Full premium theme for CMS
বুদ্ধির ঢেঁকি
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতা অবলম্বনে রচিত নাটক)
দৃশ্য- ১
[রাজপ্রাসাদ। তানপুরা-সেতারসহ এক সঙ্গীত-মূর্ছনা তৈরি হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদের ডাক পড়েছে রাজসভায়। একে একে সব মন্ত্রীর প্রবেশ। রাজার এই অকস্মাৎ ডাকে সবাই চিন্তিত। সবার খুব চিন্তাযুক্ত পদচারণা। গবু চন্দ্র রায়, যুবমন্ত্রী ও পণ্ডিতকে নিয়ে এই মন্ত্রিপরিষদ। সবার আসন গ্রহণ করা হয়েছে। সবাই সবার দিকে তাকায়। প্রবেশ করে রাজা হবু চন্দ্র রায়। রাজার প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়। সবাই স্থিরভাবে বসে থাকে।]
রাজা পণ্ডিত, যুবমন্ত্রী আর মন্ত্রী গবুচন্দ্র রায়
হঠাৎ এক ভাবনা আসে আমার মাথায়
এমন ভাবনা নিয়ে কতক্ষণ থাকা যায়!
তাই, জরুরি ভিত্তিতে-
তোমাদের ডাকা হলো রাজ্যসভায়।
প্রশ্ন করো, কী ভাবনা এসেছে মনে
যা ভেবেছি সজ্ঞানে।
গবু মহারাজ
বড় ভীত সবাই আজ।
সকাল সকাল ডাক পেয়েছি সবাই;
গিন্নীরা ভাবছে করবেন জবাই।
না রাজামশাই-
আমাদের মনে কোনো জিজ্ঞাসা নাই
ছেড়ে দেন আজ জিজ্ঞাসা ছাড়াই।
রাজা দেখ গবু, যুব আর পণ্ডিত মশায়
তোমাদের ডেকেছি উত্তরের আশায়।
নতুবা-
এমন কিছু নাই তোমাদের চেহারায়
যা দেখার জন্য আমার ঘুম হারাম হয়ে যায়।
পণ্ডিত তা ঠিক রাজামশায়
চেহারায় কী আসে যায়।
চেহারা হোক যেমন-তেমন
রাজ্য চালাতে রাজা-মন্ত্রী প্রয়োজন।
আর-
শক্ত-পোক্ত রাখতে আমাদের আসন,
প্রয়োজন, কিছু বোকা জনগণ।
রাজা হ্যাঁ-
জনগণ বোকা হলে তোমাদেরই লাভ
রাজ্যের অর্থ চুষে রাজ্য করবে সয়লাব।
যুবমন্ত্রী রাজামশাই
আমার কথা একটাই।
আমরা সদস্য মন্ত্রিসভার
অনেক কিছুতেই আছে আমাদের অধিকার।
জনগণ দু-বেলা, দু-মুঠো খাবে
না খেলে অক্কা পাবে
সেটাকেও মেনে নিতে হবে।
সব কিছু মেনে নেবে, এ জন্যই তারা জনগণ
আমাদের কাজ না, তাদের হয়ে ভাবা সর্বক্ষণ।
আমাদের নাই প্রয়োজন, নির্বাচন
তবে কেন টেনে আনি জনগণ?
জনগণকে যত কাছের ভাববেন
জনগণ থেকে ততই দূরে সরে যাবেন।
কারণ-
আমরা আপনার পাশে আছি যতক্ষণ,
ততক্ষণ, হবে না, জনগণের ইচ্ছাপূরণ।
পণ্ডিত রাজামশাই
পণ্ডিত হিসেবে একটা কথা বলতে চাই।
বিড়াল, ঢোল আর চোর
সব-সময় রাখতে হয় মাইরের উপর।
মাইর না দিলে বদ ইচ্ছা করে ভর
বসতে চায় ঘাড়ের উপর।
আগে রাজা, তারপর মন্ত্রী-পণ্ডিত, সব শেষে জনগণ
এ-শিক্ষাই দিচ্ছি সর্বক্ষণ।
গবু অর্থ-সম্পদ-দেশ- জনগণ
এসব নিয়ে আলোচনা হলো অনেকক্ষণ।
যদি অনুমতি দেন রাজামশায়
আমরা নিতে পারি বিদায়।
রাজা বিদায় নেবে মানে?
আমার ভাবনার সমাধান হবে ক্যামনে?
এই হয়েছে এক বিপদ
অপচয় হয় রাজ্যের সম্পদ।
যখনই সভা ডাকা হয়
বাজে কথায় পার হয় সময়।
মূল আলোচনা পাশ কাটিয়ে
আজগুবি সব আলোচনা শুরু করে দিবে।
এ যেন-
লিখতে গিয়ে গরুর রচনা
প্রথম কাজ হয়, গরুকে নদীর কাছে নেয়া।
শুরুতেই বললাম-
আমার হয়েছে এক ভাবনার উদয়
ভাবনামুক্ত করতেই তোমাদের ডাকা হয়।
অথচ-
কী কী প্রসঙ্গ ধরে বকবক করে
বলে, রাজামশাই বিদায় দিন তবে।
কী করে সম্ভব, রাজ্যাসনে বসা
পাশে রেখে এতো অর্থ-চোষা!
একটি ভাবনায় আমি শিহরিত হই
সেটার জবাব কই?
গবু, জানতে চাও না, কী আমার ভাবনা
যে ভাবনা, সরেও না, মরেও না?
গবু বলুন রাজামশায়
কী ভাবনার হয়েছে উদয়
ভাবনামুক্ত করবো নিশ্চয়।
রাজা মন্ত্রী গবুচন্দ্র রায়
ভাবলাম সারারাত্র;
মলিন ধূলা লাগবে কেন পায়
মাটিতে আমি চরণ ফেলা মাত্র?
(হেঁটে সামনে এসে সবাইকে একে একে দেখে)
বেতন দিতে কোষাগার হয় শূন্য
তোমাদের জন্য।
অথচ,
রাজার দিকে নাই তোমাদের দৃষ্টি
একি অনাসৃষ্টি!
আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি
ইচ্ছা হয় গর্দান কাটি।
শীঘ্র এর করবে প্রতিকার
গর্দানের ভয় আছে যার।
পণ্ডিত দেখেছেন রাজামশায়
কী অসাধারণ ভাবনা এসেছে আপনার মাথায়!
আমরাও পায়ে হেঁটে হই পার
কখনো চাই নি, মাটি লাগার প্রতিকার;
সত্যিই, তুলনা হয় না, আপনার, ভাবনা-চিন্তার।
গবু রাজার বুদ্ধির কাছে আমরা তো নস্যি
চলুন-
রাজাকে ভাবনামুক্ত করতে আলোচনায় বসি।
রাজার ভাবনা নয় মামুলী
অবশ্যই কালজয়ী।
তাই-
আলোচনার খরচ-পাত্তি আর লোকবল ক’জনা
এর জন্য করা যাক এক বাজেট রচনা।
যুবমন্ত্রী বাজেট হতে হবে অবশ্যই সাশ্রয়ী
চলুন বাজেটের খাতগুলি
চিহ্নিত করি।
রাজা বাঃ বাঃ-
সমাধান দিতে আমার ভাবনার
চিন্তার আগে প্রয়োজন হয় বাজেট রচনার
কী প্রয়োজন, এমন মন্ত্রিসভার?
