Full premium theme for CMS
সময়ের প্রয়োজনে : থিয়েটার আর্ট ইউনিটের সেই দুষ্কাল-ভেদি মানবনাট্য
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
এই অস্বভাবী মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যা কী?- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক করা হচ্ছে শুনে যে ভয় করে। এমনই করে ছেড়েছি আমরা বিষয়টা। শুনলাম, থিয়েটার আর্ট ইউনিট নাটক করছে জহির রায়হানের লেখা গল্প সময়ের প্রয়োজনে নিয়ে। জহির রায়হানের লেখা নিশ্চয় যেমন-তেমন হবে না। তবু ভয়। করা হবে যে নাটক এখন, এই সময়ে। এই সময়ের প্রয়োজন মিটবে কি তাতে? যদিও এই দল আগে কোর্ট মার্শাল-এর মতো এক মুক্তিযুদ্ধের নাটক করেছে। দলের নতুন নির্দেশক মোহাম্মদ বারী গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে রূপায়ণ করেছে। তবু তাতে ভয় কমে না; কী যে হবে নাটক কে জানে !
এই দ্বিধা শঙ্কা নিয়েই দেখতে যাওয়া নাটক। শুরুতেই দেখি, সামনে স্বচ্ছ পর্দার পেছনে গান হয় শারীরিক মুভমেন্ট-সহ। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ রবীন্দ্র সঙ্গীতটির কোরিওগ্রাফ বেশ গতানুগতিক গতিভঙ্গিমার। তাতে তেমন কোনো দৃশ্য-শ্রব্য নাট্যক্রিয়া তৈরি হয় না। এরপর সামনের স্বচ্ছ পর্দা সরলে বেশ একটা মঞ্চস্থাপত্য দেখা যায়। মধ্যমঞ্চের ঠিক পেছনে দুদিকে দুই কবন্ধ নারী-পুরুষ ঈষৎ উত্থিত শয়ান কৌণিক সমান্তরালে। পিছনে তার কতক বঙ্কিম লম্বমান ডাল-মতো সাইক্লোরামার দিগন্তরেখার পশ্চাদ্পটে। সামনে দুদিকে বুটজুতো আর গাছের গুঁড়ির বিবর্ধ আদল। সব মিলে বেশ একটা লাগসই প্রতিবেশ-দৃশ্যকল্প। পিকাসোর গোর্নিকার কথা মনে পড়ে। পরে শাহাবুদ্দিনের তীব্র গতির ফিগার মূর্তমান যদিও দেখি তবুও লম্বমান এক সমর্থ আদলের অভাব লাগে। উত্থিত কোনো শক্তিমত্তা বর্তমানে অনুপস্থিত বলেই কি? মুক্তিযুদ্ধকালে তো ছিলো সমূহ ধ্বংসোত্তীর্ণ পরাক্রমের উর্ধ্বমুখ ফিগার-আদল। মুখ-থুবড়ানো বিভঙ্গমানস-জাত বুঝি এই দৃশ্যকল্প। মঞ্চকল্পনা কামালউদ্দিন কবিরের।
পরের দৃশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মহড়া চলছে। মঞ্চে আসেন এক সাংবাদিক। জহির রায়হান-ই বুঝি। কমান্ডারের সাক্ষাৎপ্রার্থী। খবর পেয়ে তিনি আসেন। হাত মেলান। একটু ব্যস্ত বলে তিনি সাংবাদিককে পড়তে দিয়ে যান এক মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি-‘পড়তে থাকেন, আমি আসছি।’ শুরু হয় ডায়েরি পাঠ আর তার দৃশ্যখণ্ডের পরস্পর-সংলগ্ন নাট্যক্রিয়াবিন্যাস। পঠন-বর্ণন আর দৃশ্যায়নক্রিয়ায় নাট্যের রূপায়ণ ঘটতে লাগে। একালের বিশিষ্ট এক নাট্য উপস্থাপন-ভাষ্য গঠিত হয়ে চলে দৃশ্যকাব্যের স্বাচ্ছন্দ্যে। আখ্যানকার আর নির্দেশকের মুন্সিয়ানা এই আঙ্গিক রূপায়ণে স্পষ্ট হয়।
শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধার লেখন-কথন আর সাংবাদিকের পঠনক্রিয়ার দৃশ্যায়ন-নাট্য। বুড়িগঙ্গার ওপারে প্রথম গণহত্যা-দৃশ্যটি ভালো তৈরি হয় না নাট্যক্রিয়ারূপায়ণ হিসেবে। তবে মুক্তিযোদ্ধা-ক্যাম্পে নানা পেশা-শ্রেণী-বয়স-স্বভাবের চরিত্র সব জীবন্ত হয়ে ওঠে দুঃসময়ের দৈনন্দিনেও মানবিক ক্রিয়া-কথন-সম্পর্কের পারস্পরিকতায়। প্রথাগত মুক্তিযোদ্ধা-ছক ভেঙে নানা মানুষ দেখা দেয় মঞ্চে। সুন্দরী নার্সের প্রতি একজনের দুর্বলতা নিয়ে খুনসুটি জমে ওঠে নতুন স্বজন-সুজন বন্ধুদের মধ্যে। কবি, কেরানি, জেলে, পাটের দালাল- নানা পেশার সব নব বালকবীরের দল। ব্যক্তিগত নানা স্বভাব-গল্প-আখ্যান নিয়ে রচিত হয় সেই দুষ্কাল-ভেদি মানবনাট্য। অপ্রতুল খাবার নিয়েও মেতে উঠতে পারে যারা নবলব্ধ অলৌকিক চারিত্র্য মাহাত্মে। তার মধ্যে, গল্পে নেই, নাট্যকার-নির্দেশকের শোনা এক জন্মমূক মধ্যবয়স্ক পিতাও আছেন মুক্তিযোদ্ধা দলে। হাতে তার বাঁশ দিয়ে তৈরি এক বেয়নেট। পাকিস্তানি সৈন্য পেলে শোধ নেবেন তিনি স্বজন-হত্যার। এহেন সংকল্পবদ্ধ মূক মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠে যেন এক প্রতীককল্প। অথচ নাটক-চলচ্চিত্রে এ-চরিত্র হয়ে উঠতো বুঝি এক কমিক-রিলিফ- আমাদের প্রতিবন্ধী নপুংসকতার খাই মেটাতে। এই নাট্যে তাকে দেখি মূকের বাক্সময় পরাক্রমের অনির্বচনিয়তায়।
সফল এক অপারেশন থেকে ফেরা মুক্তিযোদ্ধার একক উল্লাস-দৃশ্যটি স্মরণীয় মঞ্চক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। ডায়েরির লেখক-কথক মুক্তিযোদ্ধা মামুন চরিত্রে প্রশান্ত হালদার বাস্তবোত্তর মুদ্রা-ভঙ্গী-বাচনে নবমাত্রায় এক অভিনয়কলা সৃজন করে তোলে মঞ্চে। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎকার দৃশ্যে তার আবেগমন্থ স্মৃতি উদ্ঘাটন মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু-প্রতীতির নাট্যভাষ্য তৈরি করে। অবশ্য প্রশান্ত মা-বোন-প্রেমিকার সঙ্গে অভিনয়ে স্বাচ্ছন্দ্য ঠিক পান না। তাতে অনুনাট্য-আখ্যান আর অভিনেত্রীদেরও দায় আছে। মুক্তিযুদ্ধনাট্যে নারীর অতিরেক ভাবালু-ভূমিকার বিপরীতে এই নাটকে তারা নিষ্প্রভ, নাটুকে হয়ে ওঠে। নারীবাদীরা একে কি পুরুষতান্ত্রিক এক ক্ষমতা-মনস্তত্ত্ব বলতে চাইবেন? পতিতাদের নৌকায় তোলা নিয়ে দৃশ্যটি অন্তত আরো যত্নে করা দরকার ছিল- যাদের মধ্যে মামুন দেখতে পায় তার মায়ের মুখের আদল। মা-বোন-প্রেমিকার সঙ্গে দৃশ্যগুলি অন্য কোনো নিজস্ব অভিজ্ঞতার চেনা জায়গা থেকে করা যেতে পারে। বিশেষত সবশেষে মায়ের মোমবাতি নিয়ে মঞ্চে প্রবেশের সঙ্গে আর সবাই যেন এই সময় থেকেই উঠে আসছে- এমত উচ্চাশাপূর্ণ দৃশ্যটিও ব্যর্থ হয়। বহুচর্বিত কাব্যপংক্তি দুটি দিয়েই কেবল তা সম্পন্ন হতে পারে না। নতুন কোনো লাগসই নাট্যক্রিয়ার সৃজন চাই। এই সময়ের প্রয়োজনের গভীর কোনো বোধ-উপলব্ধি যদি যথা নাট্যভাষায় রূপায়ণ করা যায় তাহলেই সবচাইতে সঙ্গত মাত্রা পেতে পারে নাট্য।
