Full premium theme for CMS
ক-তে কবি আর অ-তে অমর
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
এই সৌভাগ্য তবে আমাদের হলো- আমরা এক মহাপ্রয়াণের সাক্ষী হতে পারলাম।
প্রয়াণ একেবারেই মামুলী ব্যাপার, সবার জীবনে অবশ্যম্ভাবী। ফলে তা কখন কার জীবনে আসলো গেল তা নিয়ে মাথা ব্যথা কারো থাকে না। এমনিতেই কোনো কিছু নিয়ে মাথা ব্যথার সময় আমাদের হাতে নেই, পুরো শরীর নিয়ে আমরা চলি, সামান্য এক মাথা, সেটার আবার ব্যথা কী? গোপী গাইন বলে- বাঘা দা’ কত হলো শুনি; বাঘা বাইন বলে- সময় কই গুণি?- হ্যাঁ, আমাদের গুণে দেখার সময় নেই। জন্ম যদি বঙ্গে-ও হয়, ক্ষণকাল তিষ্ঠ হওয়ার মতো সময় কারো হাতে নেই। গায়ে ধাক্কা লাগলে পাশ কাটিয়ে যাই। দেখারও প্রয়োজন হয় না, কার সাথে ধাক্কা লাগলো, ধাক্কা লেগে কেউ পড়ে গেল নাতো? পড়ে গেলেই-বা কী, পথে হাঁটবি কিন্তু ধাক্কা সামলাতে পারবি না, তাহলে পথে নেমেছিস কেন? এভাবেই আমরা সবাই, হয়তো-বা সবাই না, কেউ কেউ, অথবা কম-বেশি সবাই-ই যে না তাই-বা বলি কীভাবে, ছুটে চলেছি আগ-পিছ কিছু না ভেবেই। ছুটলে ক্ষতি নেই, ছোটা মানেই তো গতি। গতিকে ক্ষতি বলাটা মোটেই ঠিক হবে না। কিন্তু ঐ যে, বলেছি তো আগেই, প্রয়াণ একেবারেই তুচ্ছ ব্যাপার আজ, সেটা তো এই ছোটাছুটির কারণেই। গতির কাছে যেখানে জন্মই তুচ্ছ, সেখানে প্রয়াণের না পালিয়ে উপায় নেই। প্রয়াণ মানেই অতীত, অতীতকে নিয়ে ভাববার সময় গতি দিতে চায় না। তাই অতীত আজ বিস্মৃত। অতীত তো অতীত, বর্তমানই তো তার অস্তিত্বের সংকটে আজ। আজকাল আর বর্তমান বলে কিছু নেই। বর্তমান দ্রুততম সময়ে অতীত রূপ ধারণ করছে। ফলে এখন কেবল একটা ‘কাল’ই চোখে পড়ছে- ভবিষ্যৎকাল। কিন্তু সংকট তো রয়েই গেল। ‘গতি’ই এই সংকট তৈরি করলো। সে বর্তমানকে হত্যা করে, অতীতকে বিস্মৃত করে, একক রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই একক রাজত্ব কায়েম করতে গিয়ে সে আজ নিঃসঙ্গ, আর কেবল নিঃসঙ্গই-বা বলি কেন, ভবিষ্যৎ-ও তো আজ অস্তিত্বের সংকটে। ‘ভবিষ্যৎ’ কারো উপভোগ্য হতে পারছে না। সে তো সব সময়েই নাগালের বাইরে। ভবিষ্যতের মজাটা তো তখনই হবে যখন বর্তমান থাকবে, অতীত থাকবে। তা না হলে তো কেবল ছুটে চলা। আমাদের জানা আছে মাকড়শার জন্ম মানেই মা-মাকড়শার মৃত্যু। আমরাও বুঝি কেবল ভবিষ্যতের দিকে ছুটছি, মৃত্যুর দিকে ছুটছি। এই ছুটে চলা সময়ে আমরা আমাদের যে স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ, সেই ভবিষ্যতের সাক্ষাৎ যেই-না পেলাম, সাথে সাথে সে বর্তমান না হয়ে অতীত হয়ে গেল। গতির সাথে বর্তমান অভিমান করেছে, সে তাই কাউকে বুকে ধরে রাখে না। আসার সাথে সাথে তাকে অতীতে ঠেলে দেয়। অতীতও রাগ করেছে, সে নিজ থেকেই তাকে বিস্মৃত করে দেয়। তাহলে আর থাকলো কী? বর্তমান মৃত, অতীত বিস্মৃত, ভবিষ্যৎ কেবল খাতা-কলমে আছে, বাস্তবে নেই। তার মানে আমাদের আর কোনো ‘কাল’-ই নেই। কোনো কাল না থাকা মানে তো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া। আমরা বলছি আমরা আছি, কিন্তু আদতে আমাদের অস্তিত্ব নেই। কী বীভৎস সব বাস্তবতার মুখোমুখি এখনকার মানুষ, এখনকার আমরা!