স্ব-বেতনেই বের করো উপায়
হাঁটবো কিন্তু মাটি লাগবে না পায়।
যাও তবে তোমাদের ঘরে
গিয়ে ভাবো, গর্দান বাঁচাবে কী করে।
পায়ের কাজ হাঁটা, হাতের কাজ ধরা
আর মাথার কাজ সমাধান বের করা।
সেই সমাধান বের না করে যদি আসো কাল সকালে
মুণ্ডুটা রেখে আসবে, বুদ্ধি করে
যার যার ঘরে।
(একটু ভেবে)
ঠিক আছে যাও, দুইদিন সময় দিলাম
নিদ্রা করে হারাম
বের করো সমাধান।
[রাজা দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে যায়। সবাই চোখে চোখ রাখে। ভীত সবাই]
দৃশ্য- ২
[রাজ্যের পায়ে চলা পথ। হেঁটে চলে মাঝবয়সী কৃষক জব্বার। পেছন থেকে ডাক দেবে সমবয়সী সতীশ।]
সতীশ জব্বার, জব্বার
খবর আছে মজার।
গবুমন্ত্রী, যুবমন্ত্রী আর পণ্ডিত মশাই
খেয়েছেন রাজার ধোলাই।
জব্বার কী বলিস
সতীশ
হাত করে নিশপিশ।
রাজারও তবে আছে ইশকুল
মন্ত্রীদের ধরেন তিনি চুল?
বলে ফেল আসল খবর
বাড়ি পৌঁছাই তারপর।
সতীশ খবর আর কী!
রাজাকে কে দেয় ফাঁকি?
গবুমন্ত্রী, যুবমন্ত্রী আর পণ্ডিতেরে ডেকে
রাজা নাকি বলেছেন কেশে কেশে ...
জব্বার কী বলেছেন, বলে ফেল সতীশ
অযথা সময় নষ্ট করিস।
সতীশ কী বলেছেন, তা-কি জানি?
বাতাসে শুনলাম খবরখানি।
রাজার নাকি হঠাৎ এসেছে মনে
মাটি না লাগিয়ে হাঁটা যায় ক্যামনে।
সেই ভাবনা মাথায় করে
পায়চারী করেছেন রাজা সারারাত ধরে।
ভোর বেলা পাইক পেয়াদা গিয়ে
মন্ত্রী আর পণ্ডিতেরে নিয়ে গেছে ধরে।
জব্বার মন্ত্রী আর পণ্ডিতেরে নিয়ে যাবে ধরে
তা হয় কী করে?
এতো স্পর্ধা পাইক পেয়াদার
সাহস পায়-
মন্ত্রী আর পণ্ডিতের বাড়ি ঢোকার?
সতীশ তুই চাষার ব্যাটা
মাথা মোটা।
তুই বুঝবি কী করে
ছাগল নাচে তার খুঁটির জোরে?
পাইক পেয়াদা কখনো বুদ্ধি খাটায়?
হুকুম পেলেই বাড়ি মারে, মাথায়।
লাথি মারে, পাছায়
প্রভূ যখন যা চায়।
তাই তো যখন রাজা দিল আদেশ
লাল করে দিল মন্ত্রী আর পণ্ডিতের পশ্চাদদেশ।
জব্বার মন্ত্রী-পণ্ডিতের পরিণতি কী শেষমেষ?
সতীশ যদি দিতে পারে রাজার সমাধান
বেঁচে যাবে যার যার গর্দান।
আর যদি-
দিতে না পারে ভাবনার সমাধান
রাজা-
মন্ত্রীদের ধরবেন চুল, আর পণ্ডিতের কান।
জব্বার চুল না ধরে কান কেন পণ্ডিতের বেলায়?
সতীশ চুল পাবে কোথায়, পণ্ডিতের টাক মাথায়?
তবে এ-ও হতে পারে
যদি সমাধানের ব্যত্যয় ঘটে
মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনতে হবে।
জব্বার সতীশ
এমনভাবে বলিস
মনে হয়, মন্ত্রী পরিবর্তন তুই-ই করিস।
সতীশ হাঃ হাঃ একটু কাছাকাছি থাকিস
নতুন জামা-কাপড়ও সাথে রাখিস
যেন ডাক পড়লেই শপথ নিতে পারিস।
হাঃ হাঃ, জব্বার যাই
সবাইকে খবর জানাই।
দৃশ্য- ৩
[রাজ দরবার। রাজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সামনে গবুমন্ত্রী, যুবমন্ত্রী ও পণ্ডিত। সবাইকে একবার চক্কর দিবে। তারপর নিজের গদিতে বসবে।]
রাজা কী হলো, কথা নাই ক্যান?
সবাই আর কয়টা দিন সময় দ্যান।
রাজা আশ্চর্য!
সময় দিলাম দুইদিন
এখনো মিনমিন।
কিছুই ভাবো নি দুইদিনে?
কোনো সমাধানই আসে নি মনে?
(ওরা পরষ্পরের দিকে তাকায়)
যেকোনো ধরনের জবাব চাই
নইলে নিস্তার নাই।
গবু একদম ভাবি নাই
তা ঠিক না, রাজামশাই।
আমি আর গিন্নী সারারাত ধরে
ভেবেছি সমাধান হয় কী করে!
মধ্যরাতের একটুখানি পরে
হঠাৎ চিৎকার দিলাম জোরেশোরে।
পেয়েছি পেয়েছি রাজার সমাধান
এবারের মতো বেঁচে গেল আমার গর্দান।
রাজা (রাজা উচ্চস্বরে হাসে)
মন্ত্রী গবুচন্দ্র রায়
ধূলা লাগবে না পায়?
কী দিয়ে যে তোমাকে পুরস্কৃত করি
কী চাই তোমার? হীরা, জহরত, টাকাকড়ি?
বল বল গবুচন্দ্র রায়
বের করেছ কী উপায়?
গবু না রাজামশায়-
ধূলা আরো লাগবে পায়
দেখি ধূলা লাগা কে ঠেকায়।
(রাজা অবাক ও উত্তেজিত)
রাজা বল কী
পরিষ্কার কর দেখি।
গবু রাজামশায়
অনেক ভেবে-চিন্তে আসিল উপায়
ধূলা আরো লাগাবো আপনার পায়।
ধুলা যদি না লাগে পায়ে
পায়ের ধুলা পাবো কী উপায়ে?
(মাথা নিচু করে রাখে। রাজা কাছে আসে, নিরাশ হয়ে বলে)
রাজা ওহে বুদ্ধির ঢেঁকি
মাথাটা তোল দেখি।
(মাথা তোলে)
ঘুমাও কী করে
এতো বুদ্ধি মাথায় রেখে?
বালিশ নিশ্চয়ই থাকে মাথার উপরে
যেন বুদ্ধিগুলি-
উড়াল দিতে না পারে।
(রাজা পণ্ডিতের কাছে যায়)
পণ্ডিত, আছে কোনো উপায়?
নাকি একই বুদ্ধি তোমার মাথায়?
পণ্ডিত রাজা মশাই
ভেবেছি দুইদিন দুইরাত্র ...
রাজা ধুলা লাগাবে আমার সারা গাত্র।
গর্দভ
সব।
(যুবমন্ত্রীর কাছে যায়)
যুবমন্ত্রী
সমাধান বল দেখি।
(যুবমন্ত্রী চুপচাপ তাকিয়ে থাকে)
কী সমাধান নাই?
দেখাও চেহারাখানাই।
(নিজের সিংহাসনে ফিরে আসে)
গবুচন্দ্র রায়-
ধুলা যদি না লাগে পায়ে
পায়ের ধুলা পাবে কী উপায়ে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, কথা বড় সত্য
তবে, পরে ভেবো পদধুলির তত্ত্ব।
আগের কাজ আগে তো তুমি সারো
পরের কথা ভেবো পরে আরো।
শোন গবু, যুব আর পণ্ডিত মশাই
শেষ কথা জানাই।
ধুলা যেন না লাগে পায়
একদিনের মধ্যে বের করো উপায়।
দৃশ্য- ৪
[জব্বারের বাড়ি। জব্বার মাথায় হাত দিয়ে ভাবছে। গিন্নী লুৎফুন্নেসা পাশে]
লুৎফুন্নেসা ক্যামন ভাব নিয়ে আছে দুইদিন ধরে
সংসার বাদ দিয়ে রাজ্যের চিন্তায় মরে।
কী আছে এমন ভাবনা
যার সমাধান মিলে না?
