Full premium theme for CMS
অন্য চোখে আলাপন ।। থিয়েটারওয়ালার আলাপন : কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতি
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
থিয়েটারওয়ালার পর পর তিনটে সংখ্যায় বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যজনদের সাক্ষাৎকার পড়ার সুযোগ হলো। অবশ্য প্রচলিত সাক্ষাৎকারের ধরণ থেকে এই আলাপনগুলো বেশ খানিকটা আলাদা, অর্থাৎ আলাপনের সঞ্চালকরা শুধু যন্ত্রের মতো প্রশ্ন করেই ক্ষান্ত হন নি, নিজেরাও নিজেদের মতামত রেখেছেন, আলোচনা করেছেন, তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন, ফলে আলাপনগুলো একতরফা কথাবার্তা বলার দায় থেকে রক্ষা পেয়েছে, হয়ে উঠেছে উপভোগ্য এবং একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণও। গুরুত্বপূর্ণ, কারণ- আলাপনে উপস্থিত নাট্যজনেরা বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে প্রথম প্রজন্মের সদস্য এবং এর আগে আর কখনো এত বিস্তৃতভাবে তাঁদের কথা শোনার সুযোগ আমাদের হয় নি। এসব আলাপন পড়ে একজন পাঠক হিসেবে এবং থিয়েটারের একজন দর্শক হিসেবে আমার মধ্যে কিছু প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে, কিছু নতুন অনুভূতি তৈরি হয়েছে, সেগুলো উত্থাপনের জন্যই এই লেখা।
লিজেন্ডদের ব্যক্তিমানস এবং নাট্যচর্চার স্মৃতি ও ইতিহাস
গত ৩০/৩৫ বছরে মঞ্চনাটক আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠেছে। সেই গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি কেমন ছিলো, সম্পূর্ণ নতুন একটি শিল্পমাধ্যমকে একটি মানসম্মত স্তরে নিয়ে যেতে আমাদের প্রথম প্রজন্মকে কী কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে- এসবেরই স্মৃতি, তথ্য ও ইতিহাস সম্বলিত একটি মনোজ্ঞ বিবরণ পাওয়া গেলো নাট্যজনদের আলাপচারিতায়- যা থেকে এই শিল্পচর্চার বেদনা ও আনন্দের অনেকখানিও অনুভব করা গেলো। কিন্তু আলাপনগুলোর এটাই একমাত্র গুরুত্ব নয়, একইসঙ্গে এগুলোতে উঠে এসেছে আমাদের নাট্যজগতের লিজেন্ড হয়ে ওঠা এই নাট্যজনদের ব্যক্তিজীবনের অনেকখানিও, যা তাঁদের নাট্যভাবনা, নাট্যসংগঠন এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য কর্মকাণ্ড বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। শিল্প এমন কোনো স্বয়ম্ভূ বিষয় নয় যে, সে নিজেই নিজের ইতিহাস নির্মাণ করবে, এর ইতিহাস নির্মাণ করেন শিল্পীরা। হয়তো শিল্পের নিজস্ব কিছু চরিত্র আছে, সে শিল্পীর কাছ থেকে প্রেম দাবি করে, প্রেমিক/প্রেমিকার মতো সময় ও মনোযোগ দাবি করে, না পেলে ধরা দেয় না, কিন্তু সে নিজে তার ইতিহাস লিখতে পারে না, এর জন্য শিল্পীর প্রয়োজন হয়। যে-কোনো শিল্পের ইতিহাস জানতে হলে তাই সংশ্লিষ্ট শিল্পীর ব্যক্তি জীবন-ভাবনা জানাটা জরুরি হয়ে পড়ে। শিল্পীর ব্যক্তিজীবন, বিশেষ করে তাঁর শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য তাঁর পরিণত বয়সের শিল্পচর্চায় গভীরতর ছায়া ফেলে। আলাপনে উপস্থিত নাট্যজনদের ব্যক্তিজীবনের যতটুকু জানা গেছে (খুব সামান্যই, হয়তো থিয়েটার নিয়ে কথাবার্তা বলাটাই মূল উদ্দেশ্য ছিলো বলে ব্যক্তিজীবনে খুব বেশি মনোযোগ দেন নি আলাপনের সঞ্চালকরা, যদিও প্রতিটি আলাপনই শুরু হয়েছে নাট্যজনদের ছোটবেলা সম্বন্ধে প্রশ্ন দিয়ে), সেখানেও এর প্রমাণ মিলবে। এঁরা সবাই কমবেশি নাগরিক পরিবেশে (সৈয়দ হক এবং মামুনুর রশীদ ছাড়া) ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়ে উঠেছেন, তারুণ্যে প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। এই তথ্যগুলো থেকে কি তাঁদের পরবর্তী কর্মকাণ্ডের ওপর এসবের খুঁজে পাওয়া যাবে? যাবে, আমার মনে হয়। সাঈদ আহমদ যে অ্যাবসার্ড নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়বেন, কিংবা নাসির উদ্দিন ইউসুফ যে ‘শুরুতেই এ্যাবসার্ড নাটকের প্রতি দুর্বল হয়ে’ পড়বেন (তাঁর ভাষায় -‘শুরুতেই বিপথগামী হয়ে পড়ি’)- সেটাই স্বাভাবিক, কারণ তাঁদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই নগরে। নাগরিক জীবনে অনেক এ্যাবসার্ড উপাদান থাকে, তা সে নগর যতই ক্ষুদ্র বা তুচ্ছ বা সামান্য হোক। মামুনুর রশীদের কৈশোরে দেখা গ্রাম বা তারুণ্যে মার্কসবাদী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা যে তাঁর পরবর্তী কর্মকাণ্ডে গভীর ছায়া ফেলেছে সেটা তো প্রমাণিত সত্য। আজীবন তিনি রাজনীতিঘেঁষা নাটক লিখেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে নাটককে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এরকম উদাহরণ আরও দেয়া যাবে, কিন্তু তাতে এই লেখার আয়তন আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে বলে সেই চেষ্টা থেকে নিরস্ত থাকা গেলো।
নাট্যচিন্তা