এতো সব ছুটে চলার সময়েও একটি প্রয়াণ আমাদের কাছ থেকে সময় কেড়ে নিল। আমাদের বাধ্য করলো থমকে দাঁড়াতে। এবং, হয়ত-বা তাই, এই প্রয়াণ আসলে য্যান-ত্যান প্রয়াণ না, এ এক মহাপ্রয়াণ। কোনো গতিই পারে নি, এই প্রয়াণের সময় কাউকে ছুটে চলাতে। থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করবার মতো জোর তবে এখনো অনেকের আছে!
আমরা, হয়ত-বা আমরা সবাই না, কেউ কেউ, ভাবতে থাকি আর দেখতে থাকি, দ্রুত গতিতে চলেছে স্বদেশ। চলেছে, মানে চলমান, কিন্তু আগুয়ান নয়। চলা মানেই তো আর এগিয়ে যাওয়া না, চলা মানে গতিশীল থাকা, আর এটাকে আমরা বলি সচল থাকা, এই সচলতাকেই প্রগতি বলে ভ্রম করি। এবং আমাদের এই ভ্রম ভাঙে, যখন মনে পড়ে, আমাদের কবিরা সব সময়েই সময়কে বলেছে- অন্ধকার সময়। আমরা কবিদের মুখে অদ্ভুত আঁধারের কথা শুনেছি, আজকাল অন্ধরাই যে চোখে বেশি দেখে সেটা শুনেছি, চৈতন্যে মড়ক লাগার কথা শুনেছি, এ-ও শুনেছি আমরা কৃষ্ণপক্ষ পার করছি। এগুলো তো একই সময়ে দাঁড়িয়ে লেখা নয়। তবুও কেন মনে হয় একই সময়ের? তবে কি, এই যে ছুটে চলা, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলা, তা আসলে স্থির, স্থবির হওয়া? আমরা দেখতে পাই, হয়ত-বা সবাই না, যারা যারা দেখতে চাই, তারা দেখতে পাই, পড়তে পাই, হুমায়ুন আজাদ ষোল বছর আগে প্রধান কবিকে হাসপাতালে অসুস্থাবস্থায় দেখে লিখতে থাকেন ‘... শামসুর রাহমান, আপনি যখন হাসপাতাল থেকে/ বেরিয়ে আসবেন/ তখন ঢুকবেন এক বিশাল হাসপাতালে, দেখবেন দুরারোগ্য/ বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত সমগ্র বাঙলা, তার মাটি নদী ও আকাশ।’- এবং তারপর যদি আমরা আমাদের মাঝে জাহানারা ইমামকে পেয়ে থাকি এবং তার ডাকে জ্বলে উঠে থাকি আর আবার সুনিদ্রা যাই, এবং তারপর যদি জঙ্গীদের দ্বারা আমাদের প্রধান কবিকে আক্রান্ত হতে দেখি এবং আমরা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই আর আবার বিশ্রামে যাই, এবং তারপর যদি আমরা হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণ প্রত্যক্ষ করে থাকি এবং প্রতিবাদে জ্বলে উঠে থাকি আর আবার মৌজে দিনাতিপাত করি, তবে তো সব কালের সব কবির পঙতিমালা- অন্ধকার, কৃষ্ণপক্ষ আর চৈতন্যে মড়ক লাগায় ভরে থাকবেই।
