Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সালতামামি ২০০৬ : মঞ্চনাটক আজিও সম্ভবে

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

মরিয়াও মরে না রাম । । আশা বাঁচে খাণ্ডবেরও পরে?- ধন্য আশা কুহকিনী!

এ-বছরও অনেকগুলো নতুন নাটক মঞ্চস্থ হলো। কয়েকটি তার ভালো নাটক। দর্শক ভিড় করেই দেখেছে। বাজার-মিডিয়ার সর্বগ্রাসী ছেনালি সম্পূর্ণ ছিবড়ে করতে পারে নি তাহলে তাদের। বেশিরভাগ দর্শক নবীন-নবীনা, দুর্দম যৌবন অটুট সত্তায়। নাটক আজও যারা করছে, দেখছে- তাদের তাই হাজার সালাম। একালের বীর তারা বীর্যবন্ত। বাঁচাবে তারাই তবে তাণ্ডবকালে মানবের প্রাণভোমরা- সত্তাস্বরূপ, জিয়নকাঠি। অমৃত বলহীনের লভ্য তো নয়।

তবে কথা হলো নাটকগুলোয় সেই রশদ মিলছে তো? কতটা মিলছে তারই হিসাব-নিকাশ সেহেতু করতে হবে।- ‘মানের দায় মাথায় রেখো/ জীবনে চাও প্রাণ’-

অলীকবাবু
রচনা : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
নির্দেশনা : ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রযোজনা : নাট্যজন

নাট্যজন প্রযোজনা অলীকবাবু, রচনা- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, নির্দেশনা ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। শতাধিক বছর আগের লেখা নাটক। হঠাৎ-নবাব অলীকবাবুদের নিয়ে রঙ্গনাট্য। আজকের দিনের ফেরেব্বাজির আদি পূর্বসূরী তারা। প্রযোজনায়, অভিনয়ে সেই কালই রূপায়িত। বাস্তবানুগ দৃশ্যসজ্জা উত্তম গুহের। সৌখিন বাবুয়ানার নকল বিলাসিতা গৃহস্থাপত্যে, আসবাবপত্রে। রঙে, সজ্জায়, বিন্যাসে জমকালো। পোশাক-আশাক কালানুকারী, শহুরে। চলন-বলন সেই মতো বাস্তবানুগ- ততটা সঙসুলভ নয়- ভদ্রলোকী ঐতিহ্য ধারক। তাতে অলীকবাবুর ফুটানির অলীকত্ব রঙ্গ-তামাশায় তীক্ষ্ণ হতে যেন চায় না। এতে নির্দেশকের একধরনের কাব্যিক পক্ষপাত বুঝি স্পষ্ট হয়। নাট্যকারের সেমতো অভীষ্ট ছিল কি? বরং একালীন ফ্যাশন দুরস্ত ঠাটবাট যুক্ত করা গেলে আরও লাগসই চৌকস হতে পারতো বুঝি। সেকাল একাল অন্বিত হলে নাট্য জমতো ভালো। নিজেদের অলীক যত চতুরালি তাহলে বাক্সময় হতো। আপনাপন চেহারাসুরত বেশ দেখতে পেতাম। একশ বছর আগেকার কলকাত্তাই কল্পিত বাবুয়ানার আড়ষ্টতা কাটতো। বোঝা যায় নির্দেশক কালানুগত্যের পক্ষপাতী। বাচনের সুর-ছন্দের স্পষ্টতায় মন দিয়েছেন বেশি, কমেডির এক মজা আনতে চেয়েছেন। রঙ্গতামাশার কমিক স্যাটেয়ার নয়। একালকে সরিয়ে রেখেছেন। সেটা কি সঙ্গত হয়েছে? চালচলনের বিশুদ্ধ কমেডিয়ানায় মজে কালের কিম্ভূত অলীকত্ব গরহাজির। সৌখিন হাস্যরস তাতে কেবল মিলেছে। একালীন প্রাসঙ্গিকতা কোনো পথ পায় নি ঢুকবার। নিজেদের আড়াল করা মুখোশে জমানো আখ্যানে বেশ মজা করা গেছে। মিডিয়া যা করে চলেছে অ্যাডনাট্যরঙ্গে মজিয়ে, হাসিয়ে, জমিয়ে। মঞ্চের কাছে সেই একই সৌখিন বিলাস কাম্য কি? নির্দেশক হয়তো নির্দোষভাবেই তা করেছেন। নির্মল আনন্দ দিতে চেয়েছেন দর্শককে। কমেডির হাস্যরস নিশ্চয় স্বাস্থ্যপ্রদ, জীবনে যার দেখা আর পাই না। মঞ্চে আজ তারও যে বড় অভাব। ঢাকাই মলিয়েরি স্থূল ভাঁড়ামির প্রতিষেধক হিসেবে এটা কাম্য নিশ্চয়। মিডিয়ার হুমায়ূনী রঙ্গলীলার ভং-তামাশার বদলে। এর নিশ্চয় মানে আছে। তবে আমরা একটু বেশি কিছু, অন্য কিছু চাই যদি- কেবল হাস্যরসই নয়- তার মধ্যেই ব্যঙ্গখর তূূণও যদি পাওয়া যেতো। নাট্যকার হয়তো তা ততো চান নি- তাতে কি? আজকের নির্দেশক তো চাইতে পারতেন। - তবে যা পাওয়া গেছে তা-ও কম নয়। আখ্যানের এক মজা অভিনয়ে ধরে রাখা কম কথা নয়। কথার রসিকতায় বলা, করা মঞ্চে কম কথা নয়। নটনটী দক্ষতার সঙ্গেই তা করেছেন। অলীকবাবু, তার পিতা, পরিচারক, পরিচারিকা, তরুণীটি বেশ ভালোভাবে সব করেছেন- স্পষ্ট সুর-বাচনে। তবে উনিশ শতকীয় সুরের পরিমণ্ডলটি আরও জমতে পারতো না কি- টপ্পা, ঠুংরী, বৈঠকী, আখড়াইয়ের ব্যবহরে- নির্দেশক যখন যথেষ্টই সঙ্গীতরসিক? তবু সব মিলে দর্শক নির্মল নাট্যরসে অমলিন শ্বাস নিতে পেরেছে। এই সামূহিক দূষণকালে তার মূল্য কত যে কে না জানে, মানে তা। দর্শক বড়ই হৃষ্টচিত্তে আহলাদিত আপ্লুত হয়ে এই নাটক দেখছে ভিড় করে। দিল্লি কলকাতাও শুনেছি কম খুশি হয় নি। ‘নাট্যজন’ আর ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়কে সালাম।

