Full premium theme for CMS
থিয়েটার গেইমস্ : অভিনয় প্রশিক্ষণে নতুন ভাবনা [ষষ্ঠ কিস্তি]
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
অনুবাদ: অসিত কুমার
নবম অধ্যায়
সৃজনী কল্পনা ও ফ্যান্টাসির প্রয়োগ
ইতোপূর্বে নির্মিত কর্মকাঠামোর নকশা করা হয়েছিল মনের বুদ্ধি-চিন্তা-পূর্বধারণা-সংশ্লিষ্ট কর্মকৌশল এড়িয়ে যাওয়া এবং দেহজ বল নিঃসরণের মাধ্যমে মানসিক সংবাধ দূর করার লক্ষ্য নিয়ে। এই প্রশিক্ষণ অভিনেতৃর কাজের কিছু সমস্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম। তবে কোনো-রকম বাধ্যবাধকতায় না গিয়ে সেখান থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এই সাধন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে কেবল যখন অভিনেতৃ দুর্ঘটনাক্রমে বা অবচেতনভাবে সে-সব সমস্যার আন্দাজ লাভ করে বা সে-সম্পর্কে সজাগ হয়। প্রশিক্ষক অবশ্যই সতর্ক থাকবেন যে সংকট নিরসনের জন্য অভিনেতৃর প্রয়োজন সংকটের দৈহিক বোধগম্যতা অর্জন। সেটা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত বার বার তাকে প্রতিবন্ধকতার মুখে ঠেলে দেয়া যাবে না।
এক্ষেত্রে সহায়ক হয় বিশেষ কিছু ক্রিয়া যেগুলো অভিনেতৃকে পুরোপুরি চাপ মুক্ত করে। সমস্যা যে আছে এবং সেগুলো যে দূর করতে হবে- এই ভাবনা থেকে অভিনেতৃকে সরিয়ে নেবার মাধ্যমে সচেতন মনপ্রক্রিয়াদি এড়িয়ে যাওয়াই এই সব ক্রিয়ার উদ্দেশ্য। এই কাজগুলো তার বিচরণকে মুক্ত করে দিয়ে তার কল্পনার লাগাম খুলে দেয়।
অনেক বছর আগে যখন আমাদের অভিনয়ের মূলে ছিল অনেক বেশি আবেগ (সেটাকে ভালো বলতেই হবে তা নয়) তখন অভিনয় প্রশিক্ষণের মূলমন্ত্র ছিল ‘আবেগ সুশৃঙ্খল কর’। জোরটা দেয়া হতো আবেগকে আশকারা না দেবার উপর। পৃথিবীটা এবং সেই সাথে থিয়েটারও আজ মনে হয় যেন বড় বেশি সংবাধগ্রস্ত। সেকারণে এখনকার ফ্যাশনটা বাঁক নিয়েছে অবরুদ্ধ আবেগকে মুক্ত করার দিকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সমস্যার বদল হয়। কেবল গৎবাঁধা যান্ত্রিক পদ্ধতিই এই পরিবর্তনকে আমলে নেয় না। যেটা দরকার তা হলো লব্ধ অভিজ্ঞতার শৃঙ্খলাবিধান।
আত্ম-অন্বেষণের পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে। এর শাঁস হচ্ছে সৃজনী-রূপান্তর। এবং এখানেই নিহিত অভিনয়ের শেকড়।
থিয়েটারটা যে-ভাবনার জায়গা থেকেই করা হোক না কেন এর গভীরে রয়েছে একটা রহস্যময়তা; তা অভিনয় কর্ম-সাধনে আমরা যতই বস্তুনিষ্ঠ বা বৈজ্ঞানিক পন্থার চর্চা করি না কেন। ভিন্ন স্থান-কাল-চরিত্র বাস্তবতার শর্তাধীন হয়ে একজন মানুষের অন্য মানুষে রূপান্তরের আনুষ্ঠানিকতাকে কেন্দ্র করেই থিয়েটার আবর্তিত হয়।
এই আনুষ্ঠানিক রূপান্তরের অনেকগুলো দিক আছে। তার মধ্যে পরিবেশনার প্রস্তুতির বিষয়ে প্রত্যেক অভিনেতা স্বতন্ত্র। কেউ কেউ আছেন যারা পরিবেশনকালের অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু করেন। অন্য অনেকে আবার ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ এড়াতে ‘সাডেন ডেথ’র মুখোমুখি দাঁড়ানোই ঠিক মনে করেন। কেউ আবার ব্যয়ামাদি করে শরীরের কলকব্জাগুলোকে গরম করে নেন। এমন জনের সংখ্যাও কম নয় যারা শুয়ে আরাম করেন বা একটু ঘুমিয়ে নেন। বেশ কয়েক ঘন্টা আগে থেকে পরিবেশনার সময় ঘনিয়ে আসার সাথে পাল্লা দিয়ে কীভাবে কর্মোদ্যম উপরে উঠতে থাকে তা আমি টের পাই। দৈহিক ক্রিয়ার মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা এই কর্মশক্তির চূড়ান্ত সীমাকে কাজে লাগিয়ে চাপ কমিয়ে আনার পক্ষপাতি আমি। দেখা গেছে, পরিবেশনকালে অভিনেতৃর স্নায়ুতন্ত্রের উপর যে চাপ পড়ে তা ছোটখাট মটর দুর্ঘটনায় সৃষ্ট মানসিক আঘাতের সমান। এক্ষেত্রে আরো বেশি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের এই অভিনয় পেশা তার গোপন রহস্য নিয়ে বেশি কৌতুহল বরদাস্ত করে না।
কোন অভিনেতাই পরিবেশনার আগের সময়টাকে হাল্কাভাবে নেন না। আবার নাটক শেষে বেশিরভাগ অভিনেতার মধ্যেই একরকম নি®কৃতির অনুভূতি হয়; যেন হঠাৎ করেই চাপের প্রকোপ উধাও হয়ে নির্ভারতা আসে। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কারণটা এও হতে পারে যে, পরিবেশনার আগেই তৈরি হয়ে থাকা কর্মশক্তি এবং মানসিক চাপ নির্গমনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মঞ্চস্থিত চরিত্র চিত্রণ এবং নাট্যক্রিয়া। যেটা পরিস্কার তা হলো, পরিবেশনার পর অভিনেতৃকে কোনো না কোনো মাত্রায় বহুধা আবর্তিত জট খুলে বেরিয়ে এসে তবে নিষ্কৃতি পেতে হয়।
ঐ রূপান্তর ব্যাপারটির সাথে অনেক কিছু জড়িত। বিশেষ করে চরিত্রকে আত্ম-নিরপেক্ষ করে তুলবার উপাদানগুলো: পোষাক, রূপসজ্জা, মুখোশ এবং দ্রব্যসামগ্রী। কিন্তু অভিনয়ের মূল বিষয়টি হচ্ছে অভিনেতৃর সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তি। এই বিচারে, পরিবেশনকার্য সাধনে অভিনেতৃকে রূপান্তরিত হয়ে যেতে হয় নিজ থেকে ভিন্ন ও উচ্চতর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে সেটা না করতে পারলে পরিবেশনা হয়ে পড়ে নিঃস্পন্দ ও সাধারণ।
নির্দেশকের নিজের প্রযোজনায় অবতীর্ণ হওয়ার বিরুদ্ধে একটা যুক্তি এই যে, পরিবেশনার আগে তাকে অজস্র খুঁটিনাটি বিষয়ে মন দিতে হয়; ফলে পরিবেশনার জন্য প্রস্ততি নেবার মত সময় ও স্থিরতা তিনি পান না।
আনুষ্ঠানিক রূপান্তর ও নির্ভারতা লাভের চর্চা
পরবর্তী সব অনুশীলনগুলোতে যাবার আগে করে নেয়া দরকার অষ্টম অধ্যায়ে বর্ণিত শিথিলকরণের ব্যায়ামটি যেখানে পেশিচাপকে তরল জ্ঞান করে কল্পিত নালাপথে নির্গমনের কথা বলা হয়েছে। অভিনেতাকে উৎসাহিত করা হয় যেন সে চাইলেই এটা নিজে নিজে করে নিতে পারে; যেন সে স্থান-কালের আবিষ্টতা ও সচেতন চিন্তা প্রয়াস থেকে মনকে মুক্ত করে নিতে পারে। বেশিরভাগ অভিনেতৃ এমনকি শিক্ষানবিশরাও সামান্য চেষ্টাতেই এই দক্ষতা অর্জন করে। এই অনুশীলনটির সময়সীমা উন্মুক্ত হওয়া উচিত; এটা ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ চলা দরকার বলে অভিনেতৃ নিজে মনে করবে বা যতক্ষণ তার ইচ্ছে করবে। প্রত্যেক অনুশীলনেই একটা মূহূর্ত আসে, অন্য কথায় প্রত্যেক অনুশীলনকারীর ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা একটা সময় আসে যখন প্রয়োজন বা চাহিদামত যথেষ্ট সময় ধরে অন্তরীণ চাপ অন্বেষণ প্রক্রিয়া চলেছে; যখন সে পরিভ্রমণ শেষে হঠাৎ করেই বাস্তব স্থান-কাল-পরিবেশ চেতনায় ফিরে আসে। অনুশীলনের এই যে-সময়সীমা, এটাকে দীর্ঘায়িত করা ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। বরং তার নিজের সন্তুষ্টির পর্যায়ে আসতেই অভিনেতৃর দরকার নিরবে উঠে গিয়ে একটা আসনে বসা; অন্য সবাই শেষ না করা পর্যন্ত ধৈর্যের সাথে সবাইকে লক্ষ্য করা। অংশগ্রহণকারীদের সকলের নিরাপত্তার স্বার্থে অনুশীলন বলয়ের বাইরে একজনকে থাকতে হবে। কারণ অনুশীলন প্রক্রিয়ায় কোনো একজন হয়তো কোনো এক পর্যায়ে থমকে পড়ে অবরুদ্ধ বোধ করতে পারে। এই অবস্থায় দলের নেতা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোনো ব্যক্তি তার সাথে সরাসরি স্পর্শ সংযোগ সৃষ্টি করে কথায় কথায় পথ বাতলে দেবেন; শিখিয়ে দেবেন সমস্য সমাধানের বস্তুনিষ্ঠ, যৌক্তিক পন্থাগুলো। এই কাজটা করতে হয় খুব ভদ্র-সংযত-সংবেদনশীল কায়দায় যার মধ্য দিয়ে তাকে পুরোপুরি সমসাময়িকতায় ফিরিয়ে আনা যায়।
প্রথমবারের মত খেলতে শুরু করেছে এমন জনের ক্ষেত্রে, সম্ভব হলে, খেলার উদ্দেশ্যের কথাটা নির্গমন প্রক্রিয়া শেষ করার পর জানানো ভালো। কারণ, কখনো কখনো দেখা গেছে, আগে থেকে উদ্দেশ্যের কথা বলে দেয়াতে শিক্ষানবিসের মনে সেটা এমনভাবে গেঁথে গেছে যে পন্থা অনুসরণ করে সে আর আরাম-অন্তরীণ-স্বস্তির দেখা পায় নি। পুরো প্রক্রিয়াটি একবার বুঝে নিতে পারলে, প্রায়শই দেখা যায়, তারা পূর্বধারণার বাধা মুক্ত হয়ে সহজেই অনুশীলনটির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে।
ফ্র্যাংকেনস্টাইন
অভিনেতৃকে বলা হয়, যে-বিদ্যুৎচমকে ফ্র্যাংকেনস্টাইনের কৃত্রিম রাক্ষসের প্রাণ ফিরে আসে তেমন কাল্পনিক বজ্র-বিদ্যুতে জেগে উঠতে। যে-সকল অঙ্গের সমন্বয়ে তাদের দেহ গঠিত সে-সকল অঙ্গ তারা পরীক্ষা করে দেখবে; অনুভব করবে সেগুলো কীভাবে পরস্পর সংযুক্ত, কীভাবেই বা তারা কাজ করে। এই পর্যায়টি, শরীর কীভাবে গঠিত বা কীভাবে কর্ম সাধন করে তার সুনির্দিষ্ট ও বিশদ অন্বেষণ। উচ্চতর পর্যায়ে, তাদের মগজটা কোত্থেকে এসেছে বা এর যিনি মালিক তিনি মানুষটা কেমন এবং মগজের ভিতরে যে-সব জ্ঞান-গম্যি-অভিজ্ঞতা জমা করা আছে সেগুলো কীভাবে এলো। এই স্তরটা আমি দেখেছি, কেবল অভিজ্ঞ অভিনেতৃর ক্ষেত্রেই বেশি কার্যকর। প্রারম্ভিকের জন্য, বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা প্রবণতা ত্যাগ করে মনো-অন্বেষণে নিজের কল্পনার লাগাম এতটা আলগা করা দুরূহ।
বিবর্তন
চাপ নির্গমনের পর অভিনেতৃকে বলা হয় প্রাণের বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এক পাক ঘুরে আসতে। ঝিল্লি পর্যায় থেকে শুরু করে অ-মেরুদণ্ডী, মৎস, উভচর, সরীসৃপ, চতুষ্পদ, খাড়া দ্বিপদ প্রাণী থেকে ক্রমশ মানুষ পর্যন্ত সকল পর্যায়ের মধ্য দিয়ে সে একটা কল্প-ভ্রমণ করে আসবে। অনুসন্ধানের এ এক বহুমাত্রিক ক্ষেত্র। এ থেকে একেক জন একেক রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরবে যা থেকে পরে আসবে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান। কল্পনাশক্তির পরিসর মুক্ত করে দিলে অন্বেষণ ও শিক্ষার পরিসর বিস্তৃত হয়।
শিশুর বেড়ে উঠা
“পথে প্রান্তরে শিশু ক্রীড়া” (Children’s Games in Street and Playground) বইয়ের একটা ব্যাপার আমাকে দারুণ ভাবিয়েছে। খুব ছোট্ট একটি ছেলে পথের ধারে গুটিসুটি মেরে বসে আছে; অন্য সবাই কি করছে তা নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই; সে আপন মনে বসে আছে। অন্যদিকে খেলায় মেতেছিল একদল ছেলে। তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করা হলো ঐ একাকী বসে থাকা ছেলেটি কী করছে। সে বললো ওতো একটি শিশু যার এখনো জন্ম হয় নি; যে জন্মাবার জন্য অপেক্ষা করছে। এই ঘটনাটাকে আমি নিয়েছি বড় হয়ে উঠার প্রক্রিয়াকে অনুধাবনের ভিত্তি হিসেবে। আমি যে-দলগুলোর সাথে কাজ করেছি তাদের সবার ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছি, সহজাতভাবেই যেন এরা মনে করেছে, নিজের শৈশবের বিষয়াদি এতই ব্যক্তিগত যে সেটা নিয়ে সরাসরি কাজ করা যায় না। অবশ্য এটা নিয়ে আমি প্রাপ্তবয়স্ক ও পরিপক্ক অভিনেতৃর সাথে কাজ করে দেখি নি। আমার মনে হয়েছে প্রায় প্রত্যেকেই হয় খুব কাছ থেকে দেখা কোনো শিশু যেমন ছোট ভাইয়ের সাথে নিজের সাদৃশ্যকে বা নিজের ও অন্য শিশুর মিশ্ররূপকে কাজে লাগাতে চেয়েছে। কখনো দেখা গেছে অনেকে বেড়ে ওঠার ধাপগুলোকে উপেক্ষা করে নিতান্ত ছেলেমানুষী আচরণে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এটা হয়েছে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেলায়। তাতে অবশ্য আমার কাছে অনুশীলনটি অকেজো হয়ে যায় নি। ব্যক্তিগত উন্নয়ণের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে, একজন এই অনুশীলনটিকে কতটা কাজে লাগাতে পারেন তা দিয়েই অনুশীলনের মূল্য নিরূপন হয়।
পরিবেশনার প্রস্তুতি
এই অনুশীলনটি তৈরি হয়েছিল একবার ‘ড্রামা সেন্টার’র তৃতীয় বর্ষের ছাত্রদের নিয়ে গোর্কির “ভাসা হেলেসনোভা” নাটকের কাজ করার সময়। দৃশ্যসজ্জার মধ্যেই নির্গমন (অধ্যায়-৮) শেষ করবার পর প্রত্যেক অভিনেতৃকে বলা হয় নাটকে সে যে-চরিত্রে অভিনয় করছে, সেই চরিত্র হয়ে উঠে আসতে। তারা দৃশ্যসজ্জার প্রত্যেকটি উপাদান যেমন আসবাবপত্র, অন্যান্য চরিত্র লক্ষ্য করে করে চলতে থাকে। সেটা করতে করতে যে-জৈব ও অজৈব আবহের মধ্যে তাদেরকে অভিনয় করতে হবে তার নিরিখে তাদের প্রতিক্রিয়া অবচেতনে দানা বাঁধলো। পরিবেশনা-উত্তর আলোচনায় যা বেরিয়ে এলো তাহলো এই যে, তারা তাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ ছিল কোনো রকম সচেতন চিন্তা প্রয়াস ছাড়াই। বরং ভাবনাগুলো সহজাতভাবেই নিঃসৃত হয়ে মনে ধরা দিচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে টানা মহড়ায় অভিনেতৃ যেসব কাজ করে আসছিল সেগুলোকে আত্ম-নিরপেক্ষ, সুসংহত এবং তাতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করার ক্ষেত্রে এই অনুশীলনটি যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
অনুশীলনটির সজীব স্মৃতি আমাকে এই মর্মে আস্বস্ত করে যে, অভিনেতৃ-সমবায় নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি অন্যতম শক্তিশালী সৃজনী কৌশল। এটা প্রয়োগ করা যেতে পারে কেবল নির্দিষ্ট অভিনেতৃ পরিমণ্ডলে, কারণ, অন্যান্য ক্রীড়া বা অনুশীলনের তুলনায় এটা অনেক বেশি দলীয় সংশ্লিষ্টতা দাবি করে।
আত্ম-নিরপেক্ষতা অর্জনে আরো কিছু খেলা
আগেরটির মত জোরালোভাবে না হলেও বেশ কিছু অনুশীলন আছে যেগুলো ঐ একই উদ্দেশ্য সাধনে কার্যকর। এদের বেশিরভাগই অভিনয় প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত হয় ব্যাপকভাবে। এই ধারার দুইটি খেলা ‘দৈত্য-দানব’ এবং ‘সপ্ত পাপাচার’।
‘দৈত্য-দানব’র ক্ষেত্রে অভিনেতৃকে বলা হয় তার নিজের দৈত্যটি তৈরি করতে- যার আকার-আকৃতি-চালচলন-আওয়াজ সবকিছুই স্বতন্ত্র। স্বাতন্ত্র্যের জায়গা থেকে তারা এগিয়ে যায় পারস্পরিক বিনিময়ে; বিনিময়ের মধ্য দিয়ে মিশ্রণ এবং শেষ পর্যন্ত যৌথ দৈত্যকূলের উদ্ভব। এর খুব ভালো একটা শুরু হতে পারে দ্য টেম্পেস্ট নাটকে প্রসপেরো’র দ্বীপের ছায়া অধিবাসিদের বর্ণনা দিয়ে।
‘সপ্ত পাপাচার’ খেলার বেলায় অভিনেতৃকে বলা হয় বাইবেল-এ বর্ণিত সাতটি পাপের মধ্যে একটিকে বেছে নিয়ে সেই পাপাচার সংশ্লিষ্ট আচরণ ও আওয়াজ করে পরস্পরের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় যেতে। যথেষ্ট পরিমাণ প্রস্তুতিমূলক কাজ করে না নিলে মধ্যবিত্তসুলভ সংবাধ-সংস্কার এসে অন্তরায় সৃষ্টি করবে। এর ফলে সাতটা ভয়াবহ পাপের মূর্তায়ন না দেখে আমরা দেখবো সাতটা ছোটখাট অপরাধ যা মাফ করে দেয়া যায়। এক্ষেত্রে অন্য প্রশিক্ষকরা উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করেন জীব-জন্তু। কেউ কেউ আবার যন্ত্র ব্যবহার করেন। কিন্তু সেটা মনে করি খুব বেশি যান্ত্রিক হয়ে যায়, যার ফলে কল্পনার অবাধ বিহারে বিঘ্ন ঘটে।
ওয়াল্টার মিটি’র কাল্পনিক ক্রিয়া
অভিনেতৃকে কল্পনার লাগাম আলগা করার সুযোগ দিলে মজার অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় এবং সেটা খুব মূল্যবানও হয়ে ওঠে। বিষয়টা হচ্ছে তাদের দিবাস্বপ্ন এবং অলীক কল্পনাকে সক্রিয় করে তোলা। প্রত্যেকেই কখনো না কখনো এই ব্যাপারটা করে থাকে বিশেষ করে কাছাকাছি দেখে ফেলবার মত কেউ যখন না থাকে। আমরা সবাই হয় সার্জন হয়ে অপারেশন করি; হাতের ইশারায় অর্কেষ্ট্রা পচিালনা করি; রহস্য নগরের রাজপথে ঘুরে বেড়ানো অস্ত্রধারীদের পরাভূত করে জীবন নিয়ে ফিরে আসি ডি’আরটাগনান হয়ে। এটা একটা দারুণ মজার এবং দরকারি অলীক-কল্প-ক্রীড়া। প্রকারান্তরে এবং কার্যত, এটা থিয়েটারের মূলগত বিষয়। এটা একটা অবচেতন ক্রিয়া যা সাধারণত অবদমিত হয়। আমি কখনো একেবারে সোজাসাপ্টা এই অলীক অবয়বগুলোর প্রতিচ্ছবি তৈরির দিকে ধাবিত হই না। বরং শুরু করি আরো হাল্কা ও সুস্পষ্ট ক্রিয়া দিয়ে। সাধারণত আমি শুরু করি বৃত্তাকারে দাঁড়ানো অভিনেতৃদের মধ্যে কাল্পনিক বল নিক্ষেপের মাধ্যমে। বলটিকে কখনো হাল্কা কখনো ভারী এমনকি কখনো বোমা বলে মনে করানো হয়। এই অবস্থা থেকে মনসংযোগ অটল রেখে পরবর্তী ধাপে বলি শারীরিক সংবেদনযোগে অনুভবের মধ্য দিয়ে তৈরি করতে কাল্পনিক কোনো বস্তু যার বিশেষ আকার, আকৃতি, বহিরাবরণ এবং ধারাবাহিকতা আছে, কার্যকারিতা বা উপযোগিতা থাকতেই হবে এমন নয়। তবে অভিনেতৃর শরীরে আনন্দের সংবেদন জাগায় তেমন বস্তুকল্প তৈরির কথাই বলা হয়ে থাকে। খেলাটাকে এগিয়ে নেয়া যায় তৈরি হওয়া পূর্ণাঙ্গ বস্তুটিকে অন্যের হাতে হস্তান্তরের মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে ‘করা’ ও ‘দেখা’ এই দুই ধরণের ক্রিয়া অনুশীলনের সুযোগ আসে। কিন্তু আলোচ্য বস্তুটিকে কোনো অবস্থাতেই বস্তুনিষ্ঠ মুকাভিনয় বা ইশারার ভাষায় চিহ্নিত করা যাবে না। এই খেলার উদ্দেশ্য ‘সচেতন-অনুমান’ নয় বরং ‘সহজাত-সংবেদন’। অপরের কাছ থেকে বস্তুটি গ্রহণ করে তার জন্য প্রযোজ্য ‘সাড়া’ দিতে হবে আন্তরিক সংবেদনের মধ্য দিয়ে। এটা করা হয়ে গেলে পর গ্রহণকারী তার অনুকূলে এটিকে পরিবর্তিত করতে পারবে।
ঠিক আগেরই মত, তৃতীয় পর্যায়ে যেতে অভিনেতৃকে বলা হয় মনোসংযোগের নিবিষ্টতা বজায় রেখে, তার নিজের জন্য আনন্দদায়ক মনে হয় এমন যেকোন কাল্পনিক ক্রিয়া সাধন করতে। এই অবস্থায় যাবার পর বলা হয় বাস্তব জীবন, ইতিহাস, সাহিত্য বা নাটক থেকে কোনো বিশেষ কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করতে।
একেবারে সীমাহীন সম্ভাবনার মধ্য থেকে কে কোন চরিত্র বেছে নেয় বা কেন নেয় তা অত্যন্ত কৌতুহল উদ্দীপক। প্রশ্ন না করা পর্যন্ত বাছাইয়ের কারণটা জানা যায় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাঠ্য ইতিহাস থেকে চরিত্রদের তুলে আনা হয়। অনেক ক্ষেত্রে চরিত্ররা উঠে আসে অভিনেতৃর ব্যক্তিত্ব কাঠামোর অন্তরাল থেকে। এও এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা যে, কল্প-চরিত্রটি একবার আবিস্কৃত হবার পর দ্বিতীয় বার আর তাকে নির্মাণ করা হয় না। সকালের কুয়াশার মত সূর্যের আলোকে তা হারিয়ে যায়।
এর পরবর্তী ধাপে আসে পরিবেশ কাঠামো নির্মাণের পর্যায়। স্পষ্টতই, প্রত্যেক মানুষ তার জীবনাচরণ ও পরিবেশ সাজিয়ে নেয় তার ব্যক্তিত্বের চাহিদা পূরণ এবং নিজেকে বহির্জগতের কাছে তুলে ধরবার মানসে। যারা অতি উচ্চ কল্পনাশক্তিসম্পন্ন তারা হয়তো কেবল নিজেদের জন্য নিজেদেরই মত করে পরিবেশ সজ্জা করে থাকেন। অন্যরা, যারা কম কল্পনাপ্রবণ, তারা নির্মাণটা করে বাঁধা ছক থেকে। এবং এটা সব ধরনের বিপণন এবং জনসেবা সরবরাহ ভাবনার মূলে কাজ করে। তাছাড়া এর ভিত্তিতে যে-কোনো সময়ের যে-কোনো ভূগোলের সমাজ সম্পর্কে তথ্যানুগ মন্তব্য করা যায়।
অভিনেতৃকে বলা যেতে পারে হাতের কাছের আসবাব-পত্র, অন্যান্য ব্যবহার্য, পরিসর এবং অন্য অভিনেতৃদের কাজে লাগিয়ে পরিবেশ তৈরি করে নিতে। সেটা কাল্পনিক বা বাস্তবানুগ উভয়ই হতে পারে। আসলে মানুষ ঠিক কিসে খুশি হয় তা বুঝে নিতে অনেক কাজই করবার আছে। অন্যান্য যে-কোন অনুশীলনের চেয়ে এই কাজটা আমি অনেক কমই করেছি। কারণ, এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনটা প্রশিক্ষণ বা মহড়া পরিস্থিতিতে খুব একটা বেশি অনুভূত হয় নি। তাই একে আমি এখানেই ছাড়লাম এই আশায় যে, হয়তো কেউ কোনোদিন এর সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে এটাকে এগিয়ে নেবে।
বিপরীত ব্যক্তিত্ব
পশ্চাৎ মনের বাচিক প্রতিচ্ছবি যা কি না আত্ম-সচেতনতার সৃষ্টি করে তাকে নিয়ে কাজ করার জন্য একটা খেলা আছে। অভিনেতৃদের দুই সারিতে মুখোমুখি জোড়া করে বসাতে হবে। দলনেতা তার কাজ শুরু করেন প্রশ্ন দিয়ে, যেমন-‘তোমার মুখোমুখি বসা লোকটার কোন দিকটা তোমার সবচে ভালো লাগে’, ‘তোমার কোন দিকটা ওর ভালো লাগে’, ‘ওর শরীরের কোন অংশে তুমি স্পর্শ করতে চাও’, ‘ও তোমার শরীরের কোন অংশে স্পর্শ করতে চাইতে পারে’, ‘তাকে নিয়ে তুমি কোথায় যেতে চাও’, ‘সেখানে গিয়ে কি করতে চাও’ অভিনেতৃ কখনোই এসব প্রশ্নের মৌখিক উত্তর দিতে পারবে না। প্রশ্নমালার ধাপে ধাপে অভিনেতৃর মুখাবয়বে বা দেহের কোনো না কোনো অংশে উত্তরের প্রতিফলন ঘটবে। এইসব প্রতিক্রিয়া নিয়েও তাকে প্রশ্ন করা হবে যেমন, ‘হাসলে কেন’, “তোমার অস্থিরতার কী কারণ’, ‘চোখ সরিয়ে নিলে কেন’ ইত্যাদি।”
