Full premium theme for CMS
আড্ডা : নানা শিল্পী নানা মাধ্যম
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[থিয়েটার একটি যৌথ শিল্প প্রয়াস। নানা শিল্পের সমন্বয়ে নির্মিত হয় একটি নাট্য। কবিতা, কথা সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য- নানা মাধ্যম যখন যুক্ত হয় একটি নাট্যে, থিয়েটারে, তবেই যেন সৃষ্টি হয় একটি প্রকৃত দৃশ্যকাব্য। আমরা যারা থিয়েটার চর্চায় আছি বা থাকার চেষ্টায় আছি, তারা তাদের কাজে কতটুকু সমন্বয় ঘটাচ্ছি এই সব শিল্প মাধ্যমের? যদি না ঘটাই, তবে কী করে নির্মিত হবে একটি যুৎসই দৃশ্যকাব্যের? যদি যুৎসই দৃশ্যকাব্যই নির্মিত না হলো, তবে কেনই-বা দর্শক আসবে এই নাট্য দেখতে? এ-ধরনের নানা প্রসঙ্গ খুঁটিয়ে দেখার জন্য থিয়েটারওয়ালা গত ১২ মে ২০০৬, সোমবার আয়োজন করেছিল এক আড্ডার। সেই আড্ডার শিরোনাম ছিল- ‘থিয়েটারওয়ালার আড্ডা : নানা শিল্পী নানা মাধ্যম’। আড্ডায় অংশ নিয়েছিলেন এ প্রজন্মের দুজন করে কথাসাহিত্যিক, কবি, চিত্রশিল্পী এবং নাট্যজন। এরা হলেন- ইমতিয়ার শামীম, আহমাদ মোস্তফা কামাল, মুজিব মেহদী, আলফ্রেড খোকন, শাহীনুর রহমান, বিপুল শাহ, ড. বিপ্লব বালা ও আজাদ আবুল কালাম। থিয়েটারওয়ালা সম্পাদক হাসান শাহরিয়ারের সঞ্চালনে আড্ডাটি চলে ঘন্টা-তিনেক। পাঠকদের জন্য আড্ডাটি অনুলিখন করে ছাপা হলো এই সংখ্যায়। অনুলিখন করেছে, থিয়েটারওয়ালা’র সহকারী সম্পাদক সাইফ সুমন । আড্ডাটি সম্পাদক কর্তৃক সম্পাদিত]
হাসান শাহরিয়ার
সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাদের আড্ডা শুরু করতে যাচ্ছি। থিয়েটারকে বলা হয়ে থাকে সব শিল্পের একটি সমন্বিত রূপ। বর্তমানে আমরা যারা মঞ্চ নাটকের সাথে যুক্ত তারা এই সমন্বয়টা কতটুকু করতে পারছি বা আদৌ করতে পারছি কি না বা অন্যান্য শিল্প মাধ্যমে যারা কাজ করছেন তাদের সাথে মঞ্চনাটকের সম্পর্কটা আসলে বর্তমানে কোন পর্যায়ে আছে ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা আড্ডাটা চালাতে চাই। প্রথমেই আমি আহমাদ মোস্তফা কামালের কাছে একটি প্রশ্ন রাখছি- আপনি একবার বলেছিলেন যে, ১০/১২ বছর আগেও ঢাকার মঞ্চের এমন কোনো ভালো নাটক নেই যেটা আপনি দেখেন নি। কিন্তু বিগত অনেকগুলো বছরে আপনি কোনো নাটক দেখেন নি। কেন? আগের নাটকে আপনি কী পেতেন আর এখনকার নাটকে কী পান না?
আহমাদ মোস্তফা কামাল
এখন প্রত্যাশা মতো নাটক পাচ্ছি না বলে দেখছি না- ব্যাপারটা সে-রকম না। আমার মনে পড়ে ৯৭/৯৮ পর্যন্ত আমি নাটক দেখেছি। এবং কেবল ভালো নাটক দেখেছি তা না, যে-কোনো দলের নাটকই দেখতাম। অতি সম্প্রতি অহরকণ্ডল ছাড়া আর কোনো নাটক দেখা হয় নি। কিন্তু প্রতিদিনই পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে যাই যে, আজকে কোন নাটক আছে, বা কার নাটক আছে ইত্যাদি। এখন কেন নাটক দেখছি না- এর উত্তরে আসলে অনেক উত্তর এসে যাবে। যেমন, আমার মনে হয় জীবন যাপনের ধরনটাই জটিল হয়ে গেছে। এমন এক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে আছি আমরা যে, সময়টা বের করে নাটক দেখা হয়ে উঠছে না। দিন দিন এই জটিলতা বেড়েই চলেছে। আর আমাদের যে নাগরিক সমাজ, সেটা গড়ে উঠেছে খুবই বিকৃতভাবে, ভুলভাবে। এটা যদি আরেকটু অর্গানাইজডভাবে গড়ে উঠতো তাহলে হয়তো আমাদের এতটা জটিলতার মুখোমুখি হতে হতো না। আমরা সিনেমা হলে না গিয়েও সিনেমার তৃষ্ণাটা ঘরে বসেই মেটাতে পারছি, কিন্তু থিয়েটারের বেলায় তো এটা সম্ভব না। থিয়েটারের মজা পেতে হলে থিয়েটার দেখতে যেতে হবে। আমার থিয়েটারে না যাওয়ার আরেকটি কারণ আছে, সেটা হয়তো অতটা প্রকট না, সেটা হলো আমার কিছুটা অভিমান আছে। আমি আগে যখন নাটক নিয়মিত দেখতাম, তখন কিন্তু ওসব নাটক নিয়ে পত্রিকাতেও লিখেছি। সে-সময় আমি নাটকের লোকদের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছি, কথা বলতে চেয়েছি, কিন্তু দেখা গেছে কেউ আমার সাথে ভালোভাবে কথাও বলে নি। একমাত্র পাভেলভাই আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেছিলেন। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে যে, নাটকের লোকেরা নিজেদের তারকামূল্যের ব্যাপারে এত সচেতন যে, একজন সাধারণ দর্শকের সাথে কথা বলার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করেন না। তাই আমার মনে হয়েছে- নিজের পয়সা খরচ করে নাটক দেখে, নিজ থেকে লিখে পত্রিকায় দিচ্ছি, অথচ তার একটা ন্যূনতম প্রতিক্রিয়াও পাচ্ছি না, তাহলে নাটক দেখার দরকার কী, লেখার দরকার কী? আস্তে আস্তে আমি আসলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।
হাসান শাহরিয়ার
যে-কেউ ফ্লোর নিতে পারেন, কথা এগিয়ে নিতে পারেন।
মুজিব মেহদী
আমাকে প্রথমে প্রশ্ন করলেও বোধহয় আমি এরকমই উত্তর দিতাম। তবে আমাদের নাগরিক সমাজ ব্যবস্থাটা বিকৃতভাবে গড়ে উঠেছে কি না, এটা বোধহয় স্পষ্ট করে বলা যাবে না। তবে জীবন যে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে, সে-বিষয়ে কামালের সাথে আমি একমত। ঢাকা শহরটা এমন যে, ৫ কিলোমিটার রাস্তা যেতে আমার হয়তো একঘন্টা লেগে যায়। ফলে নানা বিরক্তির মধ্যে এটা আরেকটা বিরক্তির উৎপত্তি ঘটায়। ... আর আমি কিন্তু নিজেও এক-সময় নাটক করতাম, গ্রাম থিয়েটারের সাথেও যুক্ত ছিলাম। পরে চাকরিতে ঢুকেও শ্রদ্ধেয় বিপ্লব বালার সাথে কাজ করেছি। কিন্তু আস্তে আস্তে নানা প্রতিবন্ধকতার ফলে নাটক থেকে দূরে সরে গেছি। তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলে যখন নাটক হয়, সেটা দেখা হয়, কিন্তু বেইলী রোডে যাওয়া হয় না যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। ... আর নাটকের ব্যাপারে আমার একটা ধারণা এ-রকম যে- যে সমস্ত নাটক প্রসেনিয়ামে হয়, সেগুলো সাধারণ মানুষ টিকেট কেটে দেখবে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের লেভেলের মানুষই বোধহয় যেতে পারবে। এর নিচে যারা, মানে একেবারে খেটে খাওয়া মানুষ, তারা কিন্তু প্রসেনিয়ামে যাবে না। গণমানুষের কাছে নাটককে নিয়ে যেতে হবে। পথনাটক বাড়িয়ে দিতে হবে। এক সময় মুক্তধারা ওপেন স্পেসে হয়েছে, তাহলে এখনকার নাটকগুলো হতে পারবে না কেন? যদি পথে পথে নাটক করা যায়, তাহলে যে লোকগুলো মহিলা সমিতি বা শিল্পকলায় যেতে পারছে না, তারা সহজেই সেগুলো দেখতে পারবে এবং, ফলে, দর্শক বাড়বে।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি যে পথনাটক করার কথা বলছেন, তাতে দর্শক হয়তো বাড়বে বা নাটক সাধারণ মানুষের কাছে যাবে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে পথনাটক করতে গেলে নাটকে যে ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে হয়, যে ডিজাইনে করতে হয়, যে থিমের নাটক করতে হয়, তাতে নাটকের শিল্পমান ক্ষুণ্ন হয়। বেশিরভাগই স্লোগান নির্ভর হয়ে যায়। কিন্তু থিয়েটারে শিল্পমান তো একটা জরুরি বিষয়। থিয়েটারে যে অন্যান্য শিল্পের ছাপ থাকা উচিত, কাব্যময়তা থাকা উচিত, পেইন্টিংস-র ছাপ থাকা উচিত, সেটা রাখা যায় না। কেবল দর্শক বাড়লেই তো হবে না। নাটকের মান তো বাড়াতে হবে। তাই না?
মুজিব মেহদী
হ্যাঁ, রুচির ব্যাপারটা তো ভিন্ন। এখন যাত্রা মাধ্যমে যা হয় সেখানে শিল্পের কিছু থাকে না এটা তো বলা যাবে না। এখন নাটকটাকে গণমানুষের কাছে নিতে হবে, তা না হলে আমাদের সাথে তাদের দূরত্বটা ঘোচানো যাবে না।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা বোধহয় দর্শক বাড়া-কমা বা দর্শক কেন আসে না সেই জায়গায় জোর দিয়ে ফেলছি। আজকের আলোচনাটা করতে চাচ্ছি থিয়েটারের সাথে অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সম্পর্কটা কেমন হওয়া উচিত, সে-বিষয়ে।
আজাদ আবুল কালাম
হ্যাঁ, এ-রকম হতে পারে যে, যে থিয়েটার করছে সে সাহিত্যের কিছু জানছে কি না, বা একজন কবি চিত্রকলা বিষয়ে কতটুকু খোঁজ-খবর নিচ্ছে বা সাহিত্য যে করছে সে থিয়েটার সম্পর্কে কী ভাবে ইত্যাদি রকমের আলোচনা হতে পারে। অর্থাৎ বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের পরস্পরের ইন্টারেকশনটা কতটুকু সেটা জানা যেতে পারে।
বিপ্লব বালা
আরেকটা কথা বলা যেতে বোধহয় যে, এখন থিয়েটারে যে কাজ হচ্ছে, কবিতায় যে কাজ হচ্ছে, সাহিত্যে বা চিত্রকলায় যে কাজ হচ্ছে তাদের মধ্যে কোনো যোগ আছে কি না।
আজাদ আবুল কালাম
এখানে বলা হচ্ছিল সময়ের কথা, থিয়েটার দেখার জন্য সময় করে উঠতে না পারার কথা। আরেকটা ব্যাপার এসেছে যে নাট্যকর্মীদের উন্নাসিতার বিষয় আর এসেছে বর্তমান বাস্তবতার কথা। সময়ের বাস্তবতা মানে এখন আমরা নাগরিক হওয়ার জন্য যে উল্টা-পাল্টা কাজ করছি, সেটা। বিভিন্ন মাধ্যমের যোগাযোগ দু-ভাবেই হয়, পরস্পরকে ব্যক্তিগতভাবে চেনা এবং তাদের কাজের সাথে পরিচিত হওয়া। তো আমি কিন্তু এখানে যারা এসেছে সবাইকে চিনি। কারো কারো সাথে কথা কম হয়, আবার কারো কারো সাথে বেশি হয়। আমার মনে হয় এই চেনাটা আমি তৈরি করেছি আমার প্রয়োজন থেকেই। আমি থিয়েটার করবো, ফলে এই মাধ্যমের লোকগুলোর সাথে এবং তাদের কাজের সাথে আমার পরিচিত হতেই হবে, এটা আমি প্রয়োজন মনে করি এবং এই প্রয়োজন থেকেই কিন্তু তাদের সাথে আমার পরিচয়। যেমন শামীমভাইয়ের লেখার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে অনেক আগে। কামালভাইয়ের সাথেও পরিচয় কথায় কথায় আর বিপুলের কাজের সাথে অনেকদিন আগে থেকেই পরিচিত। আলফ্রেড খোকনের কবিতা পেলেই পড়ি, এমন কি কয়েকদিন আগেও কোনো একটা সাময়ীকিতে তার কবিতা পড়েছি। তো অন্যান্য শিল্পমাধ্যম এবং থিয়েটার শিল্পমাধ্যমের মধ্যে একটা বড় ধরনের পার্থক্য আছে। আমার যদি পড়ার ইচ্ছা থাকে আমি ঘরে বসেই গল্প, কবিতা পড়তে পারি। বইয়ের দোকানে গেলাম, অনেকগুলো বই কিনে বাসায় এসে পড়তে শুরু করলাম, ব্যস হয়ে গেল। বিপুলের হয়তো এক্সিবিশন হচ্ছে, একসাথে ৫০/৬০টা ছবি আমি ঘন্টাখানেক ঘুরলেই দেখে আসতে পারবো। সে-ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে, বছরে একবার ওর প্রদর্শনী দেখলেই ওর সম্পর্কে আমার জানা হয়ে যাবে। কিন্তু থিয়েটারের ক্ষেত্রে বাসায় বসে কিছু করা যাচ্ছে না। বড় জোর থিয়েটারওয়ালা পড়া যেতে পারে হাঃ হাঃ ... আসল কথা হচ্ছে থিয়েটার দেখার তাগিদটা আমি অনুভব করি কিনা?
