Full premium theme for CMS
অন্য চোখে আলাপন।। ছয় আলাপনের আলাপন
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
থিয়েটারওয়ালার জুলাই-সেপ্টেম্বর’০৫ ও অক্টোবর-ডিসেম্বর’০৫ সংখ্যায় তিন-তিন মোট ছয়জনের আলাপন ছাপানো হলো। এটি নিঃসন্দেহে একটা পরিশ্রমলব্ধ-চমৎকার আয়োজন। এই আলাপনে অংশ নিলেন সাঈদ আহমদ, রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, আলী যাকের, মামুনুর রশীদ ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ।
সাঈদ আহমদের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করলেন থিয়েটারওয়ালার সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার ও শফি আহমেদ। তিনি আমাদের নাট্য-অঙ্গনের একজন বিদগ্ধজন। আমাদের নাট্যজগতকে বাইরের জগতের সাথে চেনানোর এক প্রবাহমানতা যেন। এমনই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অনেক বিষয়ই জানা গেল। নাটকের তৎকালীন ইতিহাস, আন্তর্জাতিক নাটক সম্পর্কে অনেক প্রাণবন্ত বিষয় এতে স্থান পেয়েছে। তবে কথা হচ্ছে, এ সবের অনেক কিছুই আমরা ইতোপূর্বে নানাভাবে জানি। তিনি বিটিভিতে বিশ্বনাটক নামে একটা অনুষ্ঠানই করতেন। সাময়িকীতে প্রায় নিয়মিতই লিখে থাকেন। তাঁর দেয়া সাক্ষাৎকারও আমরা ইতোপূর্বে পড়েছি। যার ফলে তার বলা কথার অনেক কিছুই পুনঃকথন মনে হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে হোম-ওয়ার্ক তত জোরালোভাবে করা হয়নি। এটিই বোধ করি এ আলাপনের বড়ো দুর্বলতা। তিনি অনর্গল কথা বলে গেছেন, এই দুজনও প্রায় অনর্গল কেবলই কথা শুনে গেছেন। মুগ্ধতার ভিতরই সাক্ষাৎকারটি শেষও হয়। নিজেরা নিবিড়ভাবে তেমন কিছুই জানতে চাচ্ছেন না। পাল্টাকথা শুধু নয়, দ্বিমতও তাদের আছে বলে মনে হয় না। এমনকি তিনি যখন তার প্রিয় নাট্যব্যক্তিত্বদের নাম করেন, তাতে সেলিম আল দীন, মামুনুর রশীদ, মমতাজউদদীন আহমদের নামও নেন না। কেন? আমরা বুঝতে পারি না! তিনি এও জানালেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নাটককে এবসার্ড বলা যাবে না। কেন? এটা ঠিক, অস্তিত্ববাদ বিশেষ করে নীৎশের অস্তিত্ববাদ তাঁর নাটকে আছে। কিন্তু তাঁর নাট্যপ্রবাহে কি এবসার্ডিটি নাই? আছে। সাঈদ আহমদ তো তাঁর সৃজনশীলতা নিয়েও আলোচনার সুযোগ পেলেন না। মাইলস্টোন, কালবেলা, তৃষ্ণায়, একদিন প্রতিদিন, বিশেষ করে শেষ নবাব সম্পর্কে অনেক আলোচনাই হতে পারত। শেষ নবাব তিনি লিখলেন ৭৮-৮৮ সালে। তার মানে, এ কাজে তিনি দশটি বছর ব্যয় করলেন। এ নিয়ে কিন্তু কোথাও যথার্থ আলোচনা হয়নি। শচীন সেনগুপ্ত, শিশিরকুমার ঘোষ, শামসুদ্দীন আবুল কালামের সিরাজউদ্দোল্লা থেকে এটি কেন আলাদা, তাও আমরা জানতে পারতাম। তার অন্য নাটকগুলোওতো বেশ উল্লেখযোগ্য।
