Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

কবিরের ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী : আলোকচিত্রে সাম্প্রতিক নাটকের প্রতিভাস

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

এখন আর ঠিকমতো নাম মনে করতে পারছি না,- একজন জার্মান অভিনেতা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন শিল্পভুবনের মধ্যে অভিনয় অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অবস্থানই সবচেয়ে করুণ। কারণ, অন্য সব শিল্পের কোনো না কোনোভাবে চিহ্ন থেকে যায় ভবিষ্যতের পথপ্রান্তে, কিন্তু অভিনয় এমন এক শিল্প যা তার সব উৎকর্ষ নিয়েও হারিয়ে যায় তার সমকালেই। কথাটা খুবই সত্যি, স্মৃতিধর মানুষদের কথকতায় তাঁদের কথা উল্লেখিত হলেও, অভিনয়কীর্তি ব্যবহারিক অর্থে সত্যিই ক্ষীণায়ু। অভিনয়শিল্পীদের আত্মজৈবনিক রচনায় সে-সব কথার বিস্তার হয়তো কখনো কখনো পাওয়া যায়, কিন্তু অভিনয়ের অসামান্য কৃতির নান্দনিক মুহূর্তসমূহ পুনর্দর্শনের আর কোনো সুযোগ থাকে না। এ যেন শেক্সপীয়রের গধপনবঃয নাটকের অন্তিম পর্যায়ে নায়কের আত্ম আত্ম-আবিষ্কার : ’a poor player,/ That struts and frets his hour upon the stage,/ And then is heard no more.’

সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হল (৩ জুলাই থেকে ১২ জুলাই ২০০৬) কামালউদ্দিন কবিরের আলো ও কথাদের মর্ম শীর্ষক একক থিয়েটার আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এই প্রসঙ্গেই ওপরের কথাগুলো মনে পড়লো। এমন একটা প্রদর্শনীর প্রস্তুতির কথা বেশ কিছুদিন ধরেই কানে আসছিল, আর কবির নামের এই সদাকর্মচঞ্চল তরুণ নাট্যকর্মীকে বহুদিন ধরেই দেখছি,
বিভিন্ন প্রদর্শনীর সময় নীরবে তার ক্যামেরার লেন্স দিয়ে অভিনয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মুহূর্ত আলোকচিত্রের আয়তক্ষেত্রিক সীমানায় ধারণ করতে তৎপর দৃষ্টিতে মঞ্চের সামনের কেন্দ্রভূমিতে বসে আছেন। এই বিষয়টা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মুগ্ধ করেছে, তাড়িত করেছে। নাটক ও মঞ্চের প্রতি আমার অনিঃশেষ ভালোবাসার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় আমিও অনেকবার ভেবেছি, আমাদের নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে এই মঞ্চসচল ইতিকথা কী অনায়াসেই হারিয়ে যায়। ছ’মাস বা আট মাস শ্রম স্বীকার করে, নির্দেশকের অনেক বিনিদ্র প্রহর কাটানোর পর, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মেধা, কষ্ট, পারিবারিক জীবনের প্রতি অবহেলার সম্মিলিত উপাদানের যে বিনিয়োগ আমরা দেখতে পাই পাদপ্রদীপের আলোয়, তা কয়েক সন্ধ্যার দু’আড়াই ঘন্টার প্রদর্শনীতে ঝলমলে হয়ে উঠে, আবার হারিয়ে যায়।

