Full premium theme for CMS
আলাপনে ফেরদৌসী মজুমদার
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[স্বাধীনতার পর নাট্যচর্চাটা আমাদের বেশ এগিয়ে নিয়ে গেছে, সুস্থ ভাবনা-চিন্তার আগ্রহ তৈরি করেছে। আমরা শিল্পের এক বড় কর্মকাণ্ড, কর্মযজ্ঞ- মঞ্চনাটকের নিয়মিত সাক্ষাৎ পেয়েছি। আমরা বেশি বেশি নাট্যকার পেয়েছি, পেয়েছি সৃজনশীল প্রতিভাসম্পন্ন নাট্যনির্দেশক, অনেক ভালো অভিনেতৃ। আর পেয়েছি অনেক সংগঠক, যারা ক্রমশই মঞ্চনাটকের পরিধি বিস্তৃত করেই চলেছেন। এক কথায় এঁরা সবাই আমাদের মঞ্চনাটকের পুরোধা। আমরা মনে করি আমরা এঁদের সব ভালো কাজের উত্তরাধিকারী। তাই আমরা এঁদের কাজ এবং কাজের প্রক্রিয়া জানতে আগ্রহী।
এই প্রত্যাশায় থিয়েটারওয়ালা আলাপচারিতায় মগ্ন হয়েছে কয়েকজন নাট্যজনের। তাঁদের সাথে আলাপচারিতা অনুলিখন করে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে থিয়েটারওয়ালায়। আমাদের এমনি এক নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার। সাক্ষাৎকার: বিপ্লব বালা ও হাসান শাহরিয়ার আর অনুলিখন- সাইফ সুমন]
বিপ্লব বালা
আপনার ছোটবেলার কী কী মনে পড়ে? মানে আপনার পরিবার, খেলাধুলা, বেড়ে ওঠা ইত্যাদি একটু বলুন।
ফেরদৌসী মজুমদার
আমার তো নাটকে আসার কথাই ছিল না। কারণ, আমাদের পরিবার অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবার ছিল। আমার বাবার নাম আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি লেখাপড়া আর নামাজ পড়া ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। আমরা চৌদ্দ ভাই-বোন ছিলাম, লেখাপড়া ছাড়া কারো স্থান ওনার কাছে ছিল না। ভাইদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি পড়াশোনা করতে চাইতেন না। স্কুলে যাওয়ার পথে গাছের নিচে বই মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতেন এবং বিকেলে বাড়ি ফিরতেন। বাবা তো বুঝতে পারতেন না, পরে দেখা গেল হেড মাস্টার বাসায় এসে হাজির। সব জেনে বাবা বললেন ওর কোনো ভরণ পোষণ আমি দেব না। মা-তো কান্নাকাটি লাগিয়ে দিলেন। মা ছিলেন খুবই সরল মানুষ। ঘোমটা টেনে কেবল নীরবে কাঁদতেন। কিন্তু বাবার কাছে এসব কান্নাকাটির কোনো মূল্যই ছিল না। বাবার প্রিয় মারের বস্তু ছিল জুতা। গালাগালি করতেন আর জুতা খুলে মারতেন হাঃ হাঃ ... তো আমার যদ্দুর মনে পড়ে, আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী, তখনো জুতার বাড়ি খেয়েছি হাঃ হাঃ। আর ঐ যে বললাম আমার এক ভাইকে উনি ভরণ-পোষণ করাবেন না বলেছেন, ওর নাম রুশো, আসল নাম শামসের চৌধুরী। আমার বড় আপার নাম ছিল নাদেরা বেগম, উনি থাকতেন করাচি ... তো তিনি বললেন যে- আমি রুশোকে নিয়ে যাই। নিয়ে গেলেন, সেখানেই সে বি.এ পাশ করলো, এম. এ পাশ করলো, তারপর বিয়ে করলো।
হাসান শাহরিয়ার
অভিনয় করাটা শিখলেন কীভাবে?
ফেরদৌসী মজুমদার
বাবার কাছ থেকে, আমার ধারণা বাবা অনেক কিছুই এ্যাক্টিং করতেন।
বিপ্লব বালা
সেটা কেমন?
ফেরদৌসী মজুমদার
মানে কিছু কিছু জিনিস মিন করতেন না কিন্তু আমাদের দেখাতেন যে উনি ভীষণ রেগে গেছেন। আমরা সেটা পরে বুঝতাম। তাই বলছি যে, আমার এ্যাক্টিং-এর ব্যাপারটি আসলে সেখান থেকেও আসতে পারে।
বিপ্লব বালা
আপনি তো বললেন যে, আপনার মা ঘোমটা টেনে নীরবে কাঁদতেন। তো ওনার এই জায়গাটা আপনার কখনো অভিনয় করার সুযোগ ঘটেছে?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ করেছি। এমনিতেও কোনো কান্নার দৃশ্যে আমি মায়ের কথা মনে করি। মা এতো সুন্দর করে কাঁদতেন। আমার সব সময় মনে পড়ে যে, কোনো কারণে মা কষ্ট পেয়েছেন আর লম্বা ঘোমটা টেনে নীরবে কাঁদছেন। কোনো শব্দ নেই ... কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে যেতো কিন্তু কোনো শব্দ নেই।
হাসান শাহরিয়ার
আপনারা চৌদ্দ ভাই-বোন ছিলেন ... ব্যাপারটাকে এনজয় করতেন কেমন?
ফেরদৌসী মজুমদার
খুবই। আমরা কোনোদিন বাইরের বন্ধুর অভাব বোধ করি নি। এবং বলতে সংকোচ হয়, তবুও বলি- কোনো স্কুটার এসে বাসার গেটে থামলে আমরা বলতাম, ধ্যাৎ কে আবার আসলো? মানে চাইতাম না কেউ আসুক ... আমরাই তো ভালো ছিলাম। এবং আমাদের পিঠাপিঠি ভাই-বোন যারা ছিলাম, তাদের মধ্যে গ্র“পিং ছিল। কোনো সমস্যা করলে দেখা যেত যে- নিজেদের ভুল জানলেও নিজেদের হয়ে ওকালতি করতাম। আমাদের চৌদ্দজনের মধ্যে আট ভাই ছয় বোন। ভাইদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল, যেগুলো আমাদের মুগ্ধ করতো। যেমন জহুর ভাইয়ের সাহস, মুনীর ভাইয়ের রসবোধ, মানিক ভাইয়ের নিয়মানুবর্তিতা। মানিক ভাই কিন্তু একেবারে ছোটবেলা থেকেই খুব গোছালো ছিলেন।
হাসান শাহরিয়ার
মানিক ভাই কে?
ফেরদৌসী মজুমদার
কবীর চৌধুরী। বড় ছেলে তো, তাই মানিক বলে ডাকা হতো। উনি খুব রুটিন ধরে ধরে কাজ করতেন এবং এখনো করেন।
বিপ্লব বালা
আপনার শৈশব কি গ্রামে কেটেছে?
ফেরদৌসী মজুমদার
তা বলা যাবে না। কারণ আমি যখন ঢাকার এই সেন্ট্রাল রোডের বাসায় আসি তখন আমি ফ্রক পরি। আমার শৈশব আসলে এই সেন্ট্রাল রোডেই কেটেছে।
হাসান শাহরিয়ার
ভাষা আন্দোলনের আগে পরে কিছু মনে পড়ে?
ফেরদৌসী মজুমদার
মনে পড়ে যে, মুনীর ভাই আর বড় বোন জেলে গেলেন, এগুলো দেখেছি কিন্তু অত বুঝতে পারি নি।
হাসান শাহরিয়ার
তখন এই সেন্ট্রাল রোডের পরিবেশটা কেমন ছিল? মানে বাড়ি ঘর বেশি ছিল?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, একেবারেই কম ছিল। একজন উকিলের বাসা ছিল, একটু দূরে। উনি বাবার বন্ধু ছিলেন। এছাড়া তেমন কোনো বাসা-বাড়ি ছিল না।
বিপ্লব বালা
বাবা কী চাকরি করতেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
উনি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।
বিপ্লব বালা
আপনার বাবা খুব কড়া লোক ছিলেন, মেয়েদের উপর কি বেশি কড়াকড়ি হতো?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, বরং উল্টো। মা যদি বলতেন যে- মেয়েগুলো কাজে একটুও সাহায্য করছে না, তখন বাবাই বরং বলতেন যে- এখানে কাজ করার দরকার নেই। করলে নিজের সংসারে গিয়ে করবে। বাবা অবশ্য সব কথাই বলতেন নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায়।
বিপ্লব বালা
ওনার কড়াকড়িটা তাহলে কেবল পড়াশোনার ব্যাপারে?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, শুধুই লেখাপড়ার ব্যাপারে। আর ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে।
হাসান শাহরিয়ার
আপনাদেরকে কিছু কিনে দেয়া বা কোনো উপহার দেয়া ... এসব কি বাবা করতেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, উনি এসব একদম পছন্দ করতেন না।
হাসান শাহরিয়ার
ঈদে?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, ঈদে অবশ্য বড় বোনরাই দিতেন। নাদেরা আপা কাপড় কিনে নিজেই বানিয়ে দিতেন। আর আমরা, মেয়েরা আবদার একটু কমই করতাম।
হাসান শাহরিয়ার
আপনাদের চৌদ্দ ভাই-বোনদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন কত জন?