রূপবতী
রচনা : নাসরীন জাহান
নির্দেশনা : খালেদ খান
প্রযোজনা : সুবচন নাট্য সংসদ

‘সুবচন নাট্য সংসদ’ প্রযোজনা রূপবতী। নাট্যকার- নাসরীন জাহান, নির্দেশক- খালেদ খান। নিয়মিত একের পর এক নাটক করছে ‘সুবচন’। গত বছরে করে তারা ক্ষুধিত পাষাণ-রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে- নির্দেশক একই নাট্যজন। বছর কয়েক ধরে বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসে একধরনের যাদুবাস্তব আখ্যান-আরোপণ দেখছি আমরা। স্বদেশীয় গল্প-কথনে যদিও তার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। নাগরিক বুননে তা অবশ্য খানিকটা আড়ষ্ট, বিদেশি ঠেকে। যাক সে কথা। রূপবতী তেমনি এক লোককথা-সদৃশ বিন্যাসে গ্রথিত আখ্যান- বিষয় যদিও নব-উদ্ভাবিত- কোনোরকম লোকস্মৃতি-শ্রুতির শিকড় তাতে নেই। গল্পকার- নাট্যকারের নবীন কল্পসৃজন বরং। নাট্যকারের ভাষ্যমতে : রূপবতী-র মূল কাহিনী- তিনশ বছর পর কবর থেকে উঠে একজন মানুষ তার স্ত্রী রূপবতীকে খুঁজতে খুঁজতে এক সময় নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। আসলে আমার মধ্যে কাজ করছিল যাদুবাস্তবতার ফর্মে মানুষের জীবনদর্শনের ক্ষুধা, আপোষ মানুষকে কোন অন্ধকার চেতনালোকে নিয়ে তাকে আত্মান্বেষণের সামনে দাঁড় করাতে পারে সেই বিপন্নতার চিত্র তুলে ধরতে।’ আর নির্দেশকের এষণা হলো- ‘এ শুধু নিছক গল্প বলে যাওয়া নয় বরং দূর অতীতের বাস্তবতার সঙ্গে এ সময়ের বাস্তবতার সমান্তরাল খোঁজার চেষ্টা। নাট্যে আমরা প্রয়োগ ঘটাই কুহুকী বাস্তবতা, প্রেম, দারিদ্রের কষাঘাতে নিরন্তর নিমজ্জমান প্রেমানুভূতি, ধনাঢ্য বৃদ্ধের রতির উৎকাঙ্খা ধর্মব্যবসা: আর এসবই একজন মানুষের অন্তর্যাত্রার ছবি- অন্তিমে দলিত মথিত অন্তর্গত সত্তার সাক্ষাৎ এবং সত্যদর্শন।’ - রূপায়ণে তাই দেখি এক বর্ণনাত্মক ভঙ্গি। মঞ্চের বাঁদিকে গায়েনবাদক দল। কবর ফুঁড়ে উঠে আসে বৃদ্ধ এক বংশীবাদক আলখাল্লায় মোড়া অবয়ব নিয়ে। তিনশ বছর আগে তার স্ত্রী রূপবতীর হত্যাকারী খুঁজতে গিয়ে কাহিনী বর্ণনা করতে থাকে আর তার দৃশ্যরূপায়ণ হয়ে চলে- গানের দল আখ্যানের নানা পরিস্থিতিতে চরিত্রের অন্তর্গত আবেগ-বেদনা বয়ান করে। নির্দেশক নির্মাণে চমকপ্রদ লোকফর্ম ব্যবহারের কথা বলেন। তবে তা কেবল আখ্যানবর্ণনের, লোকসুর ও চরিত্র সংলাপের সূত্রে দেখি। অথচ দৃশ্যায়নরীতিতে শারীরিক অভিনয়, কম্পোজিশন, নানা নৃত্য-কোরিওগ্রাফির সঙ্গে বিচিত্র প্রপস ব্যবহার বহিরাগত নাট্য-ইডিয়মে সম্পন্ন হয়। বিশেষত দীর্ঘ রঙিন বস্ত্রখণ্ডের ব্যবহার ঢাকার মঞ্চে দৃশ্যায়নের একটি বহু প্রচলিত মুদ্রা হয়ে উঠেছে বিষাদসিন্ধু থেকেই। ঢাকা থিয়েটারের বর্ণনাত্মক নাট্যাবলীতেও তার বহুল ব্যবহার। এ নাট্যে অভিনয়ের শারীরিকতায়ও পরিচিত চেনা ভঙ্গি লাগে।- এই আখ্যাণবর্ণনা ও বাচনের কাব্যিকতার সঙ্গে তা অবশ্য যথাপ্রযুক্ত হয়ে ওঠে। বিশেষত রূপবতীর অভিনয়ের শারীর-বাচন আন্তরিক দৃশ্যকাব্য রচনা করে নবীন অভিনেত্রীর আবেগ-সততায়। সংলাপের কাব্য-ছন্দ তাতে সহায়ক হয়ে ওঠে। যেটা আবার অন্য চরিত্রের বাচনে তত মেলে না। বিশেষ করে বংশীবাদকের স্বর-সুর-ধ্বনি চরিত্রের অন্তঃস্থ বাচনোপযোগী লাগে না। শরীরও ঠিক বলে না- যদিও তার আন্তরিকতা টের পাওয়া যায়। কথার অতিরেক কাব্যিকতা আখ্যানের নাট্যক্রিয়ায় বাধাও দেয়, কথার অনর্গল খেলা চলতে থাকে উপমা রূপকের আতিশয্যে- সঙ্গে দৃশ্যক্রিয়াদি। শ্রুতির নিজস্ব ন্যায়ের সীমাবদ্ধতা তাতে আহত হয় প্রায়ই, যেমন কিনা বিশিষ্ট ধারাপ্রবর্তক সেলিম আল দীনের নানা নাটকেও হয়ে থাকে। নাট্যকার কথাসাহিত্যিক বলেও হয়তো এই বিপত্তি ঘটে। লেখন-পঠনরীতির সঙ্গে শ্রুতিবাচন নীতির নিশ্চয় অঙ্গাঙ্গী ভিন্নতা আছে। বিশেষত দৃশ্যায়ন যেখানে বহু উপাদানে অধিক প্রকটভাবে সচলমান, বাক্সময়। নাগরিক মঞ্চে দৃশ্য-শ্রাব্যের এই অসমঞ্জস মিশ্রণ দর্শকের দীর্ঘ শ্রুতিনির্ভর সংস্কৃতিতে একাট বিরোধাভাস তৈরি করে, ভারসাম্যে অন্বিত হয়ে ওঠে না প্রায়শ। দেশি-বিদেশি মেলবন্ধনের যোগসূত্রে একটা পরিণত সাচ্ছন্দ্য এখনও অনর্জিত মনে হয়। দর্শকের সঙ্গে পারস্পরিক সম্বন্ধপাত, লেনদেন ও বোঝাবুঝির একটা অভাব চোখে-কানে লাগে। এই নাটকে নির্দেশক যদিও বলেছেন- ‘ফর্ম দিয়ে গল্প বলি নি, গল্পের প্রয়োজনে ফর্ম এসেছে।’