স্বাধীনতাকে পাওয়ার জন্য আর কদ্দিন রক্তগঙ্গায় ভাসতে হবে, আর কদ্দিনই-বা খাণ্ডবদাহন দেখতে হবে, এ-প্রশ্ন কবি করতেই পারেন। প্রশ্ন করেছেন কবি তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে, সৃষ্টিশীলতার মাধুর্য দিয়ে। আমরা নিশ্চিত হতে পারি, এই প্রশ্নের মাধ্যমেই কবি চেয়েছেন আর কেউ যেন এর পর থেকে রক্তগঙ্গায় না ভাসে, আর না দেখে খাণ্ডবদাহন। কিন্তু কবির চাওয়ায় এদেশের কিছু আসে যায় না। এ-দেশ মরণ খেলার দেশ, এ-দেশ কবিকে অসুস্থ করে ফেলবার দেশ, এ-দেশ উন্মাদের দেশ। তাই এ-দেশ কবিকে দেখিয়েছে পঁচাত্তরের রক্তগঙ্গা, দেখিয়েছে বিশ্ব বেহায়াদের তাণ্ডব লীলা। দেখিয়েছে জঙ্গীর গাড়ির শোভা বর্ধন করে চলেছে আজ কবির পতাকা। এবং, অতঃপর, আমাদের কবিকে আমরা দ্রৌপদী বলে ঠাহর করি, আমাদের কবি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে আমাদের, দেখে এই পাণ্ডবের দল কী অদ্ভুত নিরবতায় কাটিয়ে চলেছে দিনকাল, আর, শকুনীর দল ক্রমেই কবিকে উলঙ্গ করতে থাকে। আমার কবিকে বাঁচাতে কোনো কৃষ্ণই আর এগিয়ে আসে না। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করা যাক দেখি- এই শকুনী মামাই কি পরবর্তী সময়ে শকুন নাম ধারণ করেছে? হবে হয়তো। তাই তো দেখি শকুনী মামা খামছে ধরে দৌপদীর শাড়ি, আর আজকের কবি বলে- জাতির পতাকা খামছে ধরেছে আজ পুরনো শকুন।’
এক সময় বুঝতে পারি, সবাই যে পারি তা-ও না, যারা এখনো বুঝে নিতে চাই, তারা বুঝতে পারি, আমাদের আসলে রোগে ধরেছে- মাথা নত করার রোগে, নীরব থাকার রোগে ধরেছে। আমরা এখন আর ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া’ যাই না। ভানুর মতো ‘দেখি না কী করে’র রোগে ধরেছে আমাদের। আমাদের স্মরণ হয়, বেশি দূর অতীত স্মরণ করবার ক্ষমতাও নেই, তাই নিকট অতীতকেই স্মরণে আনা যায়, এবং, আমাদের স্মরণ হয়- আমরা পঁচাত্তরে একবার বলেছি-‘দেখি না কী হয়’, রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে বলেছি- ‘দেখি না কী হয়’, রাষ্ট্রবিরোধীকে রাষ্ট্রপতি বানাতে দেখে বলেছি- ‘দেখি না কী হয়’, জঙ্গীদেরকে জাতীয় পতাকা শোভিত গাড়ি দিতে দেখে বলেছি এবং বলছি- ‘দেখি না কী হয়’। এবং, আমাদের এ-ও মনে পড়ে কবে যেন শিল্পীর তুলিতে ভেসে উঠেছিল এক চিত্রকলা- ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ এবং তখন, শিল্পীর প্রতি আমাদের মাথা নত হয়। আবার, অতপঃর খেয়াল হয়, সেই ‘বিশ্ব বেহায়া’ এখন আমার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু- ঘৃণায় নয়- শ্রদ্ধায়, অপার ভালোবাসায়।- এবং, তখন চিত্রকরকে প্রশ্ন করতে এগিয়ে যাই- কে প্রকৃত বিশ্ব বেহায়া? ‘বেহায়া’ নিজে, নাকি ‘বেহায়ার’ চুম্বনের জন্য লালায়িত ‘বেহায়ারা’? আমাদের প্রধান কবি সব কিছুই দেখে গেছেন। দেখে গেছেন এ-দেশ সব সম্ভবের দেশ। দেখেছেন, আমরা আমাদের জাতির পিতাকে বলি ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং জাতীয় জঙ্গীকে বলি ‘বাংলাভাই’। এবং, আমরা স্মরণ করতে পারি যে, বঙ্গবন্ধুকে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই বঙ্গবন্ধু বলে না। কেউ বলে শেখ সাহেব, কেউ বলে মুজিব সাহেব। আবার কেউ কেউ সাহেব-সুহেব বলে না, বলে শেউখ্যা। আর কেউ কেউ, তোষামোদির জন্যই হোক আর ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়ই হোক ‘বঙ্গবন্ধু’ই বলে। কিন্তু এক জঙ্গী, বাংলার সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস করার স্বঘোষিত ব্যক্তি, এদেশের ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার কাছেই আজ ‘বাংলাভাই’ নামে স্বীকৃত। ‘বঙ্গবন্ধু’ মানে তো ‘বাংলার বন্ধু’। তাহলে ‘বাংলাভাই’-এর মানে কী? আমি এই বাংলার ছেলে, সেকি তবে আমার ভাই? আমরা এই বাংলার লোক, সে কি তবে আমাদের ভাই? পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া, আড্ডা সব জায়গায় একই উচ্চারণ সে নাকি ‘বাংলাভাই’! আজ ১৪ কোটি বাঙালি এক কথায় মেনে নিচ্ছে- সে ‘বাংলাভাই’। ধিক, এই বাংলার জনগণকে!
এ-দেশ, অনেক দিন থেকেই শুনে আসছি, সব সম্ভবের দেশ। সব কিছুই সম্ভব হয় এমন দেশ, তাহলে বোঝা গেল, এমন দেশ আর কোথাও নেই, কোথাও থাকার কথাও না। শুনেছি, যাদের পড়াশোনা আছে, জানাশোনা আছে, তারা বলেন- পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই যার জনগণ নিজের ভাষার দাবিতে রক্ত দিয়েছে। পৃথিবীতে নাকি এমন দেশ নেই, যার জনগণ একাট্টা হয়ে মাত্র নয় মাসে একটি মানচিত্র জয় করে নিয়েছে, তার চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী শত্রুর কাছ থেকে। আহ্, কী মধুর লাগে এই কম্লিমেন্ট! এবং, এই কম্লিমেন্টের ঢেঁকুর গিলতে গিলতে ভাবা যেতে পারে- পৃথিবীতে কোন দেশ আছে, যেখানে জাতির পিতার স্বঘোষিত হত্যাকারীরা জাতীয় মর্যাদা পায়? কোন দেশে জাতীয় নেতারা জেলখানায় জ্বলন্ত বুলেটের মুখোমুখি হয়? কোন দেশে দেশকে স্বীকার করে না, জাতিকে স্বীকার করে না, এমন লোকদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ে? পৃথিবীর কোন দেশে আসামী বিচারের কাঠগড়ায় উঠে ঐ বিচার ব্যবস্থাকে স্বীকার করে না বলে ঘোষণা দেয়, এবং অতঃপর তাকে সহিসালামতে জেল কোড অমান্য করে জাতীয়ভাবে জামাই আদরে রাখা হয়? সে সংবিধান মানে না বলেই কি তার জন্য সংবিধান ভাঙা হলো? হতেও পারে বা হতেই পারে। আর এই যে বিশ্ববেহায়াকে নিয়ে লোকাল বেহায়ারা টানাটানি করছে, যদিও ব্যাটা মহিলাদের টানাটানি একটু বেশিই পছন্দ করে, এবং, তার জীবনে কোনো মহিলাই বোধহয় এর আগে তাকে এতোটা মনে-প্রাণে চায় নি, তো তাকে যদি জোটে নেয়া যায়, এবং, অতঃপর, জোট যদি ক্ষমতাসীন হয়, তখন আমাদের ঐ ‘শহীদ মিলন দিবস’ আর ‘নূর হোসেন দিবস’ আর `স্বৈরাচার পতন দিবস’ বা ‘গণতন্ত্র