Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

ঢাকা ঢাকা ডাক পাড়ি।। ঢাকা গেছে কার বাড়ি [১]

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

বাংলাদেশের প্রথম সচল ‘স্টুডিও থিয়েটার’

[স্বাধীন বাংলাদেশের ৩৪ বছরের নাগরিক থিয়েটার নিয়ে কথা উঠলে তাবৎ পাতা জুড়ে থাকে ঢাকা কেন্দ্রীক নাট্যচর্চা। দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঢাকার বাইরে কতটুকু হয়েছে, তার কতটুকু খবরই-বা আমরা রাখি? থিয়েটারটাকে নিয়ে এখন যদি কিছু ভাবতে হয়, নতুন কিছু ভাবতে হয়, তাহলে প্রয়োজন দেশের যেখানে যেখানে থিয়েটার নিয়ে বিভিন্ন ভাবনা ইতোমধ্যেই এসেছে, তার সবগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া। এ লক্ষ্যেই থিয়েটারওয়ালার পক্ষ থেকে ড. বিপ্লব বালা এবং সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার উপস্থিত হয়েছিলেন বরিশালে, ‘শব্দাবলী’র স্টুডিও থিয়েটার দেখতে। ছোট্ট পরিসরে বড় স্বপ্ন নিয়ে ১৫ বছর ধরে যে স্টুডিও থিয়েটার পরিচালনা করে যাচ্ছে ‘শব্দাবলী’, তার সংবাদই জানাতে চাই দেশের সব থিয়েটারওয়ালাদের। সেখান থেকে ফিরে এসে থিয়েটারওয়ালা’র পাঠকদের জন্য প্রবন্ধ লিখেছেন ড. বিপ্লব বালা। - সম্পাদক]

১.
রাষ্ট্রের চরিত্রই এরকম বুঝি; একটি কোনো ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত-পরিচালিত হয় তাবৎ ক্রিয়াকর্ম- রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সব কাজ। একটি কোনো বিশেষ নগর, যার নাম হয় রাজধানী, হয়ে ওঠে সেই কেন্দ্র। সারাদেশের মানুষ বাধ্যতই বুঝি অভিমুখী হয় সেই ক্ষমতাকেন্দ্রের। তার ফলে দেশের আর কোনো ভারসাম্য থাকে না। একটি কোনো নগরের সঙ্গে এক ভেদাভেদের সম্পর্কই দাঁড়িয়ে যায় দেশের আর সব অঞ্চলের, নগরের শহরের। তবে সমাজের সেই চরিত্র নয়। ইতিহাসের ধারায় একেক অঞ্চল একেক ক্রিয়াকর্মে অগ্রণী থাকে। সেটা থাকাই তো স্বাভাবিক। ব্রিটিশ আমল পর্যন্তও সমাজের একটা জোর ছিল। তার ফলে কলকাতা বা ঢাকার বাইরেও নানা শহরে মানুষ বিচিত্র কর্মে লিপ্ত ছিল। ক্রমে তার ভাঙন ধরে। পাকিস্তান আমল থেকেই ঢাকা কেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকাই হয়ে ওঠে দেশের মূল ক্ষমতা-কেন্দ্র। তাই আর -সকল শহরের সঙ্গে তার উচ্চ-নিচ ভেদাভেদের সম্পর্ক। ঢাকায় যা হয় কেবল তারই নাম হয় ‘জাতীয়’। কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় লালন উৎসবও ‘জাতীয়’ হয় না। কখনো সখনো এক-দুইজন ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিনিধি ‘জাতীয়’ কোনো কাঠামোতে নেয়া হলেও কর্তৃত্ব থাকে ঢাকার হাতে। আশ্চর্য, যারা এই ক্ষমতা-বিভেদ লেখায় ধারণায় মানে না, কাজের বেলায় তারাও দেখি একই মনোভাব পোষণ করেন, একই আচরণ করেন। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে তো ঢাকা আর মফস্বল বলে ভিন্ন ক্ষমতা-বলয়ই আছে। ভোটের জন্য যা নিয়ে বেশ রাজনীতি চলে। নির্বাচনের আগে সবাই তাই ছুটে যায় জেলা শহরে- রাজনীতির বেলায় নেতারা যেমন যায় গ্রামে। আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের এক সম্মেলনে অনেক দিন আগে দেখেছিলাম- কীভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য নগণ্যভাবে অন্য শহরের এক-দুজনকে রাখা হয়েছিল কমিটিতে। আর তাদেরও নিশ্চয় হতে হয়েছিল মূল ক্ষমতাবলয়ের অনুগামী। অদ্ভুত লাগছিল, এটা যে বেশ তথাকথিত অগণতান্ত্রিক সেটা কারোই চোখে পড়ছিল না যেন- অথচ সকলেই তো মহা-গণতন্ত্রী, স্বৈরাচারবিরোধী। ক্ষমতা কাঠামোর ব্যাপারটাই এরকমই বুঝি। অজান্তে, প্রতি একক কাঠামোয় তার একই পদ্ধতি প্রক্রিয়া চলে।