আমাদের একটা খ্যাতনামা নাট্যদল ‘থিয়েটার’ বেশ কয়েক বছর আগে তাদের দু’চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনার শ্রুতি ক্যাসেট প্রকাশ করেছিল, বোধহয় ভালোই চলছিল। কিন্তু ভাবুন, মোহম্মদ জাকারিয়া আর ফেরদৌসী মজুমদার অভিনয় করছেন, তাদের চোখমুখ, মেধা, ভালোবাসা, দক্ষতা আর দায়বদ্ধতা দিয়ে, আর তা আমরা কেবল শুনছি! ভাবতে গেলে তা হরবোলাদের অনুকৃতিজাত যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তার চেয়েও তো হ্রস্ব! আমাদের নাট্যপ্রয়াসকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে International Theatre Institute (ITI)-এর বাংলাদেশ কেন্দ্র নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমি নিজেও এই সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী। আমি অনেক বার প্রস্তাব করেছি যে, আমাদের এমন একটা প্রকল্প নেয়া উচিত যার মাধ্যমে বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের সকল প্রযোজনার ভিডিওচিত্র ধারণ করে রাখা যায়। এক্ষেত্রে ব্যয়ভার আই-টি-আই ও সংশ্লিষ্ট নাট্যদল যৌথভাবে বহন করতে পারে। কত সব ভালো ভালো নাটক আমাদের স্মৃতিতেও ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এমন একটা ভিডিও গ্রন্থাগার তৈরি করতে পারলে তা যেমন আমাদের মঞ্চনাটকের একটা প্রামাণ্য ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে পারতো, একই সঙ্গে তা ভবিষ্যৎ গবেষকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হতে পারতো। এই ভিডিওচিত্রসমূহ ভালোভাবে সংরক্ষণের জন্য আমাদের শুধু একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ দরকার। আমি এমন ধরনের প্রস্তাব করেছি বহু বছর আগে। এখন তো সিডি ও ভিসিডি ফরম্যাটে এমন চিত্রধারণ অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। এই ডিজিটাল ডিভাইসের যুগে তা আর তেমন ব্যয়সাপেক্ষ নয়। দেরিতে হলেও এই উদ্যোগটা এখনও গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করি।

কামালউদ্দিন কবিরের প্রদর্শনী এই চিন্তাটা আমার মাথার মধ্যে আবার উসকে দিল। প্রথমেই অকপটে স্বীকার করে নিতে হবে যে, কবির একটা অ-সাধারণ কাজ করেছেন, আমাদের সামনে আলোকচিত্রের মাধ্যমে মঞ্চায়িত নাটকের কথা উপস্থাপন করেছেন, প্রথমবারের মতো। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম এই কাজটা করলেন এবং এভাবে ইতিহাসের সুতোয় নিজেকে বাঁধতে পারলেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে আর একবার এদেশের শিল্প-সংস্কৃতির চর্চায় তাদের অব্যাহত পৃষ্ঠপোষকতার নিদর্শন রাখলেন। এই সংস্থা বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নানামুখী ও ব্যাপক কর্মকাণ্ডে তাদের সহযোগিতা প্রদান করেছেন। এমন একটা ভিন্নধর্মী প্রদর্শনী দর্শকসমক্ষে হাজির করার জন্য তারা আমাদের সবিশেষ প্রশংসার দাবিদার।

আমাদের মঞ্চ নিয়ে যাদের ঔৎসক্য আছে, কামালউদ্দিন কবির তাদের সবার কাছেই সুপরিচিত।  অনেকদিন ধরে মঞ্চ এবং মঞ্চের বাইরের নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত তিনি। গত দু’তিন বছরে বলতে গেলে কবিরের বেশ অনুকূল মৌসুম যাচ্ছে, তার বয়সী তরুণরা এজন্য ঈর্ষান্বিত বোধ করতে পারেন। নতুন, নিরীক্ষাধর্মী এবং উৎসাহী দর্শকদের মনোযোগ কেড়েছে, এমন কয়েকটা নাটকের তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কবির বেশ কয়েকটার মঞ্চসজ্জার পরিকল্পনা করেছেন। ওর এমন পরিকল্পনায় যেমন কল্পনা আছে, তেমনি আছে শ্রম, ভাবনা, ক্রীড়াশৈলী ও ব্যতিক্রম রচনার সচেতন প্রয়াস। ঠিক চমক নয়, আবার যাকে মোটা দাগে নতুনত্ব বলি তা-ও নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক নিরীক্ষার একটা সচল প্রবণতা লক্ষ করা যাবে কবিরের কাজে। এমন সব কাজ করতে গিয়ে নিজে স্বাভাবিকভাবেই প্রণোদিত বোধ করেছেন এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় অহরকণ্ডল নামে একটা ভিন্নভাবন নাটকের নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। এসবই মঞ্চের প্রতি কবিরের নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রতিফলন।

