Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

থিয়েটারওয়ালার আলাপন : প্রাসঙ্গিক প্রতিক্রিয়া

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

থিয়েটারওয়ালা পত্রিকার ৭ম বর্ষ ৩য় সংখ্যায় (জুলাই-সেপ্টেম্বর ’০৫) রামেন্দু মজুমদার ও আতাউর রহমানের দু’টি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। ঐ সাক্ষাৎকারে, ১৯৭২ সালে থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা, ১৯৮১ সালে সিউল যাত্রার নেপথ্য কাহিনী ও ১৯৮২ সালে থিয়েটারের ভাঙন ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলতে চাই।

এক
১৯৮১ সালে সিউলে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মঞ্চায়ন উপলক্ষে প্রকাশিত, রামেন্দু মজুমদার ও সাংবাদিক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর সম্পাদিত পুস্তিকায়, ১৬ জনের দলের সচিত্র পরিচিতিতে শুধু আবদুল্লাহ আল-মামুন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার এবং তবিবুল ইসলাম বাবু অর্থাৎ আমার নামের নিচে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। থিয়েটারের ২৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ২৭.১১.৯৭ তারিখে প্রকাশিত পুস্তিকায় ‘থিয়েটার এবং ২৫ লাল গোলাপ’ শীর্ষক আবদুল্লাহ আল-মামুন এর একটি লেখা থেকে হুবহু উদ্ধৃত করছি- ‘ ... উনিশ শ’ বাহাত্তর সালেই আমরা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করি। আমরা কারা? অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, আহমদ জামান চৌধুরী, ইকবাল বাহার চৌধুরী, তবিবুল ইসলাম বাবু এবং আমি। ...’ কিন্তু সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে রামেন্দু মজুমদার বলেন, উনিসহ ... ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর তদানীন্তন পরিচালক কবীর চৌধুরী সাহেবের রুমে আবদুল্লাহ আল-মামুন, ফেরদৌসী মজুমদার, ইকবাল বাহার চৌধুরী, আহমদ জামান চৌধুরী ‘থিয়েটার’ নামে একটি দল গঠন করেন। উনি এ-ও বলেন যে- ‘থিয়েটার জন্মলগ্নে আরও ছিলেন ... মোতাহের হোসেন, ডলি আনোয়ার ... পরবর্তী সময় তবিবুল ইসলাম বাবুও যুক্ত হন।’ অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে হঠাৎ দীর্ঘ ৩৩ বছর পর রামেন্দু মজুমদারের এ ধরনের অসত্য ও বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা আমাকে অত্যন্ত বেদনাহত করেছে। এটার কি কোনো প্রয়োজন ছিল?

দুই
১৯৮০ সালে থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক রামেন্দু মজুমদার মার্কিন সরকারের ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটার্স প্রোগ্রামের আওতায় তাদের আমন্ত্রণে আমেরিকায় নাটকের ক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন। সেখানে লামামা থিয়েটারের এক কৃষ্ণাঙ্গী মহিলা এলেন ষ্টুয়ার্টের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ঐ বছরের শেষের দিকে এলেন ষ্টুয়ার্ট, ১৯৮১ সনের ১৫-২২ মার্চ দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে আই.টি.আই এর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিতব্য, ‘ফিফ্থ থার্ড ওয়ার্ল্ড থিয়েটার ফেষ্টিভাল এণ্ড কলাক্যই’ অনুষ্ঠানে আমাদের থিয়েটার নাট্যদলকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। দলটি হতে হবে সর্বোচ্চ ১৫ জনের। সিউলে এক সপ্তাহ অবস্থানকালে থাকা খাওয়া ও স্থানীয় যানবাহনের দায়িত্ব আয়োজকদের। কিন্তু বিমান ভাড়া’র সংস্থান আমাদেরকে করতে হবে। বিরাট খরচ, যা আমাদের পক্ষে নির্বাহ করা একেবারেই সম্ভব ছিল না।

রামেন্দু মজুমদার এই ব্যাপারে আর্থিক সাহায্যের জন্য তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়া’র সঙ্গে দেখা করার উদ্যোগ নেন। রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের তৎকালীন তথ্য উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিশের সঙ্গে রামেন্দু মজুমদারের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। ওনার ঘনঘন তাগিদ ও মজলিশ সাহেবের বারবার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এক মাসেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে নিমন্ত্রাতা সংগঠন একটি ফ্যাক্স বার্তায় আমাদেরকে জ্ঞাত করে যে, অনুষ্ঠিতব্য উৎসবে আমাদের অংশগ্রহণ সাত দিনের মধ্যে নিশ্চিত না করলে আমন্ত্রণ চূড়ান্তভাবে বাতিল হয়ে যাবে। দলের সবাই অত্যন্ত বিমর্ষ। দায়িত্ব এবার আমি নিজের কাঁধেই নিলাম। রাষ্ট্রপতিকে লেখা আমাদের আবেদনপত্রটি নিয়ে পুরানা পল্টনে জোনাকী সিনেমা হলের সামনে বিএনপি‘র কার্যালয়ে গেলাম। পরের দিন বিএনপি‘র কাউন্সিল সভা। পৌঁছে দেখি প্রচণ্ড ভিড়। রাষ্ট্রপতি জিয়া পালাক্রমে সারা বাংলাদেশ থেকে আগত কাউন্সিলারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছিলেন। সেখানে ভাগ্যক্রমে তৎকালীন বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব হামিদা আলী’র (পরবর্তী সময়ে ভিকারুন্নেসা গার্লস স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ) সঙ্গে দেখা হল। ওনার সঙ্গে আমার পূর্বেই অত্যন্ত সখ্য ছিল এবং ভাবী বলে সম্বোধন করতাম। ওনাকে এ ব্যাপারে অবহিত করার সঙ্গে সঙ্গেই অভিমান করে আমাকে বললেন- ‘বাবু, তোমরাতো বিএনপি’র বিরূপ সমালোচনা কর। কিন্তু তুমি যখন এসেছ, তখনতো তোমার জন্য কিছু করতেই হবে।’ যাই হোক তিনি ঐ ভিড়ের মধ্যেই আমাকে রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের কক্ষে নিয়ে গেলেন। প্রবেশ করেই সৌভাগ্যক্রমে বিএনপি’র তৎকালীন মহাসচিব ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পেয়ে গেলাম। ওনার সঙ্গে আমার চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক। পরবর্তী সময়ে তা ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তাছাড়া উনি মঞ্চনাটকের একজন নিয়মিত দর্শক ছিলেন। সংস্কৃতিবান ও প্রাণবন্ত ডাঃ বি. চৌধুরী চেম্বারে রোগীদেরকে গান শোনাতেন। ক্যাসেট যোগান দিতাম আমি। যাক্, ডাঃ বি. চৌধুরীর সঙ্গে আমার ওখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে আলাপ করলাম। এক পর্যায়ে রাত ১১টার দিকে ডাঃ বি. চৌধুরী ও হামিদা আলী, রাষ্ট্রপতি মহোদয়কে আমার উপস্থিতির কারণটি জানালেন। আবেদনপত্রটি হাতে দিয়ে চুপি চুপি বললাম যে, আমার বড় ভাই রফিকুল ইসলাম (গোরা) পশ্চিম পাকিস্তানের কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে ওনার রুমমেট ছিলেন। (রাষ্ট্রপতি জিয়া ও আমার দেশ একই জেলায় - অর্থাৎ বগুড়ায়)। রাষ্ট্রপতি মহোদয় আমাকে বললেন- ‘ও আপনি গোরার ভাই, ওতো একটা গাধা, আমি কতবার তাকে আমার সাথে দেখা করতে বললাম, আমার কথা শুনল না ... ইত্যাদি।’ আবেদনপত্রটি না পড়েই বললেন- ‘আই ডোন্ট বিলিভ ইন পেপার্স, আই বিলিভ ইন এ্যকশান। মুখে মুখে বলুন।’ আমার কথা শুনে বললেন- ‘যাবেন-নিশ্চয় সিউলে যাবেন, কনফার্ম করে দিন।’ আমিতো তাজ্জব! তখন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন আমিরুল ইসলাম কালাম। রাষ্ট্রপতি জিয়া তাঁর সামরিক সচিব লেঃ কর্ণেল মাহফুজুর রহমানকে (পরে জিয়া হত্যা মামলায় ফাঁসি হয়) নির্দেশ দেন যে, আবেদনপত্রটি নিয়ে প্রতিমন্ত্রী যেন পরের দিন সকালে বিএনপি’র কাউন্সিল সভায় তাঁর সাথে কথা বলেন। লেঃ কর্ণেল মাহফুজ, আবেদনপত্রে রাষ্ট্রপতির নির্দেশ লিখে দিয়ে তা ঐ রাতেই প্রতিমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। অগত্যা গভীর রাতে জাতীয় সংসদ হোস্টেলে অবস্থানরত প্রতিমন্ত্রীর কাছে ভোঁ-দৌড়। পৌঁছে দেখি হা হতোস্মি - ওনার ভীষণ জ্বর। দেখা করা সম্ভব হলো না।

