিয়া জানতে আগ্রহী। এই প্রত্যাশায় থিয়েটারওয়ালা আলাপচারিতায় মগ্ন হয়েছে কয়েকজন নাট্যজনের। তাঁদের সাথে আলাপচারিতা অনুলিখন করে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে থিয়েটারওয়ালায়।

আমাদের এমনি এক নাট্যজন আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাঁকে নিয়ে আলাপনে বসেছিলেন- বিপ্লব বালা ও হাসান শাহরিয়ার। আলাপনটি অনুলিখন করেছেন- সহকারী সম্পাদক সুমন নিকলী ও সাইফ সুমন। আলাপনটি সম্পাদক কর্তৃক সম্পাদিত]

বিপ্লব বালা
আপনার শৈশব কোথায় কেটেছে, গ্রামে না জেলা শহরে?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
জেলা মানে, এখন জেলা, সে-সময়ে মহকুমা ছিল। আমরা জামালপুরে ছিলাম। বাবা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। একটা কলেজে না, তাঁর স্বভাব ছিল কেবল চাকরি ছেড়ে দেয়া আর ধরা। তো শিক্ষকের ছেলে হওয়ার কারণে বাসার পরিবেশটা ঐ রকমই ছিল। পড়ালেখার প্রতি ভীষণ মনোযোগী ছিলেন। তবে এটা ঠিক খেলাধুলার মতো পড়ালেখাটাকেও তিনি আনন্দদায়ক করে তুলেছিলেন।

বিপ্লব বালা
আপনারা ক’ভাই-বোন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
আমরা ২ ভাই ২ বোন। আমি দ্বিতীয়। বড় একজন ছিলেন, মারা গেছেন। তারপর আমার পরে এক ভাই, সে থাকে জার্মানীতে, সেখানেই নাগরিকত্ব নিয়েছে। আর ছোট এক বোন।

বিপ্লব বালা
আপনার গ্রামের বাড়িও কি জামালপুর?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, গ্রামের বাড়ি হলো শেরপুর থানা। আমার জন্ম হয় নানার বাড়িতে, তা-ও শেরপুর থানায়। আর দাদা বাড়ি যেটাকে বলে, সেটা হলো গারো পাহাড়ের পাদদেশে, বকশীগঞ্জ গ্রামে, শ্রীবর্দী থানায়। নানা বাড়ি যাওয়া মানে তো একেবারে উৎসবের মতো। স্কুল ছুটি হওয়া মানে মামারা আসবে, এসে আমাদের নিয়ে যাবে। শীতের সময় গরুর গাড়ি আর গরমের সময় নৌকা।

বিপ্লব বালা
গ্রামের ছোটবেলার কী কী স্মৃতি এখনো মনে করতে পারেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে। দুষ্টুমীর কথা মনে পড়ে। আমার দাদা আসলে জমিদার বা সরদার মতুব্বর জাতীয় কিছু একটা ছিলেন। তখন ছোট ছোট ভূস্বামীদের উত্থান হয়েছে। দাদা সেরকমই একজন বোধহয় ছিলেন। আর নানাও প্রভাবশালী ছিলেন। ওনার নাতি হিসেবে আমরা বাড়তি সম্মান পেতাম। আমার ছোট ভাই, যে কিনা জার্মানী থাকে, সে একটু বেশিই দুষ্টু ছিল। মেয়েরা কলসি দিয়ে পানি আনার সময় প্রতিযোগিতা হতো কে কয়টা কলসি ভাঙতে পারে। ভাঙার পর আমরা ভয়ে থাকতাম বাড়িতে বিচার হবে। ঠিক ঠিক বিচার নিয়ে হাজির হতো মেয়েরা। নানা বলতেন- থাক ওদের মা’র কাছে যাওয়ার দরকার নাই, তোমাদের কলস দিয়ে দিচ্ছি। তো সে-সময় কিন্তু যারা সচ্ছল ছিল, তারা বছরের সব কলস, থালা-বাটি, ঘটি একবারে কিনে রাখতো। সেখান থেকে যার যার কলস দিয়ে দিতেন নানা।

হাসান শাহরিয়ার
মা’র কাছে যেতে নিষেধ করতেন কেন? আপনারা কি মাকে বেশি ভয় পেতেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, কিন্তু নানা বাড়িতে তো বাবা হলেন জামাই। সেখানে মা-ই কর্তৃত্ব খাটাতেন। এমনিতে আমরা বাবাকেই বেশি ভয় করতাম। মা তো বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছেন কিনা মনে করতে পারি না। একেক সময় মনে হতো অটোক্র্যাটের অধীনে আছি। আমি ভীষণ ভয় পেতাম। আমার ছোটটা তেমন পেত না। বাবা বলতেন- এটা করেছ? আমি হয়তো মাথা নিচু করে জবাব দিচ্ছি। তখন তিনি বলতেন- আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো। আবার যদি এমন হয় যে, আমি চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিচ্ছি, তখন আবার রেগে বলতেন- তুমি চোখে চোখ রেখে কথা বলছো কেন? মানে কোন দিকে যাই, এমন অবস্থা। তবে তখন খারাপ লাগলেও, এখন বুঝি বেশি ঢিলেমী দিলে হয় তো অনেক আগেই নষ্ট হয়ে যেতে পারতাম।

হাসান শাহরিয়ার
উনি ঘন ঘন চাকরি বদলাতেন কেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
রাগী মানুষ ছিলেন, গভর্নিং বডির সাথে খাপ খাওয়াতে পারতেন না। এবং তড়িৎ সিদ্ধান্তে চাকরি ছেড়ে দিতেন। মনের জোর ছিল, আবার সততাও ছিল। মনের জোরের দিক থেকে আমি হয়তো অতটা শক্ত না, কিন্তু সততার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও পেয়েছি বলে আমি মনে করি। আমার জীবনে তো কম সমস্যা হয় নি ... চাকরি জীবনের কথা বলছি। রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা পর্যন্ত হয়েছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়, আমি তখন টেলিভিশনে কাজ করি, আমাদের ডিজি আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন যে, তুমি কয়েক মাস ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যায়। অনেক পরিশ্রম করেছ, কিছুদিন বিশ্রাম নাও। তো আমি বললাম- স্যার আমি তো অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি। ডিজি বললেন যে, যেহেতু গন্ধ পাচ্ছ, তাহলে তুমি ছুটিতে চলে যাও, তোমার বেতন-টেতন বাসায় চলে যাবে। আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলে আসলাম। আমার ডায়বেটিস, হার্টের রোগ এ-সবকিছু তখন থেকেই দেখা দেয়। পরে জাতীয় ছাত্র সমাজের কেউ কেউ আসলো আমাকে ফিরিয়ে নিতে, কিন্তু আমি যাই নি। আমি যাই নি, আবার চাকরিও ছাড়ি নি। আমার জায়গায় বাবা হলে হয়তো আর চাকরিই করতেন না। এখানেই বাবার জেদের কাছে আমার জেদের পার্থক্য।

হাসান শাহরিয়ার
ছোটবেলায় অন্য সম্প্রদায়ের আচার অনুষ্ঠান কীভাবে দেখেছেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
আমাদের সময় হিন্দু-মুসলমান একসাথেই ছিলাম। আমরা বুঝতে পারতাম না, কেন আমার নাম মামুন আর বন্ধুর নাম শ্যামল। আমি ওর মাকে মাসী ডাকছি, ও আমার মাকে খালাম্মা ডাকছে, ভাবতাম এটাই তো নিয়ম। আমার বাবার বন্ধুদের মধ্যে ৯৫% ছিলেন হিন্দু। তখন অবশ্য হিন্দুদের প্রাধান্যও ছিল, শিক্ষা-দীক্ষায়, সবখানে। তারপরও আমাদের পরিবারের আলাদা একটা শক্তি হয়তো কোথাও ছিল। রায়টের সময় দেখতাম, ব্রিটিশ আমলে, তখন খুবই ছোট, তো দেখতাম যে, হিন্দু পরিবারের লোকজন গহনার পুটলি মা’র কাছে রেখে যাচ্ছে। আমার মা সাবধানে ওগুলো রেখে দিতেন। পরে রায়ট থেমে গেলে ওনারা ওগুলো নিয়ে যেতেন। আমাদের নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতির কোনো অভাব ছিল না। তাদের পুজা-পার্বণ, আমাদের ঈদ, সব জায়গায় আমাদের সবার অংশগ্রহণ ছিল।

হাসান শাহরিয়ার
জামালপুরে কি আপনি কলেজ পর্যন্ত ছিলেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, কলেজ হলো ঢাকা কলেজ।

বিপ্লব বালা
স্কুল জীবনে দেয়াল পত্রিকা বা এধরনের লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
আমাদের স্কুলে দেয়াল পত্রিকা বের হতো এবং সেই পত্রিকাটি আমার হাতে লেখানো হতো। মানে, আমার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল।