ফেরদৌসী মজুমদার
দশ জন। এক বোন ও তিন বোন পড়েন নি। আগেই বলেছি পড়াশোনাটাই বাবার কাছে মুখ্য ছিল। উনি স্কুলের পড়া সব পরীক্ষা করতেন। এবং ওনার কাছে আমাদের পড়া দিতে হতো। সব বিষয়ের উপরই উনি পরীক্ষা নিতেন। বলতেন- গড়গড় করে পড়ে গেলে হবে না, আবার পড়ার মধ্যে চার-পাঁচবার দম নিলেও হবে না। উনি দমের উপর পরীক্ষা নিতেন। ১-২-৩ গুনতে বলতেন, কে কত পর্যন্ত স্পষ্টভাবে বলতে পারে সেটার জন্য নম্বর দিতেন। আমার মনে হয় আমার সংলাপে স্পষ্টতা, দ্রুততা এসে গেছে ওখান থেকেই।
হাসান শাহরিয়ার
কাছ থেকে দেখলে অনেক সময় প্রতিভা বোঝা যায় না, সে প্রেক্ষিতে বলছি, আপনার কখন মনে হয়েছে যে, কবীর চৌধুরী বা মুনীর চৌধুরী, এনারা প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব?
ফেরদৌসী মজুমদার
আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, ফার্স্ট ইয়ারে, মুনীর ভাই তখন বাংলা বিভাগের শিক্ষক। কবীর ভাই বোধহয় তখন বরিশাল বি.এম কলেজে। কবীর ভাইয়ের চেয়ে মুনীর ভাইকে আমরা কাছে পেয়েছি বেশি। কারণ, কবীর ভাই চাকুরি সূত্রেই বাইরে বাইরে থেকেছেন। মুনীর ভাইয়ের হাঁটা, চলা, কাপড় পরা, কথা বলা ... সব কিছুই ছিল অনুকরণীয়। ওনার ভাষাটা ছিল উচ্চমার্গীয়, শব্দচয়ন, শব্দ প্রয়োগ এগুলো আমাদের মুগ্ধ করতো।
বিপ্লব বালা
বাসাতেও আপনাদের সাথে ওভাবে কথা বলতেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ। উনি সত্যিকার অর্থেই একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি ওনার কবর নাটকটি পড়েছেন কবে?
ফেরদৌসী মজুমদার
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি ১৯৬১ সালে। ৬৩/৬৪ সালের দিকে আমি প্রথম নাটকের সাথে যুক্ত হই। ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠীতে তখন মুনীর ভাইরা দণ্ড ও দণ্ডধর করছেন। উনি চোরের অভিনয় করছেন, সবাই বলছে অসাধারণ! কিন্তু আমার আবার নিজের ভাইতো অতটা মনে করতাম না। আবার সবাই যখন বলছে ... তখন ভাবলাম ওনার কবর নাটকটা পড়ি। তো পড়ে তো ভয় লাগলো যে, কবর থেকে উঠে আসছে ... মানে এভাবে নাটক হয়! পরে ফাইনাল ইয়ারে গিয়ে বুঝলাম যে এটা কী মানের নাটক!
বিপ্লব বালা
তাহলে আপনার নাটক শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, কলেজেও করেছি। ইডেন কলেজে পড়ার সময় একদিন মুনীর ভাই বললেন- নাটক করবি? আমি বললাম যে, আমি আবার কী নাটক করবো? উনি বললেন- কেন তুই তো সবাইকে নকল করে আমাদেরকে দেখাস ... সেটাই করবি। মানে হলো আমার আবার ছোটবেলা থেকেই একটা ঝোঁক ছিল বাসায় যে আসতো তার কিছু না কিছু নকল করতাম। এমনকি আমাদের বাসারও সবার কিছু না কিছু নকল করতে পারতাম। বাবা কীভাবে বকেন, কীভাবে মারেন ... এসব আরকি! কিন্তু মুনীর ভাই এসে যখন বললেন- নাটক করবি? তখন চট করে বাবার চেহারাটা ভেসে উঠল। বাসায় তো আবার নাচ, গান, নাটক এগুলো বেশরীয়তি কাজ হাঃ হাঃ ...
বিপ্লব বালা
বাসায় কি তখন রেডিও শুনতেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, রেডিও-তে নাটক শুনতাম। আকাশবাণীতে অনুরোধের আসর হতো, সেগুলো শুনতাম ...
বিপ্লব বালা
তাহলে এসবে নিষেধ ছিল না?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, বাবার ব্যাপারটা ছিল কী, উনি চাইতেন যা করি বাসার ভেতরেই যেন করি বাইরে যেন না যাই। আমরা ভাই-বোনরা মিলে গান গাইতাম, হৈচৈ করতাম, কিন্তু সবই বাসার ভেতরে হতে হতো।
বিপ্লব বালা
একাডেমিক লেখাপড়ার বাইরে আর কী করতেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
খেলাধুলা। আমি ব্যাডমিন্টন, ক্যারাম, মার্বেল, সাতচারা, ডাংগুলি এসব খেলতাম।
বিপ্লব বালা
কাদের সাথে?
ফেরদৌসী মজুমদার
পাড়ার ছেলেদের সাথে। কিন্তু আমাদের বাসায় আসতে হতো।
হাসান শাহরিয়ার
আপনার প্রথম নাটকের কথা বলছিলাম ...
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, তো আমি বললাম যে- আব্বাতো মেরে ফেলবে। মুনীর ভাই বললেন যে- সে দায়িত্ব আমার। আর অভিনয়টা এমন কঠিন কিছু না, একটা রোবটের চরিত্র, তুই হাত-পা টান টান করে শুধু কথা বলবি। নাটকটার নাম ছিল ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা, শওকত ওসমানের লেখা। মুনীর ভাইয়ের নির্দেশনা। কিছু বুঝি নি, অভিনয় করে চলে আসলাম।
বিপ্লব বালা
বাবা জানেন নি?
ফেরদৌসী মজুমদার
পরে হয়তো জেনেছেন। আসলে এখন বুঝি, উনি অনেক কিছু জানতেন, কিন্তু না জানার ভান করতেন। আমরা অবিবাহিত তিন বোন উপরে থাকতাম। আমাদের পায়ের আওয়াজ না পেলেই আম্মাকে জিজ্ঞেস করতেন - মেয়েরা কই? আম্মা বলতেন- একটু বাইরে গেছে। তখন উনি নাকি বলতেন- ৩টা-৬টার বাইরে, মানে তো সিনেমার বাইরে হাঃ হাঃ ...
বিপ্লব বালা
সিনেমা দেখতে চলে যেতেন!
ফেরদৌসী মজুমদার
খুব। যে বাড়িতে যত বেশি রেস্ট্রিকশন, সে-বাড়ির ছেলে-মেয়েরা তত বেশি উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী হয়। মানে যত বাধা, তত পথ খোঁজা হয়। না হলে আমাদের ফ্যামিলির মতো ফ্যামিলিতে চৌদ্দ ভাই-বোনই প্রেম করে বিয়ে করে? হাঃ হাঃ ... তো আমরা নিয়মিতই নাজ সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। এবং বাবাও জানতেন। আবারও বলছি অভিনয় করাটা আসলে বাবার কাছ থেকেই এসেছে বলে আমি মনে করি। তো যে কথা বলছিলাম ... মূলত দণ্ড ও দণ্ডধর দিয়েই শুরু। এর আগে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ করেছিলাম। তার আগে রক্তাক্ত প্রান্তর করার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে আমার হিরো ছিলেন রামেন্দু মজুমদার।
হাসান শাহরিয়ার
আপনারা এক সাথে পড়তেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, তবে আমি বাংলায় আর ও ইংরেজিতে।
হাসান শাহরিয়ার
তখন তো ড্রামা সার্কেল নাটক করতো। দেখেছেন কোনো নাটক?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, আমি দেখি নি। কিন্তু আমার বোনেরা সেখানে নাটক করেছে, কণা আপা, নাদেরা আপা করেছে।
বিপ্লব বালা
গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হতো? মানে গ্রামের সাথে যোগাযোগটা কেমন ছিল?
ফেরদৌসী মজুমদার
একেবারেই কম। যাওয়া হতো না।
বিপ্লব বালা
তাহলে গ্রামীণ চরিত্রগুলো যে আপনি করেন, সেগুলো কোন অভিজ্ঞতা থেকে?
ফেরদৌসী মজুমদার
শুনে শুনে, আর আমাদের বাসার কাছে অনেক বস্তি ছিল। আমি বাসা থেকে সেখানকার লোকজনদের অবজার্ভ করতাম। এছাড়া আমাদের বাসার কাজের বুয়াদের সাথে আমি প্রচুর মিশেছি। তাদের হাঁটা, চলন-বলন সব পর্যবেক্ষণ করতাম। এখনও করি। তবে আগে করেছি না বুঝে, এমনি এমনি। পরে দেখি অভিনয় করতে হলে এই পর্যবেক্ষণ খুব জরুরি। তারপর থেকে সচেতনভাবেই করি।
হাসান শাহরিয়ার
’৬৪-তে যখন টেলিভিশন চালু হলো তখন প্রথম নাটকেই আপনি অভিনয় করেছিলেন। তো আপনাকে খুঁজে পেল কীভাবে?
ফেরদৌসী মজুমদার
প্রথম নাটকেই আমি অভিনয় করি। মুনীর চৌধুরীর একতলা দোতলা। আমাকে খুঁজে পেল মানে ... কলিম শরাফী ছিলেন তখন অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ। উনিই যোগাযোগ করেছিলেন। কলিম শরাফী চাইছিলেন প্রথমেই টেলিভিশনটা ফিল্মের লোকজনের হাতে চলে না যাক। তখন উনি মুনীর ভাইকে বলেছিলেন যে- আপনি তো নাটক লিখেন, নাটক করেন, আপনি ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়ে নিয়েই এখানে কাজ করুন।
বিপ্লব বালা
আপনার বাবা রাগ করেন নি?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, বাবা দেখেন নি। আমাদের বাসায় তখন টেলিভিশন ছিল না। তবে পরে জেনেছেন।
বিপ্লব বালা
সেসময় অভিনয়ের ব্যাপারে আপনার কী কী সমস্যা ছিল বলে আপনার মনে হয়?