ভাবনা-চিন্তায় না গিয়ে পশ্চাৎ-মনের সহজাত প্রক্রিয়াদি সম্পর্কে সজাগ হবার একটা সুযোগ তৈরি হয় এই খেলাটার মধ্য দিয়ে। এটা আমি শিখেছিলাম অত্যন্ত প্রতিভাধর নাট্য-ক্রীড়াবিদ প্রয়াত নাফতালি ইয়াভিন’র কাছ থেকে। আমার বিশ্বাস, তিনি আবার খেলাটা পেয়েছিলেন যার কাছ থেকে তার নাম এড বারমান, আরেক মহান নাট্য-ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ।
এর সাথে মিলানো যেতে পারে ‘পরিবেশনার প্রস্তুতি’ প্রসঙ্গে যে-খেলাটার কথা বলেছি সেটা। তাতে করে প্রশ্নমালার মধ্য দিয়ে অভিনিতব্য চরিত্রের চিন্তা-ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার একটি প্রিন্ট-আউট বেরিয়ে আসে। মহড়া ও ব্যক্তিগত চর্চা থেকে আহরিত কাঁচামাল সমন্বয় ও আত্ম-নিরপেক্ষকরণের এটা একটা পন্থা।
আগে যে-কল্পনাবিহারের কথা বলেছি তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে উপরের অনুশীলনের মহড়া হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে শৃঙ্খলা বিধানের আরো একটি সাধারণ পন্থা আছে।
বাহ্যিক উদ্দীপনায় শরীর-চিন্তন প্রক্রিয়া সাড়া দেয় এবং সেই সাড়ার উপর ভিত্তি করে কর্মের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সূত্রে, অভিনেতৃর প্রয়োজন কাল্পনিক উদ্দীপকের সাড়া দেয়া। কারাগার বা পাহাড়চূড়ায় অবস্থান না করেও তাকে তেমন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বিচরণ বা অবস্থান করাকে বিশ্বাসযোগ্যতার পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সেটা করতে হলে তাকে কাল্পনিকভাবে শরীর-চিন্তন প্রক্রিয়ায় সত্যিকার সাড়া বা আন্দোলন জাগাতে হবে।
সেটা করার জন্য বা করতে শেখানোর জন্য এবং সেটা করার সময় কী ঘটে সে সম্পর্কে অবগত করার উদ্দেশ্যে কতগুলো কাল্পনিক প্রশ্নের ভিত্তিতে ধারাবাহিক কিছু খেলা সাজানো হয়েছে।
এর প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন অনুক্রমিকভাবে সাজানো কিছু মনোসংযেগের ব্যায়াম যেগুলো আমি ব্যবহার করেছি ‘কল্প-চরিত্র অবমুক্তি’র উদ্দেশ্যে। তাছাড়া অষ্টম অধ্যায়ে বর্ণিত স্বতন্ত্র-অঙ্গ-অনুভবক্রীড়াগুলোও কার্যকর। এরপর অভিনতৃকে প্রশ্ন করা হবে: ‘আপনার কাছে নিজের চোখের অনুভূতি কেমন’, ‘মুখ থাকার স্বাদ কেমন’, ‘নাক থাকার গন্ধ কেমন’? এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আলাদা আলাদাভাবে শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গের অনুভব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিই সেরা। এই ব্যায়ামের চাপটা পড়ে শরীর-চিন্তন’র উপর, শারীরিক ক্রিয়ার উপর আদৌ নয়। আরো এক ধাপ এগুলে এই অনুশীলনকে নিয়ে যাওয়া যায় অভিনেতৃকে আত্ম-সচেতন না হয়ে অঙ্গসঞ্চালন করতে পারার কৌশলগত ব্যায়ামের দিকে: ‘হাঁটু ভাজ করতে কেমন লাগে’?
সাধারণত আমি চলে যাই কাল্পনিক সাড়ার দিকে: ‘বদহজম হলে কেমন লাগে’, ‘গোড়ালি মচকালে কেমন লাগে’, ‘দাঁত ব্যথা করলে কেমন লাগে’? যেহেতু মনোসংযোগটা থাকে আবগ-সঞ্চারী শরীর-চিন্তন প্রক্রিয়াদির উপর এবং যেহেতু সঞ্চারিত আবেগ নিয়ে ভাবনা-চিন্তার অবকাশ থাকে না, প্রশ্নমালাকে যতদূর সম্ভব বিস্তৃত করে নিয়ে যাওয়া যায় নানা রকম আবেগ অনুভূতির ক্ষেত্রে। আমরা অনেক সময় আমাদের আবেগ অনুভূতিকে এমনসব শারীরিক উপমা দিয়ে বুঝাই যেন সেগুলো শারীরিক বা গতিনন্দন সংবেদনজাত; এবং সত্যিই সেগুলো তাই। আমরা বলি, ‘ধড়ে পানি ছিল না’ বা ‘পরাণ পাখি বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল’ বা ‘প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থা’ বা ‘কিছুক্ষণের জন্য হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল’ ইত্যাদি। সেকারণে, কেউ চাইলে অনুভূতির তাবৎ শরীরী উপমা এই ব্যায়ামের আওতায় নিয়ে আসতে পারে।
এই ক্ষেত্রে কাজ শেষ হলে পর কাল্পনিক সাড়ার বৃহত্তর বা সমগ্র পরিসরের দিকে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। যেমন, ‘সমুদ্র অভিযাত্রায় জাহাজের কাপ্তান হতে কেমন লাগে’, ‘গেরিলা যোদ্ধা হতে কেমন লাগে’?
এই চর্চায় ক্লিশে ও প্রোটোটাইপ- এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপন জরুরি। ক্লিশে হচ্ছে সেটা যা কাল্পনিক হয়ে উঠবার আগেই নিরূপিত এবং সমগ্র। আর প্রটোটাইপটা হচ্ছে সীমিত জ্ঞানের ভিত্তিতে নির্মিত একটা কাঠামো যেখান থেকে উত্তরোত্তর অনুসন্ধান ও উন্নয়ন সম্ভবপর। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা দেখি, আমাদের মস্তিষ্ক বিচিত্রসব উৎস থেকে তথ্য নিয়ে অবচেতনে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে রাখে। প্রক্রিয়াজাত এইসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা কাজ করি। তাহলে এও পরিস্কার হয়ে যায় যে, অভিনয় নির্মাণ প্রক্রিয়ায় পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন ও পরিস্থিতি বিশ্লেষেণ, মহড়া ও প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যত বেশি তথ্য সংগ্রহ করবো নির্মিত প্রটোটাইপ ততো বেশি সমৃদ্ধ হবে। কারিগরী প্রদর্শনীতেই যদি প্রযোজনার নির্মাণ নির্দিষ্ট বা চূড়ান্ত হয়ে যায় এবং সেই নির্দিষ্টকৃত নির্মাণেরই যদি পুনরাবৃত্তি করতে বলা হয় প্রতিটি প্রদর্শনীতে তাহলেই হয়ে গেল সেটা ক্লিশে থিয়েটার। আর অভিনেতৃ যদি নাট্য পরিস্থিতি এবং তাতে তার ভূমিকা সম্পর্কে সম্যক ও পদ্ধতিগত ধারণা লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে মহড়ারত থাকেন তাহলে প্রত্যেকটি প্রদর্শনীই হবে একটি বিশেষ রূপায়ণের প্রটোটাইপ যা কোনোদিনই রূপায়িত হবে না বা ধরা দেবে না। এর ফলে নাট্য প্রযোজনাটি সামগ্রিকভাবে ধারাবাহিক উন্নতির পথে এগুবে।
প্রোটোটাইপের রহস্য অনুসন্ধানের ইচ্ছাই শিশু-ক্রীড়ার মূল তাড়না। এমনকি সেটা জীবন ব্যাপী শিক্ষণ প্রক্রিয়ারও কেন্দ্রবিন্দু। শিশুরা তাদের ক্ষুদ্র তথ্যসীমার ভিত্তিতেই পিতা-মাতা, পুলিশ বা কোনো বীরের চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। শিশুদের খেলার মূলে থাকে এমন প্রশ্ন: ‘বাবা হতে কেমন লাগে’? তাদের খেলা ততোই পরিশীলিত হয়ে ওঠে তারা যত বেশি পর্যবেক্ষণজাত তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকে কাল্পনিক ক্রীড়ায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে যেতে থাকে। আজকের শিশু ভবিষ্যতে এমন অনেক সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে যেগুলোকে মোকাবেলা করবার মত কোনো প্রত্যক্ষ পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকবে না; সেইসব পরিস্থিতি বুঝবার একমাত্র হাতিয়ার এই কল্প-ক্রীড়াতেই নিহিত। ঐরকম অপ্রস্তুত অবস্থা বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে পরিপক্ক হয়ে না ওঠা পর্যন্ত চলতে থাকে। জীবনের কোনো কোনো পর্যায়ে আমরা সামাজিক বিনিময় এবং দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রে এমনসব জটিলতার মধ্যে পড়ি যা নিরসনের কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের থাকে না। বয়ঃসন্ধিকালে যেটা ঘটে তা হলো প্রটোটাইপ নিয়ে কাল্পনিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটা পর্যবসিত হয় একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়ায়। জীবনে প্রথমবারের মত চাকুরির ইন্টারভিউর কথাই ধরি। আমরা চেষ্টা করি ইন্টারভিউ পরিস্থিতি কল্পনা করে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করে নিতে; এতে নিজেদের একটা কার্যকর ভূমিকায় প্রতিফলিত করি। কথোপকথনের একটা পূর্ব-অনুমিত ছক দাঁড় করাই: ‘একজন আমাকে বলবেন- আসুন, বসুন প্লিজ। তাহলে বলুন, কেন আপনি আমাদের সাথে কাজ করতে চান?’ আমি বলবো- আসলে আমি মনে করি আমি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একজন মানুষ; বর্তমান অবস্থায় আমার প্রতিভার ঠিক ব্যবহারটা হচ্ছে না। আমি একটা সুযোগ খুঁজছি যার মধ্য দিয়ে নিজের সম্ভাবনাকে এবং সৃজনশীলতাকে মেলে ধরতে পারবো’। আমার কথা শুনে তিনি বলবেন- ঠিক আপনাকেই আমরা খুঁজছিলাম। দয়া করে কালই কাজে যোগ দিন।’
নিঃস্পন্দ ক্লিশের উপর দাঁড় করানো এই ডায়লগের মহড়াও চলতে থাকে মনে মনে। এর ফলে বোর্ডের ঐ কাল্পনিক কর্মকর্তার সাথে বাস্তবে খোলামেলা ভাববিনিময়ের সম্ভাবনা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এক নাটকের প্রদর্শনীতে আরেক নাটকের পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসবার মত হয়ে যায়। এই বিষয়টি অবশ্যই মঞ্চ নাটকে নির্দিষ্ট কিছু চরিত্রের রূপায়ণ প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই যে বিশেষ পরিস্থিতিতে স্নায়ুচাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষভাবে আচরণ করার পূর্ব প্রস্তুতি বা সামাজিক বিনিময়ের বিশেষ মূহূর্তকে নিজের স্বস্তির স্বার্থে নাট্যকল্পের আদলে সাজিয়ে নেয়া- এইসব প্রক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ‘সামাজিক ভূমিকা’র সমাজ বৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে। এরভিং গফম্যান’র লেখায় এর সহজ ও বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিষয়ে তার লেখা সব অভিনেতৃর পাঠ্যসূচিতে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।
কল্পনাশক্তি দিয়ে শিশুরা যেভাবে প্রোটোটাইপ বিনির্মাণে সচেষ্ট হয় তার বিপরীত পদ্ধতি অভিনেতৃর ক্ষেত্রে চরিত্র রূপায়ণ প্রক্রিয়ার একটি অংশ। আর এর মধ্যেই রয়েছে স্তানিস্লাভস্কির পদ্ধতিসমূহের মধ্যে দুইটির শিকড়। তার সেই যাদুকরী ‘যদি’ অর্থাৎ ‘যদি আমি .... হতাম তাহলে আমি কী করতাম’ আর এখানকার ‘ .... কেমন লাগে’ এই দুই পন্থা খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে আমার মনে হয় ‘... তাহলে আমি কী করতাম’ এর উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে কাল্পনিকভাবে পরিস্থিতির সাড়া না দিয়ে অভিনেতা কখনো কখনো তার করণীয় সম্পর্কে ‘চিন্তা’ করতে শুরু করে। এদিকে ‘ .... কেমন লাগে’ এই প্রশ্ন অভিনেতৃকে সরাসরি নিয়ে যায় কল্পনার অবচেতন প্রয়োগের দিকে। অর্থাৎ ‘... কী করতাম’ প্রশ্নটি চিন্তার বিষয় এবং ‘... কেমন লাগে’ অনুভবের বিষয়।
এই প্রক্রিয়াটির সাথে স্তানিস্লাভস্কির অপর যে-পন্থার মিল আছে তা হলো বাইরের জগতটাকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে চরিত্রের অন্তরলোক প্রতিফলিত হয়। এখানেও শুরুটা করতে হয় রূপকের মাধ্যমে। আমরা বলি ‘মাটিতে পা পড়ে না / শূন্যে হাঁটে’ বা ‘নাকে-মুখে কাজ’ বা ‘আনন্দে আকাশে উড়ছে’ বা ‘পায়ের নিচে জ্বলন্ত অঙ্গার’ বা ‘কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছে’। আমার মনে হয় ‘বাইরে থেকে কাজ করতে করতে ভিতরে প্রবেশ করা’ বলতে স্তানিস্লাভস্কি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন; এ দিয়ে তিনি নিশ্চয়ই পূর্বধারণা ভিত্তিক বাহ্যিক বৈশিষ্ট দাঁড় করানোর কথা বলেন নি; বলেছেন সরাসরি বা উপমা উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে বাহ্য জগতের কাল্পনিক চরিত্রায়নের কথা যা অভিনেতৃর ভিতর পরিস্থিতির শরীরী-সংবেদন জাগাবে; এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির ঐ কাল্পনিক সংবেদনই অন্তরলোক রূপায়ণের চাবিকাঠি।
এই উপমা বা রূপক অভিনেতৃ, নির্দেশক, নাট্যকার- তিন জনের জন্য তিন রকমের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। রূপক অভিনেতৃকে সাহায্য করে বাহ্যিক শরীরী-সংবেদনের মাধ্যমে অনুভূতির আত্মিক অবস্থাকে আত্ম-নিরপেক্ষ করতে। নির্দেশক দেখেন এইসব রূপক কাজে লাগিয়ে আরো বেশি জটিলসব নাট্য-রূপক তৈরি করে সেগুলো দিয়ে নাটকের বিভিন্ন অংশের ক্রিয়াকে ফুটিয়ে তোলা যায়। নাট্যকার রূপককে কাজে লাগান তার নাটকের বিষয়বস্তুকে স্পষ্ট ও সুচারুভাবে প্রকাশ করার জন্য নাটকের একটি বাস্তববাদী কাঠামো তৈরি করার উদ্দেশ্যে।
একটা গভীর অস্বস্তিকর মানবিক অভিজ্ঞতার কথা বলি: সমুদ্রের পাড়ে জল ঠেলে এগুচ্ছি; বিশাল এক ঢেউ আসছে তেড়ে; এখন কী করবো: নিচু হয়ে বসে পড়ে ঢেউয়ের বেগ সামলাবো না-কি ছুটে যাব সামনে? সেই অভিজ্ঞতার কথা ভাবলেও গা শিউরে উঠে। একবার নাট্যকার আরডেন্’র ‘দ্য ওয়ার্কহাউস ডানকি’ নাটকের একটি দৃশ্যের মহড়া চলছে। পুলিশের নতুন সদর দপ্তর উদ্বোধন হবে। এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। তাই অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে হোমরা-চোমরাগণ উপস্থিত হয়েছেন। এই অবস্থার মর্মটাকে আমরা প্রকাশ করলাম এই রূপকে: কেতাদুরুস্ত জামা গায়ে সমবেত সকলে গভীর শ্রদ্ধার ভাব নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত শুনছে; কিন্তু কারো পরণে প্যান্ট বা স্কার্ট নেই। এই রূপকটি তৈরি হয়েছিল সমুদ্রের জলে দাঁড়িয়ে থাকার সেই অভিজ্ঞতাটা থেকে।
অসিত কুমার : অনুবাদক, সদস্য- ঐকিক থিয়েটার, নারায়ণগঞ্জ।