বিপ্লব বালা
আপনার লেখালেখি কি তাহলে দেয়াল পত্রিকা দিয়েই শুরু?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, আমি লেখালেখি করতাম না। হাতের লেখা সুন্দর ছিল, তাই আমি লিখে দিতাম। আমি প্রথম লিখেছি নাটক। এবং সেটা একেবারেই না বুঝে, বিপদে পড়ে। আমাদের স্কুলে একবার আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা নাটক করবো। কেন সিদ্ধান্ত নিলাম সেটা আমার মনে পড়ে না। কিন্তু বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান হয়, নাচ হয়, কবিতা আবৃত্তি হয়, তাহলে নাটক হবে না কেন? হয়তো এমনটা ভেবেই নাটক করতে চেয়েছিলাম। তো আমরা প্রস্তাব নিয়ে স্যারের কাছে গেলাম। স্যার বললেন- ঠিক আছে, তবে শর্ত হচ্ছে তোমাদের মধ্য থেকেই কাউকে না কাউকে লিখতে হবে, আর নাটকে কোনো মেয়ে চরিত্র থাকতে পারবে না। মুশকিলে পড়লাম। সবাই বললো- তোকে লিখতে হবে। কী বিপদ! বাবার কাছে বললাম। তো বাবা বললেন, তুমি একটা গল্প ঠিক করো, যে গল্পে দ্বন্দ্ব আছে। তিনিই পরে আমাকে হেল্প করলেন আমাদের ওখানকার একজন সরকারি কর্মকর্তার গল্প বলে দিয়ে, যে কিনা চাকরি করে বড় হওয়ার পর নিজের বাবাকে বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় নি। তো আমি সেটাকেই আরো ক্লাইমেক্স এনে নাটক লিখলাম এবং নির্দেশনাও দিলাম। ব্যস, ওটাই আমার জীবনের প্রথম নাটক লেখা।

বিপ্লব বালা
তারপর কলেজ জীবনে?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
কলেজ জীবনেও একটা নাটক লিখেছিলাম। সেটাও কোনো না কোনো বাধ্যবাধকতা থেকেই। কিন্তু নাটক লিখবো বা নাটকের সাথে জড়িয়ে পড়বো, এমনটা কলেজ জীবনেও মনে হয় নি। তবে, আমার মনে আছে, তখন রেডিওতে নাটক শুনতাম। আমার কানে এখনো বাজে শম্ভু মিত্র আর তৃপ্তি মিত্রের একটা নাটক তাহার নামটি রঞ্জনা। সেখানে শম্ভু মিত্র আর তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়ের যে ঢঙ, যেটাকে পরবর্তী সময়ে হয়তো সমালোচনাও করেছি, কিন্তু ঐ সময় আমার ভেতরে নেশা জাগিয়ে দিয়েছিল। ভাবতাম এটাই বুঝি অভিনয়ের আসল ব্যাপার। তো এভাবে রেডিওতে নাটক শুনে আর নিউ মার্কেটে আড্ডা দিয়েই মোটামুটি কলেজ জীবন পার করলাম। তারপর ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিপ্লব বালা
কলেজ জীবনে সাহিত্য চর্চা কেমন করেছেন? কী কী পড়েছেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, এখন এস যেটাকে প্রকৃত সাহিত্য চর্চা বলা যেতে পারে, এমনটা আমি কলেজ জীবনেও শুরু করতে পারি নি। টুকটাক গল্প উপন্যাস পড়াটা হয়েছে, কিন্তু সাহিত্য চর্চাটা হয়ে ওঠে নি।

বিপ্লব বালা
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তো নাটক করেছেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর দেখতে পেলাম যে হলগুলোতে নাটক হয় আর ডাকসুর উদ্যোগে নাটক হয়। তখন ডাকসুতে যারা নাটকের কর্তাব্যক্তি ছিলেন, যেমন- নাজমুল হুদা বাচ্চু, আহসান আলী সিডনী, আমি তাদের সাগরেদ হয়ে গেলাম। তারা আবার সাগরেদ ছিলেন নূরুল মোমেন স্যার আর আসকার ইবনে শাইখ স্যারের। মুনীর চৌধুরী স্যারের সাথে যুক্ত হই পরে।

হাসান শাহরিয়ার
আপনি কী হিসেবে ওনাদের সাথে কাজ করতেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
প্রমপ্টার হিসেবে। তখন কিন্তু প্রমপ্টারের ভূমিকা ছিল বিরাট, অনেকটা নির্দেশকের পর পরই তার অবস্থান। তারপরও প্রমপ্ট করতে করতে মনে হলো স্টেজের উপরের মানুষগুলোকে তো দর্শক দেখে, আমাকেতো দেখে না। তখন আমি নাজমুল হুদা বাচ্চু ভাইকে বললাম যে- আমি অভিনয় করবো। কিন্তু উনি বললেন যে- না, তুমি তো নাটক লিখতে পারো, তুমি নাটক লিখবে। পরে এক সময় ডাকসুর উদ্যোগে নাটক হবে, নরুল মোমেন স্যারের নাটক, তো সেখানে পারফরমার ডাকা হলো ...

হাসান শাহরিয়ার
পারফরমার ডাকা হলো মানে? আপনি আসকার ইবনে শাইখ স্যারের দলে কাজ করতেন নাকি নূরুল মোমেন স্যারের দলে?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, তখন তো কোনো দল ছিল না। শাইখ স্যার নাটক ধরলেন তো সবাই সেখানে গেল, আবার মোমেন স্যার নাটক ধরলেন তো সবাই সেখানে গেল। নাটকের আগে অডিশন হতো। কে কে কাজ করতে চায় ডাকা হতো। তো সেখানে এবার আমি নাজমুল হুদা বাচ্চু ভাইকে ধরলাম যে- এবার আর আমি প্রমপ্টার হিসেবে থাকবো না। আমাকে অভিনয় করতে দিতে হবে। তো সেবারই প্রথম আমি নাটকে অভিনয় করলাম নাম অনেক তারার হাতছানি।

হাসান শাহরিয়ার
মোমেন স্যারের নির্দেশনায়?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, তিনি হলেন নাট্যকার এবং উপদেষ্টা। নির্দেশক ছিলেন নাজমুল হুদা বাচ্চু। মহড়া কিন্তু প্রতিদিনই হতো। মহড়া মানে, যদি কাজ না থাকতো তাহলে আড্ডা হতো। তখন থেকেই কিন্তু, যদিও জানতাম না গ্রুপ থিয়েটার কী, আমার মনে হয় আমাদের কাজ-টাজ গ্রুপ থিয়েটারের মতোই ছিল। যারা যারা এক মানসিকতার তারা তারা কাজ করা, মানে এখনও তো এমনই হয় তাই না? তো আমি আবার ছিলাম ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) প্রমোদ সম্পাদক। আমরা যখন নাটক করতাম, তখন অনেক বন্ধু ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব নিত। তারা কিন্তু মহড়া টহড়া করতো না। কিন্তু নাটকের দিন আমাদেরকে হেল্প করতো। তো আতাউর রহমান তখনও নাটকে আসে নি। সে খুব উচ্ছল ছেলে ছিল, আড্ডা দিত, তাস খেলতো, কিন্তু নাটক করতো না। একটাই কেবল তার অনুরোধ ছিল, সে বলতো- নাটকের দিন তাকে যেন মেয়েদের দিকে ভলান্টিয়ার হিসেবে দিই হাঃ হাঃ। যাই হোক, তখন একটা নাটকে আমাদের নায়ক চরিত্রে লোক লাগবে। তখন আবার যে-কেউ নায়ক হতে পারতো না। লম্বা, সুন্দর ছিমছাপ দেহ না হলে নায়ক হওয়া যেত না। তখন আমার হলে একটা নাটক করলাম, নাম মা। সেখানে ’ও নায়কের চরিত্রে অভিনয় করলো।

বিপ্লব বালা
ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
খুব কম। যেমন ছাত্র ইউনিয়ন যখন ভাঙলো আমি মতিয়া আপা আর মেনন সাহেবের দিকে গেলাম। কেন গেলাম জানি না। তখন বাংলা একাডেমীর খোলা জায়গায় নাট্য মৌসুম হতো। কয়েকটা নাটক একাধিক রাতে প্রদর্শিত হতো। সেখানে আমি একটা নাটক লিকলাম শপথ। যুদ্ধ বিরোধী নাটক। এটা ছিল কাব্য নাটক এবং চরিত্রগুলো ছিল সিম্বলিক। যেমন- একটা চরিত্র হলো যুদ্ধ, আরেকটা পৃথিবী, একটা হলো বাতাস, মৃত্তিকা ইত্যাদি।

বিপ্লব বালা
এর আগে কবিতা লিখতেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
কবিতা লেখে নাই এমন কোনো মানুষ পাবা না-তো তুমি। যে এক কলম গদ্য লিখতে পারতো না, সে-ও কবিতা লিখতো। আমার কয়েকটা কবিতা সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। যাক্, তো ঐ নাট্য মৌসুমে আমার শপথ নাটকটা মঞ্চস্থ হয় এবং আতাউর সেখানে ‘যুদ্ধ’ চরিত্রে অভিনয় করে। পরে হলে একবার বসন্ত উৎসব হলো, সেখানেও আমি একটা নাটক লিখলাম, কাব্যনাটক ঋতুরাজ।

হাসান শাহরিয়ার
মুনীর চৌধুরীর সাথে তখনও কাজ করেন নি?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
হ্যাঁ করেছি। মুনীর চৌধুরী স্যারের সাথে একাট্টা হয়ে থাকতো তখন রামেন্দু মজুমদার। আমি শুনেছিলাম যে, মুনীর চৌধুরীর বাসায় রিহার্সেল হয়। আমি ওনার দন্ড দন্ডধর নাটকে অভিনয় করেছিলাম। তারপর রামেন্দু মজুমদারের নাট্যরূপ ক্রীতদাসের হাসি- নাটকে অভিনয় করি। নাজমুল হুদা বাচ্চু ছিলেন এটার নির্দেশক। এখন যেটা নাটমণ্ডল, সেখানে অভিনীত হয়েছিল। আমি ক্রীতদাসের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম।

বিপ্লব বালা
ড্রামা সার্কেলের ব্যাপারে তখন জানতেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
হ্যাঁ, ড্রামা সার্কেলের নাটককে খুব প্রফেশনাল মনে হতো। মানে একটা কাজের পরিশীলিত রূপ কেমন হওয়া উচিত, সেটা তাদের কাজ দেখলেই বোঝা যেত। আমরা এই প্রথম দেখলাম যে, ঠিক সময়ে নাটক শুরু হয়। তারপর নাটকের লাইটের সুন্দর ব্যাবহার, সাউন্ড ইফেক্ট, মানে সব কিছুতেই পরিশীলিত ভাব।

বিপ্লব বালা
পরে তো টেলিভিশন এলো।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
হ্যাঁ, টেলিভিশনে আমি শুরু থেকে কাজ করি নি। প্রথমে দেখতাম রামেন্দু মজুমদার একটা গাড়িতে করে হলের মেয়েদেরকে নিয়ে যায় আবার নিয়ে আসে। শুনলাম, মুনীর চৌধুরীর নাটক হবে, টেলিভিশনে, সেখানে মহড়ায় যায় কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক আমার সৌভাগ্য হয় নি তাদের সাথে যাওয়া। কিন্তু পরে নাটকটা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল। ফিল্মের একটা টাচ আছে, সেজন্য বোধহয়। কিন্তু আমার সুযোগ হলো না টেলিভিশনে কাজ করা। আমিতো তখন সংবাদ পত্রিকায় পার্ট টাইম কাজ করি। সেখানে শহীদুল্লাহ কায়সার ভাই বললেন যে- তুমি একটা কাজ করো। টেলিভিশন নাটকের সমালোচনা লেখ পত্রিকায়। প্রতি সপ্তাহে একটা নাটক হবে। তুমি সেটা দেখবে, এবং সমালোচনা লিখবে। আমার এই প্রস্তাবটা খুব মনে ধরলো। তো তখন জামান সাহেব বলে এক নামকরা প্রযোজক ছিলেন টেলিভিশনে। উনি ফিল্ম খুব ভালো জানতেন, তো তার একটা নাটকের আমি সমালোচনা লিখলাম। পরের রাতেই দেখি আমার হলে একটা টেলিভিশনের গাড়ি, অভিনেতা ফরীদ আলী এসে আমাকে বলছেন যে- আবদুল্লাহ আল মামুন কে? আমি বললাম-আমি, কেন কী হয়েছে? তো উনি বললেন যে- আপনি কালকে একটু টেলিভিশনে আসবেন, জামান সাহেব আপনার সাথে কথা বলবেন। তারপর সেখানে যাওয়ার পর জামান সাহেব বললেন যে, আমার সমালোচনা ওনার ভালো লেগেছে, আমি পার্ট টাইম কাজ করবো কিনা। আমি তো সাথে সাথে রাজি। আমি জয়েন করলাম। আমার কাজ হলো তখন, যারা নাটক লিখতেন, তাদের নাটক এডিট করা। এই এডিট করতে করতেই কিন্তু টেলিভিশন নাটক লেখায় আমার হাতেখড়ি। পরে অবশ্য আমাকে পারমানেন্টলি নিয়োগ দেয়া হয়।

বিপ্লব বালা
মামুনভাই মুক্তিযুদ্ধের সময়টা নিয়ে একটু বলুন।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
আসলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি এসবের চর্চাটা মানুষ ঘরে ঘরেই করতো। তো ’৭১ এ এসে বাঙালি যখন স্বাধীন হওয়ার জন্য জাগ্রত হলো, তখন এই সুযোগটা আমরা, মানে পাকিস্তান টেলিভিশন- ঢাকা কেন্দ্র, পুরোপুরি নিই। আমরা সুকান্তের কবিতা পিকচারাইজেশন করলাম, গণসঙ্গীত করতে থাকলাম। এগুলো আমাদের ম্যানেজমেন্ট কিন্তু তেমনভাবে খেয়াল করতো না। আমরা এমন কিছু কিছু কাজ দেখিয়েছি, যেগুলো দেশে স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে পাশ করানো যেত না।

হাসান শাহরিয়ার
এগুলো কি ২৫ মার্চের পর থেকে?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, এটা আরম্ভ হয়েছে মূলত ৬ দফার পর থেকেই, অল্প অল্প, কিন্তু ’৭১ মার্চে আর্মি নামার পরপরই বেশি করে শুরু করলাম। এবং আমার কাছে মনে হয় একমাত্র ওই কয়েকটা দিনই বাংলাদেশ টেলিভিশন সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে। সে-সময় মোস্তফা মনোয়ার সাহেব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশে আমরা চলেছিলাম কয়েকটা দিন। কিন্তু ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউন হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান টেলিভিশন- লাহোর থেকে সব লোকজন এখানে আসলো, প্রডিউসার আসলো, ক্যামেরাম্যান আসলো। আমাদেরকে কোনো কাজ করতে দেয়া হতো না, চোখে চোখে রাখতো। এবং এপ্রিল-জুনের দিকে কোনো স্টাফকেই আর বাড়ি যেতে দিতো না। পূর্বানী হোটেলে রেখে দিত। আমি অবশ্য জুন পর্যন্তই ছিলাম।

হাসান শাহরিয়ার
মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তারা এমন কোনো প্রোগ্রাম কি আপনাদের দিয়ে করিয়েছে, যেটা তখন আমাদের বিপক্ষে গেছে বলে মনে হয়?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, তখন আমাদেরকে কোনো প্রোগ্রামই করতে দিত না। আমাদেরকে দিয়ে যেটা করাতো, সেটা হলো, মেইন মেইন আর্টিস্টদেরকে আমাদের মাধ্যমে ডাকানো হতো। নাটক, গান ইত্যাদি করানোর জন্য। কেউই তখন আসতে চাইতো না। তখন আমারা গোলাম মোস্তফা, হাসান ইমাম, সিডনী, এঁদেরকে বলতাম যে- একটা নাটক করে যান আবার অনেক দিন ডাকবো না। আর বিশেষ করে সব কিছু তো তখন উর্দুতে হতো। উর্দু গান, নাটক। আমাদের কিছুই করার ছিল না।

বিপ্লব বালা
বাংলা নাটক বা গান হতোই না?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
যেগুলো হতো সেগুলোকে বাংলা বলা যাবে না, ইসলামী সংস্কৃতির বলা যায়। যেমন একটা নাটকের নাম ছিল-গিয়াসউদ্দিন বলবান, এমন আর কি।

বিপ্লব বালা
স্বাধীনতার পর মঞ্চনাটক করা বা নাট্যদল করা, এগুলো কীভাবে ভাবলেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
স্বাধীনতার পর মঞ্চনাটক যে এরকম একটা জায়গায় আসবে, সেটা কিন্তু ভাবতে পারি নি। এটা আসলে হয়েছে, এখন তোমরা যাদেরকে মঞ্চনাটকের নেতৃস্থানীয় হিসেবে দেখ, তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন। সেখানে তারা মঞ্চনাটক দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং দেশ স্বাধীন হলে আমাদের দেশেও সেরকম মঞ্চনাটক শুরু করা যায় কিনা, ভাবছিলেন। তো আমাদের এখনকার এই নাট্যচর্চার শুরুটা আমি বলবো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তঃহল নাট্যপ্রতিযোগিতা হয়েছিল, সেখান থেকে। যদিও আমি আগেও বলেছি, ইতোমধ্যে নাটক লিখেছি, কিন্তু আসলে নিয়মিত নাটক করবো এমন ভাবনাটা আমার মধ্যে আসে ঐ নাট্যপ্রতিযোগিতার পর।

বিপ্লব বালা
সেই প্রতিযোগিতায় কিন্তু অনেক অন্যধরনের নাটক হয়েছে। এ্যাবসার্ড, দুর্বোধ্য,্ মানে শুরুতেই মনে হয়েছে নিরীক্ষা চলছে ...  তো সেটাকে আপনি কীভাবে দেখেছিলেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
খুবই ভালো ভাবে। মনে হলো নিশ্চয়ই এটার মধ্যে কিছু আছে।

বিপ্লব বালা
কিন্তু দর্শক কমিউনিকেট করবে কিনা এটা ভাবেন নি?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
ওটা ভাবার সময় কিন্তু আমার মনে হয় তখনও হয় নি। এমন তরুণ নাট্যকাররা নাটক লিখছে, মঞ্চস্থ হচ্ছে, এই ব্যাপারটাই তখন বড় ছিল। কিছু নাটক হয়েছে দুর্বোধ্য, আবার কিছু হয়েছে শ্লোগানধর্মী। কিছু নাটক বোঝা গেছে, কিছু যায় নি। কিন্তু সেটা আমার কাছে বড় মনে হয় নি। বড় মনে হয়েছে, স্বাধীন দেশে নিয়মিত নাটক লেখা যাবে, নাটক করা যাবে, সেটাই।

হাসান শাহরিয়ার
তারপর ‘থিয়েটার’ নাট্যদল তৈরি করলেন। সেটা কীভাবে?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
একটু আগেই বললাম যে, আমার থিয়েটার দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় কোলকাতায় ছিলেন, তারা দেখেছেন। তো কোলকাতার গ্রুপ থিয়েটার চর্চাটা আমাদেরকেও বেশ টানলো। শুনলাম ওরা অলমোস্ট প্রফেশনাল এ্যাটিচ্যুড নিয়েই থিয়েটার চর্চা করে। আমরাতো অবাকই হলাম শুনে যে, ৬ টার নাটক ঠিক ৬ টায়-ই শুরু হয়। আমাদের এখানে তো প্রশ্নই ওঠে না। এস.ডি.ও সাহেব আসবেন বা কোনো প্রধান অতিথি আসবেন, তারপর তো নাটক শুরু হবে! তো ওদের এই যে ডিসিপ্লিন, এটা বেশ আকর্ষণ করলো আমাদের। এর আগে কেবল ড্রামা সার্কেলের নাটকে এমনটা দেখেছি। মামুনুর রশীদ, আতাউর রহমান, আলী যাকের এঁরা আরণ্যক নাট্যদল গঠন করলো, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় গঠন করলো। এবং নাটকও নেমে গেল ‘বাকি ইতিহাস’। সেগুলো দেখে বা সেগুলোর খবর পেয়েই বোধহয় ভেবেছিলাম যে, একটা নাট্যদল আমরাও তৈরি করবো।

বিপ্লব বালা
‘বাকি ইতিহাস’ কেমন লেগেছিল?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
ভালো। আর তখন তো আমাদের তেমন কোনো নাটক নেই। আমরা বরং ভাবছিলাম, কী ধরনের নাটক লেখা যায়।

বিপ্লব বালা
আপনি তো স্বাধীনতার আগে থেকেই টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতেন, মঞ্চের জন্য যখন লিখবেন ভাবছেন, তখন তো মুনীর চৌধুরীর নাটক ছিল, নূরুল মোমেনের নাটক ছিল, সাঈদ আহমদের নাটক ছিল। সেগুলো করলেন না কেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যপ্রতিযোগিতা আর বাকি ইতিহাস দেখে মনে হলো টেলিভিশন একটা কৃত্রিম মিডিয়া এবং এটা শিল্প সাহিত্য চর্চার জায়গা না। ফলে নতুন দল করে নাটক করবো। হ্যাঁ, তখন ওনাদের নাটক ছিল, কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছিল ওসব নাটকে এমন কিছু ছিল না যেগুলো প্রতিদিন শো হতে পারে। একবার দুবারের জন্য ঠিক আছে, কিন্তু নিয়মিত শো করতে হলে অন্যধরনের নাটক লাগবে। তারপরও আমরা বোধহয় প্রথমে মুনীর চৌধুরীরই একটা নাটক হাতে নিয়েছিলাম, কিন্তু পরে ওটা আর করা হয় নি।

বিপ্লব বালা
টেলিভিশনেও তো আপনারা অনেক ভালো ভালো নাটক করেছেন।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
হ্যাঁ, ভালো হয়েছে কারণ, তখন আর কিছুই তো ছিল না, ফিল্ম ছাড়া। একটা কথা কী, ফিল্ম আর মঞ্চের কিন্তু দীর্ঘ ইতিহাস আছে। টেলিভিশন সে অর্থে কয়েকদিন আগে আসা একটা মাধ্যম আমাদের কাছে। টেলিভিশনের নিজস্ব কিছুই নাই। ওখানে অনেক চালাকি আছে। কিন্তু মঞ্চটা যে চালাকির জায়গা না, সেটা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম। তো দল গঠন নিয়ে বলছিলাম যে, যদিও আমরা ’৭২ সালেই দল গঠন করি, কিন্তু প্রথম নাটক নামাতে সক্ষম হই ’৭৪ সালে। আমি টেলিভিশনে চাকরি করতাম, রামেন্দু বিটপি-তে চাকরি করতেন। প্রথমেই বলা হলো আমরা অন্যের কোনো নাটক এখন করবো না, আমাকে লিখতে হবে এবং আমার সামনে একজন মাত্র অভিনেত্রী দিয়ে দেয়া হলো, ফেরদৌসী মজুমদারকে, সেভাবেই লিখতে হবে। তো আমার আবার একটা ব্যাপার সব সময়ই আছে, সেটা হলো, আমি কন্টেম্পরারী বিষয় নিয়ে লিখতে পছন্দ করি। পছন্দ করি বলবো না, আসলে মধ্যবিত্তের মানুষ হিসেবে আমি আমার চারপাশে যা দেখি, যা যা অসঙ্গতি দেখি, সেখান থেকেই নাটকের উপাদান নেয়াটা সহজ মনে করি। অনেকেই আমাকে তখন থেকেই বলতো- আপনি যে কন্টেম্পরারী কন্টেম্পরারী করেন, আপনার নাটক তো টিকবে না। না টিকলে আসলে আমার কিছু করারও নাই। আমি নিজেকে মূলত একজন এন্টারটেইনার মনে করি। তো আমি প্রথম নাটক লিখলাম ‘সুবচন নির্বাসনে’। তখন সবে অবক্ষয় শুরু হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যাখ্যা শুরু হয়েছে, মৌলবাদীরা মাথা তুলতে চাচ্ছে। এসব কিছুকে মাথায় রেখে লিখলাম সুবচন নির্বাসনে।

হাসান শাহরিয়ার
সুবচন নির্বাসনে করলেন ’৭৪ সালে। ততদিনে নাগরিক আর ঢাকা থিয়েটার তো কয়েকটি নাটক করে ফেলেছে। দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখার ব্যাপারটাও সবার নজরে চলে এসেছে। তো তখন আপনার নাটকের প্রতিক্রিয়া কেমন পেলেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
শোন, আমি এখনও অনেক ব্যাপারে হয়তো সমালোচিত হই, কিন্তু আমি নিজেকে সবসময় একজন সাধারণ মানুষের নাট্যকার মনে করি। আর শুরু থেকেই আমরা কোনো বিদেশি নাটক করতে চাই নি। এবং আমরা সেইসব নাটকই করতে চেয়েছি, যেগুলো দর্শকের একেবারেই সমসাময়িক মনে হবে। সে-হিসেবে সুবচন নির্বাসনে নাটকটি দর্শক অত্যন্ত আগ্রহভরে নিয়েছিল। এই নাটকটা যখন পপুলার হয়ে গেল, তখন বুঝতে পারলাম আমাদের দিয়েও গ্রুপ থিয়েটার হবে।

বিপ্লব বালা
এরপর যে এখন দুঃসময় লিখলেন, সেটার স্থান ও চরিত্র তো আপনার অভিজ্ঞতার বাইরে।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, অভিজ্ঞতার বাইরে না। নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে যে নাটক হয়, সেটা দর্শকের হৃদয়কে আকর্ষণ করে না। এই নাটকটা লেখার সময় কিন্তু দলীয় সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি নাট্যকার হিসেবে আরেকটা সীমাবদ্ধ জায়গা তৈরি করে দিল। আমাকে বলা হলো বন্যার উপর লিখতে হবে। তখন আমি আমার বন্যা সংক্রান্ত অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগালাম। আমি সবসময় পেছনের জীবন থেকে অসংখ্য মেটেরিয়াল পাই।

বিপ্লব বালা
কিন্তু তখনকার বন্যার পরিপ্রেক্ষিত আর আপনার অভিজ্ঞতার বন্যার পরিপ্রেক্ষিত তো এক না।  সেই পরিপ্রেক্ষিতের ভিন্নতার ব্যাপারটা খেয়ালে রেখেছিলেন কি?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
দেখ, বন্যা বলো আর যেকোনো ধরনের মহামারীই বলো, আমাদের গ্রাম অঞ্চলে প্রবলেম কিন্তু সেইম।

বিপ্লব বালা
কিন্তু ’৭৪ এ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক সমস্যার নানারকম ইলিমেন্ট, সেগুলো ঢুকেছে কি?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, আমি লিখেছি বন্যার সময় মানুষের কী দুর্দশা হয় আর রাজনৈতিকভাবে এটাকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়- এটা কিন্তু চিরকালই এক।

হাসান শাহরিয়ার
না, মামুনভাই, আমরা জানতে চাচ্ছি কমন জায়গার বাইরেও তো কিছু থাকে। যেমন, সব সময়েই সব সমাজে কিছু না কিছু অবক্ষয় থাকে। কিন্তু আপনি যখন সুবচন নির্বাসনে লিখছেন, তখন কিন্তু আপনি নির্দিষ্টভাবে দেখছেন যে, একটা মুক্তিযুদ্ধোত্তর সমাজেও মাত্র ২ বছরের মাথায় কী ধরনের অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। ঠিক সেভাবেই আমাদের দেশের অন্যান্য বন্যা এবং রিলিফের সাথে কিন্তু ’৭৪ এর বন্যার রাজনৈতিক দিকটাকে কমন করে দেখতে পারবেন না। সেই আলাদা প্রেক্ষাপট হিসেবে দেখেছিলেন কিনা?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, আমি দেখিয়েছি বন্যায় কী ধরনের সমস্যা অভাবীদের হয় এবং রিলিফ দেয়ার নাম করে কীভাবে কেবল প্রচারটাই শুধু চালানো হয়।

বিপ্লব বালা
দর্শক রিয়েকশন কেমন হয়েছিল?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
ভালো, খুবই ভালো। ৩০ টির মতো শো হয়েছিল। তখন তো ৩০ টি শো মানে বিশাল ব্যাপার।

হাসান শাহরিয়ার
শুনেছিলাম কুমিল্লায় শো করতে গিয়ে নাকি নাটকের নাম নিয়ে সমস্যা হয়েছিল?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, আমরা করতে যাই নি। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে ওখানকার একটি দল এখন দুঃসময় করতে চেয়েছিল। তখন সেখারকার ডিসি নাকি বলেছিল, দেশেতো এখন দুঃসময় নাই, সু-সময়। নাট্যকারকে বলেন নাটকের নাম পরিবর্তন করতে। তখন ওরা আমাকে বলেছিল নাম চেঞ্জ করা যাবে কিনা। আমি ‘না’ করে দিয়েছিলাম।