আমারে কও না।
জব্বার ভাবনা আমার না
ভাবনা ঐ রাজার মাথায়
বুদ্ধি দিয়া যে রাজ্য চালায়।
লুৎফুন্নেসা ভাবনা রাজার, ভাবতেছ তুমি
যত সব ফাজলামী।
জব্বার নিজের জন্য ভাবি না, লুৎফুন্নেসা
আমি-তো সামান্য চাষা।
রাজার সমস্যার যদি না হয় সমাধান
মন্ত্রী আর পণ্ডিতের যাইবে গর্দান।
লুৎফুন্নেসা তাতে তোমার বাড়বে মান-সম্মান?
গোলায় উঠবে, গোছা গোছা ধান?
এই তো জগতের নিয়ম
অন্যের ভাবনায় যায় নিজের জীবন।
মন্ত্রী, পণ্ডিত আর রাজার ব্যাপার
তা দিয়ে কী কাজ চাষার ব্যাটার?
(কাছে এসে আরও রেগে)
তোমার হবে-
যা হয় ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার।
(জব্বার নিজের ধ্যানে থেকেই কথা বলে)
জব্বার লুৎফুন্নেসা, একবার ভাবো
মন্ত্রী-পণ্ডিত করে রেখেছে মাথা নত।
এ দৃশ্য যদি দেখতে পায় নিরীহ জনগণ
সার্থক হবে তাদের জীবন, সার্থক হবে মরণ।
লুৎফুন্নেসা বাঃ, জনগণের সম্পদ চুরি করে
যদি রাজার কাছে মাথা নত করে
তাহলেই জীবন সার্থক হবে?
হাদিস কোরানে আছে
খোদা পাপ ক্ষমা না করে
যতক্ষণ না বান্দা নিজে ক্ষমা করে।
মন্ত্রী-পণ্ডিত যদি ক্ষমা চায় জনগণের কাছে
তবেই না এখানে খুশির কারণ থাকে।
অথচ-
জনগণ ধুকে মরে ফসলের আকালে
রাজ্যসভা মজে আছে ধূলা-বালি নিয়ে।
আর এদিকে-
জব্বার চাষা বসে বসে পা নাড়ে,
এতেই যেন ভাত ফুটবে হাঁড়ির ভেতরে।
জব্বার আমাদের কোনো আছে উৎসব
যা দিয়ে পাই ফূর্তির ফুসরত?
এখন আর নাই সেই ঈদ পার্বণ
যা নিয়ে বেঁচে থাকবে গ্রামীণ জনগণ?
তাই তো-
যখন রাজ্যসভায় দেখি উনিশ-বিশ
নিজেরা নিজেদের মধ্যে করি ফিসফিস।
যখন শুনি মন্ত্রী পণ্ডিত মাথা চুলকায়
আর রাজা ধমকায়
তখন-
তাদের গলা চেপে ধরি উত্তেজনায়
ঘুম ভাঙলে দেখি শুয়ে আছি খাটের তলায়।
দৃশ্য- ৫
[পণ্ডিতের বাড়ি। পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, পণ্ডিত ভাবতে ভাবতে ঘামে সিক্ত। সামনে তার সুউচ্চ গ্রন্থ আর গ্রন্থ। তার গিন্নী গৃহস্থালী কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিড় বিড় করতে থাকে।]
গিন্নী মাটি ক্যান লাগবে পায়
জানতে চায় মহারাজায়।
যতসব আজগুবি ভাবনা
ভাবনা ছাড়া য্যান ঘুম আসে না।
মাটি দিয়া হাঁটবে- ধুলা লাগবে না পায়
লাগবে মাথায়?
পণ্ডিত (পড়ার ব্যস্ততার ফাঁকে)
গিন্নী
তোমার মতো বুদ্ধি কার আছে শুনি?
তুমি নও সাধারণ কেউ
রাজ-পণ্ডিতের বউ।
রাজার ভাবনাকে না করে অপমান
দাও ভাবনার সমাধান
না হলে যাবে স্বামীর গর্দান।
এমন ভাবনার হলে উদয়
তবেই একজন রাজা হয়
একথা জানবে নিশ্চয়।
(পণ্ডিত মাথা চুলকায় আর ভাবে)
গিন্নী পাগল রাজা কী না কী ভাবে
সে ভাবনায় পণ্ডিতের চুল যাবে।
(কাছে এসে, শ্লেষাত্মক ভঙ্গিমায়)
আমার কাছে আছে সহজ সমাধান
রাজাকে গিয়ে বলেন- রাজা আপনি ঘুমান।
পণ্ডিত রাজা ঘুমাবে?
রাজ্য চলবে কীভাবে?
গিন্নী রাজ্য চলছে নাকি?
এভাবে চললে চলার দরকার কী?
আপনারা রাজ্য দেখেন নাকি?
দেখেন বলেই কি রাজ্যের এই গতি?
পদে পদে হয় জনগণের ক্ষতি।
পণ্ডিত বাঃ, তোমার কথায় মনে হয় তুমি অতি সাধারণ
এসব ভোগ বিলাস তবে কী প্রয়োজন?
জনগণের অর্থে ভরে পণ্ডিতের থলে
ওসবই তো ভোগ করো পদাধিকার বলে।
রাজা মন্ত্রীর সমালোচনা
তোমার মানায় না।
অসৎ, আমার উপার্জন
তা খেয়েই বেঁচে আছ তুমি, তোমার আত্মীয়-স্বজন।
জনগণের কষ্টে আসে চোখের জল
অথচ-
এক বেলা না খেলেই পা-দুটো অচল।
আছে জানা
সব মায়া কান্না।
পণ্ডিতি গেলেই তো আমি অচেনা।
ভেঙে চুরে পালঙ্ক
বলবে, তুমি পুরুষ নামের কলঙ্ক।
(রেগে, গিন্নীকে)
স্বার্থপর জলজ্যান্ত!
গিন্নী এতো কথার কী আছে শুনি
আমি বলেছি নাকি
ভোগ বিলাস ছেড়ে হবো সন্নাসী?
যখন টানি জনগণের প্রসঙ্গ
মনে হয় এ-জীবন বুঝি জনগণের জন্য।
তাই বলছিলাম-
যদি রাজ্য সভায়
দু’একটা নারীর আসন দেয়া যায়
দেখতাম, জনগণের জন্য কী করা যায়
নিজের মেধায়।
পণ্ডিত যদি তুলি এ-কথা রাজ্যসভায়
দুইমন্ত্রী মিলে, ফেলবে বেকায়দায়
বাপেরও সাধ্য নাই তখন-
আমার চাকরি বাঁচায়।
বাজে কথায় সময়ের ক্ষতি
ভেতরে যাও, একটু ভাবতে দাও দেখি।
দৃশ্য- ৬
[রাজার শয়নকক্ষ। ]
রাণী অনেকদিন হয় গত
মহারাজা খুবই চিন্তিত।
তাই দেখে মহারাজ
একটা কথা বলবো আজ?
রাজা আমার পরীর মতো রাণী
কথা বলতে অনুমতি লাগে নাকি?
রাণী শুনেছি রাজার ভাবনা আছে একখান
নিন পান খান
হয়েছে কি সেই ভাবনার সমাধান?
রাজা ভাবনাটা কী,
জানো তো মিষ্টি রাণী?
ধুলা লাগে পায়, তা সবাই জানি।
কিন্তু, বলো তো-
ধূলা না লাগার উপায়খানি।
রাণী কী জানি
বলেন না, উপায়খানি।
রাজা আমিই কি জানি
মিষ্টি রাণী।
আমার মাথায় ভাবনা যেটা
সমাধান বের করে মন্ত্রী আর পণ্ডিত ব্যাটা।
(কাছে এসে রাণী রাজার মাথার চুল নিয়ে নাড়াচাড়া করে)
রাণী কাজের চেয়ে আপনাদের ভাবনাই বেশি
বোকা জনগণ দেখি তাতেই খুশি।
রাজা, মন্ত্রী আর পণ্ডিত মিলে
যদি ফেলেনও রাজ্যটাকে গিলে
জনগণ তাতেই দেখি, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
রাজা রাণী
জনগণের অসুবিধা সবই জানি।
যখনই পা বাড়াই জনগণের দিকে
মন্ত্রী বাধা দেয় সামনে-
পেছন থেকে পণ্ডিত জামা ধরে টানে।
ওরা বলে-
রাজা আর প্রজার মধ্যে দূরত্ব প্রয়োজন
মাঝে মন্ত্রী-পণ্ডিত থাকবে সাঁকোর মতোন।
আমাকে বলে
রাজ্য চালাতে গেলে
জনগণের সুখ দেখলে কি চলে?