ফেরদৌসী মজুমদার
আমার একটু জড়তা ছিল। হয়তো যিনি বাবা হচ্ছেন, তাকে বাবা ভাবতে পারছি না। আহসান আলী সিডনীর সাথে একটা নাটক করেছিলাম ঢেউয়ের পর ঢেউ, সেখানে লাস্ট সিনটা ছিল, ঢেউ উঠছে, আমরা দু’জন কাছাকাছি দাঁড়ানো। সিডনী হাত বাড়িয়ে দেবে, আমি ধরবো। তো আমিতো সংকোচে ধরতেই পারছি না। তখন আমার বিয়েও হয় নি, আমি তো হাত ধরতে দেব না। পরে বাদল রহমানের হাতে সাবান দিয়ে আমার চুড়ি পরিয়ে সিডনীর হাত ধরিয়ে শট নেয়া হয়েছে। ... আমার এধরনের জড়তা কাটতে বোধহয় বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি এমন ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বড় হলেন। বাবা এতো কড়া মানুষ ছিলেন, তারপরও দাদার (রামেন্দু মজুমদার) সাথে প্রেম করলেন, বিয়েও করলেন। আপনার বাবার প্রতিক্রিয়াটা কী ছিল?
ফেরদৌসী মজুমদার
বাবা আসলে গোঁড়া হলেও ছেলে-মেয়েদের অসম্ভব স্নেহ করতেন। তিনি যখন বুঝে গেছেন যে, আমি নাছোড়বান্দা, তখন উনি চেয়েছিলেন আমার যেন কষ্ট না হয়। তাই তিনি মেনেই নিয়েছিলেন।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি আপনার পরিবারের যে আবহ বর্ণনা করলেন, সেখানে তো অনেক আগেই টের পেয়ে যাওয়ার কথা যে আপনি একটা তথাকথিত অঘটন (!) ঘটাতে যাচ্ছেন হাঃ হাঃ ...
ফেরদৌসী মজুমদার
হাঃ হাঃ ... হ্যাঁ, আমার ভাই-বোনেরা আগেই টের পেয়েছিল এবং জানতো। ওরা সব সময়ই সন্ত্রস্ত থাকতো- কী জানি ফেরদৌসী কোন সর্বনাশটা করতে যাচ্ছে।
হাসান শাহরিয়ার
মুনীর চৌধুরী কোনো ভূমিকা নেন নি?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, চিঠি তো ওনার বাসাতেই আসতো। ... আমি তোমাদের দাদাকে ছাড়া বিয়ে করবো না, এটা যখন ঘোষিত হয়ে গেল তখন মা অঝোরে কাঁদছেন। ভাই-বোনেরা ভয় পাচ্ছে, কীভাবে এই কথাটা বাবাকে বলবে। মা’র কথা হলো- বাবা তোমাকে জবাই করে ফেলবে। আমার এখনও মনে পড়ে, মা মাগরিবের নামাজ পড়ে বসে আছেন, আমি পাশে গিয়ে বসলাম। উনি আমার পিঠে হাত রেখে বলছেন- দেশে কি কোনো মুসলমান ছেলে আছিল না? আমার কী যেন হলো, আমিও বললাম- হ্যাঁ, ছিল, কিন্তু আমি তো পেলাম না হাঃ হাঃ ...
হাসান শাহরিয়ার
আপনাদের বিয়ে হয়েছে তো ’৭০ সালে, তাই না?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, বিয়ের একমাস পরেই বাবা মারা গেলেন। তারপর আমরা করাচি চলে যাই, যেন কেউ কোনো কিছু না বলতে পারে। লজ্জাও করছিল।
হাসান শাহরিয়ার
আবদুল্লাহ আল-মামুন ভাই তো তার আগে থেকেই আপনাদের সাথে পরিচিত ছিলেন তাই না?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, উনি এক বছর সিনিয়র ছিলেন। বেশ লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। আমরা সবাই বন্ধুর মতো ছিলাম। উনিও কিন্তু বেশ সাহায্য করেছিলেন আমাদের বিয়ের ব্যাপারে। পরে বলেছেন যে- উনি আমাকে পছন্দ করেন ... এটা কিন্তু কখনোই টের পাইনি। টের পাবো কীভাবে, উনিইতো তোমার দাদার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতেন।
বিপ্লব বালা
করাচিতে গিয়ে নাটকের কিছু করেছেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
করাচি টিভিতে একটা অনুষ্ঠান হতো, বাংলা শিক্ষার আসর ... নওয়াজেশ আলী খান করতেন, সেখানে আমরা কয়েকটা প্রোগ্রাম করেছিলাম। আর কেবল একটা মঞ্চনাটক করেছিলাম- জমা খরচ ইজা, প্রয়াত মুজিবর রহমান খান ছিলেন নির্দেশক।
হাসান শাহরিয়ার
যুদ্ধের সময়তো কোলকাতায় ছিলেন, তাই না?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, ও যেতে চায় নি। আমিই বরং জোর করে নিয়ে যাই। বাসার সবাই ইনসিকিউরড ফিল করছিল। আর তা ছাড়া বিয়ের পর ওর বাবা-মা-র সাথেও দেখা হয় নি। তাই জোর করেই ওকে নিয়ে গেলাম।
বিপ্লব বালা
বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
না।
বিপ্লব বালা
মুক্তিযুদ্ধের কথা বা সেসময়ের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
ফেরদৌসী মজুমদার
এটাতো অবশ্যই একটা অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতিও। আমি ৯ মার্চ’৭১ এলাম করাচি থেকে। তখন চারিদিকে প্রবল উত্তেজনা। কিন্তু আমি কখনোই ভাবতে পারি নি এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে দেশে। ২৫ তারিখ রাতে ... বেশ রাতে যখন ভীষণ রকম শব্দ হচ্ছে তখন আমি ভেবেছি এটা বাজির শব্দ, কোথাও বিয়ে টিয়ে হচ্ছে বুঝি। এটা যে এমন ভয়াবহ সেটা আমার ধারণারই বাইরে ছিল। আমরা সবাই জেগে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছি, দেখি আশপাশের সব বাড়ির ছাদেই মানুষ। এবং চারিদিকে কেবল আগুনের গোলা। কী ভয়ঙ্কর! তারপর তো সবই শুনলাম, দেখলাম। মার্চ, এপ্রিল, মে একেকটা রাত যায় আর বুঝতে পারি যে, বেঁচে আছি। পরে একদিন বাসায়ই সবাইকে মনে হলো চিন্তিত। বুঝতে পারলাম তোমার দাদার উপস্থিতি আমাদের সমস্যায় ফেলার আশংকা করছে সবাই। আমি বললাম যে আমরা কোলকাতা চলে যাব। সবাই দেখলাম বেশ খুশি। তারপর রওনা দিলাম। মা, ওনার বোরখা, ন’শ টাকা আর ছ’টা চুড়ি দিলেন। খুব ভোরে আমরা রওনা হলাম। এই যে কোলকাতা যাওয়ার যাত্রাটা এটা বেশ ভয়াবহ এবং থ্রিলিং। রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই অথচ মানুষ পথে পথে কী দরদ দিয়ে আশ্রয় দিচ্ছে, বিদায় দিচ্ছে।
হাসান শাহরিয়ার
কোলকাতায় গিয়ে কী করলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
প্রথম দিকে কিছুই করি নি। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কিছু কবিতা আবৃত্তি করেছি। তারপর আমি দিল্লীর নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশীপে আবেদন করেছিলাম। ওখানে এক ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোক ছিলেন যিনি মুনীর ভাইয়ের বেশ পরিচিত ছিলেন, আমাদের বাসায় আসতেনও, তো উনি সাহায্য করেছিলেন ফেলোশীপের ব্যাপারে। আর দিল্লীতে আমাদের থাকার জায়গা ছিল না, তখন ওনার বাসায় থাকতাম। তোমার দাদার এক আত্মীয়ের বাসায় মিঃ দাশগুপ্ত বলে একজন ভদ্রলোক আসতেন, তিনি আবার ওর একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিলেন।
হাসান শাহরিয়ার
তার মানে বেশিরভাগ সময়টা দিল্লীতেই ছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ।
বিপ্লব বালা
কোনো থিয়েটার দেখেছেন তখন?
ফেরদৌসী মজুমদার
ওখানে দেখি নি, কোলকাতায় যখন আসি তখন দেখতাম। প্রথমে দেখি নান্দীকারের নাটক ... এটা দিল্লী যাওয়ার আগে। পরে এসে উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র এঁদের নাটকও দেখেছি।
বিপ্লব বালা
কোলকাতায় থিয়েটার দেখার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
ফেরদৌসী মজুমদার
একটা জিনিস আমাকে মুগ্ধ করেছিল, সেটা হলো নাটক যেমনই হোক না কেন, দর্শক একেবারে পিনড্রপ সাইলেন্ট থাকবে। আর নাটক দেখেই বোঝা যেত যে এগুলোর প্রচুর রিহার্সেল হয়েছে। যেটা পরবর্তী সময়ে দেখেছি, আমাদের এখানে এটার বেশ অভাব ছিল।
বিপ্লব বালা
কোলকাতায় থিয়েটার দেখাটা কি কোনো প্রভাব ফেলেছে পরে নাটক করতে?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ সেটা তো করেছেই। কেয়া চক্রবর্তী, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, এঁদের অভিনয় তো ভীষণ টেনেছে আমাকে।
হাসান শাহরিয়ার
ঢাকায় এসে নাটক করবেন, মঞ্চে কাজ করবেন এমন কিছু কি ভেবেছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
ঠিক ওভাবে না হলেও, এখন যে করছি সেটা ওই ভালোলাগা থেকেই বোধহয়। এখানে এসে প্রথম নাটক দেখলাম নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের বাকি ইতিহাস। খুব ভালো লেগেছিল।
হাসান শাহরিয়ার
কোন দিকটা ভালো লেগেছে? নাটক? নাকি এই যে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক করার প্রচেষ্টাটা?
ফেরদৌসী মজুমদার
নাটক আর প্রচেষ্টা দুটোই। আমরাও কিন্তু তখন নাটকের মহড়া শুরু করেছিলাম, দণ্ড ও দণ্ডকারণ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ করতে পারি নি।
বিপ্লব বালা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নাট্যপ্রতিযোগিতা হয়েছিল, সেটা দেখেছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, ওগুলো দেখা হয় নি। কী কী কারণে যেন দণ্ড ও দণ্ডকারণ্য-ও করা হলো না। পরে আমাদের প্রথম নাটক হলো সুবচন নির্বাসনে, আবদুল্লাহ আল-মামুনের রচনা ও নির্দেশনায়।
বিপ্লব বালা
এই শুরুটায় আপনার অংশগ্রহণটা একটু বলুন। নাটক লেখা হলো, পড়লেন ...
ফেরদৌসী মজুমদার
অপূর্ব লেগেছিল, আমার মনে আছে, প্রথম নাটক তো, আবার আমিই একমাত্র মেয়ে। অনেক দায়িত্ব। পুরো প্রাণটা দিয়ে অভিনয়টা করেছিলাম।
বিপ্লব বালা
এই চরিত্রটার সাথে আপনার মিল কেমন পেযেছিলেন? মানে চরিত্রটা বের করেছিলেন কীভাবে?
ফেরদৌসী মজুমদার
রাণু চরিত্রে একটা দৃঢ়তা ছিল যেটা আমার সাথে মিলেছিল। এমনিতে একটা সাদামাটা চরিত্র কিন্তু বাবার আদর্শে সে চলে। বাবার চরিত্রটি করেছিলেন জাকারিয়া দাদা। ওটার পর থেকে আমি জাকারিয়া দাদাকে ছাড়া অন্য কাউকে বাবা ভাবতে পারতাম না।
বিপ্লব বালা
সুবচন নির্বাসনে-র একটা বিরূপ সমালোচনা হয়েছিল, লিখিতভাবেই যে- এই যে ‘সু-বচন’গুলো বলা হচ্ছে, এগুলো আসলে ‘সু’ কিনা। এগুলো পশ্চাৎপদ ‘সু’ কিনা।
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, এরকম একটা সমালোচনা হয়েছিল।
বিপ্লব বালা
আপনি মানসিকভাবে কনভিনসড ছিলেন, নাটকের সংলাপের সাথে?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, কনভিনসড ছিলাম এবং বিশ্বাস করি যে, মেয়েদের কাছে সংসার একটা বড় ব্যাপার হওয়া উচিত। ... মানে আমার মা বলতেন যে- রানধে বেটি কি চুল বান্ধে না? তো আমি নিজে দুটো এম. এ পাশ করেছি, নাটক করেছি, কিন্তু সংসারটাকে একদিনের জন্যও অবহেলা করি নি। তবে হ্যাঁ, এসব কারণে সামাজিক যে সম্পর্কগুলো ছিল, সেগুলোকে মেনটেইন করতে পারি নি।
বিপ্লব বালা
কিন্তু এই নাটকেই তো আবার সেটা কনডেম করছে। রমণীর গুণেই শুধু সংসার সুখের হবে না, পুরুষকেও চাইতে হবে।
ফেরদৌসী মজুমদার
সেটাতো অবশ্যই।
বিপ্লব বালা
এই নাটকটি করে আপনি অভিনেত্রী হিসেবে কেমন কনফিডেন্স পেলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
মনে হলো জীবনটা নাটকময় হবে। এমন উৎসাহী হলাম যে, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, নাটককে আর ছাড়া হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নাটক করেছি তার থেকে এই নাটক তো আকাশ পাতাল তফাৎ। এখানে আমরা একটা পরিবার হয়ে গেলাম। আমরা তো এক সময় আত্মীয় স্বজনদের কথা প্রায় ভুলতেই বসলাম। অথচ দলের কোনো ছেলে-মেয়ের সমস্যা হলে মাথা খারাপ হয়ে যেত। এখনো কিন্তু দলের জন্য যতটা ভাবি অন্যদের জন্য ততটা ভাবি না। এই যে জগলুল অসুস্থ, সারাক্ষণ মনে পড়ে, এমন একটা প্রতিভাধর শিল্পী ... মানে বুকটা হাহাকার করে ওঠে।
হাসান শাহরিয়ার
শুরুর দিকে তো টিকেট বিক্রি হতো পুশ করে। আপনি কি এই পুশিং সেলে অংশ নিতেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমিও টিকেট বিক্রি করেছি। টিকেটের দাম ছিল ৩টাকা, ৫টাকা। এই পুশিং সেলের পর যারা যেত তারা কিন্তু আবার অন্যদের বলতো যে, ওখানে নাটক হয়, খুব ভালো নাটক হয়। দর্শকই আমাদের দর্শক সৃষ্টি করতো।
বিপ্লব বালা
এরপর কোন নাটক করলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
তারপর শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের শেষরক্ষা, কিন্তু এরপর বন্যা শুরু হয়ে গেল ... মামুন ভাই লিখলেন এখন দুঃসময়।
বিপ্লব বালা
এখন দুঃসময়-তো আপনার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল ... ঘটনা, বাস্তবতা, চরিত্র ... তো এটা কীভাবে তৈরি করলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
চরিত্রটা ছিল গ্রামের মেয়ে বেপারী ধরে এনেছে। রক্ষিতা হিসেবে রাখে। মেয়েটির নাম জরিনা, সাংঘাতিক জেদী। এটাতে সাংঘাতিক একটা সিন আছে, ফ্ল্যাশ ব্যাকে। মেয়েটা এখানে আসার আগে একটু পাগল পাগল ছিল, কারণ, বন্যার পানিতে একটা মাচার উপর তার ছেলেকে নিয়ে শুয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখে ছেলেটা নেই, পানিতে পড়ে গেছে। সে ছেলেটাকে খোঁজে- আমার পোলা, আমার পোলা বলে। এটা করতে কিন্তু আমাকে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। এখানে দর্শক একেবারে পিন-ড্রপ সাইলেন্ট থাকে। আরেকটা হলো যে- বাচ্চা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে একটা চিৎকার দিতাম, হলের লোকেরা পর্যন্ত ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠত।
বিপ্লব বালা
তখন তো আপনি মা হয়েছেন, সেজন্য সন্তানের ব্যাপারটা ওভাবে কাজ করেছে ...
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, হতে পারে।
হাসান শাহরিয়ার
এই যে চরিত্রগুলো হয়ে ওঠা ... আমরা হয়তো বুকিশ অনেক শব্দ ব্যবহার করি- ক্যারেক্টারাইজেশন, ইম্প্রোভাইজেশন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আপনি যে অন্য চরিত্র হয়ে ওঠেন, সেখানে আপনার প্রক্রিয়াটা কী? যেমন আপনি বলছিলেন, গ্রামে যান নি বা সচরাচর যাওয়া হয় না ... তারপরও চরিত্রগুলো নির্মাণ করার আপনার কৌশলটা শুনতে চাই।
ফেরদৌসী মজুমদার
আমার ধারণা গ্রাম বা শহর, দেশ বা বিদেশ যাই হোক না কেন, একজন মা কিন্তু মা-ই। মানে কমন একটা জায়গা। আমি এখন দুঃসময় নাটকে যে চিৎকার দিই, তখন ভাবি যে, আমার মেয়ে এভাবে ভেসে গেলে কী করতাম। আমি পারিপার্শিকতা ভুলে যাই। কনসেনট্রেট করি একেবারে আমার নিজের জীবনে। সুখ-দুঃখ সবই নানাভাবে সবার জীবনেই আছে। বিভিন্ন ফর্মে হয়তো আছে। আমি আমার অবজার্ভেশনকে কাজে লাগাই। এটা আগে বুঝতাম না। পরে এন.এস.ডি থেকে তারিক আনাম আসলো, রুনু আসলো ... ওরা যখন ওয়ার্কশপে বলে যে- কনসেনট্রেট কর, চরিত্রটাতে এভাবে ঢুকে যাও ... তখন আমি বুঝলাম যে আমি কিন্তু এভাবেই করেছি। না জেনেই সঠিক উপায়ে করেছি। আবার এ-ও হয় যে আমি বেশি ইনভলব হয়ে যাই। যেমন কোকিলারা নাটকে অভিনয়ের সময় মামুন ভাই বলেন যে- ফেরদৌসী অভিনয়টা খুবই ভালো করে, কিন্তু অতিরিক্ত ইমোশনের কারণে দু-এক জায়গায় লাইট নেয়াটা খেয়াল করে না।
হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু এটাতো ক্ষতিকর, তাই না? আলোটাতো আপনাকে নিতে হবে ...
ফেরদৌসী মজুমদার
অফকোর্স, আলোটা নিতে হবে। এটা আমার ব্যর্থতা ছিল, তবে সমালোচনাটা শোনার পর ধীরে ধীরে চেষ্টা করেছি যেন আলোটা মিস না হয়।
বিপ্লব বালা
চারদিকে যুদ্ধ নাটকে তো কলগার্লের চরিত্র করেছিলেন। এর অবজারভেশন কোত্থেকে এলো?