হাসান শাহরিয়ার
এটা তো আপনি আপনার কথা বললেন, কিন্তু আপনার কি মনে হয় এখনকার নাট্যকর্মীরা একই তাগিদ অনুভব করে যে, অন্যান্য শিল্পমাধ্যম থেকে যদি কিছু না নেয়া যায় তাহলে ভালো থিয়েটার হবে না?
আজাদ আবুল কালাম
সবাই মনে করলেও কাজের বেলায় করছে না। অন্যান্য মাধ্যমের সাথে পরিচিত হতে গেলে তো সেগুলো পড়তে হবে ... তো আমার মনে হয় না, এখনকার কেউ ওভাবে সময় দিতে চায়। তবে কেউ কেউ তো নিশ্চয় আছে যারা জেনে-শুনে কাজটা করতে চায়। আরেকটা দিকও আছে, এখন কিন্তু অন্যান্য মাধ্যমের লোকেরা থিয়েটার দেখে না। আমার কিন্তু খেয়াল আছে- এক সময় শওকত আলী নাটক দেখতেন বা রফিক আজাদ নাটক দেখতেন।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি অন্যান্য মাধ্যমের সাথে পরিচিত হয়েছেন নিজের প্রয়োজনে, নিজের কাজকে ঋদ্ধ করতে। কিন্তু একজন কবি যদি মনে করে যে, যে-মানের থিয়েটার এখন হয় তা দেখে তার ঋদ্ধ হবার মতো কিছু নেই, সেখানে আপনার কী বলার থাকবে?
আজাদ আবুল কালাম
সেখানে আমার হয়তো কিছু বলার নেই, কিন্তু আমার মনে হয় কবি যে কেবল থিয়েটার দেখছে না তা না, সে হয়তো বর্তমানের চিত্রকলা বিষয়েও তেমন আগ্রহ দেখায় না বা চিত্রশিল্পী হয়তো কবিতা তেমন একটা পড়ে না ... মানে অবক্ষয়টা বোধহয় সব ক্ষেত্রেই হয়েছে।
বিপুল শাহ
এখানে একটা ব্যাপার আমি বলতে চাই যে, ঢাকার দর্শকদের কিন্তু একটা মেন্টাল সেট-আপ আছে যে- আমি ওখানে যাবো এবং নাটক দেখবো। কিন্তু মফস্বল শহরে যে নাট্য আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সেটার পেছনে কিন্তু রাজনৈতিক ব্যাপার একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। অনেক জায়গায় দেখা গেছে রাজনৈতিক প্রয়োজনেই দলগুলো সেখানকার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে উৎসাহিত করেছে। তাদের হয়তো কোনো নর্মাল গ্যাদারিং আছে, শেষে দেখা গেল একটা নাটক হলো বা গান হলো বা কবিতা আবৃত্তি হলো। ফলে মফস্বল শহরে বোধহয় এই আন্তঃসম্পর্কটা বা ইন্টারেকশনটা টিকে আছে।
বিপ্লব বালা
কার সাথে ইন্টারেকশন, রাজনীতির সাথে?
বিপুল শাহ
সবার সাথেই। দেখা গেছে একই মঞ্চে সব মাধ্যমের শিল্পীদেরই আগমন ঘটছে। আবার ছোট শহর হওয়াতে সবাই সবার সাথে আড্ডাও দিচ্ছে। ফলে ইন্টারেকশনটা হচ্ছে। ঢাকার বেলায় কিন্তু এটা হচ্ছে না।
হাসান শাহরিয়ার
খোকনভাই কিছু বলুন।
আলফ্রেড খোকন
কামালভাই এবং অন্যান্য যারা কথা বললেন, তাদের সব কথার সাথে আমি একমত নই। থিয়েটারের সাথে অন্যান্য মাধ্যমের বিচ্ছিন্নতার কথা বলা হয়েছে। আমি বলতে চাই এই বিচ্ছিন্নতা কিন্তু আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মতাদর্শ আমাদের উপর চাপানো হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে। পরিবার বলি বা সমাজ বলি বা রাষ্ট্র বলি, সব জায়গাতেই কিন্তু বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়ে গেছে। আমরা যদি ত্রিশের দশকের কল্লোল যুগের দিকে তাকাই, তাহলে কী দেখি? দেখি যে, তখন যারা কবিতা লিখতো, যাঁরা ছবি আঁকতো, যারা নাটক করতো তাঁরা সবাই একই টেবিলে আড্ডা দিত। এই কালচার কিন্তু ষাটের দশকেও ছিল।
আজাদ আবুল কালাম
নির্মলেন্দু গুণের স্মৃতিচারণে পড়লাম যে, উনি যে বাসাটয় থাকতেন সেখানে কবি, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী সবাই এক সাথে থাকতেন।
আলফ্রেড খোকন
হ্যাঁ, আর এখন এটা আপনি কল্পনাই করতে পারবেন না। আমাদের দেশে অনেক কিছুর সাথে কিছু কিছু মতাদর্শও আমদানী করা হয়েছে। সো-কল্ড একাডেমিক শিক্ষিত লোকজন এই মতাদর্শগুলোকে চাপিয়ে দিচ্ছে আমাদের উপর বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে। ফলে আমাদের সহজাত দর্শনবোধ নিয়ে আমরা কনফিউজড বলে আমি মনে করি। যার ফলে অনেক বড় বড় দর্শন আমদানী হয়েছে কিন্তু লালনের দর্শনের কোনো খবরই রাখা হয় নি।
নাগরিক ব্যস্ততার কথা বলা হলো। আমার কথা হলো একটা সোসাইটিতে বেশি লোক তো শিল্প-সাহিত্যের সাথে জড়িত থাকবে না। তো আমাদের এখানে যারা এভাবে জড়িত আছি তারা কী করছি? প্রতি সন্ধ্যায় কোথাও না কোথাও আড্ডা দিচ্ছি। ঘন্টার পর ঘন্টা পার করছি আর চায়ের কাপে তুফান তুলছি। অথচ কোনো এক সন্ধ্যায় বেইলী রোডে বা শিল্পকলায় গিয়ে মঞ্চনাটক দেখবো সেই সময়টা হচ্ছে না। এটা আমি মনে করি একটা বাজে অজুহাত। যারা বলছি তাদের কাছে ১০০ টাকা খুব বেশি টাকা না। সময় বের করাটাও কষ্টের বলে আমি মনে করি না।
হাসান শাহরিয়ার
আমাদের এখানে যদি বছরে ১৫টি নাটক মঞ্চে আসে আর সব ক’টা নাটকই যদি কেউ দেখে, তাহলেও তার কিন্তু মাত্র ১৫টি সন্ধ্যা ব্যয় হবে। ৩৬৫ দিনে ১৫টি সন্ধ্যা বের করা যাবে না, এতো ব্যস্ততা বোধহয় এখনও কারো হয়ে ওঠে নি।
আলফ্রেড খোকন
হ্যাঁ, তার মানে নাটক দেখার আগ্রহটাই তৈরি হয় নি। আমি যদি কোথাও আড্ডাই দিতে পারি তাহলে নাটকও দেখতে পারবো। আসলে ব্যস্ততা বা অন্যান্য কথাবার্তা মূল বিষয় না, মূল বিষয় হলো আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি পরস্পর থেকে। দৃষ্টিভঙ্গিটাই পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন। আর এটা সবচেয়ে বেশি প্রকট হলো থিয়েটারকর্মীদের বেলায়। থিয়েটার যেহেতু সব শিল্পমাধ্যমের মিলন দাবি করে, সেহেতু তাদের দায়িত্বটাও বেশি বলে আমি মনে করি। সে-ক্ষেত্রে তারা কিন্তু বেশ পিছিয়ে আছে। এখনকার এবং আগের প্রজন্মের কোনো নাট্যকর্মীই সমসাময়িক কবিতা, গল্প বা চিত্রকলার সাথে পরিচিত না। তারা কবি বলতে বোঝে শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ বা খুব বেশি হলে নির্মলেন্দু গুণ। গল্পকার বলতে বোঝে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর শওকত আলী, চিত্রশিল্পী মানে তাদের কাছে কাইয়ুম চৌধুরী ... এভাবে তো হবে না। এখন বর্তমান সময়ে, বর্তমান প্রজন্মের কবিদেরকে জানতে হবে, সাহিত্যিকদের জানতে হবে, জানতে হবে এ-সময়ের চিত্রশিল্পীদের। সে-ক্ষেত্রে নাটকের লোকজন একটু উন্নাসিকই বলা যায়।
বিপ্লব বালা
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, যে-কোনো উৎকর্ষতার জন্য চাই এক্সপেরিমেন্ট, নিরীক্ষা। এই নিরীক্ষা চালানো কিন্তু অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের চেয়ে থিয়েটারে একটু বেশিই কঠিন। নাটককে তার সমসাময়িক দর্শক ধরতে হয়। কবি বা সাহিত্যিক বা চিত্রশিল্পী কিন্তু সমসাময়িকতার উর্ধে উঠতে পারে। যেমন- একটি কবিতা বা গল্প বা চিত্রকর্মের শিল্পমূল্য অনেক বছর পরও আবি®কৃত হতে পারে। কিন্তু থিয়েটার একেবারে বর্তমান দর্শকের সাথে কথা বলে। ফলে অনেক বছর পর শিল্পমূল্য আবি®কৃত হবে সেই চিন্তা থেকে থিয়েটার করা যায় না। তাই এখানে এক্সপেরিমেন্ট কম হয় বা কম করা যায়।
আজাদ আবুল কালাম
হ্যাঁ, গল্পকারের প্রয়োজন হয় মস্তিষ্ক, কাগজ আর কলম। এমনও হতে পারে এটা লেখার ৫-১০ বছরে গল্পটি কেউ পড়েও দেখে নি। থিয়েটার কিন্তু নিত্য ব্যবহার্য উপকরণের মত। আজকে লিখেছি, আজকের দর্শকদের জন্য লিখেছি। সুতরাং এখনই তাকে মঞ্চে হোক বা পথে হোক, নামাতে হবে।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
তাৎক্ষণিকভাবেই আপনার দর্শক লাগবে এবং তাদের সাথে কমিউনিকেট করা লাগবে- এটা থিয়েটারের একটা বড় প্রয়োজন। তো সেই এ্যাপ্রোচটা কি আপনারা দর্শকদের করেন? অর্থাৎ একজন নাট্যকর্মী একজন লেখককে, কবিকে, চিত্রশিল্পীকে বা গায়ককে কি এ্যাপ্রোচ করেন যে- আসেন ওমুক দিন আমাদের নাটক আছে? যেমন পাভেলভাই (আজাদ আবুল কালাম) আমাকে একদিন বললেন তার সার্কাস সার্কাস নাটকটি আছে ওমুক দিন, যেন চলে যাই। আমি গিয়েছি। আবার সেদিন কবিরভাই বললেন- আমাদের নাটক আছে অহরকণ্ডল, চলে আসেন, আমি গিয়েছি। তো এমনভাবে কি আপনারা সবাইকে এ্যাপ্রোচ করেন? আমার মনে হয় করেন না। আপনাদের সাথে দর্শক কথা বলতে চাইলে আপনারা কথা বলেন না। এখন যে আপনারা আমার সাথে কথা বলছেন, সেটা এই কারণে যে, আমি এখন আহমাদ মোস্তফা কামাল হয়ে উঠেছি, বা সে আলফ্রেড খোকন হয়ে উঠেছে। আমাদের যদি এই পরিচয়টা না থাকতো আপনারা হয়তো বসতেন না। আমি বলতে চাইছি, কোনো পাঠক যদি আমাকে রাস্তায় বলে যে, সে আমার ওমুক গল্পটা পড়েছে, তাহলে আমার আনন্দের সীমা থাকে না। যত ব্যস্ততাই থাকুক আমার ইচ্ছা হয় তার সাথে ১০ মিনিট আলাপ করি। কিন্তু কোনো দর্শক যদি আপনাদেরকে বলে যে, সে ওমুক নাটকটি দেখেছে, আপনারা সেভাবে রিয়েক্ট করেন না। মনে করেন যে, এটা তো স্বাভাবিক। আসলে আপনারা আপনাদের তারকামূল্যের ব্যাপারে বেশি সচেতন। আপনাদের যে উন্নাসিক বলা হচ্ছে, সেটা এ-কারণেই।
আজাদ আবুল কালাম
কারো কারো ক্ষেত্রে এই অভিযোগ হয়তো আনা যাবে, কিন্তু সবার বেলায় তো নয়-ই। প্রকৃত অর্থে যে থিয়েটার করতে চায়, সে কিন্তু আপনাদের সাথে মিশতে চাইবে।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
আমি কিন্তু অনুমান থেকে কথা বলছি না। একেবারে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কথাটা বললাম।
হাসান শাহরিয়ার
আপনিও কি এখন পাভেলভাই বা বিপ্লব দা’র সাথে বসেছেন তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বলে?