রাজার সুখ মানেই তো জনগণের সুখ
এই নিয়মটাই চালু থাকুক।
(হতাশ হয়ে হয়ে)
দেখি কী করা যায়, সময় আসুক।
দৃশ্য- ৭
[যুবমন্ত্রীর বাড়ি। বারান্দা বা উঠোনের একপ্রান্তে হুঁকো, তামাক জ্বলছে। বড় নল দিয়ে অনেক দূরে হঁকো টানছে যুবমন্ত্রী। দূরে দেখা যাবে জব্বারকে। করজোরে কাছে আসে জব্বার।]
যুবমন্ত্রী কী খবরাখবর
জব্বার?
(জব্বার কাশে)
প্রশ্ন শুনে আসে কাশি
তামাশা নাকি?
জব্বার হুজুর-
কিছুদিন ধরে শুনছি-
যুবমন্ত্রী সেকি-
শোনা কথায় কান দিস নাকি?
জব্বার না হুজুর-
মূর্খেরা রটায়
আপনার মাথায়
ভাবনা দিয়েছে এক আমাদের রাজায়।
যুবমন্ত্রী রাজা ভাবনা দিবে আমার মাথায়!
রাজা এতো বুদ্ধি খাটায়?
আশ্চর্য-
রাজ্যের মানুষ ভাবে কী?
আমার বুদ্ধি ছাড়া রাজ্য চলে নাকি?
ঐ ভাবনা আগে আসে আমার মাথায়
বলি নাই, পাছে, রাজায়
ধমকায়।
(জব্বার একটু কাশে এবং হাসে)
জব্বার আপনার মাথায় যে বুদ্ধি আসে
রাজা ভাবেন তা পরের মাসে।
আপনার ভাবনার সমাধান
যা রাজা আপনার কাছে চান
ঐ সমাধানই বাঁচাবে আপনার গর্দান
নিয়তির কী পরিনাম!
যুবমন্ত্রী সেটাই তো দুঃখের বিষয়
নিজের ভাবনার সমাধান-
নিজেরই দিতে হয়।
জব্বার-
জানিস কোনো উপায়
ধূলা লাগানো ছাড়া কীভাবে হাঁটা যায়?
জব্বার আমাদের মতো যারা দিন আনে দিন খায়
এতো চিন্তা-ভাবনা কি তাদের মানায়?
অনুমতি দিলে এই বান্দা যেতে চায়।
(যুবমন্ত্রীর অনুমতি পেয়ে জব্বার চলে যায়। যুবমন্ত্রী পায়চারি করে)
যুবমন্ত্রী কী করা যায়
কী করা যায় ...
(ভাবতে ভাবতে একটা সমাধান পেয়ে যায়)
ধূলা যেন না লাগে পায়
তার সমাধান এভাবেই করা যায়।
দৃশ্য- ৮
[রাজ্যসভা। গবুমন্ত্রী, যুবমন্ত্রী আর পণ্ডিত বসে আছে। রাজার প্রবেশ।]
রাজা কারো মুখে দেখি হাসি নাই
সমাধান মিলে নাই?
(গবু ও পণ্ডিতের মুখ কালো। যুবমন্ত্রী হাসি দেয়)
কী ব্যাপার যুবমন্ত্রী, হাসো যে?
(কাশি দেয়)
কাশো যে?
যুবমন্ত্রী মিলে গেছে সমাধান
চলেন, যদি দেখতে চান।
দৃশ্য- ৯
[সাইক্লোরামার পেছন থেকে দেখা যাবে শত শত মানুষ ঝাড়– হাতে রাজ্যের পথ ঝাড়– দিচ্ছে। বালু বালু আর বালু উড়ছে। নিঃশ্বাস নেয়ার কিংবা ফেলার উপায় নাই। রাজ্যের সবাই কাশছে। চারিদিকে ছুটোছুটি। মেঘের মতো ধূলা চারিদিকে।]
দৃশ্য- ১০
[রাজ দরবার। বাইরে ধূলা-বালি। রাগে গড়গড় করছে রাজা। মন্ত্রীদ্বয় ও পণ্ডিত বসা। সবার মাথা নত।]
রাজা বুদ্ধি, বুদ্ধি, দেখ যুবমন্ত্রীর বুদ্ধির বহর
সারা রাজ্য দেখে ধূলার খবর।
সামান্য ধূলা, লাগে পায়ের উপর
সমাধান না পারলে, না কর।
(পায়চারি করে)
তিন-চারদিন ভাবলো আবোল-তাবোল সব
এখন দেখি পর্বতের মুষিক প্রসব।
অপদার্থ!
অর্থের শ্রাদ্ধ!
(নিজের আসনে বসে)
যুবমন্ত্রী
কিছু বলো শুনি।
(যুবমন্ত্রী চুপ)
সারা রাজ্য ধূলা দিয়ে ঢেকে
আছেন তিনি মাথা নত করে।
ধূলা রাজ্যছাড়া করতে গিয়ে
ধূলা ঢোকে জানালা দিয়ে
ঢোকে দরজা দিয়ে
লাগে চোখে মুখে।
(কিছুক্ষণ নিরবতা।)
পণ্ডিত রাজা মশাই
শেষ আর্জি জানাই?
রাজা বাঃ, আর্জি আর জানাবে কতো
নিজের সুবিধা মতো?
পণ্ডিত এবারই শেষ।
রাজা বেশ।
কিন্তু-
অর্থের শ্রাদ্ধ হবে না তো শেষমেশ?
পণ্ডিত না, রাজামশাই-
সমাধান মাথায় এসেছে অনেক আগে
এদ্দিন দেখলাম দুই মন্ত্রী কী করে।
(দুই মন্ত্রীর দিকে তাকায়)
আমি পণ্ডিত নিজে
জ্ঞানের ব্যাপারে আপনি ছাড়া সবাই আমার নিচে।
(দুই মন্ত্রীকে বলে)
আমার কথায় আপত্তি আছে?
(রাজা বিরক্ত হয়)
রাজা আসলেই কি তোমার কোনো সমাধান আছে?
পণ্ডিত আমার সমাধান অতীব সোজা-
রাজা তোমার প্যাঁচানো কথাতেই যায় বোঝা।
গবু (ঠাট্টা করে, পাশ থেকে যুবমন্ত্রীকে)
একেবারে তরতাজা।
যুবমন্ত্রী দূর যাঃ।
পণ্ডিত (বিচার চাওয়ার ভঙ্গিতে পণ্ডিত বলে)
রাজা-
রাজা কী ব্যাপার-
তোমাদের দেখি গর্দানের নাই ভয়
ঘাড়ের উপর দুইটা মাথা নিশ্চয়।
(সবাই চুপ)
পণ্ডিত, তোমার সমাধান বলো
পছন্দ হলে ভালো
তা না হলে-
চাকরি আর গর্দান দুইটাই গেল।
পণ্ডিত সমাধান বলতে চাই না মুখে
দেখবেন নিজ চোখে
আগামীকাল প্রত্যূষে।
আগামীকাল
দেখবেন, সকাল সকাল
ধূলার পড়িবে আকাল।
দৃশ্য- ১১
[জব্বারের বাড়ি। জব্বার নতুন পোশাক পড়ে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। গিন্নীর সাথে কথপোকথন।]
লুৎফুন্নেসা নতুন জামা পড়ে যায় কই?
জব্বার কেমন, মানানসই?
লুৎফন্নেসা কী ব্যাপার মতলব কী
নতুন কাউরে আনবা নাকি?
