Full premium theme for CMS
ঢাকার থিয়েটার, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৬ : সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি কলাকুশলীগণ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[থিয়েটারওয়ালা গত ২৮ এপ্রিল ২০০৬, শুক্রবার, সকাল ০৯:৩০ মিনিটে মহিলা সমিতি মিলনায়তন, ঢাকায় আয়োজন করে এক মুখোমুখি অনুষ্ঠানের। উন্মুক্ত এই মুখোমুখি অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকার থিয়েটার, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৫ : সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি কলাকুশলীগণ’। অনুষ্ঠানে সরাসরি দর্শকদের মুখোমুখি হন জুলাই-ডিসেম্বর’০৫-এ ঢাকার মঞ্চের নতুন নাটক সময়ের প্রয়োজনে, স্বদেশী, কথা’৭১ এবং অহরকণ্ডল-এর নাট্যকার-নির্দেশক-ডিজাইনার আর অভিনেতৃগণ। থিয়েটারওয়ালা সম্পাদক হাসান শাহরিয়ারের সঞ্চালনে অনুষ্ঠানটি একটানা চলে দুপুর পৌনে ২টা পর্যন্ত। পাঠকদের জন্য মুখোমুখি অনুষ্ঠানটি অনুলিখন করে ছাপা হলো এই সংখ্যায়। অনুলিখন করেছেন, থিয়েটারওয়ালা’র সহকারি সম্পাদক সাইফ সুমন]
হাসান শাহরিয়ার
সুধি দর্শক, শুভসকাল। আমাদের ঘড়িতে এখন সকাল ৯:৩০ মিনিট। নির্ধারিত সময়ে আমরা শুরু করতে যাচ্ছি আমাদের আজকের মুখোমুখি অনুষ্ঠান ‘ঢাকার থিয়েটার, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৫ : সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি কলাকুশলীগণ’। আপনারা আপনাদের আসনে বসে পড়ুন। আমাদের অনুষ্ঠানে এবার ৪টি নাটকের কলাকুশলীগণকে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি। নাটকগুলো হলো- সময়ের প্রয়োজনে, স্বদেশী, কথা’৭১ এবং অহরকণ্ডল। অনুষ্ঠান পরিকল্পনাটা আপনাদের জানিয়ে দিই। আমরা একটি নির্দিষ্ট নাটকের নাট্যকার-নির্দেশক আর ডিজাইনারদের মঞ্চে ডাকবো এবং অভিনেতৃগণ থাকবেন দর্শক-সারিতে। যে-কোনো দর্শক নির্দিষ্ট নাটকের উপর প্রশ্ন রাখতে পারবেন, তবে যারা নির্দিষ্ট নাটকটি মঞ্চে দেখেছেন তারাই পাবেন প্রশ্ন করবার অগ্রাধিকার। প্রথম পর্বে প্রত্যেক নাটকের জন্য বরাদ্দ থাকছে ৫০ মিনিট করে। ৪টি নাটকের প্রথম পর্বের প্রশ্নোত্তর হয়ে যাবার পর ৪ নির্দেশক মঞ্চে এসে বসবেন এবং তখন প্রশ্নোত্তর পর্বটি থাকবে উন্মুক্ত। অর্থাৎ যে-কোনো নাটকের উপর প্রশ্ন করা যাবে এবং নির্দেশক বা নির্দেশকের অনুমতি নিয়ে নির্দিষ্ট নাটক-সংশ্লিষ্ট যে-কেউ এর উত্তর দিতে পারবেন। তাহলে শুরু করা যাক। আমি প্রথমেই মঞ্চে আসবার জন্য অনুরোধ করছি থিয়েটার আর্ট ইউনিটের সময়ের প্রয়োজনে নাটকের কলাকুশলীদের। মঞ্চে আসবার জন্য অনুরোধ করছি নির্দেশক মোহাম্মদ বারী, সংগীত পরিকল্পক সেলিম মাহবুব (অনুপস্থিত), মঞ্চ পরিকল্পক কামালউদ্দিন কবির ও পোশাক পরিকল্পক ফরিদা আকতার লিমাকে।
সুধি দর্শক প্রশ্ন করুন।
বিপ্লব বালা
[নাট্যশিক্ষক, নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধের নিয়মিত লেখক]
এখন হয়তো এই প্রশ্নটির মানে নেই, তবুও করা যেতে পারে ... সেটা হলো- সময়ের প্রয়োজনে নাটকটা যে করা হলো, ঠিক এখনই এটা করা হলো কেন? গল্পটা যখন লেখা হয়, তখন সেটা তখনকার সময়ের প্রয়োজন মিটিয়েছে। কিন্তু এখন আপনার নাটক কতটা সময়ের প্রয়োজন মিটিয়েছে বলে মনে করছেন?
মোহাম্মদ বারী
[নির্দেশক-অভিনেতা, সময়ের প্রয়োজনে]
বিপ্লব দা’কে ধন্যবাদ। সেই সাথে থিয়েটারওয়ালাকে ধন্যবাদ, এ-রকম একটি মুখোমুখি অনুষ্ঠানে আমাদের নাটক সময়ের প্রয়োজনে-কে সম্পৃক্ত করায়। অনুষ্ঠানটি শিল্পকলা একাডেমীর এক্সপেরিমেন্টাল হলে হয়ে আসছিল। কিন্তু এবার এক আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এটি সেখানে অনুষ্ঠিত হতে পারলো না। আমি আমার ও আমার দলের পক্ষ থেকে এর নিন্দা জানাই এবং শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো ভবিষ্যতে যেন এই অনুষ্ঠানটি সেখানে হতে পারে। আমি বিপ্লব দা’র প্রশ্নের উত্তরে যাই, সেটা হলো সময়ের প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের একটি গল্প এবং বাঙ্গালি জাতির সর্বাপেক্ষা গৌরবময় ঘটনা হলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পরে বড় কোনো ঘটনা বাঙ্গালির জীবনে আছে বলে আমার মনে হয় না। তো মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে জহির রায়হান একটি ক্যাম্পের ঘটনার চিত্র এঁকেছিলেন কথা দিয়ে। এই গল্পে এক জায়গায় আছে যে, ক্যাম্প কমান্ডার সহযোদ্ধাদের জিজ্ঞাসা করছেন- কেন তোমরা যুদ্ধ করছো? এর উত্তরে একেক মুক্তিযোদ্ধা একেক উত্তর দিচ্ছে ... কেউ বলছে ওরা (পাকিস্তানিরা) আমাদের শোষণ করছে, কেউ বলছে ওরা আমাদের মা-বোনদের অত্যাচার করছে তার প্রতিশোধ নিতে চাই, কেউ-বা বলছে আমরা ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছি। তারপর কমান্ডার সব উত্তর মেনে নিয়েই বলছে- তোমাদের সব কথাই ঠিক, তারপরও আমরা আসলে যুদ্ধ করছি সময়ের প্রয়োজনে। সময়ের আহ্বানেই আমরা যুদ্ধে নেমেছি। অর্থাৎ সময়টাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি আমার রূপান্তরে, যেহেতু নাটকটা করছি সেই মুক্তিযুদ্ধেরই ৩৫ বছর পর এবং দেখতে পাচ্ছি যে, যুদ্ধের ফলাফলটা কী হয়েছে- তাই আমি বলিয়েছি, এই নাটকে, যে- আসলে আমরা যুদ্ধ করছি শান্তির প্রয়োজনে, মানুষের মুক্তির প্রয়োজনে। কারণ, আমার কাছে মনে হয়েছে- কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতার জন্য এই যুদ্ধটা হয় নি, প্রয়োজন ছিল মানুষের মুক্তি এবং এই মুক্তির জন্যই আমরা সর্বক্ষণ মুক্তিযুদ্ধ করে যাচ্ছি। সে-কারণে জহির রায়হান যেখানে বলেছেন- সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ করছি, সেখানে আমি রূপান্তরের সময় আরেকটু যোগ করেছি যে, আমরা যুদ্ধ করছি শান্তির প্রয়োজনে, মানুষের মুক্তির প্রয়োজনে। এই জন্য আমার মনে হয়েছে এই নাটক এখনও সময়ের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। ধন্যবাদ।
সৈয়দ শামসুল হক
[নাট্যকার]
এখানে রূপান্তরের কথা বলা হলো ... তো এটাকে কি রূপান্তর না অবলম্বন বলবো? আমার মনে হয় এই টার্মিনোলজিগুলো পরিষ্কার হওয়া দরকার। তুমি রূপান্তর বলছো, রূপান্তর কিন্তু একটি মর্মান্তিক কথা ... একটি রূপকে পাল্টে দেয়া। ঢাকাইয়া ভাষায় যাকে বলে- খোমা বদলে দেয়া। তো এটা পরিষ্কার করবে কি যে, তুমি গল্প অবলম্বনে করেছ না অনুপ্রাণিত হয়ে করেছ না ছায়া অবলম্বনে করেছ না একেবারে ‘খোমা’ পাল্টে করেছ, কোনটা?
মোহাম্মদ বারী
খুব যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছেন হকভাই। কিন্তু আপনার কাছে এর উত্তর দিতে আমি অক্ষম। আসলে আমি যেটা করেছি- ইংরেজিতে যাকে বলে এ্যাডাপ্টেশন, তারই বাংলা বলছি আমি রূপান্তর। আমি বরং আমি কী করেছি বলছি, আপনি বলে দিন প্রকৃতপক্ষে এটাকে কী বলা যায়। আমি যা করেছি সেটা হলো- মূল গল্পটির প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থেকে, গল্পের সূত্র থেকে নতুন কিছু ঘটনা, চরিত্র ইত্যাদি তৈরি করেছি। তো এটাকে কী বলবো?
মামুনুর রশীদ
[অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক]
গল্পটি জহির রায়হানের। তুমি এটির নাট্যরূপ দিয়েছ- রূপান্তর করো নি। পশ্চিমবঙ্গে একটা রেওয়াজ আছে, ওরা বলে- গল্প: ওমুক (ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ), নাটক : ওমুক ... তো তুমি যেটা করতে পারতে সেটা হলো- গল্প : জহির রায়হান, নাটক : মোহাম্মদ বারী। হকভাই-কে আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে ধরবার জন্য। কোনটা রূপান্তর আর কোনটা নাট্যরূপ আর কোনটা অবলম্বন- সেটা আমাদের পরিষ্কার থাকা দরকার। কারণ, আমাদের এখানে রূপান্তরের নামে যা হচ্ছে তা কিন্তু ভয়াবহ। যেমন ব্রেখটের নাটকের ব্যাংকের মালিক, সেটাকে যদি গুদারাঘাটের বেপারী করা হয় তা হলে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ভয়াবহ হবে।
মোহাম্মদ বারী
ব্রুশিয়ারে অবশ্য আমরা ‘নাট্যরূপ’ কথাটাই ব্যবহার করি।
অনন্ত হিরা
[নাট্যজন- প্রাঙ্গণে মোর]
আমি হকভাই-এর কাছেই জানতে চাচ্ছি- জহির রায়হান যে রূপটা দিয়েছেন, সেটা গল্প আর বারীভাই কিন্তু আরেকটা ‘রূপ’-ই দিয়েছেন। মানে গল্পকে নাটকের রূপ দিয়েছেন। হকভাই বলছেন- রূপান্তর বড় নির্মম, আমি বলবো একজন শিল্প-নির্মাতাকে তো শিল্প সৃষ্টির জন্য নির্মম হতেই হবে। বারীভাই তো রূপান্তরই করেছেন মনে হচ্ছে, হকভাইয়ের কী মত?
সৈয়দ শামসুল হক
আমরা অনেক শব্দ ব্যবহার করি অভ্যাসবশত। অনেকের মুখে শুনেছি বা পত্রিকায় পেয়েছি, সেটাই আমিও লিখে ফেলছি। কিন্তু এই যে রূপান্তর ব্যাপারটি ... আমি ব্যক্তিগতভাবে রূপান্তর পছন্দ করি না। কারণ, রূপকে পাল্টে দেয়াটা একমাত্র পারেন যদি একই ব্যক্তি হন। কী রকম? যেমন রবীন্দ্রনাথ যখন চিত্রাঙ্গদাকে কাব্যনাট্য থেকে নৃত্যনাট্য করেন, এটা সম্পূর্ণ তার এখতিয়ার। এটি রূপান্তরিত একটি সংস্করণ। আর কতগুলো চালু কথা আছে, যেমন- অবলম্বন, ইংরেজিতে যাকে বলে বেইজড অন। এ্যাডাপ্টেশন আর রূপান্তর কিন্তু এক না। বারী যেটা বললো এ্যাডাপ্টেশন এবং রূপান্তর এক, না এক না কিন্তু। এ্যাডাপ্টেশনকে অবলম্বন বলা যেতে পারে। আর নাটকের ব্যাপারে একটা কথা বলি- নাটকে কিন্তু মৌলিক গল্প খুব কমই হয়। সেই সফোক্লিস থেকে শুরু করে একেবারে ... কার কথা বলবো, মানে আমার ছেলে এখন নাটক লেখার চেষ্টা করছে ... সে পর্যন্ত, শোনা কথা- জানা কথা- অন্যের গল্প- প্রচলিত ইতিহাস- পুরাণ- মিথ ... এগুলোকে নিয়ে নাটক লিখতে চাচ্ছে। সমগ্র শিল্পকর্মের মধ্যে কেবল নাটকেই এই বিষয়টি বেশি পাওয়া যায় যে, বিভিন্ন সূত্র, বিভিন্নকাহিনী বা তার আখ্যানভাগ নেয়া হয়ে থাকে। শেক্সপীয়রও করেছেন। তার আগেও হ্যামলেট লেখা হয়েছে দু’বার আবার কেউ কেউ বলে ছ’বার। তাঁর ৩৬ টি নাটকের মধ্যে মৌলিক কাহিনী মাত্র ২টি। ব্রেশটেরও তা-ই ... ইতিহাস থেকে নেয়া, অন্যের কাছ থেকে নেয়া গল্প। এমনকি ব্রেশট এমনও করেছেন যে, উনি স্বীকারও করেন নি যে, এটা অমুকের গল্প বা ইত্যাদি ইত্যাদি। তো আমাদের পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, আমরা যা-ই করি না কেন- সেটা রূপান্তর না অবলম্বন না ছায়া অবলম্বন, সেটাতে পরিষ্কার থাকা। আমি এখন যে নাটকটি প্রায় শেষ করে এনেছি সেটিকে বলছি- ‘বীজ অবলম্বনে’। আজ থেকে বহু শত বছর আগের এক নাট্যকারের বীজ অবলম্বনে এটা করছি। কিছু প্যারালাল সংলাপ, চরিত্রও পাওয়া যাবে, তবুও বীজ অবলম্বনে বলছি। ঐ বীজটাকে আমি একটা নতুন জমিনে প্ল্যান্ট করছি, ভাষা পাল্টে দিচ্ছি, চরিত্রও পাল্টে দিচ্ছি, সময় পাল্টে দিচ্ছি।
তো আমি বোধহয় কিছুটা লম্বাই করে ফেললাম, এই লম্বা করার কারণ আমাকে আসলে একটু উঠতে হবে। অনেক সময় ভালোবাসার মানুষদের রেখে বাজারেও যেতে হয়, আমার বেলাতেও হয়েছে তা-ই। যেতে ইচ্ছা করছে না, কিন্তু আগে থেকে কথা দিয়েছিলাম তাই যাচ্ছি। যাবার আগে আমি বলতে চাই, এই আয়োজন অবশ্যই এক চমৎকার আয়োজন। আমরা সবাই মিলে কথা বলছি। এই সুযোগটা আরো বেশি বেশি হওয়া দরকার। আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্য থিয়েটারওয়ালাকে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ বারী
হকভাই যাওয়ার আগেই একটু বলতে চাই যে, হকভাই বা মামুনভাই, এঁনারা হচ্ছেন আমাদের কাছে একটা আদর্শের জায়গা ... তো থিয়েটারের কালগুলোকে যদি দশক-ওয়ারি ভাগ করি তাহলে সত্তরের দশক হলো আমাদের উন্মেষকাল, আশির দশক পুরোটাই রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করলো নাট্যকর্মীরা আর নব্বুই দশকে এসে যখন আমাদের নাটক একটা পরিশীলিত রূপ পেতে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই আকাশ সংস্কৃতি আর বাজর অর্থনীতির দাপটে আমাদের থিয়েটার একটু দর্শক হারালো। আমরা মনে করছি এটা সাময়িক সমস্যা কারণ, জীবন্ত মাধ্যমের সাথে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কম্পিটিশন হতেই পারে না। তবে এটা মানতেই হবে যে, আমরা আমাদের দর্শক হারিয়েছি- অন্তত পুরোনো দর্শক যে হারিয়েছি এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর বর্তমান যে দশকটি চলছে, সেটিকে আমি বলতে চাই- পালা বদলের কাল। এখন অনেক নবীন নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃ কাজ করছেন এবং আমরা মনে করি অনেক ভালো কাজ করছেন। তো আমি বেশ আক্ষেপ করেই বলতে চাই যে, এই পালা বদলের কালে আমাদের সিনিয়র নাট্যজনেরা কিন্তু আমাদের কাজগুলোকে দেখতে আসছেন না। আমাদের কাজের ভালো-মন্দ দিকগুলো যদি ওনারা নাটক দেখে ঠিক করে দিতেন, তা-হলে আমরা আরো ভালো কাজ করতে পারতাম। কাজের অনুপ্রেরণা পেতাম।
গোলাম শফিক
[নাট্যজন- পালাকার]
হকভাই-এর কথার প্রসঙ্গ ধরে আমি একটু বলতে চাই যে, ঢাকার মঞ্চে আমরা অনেক রূপান্তরিত নাটক, গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে নাটক দেখেছি। ইদানিং যেটা যোগ হয়েছে যে, কোনো বরেণ্য ব্যক্তির ডাইরী অবলম্বনে নাটক হচ্ছে। এটি খুবই ভালো কথা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে- এই নবনির্মাণ করতে বা নাটকে রূপান্তর করতে গিয়ে আমাদের কোনো অন্তর্নিহিত নীতিমালা বা ইথিকস মেনে চলা উচিত কী উচিত না? কারণ আমি সব সময় বিষয়টিকে একটা সেন্সেটিভ বিষয় হিসেবে লক্ষ্য করছি ...
