Full premium theme for CMS
অন্য চোখে আলাপন।। এ প্রশ্নের জবাব কী : আলাপনে মামুনুর রশীদ প্রসঙ্গে
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নাটকও শ্রেণী নিরপেক্ষ নয়। মেহনতি জনগণের একজন হিসেবে জনগণের আশা পূরণের গল্প সম্বলিত নাটক দেখতে ভালো লাগে। আর এ বোধ থেকে নাটক দেখি, নাটক বিষয়ক লেখালেখি পড়ি, নাট্য সংগঠকদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ আলাপন শুনতে আগ্রহ বোধ হয়। সেদিক থেকে ‘থিয়েটারওয়ালা’র ৭ম বর্ষ পূর্তি সংখ্যায় আলী যাকের, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ এর মতো খ্যাতিমান নাট্য ব্যক্তিত্ব ত্রয়ের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে একটি প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করেছেন সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার। ধন্যবাদ তাকে।
স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য। এঁদের মধ্যে মামুনুর রশীদকে একজন গণনাট্য আন্দোলক হিসেবে অবিহিত করা যায়। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত নাট্যসংগঠন আরণ্যক নাট্যদলের মাধ্যমে ’৮০-র দশকে এদেশে নতুন আঙ্গিকের নাট্যচর্চা শুরু করেছিলেন। স্ক্রীপ্টবিহীন নাটক, গ্রাম বাংলায় ঘটে যাওয়া হাজারো শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতনের ঘটনা, সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকমুখে শুনে, সত্য ঘটনাকে নাটকের সংলাপে রূপান্তর করে সংশ্লিষ্ট এলাকাতেই অভিনয় করে নাটক প্রদর্শন করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ‘মুক্ত নাটক’ কনসেপ্ট এদেশে প্রবর্তন করেন। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রশিকা (এনজিও) ও ইউনিসেফের জনৈক কর্তার সহযোগিতার কথা তিনি আলাপনে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন-‘ ... ইউনিসেফের এক কর্তাব্যক্তি প্রয়াত ড. এম আর খান আমার ইবলিশ নাটক দেখে বললেন ওনার বাসায় যেতে। তারপর উনি বললেন- মানিকগঞ্জে যে কাজটা করেছি (দ্রঃ- মাটি কাটা মহিলা শ্রমিক দিয়ে, তাদের জীবনের বঞ্চনা, সুখ-দুঃখের কাহিনী অবলম্বন করে তাদের দ্বারা নাটক অভিনীত করানোর কাজটির কথা বলা হচ্ছে) সেটা আবার শুরু করা যায় কিনা। বললাম- যায়। তখন আমাকে কুমিল্লার বার্ডের ক্রিয়েটিভ ফ্যাকাল্টিতে কাজ করার সুযোগ দিলেন। সেখান থেকে কুমিল্লার মিয়াবাজার বলে একটা জায়গা আছে সেখানে কাজ করলাম। ... আমি যখন কাজ করতে গেলাম তখন আমি বললাম যে আমার সাথে আরো লোক লাগবে। তারা রাজি হল। আমি তখন আরণ্যক’কে নিয়ে গেলাম। মিয়াবাজরে কাজ করার পর বার্ডে শেষ দিন ওরা কদম আলী করলাম। তারপর ওরা বললো আরো দশটি জেলায় কাজ করার জন্য। ... প্রত্যেক জেলায় যাওয়া আসা থাকা-খাওয়া মিলিয়ে তখনকার সময়ে দশ হাজার টাকা দিত। .... ওরা যখন ফান্ডটা তুলে নেয় তখন থেকে সারা বাংলাদেশব্যাপি মুক্তনাটক দল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করি। ওখান থেকে যে টাকাটা বেঁচেছিল সেটা দিয়ে শুরু করলাম। পরে যেখানে যেতাম, ওখানে স্থানীয় লোকজনই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিত।’
মামুনুর রশীদের এ বক্তব্য থেকে যে সত্যটি বের হয়ে এসেছে তা হল তাঁর মুক্তনাটক এনজিও-র অর্থ সহায়তায় প্রথম দিকে শুরু হলেও শেষে এনজিও আর সহায়তা না দিলেও তিনি কিছুদিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় জনগণের সহায়তায় মুক্তনাটক করেছেন। এই জনগণ কারা? এরা হয় কোনো এনজিওভুক্ত নতুবা কোনো প্রগতিশীল গণসংগঠনের মানুষ।এনজিও-রা যে মুক্তনাটকের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও অন্যায়ের প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে একে আর বিকশিত করতে চান নি, তা তাদের ফান্ড উঠিয়ে নেয়া দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না। পক্ষান্তরে প্রগতিশীল গণসংগঠন তাঁর মুক্তনাটক প্রচেষ্টার সাথে সক্রিয় ছিল। যেমন বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন (বর্তমানে- বাংলাদেশ কৃষক ও গ্রামীণ মজুর ফেডারেশন)- এর সাংগঠনিক এলাকা কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, মেহেরপুরের গাংনি, এবং খুলনা জেলার ডুমুরিয়া অঞ্চলসমূহে এ সংগঠনের সহায়তায় মুক্তনাটক অভিনীত হয়েছে। ঐ কৃষক সংগঠনের স্থানীয় সদস্যরা নাটক করেছে, আরণ্যকের নাট্যকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। মামুনুর রশীদ ও মান্নান হীরা ডুমুরিয়াতে, রেজা রুস্তক শিলাইদহে, নাসির উদ্দিন গাংনিতে অভিনীত মুক্তনাটক নির্দেশনায় শারীরিকভাইে উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তনাটক করতে গিয়ে সংগঠনের কর্মীদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার অংশবিশেষ উল্লেখ করছি। স্ক্রীপ্টবিহীন নাটকের মহড়া চলছে (শিলাইদহে)। কাহিনী এ এলাকার এক দরিদ্রব্যক্তির জমি কীভাবে এলাকার জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তি জাল করে নিয়েছিল, সেই সত্য ঘটনা। জমি জালের ঘটনায় যারা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, তাদের কেউ কেউ ঐ নাটকে অভিনয় করেছিল। এই ঘটনা নিয়ে যে সালিশ হয়েছিল তার একজন প্রভাবশালী সালিশদারও অভিনয় করেছিলেন। নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার ২/৩ দিন আগে থেকেই এলাকার প্রভাবশালী মহল, যারা জমি জালের সাথে জড়িত ছিল তারা নাট্যকর্মীদের হুমকি দিতে লাগলো, গরিব অভিনেতাদের বাড়িতে রাতে চুরি হতে শুরু হল, পরিস্থিতি এমন রূপ নিল যে, নাটক আর হয় না। এমতাবস্থায় ঐ এলাকার কৃষক সংগঠক নির্ধারিত দিনের আগেই নাটক মঞ্চায়নের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং যেদিন রাতে মুক্ত মঞ্চে নাটক অভিনীত হলো সেদিন এ এলাকার কৃষক সংগঠনের সব কর্মীকে দর্শক ও নাট্যকর্মীদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়েছিল। তবুও দু-একটা ঢিল স্টেজে পড়েছিল। তারপরও নাটক সফলভাবেই অভিনীত হয়েছিল।
এ ঘটনা বিস্তারিত বলতে হলো এ জন্য যে, শ্রেণী শোষণ-নির্যাতনকে স্পষ্ট করা এবং শ্রেণী দ্বন্দ্বকে প্রকটকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংঘটনের জন্য যদি গণনাটক করতে হয় তাহলে তা মঞ্চায়নের জন্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনের সাংগঠনিক এলাকার প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন শুধু নাট্যকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবার জন্য নয়, গণনাটক অভিনীত হওয়ার জন্যও প্রয়োজন। এনজিও-র পক্ষে এ দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়, সমীচীনও নয়।
এনজিও-রা শ্রেণী সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে, সমাজের মৌলিক সমস্যাকে স্পর্শ না করে, উপরিকাঠামোর দু-একটা ঘটনা নিয়ে তাদের অভিনয় দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছে। যেমন- যৌতুক, ফতোয়া, বহুবিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধে কিছু হালকা, হাস্যরসাত্মক নাটক তারা রুটিন কর্মসূচি হিসেবে করে চলেছে। উচ্চসুদে ঋণের ব্যবসার তীব্রতা আড়াল করার জন্য তারা এ ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে থাকে। দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে দেশের মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার একটা কৌশল হিসেবেও তারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক চর্চার এ ধারা অবশ্য ’৮০-র দশকে মামুনুর রশীদের মত নাট্য নির্দেশকদের হাত ধরেই শুরু হয়েছে।