এ-নাট্যে যাদুকর যত অনুপুঙ্খে সত্যসত্যই যাদু দেখাতে থাকেন, তাতে আলাদা মজা তৈরি হয়, নাটক থেকে যদিও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মন; অথচ নির্দেশক তো নিছক গল্প বলতে চান নি- অতীতের বাস্তবতার সঙ্গে এ সময়ের বাস্তবতার সমান্তরাল খুঁজতে চেয়েছেন- সেই অভীপসা আরও ব্যহত হয়। এই যাদুকরতো নিছক কোনো যাদুকর নন, আজকের বাস্তবতায় জুয়েল আইচ নন। তিনি যে কী তার কোনো ইশারা তার চলন-বলন-মুদ্রায় খেই মেলে না। তিনি নিশ্চয় আজকের বাজার-মিডিয়ার পরাক্রান্ত আগ্রাসী সম্মোহক, যাদুকর। জমিদারের ‘প্রেমজ দৃষ্টি’ আবারও যাদুকরের একই যাদুকৌশলকৃত্যের পুনরাবৃত্তিতে নাট্যক্রিয়া একঘেয়েমীতে পর্যবসিত করে। ফাঁসের ফাঁদের অক্টোপাস তাতে আরো তীব্র প্রবল হয়ে ওঠে না। রূপবতীর একালে দুর্লভ নাটুকে, প্রায় অবাস্তব প্রেমনিষ্ঠা চারপাশের রাক্ষুসী হা-মুখ লোলুপ দৃশ্য-অদৃশ্য বহুরূপী হাতছানির আজকের বাস্তবতা নানা নাট্যক্রিয়ায় রূপায়ণের বদলে যাদুবিভ্রমের অনুপুঙ্খতায় অবাস্তব কল্প-কাহিনী হয়ে ওঠে।- যাদুবাস্তবে বাস্তবিকতার শক্ত পাটাতনটির ইঙ্গিতও কোথাও পাওয়া যায় না। এছাড়া নাট্যের কিছু তীব্র আততিময় পরিস্থিতি, দৃশ্যান্তরের মধ্যবর্তী ছেদকালের বিলম্বহেতু কিংবা কখনও চরিত্রাবলীর প্রবেশ-প্রস্থানের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় স্পেস ও দিক-কোণের ব্যবহার বিন্যাসে গতিক্রিয়া আলগা করে দেয়। নির্দেশকের সজাগ দৃষ্টিতে এই ব্যত্যয় কী করে ঘটে বুঝতে পারি না। দৃশ্যায়নের কোরিওগ্রাফিও কোথাও কোথাও অগোছালো, অর্থহীন বাহুল্য লাগে-  নাট্যভাষা ঠিক হয়ে ওঠে না- আলগা ফর্ম হয়ে থাকে।

তবে খালেদ খান একদা বর্ণনাত্মকরীতি বা মঞ্চে অধিক শারীরক্রিয়ার সমালোচনা করলেও এই নাট্যে তিনি প্রায় নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে রূপায়ণ করেন সমর্থ এক দৃশ্যকাব্য- সমালোচনা যতই তার করা হোক না কেন। রচনার কাব্যিক বাহুল্য দৃশ্যরূপায়ণের চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ ও পালন করেন তার দীর্ঘকালের নাট্যভাবনা ও প্রয়োগের পরিণত মুন্সিয়ানায়। পুতুলখেলা বাদ দিলে এটাই বুঝি তার শ্রেষ্ঠ নাট্যরূপায়ণ। তারই ফলে দর্শক ভিড় করে দেখছে এ নাটক। কেবল কারিগরী নৈপুণ্যের কারণেই নিশ্চয় নয়। ধীমান এই নট নির্দেশক হিসেবে নাটকের চরিত্রায়ণেও সৃজন-মাহাত্ম্য দেখিয়েছেন। রূপবতীর অভিনয় তার সেরা স্বাক্ষর- যাদুকর ও জমিদারও চরিত্রাভিনয়ের উজ্জ্বল নির্মাণ। সব মিলে এবছরের সেরা এক কাজ রূপবতী।

কিনু কাহারের থেটার
রচনা : মনোজ মিত্র
নির্দেশনা : কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন
প্রযোজনা : প্রাচ্যনাট স্কুল রিপার্টরি

প্রাচ্যনাট স্কুল রিপার্টরির ১ম প্রযোজনা কিনু কাহারের থেটার। রচনা- মনোজ মিত্র, নির্দেশনা- কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। আখ্যান সঙ-আলকাপ ধরনের গ্রামীণ নাট্যরীতির থেটার দল নিয়ে। জমাটি রঙ্গ তামাশায় ক্ষমতাকাঠামোর চিরকালীন ন্যায়নীতিরহিত নৃশংস স্বরূপ খুলে ফেলে। তাতে অনেকগুলো স্তরের গতায়ত চলে দক্ষ বুননে। থেটার দল, তার ক্ষমতা কাঠামো, মহড়া ও অভিনয়স্থলের সমাজকাঠামো- পরস্পর বিন্যাসে জননাট্যের জমজমাট আদল তৈরি হয়। মঞ্চে শেষভাগের মধ্যখানে একটি মাত্র পট টাঙ্গানো- হয়তো কবেকার সংস্কৃত নাট্যরীতির তুখোড় ব্যবহার সাধারণ গরীব মানুষের সৃজন সামর্থ্যে। কুশীলবগণ গানবাজনা করতে করতে মিলনায়তন ঘুরে মঞ্চের দুপাশে বসে যায়- থেটার হবে এই উঠানে- জানা যায় সূত্রধারের কথায়। বেশ একটা রগড় হবে এমন সাজ সাজ রব ওঠে- মহড়া শুরু হয়।- সব মিলে গ্রামীণ পরিবেশ। মঞ্চে এটা হওয়া কিন্তু সহজ নয়। আজকের ফ্যাশনবাজ নাগরিকজনের পক্ষে। কমবয়সী, নবাগত অভিনেতৃ বলে হয়তো এখনও অনেকটাই সহজ অনারষ্ট হতে পেরেছে- কর্মশালা আর নির্দেশকের সততায়।- ঘটনাঘটন জমপেশ মজাদার।