বিপ্লব বালা
এরপর করলেন প্রফুল্ল রায়ের উপন্যাস নিয়ে নাটক চারিদিকে যুদ্ধ। হঠাৎ উপন্যাস থেকে নাটক করলেন কেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
ঐ যে বললাম, আমাকে সব সময়ই সমসাময়িকতা টানে। প্রফুল্ল রায়ের উপন্যাসটা পড়ে মনে হলো আমাদের যে অবক্ষয়টা তখন ছিল, ঠিক একই অবক্ষয়ের কথা উপন্যাসটাতেও আছে। কেবল আমাদের দেশের মতো করে নিলেই হলো।

হাসান শাহরিয়ার
সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য নাটক করলেন। আপনারা যেধরনের নাটক করছিলেন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-তো একেবারে অন্য ফর্মের নাটক। কীভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
সৈয়দ হকে সাহেবের সাথে আমার পরিচয় অনেক আগে থেকেই। যখন পাকিস্তান টেলিভিশন, ঢাকা কেন্দ্রে কাজ করতাম, তখন একটা সাধারণ জ্ঞানের প্রোগ্রাম তিনি করতেন, নাটক লিখতেন। তখন থেকেই পরিচয়। আমাদের নাটক এবং অন্যান্য দলের নাটকও উনি দেখেছেন তখন। অনেকদিন ধরে বাইরেও কাটিয়েছেন। বাইরের নাটক দেখার অভিজ্ঞতাও ওনার ছিল। তো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় লিখে আমাকে দিলেন করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের উপর নাটক, শুনেই তো ঝাপিয়ে পড়ার মতো অবস্থা। কিন্তু হক সাহেব যে এতো ভালো নাটক লিখবেন তা কিন্তু ভাবি নি। ওনার কবি সত্তার সাথে পরিচয় ছিল, কিন্তু নাটকও যে সেই উচ্চতায় লিখবেন এটা ভাবতে পারি নি। অসাধারণ একটা নাটক। কী নাই এটার মধ্যে? ভাষা থেকে শুরু করে সব কিছুই তাক লাগানোর মতো। প্রথমে তো আমি বুঝতেই পারি নি। দেখলাম ৩ টা কী ৪ টা চরিত্র। পাতার পর পাতা সংলাপ, বক্তৃতা, কিন্তু কথাগুলো ভালো লাগছে। যতবার পড়ছি, মনে হচ্ছে এটা করতেই হবে। পরে দলের মধ্যে পড়লাম, রামেন্দু-ফেরদৌসীসহ সবাই বললো- অসম্ভব, এটা কী করে করবো? কিন্তু আমি লেগে গেলাম। ৫ টার পর অফিস শেষে স্ক্রীপ্ট নিয়ে বসে যাই, নানা কাঁটছাট করে একটা ক্লাইমেক্সের জায়গায় নিয়ে গেলাম, যেটা মূল নাটকে ছিল না। তারপর কিছু গান ঢোকালাম, গানগুলো লেখালাম আসকার ইবনে শাইখকে দিয়ে। আরেকটা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা এটাকে কাব্যের জায়গায় রাখবো না এবং কবিতার সুর রাখবো না। আমার মনে আছে আমি ৩ মাস কাজ করেছিলাম স্ক্রীপ্ট নিয়ে। প্রতিনিয়তই একটা চেঞ্জের মধ্য দিয়েই আমরা এগিয়েছি। এমনকি টেকনিক্যাল শো দেখে হাসান ইমাম সাহেব কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন, পরে তা-ও পরিবর্তন করেছি। ১০/১৫ শো পর্যন্ত নিজেরাও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি নি। এরপর মনে হলো একেবারে মজ্জায় ঢুকে গেছে।

হাসান শাহরিয়ার
তখন কি অন্যান্য দলের নাটক দেখতেন? কেমন লাগতো?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
দেখতাম। খুবই ভালো লাগতো। ততদিনে একেক দলের নাটকের একেকটা ধরন তৈরি হয়ে গেছে। যেমন- নাগরিক করতো বাইরের ভালো ভালো নাটক। ঢাকা থিয়েটার ততদিনে শকুন্তলা-র মাধ্যমে নিরীক্ষা বা গবেষণার দিকে চলে গেছে। সেলিম আল দীন প্রায় প্রথম থেকেই গবেষণাটা ভালোবাসতো। প্রতিনিয়তই সে নতুন ধরনের নাটক লিখেছে। এটার দরকারও ছিল। তার কারণেই পরবর্তী সময়ে নাটকের ঐ ধরনের একটা ধারা তৈরিও হয়েছে। মামুনুর রশীদ সংগ্রামী মানুষের নাটক করতো, এখনও করছে। আর আমরা ব্র্যান্ডেড হয়ে গেলাম যে, আমরা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নাটক করি। তবে মাঝে মাঝে এটা ভাঙতে চেষ্টা করেছি। আমরা রবীন্দ্রনাথ করেছি, বঙ্কিম করেছি, শেক্সপীয়রও করেছি। তারপরও একবার একটা ইমেজ দাঁড়িয়ে গেলে সেটা আর মোছে না।

হাসান শাহরিয়ার
আপনি দলের সাংগঠনিক দায়-দায়িত্ব কেমন পালন করতেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
খুব কম। এটা পুরোটাই রামেন্দু মজুমদার দেখতেন। এত বছর পর এসে এখনও আমি বলতে পারবো না, টিকেট কীভাবে তৈরি হয়, কীভাবে বিক্রি হয়। আমি সব সময় ক্রিয়েটিভ দিকটা দেখেছি, নাটক লিখেছি, নির্দেশনা দিয়েছি আর দাদা সব সময় দলকে সামলেছেন।

হাসান শাহরিয়ার
রামেন্দু দা’কে আপনি মাঝে মাঝে দাদা বলে সম্মোধন করেন কেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
এটা আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে। ওনাকে আমি দাদা-ই বলি। আমি রামেন্দু মজুমদার আর ফেরদৌসী মজুমদারকে ‘আপনি’ সম্বোাধন করি, ওনারাও আমাকে তা-ই করেন। তাই বলে বন্ধুত্বের দূরত্ব আছে বলা যাবে না।

হাসান শাহরিয়ার
আপনি যে ক্রিয়েটিভ দিকটা দেখতেন বলছেন, সেখানে তো আরো অনেক ক্রিয়েটিভ লোক হয়তো ছিল, তারা কোনো বাধা মনে করে নি আপনাকে? আমাদের তো মনে হয় দল ভাঙার ব্যাপারে এমন সুযোগ না পাওয়াটাও একটা কারণ ছিল। আপনার কী মনে হয়?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
শোন, থিয়েটারের যে ভাঙন, সেটা একটা পরিবারের ভাঙনের মত। একটা পরিবারে ৩ টা ছেলে আছে, ওদের লালন-পালন করে বড় করা হলো- পরে দেখা গেল বউয়ের কথায় বা সন্তানদের কথায় তারা আলাদা হয়ে গেল। যার যার সুবিধার মত। এটা কিন্তু দোষের না। কিন্তু দোষ হলো যদি শাশুড়ির কথায় বা অন্য কারো কথায় পরিবারটা ভাঙে। আমাদের বেলায় যেটা হয়েছে, বাইরের লোকদের ইন্ধন ছিল। হয়তো কাউকে এমন বলেছে- কীরে সারাজীবন মামুনভাইয়ের নাটকই করে যাবি, তোরও তো নাটক লেখার ক্ষমতা আছে, তোকে সুযোগ দেয়া হয় না কেন? ব্যস, সে হয়তো ভাবে- ঠিকই তো। তারপরই তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। দল ভাঙার কাজগুলো তারা করেছে, যাদেরকে আমি আর রামেন্দু প্রমোট না করলে জীবনে নাটকই করতে পারতো না। একজন সিনিয়র অভিনেতা ছিলেন, যার আসা যাওয়ার ভাড়া পর্যন্ত আমরা পকেট থেকে দিয়েছি। আর আমি যেহেতু টেলিভিশনে কাজ করি, এমন কেউ নাই যার যোগ্যতা আছে কিন্তু আমি সুযোগ দিই নি। তাদের মধ্যেও অনেককে দেখেছি চোখ উল্টিয়ে দল ভাঙার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু তাতে হয়েছে কী দেখ, আমাদের দলের কর্মকান্ড একদিনের জন্যও থেমে থাকে নি। কিন্তু যারা গেছে তাদের অনেকেই এখন নামসর্বস্ব থিয়েটারকর্মী হিসেবে আছে।

বিপ্লব বালা
কিন্তু তারিক আনাম খান তো সফল।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
হ্যাঁ, তার কারণ, সে নিজে বেশ সমৃদ্ধ। সে থিয়েটারের উপর পড়াশোনা করা মানুষ। এবং নিজে অভিনয় জানে, নির্দেশনা দিতে জানে। আর তা ছাড়া সে সব সময়ই থিয়েটারটাকে পছন্দ করতো। ওকে সুযোগ দিতে গিয়েও আমাদের কম কথা শুনতে হয় নি। আমি নিজে ওথেলো নাটকে ওথেলোর চরিত্র করার জন্য উন্মুখ ছিলাম। কিন্তু যখন তারিক আনামকে পেলাম, আমার মনে হলো, ও-ই এই চরিত্রের জন্য উপযুক্ত। আমি সাথে সাথে তাকে সেই চরিত্র দিয়ে নিজে পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয় করেছি। একটা কথা আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, আমি সব সময় প্রতিভাকে প্রমোট করেছি, সেটা মঞ্চেই হোক আর টেলিভিশনেই হোক।

বিপ্লব বালা
টেলিভিশনে প্রমোট করতে গিয়ে কি মঞ্চের ক্ষতি হয় নি?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না। শোন মঞ্চটা তো কমিটমেন্টের জায়গা। ফেরদৌসী মজুমদার বা আমার থেকে কেউ কি টেলিভিশনে বেশি কাজ করেছে? কই, আমাদের দ্বারাতো থিয়েটার কখনোই ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। এখন তুমি যদি সবসময়ই হিসাব কর যে, কী পেলাম আর কী পেলাম না তাহলে তো হবে না। মঞ্চ থেকে অর্থ ছাড়া সব কিছুই পেয়েছে সবাই।

বিপ্লব বালা
অভিনয়ের সুযোগ নিয়েও কিন্তু কথা হয় যে, প্রধান অভিনেত্রী সুযোগ পান, অন্যরা পান না।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
কেউ কি কখনো চায় যে, তার নাটকটা ব্যাডলী এ্যাকটেড হোক?