আহমাদ মোস্তফা কামাল
না, একেবারেই না। আমি যখন নাটক দেখতাম, কোনো বাছ-বিচার করতাম না। সবার নাটক দেখতাম এবং সবার সাথেই কথা বলতে চাইতাম।
হাসান শাহরিয়ার
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তো একেবারে ভিন্ন। কেউ যদি রাস্তায় বলে যে, সে আমার ওমুক নাটকটি দেখেছে, ওমুক অভিনয়টা দেখেছে, তাহলে তো আমার আনন্দের সীমা থাকে না। মঞ্চে কিছু দেখে আবার রাস্তায় চিনে নাকি?
আলফ্রেড খোকন
হ্যাঁ, শাহরিয়ার ভাইয়ের কথাটাও সত্য, কিন্তু তা একেবারেই সাম্প্রতিক। নাটকের লোকদের আরেকটা সমস্যা হলো সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। এক্ষেত্রে কোলকাতার নাট্যকর্মী আর বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি যে, কোলকাতায় নাটক দেখার পর আলাপ করতে করতে যদি প্রশংসা করি, তাহলে বলে যে- দুর্বলতাগুলো বলুন। একেবারেই শিল্পীসুলভ আচরণ। আর আমাদের দেশে যখন কিছুটা দুর্বলতার কথাও বলেছি, দেখেছি যে তারা ক্ষেপে যান। আমার মনে আছে কয়েক বছর আগে আমাকে এক নাট্যদল তাদের একটি নাটক দেখার আমন্ত্রণ করেছিল। নাটক দেখার পর আবার অনুরোধও করেছিল যে- তুমি একটা রিভিউ লেখ। তো আমি টেবলয়েড সাইজের পত্রিকার প্রায় একপৃষ্ঠা জুড়ে একটা রিভিউ লিখলাম। ওটাই ছিল আমার প্রথম নাট্য-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। তো সেখানে ভালো-মন্দ সব বিষয়গুলোকেই উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। ছাপার পর দেখা গেল সমালোচনার জায়গাগুলো দলের লোকেরা গ্রহণই করতে পারলো না। বরং আমাকে বলা হলো যে- ভালোভাবে না দেখে না বুঝেই একটা কিছু লিখে দিলা? ... তো তারপর আর কখনো কিছু লিখতে ইচ্ছা করে?
আহমাদ মোস্তফা কামাল
তা-ও তো তুমি সৌভাগ্যবান যে, একটা রিয়েকশন পেয়েছ। আমি তো সেটাও পাই নি। ঈর্ষা নাটকটা আমি কমপক্ষে ২০ বার দেখেছি। দেখেছি এই কারণে যে, মাত্র ৭ টি সংলাপ দিয়ে ২ ঘন্টা কীভাবে দর্শক ধরে রাখা যায় সেটা দেখার জন্য। আমি নাটকের পর সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে কথা বলতে চেয়েছি, শেয়ার করতে চেয়েছি অথচ শেয়ার করতে পারছি না কারো সাথে। কী ভয়াবহ না? এতে আমার অভিমান হতে পারে না?
হাসান শাহরিয়ার
আমি শাহীন ভাই-র কাছে জানতে চাই, এখানে যারা উপস্থিত আছেন, অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের, তাদের মধ্যে একমাত্র শাহীন ভাই-ই আছেন যিনি ঢাকার একটি প্রধান নাট্যদলের সাথে জড়িত। তো আমি আপনার কাছে জানতে চাই, একজন চিত্রকলার লোক হিসেবে ঐ দলটিতে থেকে আপনার অভিজ্ঞতা কী? আপনি কী আপনার শিল্পের জায়গাগুলো নিয়ে থিয়েটারে শেয়ার করার সুযোগ পেয়েছেন?
শাহীনুর রহমান
আমার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা হয়, সেটা হলো ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে। আমি ঠিক আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে আগ্রহ প্রকাশ করি না, যদি না অন্য পক্ষ আগ্রহ দেখায়। আমার কম-বেশি করে আসলে অনেক নাটকই দেখা হয়। কিন্তু কোনো নাটকই সে-ভাবে আমার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না। আমি আশাহত হই, আশাহত হই নানা কারণে। আমার কিছু ভিশন আছে, ভাবনা আছে থিয়েটার থেকে কিছু প্রত্যাশা আছে, সব মিলিয়ে আমার প্রত্যাশা পূরণ হয় না। ডিজাইনে অনেক সময় আমি রিপিটেশন দেখি। ভিন্ন ভিন্ন নাটক, কিন্তু ডিজাইনটা দেখছি অনেকটা কাছাকাছি। এটা বোধহয় এজন্য যে, দল সাধারণত নিজের লোক দিয়ে ডিজাইন করায়, এবং সেই ডিজাইনারের ভেরিয়েশন আনার ক্ষমতা কম। অনেক সময় দেখি মঞ্চে একটা লাঠি পড়ে আছে, কিন্তু ওটার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি চিত্রশিল্পী হিসেবে দলে সে-ভাবে আমার চিন্তার কথাগুলো কখনো বলি নি। সেটা এমনও হতে পারে যে, আমি বুঝেছি যে, আমার সাথে ঠিক সেভাবে কেউ শেয়ার করতে আগ্রহী হবে না।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি শেয়ার করতে চেয়েছেন?
শাহীনুর রহমান
না, আমি চাই নি আবার কেউ আমাকে শেয়ার করতে ডাকেও নি। আর তাছাড়া নাটকটাকে আমার কেবল হাততালি পাওয়া বা জ্বলজ্বলে কিছু করার বাইরের জিনিস মনে হয়। সেই লক্ষ্যে যদি কেউ পৌঁছতে না চায়, তাহলে আমি এব্যাপারে কথাই বলবো না। আর আমার কাছে মনে হয়েছে, ঢাকার নাট্যজনেরা এক্সপেরিমেন্ট একেবারে করতেই চায় না। এক্সপেরিমেন্টে ভয় পায়। একজন কবি টেবিলে বসে টিকটিকিকে বিল্ডিং খাওয়ালো, মাছ উড়ালো আকাশে ইত্যাদি সব মিলিয়ে একটা কিছু তৈরি করার ফলে আমার পড়ে এক-ধরনের অনুভূতি হলো অন্যের হয়তো অন্য রকম হলো ... কিন্তু এখানে নাটক দেখার পর সবাই একই অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে যায়। নাটক এখনো কাহিনীর বাইরেই যেতে পারলো না। তারা কেবল দেখে, স্টোরি লাইন কত স্মার্ট, নায়ক কত বোল্ডলি কথা বলছে ইত্যাদি। কিন্তু যদি কোনো বিমূর্ত ফিলিং তৈরি করা যেত যে, একেক দর্শক একেক অনুভূতি লাভ করবে, তাহলে সেটা আরো ভালো হতো।
বিপ্লব বালা
এখানে একটা কথা বোধহয় বলা যায়, এখানে মাধ্যমগতভাবে একটা মুশকিল আছে। এটাও কিন্তু ভাবতে হবে। ইরাকের যুদ্ধ, চিত্রকলায় কয়েকটি রেখা দিয়ে যত সহজে করা যায়, আমরা একটা ফিগার করতে গেলে সেটা ভীষণ জটিল ব্যাপার হয়ে যায় না?
শাহীনুর রহমান
কেন, সেটা তো আরো জমজমাট হওয়ার কথা।
আলফ্রেড খোকন
আপনারা যারা নাটক করছেন, তারা থিয়োরিটেক্যালী প্র্যাকটিস করে নাটক করছেন। কিন্তু যারা দর্শক তারা কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। এই যে একটা গ্যাপ, এটা কিন্তু আপনাদের নাটকে আছে।
বিপ্লব বালা
সেটা আপনার কবিতার বেলাতেও আছে। আপনার পাঠক কী সব বুঝে তারপর কবিতা পড়ে? চিত্রকলা বুঝে তারপর এক্সিবিশনে যায়?
আলফ্রেড খোকন
একজন পাঠকের কিন্তু জানার দরকার নেই যে, কবিতাটি অক্ষরবৃত্তে নাকি ছন্দবৃত্তে। আপনি ইউরোপীয় ফর্মে এখানকার দর্শকের সামনে নাটক করছেন, কিন্তু ওটার সাথে তো দর্শকের পরিচয় নেই। আপনি বারবার পাশ্চাত্যের কাহিনীকে উপস্থাপন করে বলছেন, এদেশীয়ভাবে উপস্থাপন করছেন- তাহলে তো দর্শকের সাথে বিচ্ছিন্নতা হবেই। আমাদের হাজার হাজার কাহিনী আছে ...
বিপ্লব বালা
না, বাইরের টেক্সট নেয়ার পেছনে কারণ হলো ভালো সাহিত্য নিয়ে কাজ করা। আমাদের দেশীয় গল্প নিয়েও প্রচুর নাটক হয়েছে। এবং ভালো নাটক হয়েছে।
আলফ্রেড খোকন
আমাদের এখানে অনুবাদ করে যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে, সেগুলো মনে হয়েছে আমি এখানে বসে বাংলায় একটি ইউরোপীয় নাটক দেখলাম।
বিপ্লব বালা
কিন্তু অনুবাদ নাটকও যে সাংঘাতিক প্রাসঙ্গিক হয়, রিলেভেন্ট হয় সেটা আপনাকে মানতে হবে। আমাদের এখানে কোপেনিকের ক্যাপ্টেন হয়েছে, গ্যালিলিও হয়েছে, এগুলো কিন্তু একেবারে আমাদের নাটকই মনে হয়েছে, অথচ এগুলো অনুবাদ নাটক। গডোর প্রতীক্ষা-র মতো নাটক কী করে কমিউনিকেট করেছিল ভাবুন তো! গডো তো ভীষণ মুশকিলের জিনিস। তারপরও কোথাও না কোথাও এটার বিষয়বস্তু আমাদের সাথে মিলে গেছে ... এসব ব্যাপার কিন্তু খুব সুক্ষ্ণ। অনুবাদ নাটক মানে এই না যে, বিদেশি নাটকটা কেবল বাংলায় দেখলাম। আমার নাটক হয়ে ওঠে বলেই আমরা দেখি, তাই না?
হাসান শাহরিয়ার
শামীম ভাই বোধহয় কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন।
ইমতিয়ার শামীম
আমি শাহীন ভাইয়ের একটা কথা ধরে বলতে চাই যে, নাটককে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া ব্যাপারগুলো বলে বলে কিন্তু নাটককে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।
আজাদ আবুল কালাম
মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া মানে কী? এখন যারা দেখছে তারা কারা?
