Full premium theme for CMS
তাপস সেন : কিছু স্মৃতি কিছু কথা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
৭৫তম জন্মদিনে প্রখ্যাত নাট্যনির্দেশক রুদ্রপ্রসাদ সেন গুপ্ত তাঁর ‘বাতিওয়ালা’ লেখায় লিখেছেন- This phenomenon named Taposh Sen is going to be 75 this August. May he continue to be live his active self for decades. We can’t afford to let this man retire even if he is 75. Without him Indian stage are dark and colourless, without him, calcutta’s cultural skyline is bound to be poorer.
তাপস সেন নেই, শুধু ভারতীয় থিয়েটার অন্ধকার নয়, বর্ণহীন নয়, বাংলাদেশের থিয়েটারও এখন অভিভাবকহীন, আলোর বৈচিত্র্যহীন। তাপস সেনকে কেউ বলেন- আলো ছায়ার মানুষ, কেউ বলেন- আলোক শিল্পী, কেউ বলেন- আলোক সম্পাতকারী, কেউ বলেন- আলোর জাদুকর। তাপস সেন নিজেকে বলতেন ‘আড়ালের মানুষ’। যে যে-নামেই ডাকুক না কেন, তাপস সেন থিয়েটারের ‘আলোকিত মানুষ’, ‘আলোকিত স্রষ্টা’, The enlightend one’. তাপস সেনকে ভালোবেসে, শ্রদ্ধায় অনেকে ‘জাদুকর’ বলেন। জাদুকরের মধ্যে ফাঁকি আছে, ভেলকি আছে, মানুষকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে অলৌকিক সব কাণ্ড করেন। তাপস সেন আলোর জাদুকর হয়তো, কারো কারো কাছে, কিন্তু তাঁর কাজের মধ্যে ভেলকি নেই, নেই কোনো ফাঁকি। তাপস সেন আড়ালে থেকেও আলোকিত মানুষ। দীর্ঘ ১১/১২ বছর কোলকাতায় থিয়েটার নিয়ে পড়তে গিয়ে অনেক গুণী মানুষের ছোঁয়া পেয়েছি, একসাথে কাজ করার সুযোগ ঘটেছে তাঁদের সাথে। তাঁর মধ্যে তাপস সেন অন্যতম। আলোর বাইরে, থিয়েটারের বাইরে ব্যক্তিগত তাপস সেনকে আমি এতো জেনেছি, চিনেছি যে, ভারত বা বাঙলা থিয়েটারের এই অসামান্য স্রষ্টাকে আমার মনে হতো আমার অতি আপনজন, বিদেশে আমার পরম অভিভাবক। এতো স্নেহপরায়ন দায়িত্বশীল, যারা ওঁর সাথে মিশেছেন, সঙ্গ পেয়েছেন, তারা বলতে পারবেন। এই ছিপ ছিপে সাদা-মাটা মানুষটা কত আন্তরিক। নিজে সব সময় জানতে-শিখতে চাইতেন, আবার নিজে যেটা জানতেন, সেটা জানাতেও বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করতেন না- প্রয়োজনে এঁকে, হাতে কলমে শিখিয়ে ছাড়তেন। ব্যক্তিগত তাপস সেন বামপন্থী, মার্কসবাদী। কিন্তু অন্যায় দেখলে নম্র-ভদ্র কম কথার মানুষটা যে কীরকম আগুনের মতো জ্বলে উঠতেন তা কোলকাতার পার্টির লোকেরা যেমন জানেন, তেমনি থিয়েটারের কর্মীরাও জানেন। যেটা তাঁর কাছে অন্যায় মনে হয়েছে, সেখানে তিনি বলতে দ্বিধা করতেন না। এমন সৎ, ন্যায় পরায়ণ আলোকিত মানুষ সমাজে খুব কমই দেখা যায়। ক্লাশের বাইরে তাপস দা’র সাথে আমার প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা ‘গান্ধার’ নাট্যদলে। আমার নাট্যশিক্ষক অসীত মুখাজ্জীর পরিচালনায় তখন নতুন নাটকের কাজ চলছে। সেই সময় ঐ দলে যোগ দিই। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের তখন বিকেল নাটকের সেট, পোষাক, অভিনয়ের সব কাজ শেষ। শুধু আলোর কাজ বাকি। অসীত দা’ বললেন- যেহেতু নাটক নিয়ে পড়াশোনা করছো, তুমি ব্যাকস্টেজ-এ আলোর কাজ আর সেট শিফ্টিং-এর কাজ করবে। তাপস দা’ বলেছেন- ব্যাকস্টেজ কাজ বোঝে এমন দু-তিনজন কর্মী লাগবে তাঁর। সাথে সাথে অসীত দা’র কথায় রাজি হয়ে গেলাম। প্রাতিষ্ঠানিক পড়া পড়তে গিয়ে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, সতু সেনের কাজের প্রসঙ্গ উঠলেই তাপস সেন ও খালেদ চৌধুরীর সৃষ্টিকর্মের কথা উঠবেই। থিয়েটারকর্মীদের কাছে, থিয়েটারের শিশিক্ষুদের কাছে তাঁরা কিংবদন্তীতুল্য। তাপস সেন আর খালেদ চৌধুরীরর সাথে কাজ করতে পারাটাই সৌভাগ্যের ব্যাপার। অসীত দা’র প্রস্তাবে তাই এক কথায় রাজি। তাপস সেনের আলোর কাজ আগেই দেখেছি। বলিদান, মাধব মালঞ্চি কইন্যা, শোয়াইক গেল যুদ্ধে, জোছনা কুমারী, চৈতালী রাতের স্বপ্ন, শঙ্খপুরের সুকন্যা, দর্পণে শরৎশশী, বেলা অবেলার গল্প, বেড়া, একা এবং একা ইত্যাদি নাটকে আলোর ব্যবহার দেখে আগে থেকেই মুগ্ধ ছিলাম। থিয়েটারের বাইরেও যাত্রা এবং কিছু বানিজ্যিক থিয়েটারেও তাপস দা’র আলোর কাজ দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল।
রবীন্দ্রভারতী থেকে এম. এ পাশ করার পর আমার ইচ্ছা হলো, তাপস সেনের আলোককর্ম নিয়ে গবেষণা করবো। আমার কথাটা আমার প্রিয় শিক্ষক গবেষক ড. বিষ্ণু বসুকে ব্যক্ত করতেই তিনি খুশি হলেন। তারপরই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. পবিত্র সরকারকে ইচ্ছাটা জানাতেই তিনি বললেন- খুব মূল্যবান কাজ হবে বাঙলা থিয়েটারের জন্য। তোমার গবেষণার কাজে যা যা দরকার হবে আমার সাথে যোগাযোগ করো। ব্যস, কাজে নেমে পড়লাম। ড. বিষ্ণু বসুর সহযোগিতায় অভিসন্দর্ভ-এর খসড়া করে তাপস দা’কে দেখালাম এবং আমার ইচ্ছার কথা জানালাম এবং তিনি রাজিও হলেন। তাপস দা’র সাথে কাজ শুরু হয়ে গেল। আমার অভিসন্দর্ভের খসড়া খাতাকে উনি বলতেন ‘খেরো খাতা’। ফোন করলেই বলতেন ওমুক নাটক আছে, তোমার খেরো খাতা নিয়ে চলে এসো। আমি চলে যেতাম। কোলকাতায় তাপস দা’র প্রায় সব নাটকের আলোর কাজই আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। দেখতাম আর তাঁকে প্রশ্ন করতাম। তিনি ছোট ছোট ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর কাজের ধরণ-ধারণ আমার কাছে স্পষ্ট করে তুলতেন। বাইরে সময় দিয়ে তৃপ্ত না হলে তাঁর বাসায় আমন্ত্রণ জানাতেন। সেখানেও ঘন্টার পর ঘন্টা কেবল কাজ আর কাজের ব্যাখ্যা চলতো। শেষ দিকে ওনার কাজের বেশ বৈচিত্র্যও চোখে পড়তো। আলো-আঁধারির মধ্যে তিনি রঙের রাসায়নিক মিশ্রণের ব্যাখ্যা দিয়ে আমাকে বোঝাতেন। খুব আড্ডাপ্রিয় এই তাপস সেন নাটক বোঝাতে বোঝাতে ব্যক্তিজীবনেরও অনেক প্রসঙ্গ ধরে আলাপ করতেন। থিয়েটার, ব্যক্তিজীবন সব মিলিয়ে কেমন যেন উচ্চতায় চলে যেত আমাদের আড্ডাটা।