বিপ্লব বালা
কিন্তু নতুনদের সুযোগ না দিলে ওরা যোগ্য হয়ে উঠবে কী করে?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
এ-ব্যাপারে কিন্তু আমাকে তোমরা কেউ দোষারোপ করতে পারবে না। তৌকীর, আসিফ মুনীর, শান্তা, বকুল, আফরোজা বানু- কাকে সুযোগ দিই নি? এমন কি টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, মানুষ হিসেবে অনেককে পছন্দ করি না কিন্তু ভালো অভিনয় জানলে ডেকে কাজ দিযেছি।  তবে তোমার ক্ষমতাটা কিন্তু তোমাকেও বুঝতে হবে। ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ প্রশ্ন করবে না। এখন একই দলে যদি কেউ কাজ করে, আমার দ্বারা কি সম্ভব ফেরদৌসীকে কাস্ট না করে অন্যকে কাস্ট করা? বরং বলতে পারো একটা সময় ছিল যখন কেবল একজন অভিনেত্রীর কথা মাথায় রেখে আমি নাটক লিখতাম। পরে যখন দলে মেয়ের সংখ্যা বাড়লো, তখন আমিও সেভাবেই নাটক লিখেছি। আমি তো বলবো আমি নাট্যকার হওয়ার ফলে মাথা ধরে ধরে চরিত্র নির্মাণ করে তারপর প্রমোট করেছি। যোগ্য হওয়ার সুযোগ দিয়েছি এবং তারা যোগ্য হয়েছেও। সবাইকে ফেরদৌসী মজুমদার হতে হবে এমনও কোনো কথা নাই।

বিপ্লব বালা
আপনি ওথেলো-র কথা বললেন। কিন্তু সেখানে ডেসডিমোনার চরিত্রটি নিয়ে অনেক কথা আছে যে, তারানা হালিম করছিল কিন্তু পরে সেটা ফেরদৌসী মজুমদারকে দিয়ে দেয়া হয়েছে।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
এটা নিয়ে আমি কথা বলবো না। আমার মনে হয় না যে, এটা তারানার কথা। কারণ ব্যাপারটা তারানা যেমন জানে আমরাও জানি। তাছাড়া তারানাকে আমি কি প্রমোট করি নি? টেলিভিশন বলো এমন কি চলচ্চিত্রেও প্রমোট করেছি। একটা দলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে যা পরে মনে হতে পারে খারাপ কিন্তু সে-সময়ে ঐ কাজটিই করা উচিত হয়ে পড়ে।

হাসান শাহরিয়ার
আপনার নাটক একটা সময় পর্যন্ত প্রায় একই ধাচের হয়ে উঠছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই আমরা কোকিলারা-র মতো একটা নাটক পেয়ে গেলাম। বাংলাদেশের প্রথম একক অভিনীত নাটক। এটার লেখা এবং নির্মাণ নিয়ে কিছু বলুন।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
আমি স্বাধীনতার পরপরই তৃপ্তি মিত্রের অপরাজিতা দেখেছি। ওটাই আমার দেখা একক অভিনীত প্রথম মঞ্চনাটক। এর আগে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাত্র থাকাকালীন সময়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলে একক অভিনীত একটা ফিল্ম দেখেছিলাম। তো তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় দেখে বুঝলাম যে, মঞ্চে এমনটা করা সম্ভব। আর একটা কথা হলো, সবসময়েই, ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্রতি আমার অসম্ভব দুর্বলতা আছে। এই ভালো অভিনেতৃদের মধ্যে ফেরদৌসী মজুমদার আমার একজন প্রিয় অভিনেত্রী। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই যে, আমি তাঁর একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত এবং যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তাঁকে চিনি, জানি এবং তাঁর প্রতিভার ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। তো আমার একটা ইচ্ছা ছিল যে, ফেরদৌসীকে দিয়ে একটা একক চরিত্র নির্মাণ করবো। ফেরদৌসী মজুমদার না থাকলে হয়তো আমি এটা লিখতেই পারতাম না। কোকিলারা লেখার সময় কেবল মনে রেখেছি যে, সংলাপ এবং ঘটনা যেন কোথাও ঝুলে না যায়। কারণ, এখানে টেনে তোলার মতো আর তো কোনো চরিত্র বা ঘটনা নাই। কোনো কারণে যদি একবার দর্শক মনঃসংযোগ হারায় তো আর বসানো যাবে না। আর সন্দেহ যতটুকু সেটা আমার লেখা নিয়ে ছিল, কিন্তু এটা যে ওয়েল এ্যাক্টেড হবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।

হাসান শাহরিয়ার
একা-নাটকের ধারণাটা কোথায় পেলেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
একা হলো আমার সংলাপবিহীন নাটক। একদিন রামেন্দু এসে বললেন জার্মানীর একটা নাটক আছে একক চরিত্র কিন্তু সংলাপ নাই। শুনেই তো আমার খুব ভালো লাগলো, বললাম- আনেন। তো তারপর এটাকে মঞ্চরূপ দিলাম। এবং এটাও সত্য যে, ফেরদৌসী থাকার কারণে আমি এটাতে হাত দিয়েছিলাম। উনি চমৎকারভাবে সংলাপ ছাড়াই প্রতিটি দৃশ্য উপস্থাপন করেছেন। দর্শকও এটাকে খুব ভালো ভাবে নিয়েছিল।

হাসান শাহরিয়ার
কোকিলারা লিখলেন ৮০-র দশকে, একা ৯০-র দশকে। একেবারে নিরীক্ষা বলা যেতে পারে। কিন্তু এ সময়ে আপনার অন্যান্য নাটকগুলো কিন্তু আবারও সেই গতানুগতিক ধারার ছিল। নাটক নিয়ে আর নিরীক্ষা করলেন না কেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
দেখ, আমি তো বললাম যে, যদি আমার হাতে ফেরদৌসী মজুমদার না থাকতেন তাহলে এই  কোকিলারা এবং একা-ও লেখা হতো না। আমি সব সময়ই দলের প্রয়োজনে নাটক লিখেছি। আমি নাটকের উপর গবেষণা করি না, বা নিরীক্ষা যেটা বললা সেটাও করি না। আমার শেষ ভালো নাটক মেরাজ ফকিরের মা, সেটাও তো ১০ বছর আগের লেখা। এখন মঞ্চনাটকে যেভাবে সময় দেয় ছেলে-মেয়েরা, সেখান থেকে ভালো কিছু করা সম্ভব না।

হাসান শাহরিয়ার
আমরা একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি মঞ্চ ও টেলিভিশনের বাইরেও একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আপনার প্রথম চলচ্চিত্র তো এখনই সময়?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, আমার প্রথম চলচ্চিত্রের নাম অনেকে জানেই না, রিলিজ হয় নি। ’৭২ তে শুরু করেছিলাম জল্লাদের দরবারে, আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে, ৫০% কাজ করেছিলাম। পরে নানা জটিলতায়, পলিটিক্যাল আর প্রযোজকের কিছু সমস্যা ছিল, কাজটা শেষ করতে পারি নি। তারপর প্রথম ছবি যেটি কিনা রিলিজ হয়েছিল তার নাম অঙ্গীকার, ’৭৪-এ তৈরি করেছিলাম। তখন কেবল হাত পাকাচ্ছিলাম, ফলে একেবারে সুপার ফ্লপ যাকে বলে, তাই হলো।

হাসান শাহরিয়ার
প্রডিউসার কে ছিলেন, আপনি?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, আমার এক বন্ধু। ফ্লপ মানে একেবারেই ফ্লপ আরকি। টাকা পয়সা একটাও ঘরে ফেরে নি। তো অনেকটাই দমে গেলাম। বুঝতে পারলাম, প্রথমেই ভিন্ন ধারার ছবি করা যাবে না। ফিল্মে, কেবল ফিল্মই বা বলি কেন, সব জায়গাতেই দেখবে মূল স্রোত বলে একটা কথা চালু আছে। তো এই মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে কাজ করা খুব কঠিন। কেউ কেউ করে, কিন্তু আমি পারি না। পারি না তারও একটা কারণ আছে, আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেতো, আমার আবার সব সময় কম্প্রোমাইজ করে চলার অভ্যাস। এটা শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু কথাটা সত্য। বিপ্লব-টিপ্লব আমার দ্বারা কখনোই সম্ভব হয় নি। দেখবে আমার নাটকে বা চলচ্চিত্রে আমি শেষ দিকে একটা মিলন দিয়ে শেষ করতে চাই। মানে আমার মনে হয় তারপরও যেন মানুষ সুখি হয়।

হাসান শাহরিয়ার
না, কিন্তু আপনি তো এটা মানবেন যে, দর্শক সমাধান চাইতে আসে না। তারা চায় দ্বন্দ্বের কারণ এবং সেই কারণকে উপলব্ধি করতে। এখন আপনি যদি সমাধান দিয়ে দেন, এটাতে সাময়িক তৃপ্তি হয়তো পাওয়া যায় কিন্তু আসলে তো এটা কোনো সমাধান না।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
আমি নিজেও এটা বুঝি। লেখার শুরুতে যেভাবে দ্বন্দ্বগুলো আমি টেনে আনি, আমার মনে হয় এবার একটা ভালো কিছু করবো। কিন্তু শেষ দিকে, জানি না কেন, হয়তো আমি শিক্ষকের ছেলে বলেই, বা মধ্যবিত্তের ছেলে বলেই, মনে হয় একটা সমাধান দিয়ে দেয়া উচিত। তো এটা আমার দোষ হতে পারে, কিন্তু এটাই আমি।

হাসান শাহরিয়ার
মূল ধারার ছবির ব্যাপারে বলছিলেন।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
হ্যাঁ, তো আমার ছবি ফ্লপ হওয়ার পর, আমি এবার একটা কমার্শিয়াল ছবি বানালাম। জীবন নিয়ে জুয়া, ওটা মোটামুটি ব্যবসা করলো। কিন্তু তারপর যে কাজটা করে আমি সত্যিকার অর্থে তৃপ্ত ছিলাম, সেটি হলো সারেং বউ। সারেং বউ অনেকে করতে চেয়েছিল, শুনেছি সত্যজিৎ রায়ও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষাটা ওভাবে জানতেন না বলে করেন নি। পরে সুভাষ দত্ত-ও করতে চেয়েছিলেন। যাক্, পরে আমি করলাম।

হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু আপনি পারলেন কীভাবে, আপনিও তো নোয়াখালীর লোক না?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
সেটা হলো আমি তো আবার শহীদল্লাহ কায়সারের ভক্ত ছিলাম। ভক্ত মানে কী, একেবারে এক নম্বর চ্যালা ছিলাম। ঐ যে বললাম, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখনই পার্ট টাইম চাকরি করতাম সংবাদ পত্রিকায়। তখন থেকেই ওনার সাথে পরিচয়। ওনার সংশপ্তক আর সারেং বউ-এর প্রতি আমি দুর্বল ছিলাম। এগুলো কিন্তু ফিল্ম করার মতো করেই লেখা। ওনার সব লেখাতেই কিন্তু একটা চিত্রনাট্য চিত্রনাট্য ভাব আছে। তো স্বাধীনতার আগেই সংশপ্তক টেলিভিশনে এনেছিলাম, সবটা পারি নি, আংশিক। পরে আশির দশকে আবার নতুন করে আনলাম। ঐ সময় থেকেই নোয়াখালীর ভাষার ধরন-ধারন আমার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। সারেং বউ তৈরি করে আমি বেশ পরিচিত হয়েছিলাম, ফিল্ম মেকার হিসেবে। তারপর এখনই সময় এবং আরো অনেক ফিল্ম করেছি। আমি দু-তিন বছর পর পরই একটা করে সিনেমা তৈরি করেছি। এবার আমি একটা বানাচ্ছি দরিয়া পাড়ের দৌলতি। নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপাঞ্চলের কিছু ছিন্নমূল মানুষদের সংগ্রাম নিয়ে। প্রায় ৭৫% কাজ হয়ে গেছে। এটা এক নামকরা সাংবাদিক আছেন, কামাল সাহেব, উনি নিজে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় কিছু রিপোর্টিং করেছিলেন। পরে বই বের করেন। সেটি রামেন্দু দা’ আমাকে দেন। সেটা নিয়েই কাজ করছি।

বিপ্লব বালা
সিনেমায় কেন এলেন হঠাৎ করে?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
না, হঠাৎ করে না। আমি তো বললামই যে, মঞ্চনাটক করবো বা লিখবো এমনটা কখনোই ভাবি নি। টেলিভিশন আসলো ষাট দশকের মাঝামাঝি। এর আগে আমাদের একমাত্র বিনোদন তো ফিল্ম। ফিল্ম দেখতে দেখতেই ভাবতাম যে, ফিল্ম বানাবো। কিন্তু প্রথম থেকেই এটাও বুঝতে পারছিলাম যে, এই মাধ্যমে খরচ অত্যন্ত বেশি। ফলে চাইলেই সব সময় করা সম্ভব না।

হাসান শাহরিয়ার
দরিয়া পাড়ের দৌলতি-তে অভিনয় করছেন কে কে?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
টেলিভিশন আর ফিল্ম সব মাধ্যমের শিল্পীদের নিয়েই করছি।

হাসান শাহরিয়ার
এ পর্যন্ত ক’টি ছবি বানালেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
১৩ টি।

হাসান শাহরিয়ার
আপনার এতক্ষণের কথায় ফেরদৌসী মজুমদারের ব্যাপারে বেশ পজেটিভ মূল্যায়ন বের হয়েছে। আমরা নিজেরাও তা মনে করি। মঞ্চে বলুন আর টেলিভিশনেই বলুন ওনার বেশ কিছু মনে রাখার মতো কাজ আছে। এছাড়াও এটা অনেকটা স্বীকৃতই যে উনি আমাদের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী। কিন্তু আপনি নিজে ১৩ টি ছবি নির্মাণ করলেও চলচ্চিত্রে আমরা ফেরদৌসী মজুমদারকে সেভাবে পাই নি। কেন?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
ফিল্মে কিন্তু একটা কথা আছে- তুমি যদি ট্রেন মিস করো, সেই ট্রেন আর তুমি ধরতে পারবে না। তো সময় মতো ফেরদৌসী মজুমদার অনেক বড় কিছু সুযোগ নেন নি। একটা হলো সূর্য দীঘল বাড়ি আর হলো আমার ছবি সারেং বউ এবং এখনই সময়। সূর্য দীঘল বাড়ি-তে ডলি আনোয়ারের চরিত্রটা করার জন্য ওনাকে বলা হয়েছিল। সারেং বউ-এ কবরীর চরিত্রটার জন্য ওনাকে অফার দিয়েছিলাম, এখনই সময় ছবিতে ববিতার চরিত্রটা দিতে চেয়েছিলাম। উনি নেন নি। ওনার একটা প্রব্লেম হলো, প্রব্লেম বলবো না, এটা ওনার কাজের ধরনই বলবো, উনি খুব মেথডিক্যাল মানুষ। উনি যদিও একজন বড় মাপের অভিনেত্রী, কিন্তু দেখেছি, যত লোভনীয় প্রস্তাবই হোক না কেন, যদি উনি মনে করেন যে কাজটা করলে সংসারের ক্ষতি হবে, তাহলে উনি করবেন না, চাকরির ক্ষতি হলে করবেন না। তো দেখা গেছে কখনো ত্রপাকে মানুষ করতে হবে বলে করেন নি, কখনো হয়তো চাকরিতে সমস্যা হবে বলে করেন নি। ফলে যখন উনি মনে করলেন যে এখন ওনার সময় আছে, তখন কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ফিল্মে একটা বা দুটা সুযোগ আসবে, সেই সুযোগকেই তোমার কাজে লাগাতে হবে। তা না হলে গাড়ি আর ধরা যাবে না। তোমরা না বললেও এ-প্রসঙ্গে আমি আরেকজনের কথা উল্লেখ করতে চাই, সে হলো সুবর্ণা মোস্তফা। সময় মতো সুযোগগুলো কাজে লাগাতে না পারাতে ঠিক ফিল্মের অভিনেত্রী হতে পারলো না। মঞ্চ আর টেলিভিশনের দিকেই নজর ছিল, ফিল্মকে সিরিয়াসলি নেয় নি। তা না হলে আমি মনে করি, ফেরদৌসী মজুমদারের পারফেক্ট উত্তরসূরী ছিল সুবর্ণা মুস্তাফা।

হাসান শাহরিয়ার
আপনি আমাদের মধ্যকার একমাত্র নাট্যজন, যিনি নির্দেশক হিসেবে ৩ মিডিয়াতেই প্রচুর কাজ করেছেন। সুতরাং আমরা যাদেরকে মঞ্চে প্রতিভাধর মেনে থাকি তাদের প্রায় সবাইকেই আপনি অন্য ২ মিডিয়াতেও হ্যান্ডেল করেছেন। এর মধ্যে ফেরদৌসী মজুমদারের ব্যাপারে শুনলাম, সুবর্ণা মোস্তফা ফেরদৌসী মজুমদারের উত্তরসূরী হতে পারতেন তা-ও শুনলাম। তো আমাদের আরেক অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফকে আপনি বোধহয় কোনো মিডিয়াতেই পান নি। তাঁর সম্বন্ধে কিছু শুনতে চাই।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
এই শিমূল ইউসুফও কিন্তু আমার মিডিয়া আর্টিস্ট। তবে শিশু আর্টিস্ট ছিল। ও-কে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক নাটকে আমি টিভিতে অভিনয় করিয়েছি। যাই-হোক, তোমার একটা কথা ঠিক যে, শিমূলের মতো গুণী শিল্পীকে আমি পরিণত বয়সে কোনো কাজের সময় পাই নি। সেটা ওর অনিচ্ছার কারণেই। কারণ, সে অভিনয়টা মঞ্চ ছাড়া অন্যান্য মাধ্যমে করতে আগ্রহী না বলেই আমার মনে হয়েছে। তার ব্যাপারে আমি বলবো, প্রত্যেক শিল্পীরই কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে, শিমূলেরও আছে। আমি বলবো না যে ওর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, না তা নাই, কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। শিমূল যখন মিউজিক তৈরি করে, তখন আমার কাছে মনে হয় সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। মানে কখনো কখনো মনে হয় কী অসাধারণ! আবার যখন গান গায়, তখন মনে হয়, ও-তো কেবল গান গাইলেই হয়। কোনো আর্টিস্টের সাথে তখন তার তুলনা চলে না। কেবল যখন অভিনয় করে, তখন মনে হয়, এমন অভিনয় অনেকই করতে পারে বা পারতো। মানে সে-ক্ষেত্রে ওকে আমার একসেপশনাল মনে হয় না।

বিপ্লব বালা
না, কিন্তু উনি যে-ধরনের অভিনয় করেন, সেখানে কিন্তু আমাদের এখনকার চেনা-জানা অভিনয়ের চাইতে ঐধরনের অভিনয়টাই জরুরি। অর্থাৎ এটা কিন্তু একটা অভিনয় রীতি। সেখানে গান লাগবে, ভোকালের কাজগুলো লাগবে, মুভমেন্ট লাগবে। তো এটা কিন্তু করার মতো খুব বেশি কেউ নেই আমাদের মঞ্চে।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
তা ঠিক আছে। ওর বা ওর ঢাকা থিয়েটারের জন্য এটা ঠিক আছে। কিন্তু সেটা দিয়ে টেলিভিশন বা ফিল্মে কাজ হবে না। শাহরিয়ার আমাকে যেটা বলেছে, মঞ্চের বাইরে আমার অন্য দুই সত্তার নির্দেশক হিসেবে ফেরদৌসী মজুমদার বা সুবর্ণাকে যেভাবে মূল্যায়ন করি, সেক্ষেত্রে শিমূলের ব্যাপারে আমার মূল্যায়ন কী হবে। সে জায়গা থেকেই বলছি, মঞ্চে ’ও যেমন শক্তিশালী, সেই শক্তিমত্তা অন্য মিডিয়াতে দেখাতে না পারার কারণ হলো ওর অভিনয় রীতি। এই অভিনয়রীতি একান্তই শিমূলের। মঞ্চের জন্যে ওর কমিটমেন্ট আমি প্রশংসা করি।

হাসান শাহরিয়ার
আমরা এক সময় আপনার খুব জনপ্রিয় কিছু নাটক টেলিভিশনে দেখতে পেয়েছিলাম। সংশপ্তক বা আরো অনেক নাটক। তখন কাজের ক্ষেত্র ছিল খুব সীমিত। কিন্তু যখন কাজের ব্যপ্তি বেড়ে গেল, অর্থাৎ প্রাইভেট টিভি চ্যানেল আসলো তখন আপনি যে কাজগুলো করছেন, সেগুলো নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারছি না। আপনি কি সন্তুষ্ট?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
একেবারেই না। এখন তো কাজ করতে হবে বলে করি। হয়তো ভাবছি লেগে থাকলে সুযোগ সুবিধা মতো যদি ভালো কিছু করা যায়।

হাসান শাহরিয়ার
কেন, এখন ভালো কাজ করার অন্তরায় কোথায়?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
আসলে সময় পাল্টে গেছে। এখন ভালো কিছু করার নিয়ন্ত্রণটা আমাদের হাতে নাই। সব নিয়ে গেছে স্পন্সর যারা করে, তারা। তারা বলে দেয় একে নিবেন, ওকে নিবেন, এসব আরকি।

হাসান শাহরিয়ার
না, তারা তো গল্প ঠিক করে দেয় না। আপনাদের পান্ডুুলিপির মানও কিন্তু তেমনভাবে সাড়া জাগাচ্ছে না।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
এখন গল্প ঠিক করে দেয় না, আবার দেয়-ও। এখানে বা এখন সংকট কিন্তু বহুমুখি। যারা স্পনসর করে, তাদের পণ্যের মডেল আছে। ইদানিং ওরাই হলো সেরা অভিনেতৃ। তাদেরকে যদি কাস্ট করা হয়, তাহলে তোমার আর স্পন্সর পেতে সমস্যা হয় না। এখন ওদের কথা মনে রেখে যদি স্ক্রীপ্ট লেখ আর ফেরদৌসী, আলী যাকের আর ফরীদি-সুবর্ণার কথা মাথায় রেখে যদি স্ক্রীপ্ট লেখ, দুই স্ক্রীপ্ট কি এক হবে? কক্ষণো না। আমরা জানি যে, যেহেতু টিভি মিডিয়া আর্থিকভাবে আকর্ষনীয় তাই সবাই মঞ্চ ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু কমিটমেন্ট কি টিভি মিডিয়াতেও আছে? একেবারেই নাই। এই যে এতো সিরিয়াল দেখ, টেলিভিশনে সিরিয়ালতো শুরু করেছি আমি, সেই স্বাধীনতার আগে, সংশপ্তক দিয়ে। তার মানে ‘অপকর্ম’-টাতো আমাকে দিয়েই শুরু। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, তখন এটা অপকর্ম ছিল না। মঞ্চের নাটকের যেমন মহড়া হয়, আগে টেলিভিশন নাটকেরও মহড়া হতো। বড় বড় আর্টিস্টও ২/৩/৪ দিন মহড়া না করে ক্যামেরার সামনে আসতেন না। কেবল শ্যুটিং-এর দিন কস্টিউম নিয়ে উপস্থিত হওয়া, এটা আমরা ভাবতেও পারি নি। এখন আরেকটা ‘বেয়াদবি’ করে, এসেই বলে- আমাকে কিন্তু ছেড়ে দিতে হবে। আমার অংশগুলো একটু আগে করতে হবে, এসব। তো কোনোভাবেই মান বজায় রেখে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবু করে যাচ্ছি, কারণ এটা ছাড়া তো আর কোনো কাজ করতে পারি না।

হাসান শাহরিয়ার
মঞ্চে যদি একটু সময় বেশি দেন, তাহলে হয়তো আবার মঞ্চের অবস্থা ভালো হতেও তো পারে।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
কাদেরকে নিয়ে সময় দেব! এবার একটা প্রোডাকশন নামালাম জন্মদিন, ৪-৫টা রান-থ্রু করতে পেরেছি কিনা সন্দেহ। দর্শক এসে দেখে চরিত্ররা ডায়লগ ভুল করছে বা ... মানে রিহার্সেল কম হলে দর্শক টের পায় না? দর্শক কি বোকা নাকি? তো কাকে নিয়ে মঞ্চ করবো। আবার মঞ্চ যেহেতু পয়সা দেয় না, তাই জোরও করতে পারি না। সব মিলিয়ে একটা অতৃপ্ত সময় কাটচ্ছি।

হাসান শাহরিয়ার
আপনার সব ধরনের নাটকেই কোনো রকম দানা বাঁধার পর শেষে এসে কোনো না কোনোভাবে মিলন ঘটানোর তাগিদ থাকে। এক সময় এটাকে বলা হতো, সিনেমার মতো শেষে মিলিয়ে দেয়া। এতে কিন্তু ভালো নাটক হয়ে ওঠার পথে বাধা হয়। আপনি একটু আগে এটা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এটা থেকে উত্তরণ সম্ভব কিনা?

আবদুল্লাহ আল-মামুন
এটা একেবারে সত্য অভিযোগ। আমি আসলে আগেই বলেছি, আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। বাবা প্রিন্সিপাল থাকার কারণে সব সময় দেখেছি সমস্যা হলে সবাইকে ডেকে একটা মিমাংসা করে দেন। তো সেখান থেকেও পেতে পারি বা মধ্যবিত্ত মন বলে যে, সব কিছুর পরও যদি ভালোভাবে থাকা যায় সেটাই ভালো। আর ভালো নাটক হয়ে না উঠলে তো আমি কিছু করতে পারবো না। আমি যা পারি সেটাই করি। এর চেয়ে ভালো তো পারি না। কী করবো বলো? কিন্তু সব মিডিয়াতে কাজ করি এবং করে যেতে আমার ভালো লাগছে, এটাই বলতে পারি।

হাসান শাহরিয়ার
মামুনভাই, আমরা আপনার সাথে কথা বললাম, অনেক কিছু জানতে পারলাম। তবু শেষ কথা, ভবিষ্যতের মঞ্চ নিয়ে আপনি কিছু বলুন।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
দেখ, আজ ৩৫ বছর মঞ্চ নাটক করি, আজ এখানে এসে দেখি এখনও ৩৫ টা ছেলে-মেয়ে তৈরি করতে পারি নি, যারা নিয়মিত মঞ্চনাটক করবে। এটা আমার বড় আফসোসের একটা জায়গা। তবু আমি মনে করি, মঞ্চনাটককে ধরে রাখবার জন্য ভুরি-ভুরি নাট্যকর্মীর দরকার হয় না। যদি নাট্যশিল্পীরা মনে করে যে, মিডিয়াতে কাজ করেও কেবল পয়সার পেছনে না ছুটে জীবনের পেছনে ছুটবে, তাহলেও মঞ্চে সময় দেয়া সম্ভব এবং যে-ক’জন ভাববে সম্ভব, সেই ক’জনকে দিয়েই মঞ্চ এগিয়ে যাবে।

হাসান শাহরিয়ার
আপনাকে ধন্যবাদ।

আবদুল্লাহ আল-মামুন
তোমাকে ধন্যবাদ, বিপ্লব বালাকে ধন্যবাদ। আর থিয়েটারওয়ালার মাধ্যমে সব মঞ্চকর্মীকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।