দিবস’- এসব দিবসগুলোর কী হবে? তবে হ্যাঁ, এ-প্রশ্ন মাথায় আসলে সাথে সাথেই এর সমাধান মিলে যায়, এবং আমরা বুঝতে পারি স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে নিয়ে যদি ‘স্বাধীনতা দিবস’ বা ‘বিজয় দিবস’ পালনে কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে ডা. মিলন আর নূর হোসেনের বেলায় এতোকিছু ভাবার কী-ই-বা আছে। আমরা আরেকটু ভাবতে বসি, এবং, মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি, আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন যদি হয় স্বাধীনতা, জানি না, শুনেছি এটাই নাকি বড় অর্জন, তবে তো সবচেয়ে বড় সম্পদ আমাদের ‘স্বাধীনতার কবি’। এবং, আমরা প্রত্যক্ষ করি আমাদের স্বাধীনতার কবির প্রয়াণে দেশের কোনো ক্ষতি হয় না, জাতীয় সংবাদের শিরোনাম হতে তাঁকে আর আর চার-পাঁচটি ঘটনাকে সাইড দিতে হয়, এবং শেষাবধি এ-ও দেখি, যেহেতু সে হতভাগা এবং সে মৃত্যুর সময়টা ঠিকভাবে বেছে নিতে পারে নি, সরকারি ছুটি শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে, তাই তাঁকে রাষ্ট্রীয় কোনো মর্যাদা দেয়া হলো না। তো এই যে এতো কথা বলা হলো, এতোকিছু যেখানে ঘটে, সেটাকে কি একটা ‘দেশ’ বলা যাবে? এই প্রশ্ন করোটিতে আসার সাথে সাথে, একটা শব্দ নজরে পড়ে এবং নজরে পড়তেই এক অদ্ভুত ব্যাপার আবিষ্কার হয়। আবিষ্কার হয়, এই দেশের নাম- ‘বাংলা’-দেশ। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশকেই ‘দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করতে নামের শেষে ‘দেশ’ যোগ করা লাগে না। ভারতের লাগে না, পাকিস্তানের লাগে না, চীন-জাপানের লাগে না, চিলির লাগে না, পেরুর লাগে না, না না বেশিরভাগেরই লাগে না। কিন্তু আমাদের লাগে। বাংলা-যে একটি ‘দেশ’, সেটা বোঝাতে নামের শেষে ‘দেশ’ যুক্ত করতে হয়। এবং, তখন মনে পড়ে, বাচ্চাদের বেলায়, যারা ভালো আঁকিয়ে না, তারা যখন কিছু আঁকে, তখন অংকিত চিত্রটির নিচে লিখে দিতে হয় কী এঁকেছে তারা। নয়তো ভুল হয়, চিনতে ভুল হয়। আম-কে মনে হয় আপেল, কলা-কে মনে হয় শশা। পেঁপে-কে কুমড়া বলে ঠাহর হয়। তাই পরিচয় নিশ্চিত করতেই চিত্রের নিচে লেখা থাকে তার নাম। বাংলার কর্মকাণ্ডও সভ্য পৃথিবীতে এক সংশয় তৈরি করেছে, এতো সব ঘটনা ঘটে যেখানে, সেটা কি আদতে কোনো ‘দেশ’? হ্যাঁ, শুধু শুধু ভুল বুঝবেন না, এটা অবশ্যই একটা ‘দেশ’। বিশ্বাস না হয় নামটি ভালো করে দেখুন বাংলা-‘দেশ’।