অহরকণ্ডল প্রযোজনার একটা দূরবর্তী ইঙ্গিত অবশ্য আমি শনাক্ত করতে পারি কবিরের এই আলোচ্য প্রদর্শনীর শিরোনামে। তার নির্দেশিত ওই নাটকে এক ধরনের বোধ্যতার সংকট আছে, একথা আমাকে বলেছেন বেশ কয়েকজন নাট্যজন। এই প্রদর্শনীর যে শীর্ষনাম তা আবার অমনভাবেই দর্শকদের জন্য গ্রহণযোগ্যতার সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কবিরের এই প্রদর্শনীর নামকরণ কিছু প্রশ্ন উৎপাদন করতে পারে দর্শকদের মনে। তিনি ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষার শব্দসংযোজনে নাম নির্বাচন করেছেন। অনুমান করি ইংরেজি ভাষ্যের প্রতি তার দুর্বলতা বেশি, কারণ, প্রদর্শনী উপলক্ষে যে দৃষ্টিনন্দন মোটা বোর্ডে ছাপা ব্যয়বিলাসী স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছে তার প্রচ্ছদ ইংরেজি শীর্ষনাম Light and Discourse ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে বাংলা ভাষার ঠাঁই জোটে নি। কবির বাংলা নাম দিয়েছেন আলো ও কথাদের মর্ম। Discourse এমন এক intellectually heavyweight শব্দ যে, এর নির্বিকল্প বাংলা প্রতিশব্দ অনুসন্ধান এক কঠিন ও দুর্গম অনুশীলন বলেই বিবেচিত হতে পারে। ‘কথাদের মর্ম’ এই নব্যবিনির্মিত ভাষ্যে discourse-কে আদৌ ধারণ করা যায় কিনা তা নিয়ে তাত্ত্বিকরা প্রবল সংশয় তুলতে পারেন; আবার তার কাজের ধারার মাধ্যমে কবির নিজেকেও এই তাত্ত্বিকতার অংশীদার করে তুলেছেন।

একটা মৌলিক প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দিয়েছে। ৩ থেকে ১২ জুলাই ২০০৬ বেঙ্গল শিল্পালয়ের গ্যালারীতে আমরা যা দেখলাম তা তো একটা প্রদর্শনী, আলোকচিত্রের। আলোকচিত্র মানে হচ্ছে চিত্রীর শ্রম এবং নিজস্ব প্রয়োগনিরপেক্ষ বিশেষ object-এর ক্যামেরাবন্দি রূপায়ণ। এখানে কোন object-টা কোন দিক থেকে তিনি ধরবেন, তার প্রতিভার স্বাক্ষর থাকবে শুধু ওইটুকুতেই। এই কথা কবিরের নিজের নির্দেশিত নাটক অহরকণ্ডল সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। আর তাই যদি হয়, আর আলোকচিত্রী যদি কোনো নির্দিষ্ট theme ধরে তার উপস্থাপন, ক্রমবিকাশ ও বৈচিত্র্যমুখিনতা আলাদাভাবে অথচ সমন্বিত ভাবনার প্রতিফলন হিসেবে তুলে না ধরেন, তাকে কি আমরা discourse বলতে পারবো? বিষয়টাকে বোধহয় আরেকটু জটিল করে তুলেছেন আমাদের দেশের একজন অগ্রগণ্য কলাবোদ্ধা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি তার ভূমিকাবচনে এমন একটা রায় দিয়েছেন যে, মনে হয় কবির মঞ্চের ংঢ়ধপব এর যে ব্যবহার- তার এক মুগ্ধ প্রতিবেদক তদুপরি এর সঙ্গে আলোও গুরুত্বপূর্ণ এবং এই উভয়কে তিনি নাটকের প্রধান বিষয়প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত করে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। ইসলামের অভিমত হল, এই অর্থে তা আমাদের মঞ্চের এক discourse  হয়ে উঠেছে।

কবির এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে কী বক্তব্য পেশ করতে চেয়েছেন, তার কোনো মুদ্রিত রূপ দেখতে পাই না এই স্মরণিকায়। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তার বক্তব্য শুনেছিলাম। এমন অনুষ্ঠানে যেমন হয়, তেমনই, খুশি, অভিভূতি, নিজের শ্রমের ও সখের সপক্ষে কিছু কথা এবং এর বর্তমান স্বীকৃতির জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ইত্যাদির প্রকাশ। অন্য একটা ভাবনার কথা তিনি বলেছিলেন, সে প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করবো। কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কবিরের কাজের পর্যালোচনায় আলোকচিত্রীর সপক্ষে যা দাবি করে বসলেন, তা প্রদর্শনীর ভেতর থেকে গভীর মনোযোগে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি আমি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাপ্য গুণকীর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের ভূমিকাবচন মূলত স্তুতিবাচক হয়ে থাকে। কিন্তু গ্যালারীতে প্রদর্শিত ছবির ধরণ ও ধারা বিশ্লেষণে আমি এই কাজকে `indeed a discourse on our stage’ বলতে সম্মত হবো না। ইসলামের কথা মানলে আমাদের stage-এ theatre এবং craft অত্যন্ত সীমিত ও সংকীর্ণ এবং নেহাতই একবিংশ শতকীয় মনে হবে। আমাদের মঞ্চ-প্রযোজনার কালানুক্রমিক ইতিহাস অথবা আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বা নির্দেশকের নিজস্ব দর্শন বা দায়বদ্ধতা কিংবা জনরুচি নির্মাণ ও বিকাশের কোনো ধারাবাহিতা চিহ্নিতকরণ বা আমাদের নাট্যসাহিত্য ও মঞ্চায়নের প্রধান প্রবণতার প্রতি কোনো সুপরিকল্পিত, যুক্তিপরম্পরানির্ভর বা বিশ্লেষণবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আমরা এই প্রদর্শনী থেকে শনাক্ত করতে পারি বলে আমার মনে হয় নি। Discourse হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে এখানেই আমার আপত্তি।

নবনির্মিত শব্দচয়ন ‘কথাদের মর্ম’ দ্বারা আমরা যদি তাকে discourse কেন, ওই ইংরেজি শব্দের অর্থব্যাপকতা গণ্য করে তার সমাত্মীয় করে তোলার চেষ্টা করি, তাতেও ওই শব্দযুগলের মর্ম  আলাদা করে ব্যাখ্যা করে বলে দিতে হবে। কথা’র বহুবাচনিক রূপ দেবার জন্য প্রচলিত ‘দের’ ব্যবহার বেশ চমকপ্রজ, মনে হয় কিছুটা djuce অভিধানের প্রভাববলয়যুক্ত। ইংরেজি শব্দ light বা তার অকাট্য বাংলা প্রতিশব্দ ‘আলো’ কবির যে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করেছেন, তা বুঝতেও কষ্ট হয়। মনে হতে পারে, এটা তার ক্যামেরার কাজের জন্য অর্থাৎ আলোকচিত্রের নৈপুণ্য ও অর্থবহতা সৃষ্টির জন্য যে আলোর ব্যবহার করেছেন, ইঙ্গিতটা সেদিকে। আবার সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ভূমিকাবচন পড়ে মনে হতে পারে, ক্যামেরায় যেসব নাট্যমুহূর্ত ধারণ করা হয়েছে, ইঙ্গিতটা সেই প্রাথমিক বিষয়ের দিকে। এটা মেনে নেবার ক্ষেত্রেও আবার মনে দ্বিধা তৈরি হয় এই জন্যে যে, প্রদর্শনীর অধিকাংশ ছবিতে নাট্যপ্রযোজনার জন্য পরিকল্পিত আলোকসম্পাতের প্রতি আলাদা বা সবিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়েছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বাংলা ‘কথাদের’ কথাটাও স্পষ্ট করে বোধের সীমানায় ধরা দেয় না। 