ইমতিয়ার শামীম
আমি গণমানুষের কথা বলছি।
আজাদ আবুল কালাম
গণমানুষের তো নিজের সম্পদ আছে। আপনার শহরে বসে তৈরি করা জিনিস দেখার জন্য সে বসে নেই। তার বিশাল রতœভাণ্ডার আছে, তার পালাগান আছে, নিজস্ব থিংকিং আছে, ফিলোসফি আছে, সে আপনার জিনিস দেখার জন্য বসে নেই।
ইমতিয়ার শামীম
কিন্তু থিয়েটারের লোকজনের ভেতরে ভেতরে একটা ইচ্ছা ছিল যে, সে গণমানুষের জন্য নাটক করবে। এর ফলে কিন্তু আপনা থেকে যে উন্নত দর্শক শ্রেণী তৈরি হওয়ার কথা ছিল, সেটা কিন্তু হয় নি।
হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু আসলে আমরা যারা নাগরিক থিয়েটার করছি, আমরা কি থিয়েটারটাকে গণমানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য করছি?
বিপ্লব বালা
না, একটা সময়ে কথাটা উঠেছিল।
আজাদ আবুল কালাম
একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সবকিছুর মধ্যেই মানুষের কাছে যাওয়া, গণমানুষের কাছে যাওয়া ...
বিপুল শাহ
এই যাওয়াটার মধ্যেই বড় সমস্যা। আমরা যত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, ততই বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। আমার কাছে যেটা মনে হয় ... যদিও আমি সরাসরি নাটকের লোক নই, চিত্রকলার লোক, আমি মফস্বল শহর থেকে এসেছি, আমি জানি মফস্বল শহরের যে কালচারটা ছিল ... মানে পাভেল যেটা বলছিল যে, ওদের নিজস্ব পালাগান আছে বা অন্যকিছু আছে, সেগুলো কিন্তু এখন বাস্তবে নেই, ইতিহাসে আছে।
মুজিব মেহদী
না, না, আমি আমার নেত্রকোণার খবরই জানি যে, ওখানে অন্তত ২০টি পালার নিয়মিত প্রদর্শনী হয়।
বিপুল শাহ
সেটা হয়তো হয়, কিন্তু বাস্তবে সেখান থেকে, সেই রুটলেভেল থেকে যখন কুদ্দুস বয়াতিদের তুলে আনা হয় তখন কিন্তু তারা রুটলেস হয়ে পড়ছে।
মুজিব মেহদী
হ্যাঁ, যাদের নিয়ে আসা হচ্ছে শহরে, তাদেরকে সর্বনাশ করা হয়েছে।
বিপুল শাহ
এই যে নিয়ে আসা এবং নিয়ে যাওয়া, এর ভেতর দিয়েই কিন্তু বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে ফেলছি। ঢাকায় যারা নাটক করছে, তাদের মানসিক বিচ্ছিন্নতাও কিন্তু আছে। আমি ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল দেখে নাটকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তো তখন যারা নাটক করতো, তাদেরকে যদি বলা হতো মফস্বলে ওয়ার্কশপ করতে যেতে, তারা রাজি হয়ে যেতেন। এখন কিন্তু যান না। এখন কেবল কল শো’তে যান। নাটকের বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ হলো, নাটকের লোকেরা এখন ব্যবসায়িক প্রবণতার দিকে, বৈষয়িক হওয়ার দিকে ঝুঁকছেন। একটা কথা বুঝতে হবে, গণমানুষের কাছে যাওয়া মানে কিন্তু নাটক নিয়ে যাওয়া না, নাটক সম্পর্কে তাদেরকে ইন্সপায়ার করা। মফস্বলে যে কাজগুলো হয় সেটাকে মেনে নেয়া। তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা। থিয়েটারের লোকজন কিন্তু ভাবছেন, তারা ঢাকায় বসে ফর্মুলা তৈরি করে দেবেন, এবং সেটাকেই নাটক বলতে হবে। হয়তো-বা অন্যান্য শিল্পমাধ্যমেও এই মোড়লীপনাটা থাকতে পারে, কিন্তু থিয়েটারে থাকলে সেটা বেশি বিপদজনক। কারণ, থিয়েটারকে কেবল বিভিন্ন শিল্পের সাথে সমন্বয় রাখলেই চলবে না, বিভিন্ন মানুষের সাথেও সমন্বয় রাখতে হবে। সেটা কিন্তু হচ্ছে না। আমি একটা উদাহরণ দিযেই বলতে পারি- আগে নাটকে নির্দেশকের সাথে অন্যান্য ডিজাইনারদের যে সমন্বয়টা হতো এখন তো সেটা হয়-ই না। লাইট, সেট, কস্টিউম ডিজাইনার আর নির্দেশক, সবাই কেমন যেন আলাদা আলাদাভাবে নাটকে উপস্থিত থাকেন। এটা নাটক দেখলেই বোঝা যায়। তো যাদের নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, তারা তো সবার কাছ থেকেই বিচ্ছিন্ন হবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
আজাদ আবুল কালাম
বিপুলের কথা প্রসঙ্গেই বলি, আমাদের আরেকটা সংকট হলো, সব ডিজাইনার দলের ভেতরেই থাকে, দলের লোকদের দিয়েই সব করানো হয়। যারা থিয়েটার করছি, এমন তো হতেই পারে যে, সেট ডিজাইনের ক্ষেত্রে একজন চিত্রকলার লোক আনা হলো, কস্টিউমে প্রফেশনাল কাউকে আনা হলো বা নাটক লেখার ব্যাপারে কোনো কবি’র আশ্রয় নেয়া হলো ... মানে তাহলে হতো কী, যোগাযোগটা বাড়তো, আদান-প্রদানটা বাড়তো। আগে অনেক ফাইন আর্টের লোক ছিল যারা থিয়েটারের ডিজাইনের সাথে জড়িত ছিলেন, আমাদের সৈয়দ হক ভাই আছেন, যিনি বেসিক্যালি একজন কবি হওয়ার কারণে আমাদের নাটকের মানটাকে উন্নত করতে পেরেছিলেন। এখন কিন্তু এসব নেই। এখন একটা দলে সবাই সব কিছু করতে পারে।
বিপুল শাহ
নাটকে নির্দেশক হয়তো চাচ্ছেন একটা সুরিয়েলিস্টিক ইমেজ তৈরি করতে, অথচ ডিজাইনারের সে-বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই। তবুও দেখা যাবে ডিজাইনটা সে-ই করছে। দল টেকাতে গেলে হয়তো মেনে নিতে হচ্ছে এসব।
ইমতিয়ার শামীম
সত্যিকার অর্থে থিয়েটার বোধহয় মিডিওকারদের দখলে আছে। এখানে স্পেশালাইজড লোক দরকার। সব জানার পর একটা বিশেষ জানা নিয়ে কাজ করার কথা বলছি। যেমন, আমরা ছোট বেলায় সব পড়েছি- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি ... তো পরে কিন্তু আমাকে একটা বিষয় বেছে নিতে হয়েছে, স্পেশালাইজেশনের কারণে। সব বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা থাকার পর স্পেশালাইজড হলে সবার সাথে কমিউনিকেট করতে সুবিধা হয়, সম্পর্কটা তৈরি করা সহজ হয়। মিডিওকারের স্তর থেকে উপরে উঠতে হবে। এই স্তর থেকে উপরে উঠেছে বলেই আমরা দেখি যে, রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইন দুজনে কথা বলছে এবং পরস্পরকে কমিউনিকেট করতে পারছে।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
হ্যাঁ, সে-কারণেই রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইন কথা বলে বের হওয়ার পর সাংবাদিকরা যখন আলাদাভাবে দুজনকে দুজনের সম্বন্ধে মূল্যায়ন করতে বলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ বলেন- উনি তো বড় মাপের কবি, আর আইনস্টাইন বলেন- উনি তো বড় মাপের বিজ্ঞানী। মানে আমরাও যদি পরস্পর পরস্পরের সাথে ভাব বিনিময়ের চর্চা করতাম, তাহলে হয় তো পাভেলকে আমার মনে হতো একজন কবি বা বিপুলকে মনে হতো গদ্যকার।
ইমতিয়ার শামীম
এই ব্যাপারটা ঘটা সম্ভব যদি কেউ মিডিওকারের পর্যায় অতিক্রম করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন দুজনেই মিডিওকারের পর্যায়টা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। ফলে ভাবনা চিন্তায় তারা নিজেদেরকে আলাদা করতে পারেন নি। দুজনেরই মনে হয়েছে তাঁরা কবি এবং বিজ্ঞানী।
বিপুল শাহ
এটা কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার। আমরা পরস্পর আদান-প্রদান তো দূরের কথা, কথাই তো বলি না। আজকে থিয়েটারওয়ালা আনুষ্ঠানিকভাবে যদি না ডাকতো তাহলে অনেকের সাথে পরিচয়ই হতো না। অথচ আমরা একই সময়ের একই জায়গার মানুষ।
হাসান শাহরিয়ার
হ্যাঁ, আর যদিও কদাচিৎ দেখা হয়, তখন আর এই শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কথা হয় না, কথা হয় প্রথম আলোতে বেতন কত পাচ্ছেন বা আপনি কি এনটিভি-তেই থাকবেন? ইত্যাদি ইত্যাদি হাঃ হাঃ।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
এব্যাপারে এবার আমি শাহরিয়ার ভাইকে অভিযুক্ত করে একটা কথা বলি ... দেখেন আমাদের বিচ্ছিন্নতা কতদূর পর্যন্ত গেছে ... শাহরিয়ার ভাইয়ের সাথে এই আড্ডার ব্যাপারে কথা হলো, তো উনি আমাকে বললেন দুজন কবিকে রাখতে চাই, একজন হচ্ছেন আলফ্রেড খোকন, আরেকজন কে হতে পারেন? তো আমি বললাম যে, মুজিব মেহদীকে নিতে পারেন। শাহরিয়ার ভাই বললেন যে, আপনি (আমি) একটু যোগাযোগ করেন। এটা বলার একদিন পরেই মুজিব মেহদীর সঙ্গে দেখা। তাকে কথাটা বলার পর বললো যে, আমার সাথে তো শাহরিয়ার ভাইয়ের একটু আগেই দেখা হলো, কই কিছু তো বললেন না। বোঝেন অবস্থা ... তো পরে একদিন শাহরিয়ার ভাই ফোনে বললেন- কামাল ভাই, মুজিব ভাইকে আমি চিনি আট বছর ধরে, কিন্তু ইনি যে কবি মুজিব মেহদী তা তো জানতাম না। ... এবার আপনারা বলেন, শাহরিয়ার ভাইয়ের সাথে মুজিবের চেনা-জানা আট বছরের অথচ তিনি জানেন-ই না যে, মুজিব কবিতা লেখে। আমি শাহরিয়ার ভাইকে অভিযুক্ত করছি এই বিচ্ছিন্নতার জন্য।
হাসান শাহরিয়ার
আমি এই অভিযোগ মাথা পেতে নিলাম হাঃ হাঃ। এবং এ-ও বলছি যে, এই বিচ্ছিন্নতাবোধ কাটানোর জন্যই তো এই আয়োজন করলাম, তাতে পাপ যদি কিছুটা মাপ হয় হাঃ হাঃ।
বিপুল শাহ
তবে এটাও সত্য যে, এমন ফরমাল আড্ডায় কিন্তু বিচ্ছিন্নতা কাটবে না। আমার সাথে পাভেলের পরিচয় প্রায় ২০ বছর ধরে। আমি চারুকলায় আঁকছি, ও হয়তো রিহার্সেলের আগে আমার এখানে চলে এলো। খোঁজ-খবর নিচ্ছে, কী বিষয় নিয়ে আঁকছি ইত্যাদি। আমার হয়তো একটা এক্সিবিশন হবে, পাভেল হয়তো বললো যে, দোস্ত তোর এক্সিবিশনের দিন এখানে এসে আমরা একটা পথনাটক করবো। তো দেখা গেল আমার এক্সিবিশনের আগে সে একটা দর্শক জমিয়ে ফেললো। আমি বলছি যে, এটা যদি আমি অর্গানাইজ করতাম তাহলে এক রকম হয় আর যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করা হয় তাহলে আরেক রকম হবে। এবং এই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমাদের সম্পর্কগুলো তৈরি হতে হবে।
আজাদ আবুল কালাম
নাটকের দলগুলোকে আসলে কোথাও যেতে হয় না, কারণ, দলগুলো হলো সোসাইটির মতো ... এখানে খালু আছে, বড় ভাই আছে, জ্যাঠা আছে, বেয়াদপ ভাই-ও আছে, বেকার ছেলেও আছে ... তো মহড়ায় গেলে দেখা যায় একটা সোসাইটির সবাই একটা দলে আছে, সে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করে। ফলে অন্য কারো কাছ যাওয়া বা সেখান থেকে কিছু নেয়া, এটা সে ভাবতে পারে না।
মুজিব মেহদী
স্বয়ং-সম্পূর্ণতা থাকলে ... মানে, এটা এক অর্থে প্রয়োজনীয়-ও কিন্তু।
বিপ্লব বালা
যে-কোনো মাধ্যমেই এটার বোধহয় এক ধরনের দরকারও আছে।
আলফ্রেড খোকন
আমরা যারা এখানে বসেছি, তাদের কথাই ধরুন। আমরা সবাই কম-বেশি নাটক দেখেছি, অথচ আপনারা কিন্তু আমাদের গল্প-কবিতা পড়েন না বা ছবি দেখেন না।
আজাদ আবুল কালাম
কেন পড়বো না বা দেখবো না? অবশ্যই পড়ি, দেখি।
আলফ্রেড খোকন
এখানে আপনারা তিনজন নাটকের সাথে জড়িত। আমি নিশ্চিত জানি একজন ছাড়া আর কেউ আমাদের কবিতা পড়েন নি।
বিপ্লব বালা
কেন, কার কবিতা পড়ি নি?