এতো কিছু ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া’-যে যাই না, তার কারণ, ‘আমরা নরকে আছি, অথচ সে জ্ঞান নেই মনে’। ক্রমশই আমরা আমাদের জমিনের দখল দিয়ে দিচ্ছি আর নিজেদের ‘নিরাপদ’ করে রাখছি, শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে চলেছি, শরীরে, মেধায়, সংস্কৃতিতে। কিন্তু আমরা তো ডাক শুনি, জেগে উঠবার ডাক। আমার কবি বলে- জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?- ডেকেছে, যুগে যুগে এই বাঙলায়, অনেকেই এভাবে ডেকেছে, জাগতে বলেছে। আমরা জাগি নি তা নয়, আমরাও জেগেছি। অনেকবারই জেগেছি। কিন্তু অনেকদিন পার হয়, কেমন যেন নিশ্চুপ, নিথর হয়ে বসে আছি আমরা সকলে। কোনো অত্যাচারে আর অনাচারেই আমাদের নড়ে না শরীর। আমাদের জমিন দখল হয়ে যায়, দখল করে নেয় দেশ-বিদেশের সব লুটেরা। আমরা সেই নিশ্চুপ নিথর হয়েই বসে আছি। কবিতা-গল্প কিংবা নাটক লেখার উপাদান খুঁজছি কেবল।
আমার কানসাট জাগে, আমার শনির আখড়া জাগে, জাগে দ্যাখো গার্মেন্টস শ্রমিক, সবশেষে জাগে ঐ ফুলবাড়ি। তা-ও বেহুঁশের মতো পড়ে আছি আমরা। কবিতা-গল্প-আর নাটক লেখার উপাদান খুঁজি। এবার তবে সেই খোঁজা-খুঁজিতেও আসে আঘাত। হাসান আজিজুল হক আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপর চাপাতি নেমে আসে। যে দু’জন, ঢাকায় বসে মৌজ মারে না, ঢাকার বাইরে থেকে করে যাচ্ছে যুদ্ধ, একের পর এক। আমরা ঢাকার সংস্কৃতিবান পাবলিক-সকল, চুপচাপ, শহুরে হওয়ার ধান্ধায় করছি দিন পার।
আর কত! এবার জেগে ওঠ্ গ্রাম থেকে ভেসে আসা, আশ্রয়হীন সংস্কৃতিজীবীরা। রেহাই নাই যদি না এবারও চুপ থাকিস। আকাশে বাতাসে এখন ‘মুখরিত’ স্লোগান- স্বৈরাচার রাজাকার বুঝি না, ক্ষমতায় যাব, ক্ষমতায় যাব।- তারপরও যদি শহুরে লেবাস না ছাড়িস তো কে নেবে তোর দায়ভার?
গ্রামের পোলা ছদ্মবেশ ছাড়্। আমার কবির মতো জেগে ওঠ্। চল তবে সবাই হুঙ্কার দিয়ে হেলাল হাফিজের মতোই বলে ওঠি-
‘রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি,
আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি।’
আমাদের আরেকটি রোগও আছে, আমরা আশা ছাড়ি না। এবার তবে এই রোগটিই চাঙ্গা হোক। দৃপ্ত কণ্ঠে আমরা তবে একাট্টা হই, এবং সিদ্ধান্ত নিই, আমরা কেবলই শ্বাসজীবী হয়ে বাঁচবো না। আমার প্রধান কবির মতো সচল যেন থাকে আমাদের বোধ- ‘আমরা ক’জন শ্বাসজীবী/ ঠায় বসে আছি/ সেই কবে থেকে। অকস্মাৎ কুকুরের/ শানিত চিৎকার/ কানে আসে, যাই জানালার কাছে, ছায়াপ্রায়। সেই/ পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে জলপাইরঙ/ একটি জিপের দিকে, জিপে/ সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়। ভাবি, যদি/ অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর।’
প্রধান কবি, স্বাধীনতার কবি- তুমি অমর।
ইতি
হাসান শাহরিয়ার
২৮ অগাস্ট ২০০৬
সোবহানবাগ, ঢাকা।