Full premium theme for CMS
অন্য চোখে আলাপন।। প্রসঙ্গ : থিয়েটারওয়ালার আলাপনে নাট্যব্যক্তিত্ব [প্রথম কিস্তি]
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যজনদের নিয়ে থিয়েটারওয়ালা ধারাবাহিকভাবে যে আলাপন তৈরি করে ছাপছে, সে-ই তো যথেষ্ট। তারপর এই নিয়ে আরো কিছু লিখবার অথবা বলবার প্রয়োজন আছে কি? এতো ওজনদার আলোচনার উপর আরো কোনো আলোচনা কি বিরক্তির সৃষ্টি করবে না পাঠকের মাঝে? এছাড়াও নাট্যশিক্ষক বিপ্লব বালা থিয়েটার নিয়ে লিখছেন- ‘মিলিতে হবে দুইজনে’ শিরোনামে কিংবা ‘দর্শকের মুখোমুখি নাট্যকার, নির্দেশক এবং কলাকুশলী’দের আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে লিখেছেন-‘অন্ধের হস্তি দর্শন’ শিরোনামে। এই কি যথেষ্ট নয়? লক্ষ্য করা যায় নাট্যজন বিপ্লব বালা তাঁর প্রায় সব লেখার মধ্য দিয়ে একটা কথা বলবার চেষ্টা করেন যে- আমাদের নাটকের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অন্যের মতামতকে জেনে, বুঝে, শুনে- প্রয়োগ কর্মটার সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জনের মাধ্যমে একটা ভিন্নমাত্রিক কমিউনিকেশনের পথ সৃষ্টি করা যায় কিনা? কমিউনিকেশনের এইসব বিষয় নিয়ে নাট্যকার, প্রযোজনা সংশ্লিষ্ট মানুষ এবং দর্শক- এদের মাঝে কার কী ভূমিকা থাকতে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একেবারেই নিরপেক্ষভাবে, নাটক এবং দর্শকের পক্ষে অবিরাম লিখে যাচ্ছেন বিপ্লব বালা। যারা পড়বার তারা পড়ছেন, যারা বুঝবার তারা বুঝছেন এবং যাদের নেবার তারা কিন্তু নিচ্ছেন। এটা পুরোটাই মস্তিষ্ক প্রসূত, সৃজন ঘনিষ্ট বিষয়। আমি কীভাবে চলবো, কোন পথে চলবো, আমার জীবন দর্শন কেমন হবে- সেসব বলে দেবে আমার বিবেক, আমার মস্তিষ্ক। এই দুটো জায়গায় নাট্যকর্ম দিয়ে আমরা একটু নাড়া দিতে পারি মাত্র, কিন্তু করণীয় যা কিছু তা কিন্তু করবেন মানুষ; যারা দেখেন এবং যারা করেন অথবা এমনও হতে পারে দুই পক্ষের মিথষ্ক্রিয়ায় ঘটে যেতে পারে একটা কিছু।
তবে এ কথাও সত্যি যে- আমরা একটি জাতি, বার বার যুদ্ধ করেছি, রক্ত ঝরিয়েছি, স্বাধীনতা অর্জন করেছি, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু এতো কিছু করবার পরও যদি মানুষের দিকে ফিরে তাকাই তখন কিন্তু দৃশ্যমান হয় মানুষের মুক্তি আসে নি। আসলেই মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসে নি; অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ের মীমাংসা হয় নি, মানুষের চিন্তার মুক্তিও আসে নি। আমাদের সমাজের এই সব জলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি দেখে এখন যেটা সবচেয়ে বেশি করে অনুভূত হয় সেটা হচ্ছে মানুষ অতীতে যত সংগ্রাম করেছে, যত রক্ত