আতাউর রহমান আর রামেন্দু মজুমদার একধরনের মোহাচ্ছন্নতার ভিতর তাদের কথাবার্তা বলে গেছেন। তারা তাদের নাটকের ও ব্যক্তিগত ইতিহাস জানালেন। কথা থাকলে যেভাবেই হোক অনেক কথাই বলে নেয়া যায়। তাই বলেছেন রামেন্দু মজুমদার। ব্যক্তিজীবন, পড়াশোনা, চাকুরি, ফেরদৌসি মজুমদারের সাথে পরিচয়-পরিণয়, এসব তো তার জীবনের গায়ে-গায়ে লেগে থাকা অনেকটাই আটপৌরে কথা। তিনি নাট্যসংগঠনের মেলাদিক, থিয়েটারের কথা, এর ভাঙনের কথা, নিজেদের সাফাই গাওয়ার স্পৃহা, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান করার তাগিদ, আন্তর্জাতিক নাট্যভূবনের সাথে একধরনের যোগাযোগ, নাটকের পত্রিকা করা, নাটকের জন্য মঞ্চের বাইরে থেকেও অনেককিছু করার মানসিকতা তার আছে বলে জানালেন। সাঈদ আহমদের সাক্ষাৎকারের মতোই এটিও খুব বেশি অর্গানাইজড নয়, তবে তথ্যগুলো বেশ পরিষ্কার। তবে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কাজ নিয়ে, গ্রুপের ভাঙন নিয়ে আরও নানান বিষয় জানা যেত। ম্যাকবেথ করার বিষয়ে আলী যাকের বললেন একত্রে মানসম্পন্ন অভিনয় করার কথা, আবার রামেন্দু মজুমদার জানালেন ব্রিটিশ কাউন্সিল কর্তৃক দেয় অনুদানের কথা। আবার থিয়েটারের বিদেশ গমন, গমনের নানান পর্যায়, ভাঙন নিয়ে তবিবুল ইসলাম বাবু বললেন ভিন্ন কথা। এখানে আরও একটা ব্যাপার জানা বা বোঝা যায়, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের শো করার নিমিত্তে যাওয়া-আসার খরচ আদায়ের বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য রামেন্দু মজুমদার আর তবিবুল ইসলাম বাবু বিএনপি অফিসে গেলেন। রাত ২টায় জিয়াউর রহমান এসে সংস্কৃতি মন্ত্রীকে ফোনে কথা বলে তা ঠিক করে দিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই যে দেশের একজন প্রেসিডেন্ট রাত ২টায় একটা নাটকের দলের জন্য এ কাজটি করলেন, তাতে কিন্তু রামেন্দু মজুমদারের কোনো কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ পেল না। মনে হচ্ছে, জিয়া কোনো হলের মালিক বা তাঁর কোনো খেয়াল-ঠাট্টাধরনের আত্মীয়। আসলে তাঁরা কথা বলার আগে নিজেদেরকে প্রগতিশীল-অসাম্প্রদায়িক করে নেন, এবং সেইভাবে উত্তর সাজান। আবার নিজেদের পছন্দের দলকে খুশি করার একখান চেতনাও থাকে। কথা হচ্ছে, একজন সামরিক শাসকের রাজনৈতিক অভিলাষ, শ্রেণীচরিত্র নিয়ে অনেক কথাই উঠে আসে, কিন্তু সামাজিক ইতিহাসকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। কারণ এসবের তো ডকুমেন্টস আছে। জিয়ার সাথে সেই সময়ে হাসান ইমাম, গোলাম মোস্তফা থেকে শুরু করে অনেক অনেক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সৈনিকের একটা প্রীতির সম্পর্ক ছিল। সমকালে কাউকে খুশি করার মানসে তা যদি কেউ বাই-পাস করতে চান সেটা প্রকৃত ইতিহাস হয় না। আর সিউলে যাওয়ার ব্যাপারে কতভাবে দৌড়াদৌড়ি তারা করেছেন, তাতো তবিবুল ইসলাম বাবু এক্কেবারের অনুপুঙ্খভাবে বললেন। আসলে আমাদের সমাজে এক্সাম্পল-পার্সনালিটির খুব অভাব। কায়েস আহমেদের উপন্যাস দিনযাপন-এ সরজুবালা (!) নামের একটা চরিত্র মনোতোষ মাস্টার নামের বামপন্থি চরিত্র সম্পর্কে অনেকটা এভাবেই (!) বলে যে, আমি তো রাজনীতির এতকিছু বুঝি না, শুধু দেখি মানুষটা খুব ভালো। তো, আমরাও সমাজের সবক্ষেত্রে বিশেষ করে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রের মানুষগুলোকে এক্সাম্পল-পার্সন হিসেবে দেখার বা বোঝার স্বাদ জাগে। কিন্তু বাস্তবে কী শুনি - পাশের রাজ্য কোলকাতা গিয়েও অনেকেই (সবাই নন নিশ্চয়ই - প্রকৃত গুণী শিল্পীকে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানাই) দামি শাড়ি-কাপড়ের ভাঁজ ভেঙে-ভেঙে চোরাকারবারির মতো লুকিয়ে হরহামেশা নিয়ে আসেন। এধরনের কথা যখন আমরা, মানে নাট্যজগতের বাইরের মানুষেরা শুনি, তখন অবাক হওয়া ছাড়া আমাদের পথ থাকে না।