ফেরদৌসী মজুমদার
আমি কিছু স্টীল ছবি দেখেছিলাম, ড্রেস আর মেক-আপের জন্য। আর মেয়েটি যেহেতু শিক্ষিত ছিল, কাজেই একেবারে নিম্নমানের নয়।
বিপ্লব বালা
চোখে দেখেছেন, এই প্রফেশনের কাউকে?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, সেই সুযোগ হয় নি।
বিপ্লব বালা
তখন তো শিক্ষিত কল গার্ল আমাদের দেশে শুরু হয়ে গেছে, তাই না?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, প্রকাশ্যে ছিল না যে, অবজার্ভ করা যাবে। আর সিগারেট যেটা খেতাম, তার একটা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। বাসায় একবার খালাতো ভাই-বোনেরা বেড়াতে এসেছিল, তখন ভাইয়েরা জমাট আড্ডায় সিগারেট খেতো। আমরা, বোনেরা তখন চুরি করে দরজা বন্ধ করে খেয়েছিলাম। সবাই তো কাশতে কাশতে অস্থির, কিন্তু আমি পুরোটা শেষ করেছিলাম।
বিপ্লব বালা
এই চরিত্র করতে মানসিক আড়ষ্টতা বা অস্বস্তি হয় নি?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, আমি যা নই, সেই চরিত্র করতেই আমার বেশি ভালো লাগে। আমি স্কুল টিচার, সুতরাং মাস্টারের চরিত্রে আমার ভালো লাগে না।
হাসান শাহরিয়ার
দলের মেয়ে সংকট তো ততোদিনে কেটে গেছে বোধহয়, তাই না? আমরা শুনেছি, দলে মেয়ে নেই বলে মেয়ে চরিত্র মামুন ভাই নির্মাণ করতে পারছিলেন না ...
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, এই চারদিকে যুদ্ধ নাটকে কয়েকটি মেয়ে চরিত্র আছে, এবং মেয়ে আছে বলেই উনি এ নাটকটা হাতে নিয়েছিলেন।
হাসান শাহরিয়ার
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটু শুনতে চাই। অন্য ফর্মের নাটক, কাব্যনাটক ইত্যাদি সব মিলিয়ে ...
ফেরদৌসী মজুমদার
এই প্রথম বোধহয় একটি চরিত্র পেলাম যেটিকে কিছুতেই দাঁড় করাতে পারছিলাম না। কাব্যনাটক তো আগে করি নি, পড়িও নি। ছন্দ মেলাতে গিয়ে ছড়া বলার মতো হয়ে যাচ্ছিল। আমি এই প্রথমবারের মতো মামুন ভাইকে বললাম যে- আমাকে ছেড়ে দিন, আমি পারবো না। অন্য কাউকে দিয়ে করান। মামুন ভাই বললেন- আপনার কী মনে হয়, আপনি পারবেন না আর অন্য কেউ পারবে? উনি রেগে বললেন- পারছেন না, কিন্তু পারতে হবে। ছন্দ ভুলে যান, সংলাপ মনে করে পড়–ন। পরে বাসায় এসে আবার শুরু করলাম, আস্তে আস্তে মজা পেয়ে গেলাম।
হাসান শাহরিয়ার
হক ভাইয়ের সাথে আপনার আগে পরিচয় ছিল? ওনার সাহিত্য আগে পড়েছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
না পরিচয় ছিল না। সাহিত্য পড়েছিলাম।
বিপ্লব বালা
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়- নাটকে আপনার চরিত্রের শেষ দিকে যে হাহাকার, সংকট সেটা বের করতে গেলে নিজের জীবনে বা অভিজ্ঞতায় তো সেটা থাকতে হবে। এটা পেলেন কীভাবে?
ফেরদৌসী মজুমদার
এটা আসলে আমার কল্পনা। আমি মনে করি এরকমই হয় ...
বিপ্লব বালা
না মানে দুঃখের বা ব্যথার কোনো জায়গায় হয়তো নিজের কোনো কিছুর সাথে মেলাতে হয়, আমি সেই মেলানোর জায়গাটার কথা বলছি।
ফেরদৌসী মজুমদার
এটা আমি চিন্তা করেছি যে, একটা মেয়ে বাবার জন্য তার ইজ্জত হারাল, স্বামীও চলে গেল ... এমনকি স্ক্রীপ্টেও লেখা আছে- হাঁসকে খাটাশে খেলে যেমন হয়, ঐ মেয়েটার জীবনও তাই। আমার মনে হয় যে, কোনো চরিত্রের ভেতরে যদি কেউ ঢুকতে চায় তাহলে সেটা কল্পনায় নিজের মধ্যে এসে যায়।
বিপ্লব বালা
এই চরিত্রটা করতে গিয়ে কি কখনো মনে হয়েছে যে, নিজেকে জানাটা অন্যরকম হয়েছে ... মানে নিজের জীবন অভিজ্ঞতা, অনুভূতির জায়গা থেকে কি মনে হয়েছে যে এই চরিত্রটি না করলে পেতেন না?
ফেরদৌসী মজুমদার
একটা চরিত্র করতে গিয়ে তো এমনিতেই অনেক কিছু যুক্ত হয়, নিজের অভিজ্ঞতায়। কিন্তু এই চরিত্রটি যত দুঃখের, তখনো আমি অত দুঃখ নিজের জীবনে পাই নি। কারণ আমি বাবা হারিয়েছি, সেটাও স্বাভাবিকভাবেই। কেবল মুনীর ভাইকে হারানো ছাড়া আর কোনো দুঃখের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে ছিল না। সেকারণে আমি আসলে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিলাম যে, ঐ জায়গায় আমি হলে কী করতাম ...
বিপ্লব বালা
না, আপনি হলে কী করতেন এটা পাবেন কোথায়, যদি না ঐ জাতীয় কষ্টের পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা আপনার না থাকে?
ফেরদৌসী মজুমদার
আমি এভাবে মনে করেছি যে, আমার বাবা আমাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন, তখন আমার যেমন লাগবে এটা ভাবতে চেষ্টা করেছি।
হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু আপনি যখন ভাববেন যে আমার বাবা এমন করলে কী করতেন, তখন তো মনে পড়বে যে আপনার বাবা তো এমনটা করতেই পারেন না। আপনার নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো, আপনার বাবা এমনটা করতেই পারেন না, তাই না?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, পারেন না, কিন্তু যদি করতেন ... আর এমন কিছু কল্পনায় যে আনতে পারবে না বা যদি আনার শক্তিই না থাকে তাহলে তার অভিনয়ই করা উচিত না।
বিপ্লব বালা
এই নাটকের চরিত্রটি করে আপনার অর্জন কেমন হয়েছে বলে মনে করেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
এটা আমার সৌভাগ্য। আজকে আমার এই অবস্থানে আসার জন্য একটা মুখ্য ভূমিকা ছিল এই চরিত্রটির। এখন মনে হয় যে, এই চরিত্রটি যদি আমি না করতাম তাহলে বোধহয় আমি অন্যরকম হতাম। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এর মাতববরের মেয়ে আর টেলিভিশনে সংশপ্তক নাটকের হুরমতি, এই দুইটি চরিত্রই এখন পর্যন্ত আমাকে এবং জনগণকে আলোড়িত করে।
হাসান শাহরিয়ার
বাংলাদেশে মঞ্চস্থ গোটাকতক নাটকের নাম বললেই পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-র নাম চলে আসে। আমরা অনেকেই এটাকে মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবে মনে করি। কিন্তু নাট্যকারের জবানীতে আমরা শুনেছি যে, এটা অনেক বৃহত্তর মুক্তির নাটক। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে নাটক। আপনারা যখন স্ক্রীপ্ট এনালাইসিস করছিলেন, তখন নাটকটিকে কীভাবে দেখেছিলেন?
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ, এখানে আমিও একটু বলি, এটা যতটা না মুক্তিদ্ধুদ্ধের তার চেয়ে বেশি ধর্মন্ধতার বিরুদ্ধের। সেসময়ে ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে এরকম প্রশ্ন করা কিন্তু সহজ কথা না। এমনকি এখনও করা যায় বলে সাহস হয় না। আপনারা এটা নিয়ে কী ভেবেছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, রিহার্সেলে কিছু কিছু পরিবর্তনও হয়েছে। যেমন শেষে মাতববরের কোনো শাস্তি হবে না, এটা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। ওকে একটা শাস্তি দিতেই হবে। তো মামুন ভাই সাজালেন যে- ওকে শেষে মেরে ফেললেন, দর্শকও হাততালি দেয়।
হাসান শাহরিয়ার
আমি জানতে চাচ্ছি নাটকটি মূলত যে সর্বজনীন বিষয়টিকে ধরতে চেয়েছিল, ধর্মান্ধতা ... তো মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার এসব দেখাতে গিয়ে মূল রসটা দর্শক হারিয়েছে কিনা?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, আমার মনে হয় আমরা যেভাবে করেছি, তাতে মূল মেসেজটাই দর্শক পেয়েছে।
বিপ্লব বালা
এটা একটা সাধারণ কথা যে, অভিনয় শিল্পে নাকি নানা চরিত্রের মাধ্যমে অভিনেতা আসলে নিজেকেই কোথাও আবিষ্কার করে। নিজেরই একেকটা সত্তা খুঁজে পান একেকটি চরিত্রে। এটা যদি সত্যি হয় আপনিও নিশ্চয়ই নিজেকেই খুঁজেছেন। তাহলে ধরুণ দুই বোন নাটকে শর্মিলা-র মধ্য দিয়ে আপনি নিজের জীবনের কী আবিষ্কার করেছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই দুর্বলতা ছিল, এখনো আছে। আমি এখনও মনে করি রবীন্দ্রনাথের নাটকের একটা চরিত্র করতে পারাটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।
বিপ্লব বালা
অন্য নাটকের চরিত্র থেকে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের কী ভিন্ন লাগে?
ফেরদৌসী মজুমদার
ভিন্ন এর আভিজাত্যটা- ভাষা সংলাপে সবই আধুনিক। তার নাটকের চরিত্রগুলো নিয়ে ভাবতে হয়। যে চরিত্র নিয়ে খাটতে হয় না, সেসব চরিত্র আমার ভালো লাগে না। দুই বোন-র বেলায় যেটা ঘটেছিল, আমার চেয়ে বেশি চঞ্চল হওয়ার কথা ছিল আমার ছোট বোনের। কিন্তু দেখা গেল আমিই বোধহয় বেশি চঞ্চল ছিলাম।
বিপ্লব বালা
তার মানে ঐটা আপনার স্বভাবের মধ্যে আছে।
ফেরদৌসী মজুমদার
আছে। তখন কিন্তু মনে হতো এটা আমার ব্যর্থতা। আমাকে আরেকটু অসুস্থ হতে হবে, আরেকটু ভারি হতে হবে, কথাগুলো আরেকটু ধীর গতির হবে ... তো এগুলো আমি দর্শকদের কাছ থেকেও শুনেছি। আমি মনের মতো ছোট বোন পেয়েছিলাম মিতা চৌধুরীকে। ও বেশ চঞ্চল ছিল। অন্যদের মধ্যে ব্যাপারটা তেমনভাবে আসে নি।
বিপ্লব বালা
তার মানে কি, শর্মিলার ট্র্যাজিডিটা ধরতে আপনার মুশকিল হচ্ছিল? আপনার ব্যক্তিজীবনের চঞ্চলতা শর্মিলার নিঃসঙ্গতা ধরতে পারছিল না?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, আমি কিন্তু তা মনে করি না। দর্শক কিন্তু আমি যা নির্মাণ করেছি, সেটাকেই গ্রহণ করেছে।
হাসান শাহরিয়ার
দর্শক কেমন হতো এই নাটকের? কোন ধরনের দর্শক বেশি আসতো?
ফেরদৌসী মজুমদার
এই নাটকে অন্যরকম এক আবেদন ছিল বিশেষ করে মহিলাদের কাছে। প্রায় সব শো-ই হাউজফুল হত।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি ওথেলো নাটকের অভিজ্ঞতাটা একটু বলুন। এতদিন তো দেশীয় চরিত্র করেছেন। এবার না জানা বা অভিজ্ঞতার বাইরের চরিত্র ... একটু বলুন।
ফেরদৌসী মজুমদার
আমরা দেশের আবদুল্লাহ আল-মামুন করেছি, রবীন্দ্রনাথ করেছি, সৈয়দ শামসুল হক করেছি। তারপরই ধরলাম ওথেলো। এই নাটকে প্রথমে আমি এমিলিয়া করেছি, ডেসডিমোনা করেছিল তারানা হালিম। পরে সে পরীক্ষা সংক্রান্ত কারণে আর করতে পারে নি, আমি ডেসডিমোনা করেছি। যেহেতু এটা অন্য পটভূমি, অন্য সমাজ, পোষাক থেকে শুরু করে সবই অন্যরকম। আমার সংলাপ নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না, যেটা ছিল সেটা হলো মেট্রিক পাশের পর থেকে শাড়ি পরি। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম যে, এসব ড্রেস আমি কীভাবে পরবো। বা আমাকে মানাবে কিনা। বরাবরই তো আমার বাঙালি চেহারা। তো পরে দেখা গেল আর অসুবিধা হয় নি।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি বলছেন তারানা হালিম পরীক্ষা সংক্রান্ত কারণে ডেসডিমোনা করতে পারে নি। কিন্তু আমরা শুনেছি পরীক্ষা শেষে তিনি আবার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি চরিত্রটি ছাড়তে রাজি হন নি।
ফেরদৌসী মজুমদার
ব্যাপারটা মোটেই তা নয়।
হাসান শাহরিয়ার
ডেসডিমোনা চরিত্রটি তোলার জন্য ক’দিন সময় পেয়েছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
বেশি না, মাস খানেক।
হাসান শাহরিয়ার
এতো কম সময় লাগার পেছনে এমনটা ছিল কিনা যে, ডেসডিমোনা চরিত্রটি করার প্রতি আপনার আগে থেকেই দুর্বলতা ছিল?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, আগে থেকেই ছিল, কিন্তু যেহেতু ডেসডিমোনার বয়স হতে হবে ১৫/১৬ বছর, তাই আমার চেয়ে তারানাকেই প্রেফার করা হলো এবং ও ভালোও করছিল। তবে আমি চরিত্রটি পাওয়ার পর বিভিন্ন দেশের কয়েকটি ওথেলো-র ছবি দেখলাম, দেখলাম যে কোথাও ডেসডিমোনা ৩০/৩২ বছরের কম বয়সী কেউ অভিনয় করে নি। কারণ শুধু বয়স হলেই তো হবে না, চরিত্রটিকে ধরতে হবে তো।
হাসান শাহরিয়ার
বিদেশি চরিত্রের মধ্যে এমিলিয়া বা ডেসডিমোনার চেয়ে লেডি ম্যাকবেথে ভালো অভিনয় করেছিলেন ... অন্তত যাকের ভাইয়ের মূল্যায়ন হচ্ছে, আপনার সেরা অভিনয়টা হয়েছে লেডি ম্যাকবেথ চরিত্রে। আপনার কী মনে হয়?
ফেরদৌসী মজুমদার
হতে পারে। তবে এটার কারণ হলো নির্দেশক। অসাধারণ একজন নির্দেশক ছিলেন। আমার মনে আছে ম্যাকবেথ করার যখন সিদ্ধান্ত হলো তখন ক্রিস্টোফার স্যান্ডফোর্ড আমাকে দেখতে চাইলেন, কথা বলার জন্য। এর আগে যাকেরের সাথে কথা হয়ে গেছে। তো আমাকে উনি বললেন- আমি ম্যাকবেথ দেখেছি কিনা বা পড়েছি কিনা বা অন্তত রেকর্ডে শুনেছি কিনা। আমার উত্তর ছিল- না। তখন উনি বললেন- এটাই আমি চেয়েছিলাম। আমি নিজের মতো করে তৈরি করবো। কারণ, আগে দেখা থাকলে, অনুকরণের ভয় থাকে। কোথাও না কোথাও একটা ইনফ্লুয়েন্সের ভয় থাকে। আমি বোঝাবো তুমি বুঝবে, তারপর করবে।
হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু যাকের ভাইয়ের তো এটা পড়া ছিল, দেখাও ছিল। ওনার অভিনয়ে কি কোনো অনুকরণ করার প্রবণতা আপনি পেয়েছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, তা না। সবার জন্য যে সবটা প্রযোজ্য তা না। আমি মনে করি আমার দেখা না থাকাটা উপকার হয়েছে। আমি যখন রিহার্সেলে কোনো কিছু এসকেপ করতাম, নির্দেশক সাথে সাথে থামিয়ে দিতেন। উনি নাকি ধ্বনিটা বুঝতে পারতেন। এটা অবশ্য সৈয়দ শামসুল হকের কৃতিত্ব। ওনার অনুবাদটা হয়েছিল অসাধারণ।
বিপ্লব বালা
চরিত্রটি কিন্তু বেশ জটিল। মানে চরিত্রায়নে বেশ মুশকিল আছে, এক্ষেত্রে নির্দেশকের কীভাবে সহযোগিতা করেছিলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
রিহার্সেলের সময় উনি বলতেন, আমার সংলাপ বলার সময় মুখে ঐ এক্সপ্রেশনটা আসছিল না। তখন সংলাপ বারবার পড়ে বোঝার চেষ্টা করেছি। আর আমার এন্ট্রিটাই হচ্ছিল না। মানে স্বামী দাঁড়িয়ে আছে, ভাবছে হত্যা করবে কি করবে না। তিনি বললেন- তখন তোমার এন্ট্রিটাই সবাইকে চমকে দিতে হবে। উনি বললেন যে তোমার গাউনটাকে ব্যবহার করো। রেগে গেলে টাস করে একটা বাড়ি দেবে, ঘুরে যাবে। অভিনয়ে কস্টিউম যে কথা বলে ওটা তখন আমি বুঝেছিলাম।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি দলের সাংগঠনিক দায়িত্বগুলো কতটুকু পালন করেন? যেমন- নতুন নাটক সিলেকশন বা নাটকের খরচ কীভাবে আসবে ইত্যাদি বিষয়গুলোতে মাথা ঘামান?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, আমি মনে করি যার যা কাজ তাই করা উচিত। কোথায় শো হবে, নাটকের খরচ কীভাবে উঠবে এগুলো মামুন ভাই, তোমার দাদা বা যারা দায়িত্বে আছেন তাদের ভাবনা। বিশেষ করে খরচের এই ব্যাপারটা তোমার দাদাকেই মাথায় রাখতে হয়। এবং সে পারেও এই কাজটা। আর আমার কাজ অভিনয় করা আর দল ভাঙতে গেলে তা ঠেকানো।
হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু আপনার দলই কিন্তু সবচেয়ে বেশিবার ভেঙেছে বা দল থেকে চলে গেছে। এমনকি এই ওথেলো বা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের সময়ই প্রথম দল ভেঙেছে। তখনকার কথা কিছু মনে আছে?
ফেরদৌসী মজুমদার
তখন আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গিয়েছিল। এতো কষ্টের তৈরি দল ... তখন তো সবাই আমার বাসায় আসতো খেতো, আমাকে অনেকেই ভাবী বলে ডাকতো, যখন তখন বাসায় চলে আসতো। এমনও হয়েছে এসে বাসায় গল্প করছে অনেক্ষণ ধরে, আমি বলেছি- তোরা এখন চলে যা, কিন্তু তারা তোয়াক্কা না করে আড্ডা দিয়েই গেছে। থিয়েটার তো পরিবার তাই না?
হাসান শাহরিয়ার
আপনিতো ঐভাবে সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন নি বলছেন। তো দল ভাঙার ব্যাপারে আপনার অনুভূতি তো আবেগের অনুভূতি, সেটা শুনতে চাচ্ছি।
ফেরদৌসী মজুমদার
এটা একটা ট্র্যাজিক জায়গা। আমার খুব কষ্টের স্মৃতি আছে ... থিয়েটার ভাঙার পর ওরা আমাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। অথচ এই লোকগুলোই আমার কত কাছের ছিল। এমনকি যে লোক মামলা করেছে, যেদিন মামলা করেছে, সেদিনও আমার বাসায় এসে বলেছে- ভাবী আমার খিদে পেয়েছে, একটু কিছু খাওয়ান। পরে যখন শুনলাম এই ব্যক্তিটি মামলা করে আমার বাসায় খেতে এসেছিল ... ভাবতে পারি না, ভেবেছি যে মানুষ এমন হয়!
হাসান শাহরিয়ার
একটা সময় ছিল, যখন দলে আপনি একমাত্র অভিনেত্রী ছিলেন। পরে অন্যান্য আরো অভিনেত্রী আসলো। আপনি যখন অভিনয় করেন, দর্শক মানতে চায় যে, এই অভিনয়টা আপনি ছাড়া কেউ করতে পারতো না। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে একটি অভিযোগ শোনা যায় যে, আপনি এভাবে কেন্দ্রীয় চরিত্র নিয়ে নেয়াতে অন্যরা নিজেদেরকে মেলে ধরতে পারে নি। এটার ব্যাপারে আপনার অভিমত শুনতে চাই।
ফেরদৌসী মজুমদার
এটা সত্যি যে কেন্দ্রীয় চরিত্র আমি করেছি। কিন্তু অন্যান্য মেয়ে চরিত্র যারাই করেছে তাদেরকে আমাকেই শেখাতে হয়েছে। এটাও তো আরেকটা সত্যি। আমি নিজে ঘন্টার পর ঘন্টা ডায়লগ ডেলিভারি শিখিয়েছি, উচ্চারণ শিখিয়েছি, স্ক্যানিং শিখিয়েছি, অভিব্যক্তি শিখিয়েছি। তখন যাদের শিখিয়েছি, তারা কখনো বলে নি যে- আপনার চরিত্রটা সোজা বেশি, ওটা আমি করবো। আর তা ছাড়া, নির্দেশক বা দল তো চাইবেনই যে- সবচেয়ে ভালো কাজটা বেরিয়ে আসুক। আজ পর্যন্ত আমি নির্দেশককে বলি নি যে- আমাকে ঐ চরিত্রটি দিন।
হাসান শাহরিয়ার
নাট্যকার তো আপনার দলেরই শিল্পী। উনি যদি আপনাকে মাথায় রেখেই চরিত্র নির্মাণ করেন, তাহলে তো আর আপনাকে চাইতে হয় না।
ফেরদৌসী মজুমদার
আমাদের নাট্যকার সব সময় একটা কথা বলেন যে- আমি এমন নাটক লিখবো না, যেটা আমার দল করতে পারবে না। উনি কেবল আমার চরিত্র না, পুরো নাটকটাই লেখেন দলের শক্তি বুঝে।
বিপ্লব বালা
সেক্ষেত্রে নাট্যকারের একটা সুযোগ ছিল যে অন্যান্য যেসব অভিনেত্রীরা তৈরি হচ্ছে, তাদেরকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, মানে ভাবার তো সুযোগ থাকে। তো আপনার কী মনে হয় নাট্যকার এটা ভেবেছেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
আমি মনে করি ভেবেছেন এবং সেভাবে লিখেছেনও। আমাদের অনেক নাটক আছে যেগুলোতে আমি ছাড়াও অনেক নারী চরিত্র আছে, এবং সেগুলো অনেকেই ভালো অভিনয় করেছে। চোর চোর নাটকে আমি তো অভিনয়ই করি নি। কারণ প্রধান নারী চরিত্রটিতে মিতা চৌধুরীকে বেশি মানিয়েছিল।
বিপ্লব বালা
তাহলে এরকম হতে পারে যে, একটা কথা আছে না- বড় গাছের পাশে ছোট গাছ বাড়তে পারে না ... এটার একটা বাস্তবতাও আছে, ছায়া পড়ে যায়। এক্ষেত্রে আপনি বাধা হয়ে আছেন হয়তো বা। আপনাকে পাশে রেখে একই মঞ্চে অন্যদেরকে একটু ম্লান লাগবেই। এটাও হয়তো মেনে নিতে হবে। ... আমি একটু অন্য প্রসঙ্গে বলি ... টেম্পেস্ট আপনার কেমন লেগেছিল?
ফেরদৌসী মজুমদার
আমার অত ভালো লাগে নি। আলী যাকের, শান্তা, আশীষ খন্দকার এরা সবাই ভালো করেছে। নির্দেশকও ভালো ছিল। কিন্তু আমার চরিত্রটা আমি ঠিক এনজয় করি নি।
বিপ্লব বালা
কেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
আসলে আমার নাটক ভালো লাগে যেখানে গল্প থাকবে, ক্লাইমেক্স থাকবে ... আর তা ছাড়া, আমার কস্টিউমটা পছন্দ হচ্ছিল না। কস্টিউম পছন্দ না হলে আমি অভিনয়ে সাচ্ছন্দ বোধ করি না।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি আপনার দলে মূলত একজন নাট্যকার-নির্দেশকের হাতে কাজ করেছেন। আপনার কি কখনো মনে হয় যে, এতে করে আপনি সীমাবদ্ধ হয়ে গেছেন, গণ্ডিবদ্ধ হয়ে গেছেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, কখনো না। একটা কথা হয়তো কেউ জানে না যে, মামুন ভাই কখনো আমার উপর কিছু চাপিয়ে দেন নি। উনি আমাকে চরিত্রটা বুঝিয়ে দেন, তারপর আমি আমার মতো করে তৈরি করেছি। আমি অনেক কিছুই যোগ করেছি, মামুন ভাই এতে খুশিই হয়েছেন।
হাসান শাহরিয়ার
মামুন ভাই ছাড়া আমাদের দেশের আর কোনো ডিরেক্টর আছেন যার নির্দেশনায় কাজ করেন নি বলে আপনি অতৃপ্ত?
ফেরদৌসী মজুমদার
ওভাবে ভাবি নি। তবে জামিল আহমেদের নির্দেশনায় কাজ করার ইচ্ছা ছিল। আমি ওর বিষাদসিন্ধু দেখেছিলাম। খুব ভালো লেগেছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল ওর সাথে একটা কাজ করতে পারলে ভালো হতো।
হাসান শাহরিয়ার
আর কোন কোন নাটক আপনার ভালো লেগেছে?
ফেরদৌসী মজুমদার
নূরলদীনের সারাজীবন-এ আলী যাকের ও আসাদুজ্জামান নূরের অভিনয় ভালো লেগেছে। ঢাকা থিয়েটারের নাটক ভালো তবে অনেক লম্বা, আমি অধৈর্য হয়ে যাই। কীত্তনখোলা, শকুন্তলা দেখেছিলাম। ভালো লেগেছিল। আরণ্যকের ইবলিশ, ওরা কদম আলী দেখেছিলাম।
হাসান শাহরিয়ার
এগুলোতো অনেক পুরোনো। আশির শেষে বা নব্বুইয়ের কোনো নাটক?
ফেরদৌসী মজুমদার
সেটা বোধহয় কেবল বিষাদসিন্ধু আর জয়জয়ন্তী দেখেছিলাম। যদিও জয়জয়ন্তী শেষ করতে পারি নি। আসলে নিজের দলের নাটক, স্কুল, তারপর সংসার এসব করে আর সময় করে উঠতে পারি না। নাটক দেখা হয় না বললেই চলে।
হাসান শাহরিয়ার
কোকিলারা স্ক্রীপ্টটা কীভাবে পেলেন? মানে করবেন এই জন্যই লেখা হয়েছিল?
ফেরদৌসী মজুমদার
তাই মনে হয়। কারণ, একদিন মামুন ভাই আমাকে বললেন যে- আপনি দুই ঘন্টা স্টেজে থাকতে পারবেন? আমি বললাম- কেন? বললেন যে- না আমি একটা নাটক লিখবো, আপনাকে একা করতে হবে, কিন্তু চরিত্র অনেক। আমি বললাম লেখেন। আমি ভাবতে পারি নি যে, উনি লিখে ফেলবেন। লিখে যখন পড়ে শোনালেন, আমি বললাম- এটাতো অসম্ভব। তিনটি এপিসোড দুই ঘন্টা স্টেজে থাকতে হবে, এটা কীভাবে সম্ভব! উনি বললেন- আপনাকে পারতে হবে, আপনি না পারলে কে পারবে? যতদিন লাগুক পারতে হবে। ব্যস, তারপর শুরু হলো স্ক্রীপ্ট মুখস্ত করা। বাসার কাজের লোকজন তো ভাবতো আমি পাগল হয়ে গেছি। তা না হলে সারাক্ষণ বিড়বিড় করবো কেন? তারপর এক সময় মঞ্চে এলো। সবাই-তো ভালোই বললো, কোলকাতাতেও ভালো রিভিউ হয়েছিল।
হাসান শাহরিয়ার
কোকিলারা- একা অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু সংলাপ তো ছিল প্রচুর, কিন্তু এরপর যে একা নাটকটি একা করলেন, সেখানে তো সংলাপই নেই। সেটা করতে গিয়ে ...
ফেরদৌসী মজুমদার
অসাধারণ! আমার এখনও একা অভিনয় করতে ইচ্ছা করে। জার্মান নাটক অনুসরণে মামুন ভাইয়ের একটা অসাধারণ স্ক্রীপ্ট, এটাতে কোনো সংলাপ ছিল না। আমাকে মুভমেন্ট মুখস্ত করতে হতো। মিউজিকের সাথে সাথে একেকটা মুহূর্ত তৈরি করা ... খুব কঠিন কাজ। শেষটাতে মেয়েটা আত্মহত্যা করে। আমাদের কেউ কেউ বলেছিল যে- শেষটা কিন্তু আশাব্যঞ্জক হলো না। এতে করে আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়তে পারে। চার-পাঁচটা শো-এর পর আমরা আলাপ করে ঠিক করলাম ... নাটকের শেষে বাউ করে আমি বলে দিতাম- জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া কিন্তু সমাধান না, মৃত্যু কোনো সমাধান না।
বিপ্লব বালা
এখানে এখন আর যুদ্ধ এবং যুদ্ধ কেমন লেগেছিল? মানে স্ক্রীপ্ট, প্রোডাকশন সব মিলিয়ে?