ঝরিয়েছে, সম্ভবত মানুষের মাঝে সেই সংগ্রাম করবার এবং রক্ত ঝরাবার মতো একটি অবস্থা ছিল, বর্তমানে যেটা নেই। একে ঠিক হতাশাবাদ বলা যাবে না কখনোই। বাস্তব দৃষ্টে মনে হয় কেমন উদ্দেশ্যবিহীন পথ চলা আমাদের সবার। একটা সময় ছিল যখন মানুষ মানুষকে ডেকেছে, মানুষ সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে; যুদ্ধ করেছে, রক্ত ঝরিয়েছে। যুদ্ধ করবার আর রক্ত ঝরাবার অধ্যায়টা তখনই ছিল; এখন নেই। এখন তো কেউ ডাকে না- তাহলে সাড়াটা দেবে কে? মানুষের অধিকারের প্রসঙ্গটি এখন চলে গেছে রাজনীতিবিদদের পকেটে। তারা এটা নিয়ে ব্যবসা করে, ভোটে দাঁড়ায়, ভোট চায়, সংসদে যায়; কিন্তু মানুষের অধিকার থেকে যায় আষ্টে পৃষ্ঠে মানুষের সঙ্গে, যা মানুষকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় এবং এক সময় নিঃশেষ করে দেয়। এদেশের সমাজতান্ত্রীক দলগুলো কখনোই শেকড়ের মানুষদের সাথে গড়ে তুলতে পারে নি রাজনীতির বন্ধুত্ব। এক সময়ে একটা ডাক আসতো মধ্যবৃত্ত শ্রেণীর মধ্য থেকে, এই ডাকে যারা সাড়া দিতো তারাও মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই ছিল। সেই ডাকেই ভাষা এসেছে, স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু মানুষের মুক্তি আসে নি। একেবারে শেকড় থেকে শোষিত মানুষের জন্য ডাক শুনবার প্রতীক্ষায় আমরা দশকের পর দশক অতিক্রম করে দেখি সর্বত্রই চলছে কেমন খেলা খেলা। কে আর ডাক দেবে তবে? কে আসবে সেই ডাক শুনে?
সেইখানে নাট্যকর্মীরা একটি মিলনায়তনের মধ্যে মানুষকে ডাকে, কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক কথা তারা বলতে চায় নাট্যপ্রিয় মানুষদের কাছে। দৃশ্যত এই ক্রিয়াটিকে আয়োজনে ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু জেগে ওঠবার জন্য অথবা জাগাবার জন্য ক্রিয়াটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ। একবার যদি মিলে যায় দুই পক্ষ, তবে হয়তো মানুষই ডেকে উঠবে- ‘জাগো বাহে কুনঠে সবাই’। সব আশা, প্রত্যাশা, হতাশা নিয়েই তো নাট্যকর্মীরা আজো প্রতিনিয়ত ডাকে দর্শকদের- আসো, নাটক দেখো, আমরা যা বলতে চাই শোনো, সমাজ থেকে যতটুকু ক্ষত জোগাড় করতে পেরেছি ততটুকুই সাজিয়ে রেখেছি তোমাদের জন্য। আসো, দেখো। দেখতে দেখতে একবার যদি ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এই অনুভূতি- না, এই ক্ষত আর না!! তবেই হয়তো ঘটে যাবে প্রলয় কাণ্ড। সেই স্বপ্নেই মানুষজন প্রতিনিয়তই নাট্যকর্ম করে যাচ্ছেন মানুষের জন্য। শুধু নাগরিক মানুষের জন্য নয়, একেবারে শেকড়ে যে মানুষটি পুড়ে ছাই হয়ে বেঁচে থাকে, যার শিক্ষা নেই, অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, বেঁচে থাকবার কিছুই নেই, সেই সব মানুষের আগুন নেভাবার জন্য যদি কোনো নাট্যকর্ম করা যায়- সেই প্রত্যাশায় তাকিয়ে থাকি আমরা প্রতিনিয়ত। সবাই আজ কিন্তু মুক্তি চায়।
এই মুক্তির জন্য থিয়েটার এবং দর্শকের সাথে কমিউনিকেশনের জন্য শুধু নাগরিক অথবা গ্রামের থিয়েটার এবং এদের দর্শকই যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে একটি মুখপত্র খুবই প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনের জায়গা থেকেই দীর্ঘদিন যাবৎ এ দেশে নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার ‘থিয়েটার’ পত্রিকা প্রকাশ করে আসছেন। অনেক ঘাত, প্রতিঘাত এবং কাঠ-খড়ি পুড়িয়ে তবুও মুখপত্রটি সচল রেখেছেন। সময়ের প্রয়োজনে সাত বছরব্যাপী ‘থিয়েটারওয়ালা’-ও প্রকাশিত হচ্ছে নাটকের মুখপত্র হিসেবে। কিন্তু নাট্য মুখপত্র হিসেবে থিযেটারওয়ালা-র ব্যতিক্রম কার্যক্রমের মধ্যে চোখে পড়ে- তারা উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা নিয়ে মুখোমুখি আলাপ করেন প্রযোজনা সংশ্লিষ্ট মানুষদের সাথে। এতে করে পাঠক অথবা দর্শকের সামনে খুলে যায় একটি প্রযোজনার ভেতর-বাহির। প্রযোজনাটিকে তখন একটা স্বচ্ছ আয়নার মতো দেখায়। এ ছাড়াও থিয়েটারওয়ালা আয়োজন করেছে- বাংলাদেশের সাত নাট্যকার ও নির্দেশকের মুখোমুখি অনুষ্ঠান। সেখানেও বিশিষ্ট নাট্যজনেরা নিজেদের দাঁড় করিয়েছিলেন দর্শক-সমালোকদের সামনে। হয়তোবা তারই ধারাবাহিকতায় থিয়েটারওয়ালা এখন আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়েছে দেশ বরেণ্য নাট্যজনদের সাথে। এ পর্যায়ে এ পর্যন্ত ৬ নাট্যব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ট আলাপন আমরা পেয়েছি থিয়েটারওয়ালার গত দুই সংখ্যায় (জুলাই-সেপ্টেম্বর’০৫ ও অক্টোবর-ডিসেম্বর’০৫ সংখ্যা)। আশা করছি একাজটি ধারাবাহিকভাবেই এগিয়ে যাবে থিয়েটারওয়ালার আগামী সংখ্যাগুলোতেও।
জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৫ সংখ্যায় তিন নাট্যজন সাঈদ আহমদ, রামেন্দু মজুমদার এবং আতাউর রহমান আর অক্টোবর- ডিসেম্বর ২০০৫ সংখ্যায় আরও তিন নাট্যজন আলী যাকের, মামুনুর রশীদ এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ এর সঙ্গে আলাপনগুলো বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এইসব আলাপনের মধ্য দিয়ে দেশবরেণ্য ছয়জন মানুষের থিয়েটার ঘনিষ্ট জীবন অনেকটা আয়নার মতোই স্বচ্ছ হয়ে ফুটে উঠেছে আমাদের কাছে। শৈশব থেকে কীভাবে এই বরেণ্য মানুষগুলো ক্রমে ক্রমে থিয়েটারের মানুষ হয়ে উঠলেন আমরা তার অনেক কিছুই জানতে পারলাম। নাট্য সম্পৃক্ততা দিয়ে এই মানুষগুলো শুধু নাট্যাঙ্গনে স্থান করেই নেন নি, এদের কর্মের মধ্য দিয়ে আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছেন। এঁনারা যা কিছু আমাদের দিয়েছেন তাঁদের জীবন পুড়িয়ে, আমরা কতটুকু তার নিতে পেরেছি, কতটুকু তার নেয়া অত্যাবশ্যকীয়, এঁদের নাট্য ঘনিষ্ট জীবনের কাছ থেকে উত্তর প্রজন্মের মানুষদের শিখবারই বা কী আছে- এরকম কিছু বিষয় মনে হয় আলোচনা করা যেতে পারে এই নাট্যব্যক্তিত্বের আলাপচারিতা থেকে। এ উদ্দেশ্য নিয়েই আমার এই কলম ধরা।