আলী যাকেরের সাক্ষাৎকার থেকে তাঁর বেড়ে ওঠা, বাবার চাকুরিসূত্রে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ, নাটকের সাথে জড়িয়ে পড়া, মঞ্চনাটকের সাথে তার সম্পর্কের কথা জানতে পারি। তবে এই সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে, এখানেও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদ্বয়ের হোম-ওয়ার্ক খুব বেশি ছিল না। যার ফলে আলাপনের মৌলস্বরটাই বিঘ্ণিত হয়েছে। এটিও মূলত হয়ে পড়েছে কথনসাহিত্য, অর্থাৎ আলী যাকেরের কথা প্রায়ই এরা শুনেই গেলেন। কাউন্টার প্রশ্নই একটা আলাপনের সবচেয়ে দরকারি জায়গা। আর এডিটিংটাও সেইভাবে সাজানো দরকার। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় অনেক কথাই শুনে যেতে হয়; অনেক কথা মুখ, হাত, পা, বা সর্বাঙ্গের ইশারায় ধরে নিতে হয়। এখানে যতকথা যেভাবে জানানো হলো, তার অনেককিছুই সংক্ষেপে জানানো যেত বা বাদও দেয়া যেত হয়ত। কিন্তু সবই সরল-সোজাভাবে আমাদের শুনে যেতে হলো। ২৯ পৃষ্ঠার এই আলাপনকে ১৪-১৫ পৃষ্ঠায় হয়ত নিয়ে আসা যেত। অনেক ক্ষেত্রেই আবার প্রশ্নটিকে যথার্থভাবে ধরা হয়নি। যেমন, আলী যাকের জানাচ্ছেন, আরণ্যক ছেড়ে নাগরিক - তাই তো আসা যায়। এধরনের তথ্যকে হেঁয়ালিভাবেই নেয়া যায়। কিন্তু আমরা যদি ৭২-৭৪ এর সমাজ-বদলানোর সংগ্রামশীলতাকে দেখি তাহলে নাগরিক তখন অতিশয় এক অনির্দিষ্ট নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ পরিচ্ছন্ন এক নাট্যদল মাত্র। মানবমুক্তির সার্বিক আন্দোলনে তাদের তেমন দেখা যায়নি। সেই ধরনের নাটকের প্রতি তাদের আগ্রহও ছিল না। আরণ্যক তখন বিপ্লবের আলোড়নে রীতিমতো টগবগ করছে। কাজেই আলাপন গ্রহণকারী যখন অনায়াসে এ কথাকে ছেড়ে দেন, তখন ধরতে হবে, সমাজ বদলানোর স্পিরিট সম্পর্কে তাদের তেমন আগ্রহ নেই। আবার দেখা যাচ্ছে, দেশগড়ার বিষয়ে তিনি খুব জোর দিচ্ছেন, তা তো দরকারই। কিন্তু সেই সময়ের সামাজিকতা, রাষ্ট্রীয় অবস্থার ভিন্ন চিত্রও ছিল। তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়া বিপুল যুবসমাজ রাষ্ট্রের ইকোনোমিক সিস্টেমকে ভেঙে দেয়ার কাজে দারুণ তৎপর ছিল। আর সেই সময় আলী যাকেরের কাছে চাকুরিগ্রহণের মতো ছা-পোষা আব্দার আসছে। তিনি অচলায়তন নাটকে প্রতিবাদের ব্যাপার বললেন। এর চুলচেরা বিশ্লেষণের জায়গা এটি নয়, তবু বলতে হয়, কথা হচ্ছে, এখানে যেমন প্রতিবাদের ধরন আছে, তেমনি সামন্ত-আবেশের কাছে আত্মসমর্পণও কম নেই। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমার তো মনে হয়েছে অন্তত দুইটা জায়গাই আলাপনের সিরিয়াসনেস অনেকটা খামোকাই ভিন্নদিকে বাঁক দিয়েছে। ১. নুরলদীনের সারাজীবন-এ আলী যাকের সৈয়দ হকের কণ্ঠ দ্বারা প্রভাবিত হলেন। কারণ সৈয়দ হক প্রথমেই সবাইকে তার চমৎকার কণ্ঠ দিয়ে নাটকটির পাঠ দিতেন। বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এ নিয়ে কণ্ঠের ব্যবহার, ইতিহাস, এর প্রভাবের ঐতিহাসিক ধরন ইত্যাদি নিয়ে আরও বিষয় জানার আগ্রহ তৈরি হয়। নির্দেশক সৈয়দ হকের এ বিষয়টি থেকে তার কুশীলবদের কীভাবে রক্ষা করতেন, বা করেছিলেন কিনা, আমাদের জানা নাই। রবি ঠাকুর যে নাটকে মানসম্মত ভাষার ব্যাপারে মতামত জানালেন, এ নিয়েও নাটকের আলাপনে অনেক কথা জানার স্পৃহা জাগ্রত হয়। ২. সামন্ত ধারার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ রবি ঠাকুর - তার দরকার দরবারি মান-সম্মত ভাষা। ভাষার প্রাকৃত বা অপভ্রংশের রূপ খুঁজে নেয়ার এই কালে শুধু রবি ঠাকুরের ভাবনা নিয়ে কালযাপন করা যুক্তিযুক্ত কিনা তা ভেবে দেখতে অনুরোধ করব। নাটকের মতো জীবন-অন্বেষী একটা মাধ্যমের ভাষা ভদ্রলোকিত্ব থেকে জনমানসের ভাষাভিত্তিক সংস্কারকে মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে অনেক কাজই করতে পারে।
নাটক করার ফলে লাইফটা হলো ইন্টারেস্টিং, মিনিংফুলও- আতাউর রহমানের নাট্যবিষয়ক এ-ধরনের অবজার্ভেশনকে এভাবে দেখলে, দেখার সিদ্ধান্ত নিলে, তার পার্সনালিটির ব্যাপারে একটা মীমাংসা হয়ত আমাদের হয়ে যায়। কিন্তু তারচেয়েও অনেক কথা, অনেক মিনিংফুল ইতিহাস তিনি অবলীলায় বলে গেছেন। তার বলার ধরনটা ভালো। ডিপ্লোমেসি নেই, অহঙ্কার নেই। কিন্তু এভাবে কথা বলার কী যে যন্ত্রণা তা তো থিয়েটারওয়ালার পরের সংখ্যাতেই বোঝা গেল। তবে এ কিন্তু সত্যি, শিল্প-সাহিত্যের বিশুদ্ধ লোকগুলো খুবই সেনসিটিভ, একধরনের মাতাল-হাওয়ার ভাব তাদের থাকে। জাগতিক দিক নিয়ে ভাবলে তারা তো কিছুই যখন পান না, তখন কোনো ধরনের অবহেলাই তারা সহ্য করতে পারেন না। এ জন্যই হয়ত শ্যামা থেকে শ্যামাপ্রেম, বা এর প্রযোজনার ধরন নিয়ে তাঁর কথাকে গ্রহণ করতে পারেননি অনন্ত হিরা। বিষয়টা আবার দুইজনের দিক থেকেই গ্রহণযোগ্যও হয়ে যায়। এখানেই বোধহয় ব্যক্তির নানামুখী মতামত আলোকপাত করার সম্ভাবনার কথাও ওঠে। তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে একটা বিষয় উঠে আসে, মানে ইতিহাসও জানতে পারি; সেই ইতিহাস আবার থিয়েটারওয়ালার পরের সংখ্যার আলী যাকেরের সাথে অনেক জায়গায় মিলে যায়। কারণ এ দুজন তো নাট্যভূবনে একই বংশজাত। তবে তাদের ভাবনা-চিন্তা, বেড়ে ওঠার বিষয় কিন্তু বেশ আলাদাও। আমার তো এমনই হয়, তিনি অনেক সিরিয়াস নান্দনিক বিষয়কে এত চড়াই-উৎরাই পেরোনো জীবনেও ধারণ করতে পারছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, বেশ প্রাণবন্ত একটা ইন্টারভিউ এটি। রামেন্দু মজুমদার আর আতাউর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলেন বিপ্লব বালা ও হাসান শাহরিয়ার।
আলী যাকেরের আলাপনটি যে-কারণে ফ্যাকাসে মনে হয়েছে, মামুনুর রশীদের সাথে আলাপনে এর বিপরীতটিই মনে হয়েছে। এটি একটি জলজ্যান্ত আর পরিপক্ব সাক্ষাৎকার। এবং তা সম্ভব হয়েছে আলাপন গ্রহণকারী আজাদ আবুল কালাম, বিপ্লব বালা ও হাসান শাহরিয়ারের দরুণ। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, আজাদ আবুল কালামের ইন্টারোগেশনই এটিকে এতো প্রাণময় করেছে। এখানেই ব্যক্তিত্বের প্রশ্নটি চলে আসে। কারণ সাক্ষাৎকারটি পড়লে এটা অতি সহজেই বোঝা যায়, আজাদ আবুল কালামের পড়াশুনা, প্রশ্নের ধরন, মামুনুর রশীদের ব্যাপারে জানার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। এমনকি এও বোঝা যায়, মামুনুর রশীদের যেন প্রস্তুতিই ছিল এইভাবে যথার্থ কথাটি যথার্থ ভাবাবেশ নিয়েই বলতে হবে। এতে মামুনুর রশীদের চমৎকার, মোহনীয় শৈশব, রাজনীতি, নাটক করার তাড়না, দর্শন, নিজেকে একটা জায়গায় রাখার ইচ্ছাশক্তিই তাকে একটা অবস্থানে নিয়ে রেখেছে। এটিই থিয়েটারওয়ালার একটা আদর্শ-আলাপন।
নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন বিপ্লব বালা ও হাসান শাহরিয়ার। এতে তাঁর শৈশব-কৈশোর-রাজনীতিক চিন্তাচেতনা, নাটকের প্রতি টান, ঢাকার নাটকের সার্বিক ইতিবৃত্ত জানা গেল। জানা গেল, নাট্যচক্র ও ঢাকা থিয়েটারের অনেক কথা। জীবনইতিহাসে তার বড়ো বৈশিষ্ট্যযুক্ত অংশ হচ্ছে মুুিক্তযুদ্ধে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। ঢাকা থিয়েটারবিষয়ক আলোচনাটা আরও সামগ্রিক হ’ত যদি এতে অভিনেত্রী সুবর্ণার আগমন, কাজের ধরন, আবারও দল ছেড়ে দেয়ার বিষয়টা নিয়ে আরও কথা বলা যেত, কথা বলা যেত মানে আমাদের মতো নাট্যজগতের বাইরের মানুষ হিসেবে এসব তো জানতে চাই। তবে অনেক বিষয়, যেমন ঢাকার নাটকের নানান তথ্য, গ্রাম থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটারের ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোই জানা গেল। তবে এই আলোচনায় অন্তত চার জায়গায় মূল আলোচনার বাঁক ফেরানো দেখলাম যা মোটেই যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। ১. তাঁর সাথে সিরাজ সিকদারের রাজনৈতিক আলোচনাকে গুরুত্ব না দিয়ে হাসান শাহরিয়ার থিয়েটারের শিল্পভাবনায় চলে গেলেন। অথচ সেই সময়ে বাম-আন্দোলনের নানান বিষয়. সামাজিক-রাষ্টনৈতিক বিষয়গুলো উঠে আসতে পারত। ২. বিপ্লবী সাহিত্য কেমন হওয়া দরকার, রবি ঠাকুরের অবস্থানটা তাতে কেমন হবে, এমন একটা জায়গায় বিপ্লব বালা ঢাকা থিয়েটার কর্তৃক প্রথম দুইটি নাটক করার দিকে চলে গেলেন। ৩. তিনি যখন নাট্য-শরীর নিয়ে কথা বলতে চাইলেন, তখন হাসান শাহরিয়ার সৈয়দ হক শুধুমাত্র সাহিত্যিক হয়েও কেন নাটক লিখতে গেলেন, তা জানতে চইলেন। ৪. তিনি একপর্যায়ে জানালেন তারা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ করেছিলেন, শম্ভূ মিত্র কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এ কাজটি তারা করতে চাইলেন। তো, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রেখে হাসান শাহরিয়ার তাঁর কাছে আলাদা করে জানতে চাইলেন গ্রাম থিয়েটারের নাটকের ধরন কেমন। এখন কথা হচ্ছে, এসবও জানার বিষয়, কিন্তু যে প্রশ্নগুলো শুনলে আমরা নিজেরাই অনেক উত্তর রেডি করে ফেলতে পারি, সেইসব প্রশ্নের গুরুত্ব বেশি হয়, নাকি নাটকের নান্দনিক-রাষ্ট্রনৈতিক-ইতিহাসভিত্তিক বিষয়ে জানাটা বেশি দরকারি?
তাঁর কাছ থেকে আরও একটা বিষয় জানার দরকার ছিল, তা হচ্ছে, নাট্য-নির্দেশনার শক্তির বিষয়টি। এখন তো এমনও শোনা যায়, স্ক্রীপ্টের চেয়ে নাট্যনির্দেশনাই নাটককে সমকালে নবতর প্রাণ দিচ্ছে। এর প্রমাণও কিন্তু আমরা পাই। যেমন সেলিম আল দীনের প্রাচ্য নাটকটি সাহিত্যমূল্যে এত শিল্পোত্তীর্ণ নয়। শাদামাটা বর্ণনার এক লেখা। কিন্তু তিনিই এটিকে নিয়ে গেছেন দারুণ সৌকর্যপূর্ণ জায়গায়। বাংলাদেশের নাট্যনির্দেশনা যাদের মেধা আর নিষ্ঠায় ভিন্ন মর্যাদা পেল, তিনি তাদের একজন।
তিনজনের সাক্ষাৎকার অর্থাৎ আলী যাকের, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ সম্পর্কে তিনধরনের অভিজ্ঞতা হয়। কিংবা তিনভাবে চরিত্রগুলো নির্ণিত হয়। আলী যাকেরকে রাজনীতির ভাষায় মনে হতে পারে রুচি-সহবাসের দ্যুতিময় পুরুষ। এ ধরনের সুধিজনের রুচি খুব হাল-আমলের, শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা ভালোই রাখেন, রবীন্দ্র ভাবনা খুবই ঝরঝরে, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কেও উচ্চমার্গীয় ধারণা রাখেন, জগতের এমন কোনো বিষয় নাই যা নিয়ে তাঁরা রুচিশীল-মার্জিত কথা বলতে পারেন না, রুচিকে পণ্য করতেও জানেন, দৃশ্যত অসাম্প্রদায়িক, মধ্যবিত্তের মূল্যবাধকে কখনও কখনও ইরিটেট করেন, এরা আবার অন্ত্যজ শ্রেণী সম্পর্কে সফ্ট কর্নারও লালন করেন! শিল্পবোদ্ধাদের কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন, এরা এনলাইটেট বুর্জোয়া। মামুনুর রশীদ মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের প্রতি বেশ দায়িত্ববান, কিন্তু নিদারুণ কাল তাঁকে থামিয়ে রেখেছে! নাসির উদ্দিন ইউসুফ যথার্থ পরিশীলিত, প্রগতিশীল, নন্দনতত্ত্বের প্রতি দায়বদ্ধ একজন মানুষ। তিনজনের আলোচনা থেকে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের পার্সনালিটিও আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। আজাদ আবুল কালাম অনেকটা সাহিত্যমুখী, সাহসী, বিবেবচনাবোধও প্রবল। বিপ্লব বালা খুবই তীক্ষ্মমেধাময় আর নাট্যভাবনার এক মানুষ, হাসান শাহরিয়ার নাটকের ইতিহাস জানা, নানান তথ্য নেয়ার বিষয়েই প্রাধান্য দেন- অনেক তত্ত্ব-তথ্য জানার আগ্রহই বেশি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ অত্যন্ত সিরিয়াস, জীবননিষ্ঠ কাজ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ মানেই তো, ‘চল দোস্ত তিনার লগে কথা কইয়ে আসি’ নয়। এর একটা নান্দনিক, সৌকর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক দিক আছে। সেসবের অনেককিছুই থিয়েটাওয়ালা পূরণ করতে গিয়েও কোথায় যেন খানিক জড়োসড়ো হয়ে আছে। তবে কাজ হিসেবে তাদের একধরনের চলমানতা আছে। মানে আমি বলতে চাচ্ছি, আলাপনের প্রথম সংখ্যাটি থেকে সংখ্যার আলাপন বেশ গোছানো। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ছয়টি আলাপনের শুরুতেই একটা ভূমিকা দেয়া আছে। এটি সুলিখিতই, তবে তা আরও স্পেসিফিক হলে ভালো লাগত। যেমন স্বাধীনতার পরের নাট্যচর্চায় সুস্থ ভাবনা-চিন্তার কথা তারা ‘মানুষ’ হবার আকাক্সক্ষার কথা বলা হলো, মঞ্চনাটকের ব্যাপারেই শুধু জোর দেয়া হলো। তো, সুস্থ চিন্তা-ভাবনা বলতে থিয়েটারওয়ালা কী বোঝাচ্ছে? এর তো একটা নির্দিষ্ট রূপ থাকা দরকার। ‘মানুষ’ হওয়ার বিষয়টাও স্পেসিফিক নয়। শুধু মঞ্চনাটকের উপর কেন জোর দেয়া হচ্ছে! আমাদের নাটকের ইতিহাস, নাটকের লোকজ নানান ধারা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধে মঞ্চবিহীন নাটকের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আলাপনের সময় উল্লেখ করাটা কিন্তু দরকার ছিল। কারণ, একসময়ের কথা, আনন্দ, হাহাকারকে তো অন্য সময়ের উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। তবে ভাবলে অবাক হতে হয়, থিয়েটারওয়ালা প্রতি সংখ্যাতেই কী করে তিনজনের সাক্ষাৎকার ছাপাতে পারে! কারণ কাজটি খুবই পরিশ্রমসাধ্য। সাক্ষাৎকার নেয়ার প্রস্তুতি, গ্রহণ, ফিতা থেকে আবার কথায় রূপান্তর, কম্পোজ করা, এডিট করা- সে এক মহাযজ্ঞ। এই মহাযজ্ঞ যে কীভাবে থিয়েটারওয়ালা পরিবার সম্পাদন করছেন, ভাবতেই অবাক লাগে।
তবে থিয়েটারওয়ালাকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই একটা ব্যাপার মনে হয়, সাক্ষাৎকার বা আলাপন শুধু নয় একে প্রকৃত ছোটকাগজ করতে চাইলে তিন মাস পর-পর বের করার পরিকল্পনার বদলে আরও অধিক ও অনির্দিষ্ট সময় নিয়ে বের করা দরকার। আর সময়ের ব্যাপারটা মাথায় থাকলে ধারে-কাছের মানুষজনদের নিয়ে কাজ করতে হবে। ফেস-ভ্যালু খুঁজতে হবে, কম্প্রমাইজ তো করতেই হবে। এর কনটেন্ট, লেখার ধরন, প্রথাবিরোধিতার বিষয়েও আরও সচেতন হওয়া দরকার। প্রথাবিরোধী, প্রগতিশীল নাট্যভাবনাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া দরকার। ইতোপূর্বেও বলা হয়েছে, আলাপনও সময় নিয়েই করা উচিত। একটা পার্সনালিটি সম্পর্কে ভালোভাবেই স্টাডি করতেই তো বেশ সময় চলে যায়। এ সাক্ষাৎকারের পরিধি বেইলি রোড ছাড়িয়ে দেশব্যাপী, এমনকি আন্তর্জাতিক করা উচিত।
(৩০-০১-২০০৬)
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): গল্পকার, সম্পাদক- কথা (কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ)