Full premium theme for CMS
শোক তবে সত্যিই শক্তি হয়
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
এবং আমাদের দেখার সুযোগ ঘটে যে, শোক তবে সত্যিই শক্তি হতে পারে।
শোককে শক্তিতে রূপান্তরের কথা প্রায়শই শোনা যায়, দেখা যায় না। দেখা যাওয়ার কারণও নেই, যার শোকে শক্তি নেব, তার শক্তি কৈ? এজন্যই তো শোক শোকই, সেখানে থাকে কেবল কান্না আর বেদনা। কিন্তু এবার বাংলার মানুষ দেখলো এক ভিন্ন চিত্র। শোকে কান্না থাকে, বেদনা থাকে কিন্তু তার সাথে শক্তিও যে থাকে- তা-ই দেখে নিল বাঙালি। প্রয়াণ যে এতটা গৌরবময় হয় তা কে ভেবেছে আর কে দেখেছে কবে! অনেকে বলছেন, হয়তো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়াই বলছেন, আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাগবেই-বা কেন, সৃজনশীল মানুষের কল্পনাশক্তি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে তো যেতেই পারে, তো তারা বলছেন- রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর এমন গৌরবময় বিদায় নাকি ঘটে নি কোনো বাঙালির জীবনে। সুরের মূর্চ্ছনায় আবিষ্ট করে বিদায় দিচ্ছে শবদেহ, স্বজনরা, কী অসাধারণ চিত্রকলা!
এই স্বজন কারা? এবং তখনই আরেক প্রশ্নে এসে যায়- কে না এই স্বজন? আমাদের ওয়াহিদ ভাই চলে গেছেন। চলে যাওয়ার আগে তিনি সবার কাছে গেছেন, তিনি জেনেছেন, কাছে আনতে কাছে যেতে হয়। কাছে সে-ই তো যাবে, যে নিজেকে ছোট ভাবে, অন্যের চেয়ে। এখন তো আর কেউ নিজেকে ছোট ভাবে না। পণ্য-বিশ্ব কখনো নিজেকে ছোট করে ভাবতে শেখায়-ও না। পণ্যের ধর্মই হলো নিজেকে বড় বলে জাহির করা। আমিই সেরা, অন্যদের থেকে, এই-তো পণ্যের পরিচয়। তো যদি কেউ সেরা হয় তখন তো সে বিচ্ছিন্ন-ও হয়, অন্যদের থেকে। আর এই বিচ্ছিন্নতার পোশাক পরে কে পারে কাকে কাছে টানতে? এবং যেহেতু কাছে টানে না, তাই কেউ তার কাছে আসেও না। আর এই না-আসার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে বিচ্ছিন্ন এক সমাজব্যবস্থা। এই সমাজব্যবস্থায় কোনো সমাজ নেই, নিঃশ্বাস নেয়া কিছু মানুষ আছে কেবল। গিজগিজ করছে কিন্তু তেল-জলের মতো, মিশ খায় না। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে থোকে থোকে সাজানো পণ্যের মতোই- অনেক আছে কিন্তু সবাই আলাদা। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে এক রাজপুত্র কী করে পারলো এতো মানুষের স্বজন হতে? বিস্ময় তো বটেই! আমাদের কাছে তো আরো বিস্ময়কর, কেননা আমরা তো প্র্যাক্টিকেল মানুষজন। শুনেছি, অনেকের মুখে, ওয়াহিদ ভাই ছিলেন ইমপ্র্যাক্টিকেল, সব ব্যাপারেই। এই ইমপ্র্যাক্টিকেল যারা বলছি- তারা তো যদ্দুর দেখি-জানি, তদ্দুরই বলবো- এ্যাবসার্ড নাটকের মতো। নাটক বুঝি না, তাই নাম দিয়েছি এ্যাবসার্ড নাটক। যদি এ্যাবসার্ডই হয় তাহলে নাট্যকার লিখলেন কী করে! কোনো মানুষ কি ইমপ্র্যাক্টিকেল হয়, নিজের কাছে? হয় না। যা সম্ভব না, বাস্তবে, সে কাজ কেউ কখনো হাতে নেয় না। যিনি নেন তিনি জানেন একাজ সম্ভব, ব্যর্থ হতে পারেন, সেটা তো পরের ধাপ। সার্কাসে সরু দড়িতে শিল্পী যখন অবলীলায় হাঁটাহাঁটি করেন, দর্শক তখন চোখ বুজে থাকেন, ভয়ে, যদি পড়ে যায়! যে পড়বে তার ভয় নেই, ভয় হলো যে বসে আছে, শক্ত গ্যালারীতে। একজন মানুষ আমার চেয়ে কত বড় হতে পারেন, তা কী করে আন্দাজ করবো, যে সারাক্ষণ কেবলি নিজেকে নিয়ে আছি ব্যস্ত?
থিয়েটারের একটা রূপ হলো, সে দলবদ্ধভাবে কাজ করে। এই সময়ে যতই বলা হোক না কেন, থিয়েটারে পেট চলে না, কিন্তু এই দলবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিলে হবে না। এই দলবদ্ধ হওয়া মানে কেবল একটা দলের ১০-২০ জন এক হওয়া না। এই শিল্প মানুষকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে বাঁচায়। সে গোপনে, একা, কিছু করতে পারে না। তাকে আসতে হয় জীবন্ত হয়ে, জীবন্ত মানুষের সামনে। এই যুথবদ্ধতার অভাবই এখন মহাসংকট। ওয়াহিদ ভাই সব সময়ই সবাইকে মেলাতে চেয়েছেন, এক সাথে। তারপরও, অনেকেরই ধারণা, ঠিক তেমনভাবে থিয়েটার তাঁর করা হয় নি। যারা বলেন তারা জানেন না, সারাজীবন তিনি কেবল থিয়েটারই করে গেছেন। আমরা বুঝি নি, বোঝা সম্ভবও না, প্র্যাক্টিকেল মানুষজন কি ‘ইমপ্র্যাক্টিকেল’ মানুষের কাজ বুঝবো?
থিয়েটারওয়ালাদের রিয়েক্ট করতে জানতে হয়। যে রিয়েক্ট করে না, সে জীবিত না, মৃত। থিয়েটার কেবলি জীবিত মানুষদের। ওয়াহিদ ভাই রিয়েক্ট করতেন। সেটা বোঝা যেত, লেখায়, বলায় আর আচরণে তো বটেই। উনি চাইতেনও সবাই যেন রিয়েক্ট করি- যা চলছে, যেভাবে চলছে, সেভাবে যেন না চলে। আমরা, থিয়েটারওয়ালারা, রিয়েক্ট করা ভুলে গেছি। স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ-স্বৈরাচার জাতীয় কিছু বুলি আউড়িয়ে বাজার মাত করতে চাচ্ছি। কিন্তু সেগুলো ধোপে টিকছে না। মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি অসহায় ছিল, গত ক’মাস আগেও, তখনও আমরা রিয়েক্ট করি নি। যখন সংবিধান রক্ষা করা হচ্ছিল, অসাংবিধানিকভাবে, আমরা রিয়েক্ট করি নি। শুনছি, বলছে- নির্বাচন ছাড়া গতি নেই, নির্বাচন হতেই হবে।- কিন্তু কীভাবে হবে নির্বাচন, ভোটার কই? আমরা কিন্তু রিয়েক্ট করি নি। করা সম্ভবও না। আমরা ধরে নিয়েছি, কেন সম্ভব না ভোটার ছাড়া নির্বাচন, যদি দর্শক ছাড়া থিয়েটার হয়? দর্শক থেকে আমরা যখন বিচ্ছিন্ন হয়েছি, তখন থেকেই আমাদেরকে রাজনীতিবিদদের মতোই দেখাচ্ছে, আমরা বুঝতে পারছি না, কিন্তু দর্শক বুঝতে পারছে। আমাদের রিয়েক্ট না করার আরেকটা কারণও আছে। রিয়েক্ট করতে গেলে দূরদর্শীও হতে হয়। সেই দূরদর্শিতা আমাদের নেই। এখনও সুদখোর মহাজনেরা দখল নিতে চায় রাষ্ট্রের। মানুষের অধিকার যখন ঋণমুক্ত জীবন যাপন করা, সেখানে ঋণ-গ্রস্থ করেই শান্তি আনার চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে সবাই কিছু না কিছু বলছে, আমরা বলছি না। বলা সম্ভবও না। রাষ্ট্র-অর্থনীতি-মানুষ এ-সব কিছুই তো আমাদের বিচার বিবেচনার বাইরে। তাহলে আর রিয়েক্ট করবো কীভাবে? আমরা ঘটে যাওয়া দৃশ্যের দৃশ্যায়ন করি, কিছু ঘটাই না। এটাকে থিয়েটার বলে না।
ওয়াহিদ ভাই আরেকটা কাজ করেছেন, সবার অলক্ষ্যেই। আমরা জানি, অন্তত জানার কথা তো বটেই, অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো সম্পদের সুসম বন্টন। আধুনিক মন দিয়ে বুঝতে হবে এই সম্পদ কেবল ভাত-কাপড় না, মেধাও বটে। ওয়াহিদ ভাই বুঝেছিলেন, পণ্ডিত হয়ে ঘরে বসে থেকে লাভ নেই, যেমন লাভ নেই অর্থ-সম্পদ কোনো ব্যক্তি বিশেষের কুক্ষিগত হলে। অর্থের অসম বন্টন যেমন অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের মূল কারণ, তেমনি জানাশোনার অসম বন্টনও সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের মূল কারণ। জাতিকে সংস্কৃতিমনষ্ক করতে গেলে সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে হয়, সবখানে, সবার কাছে। ওয়াহিদ ভাইয়ের পাণ্ডিত্যের কথা শুনেছি, ঈর্ষণীয়! কিন্তু তিনি পণ্ডিত হয়ে ঘরে বসে থাকেন নি। সেটা বন্টন করতে চেয়েছেন সবার কাছে। ছুটে গেছেন গ্রামে গ্রামান্তরে। শুনেছি, সেই ১৯৬১ সাল থেকেই শুরু করেছেন তাঁর এই নিরন্তর বিলি-বন্টন। শুদ্ধ মানুষ গড়তে গেলে, অ-শুদ্ধদের কাছে যেতে হয়, অ-শুদ্ধরা তো কাছে আসবে না। আগুন নিজের প্রাণে থাকলে চলে না, আগুন ছড়িয়ে দিতে হয় সবখানে, সবখানে। ওয়াহিদ ভাই আগুনকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবখানে, তাই-তো তাঁর চলে যাওয়ার পর কেউ মুষড়ে পড়ে নি। মুষড়ে পড়া মানুষের ভেতর কি সুর আসে?
এই যে ছড়িয়ে দিতে হয়, এবং ছড়িয়ে দিতে গেলে নিজেকে নিঃস্বও হতে হয়, এবং এই নিঃস্ব হওয়া মানে আবার প্রকারান্তরে নিজেকে ঋদ্ধ করা- এতো কিছু বোঝার ক্ষমতা কি থিয়েটারওয়ালাদের আছে? ছায়ানট ভবনে যখন সবাই যায়, এবং গিয়ে দেখে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে, যার কিনা নিজের কোনো ঘর ছিল না, কিন্তু তৈরি করে গেছে সবার জন্য ঘর- ছায়ানট ভবন, এবং আমরা যারা যাচ্ছি তাদের সবারই আছে নিজস্ব ঘর কিন্তু সবার জন্য নেই কোনো ঘর- কোনো মঞ্চ- তখন কোন বলে বলিয়ান হয়ে আমরা বলতে পারি- ওয়াহিদ ভাই আমরা আপনার অনুসারী। সারাজীবন যারা ভাবলাম নিজেদের জন্য কেবল, সবাইকে বাদ দিয়ে, তারাই কিনা এসেছি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁকে, যিনি নিজের জন্য ভাবেন নি কোনোদিনই, সবাইকে ছাড়া?
কিন্তু সবাই কি ভেবেছি কেবল নিজেদের জন্য, আর সবাইকে বাদ দিয়ে? এ-ও এক অদূরদর্শিতা যে, সবাইকে নিজের মতো করে ভাবা। এই চোখ দেখে তো কেবল অতটুকুই যা সামনে থেকে দেখা যায়। কিন্তু ওয়াহিদ ভাই যাদের কাছে গেছেন, থেকেছেন সারাজীবন যাদের সাথে, তাদের খবর কতটুকুই-বা জানি বা জানলেও বোঝবার ক্ষমতাই-বা আছে কতটুকু যে তাদের নিয়ে কথা বলি? ‘ইমপ্র্যাক্টিকেল’ ওয়াহিদ ভাই কত শত-সহস্র ‘ইমপ্র্যাক্টিকেল’ মানুষ তৈরি করে গেছেন গ্রাম-গঞ্জে তার খবর জানা কি সম্ভব এই ঢাকায় বসে, উদ্বস্তু হয়ে, আগাগোড়া প্র্যাক্টিকেল মানুষ হয়ে?
তিনি জেনেছেন, কাছে আনতে কাছে যেতে হয়। কাছে সে-ই তো যাবে, যে নিজেকে ছোট ভাবে, অন্যের চেয়ে। এখন তো আর কেউ নিজেকে ছোট ভাবে না। পণ্য-বিশ্ব কখনো নিজেকে ছোট করে ভাবতে শেখায়-ও না। পণ্যের ধর্মই হলো নিজেকে বড় বলে জাহির করা। আমিই সেরা, অন্যদের থেকে, এই-তো পণ্যের পরিচয়।
থিয়েটার করতে হলে, মানুষের কাছে যেতে হয়, কারণ, মানুষ নিয়েই তো থিয়েটারওয়ালাদের কারবার। আর এই মানুষ ঢাকায় বসে পাওয়া যাবে না। ঢাকায় মানুষ আসে, ‘আসা’ মানুষদের সহজেই চেনা যায়, কারণ তারা আমাদের মতোই ‘আসা’ মানুষ। মানুষ চিনতে হলে মানুষের কাছে যেতে হয়। সেই মানুষজন ঢাকায় নেই। ওয়াহিদ ভাই সেই মানুষগুলোর কাছে গেছেন সারাজীবন। তাঁর চলে যাওয়া শোক নাকি শক্তি তা বুঝতে হলেও আমাদের যেতে হবে সেই মানুষগুলোর কাছেই, যারা সম্ভবত ‘ইমপ্র্যাক্টিকেল’। আমাদের এই সবচেয়ে সংকটকালীন সময়ে সংকটকে বুঝতে হলে থিয়েটারওয়ালাদের আর ‘প্র্যাক্টিকেল’ হলে চলবে না। ওয়াহিদ ভাই যে ‘ইমপ্র্যাক্টিকেল’ মানুষ তৈরি করে গেছেন দেশের আনাচে-কানাচে, সেখানে গিয়ে, সেখান থেকে শক্তি আনতে হবে। সেই শক্তি দিয়ে থিয়েটার করতে হবে। শাদা চোখ নিয়ে আর থিয়েটার চলবে না। থিয়েটারওয়ালাদেরও হতে হবে ‘ইমপ্র্যাক্টিকেল’।
ইতি
হাসান শাহরিয়ার
সোবহানবাগ, ঢাকা
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