পুতনা রাজ্যের উজির এক নারীর শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে। লাট সাহেব বলেন- এর যদি বিচার না হয়, তাহলে আমি সিংহাসন ফালাইয়া দিমু। রাজা পড়ে মহা বিপদে, তার যত অপকর্মের দোসর উজিরেরে কী করে চৌদ্দ ঘা চাবুক মারে।- খুঁজতে বলে এমন একজনকে যে নিজে এসে দোষ স্বীকার করবে। চার থলি টাকা নিয়ে ঘন্টকর্ণের বৌ জগদম্বা উজিরের হাতে তুলে দেয় স্বামীকে। তারপর তার বাড়ি লাইন দেয় যত চোর-ডাকাত-দাগী আসামীর দল থলি থলি টাকা নিয়ে। অপরাধ করে তারা আর সাজা ভোগ করে ‘সাজা খেগো অফিসার’ ঘন্টকর্ণ। ভালোই চলে দেশ। হঠাৎ একদিন রাজা ফেঁসে যায় ছাগল খুনের দায়ে। লাট সাহেবের বুদ্ধির প্যাঁচে রাজার হল ফাঁসির আদেশ। রাজা ভাবে ভয় কী- ‘নে রে বাবা ঘন্টকর্ণ, উঠে পর ফাঁসিকাষ্ঠে।’- এর মধ্যে নানা সময় বারে বারে চরিত্র-অভিনেতৃ ঢুকে পড়ে পরস্পরে- জমে ওঠে তীক্ষ্ম সব রাজনৈতিক খুনসুটি। রাজা-উজির-লাটবেলাট আর লোককথার ঘন্টকর্ণ জগদম্বা- সব মিলে দেশি বাংলা রীতির এক উপস্থাপন, তার সঙ্গে মেলানো হয় ঘটমান বর্তমানও। এহেন রূপায়ণ সহজকর্ম নয় আজ। এক সময়, আশি দশক পর্যন্ত এরকম নানা রঙ্গব্যঙ্গের রাজনৈতিক নাট্য হতো। ব্রেশটের প্ররোচনায়। আজ সেসব গল্পকথা। আজিকালি নান্দনিক কত সৃজন লম্ফে উল্লম্ফে থিয়েটার ইডিয়মের বিচিত্র বিস্তার স্ফূর্তি। রাজনীতি-টিতির দিন গুজার গিয়া- বড়জোর পথনাটকে হলেও হতে পারে- মঞ্চে ওসব স্থূল পশ্চাদপদতা আর নয়। ওসব দিন অনেক আগে পেরিয়ে এসেছি আজ মুক্তবাজারী একুশ শতকে।- মাঝে মধ্যে তাই বুঝি অনভ্যস্ত সৌখিন দর্শক কিছু বেরিয়েও গেছে দেখেছি। নাট্য বড়ই নিরাভরণ, একটি দুটি প্রপস ব্যবহৃত- এই আখানে রূপায়ণে যা মানানসই। বাচন কিছু আরোপিত লাগে- দ্রুততর স্মার্টনেস দর্শকের অভ্যস্ত শ্রুতির সঙ্গে মিলতে সমস্যা করে। বিষয়-ভাষারীতি একে দর্শকের অচেনা, তাতে আরো বিপত্তি ঘটে। তবে শারীরভঙ্গির সহজ গ্রামীণ স্বাচ্ছন্দ্য লাগসই হয়েছে। নবীন অভিনেতৃদল নাগরিকমঞ্চে যতটা অনায়াস স্ফূর্তি এনেছে সেটা তারিফযোগ্য। শুরুর গান থেকে একটা প্রত্যাশা জাগে- মাঝেমধ্যে আরও গান যদি হতো তবে মনে হয় আরো জমতো।- তবু সব মিলে প্রাচ্যনাট আর তার নবীন নির্দেশককে সালাম জানাই।

লোকনায়ক
রচনা ও নির্দেশনা : অনন্ত হিরা
প্রযোজনা : প্রাঙ্গণে মোর

‘প্রাঙ্গণে মোর’ নবীন দল।- বছর কয়েকের। নিয়মিত নাটক করছে তারা একের পর এক। লোকনায়ক নবরূপায়ণ তাদের। চারণ কবি মুকুন্দ দাসকে নিয়ে এ নাট্যের রচনা ও নির্দেশনা অনন্ত হিরার। এই এতদিনে তবু হলো জনকবিবরকে নিয়ে নাটক। বিগত গণযুগে যেটা অধিক সঙ্গত, প্রাসঙ্গিক ছিল। তখন তো মজে ছিলাম ব্রেশট নিয়ে- দেশি নায়কদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে। তাই বুঝি সেই ছদ্ম মেকি গণজোশ দুদিনেই এমন বাসি হলো। ‘প্রাঙ্গণে মোর’ অনেক আয়োজন করে, কর্মশালা-সেমিনার করে এ নাট্যের রূপায়ণ সম্ভব করে তুললো।-

