Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

আলো ও কথাদের নাট্য-দৃশ্যকল্প : কবিরের ডিসকোর্স-মর্ম

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

ক্যামেরা মিথ্যে বলে না- এরকম একটা কথা একসময় বলা হতো। সে কতকাল আগের কথা। আজ আর সেসব বলে না কেউ। গ্রাফিকস প্রযুক্তির যুগে কী না করা যায় ক্যামেরা দিয়ে। দিনকে রাত, তিলকে তাল। যুদ্ধ-প্রচারেও তার অমোঘ ব্যবহার আজ। আবার এর বিপরীত ঘটনাও আছে। একেক ক্যামেরা তুলে ধরে এমন সব ছবি, উদঘাটন করে ঘটনা-সত্যের বিশ্বরূপ-বিরূপ-কুরূপ দৃশ্যাবলী। ক্যামেরা আজ সৃজন-নন্দনের বহুরূপকলা একটি ফ্রেমের স্থিরচিত্রে বাক্সময় করে তোলে। তাতে হাইকু-প্রতিম সামর্থ্যে রূপায়িত হয় কত স্তর-মাত্রাসম্পন্ন দৃশ্য-বাচন।

নাট্যের বিবিধ বিচিত্র চলচ্ছবির একটি মাত্র স্থিরচিত্রকল্প সমগ্রের নিহিত মর্ম উদভাসিত করতে পারে ক্যামেরা। ফ্রেমের নির্বাচন-যাথার্থ্যে এহেন নন্দন সম্ভব হয়। আমরা তো জানি, দর্শকের দর্শন মননে নাট্যের একটি দুটি দৃশ্যকল্প সমগ্রতার এক স্মৃতিচিত্র প্রাপ্ত হয়। একটি কোনো নাট্যের অভিজ্ঞান হয়ে ওঠে সেমতো একেক দৃশ্যকল্প। নাট্যনন্দনের অর্জন এভাবে তার মনে চিরজাগরূক থাকে। কেবলি দৃশ্যের জন্ম হওয়া এই জগৎ সংসার আমাদের কাছে তো নির্বাচিত চিত্রকল্পেই ধরা দেয়। নানা মানে-অনুভবের প্রতিমা তৈরি করে। নাট্যের নির্দেশক চান এমত নানা দৃশ্য-ছবির মুহূর্ত সৃজন করতে। যাতে একেক দর্শক তার মতো করে সঞ্চয় করে নিতে পারে একান্ত অভিভবকল্প। নাট্যের ভাষা সম্ভব করে তোলে এমত নানা দৃশ্যের মুহূর্ত-ছবির রূপায়ণ। আলোকচিত্র তাইতো কেবলমাত্র মনোহর চিত্র মাত্র নয়, সেটি চিত্রীর এক বিশেষ অবলোকন, নির্বাচন। তাতে নাট্যটি সম্পর্কে তার বিচার-বিবেচনার এক দৃশ্যচিত্রগত ব্যাখ্যান পাই। কোন দৃশ্যকল্পটি তিনি ফ্রেমে গেঁথে তুললেন তাই দিয়ে নাট্যটি বিষয়ে তার দর্শনবোধটি আমরা পাই।

Light and Discourse, আলো ও কথাদের মর্ম- শিরোনামে নাট্য-আলোকচিত্রের এক প্রদর্শনী হলো বেঙ্গল গ্যালারীতে। আলোকচিত্রী কামালউদ্দিন কবির। দশ বছর আগে ভেবেছিলেন তিনি, মঞ্চে যেসব নাট্যমুহূর্তগুলো তৈরি হচ্ছে তা ধরে রাখা দরকার। একসময় দেখেন অনেক জমেছে। অনুভব করেন, যারা নতুন এসেছে এবং আসতে চাইছে তাদেরকে  এগুলো দেখানো দরকার। তার আশা, এই আলোকচিত্রগুলো ধারণা দেবে বর্তমান সময়কার নাট্যচর্চার রকম সম্পর্কে এবং আগামী দিনের মানুষ এ থেকে অনেক চিন্তা পাবে।

আলোকচিত্রে মঞ্চের নাট্যমুহূর্তগুলো ধরে রাখা হয়। অর্থাৎ নাট্যের নির্বাচিত সবিশেষ মুহূর্তগুলো ফ্রেমে স্থির করা। আলোকচিত্রী এই প্রদর্শনীতে ‘যারা নতুন এসেছে এবং আসতে চাইছে তাদেরকে’ দেখাতে চেয়েছেন মঞ্চমুহূর্তসকল যাতে বর্তমান সময়কার নাট্যচর্চার রকম দেখা যাবে। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ১৯৯৯ ও ২০০৩ সালের একটি করে ছবি, বাকি সব তারপরেকার। ‘যারা নতুন এসেছেন এবং আসতে চাইছেন’ তাদেরকে এই সময়কালে নতুন নাট্যের তৈরি হওয়া মুহূর্তগুলো দেখাতে চেয়েছেন তিনি। তার আগেরগুলো নয় কেন? এ সময়েরগুলো তো তারা দেখছেনই। আগের ছবি নেই বলে কি? থাকলে সেগুলোই তো আগে দেখানো দরকার নতুনদের, যার বেশিরভাগ তারা দেখে নি। প্রদর্শনীতে ২-৩ বছরে নতুন এসেছেন এমন নির্দেশক-কৃত নাট্য-দৃশ্যছবি পাচ্ছি- আমিনুর রহমান মুকুল, ত্রপা মজুমদার, দেবাশিষ ঘোষ, অনন্ত হিরা, নূনা আফরোজ। একই সময়ে এর বাইরে থেকে গেল কতজন নবীন নির্দেশকের নতুন নাট্যমুহূর্তগুলো। নির্বাচন তাহলে কোন হিসেবে হলো? কেবল কি আলোকচিত্রের মান, নাট্যরুচি- নাকি যেগুলো তোলা হয়েছে কেবল তার ছবি দিয়ে? নাট্যমুহূর্ত তো সমগ্র নাট্য, তার মানের বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে হতে পারে না।  যদি তেমন  বিচ্ছিন্ন কিছু হয়ও যা চিত্রী বিশেষ কৃতিত্বে তেমন বিশেষ করে তুলেছেন ছবি, তাকে কি মঞ্চের বিশিষ্ট মুহূর্ত বলা যাবে? নাট্যের সমগ্রতায় অঙ্গাঙ্গী না হয়েও তার কি সেই মূল্য থাকবে? এটা আলাদা করে উল্লেখ করা যেতে পারে বড়জোর- সেইটুকু তার প্রাপ্য। আমরা নিশ্চয় নাট্যমানের সামগ্রিকতায় মুহূর্তটির মূল্য পরিমাপ করবো- কোনো বিচ্ছিন্ন আকস্মিকতা তো প্রামাণ্যের মর্যাদা পেতে পারে না। পারে কি? এছাড়া গত বছর দুয়েকে জেলাশহরের সেরা প্রযোজনাগুলোকে ঢাকার মঞ্চে প্রদর্শন করার সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, সেগুলোও আমরা অনেকে দেখেছি। তাতেও ছিল কত বাক্সময় নাট্যমুহূর্তাবলী। এগুলো থেকে তিনটি মাত্র ছবি আছে এ প্রদর্শনীতে। চট্টগ্রাম বিটা প্রযোজিত পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশিত মীনকন্যা, আহমেদ ইকবাল হায়দার নির্দেশিত, তীর্যক প্রযোজিত মধুমালা আর যশোর বিবর্তন প্রযোজিত ও ফয়েজ জহির নির্দেশিত নাটক কৈবর্তগাথা-র ১টি করে ছবি আছে। গত ২-৩ বছরে ঢাকার প্রবীণ নির্দেশকদের ছবিই সংখ্যায় বেশি প্রদর্শিত। তাতে অবশ্য বাদ গেছে আলী যাকের নির্দেশিত পুনর্নির্মিত নূরলদীনের সারাজীবন ও কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, আতাউর রহমান নির্দেশিত রক্তকরবী, নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত বনপাংশুল, হাতহদাই ও পুনর্নির্মিত মুনতাসির ফ্যান্টাসী-র ছবি। গত কয়েক বছরের ভালো ভালো আরো অনেক নাটকের ছবিও নেই- ক্রুসিবল, এ ম্যান ফর অল সিজনস, কইন্যা, আরজ চরিতামৃত, গোলাপজান এসব নাটকের নাম তো উল্লেখ করাই যায়। আমাদের মঞ্চের বিশিষ্ট প্রযোজনা কোর্ট মার্শাল-এর যে ছবিটি দেয়া হযেছে তাতে কি এমন একটি মুহূর্তদৃশ্য চোখে ভাসে যাতে কিনা বিষয়ের অন্তঃস্থ পরিচয় মেলে? অবশ্য শুনেছি, পরে নাকি গোলাপজান-এর একটি ছবিকে ঠাঁই দিয়ে কোর্ট মার্শাল-এর ছবিটিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এমন নাকি আরেকটিও হয়েছে- উদ্বোধনী দিনে ঋষি কাব্য নাটকের একটি ছবি থাকলেও পরে তার বদলে অন্য দলের অন্য নাটকের একটি ছবি দেয়া হয়েছে। এটা কোন নান্দনিক বিচারবুদ্ধির কাজ হলো বোঝা গেল না। সদ্য মঞ্চে রূপায়িত নবীন নির্দেশক মোহাম্মদ বারীর নানা বিশিষ্ট মুহূর্ত-সম্পন্ন সময়ের প্রয়োজনে-এর কোনো ছবি নেই। আগামী দিনের মানুষের অনেক চিন্তা পেতে এ নাট্যদৃশ্য আবশ্যক ছিল নাকি? অথচ অনেক ছবি আছে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের পরীক্ষা-প্রদর্শনী নাট্যের। প্রদর্শনীর ক’দিন আগে মঞ্চস্থ থিয়েটার স্কুলের সমাপনী প্রযোজনারও ১টি ছবি আছে। নবীনদের উৎসাহ দিতেই কি? অথচ বছর পাঁচেক ধরে আগত অনেক নবীন নির্দেশকদের কোনো ছবি নেই। এদের মধ্যে- অলোক বসু, সাইদুর রহমান লিপন, তৌফিকুল ইসলাম ইমন-এর নাম তো করাই যায়। এদের সব নাটকের ছবি নিশ্চয়ই তোলা ছিল না। তুললেও বাদ দিতে হয়েছে গ্যালারীতে জায়গা কম বলে। তবে একাধিক ছবি আছে এমন অনেক নাটকের নির্বাচনের পেছনেও নিশ্চিত সঙ্গত কারণ আছে। কিন্তু কী সে কারণ?- নাট্যমান, না কি নাট্যদৃশ্য বা মুহূর্তের বিশিষ্টতা যাতে বর্তমান নাট্যচর্চার রকম সম্পর্কে  আগামী দিনের মানুষ অনেক চিন্তা পাবে? কোনো বিবেচনাসূত্র ঠিক দাঁড়ায় না। নানা বিবেচনার জট পাকিয়ে যায়। অথচ হঠাৎ করে তো এই প্রদর্শনী নয়। বছর দশেকের ভাবনা, বহু বছর ধরে তোলা এবং অন্তত এক বছরের পূর্বনির্ধারিত প্রস্তুতিকাল যাপনের অর্জন এমন বেদিশা লাগবে কেন? তার পরে বলতে হয়, কটা ছবি নাট্যের বিশিষ্ট চারিত্র্যের দৃশ্যকল্প প্রতিম হয়েছে- যেটা ইতোমধ্যে দর্শকের স্মৃতিভাণ্ডারে গ্রথিত হয়েছে বা প্রদর্শনীতে দেখার পর হয়ে উঠবে?

স্বদেশীয় নাট্যকৃত্য মনসার পালা-র কয়েকটি দৃশ্যছবি আছে, দর্শকের অবলোকন-দৃশ্য সহ। কবির শুনেছি এমত দেশীয় নানারীতির অনুষ্ঠান প্রায় নিয়মিত দেখে ফেরেন। তার থেকে একটির মাত্র ছবি কেন তবে প্রদর্শনীতে? ইসলামউদ্দিনের কমলারাণীর সাগরদীঘি তো ঢাকার মঞ্চ থেকে তোলা। তাহলে কী দরকার ছিল কেবল মনসার পালা-র ছবি প্রদর্শনের? যদি না স্বদেশীয় বিবিধ রীতির রকম সম্পর্কে নাগরিকজনদের কোনো ধারণা দেয়া গেল। এটা নামকাওয়াস্তে দায়সারা কাজ হলো না কি?- কোনো ভারসাম্যের সামঞ্জস্য যেখানে থাকলো না। কবিরের কাছ থেকে এমত সৌখিন মজদুরি কাম্য হতে পারে কি?- এমন খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন উপস্থাপনা?- সবটাই কেমন এলোমেলো। তালগোল পাকানো। এমন অসাবধানতা কবিরের অন্তত মানায় না বলে জানতাম।