চট্টগ্রামে আর রাজশাহীতে বুঝি ধীরে ধীরে একটা সচেতনতা এসেছে। ঢাকা থেকে সব সময়ই যে এক হাত-তোলা-সমর্থনই চাওয়া হয়, যেন তাদের ভিন্ন কোনো মতামত থাকতেই পারে না- এটা প্রশ্ন করা শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামে আলাদা নাট্য সমন্বয় পরিষদ আছে। এমনকি অনেক ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে ভিন্ন অবস্থানও নেয়া হচ্ছে। যেমন বাংলা মাসের তারিখে নতুন সুবিধাজনক যে হিসেব বার করা হয়েছে, যাতে পঞ্জিকার সঙ্গে পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে- তার ফলে গ্রামসমাজের সঙ্গে শহরের আরেক ধাপ ভেদ ঘটে গেল; এতকালের নানা হিসাব সমন্বিত বিবেচনা বাতিল করা হলো এতো সহজে আর তাতে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেও বাংলা সন দিন-তারিখের হিসাব ভিন্ন হয়ে গেল। রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা শহরের সংস্কৃতিজন এটা মানে নি। এর মধ্যেও যে থাকতে পারে এমন রাজনীতি, যাতে কিনা আলাদা করে ফেলা যায় সবকিছুই পশ্চিমবঙ্গ থেকে- একথা মনে করা হয়েছিল। ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা যে এটা লক্ষ্য করছেন না, তাতেও বেশ আহত দেখেছিলাম তাঁদের।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একটি জাতীয় কমিটি আছে। তার এক সম্মেলনে বেশ ক’বছর আগে কথা উঠেছিল এনজিও-র সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে। এক সঙ্গে কাজ না করারই প্রস্তাব নাকি উঠেছিল। সেইমতো অনেক জেলা শহরে অনেকে সেটা মানেন, অনেকে মানেন না। অথচ জোটের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাই যে নানাভাবে নানা এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত তা-ও হয়তো জেলা শহরের জানেন না সকলে। জোট-ভুক্ত অনেক সংগঠনও নানা সময়ে এনজিও-দের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা নেয়। অথচ জেলাতে তাদের শাখা সংগঠন প্রবল এনজিও বিরোধিতা করে চলতো। এ নিয়ে একটা হ্যস্তন্যস্ত কিন্তু তারা করতে পারছেন না ঢাকার সঙ্গে। তার ফলে কোনো কোনো জেলা ঢাকার কেন্দ্রীয় কমিটি বা জোটের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আর মানছেন না। এটা নিশ্চয়ই ক্ষতিকর। দেশময় কোনো মিলিত সংস্কৃতিকর্ম সংগঠিত করার ব্যাপারে এটা বাধা হবে।