শুরুতেই নানা দেশি বাদ্যযন্ত্রে কনসার্ট বাজে- নাট্যের আবহ তৈরি হয়। তারপর কুশীলবগণ যাত্রার প্রারম্ভ ধরণের গান গেয়ে মঞ্চে উঠে যেন চারদিকের আসর বন্দনা করে। যদিও প্রসেনিয়ামের মুখোমুখি কেবল দর্শক। এর মধ্যে তিন মুকুন্দবেশী অভিনেতৃ মাথায় পাগড়ি বদল করে। তারপর এক মুকুন্দ বসে আত্মকথন করে- মুকুন্দের পূর্বপুরুষের বিক্রমপুর থেকে বরিশাল আসার খবর দেয়। নৌকা করে সেই আগমনও দেখানো হয়। জন্ম থেকেই জীবনকাহিনী শুরু হয়। তারপর হঠাৎ করে কালীপূজার আয়োজন দেখি। ছাগলের তৈরি প্রপস নিয়ে বলিও দেয়া হয়। মুকুন্দ কালীভক্ত ছিলেন জানি। তাই কি শুরুতে এই আয়োজন?- তবে শক্তির দেবী কালী যে জনমনে মাতৃশক্তির এক আধার, উপর্যুক্ত বাস্তবানুগ দৃশ্যে লোকবীর্যবত্তার উপযোগী তেমন প্রতীককল্প ঠিক রচিত হয় না। এরপর সূত্রধার ধরনের দুই মাতাল তরুণ-মুকুন্দ কে, কেন তাকে নিয়ে নাটক- তামাশার জোকারের মতো করে তার ফিরিস্তি দেয়। বোঝা যায় একালের দর্শককে রঙ্গব্যঙ্গে একটা ধরতাই দিতে চায়। তবে ট্রাক ড্রাইভার পরিচয়ে তারা গ্রুপ থিয়েটারি সচেতনায়, স্মার্টনেসে সব বলে। লঘু রসিকতায় ভারি বিষয়ে দর্শককে উদ্বুদ্ধ করতে বুঝি। কারো কারো এই পদ্ধতি এহেন সিরিয়াস নাট্যপোযোগী ঠেকে না। তবুও এটা নিশ্চয় পরিচিত এক থিয়েটার-ইডিয়ম। এরপর কৈশোরকাল থেকে মুকুন্দের সঙ্গীতপ্রেমের স্কুল-দৃশ্য, বিদ্যালয় ত্যাগ, কীর্তন দলে যোগদান একে একে ঘটতে থাকে। মুকুন্দকাহিনীতে অঙ্গাঙ্গী মহাত্মা অশ্বিনী দত্তের শিক্ষাশেষে কোলকাতা থেকে বরিশালা আগমন, নদীর ঘাটে তাকে নিতে আসা, পিতৃসকাশে অশ্বিনী কুমারের সংকল্প ঘোষণা, সমাজ-রাজনীতি কর্মে তার যুক্ততা, সেই সূত্রে মুকুন্দের সঙ্গে পরিচয়, ভক্তিসাধনের বদলে শক্তিসাধনে তার উদ্বুদ্ধ হওয়া; ইতোমধ্যে মুকুন্দের বিবাহ, সঙ্গীত প্রেমে গৃহবিরহ- টুকরো দৃশ্যে একের পর এক ঘটে চলে বিশদ অনুপুঙ্খতায়। তারপর আসে মুকুন্দের আসল কর্মজীবন, দল গঠন করে জাগরণী গানের জোয়ার জাগে। ইংরেজ পুলিশ সুপার আর বাঙালি ভাঁড় পুলিশ কর্মকর্তার কমিকনাট্যও শুরু হয় পাশাপাশি। টিপিক্যাল উৎপল দত্তীয় গণনাট্য মুদ্রাদোষের রঙ্গ চলে। ব্রিটিশের দোর্দণ্ড প্রতাপের ইতিহাস-তথ্য তাতে জোলো হয়ে যায়- নাটুকে ইচ্ছাপূরণের এই খেলো দৃশ্যায়ন পুনরাবৃত্ত হয়ে চলে। এছাড়া মুকুন্দ দাশের গানের অমন দাপট শক্তিমত্তা তার সাধু উচ্চারণে ঠিক সঙ্গতি পায় না। বরিশালের স্থানীয় বাচনের সতেজবীর্য অব্যবহৃত হওয়ায়। আঞ্চলিক ভাষা নাগরিক মঞ্চে সর্বদা কমিক রিলিফ মাত্র- তাই বুঝি মুকুন্দনাট্যেও তা অপাংক্তেয়। বরং এখানেই কি সুযোগ ছিল না নাগরিক সৌখিন উচ্চম্মন্যতা ভেঙে জনবাচনের সামর্থ্য উদঘাটন প্রয়োগের? নিশ্চয় তাতে আঞ্চলিক ভাষায় সর্বজনীনতা বাধা পেত না। এ নাট্য তার সঙ্গত স্বাধীন ভিত্তি পেয়ে যেত।

এই ইতিহাসনাট্যে একালীন শব্দ ব্যবহারও কানে লাগে- গানের শেষে হাততালি দেয়া, ধন্যবাদ জ্ঞাপন, মুকুন্দের দাওয়াত কবুল করায়ও। মুকুন্দের শারীর-বাচনেও লোকনায়কের দেশি তেজি রোখ নাগরিক শালীন ধরনে চাপা পড়ে যায় অথচ গান তো ভালোই তোলা হয়েছে- একক, কোরাস, দুই-ই যথেষ্ট ভালো। এতো টুকরো দৃশ্য, তথ্যের অনুপুঙ্খতাও নাট্যের গতি, বিশেষত বিরতির পর ঢিমেঢিলে করে দেয়। কখনো টানটান হতে দেয় না- দাঙ্গার কোরিওগ্রাফিতেও নয়। মালাওন বলে গালি দেওয়াও তখনকার বাচনে সত্য নয়। তবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের চরিত্রায়ণ ভালোই উৎরে যায়। দেশবন্ধু ততটা না হলেও। এতোই যখন ইতিহাস তথ্যের দৃশ্যায়ন হলো, তবে কেন একমঞ্চে নজরুল-মুকুন্দের নেচে নেচে আসর জমানোর ঐতিহাসিক সত্যের ব্যবহার, প্রয়োগ বাদ গেল? সেটাতো যুৎসই নাট্য তৈরি করতো। বা মুকুন্দকে যখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর যেকোনো গান গাইবার অনুমতি দিলেন- তখন তো সুযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথের কোনো স্বদেশী গানের মুকুন্দ- উপস্থাপনা। তাছাড়া মুকুন্দের মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নিতে হবে কেন কাহিনী? একটা লোকনায়কোচিত পূর্ব সমাপ্তি কি অধিক নাট্যসঙ্গত হতো না?

শুনেছি প্রথম অভিনয়ের পরে অনেক সম্পাদনা হয়েছে, আরও একটু যদি করা যেতো, টুকরো দৃশ্য কমানো গেলে টেলিভিশনি নির্বীর্যতা কাটিয়ে যোগ্য মঞ্চমাত্রা অর্জন করবে নাটক মনে হয়। হয়তো এটা এসময়েরই দুর্বলতা। জীবনে, বাস্তবে নেই যেখানে প্রবল কোনো বীর্যবত্তা। ক্ষমতা -রাজনীতি ভিতর থেকে ক্ষয় প্রায় সম্পন্ন করেছে যে। মুকুন্দ-শরণ নিয়ে একটু উঠে দাঁড়াবার উপায় কী করে হতে পারে সেই দায়ের পন্থাসন্ধান করতে চাইবে কি নবীন দল ‘প্রাঙ্গণে মোর’? তার শুভসূচনা যেহেতু তারা করতে পেরেছে- আরো আরো সুলুকসন্ধানের কঠিন দুর্বহ ব্রতপালন তাদের কাছেই চাইতে পারি না কি?- ‘তোমার পতাকা যারে দাও/ তারে বহিবারে দাও শকতি’। রঞ্জনের পথ চেয়ে নন্দিনীর প্রতীক্ষা কবে যে ঘুচবে- কেউ কি তা জানে?

ডাকঘর
রচনা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নির্দেশনা : শামীম সাগর
প্রযোজনা : পালাকার

রবীন্দ্রনাট্য ডাকঘর করলো পালাকার- তাদের স্টুডিও প্রযোজনা-৭ হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ করাটাই তো একটা ঘটনা। প্রকৃত সৃজন-তাকদের একটা অগ্নিপরীক্ষা তাতে হয়। ঢাকার মঞ্চে এ কাজে সফল বোধহয় একমাত্র অচলায়তন- নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রযোজনা। শুনছি এখন ঢাকায় ডাকঘর করছে ৩ টি দল। মঞ্চস্থ হয়েছে কেবল পালাকার প্রযোজনা। বেশ একটা টানটান ঔৎসুক্য নিয়ে স্টুডিওতে ঢুকি। তিনদিকে দেয়াল ঘেঁষে বসার জায়গা- এক পাশে অবশ্য একটিই মাত্র সারি। ফাঁকা মঞ্চের উপর দিকে যেন গাছে ছড়ানো পাতায় ডালে আটকে পড়া ছেঁড়া ঘুড়ি। মেঝেতে একটা টুল মতো বুঝি। হঠাৎ করে বাজনা শুরু হয় চারপাশ থেকে- মঞ্চে ঢুকে পড়ে একদল শরতের খুশির গান গেয়ে- নেচে চলে তার। এর মাঝেই উদাসী সুর বাজে- ঐ দলেই বুঝি ছিল মাধব দত্ত। সে একা হলে কবিরাজ আসে হামাগুড়ি দিয়ে প্রায়- হাতে তার পাঁজিপুথির সম্বল। মাটিতে মিশে যাওয়া একটা সরীসৃপ যেন সে। প্রাণের জীবনের এক সাক্ষাৎ প্রতিপক্ষ- বুঝি মৃত্যুদূত, বিনাশকামী। মাধব দত্তের ব্যাকুল সব জিজ্ঞাসা অমলের অসুখ নিয়ে। তা নস্যাৎ করতে, আতঙ্কে ত্রস্ত করতেই উল্লাস এই বিকারীর। বোঝা যায় স্বাভাবিকতাবাদী বাস্তবানুগত নয় অভিনয়, পোশাক-সজ্জা, রূপায়ণ। এতেই নিদের্শকের মতির একটা ধরতাই মেলে। একটু পরেই বোঝা যায় ডাকঘর- এর এক নবমঞ্চনির্মাণই করা হয়েছে- টেক্সট এর প্রচল থেকে নব নাট্যভাষ্যে, ইডিয়মে মুক্তি খুঁজেছে বয়সে নবীন, চর্চায় কমপক্ষে একযুগের অধিক যুক্ত নাট্যজন শামীম সাগর। তার বিবেচনায় অমল বয়স্ক মাধব দত্তের ভেতরজন, প্রাণপাখি। যেন সবার মধ্যেই থাকে এক অমল। বাস্তব বৈষয়িক বিশ্বে প্রতি মানুষের আত্মনাট্য করে তুলতে চায় দেখি ডাকঘর-কে, মাধব অমলের দ্বৈতাদ্বৈত টানাপোড়েনে। নবীনের পক্ষে সঙ্গত এক তাকদ বুঝি- এহেন বাচনভাষ্যে মঞ্চরূপায়ণ, নির্মাণে। তবে আমাদের অভ্যস্ত মনে এই রূপ-রূপান্তরণ স্পষ্টগ্রাহ্য করতে নাট্যমুদ্রা, ইডিয়মের আরো সহায়তা চাই।

ঠাকুরদা আসে, মুক্তপ্রাণসঙ্গী সে। মাধব তাকে নিয়ে একই সঙ্গে যে দ্বৈধতার লীলায় মাতবে তা ঠিক তত জমে না প্রথমবার। মাধব দত্তকে একটু কমবয়সী লাগে। তার ভেতরের অমল বেঁচে আছে বলেই কি?- তবে ঠাকুরদাকে নির্দেশক বা অভিনেতা শনাক্ত করতে ঠিক পেরেছেন বলে মনে হয় না। গ্রামসমাজে এই সেদিনও একাট পরিচিত চরিত্র যে তিনি। গৃহস্থ ঘরে ঘরে তার গতায়ত- ফকির, বাউল কিংবা পাড়ার সবার জমানো দাদা নানা কেউ- নানা রূপের ঠাকুরদা ছিল একদিন। অন্তত বাউলেরা তো রয়ে গেছে আজও, বোষ্টম বোষ্টমীও নিশ্চয় কোথাও বর্তমান। অথচ অভিনয়ে ঠাকুরদা ঠিক সঙ্গত স্বাভাবিক স্ফূর্তি পায় না। কিন্তু অমল? প্রতীককল্প এই চরিত্রটিকে নিজস্ব এক অনায়াস বাচনে, শারীরমুদ্রায় ধরেছে নবীনা বিস্ময় লাগে। রবীন্দ্রবচন প্রায়শইতো অদ্ভুত এক সুরেলা ন্যাকামীতে পর্যবসিত করে ছাড়ি আমরা- অথচ তা যে আমাদের মনের আবেগের সহজ-গভীর ভাষ- কথ্যবাচনে যার সত্যকার স্পন্দ জাগে- প্রতি যুগের অভিনেতৃকে তা আবিষ্কার করতে হবে। এটাও যে অনিবার্য এক মঞ্চদায় বিশেষ- নবীন প্রজন্ম সেটা বুঝতে শুরু করেছে- করে দেখিয়েছে- তাতে খুব কৃতজ্ঞ লাগে। অথচ দইওয়ালা বয়েসী এক কৃত্রিম বাচনে সত্য কোনো চরিত্রসত্তা দাঁড় করায় না। অমল যদিও নানা সুর ছন্দে সুন্দর মজা করে তার সঙ্গে। এরা যে গ্রামসমাজের একেক অঙ্গাঙ্গী নিকটজন, পেশাজীবী। বড়ই অচেনা তারাই আজ নগর দেশে। জেলা শহরে অন্তত কুষ্টিয়ায়ও দেখা মেলে না কি দইওয়ালা?- কোথায় হারালো সেই ডাক- দই, দই, ভালো দই। এই ডাক ফিরিয়ে আনাটাও কি গভীর এক সাংস্কৃতিক নান্দনিক দায় নয় নাট্যজনের? বাংলামনের স্বদেশী কত না বাংলা-ডাক রবীন্দ্রনাথ ধরে রেখেছেন। আর আমরা তার বাচন, পুনর্বাচনের দায় নেবো না কি? প্রহরী চরিত্রটি পাহারাদার বা ডাকপিয়নের সঙ্গে কিছু কি মেলে? তার কাজের একটা বড় মানে নিশ্চয় আছে- কালজ্ঞাপক রক্ষক বা ঘোষক হিসেবে। কিন্তু চেনা পরিচিত বাস্তবকল্পতো চাই- নইলে মানুষটার আদল জ্যান্ত হবে কী করে মঞ্চে। মনে হয় না এটা স্পষ্ট করা গেছে- চেষ্টাতো নিশ্চয় নানাভাবে হয়েছে। আর টিপিক্যাল থিয়েটারি মোড়ল না করার চেষ্টা বোঝা গেছে- কিন্তু ক্ষমতা প্রতিভূর মস্তানি চরিত্রায়ণে থাকতে তো হবে। এরা তো আজ গ্রাম-নগর উভয় সমাজে সব চাইতে পরিচিত বাস্তব- নানা বিচিত্র চেহারায়, চরিত্রে। মোড়লের একটা গ্রাহ্য আদল তাই আনতেই হবে। নইলে নাট্য ঠিক জমে না। সুধা একটু বেশি বয়সি হয়ে গেছে- গ্রামীণ সারল্য তাতে যেন আসে না। কিছুটা টেলিভিশনি বানানো স্মার্ট মনে হয়।

নাট্যে নানা সময় নানা পরিস্থিতির ব্যাখ্যা হয়েছে টেক্সট বহির্ভূত রবীন্দ্র গানে গানে। দইওয়ায়ালার বেলা যেমন চণ্ডালিকা-র দই চাই, দই চাই গো গানটি। সব গান সব জায়গায় ঠিক হয়তো লাগেও না- তাতে কী- প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে যে ওদের, তাতে বিচার ভেসেও যায়- রবীন্দ্রনাথের এক মুক্তিনাট্য হয়ে ওঠে নানা গানে গানে- সেটা সবার ভালো লাগে। ‘আমরা সকলেই অপেক্ষায় আছি। আমাদের এই ছোট্ট শরীরটার পানে বিরাট বিশ্ব-শরীরের একটা আনন্দের টান কাজ করছে সব  সময়।’- নির্দেশকের ভাবন-বাচন এরকম।

তবে শেষ রক্ষা হলো কি? অমলের মৃত্যুর কথাই ভাবা হলো যেমন ভাবনায় অভ্যস্ত সকলে? অমল যে রাজকবিরাজের কাছে ‘দেশে দেশে ঘরে ঘরে রাজার চিঠি বিলি করার কাজ নেবে’, সে যা কিছু আছে কেবলি দেখে বেড়াবে। যেন অন্ধকারে চেনা যায় ধ্রুবতারা, কিংবা ঠাকুরদা যে বলে, রাজা এসে ডাকলেই জেগে উঠবে অমল- এসব কি তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা? রাজা মানে তাহলে কি ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা, তার ডাকে জাগা মানে তাই কি মৃত্যু?- এই জায়গাগুলো কীভাবে দেখা হয়েছে ঠিক বোঝা যায় না। একটা পরাক্রান্ত রাজকীয় কৃত্যাদি, দণ্ড পতাকাসমেত অভিনীত হয় বটে। অমল অসীম অনন্তে মিলায়, সীমাবদ্ধ জীবনে ধরে রাখা যায় না তাকে- এমন একটা ভাবনা বুঝি নির্দেশকের। - যাই হোক সব মিলে খুবই কৃতজ্ঞ লাগে রবীন্দ্রমুক্তির এই মঞ্চস্ফূর্তি দেখে।

রাতের অতিথি
রচনা :উৎপল দত্ত
নির্দেশনা : শফিকুল ইসলাম সোহেল
প্রযোজনা : থিয়েটার সেন্টার

গত বছরও উৎপল দত্তের আরেকটি নাটক অভিনীত হয়- রাতের অতিথি। থিয়েটার সেন্টারের ২৮ তম প্রযোজনা। ’৯০-র দশকে উৎপল দত্তের এবার রাজার পালা করেছিল তারা। নির্দেশক শফিকুল ইসলাম সোহেল মনে করেন- ‘আমাদের দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে এ নাটকের কাহিনী অনেক বেশি সঙ্গতিপূর্ণ, যদিও তা ষাটের দশকে রচিত।’ তার আকাঙ্ক্ষা- ‘এ নাটকের মধ্য দিয়ে যদি আমাদের বিবেক আমাদেরকে এক মুহূর্তের জন্য নাড়া দেয় ... এবং ক্ষণিকের জন্য আমাদের মাঝে দেশপ্রেম জেগে ওঠে, তবে আমাদের শ্রম সার্থকতা পাবে।’ কথাগুলো পুরনো দিনের মতো, অনেককাল আগে যা শোনা যেত। এখন এসব আবেগ ছেলেমানুষী অনান্দনিক মনে করা হয় বুঝি। তবে এই দলের প্রযোজনাগুলোতে এমন ভাবনার এক ধারাবাহিকতা দেখা যায়। উৎপল দত্তের নাট্যরচনায় নির্দিষ্ট অভিমুখিতা থাকে। প্রায়শ তা সরল সহজ, একরৈখিক লাগে। তবে আখ্যান-সংলাপ প্রায়াশই লাগসই হয়। তার কথার মজা ও ধার সর্বদাই উপভোগ্য। যদিও বেশিরভাগ দর্শক তাকে হিন্দি সিনেমার এক জোকার হিসেবে জানে, চেনে- তার রাজনৈতিক, নান্দনিক বিরাট পরিচয় তত নয়।

এই নাটকে বেশ একটা নাটুকে কৌশল নেয়া হয়েছে। ক্ষমতার নানা মানুষজনকে একজায়গায় হাজির করিয়ে তাদের স্বরূপ, কীর্তি ফাঁস করে দেয়ার একটা নাট্যরগড় জমিয়ে। এক লেখক সবাইকে নিমন্ত্রণ ক’রে বলে- তার নতুন লেখা ‘ব্যবচ্ছেদ’ ছাপা হচ্ছে- তাতে এই এই সব সত্যকথন আছে। শুনে তো সবার কাছা-খোলা অবস্থা। নানা রকম ভয়-লোভ-অনুনয় করে চলে তারা। একজন কেবল, এক পত্রিকা মালিকের স্ত্রীকে, যাকে তার স্বামী কাজ বাগানোর কল বানিয়েছিল- ক্রমে সে হয়ে ওঠে বহুবল্লভা রমণী; তার প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্ন, সে সব স্বীকার করে, বদলাতে চায়, মানুষ বদলাতে পারে- এরকম কথা উঠে আসে। পরে জানা যায় লেখকটি ঠিক সুস্থ স্বাভাবিক কেউ নয়। পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছে। পুলিশ তাকে খুঁজে পায়। ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। একজন বাদে- পত্রিকামালিকের স্ত্রী তাল মেলাতে পারে না, নিজেকে হারিয়ে ফেলে- বোঝা যায় সেও হয়ে উঠেছে বুঝিবা পাগল- কী করে কেউ যে এমন হয় সহসা সেটা যেন স্পষ্ট হয়- বেশ একটা ধাক্কা লাগে। এই অভিনয়টা সহজ নয় তো। রেহানা সামদানী খুবই সত্যতার সাথে তা করেছেন। তাতে নাট্যকারের অভিলাষ পূরণ হয়েছে। হালকা চালে, হাসতে হাসতে, মজা করে করে এমন একটা জায়গায় পৌঁছনো সহজ নয়। তার অভিনয় আরও কঠিন। সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক যেমন আমাদের সকলকে বড় উলঙ্গ করে ছাড়ে।

বেশিরভাগ নতুন অভিনেতৃ নিয়ে নবীন নির্দেশক প্রাণপণে যতটা করেছেন তারিফ করতে হয়। সমস্যা হয়েছে মূলত বানানো এক কলকাত্তাইয়া আরোপ করতে গিয়ে। তাতে সব চরিত্র তার বিশিষ্ট সামাজিক আদলের ভিত্তি ঠিক না পেয়ে ক্যারিকেচারই মাত্র হয়ে ওঠে- একজন কোনো ৎবধষ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন না। যেমন পুলিশমন্ত্রীকে তার পোশাকে একটা চেনা চরিত্র এলেও তার অভিনয়ে কখনোই ক্ষমতাধরের মৌল পরিচয়কে চেনা যায় না- কেবলি জোকারি করে চলে সে পথনাটকের পুলিশের মতো। ঘেরের মালিক বা ধনী ব্যবসায়ী, এমনকি পত্রিকা মালিকও চলাফেরা, আচার আচরণ- শারীর বাচিকের সামাজিক নানা মুদ্রায় বিশিষ্ট একেক চরিত্র হয়ে উঠতে ঠিক পারে না- কমিক করাই যেন তাদের কাজ হয়ে দাঁড়ায়- সেটাও তাই বানানো হয়-চরিত্রের নির্দিষ্ট বাস্তবভিত্তি না পেয়ে। অথচ পত্রিকার মালিকের স্ত্রী ও সমাজসেবিকা জীবন্ত হয়ে ওঠেন। সমাজসেবিকা চরিত্রে নাহিন শফিক অবশ্য আজকের এন.জি.ও নারী নেত্রীর ব্যক্তিত্ব গড়নটি ঠিক আনতে পারেন নি, তবু পুরুষ নাচানো-খেলানোর পরিচিত ঢঙঢাঙ ভালোই করেছেন। খুবই পরিণত অভিনয় করেছেন রেহানা সামদানী, পত্রিকামালিকের স্ত্রী সুলোচনা চরিত্রে। এই নাটকে তারই দায় ছিল বাস্তবিক স্বাভাবিক ব্যক্তি হয়ে ওঠা- সেটা তিনি খুবই দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। ঢাকার মঞ্চে এমন চরিত্রানুগ আত্মস্থ অভিনয় দুর্লভই বলতে হয়। লেখক চরিত্রে নির্দেশক শফিকুল ইসলাম সোহেল প্রাণপণে সত্য হতে চেয়েছেন- তবে তার বাচন তাকে পদে পদে অসহায়তা করেছে, এক পর্দা- এক ধ্বণিতে কণ্ঠস্বরটি ধরে রেখে। শারীরিক গতিচ্ছন্দ যদিও তার খুবই সঙ্গত স্ফূর্তিই পেয়েছে।

সব মিলে থিয়েটার সেন্টারের রাতের অতিথি গত বছরের ভালো একটি প্রযোজনাই। ক্যারিকেচারের অতিরেক ঝরিয়ে, বানানো কাল্পনিক কলকাত্তাইপনা ছেড়ে, জীবন্ত আজকের সামাজিক একেক চরিত্র হয়ে উঠেই যদি তাবৎ রঙ্গ-ব্যঙ্গ-কমিক-স্যাটায়ারের পরিচিত বাস্তব মুদ্রাসকল সত্য সত্য আয়ত্ত করায় মন দেয় নির্দেশক-অভিনেতৃগণ তবে এটি আরো তীক্ষ্ণ, খর নাট্য হয়ে উঠবে। আলো ও আবহসঙ্গীত কোথাও তেমন বাক্সময় হয়ে ওঠে না- এই নাট্যক্রিয়ায় লাগসই তেমন লাগে না ঠিক। তবে এ নাটকে ক্ষমতাধরদের অপকর্ম কুকর্মের যা ফিরিস্তি শোনা যায়, তাতো আজকের বাস্তবতায় যেন প্রাগৈতিহাসিক কালের, মান্ধাতার আমলের। তবু কোথাও যেন লাগে, একেবারে দিনকয়েক ধরে দেশজুড়ে গেড়ে বসা ক্ষমতার কাছায় টান লাগার মতো বিস্ময়-ঘটন ঘটেছে তো শুনি- তাতে যেন বেছন জাগছে কোনো লুপ্ত হৃত মানববৃত্তির- ধন্য আশা কুহকিনী। তবে নাট্যকারের ইচ্ছাপূরণ, মানুষ বদলাতে চায়, বদলাতে পারে- এহেন সরল নীতিবাক্য রূপকথার মতোই আজব সরল লাগে। ইচ্ছাপূরণের একদা কথিত বিশ্বাস্য বুলিই ঠেকে। তবে এটাও ঘটনা:বুলিকথন-। শেষ দিকে সব দেখে শুনে হতভম্ব পত্রিকামালিকের স্ত্রীর কীরকম পাগলের মতো হাসতে থাকা কেবল কি অভিনয়গুণে ধাক্কা মারে কোথাও? বোধহয় না। চকিত এক স্বরূপ উন্মোচন ঘটে যেন, লুকিয়ে পালিয়ে থাকা যায় না নিজের থেকে। নাটক শেষে সবাই তাই কেমন চুপ করে যায় যেন। মুখে আর কারো কথা সরে না, আলো নিভে যায় মুখের। নাট্যকার নিশ্চয় এমনই চেয়েছিলেন। তারই আয়োজনে ঘটনাঘটনের দক্ষ বুনন ঘটিয়েছেন একটা গভীর জায়গা তৈরি যাতে হয়ে যায়। মনের কোন তার যে কখন কীভাবে বেজে ওঠে কে তার ইয়ত্তা করে!

বিপ্লব বালা : নাট্যজন, শিক্ষক ও সমালোচক