আলফ্রেড খোকন
আপনি মুজিব ভাইয়ের কবিতা পড়েছেন?
বিপ্লব বালা
অবশ্যই।
মুজিব মেহদী
বিপ্লব দা’ আমার অনেক পুরোনো পাঠক।
আলফ্রেড খোকন
আমার কবিতা পড়েছেন?
বিপ্লব বালা
নিশ্চয়ই পড়েছি।
আলফ্রেড খোকন
সেটা তাহলে আমার সাথে পরিচয়ের পর পড়েছেন।
মুজিব মেহদী
কেন, আমরা কবিরাই কি সব কবির কবিতা পড়ি? নিশ্চয়ই পড়ি না। সুতরাং এ আশা করাটাও আমার মনে হয় না দরকার আছে।
বিপুল শাহ
ঢাকায় অনেক দল নাটক করে, সবার নাটক কি আমরা দেখি?
আজাদ আবুল কালাম
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়- আমি কি কখনো কোনো পেইন্টারের সাথে এক বাসায় থেকেছি? কোনো কবির সাথে কি আমি একটি বাসা নিয়ে থাকতে পারবো? মানে এতটা কাছে না আসলে কতটুকু জানা যাবে? বা এটা ভাবি যে, আমি কি কোনো পেইন্টারের ছবি দেখে বলতে পারছি যে, এই জায়গাট ভুল বা এটাকে এমন করলে ভালো হতো? বা কোনো কবি কি আমার নাটক দেখে বলে যে, এটা এমন হলে ভালো হতো? আমার রিয়েলাইজেশন হচ্ছে, ইন্টারেকশনে যাওয়টাই কেবল না, সেই ইন্টারেকশনের মানটা দেখতে হবে। এমন উঁচু পর্যায়ের ইন্টারেকশন দরকার, যার ধারে কাছেও আমরা নাই। যেমন, আজকের এই বসা নিয়েও কিন্তু অনেকে বলবে- ফালতু ব্যাপার, আর কাম পায় না, হাঃ হাঃ।
আলফ্রেড খোকন
এই ইন্টারেকশনটা আরো বেশি দরকার এই কারণে যে, তা না হলে আপনাদের নাটক কিন্তু গণমানুষের কাছে কোনোদিন যাবে না। আপনার পত্রিকা বলছে, ‘থিয়েটার করতে পড়তে হয়’ ... তো কেবল থিয়েটার করতেই না, আমি বলবো থিয়েটার দেখতেও পড়তে হয়। আপনার দর্শককেও শিক্ষিত হতে হবে, জানাশোনা থাকতে হবে। তা না হলে হবে না। সোসাইটি কিন্তু লিড দেয় কতিপয় মানুষই, সবাই দেয় না। সেই কতিপয় মানুষজনের কাছে-ও যদি থিয়েটার যেত তাহলেও কাজ হতো। আমার মনে হয় না, এতটুকুও গেছে।
হাসান শাহরিয়ার
পাভেল ভাইকে বলছি, আপনি নাটকের টেক্সটকে কীভাবে দেখেন? আমরা সব সময়ই কিন্তু বর্তমান দর্শককে ধরতে চাই, নির্দেশক-অভিনেতা হিসেবে। কিন্তু নাটকের টেক্সট তো বর্তমান সময়কে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের কারো দ্বারা পুনরায় মঞ্চায়িত হবে। সেক্ষেত্রে মঞ্চনাটকের বেলায় কিন্তু নাট্যকার অনেক বেশিদিন জীবিত থাকেন। তো এটা নিশ্চয়ই নির্ভর করে সেই নাট্যকারের সৃজনশীল ক্ষমতার উপর। সেই ধরনের ক্ষমতাবান নাট্যকার কি আমরা যথেষ্ট পেয়েছি? যদি না পেয়ে থাকি কেন পাই নি বলে আপনার মনে হয়?
আজাদ আবুল কালাম
আমরা যদি কাল বা সময়কে বিবেচনা করি তাহলে দেখবো, আমরা হয়তো এখন বলছি- সৈয়দ হকের বা সেলিম আল দীনের নাটক বেঁচে থাকবে, কিন্তু আমি মনে করি এটা নিশ্চিত না। কারণ, আমরা জানি না পরে কী হবে। আরেকটা কথা হলো আমাদের নাটকের লোকদের কিছু লিমিটেশন আছে, আমি আমাকে সহ-ই বলছি, লিমিটেশনটা হচ্ছে, আমরা ধরেই নিই যে, নাটক করতে একটা স্ক্রীপ্ট লাগে। একজন নাট্যকার নাটক লিখে দেবেন তারপর থিয়েটার করবো। কিন্তু আমি মনে করি- সাহিত্য, চিত্রকলায় যদি সারা দুনিয়াটাই তার টেক্সট হয় তাহলে নাটকের বেলায় নয় কেন? আমার এটা কখনোই মনে হয় না যে, আমাদের বাংলা নাটকে নাট্যকার পাচ্ছি না বা ভালো টেক্সট পাচ্ছি না বলে নাটক পিছিয়ে আছে। যে-কোনো ৫ টি লাইনই টেক্সট হতে পারে। সেটা নিয়েই অভিনেতা-নির্দেশকরা কাজ করতে পারেন। বাংলাদেশ কেন, কোন দেশের কয়জন নাট্যকার যুগ যুগ ধরে বেঁচে আছেন বা থাকবেন? এত বড় এক আমেরিকা, সে এ-পর্যন্ত ক’জন নাট্যকার পেয়েছে, যারা কালোত্তীর্ণ হয়েছেন? বড়জোর ৫ জন। ইংল্যান্ডে শেক্সপীয়র থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ক’জন নাট্যকার আছেন বা হয়েছেন? ওখানে তো থিয়েটারটা আছে শত শত বৎসর ধরে। তো আমার কাছে লিখিত, সুসংগঠিত টেক্সট-কে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। কারণ নাট্যকার প্রতিদিন জন্মাবে না। আর ওনারা না জন্মালে আমাদের নাটক হবে না, এটাও ঠিক না।
আলফ্রেড খোকন
প্রচলিতভাবে বলা হয় যে- সাহিত্য হচ্ছে সমাজের রিফ্লেকশন। সাহিত্যের মধ্যে আমি সব শিল্পমাধ্যমকেই ধরছি। এখন ২০০৬ সালে দাঁড়িয়ে আপনারা যখন নাটক করছেন, তখন এই সময়ে অন্যান্য মাধ্যমে, যেমন, কবিতায়, গদ্যে বা চিত্রকলায় কী কী কাজ হচ্ছে সেগুলো সম্বন্ধে আপনার জানা থাকতে হবে। আপনারা আমার মনে হয় না, সম-সাময়িক অন্যান্য শিল্পচর্চার ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখেন। আমি এটা বলছি একারণে যে, নাটক কিন্তু সব শিল্পের সমন্বিত রূপ। আমার কবিতার বেলায় কিন্তু এটা না হলেও চলে, মানে একজন কবির কিন্তু নাটক না দেখলেও চলে।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
না, না, আমি ডিফার করছি। খোকন হয়তো এটা বলছে, ইন্ডিভিজুয়াল মাধ্যম হিসেবে, মানে কবিতা যে অর্থে অনেক বেশি ইন্ডিভিজুয়াল মাধ্যম, নাটক সেটা না। কিন্তু নাটক অবশ্যই একজন কবিকে, গল্পকারকে বা চিত্রশিল্পীকে হেল্প করে। আমি যেহেতু গল্প উপন্যাস লিখি, আমার মনে হয়েছে একটা ভালো নাটক দেখার পর আমার ভেতরে আইডিয়াগত ব্যাপক পরিবর্তন আসে। একটা ভালো নাটকে কবিতা থাকে, চিত্রকলা থাকে ... তো সেটা আমাকে হেল্প করবে না? অবশ্যই করবে। এবং সে-কারণেই আমি নাটকের লোকদের সাথে এক-ধরনের ইন্টারেকশন চাচ্ছিলাম, যেটার কথা আমি শুরুতেই বললাম যে, নাটক দেখার পর তাদের সাথে আলাপ করতে চেয়েছি, কীভাবে কী হলো সেটা জানার জন্য। যে-কোনো কারণেই হোক সেটা হয়ে ওঠে নি। হলে সবারই উপকার হতো বলে মনে করি। এখানে একটু আগে প্রসঙ্গ উঠেছে, দর্শকের মান নিয়ে, মানে দর্শককেও শিক্ষিত হতে হবে, এসব নিয়ে। তো আমার মনে হয় এতে করে দর্শককে হেয় করা হচ্ছে। কারণ, এখন যারা নাটক দেখতে আসে এরা কারা? স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কারা থিয়েটারটাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে? অবশ্যই দর্শক। এখন তাদেরকে সাধারণ মানের ভাবাটা ঠিক না। এমন দর্শকও হয়তো আসেন যারা আমাদের চেয়ে উন্নত সাহিত্যমনা। পোষাক-আষাক দেখে তো বোঝার উপায় নেই যে, নির্দিষ্ট দর্শক কিছু জানে কী জানে না। কিন্তু এই এত অস্থির আর ব্যস্ত সময়ে যে মানুষটি এত কিছু ফেলে কেবল থিয়েটার দেখতে এলো, সে নিশ্চয়ই সাধারণ নয়। তাকে সম্মান করা উচিত। থিয়েটারওয়ালার কিছু মুখোমুখি বা আড্ডার অনুলিখন আমি পড়েছি, সেখানেও দেখলাম দর্শকদের খুব হেয় করে কথা বলেছেন অনেকে, এটা কিন্তু দুঃখজনক।
মুজিব মেহদী
আমার একটা কথা আছে, সেটা হলো, বর্তমানের থিয়েটারকর্মীরা কবিতা বা চিত্রকলার ব্যাপারে জানেন না, আর আমরা সবাই জানি, এটার বিপক্ষে আমি অবস্থান নিচ্ছি। কেন, বর্তমানে ক’জন কবি বর্তমান সময়কার চিত্রকলার ব্যাপারে পড়াশোনা করে? বা গল্প-উপন্যাস নিয়ে নাড়াচাড়া করে? আমি আরো গভীরে গিয়ে বলতে চাই, কবি হিসেবেই বলতে চাই, ক’জন কবি বর্তমানের কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করে? খুব বেশিজন করে না। তার মানে কেবল থিয়েটারেই সংকট আছে তা না, সংকট সব শিল্প-মাধ্যমেই বিরাজ করছে। এবং এই অস্থির সয়মটাতে এই ধরনের আড্ডার মাধ্যমে সংকট কাটানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, এটা বেশ আশার কথা।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
দর্শকদের ব্যাপারে যেটা বলছিলাম যে, দর্শককে সম্মান দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কঞ্জুস বা সাতঘাটের কানাকড়ি না হয় যে-কোনো দর্শকের ভালো লাগবে, কিন্তু ঈর্ষা, যৈবতি কন্যার মন, চাকা এগুলোও তো দর্শক দেখেছে। এগুলো এমন নাটক না যে, মুড়ির মতো খাওয়া যায়। এসব নাটক যেসব দর্শক দেখেছে বা দেখছে এবং ভালো বলছে, সেই দর্শকদেরও আমাদের সম্মান করা উচিত।
বিপ্লব বালা
খোকন হয়তো এ-কথাগুলো এজন্য বলেছে যে, দর্শকের রুচি ক্রমেই একটা গোলমেলে জায়গায় চলে যাচ্ছে।
হাসান শাহরিয়ার
সেটা কি কেবল নাটকের দর্শকদের বেলাতেই, নাটকের লোকদের রুচি গোলমেলে হয় নি?