অভিসন্দর্ভ রচনাকালে অনেকের কাজের প্রসঙ্গই আসতো। বিশেষ করে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত আর সতু সেনের কথা তো আসতোই। শম্ভু মিত্র আর উৎপল দত্তের কাজের ব্যাখ্যা তিনি দিতেন এভাবে- এল.টি.জি এবং বহুরূপী, এই দুটি দলের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দু’রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে। দুটোই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নাটকে আলোর প্রয়োগ নিযে শম্ভু মিত্র এবং উৎপল দত্তের ভাবনা ছিল দু’রকমের। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় শুরুর দিকে শম্ভু মিত্রের সঙ্গে কাজ করে অনেক জানা এবং ভাবার সুযোগ হয়েছে। ওঁর ভাবনাটা নাটকের অর্ন্তনিহিত মনস্তাত্ত্বিকতা নিয়ে। অনেক বেশি বিশ্লেষণমূলক। তাঁর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয় আনুষঙ্গিক আর সব কিছুকে। উৎপলের কাজের ধারা, রীতি-নীতি অন্যরকম। সে সম্পূর্ণ ছবি তৈরি করেছে। তাঁর নাটকে সে মানুষের চরিত্রের ওঠা-বসা-চলা, তার বিপুল কর্মকাণ্ডকে অর্কেস্ট্রার মত একসুরে বাঁধতে চেয়েছেন। অঙ্গার, তিতাস একটি নদীর নাম, কল্লোল- এই নাটকগুলো থেকে উৎপলের সঙ্গে কাজ করার শিক্ষা, ভাবনা আমাকে আনন্দিত করেছে। ... শম্ভু মিত্রের পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তবে মূল্যবান। উনি নিজে চোখে দেখে বুঝে নিতে পারতেন। বিশ্লেষণ করার এবং আলোর ভাষা বোঝাবার ক্ষমতাও ওঁর আছে। তাই তাঁকে সেই মতে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করতে আনন্দ হতো। (অন্তরঙ্গ আলো, পৃ: ৮৪)।
ওঁর সাথে যখন নাটক দেখতাম, তখন আড়চোখে তাকিয়ে খেয়াল করতাম, প্রতিটি মুহূর্তেই কোনো না কোনো অনুভূতি তিনি নিরবে প্রকাশ করতেন। সেটা কখনো মাথা ঝাঁকিয়ে, কখনো ভ্রু কুঁচকে, কখনো বা সোর্স অব লাইট খুঁজে। নাটক শেষে অনেক আলাপ হতো। একদিন জানতে চাইলাম, তরুণ নির্দেশকদের কাজের ব্যাপারে তাঁর মতামত। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন- ‘এখন আগের মতো বেশি নাটক দেখা হয় না। শরীর পারমিট করে না। তা ছাড়া কোলকাতার বাইরেও যেতে হয় বিভিন্ন কাজে। তবে একটা কথা বলা যায়, অনেকে ভালো নাটক করলেও ভালো অভিনয় কিন্তু খুব একটা চোখে পড়ছে না। আমার মনে হয় ইদানিং অভিনেতারা নাটকে কম সময় দেন। যার ফলে সংলাপগুলোকে মুখস্ত বুলির মতো শোনায়।
শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল দত্ত, শাঁওলী মিত্র, অনুসূয়া মজুমদার, মায়া ঘোষ, অশোক মুখোপাধ্যায়, অসীত মুখাজ্জীর মতো অভিনেতা কোথায় আজ? তবে কারো কারো অভিনয় দেখলে সম্ভাবনাময় মনে হয়। আরেকটা সমস্যা কোলকাতার থিয়েটারে প্রকট হয়ে উঠেছে, সেটা হলো টোটালিটির অভাব। সেট, লাইট, কস্টিউম, সঙ্গীত সব মিলিয়ে যে থিয়েটার, সেই থিয়েটারটা আজকাল চোখে পড়ছে না। সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে সব জায়গাতে। সেই দায় থেকে আমিও মুক্ত নই। এখানে আমারও ব্যর্থতা আছে। আমি অনেকের সাথেই কাজ করতে রাজি হয়ে যাই যার সাথে কাজ করা আমার উচিত না। কারণ, সে হয়তো লাইটের কিছুই বোঝে না। আমাকে বলে- দাদা আপনি যা ভালো মনে করেন, তাই করেন। তো এভাবে তো ভালো নাটক তৈরি হয় না। তাই না? মনে রাখতে হবে, নাটক হলো যৌথ শিল্প। এখানে একজনের কারিশমা অন্যজনকে ক্ষতি করতে পারে।’ আলো পরিকল্পনার ব্যাপারে তাঁর মতামত হলো - প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো নির্দিষ্ট প্রযোজনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনায় কিছু অস্পষ্টতা থাকে বটে, কিন্তু ক্রমশ আলোচনা এবং মহলার মধ্য দিয়ে পরিচালকের ধারণা এবং সেই বিশেষ দলের অবস্থা এবং ক্ষমতা অনুযায়ী আমিও আমার চিন্তাকে পরিস্ফুট করতে অগ্রসর হই। নাটকের ভাব এবং পরিবেশ সৃষ্টি করবার জন্য প্রধানত নাট্যপরিচালকের নির্দেশ মতই আমি আলো প্রক্ষেপনের ব্যবস্থা করি।- (অন্তরঙ্গ আলো, পৃ: ৫০-৫১)। আবার আরেক জায়গায় নির্দেশক ও আলোকশিল্পীর সমন্বয়ে নাটক কীভাবে শিল্প হয়ে ওঠে সেই প্রঙ্গে বলেছেন- মঞ্চে দর্শক কী দেখবে, কতটা দেখবে, কতক্ষণ দেখবে, কী দেখবে, কী দেখবে না, এর নির্বাচন করে যে নির্দেশক বা নির্দেশক-আলোক নির্দেশক দু’জনে মিলে।- (অন্তরঙ্গ আলো, পৃ: ১০০৩)। আসলে তাপস সেনের চিন্তার জগৎ এতো বি¯তৃত, শিল্পভাবনার প্রতি এতো আগ্রহ, প্রযুক্তিগতভাবে তিনি এতো শক্তিশালী, মঞ্চ স্থাপত্য, রঙ, অভিনয় কম্পোজিশন সম্পর্কে তাঁর প্রখর জ্ঞান, তার সাথে কল্পনা ও সৃজনীশক্তির প্রয়োগ করার অসীম ক্ষমতার কারণে অনুল্লেখযোগ্য নাটকও শিল্পের গুণাবলীর রূপ ধারণ করে বসতো আলোর বিচিত্রতায়। উনি যে মনে প্রাণে থিয়েটারের লোক ছিলেন তা আরেকটু প্রমাণ পাওয়া যায় এভাবে যে, কোনো দলে আলোক পরিকল্পনা করার সময় সেই দলের আর্থিক অবস্থাটা তিনি আগে জেনে তারপর পরিকল্পনা করতেন। এ-ব্যাপারটা অনেকের মধ্যেই ইদানিং অনুপস্থিত দেখা যায়।
পূর্বেই বলেছি, তাপস দা’র সাথে আমার প্রথম কাজ করার সুযোগ হয় ‘গান্ধার’র তখন বিকেল নাটকের মাধ্যমে। ঐ নাটকটি ছিল মাত্র দুটি চরিত্রের। তো একটা দৃশ্য আছে ডাঃ পার্থ স্যানাল (অসীত মুখাজ্জী) মঞ্চে ফাঁকা রাস্তায় ট্যাক্সি খুঁজছেন আর তখন তারই রুগী মিসেস উমা রায় (শিপ্রা লাহিড়ী। পরে অবশ্য বহুরূপীর দীপা দাশ ও সব শেষে ডলি বসুও এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন) মঞ্চে প্রবেশ করতেন। তাপস দা’ অসীত দা’কে বুঝিয়ে বলতেন যে, যখন বিদ্যুৎ চমকাবার শব্দটা আসবে অসীত দা’ যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে সংলাপ দেন। তারপর টিপ টিপ বৃষ্টির কয়েকটা ফোটা পড়তে শুরু করলে, ছাতাটা খুলতে বলতেন। তো সংলাপটা ছিল- ‘এই বুঝি বৃষ্টি নামলো। ...’