আলাপনে প্রথম ব্যক্তিত্ব সাঈদ আহমদ সম্পর্কে পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে একজন বাঙালি লিয়েবেদেফকে পড়ছি। লিয়েবেদেফ সাঈদ আহমদ শিখলেন মিউজিক, একটা অর্কেস্ট্রা দল বানালেন। আটখানা বাদ্যযন্ত্র ছিল তাঁর। তারপর শিক্ষার প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরিয়ে বিলেত, সেখানে লণ্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স এর ছাত্র অথচ নিয়মিত দেখতে যেতেন নাটক। জানতে পারি আসলে নাটকের মাঝে খুঁজতে যেতেন মিউজিক। মিউজিক খুঁজতে খুঁজতে বিবিসি-তে বাজিয়েছেনও, বাজিয়েছেন সব জাদরেল সব বাদকের সঙ্গে, এনসাইক্লোপিডিয়ায় যাঁদের নাম আছে। অদ্ভুত এই মানুষ মিউজিক নিয়ে খেলতে খেলতে কখন যে নাটকের লোক হয়ে উঠলেন! লিখলেন নট আই বা আমি না এবং কোনো এক বেদনায় ছিঁড়েও ফেললেন তা - এর কোনো কিছুই আমাদের জানা ছিল না। সৃষ্টি করতে হলে ভেতরে সৃষ্টির বেদনা থাকতে হয়, নাট আই ছিঁড়ে ফেলেও তিনি বসে থাকেন নি, লিখেছেন দ্য থিংক। দ্য থিংক মঞ্চস্থ হয়েছে আমেরিকায়, মঞ্চস্থ হয়েছে পাকিস্তানের কয়েকটি প্রদেশে, কয়েকটি ভাষায়। থিয়েটারওয়ালার আলাপন থেকে এ-সবই আমাদের জানার সুযোগ হয়েছে। দ্য থিংক এর পর মাইলপোস্ট। মানুষের ইনহেরেন্ট তাড়নার সাথে তাঁর সৃষ্টির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আ্যাবসার্ড বড়ই কঠিন নাটক। সেই আ্যাবসার্ড লিখেছেন আমাদের লিয়েবেদফ সাঈদ আহমদ। আ্যাবসার্ড আসলেই মিউজিকের সাপোর্ট নির্ভর অথবা মিউজিক নির্ভর। সেজন্যই তিনি লিখেছেন আ্যাবসার্ড নাটক অথবা তাঁর লেখায় এসেছে আ্যাবসার্ডিটি। জীবিকা এবং শিক্ষার অন্বেষণে পরিব্রাজক এই বাঙালি কাজ করেছেন আমিরিকার এরেনা স্টেজ-এ, তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ এরেনা স্টেজ-এ তাঁর নামে একটি সারি আছে। বাঙালি লিয়েবেদেফ সাঈদ আহমদ আমেরিকার এরেনা স্টেজে বিশ্বের সেরা সেরা নাট্যব্যক্তিত্বদের সঙ্গে বেঁচে থাকবেন হাজার বছর। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে যে লোক চিত্রকলার উপর ছোট্ট একটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতেও কুণ্ঠা বোধ করেন না তখন তাঁর জীবন থেকে আমরা, নাট্যকর্মীরা এই শিক্ষাই কি নিতে পারি না- শিক্ষার সময় মৃত্যু পর্যন্ত এবং শিক্ষার কোনো গণ্ডী থাকা ঠিক না?
আমরা নাটকের দৃশ্যপটের মতোই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সাঈদ আহমদকে দেখি বিলেতে অথবা আমেরিকায়, করাচি অথবা লাহোরে। দৃশ্যপটে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে দেখি, বজলুল করিমকে দেখি; এ বড়ই চমৎকার দৃশ্যকাব্য সৃষ্টি করেছে থিয়েটারওয়ালা। আমরা সাঈদ আহমদ নামের একজন লিজেন্ডকে নিয়ে বিশাল ব্যাপৃত এবং বিচিত্র নাটক দেখতে থাকি আলাপনে; ক্লান্তিহীনভাবে এবং ঐকান্তিক আগ্রহে। কতো শাখা-প্রশাখা এই লিয়েবেদেফের জীবনে! ভারতের শেকড়ের মানুষদের নিয়ে যিনি নাট্যচর্চায় লিপ্ত সেই নাট্যব্যক্তিত্ব হাবিব তানভীরের সাথে সখ্য ছিল সাঈদ আহমদের। বিপ্লবী নাট্যকার সফদর হাশমী, যিনি গণমানুষের জন্য নাটক করতে গিয়ে রাজপথে প্রাণ দিয়েছেন, সেই বিপ্লবী নাট্যব্যক্তিত্বের সাথে ঘনিষ্টতা অবাক করে দেয় আমাদের। খুশবন্ত সিং কী করে বন্ধু হন তাঁর! এতো দৃশ্যকাব্যও নয়, একটা পাঠ্যপুস্তক। কী করে নানা বিচিত্রতায় একজন বালক সেতার বাদক থেকে শুরু করে অর্কেস্ট্রা দল, তারপর নাট্য রচনা, নাট্যকর্ম- সবই বিদেশে, পরিব্রাজক জীবনে। তারপরও কীভাবে গতিশীল জীবন আর জীবনের সব বোধ যা থেকে নাট আই, দুর্বিক্ষের দৃশ্যকাব্য মাইলপোস্ট, তারপর অধ্যাপনা- পৃথিবীবিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। জীবনের পথ চলায় পরিচয় হয় বিশ্বখ্যাত নাট্যকার ইউজিন এয়োনেস্কো, নোবেল বিজয়ী নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট আর আর ওলে সোয়েঙ্কার সাথে।
আলাপনের দৃশ্যকাব্যে শুধু আমরা ঘটনায় টইটম্বুর সাঈদ আহমদের নাট্য ঘনিষ্ট জীবন দেখি না, উনিশ দশকের শুরুতে ঢাকায় নাট্যচর্চা কেমন ছিল, তার একটি দৃশ্যপটও ভেসে ওঠে আমাদের মানসপটে। আমরা দেখি ঢাকায় কীভাবে বানিজ্যিক নাটক হতো এবং কীভাবে সবাক চলচ্চিত্র সেই নাট্য বিনোদনকে বন্ধ করে দিলো। নাট্যকার নূরুল মোমেন সম্পর্কে সাঈদ আহমদ বলেছেন- নেমেসিস লিখবার পর তিনি আর লিখতে পারেন নি। কারণ, লিখবার জন্য ভেতর থেকে চাপ অনুভব করতে হয়। ভেতরের এই চাপ লিয়েবেদেফ সাঈদ আহমদের ছিল প্রচণ্ড। তা না হলে ওয়েটিং ফর গডো-র মঞ্চায়ন দেখেই ক্ষান্ত হতেন। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে তা হয় নি। তিনি ওয়েটিং ফর গডো নিয়ে ইংরেজিতে একটা আর্টিকেল লিখলেন এবং এই আর্টিকেলের সুবাদেই যোগাযোগ গড়ে ওঠে নোবেল বিজয়ী নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের সাথে। সাঈদ আহমদ প্রসঙ্গে পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে থিয়েটারওয়ালা সব চেয়ে বেশি পরিকল্পনা করেছে আলাপনটি কীভাবে সাজানো যায় সেই দিকে। সম্ভবত সেকারণেই আলাপনের এই পর্বটা কত্থক নৃত্যের সুরের সাথে নেচে নেচে ওঠে সাঈদ আহমদের জীবনের যতো সাজানো অধ্যায় দিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা সেই দৃশ্যকাব্যে অবগাহন করি। আলাপনে সাঈদ আহমদ পর্ব পুরোটাই একটি কাব্যনাটক অথবা একটি সঙ্গীত মনে হয়, যেখানে লয়, তাল, ছন্দ, সুর- সব কিছুই বাজে, ভীষণভাবে বাজে। কোথাও তাল কাটে না, সুর কাটে না।