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ, আমি নিজেদেরকেই বলছি।
আলফ্রেড খোকন
না, নিজেদের ভেতরে যে গোলমেলে ব্যাপার আছে সেটা আপনারা বলছেন না। থিয়েটারওয়ালার গত সংখ্যাতেই আপনারা একটা আড্ডায় বসেছিলেন। সেখানে আপনারা কেউ কেউ বলেছেন- আন্তর্জাতিক মানের নাটক করছেন, সেটা যদি দর্শক না বোঝে তো ওটা তাদের ব্যর্থতা। মান্নান হীরা বলছেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, পেইন্টাররা নাটক দেখে না। ... তার মানে কী দাঁড়ালো সব দর্শক তো আপনারা বিদায় করে দিয়েছেন। আবার দর্শক না আসার ব্যাপারে লিয়াকত আলী লাকী বলছেন- আমরা নাটক করছি, দর্শক যদি না দেখতে যায়, সেটা দর্শকের দুর্বলতা। ... তো এখন কী বলবেন, দর্শকদের রুচি গোলমেলে নাকি আপনাদের রুচি গোলমেলে?
আজাদ আবুল কালাম
না, দর্শকদের নিচু চোখে দেখাতো সবক্ষেত্রে ঠিক না। আমি একবার একটা নাটক করছিলাম, সামনে দেখি গুন্টার গ্রাস আর এস. এম. সুলতান বসা। তো এমন দর্শকও তো নাটক দেখে। আবার কোনো নাটকে হয়তো দেখা গেল এক নব দম্পতি সেজেগুজে নাটক দেখতে এসেছে। আমরা কিন্তু তখন ধরেই নিই যে, ব্যাপারটা সৌখিন। কিন্তু এই নব দম্পতির সাহিত্য চিন্তা বা পড়াশোনা, মেধা যে আমাদের চেয়ে অনেক উঁচু স্তরের হতে পারে, সেটা আমাদের মেনে কাজ করতে হবে। আর দর্শক কমে যাওয়ার যে কথাটা উঠেছে, সে-ব্যাপারে আমি বাইরে নাটক দেখার অভিজ্ঞতা বলতে পারি। সেটা হলো সারা বিশ্বেই অন্যান্য শিল্প-মাধ্যমের তুলনায় থিয়েটারকে আমার অনগ্রসর মনে হয়েছে। নাটক অন্যান্য শিল্প-মাধ্যগুলো থেকে পিছিয়ে আছে বলেই দর্শক কম হচ্ছে।
বিপ্লব বালা
এটা কি বাইরের বেলায়?
হাসান শাহরিয়ার
এটা কি সব-সময়?
আজাদ আবুল কালাম
কেবল বাইরে না, সব জায়গাতেই। সব-সময় না, এখন। নিউইয়র্কে আগে নাটক দেখার জন্য একমাস আগে থেকে টিকিট কাটতে হতো, আর এখন দিনেরটা আপনি দিনেই পাবেন।
আলফ্রেড খোকন
এই যে, নাটককে অনগ্রসর বলছেন, কখনো ভেবেছেন- কেন অনগ্রসর?
আজাদ আবুল কালাম
এটার কারণ হচ্ছে যে, সারা বিশ্বে ইন্ডিভিজুয়াল এত ইম্পোর্টেন্ট হয়ে গেছে যে, কয়েকজনকে একত্রিত করে কাজ করাটাই দুরূহ হয়ে পড়ছে। থিয়েটার মানেই কিন্তু আপনার পাঁচ-দশজন লোক লাগবে, তাদেরকে দিনের পর দিন নির্দিষ্ট সময়ে, পর্যাপ্ত সময়ের জন্য লাগবে। আবার এই পাঁচ-দশজনের মেধার স্তর কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। তো এ-সব কিছুর সমন্বয় করাটা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সবাই। একজন কবি’র কেবল নিজে মেধাবী হলেই হয়, চিত্রশিল্পীর হয়, কিন্তু একজন থিয়েটারকর্মী কেবল নিজের মেধা দিয়ে থিয়েটার করতে পারে না।
আলফ্রেড খোকন
তারপরও তো দেখা যায় এখনও অনেক নাটক দর্শকপ্রিয় হয়, লোকজন দেখে ...
আজাদ আবুল কালাম
হ্যাঁ, এটা সত্য। এখন ধরুন, কোনো কোনো দলের একটা নাটক দর্শক পাচ্ছে আবার অন্যটা পাচ্ছে না। নাগরিক সম্প্রদায়ের রক্তকরবী-তে দর্শক হয় কিন্তু কোপেনিকের ক্যাপ্টেন-র মতো ভালো নাটকেও দর্শক হয় না। আমি যেদিন দেখেছি, সেদিন ৩০ জন দর্শক ছিল।
মুজিব মেহদী
রক্তকরবী-তে দর্শক হওয়ার কারণ হিসেবে আপনি কী দেখেন?
আজাদ আবুল কালাম
এটার পেছনে অনেক কারণ আছে।
মুজিব মেহদী
এখানে রবীন্দ্রনাথও কি একটা ফ্যাক্টর না?
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ, তাতো বটেই, রবীন্দ্রন্থা ফ্যাক্টর, রক্তকরবী ফ্যাক্টর, অপি করিম ফ্যাক্টর ...
আজাদ আবুল কালাম
রক্তকরবী নিজেই তো একটা ব্র্যান্ড নেম, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় ব্র্যান্ড নেম, পাশাপাশি মডেলও আছে। পত্রিকার ব্যাপার তো আছেই। নাগরিকের (নাট্যদলের) নতুন নাটক আসছে, ওমুক ওমুক অভিনয় করছে, এসব প্রচার হতে থাকে তো স্ক্রিপ্ট রিডিং শুরু হওয়ার দিন থেকে।
আলফ্রেড খোকন
কিন্তু প্রাচ্যনাটের সার্কাস সার্কাস-ও তো বেশ জনপ্রিয় এবং প্রচুর দর্শক হয়। সেখানে তো কোনো ব্র্যান্ড নেম নেই।
আজাদ আবুল কালাম
হ্যাঁ, এটা হয়। সুনামের কারণে হয়। প্রথম দিককার শো’গুলোতে খুব কম দর্শক হতো। আস্তে আস্তে জানার পর হয়তো দর্শক বেড়েছে।
বিপ্লব বালা
একটা কথা মানতে হবে, আমাদের এখানে কেউ ভালো নাটক করেছে, কিন্তু দর্শক পায় নি, এমন উদাহরণ নেই। ভালো নাটক যদি চালিয়ে যাওয়া যায় তো আস্তে আস্তে দর্শক হবেই। ভালো নাটককে দর্শক সব সময়ই পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে।
আজাদ আবুল কালাম
সে-জন্যই আমি বলতে চাই, এই যে বলা হচ্ছে দর্শক কমেছে, তার মূল কারণ হলো- নাটকের মান কমেছে।
বিপ্লব বালা
অবশ্যই।
শাহীনুর রহমান
আমি একটু বলি, একটা নাটক যখন মঞ্চে আসে তখন যদি প্রচুর দর্শক এটা দেখতে থাকে, মানে জনপ্রিয় হয়, তাহলে আমি বলবো এটাতে কোনো ঝামেলা আছে। সেটাতে তখন সমসাময়িক কিছুকে ধরাটাই মুখ্য মনে হয়, তার চিন্তা, অধ্যাবসায়, তার গ্র্যাজুয়েলি এগিযে যাওয়া, এসবে কোথাও ফাঁক আছে বলে মনে হয়। একদল নাট্যকর্মী প্রচুর চর্চা, পড়াশোনা, মেধা দিয়ে একটা নাটক দাঁড় করালো আর দর্শক, যে কিনা ছ’মাসে একবার নাটক দেখে, একেবারেই এ্যামেচার, সে আসলো দেখলো এবং নাটকটা বুঝে ফেললো? এটা কেন হবে?
মুজিব মেহদী
তার মানে কী, ভালো নাটকে বা এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে এ-ধরনের নাটকে দর্শকের কমতি হতেই হবে?
শাহীনুর রহমান
হ্যাঁ, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, আমি মনে করি, প্রচুর মানুষ কখনো চিন্তাকে ধারণ করে না। মানে আমি দর্শক নাটককে নিলে সেটা ভালো নাটক, সেখানে গুরুত্ব কম দিতে চাই, বরং প্রচুর দর্শক নিয়ে নিলে আমার এটার মান নিয়ে সংশয় হয়।
বিপ্লব বালা
আপনি দর্শককে কম গুরুত্ব দিতে চান?
শাহীনুর রহমান
আমি বলতে চাই যে, দর্শককে আমি ঐ হাইটে কীভাবে দেখবো? আমি ইউরোপীয়, ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাস পড়ে, আজকের সময়কে বুঝে একটা ছবি আঁকছি, তো আমি কী করে আশা করবো যে, ঐ দর্শক এসে টোটাল কাজটা বুঝে ফেলবে?