ভোরে আবার ছুটলাম। প্রতিমন্ত্রীর জ্বর তখনও কমেনি- খুব অসুস্থ। দরজা বন্ধ। তখন প্রতিটি মুহূর্ত  আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। সাত দিনের মধ্যে একদিন চলে গেল- মন খারাপ। এরপর আবেদনপত্রটি নিয়ে শিল্পকলা একাডেমীতে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। মঞ্চে রাষ্ট্রপতি জিয়া উপবিষ্ট, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটি পরিবেশিত হচ্ছিল। ডাঃ বি. চৌধুরী মহাসচিবের দীর্ঘ প্রতিবেদন পাঠ শুরু করলেন। অতি সন্তর্পণে মঞ্চের উইংসের পাশে গেলাম। নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন বিভিন্ন পর্যায়ে আমাকে বাধা দিচ্ছিল। হঠাৎ দেখি মঞ্চের একেবারে পেছনে জাসাসের প্রতিষ্ঠাতা, গায়ক ও গীতিকার লোকমান হোসেন ফকির মেঝেতে অনেকের মধ্যে বসে আছেন। লোকমান হোসেন ফকির, নারায়ণগঞ্জ একাডেমী অব ফাইন আর্টসের (নাফা) প্রতিষ্ঠাতা আর আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে মেট্রিক ও আই.এ পাশ করেছিলাম, ঐ সুবাদে ওনার সঙ্গে আমার অনেকদিনের পরিচয় ছিল। বড় হৃদয়ের মানুষ। চুপি চুপি ওনার পাশে গিয়ে সব বললাম। ডাঃ  বি. চৌধুরীর বক্তৃতা শেষে, লোকমানভাই ওনাকে বাইরে ডেকে আনলেন। প্রতিমন্ত্রীর অসুস্থতার কথা শুনে ডাঃ বি চৌধুরী আমাকে বলেন যে, ওনার পক্ষে এ ব্যাপারে সরাসরি নাক গলানো ঠিক হবে না। নিচে, দর্শকের প্রথম সারিতে উপবিষ্ট শিক্ষামন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরীর কাছ থেকে আবেদনপত্রে সুপারিশ করে আনলে ওনার পক্ষে আমাদেরকে সাহায্য করা সহজ হবে বলে আমাকে পরামর্শ দেন (তখন সংস্কৃতি বিষয়ক বিভাগটি সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল)। মহা মুশকিলে পড়লাম। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা শুরু হয়েছে। আমি, দর্শকদের প্রথম সারিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ও উপ-প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের জামালউদ্দিন আহম্মদের মাঝে উপবিষ্ট শিক্ষামন্ত্রীর কাছে গেলাম। শিক্ষামন্ত্রীকে আবেদনপত্রটি দেখালাম। তখনও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সঙ্গত কারণেই শিক্ষামন্ত্রী আমার উপর বিরক্ত হয়ে অফিসে দেখা করতে বললেন। কিন্তু আমার হাতেতো সময় নাই। হঠাৎ উপ-প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেখে বললেন-‘ কি বাবু, এখানে কেন?’ (স্বাধীনতা সংগ্রামের অসহযোগ আন্দোলনের সময়, বর্তমান ৩২, বঙ্গবন্ধু এভিন্যুর দোতলায় বার্মা অয়েল কোম্পানী (বিওসি) কার্যালয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিন আহম্মদ আবাসিক কর্মকর্তা ও আমার বড় ভাই রফিকুল ইসলাম আঞ্চলিক বিক্রয় ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মঞ্চ ও টিভি শিল্পী হিসেবে উনি আমাকে স্নেহ করতেন)। ওনাকে কারণটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষামন্ত্রীকে আমার আবেদনপত্রে সুপারিশ করতে অনুরোধ করলেন। শিক্ষামন্ত্রী ইতস্তত করায় উপ-প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে টাকা পয়সার ব্যাপার আছে বলে তাঁকে দিয়ে আবেদনপত্রে সুপারিশ করিয়ে এবং নিজেও সুপারিশ করে শিক্ষামন্ত্রীকে বললেন যে, ওনারা যখন অর্থমন্ত্রী এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুপারিশ করেছেন তখন তাঁকেও করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী যুগপৎ অবাক ও হাসতে হাসতে আবেদনপত্রটিতে সুপারিশ করলেন। আমিতো মহাখুশি।  

মধ্যাহ্নভোজ বিরতিতে রাষ্ট্রপতি মহোদয় মঞ্চ থেকে নামলেন। নিরাপত্তা বাহিনী ও দলীয় কর্মীদের বেষ্টনী ঠেলে রাষ্ট্রপতি মহোদয়কে প্রতিমন্ত্রীর অসুস্থতার কথা জানালাম। এবং আবেদনপত্রটি দেখালাম। তিনমন্ত্রীর সুপারিশসহ আবেদনপত্রটি দেখে উনি অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। ডাঃ বি. চৌধুরীও হাসতে হাসতে আমাকে সন্ধ্যায় সদলবলে বিএনপি’র কার্যালয়ে আসতে বললেন। সন্ধ্যায় আবদুল্লাহ আল-মামুন, রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদার সহ বিএনপি অফিসে উপস্থিত হলাম। মঞ্চ ও টিভি’র অভিনেত্রী হিসেবে ফেরদৌসী মজুমদারের সুখ্যাতি তখন জনপ্রিয়তার মধ্যগগনে বিরাজ করছিল। ওনাকে দেখে সবাই উৎফুল্ল। রাষ্ট্রপতি মহোদয় ফেরদৌসী আপাকে টেলিভিশনের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বলে আখ্যায়িত করলেন। আমাদের আবেদনপত্র পড়ে ও কথাবার্তা শুনে রাষ্ট্রপতি বললেন- ‘এত টাকা কোথা থেকে দিব?’ তখন কোরিয়ার একটি ঠিকাদারী সংস্থা দেশের উত্তরাঞ্চলে কোটি কোটি টাকার বিদ্যুতায়ন সংযোগের কাজ করছিল। রাষ্ট্রপতি মহোদয় ওদেরকে যাতায়াতের ভাড়া বহনের অনুরোধ করতে নির্দেশ দেন। আমাদেরকে পরদিন সকালে তৎকালীন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব সিদ্দিকুর রহমানের সাথে দেখা করতে বললেন। সকালে আমাদেরকে দেখেই সচিব মহোদয় মহাখাপ্পা। বললেন- ‘আপনারা সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে যান, এটা ভালো অভ্যাস না, আমরা কী জন্য আছি -ইত্যাদি ইত্যাদি’। দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছলেন। ইংরেজি ও কোরিয়ান ভাষায় ছাপা লেটার-হেডে আমন্ত্রণপত্রটি পড়ে সংগঠন সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। কিন্তু পত্রে মুদ্রিত কার্যকরী পরিষদের একজন সদস্য তাঁর পরিচিত বলে আমাদেরকে জানালেন। যাই হোক রাষ্ট্রদূত, যথারীতি কুটনীতিকের মতো তার দেশে বিরাজমান আর্থিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির অজুহাত দেখিয়ে তারপরও এ ব্যাপারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আগ্রহের কথা জেনে আমাদেরকে  সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন।  

পরের দিন সকালে রামেন্দু মজুমদার আমাকে মহানন্দে জানালেন যে, দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ১৫ জনের সিউল-ঢাকা অর্থাৎ  একদিকের ভাড়া বহন করতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু পরে আরো জানতে পারলাম ইতোমধ্যে সং®কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় দুঃখজনকভাবে রাষ্ট্রপতি মহোদয়কে বলেছে যে, সরকার যখন একদিকের বিমান ভাড়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে, তখন আরেক দিকের ভাড়া থিয়েটার নাট্যদল নিজেরাই বহন করুক। খবরটি শুনে আমরা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। এত টাকা কীভাবে যোগাড় হবে? দলের সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। উপরন্তু গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত পরের দিন আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছে। আমাদের হাতে আছে মাত্র দু’দিন। হরতালের দুপুর বেলায় সেগুন বাগিচায় আমার অফিস থেকে হেঁটে মগবাজারের ডাঃ বি. চৌধুরীর বাসায় গেলাম। সারা সকাল রুগী দেখে ডাঃ চৌধুরী পরিশ্রান্ত , তাঁকে উদ্ভুত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করতেই উনি আমাকে আর কোনো প্রকার সাহায্য করার অপারগতা প্রকাশ করলেন। বললেন যে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আপনি ইতোমধ্যেই ৩/৪ বার দেখা করেছেন। উনিতো একদিকের ভাড়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। অতএব তার পক্ষে রাষ্ট্রপতিকে এ ব্যাপারে আর অনুরোধ করা একেবারেই সমীচীন হবে না। শারিরীক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আমি, অত্যন্ত হতোদ্যম ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে চলে আসছিলাম- খেলা শেষ! হঠাৎ ঐসময় ডাঃ বি. চৌধুরীর পি.এ রাষ্ট্রপতি ফোন করেছে বলে তাঁর কাছে হ্যান্ডসেট নিয়ে উপস্থিত হলেন। রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি ডাঃ বি. চৌধুরীর শরীরে হাত বুলিয়ে আমাদের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে বলার জন্য আকূলভাবে ইশারায় অনুনয় বিনয় করতে থাকি। কথোপকথনের শেষের দিকে আমতা আমতা করে ডাঃ বি. চৌধুরী রাষ্ট্রপতি মহোদয়কে আমাদের বিষয়টি জানালেন। ফোন শেষে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন যে, আপনার প্রতি উপরওয়ালার অশেষ কৃপা আছে। ঐ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির ফোন আসাতেই ওনার পক্ষে আমাদের জন্যে কিছু বলার সুবিধা হয়েছে। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে আমি ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম। ডাঃ বি. চৌধুরী আমাকে বললেন সন্ধ্যায় যেন আমরা অবশ্যই ওনার বাসায় দেখা করি। রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদারকে নিয়ে ডাঃ বি. চৌধুরীর বাসায় গিয়ে শুনলাম, উনি মুন্সীগঞ্জে একটি খালকাটার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গেছেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে খেতে বসতেই রাষ্ট্রপতির জরুরী ফোন পেয়ে খাওয়া ছেড়ে আমাদেরকে ওনার পিছু পিছু আসতে বলে, বিএনপি অফিসে রওনা দিলেন।

আমরা তৎক্ষণাৎ ধানমণ্ডি রওনা দিলাম। ডাঃ বি. চৌধুরী জানালেন- কিছুক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি এসে পৌঁছবেন। আমরা অপেক্ষা করছি। রামেন্দু মজুমদার আমাকে বললেন- ‘বাবু, বাসায় ফিরে চলো, সিউল যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’ কিন্তু ফেরদৌসী আপা নাছোড়বান্দা। বললেন, বাবু যখন এই ক’দিন এত পরিশ্রম করে এই পর্যায়ে এসেছে তখন শেষ মুহূর্তে আমাদের হাল ছাড়া উচিত হবে না। যাক্, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অফিসে প্রবেশ করেই একহাত রামেন্দু মজুমদারের পিঠে আরেক হাত আমার পিঠে রেখে, আমাদেরকে চা পরিবেশনের নির্দেশ দিয়ে অপেক্ষা করতে বললেন। আমরা ওনার এডিসি’র রুমে বসে গল্প করতে থাকলাম। তিনজন সুবেশ এডিসি সেই সময়ের মঞ্চ ও টিভির জনপ্রিয় অভিনেত্রী ফেরদৌসী আপাকে দেখে খুব খুশি। রাত ১২ টা বাজতেই রামেন্দু মজুমদার আমাকে ঠাট্টা করে বললেন- বাবু, গুড মর্নিং।

রাত আড়াইটার দিকে রাষ্ট্রপতি মহোদয় তার খাস কামরায় আমাদেরকে ডেকে পাঠালেন। পাশের কক্ষে উচ্চালাপ হচ্ছিল। রাষ্ট্রপতি মহোদয় একটি অতি জরুরি কাজে ব্যস্ততার দরুণ আমাদেরকে গভীর রাত পর্যন্ত বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমাদের সঙ্গে কথাচ্ছলে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। (সিউল যাওয়ার পূর্বে স্ত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে নাটকটি দেখেছিলেন)। কথার মাঝে আমার বড় ভাই মিলিটারি একাডেমীতে কী সব কাণ্ডকারখানা করতেন সেকথাও বলছিলেন। ইতোমধ্যে সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর বাসায় ফোন করতে নির্দেশ দেন। অসুস্থতার কারণে প্রতিমন্ত্রী ফোন বন্ধ করে রাখাতে লাল ফোনে সংযোগ দিতে বলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া ফোনে হাসতে হাসতে প্রতিমন্ত্রীকে বললেন- কি ঘুমাচ্ছেন নাকি? ওনার সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমাদের দরখাস্তে- ‘১৫ জনের ঢাকা-সিউল টিকিট দিন- জিয়া’ লিখে ও সিউলে আমরা যেন ভালোভাবে নাটক মঞ্চস্থ করে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনি এই শুভ কামনা শেষে আমাদেরকে বিদায় দেন। ভোর ৪টার দিকে রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী আপা আমাকে হাতিরপুলে নামিয়ে দিলু রোডে নিজের বাসায় চলে গেলেন।

কিন্তু রামেন্দু মজুমদার থিয়েটারওয়ালায় উল্লেখিত সাক্ষাৎকারে বলেন- ‘... কিন্তু আমাদের তবিবুল ইসলাম বাবু ছিল একেবারে নাছোড়বান্দা, তার যেকোনো কাজে নামলে তা করেই ফিরতে হবে ... সে বললো - চলেন আমরা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করি, তাকে ধরলে ফল হতে পারে। বাবু বিএনপি অফিসে নিয়ে গেল, রাত ১টা বাজে, প্রেসিডেন্টের তখনো দেখা নাই, আমিতো বললাম-চলো বাড়ি ফিরে যাই ... বাবু বললো -এতোটা এসে ফিরে যাব না।  ... তো তখন অলি আহমদ ছিলেন ওনার সেক্রেটারী, জিয়াউর রহমান এলে, অলি আহমদ সব বললেন ... তো রাত দুটার সময় জিয়াউর রহমান ফোন করলেন সংস্কৃতি মন্ত্রীকে, হাতিয়ার লোক ছিলেন নামটা মনে করতে পারছি না ... রাত দুটার সময় ফোন করে বললেন - আপনি ঘুমাচ্ছেন, এ্যাতো সকাল সকাল ঘুমান কেন? শুনুন নাটকের দল যাবে সিউলে, ১৫ জনের দল, ওদের এ্যাম্বেসীকে বলেন একদিকের ভাড়া দিতে আর আমরা একদিকের ভাড়া দিব। ব্যস হয়ে গেল ... ।’ অথচ মজার কথা হলো সাত দিনের লবিংয়ের কখনই কোনো পর্যায়েই রাষ্ট্রপতি জিয়ার সেক্রেটারী অলি আহমদ, সিউল যাওয়ার ব্যাপারে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলেন না। উনি ঐ বিষয়ে কিছুই জানতেন না - আজও জানেন না।

দুঃখজনকভাবে সাক্ষাৎকারে রামেন্দু মজুমদার, আমার উল্লেখিত সাত দিনের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও লবিংয়ের কিছুই উল্লেখ না করে, একটি রাতের মাত্র ১ ঘন্টার ঘটনার মধ্যেই সিউল যাত্রার পুরো নেপথ্য কাহিনীর বর্ণনা দিলেন? আমার অনুরোধে ওনারা রাষ্ট্রপতি জিয়ার কাছে রাত ১টায় গেলেন, আর রাষ্ট্রপতি মহোদয় আমাদের কথা শুনেই রাত ২ টার সময় সিউল যাওয়ার ১৫ জনের যাতায়তের খরচের বন্দোবস্ত করে দিলেন? বাহ, চমৎকার! রামেন্দু মজুমদারের এই নিতান্তই হাস্যকর, উদ্ভট ও অতিশয় বানোয়াট কাহিনীটি আমাকে হতবাক ও বিষ্ময়াবিষ্ট করেছে!! আমি তো ভাবতেই পারছি না এসব উনি কীভাবে বললেন !!!

কোরিয়া যাওয়ার জন্যে নিজের দলের স্বার্থে কাজ করেছি- এটা একজন দলীয় কর্মীর কর্তব্য। এটা নিয়ে বড়াই করার কিছুই নেই। সুতরাং গত চব্বিশ বছর অনেকের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও সিউল যাওয়ার নেপথ্যে কাহিনী কোথাও লিখিনি। এই ষাট বছর বয়সে, নিতান্তই অনিচ্ছা সত্বেও এটা নিয়ে লিখতে হচ্ছে বলে আমি সংকোচ বোধ করছি। এই ভূখণ্ডের ইতিহাসে, এদেশের কোনো নাট্যদলকে ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশে সর্বপ্রথম নিয়ে যাওয়ার ঐ ঐতিহাসিক ঘটনায় আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করলে শিহরিত ও রোমাঞ্চিত হই।

কোরিয়া যাত্রার ব্যাপারে প্রয়াত রাষ্ট্রপ্রতি জিয়া, ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, অধ্যাপিকা হামিদা আলী, প্রয়াত গায়ক ও গীতিকার লোকমান হোসেন ফকির এবং প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিন আহম্মদের অবদানের জন্য দীর্ঘ ২৪ বছর পর লিখিতভাবে তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্য রামেন্দু মজুমদারকে অশেষ ধন্যবাদ।

তিন
১৯৮২ সালে থিয়েটার দলের প্রথম ভাঙন হয়। ১৯৮১ সালে থিয়েটার প্রযোজিত ওথেলো নাটকের ডেসডিমোনা চরিত্রের প্রতি ফেরদৌসী মজুমদারের দুর্বলতা সত্ত্বেও নির্দেশক আবদুল্লাহ আল-মামুন, তারানা হালিমকে নির্বাচিত করেন। ফেরদৌসী মজুমদার এমেলিয়া চরিত্রে অভিনয় করেন। মাঝে তারানা হালিম মেট্টিক পরীক্ষার জন্য ছুটি নিয়েছিল। ছুটির সময় ডেসডিমোনা চরিত্রে ফেরদৌসী মজুমদার ও এমেলিয়া চরিত্রে আফরোজা বানু অভিনয় করেন। তারানা’র পরীক্ষার শেষে ফেরদৌসী মজুমদার নানান অজুহাতে ডেসডিমোনা চরিত্রটি ছাড়তে সম্মত হলেন না। এক সন্ধ্যায় কন্যা সমতুল্য তারানা হালিম, ডেসডিমোনা’র পোশাক-পরিচ্ছদ অশ্রুসিক্ত নয়নে ফেরৎ দিয়ে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক পরিবেশে দুঃখজনকভাবে দলত্যাগ করে। পরবর্তী সময়ে আমাদের দলের সদস্য এবং আবদুল্লাহ আল-মামুনের চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার কর্মচারী শাহাবুদ্দিন মজুমদার, আফরোজা বানুর নামে একটি কুৎসিৎ অপপ্রচারণায় লিপ্ত হয়। যথার্থই আফরোজা বানু দলের কর্মকর্তাদের কাছে বিচার চান। কিন্তু রামেন্দু মজুমদার ও আবদুল্লাহ আল-মামুন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে এ ব্যাপারে কিছু করার অপারগতা ব্যক্ত করেন। আফরোজা বানু কার্যকরী পরিষদকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুনরায় অনুরোধ করে। ওনারা ক্ষিপ্ত হয়ে আপাতত ওথেলো মঞ্চায়ন স্থগিত রেখে দলের অন্য একটি চলতি নাটক সেনাপতি মঞ্চায়নের সিদ্ধান্ত নেন। আমরা কতিপয় সদস্য, তারানা হালিম ও আফরোজা বানুর প্রতি অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে সেনাপতি নাটকে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকি। ওনারা কোনো আলোচনায় না বসে একতরফাভাবে প্রতিবাদকারীদের সদস্যপদ বাতিল করেন। এভাবেই থিয়েটারের প্রথম ভাঙন হয়।

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে ঐ ব্যাপারে নিজেদের ভুল স্বীকার করে রামেন্দু মজুমদার বলেন- ‘আমার কাছে কিন্তু মনে হয় এই অনড় থাকাটা আমাদের উচিত হয়নি কারণ ওদের সাথে কথা বলে একটা সমঝোতায় আসা যেত এবং শৃঙ্খলা আরোপের হয়ত ভিন্ন পন্থা নেয়া যেত।’ রামেন্দু মজুমদার যথার্থই বলেছেন। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেল- তাদের এই মনোভাব প্রথম থেকেই থাকলে থিয়েটার থেকে তিন তিনবার দেশের বিশিষ্ট নাট্যকর্মীরা চলে যেতেন না। প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য হিসেবে থিয়েটারের এই দুর্ভাগ্যজনক ভাঙনের জ্বালা আমাকে আমৃত্যু দহন করবে।

এই প্রসঙ্গে আতাউর রহমান তার সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে বলেন- ‘কিন্তু থিয়েটার যখন ভাঙলো ... মানে কবীর চৌধুরী স্যার, রামেন্দু মজুমদার, মামুন মিলে যে থিয়েটার করলো, পরে কেরামত মওলা, তবিবুল ইসলাম বাবু, মমতাজ সাহেবরাও এলেন, পরবর্তী সময়ে যখন দল ভাঙলো তখন তারা কিন্তু নাম সহ নিয়ে ভাঙলো, এটা কেমন কথা! এটা হীনমন্যতা বলে আমি মনে করি।’ আতাউর রহমান থিয়েটারের সদস্য নন, উনি ভিতরের খবর জানেন না। উনি কারো কাছ থেকে শুনে বা রামেন্দু মজুমদারকে তুষ্ট করার জন্য, ‘পরে তবিবুল ইসলাম বাবু এলেন’ (অথচ আমি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য), ‘নামসহ থিয়েটার ভেঙে হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছেন’ বলে আপত্তিজনক মন্তব্য করেছেন।  উনি অযথাই অযাচিত ও অনাহুত বক্তব্য দিয়ে কাজটি ঠিক করেননি।

সাক্ষাৎকারে আতাউর রহমানের অনেক বিতর্কিত বক্তব্যের মধ্যে একটির উল্লেখ না করে পারছি না। উনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে বলেন- ‘ ... যখন রামেন্দু মজুমদার তার মেয়ের বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান করেনি, তখন সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি আমি। কারণ একটি অর্থহীন সময় ও স্বাস্থ্য নষ্টকারী লোকাচার ভাঙতে পারে বড় মানুষেরাই। ...’ অথচ পৃথিবীর সর্বত্র জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় সবাই নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী বিবাহ উপলক্ষে অনুষ্ঠান করে থাকে - আতাউর রহমানের  বিবেচনায় তারা কোন মাপের মানুষ? একজনকে খুশি কিংবা তোয়াজ করার জন্য অযথাই অন্যের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আঘাত করা কি আতাউর রহমানের সমীচীন হয়েছে? আশা করি এগুলোর জবাব পাবো। ধন্যবাদ।

তবিবুল ইসলাম বাবু
নাট্যব্যক্তিত্ব, সদস্য- নাট্যজন

[বিঃদ্রঃ- সম্পাদকের মন্তব্য : অগ্রজ নাট্যব্যক্তিত্ব তবিবুল ইসলাম বাবু থিয়েটারের সিউল যাত্রার ব্যাপারে যে নেপথ্য ঘটনাবলী বর্ণনা করেছেন, তা থেকে থিয়েটারের প্রতি তাঁর বা তাঁদের বা অগ্রজ প্রজন্মের ভালোবাসা ও সংগ্রামের জায়গাটি পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু যেহেতু লেখাটি থিয়েটারওয়ালায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারের প্রতিক্রিয়া, তাই বিনীতভাবে জানাচ্ছি যে- যদি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার এতো বিস্তৃত পরিসরে সিউল যাত্রার নেপথ্য বর্ণনা দিতেন, সেটাও সম্পাদকীয় কাঁচিতে কাঁটা পড়ে ছোট হয়ে যেত। কারণ দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের এই প্রশ্নোত্তরটি ছিল ছোট একটি অংশ (গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই)। সে জন্য সাক্ষাৎকারের এই অংশটুকুর অতিসংক্ষেপিত হওয়াটা সম্পাদনাজনীত পরিমিতি বোধ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। নাট্যজন তবিবুল ইসলাম বাবু-র প্রতিক্রিয়ার অন্যান্য অংশের ব্যাপারে সম্পাদকের কোনো মন্তব্য নেই। ধন্যবাদ।]

[থিয়েটারওয়ালার ৭ম বর্ষ জুলাই-সেপ্টেম্বর ’০৫ সংখ্যায় প্রকাশিত রামেন্দু মজুমদারের সাক্ষাৎকারের কিছু অংশের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জনাব তবিবুল ইসলাম বাবু রামেন্দু মজুমদারকে একটি পত্র প্রেরণ করেন (উপরের প্রবন্ধটি নয়, স্বতন্ত্র্য একটি পত্র)। সেই পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি (রামেন্দু মজুমদার) সম্পাদক, থিয়েটারওয়ালা বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্রটি হুবহু ছাপা হলো। ]

৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৫
হাসান শাহরিয়ার
সম্পাদক- থিয়েটারওয়ালা

প্রীতিভাজনেষু
থিয়েটারওয়ালার ৭ম বর্ষ জুলাই-সেপ্টেম্বর ’০৫ সংখ্যায় প্রকাশিত আমার সাক্ষাৎকারে থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের নাম নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক পরিহার করতে এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, তবিবুল ইসলাম বাবু প্রথম থেকেই আমাদের সাথে ছিল, তবে বাংলা একাডেমীর প্রথম সভায় তার উপস্থিতির কথা মনে করতে পারছি না। তাই বলে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নন, এমন কথা আমি বলিনি। আপনার পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের ৮০ পৃষ্ঠায় আমি এক প্রশ্নের জবাবে বলেছি-‘তারপরও যদি প্রতিষ্ঠাতাদের দিকে তাকানো যায় তাহলে কেবল তবিবুল ইসলাম বাবু এক থিয়েটারে কাজ করতো ... মানে সে-ও কিন্তু এখন নতুন দল করেছে, নাট্যজন ...’

যাই হোক, আমার এ সাক্ষাৎকারের প্রেক্ষিতে তবিবুল ইসলাম বাবু প্রথমে কুরিয়ার সার্ভিসে ও পরে রেজিস্টার্ড ডাকে পাঠানো কঠোর ভাষায় লিখিত ২৯-০৮-০৫ তারিখের এক পত্রে আমাকে জানিয়েছেন-‘আমি (তবিবুল ইসলাম বাবু) থিয়েটারে (নাট্যদল) আপনার মতো একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অথচ আমি ‘পরবর্তী সময়ে ‘থিয়েটার’-এ যুক্ত হয়েছি’ এরূপ বক্তব্য দিয়ে আমার অবমূল্যায়ন করে আমাকে মানসিকভাবে আহত এবং নাট্যজগতের কর্মীদের কাছে আমাকে হেয় করেছেন এবং দেশের সংস্কৃতবান সুধীজন ও নাট্যকর্মীদের কাছে আমার ভাবমূর্তি বহুলাংশে ক্ষুণ্ন করেছেন। আপনার এহেন মিথ্যা উক্তিতে আমি অত্যন্ত মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছি। আপনি অনুগ্রহ করে থিয়েটারওয়ালার ঠিক পরবর্তী সংখ্যায় আপনার এই অসত্য কথন সংশোধন করবেন। অন্যথায় আমি আপনার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে বাধ্য হবো।’

তাই আপনাকে অনুরোধ করছি আমার এ পত্রটি আপনার পত্রিকায় প্রকাশ করে আমাকে মামলার হুমকি থেকে রক্ষা করবেন। জীবনের এই প্রান্তে এসে এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মামলা-মকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ার কথা আমি ভাবতেই পারি না। তা ছাড়া অতীতের সুখস্মৃতিগুলোই মনে রাখতে চাই, দুঃখ ও বেদনার এসব ঘটনা অনেকটাই ভুলে গেছি এবং ভুলে থাকতে চাই।

প্রীতি ও শুভেচছা জানবেন। ইতি

স্বাক্ষর
(রামেন্দু মজুমদার)
রামেন্দু মজুমদার
নাট্যব্যক্তিত্ব, সদস্য- থিয়েটার (নাটক সরণী)