জব্বার ধুর যাঃ, ঠাট্টা করো নাকি
ছাতাটা দাও দেখি।
লুৎফুন্নেসা আমার মাথায় হাত দাও
কী হইলো, এদিক চাও।
জব্বার দাও পান দাও।
লুৎফুন্নেসা নাও, পান খাও
কিন্তু আমারেও সঙ্গে নাও।
জব্বার হাঃ হাঃ, সন্দেহ যদি হয়
যাবা নিশ্চয়।
যাচ্ছি নদীর ওপার
বন্ধুর বাড়ি বেড়াবার।
বন্ধু, জাতে চামার
তাকে খবর দেব এখানে আসবার।
লুৎফুন্নেসা কী কারবার
যাচ্ছ বন্ধুরে আনবার
অথচ ঘরে নাই বাজার!
জব্বার কী যে বল বউ-
কী তোমার কথার বাহার
চামার, দোস্ত আমার, ছোটবেলার
দোস্তামির চেয়ে বড় হইল খাবার-দাবার?
(নেপথ্যে চামার ডাকে)
চামার দোস্ত জব্বার।
জব্বার কী ব্যাপার, কন্ঠ তো পরিষ্কার।
চামার কন্ঠ আমার, বন্ধু তোমার
জাতে চামার।
অনুমতি দাও ভেতরে আসবার।
(ভেতরে আসে)
(নেপথ্যে গান)
জব্বার কে যায়?
সতীশ আমি সতীশ, যাই পণ্ডিতের বাড়ি
তাড়াতাড়ি।
পণ্ডিতের দেয়া খবর, বুদ্ধিমান দরকার একজন
আমাকে প্রয়োজন।
জব্বার সেই বুদ্ধিমান তুই?
পুকুর কাটবে কোদাল নাই
নিয়া যাচ্ছে সুঁই।
সতীশ এই-তো দেশের বুদ্ধির বহর
যাইরে জব্বার।
(নেপথ্য কন্ঠ চলে যায়)
জব্বার দোস্ত, কতদিন গত হয়
বউয়ের সাথে নাই তোমার পরিচয়।
চামার আমি দিই আমার পরিচয়
তাতে যদি দোষ কিছু মাফ হয়।
বৌদি
আমি আপনার স্বামীর সব-ই।
আমি জাতে চামার, নামেও চামার।
আর কিছু আছে জানার?
লুৎফুন্নেসা না, দেখলাম কত টান দুই দোস্তে
যা আছে তাই খাবেন আল্লাহর-ওয়াস্তে।
দৃশ্য- ১২
[পণ্ডিতের বাড়ির সামনের অংশ। সতীশ এসেছে।]
পণ্ডিত সতীশ
এসেছিস?
সতীশ জ্বী হুজুর-
করেছেন সমন জারী
না এসে কি পারি?
পণ্ডিত না, ভাবলাম যদি হয় দেরি।
সতীশ আপনার ডাক যখন পৌঁছায়
থাকতে পারি কি বিছানায়?
চলে আসলাম তখন
দৌড়ে আসতে যতক্ষণ।
(পানের বাটা নিয়ে আসে গিন্নী। পান দেয় পণ্ডিতকে)
পণ্ডিত সতীশ, খাবি নাকি পান?
সতীশ হুজুরের কাছ থেকে খাব পান!
দুইটা না তিনটা না, একটা মাত্র প্রাণ
সেটাও নিতে চান?
পণ্ডিত হায়রে সতীশ
কী বলিস!
আমারই প্রাণের নাই ঠিক
রাজা করে খিটমিট।
আকাশ পড়েছে আমার মাথায়
সমাধানের পর সূর্য দেখতে চায়।
আমিও বলে দিয়েছি
সূর্য কী করে আগে ওঠে দেখি!
(কিছুক্ষণ নিরবতা)
কিন্তু-
বলেছি তো উত্তেজনার বশে
দুই মন্ত্রীকে দিতে চড়, কষে
এখন তো দেখি নিজের গর্দানেই ছুরি বসে।
সতীশ একটা কথা বলি দিলে অভয়
সমাধান চান না আমার কাছে নিশ্চয়;
এত বড় কাজ কি চাষারে দিয়া হয়?
গিন্নী বিপদে পড়লে চাষা কী আর পণ্ডিতই কী
ওনার মাথা ঠিক আছে নাকি?
যে কয়টা চুল আছে তা-ও পড়ার বাকি।
পণ্ডিত সতীশ
কথাটা বুঝিস।
তুই চাষ করিস, তাই আমরা খাই
বুদ্ধি দে না, তোর বুদ্ধিতেই না হয় রাজ্য চালাই।
সতীশ এ কেমন কথা পণ্ডিত মশাই!
আমার ফসল, আমার বুদ্ধি
তবে দেশ চালাতে আপনার প্রয়োজন কী?
নিয়ে আমার সমাধান
আপনারা মন্ত্রী বনে যান
এটা কেমন কথা আমারে বোঝান।
পণ্ডিত এটাই হলো রাজা-প্রজার ব্যবধান।
গিন্নী সারারাত জেগে থাকে চিন্তায় চিন্তায়
চাষার কাছে বুদ্ধি চায়, দিনের বেলায়!
এদিকে আমার ইজ্জত যায়।
পণ্ডিত ইজ্জতের এত ভয়, তবে বের করো উপায়
পায়ে ধূলা লাগা কী করে বন্ধ করা যায়।
এতে খুশি হবেন রাজায়
স্বামীর গর্দান আর তোমার ইজ্জতও বেঁচে যায়।
গিন্নী আপনারা যা পারেন না, তা করবে এই চাষায়?
পণ্ডিত ডেকেছি তো সেই আশায়।
(গিন্নী ভেতরে চলে যায়)
ওরে সতীশ, চাষার ব্যাটা
বুদ্ধি খাটা।
সতীশ হুজুর,
চাষার বুদ্ধিতে যদি বেঁচে যান প্রাণে
ঠিক আছে, বুদ্ধি দিই একটা, কানে কানে।
(কানে কানে বলে, পণ্ডিতের মনে ধরে)
পণ্ডিত বুদ্ধিটা গোপন র্ক
রাজাকে শোনাবো বুদ্ধি তোর।
খুশি হলে প্রশংসা যাবে আমার উপর।
কিন্তু-
বুদ্ধি শুনে যদি রাজা চোখ-মুখ লাল করে
সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থাকবি সারাদিন ধরে।
(বলে ভেতরে চলে যায়)
(সতীশ চতুরতার সাথে বলে)
সতীশ : আগে তো রাজার কাছে যান
বুদ্ধি শোনান।
মান-সম্মান নিয়ে যদি আসেন ফিরে
কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো সূর্যের নিচে।
দৃশ্য- ১৩
[রাজ দরবার। পণ্ডিতের সিদ্ধান্ত দেবার পালা। দুইমন্ত্রীও উপস্থিত।]
রাজা বড় গলা করে একদিন বেশি নিয়েছে সময়
দেখি পণ্ডিতের মাথা থেকে কী বেরয়।
(সবাই চুপ)
সবাই চুপ্, সেকি
পণ্ডিত, কথা বলো দেখি।
(পণ্ডিত চুপ)
গবুমন্ত্রী পারে নাই, যুবমন্ত্রীও না
তুমিও না পারলে না করো না।
পণ্ডিত রাজা মশাই-
অনেক ভেবেচিন্তে বের করেছি সমাধান
এবার নিশ্চয়ই প্রমাণ হবে আমি বিদ্বান
সমাধান, সবার সামনেই বলি- যদি চান।
রাজা চাইলাম সবার সামনে
সমাধান দিবে গোপনে
তা হয় ক্যামনে?
পণ্ডিত তা হলে রাজা মশাই, শোনেন
দুইমন্ত্রী, আপনারাও কান দেন।
আমাদের মহান রাজা থাকিবেন ঘরে
দিন-রাত ধরে।
বাহির দরজা রাজার জন্য বন্ধ
সমাধান কি মন্দ?
(পণ্ডিত খুশি খুশি ভাব করে)
ধূলার মাঝে না যদি দেন পা
পায়ে ধূলা তো লাগে না।
(দুই মন্ত্রী ও রাজা পরষ্পরের দিকে তাকায়। রাজা নিশ্চুপ বসে থেকে কিছুক্ষণ পর কথা বলে)
রাজা বাঃ বাঃ, তুমিও দেখি বুদ্ধির ঢেঁকি
তোমার ঢেঁকি দেখি
দুই মন্ত্রীর চেয়ে শক্ত বেশি।
আমার যদি হয় মাথা ব্যথা
ওষুধ না দিয়ে, তুমি তো মাথা কেটে নিবা।
পণ্ডিত, তুমি তো মহা-ভয়ঙ্কর
ক্ষতি লুকিয়ে থাকে চিন্তার ভিতর।
রাজাকে যদি বন্ধ রাখা যায়
তোমাদের হয় ফাজলামীর উপায়।
পণ্ডিত, রাজা বন্ধ থাকবে সব-সময়
বাইরে যাবে না নিশ্চয়।
যুবমন্ত্রী, রাজা বাইরে যাবে না
এর চেয়ে মরণ ভালো না?
গবু, তুমি সমাধান দিলা-
লাগবে ধূলা আরো
যেন পায়ের ধূলা নিতে পারো
এরপর তোমাকে জীবিত রাখা উচিত হয়েছে কারো?
যুবমন্ত্রী-
অনেক ভেবেচিন্তে বের করলে উপায়
ধূলা দূর না হয়ে রাজ্য ডুবলো ধূলায়।
(পণ্ডিতের কাছে আসে)
আরেকজন বের করেছে উপায়
আমাকে দরজা বন্ধ করে রাখতে চায়।
এরপরও সমাধানের জন্য বসে আছি কোন আশায়!
পণ্ডিত না রাজামশায়-
কেবল ঘরের মধ্যে থাকবেন, তা কি হয়?
প্রয়োজনে বাইরে যাবেন নিশ্চয়।
রাজা ঠিক আছে পণ্ডিত, বলো দেখি
বাইরে যাবার উপায়খানি।
পণ্ডিত আপনি হলেন রাজ্যের রাজপতি
রাজ্য না দেখলে রাজ্যেরই ক্ষতি
আপনাকে ঘরে বন্ধ রাখা
ছিঃ পণ্ডিত নয় এত বোকা।
আপনাকে ঘুরে ঘুরে রাজ্য দেখতে হবে।
রাজা ধূলা কে সামলাবে?
পণ্ডিত ধূলা লাগবে না পায়
একথা বলতে পারি নির্দ্বিধায়।
আপনি বসবেন জনতার মাথায়
ধূলা যা লাগার, লাগবে জনতার পায়।
আগে রাজ্য দেখতেন কষ্ট করে
পায়ে হেঁটে।
এখন দেখবেন অনেক আরামে
জনতার কাঁধে চড়ে।
দৃশ্য- ১৪
[রাজ্যের পায়ে হাঁটা পথ। রাজা চড়েছেন দুই জনতার হাতে হাত রাখা পালকিতে। পেছনে বাদ্যযন্ত্রীদল। তার পেছনে রাজ্যের যত ছেলেপুলের দল। সবার মধ্যে চাপা হাসি। রাজাকে খেলার পুতুল মনে হয় সবার কাছে। মন্ত্রীদ্বয় ও পণ্ডিত সাথে সাথে যাচ্ছে। পণ্ডিতের মুখে গর্বের হাসি। কিন্তু রাজাও নিজেকে একসময় ভাঁড় ভাবে। পথে এক ধারে জব্বার ও চামার দেখছে এই দৃশ্য। চামার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। রাজার পালকি রাজ্যময় ঘুরে বেড়ায়। রাজার পালকি দূরে চলে যায়। জব্বার ও চামার কথা বলে)
চামার জব্বার
একি কারবার!
সামান্য ধূলা যেন না লাগে পায়
রাজা উঠে গেলেন জনতার মাথায়!
জব্বার দোস্ত-
ধূলাকে তুমি বলো সামান্য
মন্ত্রী আর পণ্ডিত থাকে চিন্তায় মগ্ন।
সবার সমাধানেই রাজা রুষ্ট হলো
পণ্ডিতের সমাধান বোধহয় মন্দের ভালো
কী বলো?
চামার তাই তো মনে হলো।
জব্বার তোমার মাথায় আছে কোনো উপায়
ধূলা না লাগিয়ে কীভাবে হাঁটা যায়?
চামার (ঠাট্টা করে)
হ্যাঁ, আছে সহজ উপায়
ধূলা যেন না লাগে পায়
পা দুটা কেটে ফেলা যায়।
জব্বার ঠাট্টা বাদ দাও
নিজের ভালো যদি চাও
সমাধান নিয়া রাজার কাছে যাও।
চামার : আমি চামারের ব্যাটা চামার
আমার কী প্রয়োজন, সমাধান দিবার?
রাজার?
জব্বার : বড় উত্তম সময়ে এসেছ এবার
সমাধানে সদস্য হবা মন্ত্রিসভার।
কে খবর নিবে তোমার
তুমি চামারের ব্যাটা চামার?
দৃশ্য- ১৫
[রাজার শোবার ঘর। রাজা আরাম কেদারায় শুয়ে আছে। রাণী পান দেয়, পান খায়। আদুরে কান্না কান্না গলায় কথা বলে।]
রাণী এটা কোনো সমাধান হলো?
রাজ্যের মানুষ দেখলো
আমার রাজা কোলে চড়ে
সারা রাজ্য ঘুরলো।
রাজা পণ্ডিতের বাচ্চা পণ্ডিত
আমারে একবার করে কাৎ
একবার করে চিৎ।
আমারে বলে-
রাজামশায়, রাজ্য দেখবেন আরাম করে
জনতার কাঁধে চড়ে।
আমি ভাবলাম-
বুঝি বাড়বে আমার মান, সম্মান
কিসের কী-
আমারে নিয়া ঠাট্টা করে পিচ্চি পোলাপান।
(রাণী কেঁদে ফেলে)
রাণী মাঠের মধ্যে পণ্ডিতেরে ধরিয়ে রাখেন কান
যান।
রাজা মন্ত্রী, পণ্ডিত কারোই নাই বুদ্ধিসুদ্ধি
কী হবে রাজ্যের পরিণতি!
রাণী রাজ্যের পরিণতির কথাই যদি ভাবেন
এগুলি ছাটাই করেন।
দিতে গিয়ে সমাধান
আমার রাজাকে করে অপমান!
(রাজাকে আদুরে গলায়)
ধূলা লাগুক পায়
বাদ দেন সমাধানের উপায়
তাতে মান সম্মান যদি কিছুটা বেঁচে যায়।
রাজা সম্মান যাক, সেটা কে চায়?
রাণী রাজা, আমার কাছে আছে খবর
শুনবেন কি, এতো ব্যর্থতার পর?
(পুরুষতান্ত্রিক ভাবনায়)
রাজা তোমার মাথায়ও বুদ্ধি আসে!
কী দুর্যোগ ভাসে
রাজ্যের ভাগ্যাকাশে!
হাতি যখন গর্তে পরে
চামচিকাও লাথি মারে।
রাণী নিজেকে হাতি ভেবে সুখ পান
ওদিকে ঠাট্টা করে পিচ্চি পোলাপান
এখনও সময় আছে, যদি সমাধান চান
সিংহের গর্জন না করে ইঁদুরের কাছে যান।
শুনুন-
রাজ্যে এক প্রজা আছে, নাম জব্বার
তার বন্ধু চামার
থাকে নদীর ওপার
কিছুদিন হয় এসেছে বন্ধুর বাড়ি বেড়াবার।
রাজা তা কী করার আছে, তার?
রাণী তাকে ডেকে আনুন রাজদরবারে
রাজ্যটাকে মুড়ে দিক চামড়া দিয়ে।
তারপর রাজা যখন হাঁটবে
ধূলা কী করে বেরুবে?
রাজা বাহবা রাণী
দেখি তোমার মুখখানি
এটাই তো উত্তম সমাধান
কে আছিস, চামারকে ডেকে আন।
দৃশ্য- ১৬
[রাজ-দরবার। মন্ত্রীদ্বয় ও পণ্ডিত বসা। চামারকে বেঁধে আনা হয়েছে। সে দাঁড়িয়ে আছে। রাজ-সিংহাসন খালি। এখনো রাজার প্রবেশ ঘটে নি। রাগত চোখে চামারের দিকে তাকায় গবুমন্ত্রী, যুবমন্ত্রী ও পণ্ডিত। গবুমন্ত্রী এগিয়ে আসে।]
গবু কিরে চামারের ব্যাটা চামার
কারণ জানিস তো এখানে তোকে আনার?
আমরাই দিতে পারিনি সমাধান
অথচ
রাজা তোর কাছে বুদ্ধি চান।
আমরা কেউ দিতে পারিনি সমাধান
তবুও বেঁচে গেছে গর্দান
তোর কিন্তু কলিজা ধরে দিবে টান।
(উঠে আসে যুবমন্ত্রী)
যুবমন্ত্রী তোর মাথায় কী বুদ্ধি আছে?
রাজা হাঁটবেন মাথা দিয়ে
পা দু’টা উপরে তুলে?
আমরা সদস্য মন্ত্রিপরিষদের
রাজা বুদ্ধি নেয় চামারের
কী হবে এই রাজ্যের!
চামার আমার কী দোষ?
হচ্ছেন নাখোস।
(রেগে)
যুবমন্ত্রী বোস্।
(চামার বিড়বিড় করে)
চামার আসলাম বন্ধুর বাড়ি বেড়াবার
কপাল দেখি জেলে যাবার
কী দোষ আমার!
গবু ওরে চামারের ব্যাটা চামার
বিড়বিড় করিস আবার
সময় হয়েছে তোমার
চড় খাবার।
চামার কম্মো সাবাড়।
(পণ্ডিত কাছে আসে। দুই মন্ত্রী দূরে দাঁড়িয়ে থাকে)
পণ্ডিত তুই কী জানিস, রাজ্যের সমস্যা?
চামার পাগল হয়েছে রাজা আর মন্ত্রিসভা।
পণ্ডিত যাঃ কী বলিস
খেই হারিয়ে ফেলিস
রাজার সামনে বলে দেখিস
দেখবি গর্দান ছাড়াই বাড়ি ফিরে গেছিস।
চামার ইস্স্।
পণ্ডিত চামার এদিকে আয়
দুইমন্ত্রী যেন শুনতে না পায়।
রাজার ব্যাটা রাজা তোকে ডেকেছে
নিশ্চয়ই জানে, বুদ্ধি আছে
তোর ঘটে।
চামার তা আমার কী করার আছে?
পণ্ডিত আছে আছে-
এজন্যই তো পণ্ডিত এসেছে
চামারের কাছে।
নইলে তোরে কে পোছে?
রাজাকে তুই দিবি সমাধান
যদি রাজা তাতে সন্তুষ্টি পান
বলবি, রাজা, কথা আছে একখান।
চামার আপনি কী চান?
(রাগত)
পণ্ডিত আমার কথায় দে কান।
রাজাকে তুই বলবি-রাজা, আমি দিলাম যে সমাধান
সেটা আমার না, পণ্ডিত মশাইয়ের দান।
(ফিসফিসিয়ে গবুকে বলে)
যুবমন্ত্রী পেতে রাখুন কান
কী যেন ফন্দি আঁটে পণ্ডিত শয়তান।
চামার ঠিক আছে-
কিন্তু, যদি শুনে আমার সমাধান
রাজা ক্ষেপে যান;
শুনতে চান
কে দিল এই বুদ্ধি তারে ধরে আন?
(পণ্ডিত রেগে যান)
পণ্ডিত রোদে দাঁড়িয়ে থাকবি ধরে কান।
(রাজা প্রবেশ করে)
রাজা রাজ্য নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত
মন্ত্রিসভায় যদি থাকে তোমাদের মতো
গর্দভ যত
অ্যাঁ, করে রেখেছে মাথা নত।
রাজ্যে কত-রকম সমস্যা হয়
আমার কাছে এসে কয়
চিন্তার কিছু নাই রাজামশায়,
সমাধান হবে নিশ্চয়।
কত সমস্যা হয় প্রজাদের
নুন আনতে পানতা ফুরায় যাদের।
আমার কাছে এসে বলে-
এসবের সমাধান তো ওয়ান-টু’র ব্যাপার
পরে খবর আসে প্রজা মরার।
গবু আমাদের কী আছে করার?
রাজা সদস্য হয়েছো কেন, মন্ত্রিসভার?
আমার রাজ্যে নিশ্চয়ই আছে অনাচার
অত্যাচার
কে খবর রাখে কার?
তালে আছে যার যার।
এখন শেষ ভরসা চামারের ব্যাটা চামার।
গবু চামার করবেটা কী
সমাধান দিবে নাকি?
যুবমন্ত্রী পাগল নাকি?
পণ্ডিত তা-ছাড়া আবার কী!
রাজা না, সমাধান ছিল আমার ঘরে
জানতে পারি তা গতরাতে।
আন্দাজ আছে কীভাবে হতে পারে?
গবু হয়ত-বা স্বপ্নের ভেতরে।
রাজা গর্দভ আর কাকে বলে!
আমার লক্ষ্মী রাণী দিয়েছে সমাধান
বললো, যদি ধুলা থেকে বাঁচতে চান
রাজ্যটাকে চামড়ার জামা পড়ান।
যুবমন্ত্রী মহারাজ-
যদি না নেন অপরাধ
একটা কথা বলার হয়েছে সাধ।
আমারও এসেছিল এই বুদ্ধি মনে মনে
এখন ভাবি, রাণী মাতা জানলো ক্যামনে?
গবু রাজামশায়-
আমার মনেও হয়েছিল উদয়
রাজ্যটাকে চামড়া দিয়ে মুড়ে দিলে হয়।
কিন্তু ভাবলাম-
এত চামড়া পাওয়া যাবে না বোধহয়
শুধু শুধু বুদ্ধি ক্ষয়
নিশ্চুপ থাকা ভালো নিশ্চয়।
রাজা তবুও স্বীকার করবে না পরাজয়।
চামার সমাধান যেহেতু পাওয়া গেছে
আমাকে বেঁধে রাখার কি প্রয়োজন আছে?
আমাকে যেতে দিন বন্ধুর কাছে।
রাজা সমাধান দিয়েছে রাণী
কথা নয় চারটিখানি।
তারপরও তোকে ধরে আনার কারণ
তুই করবি হুকুম পালন
করবি সমাধানের বাস্তবায়ন।
সমাধান পেয়ে গেছি রাণীর কাছে
তার বাস্তবায়ন বাকি আছে।
রাজ্যের সমস্ত পশু করবি জবাই
চামড়াগুলোকে করবি সেলাই।
তারপর-
চামড়াগুলো বিছিয়ে দিবি মাটির উপর।
(তোষামুদির ভঙ্গিতে মন্ত্রীরা কথা বলে)
পণ্ডিত আপনার বুদ্ধির তুলনা হয় না মহারাজ
আরেকবার প্রমাণ করলেন আজ।
গবু চামারকে এখনই লাগিয়ে দেব কাজে
কাজ শেষ হবে, মহারাজ ঘুমুতে যাবার আগে।
যুবমন্ত্ মহারাজ, আমি তবে যাই
ঢোলক দিয়ে রাজ্যে খবর ছড়াই।
দৃশ্য- ১৭
[রাজ্যের পথে ঢোলক দল। যুবমন্ত্রীও আছে সাথে সাথে। ঢোলক বলে।]
ঢোলক শোনেন শোনেন রাজ্যবাসি
শোনেন দিয়া মন
এবারের মতো বেঁচে গেল
মন্ত্রীদের জীবন।
ধূলা আর লাগবে না ভাই
মহারাজার পায়
রাণী মাতা বের করেছেন
না লাগার উপায়।
মহারাজার পা বাঁচাতে
এখন যেটা হবে
চামড়া দিয়ে রাজ্যটাকে
মুড়ে দিতে হবে।
সারা-রাজ্যের যে যে ঘরে
পশু আছে যত
চামারের ব্যাটা করবে জবাই
রাজার আদেশ মতো।
দৃশ্য- ১৮
[রাজ্যসভা। যুবমন্ত্রীর প্রবেশ।]
যুবমন্ত্রী মহারাজ, শেষ সব আয়োজন
যার যার পশু নিয়ে হাজির জনগণ
চলুন-
করে আসি পশু বলির শুভ উদ্বোধন।
গবু পণ্ডিত মশায়
যুগান্তকারী এমন কাজের বেলায়
রাজার জন্য প্রয়োজন
অসামান্য এক ভাষণ।
হয়েছে কি রচনা
হলে হয়ে যাক তার খসড়া শোনা।
পণ্ডিত রাজামশাই
ভাষণের খসড়া শোনাই?
চামার রাজামশাই
দু-একটা কথা বলতে চাই।
যুবমন্ত্রী কোনো কথার নাই প্রয়োজন
করে যাবি শুধু নির্দেশ পালন।
রাজা আহঃ, দেখি না কী শোনায়
বলা তো যায় না, যদি কাজে লেগে যায়।
চামার রাজামশাই-
চামড়া বিছিয়ে দেব মাটির উপর
বাদ যাবে কি কোনো মাঠ-ঘাট-প্রান্তর?
(কথা ছিনিয়ে নেয়)
গবু না-
বিছিয়ে দিবি, যেখানে যেখানে মাটি আছে
রাজ্যের আনাচে কানাচে।
পথ-ঘাট ফসলের মাঠ
কিছুই যাবে না বাদ।
চামার চামড়া বিছিয়ে দিলে ফসলের মাঠে
তারপর কী ঘটে?
ফসলের আকাল হবে সারা রাজ্যে
জনগণ মারা যাবে দুর্ভিক্ষে
রাজা মন্ত্রী কেউ কি বাদ যাবে?
পণ্ডিত মহারাজার পায়ে যেন না লাগে ধূলা
তার সমাধান হবে পয়লা
তারপর দেখবো, ফসল হলো কী হলো না।
চামার মুণ্ডু কাটার আগে ভাবেন, কাটবেন কিনা
কাটার পর কিন্তু জোড়া লাগবে না।
রাজা চামার, বড় সত্য তোর ভাবনা
রাজ্য বাঁচবে ক্যামনে ফসল বিনা?
না না-
ফসলের মাঠ
এই কর্মসূচি থেকে বাদ।
চামার রাজামশাই
আরেকটা কথা বলতে চাই।
যুবমন্ত্রী চামারের কাছ থেকে দেখি বাঁচার উপায় নাই।
চামার নিয়মিত বৃষ্টি হলে
তবেই তো ফসল ফলে?
করতে ফলন
চাষাবাদ প্রয়োজন।
গবু চাষারা করবে সেই আয়োজন
মহারাজ, চামার শুধুই করছে সময় ক্ষেপন।
চামার না মহারাজ, এ নয় সময় ক্ষেপন
চাষা কাজ করে তার সাধ্য মতন
কিন্তু লাঙ্গল টানতে পশুর প্রয়োজন।
সেই পশুই যদি শেষ করি মেরে
জীবন চলবে কী করে?
তাই বলি-
এমন সমাধান বের করতে হবে
যেন সমাধানে সমস্যা না বাড়ে।
রাজা বলিস কী
সমস্যার সমাধানে সমস্যা বাড়ে নাকি?
চামার কেন নয়, রাজামশায়
উপরওয়ালারে ডাকেন যখন খরার সময়
তখন কী হয়?
আমরা বলি-
হে উপরওয়ালা, আমাদের বাঁচান
তিনি তখন তার কারিশমা দেখান
দুইদিন পর রাজ্যটাকে বন্যায় ভাসান।
খরা আর বন্যার একই তেলেসমাতি
দুটোতেই ফসলের ক্ষতি।
গবু বল আগে, রাজার পায়ের হবে কী গতি?
যুবমন্ত্রী রাজাকে কী করতে হবে?
ধূলা লাগিয়েই হাঁটতে হবে?
পণ্ডিত রাজামশাই
চামারের হাতেও সমাধান নাই
এর চেয়ে ভালো, করে ফেলি পশু জবাই।
চামার বলেছি তো রাজামশায়
সমাধান যেন সমস্যা না বাড়ায়
একটা বুদ্ধি আছে আমার মাথায়।
ধরুন-
বৃষ্টির পানি থেকে মাথা বাঁচাতে
সমস্ত আকাশ কি ঢেকে দেন তিরপল দিয়ে?
পণ্ডিত বলছে কী যা তা
এর জন্য তো আছেই, গোলাকার ছাতা
আর তোদের জন্য আছে কচুর পাতা।
চামার ঠিক তেমন একটা সমাধান বের করা যায়
পায়ের বেলায়।
মহারাজ, এতো আয়োজন
কী প্রয়োজন?
ধূলা লাগবে না পায়
এর সমাধান সহজেই করা যায়।
নির্দেশ দেন যেন পশুগুলি বাঁচে
আমার কাছেই যথেষ্ট চামড়া আছে।
(সবাই অবাক)
পণ্ডিত যথেষ্ট চামড়া আছে!
চামড়া কি ধরে, গাছে?
(চামার হাসতে হাসতে নিজের ব্যাগ থেকে এক টুকরা চামড়া বের করবে এবং মুচির সমস্ত জিনিস-পত্র বের করবে)
যুবমন্ত্রী চামার, আমার দিকে তাকা দেখি
এতটুকু চামড়া দিয়ে রাজ্য ঢাকবি নাকি!
চামার রাজ্য ঢাকার কর্মসূচি তো আগেই হয়েছে বাদ
সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে বলেন- সীতা কার বাপ!
[চামার মুচকি হেসে রাজার কাছে এসে পায়ের মাপ নেবে। ওদিকে ঢোলকের বাদ্য ও পশু জবাইয়ের নির্দেশ শোনা যাবে। ইতোমধ্যে জুতা বানিয়ে ফেলবে চামার। চামড়ার জুতা রাজার পায়ে পড়াবে।]
চামার এটাই তো উত্তম সমাধান
মশা মারতে খামাখা কামান দাগান।
যদি পা দুটো মুড়ে দেয়া যায়
ধূলা তো আর লাগে না পায়।
সারা রাজ্য ঢাকার কী প্রয়োজন
পা ঢাকার উপায় আছে যখন?
হাটুন মহারাজ, হাটুন নির্ভয়ে
ধূলা আর লাগবে না পায়ে
পা মুড়ে দিয়েছি চামড়া দিয়ে।
প্রয়োজন নাই আর পশু জবাই করার
এ আর্জি করে চামারের ব্যাটা চামার।
পণ্ডিত হায়রে ভগবান
এই সমাধানই তো মনে মনে ভাবলাম।
কিন্তু সেটা
জানলো ক্যামনে চামার ব্যাটা!
গবুমন্ত্রী কী কারবার
সমাধান দিতে গিয়ে রাজার
চামার চুরি করে বুদ্ধি আমার!
যুবমন্ত্রী মহারাজ-
আমিও চাচ্ছিলাম পা দু’টো মুড়ে দিতে
কিন্তু ভীত ছিলাম, পায়ের কাছে যেতে।
চামার রাজামশাই, পেয়েছেন এক মন্ত্রিপরিষদ
যতসব
আপদ।
বুদ্ধি চাইলে বুদ্ধি নাই
নিজের বলে দাবি করে অন্যের বুদ্ধিটাই।
[রাজা হাঁটতে থাকেন। সবাই তার পেছন পেছন ঘুরতে ঘুরতে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন।]
হাসান শাহরিয়ার : নাট্যজন, সম্পাদক- থিয়েটারওয়ালা