পীড়াদায়ক হলেও সত্যি যে, আমাদের নাট্যজগতের প্রথম প্রজন্মের পুরোধা ব্যক্তিদের এত দীর্ঘ দীর্ঘ আলাপচারিতা পড়েও তাঁদের নাট্যচিন্তা সম্বন্ধে খুব সামান্যই জানার সুযোগ হলো। নাট্যজনদের নাট্যচিন্তাহীনতার এই কারণটি ঠিক বোঝা গেলো না। নাটক সম্বন্ধে কি এঁদের তেমন কোনো মৌলিক ভাবনা নেই, নাকি আলাপনের সঞ্চালকরা সেগুলো তুলে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন? এই ঘটনাটি সম্ভবত অন্যান্য শিল্পমাধ্যম সম্বন্ধে কল্পনাও করা যায় না, অর্থাৎ শিল্পের অন্যান্য শাখা- যেমন সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত বা চলচ্চিত্রের প্রথম সারির শিল্পীদের সঙ্গে এমন একটি আলাপচারিতার আয়োজন করলে সংশ্লিষ্ট শিল্পমাধ্যম সম্বন্ধে তাঁদের পরিষ্কার মতামত এবং মৌলিক চিন্তার পরিচয় পাওয়া যেত। আমাদের যে-কোনো লেখকের সাক্ষাৎকার পড়লেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমনকি এই আলাপনগুলোর মধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আলাপনটি যে মানের দিক থেকে সবচেয়ে উঁচু সেটিও সম্ভবত সবাই স্বীকার করবেন। সৈয়দ হক যেহেতু শুধুমাত্র একজন নাট্যকার নন, বরং সব অর্থেই আমাদের প্রধানতম লেখক, সাহিত্যের সবগুলো শাখায় তাঁর অবাধ ও সাফল্যময় বিচরণ, তাই তাঁর শিল্পচিন্তাও খুব উঁচুমাপের এবং মৌলিক। এই সাক্ষাৎকারে অবশ্য তিনি প্রধানত নাটক নিয়েই কথা বলেছেন এবং সেখানেও তাঁর মৌলিক চিন্তার পরিচয় পাওয়া গেছে। উদাহরণস্বরূপ নাটকের সমকালীনতা প্রসঙ্গে তাঁর মতটি প্রণিধানযোগ্য- নাটকের সাথে স্পোর্টের খুব মিল আছে, সেটা হচ্ছে- গোল দিলে সবাই দেখতে পায়। গোল দিলে কিন্তু সাথে সাথে হাততালি পড়ে, কেউ এক শতাব্দী পরে হাততালি দেয় না। নাটকও কিন্তু যখনকার তখনকার, সেটা সফোক্লিস বলো কিংবা কালিদাসই বলো। আমাকে কিন্তু এখন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বলে, শ্রেষ্ঠ কবি বা গল্পকার বলে না, কারণ এগুলো পঞ্চাশ বছর বা একশ বছর অপেক্ষার পর বলবে, যদি বলতে হয়। আরেকটি প্রসঙ্গে- মঞ্চ এমন একটি জায়গা যেখান থেকে মিথ্যা কথা বলা যায় না। শুধু রাজনৈতিক মিথ্যা না...কিছু জীবন্ত লোক করছে, কিছু জীবন্ত লোকের সামনে- এই জন্য নাটকে মিথ্যা বলা যায় না। আজকে মঞ্চে যত কাঁচা কাজই হোক তার মধ্যে একটা সততা আছে। সেই সততা একেবারে হরতকির মতো... একেবারে খটখটে। সরাসরি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও নাটক ও মঞ্চ সম্বন্ধে তাঁর এরকম মন্তব্যের সমতুল্য মন্তব্য অন্যান্য আলাপনগুলোতে পাওয়া যায় নি। এমনকি নাটকের সাহিত্যমূল্যের বিষয়টি সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্যটিও ভেবে দেখবার মতো- লিখিত রূপটা হচ্ছে বাড়তি পাওয়া। ..এটা চায়ের কাপে পিরিচের মতো...তলাপাত্রটা বড় না, মহাপাত্রই বড় এবং সেটা হচ্ছে কাপ। এই তলাপাত্র হচ্ছে সাহিত্যমূল্য আর মহাপাত্র হচ্ছে থিয়েটার। ...রবীন্দ্রনাথই হোক আর সফোক্লিসই হোক বা কালিদাসের নাটকই হোক, যেটা পড়ছি সেটা সাহিত্য পড়ছি এবং পড়ে তলাপাত্রের প্রশংসা করছি। এগুলোর মহাপাত্রটা হচ্ছে মঞ্চরূপটা। মঞ্চে না আনা পর্যন্ত সেটা আবার নাটক হয় নাকি? আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন সৈয়দ হক এই আলাপনে- পরাধীন জাতির নাটক হয় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথের কথা বলেছেন যে, তাঁকেও স্বাধীনতা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। অন্যগুলো হয়, নাটক হয় না কেন - এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন - এটা জীবন্ত, নাটক মানে মঞ্চ। নাটক লেখাটাও নাটক নয়, মহড়াও নাটক নয়- এটা দর্শকের চোখের সামনে হতে হয়। কিন্তু আমরা এ সম্বন্ধে আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা আশা করেছিলাম, তাঁর দেয়া উত্তরটিকে যথেষ্ট বলে মনে হয় নি আমার, সঞ্চালকরাও এ নিয়ে আর কথা বাড়াননি, ফলে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
এই আলাপনটির নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রথম আমরা ‘নাট্যকার’ সৈয়দ হকের নাটক রচনার প্রেক্ষিত, এর সঙ্গে তাঁর জড়িয়ে পড়ার স্মৃতি, নাটক সম্বন্ধে তাঁর চিন্তা এবং বাংলাদেশের নাট্যকার ও নাটক সম্বন্ধে তাঁর মূল্যায়ন জানতে পারলাম। (এবং এইখানটায় এসে আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন নতুন সৈয়দ হকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। আমি নিজেও তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি, সেটি অবশ্য ৭/৮ বছর আগের কথা, দেখেছি তিনি অন্যদের মূল্যায়ন করার ব্যাপারে খুব কুণ্ঠিত, পারতপক্ষে কারো সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করতে চান না। কিন্তু এই আলাপনে তিনি অকুণ্ঠভাবে অন্য নাট্যকারদের সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন, সমালোচনা করেছেন, খারিজও করেছেন। তবে কি ‘নাট্যকার’ সৈয়দ হক সাহিত্যের চেয়ে নাট্যজগত নিয়ে কথা বলতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?)