তবে এটা খুবই প্রজ্ঞাপ্রসূত লাগে: ‘পাকিস্তানি হানাদার’ আর ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’ শব্দগুলো একবার দুবার মাত্র যে বলা হয়। সমাজমানস অবচেতনের বিভঙ্গ-দশার sign-signal মনে না রাখায় বাহাদুরি নেই। যেহেতু এই অবস্থার দায় আমরা কেউই এড়াতে পারবো না। তাই অত হাত তোলা পরাক্রমভঙ্গির নির্বীর্য ইচ্ছাপূরণের দৃশ্য যত না করা যায় তত ভালো। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গত আস্ফালনও পরিমিত হওয়া চাই। তখনকার চরিত্র-পরিস্থিতিতে তা সত্য হলেও বর্তমান থেকে বিযুক্ত হয়ে কিছু করলে ফল ফলবে না। এখনকার ন্যুব্জ খঞ্জ পঙ্গুতা মনে রেখেই সব করতে হবে। মূক-যোদ্ধার প্রতিশোধ-পরবর্তী আনন্দ-দৃশ্য ‘কামালপাশা’ কবিতাটি দিয়ে হতে হতেও হল না। -কবিতাটির অতিব্যবহারের বাস্তবতাই হয়তো তার কারণ। ‘এখন যৌবন যার’ কবিতা-পঙ্ক্তি নাট্যবাচনে করা হয় ভালোই, তবুও ঠিক ক্রিয়াবেগ তাতে ঘটে কি? কেন মুক্তিযুদ্ধ করছো- কমান্ডারের এই প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধাদের জবাব তথ্য হিসেবে হয়তো ঠিকই আছে- কিন্তু আজকের অভিনেতা সেই আগুন কী করে ছুঁতে পারবেন- কেবল অভিনয়ই পারে কি নিভন্ত, সাতবাসি মড়া-মন বাঁচাতে? ভেতরে ছাইচাপা কিছু থাকলে না হয় কথা ছিল। তখনকার যোদ্ধাদের ভবিষ্যৎ-দুর্ভাবনার কথপোকথন দৃশ্যটি আরো যত্নে, বর্তমান-সংলগ্ন ট্র্যাজিকগ্লানির রণন থেকে উদ্ঘাটন করা দরকার।
অনেক কিছু হয়েছে বলেই আরো একটু করে তোলার দায় নিতে বলা। -এই ইচ্ছাটা যে করা গেল সেতো এই নাট্যের ধ্বংসস্তূপ-উত্থিত সম্ভাবনায় আলোড়িত হয়েই। তার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃদের প্রতি। এস এম সোলায়মানের দল সদগুরুর মর্যাদা যথাপালনই করেছেন। এটা এই সময়ে বিরাট অর্জনই বলতে হয়। দলীয় ও ব্যক্তিগত অভিনয়মানও বেশ ভালো। তবুও কমান্ডার সেলিম মাহবুব, মুক্তিযোদ্ধা সাইফ সুমন, এজাজ, চন্দন রেজা, রিয়াজের কথা বলতেই হয়। নাসিরুল হক খোকন কল্পিত আলো দৃশ্যরূপায়ণে পুরোপুরি সদ্বব্যহৃত হয় নি। তবে পশ্চাদ্পটের দিগন্ত, শরণার্থী ও অভিযানের যাত্রার দৃশ্যালোক মায়া বেশ লাগে। সেলিম মাহবুব-কৃত সঙ্গীত-ধ্বনিতে আরও একটু কিছু করা চাই। প্রথম গানটি তো পাল্টানো উচিত নানা কারণে। ফরিদা আকতার লিমার পোশাক মঞ্চের রঙের সাথে মেলে ভালো। তবে পতিতাদের পোশাকে বর্ণ-বৈচিত্র্য চাই, জয়ার শাড়ি ও উড়নির রঙও ঠিক লাগে না।
জয় হোক নবাগত নাট্যকার-নির্দেশক মোহাম্মদ বারীর।
ড. বিপ্লব বালা : নাট্যকার, নির্দেশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত