Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সমগ্র’র বিনিময়ে কবি

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

এমন অনেক কথা বলা যেতে পারে যা বলা যায় না, বলা হয় না। এমন অনেক কথা কবিও বলতে চান, যথাযথ কথাশ্রোতা না থাকার কারণে কবির বলা হয় না। এমন অনেক বেদনার ভার থেকে নির্ভার হতে চান কবি, নির্ভারের নির্ভরতা না পাওয়ায় ভার বহন করে চলতে হয় কবিকে। এমন প্রেমাস্পদের কাছে সবকিছুর বিনিময়ে দাবি করেন সেই প্রেম- যা পেলে সকল অপূর্ণতা পূর্ণতায় বিকশিত হয়। কবি সে, এক জীবনের বিনিময়ে যাকে সম্প্রদান করে দিয়ে যেতে চান তাঁর সমগ্র অর্জন- তার বাণী, তার ছন্দ, তার অভিজ্ঞান কিংবা নতুন বারতা নিয়ে আসার অসম্ভব আনন্দ ও বেদনা। মানুষ হয়েও মানবের থেকে আলাদা এক মানুষ- সেই কবি, কবির অন্তরের অভিপ্রায়: ‘আমার সবকিছুর বিনিময়ে যদি তাকে পাই।’(কবির অন্তরঙ্গ এক তরুণ সাহিত্যিকের কাছ থেকে পাওয়া উক্তি, যা কবি করেছিলেন তাঁর ৬০-৬৫ বছর বয়সে)।

না-পাওয়ার মধ্যে পাওয়ার আকুলতা, অধরাকে ষ্পর্শের আবিষ্কার আর অতৃপ্ত আকাঙ্খার সেই অসম্ভবকে সম্ভবের স্রষ্টা কবির প্রসঙ্গে যতবার, যতভাবে, যত যত, যা যা লেখা সম্ভব, তাতে কবির কী-বা আসে যায়! তাতে তার কাব্যকলার, বিশাল সৃষ্টির জগতেই-বা কী প্রভাব পড়ে! কবির সৃষ্টি হয়তো প্রভাব বিস্তার করে যায় তার সমকালে, অতীত কিংবা অনাগত ভবিষ্যতে। কবিকে ঘিরে কবিত্বের যত গল্প ও পরম্পরা। কবিকে ঘিরে যত স্বাদ ও বিস্বাদ। ছন্দ ও দ্বন্দ্ব। রূপ ও স্বরূপের আবিষ্কার। এমন অনেক কিছু। এমন শতশ দ্বিধা ও অভিধার এক অনিবর্চনীয় দরজার ভিতরে কিংবা অভ্যন্তরে বসে কবির অভিজ্ঞান আসে:

    ‘ভায়োলিন চায় স্তব্ধ নদীতীর, কবিতার বর্ণিল টেরেস,
    সোনালি ট্রাম্পেট চায় একগুচ্ছ সতেজ গোলাপ,
    ব্রাউন গীটার চায় তারে তারে সুন্দরীর ঘুমন্ত শরীর। (অপরাহ্নে একদল মিউজিসিয়ান)

কিন্তু আমরা কি জানি কবি কী চান! আমরা কি কবির চাওয়ার প্রসঙ্গে স্তব্ধ হাওয়ার মত হঠাৎ দাঁড়াই! কবির কাছ থেকে কখনো উপশম। কবির কাছ থেকে অব্যক্তর ভাষা। কবির কাছ থেকে শব্দ ও নৈঃশব্দর ছন্দ। কবির কাছ থেকে প্রেম। কবির কাছ থেকে আকাশ ছোঁয়ার বাসনা। কবির কাছ থেকে ষ্পর্শের আঙুল, আঙুলের শিহরণ। কবির কাছ থেকে নূতনের শিরোনাম, কবির কাছ থেকে লুপ্ত পুরাতনে অবগাহন। কবির কাছ থেকে মা, কবির কাছ থেকে ষ্পর্ধা, কবির কাছ থেকে সুষমা। কবির কাছ থেকে সুশ্রুষা যেন বিরাট এই পৃথিবীর কাছ থেকে ... কবির কাছ থেকে ব্যথা ও বেদনার উপশম নিয়ে, কবির কাছ থেকে ভালোলাগা আর ভালো না-লাগার সম্বন্ধ রচনা করে করে, তার কাছে বসে থাকি, তার কাছ থেকে চলে যাই। অসংগতির মৃত্তিকায় বসে কবির নিবিড় চোখে ভৎর্সনা, আরাধনাও কবির কাছ থেকে।

কিন্তু এতকিছু যে কবির কাছ থেকে ক্রমশ পেতে যাই, সেই কবি যাবেন কার কাছে! তবুও কবি সমগ্র’র বিনিময়ে নিবেদিত হতে চান কার কাছে? কোন সে কবি! কেন তিনি চান! তার শব্দে-নৈঃশব্দে কেন সেই মৃদু-মধুময়, অসহ্য ও অসম্ভব হতে চান- কেন প্রাণ খুলে উজাড় হতে চান! কবির চারপাশে, প্রাত্যহিকীতে জড়িয়ে থাকা আরও যত অবলম্বন- সবকিছুর প্রতিই কবির ভ্রুক্ষেপহীন অথচ নিঃশর্ত দান তো চলেই। কিন্তু জীবনদৈর্ঘ্যের এই ষাট-পয়ষট্টিতে পড়েও কবি একাগ্র সেই অন্যঘরে, অন্যস্বরের দ্যোতিময় আকাঙ্ক্ষার কাছে কেন প্রবল সমর্পিত- কী তার আশ্চর্য মহিমা! কেমন তার মায়াবী বাহু- কেমন সে বাহুর আলিঙ্গন, যার কাছে কবির নিবেদন হতে পারে সমগ্র অর্জন!

তাহলে কবির সমগ্রজুড়ে এত অপ্রাপ্তির ফুল, এত নিবেদনগুচ্ছ! দৃষ্টির ঐন্দ্রজালিক কুহকে লোকালয়ে তার দেখা পান, অথচ প্রকাশ্যে তার স্পর্শ মেলে না। গোপনে হোক আর প্রকাশ্যেই হোক বাসনার সেই সুধাময়ীর কাছে মিলনের এই যে সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় নিমগ্ন কবির প্রকাশ, বিরহের দীর্ঘশ্বাসে তা ষ্পষ্ট হয় কোনো এক তরুণ বন্ধুর চোখের বিপরীতে।

শামসুর রাহমানের কবিতা ও অন্যান্য সৃষ্টি প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা করা যায়, ভবিষ্যতে তা হবেও। কিন্তু হুমায়ুন আজাদের নিঃসঙ্গ শেরপা ছাপিয়ে তা আপাতত কোনো মহত্ব দাবি করতে পারবে না। কবির সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের লেখা নিঃসঙ্গ শেরপা-কে আমি যুক্তি ও বোধে জারিত এক মেধাবী মানুষের বিস্ময়কর অবলোকন মনে করি- যা কবিরও বিস্ময়কর প্রাপ্তি। হুমায়ুন আজাদ তার শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা গ্রন্থে-ও প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘১৯৭৭-উত্তর তাঁর কবিতা এগোয় নি... ভরে উঠেছে নিজেরই পুনরাবৃত্তিতে...।’ কবি শামসুর রাহমান নিঃসন্দেহ সৌভাগ্যবান। কারণ বাংলাভাষার অনেক মহত্তম কবি ও শিল্পীর কপালে এমন জয়টীকা জীবিতকালে তো দূরের কথা, মরনোত্তর কালেও কেউ আঁকে নি। জীবিতকালে নিঃসঙ্গ শেরপার মত এত অসাধারণ সমালোচনা ও অভিনন্দন বাংলা কবিতায় কোনো কবির জীবনসমগ্রে ঘটে নি।

২১ অগাস্ট ২০০৬

আলফ্রেড খোকন : কবি