ফেরদৌসী মজুমদার
এখানে এখন আমরা খুব পছন্দ করেছিলাম, কিন্তু দর্শক ওভাবে নেয় নি। এটা তো ভার্স প্লে, আমাদের কাছে খুব ভালো লাগতো। খুব সুন্দর সুন্দর কথা, কিন্তু একটু উচ্চ মার্গের কথা ... দর্শকের মাথার উপর দিয়ে হয়তো চলে যায়। আর যুদ্ধ এবং যুদ্ধ খুব ভালো লেগেছিল। দর্শকদেরও ভালো লেগেছিল। সেখানে শান্তা খুব ভালো অভিনয় করেছিল। আমি করেছিলাম গ্রামের একটা খুব সরল মহিলার চরিত্র।
হাসান শাহরিয়ার
নির্দেশনার কাজ আপনি কেমন এনজয় করতেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
অভিনয়ের চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি এনজয় করতাম না। এটা খুব কঠিন কাজ। তবে নির্দেশনা দিতে গিয়ে আমি বুঝেছি যে- অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভেতরে মালমসলা না থাকলে পিটিয়েও কিছু বের করা যায় না। আর নির্দেশনার কাজে আমি আগ্রহীও ছিলাম না, মামুন ভাইয়ের চাপে পড়ে দিতে হয়েছে।
বিপ্লব বালা
মেরাজ ফকিরের মা-তে অনেকদিন পর বোধহয় বড় কোনো অভিনয়ের সুযোগ পেলেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, আর চরিত্রটা পছন্দও হয়েছে। এটা আসলে মামুন ভাই লিখেছিলেন অন্য একটি সংগঠনের জন্য। তো সেই সংগঠন চাইলো যে, মেরাজ ফকিরের মা যেহেতু হিন্দু, এই ইস্যুটা বাদ দিতে। মামুন ভাই রাজি হলেন না, কারণ, এটা বাদ দিলে তো আর নাটক থাকে না। পরে আমাকে পড়তে দিলেন। আমি আবার নাটক পড়ার আগে পাতা উল্টিয়ে দেখি যে আমার কোনো চরিত্র আছে কিনা। তো পড়ে তো আমি খুবই ইমপ্রেসড। বললাম এই নাটক কাউকে দেয়া যাবে না। আমরাই করবো। দর্শকও কিন্তু এই নাটকটা ভালোভাবে নিয়েছিল।
হাসান শাহরিয়ার
আপনার অনেক কথাতেই কিন্তু দর্শকের ব্যাপারটা চলে আসছে। তো আপনি নাটক করতে গিয়ে বা অভিনয় করতে গিয়ে দর্শকের কথা কতটুকু মাথায় রাখেন? মানে কী মনে হয়, দর্শক নাটক দেখতে আসে কেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
নাটক ও দর্শক অবিচ্ছেদ্য। দর্শক ছাড়া নাটক অকল্পনীয়। যেকোনো অভিনেতা অভিনেত্রীর মাথায়, তার অবচেতন মনে দর্শকের একটা বিরাট অূমিকা থাকে। দর্শকের জন্যই তো আমি অভিনয় করি। তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যই আমার আপ্রাণ চেষ্টা থাকে।
হাসান শাহরিয়ার
মুক্তি নাটকের সময় তো আপনি অসুস্থ। তারপরও করতে হলো কি মেয়ের চাপে?
ফেরদৌসী মজুমদার
তাতো অবশ্যই। আমার মেয়ের কথা হচ্ছে- তুমি শেষ জীবন পর্যন্ত অভিনয় করে যাবে। প্রয়োজনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অভিনয় করবে। তো তার কথাতো রাখতেই হয়। করার পর ও খুব খুশি হয়েছিল। তবে ও খুব কড়া নির্দেশক। আমাকে রাজি করানোর সময় কত অনুনয় বিনয়, আর যখন মহড়া শুরু হলো, তখন একটু দেরিতে গেলেই বাঁকা চোখে তাকাতো। বলতো- তুমিই যদি দেরি করে আসো তো অন্যরা কী করবে? ওর এসব ব্যাপার অবশ্যই আমাকে আনন্দই দেয়। সংগঠনের কাজগুলোও ও ভালোভাবে করে, ওর বাবার মতো।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি এমনিতে পড়াশোনা কেমন করেন, বাসায়?
ফেরদৌসী মজুমদার
না, একদম না। আমার অভ্যাস নেই বেশি। আসলে সময় পাই না। নাটক, চাকুরি, সংসার ... তারপর আর সময় কোথায় বল?
হাসান শাহরিয়ার
টেলিভিশন দেখেন?
ফেরদৌসী মজুমদার
হ্যাঁ, পুরোনো ছবি দেখতে ভালো লাগে। উত্তম কুমারের ছবি হলে এখনো চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি।
হাসান শাহরিয়ার
আপনাদের প্রজন্মের থিয়েটারকর্মী আর এখনকার থিয়েটারকর্মী, কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে?
ফেরদৌসী মজুমদার
আসলে জীবন অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। অনেক কঠিন হয়ে গেছে। এখনকার শিল্পীদের সিনসিয়ারিটি নিয়ে একটু আক্ষেপ তো হয়-ই। আবার ভাবি যে, এই বৈরি সময়ে থিয়েটার করে যাওয়াও-তো অনেক কঠিন। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় আগে যেমন ছিল, এখনও আছে, সেটা হলো, থিয়েটারকে কিছু মানুষ জীবন দিয়েই ভালোবাসবে এবং তারাই থিয়েটারটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
হাসান শাহরিয়ার
গ্রুপ থিয়েটার চর্চার ব্যাপারে আপনার মত কী? এভাবেই চলবে? প্রফেশনাল হওয়ার ব্যাপারে আপনার কোনো চিন্তাভাবনা আছে।
ফেরদৌসী মজুমদার
এভাবে চলা খুব কঠিন। আবার প্রফেশনালিজমের ব্যাপারে অনেক আগেই অনেকে উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু পারে নি। আমার মাথায় ঠিক আসছে না যে, কীভাবে প্রফেশনাল থিয়েটার করা যায়, কিন্তু এটার প্রয়োজন সেটা বুঝতে পারছি।
হাসান শাহরিয়ার
একেবারে শেষদিকে এসে আপনাকে এমন একটি প্রশ্ন করছি যা কেবল আপনার জীবনের ট্র্যাজেডি না, বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি। আপনি প্রথম শুনলেন যে- মুনীর চৌধুরী আর নেই, তাকে আমাদের দেশীয় রাজাকার বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে, আপনার ঐ সময়ের রিয়েকশন এবং ৩৪ বছর পরের রিয়েকশন একটু বলুন।
ফেরদৌসী মজুমদার
৩৪ বছর আগে যখন মুনীর ভাইকে হারাই, তখন কিন্তু বাংলাদেশের সম্পদ হিসেবে হারাই নি। তখনকার অনুভূতি ছিল একান্তভাবে আমার একটা প্রিয় প্রতিভাবান ভাই হারাবার বেদনা। তাঁকে আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায় ১৪ ডিসেম্বর, আর যখন শুনেছিলাম, সেদিন ছিল ১৬ ই ডিসেম্বর। রাতে একটা নেমনতন্ন খেয়ে ফুরফুরে মনে আমি এবং তোমার দাদা দিল্লীর বাড়ি ফিরে এসেছি। স্বাধীন দেশে ফিরে যাওয়ার এক অপার আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে ঘুমুতে যাব, তখনই এ মর্মান্তিক খবরটা রেডিও তে শুনে তোমার দাদা আমাকে দিলেন। আমার যে কী হয়ে গেল আমি আজও বলতে পারবো না। সারারাত তো কাঁদতে কাঁদতেই কেটে গেল। হয়তো বা দেশে সবার সাথে থাকলে দুঃখটা ভাগ করে নেওয়া যেত। তখন ঢাকায় টেলিফোনে কাউকে পাওয়াও খুব কঠিন ছিল। ফলে এটা সেটা ভেবে, ভাই হারাবার ব্যথাটা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। একসময় আমি বোধহয় ৩/৪ রাত না ঘুমিয়ে একটু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। সেসময় বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন আমার ভাই-বোনের ফরাসী শিক্ষক মাদাম গুস। তখন মায়ের ভূমিকাটা তিনিই পালন করেছিলেন। আমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে, সেবা করে সুস্থ করে তুলেছিলেন। যা হোক ভারাক্রান্ত ও ক্লান্ত হৃদয়ে আমরা মধ্য জানুয়ারিতে ঢাকায় ফিরে এলাম। কিন্তু মুনীর ভাইকে আর পেলাম না। বহুদিন আমাদের সবারই আশা ছিল- বোধহয় ওনাকে আবার ফিরে পাবো। কিন্তু একসময় সে-আশাও ক্ষান্ত দিলাম।
যত দিন যেতে লাগলো ততই ভাই হারাবার ব্যথাটায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। কারণ, শুধু আমার ভাই-ই তো নয়, আরও কত কত জ্ঞানী-গুণী লোককেই তো পাকিস্তানীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আর তা ছাড়া একটা দেশকে খোঁড়া করতে, পঙ্গু করতে শত্রুরা এঁদের প্রাণই তো হরণ করবে, তোমার আমার প্রাণ তো নয়- এই হচ্ছে আজকের সান্ত্বনা আমার।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা কয়েকদিন আপনার কাছে আসলাম, কথা শুনলাম। এই অসুস্থ শরীর নিয়েও আমাদের নাট্যজনদের জন্য কিছু বললেন, আপনাকে সব নাট্যজনদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।
ফেরদৌসী মজুমদার
তোমাদেরকেও ধন্যবাদ। আমি চাই যারাই থিয়েটার করো, মন দিয়ে করো। কষ্ট যেহেতু করছোই, কষ্টটা যেন কাজে লাগে। ধন্যবাদ।