। তাপস দা’ ঐ দৃশ্যটাকে বলতেন বৃষ্টির কারসাজি। এবং এই দৃশ্যটা করে তাপস দা’ খুবই তৃপ্ত ছিলেন। কিন্তু এখানে প্রসঙ্গটি টানলাম এজন্য যে, এই তৃপ্তিই তাপস দা’র শেষ তৃপ্তি ছিল না। প্রতিনিয়তই তিনি নিজের তৃপ্তিটাকে অতৃপ্ত করে রাখতেন। সে কথাটাই তাহলে বলি। যখন দেখলেন যে, বৃষ্টির দৃশ্যটি খুব ভালো হয়েছে, তখনই তিনি অসীত দা’কে বললেন যে, মঞ্চে যখন মিসেস উমা রায় ঢুকবেন এবং একই ছাতার নিচে দু’জন অবস্থান করবেন, তখনকার দৃশ্যটা একটু অন্যরকম করতে চান। অসীত দা’ সায় দিলেন। তখন তাপস দা’ আমাদের নেপথ্য কর্মীদেরকে লাইট ঢেলে সাজানোর নির্দেশ দিয়ে বললেন, ওমুক লাইটটি ওমুক জায়গায় যাবে, ওভাবে ঐ লাইট একেবারে মুখের উপরে ফেলবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর মঞ্চের দুই অভিনেতৃকে বললেন যে, যখন জোরে বৃষ্টি হবে, তখন অসীত দা’ আর শিপ্রা লাহিড়ী যেন তাদের পাজামা আর শাড়িটা একটু একটু করে গোড়ালীর উপরে তোলেন। ব্যস, তারপরই দৃশ্যটা শুরু হলে কিছুক্ষণ পর আমরা দেখতে পাই বৃষ্টি যত বাড়ছে মঞ্চে দেখা যাচ্ছে চরিত্রদ্বয়ের নিচে দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। এই আলো-আঁধারির পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি সব সময়ই চালিয়ে যেতেন। এবং তা চালিয়ে যেতেন কোনো পূর্ব ধারণা প্রসূত না। একেবারে মঞ্চের উপরকার বিভিন্ন সিচুয়েশনই তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতো।
আলো পরিকল্পক হিসেবে কাজ করলেও ক্রমেই তিনি হয়ে যেতেন ঐ দলের একজন কর্মীর মতো। নাটক, দল সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে একাকার করে ফেলতেন এই ক্ষণজন্মা মানুষটি। তাপস সেন কত নিষ্ঠাবান শিল্পী ও স্রষ্টা ছিলেন তা বিভাস চক্রবর্তীর লেখা থেকেই আন্দাজ করা যায়। স্মৃতিচারণে বিভাস চক্রবর্তী বলছেন- মহাকালীর বাচ্চা নাটকে শেষ দৃশ্যে দু’দিক থেকে দুটো স্পট হাতে করে দু’জনের মঞ্চে ঢোকার পরিকল্পনা ছিল। ঢুকলো-ও দু’জন। তাঁদের মধ্যে- কী আশ্চর্য, একজন তাপস দা’। (নাট্যসোপান, পৃ: ৯)। থিয়েটারের এই স্রষ্টা, মহান শিল্পী প্রয়োজনে তাঁর স্রষ্টার খোলস ফেলে সাধারণ নাট্যকর্মী হয়ে যেতে পারতেন, সহজে ভীড়ের মধ্যে মিশে যেতে পারতেন।
তাপস সেনের সৃষ্টিকর্মকে এই মুহূর্তে কোনো তত্ত্বে বা ফর্মুলায় ফেলা খুব কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন গবেষণা আর অনুসন্ধান। তাঁর মৌলিক সৃষ্টিকর্ম বা শৈল্পিক চেতনাসমৃদ্ধ আলোর বৈশিষ্ট্যগুলো তথাকথিত পুঁথিগত ফর্মুলায় পড়ে না। তিনি পর্যায়ক্রমে কাজ করতে করতে কাজের ধারার যেমন গতিপথ পরিবর্তন করেছেন, তেমনি আলোক তত্ত্বের একটা নিজস্ব স্টাইল বা দর্শনেও পরিণত করেছেন। সেই দর্শনকে আবিষ্কার করা দরকার, তিনি কীভাবে কোন পদ্ধতিতে বিজ্ঞানকে শিল্পস্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন তার অনুসন্ধান করা দরকার। তিনি যে মঞ্চে আলো-আঁধারির চিত্র আঁকতেন, তার কিছুটা অভিজ্ঞতার আভাস পাওয়া যায় ‘অন্তরঙ্গ আলো’ বইতে। থিয়েটারের বাইরেও তিনি এতো বিচিত্র মাধ্যমে কাজ করেছেন, যেমন- সিনেমা, যাত্রা, বানিজ্যিক থিয়েটার , নৃত্য-নাট্য, শিশুতোষ নাটক, এই সব মাধ্যমে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, ভিন্ন ভিন্ন আলোকমালা সৃষ্টি করেছেন, বিভিন্ন মাধ্যমের বিভিন্ন ঘরানা বা বিভিন্ন পটভূমিকে একই তত্ত্বে বা সূত্রে তুলে আনা সম্ভব নয়, গবেষণা ব্যতিরেকে। তবে তাঁর ঐতিহাসিক কর্মগুলোকে উৎসাহী ও অনুসন্ধানী কোনো গবেষক চেষ্টা করলে তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্বে নিয়ে আসতে পারেন। তাপস সেন তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে খুব বেশি লেখেন নি। সংগ্রাহক, গবেষক, নাট্য সমালোচক ড. বিষ্ণু বসু মহোদয় অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁর প্রকাশিত লেখা বিভিন্ন সেমিনারের বক্তৃতাগুলোকে একত্রিত করে ‘অন্তরঙ্গ আলো’ বইটি সম্পাদনা করে বাঙলা থিয়েটারে তাঁর অবদান ও অভিজ্ঞতাকে জানার সুযোগ করে দিয়ে আমাদের কিছুটা দায়মুক্ত করেছেন। তাছাড়া তাপস সেনের উপর ‘সোপান নাট্যপত্র’ আশিষ গোস্বামী সম্পাদিত পর পর দুটো সংখ্যা বের করেছেন, তা ছাড়া প্রণব কুমার দাশ ‘নাট্যরঙ্গ’ থেকে বের করেছেন ইংরেজিতে ‘অ ঝঃধমব ড়ভ ষরমযঃ ধহফ ংযধফব’ আর বাংলায় ‘আলো ছায়ার উপাখ্যান’। দুটো প্রবন্ধই মূলত স্মৃতিচারণমূলক বা তাপস সেনের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা। তারপরেও স্মৃতিচারণ থেকে অনেক অজানা তথ্য উদঘাটিত হয়েছে, জানা গেছে তাপস সেনের শিল্পভাবনা। শম্ভু মিত্র নেই, উৎপল দত্ত নেই, নেই বিজন ভট্টাচার্যও এবং এখন নেই আমাদের সবার প্রিয় তাপস সেনও। তাপস সেন নেই কিন্তু তঁদর অনেক সহযোদ্ধাই এখনো সক্রিয়, তাঁদের নামের সংক্ষিপ্ত তালিকা করলেও সেখানে নাম আসবে- খালেদ চৌধুরী, রুদ্রপ্রসাদ সেন গুপ্ত, কুমার রায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভা সেন, মনোজ মিত্র, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল ঘোষ, সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলকণ্ঠ সেন গুপ্ত, অরুণ মুখাজ্জী, সুরেশ দত্ত, রমাপ্রসাদ বনিক, ইব্রাহিম আল কাজী, নাসিরউদ্দিন শাহ, কনিষ্ক সেন, ফিরোজ খান, জয় সেন, মামুনুর রশীদ, মৃণাল সেন, অপর্ণা সেন, ভিশান্তারাম, তপন সিংহ, গৌতম ঘোষ, হেমা মালিনী, বৈজয়ন্তী মালা-দের মতো নাম। তাঁরা তাঁদের কাজের অভিজ্ঞতাগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতে উদ্যোগ নেবেন বলে আশা রাখি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই আলো-ছায়ার মানুষটিকে উপস্থাপন করার দায়িত্ব অতি অবশ্যই তাঁদের, যাঁরা তাঁর (তাপস সেন) কাজের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। আমি অকুণ্ঠভাবে তাঁর ভালোবাসা, স্নেহ আর সহযোগিতা পেয়েও তাঁকে নিয়ে, তাঁর প্রয়োগ-পদ্ধতির বিজ্ঞানভিত্তিক সূত্র আবিষ্কার করতে পারলাম না। আমার ‘খেরো খাতা’টা অসমাপ্তই রয়ে গেল। আশা রাখি খুব শীঘ্রই অসমাপ্ত খেরো খাতাটির সমাপ্তি টানবো।
কুন্তল বড়ুয়া : নির্দেশক ও নাট্য-শিক্ষক