আসলে ঢাকার সঙ্গে একটা নেতাকর্মীর সম্পর্কই তো দাঁড়িয়ে গেছে জেলা শহরের। এটাই বুঝি গোলমেলে। ঢাকার ক্ষমতা, যোগাযোগ, প্রচার বেশি। জেলার সবাই প্রায় তাই তাদের সঙ্গে যোগ রাখতে চায়, সুযোগ-সুবিধা বা নামের জন্য- নিশ্চয়ই একটা ঐক্যবদ্ধ আদর্শের জন্যও। সেটাই আসলে টাল খায়। প্রতি জেলা শহরের নিজস্ব একটা ভাবনা চিন্তা কাজ-কর্ম তাতে ব্যহত হয়। একটা নির্ভরশীলতার সংস্কৃতিই দাঁড়িয়ে যায়- ঠিক সশ্রদ্ধ বিনিময়টা ঘটে না। সুলতানের মতো মর্যাদাবোধ অর্জনের দায় নেয়া হয় না। নিজের কাজটা করে গেলে ঢাকা বা গোটা দেশই যে বাধ্য হবে তাঁকে বরণ করে নিতে- এই আত্মনির্ভরতা পায় না সকলে। অথচ আরজ আলী মাতুব্বর সেই কোন গণ্ডগ্রামে বসে কাজ করে গেছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ঢাকা তাঁদেরকেই মর্যাদা দেয় যারা নিজের কাজটার একটা মূল্যমান নির্মাণ করেছেন, করতে পেরেছেন। হাসান আজিজুল হক, সনৎকুমার সাহা, আলী আনোয়ার, অনুপম সেন, প্রয়াত সাধন সরকার, আবুল মোমেন, যতীন সরকার, শান্তনু কায়সার, নিখিল সেন, প্রয়াত নাজিম মাহমুদ- ঢাকার বাইরে মফস্বল শহরে বসে কাজ করেই তো জাতীয় মর্যাদা অর্জন করেছেন। কাজটা শেষ পর্যন্ত গুণমানেই তো বিবেচিত হয়। ঢাকার পিছে পোঁ ধরার ওপর নয়। অবশ্য ঢাকার সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ যারা রাখেন তাঁদের অন্য ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যই থাকে- যা ব্যক্তিগত স্বার্থসম্বলিত, ঠিক কাজ-আদর্শ প্রণোদিত তত নয়। অথচ কাজের মতো কাজ ঢাকাও অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। চট্টগ্রামের বিজয় মেলা বা যশোরের পয়লা বৈশাখের র‌্যালী এখন ঢাকায় শুধু নয়, দেশজুড়েই করা হচ্ছে। জেলা শহরে শহরে এই স্বাধীন স্বয়ংভর মর্যাদা-সম্পন্ন কাজ হোক- তাতেই সারা দেশের মুক্তি। ঢাকা শহর তো ক্রমে একটা বাজারি গঞ্জে পরিণত হচ্ছে। বিশেষ বাণিজ্য বিজ্ঞাপন প্রচারের ধান্দা ছাড়া কাজ কিছু বোধহয় আর হবার নয় ঢাকায়। প্রকৃত কাজের দায় আর ভার আজ ঢাকার বাইরে দেশময় ছড়িয়ে গেছে। মুক্তবাজারের গ্রাসের অনেকটা বাইরে এখনও আছে বুঝি জেলা শহর। কাজেই দায়দায়িত্ব পড়েছে এখন সেখানকার কর্মোদযোগী মানুষজনের ওপর। এখনও তো প্রতি জেলায়ই- প্রায় কাজের নানা যোগ্য মানুষ আর দল-সংগঠন আছে। হয়তো বেশ খানিকটা দিশাহারা অবস্থা তাদের তবুও সব একেবারে নিঃশেষ হয়ে তো যায় নি। এই সুযোগটা, দায়টা নেয়া চাই। তার প্রথম শর্ত হলো: ঢাকার মুখ চেয়ে না থেকে নিজেদের সাধ্যমতো কাজগুলো করে যাওয়া। যেন ঢাকাও একদিন আবার চেতন-হুঁশ ফিরে পায়- তাদের বাজার-দৌড় ক্ষান্ত করার মতি অর্জন করে। দেশের কাছে হারানো মান ফিরে পেতে কেউ কেউ নিশ্চয়ই একদিন উদযোগী হবে। ঢাকার এই বেহুঁশকালে জেলা শহর তার দায়টা সাধ্যমতো পালন করুক।

২.
কত ঘটনাই তো ঘটে ঢাকার এই ক্ষমতার, কেন্দ্রের বাইরে।

আচ্ছা, যদি প্রশ্ন করা যায়, বাংলাদেশে প্রথম কোথায় মোটের উপর এখনও এক স্টুডিও থিয়েটার চলছে নিয়মিত, সপ্তাহের একদিন এক স্থায়ী স্টুডিও মঞ্চে? আমরা নিশ্চয়ই প্রথমটায় কিছু ঠিক হাতড়ে পাবো না। কারো কারো হয়তো মনে পড়বে আমিনুর রহমান মুকুলের কথা, ওরা তো বছর কয়েক ধরেই না করে চলেছে এক স্টুডিও থিয়েটার, দিলু রোডে আর এখন তো নাটক সরণিতেই। তা সেই আমিনুর রহমান মুকুলও নাকি আগে থেকে ভাবনা থাকলেও, দেশের আর এক জায়গায় দেখে, উৎসাহী হয়ে এটা করে চলেছে। সেই ‘আর এক’ জায়গা হলো বরিশাল। বরিশাল ‘শব্দাবলী’ নামের গ্রুপ স্টুডিও থিয়েটার করে চলেছে নিয়মিতভাবেই, প্রায় পনের বছর ধরে, সেই ১৯৯১ সাল থেকে। দলের জন্ম ১৯৭৮।

কেউ হয়তো বাঁকাভাবে বলতে পারে- আমরা পারিও বটে। বাজারে নতুন মাল কিছু আইলে হয়, আইসে বইলা শুনলে হয়, আর দেখলে তো কথাই নাই, একেবারে ঝাঁপায়া পড়ুম নে। সেই উপনিবেশকাল থেকে এই ট্র্যাডিশন সমানে চলতাছে- এখন আর কোলকাতা ভায়া হইয়া নকলের নকল মাল না- একেবারে ডাইরেক্ট। মডার্ন-পোস্টমডার্ন-এ্যাবসার্ড-এপিক-পোস্ট কলোনিয়াল। চ্যাম্পিয়ন বাজারির কোনো জরিপ নাই- দুর্নীতিতে প্রথম হওয়ার মতো- তা হইলে দেখায় দিতাম। তবে এসব কথা বলার লোক কমেও আসছে- এমন আকাল পড়েছে নাট্যবাজারে। অথচ সেই আলী যাকের, আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর থেকে বাচ্চুভাই-মামুনভাই হয়ে জামিল-নীলু-তারিকভাই হয়ে আশীষ, আজাদ আবুল কালাম পর্যন্ত যা কিছু করেছে এমন সব বিপ্লবী কি আধুনিক বুলিস্পৃষ্ট হয়েই করেছে। পরিবেশ থিয়েটার, ন্যারেটিভ, এপিক রিয়েলিজম, কমন স্কাই. স্টুডিও থিয়েটার, কম্যুনিটি থিয়েটার, নিও এথনিক থিয়েটার- আরো কত কী- যার একটাও আমাদের মাথা থেকে বের হয় নি। তবে কেউ কি আর অস্বীকার করতে পারি- বাংলাদেশে নাটকে যা-কিছু বলার মতো তেমন হয়েছে নাটকে, এরাই করেছেন। এরাই তাই এখন পর্যন্ত আমাদের হিরো, রোল মডেল, স্থায়ী স্টার। তাদের নস্যাৎ করলে তো নাট্যচর্চা কি গ্রুপ থিয়েটার খতম।

বরিশালের ‘শব্দাবলী’ কোথায় পেল এই স্টুডিও থিয়েটারের ধারণা? ১৯৮৭ সালে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান এক নির্দেশক-কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালা নামটাই তো দারুণ। কামারশালা থেকেই কি কথাটা এসেছে? কামারের জ্বলন্ত আগুনে লোহার উপর লোহা পেটানোর ভিজ্যুয়াল এ্যাকশনটা তো লাগসই এক নাটকীয় দৃশ্যকল্প। যদিও লোহা পেটালে সোনা হয় না, পুড়িয়ে খাঁটি সোনা তৈরি করতে ঐরকম ভয়ানক পেটাপেটিও করতে হয় না, সেটা ভিন্ন ধরনের কাজ। তবে তখনও তো চলছিল এক হাতিয়ার যুগ- সমাজ বদলের, শ্রেণী সংগ্রাম। সবাই তা না ভাবলেও শ্রমক্রিয়ার এক অভিঘাত ভেতরে একটা পুলক জাগাতোই- অন্তত নান্দনিক এক চেতাবনি সঞ্চার করতো বুঝি। থাক সে কথা। শব্দাবলীর সৈয়দ দুলাল করে সেই কর্মশালা। সেখানে তারিক আনামের কাছ থেকেই শোনে কথাটা- স্টুডিও থিয়েটার। তখন তো ‘আমাদের মঞ্চ আমরা গড়বো’ বলে আন্দোলন-নাটক চলছে। মিটিং-মিছিল চলছে। তারিকভাই হয়তো বলেছিলেন- কবে যে আমরা গড়বো আমাদের মঞ্চ, তারচেয়ে বরং এখনই শুরু করা যায়, যে-কোনো বড় এক ঘরের মধ্যেই এক নাট্যশালা- স্টুডিও থিয়েটার’। সৈয়দ দুলালের মনে লাগে কথাটা। তিনি ফিরে গিয়ে দলকে বলেন আইডিয়াটা। দল রাজি হয়। তারপর খুঁজে পায় সরকারি এক বাড়ির বড় এক ঘর। সরকারের অনুমতি পাওয়ার জন্য যা যা লাগে তা একটু একটু করে সৈয়দ দুলাল করে ফেলে ক্রমে। কাজের লোক সে। বরিশালের নাম রেখেছে।

তাদের এই নিয়মিত নাট্যচর্চায় আর একটি বিশেষ লক্ষণ। তারা নাট্য নির্দেশনা দেয়ার জন্য একের পর এক নাট্যকলায় শিক্ষিতদের নিয়ে যায় দলে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্বে অনার্স (পরে এম. এ) সাজেদুর রহমান চঞ্চল ১৯৯১ সালে প্রথম কর্মশালা করায়। তবে প্রথম স্টুডিও থিয়েটার প্রযোজনা মনোজ মিত্রের মেষ ও রাক্ষস এর নির্দেশনা দেয় সৈয়দ দুলাল। কর্মশালা করিয়ে তারপর নাটকের রূপায়ণ করা হয়। এরপর থেকে কর্মশালা প্রশিক্ষকই সাধারণত নাটকের নির্দেশনা দেয়। আমিনুল ইসলাম দুর্জয় ও পঙ্কজ ১৯৯৪ সালে মলিয়েরের তার্তুফ অবলম্বনে ‘তিনি মুক্তিদাতা’ নির্দেশনা দেয়। এ নাটকের অভিনয়কালে মঞ্চে হামলা-ভাঙচুর করা হয়। নাটকে ধর্মীয় লেবাসধারীর কীর্তিকলাপ ছিল। এরপর আবার সাজেদুর রহমান চঞ্চল ব্রেশটের সেনোরা কারারের রাইফেল নিয়ে কর্মশালা করায়- নাটকটির নির্দেশনা অবশ্য দেন সৈয়দ দুলাল। চঞ্চল পরে ভারতের পণ্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণাকালে শব্দাবলীর স্টুডিও থিয়েটার-এ নির্মাণ করে কলরিজের কবিতা দ্যা রাইম অব দ্যা এনসিয়েন্ট ম্যারিনার এর নাট্যভাষ্য ‘একজন নাবিক ও একটি শঙ্খচিল’। এর আগে ১৯৯৬-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের শিক্ষক দিল্লীর এন.এস.ডি-স্নাতক ড. ইস্রাফিল শাহীন সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নির্দেশনা দেন। ১৯৯৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রথম ব্যাচের এম.এ কামালউদ্দিন কবির ৪০ দিনের এক কর্মশালা করান। এবছরই নাট্যচক্রের আলোক পরিকল্পক ও নির্দেশক দেবপ্রসাদ দেবনাথ স্থানীয় লোকগাথা গুনাই বিবি রূপায়ণ করেন। নাট্য রচনা করেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলায় এম. এ ড. বিপ্লব বালা। একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের নাট্যকলায় এম. এ জসীম উদ্দিন রূপায়ণ করেন ময়মনসিংহ গীতিকা কাজল রেখা। পোশাক পরিকল্পক একই বিভাগের এম. এ এনাম তারা সাকি।