প্রদর্শনীর শীর্ষনাম নিয়ে এই বুদ্ধিজৈবিক বিতর্ক আপাতত শিকেয় তুলে রাখি। আমরা বরং এই স্বতন্ত্র মেজাজের প্রদর্শনীটাই ঘুরেফিরে দেখি, বিবেচনা করি। খুবই চমৎকার সব ছবি আছে। আমার নিজের দেখা অনেকগুলো প্রযোজনা ফিরে দেখলাম। ওই বিশেষ নাট্যমুহূর্তের দৃষ্টিরোমন্থন করতে গিয়ে কবিরের আলাদাভাবে নির্বাচনের হেতুটা আবিষ্কার করতে পেরেছি। বেশ ভালো লেগেছে। বুঝতে পারি, প্রদর্শনীর জন্য ছবি বাছতে গিয়ে কবিরকে হিমসিম খেতে হয়েছে। কোনটা রাখবো আর কোনটা ছাড়বো এবং বেঙ্গল গ্যালারির দেয়ালের space কতটা পাওয়া যাবে এবং তারও নান্দনিক ব্যবস্থাপনাটা কীভাবে করা যাবে, এধরনের সমস্যায় তাকে পড়তে হয়েছে। এখানেও আমি অনেক চেষ্টা করেও সন্তুষ্ট হতে পারি নি। বুঝতে পারলাম না, ছবিগুলোর এই প্রদর্শনীসম্পৃক্ত বিন্যাস কোন দৃষ্টিভঙ্গি অথবা দুর্বলতার ভিত্তিতে রচিত হল। ‘আলো’-র ওপর যে জোর দেয়া হয়েছে তার অর্থদ্যোতনা বা পরম্পরা খুঁজলাম বিন্যাসে, যুক্তির স্থিতি পেতে পারে এমন আধুনিক বিন্যাস খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছি। Discourse-এর গতিবিধি অক্টোপাসের মতোও হতে পারে, তাতেও কোনো তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রয়াস শনাক্ত করতে পারি নি। কালানুক্রম, বিষয় বিবেচনা, ধারা, প্রাতিষ্ঠানিক বা দলভিত্তিক প্রযোজনার ইতিবৃত্ত কোনোভাবেই বিন্যাসের একটা যুক্তিভিত্তিক কাঠামো আলাদাভাবে তৈরি করতে পারি নি। হতে পারে এ-ও আমার নিজের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু কবিরের এই প্রদর্শনীর একটা স্বাতন্ত্র্য আছে যা নিশ্চয়ই অনাকাঙ্খিত। অনেক সময়ই দেখা যায় এবং অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই তা ঘটে যে, প্রদর্শনীতে অনেক ছবি আছে, কিন্তু স্মরণিকায় সেই সবগুলোর প্রতিচিত্র অর্ন্তভুক্ত করা যায় নি। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্মরণিকায় যে ছবির অর্ন্তভুক্তি আছে, প্রদর্শনীতে তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন স্বাতন্ত্র্যকে নিশ্চয়ই ইতিবাচক বলে গণ্য করা যাবে না।

সত্যি বলতে কী, যখন থেকে কবিরের এই প্রদর্শনীর কথা শুনেছি, তখন থেকেই মনে প্রত্যাশা জমছিল। তা আমাদের এই পোড়া দেশে অন্যরা সদাহতাশ করলেও নাট্যকর্মী বন্ধুজনরা সাধারণত আমাদের আশ্বস্ত করে থাকেন, তা সবটা না হলেও অনেকটা। কবির আমাকে এবং আমার মতো অনেককে অনেকটা হতাশ করেছেন। বলছি, দশ বছর ধরে নাট্যমুহূর্ত ধরার জন্য ক্যামেরার লেন্সে চোখ পেতে আছি অথচ এই প্রদর্শনীতে দশ বছরের ছবি নেই। ১৯৯৯ সালের একটি ছবি, ২০০৩ সালের একটি ছবি, বাদবাকি সব ছবিই এরও পরে তোলা। কবির নিজে নাট্য বিষয়ে অভিজ্ঞজন, তাই ছবিতে আমি যাতে স্বতন্ত্রভাবে বুঝতে পারি এটা নাটক, এটা নির্বাচিত প্রেক্ষাপটে কারো portrait নয়, celluloid-এ যেমনটি দেখা যায় তা থেকে ভিন্ন, সেই স্বাদটা অধিকাংশ ছবিতে পাওয়া যায় নি। যে light নিয়ে এত কথা, তার প্রতিফলনে আমাদের মঞ্চনাটকে অনেক সময় যে মুন্সিয়ানা দেখেছি, তা মন ভরে খুঁজে পেলাম না।

বিষয়টাকে discourse হিসেবে পরিগণ্য করার জন্য অন্তত তো দরকার ছিল আরো detail অর্থাৎ প্রথম মঞ্চায়ন কবে, কাহিনীর কোনো পূর্বসূত্র ছিল কিনা, নাট্য বিষয়ের ঝোঁক কোন দিকে, কত সংখ্যক প্রদর্শনী হয়েছে ইত্যাদি একটু বলে দেবার দরকার ছিল। আমরা কি এই discourse-এর মাধ্যমে আমাদের মঞ্চনাটকের বিবর্তনটা ধরতে চাইব? অনেকেরই তেমন প্রত্যাশা ছিল, কথা বলে বুঝেছি। ধরে নিলাম, নানান রাজনৈতিক ও আর্ন্তজাতিক কারণে এখন আর আমাদের মঞ্চে Brecht তেমন অভিনীত হয় না। কিন্তু ঠিক এখনও তো Brecht প্রযোজনা চলছে। চলছে Moliere। এই ফরাসী নাট্যকারের লোক নাট্যদল প্রযোজনা কঞ্জুস প্রদর্শনীর সংখ্যায় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আর ক’দিনের মধ্যে তা অর্ধসহস্র প্রদর্শনীতে পা দেবে। Brecht বা Moliere এর কোনো প্রযোজনার ছবি নেই। Shakespeare-এর কোনো নাট্যমঞ্চায়নের ছবি নেই, দশ বছরটা কি এভাবে ধরা যায়? কিন্তু কিছুদিন আগেও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ ম্যাকবেথ প্রযোজনাটির একাধিক প্রদর্শনী করলো। বা এখনও তো এই মহান নাট্যকারের রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট ভেঙে এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট নাম দিয়ে বরিশালের ‘শব্দাবলি’ একটা প্রযোজনা করছে এবং তার মঞ্চায়ন ঢাকার মঞ্চেও দেখা গেল। এর একটা ছবি থাকলে ঢাকার বাইরের নাটকের ভুবনটাকে তো আর একটু স্পর্শ করা যেত। এই প্রদর্শনীতে আরো নেই রবীন্দ্রনাথ। স্ত্রীর পত্র’র একটি ছবি আছে যা দিয়ে রবীন্দ্রনাটকের প্রতিনিধিত্ব বোঝানো যায় না। তিনি কেন নির্বাসিত হলেন বোঝা গেল না। অথচ অনেকগুলো রবীন্দ্রনাথ এখন মঞ্চে। আমাদের একটি প্রধান দল নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের প্রযোজনা রক্তকরবী চলছে। এমন একটা বড় মাপের নাটক, তদুপরি এই নাটকের মঞ্চসজ্জায় যে ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছে, তার আলোকচিত্র অর্ন্তভুক্ত না হওয়ায় কবিরের নির্বাচনে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ উঠতে পারে। শুধু set design খুঁজতে গিয়েও আমি কবিরের ঝোঁকটা বুঝে উঠতে পারি নি। বনপাংশুল, হাত হদাই, নুরলদীনের সারাজীবন, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, মুনতাসির ফ্যান্টাসী, ক্রুসিবল, এ ম্যান ফর অল সিজনস সহ অনেক অসাধারণ প্রযোজনার কোনো ছবি নেই। যদিও মনে হতে পারে এগুলো অনেক আগের প্রযোজনা, কিন্তু গত কয়েক বছরে অনেকগুলো আবার নবনির্মিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে বহুবার পুনপ্রদর্শিতও হয়েছে। এছাড়াও মাত্র কিছুদিন আগে শততম প্রদর্শনী করা গোলাপজান প্রযোজনার ছবিও নেই, যে প্রযোজনাটি যেকোনো দিক থেকেই ঢাকার মঞ্চের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার একটি বলে দাবি করতে পারে। যদিও শুনেছি, প্রদর্শনীর মাঝপথে গোলাপজান-এর একটি ছবিকে স্থান দেয়া হয়েছিল, তবে তার জন্য ঢাকার এবং ঐ নাট্যদলেরই আরেকটি দর্শক নন্দিত নাটক কোর্ট মার্শাল-এর ছবিটিকে সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল। সবকিছু মিলে কেমন যেন এলোমেলো ভাবনা-চিন্তা থেকে কবির নিজেকে মুক্ত করতে পারে নি।