অন্যদিকে সাঈদ আহমদ আমাদের নাট্যজগতে বিশাল মাপের মানুষ- প্রায় সারাটি জীবন নাটক নিয়ে কাটিয়ে দিলেন, তাঁর কাছে আমাদের ঋণও অনেক, বিশেষ করে বিশ্বনাটকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার ব্যাপারে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা আমাদেরকে আরও বহুকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে- অনেক স্মৃতিচারণ করলেন তিনি, ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের এখানে কি-রকম নাট্যচর্চা হতো তার মনোজ্ঞ বিবরণও পাওয়া গেলো, আগেই বলেছি এসব স্মৃতি ও ইতিহাসের একটি আলাদা মূল্য আছে, কিন্তু এত বড় মাপের একজন নাট্যজনের কাছ থেকে নাটক নিয়ে মৌলিক একটি চিন্তা পাওয়ার প্রত্যাশা ছিলো, সেটা পূরণ হলো না। যে দু-একটি কথা দ্যুতি ছড়িয়েছে সেগুলোর উদাহরণ হিসেবে এ্যাবসার্ড নাটকে জড়িয়ে পড়া সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য- আমি মিউজিক ভালো বুঝতাম। মিউজিক ইজ ভেরি ইমপর্টেন্ট ফর এ্যাবসার্ড নাটক। মিউজিক সংঞ্জাহীন, মিউজিক কেন দাগ কাটে এটা কেউ বলতে পারবে না। ঠিক তেমনি মিউজিক বোঝার কারণেই আমি এ্যাবসার্ড ফর্মটাকে বেছে নিয়েছিলাম। মিউজিক যেমন কাটা কাটা, এ্যাবসার্ড নাটকের সংলাপও হয় কাটা কাটা। অর্থাৎ তিনি এ্যাবসার্ড নাটকের ফর্মের মধ্যে মিউজিকের বিমূর্ত রূপটি খুঁজে পেয়েছিলেন, এবং মিউজিকের প্রতি তাঁর আশৈশব প্রেমই যে তাঁকে এ পথে টেনে এনেছে সেটাও তাঁর কথা থেকেই বোঝা যায়। এবং বোঝা যায় এ-ও যে, মিউজিক যেমন কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই মানুষকে আকর্ষণ করে, নাড়া দেয়, তিনিও চেয়েছেন এমন একটি ফর্ম যেটি কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য বা বোধগম্য কারণ ছাড়াই মানুষের কাছে পৌঁছবে। নাটকের এ্যাবসার্ড ফর্মটির সঙ্গে মিউজিকের সাযুস্য খুঁজে পাওয়ার এই বিষয়টি অবশ্যই নতুন এবং মৌলিক চিন্তার পরিচয় বহন করে। আবার মুনীর চৌধুরী ও নূরুল মোমেনের আর নাটক না লেখা প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য- আসলে সাসটেইন এ্যাফোর্ট থাকতে হয়। এই মন্তব্যটি অন্যসব শিল্পমাধ্যমের জন্যও প্রযোজ্য। শুধু শিল্পমাধ্যম বলি কেন, জীবনের যে-কোনো বিষয়ের জন্যই প্রযোজ্য- ওই ‘সাসটেইন এ্যাফোর্ট’ না থাকলে কারো পক্ষেই কিছু করা সম্ভব হয় না, বহু প্রতিভাবান মানুষ চোখের আড়ালে চলে যান বা অকাল মৃত্যু ঘটে ওটা না থাকার ফলেই। এটি শুধু নাটক নয়, জীবন সম্বন্ধে তাঁর দার্শনিক উপলব্ধির ফল। এরকম আরেকটি মন্তব্য (একটি প্রশ্নের প্রেক্ষিতে)- আমাদের দেশের পেইন্টাররা নাটকের সাথে যায়নি। কেউই কারো সাথে যায় না, একা একা সব করতে চায়। আসলে এই আদান প্রদানের জন্য এক ধরনের মানসিক sophistication প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে ওসব sophistication নেই।- এটি আমাদের শিল্পসাহিত্যের মানুষজন সম্বন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। কিন্তু ৩২ পৃষ্ঠার এই আলাপনে দ্যুতি ছড়ানো এই দু-তিনটি মন্তব্য ছাড়া আর এমন কী-ই বা আছে যা পরবর্তীকালের নাট্যকর্মীদের বা নাটক-প্রিয় পাঠক-দর্শকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে? বরং দু-একটি সুইপিং কমেন্ট তাঁকে একটু খাটোই করবে। যেমন- আমাদের দেশে আর কেউ এ্যাবসার্ড নাটক লিখলো না কেন - এরকম একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন- নাট্যকার কোথায়? ঘুরে ফিরে এক সৈয়দ শামসুল হক, এক সেলিম আল দীন, এক মামুনুর রশীদ দিয়ে কি দেশ চলে? নাট্যকার থাকতে হয় ভুরি ভুরি। নাট্যকারে গিজগিজ করলে তো বিভিন্ন ধরনের নাটক আসবে।- সাঈদ আহমদ আমাদের সবার চেয়ে বেশি জানেন মেনে নিয়েই একটি প্রশ্ন তাঁকে বিনয়ের সঙ্গেই করা যায়- পৃথিবীর কোন দেশে কোন সময়ে ভুরি ভুরি নাট্যকার ছিলো? নাট্যকারে গিজগিজ করতো বা করছে এমন একটি দেশের নামও কি বলা যাবে? যাবে না। তাই বলে কি বিভিন্ন ধরনের নাটক লেখা হয় নি?
এইসব জায়গায় এসে সঞ্চালকদের অতি বিনয়ী হওয়াটা ভালো লাগে নি, প্রশ্নগুলো তাঁকে করা যেতো।
নাট্যচিন্তা বা শিল্পচিন্তার অভাববোধ অন্যান্য আলাপনগুলোর ক্ষেত্রেও কমবেশি তৈরি হয়েছে। যেমন ওই একই সংখ্যায় রামেন্দু মজুমদারের কাছ থেকে বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ইতিহাস সম্বন্ধে যথারীতি জানা গেলো, জানা গেলো তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অনেককিছু, কিন্তু ৩৭ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ আলাপনে মাত্র একটি বাক্যে তিনি থিয়েটার সম্বন্ধে অস্পষ্টভাবে নিজের ধারণা ব্যক্ত করেছেন। বিভিন্ন নাট্যদলের নাটকের ধরণ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে পদাতিকের নাটক সম্বন্ধে তিনি বললেন - সোলায়মানের নাটক মানে গান-সমৃদ্ধ নাটক, সে কারণে এই নাটকগুলো প্রকৃত অর্থেই ‘থিয়েটার’ হতো। অর্থাৎ, তাঁর মতে- প্রকৃত থিয়েটার মানে গান-সমৃদ্ধ নাটক!! এ সম্বন্ধে মন্তব্যহীন থাকাটাই শ্রেয় মনে হচ্ছে।