কামালউদ্দিন কবির তো একজন আলোকচিত্রী মাত্র নন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী,- নাট্যনির্দেশনা, মঞ্চনির্মাণ, গবেষণা-সমালোচনা ও শিক্ষকতায় ধীমান নাট্যজন। বছর দশেক ধরে তোলা নাট্যমুহূর্তগুলো তো তাঁর নাট্যনন্দনের ভাষ্য ব্যাখ্যান, বিশ্লেষণ অবলোকনের গবেষণা-দর্শন বাচন। তাই বুঝি এ প্রদর্শনী এমন ডায়লগে উদ্বেজিত করলো। আলো ও কথাদের মর্ম- Light and Discourse-এ কেবলি যে দৃশ্যের জন্ম হয়- তার বাচন, পুনর্বাচন, নির্বাচন নিয়ে এত কথা উঠলো।

বহু নাট্যজনের স্মৃতি মনন-নন্দনে এমত নানা অভিভাবের চেতাবনী সঞ্চার করেছে শুনেছি। আমরা চাইবো অন্যদের সঙ্গে সঙ্গে কবিরও লিখে তার বিবেচনা-ভাবনা বলেন। প্রদর্শনী দেখে যার তল ঠিক ইয়ত্তা করা গেল না। বহুর দর্শনে মেলেতো সত্যের এক সমগ্রতা, তার আত্মপরিচয়। কোনো সত্যই তো আর একমাত্র বা সম্পূর্ণ নয়। রুচির এক সুস্থ স্বস্থ ডায়লগে উদ্বোধিত হোক আলো ও কথাদের মর্ম- তার ডিসকোর্স।

কবির নিশ্চয় এমত দায়পালনে সমর্থ, অধিকারীজন। আমরা তার কাছে মঞ্চে রূপায়িত নাট্য দৃশ্যকল্পসমূহের এক বিন্যস্ত, সংহত সমগ্রতার আলোচিত্রগত ব্যাখ্যান, বিশ্লেষণের গবেষণ-বাচন চাইবো। তিনি তার উপযুক্তজন বলে বিবেচনা করি।

ড. বিপ্লব বালা : নাট্যজন, শিক্ষক ও সমালোচক