তারপরও মনে হয় আলাপন থেকে বাদ পড়েছে তাঁর অনুবাদ কর্মের অধ্যায়টুকু। এতো বড় একটা নাটকে দৃশ্যের পর দৃশ্যের ঠাসানো বুননের মধ্য থেকে তাঁর অনুবাদ অথবা টিভিতে বিশ্বনাটকের উপস্থাপনা পর্বটুকু বাদ পরা তেমন কোনো ভুল না হলেও আলাপনটিকে সীমাবদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে। স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো যে বাঙালি আমাদের সামনে দৃশ্যমান তার এই অংশটুকু সম্ভবত আমরা এখানে যোগ করতে পারি। সাঈদ আহমদ নাটক লিখেছেন, আমেরিকায় ইনডিয়ান প্লে মঞ্চায়নের জন্য কনসালটেন্সি করেছেন, পুরো জীবনটাকেই বয়ে বেড়িয়েছেন নাটকের তরীতে। তিনি রচনার পাশাপাশি ইউজিন এয়োনেস্কোর দু’টি নাটক বাংলায় অনুবাদ করেছেন- নাটক দুটো হলো চেয়ার এবং টেকো অভিনেত্রী। এছাড়াও ‘পাঁচটি বিশ্বনাটক’ নামে আরো পাঁচখানা বিদেশি নাটক অনুবাদ করেছেন, নাটকগুলো হচ্ছে- হারানো চিঠি, নাট্যকার লুকা কারাজিয়ালে, লেডি আওই, নাট্যকার ইউকিও মিশিমা, মধ্য গ্রীষ্মে তুষারপাত, নাট্যকার গুয়ান হাই চিঙ, কোন পথ নেই, নাট্যকার- জ্যাঁ পল সার্ত্র, প্রতিবাদ, নাট্যকার ভাচলাভ হ্যাভেল। উক্ত দুটো অনুবাদ গ্রন্থই প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী। নিজের লেখার মাধ্যমেই কেবল তিনি বিশ্বনাটককে আমাদের সামনে তুলে ধরেন নি, টেলিভিশনের পর্দায় ‘বিশ্বনাটক’ শিরোনামে একটা অনুষ্ঠান দীর্ঘদিন তিনি উপস্থাপনা করেছেন। এই উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিদেশি নাম করা লেখকদের অনেক ভালো ভালো নাটক আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সম্ভবত বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে আজ তাঁর বিশ্বনাটকের অনুষ্ঠানটি, যা কিনা সত্যিই একটি উঁচু মানের অনুষ্ঠান ছিল, সেটি আর টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে না। কারো না কারো হাত ধরেই এই অনুষ্ঠানটির ধারাবাহিকতা থাকা উচিত।
সাঈদ আহমদের বর্ণাঢ্য জীবন থেকে আমরা কী কী শিখতে পারি তা হলে? খুব সহজ কথায়- পরিব্রাজক হওয়া ছাড়া পথ নেই সৃষ্টির জন্য। এই ভ্রমণ শুধু দেশ থেকে দেশান্তরে নয়, শিল্পের প্রতিটি শাখায়, সাহিত্যের যত রকম ডালপালা আছে, সব কিছুতে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন- আমাদের দেশে পেইন্টারদের সাথে নাটক যায় নি। আসলেও যায় নি, আরো অনেক কিছুর সঙ্গেই যায় নি। শাখা মেলবার ভীষণ প্রয়োজন আছে আমাদের সর্বত্র। শিখবার জন্য, ভাবের আদান প্রদানের জন্য। সাঈদ আহমদ আদান প্রদানের প্রসঙ্গে বলেছেন- এই আদান প্রদানের জন্য যে সফোস্টিকেশন প্রয়োজন, সেই সফোস্টিকেশন আমাদের মাঝে নেই। যদি নিজেকে মেলে ধরা যায় শিক্ষার পাদ প্রদীপে- তবেই হয়তো সেই সফোস্টিকেশন আসতে পারে আমাদের মননে এবং তবেই হয়তো আমাদের নাট্যকর্ম আরো বেশি সমৃদ্ধ হতে পারে।
[বাকীটুকু সংখ্যা ২০ এ ছাপা হয়েছে]
এম এ সবুর : নাট্য বিষয়ক প্রবন্ধ লেখক।