ফেরদৌসি মজুমদারও একটি বাক্যেই সেরেছেন, যদিও এই একটি মন্তব্যই তাঁকে বোঝার জন্য যথেষ্ট। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় নেই এমন কোনো চরিত্রে তিনি কীভাবে অভিনয় করেন এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- আমার মনে হয় যে, কোনো চরিত্রের ভেতরে যদি কেউ ঢুকতে চায় তাহলে সেটা কল্পনায় নিজের মধ্যে এসে যায়। ... আর এমন কিছু কল্পনায় যে আনতে পারবে না বা যদি আনার শক্তিই না থাকে তাহলে তার অভিনয়ই করা উচিত না।- কল্পনায় একটি অজানা চরিত্রের সঙ্গে লীন হতে পারার শক্তি যার নেই তার অভিনয়ের যোগ্যতাই নেই- এই বাক্যটি তাঁর উত্তরসূরীদের জন্য একটা কোটেশন হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, আর ওই লীন হতে পারেন বলেই ফেরদৌসী মজুমদার এত বড় মাপের অভিনেত্রী।
খুব বেশি মৌলিক চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় নি আতাউর রহমান, আলী যাকের বা মামুনুর রশীদের কাছ থেকেও (যদিও আলী যাকেরের- দর্শককে থিয়েটারে আসতে হবে নিজের জীবন দেখতেই কেবল নয়, জীবন কেমন হওয়া উচিত এবং অন্যদের জীবন কেমন এসব কিছু নিয়ে তাকে ভাববার প্রস্তুতি থাকতে হবে- এই মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ), অবশ্য নাটক নির্বাচন এবং নাটকের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে এঁরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত রেখেছেন।
নাট্যচিন্তা, বিশেষ করে নির্দেশনা নিয়ে, সবচেয়ে বেশি কথাবার্তা হয়েছে নাসির উদ্দিন ইউসুফের সঙ্গে আলাপচারিতায়। অন্যান্য আলাপনের চেয়ে এটি অনেক বেশি প্রাণবন্ত এবং জমজমাটও ছিলো। তর্ক-বিতর্কে, ধারালো প্রশ্ন ও চৌকস উত্তরে আলাপনটি দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। ‘মৌলিক নাটক’ করা এবং ‘বাংলা নাটককে বিশ্ব নাট্যধারার সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়’ থেকে যে দলের জন্ম, বাঙলা নাট্যরীতির অন্বেষণ, ‘আমাদের’ নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের কথা বলতে বলতে যে দলটি তাদের তৈরি করা রীতিকে একমাত্র বাঙলা নাট্যরীতি হিসেবে দাবি করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে, তাঁদের কাছে এই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করাটা জরুরি ছিলো। নাটক-নিদের্শনা সম্বন্ধে নাসির উদ্দিন ইউসুফের কয়েকটি মন্তব্য তুলে ধরলে নির্দেশক হিসেবে তাঁর অবস্থানটি জানা যাবে- আমি মঞ্চে একটি কাব্য তৈরি করতে চাই ... আমি কবিতার সমকক্ষ হতে চাই। আমি চাই শামসুর রাহমানের একটা ভালো কবিতার সমকক্ষ আমার থিয়েটার হোক। ... আমি আমার জন্য থিয়েটার করি...আমার ভালো লাগে তাই করি। এখন দর্শক যদি দেখে আর তার ভালো লাগে, সেটা আমার বাড়তি পাওয়া। কারণ আমি কবিতা আর সংগীতের বিমূর্ততাকে ছুঁতে চাই থিয়েটার দিয়ে। তাঁর এই কথাগুলো থেকেই বোঝা যায়- তিনি উচ্চাভিলাষী নির্দেশক। মঞ্চে কিবরিয়ার পেইন্টিং নিয়ে আসতে চান- একথাও তিনি বলেছেন এই আলাপনে। তাঁর সাফল্য ব্যর্থতা বিচার করার যোগ্যতা আমার নেই, কিন্তু এই আকাঙ্খাটি আমাকে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে। থিয়েটার দিয়ে যিনি কবিতা বা সংগীতের বিমূর্ততাকে ছুঁতে চান, তিনি যে আমৃত্যু চলমান থাকবেন, কোনোদিনই থামবেন না, তৃিপ্তর ঢেকুর তোলা তাঁর কখনোই হবে না- একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কারণ, সত্যি সত্যি তো আর কবিতা বা সংগীতের বিমূর্ততাকে ছোঁয়া যায় না! থিয়েটার কেন, কোনোকিছু দিয়েই সেটা যায় না, কিন্তু
কারো যদি ওটাই লক্ষ্য থাকে, তাহলে এই না ছুঁতে পারার অতৃপ্তিই তাঁকে চলমান রাখবে। শিল্পচর্চার সবচেয়ে জরুরি বিষয়টিই হচ্ছে অতৃপ্তি, একজন তৃপ্ত শিল্পী আসলে মৃত শিল্পী, তাঁর পক্ষে নতুন কিছু করা আর সম্ভব হয় না। নির্দেশনা সম্বন্ধে তাঁর চিন্তাভাবনাও পরিষ্কার। দর্শকদের কথা ভেবে নাটক করেন না তিনি, একথা খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে তিনি বলেছেন- আমি তো কাউকে (দর্শককে) বলছি না...আমি আরেকটা ক্যারেক্টারের সঙ্গে ইন্টারেক্ট করছি। তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে দর্শক দেখছে। ...দর্শক তখনই আসে যখন পর্দাটা ওঠে বা আলো জ্বলে। ...আমরা মঞ্চে যে চরিত্রটা দেখি সেটা একটা চরিত্র, নাট্যকার যে চরিত্র লিখেছে তাকে দেখছি না, অভিনেতা যে ব্যক্তি তাকে দেখছি না, দেখছি নির্দেশক-অভিনেতার ইন্টারেকশনে যে চরিত্রটি দাঁড়ালো সেটি।...দর্শক মঞ্চে দেখে তার মতো করে হয়তো আরেকটা চরিত্র দাড় করায়।