হাসান শাহরিয়ার
না, আপনি তো অনেক কিছুই ভাববেন, কিন্তু দর্শক তো দেখছে আপনার কাজের আউটপুট। সে বুঝতেই পারে। দর্শক তার মননশীলতা দিয়ে বোঝে, সে তো সৃষ্টি করছে না। তো তার অন্যান্য মাধ্যমের পড়াশোনা, আর্থ-সামাজিক বিষয় নিয়ে ভাবনা, সব মিলিয়ে তার একটা মেধাস্তর তৈরি হয়। এবং সেটা দিয়ে সে নাটককে বোঝে। তার তো নাটক তৈরির গ্রামার জানার দরকার নেই। একটা ভালো রান্নার উপাদানগুলোর অনুপাত আপনি জানেন না, কিন্তু খাওয়ার পর তো বোঝেন যে, এটা সুস্বাদু কি না। তাই না? উপাদানগুলোর সঠিক অনুপাত জানার দায়িত্ব পাচকের, খাদকের না।
শাহীনুর রহমান
আমি বলতে চাচ্ছি, দর্শক বলতে আমি তাকেই বুঝবো, যে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে। কিন্তু যে এ্যামেচার দর্শক, সে এসেই আমার আর্ট বুঝে ফেলবে, এই আশাটাই আমি শুরুতে বাদ দেব।
মুজিব মেহদী
নাটকের যখন এক্সপেরিমেন্ট করা হয়, তখন প্রথম ভাবা উচিত দর্শকের সাথে এই এক্সপেরিমেন্ট কতটা কমিউনিকেট করবে। মানে, যত বড় মাপের এক্সপেরিমেন্ট-ই হোক না কেন, সেটা যদি ফিফটি পারসেন্ট দর্শকও কমিউনিকেট করতে না পারে, তাহলে সেটার কোনো মূল্য নেই।
বিপুল শাহ
চিত্রকলার ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় শিল্পী আছেন, যারা তাদের সময়ে দর্শকদের সাথে কমিউনিকেট করতে পারেন নি, পরে করেছেন।
মুজিব মেহদী
এটা চিত্রকলার ক্ষেত্রে হতে পারে। থিয়েটারে হবে না। থিয়েটার তো ইন্সটেন্ট মাধ্যম।
হাসান শাহরিয়ার
কবিতা, গল্প-উপন্যাস, চিত্রকলা বর্তমান পাঠক বা দর্শকের চেয়ে অনেক উঁচু স্তরের হতে পারে। এবং শিল্পীর মৃত্যুরও বহু পর এগুলো মূল্যায়িত হতে পারে। কিন্তু নাটক কেউ বিশ বছর পরের জন্য লেখে না। তাকে সমসাময়িক দর্শক ধরতে হবেই। কারো কারো ব্যাপারে এই কথা না-ও খাটতে পারে, সেখানে আবার অন্য ব্যাপার আছে।
বিপুল শাহ
দশ বছর পরের দর্শকের জন্য লিখে না, কিন্তু অনেক নাট্যকার তো ২/৩ শ বছর পরও জনপ্রিয়।
আজাদ আবুল কালাম
যে নাটক ২/৩ শ বছর পরও জনপ্রিয়, সেই নাটক তার রচনার সমকালেও জনপ্রিয় ছিল।
হাসান শাহরিয়ার
সমসাময়িককালে নিন্দিত, কিন্তু অনেক পরে জনপ্রিয় হয়েছে, এমন নাটকের উল্লেখ করা কঠিন।
মুজিব মেহদী
মানে একটা স্ক্রিপ্ট লিখলাম কিন্তু সেটা যতক্ষণ পর্যন্ত না দর্শকের সামনে যাচ্ছে, ততক্ষণ তো এটা থিয়েটারই না।
বিপুল শাহ
অনেকে বলে- শিল্পের জন্য শিল্প করছি। আমি মনে করি তারা একটু উন্নাসিক। কেউ শিল্পের জন্যই শিল্প করে না। প্রথমত সে করে নিজের জন্য। দর্শক দেখে সেটাকে ভালো বললো কি না, তার চেয়ে জরুরি, শিল্পী নিজে কাজটা করে তৃপ্ত কি না।
বিপ্লব বালা
আপনি তৃপ্ত না হয়ে সেটাকে দর্শকের সামনে আনবেন কেন? নিজে তৃপ্ত না হলে তো সেটা শিল্প হচ্ছেই না। এখানে যা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটাকে আগে তো শিল্প হতেই হবে।
হাসান শাহরিয়ার
শিল্প যে হয়েছে, এর মান নির্ধারণ যদি করে শিল্পী নিজে তাহলে বলতে হয়, আমরা যেগুলোকে খারাপ নাটক বলি, সেই নাটকের দল কিন্তু তৃপ্ত হয়েছে বলেই নাটকটাকে মঞ্চে এনেছে। কিন্তু দর্শক হয়তো নাটকটাকে নেয় নি। ঐ দলের কাছে নির্দিষ্ট নাটকটা শিল্প হয়েছে, কিন্তু দর্শকের কাছে হয় নি।
বিপুল শাহ
আবার দর্শকের কাছে গ্রহণীয় হলেও কথা থেকে যায়। যেমন- এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় যে-পরিমান কবিতা, নাটক, চিত্রকলা হয়েছে সেগুলো সব যে শিল্প হয়েছে সেটা বলছি না, কিন্তু সময়ের একটা পারপাস সার্ভ হয়েছে। তো দেখা গেছে দর্শকদের পারপাস সার্ভ করতে গিয়ে ঐ সময়ের কাজগুলো বেশিদিন আর টিকে থাকে নি। কারণ, দর্শকদের পারপাস সার্ভ করতে গেলে শিল্পের মানে ঘাটতি পড়বেই।
হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু কবিতা বা চিত্রকলার পাঠক-দর্শক আর থিয়েটারের দর্শক কিন্তু এক না। আপনারা আপনাদের ছবি বিক্রি করেন, আমরাও কিন্তু আমাদের নাটক বিক্রি করি, অভিনয় বিক্রি করি, কবি তার কবিতা বিক্রি করে। কিন্তু আপনারা একটা ছবি আঁকার পর সমঝদার দর্শকের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন, বছরের পর বছরও অপেক্ষা করতে পারেন। কিন্তু আমাদেরকে থিয়েটারটা বানানোর সাথে সাথে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হয়, কারণ থিয়েটার জীবন্তু শিল্প-মাধ্যম, এটাকে প্রিজার্ভ করা যায় না। ফলে বর্তমানের দর্শকই আমাদের কাছে ইম্পর্টেন্ট, ভবিষ্যৎ আমাদের কাছে তেমন জরুরি নয়।
বিপুল শাহ
অভিনয় বিক্রির ব্যাপারে তাহলে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমাদের এলাকায় যাত্রাপালায় একজন রাজার ভূমিকায় অভিনয় করতো। খুব গরিব ঘরের ছেলে। তো পালায় যখন সে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করছে, তখন তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে দর্শক তার কোমরে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। কিন্তু সে দর্শকদেরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে, টাকা নিবে না। মানে হলো সে তখন রাজা, রাজা কী করে অন্যের টাকা নিবে? এতটা ডিভোশন নিয়ে সে অভিনয় করতো। বর্তমান অভিনেতাদের সেই ডিভোশনটা নেই। সে মঞ্চে অভিনয় করে আর ফাঁকে ফাঁকে তাকায়, যদি কেউ তার অভিনয় দেখে টেলিভিশনে ডাকে, তাহলেই তো সে স্টার। সব সময় ধান্দায় থাকে।
আজাদ আবুল কালাম
এখন তুই (বিপুল সাহ) যদি ঢালাওভাবে মন্তব্য করিস তাহলে তো হবে না। এখানে বিপ্লব দা’ আছেন, উনি তো থিয়েটারের লোক, টেলিভিশন স্টার না। আবার অনেকে আছেন টেলিভিশন স্টার হওয়ার পরও সে কেবলই থিয়েটারের লোক। টেলিভিশনে যান দুটো কারণে, এক- ওখানে অর্থের একটা সংস্থান হয়, দুই- ভিন্ন মাধ্যমে কাজ করার ইচ্ছা থাকতেই পারে। সবাই চাইবে তার অভিনয়টা বেশি বেশি দর্শক দেখুক। তবে হ্যাঁ, এই প্যাকেজ আসার পর থিয়েটারের কিছু লোক বেশ উন্নাসিক হয়েছে, বেয়াদপও হয়েছে কেউ কেউ।
হাসান শাহরিয়ার
তবে এই প্রাইভেট চ্যানেল আসার পর কি কেবল থিয়েটারকর্মীরাই নষ্ট হয়েছে? চিত্রকলার লোক হয় নি? কবি হয় নি? সাহিত্যিক হয় নি? অসংখ্য বস্তাপঁচা নাটক হয়, প্রতিদিনই হয়, যে-গুলোর রচয়িতা কোনো না কোনো কবি বা সাহিত্যিক। একটা হতে পারে স্বাধীনতার পর থেকেই যে-কোনো কারণেই হোক, থিয়েটারের লোকদের প্রতি মানুষের আকাক্সক্ষা বেশি ছিল, তাই তাদের স্খলনটাই সবার আগে নজরে আসে।
ইমতিয়ার শামীম
আবার এটাও ঠিক যে, দর্শকও আগের মানে দাঁড়িয়ে নেই। তারও স্খলন হয়েছে প্রচুর। এতো যে বস্তাপঁচা নাটকের কথা বলা হলো, এগুলো কোনো না কোনোভাবে দর্শকপ্রিয় হয়েছে। কীভাবে হলো? নিশ্চয়ই দর্শকদের রুচিও নিুগামী হয়েছে।
মুজিব মেহদী
কিন্তু কিছু কিছু সিলেকটিভ দর্শক আছে, যারা মানের হেরফের হলে রিয়েক্ট করে। ঐসব দর্শক যেন থিয়েটার বিমুখ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।
আজাদ আবুল কালাম
৫ জন দর্শকও যদি টিকিট কাটে, আমাকে সর্বস্ব দিয়েই নাটকটা করতে হবে। হেলাফেলা করা ঠিক না।
হাসান শাহরিয়ার
আসন আছে ৩০০, কিন্তু যে ৫ জন টিকিট কেটেছে, তারা তো দায়ী না যে, কেনো বাকি ২৯৫ জন আসলো না। সুতরাং তাদেরকে সম্মান দিয়েই কাজটা করতে হবে।
বিপ্লব বালা
একটা কথা কোলকাতায় খুব শুনতাম যে, যদি ১ জন দর্শকও হয়, তবুও সবটুকু দিয়ে নাটকটা করতে হবে।
আলফ্রেড খোকন
হ্যাঁ, সেই একজনকেই জয় করতে হবে। এ-প্রসঙ্গে আমি একটা গল্প বলতে পারি ... জীবনানন্দ দাশ যখন মারা যান তার ৫ মিনিট আগে একবার জ্ঞান ফিরেছিল। উনি তো ১৪ অগাস্ট আহত হন আর মারা যান ২২ অগাস্ট। তো জ্ঞান ফেরার পর দেখেন যে, তার পাশে বসা আছে বড় মেয়ে, মঞ্জুশ্রী দাশ। চেতন ফেরার সাথে সাথেই জীবনানন্দ বলছিলেন- প্রেমেন এসেছে? মঞ্জুশ্রী বললেন যে- তোমার কথা বলা বারণ আছে। জীবনানন্দ তখন বললেন যে- কিন্তু প্রেমেন তো বলে আমার কবিতা নাকি কিছুই হয় না। ... এবং এইটুকু বলেই তিনি মারা যান। এর মানে হচ্ছে, প্রেমেন জীবনানন্দের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তিরিশের দশক থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যত কবিতা তিনি লিখেছেন, তা প্রথমেই তিনি দেখাতেন প্রেমেন্দ্র মিত্রকে। আর প্রেমেন্দ্র মিত্র সব সময়েই বলতেন যে, কিছুই হয় নি, যা আবার লিখে নিয়ে আয়। জীবনের শেষ দিকে তো জীবনানন্দের গ্রহণযোগ্যতা চলে আসছিল, কিন্তু ঐ প্রেমেন্দ্র মিত্রকে জীবনানন্দ কখনো জয় করতে পারেন নি। ফলে তার সব স্বীকৃতি ফেলে দিয়ে মৃত্যুর পূর্বে সে কেবল প্রেমেনকে খোঁজে, যে কিনা বলে যে, তার কবিতা কোনো কবিতাই না। তো থিয়েটার বলেন আর যে-কোনো শিল্পই বলেন, এমন কেউ থাকতে হবে যাকে জয় করতে করতেই আপনার জীবন শেষ হয়ে যাবে। আর এই জয় করার চেষ্টার মধ্য দিয়েই দেখবেন আপনি শিখরে পৌঁছে গেছেন। আপনার সামনে একজন বসা না অনেকে বসা তাতে কী আসে যায়? যে বসে আছে তাকেই জয় করতে হবে।
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ, একজন আর সহস্রজনে তো কোনো ভেদ নেই।
হাসান শাহরিয়ার
পাভেল ভাইয়ের কাছে জানতে চাই, আমরা থিয়েটারে অন্যান্য শিল্পের সমন্বয় নিয়ে কথা বললাম, অন্যান্য মাধ্যমের শিল্পীদের সাথে বন্ধুত্বের কথা বললাম, সখ্যের কথা বললাম এবং কিছুটা জেনেছি যে আপনার ভেতরে এই ব্যাপারগুলো অনেক আগে থেকেই কাজ করছে। তো আপনার কী মনে হয় এখনকার থিয়েটারকর্মীরা কি আদৌ ভাবে যে থিয়েটার করতে হলে তাকে কবিতা জানতে হবে, চিত্রকলা জানতে হবে?
আজাদ আবুল কালাম
আমি মনে করি বাংলাদেশে যেখানে ১৪ কোটি লোক সেখানে ২/৪ জন লোক কোনো কিছুতেই, কোনো শিল্প মাধ্যমেই কিছু করতে পারবে না। এর জন্য অনেক লোক লাগবে আর এই যে ‘লোক’ বলছি, সেটা খেটে খাওয়া লোক না, মেধাবী লোকের কথা বলছি। থিয়েটারে এই মেধাবী লোকের সংখ্যা কম, এবং স্পেশালি আমাদের জেনারেশনে একেবারেই কম। এই কম হওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। আমরা এখানে সময় নিয়ে অনেক কথা বলেছি। এই সময়ের হাতছানিতে আমরা অনেকে পড়ে গেছি। আমাদের জেনারেশনেই আপনার-আমার সাথে কিন্তু আরো অনেকেই থিয়েটার শুরু করেছিল, তাদের অনেকের মেধা চুরি করে নিয়ে গেছে সময়ের হাতছানি। কেউ অর্থ উপার্জনের জন্য বিক্রি হয়েছে, কেউ-বা স্টার হওয়ার জন্য এদিক সেদিক দৌঁড়াচ্ছে। তবে আমি কোনোভাবেই হতাশ নই। এই সময়েও কিন্তু অনেক তরুণ আমার কাছে আসে, কাজ করতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অনেকে আছে যারা ভালো কাজ করতে চায়। এবং তাদের অনেকেই বর্তমানের চিত্রকলা, কবিতা, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে বা জানতে চায়। সুতরাং হয়ত-বা আমরা যে অস্থির সময় পার করছি, সেটা আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না। একটা নতুন জেনারেশন তৈরি হচ্ছে।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
শিল্পী আসার বা তৈরি হওয়ার কিন্তু একটা ধারা আছে। যখন শিল্পীর শূন্যতা চরমে পৌঁছায়, তখনই কিন্তু সম্ভাবনা থাকে নতুন শিল্পীর আগমনের। আমরা বোধহয় সেই সময়ের খুব কাছাকাছি আছি।
বিপুল শাহ
গ্রুপ থিয়েটারে একটা বিশেষ প্রবণতা আছে, সেটা হলো, ডিজাইনের ক্ষেত্রে নিজেদের দলের লোক দিয়েই ডিজাইনটা করাতে চায়। এই প্রবণতাটা বোধহয় ছাড়া দরকার।
শাহীনুর রহমান
আচ্ছা, এটা কি কোনো অযোগ্যতা যে, আমার দলের নাটক কিন্তু সেট ডিজাইনটা করালাম আমি অন্য কাউকে দিয়ে?
হাসান শাহরিয়ার
এটা কিন্তু এখন আর নেই বললেই চলে। প্রায় সব দলই ডিজাইনের কাজগুলো করাচ্ছে বাইরের কাউকে দিয়ে। অন্য দলের লোক দিয়ে।
শাহীনুর রহমান
না, আমি অন্য দলের লোক নিয়ে করতে বলছি না। যদি দলের নিদের্শক মনে করেন যে, তার কোনো একটা নাট্য-মুহূর্ত তৈরি করতে একটা এক্সপ্রেশানিজমের ছাপ আনতে হবে, সেক্ষেত্রে তিনি বাইরে থেকে একেবারে চারুকলার একজনকে আনলে ক্ষতি কী?
হাসান শাহরিয়ার
ক্ষতি নেই, আমি প্রয়োজন বোধ করছি কিনা সেটাই হলো কথা।
আজাদ আবুল কালাম
গ্রুপ থিয়েটার সব সময়ই বলে-আমি খুব গণতান্ত্রিক। তো গণতন্ত্র করতে গিয়ে নিজেদের খুব লিমিট করে দেয়। গণতন্ত্র করতে গিয়ে কিন্তু আমরা বিরাট বড় স্বৈরাচার হয়ে গেছি। এবং আমাদের দলগুলো আন্তঃসম্পর্ক দেখলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন। কোনো দলের কোনো সর্বনাশ হলে অন্য দলগুলো খুব খুশি হয়। একদল হয়তো শো করতে পারে নি, আরেক দল তাতেই খুশি হয়।
হাসান শাহরিয়ার
অন্যের ব্যর্থতাকেই এখন অনেকে নিজের সফলতা হিসেবে ভাবছে। আরেকটা ব্যাপার কিন্তু দলগুলোতে আছে যা কিনা অন্যান্য শিল্প মাধ্যম থেকে একেবারেই আলাদা। সব শিল্পমাধ্যমে শিল্পী বড় হয় তার নিজের কাজ দিয়ে। থিয়েটারে কিন্তু শিল্পী বড় হয় বয়স দিয়ে। যত শিক্ষিত মেধাবী নাট্যজনই দলে ঢুকুক না কেন, মাথামোটা সিনিয়র কেউ হয়তো বলবে- ২০ বছর ধরে নাটক করছি, তোমার কাছে এখন শিখতে হবে সেটের রঙ কেমন হবে? আগে চেয়ার টানো পরে নাটক ক’রো। ... এবং এই এটিচিউড আগে ছিল দলের ভেতরে, ৩৪ বছরে এসে এখন কিন্তু থিয়েটার পাড়াতেই এই বয়সভিত্তিক মুরুব্বীয়ানার প্রকাশ ঘটেছে। সব বয়স্করা এখন একটি দল, তার পরের বয়স্করা আরেকটি দল, এভাবে চলছে। তো অন্যান্য মাধ্যমে কিন্তু এই হারে মুরুব্বীগিরী নেই, আমাদের মুরুব্বীগিরী কিন্তু মেধা বিকাশের অন্তরায় হযে পড়েছে।
শাহীনুর রহমান
আচ্ছা, আপনারা নাটক সিলেক্ট করেন কীভাবে? শুনেছি তিন-চারটা নাটক নিয়ে নির্দেশক একটাকে সিলেক্ট করেন। তো এই সিলেকশানের সময় কী কী মাথায় রাখা হয়?
বিপ্লব বালা
আমার তো সব সময়ের একটা অভিযোগ বাংলাদেশের থিয়েটারের উপর, সেটা হলো এখানকার থিয়েটার কখনো সময়কে বিবেচনা করে নাটক করে না। কী কী ঘটছে, তার প্রেক্ষিতে আমার শিল্পভাবনা কী হবে, সেটাকে মাথায় রেখে টেক্সট হাতে নেয়া এক-রকম হয় না বললেই চলে। এক সময়ে হয়েছে, নূরলদীনের সারাজীবন বা কোপেনিকের ক্যাপ্টেন ইত্যাদি।
হাসান শাহরিয়ার
এমনও কিন্তু হয় যে, এখন একটা শেক্সপীয়র ধরা উচিত বা ইবসেন ধরা উচিত। বা অনেক কিছুই তো করলাম, এখন একটা রবীন্দ্রনাথ করলে হয়।
শাহীনুর রহমান
যে বাস্তবতা আমরা ফেস করছি, জীবন জীবিকার কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে চলছি, এখনকার মিডিয়ার থাবা বা গ্লোবালাইজেশন ইত্যাদির ভেতর দিয়ে পার হওয়া সময় এটা, এই সময়ে আমরা প্রাসঙ্গিকতা খুঁজব না?
বিপ্লব বালা
প্রাসঙ্গিকতা কথাটা কিন্তু প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ আজকে কিন্তু অনেক কথা বলা হলো থিয়েটার সম্পর্কে যে, থিয়েটার একেবারে বর্তমান দর্শকের জন্য করা হয়। তো বর্তমান দর্শক তো বর্তমানের জটিলতা কীভাবে ফেস করবে সেটা দেখতে চায়। থিয়েটারের লোকজন কিন্তু বর্তমান সময়ের নাটক কী হওয়া উচিত এ-ব্যাপারে একেবারে নির্বিকার।
মুজিব মেহদী
মানে সময়টার যে দাবি, সেটা শিল্পের কোনো মাধ্যমেই আমরা ধরতে পারছি না, দাবিটা ফুলফিল করতে পারছি না। কারণ, সময়টাকে আমরা ধরতে পারছি না। এতো স্পীড আর এতো বেশি হাতছানি এই সময়টাতে যে, খেই হারিয়ে ফেলছি। আজকে ভাবছি এই ঘটনাটা ইম্পোর্টেন্ট, কালকেই দেখি সেটা গৌণ হয়ে যাচ্ছে। মানে আমি কোনটাকে ধরবো?
বিপ্লব বালা
গোটা বিশ্ব জুড়েই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যে অস্থিরতা, সেটাতো ভয়াবহ জায়গায় চলে যাচ্ছে।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
পুরো বিশ্বেই কিন্তু কয়েক যুগ হয়ে গেল, তেমন কোনো মতবাদ তৈরি হয় নি। ফিলোসফিক্যাল উইং-ই তৈরি হয় নি।
ইমতিয়ার শামীম
দার্শনিক একটা শূণ্যতা আছে। আমরা এখন যাদের থিংকার হিসেবে দেখছি, তারা কিন্তু ঠিক মতবাদ দেয়ার মতো না। মার্কসের সম্পর্কে আমরা বলতে পারি যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমন কি বিজ্ঞান, সংস্কৃতি সমস্ত কিছু কাভার করার ক্ষমতা তার ছিল। এখন কিন্তু সেই শূণ্যতাটা রয়ে গেছে।
আলফ্রেড খোকন
একেটা সময় একেক রকম। আমাদের সময়টা আমাদের মত। এই সময়ে থেকে আমরা কী করছি সেটা ইম্পর্টেন্ট।
মুজিব মেহদী
হ্যাঁ, কিন্তু এই সময়টা এমনই সময় যে, কোনো মাধ্যমেই কিছু করা হয়ে উঠছে না। পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে আছে সবাই।
আলফ্রেড খোকন
না, এখানে যেমন আমরা ৮-৯ জন বসেছি, এই বসাটাও তো একটা ঘটনা। আবার এমন ঘটনা এই সময়েই বাংলাদেশে হয়তো আরো বহু জায়গায় ঘটছে। আমি বলতে চাচ্ছি, যারা এই সময়টা নিয়ে চিন্তিত, তারা কেবল চিন্তা করে বসে নেই, তারা নিশ্চয়ই ভাবছে কীভাবে এই সময়টা থেকে উত্তরণ পাওয়া যায়। এবং এই উত্তরণ এ-ধরনের আড্ডা থেকেই বেরোনো সম্ভব।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
হ্যাঁ, আর এই আড্ডাটা এমনই হওয়া উচিত, এই যে আমরা বিভিন্ন শিল্প-মাধ্যমের লোক একসাথে বসলাম, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যাদের ভাবনাগুলো শেয়ার করতে পারছি। আর একটা কথা আমার মনে হয়, সব সময়ই কিন্তু সমকালীন সময়টাকে বেশ জটিল মনে হয়। আজ থেকে ২০ বছর আগের কোনো আড্ডা পড়লে হয় তো পাবো, তখনকার সময়টা জটিল ছিল। আবার আজকের আড্ডাটা যদি ২০ বছর পর কেউ পড়ে, তাহলে হয় তো বলবে- তোমরা আর কী জটিল সময় পার করেছ, এখনকার সময়টাই হলো প্রকৃত জটিল সময়।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা আড্ডার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে গেছি। এবার আপনাদের কাছে একটু জানতে চাচ্ছি, আপনারা কম-বেশি সবাই থিয়েটার দেখেন, তো আপনাদের কখনো ইচ্ছা হয়েছে নাট্যকার হতে?
মুজিব মেহদী
আমার কেবল ইচ্ছাই হয় নি, দু-একটা নাটক লিখে নিজে মঞ্চায়নও করেছি। কী কারণে যেন পরে আর লেখা হয় নি। অনুপ্রেরণাটা পাই নি বলেই হয়তো।
হাসান শাহরিয়ার
পাভেল ভাই প্রথম দিকে বলছিলেন, টেক্সট জরুরি না, আপনার কী মনে হয়?
মুজিব মেহদী
না না, টেক্সট জরুরি। পাভেল ভাই-ই আবার বলেছেন- রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী একটা ফ্যাক্টর। তো রক্তকরবী-র টেক্সট আছে বলেই না উনি এটা বলতে পারলেন। শেক্সপীয়র তো বেঁচে আছেন, কারণ তাঁর টেক্সটগুলো আছে।
আজাদ আবুল কালাম
আমি তাদেরকে অস্বীকার করছি না। আমি বলেছি এঁদের সংখ্যা সব সময়ই কম থাকে।
আহমাদ মোস্তফা কামাল
নাটক লেখার ইচ্ছা আমার বহুবার হয়েছে। কিন্তু এখনও আমার কাছে মনে হয় নাটক লেখার কর্মটা বেশ জটিল। গল্প-উপন্যাস লেখার চেয়ে নাটক লেখাটা আমার কাছে বেশি জটিল মনে হয়।
আলফ্রেড খোকন
তবে ইদানিং আমি যে নাটকগুলো দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, কোথায় থামতে হবে তা নাট্যকাররা জানেন না।
বিপ্লব বালা
সেটা কেমন?
আলফ্রেড খোকন
যেমন নাটক দেখতে দেখতে অনেক জায়গাতেই আমি দাঁড়িয়ে গেছি, নাটক শেষ মনে করে। পরে দেখি না শেষ হয় নি।
বিপ্লব বালা
তাতে অসুবিধা কী? আর আপনি দাঁড়ালেই শেষ করতে হবে, এটা ভাবছেন কেন?
আলফ্রেড খোকন
আমার কাছে মনে হয়েছে নাটকটা ওখানেই শেষ হতে পারতো।
মুজিব মেহদী
৩০০ জন দর্শকের কাছে মনে হলো না, আপনার কাছে মনে হলো কেন? এটাতো আপনারও সমস্যা মনে হতে পারে।
আলফ্রেড খোকন
কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে কোথায় থামতে হবে সেটা জানতেই হবে। মানে পরিমিতিবোধ খুব জরুরি।
হাসান শাহরিয়ার
আমরাও আড্ডার একটা পরিমিতিবোধ রাখি, এবার শেষ করি হাঃ হাঃ। অনেক কথা হলো, হয়ত-বা বিক্ষিপ্ত কথাবার্তাও হলো। তবু আমরা মনে করি বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পীদের এ-ধরনের আড্ডা অনেক বড় মাপের শিল্প তৈরিতে সাহায্য করবে। ভবিষ্যতেও এ-ধরনের আয়োজনের আশা রেখে থিয়েটারওয়ালার পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আজকের আড্ডার সমাপ্তি টানছি। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।