আমাদের নাটকের discourse পাঠ করতে গিয়ে আমরা খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পীদের ছবি খুঁজবো স্বাভাবিক কারণেই। ফেরদৌসী মজুমদার আছেন, মামুনুর রশীদ, শিমূল ইউসুফ আছেন, কিন্তু আলী যাকের, আবদুল্লাহ আল-মামুন, আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, আবুল হায়াত, লাকী ইনাম, ইনামুল হক, জামালউদ্দিন হোসেন নেই। সৈয়দ শামসুল হকের মত প্রধান নাট্যকারের কোনো নাটকের ছবি নেই। লোকনাট্যের বিষয় অর্ন্তভুক্ত করেছেন কবির, খুবই ভালো। মুস্তাফা মনোয়ার প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন। ভাবতে অবাক লাগে না যে, পুতুল নাচের কোনো ছবি নেই, শিশুনাট্যের কোনো ছবি নেই, তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম নেই। Discourse যখন তিনি রচনা করবেন, কেন আমাদের যতটুকুই থাকুক, সেই মূকাভিনয়ের ছবি নেই কেন? নাচ বা নৃত্যনাট্যকে কি কবির নাটকের বিষয় বলে বিবেচনা করেন না? মিনু হক, তামান্না, শিবলী, শর্মিলা-এরা যে নৃত্যনাট্যের জন্য এত কাজ করে যাচ্ছেন, তার স্বৃীকৃতি জুটবে না? নাচের কথাতেই মনে হল, কবিরের প্রদর্শনীতে রাঢ়াঙ বা কালসন্ধ্যার choreography-র ছবি থাকলেও এই দিকটায়ও মনোযোগের কিছুটা ঘাটতি আছে। গত প্রায় দু’দশক ধরে আমাদের দেশের পথনাটক আলাদা একটা ধারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এমন কি বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ নামে আলাদা সংস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই প্রদর্শনীতে পথনাটককে স্পষ্টতই উপেক্ষা করা হয়েছে।

প্রদর্শনীতে দেখা গেছে, কোনো কোনো প্রযোজনার অনেকগুলো ছবি আছে। যেমন-মধ্যম ব্যায়োগ, বেহুলার ভাসান, মনসামঙ্গল, মিমাংচিনা, বিনোদিনী, মুক্তি। এখানেও কবিরের নির্বাচনের বা পক্ষপাতের কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।

আলোচনার প্রথম দিকে বলেছিলাম, প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় কবিরের একটা মন্তব্য বিষয়ে আমার প্রতিক্রিয়া জানাব। কবির একটা কথা, তার বিচারে এটাই হয়ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, বলেছিলেন যে, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যবিষয়ে আলাদা আনুষ্ঠানিক পাঠদানের ব্যবস্থা আছে, সেখানে Theatre Photography নামে একটি বিশেষ কোর্স প্রচলন করা উচিত। আমার ঠিক জানা নেই দিল্লীর National School of Drama (NSD) অথবা লন্ডনের Royel Academy of Dramatic Arts (RADA)-এ এমন কোনো আলাদা কোর্স আছে কি না। কিন্তু Photography একটি বিশেষায়িত এলাকা তা মানতেই হবে। এ বিষয়ে অনুশীলন ও যথাযথ জ্ঞান লাভ করার পর কেউ প্রকৃতি, কেউ সমাজবস্তবতা, কেউ দারিদ্র্য, কেউ গতিময়তার ছবি তোলেন, এবং তার মধ্য দিয়ে তার নিজের ঝোঁকের বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত করেন। যিনি নাটকের ভালো ছবি তুলতে চাইবেন, তার দরকার নাটকের প্রতি ভালোবাসা বা নিত্যদুর্বলতা, যেমনটি কবিরের ক্ষেত্রে পাই। তিনি আলোকচিত্র গ্রহণের পাঠটা গভীরভাবে গ্রহণ করলেই নিজের নাট্যবোধের মণিকাঞ্চন যোগে Theatre Photography-র এলাকায় অবদান রাখতে পারবেন। আলাদা কোর্স প্রণয়ন আমাদের নাট্যচর্চাকে এগিয়ে দেবে বলে মনে হয় না।

প্রদর্শনী, কবিরের ছবি ধারণ ও নির্বাচন ও সীমাবদ্ধতা এবং চিন্তা ও পরিকল্পনাগত শৈথিল্য সম্পর্কে ওপরে যা বললাম, তা একান্তই প্রত্যাশার অবলোপতাড়িত, কিন্তু নিঃসন্দেহে এই সব মন্তব্য ভালোবাসাপ্রসূত, বিদ্বষজাত নয়। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের একজন ঘরের মানুষ (insider) হিসেবে কষ্টের কথাটা বললাম। আশা করি, কবির নিজে কিছুটা কষ্ট পেলেও বুঝবে এসব বলে ওকে আসলে বাড়তি উৎসাহের যোগান দিতেই চাইছি আমি।

শফি আহমেদ : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়