হাসান শাহরিয়ার
একটু পরিষ্কার করলে বোধহয় ভালো হয়। ধরুণ সময়ের প্রয়োজনে বা বিনোদিনী নাটকে এধরনের কিছু পেয়েছেন কি?
গোলাম শফিক
না, এটি সাধারণ প্রশ্ন। এটি উল্লেখিত নাটকগুলোর ব্যাপারে না-ও হতে পারে। আমি বারীভাইকে প্রশ্ন করছি এধরনের রূপান্তরে রূপান্তরকারীর বা নব-নাট্যনির্মাণকারীর কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করা উচিত?
মোহাম্মদ বারী
আমি যেটা মনে করি যে, একজন রূপান্তরকারীর স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। রূপান্তরের যে বিষয়টি, যেটি অনন্ত হিরা একধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছে, যে, এটি তো এক ধরনের রূপেরই বদল হচ্ছে। গল্প থেকে নাটক, মানে কাঠামোটাই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে- সাহিত্য থেকে দৃশ্যকাব্যে রূপান্তর। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় যে, নাট্যরূপ বা রূপান্তর যেটাই হোক না কেন সেটা যিনি করেন তার উপর ছেড়ে দেয়া উচিত।
নূনা আফরোজ
[নাট্যজন- প্রাঙ্গণে মোর, নির্দেশক- স্বদেশী]
আমি বারীভাইয়ের একটু আগের কথার প্রসঙ্গে বলতে চাই ... সেটা হলো, আমাদের সিনিয়র নাট্যজনরা নাটক দেখেন না। এই প্রক্রিয়াটি যদি চলতে থাকে তো আমি ভীষণভাবে শঙ্কিত যে, আমাদের সিনিয়ররা কি আলটিমেটলি নাটকের সাথে জড়িত থাকবেন না? তো আমরা জুনিয়ররা কী করছি, কেমন করছি এই বিষয়টি তো শেয়ারিং হচ্ছে না। এই বিষয়ে মামুনভাই বা হকভাইয়ের কাছ থেকে কিছু জানতে চাই।
মামুনুর রশীদ
আমি নিজ থেকেই ভাবছিলাম, এই কথাটার জবাব দেয়া দরকার। আমার প্রশ্ন হলো থিয়েটারে কি নবীন প্রবীণ বলে কোনো কথা আছে? একজন সিনিয়র যদি ভালো নাটক করতে না পারে, তাহলে কি শুধু সিনিয়র বলেই লোকে সেটা দেখতে আসবে? আর জুনিয়াররা ভালো করলেও সেগুলো দেখতে আসবে না? হকভাইয়ের কথাই যদি বলি, উনি আমার কত সিনিয়র! সেই ছোটবেলা থেকে ওনার সাহিত্যকর্মের সাথে আমি পরিচিত। কিন্তু উনি কি আমার বন্ধু নন? সেই বন্ধুত্বটা তৈরি হবে কিন্তু সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়েই। আজকে সকালে আমি ভাবছিলাম যে, থিয়েটারওয়ালার এই আয়োজনে আমি কেন যাচ্ছি? তো আমার মনে হলো আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে যাচ্ছি। কারণ, আজকের এই আয়োজনে যারা মুখোমুখি হচ্ছে তারা সবাই নবীন, এবং আমি মনে করি এই নবীনদের সাথে লড়াই করেই আমাকে টিকে থাকতে হবে। সুতরাং আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা কী ভাবছে, কী করছে, সেটা আমার জানা দরকার। এই জন্যই এখানে আসা। আর হ্যাঁ, আমাদের সিনিয়রদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা নিজেদের নাটক ছাড়া অন্য-কোনো নাটক দেখেন না। তারা হয়তো ভাবেনও যে, তাদের নাটক ছাড়া অন্যদের নাটক আসলে হয়ও-না। তো তারা যদি না আসেন তাহলেও তোমাদেরই বা কী আসে যায়?
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। তবু একটা কথা বলা প্রয়োজন, সেটা হলো মামুনভাই- আপনারা যখন কাজ শুরু করেছিলেন, তখন কোনো সিনিয়র নাট্যকর্মী ছিলেন না। সুতরাং আপনাদের অনুপ্রাণিত করার মতো অভিভাবক হয়তো ছিলেন না, কিন্তু আবার আপনাদের কাজে বাধা দেবার লোকও কিন্তু কেউ ছিলেন না। আমাদের অভিভাবক থাকার ফলে হয়েছে কী, সহযোগিতা না করলেও মাঝে মাঝে অসহযোগিতা পেয়ে যাই, আর তখন আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই।
কামালউদ্দিন কবির
[নাট্যজন- জন্মসূত্র, নির্দেশক- অহরকণ্ডল, মঞ্চ পরিকল্পক- সময়ের প্রয়োজনে]
মামুনভাইয়ের কথা প্রসঙ্গে বলি, হ্যাঁ, শিল্পসৃজনের ক্ষেত্রে নবীন-প্রবীণের অবশ্যই বিভেদ না রাখাই ভালো, কারণ শিল্পকর্মই তার নতুনত্ব, সৌন্দর্য, সৌকর্য প্রকাশ করবে। তারপরও একটি নাট্যকর্ম নিয়ে যখন একজন মামুনুর রশীদ, একজন সৈয়দ হক বা একজন আতাউর রহমান কথা বলেন, তখন অবশ্যই সেটা আমাদের জন্য একটি বিশেষ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিতে চাই- সম্প্রতি একটি নাট্যপত্রে দেখলাম, শ্রদ্ধেয় আতাউর রহমানভাই লিখেছেন- ‘... আরেকটি প্রবণতা বাংলাদেশের মঞ্চে ইদানিং লক্ষ্য করছি। তা হলো, ন্যারেটিভ থিয়েটারের নামে বেশ কয়েকটি নাটকের দল ঢাকা থিয়েটারের এবং সেলিম আল দীনের নাট্য-রচনাকে অযোগ্য অনুসরণ করছেন।...।’ এখন এই লাইনটি পড়ে নিশ্চয়ই মনে হতে পারে, শ্রদ্ধেয় আলোচক এই সময়ের যে-সমস্ত তরুণ নাট্যজন ন্যারেটিভ থিয়েটারের চর্চা করছেন, তাদের সব কাজগুলোকেই দেখেছেন। কিন্তু আমি যদ্দুর জানি, আমার অহরকণ্ডল নাটকটি, যেটি কিনা বর্ণনাত্মক রীতিতে নির্মিত সেটি উনি দেখেন নি। তো এই যে না দেখেই ঢালাও মন্তব্য করা, এটা কিন্তু আমাদের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, ওনার মন্তব্য কিন্তু অন্যান্য দর্শকদের উপর প্রভাব ফেলবে। ধন্যবাদ।
হাসান শাহরিয়ার
কিছু কথা হলো যেগুলো ঠিক সময়ের প্রয়োজনে নাটকের উপর ভিত্তি করে না, তবুও বিষয়গুলো জরুরি ছিল বলে সময় দিলাম। তো আমি আশা করছি এই সময়টুকু সময়ের প্রয়োজনে নাটকের বরাদ্দ থেকে কাটা যাবে না। আমি এই নাটকের উপর প্রশ্ন চাইছি।
ঠাণ্ডু রায়হান
[নাট্যজন- আরণ্যক নাট্যদল, আলো পরিকল্পক- স্বদেশী]
আমার প্রশ্ন বারীর কাছে, যদিও প্রশ্নটা আলো বিষয়ক, সেটা হলো সময়ের প্রয়োজনে নাটকে আম্বার কালার বলে একটি আলো মঞ্চে বারবার এসেছে ... সেটা যুদ্ধের সময়ে এসেছে, দুঃখের সময়ে এসেছে ... একই রঙ বারবার এসেছে। আরেকটি আলো ছিল, গোবো লাইট ব্যবহার করা হয়েছে, প্রথমেই যে পর্দাটা থাকে মঞ্চের সামনে এর উপর, যেটা হলে ঢুকেই চোখে পড়ে। কিন্তু নাটকের আর কোথাও সেই আলোটি ব্যবহার করা হয় নি। এটা কেন?
মোহাম্মদ বারী
আসলে লাইট ডিজাইনার নাসিরুল হক খোকন এটার ভালো উত্তর দিতে পারতেন। উনি এই অনুষ্ঠানে আসতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন, তো আমি নির্দেশক হিসেবে এর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি। আমি ডিজাইনারের সাথে প্রথম আলাপ কালেই বলেছিলাম যে, টোটাল নাটকেই আমি একটা মৌন ছবি চাই, উজ্জ্বলতাটা একটু কম চাচ্ছিলাম। তো টেকনিক্যাল যে বিষয়গুলো আছে যেটা বললেন যে, আম্বার কালারের ব্যবহার এগুলো আমি খুব একটা বুঝি না। আর শুরুতেই পর্দার উপর যে লাইটের কথাটা বললেন, সেটা আমি যুদ্ধের পটভূমির জায়গাটা স্বচ্ছ পর্দার ব্যবহার করেছিলাম আর মূল নাটকটা অর্থাৎ ক্যাম্পের সময় পর্দাটা উঠিয়ে দিয়েছিলাম। পরে অনেকের কথায় বোঝা গেল যে, এই শুরুর লাইট ফেলাটা তেমন কিছু তৈরি করছে না, ফলে এটা এখন বাদ দিয়ে দিয়েছি। তবে গোবো লাইটের ব্যবহার আমরা পরেও করেছি, নাটকের শেষের দিকে যখন সুশীলের মৃত্যু সংবাদ আগে তখন রক্ত ঝরার জায়গাতেও আমরা ব্যবহার করেছি ... মানে ভেতরের ক্ষরণটা বোঝাবার জন্যই গোবো ব্যবহার করেছি। ধন্যবাদ।
ফয়েজ জহির
[নাট্যজন- আরণ্যক নাট্যদল, মঞ্চ পরিকল্পক- স্বদেশী]
আমি মনে করি একজন ডিজাইনার হিসেবে নাটক দেখতে যাওয়ার আগে একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে নাটক দেখতে যাওয়া উচিত। তো আমি একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে সেট ডিজাইনার কবিরভাইয়ের কাছে প্রশ্ন রাখছি- নাটকের নাম যেহেতু সময়ের প্রয়োজনে এবং বারীভাই যেভাবে বললেন যে, মানুষের শান্তির প্রয়োজনে, মুক্তির প্রয়োজনে যুদ্ধ হয়েছে, তো সেই জায়গাটা উপলব্ধি করে আপনি আপনার ডিজাইনে এই সময়টা কীভাবে দেখেছেন?
কামালউদ্দিন কবির
ধন্যবাদ জহিরভাই। যে-কোনো নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা করার সময় আমরা প্রথমেই যে কাজটা করি, সেটা হলো, নাটকের প্রেক্ষাপটটি কী বা ঘটনাটি কোথায় ঘটছে, কোন সময়ে ঘটছে, সেটা মাথায় রাখা। সময়ের প্রয়োজনে একটি বাস্তব ঘটনাভিত্তিক নাটক। সেক্ষেত্রে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এটাতে বাস্তবানুগভাবে মঞ্চ পরিকল্পনা করবো না। এরপর কী করলাম এটা একটু বলি, তাহলে তরুণ নাট্য-শিক্ষার্থী যারা আছেন, তারা উপকৃত হতে পারেন। আমি এই কাজটির জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সচিত্র তথ্যগুলো খোঁজা শুরু করলাম। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পেইন্টিংস দেখা শুরু করলাম। আসলেই একটু বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধের একটি ক্যাম্পের ঘটনা এবং এতই বাস্তব ঘটনা যে, ক্যাম্পের যাবতীয় উপকরণ দিয়েও করা যেত, কিন্তু এই যে প্রশ্ন করা হলো- সময়ের প্রয়োজনটা আমি কীভাবে দেখেছি, সেজন্যই আমি খুঁজতে থাকলাম এ-সময়টাকে কীভাবে সামনে আনা যায়। তো এই খোঁজাখুঁজির মধ্যেই পেয়ে যাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শিল্পী শাহাবুদ্দিনের একটি পেইন্টিং, যেটির নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা’। তো এই নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনায় বলা যায় যে, শাহাবুদ্দিনের ঐ চিত্রকর্মটিরই একটা ত্রিমাত্রিক অবস্থা তৈরি করার চেষ্টা করেছি। তবে নিশ্চয়ই শিল্পী শাহাবুদ্দিনের পেইন্টিং-এ যে গতিশক্তি, যে ফোর্স, সেটি হয়তো আনা সম্ভব হয় নি, কেননা পেইন্টিং-এ রঙ-এর যে নানা ব্যবহার, নানা বৈচিত্র্য, সেটি মঞ্চে থ্রি-ডাইমেনশনালি তৈরি করাটা বেশ কঠিনই হয়ে পড়ে। তবে চেষ্টা করেছি ঐ গতিটা কোনোভাবে আনা যায় কিনা। কিন্তু আপনি ডিজাইনার হিসেবে নিশ্চয়ই বোঝেন যে, কোনো ডিজাইন এককভাবে হয়ে উঠতে পারে না। সব ডিজাইনের মধ্যে একটা আন্তঃসম্পর্ক থাকতে হয়। এবং সেটের সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক থাকতে হয় আলোর। এক্ষেত্রে আমার সাথে লাইট ডিজাইনারের যেটুকু আলাপ আলোচনা হওয়ার কথা ছিল, সেটা ঠিক করে উঠতে পারি নি আমরা। এটা যে-কারো কারণেই হতে পারে, তবে আমি আমার সেট নিয়ে কিছুটা অসন্তুষ্ট এই আলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে না পেরে। আবার পেছনে সেটে যে রেখাগুলো তৈরি করেছিলাম, যে উদ্দেশ্য নিয়ে করেছিলাম, সেটাও আলোর সমন্বয়ের অভাবে হয়ে ওঠে নি। তো সময়ের প্রয়োজনে-র নাটকের সেটে আমি চেয়েছিলাম- মুক্তিযুদ্ধের যে গতিশক্তি, ফোর্স এখন থাকা দরকার, যেটা শাহাবুদ্দিনের পেইন্টিং-এর আছে, সেটাকে তুলে ধরতে। আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে সেই গতিটার এখন বেশি প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
হাসান শাহরিয়ার
সময়ের প্রয়োজনে-র নির্দেশককে আমি আবার পরে মঞ্চে আমন্ত্রন জানাবো। এখন আপাতত মঞ্চের সবাইকে দর্শক-সারিতে বসতে এবং দর্শক-সারি থেকে প্রাঙ্গণে মোর-র স্বদেশী নাটকের সাথে জড়িত নির্দেশক ও ডিজাইনারদেকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি। মঞ্চে আসবেন- নূনা আফরোজ, ঠাণ্ডু রায়হান ও ফয়েজ জহির। আমরা জানি জগলুল আলম অসুস্থ। সে এই নাটকের সঙ্গীত পরিকল্পক। কিন্তু ডাক্তারের বারণ আছে জনসমাগমে তার আসতে।
ধন্যবাদ সবাইকে। আমি এখন স্বদেশী নাটকের উপর প্রশ্ন চাচ্ছি।
কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন
[নাট্যজন- প্রাচ্যনাট]
রবীন্দ্রনাথের নাটক বলতেই আমরা একধরনের ছবি দেখি, আবার একধরনের নস্টালজিয়াও কাজ করে বা আমরা আগে যা দেখেছি, সেই জিনিসগুলোও কাজ করে। তো আমি নির্দেশকের কাছে জানতে চাচ্ছি, আপনি নির্দিষ্ট কোন ভাবনা থেকে কাজটি হাতে নিয়েছেন?
নূনা আফরোজ
অভিনয়ের দিক থেকে আমি সম্পূর্ণই রবীন্দ্রনাথকে মাথায় রেখে ... মানে সেই সময়, সেই ভাবনা মাথায় রেখেই কাজটা করেছি। রবীন্দ্রনাথের বাইরে যদি গিয়ে থাকি তবে সেটা অবচেতনভাবেই গিয়েছি। কিন্তু আমার ভাবনা পুরোটাই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই ছিল। আপনি যে নস্টালজিয়ার কথা বললেন, রবীন্দ্রনাথের কাজের ব্যাপারে, আমার মনে হয় আমিও সেখান থেকে খুব একটা বের হয় নি।
কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন
কিন্তু এই সময়ে আপনি স্বদেশী নিয়ে কাজ করেছেন, সে-ক্ষেত্রে একটু অন্য কিছু ভাবা যেতো কিনা? আমরাতো কোলকাতায় যারা করেছে তাদেরটা কেউ কেউ দেখেছি, আর আমরা অডিও-তে শুনে থাকি। তো আপনার কি মনে হয় নি, ঐ জিনিসটা রিপিট না করে অন্য কিছু বা অন্য ভাবনায় এখানে কাজ করা যেতো?
নূনা আফরোজ
আপনি কি আরেকটু পরিষ্কার করবেন, ঠিক কী জানতে চাচ্ছেন?
কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন
আমি স্পেসিফিক্যালি বাচিক অভিনয়টার কথা বলছি। মানে সেই একই পুরোনো ভঙ্গিটা না রেখে আমরা এখন যেভাবে কথা বলি, সেরকম কিছু কি করা যেত না?
নূনা আফরোজ
আমার তো মনে হয় আমরা পুরোপুরি সেই বাচনিক ভঙ্গি থেকে বের হওয়ার চেষ্টাই করেছি। আপনি বোধহয় শম্ভু মিত্র যেটা করেছিলেন, সেটার কথা বলছেন, মানে ওঁর বাচনিক ভঙ্গির কথা ... আমরা কিন্তু ওটা মাথাতেই রাখি নি। ফলে ওদের চেয়ে আলাদা কিছু করতে হবে সেই ভাবনা নিয়ে কাজই করি নি।
কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন
না, সংলাপ শুনে কিন্তু মনে হয়েছে এক ধরনের আর্টিফিসিয়াল জিনিস কাজ করেছে। সংলাপ বলার ধরনে এক ধরনের মেকিভাব ছিল বলে মনে হয়েছে।
নূনা আফরোজ
যদি মেকি ভাব মনে হয়ে থাকে তাহলে আমরা নিশ্চয়ই আরো চেষ্টা করবো পরবর্তী সময়ে ওটা কাটিয়ে উঠতে।
তানসেন নিকলী
[নাট্যজন- দৃশ্যপট]
চার অধ্যায় উপন্যাস অবলম্বনে নাটক করলেন, নাম দিয়েছেন- স্বদেশী। নামটি স্বদেশী করলেন কেন?
নূনা আফরোজ
হ্যাঁ, নামটি চার অধ্যায়ও রাখা যেত। উপন্যাস হিসেবে চার অধ্যায় নামটি আমার ভালো লেগেছে, কিন্তু এর মঞ্চরূপ দিতে গিয়ে ঐ নামটি আর আমার ভালো লাগে নি। তাই আমি স্বদেশী নাম দিয়েছি।
গোলাম শফিক
নাটকটি দেখার পরপর আমি কিছু দর্শক প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে অভিনয় নিয়ে। নূনা আফরোজ যখন দীর্ঘ সংলাপ বলছিলেন, তখন এটাকে কেউ কেউ বলেছে যে, শ্রুতি নাট্যের আদল চলে এসেছে। এ ব্যাপারে নূনা আফরোজের কী মনে হয়?
নূনা আফরোজ
আসলে এই নাটকটিতে এতো বেশি কথা আছে যে, সে-কারণেই এমন মনে হলো কিনা কী জানি। কিন্তু এটাকে শ্রুতি নাটক মনে হোক এটা নিশ্চয়ই আমরা চাই নি। ফলে আমরা এখন থেকে এ ব্যাপারটা সচেতনভাবে লক্ষ্য করবো।
গোলাম শফিক
আমার যেটা মনে হয়েছে, শারীরিক অভিনয় এই নাটকে তেমনভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নি।
নূনা আফরোজ
সেটা না হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, কারণ, এটা মূলত সংলাপ নির্ভর নাটক, বাচিক অভিনয় নির্ভর নাটক। আমরা যেভাবে ডিজাইন করেছি, সেখানে শারীরিক অভিনয় সেভাবে ডিমান্ড করে কি? আমি পরিকল্পিতভাবেই ব্লকিং ও মুভমেন্ট কম রেখেছি, কারণ, গভীর কথাবার্তার সময় মানুষ তো মুভ কম করে তাই না? আমরা বাচনিক জায়গাটাতে জোর দিয়েছি বেশি।
নাহিদ সুলতানা স্বাতী
[নাট্যজন- প্রাচ্যনাট, পোশাক পরিকল্পক- কথা’৭১]
আমার প্রশ্নটাও অভিনয় নিয়ে। আমার মনে হয় না, রবীন্দ্রনাথের নাটক শুধুমাত্র কথা সর্বস্ব। শুধু শোনার জন্য রবীন্দ্রনাথের নাটক না। তাহলে থিয়েটার দেখতে আসবো কেন? স্বদেশী-তে মনে হয়েছে সব অভিনেতা-অভিনেত্রী খুব বেশি সতর্ক ছিলেন ওনাদের উচ্চারণ নিয়ে, বাচনিক জায়গাগুলো নিয়ে। যার ফলে রিয়েলিস্টিকের বাইরের মনে হয়েছে। তো এখন যদি রবীন্দ্রনাথ করি তাহলে আমাদের চিন্তা করা উচিত, কেন করবো? কীভাবে করবো? বিশেষত অভিনয়টা। স্বদেশী-র ক্ষেত্রে মনে হয়েছে আরো বেশি সময় নিয়ে, চর্চা করে চরিত্রটা নিজের মধ্যে এ্যাডাপ্ট করে করা উচিত।
নূনা আফরোজ
আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সাজেশনগুলো মনে থাকবে। আর একটা কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের নাটক মানেই মুভমেন্ট কম বা এ্যাক্টিং অন্যরকম তা কিন্তু আমি বলি নি। আমি বলেছি, স্বদেশী যেভাবে ডিজাইন করেছি সেখানে বাচনিক জায়গাটতে জোর দিতে চেয়েছি। তবে হ্যাঁ, যদি এর ফলে এটাকে শ্রুতি নাটক মনে হয়ে থাকে, তবে আমরা তা পরিবর্তন করার চেষ্টা করবো। কারণ, আমরা এটাকে শ্রুতি নাটক বানাতে চাই নি।
কুমার প্রীতীশ বল
[নাট্যজন- ঢাকা পদাতিক, নাট্যকার- কথা’৭১]
আমি জানতে চাচ্ছি, ২০০৫-এ দাঁড়িয়ে কেন আপনি রবীন্দ্রনাথে চার অধ্যায় নিয়ে স্বদেশী নাটক করার কথা ভাবলেন। রবীন্দ্রনাথের তো আরো উপন্যাস বা নাটক ছিল?
নূনা আফরোজ
চার অধ্যায় ১৯৩৪ সালে লেখা স্বদেশী আন্দোলনের উপর, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লেখা এই নাটক। আমরা কি আজকে, এই ২০০৫-৬ সালে, ঐ জায়গা থেকে সরে আসতে পেরেছি? এই উপন্যাস বা গল্প কি এখনও প্রাসঙ্গিক না? আর তা ছাড়া যদি বলেন কেন করলাম, সেটা হলো এই উপন্যাস আমার পছন্দের উপন্যাসগুলোর একটি। রবীন্দ্রনাথ সন্ত্রাস পছন্দ করতেন না- সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে উনি এটা লিখেছেন। এই সময়ে চারিদিকে এমন সন্ত্রাসের সময় এটাকে মঞ্চে আনতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।
কুমার প্রীতীশ বল
সেই সময় তো সন্ত্রাসী বলা হতো যারা স্বদেশী ছিলেন, তাদেরকে। এবং এই সন্ত্রাসবাদ শব্দটা স্বদেশীদের উপর বৃটিশরা চাপিয়ে দিয়েছিল। সূর্যসেনকে সন্ত্রাসী বলা হয়েছিল। আজকে কিন্তু সন্ত্রাসবাদ আর সেদিনের সন্ত্রাসবাদ এর মধ্যে নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে।
নূনা আফরোজ
নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথেরই একটি কথায় আছে ... এটা সম্ভবত ১৯০৮ সনে বলেছিলেন যে- দেশীদের নাম করে অন্যায়কেও ন্যায় বলিয়া ধরিয়া নিই, তাহলে সেই পতন ঠেকাইবে কে?।’ আসলে যেটা অন্যায় সেটাকে অন্যায় হিসেবেই চিহ্নিত করা উচিত। সেই সময়ের সন্ত্রাস আর এই সময়ের সন্ত্রাস এক না কিন্তু সন্ত্রাস তো? আমার কথা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।
ফয়েজ জহির
এই নাটকে আমি এবং ঠাণ্ডু রায়হান একই সাথে কাজ করেছি। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াও ছিল। তারপরও নাটকটি যখন দেখি, তখন একধরনের প্রশ্ন মনে থেকে যায় এবং আমার মনে হয় এই প্রশ্নগুলো দর্শকের মাঝেও বিদ্যমান। তো ঠাণ্ডু রায়হানের কাছে আমার প্রশ্ন-স্বদেশী নাটকের যে প্রেক্ষাপট নাটকের চরিত্রগুলোর মধ্যে যে টানাপোড়েন, যে সংগ্রাম, সেই জায়গার রঙটাকে উনি কীভাবে দেখেছেন, এটা যদি একটু বলতেন।
ঠাণ্ডু রায়হান
স্বদেশী নাটকের লাইট করার জন্য নূনা যখন আমাকে ফোন করলো, আমি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, চার অধ্যায় আমার আগেই পড়া ছিল, আর তরুণ নির্দেশকদের সাথে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। তো আমি ওদের মহড়া দেখতে গেলাম। আমরা যারা নেপথ্যে কাজ করি, মানে ডিজাইনের সাথে যুক্ত, তাদের প্রথমত নাটকটা ভালো লাগতে হবে নিজের কাছে এবং একটা ধাক্কা পেতে হবে। কারণ, ধাক্কা না পেলে কোনো কিছু বের হয় না। তো আমার মহড়া পছন্দ হলো। আপনারা লক্ষ্য করলে দেখবেন, আমি এই নাটকে ব্লু এবং হলুদ দুটি কালার বেশি ব্যবহার করেছি। মানে ধুসর একটা কালার আনার চেষ্টা করেছি। আর একটু আগেই দর্শকদের কাছ থেকে যেটা বলা হয়েছে যে, এই নাটকে কথা বেশি- হ্যাঁ, আমিও চিন্তা করলাম, কথাই যেহেতু বেশি, তাই বেশি আলোর মধ্যে থেকে যদি এতো কথা বলে, তাহলে দর্শকের ভালো লাগবে না। তাই জোন জোন ভাগ করে আলোগুলো ব্যবহার করেছি এবং লক্ষ্য করলে দেখবেন এক জোন থেকে অন্য জোনে যাওয়ার সময় পেছনে একটা সবুজ কালার ব্যবহার করেছি- দিস ইজ দ্য সিম্বল অব স্বদেশী। এই নাটকে মিউজিকও চমৎকার করেছে, জগলুল বরাবরই ভালো করে। তো নাটকের শুরুতেই ও যে মিউজিকটা দেয়, নূনা আমাকে বললো- ঠাণ্ডুভাই এটার সাথে আমি কিছু একটা চাচ্ছি। তো আমি করলাম কী, যখন বন্দে মাতরম দিয়ে নাটক শুরু হয়, সেখানে মঞ্চের পেছনে একটা আগুনের ইফেক্ট তৈরি করলাম। এবং নাটকটা শুরু করলাম প্রচণ্ড একটা ব্রাইট আলো দিয়ে। এবং শেষ করেছি কিন্তু আবার ছোট্ট একটা আলো দিয়ে। যখন দুজনই মারা গেল, ওদের ছোট্ট একটা আলোতে ফেলে দিলাম। আর প্রেক্ষাপট যেহেতু অনেক আগের তাই আমি হলুদের ব্যবহার করে ধুসরকে ধরতে চেয়েছি। ধন্যবাদ।
আবদুল্লাহ আল মামুন তাজু
[নাট্যদর্শক, বাম রাজনীতির সাথে জড়িত]
আসলে চার অধ্যায় যে উপন্যাস, তৎকালীন সময়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটো ধারা ছিল- একটা হলো মহাত্মা গান্ধীরজীর ধারা এবং রবীন্দ্রনাথ নিজে এই ধারার লোক ছিলেন। সেই সময় শরৎচন্দ্র যখন পথের দাবী লিখলেন তখন তারই জবাব হিসেবে চার অধ্যায় লেখা হয়েছিল। আমার মনে হয় সেদিনের যে প্রেক্ষাপট এবং আজকের বাংলাদেশের যে প্রেক্ষাপট সেখানে সন্ত্রাসবাদের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের যে বক্তব্য এ নাটকে সেটাকেও গ্রাস করে ফেলা হয়েছে। আজকে মৌলবাদীদের সন্ত্রাসবাদের যে প্রভাব তাকে কীভাবে ফেস করা যায় এই জায়গাটা আনা দরকার ছিল।
নূনা আফরোজ
ধন্যবাদ আপনাকে। সন্ত্রাস আসলে এই নাটকের মূল বক্তব্য না, এটি একটি প্রধান বক্তব্য। রবীন্দ্রনাথ আসলে স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন- চার অধ্যায় তার একটি প্রেমের উপন্যাস। আমিও কিন্তু সেদিকটাই ধরবার চেষ্টা করেছি। সন্ত্রাস একটি বিষয় হিসেবে এসেছে, মূল বিষয় নয়।
বিপ্লব বালা
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সন্ত্রাস আর এখনকার সন্ত্রাস এক না- এ কথাটা ঠিক আছে, কিন্তু এই সময়ে কীভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে সেটা দেখতে হবে। যেমন ধরা যাক, ইন্দ্রনাথ যে চরিত্র সে যে পর্যায়ের তাত্ত্বিক, তার বুদ্ধির যে ক্ষমতা ... সেই জায়গায় এখনকার যারা সন্ত্রাসী তাদের মধ্যেও কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ থাকে এবং তার মধ্যেও কিন্তু একধরনের আদর্শবাদও থাকে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে, ওটা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হতে পারতো যদি আমরা ইন্দ্রনাথকে দেখতাম এখনকার কোনো সাংঘাতিক ব্যক্তি যে মানুষকে মটিভেট করতে পারে। এমন প্রচুর লোক কিন্তু এখনও আছে যাদের আমরা খারাপ বলছি, কিন্তু আসলে তারা সমাজের জন্যই কাজ করছে। সেটা পোষাকে, অভিনয়ে সব মিলিয়েই করা সম্ভব ছিল। এমন কি ডায়লগ না পাল্টিয়েও করা সম্ভব ছিল। সেই আইডেন্টিফিকেশনের সমস্যাটা বোধহয় ছিল এই নাটকে। রবীন্দ্রনাথের লেখা, অনেক আগের ব্যাপার ... এগুলো ঠিক ভালো লাগে না, আমাদের চেনা চেনা মনে হতে হবে তো। অতিন, ইন্দ্রনাথকে তো চেনা চরিত্র লাগে না এখন। মানে এগুলো ভেবে করলে হয়তো আরো ভালো কাজ দাঁড়াতে পারতো।
নূনা আফরোজ
ধন্যবাদ বিপ্লব দা’। আপনি অবশ্য কোনো প্রশ্ন রাখেন নি। মতামত দিয়েছেন। আসলে আমি এই নাটকে সন্ত্রবাদ বা ঐ সময়টাকে ধরা, এ-ধরনের কোনো ভিউ থেকে দেখি নি। আমি এক হচ্ছে প্রেমের জায়গাটা ধরতে চেষ্টা করেছি আর হচ্ছে সব গল্প বা উপন্যাসকে এখনকার সময়ের মতো করে করতে হবে, সেভাবেও ভাবি নি।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। আমরা পরে আবার স্বদেশী নাটকের নির্দেশককে মঞ্চে ডাকবো। এখন আপাতত মঞ্চের সবাইকে দর্শক-সারিতে গিয়ে আসন নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি আর দর্শক-সারি থেকে ঢাকা পদাতিকের কথা’৭১ নাটকের নাট্যকার-নির্দেশক সহ সব ডিজাইনারদের মঞ্চে আসবার জন্য অনুরোধ করছি। কুমার প্রীতীশ বল, দেবাশীষ ঘোষ, মঞ্জুর আহমেদ (অনুপস্থিত), সাইদুর রহমান লিপন (অনুপস্থিত), আবদুল হালিম প্রামাণিক (অনুপস্থিত), নাহিদ সুলতানা স্বাতী আপনারা মঞ্চে চলে আসুন। ... কথা’৭১ এর উপর প্রশ্ন করবার জন্য অনুরোধ করছি।
আকতারুজ্জামান
[নাট্যজন- সময় সাংস্কৃতিক দল]
কথা’৭১ নাটকটা দেখতে মিলনায়তনে ঢুকেই যেটা দেখি যে, একটা রাজনৈতিক মঞ্চ এবং সেখানে ভাষণ দিচ্ছে- ... এই হবে, সেই হবে। কিন্তু এই ভাষণটা সরাসরি রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে না দিয়ে অন্য কিছু ব্যবহার করা যেতো কিনা। এটা আমার নির্দেশকের কাছে প্রশ্ন।
দেবাশীষ ঘোষ
[নাট্যজন- ঢাকা পদাতিক, নির্দেশক- কথা’৭১]
ধন্যবাদ আকতারকে এবং সেই সাথে থিয়েটারওয়ালা-কে ধন্যবাদ এরকম একটি অনুষ্ঠানে ঢাকা পদাতিককে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। কথা’৭১ নাটকের ডিজাইনটা আমি যেভাবে করেছি যে, দর্শক টিকেট কেটে যখন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারের লবিতে ঢুকবে তখন থেকেই যেন নাটকটার সঙ্গে ইনভলব হতে শুরু করে। এজন্য তারা যখন হলের লবিতে ঢোকে তখন বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখতে পায়, আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন টার্নিং পিরিয়ডগুলোর প্রদর্শনী ... সেই ’৪৭ থেকে ’৫২ বা তারপর এক এক করে আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুর প্রদর্শনী, যাতে করে তারা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে যে, সে একটা সমাবেশে যাচ্ছে। তারপর সে যখন হলে ঢোকে তখন দেখতে পায় একটা সমাবেশের প্রস্তুতি চলছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। ততক্ষণে কিন্তু অন্যান্য দর্শকও ঢুকছে। ঢুকছে আর বুঝতে পারছে যে, সে একটা সমাবেশে এসেছে, সেই পরিবেশটা যেন পায় সেকারণেই এটা আমি এভাবে ডিজাইন করেছি।
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ, সেটা বোঝা গেছে। তবে রিয়েলিস্টিকভাবে যে-সব স্লোগান ব্যবহার করা হয়েছে- সেগুলো এখনকার বাস্তবতায় যান্ত্রিক বা মিথ্যা মনে হয়েছে। এখনকার থিয়েটারে সেই স্লোগানকে সত্য ভাবাতে গেলে অন্যরকমভাবে আনতে হবে। এই জনসভাও-তো এখন আর নেই। এই বাস্তবতাটা তো মনে রাখতে হবে। মনে রেখে তো কাজটা করতে হবে। সেখানে বোধহয় কোথাও কিছু মিস হয়েছে। আমার মনে হয় টোকেন হিসেবে সব আছে কিন্তু এই টোকেন বর্তমান বাস্তবতায় কী ক্রিয়া করছে এটা কোথাও মিস হয়েছে বলে মনে হয়, যার ফলে উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়েছে।
দেবাশীষ ঘোষ
স্পেসিফিক্যালি কোন জায়গাটার কথা বলছেন, জনসভার জায়গাটা?
বিপ্লব বালা
সব মিলিয়েই বলি তাহলে। শুরুতে যে পিসগুলো করা হয়েছে, লবিতে, ওগুলোর একটা-দুটো ছাড়া বাকিগুলো খুবই মেকানিক্যাল, প্রথাগত। এমন সরলভাবে করা হয়েছে যে, কোনো ক্রিয়া করে না। এবং হলে ঢুকেই যে ভাষণ শোনা যায় সেটা কোনো ক্রিয়া করে না ভেতরে। এই ভাষণ দিয়ে একধরনের করুণা আদায় করতে চাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রটি, সেটা খুব লজ্জাও লাগে।
দেবাশীষ ঘোষ
বিপ্লব দা, আমি যেটা করতে চেষ্টা করেছি, সেটা হলো, সাধারণত মিটিংগুলোতে কী দেখা যায় ... দেখা যায় যে, মূল বক্তারা আসার আগে অনেকেই বক্তৃতা দিয়ে মানুষ জমিয়ে রাখে। সেগুলো হয়তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ কথা না-ও হতে পারে। তো আমিও চাচ্ছিলাম যে, দর্শক টিকেট নিয়ে নিজ আসনে বসতে বসতে এই কথাগুলো চলতে থাকুক, যাতে মনে হয় যে, একটা সমাবেশেই এসেছে। এই জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমি চাচ্ছিলাম-ও না।
বিপ্লব বালা
কিন্তু সেটা তো আমার সিরিয়াসনেস নষ্ট করছে। একটা টিপিক্যাল সমাবেশের বাজে পরিবেশ আনছে। সেটা কি এই নাটকে আমরা চাইছি?
দেবাশীষ ঘোষ
না, তা চাইছি না।
কাজী চপল
[নাট্যজন- ঢাকা পদাতিক, অভিনেতা- কথা’৭১]
আমি নাটকের একজন অভিনেতা এবং ঐ সমাবেশে আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বক্তৃতা করি। পিতা এবং পুত্রের একটা দ্বন্দ্ব তো চলে এই নাটকে ... তো আমি এখানে একজন হতাশ পিতা, যে ’৭১ সালে যুদ্ধ করেছিল কিন্তু আজকের সমাজে সে পরাজিত। অভিনেতা হিসেবে আমার উপলব্ধিটা ছিল এরকম।
বিপ্লব বালা
কিন্তু হতাশ মুক্তিযোদ্ধা যেভাবে বলছে, সেই বলাটা দর্শক হিসেবে আমার কাছে সত্যি লাগছিল না এবং এই বলা কথাগুলো এতো ব্যবহৃত, ক্লিশে, এতো নাটকে ব্যবহার করা হয়েছে যে, সেগুলো আর টানে না।
অপূর্ব
[জনৈক দর্শক]
টিকেট কেটে দর্শক হলে ঢোকার পর তার সময় নষ্ট না করার যে মনোভাব, সেটা ভালো লেগেছে এবং দর্শককে যে আপনারা বিচ্ছিন্ন ভাবেন নি, এটাও ভালো লেগেছে। আমার দুটো প্রশ্ন- প্রথমটা রচয়িতার কাছে- এই নাটকে ’৭১ এর সরাসরি ঘটনা চলে এসেছে ৭৫ ভাগ আর ২০০৫ সালে পিতা-পুত্রের মুখোমুখি বিষয়টি ২৫ ভাগ। প্রশ্ন হচ্ছে, পিতা-পুত্রের যে কন্ট্রাডিকশন, এটাই কি বেশিরভাগ সময় জুড়ে আনা যেত না? আনলে কি ভালো হতো না? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি নির্দেশকের কাছে- আপনি কথা’৭১ এর ডিজাইন যেভাবে করেছেন, তাতে করে এক্সপেরিন্টোল হল ব্যতীত অন্য কোথাও কি এটার মঞ্চায়ন সম্ভব? বরিশাল বা চট্টগ্রাম বা অন্য কোথাও করার ব্যাপারে আপনি কী ভেবেছেন?
ফয়েজ জহির
আমি এই সাথে একটা প্রশ্ন করে নিই। পিতা-পুত্রের সম্পর্কের বা সংকটের যে ব্যাপারটা এসেছে, সেখানে পিতাকে দেখানো হয়েছে হতাশাগ্রস্ত, কেন? পুত্র গিটার কিনছে, পুত্র ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ছে, পুত্র ইংরেজিতে গান গায় ... তো এতসব ব্যাপারে কি পিতা কনসার্নড না? এদ্দিন পর এসে সে হতাশ হচ্ছে কেন? আর এতদিন ধরে একজন মুক্তিযোদ্ধ কী করে তার পুত্রকে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শোনায় নি? তাহলে কি পিতা দায়িত্বহীন? তার মানে তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পিতাও লালন করে নি। এ বিষয়গুলো আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
এম. এ. সবুর
[নাট্যদর্শক, নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধ লেখক]
আমিও এরই সাথে একটি প্রশ্ন করে দিতে চাই, তাহলে উত্তর দিতে সুবিধা হবে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য একটা ভীষণ শিক্ষণীয় বিষয়, একটা কষ্টের বিষয়, একটা স্মৃতিচারণের বিষয় এবং আমাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়। এই নাটকে মুক্তিযুদ্ধের কিছু ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হয়েছে ... নির্যাতন, তখনকার অনেক ছবিসহ, আরো অনেক কিছু। কিন্তু এটার জন্য তো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বা জাতীয় জাদুঘরই আছে। এখানে তো সেগুলোকে ব্যবহার করে থিয়েটার তৈরি করতে হবে। তা হয় নি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ফয়েজ জহিরের সাথে একমত হয়ে বলতে চাই, কোনো মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের বয়স যদি হয় ২০/২২ বছর, আর সেই পিতা যদি তাকে এতোদিনেও মুক্তিযুদ্ধের কোনো গল্প বা চেতনা বা বাঙ্গালি সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুই না বলে থাকে, তাহলে ঐ পিতার আহাজারিতে আমাদের কিছু যাবে আসবে কি? আমার কাছে এগুলো বেশ আরোপিত মনে হয়েছে। এ বিষয়গুলো নাট্যকার কী ভেবেছেন একটু জানতে চাই।
কুমার প্রীতীশ বল
ধন্যবাদ। তিনজনের প্রশ্নের আমি একসাথেই জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি। আমি আসলে যে জায়গাটা ধরতে চেয়েছি সেটা হলো, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সন্তানদেরকেই তৈরি করতে পারেন নি, নিজের ঘরকেই ঠিক করতে পারেন নি। নিজে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী চারমূল নীতিতে বিশ্বাসী কিন্তু সে তার পরের জনারেশনকে তৈরি করতে পারেন নি, ফলে তারা বিভ্রান্ত হযে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে এবং এই যে চলে যাচ্ছে, সেটাও তারা খেয়াল করেন নি। বরং তারা বাইরে মাঠে বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশের কথা বলছেন। নাটকের শুরুতে দেখতে পাই একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন যুদ্ধাপোরাধী সাংসদের বিচার চাইতে এক সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন। এবং বাসায় ফিরে দেখছেন তার ছেলেই মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনার জায়গায় নেই। তখন সে তার ছেলেকে মটিভেট করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা ছেলের সামনে তুলে ধরেন। আমি চেয়েছিলাম, যারা এখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে মাঠে বক্তৃতা দিচ্ছেন অথচ তার নিজের ঘরই ঠিক নেই, তাদেরকে একটু জাগিয়ে তুলতে।
দেবাশীষ ঘোষ
আমি প্রীতীশ দা’র সাথে একটু যোগ করতে চাই, সেটা হলো- কথা ’৭১ নাটকের মূল ভাবনাটা মুস্তফাভাইয়ের (দলের সিনিয়র সদস্য, অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী) মাথায় এসেছিল, এবং তা পিতা-পুত্রের বাস্তব দ্বন্দ্ব থেকেই। সেটা হলো কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে অষ্ট্রেলিয়াতে ওয়াজ করতে যাওয়ার কথা ছিল সাঈদীর। তো ওখানে যারা মুক্তিযোদ্ধা আছেন বা পক্ষের প্রগতিশীল লোকজন আছেন, তারা এটার বিরোধীতা করলেন। এবং কোনোভাবেই যেন এই যুদ্ধাপোরাধী সেখানে ঢুকতে না পারে তার সেজন্য ক্যাম্পেইন করতে নামলেন। তো যখন তারা বাঙ্গালি পরিবারগুলোতে ক্যাম্পেইন করছেন, দেখা গেল সেখানকার তরুণ ছেলে-পেলেরা সাঈদীর পক্ষ নিল। তাদের ভাষ্য হচ্ছে- সাঈদী কখন কী করেছে তা তাদের জানার দরকার নাই, সে এখন নির্বাচিত সাংসদ, এটাই তার বড় পরিচয়। আর সে যদি ’৭১ সালে বিরোধীতা করে থাকে বা ধর্ষণ করে থাকে তাহলে তার বিচার করতে পারতেন, যেহেতু বিচার করেন নি, সেহেতু নিশ্চয়ই ঐ বিরোধীতা বা ধর্ষণের যৌক্তিক কারণ ছিল। ... তো যে ছেলে এ-কথাগুলো বলেছিল, তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি ওখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনেক বক্তৃতাও দিয়ে থাকেন। তো এমন পিতার এমন সন্তান ... মানে কথা’৭১-এ আমরা এই ব্যাপারটাই আনতে চেয়েছিলাম।
ফয়েজ জহির
অষ্ট্রেলিয়ার ব্যাপারটা ভিন্ন। ঐ পিতার মধ্যেই তো স্ববিরোধিতা আছে। সে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, এখন দেশ ছেড়ে চলে গেছে, এবং এতদিন ধরে সেখানে বক্তৃতা দেন কিন্তু নিজের ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধের কিছুই শেখান নি ... এটা তো স্ববিরোধিতা। যে পিতার মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে, সে নিজের ঘরের জন্যও কিছু করতে পারেন না, সমাজের জন্যও কিছু করতে পারেন না। এধরনের বাবাদের জন্য যে ধরনের শ্লেষ বা ঘৃণা জন্মানোর প্রয়োজন ছিল, সেটা এই নাটকে উচ্চারিত হয় নি। নাটকের শেষ দৃশ্যে দেখলাম সবাই খুব আবেগে আপ্লুত এবং অনেকেই কাঁদছে। তো কান্না কি আমাদের ক্ষোভকে বা ঘৃণাকে প্রশমিত করে দেয় না?
কুমার প্রীতীশ বল
জহিরভাই কান্না কিন্তু মানুষের ক্ষোভকে আবার বাড়িয়েও দিতে পারে। আমাদের সব শো-তেই দেখি লোকজন কাঁদে। তো একদিন এক দর্শককে জিজ্ঞাসা করলাম যে- আপনার এই ইমোশনের কারণ কী? উনি বললেন যে, আমার দুটো রুমাল ছিল, দুটোই ভিজে গেছে। বললাম কেন? তিনি বললেন- আমার কাছে বারবার মনে হচ্ছিল ঐ পিতাটা আমি নিজে।
এম. এ. সবুর
বাঃ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম, স্বাধীন করে দেশ থেকে চলে গেলাম অষ্ট্রেলিয়াতে ... এটা হচ্ছে স্কেপিজম। যে-দেশের জন্য যুদ্ধ করলাম সেদেশে চাওয়া পাওয়া মিললো না, তখন ঐ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে নিজে বাঁচতে চলে গেলাম ... সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ওনার কাছে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের জায়গায় নাই, এখন ছেলে-পেলে নিয়ে বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে মুখ্য। সেজন্যই কিন্তু তিনি অষ্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। আসলে মুক্তিযুদ্ধে কেউ গেছেন বুঝে, আর কেউ গেছেন আবেগে। আবেগে যে গেছেন সে আজকে হতাশাগ্রস্ত হতেই পারেন। কিন্তু যে বুঝে গেছেন, সে কিন্তু আজকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না, এই প্রতিকূল সমাজ ব্যবস্থায়। যে স্লোগান নিয়ে ’৭১-এ যুদ্ধ করেছিলেন, সেই একই স্লোগান দিয়ে এখনকার বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি দেবেন- এটা অলীক বিষয়। সুতরাং এই অলীক জায়গায় থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ভাসা-ভাসাভাবে কো-রিলেট করা আমার মনে হয় উচিত না।
দেবাশীষ ঘোষ
তা ঠিক আছে, কিন্তু আমরা দেখাতে চেয়েছি- আমাদের সন্তানদের আমরা সঠিক পথ দেখাই নি। আর অষ্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেবার কথা যেটা বললেন, সেটা হলো একেজনের বাস্তবতা একেক রকম। অষ্ট্রেলিয়ায় অনেকের এমনও সন্তান আছে যারা ‘মেড ইন পাকিস্তান’ দেখলে সেই পণ্য কেনে না। তো আসলে সন্তানকে কে কীভাবে নিজের সংস্কৃতি বোঝাবে তার উপর নির্ভর করবে সেই সন্তানের বেড়ে ওঠা। আমরা সেটাই ধরতে চেয়েছি।
কুমার প্রীতীশ বল
আপনারা যেটা তুললেন যে, আজকের দিনে কেন এই কথা’৭১ করা ... তো আমি বলবো, আজকের যে মৌলবাদীদের উত্থান, তাদের ক্ষমতায় যাওয়া, এ-সব কিছুর যদি সঠিক বিশ্লেষণ করতে হয় তাহলে আমাদেরকে ঐ ’৭১ সালেই ফিরে যেতে হবে। সেখান থেকেই বিশ্লেষণ শুরু করতে হবে। এ-জন্যই আমি এটাকে এ-সময়ে প্রাসঙ্গিক মনে করেছি।
জনৈক
না, এখানে কেউ কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বোধহয় বলতে চায় নি। বলা হচ্ছে, যে ভাষায় বা ডিজাইনে আপনারা এটাকে উপস্থাপন করেছেন, সেটা দিয়ে নতুন করে কোনো দাগ কাটা যাবে না।
মাহফুজ
[নাট্যজন- প্রাঙ্গণে মোর]
আমার দুটো প্রশ্ন। একটা আগে একজন করেছেন, কিন্তু উত্তর পাই নি ... সেটা হলো নাটকটি কি কেবল এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে করবেন বলেই এমন ডিজাইন করেছেন? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো- এতো বড় বা বিশাল প্লাটফর্ম ব্যবহারের ফলে নাটকের অভিনয়ের জায়গাটা কমে গেছে বলে মনে হয়েছে। নির্দেশকের কী মত?
দেবাশীষ ঘোষ
কথা’৭১ ডিজাইন করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে নয় মাসের কথা আমি বলছি ... বিশাল ক্যানভাস! এটা যখনই ভাবছিলাম, আমি এটাকে কোনোভাবেই প্রসেনিয়ামে ঢোকাতে পারছিলাম না। তো যখন এক্সপেরিমেন্টাল হলের সুবিধাটা বা হলের সুযোগগুলোর কথা আমি জানলাম, তখন জায়গাগুলোর ব্যবহারের লোভ আমি সামলাতে পারি নি। এই ব্যাপারে শিল্পকলায় কর্মরত বন্ধু জসীম আমাকে খুবই সাহায্য করেছে। সুতরাং, মূলত বলা যায়, এই নাটকটি ঐ হলের কথা মাথায় রেখেই করা। আর অভিনয়ের কথা যদি বলেন, আমি মনে করি যদি কেউ পারফরমেন্স করতে পারেন, তবে তা ছোট বা বড় স্পেস কোনো ব্যাপার না। তবে যদি আপনার মনে হয়ে থাকে যে অভিনয়ের দিকটার ঘাটতি ছিল, তাহলে দর্শক হিসেবে আপনার কমেন্টকে অবশ্যই গুরুত্ব দেব। তবে আমার মনে হয় ওরা যথাসাধ্য ভালো অভিনয়ের চেষ্টা করেছে এবং সফলও হয়েছে।
কামালউদ্দিন কবির
আমি ডিজাইন নিয়ে একটু বলতে চাই। কথা’৭১ এর সামগ্রীক উপস্থাপনা, যেটা মিলনায়তনের লবি থেকে শুরু হয়ে ভেতরে পর্যন্ত বিস্তৃত, এই সামগ্রীক উপস্থাপনা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কেন না, সমগ্র ব্যাপারটিতে একটি থিয়েট্রিক্যাল প্রেজেন্টেশন আছে। যেটা আমার ভালো লেগেছে। তবুও আমি দুটো প্রশ্ন করতে চাই, প্রথমত- সেট ডিজাইনে, বিশেষ করে সেট প্রপস হিসেবে নাটকের এক পর্যায়ে অনেক মৃতদেহের ডামি ব্যবহার করা হয় ... যেটা কিনা অনেক ব্যয়-সাপেক্ষ। এটার কতটুকু প্রয়োজন ছিল? দ্বিতীয়ত- কস্টিউম ডিজাইনে কোনো নাট্যিক উপস্থাপনা করা যেত কিনা ... যেহেতু সমগ্র উপস্থাপনাটাই নাট্যিক ছিল। মানে বাস্তব কস্টিউম ডিজাইনে কেন যাওয়া হলো?
দেবাশীষ ঘোষ
আমি আমার অংশটুকুর জবাব দিচ্ছি ... ২৫ মার্চে’৭১ এর জগন্নাথ হলের ঘটনাটা ভিজ্যুয়াল করার চিন্তাটা যখন মাথায় আসলো তখন ডিজাইন করতে গিয়ে ৮/৯ জন পারফরমার পাচ্ছিলাম, যারা দলের এবং নাটকের ঐ সময়ের জন্য ফ্রি। তো বিশাল এই ঘটনাটা এই কয়জন দিয়ে ডিজাইন করাটা আমার মনপুত হচ্ছিল না, আমার মতো করে ছবিটা বানাতে পারছিলাম না। তাই এর ভয়াবহতা বোঝাবার জন্য অনেকগুলো ডামি ব্যবহার করতে হয়েছে।
নাহিদ সুলতানা স্বাতী
আমি কস্টিউমের ব্যাপারে নির্দেশকের সাথে অনেক কথা বলেছি। আমিও চাচ্ছিলাম সাজেস্টিভ কিছু করার, কিন্তু ডিরেক্টর বললেন যে- না আমি যেহেতু ডকুমেন্ট্রির মতো কাজ করছি, সেজন্য রিয়েলিস্টিক ডিজাইনই চাচ্ছি। তখন আমি ঐ সময়ের পোষাকের উপর ভাবনা-চিন্তা করে, ঐ সময়টাকেই ধরতে চেয়েছি।
দেবাশীষ ঘোষ
হ্যাঁ, স্বাতীকে আমি কস্টিউম ডিজাইনের ব্যাপারে জ্বালিয়েছি। ও চাচ্ছিল পাকিস্তানী আর্মির পোষাক র্যাবের সাথে মিলিয়ে কালো করতে। কিন্তু যেহেতু এটা একটা ডকুড্রামা, সেহেতু এখানে ঐ সময়টাকে ধরা খুব জরুরি, তা না হলে এখনকার প্রজন্মের কেউ ভুল বুঝতে পারে।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। আমি এখন অনুরোধ করবো কথা’৭১ এর কলাকুশলীদের গ্যালারীতে আসন নেবার জন্য এবং পরে আমি এই নাটকের নির্দেশককে আবার মঞ্চে আমন্ত্রণ জানাবো। আর সেই সাথে অনুরোধ করছি জন্মসূত্রের প্রথম প্রযোজনা অহরকণ্ডল নাটকের কলাকুশলীদের মঞ্চে আসবার জন্য। মঞ্চে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি- কামালউদ্দিন কবির, অসিত কুমার ও ফরিদা আকতার লিমাকে। ... আমি অহরকণ্ডল নাটকের উপর প্রশ্ন চাচ্ছি।
গোলাম শফিক
আমি নির্দেশকের কাছে জানতে চাইবো, তিনি অহরকণ্ডল-এ প্রচলিত কোনো প্রপস ব্যবহার করেন নি কেন? এই প্রপস ব্যবহার না করার পেছনে বিশেষ কোনো চিন্তা কাজ করেছিল কিনা? অথবা উনি কি মনে করেন অভিনয়ের মাধ্যমে প্রপসের ঘাটতিটা পূরণ হয়েছিল?
কামালউদ্দিন কবির
অহরকণ্ডল-এর পাণ্ডুলিপিটা বর্ণনাত্মকরীতিতে রচিত হয়েছে। এটা উপস্থাপন করতে গিয়ে আমরা প্রধানত আমাদের যে দেশজ নাট্যরীতি যা যা আছে এবং যেখানে বর্ণনা এবং অভিনয় একাকার হয়ে থাকে, সেই দিকটাতেই আমার মূল মনোযোগ ছিল। এবং এই উপস্থাপনার প্রতিটি জায়গায় আমরা চেয়েছি আমরা যেন আমাদের নিজস্ব নাট্যরীতির একটি আধুনিক নাগরিক নাট্য-পরিবেশন তৈরি করতে পারি। যেহেতু আমরা নাগরিক শিল্পীরা নাগরিক দর্শকদের সামনে এটা উপস্থাপন করছি। তো লোকজ নাটক বা দেশজ নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, ন্যূনতম উপাদান সহযোগে অনেক কিছু উপস্থাপন করা। এই শিল্প শক্তিটি মনে রেখেই আমরা হুবহু কোনো দেশজ উপাদান বা দেশজ আবহ তৈরির চেষ্টা করি নি, বরং ঐ যে শিল্পশক্তি, সেটি কথা এবং অভিনয় দিয়েই দর্শকের সামনে তুলে ধরা সম্ভব। তো এখানে বলে রাখা ভালো যে, জন্মসূত্রের প্রথম প্রযোজনা অহরকণ্ডল, আমাদের দিক থেকে একটা নিরীক্ষা ছিল যে, এই কথা, এই বর্ণনা দিয়ে দর্শকের সাথে কতটা সংযোগ স্থাপন করতে পারি। তো এখনো সেই নিরীক্ষা শেষ হয় নি। প্রতিটি প্রদর্শনীতেই আমাদের এক ধরনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তাতে মনে করি প্রচলিত কোনো প্রপস ব্যবহার না করেই ঐ মুহূর্তটির নাট্যগুণ বের করা গেছে।
এম. এ. সবুর
নাটকটাতো একটা রাতের ঘটনা। সেখানে আলোক প্রক্ষপণেও রাতের আবহ তৈরি হয়েছে কিন্তু নাটকটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আরো যে-সমস্ত উপাদান প্রয়োজন হয়, সেখানে মিউজিক একটা বড় ব্যাপার। রাতে তো সাধারণত ঝিঁ ঝিঁ পোকা বা শেয়াল ডাকে। তো কিছু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে যে, এগুলো যদি ভাবা হতো, তাহলে পরিবেশটা আরো গ্রহণযোগ্য হতো। এটা নির্দেশক বা সঙ্গীত পরিকল্পক বলবেন যে, এটা কি সচেতনভাবেই বাদ গেছে না অবচেতনভাবে? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে- দানিউল চরিত্রটা নিয়ে। সমাজে দানিউল শ্রেণীটা হচ্ছে একটা বঞ্চিত শ্রেণী এবং এই বঞ্চনাটা এতো বেশি যে, কিছু পেতে তারা কাউকে হত্যা করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। তো দানিউলের বঞ্চনার জীবনের যে ক্ষোভ এটা বর্ণনার ভেতর দিয়ে যা বলে, তা কোনো এ্যাকশনের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করতে পারলে ভালো হতো। বর্ণনার ভেতর দিয়ে যখন যায়, তখন মনে হয় তার ভেতরে ক্ষোভ যন্ত্রণা, তার ভেতরে সত্য চেনার যে প্রয়াস, সেটার শক্তিটা বোধহয় নাটকের মধ্যে কমে যায়। এই বিষয়টি দর্শক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে। তো যদিও নির্দেশক একটু আগে রীতির কথা বলেছেন, তবুও আমার কাছে মনে হয়েছে, বর্ণনার জায়াগাগুলো এ্যাভয়েড করে কোনো নাট্যক্রিয়ার দ্বারা দৃশ্য তৈরি করা যেত কিনা?
মোহাম্মদ বারী
সঙ্গীত বিষয়ে আমারও একটা প্রশ্ন আছে, এখনই বলে ফেলি, তাহলে একসাথে উত্তর দিতে পারবেন। আমি অহরকণ্ডল-এর তিনটি প্রদর্শনী দেখেছি, তো প্রথম দিকের শো-তে আবহসঙ্গীতটি আমার কাছে পরিমিত বা সঙ্গত মনে হয়েছিল, একটা নিরবতার মধ্যে ধ্বণীর যে ভাষা, সেটা পেয়েছিলাম। কিন্তু একেবারে লাস্ট শো-টা দেখে মনে হলো সাউন্ড কিছু বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে রাতের নিরবতার মধ্যে বাতাস দেয়ার জন্য একটা সাউন্ড ইফেক্ট দেয়া হয়েছে, যেটা খুবই ডিস্টার্বিং মনে হয়েছে। এখন এটা তৈরি করা না যান্ত্রিক গোলযোগ বুঝতে পারলাম না।
অসিত কুমার
প্রথমে সবুরভাইয়ের প্রসঙ্গটা নিয়ে বলি যে, রাতের আবহে শেয়ালের ডাক, ঝিঁ ঝিঁ, প্যাঁচার ডাক, এগুলো প্রাথমিক ভাবনায় এসে যায়। আমাদেরও এসেছিল, কিন্তু টেক্সট-টা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখি যে- নিশীথ রাতের এ-সব শব্দাবলী বদিউজ্জামান আলমগীরের হাতে কবিতায় রূপান্তরিত হয়। যখন এ-সব শব্দ কবিতারূপে আসে টেক্সট-এ তখন সঙ্গীত আয়োজনের জায়গায় একটা সংকট তৈরি হয়। আমি সেই সংকটে পড়েছিলাম। চরিত্রের বর্ণনায় এসে যায়- রিনিকি ঝিনিকি ঝিনিকি (টেক্সট থেকে উদ্ধৃত) ... তো রাতের আবহ উপস্থাপনে এ শব্দগুলো তো অসাধারণ। এই নাটকের আবহ সঙ্গীত করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, আমার আসলে কিছু করার নেই। সঙ্গীত আপনাতেই এই নাটকের অর্ন্তনিহিতরূপে উপস্থিত ভীষণ শক্তি আর কাব্যিক মাধুর্য নিয়ে। তো রাতের আঁধারে আপনি যে আবহ সঙ্গীত চাচ্ছেন সেটা মূলত রিয়েলিস্টিক। কিন্তু এই নাটকের ডিরেক্টরিয়াল ডিজাইন রিয়েলিস্টিক না, অভিনয় রিয়েলিস্টিক না, এবং নাটকটাও সেই অর্থে রিয়েলিস্টিক না ... সেখানে আমি রিয়েলিস্টিক সাউন্ড থ্রো করি কীভাবে? প্রতি শো-তেই আমি একটু একটু ভিন্ন করছি, মানে নিরীক্ষা শব্দটি ব্যবহার করতে একটু ইয়ে লাগে, কিন্তু আসলে নিরীক্ষাই বোধহয় চলছে এবং চলবে। অন্যান্য নাটকের মতো এই নাটকেও নৈঃশব্দ এবং শব্দের একটা ইন্টার প্লে আছে, যেজন্য আমি খুব সাবধান থাকবার চেষ্টা করেছি যে নৈঃশব্দের সম্ভাবনাকে আমি ব্যহত করছি কিনা। এই নাটকের তিনটি চরিত্রের যে মনস্তাত্বিক সংকট আছে সেটা কিন্তু আমাদের কাছে আসে উল্টো পথে। তারাতো সংকটগুলো নিয়েই বড় হয়েছে, তারা মিথ, বিভিন্ন লোক-উপাদান শ্রবণে বড় হয়েছে। প্রত্যেকটা মানুষই তাদের সংস্কৃতির, তাদের লোকজীবনের, তাদের বিশ্বাসের ফলশ্র“তি। আমরা নাটকের এই মানুষগুলো দেখি উল্টো জায়গা থেকে। প্রকৃতি, সমাজ, পরিবারের মধ্যে তার কন্সট্রাকটেড হয়েছে, আমরা তাদের ডি-কন্সট্রাকশনটা দেখি। ফলে আমাকে এই ডি-কন্সট্রাকশনটা ধরার চেষ্টা করতে হয়েছে। এবং ধরতে গিয়ে কিছু কিছু কাজ করতে হয়েছে। এখন বারীভাইয়ের প্রশ্নের ব্যাপারে বলি- উনি যে বিষয়টা নিয়ে দর্শক হিসেবে ডিস্টার্ব ফিল করেছেন, সেটা প্রথম থেকেই ছিল, সব শো-তেই ছিল। কিন্তু বিশেষ করে সর্বশেষ শো-তে যান্ত্রিক ত্র“টির জন্য এটা হয়েছে, বিশেষ করে সাউন্ড বক্সগুলো কাছাকাছি যারা ছিলেন তারা বোধহয় বেশি সমস্যা ফিল করেছেন। আর ককশিটের শব্দের মতো যেটা মনে হয়েছে সেটা আসলে এক ধরনের পেভলস ছিল, তো ঐ দিন সাম হাউ মাইক্রোফোন শব্দটা বেশি টেনেছে, ফলে সাউন্ড বক্সের কাছাকাছি বসা দর্শকদের অসুবিধা হয়েছে। সেজন্য আমি দুঃখিত।
হাসান শাহরিয়ার
দানিউল চরিত্রটা নিয়ে সবুরভাইয়ের একটা প্রশ্ন ছিল, সেটা আমার মনে হয় রতন দেব দিতে পারবেন, কারণ ইনিই দানিউল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ওনাকে দর্শক সারিতে দেখতে পাচ্ছি। আমরা তার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
রতন দেব
[নাট্যজন- উদীচী, অভিনেতা- অহরকণ্ডল]
দানিউলের যে চরিত্র বা ক্রাইসিস, এটা দানিউল যেভাবে উপস্থাপন করে, সেটা শুধুমাত্র কথা না বলে আরো কোনো জেশ্চার বা আরো কোনো ক্রিয়া দিয়ে করা যেতো কিনা, সেটা অবশ্য নির্দেশকের ব্যাপার। আমি, কেবল আমি না, এই নাটকের সবাই প্রথম থেকেই বুঝে নিয়েছি যে, এই নাটকের মূল শক্তিটা হচ্ছে টেক্সট। এই টেক্সটটা যত কম প্রপস, যত কম কোরিওগ্রাফি বা কম মিউজিক দিয়ে ভিজ্যুয়াল করে দর্শককে শোনানো যায় ততই ভালো হবে বলে আমরা মনে করেছি। তো দানিউলের যে ক্রাইসিস সেটা বর্ণনার ভেতর দিয়ে তার শরীরটা ব্যবহার করে করতে চেষ্টা করেছি, হতে পারে কোনো দর্শকের হয়তো ভালো লাগে নি। আবার অন্য দর্শকের হয়তো এই কারণেই ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ।
পায়েল আজাদ
[নাট্যজন- পালাকার]
আমার প্রশ্নটা রতন দা’র কাছে। উনি ভালো অভিনয় করেন, সেটা আগেই শুনেছিলাম, এবং শুনেই অহরকণ্ডল দেখতে গিয়েছিলাম। তো সেখানে ওনার অভিনয় ভালো লেগেছে। কিন্তু তার পরপরই আমি ওনার নিজের দলের নাটক বৌবসন্তী দেখতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ওনার অভিনয় অনেকটাই দানিউল চরিত্রের মতো হয়ে যাচ্ছে ... মানে সংলাপ বলার ধরন বা জেশ্চার এসব মিলে যাচ্ছে। তো এটা আমার কাছে অভিনেতা হিসেবে একটা সীমাবদ্ধতা মনে হয়েছে। দুই চরিত্রের মুভমেন্ট, কাউকে খোঁজা, কিছু কিছু লুক, প্রায় একই রকম। তো এটা কি আপনি সচেতনভাবে করেছেন, নাকি হয়ে গেছে?
রতন দেব
নিজেকে খুব সম্মানিত মনে হচ্ছে, কারণ, আমি ভেবেছিলাম কেবল ডিজাইনারদেরকেই প্রশ্ন করা হবে। এখন দেখছি অভিনেতাদেরকেও করা হচ্ছে। যাক, আমার উত্তর হচ্ছে, একজন সাধারণ অভিনেতা যখন একই সাথে কয়েকটি নাটকে কাজ করেন, তখন তার অনেক কিছুই অন্য চরিত্রগুলোর সাথে মিলে যায়। তবে আমি চেষ্টা করি যেন না মিলে। এবং আমি মনে করি খুব বড় মাপের অভিনেতা এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেন। আমি যদি কাটিয়ে উঠতে না পারি, সেটা অবশ্যই আমার সীমাবদ্ধতা। তবে আমি সচেতনভাবে মিল রাখি না। নিজের অজান্তেই হয়তো হয়ে যায়। এরপর থেকে এ-ব্যাপারে সচেতন থাকবো। ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ বারী
আমার একটা বিষয় জানার আছে, এখানে তিনজনের ব্যক্তিজীবনের আখ্যানভাগটা ব্যক্ত করতে গিয়ে ... বিশেষ করে আকমলের অংশে তার পেরিমা নিয়ে যে প্রসঙ্গটা এসেছে, সেটি আমাকে দর্শক হিসেবে ভীষণভাবে অন্যদিকে টার্ন করাচ্ছিল। অন্য একটি গল্পের দিকে মনোযোগের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। বাকি দু’জনের গল্পটা কিন্তু নাটকের সাথে মিশে গেছে স্বাভাবিক গতিতেই, কিন্তু আকমলের পেরিমার গল্পটি একেবারেই বিচ্ছিন্ন মনে হয়েছে। সেটাকে কোনোভাবে ব্যালেন্স করা যেত কিনা?
হাসান শাহরিয়ার
কে উত্তর দিবে, নির্দেশক না অভিনেতা?
কামালউদ্দিন কবির
অভিনেতাই দিক। উনি এখানে উপস্থিত আছেন।
হাসান শাহরিয়ার
দিলীপ চক্রবর্তী।
দিলীপ চক্রবর্তী
বারীভাই যে প্রশ্নটা করেছেন, সেটা টেক্সট-এর জায়গা থেকে। নাটকের শুরু হচ্ছে তিন মদ্যপ যুবকের বিক্ষিপ্ত কিছু কথা দিয়ে। তাদের ভেতরকার চিন্তাগুলোর কিছু প্রকাশ পায় মাত্র। সেই চিন্তাগুলো নাটকে পরবর্তী পর্যায়ে আর কন্টিনিউ করে না। এই বিক্ষিপ্ত চিন্তারই একটা প্রকাশ আকমলের পেরিমা সংকট ... দানিউলেরও আছে, বাহারেরও আছে সেগুলো অন্যরকম। সে-ক্ষেত্রে পুরো নাটকে এই বিষয়টা টানা যেত কিনা, সেটাতো ভিন্ন বিষয়, কিন্তু টানা হয় নি তাতে কোনো সমস্যা আমি পারফরমার হিসেবে বোধ করি নি। ধন্যবাদ।
তানসেন নিকলী
আমার একটি প্রশ্ন আছে। তার আগে জন্মসূত্র-কে ধন্যবাদ, এরকম একটি ভালো প্রযোজনা আমাদেরকে উপহার দেয়ার জন্য। প্রশ্নটা হলো, নাটকের ঘটনা হলো চরের মধ্যে, সেখানে আমরা মঞ্চে দুটো মোড়া দেখতে পাই, বেতের তৈরি। চরের দৃশ্যে বেতের মোড়া ব্যবহারের কারণ জানতে চাই।
কামালউদ্দিন কবির
সেটা আসলে বেতের মোড়া ছিল না, মেটাল দিয়ে তৈরি ... যাই হোক দর্শকের কাছে যদি বেতের মনে হয় তাহলেতো ভাবনার বিষয়ই। মেটালের উপর কাগজের ব্যবহার করে ওটা করা হয়েছে। আর এগুলো ঠিক মোড়া হিসেবে ব্যবহার করা হয় নি। কারণ, আমাদের উপস্থাপনায় বাস্তবানুগ কোনো জায়গা নেই। আমরা থিয়েট্রিক্যাল একটা স্পেসই তৈরি করতে চেয়েছি। মূলত পারফরমারদের সুবিধার জন্যই এই উপাদানগুলো তৈরি করা, এটা গাছের গোড়াও বোঝানো হতে পারে, আবার উঁচু কোনো জায়গাও বোঝানো হতে পারে ... মানে আমরা কোনোভাবেই চরের বাস্তব দৃশ্যায়ণ করি নি, কারণ, টেক্সট-এ সব বর্ণনাই আছে, সেগুলো আবার রূপায়ণের প্রয়োজন বোধ করি নি।
সুদীপ্ত
[শিক্ষার্থী- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
কবির স্যারের কাছে আমার প্রশ্ন ... আমরা দেখতে পাই নাটকটি খুবই সামাজিক এবং রিয়েলিস্টিক নাটক। কিন্তু এর ভেতরে কিছু অলৌকিক অবস্থার মঞ্চায়ন হয়েছে, এটা কি তিনজনের মদ্যপ অবস্থার জন্য হয়েছে? আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে তিনজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল হচ্ছে বাহার, অথচ এক-সময় তার উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হলো খুন করার। আবার পরে দেখা গেল তিনজনই বলছে- আমি খুন করবো। এই ব্যাপারটা কন্ট্রাডিক্ট করছে না?
কামালউদ্দিন কবির
প্রথম কথাটা ছিল যে, অলৌকিক বিষয়গুলো যে আসে সেটা নিয়ে। আচ্ছা আমরা যে মানুষ, সেই মানুষ যে যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সে তার পারিপার্শিক অভিজ্ঞতা নিয়েই বেড়ে ওঠে। এই অভিজ্ঞতাগুলো মধ্যে কেবলই লৌকিক বা চাক্ষুস অভিজ্ঞতা নিয়ে সে বড় হয় না, এর বাইরেও তার একটা জীবন, জগৎ তৈরি হতে থাকে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের মানুষকে দেখবেন তাদের প্রয়োজনীয় কথাবার্তায় নানান উপমা, নানান প্রতীক, ব্যঞ্জনা তৈরি হয় যেটা কিনা আমাদের নাগরিক মানুষের মধ্যে অনেকটাই কম। তো এই নাটকের তিনটি চরিত্রেও সেটা আছে- তাদের ছোটবেলায় মায়ের কাছে শোনা গল্প এখনও পরিণত বয়সে এসে নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়া তৈরি করে। সেখান থেকেই এই ‘অলৌকিক’ বিষয়গুলো এসেছে। আরেকটা প্রসঙ্গ যেটা এসেছে, শেষে খুন করার ব্যাপারে ... শুরুতে তিনজনের মধ্যেই বিক্ষিপ্ততা থাকলেও শেষে একটা বিন্দুতে এসে তিনজনই এক হয় যে খুনটা তারা করবে। প্রত্যেকটা মানুষের আচার-আচরণ-বৈশিষ্ট্য-সাহস ভিন্ন ভিন্ন হয়। এখানে তিনজনের মধ্যে বাহার অপেক্ষাকৃত দুর্বলচিত্তের মানুষ, সেজন্য দানিউল তাকে একটা প্র্যাকটিসের মধ্যে নিয়ে যায় এবং সেভাবেই তাকে তৈরি করে। দানিউল তার আঙ্গুর কাকুর কথা বলে, অহরকণ্ডল পাখিটার কথা বলে ... বলে যে, অহরকণ্ডল পাখি সব পারে। আজকে এই পাখিই নিয়ামুলকে আমাদের কাছে এনে দেবে। তো তখন তিনজন অবচেতনভাবে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় যে- হ্যাঁ খুন করবো। অতএব এখানে আমার মনে হয় কন্ট্রাডিকশন নয়, তাদের ট্রান্সফরমেশন ঘটে। ধন্যবাদ।
দেবাশীষ ঘোষ
কবিরভাইয়ের কাছে আমার একটি প্রশ্ন। আপনাকে আমরা দেখি বিভিন্ন দলে নির্দেশনা দিয়েছেন, ডিজাইন করেছেন। তো অহরকণ্ডল করতে আপনাকে একটা নতুন প্লাটফর্ম তৈরি করতে হলো কেন? অন্য কোনো দল না করে জন্মসূত্র করার পেছনে কোনো কারণ আছে কিনা?
কামালউদ্দিন কবির
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে অহরকণ্ডল করার জন্য জন্মসূত্র করেছি আমরা। এর আগে অহরকণ্ডল করার জন্য একটা প্লাটফর্ম খুঁজছিলাম। কেন খুঁজছিলাম? কারণ, আমাদের এই সময়ে, বিশেষ করে ১৯৯০ থেকে বাংলা নাটকে একটা বিরাট বাঁক বদল হয়েছে। সেটি হয়েছে সেলিম আল দীনের কল্যাণে। উনি সুনির্দিষ্টভাবে, সুচিন্তিতভাবে ওনার রচনারীতিতে একটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, সেটা হচ্ছে বর্ণনাত্মক নাট্য-রচনারীতি। ওনার চাকা নাটক দিয়ে সেটা শুরু হয়েছে। এরপর থেকে অনেক তরুণ নাট্যকার এই বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে নাটক রচনা শুরু করেছেন। যদিও আমরা সাইন বোর্ড ঝোলাতে চাই না যে, আমরা বর্ণনাত্মক নাটক করছি। আমরা মূলত থিয়েটারই করছি। তো আমি অনেক দলের সঙ্গেই কাজ করেছি কিন্তু অহরকণ্ডল করার জন্য যে চিন্তা-ভাবনা করেছি সেই ভাবনাটা শেয়ার করার জন্য সে-রকম অন্তরঙ্গ বন্ধুতা দরকার, সেটা হয়তো কোনো দলের সাথে গড়ে ওঠে নি। ... আমি দেখছি দর্শক সারি থেকে দিলীপের হাত উঠেছে, সে বোধহয় বলতে চায় ...
দিলীপ চক্রবর্তী
আমাদের ভেতরকার যে আলাপ আলোচনা বা ভাব আদান প্রদান হয়েছিল, সেটা একটু বলতে পারি। আমরা শুধুমাত্র আমাদের মতো করে থিয়েটারটা করতে চেয়েছি বা চাই। যেমন- কবিরভাই, আমি, রতন দা’, আনোয়ার, লিমা এরকম আমরা ক’জন বন্ধু আমাদের মতো করে ভাবতাম যে, আমরা এভাবে থিয়েটারটা করতে চাই। এখন প্রশ্নকর্তাকেই যদি জিজ্ঞাসা করি- আপনি কি আপনার দলে আপনার মতো করে থিয়েটারটা করতে পারছেন? আমাকে উত্তর দেবার দরকার নাই, আমি বলতে চাইছি, এরকম প্রতিবন্ধকতা আমাদের প্রতিটি দলেই আছে। আমরা সেই জায়গা থেকে সমমনা ক’জন বন্ধু চেয়েছিলাম যে, আমাদের মতো করে থিয়েটারটা করতে ... এবং এজন্য আলাদা প্লাটফর্ম তৈরি করেই করা যায় কিনা। তো আমি বলতে চাই, জন্মসূত্র কোনো গ্রুপ থিয়েটার না, এটি একটি থিয়েটার প্লাটফর্ম এবং একটা ওপেন প্লাটফর্ম।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। অহরকণ্ডল-এর সময় শেষ। মঞ্চের সবাইকে দর্শক সারিতে বসবার জন্য অনুরোধ করছি। এবার আমি চার নাটকের চারজন নির্দেশককে মঞ্চে আসবার জন্য অনুরোধ করবো এবং এই পর্বটি হবে উন্মুক্ত। আপনারা যে-কোনো সময় যে-কোনো নাটকের উপর প্রশ্ন করতে পারেন। নির্দেশক বা সংশ্লিষ্ট কেউ এগুলোর উত্তর দেবেন। ধন্যবাদ। প্রশ্ন চাচ্ছি দর্শকদের কাছ থেকে।
রতন দেব
আমার প্রশ্নটা সময়ের প্রয়োজন নাটকের উপর। দুটি নাটকের পটভূমি মুক্তিযুদ্ধ। তো এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক করা আসলেই সাহসের বিষয়। বারীভাইয়ের কাছে আমার প্রশ্ন- বর্তমান সময়কে মাথায় রেখেই কি এই নাটক এখন করলেন, নাকি মুক্তিযুদ্ধ সবসময়েই প্রাসঙ্গিক এই ভেবে এখন নাটকটি করলেন? আরেকটি কথা হলো- জহির রায়হানের সময়ের প্রয়োজনে গল্পটি আমরা স্কুলে পাঠ্য হিসেবে পড়েছি। তখন একটা ইমেজ চোখের সামনে ভেসেছিল, কিন্তু নাটক দেখতে গিয়ে বিশাল সেট, ক্যাম্পের নানা ঘটনা, নানা চরিত্র সব মিলিয়ে ইমেজটা বাধাপ্রাপ্ত হয় ... এই বিষয়ে বারীভাইয়ের মত কী?
মোহাম্মদ বারী
এটা হয়তো আমার ব্যর্থতাই, যে ইমেজটার কথা রতন বলছেন, আমি নাট্যরূপায়ণ করতে গিয়ে ঐ ইমেজটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেই নি। কারণ, জহির রায়হান তার গল্পটা ফিল্মের ভাষায় লিখেছেন- দূরে একটি গ্রাম ... লং শটে দেখছেন উনি ... একটি লাউয়ের মাচা, ক্লোজ শট ... একটি লাউ, ভেরি ক্লোজ শট ... ইত্যাদি ইত্যাদি। তো আমার মনে হয়েছে যদি কথাসাহিত্যকে উনি ফিল্মের ভাষায় বর্ণনা করতে পারেন, তাহলে তার ফিল্মের ভাষাটাকে থিয়েটারের ভাষায় রূপান্তর করলে কী দাঁড়ায় দেখা যাক ... এধরনের একটা ‘বোকামী’ চিন্তা আমার মাথায় আসলো। এবং দলেও যখন আলাপ করলাম, তখন অনেকেই বললো যে- এটাকে কীভাবে করবেন? এমনও আলাপ হয়েছে যে- প্রথমে আমরা সতীর্থ কিছু বন্ধু নাট্যজনদের দেখাবো তারা যদি বলে যে- হ্যাঁ এটাকে দর্শকদের কাছে নেয়া যায়, তবেই আমরা সেটা মঞ্চে আনবো। তো শেষ পর্যন্ত দেখা গেল - হ্যাঁ একটা কিছু দাঁড়িয়েছে এবং এখনও আমরা সেটার প্রতিক্রিয়া পাই। আপনি যে বললেন- আপনার ইমেজ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, সেটা আমার সাফল্যও হতে পারে, ব্যর্থতাও হতে পারে। আর প্রথম যে প্রশ্নটা করেছিলেন যে, এখন এই নাটক কেন? আসলে পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এই নাটকটা করা যায়। সে-ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ সব সময় প্রাসঙ্গিক বলেই করলাম, এই সময়কে মাথায় রেখে ধরি নি।
অনন্ত হিরা
বারীভাই যে দলে কাজ করে- থিয়েটার আর্ট ইউনিট ... সে-দলের আরেকটি নাটক আছে মুক্তিযুদ্ধের উপর- কোর্ট মার্শাল। ওটাতে আপনি অভিনয়ও করেন। আর মুক্তিযুদ্ধের উপর সময়ের প্রয়োজনে নাটকের আপনি হলেন নির্দেশক-অভিনেতা। তো আমার প্রশ্ন, আপনার কী মনে হয়- কোর্ট মার্শাল নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা মূল্যবোধ এ-সব বিষয়গুলো যেভাবে নাড়া দেয়, সময়ের প্রয়োজনে কি সেই জায়গাটা স্পর্শ করতে পেরেছে? আরেকটি প্রশ্ন হলো- আমরা মঞ্চে বা টিভি নাটকে অনেক মুক্তিযুদ্ধের নাটক দেখি, যেগুলো কল্পনা, আবেগের বাড়াবাড়ি বা রোমান্টিসিজমে ভরা। তো আপনি কি মনে করেন- সময়ের প্রয়োজনে নাটকে এব্যাপরগুলো উৎরিয়ে গেছে?
মোহাম্মদ বারী
শেষেরটা দিয়েই শুরু করি; আমারতো মনে হয় আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শুধু শুধু আবেগ বা অতিরঞ্জন এসব একেবারে কমিয়ে করেছি। দর্শক যেন বিরক্ত না হয় সেদিকটা অবশ্যই আমি লক্ষ্য রেখেছি। এবং এ-নিয়ে দর্শকদের কমেন্টও পজেটিভ। আর প্রথম যে প্রশ্নটা করা হলো, দুই নাটকের তুলনা দিয়ে, তার প্রেক্ষিতে বলবো কোর্ট মার্শাল অবশ্যই একটি অত্যন্ত সফল নাটক। কেবল আমার দলেরই না, বাংলাদেশের মঞ্চের একটি অন্যতম ভালো নাটক কোর্ট মার্শাল। ভালো নাটক এবং পাশাপাশি জনপ্রিয় নাটক। তবে কোর্ট মার্শাল যে জায়গাটা ধরেছে সময়ের প্রয়োজনে কিন্তু আবার অন্য জায়গা থেকে করা ... মানে এটা অনেকটা মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য উপস্থাপনা বলবো।
সাইফুল
[নাট্যজন- প্রাঙ্গণে মোর]
আমার প্রশ্ন না, মতামত, কথা’৭১ নিয়ে ... সেটা হলো এই নাটকের এতো বিশাল আয়োজন দেখে আমার মনে হয়েছে, এতোটা প্রয়োজন ছিল কিনা? আমার মনে হয়েছে মঞ্চে বেশি বেশি বিভৎসতা দেখানো হয়েছে। একটু আগে প্রীতীশ বল দা’ বললেন যে- একজন দর্শকের দুটো রুমাল ভিজে গেছে, তো সেটা এই বিভৎসতা দেখার ফলেও হতে পারে।
দেবাশীষ ঘোষ
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই প্রজন্মের কতটুকু স্টাডি আপনার আছে আমি জানি না, তবে এটুকু বলতে পারি আমি বিভৎসতার কিছুই দেখাতে পারি নি। যারা এই বিভৎস কাজ করেছে, তারা আজ কোথায় আপনি জানেন?
মাহফুজ
আপনি যাদের কথা বলছেন, আমরা কি তাদেরকে মহিলা সমিতিতে এনে সেটা দেখাতে পারছি?
দেবাশীষ ঘোষ
দেখা না দেখা দর্শকের দায়িত্ব। আমার আপনার দায়িত্ব না তাদেরকে এনে দেখানো। আর তাদের দেখাতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সেই বিভৎসতার স্বরূপটা আমাদের জানা দরকার। এবং আমরা দেখছি কিনা সেটাই হলো আসল কথা।
ঠাণ্ডু রায়হান
আমার কবির বা দিলীপের কাছে একটু জানার আছে, সেটা হলো- জন্মসূত্র কি একটা প্রফেশনাল গ্রুপ?
দিলীপ চক্রবর্তী
এই উত্তরটা আমিই দিতে চাই, যদিও আজকের অনুষ্ঠানে এটা প্রাসঙ্গিক কিনা আমার জানা নেই। আমাদের দলটি প্রফেশনাল কিনা জানি না, কিন্তু আমরা প্রফেশনাল হতে চাই। আপনার সহযোগিতা চাই। এবার আমি কথা’৭১ নাটক নিয়ে একটা প্রশ্ন করতে চাই, সেটা হলো কথা’৭১ নাটকের বাইরে যে-সমস্ত খণ্ড খণ্ড দৃশ্য দেখানো হয়েছে, সেগুলো দর্শককে কতটুকু আলোড়িত করেছে? আর পুরো নাটকটাতে মেলোড্রামা বেশি করে ভর করেছে বলে আমার মনে হয়েছে, নিদের্শক হিসেবে আপনার কী মনে হয়েছে?
দেবাশীষ ঘোষ
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমি বলতে চাই, সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটিয়ে নাটক দেখতে এসে থার্ড বেল পড়লেই হলে ঢুকে নাটকে বসে যাওয়া, এই চিরাচরিত আয়োজন থেকে আমারটাকে আলাদা করতে চেয়েছি। দর্শক বাইরের খণ্ড চিত্রগুলোতে বেশি করে ইনভলব হবে এমন আশা আমিও করি নি। তবে যে দর্শক যতটুকু নেবে, সেটাও আমার কাছে কম নয়। আর মেলোড্রামার ব্যাপারে বলতে চাই, নিশ্চয়ই আপনার কাছে মনে হয়েছে বলেই আপনি বলছেন, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় নি।
আনোয়ার ইব্রাহিম
[সাংবাদিক]
কথা’৭১-এর ব্যাপারে আমি বলতে চাই, যে বাবাকে আপনি সৎ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে আমার তাকে ভণ্ড মনে হয়েছে। যে তার নিজের সন্তানকে ৫/৬ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধের কথা না বলে, ২২ বছর বয়সে এসে শোনায়, তাকে ভণ্ড ভাবা ছাড়া আর কী থাকে?
রতন দেব
আমিও একটু বলে নিই, একই প্রসঙ্গে ... সেটা হলো নাটকের ক্রাইসিসটা হলো ছেলে মুক্তিযুদ্ধ বোঝে না, বাবা বলছে, আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তুই কেন বুঝবি না .. ইত্যাদি ইত্যাদি। তো এখনকার প্রজন্মকে যদি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জানাতে চাই, তাহলে আপনি যেভাবে করেছেন, সেভাবে হবে না। এই বাবা-ছেলের সংলাপ অত্যন্ত ক্লিশে। এগুলো উপরি উপরি কথাবার্তা এবং একসময় বিরক্তও তৈরি করে। এখানে থিয়েটারী ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে হবে। এই সময়ের ভাষা তৈরি করতে হবে।
হাসান শাহরিয়ার
যেহেতু সংলাপ নিয়ে কথা উঠেছে, আমার মনে হয় এখানে দর্শক সারিতে নাট্যকার আছেন, আপনি উত্তর দিন।
কুমার প্রীতীশ বল
আমার মনে হয় এটাই দরকার ... মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা বলা দরকার। এখানে একেকজন একেকভাবে দেখছেন, বলছেন, এটাকেও আমি পজিটিভ মনে করি। নাটকে আমরা নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস দিতে চাই নি। আমরা চেয়েছি, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তারা যেন বুঝতে পারেন যে- যুদ্ধের পর পরের প্রজন্মকে কীভাবে গাইড করা উচত ছিল। সেখানে কেন বাবাকে ভণ্ড মনে হবে তা আমার বোধগম্য নয়।
যশ যায়েদী
[নাট্যজন- দৃশ্যপট]
কবিরভাইকে আমার প্রশ্ন ... আমি অবশ্য প্রথমে নাটকের নামটিও ভুল বুঝেছিলাম, যাই হোক প্রশ্নটি হলো- আমার মনে হয় সব দর্শক আপনি নাট্যকলা বিভাগের বা ঐ মানের পাবেন না, আমার মতো সাধারণ দর্শকও নাটকটি দেখতে আসবে। সে-ক্ষেত্রে আমার কাছে নাটকটি একটু বেশি মাত্রায় কঠিন মনে হয়েছে।
কামালউদ্দিন কবির
নাটকটির নাম নিয়ে সমস্যা থাকতেই পারে। এটি একটি অপরিচিত নাম। বাংলাদেশেরই লোককাহিনীর গল্পের একটি পাখির নাম ‘অহরকণ্ডল’। মানিকগঞ্জ এলাকাতে এটা পরিচিত। আর নাটকটির কঠিনত্ব নিয়ে যেটা বললেন, সেখানে আমি একটু বিনীতভাবেই বলতে চাই, যে-কোনো শিল্প উপভোগের জন্য একধরনের একটা চর্চা থাকতেই হয়। কিন্তু নাটকের ক্ষেত্রে বোধহয় আমরা একটু বেশিই আবদার করে ফেলি যে- নাটকটা একটু সহজ-সরল উপস্থাপনা করতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি, দর্শক যেহেতু থিয়েটারের অন্যতম উপাদান, সেহেতু নাট্যদর্শকেরও একটা চর্চার জায়গা থাকা উচিত।
গোলাম শফিক
কবির একটু আগে বর্ণনাত্মকরীতির নাটক নিয়ে যেটা বললেন, সেটা শেষ করেন নি। এই বিষয়টা ইতোমধ্যেই একটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আমরা যারা এই রীতির কাজ করছি তারা খুব বুঝে-শুনেই কাজ করছি, স্টাডি করে নিজেকে পরিষ্কার করেই কাজ করছি। সেলিম আল দীন-কে একবার প্রশ্ন করেছিলাম- আপনি যেটা করছেন, সেটা আমরা কেন করবো? জবাবে তিনি বলেছিলেন- মধ্যযুগের বাংলানাটক সেলিম আল দীনের পৈত্রিক সম্পত্তি নয়, এখানে সকলেরই প্রবেশাধিকার আছে। তো উনি যেটা করেছেন, সেটা হলো একটি ছিন্ন সূত্রকে ধরিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আমার মনে হয় যে, বর্ণনাত্মক নাটক কোনো দলের বা ব্যক্তির নয়, সকলেরই সম্পত্তি। এই নিয়ে কোনো বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই বলে আমার মনে হয়।
জনৈক
কবিরভাইয়ের কাছে প্রশ্ন- অহরকণ্ডল নাটকে যে ভাষারীতি, সেখানে সংস্কৃত এবং তৎসম শব্দের ব্যবহার রয়েছে। এই আধুনিক সময়ে ভাষার মানের চর্চার চলতিরীতি উপেক্ষা করে সেই সংস্কৃত ও তৎসম শব্দের ব্যবহার এখনও বর্তমান দর্শকদের কাছে পৌঁছা বা সফল হওয়া আদৌ সম্ভব কিনা? নাকি এই ব্যবহাররীতিটির মধ্যে আপনার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য বা কৌশল বা আকাঙ্খা রয়েছে?
কামালউদ্দিন কবির
প্রশ্নকর্তাকে ধন্যবাদ। এই ধরনের প্রশ্নই আসলে আশা করছিলাম। সংক্ষেপে দুটো কথা বলি- একটা হচ্ছে ভাষা, শিল্প সব-কিছুর একটা বিবর্তিত রূপ থাকে। আমরা বারবার নিজস্ব নাট্যরীতির কথা বলছিলাম ... তো সে-রকম নিজস্ব শিল্পের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের কথাসাহিত্যের যে ঐতিহ্য, সেটার একটা নিজস্ব গঠন, শব্দ-চয়ন আছে। এখন আমরা যদি মনে করি আমাদের অতীত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী আমরা, তাহলে সেই ভাষা-ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে আমরা কোন ভাষায় আমাদের শিল্প উপস্থাপন করবো? এই চিন্তা নিয়েই কিন্তু কবিতা বা পেইন্টিংস-এ আমাদের লোক-ঐতিহ্যের যাবতীয় অনুষঙ্গ নিয়ে তারা আধুনিক শিল্প নির্মাণ করছেন। সেখানে আমাদের বাংলা নাট্যরীতিতে যদি কেউ দাবী করি বা চেষ্টা করি গবেষণা করার যে, নিজস্ব ভাষা যেটা আছে সেটা আধুনিক দর্শকদের সামনে কীভাবে উপস্থাপন করা যায়, সেটা কেমন হয়। আর যেহেতু অনেক-দিনের একটা গ্যাপ আছে বা গ্যাপ হয়েই আছে, সেহেতু মনে হতে পারে যে, এগুলো অচেনা শব্দ বা ভাষা। আমি প্রযোজনায় যাবার আগে আমাদের শ্রদ্ধেয় নাট্যজন থেকে শুরু করে কবি, পেইন্টার, সাংবাদিক অনেককেই পাঠ করতে দিয়েছিলাম পাণ্ডুলিপিটি। তো সবারই প্রায় একই মন্তব্য ছিল যে- না এই ভাষায় আমাদের দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা সম্ভব না। এরকম মন্তব্য নিয়েও আমরা কাজটা শুরু করেছিলাম, এখনও চালিয়ে যাচ্ছি এবং আশার কথা আমরা নিজেদের মধ্যে কন্ফিডেন্সটা পাচ্ছি। ধন্যবাদ।
রানা
[নাট্যজন]
আমার প্রশ্নটা সম্পাদককে যিনি এখন সঞ্চালকের ভূমিকায় আছেন ... প্রশ্নটা হলো আমরা অনেকেই নিয়মিত ‘থিয়েটারওয়ালা’ পড়ি, এবং অনেকেই এটার সম্পর্কে জানি। প্রকাশনার বাইরে এখন দেখছি আপনারা নাট্যকর্মীদের একটা ভাবনার জায়গা তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এটায় আপনারা কতটুকু সার্থকতা অর্জন করেছেন বলে মনে হয়? মানে ঐ জায়গাটা তৈরি করা গেছে কিনা?
হাসান শাহরিয়ার
এখন তো দেখছি সঞ্চালকই সরাসরি মুখোমুখি দর্শকের হাঃ হাঃ ... যাক, আসলে আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, আমরা সবাই বলি যে- ‘আমি কিন্তু সমালোচনা পছন্দ করি। যে-কোনো ধরনের সমালোচনা’। তো তারপর দেখবেন আপনি যখন সমালোচনা করবেন, তখনই উনি রেগে যাবেন, এবং আপনি যে কিছুই বোঝেন না, সেটা তিনি আপনাকে বুঝিয়ে দেবেন। তার মানে আমরা সমালোচনা ততটুকুই পছন্দ করি, যতটুকুতে প্রশংসা আছে। তাই আমরা চেয়েছি আমরা যেন পরষ্পরের সাথে খোলামেলা আলোচনা-সমালোচনার পরিবেশটা তৈরি করতে পারি। নাটক বা সাহিত্য নিয়ে বা নিজেদের কাজ নিয়ে আড্ডা, মিথষ্ক্রিয়া এসব যেন বেশি বেশি করতে পারি সে-জন্যই এই আয়োজন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বহুদিন এধরনের চর্চা ছিল না, এবং আমরাও মোটে ৩টি অনুষ্ঠান করেছি। আশা করি এভাবে করতে করতে প্রলপ্রসু কিছু পাওয়া যাবে। ধন্যবাদ।
ফয়সাল রাজিব
[সম্পাদক- চরৈবেতি, নাট্যজন- নাট্যকেন্দ্র]
কবির স্যারের কাছে একটু জানতে চাই, আপনি ‘জন্মসূত্র’ এবং অহরকণ্ডল নাটক করলেন। তো জানলাম যে, এটা গ্রুপ থিয়েটার না। তো আপনি অভিনেতা কীভাবে নির্বাচন করেন? ৫ জন ডেকে বাছাই করে ৩ জন, নাকি অন্য কোনোভাবে?
কামালউদ্দিন কবির
প্রথম উদ্যোগ হিসেবে আসলে নিজ থেকেই ৩ জনকে নিয়ে নিয়েছি। আশা করছি পরবর্তী সময়ে নাটকের প্রয়োজনে বেশি চরিত্র লাগলে বাছাই করে নেব।
হাসান শাহরিয়ার
আমাদের সময় প্রায় শেষ। শেষ প্রশ্নটি করার জন্য অনুরোধ করছি। যেহেতু অনেকক্ষণ তিনি কোনো প্রশ্ন করছেন না, এবং বিপ্লব দা’র প্রশ্ন দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেছিলাম, তো আমার মনে হয় শেষ প্রশ্নটি বিপ্লব দা’ আপনিই করুন।
বিপ্লব বালা
অহরকণ্ডল নাটকের নির্দেশক একটু আগে পেইন্টিংস বা কবিতার রেফারেন্স দিয়েছেন, ভাষার ব্যাপারে বলতে গিয়ে, বলেছেন- আধুনিক থিয়েটারেরও একটা নিজস্ব ভাষা হওয়া উচিত। কিন্তু বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের কিন্তু আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে, সেটা মনে রাখতে হবে। পেইন্টিংস, কবিতা একভাবে এক্সপ্রেস করে, মঞ্চ আবার অন্যভাবে এক্সপ্রেস করবে। সেই মঞ্চের ভাষার জায়গা থেকে আপনাকে ভাবতে হবে টেক্সট এর ভাষাটা কী হবে। কারো সাথে পাল্লা দেয়ার তো কিছু নেই, প্রত্যেকটা মাধ্যম আলাদা আলাদা। প্রত্যেক মাধ্যমের সীমাবদ্ধতাও কিন্তু আলাদা আলাদা। তো সেদিক থেকে বিবেচনা করে আপনার টেক্সট-এর ভাষা ঠিক করতে হবে। বুঝতে হবে, এটা মঞ্চের জন্য করছেন, মঞ্চের দর্শকদের জন্য করছেন। সেদিক থেকে অহরকণ্ডল নাটকের ভাষাটা কিন্তু মঞ্চে আনার ব্যাপারে একটু গোলমেলেই বোধহয়।
কামালউদ্দিন কবির
মাধ্যমগত যে ভিন্নতার কথা বললেন, সে-বিষয়ে অবশ্যই আমি আপনার সাথে একমত। নাট্যরীতি অহরকণ্ডল নিয়ে নানা কথা উঠেছে বলে প্রসঙ্গগুলো বলছিলাম। আমি আবারো বলছি যে, কবিতা-পেইন্টিংস যদি আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে আধুনিক রূপায়ণ করতে পারে, তো নাটক কেন পারবে না? নাটকের ক্ষেত্রে কেন শুধু গৎবাঁধা একটা জায়গায় বসে থাকবো? দর্শককে একটা নতুন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে কেন নিয়ে যাবো না? এতে দর্শক শুধু একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমকে একটা ফর্মকে থিয়েটার ভাববে না, তারা নতুন নতুন থিয়েটার শিল্প-ভাষার মুখোমুখি হবেন। ধন্যবাদ।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ সবাইকে। আজকের মতো শেষ করতে হচ্ছে ... চার-নাটকের সবাইকে, সুধি দর্শকদের এবং এই অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন, তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে আগামী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিতব্য আরেকটি সরাসরি মুখোমুখি অনুষ্ঠান দেখার আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে শেষ করছি।