২০০২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যতত্ত্বে এম. এ আমিনুর রহমান মুকুল রূপায়ণ করেন, গোলাম শফিক-এর নাটক শিলারী। পোশাক পরিকল্পক একই বিভাগের এম. এ আলী আহম্মেদ মুকুল। আলোক পরিকল্পনা ঢাকার দেশ নাটকের ইসরাত নিশাত। স্টুডিও থিয়েটারের আলোক ব্যবস্থাপনার নব পরিকল্পনাও তিনি করেন। ২০০৪ সালে শেক্সপীয়ারের রোমিও এন্ড জুলিয়েট- এর সায়মন জাকারিয়া-কৃত নবভাষ্য এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও জুলিয়েট, নির্দেশনা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ থেকে নাট্যকলায় এম. এ সাইদুর রহমান লিপন।

এইসব নির্দেশনা পরিকল্পনা পেশাদারি ভিত্তিতেই হয়েছে। জেলা শহরের একটি দলের পক্ষে যা মোটেই সহজকর্ম নয়। করিৎকর্মা সৈয়দ দুলালের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে এই ব্যয়ভার সামলানো। শুনেছি, স্টুডিও থিয়েটার করা হয় পেশাদারি থিযেটার গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে। বাংলাদেশে অবশ্য এই কাজ দূর-অস্ত এখনো পর্যন্ত। সেই মনোভাব ও দায় নেয়ার স্বাবলম্বন নাট্যজনের চরিত্রে অনায়ত্তও বুঝি। আমরা কেউ সে-ভাবে নাটক করতে চাই-ও নি আসলে। এটা আমাদের কাছে অবসরকালীন বিনোদনই শেষ পর্যন্ত। অবশ্য তাকেও জীবিকা বা ক্ষমতার নানা বাস্তব প্রয়োজনে ব্যবহার করা গেছে যুৎসই প্রয়োগ নৈপুণে। নাটক আমাদের কাছে বাঁচা-মরার বিষয় ঠিক নয় যেমন কিনা ব্যক্তিগত চাকুরি বা ব্যবসার বেলায় বলা যায়। তার জন্য অন্য ধ্বক লাগে। যতই কেন বিজ্ঞাপনী বা মিডিয়া ব্যবসায় আমাদের মেধা লাগসই বাজার বিপণনে দুরন্ত সফলতা অর্জন করুক। তবে ক্রোড়পতি বন গিয়া কজন আর!

শব্দাবলী এতদিনে স্বাবলম্বী হতে চাইছে। চেষ্টা অবশ্য আগে থেকেই করছে তারা। ১৯৯৪ সালে সফোক্লিসের আন্তিগোনে অবলম্বনে দর্পহারী রচনা করেন দলীয় কর্মী সৈয়দ আওলাদ, বর্তমানে খ্যাতিমান মিডিয়া-চিত্রগ্রাহক। নির্দেশনা সৈয়দ দুলালের। ১৯৯৮ সালে শান্তনু বিশ্বাসের ইনফরমার নির্মাণ করেন যৌথভাবে খোকন মুখার্জি ও শহীদুল ইসলাম। বছরের সেরা দশটি নাটকের একটি বলা হয় একে।

২০০৬ সালে তাদের সাম্প্রতিক প্রযোজনা সেলিনা হোসেনের নীল ময়ূরের যৌবন। একই নাম রেখে নাট্যভাষ্য করে সুনন্দ বাশার আর নির্দেশনা দেন সৈয়দ দুলাল। ঢাকার দর্শক শব্দাবলীর ৩ টি প্রযোজনা দেখেছে গুনাই বিবি, শিলারী আর এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও জুলিয়েট। শিলারী অধিক প্রশংসিত। জেলা শহরে নির্দেশনা কর্মটি এত কর্মশালা করে, ঢাকার নাটক দেখেও তত দাঁড়াচ্ছে না। কোনো কোনো শহরে দু-একজনের কাজ অবশ্য আশা জাগায়। জেলা শহরের বেশিরভাগ নেতা-সংগঠক-নির্দেশক তাবৎ মেধা ফেডারেশানের ক্ষমতাবাজিতে খরচ করে দেউলিয়া ফকির প্রায়। তবে শব্দাবলীর নতুন নাটক নীল ময়ূরের যৌবন দেখে উৎসাহী হতে হয়। এতদিনের শিক্ষিত নাট্যজন-নির্দেশকের কাজের ফল ফলেছে। এমনকি এ নাট্যে তারা পূর্ববর্তী শিক্ষানবিশী কালপর্বের সব কাজকে ছাড়িয়ে গেছে। চর্যাপদ-কালীন আখ্যান সঙ্গত এক নাট্যভাষায়, শারীরমুদ্রা ও বাচন বিশিষ্টতায় রূপায়ণ করেছেন। এমত সৃজনসামর্থ্য তারিফযোগ্য- বিস্ময়করই লাগে এমনই এক থিয়েটার-ইডিয়ম উদ্ভাবনায়। এমনই এক নাট্য-স্বাবলম্বন তারা আয়ত্ত করেছে যার জন্য কর্মশালা আর স্টুডিও থিয়েটারের চর্চা নিজেদের পিঠ চাপড়াতে পারে। নিজেদের ঢাক নিজেরা পিটিয়ে ফাটানোর আগে আমাদের উচিত একটু অন্তত ওদের ঢাকটা পেটানো- ফাটিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত। ক্ষমতা-কেন্দ্রের চরিত্র মতো ঢাকার আমরা তো সহজে কেউ কারো, বিশেষত জেলা শহরের কাজ নিয়ে সহসা উচ্চবাচ্য করি না, যদি না বিশেষ কোনো লেনদেন কিংবা ফেডারেশন বা আইটিআই-এর ক্ষমতা ছকে মেলে। এ বিষয়ে ঢাকাকে উপেক্ষা করার মতো স্পর্ধা চট্টগ্রামেরই আছে। অন্যেরা বড় বেশি ‘ঢাকা ঢাকা ডাক পাড়া’য় পারঙ্গম। ঢাকার পিঠ চাপড়ানোর মুখাপেক্ষী। দিল্লী, কোলকাতার পরেই তারা ঢাকাবাদী। ক্ষমতা বলে কথা, সাধ্য কী কেউ মান্য না করে?