- তার এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে হয়তো অনেকেই একমত পোষণ করবেন না, কিন্তু নির্দেশনা সম্বন্ধে এটি তাঁর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি, সেটি মানতেই হবে এবং এই মৌলিক চিন্তার জন্যই তিনি শ্রদ্ধা পেতে পারেন। এসব কথা থেকে আরেকটি বিষয়ও পরিষ্কার বোঝা যায়- নির্দেশক হিসেবে তিনি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ভোগ করতে চান, সেই স্বাধীনতায় নাট্যকার, অভিনেতা বা দর্শকের কোনো রকম হস্তক্ষেপ তিনি মেনে নেবেন না। চলচ্চিত্রকে যেমন বলা হয় ডিরেক্টর’স মিডিয়া, নাসির উদ্দিন ইউসুফ একজন নির্দেশক হিসেবে থিয়েটারকেও সেই জায়গায় নিয়ে যেতে চান, যে কারণে তিনি বলতে পারেন- আমরা মঞ্চে যে চরিত্রটা দেখি সেটা একটা চরিত্র, নাট্যকার যে চরিত্র লিখেছে তাকে দেখছি না, অভিনেতা যে ব্যক্তি তাকে দেখছি না, দেখছি নির্দেশক-অভিনেতার ইন্টারেকশনে যে চরিত্রটি দাঁড়ালো সেটি। অর্থাৎ নাট্যকারের তৈরি করা চরিত্রকে নিজের মতো করে তৈরি করাটাকে নির্দেশকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করেন তিনি। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে হয়তো সবার পক্ষে কাজই করা সম্ভব নয়- নির্দেশকের এমন একচ্ছত্র আধিপত্য ও স্বাধীনতা যে-কোনো নাট্যকার বা অভিনেতার পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। তাঁর সৌভাগ্য যে, তিনি তাঁর দলের কাছ থেকে সেই স্বাধীনতাটুকু পেয়েছেন, যে কারণে সাত ঘণ্টার কীত্তনখোলাকে তিনি পৌনে তিন ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন! কিন্তু নির্দেশক হিসেবে ব্যক্তি নাসির উদ্দিন ইউসুফের উচ্চাভিলাষকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেও, দর্শককে একবারেই খারিজ করা, দর্শক বুঝলো কি বুঝলো না এটা একবারেই বিবেচনা না করে নিদের্শনা দিয়ে যাওয়ার মধ্যে আমি কোনো গৌরব দেখি না। কারণ, (এই বিষয়ে আমি বিপ্লব বালা এবং হাসান শাহরিয়ারের সঙ্গে পুরোপুরি একমত যে)- থিয়েটার বিষয়টি সমসাময়িক। এটা সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র বা চিত্রকলার মতো শিল্পমাধ্যম নয়, এমনকি নাট্যসাহিত্যের মতোও নয়, কারণ ওগুলো সৃষ্টির বহুদিন পরও গৃহীত হতে পারে, কিন্তু মঞ্চে অভিনীত নাটক সমকালে গৃহীত না হলে পরে আর সে সুযোগ থাকে না। সৈয়দ হকও এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবেই জানাচ্ছেন- (অনেকে দর্শকের বোঝা না বোঝাটাকে দর্শকের ব্যর্থতা বলে মনে করেন। আপনার মত কি?- এ প্রশ্নের উত্তরে)- না না, তাহলে বলতে হবে ওরা কাজটাই বোঝেন না। নাটক লেখা হলেই তা নাটক হয় না বা মহড়াতেও নাটক হয় না। নাট্যকার-নাট্যজন-দর্শক এই তিনের মিলনেই হয় নাটক। ঢাকা থিয়েটার ‘আমাদের নাট্যরীতি’ বলে যে রীতিটিকে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে সে সম্বন্ধেও সৈয়দ হক কথা বলেছেন- বর্ণনাত্মক রীতির প্রচার প্রসার, এসব কিন্তু মারাত্মক ক্ষতি করেছে আমাদের নাটকের। ...নাটক অন্য জিনিস- বর্ণনাত্মক রীতি নাটক না। আমার মনে হয় সেলিম আল দীন একসময় বুঝতে পারবে, এই ধরনের কোনো একাডেমিক জিনিস চাপিয়ে দেয়া ঠিক না। আমি এমনও শুনেছি যে, ও বলে- আমাদের এটাই একমাত্র নাট্যরীতি...এটাও হতে পারে না।... আমি বলবো যে, যে এমন বলবে সে একটা অস্বাস্থ্যকর কথা বলছে। বর্ণনাত্মক রীতি না হয় একটা ধারা হতে পারে, কিন্তু এটাকে যেভাবে একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেয়া হচ্ছে ইটস এ গ্রেট ডিসসার্ভিস টু আওয়ার ড্রামাটিক মুভমেন্টস।
ঢাকা থিয়েটারের ‘আমাদের থিয়েটার’ সংক্রান্ত ধারণা নিয়ে আলী যাকের এবং আতাউর রহমানও সমালোচনা করেছেন। আলী যাকেরের ভাষ্য হলো - বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে কিছু কিছু নাট্যজন নিরন্তর গবেষণা করে যাচ্ছেন, লেখালেখি করছেন এবং বাংলা থিয়েটারের সোনালী অতীত সম্বন্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। আমি এই পর্যন্ত তাঁদের মতামতের সাথে একমত আছি। কিন্তু যখনই তাঁরা এমত বলেন যে, আমাদের নাট্যকলার কাজকর্মে কোনো বিশেষ রীতির প্রতিফলন অনিবার্য, তখন আমার দ্বিমত পোষণ করা উপায় থাকে না। প্রায়োগিক শিল্পকলা কি কোনো বিশেষ রীতির দ্বারা আবদ্ধ হতে পারে বা হওয়া উচিত?... আমি মনে করি যে, যে কোনো সৃজনশীল শিল্পকলার চর্চায় সনাতন মনোবৃত্তি আমাদেরকে পশ্চাদমুখি করে রাখে। আর আতাউর রহমানের ভাষ্য হলো- ওরা যে বলে- বাংলাদেশের নাটককে আলাদা করে চেনাতে চায়, সেটাকে কিন্তু আমার সোনার হরিণ মনে হয় বা মনে হয় এর কোনো প্রয়োজন নেই। নাটক দেখলেই চেনা যাবে যে এটা বাংলাদেশের নাটক - এই চেনাটার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। (এরপর- না, তারা বলছে যে, নিজস্ব থিয়েটার ল্যাংগুয়েজ তৈরি করা ... প্রশ্নের উত্তরে)- এটা কোথাও আছে নাকি? কোনো দেশে? ‘কাবুকি’ ‘নো’ সব ক্যাসিক্যাল ফর্ম। এগুলো তো মিউজিয়াম পিস। সেলিম আল দীন যতই বলুক কেরামতমঙ্গল মঙ্গল কাব্যের ঢঙে লিখেছে, খণ্ড খণ্ড ভাগ করেছে, কিন্তু সেলিম অতীতকে দেখছে একজন আধুনিক মানুষের চোখ দিয়ে। অতীতের কিছু মণিকাঞ্চন নিয়ে এসেছে, নিয়ে সে কিন্তু আধুনিক মননে স্থাপন করেছে। চোখটা কিন্তু আজকের চোখ সেটা ভুললে চলবে না। কাজেই আমরা ব্যাক গিয়ারে যেতে চাই না। পিছন ফিরে তাকাবো, কিন্তু পেছনে যাব কেন?
দেখা যাচ্ছে ঢাকা থিয়েটারের কথিত বাঙলা নাট্যরীতি, নিজস্ব আঙ্গিক, আমাদের থিয়েটার ইত্যাদি নিয়ে একটি বিতর্ক নাট্যজগতে বেশ জোরেশোরেই চালু আছে (এ নিয়ে‘ থিয়েটারওয়ালা’ একটা আলাদা আড্ডার আয়োজন করতে পারে কী না, সম্পাদককে সেটা ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি), এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফের সঙ্গে আলাপনে বিপ্লব বালা এবং হাসান শাহরিয়ার এ নিয়ে প্রচুর কথা বলেছেন, তর্ক উত্থাপন করেছেন এবং একটি মীমাংসায় পৌঁছতে চেয়েছেন। যদিও এরকম একটি বিষয়ে মীমাংসায় পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব, তবু দর্শককে কমিউনিকেট করার প্রশ্নে তাঁরা যেভাবে বিতর্ক চালিয়ে গেছেন সেটা বিশেষভাবে প্রশংসার দাবি রাখে। ঢাকা থিয়েটারের ‘নীরিক্ষাপ্রবণ’ নাটক না বোঝার অভিযোগ বেশ পুরনো, এ প্রসঙ্গে বিপ্লব বালা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন–
বিপ্লব বালা
একটা কথা জিজ্ঞেস করি...আপনি যে কাজগুলো করছেন, সেলিমভাই সহ, সেগুলো আপনার দলের নাট্যকর্মীরা, যারা অভিনয় করছেন তারা কতটুকু বুঝেশুনে করছেন?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, সবাই তো সমানভাবে বোঝে না, কেউ কেউ হয়তো না বুঝেই করছে।
বিপ্লব বালা
তারাই যদি না বোঝে তাহলে দর্শক বুঝবে কী করে?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
এটা কঠিন একটা প্রক্রিয়া। একটা নতুন ঘরানা তৈরির চেষ্টা তো... তো দুইশ বছর ধরে যেটা চলে আসছিলো নগর থিয়েটারে...আমরা যখন এই নগর জীবনেই আমাদের নিজস্ব থিয়েটারটা নির্মাণ করতে গেছি, তখন তো প্রশ্নই চলে আসলো যে, এটা কি থিয়েটার নাকি? আমরা বললাম, হ্যাঁ এটাই আমাদের থিয়েটার।
আমার প্রশ্নটিও এখানেই। তাঁরা ‘আমাদের থিয়েটার’ কিংবা ‘বাঙলা নাট্যরীতি’ নামে এমনই এক ঘরানা তৈরি করলেন যে, সেটা দর্শকদের কাছে পৌঁছানো তো দূরের কথা, তাঁদের দলের অভিনেতৃরাই বোঝেন না! এটাকে তাহলে তাঁরা ‘আমাদের’ থিয়েটার বলে দাবি করেন কোন অধিকারে? কিংবা এই ‘আমাদের’-এর মধ্যে কে কে আছেন? সমগ্র দেশ? শুধু ঢাকা থিয়েটার? নাকি শুধুই সেলিম আল দীন আর নাসির উদ্দিন ইউসুফ?
দর্শকভাবনা
রামেন্দু মজুমদার দর্শকদের সম্বন্ধে একটা মন্তব্য করেছেন - যে-কোনো খেলার ব্যাপারে বিভিন্ন দলের সমর্থক যেমন থাকে তেমনি প্রতিটি নাট্যদলেরও নিজস্ব দর্শক তৈরি হয়েছে- এমনটি দাবি করে তিনি বলেছেন- সেই দলের যে নাটকই হোক না কেন দর্শকরা সেটা দেখবেই। নাগরিকের দর্শক একটু আলাদা- উচ্চবিত্তের দর্শক, হাই-ফাই দর্শক...ঢাকা থিয়েটারের নাটক মানে নিরীক্ষা... তো তরুণ, নিরীক্ষাপ্রিয়, ইন্টেলেকচুয়াল দর্শক হলো তাদের, আবার আরণ্যক হলো বামঘেঁষা দর্শক বা যারা এখনও মনে করে নাটকের মাধ্যমে সমাজ বদল করা যায়...আর আমাদের (থিয়েটারের) দর্শক হলো মধ্যবিত্ত মানসিকতার, সমসাময়িক রাজনীতিতে আগ্রহী দর্শক...মোটামুটি এই হলো মোটা দাগের ক্যাটাগরি। দর্শকদের এই শ্রেণীবিভাজন দেখে বিপদে পড়ে গেলাম। আমি নিজে যে কোন শ্রেণীর দর্শক সেই অবস্থান নির্ণয় করতে পারলাম না, কারণ আমি এই সবগুলো দলের এবং এর বাইরে আরও অনেক দলের নাটক একই সময়ে দেখেছি। শুধু আমি নই, আমার চেনাজানা অন্তত শ’খানেক দর্শক (যারা শুধুই দর্শক, থিয়েটারের সঙ্গে অন্য কোনোরকমের সম্পর্ক তাদের কখনোই ছিলো না, এখনও নেই) একই সময়ে বিভিন্ন দলের নাটক দেখতো। তাঁর কথা শুনে মনে হলো এই লিজেন্ডরা দর্শকদের সম্বন্ধে আসলে কিছুই জানেন না। জানেন না যে, অধিকাংশ দর্শকই দলের নামে নাটক দেখে না, দেখে নাটকের গুণে।
আতাউর রহমান অবশ্য দর্শকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন- থিয়েটার ইজ এ কোঅপারেটিভ আর্ট। দর্শক এখানে ঈশ্বর। নিজের জন্য থিয়েটার করলে তো ঘরে বসে নাটক পড়লেই হয়। একই সুর শোনা গেছে ফেরদৌসী মজুমদারের কণ্ঠেও- নাটক ও দর্শক অবিচ্ছেদ্য। দর্শক ছাড়া নাটক অকল্পনীয়। যে-কোনো অভিনেতা অভিনেত্রীর মাথায়, তার অবচেতন মনে দর্শকের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। দর্শকের জন্যই তো আমি অভিনয় করি। তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যই আমার আপ্রাণ চেষ্টা থাকে।
অন্যদিকে নাসির উদ্দিন ইউসুফ দর্শককে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। জানুয়ারি-মার্চ সংখ্যার কয়েকজন নাট্যজনের আড্ডায়ও বারবার দর্শক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। কিন্ত তারিক আনাম ছাড়া অন্যরা দর্শকদের সম্বন্ধে খুব শ্রদ্ধা পোষণ করেন বলে মনে হলো না। এমনকি দর্শকরা কেন নাটক দেখে বা দেখে না, সে সম্বন্ধে আলোচনায় লিয়াকত আলীর লাকীর মতো নাট্যজনও নিতান্তই হাস্যকর মন্তব্য করেছেন। অবশ্য বিপ্লব বালা, হাসান শাহরিয়ার, আজাদ আবুল কালাম আগাগোড়াই (শুধু এই আড্ডায় নয়, অন্য আলাপনগুলোতেও) বারবার দর্শকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে- দর্শকদের মূর্খ ভাবার একটা প্রবণতা আমদের নাট্যজনদের মধ্যে আছে। যে দর্শকরা তাঁদেরকে তিন যুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদেরকে এরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো ঘটনা বোধহয় অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমে কল্পনাও করা যায় না। নাট্যজনরা কোনোদিনই দর্শকদের সম্বন্ধে কিছু জানতে চান নি। তারা কেন নাটক দেখতে আসে, কিংবা আগে নাটক দেখতো এখন কেন দেখে না, কিংবা একটি নাটক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলে কেন দর্শকরা সেটিকে এত পছন্দ করছে- এই বিষয়গুলো তাঁরা কখনোই দর্শকদের কাছ থেকে জানতে চান নি। তাঁরা তাঁদের মতো করে একেকটি হাইপোথিসিস দাঁড় করান, সেটা সম্পূর্ণভাবেই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিজাত, দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে থাকেই না। আর থাকবেই বা কিভাবে, দর্শকদের সঙ্গে ইন্টারেকশন বলতে কিছু তো আমাদের থিয়েটার-চর্চার মধ্যেই নেই! নাট্যজনরা তো দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেনই না, কোনো দর্শক যদি নিজে থেকে অভিনয় বা নির্দেশনা বা মঞ্চ পরিকল্পনা বা মিউজিক ডিরেকশন বা অন্য কোনো কিছু নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে যান, তাহলে তাঁরা এমন এক দৃষ্টিতে তাকান- যেন ভিন্ন গ্রহের কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীব তাঁদের মতো মহামানবদের সঙ্গে কথা বলার দুঃসাহস দেখিয়ে মহা অপরাধ করে ফেলেছেন। দর্শক সম্বন্ধে এই ধরনের উন্নাসিকতা এবং অজ্ঞতার একটা জবাব দর্শকরা দিতে শুরু করেছেন, আর আমার মনে হয় এজন্যই মঞ্চনাটকের দর্শক কমে যাচ্ছে। একথা সবাই নিশ্চয়ই মানবেন, মঞ্চে যারা নাটক দেখতে যান তাঁদের সাংস্কৃতিক চেতনার মান খানিকটা হলেও উঁচুতে এবং তাঁরা ঠিক প্রচলিত স্রোতে গা ভাসানো মানুষ নন। তো, তাঁরা যদি টের পেয়ে যান যে, নাট্যজনদের কাছে তাঁদের কোনো মূল্য বা সম্মান তো নেই-ই, বরং আছে সীমাহীন অবজ্ঞা, তাহলে কেন তারা ফের নাটক দেখতে যাবে? হাসান শাহরিয়ারের ভাষায়- দর্শককে যখন আপনি প্রমাণ করে দেন যে, সে মূর্খ, তারপর সে টাকা খরচ করে আপনার নাটক দেখতে আসবে কেন? মূর্খ সাজার জন্য? (আড্ডা, জানুয়ারি-মার্চ, সংখ্যা ০৬)। হাসান শাহরিয়ারের এই প্রশ্নটি একজন দর্শক হিসেবে আমিও সমস্ত নাট্যজনের কাছে রাখলাম।
দলভাঙা
আমরা যারা থিয়েটারের লোক নই, নিছক দর্শক হিসেবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের মধ্যে দলভাঙা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন ও কৌতূহল থাকে। আমরা বুঝতে পারি না, রাজনৈতিক দলগুলোর মতো নাটকের দলগুলোও কেন বারবার ভাঙে। রাজনৈতিক দল ভাঙলে তবু দুই অংশ থেকেই আত্মপক্ষ সমর্থনসূচক কিছু বক্তব্য পাওয়া যায়, নাটকের দলগুলোর কাছ থেকে তা-ও পাওয়া যায় না। এ থেকে বোঝা যায় - জনগণের প্রতি বিন্দুমাত্র কমিটমেন্ট নেই এমন দলগুলোও তাদের অবস্থান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার দায়িত্ব অনুভব করে, নাট্যদলগুলো দর্শকদের প্রতি সেই দায়টুকুও অনুভব করে না। যে দর্শক তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদের যে বিষয়টি জানাবার প্রয়োজন আছে সেটা তাঁদের মনেও পড়ে না। দর্শকদেরকে তাঁরা কতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন সেটা এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। ফলে, আমরা দেখতে পাই, অনেকদিন ধরে একসঙ্গে কাজ করতে থাকা লোকগুলো হঠাৎ করেই আলাদা হয়ে গেছেন। যাহোক, থিয়েটারওয়ালার আলাপনগুলোতে বারবার এই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, এবং এই প্রথমবারের মতো আমরা তাঁদের মুখে এ নিয়ে মন্তব্য শুনতে পেয়েছি।
রামেন্দু মজুমদার থিয়েটারের ভাঙন সম্বন্ধে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নিয়ে সিউল যাওয়ার ঘটনাটিকে মূল কারণ হিসেবে সনাক্ত করেছেন। এর একটি উত্তর পাওয়া গেলো তবিবুল ইসলাম বাবুর ভাষ্যে - তারানা হালিম ও আফরোজা বানুর প্রতি কিরকম অন্যায় আচরণ করা হয়েছিলো তার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেছেন - আমরা কতিপয় সদস্য, তারানা হালিম ও আফরোজা বানুর প্রতি অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে সেনাপতি নাটকে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকি। ওনারা কোনো আলোচনায় না বসে একতরফাভাবে প্রতিবাদকারীদের সদস্যপদ বাতিল করেন। এভাবেই থিয়েটারের প্রথম ভাঙন হয়।- দেখা যাচ্ছে থিয়েটারের ভাঙন সম্বন্ধে রামেন্দু মজুমদার এবং তবিবুল ইসলাম বাবুর ভাষ্যে কোনো মিলই নেই। এবং যেহেতু তবিবুল ইসলাম বাবুর এই ভাষ্যের কোনো প্রতিবাদ রামেন্দু মজুমদার করেন নি (যদিও একটি ব্যাখ্যমূলক চিঠি দিয়েছেন কিন্তু সেটা থিয়েটারেরর ভাঙন সংক্রান্ত নয়), ধরে নেয়া যায়- তবিবুল ইসলাম বাবুর ভাষ্যটিই সত্য।
অন্যদিকে নাগরিকের ভাঙন সম্বন্ধে আলী যাকেরের বক্তব্য- কেউ যদি নিজেকে প্রতিভাধর বলে মনে করেন, তাহলে নিজেই দল তৈরি করে কাজ করতে পারেন ...এটাই স্বাভাবিক- স্বাভাবিক বললেও এই কথাটির মধ্যে বেরিয়ে যাওয়া নাট্যজনদের প্রতি বিদ্রুপ আছে। আতাউর রহমান বলেছেন- আমার দল প্রতিভার ওভার লোডের কারণে ভাঙেনি। ভেঙেছে কারণ, জামালউদ্দিন হোসেন, রওশন আরা হোসেন, ইনামুল হক, লাকী ইনাম বা আবুল কাশেমরা ভেবেছেন যে, আমরা দু-একজন নাগরিকের ক্রীমটা খাচ্ছি। আমরাই কেবল ডিরেকশন দিচ্ছি, আমেরিকা যাওয়ার সময় টিম সিলেকশন করছি, ডাণ্ডা ঘোরাচ্ছি... মানে পার্সোনালিটি ক্ল্যাশের কারণে দল ভেঙেছে।- এটি একটি অরুচিকর, আপত্তিকর ও অপমানজনক বক্তব্য। এ দুজনই দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া নাট্যজনদের অপমান করেছেন, তাঁদের প্রতিভা নিযে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেছেন- এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা অভিযুক্তদের কাছ থেকে এর কোনো উত্তর পাই নি, যেমনটি পাওয়া গেছে থিয়েটারের ভাঙন সম্বন্ধে তবিবুল ইসলাম বাবুর কাছ থেকে। সম্ভবত তাঁরা অনেক বেশি উন্নত রুচির লোক বলেই এমন অরুচিকর মন্তব্যের উত্তর দেন নি।
আলী যাকের যেমন এঁদের প্রতিভা নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন, তার উত্তর দেয়া আমার কাজ নয়। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আতাউর রহমানের আরেকটি মন্তব্য নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। ঈর্ষা’র প্রদর্শনী বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- জামালউদ্দিন হোসেন দল থেকে চলে যাবার পর প্রদর্শনী বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম।.. ঐ চরিত্র কে তুলবে বলো? আর ঠিক সাবস্টিটিউট দিয়ে কোনো নাট্য প্রযোজনার মান ধরে রাখা যায় না। তবুও নূর বা আবুল হায়াতকে বলেছিলাম...অতো বড় সংলাপ মুখস্ত করা কঠিন কাজ। তাই বাদ দিতে হলো আর কি! এর আগে আতাউর রহমান বলেছেন- আমি যে নাটকগুলো নিয়ে গর্ববোধ করি তার মধ্যে একটি হচ্ছে ঈর্ষা, আরেকটি ওয়েটিং ফর গডো। অসংখ্য ভালো নাটকের নির্দেশক হয়েও তিনি যে নাটকটি নিয়ে বিশেষভাবে গর্ববোধ করেন, সেই নাটকটি তাঁকে বন্ধ করে দিতে হয় একজন অভিনেতার জন্য এবং তাঁর অসহায় সুর শোনা যায়- ঐ চরিত্র কে তুলবে বলো?- তবু তাঁর প্রতিভা সম্বন্ধে বিদ্রুপ! আশ্চর্য!! এবার ঈর্ষা নিয়ে আমি আমার ব্যক্তিগত একটি অনুভূতির কথা বলতে চাই। এই নাটকটি আমি ঠিক কতোবার দেখেছি মনে করতে পারবো না, তবে অধিকাংশ প্রদর্শনীতে আমি দর্শক হিসেবে ছিলাম, এবং আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে - ঢাকার মঞ্চে এ পর্যন্ত প্রদর্শিত নাটকগুলোর মধ্যে ঈর্ষা সবচেয়ে জটিল এবং উঁচুমাপের নাটক। একটি নাট্যদল, একজন নাট্যকার, একজন নির্দেশক এবং অভিনেতৃরা কতোখানি পারঙ্গম হতে পারেন- এ নাটকটি তাঁর উজ্জ্বলতম উদাহরণ। শুধু আতাউর রহমান নন, পুরো বাংলাদেশই যে কয়েকটি নাটক নিয়ে গর্ব করতে পারে, তার মধ্যে ঈর্ষা প্রথমসারির নাটক। অথচ দুঃখজনকভাবে এই নাটকটির প্রদর্শনী বন্ধ করতে হলো জামালউদ্দিন হোসেনের দলত্যাগের ফলে, এটা শুধু আতাউর রহমান বা নাগরিকের ক্ষতি নয়, পুরো থিয়েটারের জন্যই ক্ষতিকর হয়েছে। এই বিষয়টি কি নাগরিকের (নাট্যদলের) কর্তাব্যক্তিরা আগে উপলব্ধি করতে পারেন নি? পারলে দলের ভাঙন ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নেন নি কেন? দলভাঙা সম্বন্ধে রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, আলী যাকের বা ফেরদৌসী মজুমদার যা বলেছেন সেটাকে প্রমিত হিসেবে ধরে নেবার কোনো কারণ নেই । এর পেছনে হয়তো আরও অনেক কারণ ছিলো যা তাঁরা উল্লেখ করেন নি। (তবিবুল ইসলাম বাবু’র ভাষ্য থেকে এর প্রমাণ মেলে।) এ সম্বন্ধে বরং নাসির উদ্দিন ইউসুফের কথাটি ভেবে দেখা যেতে পারে- ঢাকা থিয়েটারের সাংগাঠনিক কাঠামোর ব্যাপারে জানতে চাই - এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানাচ্ছেন- কোনো সাংগাঠনিক কাঠামো নেই। প্রথমে তিনজনের একটা আহ্বায়ক কমিটি ছিল...আমি বললাম একটা ফরমাল কমিটি করার জন্য। কিন্তু কেউ মানলো না।..কারণ..ফরমাল কমিটি করলে প্রেসিডেন্ট হবে, সেক্রেটারি হবে...দেখা যাবে থিয়েটারে ব্যস্ততা কমে যাবে, তাই বলা হলো যে প্রডাকশনভিত্তিক কাজ বন্টন করা হবে। নাটকের নির্দেশকের কথাতেই সে সময়টায় দল পরিচালিত হবে। এভাবেই ঢাকা থিয়েটার চলছে। সে কারণেই বোধহয়, অনেকেই আমাদের দল ছেড়ে চলে গেলেও ‘দল ভাঙা’ যেটাকে বলে সেটা হয় নি। তাহলে কি সাংগাঠনিক কাঠামোর জন্যই দল ভাঙে? যাঁরা নেতৃত্ব থাকেন তাঁরা কি সত্যি সত্যি দলের ‘ক্রীমটা’ খান? দল কি তাঁদের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের শিকার হয়? এসব প্রশ্ন একজন নগন্য দর্শক হিসেবে নাট্যজনদের কাছে পেশ করা গেলো- উত্তর দেয়া না দেয়া তাঁদের ইচ্ছা।
পরিশেষে বলি, শূন্য থেকে শুরু করে থিয়েটার-চর্চাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসার পেছনে আমাদের প্রথম প্রজন্মের নাট্যজনদের অবদান অপরিসীম। তাঁদের হয়তো অনেক ভুলত্রুটি আছে, আমরা সেগুলোর সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু তাঁদেরকে বর্জন করতে পারি না। তাঁদের প্রাপ্য সম্মান আমাদেরকে দিতেই হবে। তাঁদের ভুলত্রুটিগুলোকে আমরা বরং দেখতে পারি নতুন রাস্তায় নতুন হাঁটতে শেখা শিশুর হোঁচট খাওয়ার মতো স্বাভাবিক একটা ব্যাপার বলে। কিন্তু পথটি আর নতুন নেই, প্রায় ৩৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আজকের যে নতুন প্রজন্ম একই পথে হাঁটতে শুরু করেছে- তারা যেন হোঁচট না খান। আমরা, দর্শকরা- নাট্যজনদের কাছে যাদের গুরুত্ব অতি সামান্য- আশা করবো, নতুন প্রজন্ম তাঁদের পূর্ববর্তীদের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নিয়ে পথ চলবেন, বাংলাদেশের থিয়েটারকে নিয়ে যাবেন বিশ্বমানের কাছে।
থিয়েটারওয়ালার এরকম আয়োজন অব্যাহত থাকুক। থিয়েটারওয়ালার মতো একটি পরিচ্ছন্ন পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশের মতো একটি কষ্টসাধ্য কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাবার জন্য এর সম্পাদক ও কলাকুশলীদের আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
আহমাদ মোস্তফা কামাল (
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
) : কথাসাহিত্যিক