তাঁর ভাষাতেই বলি- ’... যারা মুক্তনাটকের সাথে জড়িত ছিল, তাদের সবাইকে গণসাহায্য সংস্থা কিনে নিল। যারাই চাকুরির জন্য ওখানে গিয়ে বলতো- আমি মুক্তনাটক করি, তাকেই কিনে নিত। ... এখন ব্র্যাক, প্রশিকা, তারা সেইম আদলে করছে।’ তাঁর এ বক্তব্যের পর নিশ্চয়ই বলা যায় প্রথমে এনজিও তাঁকে (মামুনুর রশীদ) দিয়ে মুক্তনাটকের আইডিয়াটা (যেটা এনজিও-রই) বাস্তবায়ন করিয়ে নিল, এবং তার জন্য অর্থও ব্যয় করা হয়েছিল, তারপর তৈরি কর্মীদের পেয়ে গেল এনজিও। এখন তারা নাটকের মাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে একটা দর্শনই প্রচার করছে, তা-হলো প্রগতিশীল রাজনীতি এবং নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক কর্মীরা জনগণকে কিছুই দিতে পারে নি। যা কিছু দেবার এনজিও-রা এবং তাদের ডোনার-রা (মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর মালিকগণ) দিচ্ছে।
যে শক্তিশালী গণমাধ্যম শ্রেণী সংগ্রামকে শাণিত করার কাজে সহায়তা করতে পারতো, তা আজ এনজিও-র হাতে এসে প্রচার করছে এনজিও-র ঋণ নিয়ে ছাগল পালন করে জনৈকা হাজেরার জীবনের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার গল্প। জনৈক ঋণের ব্যবসায়ী (সরকারি ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে দরিদ্র জনগণের কাছ তা চড়া সুদে ধার দিয়ে আয় অর্জনকারী) বিদ্যমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন- এটাও কম নাটকীয় ঘটনা নয়।
শক্তিশালী এবং কালজয়ী নাটকের পটভূমির স্রষ্টা জনগণ। গণ আন্দোলন, গণনাটকের ভ্রুণ সৃষ্টি করে। গণ আন্দোলন যত শক্তি অর্জন করে তত বেশি প্রগতিশীল নাটকের জন্ম হয়। যেমন নীল চাষীদের সংগ্রামের পটভূমিতে নীল দর্পণ, তেভাগা আন্দোলনের মৃষ্টি নূরলদীনের সারাজীবন, ভাষা আন্দোলনের সৃষ্টি কবর, এমনকি ’৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতেও অল্প-বিস্তর নাটক সৃষ্টি হয়েছে। আজ গণ আন্দোলন সুসংগঠিত নয়। জনগণের শত্র“দের জয়জয়কার, তাই ভালো নাটকও সৃষ্টি হচ্ছে না, বিশেষ করে প্রগতিশীল বিপ্লবী নাটকের জন্ম হচ্ছে না। রাজনৈতিক ক্ষোভ, সৃজনশীলতার অভাব নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করছে। প্রগতিশীল আন্দোলনই সৃজনশীল গণনাটকের সৃষ্টি করে। আর এ গণনাট্য আন্দোলন পরিচালনার জন্য নাট্যকর্মীদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট আবশ্যক। ‘ওরা কদম আলী লিখেছি, ‘আমি কদম আলী’ তো লিখি নি’ বললেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না বা ‘আমি মার্কসবাদী, কমিউনিস্ট নই’ বললে শ্রেণী চরিত্র গোপন হয় না।
মামুনুর রশীদ বলেছেন-‘ ... বহুদিন বদরুদ্দীন উমর ভাই বলেছেন যে, আপনি টেলিভিশনে যান কেন? ... আয়ের উৎস না থাকলে চাঁদা তুলে খেতে হতো। যদি আমার মেধা থাকে, সেটাকে আমি সৃজনশীল কাজে লাগিয়ে আয় করবো না?’ নিশ্চয়ই করবেন, তবে জনগণের কাজ করতে গিয়ে জনগণের থেকে চাঁদা তুলে খাওয়াতে অমর্যাদা কোথায়? আপনি টিভিতে যে সব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর হালকা বিজ্ঞাপন দিয়ে আয় করেন নতুবা এনজিও থেকে টাকা নিয়ে সৃজনশীল নাট্য আন্দোলন করেন, মেধা বিক্রি করেন জন দুশমনদের কাছে, এটা আপনার কাছে মেধা বা প্রতিভার মূল্য মনে হলেও জনগণের জন্য সমূহ ক্ষতিকর কাজ।
অতিসম্প্রতিকালে বাংলাদেশের জনগণের উপর জঙ্গিবাদী হামলা, আখমাড়াই-র দাবীতে আন্দোলনরত কৃষকের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণ ও হত্যা, সার-বীজ-তেলের জন্য কৃষকদের আহাজারী, পল্লীবিদ্যুৎ-এর শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত জনগণের উপর পুলিশী হামলায় নিহত নবাবগঞ্জের বীর জনতার জন্য কি নাট্যকর্মীদের, সংগঠকদের কিছুই করার নেই? একটি নাটকও কি রচিত হতে পারে না, অভিনীত হতে পারে না? টিভি-র ঘেরাটোপে থেকে বের হয়ে না আসলে সৃজনশীল নাটকের অপমৃত্যু রোধ অসম্ভব। যিনি টিভি-র মালিক তার স্বার্থ বিরোধী কোনো নাটক কি টিভি-তে করা যায়? গ্রাম বংলার মুক্তমঞ্চ ছাড়া কি সৃজনশীল নাটক মঞ্চায়ন সম্ভব? আজকের বাস্তবতাই এসব প্রশ্নের জন্ম দিযেছে- এ প্রশ্নের জবাব কী?
অজয় কুমার বিশ্বাস : প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ। সহকারি অধ্যাপক (অর্থনীতি), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।