এই হয়তো আমাদের মৌলিক সংকটস্থল। অথচ সৃজনকলাটি তো স্বাধীন স্বাবলম্বনের এক স্বতোস্ফূর্তি। একসময় তো একে ঈশ্বরের সমকক্ষ ক্রিয়া বলা হতো। ঠিক সেই তাগদটারই বুঝি অভাব ঘটে প্রায়শ। কাউকে সামনে না রেখে ঠিক ভরসা জাগে না। পীর মুরশীদ গুরুবাদী এক ঐতিহ্য যে আমাদের। অথচ সেই নাকি আসল গুরু যে কিনা শিষ্যের মধ্যে চারিয়ে দিতে পারে আত্মদীপনের এক চেতাবনি, বিচিত্রবীর্য সৃজনফুলকি। মহাভারতে শরশয্যায় অর্জুনকে ভীষ্ম নাকি এমনই বলেছিলেন- তেমন শিষ্যই নাকি শিক্ষকের গুরুর আদর্শ! আচ্ছা, থিয়েটার শুনি নির্দেশকের এক স্বৈরক্রিয়ায় সম্পাদ্য। তারা কি তবে এমন অনুসারী চান না, যে কেবলি মাথা নত করে, নাকে খত দেবে না?  তা কেমন হয় আমাদের নাট্য-রূপায়ণ-প্রক্রিয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণপদ্ধতি। নির্দেশক-শিক্ষকের এক ক্ষমতারতির হাত-পা বাঁধা উপায়-কল বা ক্রীড়নক হয়েই ওঠে নাকি শিক্ষার্থী নাট্যজন? তারপর তারাও একদিন আবার এমন দাপটের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে ওঠে। সমমর্যাদার এক পারস্পরিক বিনিময়ের মিথষ্ক্রিয়ায় কি কোনো শিক্ষা বা নাট্য রূপায়ণ হয়? যৌথ কোনো সৃজনস্ফূর্তি নাট্যক্রিয়ায় কখনো কি ঠিক জাগে? এত যে বলা হয়- থিয়েটার একটি যৌথ শিল্প-মাধ্যম,- তাহলে? মুখে মুখে তো ডায়লগের গুণগানে মুখর আমরা। এটাতো আজ সর্বশেষ আমদানি-বুলি! যত ক্ষমতার মুখেই তো আজ এই এক রা- ডায়লগ চাই, ডায়লগ। ধ্বনি বিন্যাসটাই তো লাগসই। স্মার্ট, ক্ষমতা-বাজার মাত করা। একদিন যেমন ‘বিপ্লব’ কথাটার ছিল বিশ্বজোড়া বাজার। আজ তা কেবল মিডিয়া-প্রযুক্তির পত্রিকা-হেডিং-জোড়া ক্যাপশন, -‘বদলে গেছে দিন, ঘটে গেছে বিপ্লব’।

সত্যই কিন্তু তাই ঘটেছে- বাজারের বিশ্ববিপ্লব। জেলা শহর এ জায়গায় বুঝি পিছিয়ে আছে। সেটাই হয়তো তার একমাত্র সম্বল হতে পারে। নিজেদের অনেকখানি স্বাধীন আত্মমর্যাদায় কিছু করার। বাজারে মুখ ডুবিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ঢাকা কি নিজের অজান্তেই চেয়ে আছে না অনেকখানি বাজার-গ্রাসমুক্ত জেলা শহরের দিকে? এখনও হয়তো সম্ভব শহরে শহরে তেমন কিছু করার যা ঢাকায় বসে আর করা যাবে না। মিডিয়া-সংস্কৃতি বাজার পুরোটা এখনো হয়তো গিলে ফেলতে পারে নি গোটা দেশ, মানবমনের সবটা। জীবন্ত, বাজার বিষে অজর্জর মানুষ, দর্শক আছে সেখানে। জানি না এ-ও হয়তো নিরুপায় উদভ্রান্তির এক কল্পবিলাস!

তবু যে, শব্দাবলী এখনও পর্যন্ত নিজেদের ছোট স্টুডিও থিয়েটারে নিয়মিত এক নাট্যচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে, গাঁটের বা নানাভাবে জোগাড় করা পয়সায়- সেটা বড় গলায় বলার মতো ঘটনা বটে। নাট্যজন যে যেখানে যেমন করে যতটা পারে এমন এক সৃজন-স্পৃহা দেখাতে পারে না কি?- কী বলেন সতীর্থ ভাই-ভগ্নী সকল?

ড. বিপ্লব বালা : নাট্যজন, শিক্ষক ও সমালোচক