Full premium theme for CMS
আলাপনে মামুনুর রশীদ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[স্বাধীনতার পর নাট্যচর্চাটা আমাদের বেশ এগিয়ে নিয়ে গেছে, সুস্থ ভাবনা-চিন্তার আগ্রহ তৈরি করেছে। আর তৈরি করেছে ‘মানুষ’ হবার আকাঙ্ক্ষা। আমরা শিল্পের এক বড় কর্মকাণ্ড, কর্মযজ্ঞ- মঞ্চনাটকের নিয়মিত সাক্ষাৎ পেয়েছি। আমরা বেশি বেশি নাট্যকার পেয়েছি, পেয়েছি সৃজনশীল প্রতিভাসম্পন্ন নাট্যনির্দেশক, অনেক ভালো অভিনেতৃ। আর পেয়েছি অনেক সংগঠক, যারা ক্রমশই মঞ্চনাটকের পরিধি বিস্তৃত করেই চলেছেন। এক কথায় এঁরা সবাই আমাদের মঞ্চনাটকের পুরোধা। আমরা মনে করি আমরা এঁদের সব ভালো কাজের উত্তরাধিকারী। তাই এঁদের কাজ এবং কাজের প্রক্রিয়া জানতে আগ্রহী, হতে আগ্রহী তাঁদের মতো বা তাঁদের চেয়ে বড় কিছু।
এই প্রত্যাশায় থিয়েটারওয়ালা আলাপচারিতায় মগ্ন হয়েছে কয়েকজন নাট্যজনের। তাঁদের সাথে আলাপচারিতা অনুলিখন করে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে থিয়েটারওয়ালায়। আমাদের এমনি এক নাট্যজন মামুনুর রশীদ। সাক্ষাৎকার: বিপ্লব বালা, আজাদ আবুল কালাম ও হাসান শাহরিয়ার আর অনুলিখন- সাইফ সুমন]
বিপ্লব বালা
মামুনভাই, একেবারে ছোটবেলা থেকে শুরু করুন ... বাড়ি, গ্রাম, দাদা-নানাবাড়ি যা যা মনে পড়ে।
মামুনুর রশীদ
আমার জন্ম মামাবাড়ি। গ্রামের নাম পাইকড়া, টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানার অন্তর্গত। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন ... অনেকটা রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত পোস্টমাস্টারের চাকরি হাঃ হাঃ। আমি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। আমার মায়ের খুবই কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল ... তের বছর বয়সে হতে পারে। তো ছোট বেলার গ্রামের অনেক স্মৃতি আছে ... একটা স্মৃতি এখন আমার খুবই মনে পড়ে, ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি। তখন আমার বয়স মাত্র ৪ বছর। তখন থেকেই আমার দাঁতে ব্যথা ... তখন থেকে মানে এখনও কিন্তু দাঁত ব্যথা আমার নিত্য সঙ্গি হাঃ হাঃ ... তো সেদিনও দাঁতে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। মা আমাকে কোলে নিয়ে স্কুলের সামনে নিয়ে গিয়েছিলেন ... সেখানে ছোট মামা স্লোগান দিচ্ছিলেন, আমার স্পষ্ট মনে পড়ে- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই। একেবারে টাঙ্গাইল শহর থেকে ৬ মাইল ভেতরে, তখন প্রত্যন্ত গ্রাম, সেখানে এই স্লোগান চলছিল। আমার দুই মামা, ছোট মামার আবার নানাদিকে উৎসাহ। একদিকে গান আবার আরেকদিকে নামকরা ফুটবলার ছিলেন।
বিপ্লব বালা
কী ধরনের গান গাইতেন?
মামুনুর রশীদ
আধুনিক গানই বেশি গাইতেন। মামাবাড়ির স্মৃতিটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি জাগ্রত। কারণ, আমার দাদার সাথে বাবার সম্পর্কটা ভালো ছিল না। দাদা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন, দাদী মারা যাবার পর। এরপরই বাবা মামাবাড়ি চলে আসেন। তবে আমরা যেতাম, মাঝে মাঝেই দাদাবাড়ি যেতাম। দাদাবাড়ি ছিল ঘাটাইল থানায়। বিশেষ করে শীতের সময় খুবই ভালো লাগতো ... একমাইল দূরেই পাহাড়। তখন পাহাড় মানেতো দূর্গম জঙ্গল। সকাল বেলার সূর্যটা উঠতো পাহাড়ের ঠিক পেছন থেকে। বিকেল বেলা পাহাড়ের পথগুলোকে মেয়েদের সিঁথির মতো মনে হতো, খুবই ভালো লাগতো। আমাদের গ্রামে যারা বিত্তবান, তারা কাঠের ব্যবসা করতো। আমাদের বাড়ির চারিদিকে এবং অন্যদের বাড়ির মাঝখানে একটা পুকুর ছিল। পুকুরটার নাম ছিল ‘আন্ধা পুষ্কুনি’। ‘আন্ধা পুষ্কুনি’ নাম হওয়ার কারণ হলো, পুকুরের চারপাশে এতো গাছ ছিল যে দিনের বেলাতেও আলো ঢুকতো না, ফলে অন্ধকার হয়ে থাকতো। আমাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়িও ছিলো পাশাপাশি। আমার আরেক চাচা বিয়ে করেছিলেন পাশের গ্রামের এক সুন্দরী মহিলাকে। বিয়ের পর এক ছেলে হলো এবং তার বছর দুই পর চাচা ব্রঙ্কাইটিসে মারা গেলেন। চাচীর বয়স খুবই অল্প ... তাই সবাই মিলে তাকে অনুরোধ করলেন আমার আরেক চাচাকে বিয়ে করবার জন্য। তো এই প্রস্তাব শুনে চাচা দেশান্তরি হলেন ... মানে ভাবীকে বিয়ে করতে হবে এটা মেনে নিতে পারেননি। পরে অবশ্য ফিরে এসেছিলেন। আর আমার চাচীরও বিয়ে হয়েছিল, তবে অন্য ছেলের সাথে। ... মজার ব্যাপার হলো আমরা যখন দাদাবাড়ি যেতাম তখন ঐ চাচীকে নাইওরী আনতাম। ঐ চাচীর দ্বিতীয় স্বামীও ব্যাপারটাকে কোনো খারাপ চোখে দেখতেন না।
হাসান শাহরিয়ার
বাবা যেহেতু পোস্টমাস্টার ছিলেন, সে সুবাদে নিশ্চয়ই অনেক জায়গা ঘোরা হয়েছে।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, যেমন আমার স্কুল শুরু হয়েছিল ময়মনসিংহের ফুলপুরে। টাঙ্গাইল থেকে দিনে একটি বাস যেত, সকাল বেলায়। বাসটা যখন মধুপুর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেত ... ১১/১২ মাইল রাস্তা ... তখন জানালা-টানালা সব বন্ধ করে দিতে হতো। কারণ, একদিকে বাঘ, হাতি এদের উপদ্রব, আর অন্যদিকে ডাকাতের উপদ্রব। এখনতো সব ফাঁকা। আমরা যখন সাথে যেতাম তখন দেখতাম যে, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বন্দুক ছিল। দুটো কারণে, এক হচ্ছে শীতের সময় বন্য শুয়োররা আক্রমণ করতো, সেটা থেকে আত্মরক্ষার জন্য ... এটা আমি দেখেছি। আর দ্বিতীয় কারণ হলো- আমরা শিকারে বের হতাম। সূর্য ওঠার আগেই চাচাদের সাথে শিকারে যেতাম বন মোরগ মারার জন্য। এই শিকারে আমাদের গাইড হিসেবে থাকতো মধুপুর বনের আদিবাসী মান্দীরা। ওদের একটাই দাবী, শিকার শেষে তাদেরকে একটা গুলি দিতে হবে।
বিপ্লব বালা
কেন? গুলি দিয়ে তারা কী করবে?
মামুনুর রশীদ
শুয়োর মারবে, খাওয়ার জন্য। পরে বাবা ফুলপুর থেকে বদলী হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলেন। আরেকটা মজার স্মৃতি আছে ... এলেঙ্গা বলে একটি জায়গা আছে, দেবেশ ভট্টাচার্য, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বাবা এনাদের গ্রাম ... তো ওনারা ওখানকার জমিদার ছিলেন। ঐ গ্রামের স্কুলের একটা স্মৃতি মনে পড়ে। ঐ গ্রামের একদিকে নদী, অন্যদিকে জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির ওরা কালীপূজার উপাসক ... আর ভট্টাচার্যদের অর্ধকালীর বংশধর বলা হতো। ওরা দূর্গাপূজা করে না, করে কালীপূজা। কালীপূজার সময় তিনদিন ধরে ক্ষ্যামটা নাচ হতো ... তাদের নাটমন্দির ছিল, সেখানে নাচ, যাত্রা হতো। পাঠা বলি হতো, আরো কত কি! সেখানে এতো পালা-পার্বণ হতো যে শুরু হতো দূর্গাপূজা থেকে আর শেষ হতো সরস্বতী পূজায়। এই জমিদার বাড়ির কারণেই আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কৃষ্ণলীলা, রামলীলা দেখার। তারপর কথক ঠাকুর মহাভারতের গল্প বলতো, একটি মাত্র লাঠি নিয়ে। এই লাঠিটাই তরবারি হয়ে যাচ্ছে, রথের রশি হয়ে যাচ্ছে, চমৎকার ব্যাপার, তখন তো মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। ঐ গ্রামে একটা পতিতালয় ছিল, খুব ক্ল্যাসিক্যাল এবং দেখতে ওরা অপূর্ব সুন্দরী ছিল। আমার দুই ক্লাশ সিনিয়র এক ভাই ছিল, দেবল দা’ ... তার সাথে ঐ বাড়িতে যেতাম।
বিপ্লব বালা
উনি পতিতালয়ে থাকতেন?
মামুনুর রশীদ
উনি এক পতিতারই সন্তান।
বিপ্লব বালা
আপনারা জানতেন, উনি ওখানকার ...
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, সেজন্য অনেক বাধাও আসতো। আমার বাবা খুব কনজারভেটিভ ছিলেন। আমরা লুকিয়েই যেতাম। না গিয়ে পারতাম না, কারণ ওরা খুব আদর যতœ করতো। আর তখন তো বুঝতে শিখেছি যে, ওটা সেক্স ইন্ডাস্ট্রি, ওদের বাড়িগুলো ছিল নদী তীরবর্তী।
আজাদ আবুল কালাম
আপনার স্কুল জীবনের প্রিয় শিক্ষকদের নাম মনে পড়ে?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, ঐ গ্রামের স্কুলে পড়ার সময়েই আমি সত্যিকার অর্থে কয়েকজন শিক্ষক পেয়েছিলাম ... দক্ষিণারঞ্জন আইচ, আমরা দক্ষিণা স্যার বলতাম। এই রকম ডেডিকেটেড শিক্ষক আমি আর দেখিনি, তিনি অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের লোক ছিল। তার পিঠে চাবুকের কালো দাগ ছিল। হেড স্যার ছিলেন নিত্যানন্দ স্যার। উনি প্রতিদিন টাঙ্গাইল শহর থেকে সাইকেলে করে আসতেন। কিন্তু কোনোদিন লেট করতে দেখিনি। ওয়ার্নিং বেলটা বাজলেই দেখা যেত তার সাইকেলের চাকাটা স্কুলে ঢুকতো। প্রিয়নাথ স্যার গণিত করাতেন চমৎকার এবং কোনো অংক কেউ না বুঝলে উনি নিজেই ধরতে পারতেন যে, সে বোঝেনি। লতিফ স্যার ছিলেন হিরো ... গ্রামের যেকোনো সমস্যায় উনি সবার আগে সেখানে উপস্থিত। আমার জীবনে হিরো বলতেই লতিফ স্যারের কথা মনে পড়ে। আরেকটা ব্যাপার মনে পড়ে ... আমি তখন ক্লাশ সেভেনে পড়ি, স্কুলের ভেতরে ক্লাশ সেভেনের কক্ষে একটা লোক আত্মহত্যা করেছিল। ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যার প্রথম চেহারাটা ওখানেই দেখি ... এটা খুব খারাপ লেগেছিল। আর খারাপ লাগতো দেশত্যাগের ঘটনা, কারণ তখন এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছে ... আমাদের ছায়া দি, অশোকা দি, আমার ক্লাশ মেট অনিমা চলে গেল ... আমার খুব খারাপ লেগেছিল।
বিপ্লব বালা
এই মাইগ্রেশনের রিয়েকশনটা কী ছিল, বড়দের মধ্যে?
মামুনুর রশীদ
মুসলমানরা বলতো- এই যে দ্যাখো, দেশটাকে নিজের ভাবতে পারলো না, সব সম্পত্তি পাচার করছে, মেয়েগুলিকে পাচার করছে। তো ওরা আসলে জমিদার ছিল, ওদের আগে থেকেই রাঁচিতে বাড়ি ছিল। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে জমিদারের স্ত্রী ছিলেন যাদববাবুর মেয়ে ... পাটি গণিতের যাদববাবু। আমরা জমিদারের স্ত্রীকে দাদু বলে ডাকতাম।
বিপ্লব বালা
আপনাদের এক্সেস ছিল, জমিদার বাড়িতে?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, দাদু আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। আর উনি যেভাবে আমার নাম উচ্চারণ করতেন, আমার বাবা-মা-ও তেমনভাবে উচ্চারণ করতেন না। আর তাছাড়া বড় এক্সাইটিং ব্যাপার হচ্ছে যে, যার পাটিগণিত আমরা স্কুলে কষি তার মেয়ে আমার সামনে হাঃ হাঃ ...
বিপ্লব বালা
স্কুলে হিন্দু মুসলমানের রেশিও কেমন ছিল?
মামুনুর রশীদ
তখনও মুসলমানের সংখ্যা কম ছিল, বিশেষ করে ঐ গ্রামে। তবুও আমাদের সময় থেকেই মুসলমান ছেলেরা ডমিনেট করতে শুরু করলো। আগে গোপি দা ফার্স্ট হতো, ওমুক দা ফার্স্ট হতো, আমাদের সময় থেকে আমরা ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হওয়া শুরু করলাম।
আজাদ আবুল কালাম
এটা কোন ইয়ারে?
মামুনুর রশীদ
১৯৫৯ সালে কথা।
আজাদ আবুল কালাম
আচ্ছা মামুনভাই, আপনি প্রথম ইলেক্ট্রিসিটি দেখলেন কবে?
মামুনুর রশীদ
১৯৫৯ সালে, টাঙ্গাইল শহরেই সম্ভবত প্রথম ইলেক্ট্রিসিটি দেখি। তারও আগে ... সেটা ইলেক্ট্রিসিটি ছিল কিনা জানি না, তখন আমার ৫/৬ বছর বয়স, সিরাজউদ্দৌলা দেখেছিলাম টাঙ্গাইল করনেশন ড্রামাটিক ক্লাবে। আমার শুধু এইটুকুই মনে আছে- পথহারা পাখি ... গানটা, আর লাইট ছিল ... কিন্তু কিসের লাইট মনে করতে পারছি না। আমি পথহারা পাখি গানটা শুনতে শুনতে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আজাদ আবুল কালাম
আপনি মেট্রিক পাশ করেছেন কোথা থেকে?
মামুনুর রশীদ
টাঙ্গাইল বল্লা করনেশন হাই স্কুল থেকে। আমাদের সময় এক অদ্ভুত নিয়ম চালু হলো। ’৬২ সালে ক্লাশ নাইনে চার সাবজেক্ট পরীক্ষা দিলাম আর ’৬৩ সালে দিলাম ক্লাশ টেনের পরীক্ষা ... তো এই দুটা মিলে এসএসসি’র রেজাল্ট হতো।
আজাদ আবুল কালাম
ছোট বয়সে যাত্রা দেখেছেন, কিন্তু বুঝতে যখন শিখলেন, তারপর কবে যাত্রা বা থিয়েটার দেখেছেন?
মামুনুর রশীদ
আমি তো এলেঙ্গা এবং বল্লা, দুই জায়গাতেই লেখাপড়া করেছি, তো এই দুই জায়গাতেই যাত্রা দেখেছি ... সোহরাব-রুস্তমসহ নানা যাত্রা আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল।
আজাদ আবুল কালাম
এগুলো কি কেবল দেখাতেই সীমাবদ্ধ ছিল নাকি ভাবতেন যে আপনিও করবেন?
মামুনুর রশীদ
না না, কেবল দেখা না, দেখার পরই রিয়েকশন হতো ... সাতদিন দশদিন আমার ভেতরে ওটা কাজ করতো, ভুলতে পারতাম না। সোহরাব-রুস্তম এখনো আমার স্মৃতিপটে আছে। বিজয়বাবু রুস্তম করতেন ৫ ফিট ৩ ইঞ্চি লম্বা, কিন্তু অসাধারণ অভিনেতা। আমি এখনও তার কণ্ঠস্বর ভুলতে পারি না। আরেকটা কৌতুহল আমার ছিল, এটা বোধহয় সবারই থাকে, সেটা হলো কেবল যাত্রা দেখা না, যাত্রার পর ঐ লোকগুলো কী করে তা দেখা। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে যেতাম, গিয়ে দেখতাম যে একটু আগে যে সোহরাবকে মেরে ফেলা হয়েছে, সে বসে বসে বিড়ি টানছে ... কিন্তু এই লোকটা আমার মাথায় নেই, ভর করে আছে সেই বীর সোহরাব।
আজাদ আবুল কালাম
আমার মনে আছে আপনি প্রায় সময় বলতেন সোহরাব রুস্তম করবেন .... সুবচন যখন তীর্থঙ্কর করলো সেটা কি আপনার কোনো ইনফ্লুয়েন্স ছিল।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, একটা অনুপ্রেরণা হয়তো কাজ করেছে।
আজাদ আবুল কালাম
আরেকটা ব্যাপার আমার জানতে ইচ্ছে করে ... সেটা হলো বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় গেলেই আপনার বন্ধু পাওয়া যায়। এই বিশাল বন্ধু হওয়ার সূত্র কী ছিল?
মামুনুর রশীদ
থিয়েটার।
বিপ্লব বালা
সেটা কোন সময় থেকে?
মামুনুর রশীদ
কলেজ থেকেই থিয়েটার করি আমি। সেকেন্ড ইয়ার থেকে আমি নাটক লিখতে শুরু করি।
বিপ্লব বালা
কোথায় পড়তেন?
মামুনুর রশীদ
পলিটেকনিক-এ ... আমি প্রথমে ভর্তি হই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অল্পদিন পর ঢাকা কলেজে, তার অল্পদিন পর পলিটেকনিক-এ।
বিপ্লব বালা
এরকম কেন?
মামুনুর রশীদ
এটা একটা অস্থিরতা কাজ করেছে যে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন কোনো প্রসপেক্ট নেই ... ’৬৩ সালের কথা বলছি ... তা-ও আবার একেবারে গ্রামে, পছন্দ হলো না। ঢাকা কলেজে আসলাম, তখন আবার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। পরে পলিটেকনিক-এ ভর্তি হলাম। একটা স্কলারশীপ পেয়ে গেলাম, তখনকার দিনে ৮৫০ টাকা। সেখানে আমার শিক্ষক ছিলেন রাকিবউদ্দিন সাহেব ... শর্মিলী আহমেদের স্বামী। উনি তখন বিধায়ক ভট্টাচার্যের সাথে কাজ করেছেন, কোলকাতায়। এখানে তিনি মাটির পাহাড় নামে একটা ছবিও করেছিলেন ... উনি সেটার এসিসটেন্ট ডিরেক্টর ছিলেন। তো উনি নাটক নিয়ে খুব ভাবতেন, আমি ভাবতাম যে- নাটক নিয়ে আবার ভাবার কী আছে। রামেন্দু দা’র বড়ভাই রণেন্দু স্যার, উনিও পলিটেকনিক-এ শিক্ষক ছিলেন। ওনারা সবাই নাট্যানুরাগী ছিলেন। ওখানে প্রচুর কালচারাল এ্যাকটিভিটি হতো। সেখানেই এক সময় আমি নবীণ বরণ নিয়ে একটা নাটক লিখে ফেললাম। নাগরিক নাট্যাঙ্গনের আবুল কাশেম, উনি তখন ওখানে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেন। উনি পড়ে বললেন যে- ভালো হয়েছে। তো ওটা করার পর বেশ নাম হলো। এই যে নাটক লেখা, এটা কিন্তু আমার এসেছে একটা শ্রদ্ধার জায়গা থেকে। সেটা হলো, যখন যাত্রা বা থিয়েটার দেখতাম, ছোটবেলায়, তখন আমি কিন্তু ভাবতাম যে এই পুরো ব্যাপারটার পেছনে নিশ্চয়ই একজন মানুষ আছে যিনি এটা লিখেছেন। তার মানে উনি তো দারুণ ক্ষমতাবান! সেখান থেকে হয়তবা আমি লেখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হই। তারপর থেকে পড়াশোনা করতে থাকি।
বিপ্লব বালা
তার আগে, স্কুল জীবনে সাহিত্য পাঠের অভ্যাস ছিল?
মামুনুর রশীদ
ছিল।
বিপ্লব বালা
লেখা শুরু কি নাটক দিয়েই?
মামুনুর রশীদ
না না, কবিতা দিয়ে শুরু, সেই ক্লাশ ফাইভে। আমার কিন্তু ইচ্ছা ছিল গায়ক হবো, তবলা শিখছিলাম, কিন্তু বাবার অত্যাচারে সেটা হয়নি হাঃ হাঃ। তো কবি রফিক আজাদ আমার মামা, ডাক নাম জীবন। জীবন মামা কবিতা লিখতেন এবং কঠিন কঠিন কবিতা, কিছুই বুঝি না। আশরাফ সিদ্দিকী আমার চাচা হন, তিনিও কবিতা লেখেন। রফিক আজাদ কিন্তু ওনারই ভাইয়ের শ্যালক ... তো ব্যাপার হচ্ছে যে, ওনার কবিতা বুঝি কিন্তু রফিক আজাদের কবিতা বুঝি না। আশরাফ সিদ্দিকীর সাথে বিকাল বেলায় হাঁটতে যেতাম, তখন জিজ্ঞাসা করতাম- চাচা কবিতা লেখেন কীভাবে? উনি বলতেন আল্লা বাণী পাঠায়, ওহী নাজিলের মতো, সেটাই লিখি। এরপরও কোনো কোনো কবির সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। যেমন নির্মলেন্দু গুণ।
পলিটেকনিক-এ পড়ার সময় এক বন্ধু ছিল, দেলোয়ার হোসেন বাচ্চু, এখন ‘সবুজ অপেরা’র মালিক। তারই বন্ধু ছিল নির্মলেন্দু গুণ, আনন্দমোহন কলেজে পড়তো। তো একবার বাচ্চুর সাথে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেলাম বেড়াতে, সেখানেই গুণের সাথে পরিচয়। ঐ দিনই আমি গুণকে ঢাকায় নিয়ে এলাম। তারপরের কাহিনী ওর বইতে লেখা আছে। তো যদিও শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে পরে আর লেখা হয়নি। নাটক লিখলাম। ৬৫/৬৬ সালের কথা। ৪/৫ টা নাটক লিখে ফেলেছি। রেডিওতে অডিশন দিয়ে পাশ করেছি। নাটকও করেছি কয়েকটা। আর টেলিভিশনও তখন এসে গেছে, সেখানেও ঘোরাঘুরি করছি। তখন কিন্তু প্রচুর টাকা আয় করতাম আমি।
বিপ্লব বালা
আপনার রাজনীতির সাথে যোগাযোগটা হলো কীভাবে?
মামুনুর রশীদ
পলিটেকনিক-এ থাকার সময় থেকে। তখন পাশের রুমেই ছিলেন রহমত আলী, এখন সে কালিয়াকৈরের এমপি। ও বয়সে একটু বড় ছিল, কিন্তু একই ক্লাশে পড়তাম। ও আমাকে উদ্বুদ্ধ করে ছাত্রলীগ করতে। আমিও গেলাম, ভালো লাগলো। তখন কাজী আরিফ ঢাকা সিটির সভাপতি, আমি আর শেখ শহীদ সহ-সভাপতি। ছয় মাসের মতো ছিলাম, পরে আর ভালো লাগলো না। বেটার আই লাইকড ছাত্র ইউনিয়ন। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নে যখন ঢুকতে যাব, তখন সেটা ভাগ হয়ে গেল- মেনন আর মতিয়া গ্রুপ।
আজাদ আবুল কালাম
মঞ্চ নাটক কীভাবে শুরু হলো?
মামুনুর রশীদ
পলিটেকনিক-এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে ভর্তি হতে গেলাম, কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার বললেন যে- কোনো পার্ট টাইম স্টুডেন্টের কাজ না ইংরেজী পড়া হাঃ হাঃ। তখন আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হলাম। ডিসকনটিনিউ করে পরে পাশ করলাম। পড়ালেখাটা ততদিনে গৌণ বিষয় হয়ে গেছে। খুঁজতে লাগলাম, কোথাও নাটক করা যায় কিনা। তখন শুনলাম যে আসকার ইবনে শাইখ মঞ্চনাটক করেন। তো ওনার পেছন পেছন ঘুরতে লাগলাম। উনি তখন নাটক লিখেন, ডিরেকশন দেন আমি তার এসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করি।
আজাদ আবুল কালাম
ওনার সাথে পরিচয় কীভাবে?
মামুনুর রশীদ
ঐ-যে টেলিভিশনে একটা নাটক লিখলাম, টেলিভিশনে নাটক লিখেই মুনীর চৌধুরী, আসকার ইবনে শাইখ, নূরুল মোমেন ওঁদের চোখে পড়ে গেছি। সবচেয়ে ভালোভাবে চোখে পড়লাম যখন টেলিভিশন থেকে শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক-র নাট্যরূপ দিতে বললো। এটা ৬৮/৬৯ সালের কথা। তখন আমি দুইজন নাট্যগুরু পেয়ে গেলাম। একজন আসকার ইবনে শাইখ, আরেকজন আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম নামে একজন নাটকের ডিরেকটার ছিলেন। হি ওয়াজ এ ওয়ান্ডারফুল এ্যাক্টর অলসো। ওনার বাসায় বসে সারারাত নাটক লেখাতেন আর কারেকশন করে দিতেন ... খুব নিঃস্বার্থ লোক ছিলেন। আবদুল্লাহ আল-মামুনভাইয়ের ছোটভাই আমার বন্ধু ছিলো, কিন্তু মামুনভাই প্রথম দিকে তেমন কাজ দেননি, পরে কিছুটা দাঁড়ানোর পর কাজ দিলেন এবং সংশপ্তক-টা তিনিই আমাকে ডেকে বললেন নাট্যরূপ দেয়ার জন্য। তখন শহীদুল্লাহ কায়সারের সাথেও পরিচয় হলো। এর পরপরই দেশে আন্দোলন শুরু হয়ে গেল।
আজাদ আবুল কালাম
তখনও তো রাজনীতির সাথে জড়িত?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, কিন্তু কোনো পলিটিক্যাল পার্টির আন্ডারে না। আমার জীবনটা তো তখন নানা কিছুর সাথে জড়িত। একদিকে নির্মলেন্দু গুণ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ... এদের প্রত্যেকের সাথে প্রায় প্রতিদিন নিউমার্কেটের কর্নারে আড্ডা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের পেছনে পেছনেও তখন ঘুরি ... এটাও এক ধরনের ব্যস্ততা হাঃ হাঃ, তারপর রাতের বেলা ‘ক্যাফে ডি তাজে’র ওখানে একটা গাঁজার আসর বসতো, সেখানেও বসা হতো। সেই সময় সিনেমার সাথে একটা যোগাযোগ ঘটে যায়। সুজয় শ্যাম, সমর দা, রাজা হোসেন খান, সামাদভাই, রোজী সামাদ, জহির রায়হান এদের সাথেও যোগায়োগ হলো, আড্ডা হতো।
হাসান শাহরিয়ার
এই আড্ডাগুলো কোথায় হতো?
মামুনুর রশীদ
ক্যাফে ডি তাজে বা সামাদভাইয়ের বাসায় ... রোজি সামাদের হাজবেন্ড ছিলেন। আরেকটা আড্ডা ছিল পুরান ঢাকায়। বিউটি বডিং আর শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন, এটা একটা বিরাট ব্যাপার... ৫০ পয়সায় বিরিয়ানী। আগেই তো বললাম তখন কিন্তু আমার অনেক ইনকাম। টেলিভিশনে একটা নাটক লিখলে ৪৫০ টাকা দিত। ডিজি’র বেতনও ৪৫০ টাকা হবে কিনা সন্দেহ। এমনও গেছে যে- সেই মাসের চারটা নাটকই আমি লিখেছি। তখন থেকে আমার পরিচয়ের গণ্ডীটাও বাড়তে লাগলো। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এদের সাথেও পরিচয় হয়েছে। আতাভাইয়ের সাথেও পরিচয় হয়েছে, সেটা অবশ্য আগেই হয়েছে ৬৯ সালে, তখনও আলাপ করতাম কীভাবে মঞ্চনাটক করা যায়।
আজাদ আবুল কালাম
আমরা জানতে পারলাম যে, আপনার ঐ সময়ের আড্ডাটা কিন্তু কবিকূলের সাথে বা সাহিত্যিকদের সাথেই বেশি হয়েছে। তাহলে একটু জানতে চাই যে- আপনি কবি বা কথা সাহিত্যিক হলেন না কেন?
মামুনুর রশীদ
তার আগেই তো মাথায় নাটক ঢুকে গেছে। তুমিতো ময়মনসিংহের নূরুল আনোয়ারকে চেনো। তার ওখানে গেলে রবীন্দ্রনাথ কখন কোন গান লিখেছেন, তার বুৎপত্তিসহ বলতে শুরু করতেন। তার ওখানেও আমার অসাধারণ সময় কেটেছে ... তো আমি তো সঙ্গীতজ্ঞও হতে পারতাম। তিনি আমাকে বলেছিলেনও যে তুমি গান করো, তোমার গলার বেইজটা ভালো ... কিন্তু ওগুলো কিছুই হয়নি, কারণ নাটকটাই কীভাবে কীভাবে যেন ভেতরে ঢুকে গেছে।
বিপ্লব বালা
ততদিনেও তো কেবল টেলিভিশন নাটকই লিখেছেন। তো মঞ্চনাটক করবেন এটাকে জাগ্রত রাখলেন কীভাবে?
মামুনুর রশীদ
মঞ্চ সব সময়েই ভেতরে ছিল। তখন কতগুলো নাটক হতো। যেমন- চীন-পাকিস্তান মৈত্রী সমিতি লাল লণ্ঠন করলো। আবদুল্লাহ ইউসুফ ডিরেক্টর, আমি এসিসটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে ঢুকে গেলাম। বুলবুল আহমেদ, নাজমুল হুদা বাচ্চু এরা অভিনয় করতো তখন।
বিপ্লব বালা
সংস্কৃতি সংসদের সাথে ছিলেন?
মামুনুর রশীদ
যোগাযোগ ছিল কিন্তু জড়িত ছিলাম না।
বিপ্লব বালা
ড্রামা সার্কেলের নাটক দেখেছেন?
মামুনুর রশীদ
ড্রামা সার্কেল তো অনেক আগের। কোনো নাটক দেখা হয়নি। তবে বজলুল করিম, মীর মকসুদ-উস-সালেহীন ওনাদের নাম শুনেছি, চিনতাম। নাগরিক তখন মঞ্চনাটক করার চেষ্টা করছে ...
আজাদ আবুল কালাম
নাগরিক তো প্রথমে রেডিও-তে নাটক করলো তাই না?
মামুনুর রশীদ
রেডিও-রটা বলতে পারবো না, তবে টেলিভিশনে আমি প্রথম আতাউর রহমান আর ইনামুল হককে দিয়ে ইদিপাস-র অংশবিশেষ করালাম। তখন ইনামের সাথে আমার বন্ধুত্ব বেশি ছিল ... সে-ও টেলিভিশনে লিখতো, অভিনয় করতো।
আজাদ আবুল কালাম
টেলিভিশনে নাটক লিখলেও এটার বিকল্প জায়গা বা মঞ্চনাটকটা আপনার মাথায় কাজ করতো?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, কারণ ওখানে সফোস্টিকেশন ছিল। ওখানে মুস্তাফা মনোয়ারের মত লোক ছিল। মুস্তাফা মনোয়ারের তখন নাটকের দিকে প্রচণ্ড ঝোঁক। খুবই অভাবনীয় কাজ করলেন উনি টেমিং অব দ্য শ্রু। এটা দেখে তো আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেল। কস্টিউম, অভিনয় আর মুনীর চৌধুরীর অনুবাদ ... সব কিছুর সম্মিলনে যে কী হতে পারে এটা উনি দেখিয়ে দিলেন। আর তখন কিন্তু কোলকাতার সাথে একমাত্র যোগাযোগ রেডিও-র মাধ্যমে। শম্ভু মিত্রের অভিনয় শুনি, তৃপ্তি মিত্রের, নীলিম দাসের অভিনয় শুনি ... আবার আমাদের রেডিও-তেও ভালো ভালো নাটক হতো। খান আতার প্রডাকশন হতো, আবদুল্লাহ আল-মামুন তখন ভালো ভালো নাটক লিখতেন। ‘উল্টোরথ’ নামে একটা পত্রিকা আসতো কোলকাতা থেকে, তার মাধ্যমে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তের কাজের কথা শুনতাম। এছাড়াও ওখান থেকে যারা আসতো তাদের কাছে মঞ্চনাটকের গল্প শুনতাম। এভাবেই বোধহয় একটা মানস গঠন প্রক্রিয়া চলছিল এখানে মঞ্চনাটক করার ব্যাপারে। এগুলো স্বাধীনতার আগের কথা বলছি। তখন মনে হতো যে যদি দেশটা স্বাধীকার অর্জন করে তবে মঞ্চনাটক জাতীয় কিছু করবো।
আজাদ আবুল কালাম
তখন পর্যন্ত তো স্বাধীনতার ব্যাপারটা আসেনি?
মামুনুর রশীদ
না, তখনও স্বাধীকার, স্বায়ত্ত্ব¡শাসন এসব চলছিল। তখন তো রবীন্দ্র চর্চা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, টেলিভিশনে সেন্সরশীপ চলে এসেছে ... এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না ইত্যাদি। এগুলো বিভিন্নভাবে আমাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করছিল। এর মধ্যে আমি কিন্তু চলচ্চিত্র স্ক্রীপ্ট লেখা শুরু করলাম, সূর্যগ্রহণ, এটা ’৭০ সালে কথা। সামাদভাই করলেন। তখন ফিল্মের অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিল কিন্তু তারপর তো ’৭১ চলে আসলো। আমি প্রথমদিকে এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। পরে টাঙ্গাইল ফিরে গেলাম, ওখানে গিয়ে কাদের সিদ্দিকীর সাথে দেখা হলো ...
বিপ্লব বালা
কাদের সিদ্দিকীর সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল?
মামুনুর রশীদ
না, তার ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সাথে আগে পরিচয় ছিল। শুনতাম ওর এক ভাই আর্মিতে আছে। পরে চলে এসে রাজনীতিতে জড়িত হয়। আমরা দেখতাম যে, সে একটা ছোট বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পরে পাশের গ্রামের কুম্ভকাররা এসে আমাদেরকে অস্ত্রের সন্ধান দিলো। আমরা অস্ত্রগুলো এনে কাদের সিদ্দিকীকে দিলাম, ওর সাথে কিছুদিন ছিলামও।
বিপ্লব বালা
অস্ত্রের সন্ধান এলো কীভাবে?
মামুনুর রশীদ
কালিহাতিতে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধের পর আমাদের আর্মিরা কিছু অস্ত্র ফেলে যায়। সেই অস্ত্রগুলো পালরা ওদের পুনে ঢুকিয়ে মাটি দিয়ে লেপে দিয়েছিল। তখন আমাকে এসে খবর দিল যে- এই এই অবস্থা, এখন আমরা কী করি? কাদের সিদ্দিকীকে খবর দিলাম। গ্রামবাসীদের নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করে ওকে দিলাম। দুয়েকটা অপারেশনেও ছিলাম। পরে অবশ্য ঐ গ্রামেও থাকতে পারিনি। কারণ, কাদের সিদ্দিকীর ওয়ার স্ট্র্যাজেডির সাথে আমার ওয়ার স্ট্র্যাজেডি মিল ছিল না। পরে আগরতলা হয়ে কোলকাতায় চলে যাই এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিই।
হাসান শাহরিয়ার
কাদের সিদ্দিকীকে ছেড়ে কোলকাতায় কাদের কাদের পেলেন?
মামুনুর রশীদ
ওখানে গিয়ে পেলাম মুস্তফা মনোয়ারকে, আরো পেলাম হাসান ইমাম, আশরাফুল আলম, শহীদুল ইসলাম, মুস্তফা আনোয়ার, আবদুল্লাহ আল ফারুক, আবদুল জব্বার, জামিল চৌধুরী, বাদল রহমানকে। মুস্তফা মনোয়ার বললেন- চলো নাটক করি। বললাম- চলেন করি। তো নাটক লেখা হলো। সেই নাটকে একটা পাকিস্তানী জেনারেলের চরিত্র ছিল, বললেন- এটা কে করবে? তো একদিন ট্রামে যাচ্ছি, দেখি উল্টোদিক থেকে আলী যাকের আসছে। তখন আমি এসে বললাম যে রোলটা আলী যাকেরকে দিয়ে করান।
হাসান শাহরিয়ার
তিনিও কি তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন না?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, ও নিউজ কাস্টার ছিল। যাক্, তাকে বললাম- নাটক করবা নাকি? ও বললো পারবো? আমি বললাম- পারবা পারবা, আসো।
বিপ্লব বালা
রেডিও নাটক নাকি?
মামুনুর রশীদ
না না, মঞ্চ নাটক। আমার লেখা পশ্চিমের সিঁড়ি। তবে রেডিও-তেও তখন আমি একটা সিরিয়াল করতাম মুক্তির ডায়েরী, ওখানেও একটা আর্মির ক্যারেক্টার ছিল, বললাম- ওটাও তুমি কর। ও করলো, এভাবেই ওর অভিনয় জীবন শুরু হলো।
বিপ্লব বালা
কোলকাতায় থাকতেন কোথায়? আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল?
মামুনুর রশীদ
আর্থিক অবস্থা তো খুবই খারাপ ছিল। থাকতাম উদয়ন ছাত্রাবাসে। সেখানে নরেণ বিশ্বাস, আহমেদ ছফা আর আমি থাকতাম। নরেণ দা’ই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। আমি আর আহমেদ ছফা এক খাটে থাকতাম আর নরেণ দা’ একটু মোটা ছিলেন, ওনাকে দিলাম একটা খাট।
বিপ্লব বালা
ছায়ানটের সাথে আপনার যোগাযোগ ছিল?
মামুনুর রশীদ
না, যোগাযোগ ছিল না, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে তো জানতামই। তখন কিন্তু তারা একটু উচ্চবিত্ত পরিমণ্ডলের লোক ছিলেন ... এটা একটা সমস্যাও ছিল বোধহয় ...
আজাদ আবুল কালাম
তখন রবীন্দ্র চর্চার গণ্ডীটাও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বোধহয়, তাই না?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, কিন্তু তাদের কাজ কিন্তু বিরাট সাহসিকতাপূর্ণ ছিল ... যেমন- পহেলা বৈশাখ এভাবে উদযাপন করা কিন্তু সে সময়ে বিশাল কাজ!
আজাদ আবুল কালাম
মামুনভাই, পশ্চিমের সিঁড়ি দিয়ে সম্ভবত আপনি সিরিয়াসলি কাজ শুরু করেছিলেন ... আমি যেটা জানি যে- পশ্চিমের সিঁড়ি একটা সিম্বলিক প্লে। তো আপনার শুরুটাই সিম্বলিজম দিয়ে, একটু মেটাফোরিক, এ্যাবসার্ড ...
মামুনুর রশীদ
খুবই মেটাফোরিক।
আজাদ আবুল কালাম
এধরনের সিম্বলিজম দিয়ে শুরু করে পরে একেবারে রিয়েলিস্টিক ফর্মে চলে এলেন কেন?
মামুনুর রশীদ
দ্বিতীয় নাটকও কিন্তু এবস্ট্রাক্ট জায়গা থেকে করা গন্ধর্ব নগরী। এর মধ্যে আমার ইবসেন, গোর্কী এসব পড়া হয়েছে এবং এগুলো আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। কাফকা হয়ে শেষে টলস্টয় এগুলোও নাড়া দিল। তো ’৭৬ সালে আমি টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখলাম জনৈক কদম আলী। করার পর মনে হলো এটা মঞ্চের জন্যও ভালো হবে। পরে অনেকটা ট্রিলজির মতো হয়ে গেল ওরা আছে বলেই এবং ইবলিশ লেখার পর। এভাবেই আসলে রিয়েলিস্টিক ফর্মটা চলে আসলো লেখায়।
হাসান শাহরিয়ার
একটু পিছিয়ে কথা বলি ... এসব নাটক তো ’৭৬ সালের পর মঞ্চে এনেছেন ... কিন্তু ‘আরণ্যক’ তো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরো আগে?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে ১ ফেব্রুয়ারিতেই আরণ্যক নাট্যদল গঠন করি এবং ২০ ফেব্রুয়ারি ’৭২ তারিখে কবর নাটকটি করি আমার নির্দেশনায় ... সেখানে আলী যাকের অভিনয় করেছিল।
হাসান শাহরিয়ার
আরণ্যক নামটি দিলেন কেন?
মামুনুর রশীদ
টেলিভিশনে কথা হচ্ছিল যে- একটা নাটকের দল করবো, কী নাম দেয়া যায় ... আবদুল্লাহ আল-মামুন বললেন যে- ‘নাগরিক’ তো আছেই, তোমরা আরণ্যক হয়ে যাও। ব্যস, তারপরই নাম দিলাম ‘আরণ্যক নাট্যদল’।
আজাদ আবুল কালাম
আপনার বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা বা চিন্তা-ভাবনার শিফটিং এসবের পেছনে উৎপল দত্তের একটা বিরাট ভূমিকা আছে, সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
মামুনুর রশীদ
উৎপল দত্ত তো আমার কাছে একটা বিস্ময়! তার সাথে দেখা হওয়ার আগেও তার সম্পর্কে জানতাম। তার প্রথম নাটক দেখি টিনের তলোয়ার। এটা দেখে তো আমি রীতিমতো অভিভূত। আমি আর মুস্তফা মনোয়ার একসাথে দেখেছিলাম। তারপর অন্যান্য নাটকও দেখেছি, পড়েছি। বিশেষ করে উনি তো তখন ‘যপেন দা’ যপেন দা’, চায়ের ধোঁয়া’ এসব লিখছেন। মাইকেল, গিরিশ ঘোষ, শেক্সপীয়ার, ব্রেশট, গোর্কী এসব নানা বিষয় নিয়ে লিখছেন এবং এসব বিষয়ে যে তার জানার কী বহর সেটা চিন্তাও করা যায় না। তার লাইব্রেরিতে বসে যখন কথা হতো, সেটা অভিভূত হওয়ার মতো। উৎপল দা’র পাশাপাশি তাপন সেনও আমাকে প্রভাবিত করেছিল। তাপস দা’র লাইট ও পাশাপাশি নাটক নিয়ে যে ব্যাখা সেটা তো অসাধারণ। কেবল উৎপল দত্তের না শম্ভু মিত্রের নাটকও দেখেছি। ওনার ডলস হাউজ দেখে তো মাথা খারাপ হয়ে যাবার দশা, তারপর পাগলা ঘোড়া দেখলাম ...
হাসান শাহরিয়ার
রক্তকরবী, চার অধ্যায় দেখেছেন?
মামুনুর রশীদ
না দেখা হয়নি। তারপর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক দেখেছি, অভিনয় দেখেছি। কী চমৎকার অভিনয়! উনি মানুষ হিসেবেও ভালো ছিলেন। কোলকাতায় মুক্তাঙ্গন নামে একটা জায়গায় নাটক হতো, সেখানেও নাটক দেখেছি। তো এ সব কিছু মিলিয়ে আসলে মঞ্চনাটকটা করতে হবেই এমন একটা ব্যাপার দাঁড়িয়েছিল। তবে আমার ভেতরে উৎপল দা’র প্রভাবই বেশি মনে হয়ে। উনি বলতেন- আই এ্যাম নট এন আর্টিস্ট, আই এ্যাম এ প্রোপাগান্ডিস্ট ... আমিও আজকাল বলে থাকি যে- আমি আসলে একজন প্রচারক।
হাসান শাহরিয়ার
আপনার নাটকে রাজনীতি সরাসরি আসে এবং আপনার দলও একই ধরনের স্লোগানে বিশ্বাসী। রাজনীতি তো সরাসরি করেননি কখনো, ভবিষ্যতে করবেন?
মামুনুর রশীদ
এটা আমার নিজের কাছেও একটা প্রশ্ন যে- সরাসরি রাজনীতি না করেও নাটকে রাজনীতি ছাড়তে পারিনি। আসলে স্বাধীনতা, তারপর সারা বিশ্বেই সমাজতন্ত্র বা এই ধরনের জীবন দর্শনের একটা হৈচৈ ছিল বলে বুঝেছি যে- জীবনে রাজনীতিটাই মুখ্য। এখন সেটাকে কীভাবে নাটকে আনা যায় তার একটা প্রচেষ্টা তো থাকবেই। সেদিক থেকে আমি বোধহয় একটু বেশি মাত্রায় সরাসরি এনেছি। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, শ্রেণী সংগ্রামকে যদি সামনে রাখা যায় তাহলে নাটকের চরিত্রগুলো খুব স্পষ্ট হয় আমার কাছে।
আজাদ আবুল কালাম
সেক্ষেত্রে এধরনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আপনার মনে হয়নি যে- মানুষকে কখনো কখনো ছোট করে ফেলেছেন বা ক্লীশে করে ফেলেছেন?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, সেটা আমার মনে হয়েছে। মনে হওয়ার পরই কিন্তু আমার লেখার ধরনের পরিবর্তন করেছি। আমার মনে হয়েছে মানুষকে ঠিক এভাবে দেখা ঠিক না। জেনেটিক্যালি মানুষের ভেতরে খারাপ-ভালো এসব ব্যাপার আছে, তাই খুব সরলভাবে বিশ্লেষণ করা ঠিক না। ধনী মানেই সে গরীবকে মারতে যাবে না আবার গরীব মানেই এই না সে ধনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবে। প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যেই লড়াই আছে এবং সেই লড়াইটা আবিষ্কার করার জন্য কেবল শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বটাই যথেষ্ট নয়।
হাসান শাহরিয়ার
এই বোঝাটা কি আমরা জয়জয়ন্তী থেকে দেখলাম?
মামুনুর রশীদ
আমার মনে হয় সমতট থেকে। পরে মানুষ নাটকে এসেছে এবং তারপর জয়জয়ন্তী। আসলে সত্তরের দশকে আমাদের লেখাগুলো খুব স্কীমিটিক হয়ে যাচ্ছিল ... স্কীম নিয়ে বসে লেখা, হুইচ ওয়াজ নট গুড অলসো। পরবর্তী সময়ে দেখছি এই স্কীম থেকে আর বের হতে পারছি না। নাটকে একটা গণ চরিত্র থাকে এবং কোথায় যেন আমাদের বাধ্য করে একটা সীমাবদ্ধতায় নিয়ে যেতে।
হাসান শাহরিয়ার
এসব ভাবার সময়ে বা এই যে লেখার শিফটিং করছেন সেগুলো কী আপনি নিজে নিজেই ভেবেছেন নাকি দর্শক এখন কী ভাবছে না ভাবছে এগুলোও আপনাকে প্রভাবিত করেছে?
মামুনুর রশীদ
আসলে যখন আমি ভাববো যে আমার নাটক কমিউনিকেট করাতে হবে, তখনই কিন্তু বোঝা যায় যে আমার মাথায় দর্শক আছে। তবে আমার ভাবনাটাকে দর্শকের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চাই, দর্শকের কথা ভেবেই নাটক লিখি এটাও কিন্তু ঠিক না। সুতরাং এইসব শিফটিং আমার মনে হয়, আমার নিজের ভাবনা, দর্শক ভাবনা সবকিছু মিলিয়েই হয়।
হাসান শাহরিয়ার
শুরুতে নাটক করতে গিয়ে দর্শক টানতেন কীভাবে ... মানে পরে কিন্তু দেখলাম আপনাদের একেকটা দলের কম-বেশি একেক রকম নির্দিষ্ট দর্শক আছে, প্রথমে নিশ্চয়ই দর্শক পেতে কষ্ট হয়েছে?
মামুনুর রশীদ
অবশ্যই, খুবই ডিফিকাল্ট ছিল। তবে সত্তরের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক নামকরা নাটক আমরা করতে পেরেছি। ফলে নাটকের দর্শক সেই সময়ে তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়। একই সাথে কিছু নাটকের নাম করতে পারবে তোমরা। ধরো- ওরা কদম আলী, সুবচন নির্বাসনে, মুনতাসির ফ্যান্টাসী, সৎমানুষের খোঁজে এমনকি শকুন্তলা-ও বেশ নাড়া দিয়েছিল। সেই তৈরি দর্শকই কিন্তু তারপর থেকে নাটক দেখছে। এখন অবশ্য নতুন দলও দর্শক তৈরি করছে, নিজস্ব দর্শক। যেমন- তোমার (আজাদ আবুল কালাম) প্রাচ্যনাটের নিজস্ব দর্শক আছে বলে আমি মনে করি।
হাসান শাহরিয়ার
আপনারা কিন্তু দলের বাইরের নাট্যকারের নাটক করেননি। কোরিওলেনাস ছাড়া, যদিও সেটাও আপনার দলের নাট্যকারেরই অনুবাদ। এটা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাকি আপনা আপনি হয়ে গেছে?
মামুনুর রশীদ
না উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না। তবে আমাদের দলে আমরা নাট্যকার পেয়েছি, একাধিক নাট্যকার পেয়েছি যারা আমি বলবো ভালো নাট্যকার। আমি আবদুল্লাহেল মাহমুদ, মান্নান হীরার কথা বলছি। তো তাদের নাটক, আমার নাটক, এগুলো করতে করতেই আসলে বছর পার হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা দলের দায়িত্ব বলেও আমি মনে করি। তবে আমার ইচ্ছা আছে চেকভ করার। দেখি সুযোগ হয় কিনা।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা দেখেছি আপনি নাটক লেখার ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন এনেছেন। সেই সাথে আমরা দেখেছি যে, দলের নাট্যচর্চার ভাবনা-চিন্তুা নিয়েও কিছু কাজ করেছেন। এর মধ্যে আমরা আপনাদের মুক্তনাটকের কথা বলতে পারি। এটা শুরু করার ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করুন।
মামুনুর রশীদ
আমাদের চিন্তাটা ছিল থিয়েটারটাকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া। একটা সময়ে যখন মার্কসিজম, বিবর্তনবাদ, অস্তিত্ববাদ এগুলো পড়লাম, তখন মনে হলো শিল্প আর জীবন তো একসময় এক জায়গায ছিল। যে লোকটা শিকারে যাচ্ছে, সে-ই শিকার করে গান গাইতে গাইতে ফিরছে। পরে সে-ই অভিনয় করে দেখাচ্ছে। আবার যে ধান কাটছে, রান্না-বান্না করছে সে-ই আবার গান গাইছে। তো এগুলো থেকে অনেক রিচ্যুয়াল তৈরি হয়েছে। আমি কিন্তু মানুষের মহত্বম সম্ভাবনায় বিশ্বাসী। সেই থেকে গ্রামের একজন নিরক্ষর মানুষও যে অভিনয় করতে পারবে এবং সেটা তার রিচ্যুয়ালের অংশ হবে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। এই এক্সপেরিমেন্ট আমি প্রথম করি মানিকগঞ্জে, মাটিকাটা মেয়েদের নিয়ে। ওরাতো প্রথমে বোঝেই না, কীসের কী অভিনয় ... পরে ওদের যে বঞ্চনার জায়গাটা, প্রতারণার জায়গাটা এগুলো বের করতে বললাম। তো ওরা যেটা বের করছিল সেখানে কোনো বানানো গল্প নেই, একেবারে আয়নায় নিজেদের দেখতে লাগলো। ঐ গল্প ধরে ধরেই বলেছি যে তাহলে তুমি হও অমুক, তুমি হও তমুক। এবং আমাদের দেখাও যে কীভাবে তোমাকে অমুকে শোষণ করেছে, কথাগুলো কী ছিল ইত্যাদি। এভাবে মহড়া দিতে দিতে নাটক দাঁড়িয়ে গেল। এর জন্য কয়েকজনের চাকরি চলে গেল, আবার সবাই সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করে সেই চাকরি ফেরতও নিল।
হাসান শাহরিয়ার
এটাতো আরণ্যক মুক্তনাটক শুরু করার আগের কথা বলছেন বোধহয়।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, আমাকে প্রশিকা থেকে বলা হয়েছিল তাদের একটা ওয়ার্কশপে ক্লাশ নেয়ার জন্য। তখন তো এনজিও এতো ভয়াবহ রূপ নেয়নি। প্রশিকাও তখন খুব ছোট। তো সেখানে ক্লাশ নিতে গিয়ে অনেক নাটকের কথা বলতাম ... তখন ওদের একজন বললো যে, কাছাকাছি মাটিকাটার মহিলারা আছে তাদের নিয়ে নাটক করতে। তারপর সফল হওয়ার পর ইউনিসেফের এক কর্ত্তা, প্রয়াত ড. এম আর খান আমার ইবলিশ নাটক দেখে বললেন ওনার বাসায় যেতে। তারপর উনি বললেন যে- মানিকগঞ্জে যে কাজটা করেছি সেটা আবার শুরু করা যায় কিনা। বললাম যায়। তখন আমাকে কুমিল্লার বার্ডের ক্রিয়েটিভ ফ্যাকাল্টিতে কাজ করার সুযোগ দিলেন। সেখান থেকে কুমিল্লায় মিয়াবাজার বলে একটা জায়গা আছে সেখানে কাজ করলাম।
হাসান শাহরিয়ার
এটা ব্যক্তি মামুনুর রশীদের কাজ না আরণ্যকের কাজ?
মামুনুর রশীদ
আরণ্যক কীভাবে ঢুকলো সেটাই বলছি ... আমি যখন কাজ করতে গেলাম তখন আমি বললাম যে- আমার সাথে আরো লোক লাগবে। তারা রাজি হলো। তখন আমি আরণ্যককে নিয়ে গেলাম। মিয়াবাজারে কাজ করার পর বার্ডে শেষ দিন ওরা কদম আলী করলাম। তারপর ওরা বললো আরো দশটি জেলায় কাজ করার জন্য।
হাসান শাহরিয়ার
ওরা টাকা দিত নিশ্চয়ই।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, তবে বেশি না। প্রত্যেক জেলায় যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া মিলিয়ে তখনকার সময়ে দশহাজার টাকা করে দিত।
হাসান শাহরিয়ার
আরণ্যকের কে কে যেত?
মামুনুর রশীদ
সবাই। সবাইকেই যেতে হতো।
আজাদ আবুল কালাম
বাংলাদেশ মুক্তনাটক দল কখন করলেন?
মামুনুর রশীদ
ওরা যখন ফান্ডটা তুলে নিল, তখন থেকে সারা বাংলাদেশ ব্যাপি মুক্তনাটক দল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করি। ওখান থেকে যে টাকাটা বেঁচেছিল সেটা দিয়ে শুরু করলাম। পরে যেখানে যেতাম, ওখানে স্থানীয় লোকজনই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিত।
হাসান শাহরিয়ার
অভিনয় তো ঐ এলাকার লোকজনই করতো, আপনাদের কাজটা কী ছিল?
মামুনুর রশীদ
আমরা উদ্যোক্তা ছিলাম। সেখানে গিয়ে গল্প ঠিক করে প্রশিক্ষণ দিয়ে নাটক নামিয়ে দিয়ে আসতাম।
হাসান শাহরিয়ার
ঢাকা থিয়েটারের গ্রাম থিয়েটার আর আপনাদের মুক্তনাটক কি একই সময়ের?
মামুনুর রশীদ
না, ওদেরটা পরে হয়েছে।
আজাদ আবুল কালাম
তখন আরণ্যকের কাজ নিশ্চয়ই থেমে থাকেনি। আরণ্যক কী কী কাজ করতো তখন?
মামুনুর রশীদ
ইবলিশ, নানকার পালা। আর মুক্তনাটকের অভিজ্ঞতা দিয়ে আবদুল্লাহেল মাহমুদ করলো সাতপুরুষের ঋণ।
হাসান শাহরিয়ার
মুক্ত নাটক নির্মাণের পর্যায়গুলো একটু বলবেন? নতুন নাট্যকর্মীরা জানতে পারবে।
মামুনুর রশীদ
কোনো একজন পরিচিতজনের সাথে নির্দিষ্ট কোনো গ্রামে যাই। সেখানে ওরাই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। সেখানে আমরা ছাত্র, কৃষক বা হয়তো গান করে বেড়ায় কিংবা জেলে ... যে-ই হোক না কেন তাদের সাথে বসি এবং সেখারকার কোনো কাহিনী সংগ্রহ করতে বলি। অথবা প্রথমে বলি যে- আপনাদের সমস্যাগুলোর কথা বলেন। তো হয়তো বলে যে- না, আমাদের কোনো সমস্যা নাই। আমরা রাজনীতির কারণেই ঐ শ্রেণী বৈষম্য বা নিপীড়ন ... এসব কথা শুনতে চাইতাম। তো প্রথম দিন বলে- না কোনো সমস্যা নাই। ওরাই আবার দ্বিতীয় দিন কিছু কিছু সমস্যার কথা বলে। এমন করেই এগুতে থাকে। নতুন মুখ আসে আবার পুরাতন অনেকে চলে যায়। নাটক করতে দেবে না, এমন জোটও তৈরি হয়, তবে এগুলোর মধ্য দিয়েই নাটক এগিয়ে যায়। স্ক্রীপ্ট তৈরি হয় মুখে মুখেই। ওরাই বলে, এমনকি যারা রিহার্সেল দেখে, তারাও বলে এটা এটা বলতে হবে ইত্যাদি। তো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটে শো-র সময়। নাটক দেখতে দেখতে দর্শক বোঝে যে এটা তাদের কোনো একটা ঘটনা। তখন হয়তো দর্শক সারি থেকে নাটকের মধ্যেই একজন ঢুকে যায়, বলে- টিপ সইটা এভাবে দে, এভাবেই দিছিল, আমি সাক্ষী ইত্যাদি হাঃ হাঃ। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা!
হাসান শাহরিয়ার
নাট্যকার হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই অনেক উপাদান পেয়েছেন।
মামুনুর রশীদ
নিশ্চয়ই অভিনেতারাও অনেক চরিত্র দেখার সুযোগ পেয়েছে, এগুলো পরে কাজেও লাগিয়েছে।
হাসান শাহরিয়ার
আশির দশক পর্যন্ত মুক্তনাটকের কার্যক্রম ছিল, তাই না? এখন তো কোনো কার্যক্রম নেই বোধহয়।
মামুনুর রশীদ
না, নব্বুই দশকেও ছিল। তারপর আর চালাতে পারলাম না। আসলে বাস্তবতা হলো যারা মুক্তনাটকের সাথে জড়িত ছিল তাদের সবাইকে গণ সাহায্য সংস্থা কিনে নিল। যারাই চাকরির জন্য ওখানে গিয়ে বলতো আমি মুক্তনাটক করি, তাকেই কিনে নিত। অর্থনৈতিক ব্যাপারে কিছু করতে না পারলে যেটা হয় আরকি। এখন ব্র্যাক, প্রশিকা, তারা সেইম আদলে করছে।
আজাদ আবুল কালাম
এবার অন্য একটা প্রসঙ্গে বলি ... আমার কাছে মনে হয়েছে আপনার ইবলিশ নাটকে একদিকে ডেলিবারেট সেন্স অব প্রপাগান্ডা আছে, আবার অন্যদিকে ওটার একটা এপিক ইমেজও আছে। এটা আমি টেক্সট-এর কথা বলছি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে প্রযোজনায় এটার এপিক জায়গাটা বা তার বিশালত্বটা আনা যায়নি বা আনতে পারেননি। যেমন প্রযোজনার উৎকর্ষতার জন্য আমরা কীত্তনখোলা-কে এপিক বলি, কিন্তু একই গুণাগুণ ইবলিশ-এ থাকার পরও এটাকে এপিক বলি না। এবং আপনার অনেক নাটকই কৌশলগত কারণে ঐ জায়গায় যেতে পারেনি। আপনার কী মনে হয়?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, হতে পারে। এটার একটা কারণ হতে পারে, আরণ্যকে কিন্তু ঐ সময়টাতে কেউ অভিনেতা হয়ে আসতো না। এসে অভিনেতা হতো, মানে আমাকে কেবল স্ক্রীপ্ট লিখলেই চলতো না, নির্দেশনা দিলেই চলতো না, অভিনেতাকেও হাতে ধরে শেখাতে হতো। এমনকি টাকাও জোগাড় করতে হতো। এজন্য বোধহয় সৃজনশীল কাজগুলোর জন্য যে সময়টা দেয়া দরকার সেটা দেয়া হয়নি। ঢাকা থিয়েটারের সেই সমস্যাটা কখনোই ছিল না। তাদের জামিল আহমেদের মতো ডিজাইনার ছিল, যে নিজের চিন্তাতেই সব করতে পারে, এক দল ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিল। তবে আমি বলবো এখন আর আমার দলের সেই সমস্যাটা নেই। এখন নির্দেশক আছে, ডিজাইনার আছে, ভালো অভিনেতা আছে। এবং আমার মনে হয় জয়জয়ন্তী থেকে আমি আমার মতো করে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে পেরেছি।
হাসান শাহরিয়ার
আপনি সব সময়েই চেয়েছেন যেভাবেই হোক থিয়েটার করবেন। এখনো টিভি মিডিয়ায় এতো কাজ করেও আপনি মঞ্চে অনেক তরুণদের থেকেও নিয়মিত সময় দিচ্ছেন। তো কেবল থিয়েটার করে বাঁচা যায় কিনা এমন ভাবনা থেকেই বোধহয় ‘বাঙলা থিয়েটার’ তৈরি করেছিলেন, তাই না? ওটা নিয়ে কিছু বলুন।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, আর প্রথম দিকে সফলও ছিলাম। যখন মানুষ নাটকটা নামালাম, এমন মাসও গেছে যে একেকজন দুই-আড়াই-তিন হাজার টাকাও আয় করেছি। মানুষ নাটক নিয়ে বিদেশও গেছি। কিন্তু সমস্যা হলো বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য বা জীবন যাত্রার এমন একটা অবস্থা যে, ঠিক কত টাকা হলে তোমার চলবে সেটা তুমি নিজেও জান না। পশ্চিমবঙ্গ হলে আমার মনে হয় নাটক করে খেতে পারতাম।
হাসান শাহরিয়ার
প্রফেশনাল দল করার জন্য যে সাংগঠনিক কাঠামো দরকার, সেটা কি বাঙলা থিয়েটারের আছে?
মামুনুর রশীদ
না, তা নাই। সেটার জন্যও টাকা দরকার। এর কারণেই খুব বেশি কিছু হয়তো করতে পারিনি। এখন ইচ্ছা আছে, ছোট কাস্টের নাটক নামিয়ে কিছু করা যায় কিনা। চে’র সাইকেল দিয়ে আবার শুরু করলাম। একবার ভেবেছিলাম একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে, একশজন দর্শক বসানো যায় এমন একটা বাড়ি, সেখানে নাটক করা যায় কিনা। এখন ‘পালাকার’ যেটা করছে, আমিনুর রহমান মুকুল কিন্তু আমার ধারণা খুব ভালো একটা উদ্যোগ নিয়েছে, স্টুডিও থিয়েটার করে প্রতি শুক্রবার নাটক দেখাচ্ছে। তবে প্রফেশনাল থিয়েটার করলে কিন্তু পপুলার পারফরমার লাগে। তা না হলে দর্শক আনা খুব কঠিন।
হাসান শাহরিয়ার
পপুলার পারফরমার নিয়ে কাজ কিন্তু করেছেনও, কিন্তু আমি যদ্দুর জানি কয়েকটি শো হওয়ার পর দেখা গেছে ঐ পারফরমারের দল থেকে আপত্তি উঠেছে যে- কেউ বাইরে কাজ করতে পারবে না। এটা কি সঠিক তথ্য?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, সবাই বলতো আমি স্টারিজমকে ব্যবহার করছি। কিন্তু এখন দেখ সেই পারফরমাররা কিন্তু আর থিয়েটারও করে না। একটা ব্যাপার কী জান, আমাদের কারো কারো আইডিয়াটা হলো যত পার দুষ্টুমি, নোংরামি করে টাকা কামাও ক্ষতি নাই, কিন্তু থিয়েটার করে টাকা কামানো যাবে না। এর কারণেই এক সময় ওরা থিয়েটারও আর করতে পারে না।
আজাদ আবুল কালাম
আপনি একাধারে নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা। আবার সাংগঠনিক দায়িত্ব আপনার প্রচুর। আপনি আরণ্যকের কর্ণধার, বাঙলা থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান, আগেও একবার চেয়ারম্যান ছিলেন ... তো এতো কিছুর ফলে আপনার আর্টিস্টিক দিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাকি এগুলো পরিপূরক?
মামুনুর রশীদ
আসলে সমস্যা হচ্ছে। দেখ, যদিও গত তিন বছরে আমি রাঢ়াঙ নামিয়েছি, চে’র সাইকেল নামিয়েছি। টিভি মিডিয়াতে প্রচুর কাজ করেছি। আবার চেয়ারম্যানগিরিও করেছি হাঃ হাঃ। কিন্তু মাঝে মাঝে খুবই খারাপ লাগে, যখন বোঝাটা আমার একার উপর পড়ে যায়।
আজাদ আবুল কালাম
একটু অন্য প্রসঙ্গে আপনাকে জিজ্ঞাসা করি। আপনি নিজেকে মার্কসিস্ট ভাবতে পছন্দ করেন। আবার আপনার লেখায়ও এগুলোর ছাপ পাই। কিন্তু আমরা দেখি যে, আপনি কিন্তু একটু ভালো থাকার দিকে নজর আছে। যেমন ভালো একটা গাড়িতে চড়বেন, ভালো ভালো খাবেন, ভালো বাড়িতে থাকবেন। এই আপনিই আবার রাঢ়াঙ লিখেন, ইবলিশ লিখেন। তো কেমন কনফিউজিং না?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, এটা আমাকে প্রচুরজনের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে। বলে লিখেন তো ওরা কদম আলী, আর সিগারেট টানেন দামী দামী, হাঃ হাঃ। আমি বলি যে- দেখেনভাই নাটকের নাম তো ‘আমরা’ কদম আলী না, হাঃ হাঃ। আসলে হলো কী আমি নিজে কিন্তু দরিদ্র না। আমার জীবনে মধ্যবিত্তের ক্রাইসিস আছে, আরো অনেক জটিলতা আছে। আর দারিদ্রের সমবন্টন নিশ্চয়ই সমাজতন্ত্র না। আয়ের একটা উৎসও তো লাগবে। বহুদিন বদরুদ্দীন উমরভাই বলেছে যে- আপনি টেলিভিশনে যান কেন? আমি বলতাম- টেলিভিশনে যাই বলেই তো আপনি আমাকে ডেকেছেন। আমি নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ, আমার তো আকাঙ্খা থাকবেই। আয়ের উৎস না থাকলে আমাকে চাঁদা তুলে খেতে হবে। যদি আমার মেধা থাকে, সেটাকে আমি সৃজনশীল কাজে লাগিয়ে আয় করবো না? কিন্তু টাকা না থাকলে সৃজনশীলতা নিয়ে অনেক টিটকারী হতো যে- কিছু করতে পারে না, তাই শিল্পী শিল্পী ভাব ধরেছে। আমি দরিদ্র দর্শনে বিশ্বাসী না। আমি নিজে ভালো থাকবো, অন্যকেও ভালো রাখবো।
আজাদ আবুল কালাম
আপনার কী মনে হয়, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যেসব নাটক লিখেন বা অন্যান্য শিল্প মাধ্যমেও এই দর্শনের যে কাজ হয়েছে- গল্প, কবিতা, উপন্যাস যেকোনো মাধ্যমে ... এর দ্বারা কি সমাজের কোনো উপকার হয়েছে?
মামুনুর রশীদ
অবশ্যই। তবে বিশ্বে সমাজতন্ত্রের ক্রাইসিস, আমাদের দেশের মিলিটারী শাসন, স্বৈরতন্ত্র এসব কারণে ব্যাপারটা ভিজিবল হয়নি। রাজনীতিতে সুস্থতা থাকাটা তো জরুরী তাই না? আমাদের সমাজতন্ত্রী রাজনীতিবিদরা জনবিচ্ছিন্ন। তারা কী কারণে জনবিচ্ছিন্ন সেটা পর্যন্ত তারা খুঁজে দেখতে চায় না। বা তারা হয়তো স্বীকারও করে না যে তারা জনবিচ্ছিন্ন। এগুলোও আমাদের কাজের জন্য অন্তরায় বলে আমি মনে করি। আমরা অনেক নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে ভাবছি, নিয়তই নিজেদের পরিবর্তন করছি, নতুন ফর্ম নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু তারা ঐ এক জায়গায় পড়ে আছে। একই সুরে একই কথা যুগ যুগ ধরে বলে যাচ্ছে। সেদিন কর্নেল তাহেরের মৃত্যুবার্ষিকীতে এ কথাগুলো একইভাবে তাদের বলতে শুনেছি। তো সমাজের উপর সাহিত্যের প্রভাব ফেলতে হলে রাজনীতির সাপোর্ট লাগবে। আবার সাহিত্যও নিজেই একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।
আজাদ আবুল কালাম
মামুনভাই আপনি একবার বলেছিলেন যে, আসকার ইবনে শাইখের সাথে আপনার সখ্য ছিল। ওনার কোনো প্রভাব কি আপনার উপর পড়েছে?
মামুনুর রশীদ
আমি বলেছি যে, ওনার সাথে আমার ৬৮/৬৯ সালের দিকে পরিচয় হয়। এবং উনি প্রথমেই আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়ে বললেন যে, অদ্বৈত বর্মন হচ্ছে বেশি গ্রহণযোগ্য দ্যান মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। উনি বললেন যে- পদ্মা নদীর মাঝি লিখেছেন একজন ব্রাক্ষ্মণ আর তিতাস একটি নদীর নাম লিখেছেন এমন একজন যিনি নিজেই জেলে। উনি বলতে চাইলেন যে, অদ্বৈত বর্মন একেবারে আমার লেখক। আমি অবশ্য তার কথার সাথে একমত হয়নি। উনি তারাশঙ্ককরের ভক্ত ছিলেন। আপাদমস্তক একজন নাটকের লোক, কারো ভেতরে কোনো ন্যূনতম সম্ভাবনা দেখলেই কাছে টানতেন। কোনো দায়সারা গোছের লোক না, একজন ভালো ট্রেইনার ছিলেন। অভিনয় বা লেখালেখিও একেবারে হাতে ধরে শেখাতেন। এবং উনি কিন্তু তখন একেবারেই একজন অসাম্প্রদায়িক লোক ছিলেন।
হাসান শাহরিয়ার
মুনীর চৌধুরী, নূরুল মোমেন, সাঈদ আহমদ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
মামুনুর রশীদ
মুনীর চৌধুরী ভীষণ ইন্টেলেকচুয়াল ছিলেন। তার পাণ্ডিত্য অসাধারণ। উনি অনুবাদ করতেন, ওয়েস্টার্ন থিয়েটারের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়েছিলেন। কিন্তু ওনার সাথে সরাসরি ইন্টারেকশন ওভাবে হয়নি। নূরুল মোমেনকে চিনেছি নেমেসিস দিয়ে, ভালো নাটক। তবে উনি নিজের কথা বলতেন বেশি, সঙ্গতকারণেই তার সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়নি। সাঈদ আহমদের সাথে পরিচয় হয়েছে অনেক পরে। তিনি তো বিদেশেই থাকতেন বেশি। জানতাম যে, আমাদের একজন নাট্যকার আছেন যিনি ইংরেজিতে নাটক লিখেন, ওনার নাটক বিদেশেও হয়। ব্যাপারটা অবশ্যই একসাইটিং ছিল। পরে ওনার নাটক দেখেছি। মাইলপোস্ট খুবই ভালো নাটক। ব্যক্তিগত সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। খুব চমৎকার মানুষ।
আজাদ আবুল কালাম
নাটক তো সাহিত্যেরই একটা অংশ এবং নাট্যসাহিত্যও সাহিত্যের একটা বিশাল অংশ। কিন্তু আমরা আজকাল কিছু নাটক পাই যেগুলোকে বলা হচ্ছে ‘ন্যারেটিভ নাটক’, কেবল সেলিম আল দীনের লেখার কথা বলছি না, আমাদের আরেক বন্ধু বদরুজ্জামান আলমগীরও লেখে আরো অনেকে লেখে .. তো সেগুলো পড়লে আমার কিন্তু কথা সাহিত্যই মনে হয়। আমার কাছে চাকা, যৈবতী কন্যার মন বা তারাশঙ্করের কবি পড়লে একই রকম লাগে।
মামুনুর রশীদ
বর্ণনাত্মক নাটক আমাদের সাহিত্যে নতুন কিছু না। আমাদের নাট্য ধারায়ও নতুন কিছু না। মহাভারতের কথক ঠাকুর যখন গল্প বলে সেটা কী হয়? অবশ্যই বর্ণনাত্মক, বর্ণনাত্মকের ভেতর দিয়ে সে মহাভারত যুদ্ধটা দেখাচ্ছে।
আজাদ আবুল কালাম
সেলিম আল দীন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ওনার কাজগুলো অনেক বেশি থিওরাইজড হচ্ছে, অন্যদিকে আপনার কাজগুলো, পার্টিকুলারলি লেখাগুলো থিওরাইজড হচ্ছে না। সেলিম আল দীনের কাজকে থিওরী দিয়ে ব্যাখ্যা করছে, আপনার কাজকে কিন্তু থিওরী দিয়ে ব্যাখ্যা করছে না। আপনি এখন বলছেন বলে আমরা একটা স্কেলিটন পেয়ে যাচ্ছি যে, লেখাটা এভাবে এভাবে দাঁড়িয়েছিল। অনেক বছর পরের মানুষ কিন্তু এটা পাবে না। তো আপনার কি নিজেকে একারণে ইনসিকিউরড মনে হয়?
মামুনুর রশীদ
না এটা আমার একদমই মনে হয় না। কেন মনে হয় না? সেটা হলো আমি কিন্তু সেলিম আল দীনের মতো কেবল নাট্যকার না। আমি থিয়েটারের সবগুলো উইং-এর সাথে যুক্ত আছি, অর্থাৎ একটা বহমান শিল্পের স্রোতধারার সাথে যাচ্ছি। সেলিম কিন্তু সেই স্রোতধারার সাথে যাচ্ছে না। সে কেবল দেখছে। একটা জিনিস তৈরি করে সে ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে তীরে দাঁড়িয়ে দেখছে। এখানে তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে, থিওরাইজড হওয়ার প্রয়োজন আছে। আমারও আছে, সেটা আমার কর্মীদের সাথে। তো আমাকে কখনোই ইনসিকিউরড মনে হয় না।
আজাদ আবুল কালাম
আপনি তো নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, সংগঠক ... এগুলোর মধ্যে কোনটাকে আপনি এনজয় করেন বেশি?
মামুনুর রশীদ
অভিনয় হচ্ছে আমার গ্রেট প্লেজার।
আজাদ আবুল কালাম
আপনার নাটক পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে, দ্রুত শেষ করে দেয়ার একটা প্রবণতা আপনার ভেতরে আছে। হয়তো প্রযোজনার সময় সেগুলোকে শুধরে নেন, কিন্তু সে কারণে আমার কাছে স্ক্রীপ্টগুলোকে খসড়া মনে হয়। ফলে আপনার নাটক সাহিত্য হয়ে ওঠাটা কঠিন বলে মনে হয়। আপনার কী মনে হয়?
মামুনুর রশীদ
আমারও মনে হয়। একটা পর্যায় পর্যন্ত আমি নিজেও চাইনি যে, এটা সাহিত্য হয়ে উঠুক। সেই ভাবনা থেকে লিখতাম না, চাইতাম এটা নাটক হয়ে উঠুক। কিন্তু জয়জয়ন্তী থেকে লক্ষ্য করলে বোধহয় দেখা যাবে কিছুটা চেঞ্জ হয়েছে। আমি নাটকে কেবল একটু ডিরেকশন দিয়ে দিচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ তাই করেছে। কেবল সংলাপ লিখেছে ... সেগুলো তো সার্ভাইভ করে গেল। এটা ঠিক যে, ওনার সংলাপের গুণেই সার্ভাইভ করেছে। ডাকঘর এতো বিখ্যাত কীভাবে হয়? একজন ডিরেক্টরের জন্যতো বেশি কিছু লাগে না। অমল দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে, রুগ্ন একটি বালক- ব্যস, ইটস এনাফ ফর এন ইমাজিনারি ডিরেক্টর। আর নাট্যরচনাকে সচেতনভাবে সাহিত্যের দিকে নিয়ে যাওয়া, সেটা কিন্তু আমার নাই। সেলিম আল দীন বা সৈয়দ শামসুল হকের সাথে আমার বিরাট পার্থক্য হলো ওনারা পরিপূর্ণ নাটকটাই লিখেন, যেটা মঞ্চে না আসলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু আমি একটা স্কেলিটন দাড় করাই বাকীটা বা বেশিরভাগ জায়গাটা মহড়াকক্ষে গিয়ে হয়। আমার কাছে মহড়াকক্ষ সৃজনের বিশাল জায়গা মনে হয়।
হাসান শাহরিয়ার
এক্ষেত্রে নির্দেশক মামুনুর রশীদের সাথে নাসির উদ্দিন ইউসুফের নিশ্চয়ই মিল আছে ... মানে বাচ্চুভাইও কিন্তু বলেন ওনার পূর্ণাঙ্গ স্ক্রীপ্ট দরকার নেই, একটা আইডিয়া পেলেই হয়, বাকীটা নির্দেশকের কাজ।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, ওর ঐ ঝোঁকটা আছে কিন্তু বাচ্চুর ডিরেকশনের প্রক্রিয়া আর আমার প্রক্রিয়া কিন্তু এক না। বাচ্চু অনেক বেশি অভিনেতাদের উপর ডিপেন্ড করে, টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলোর দিকে অনেক বেশি ডিপেন্ড করে। সে কারণে ও সব সময় একটা কম্পোজিশন খোঁজে এবং সিনটাকে খুব চমৎকার দৃষ্টিগ্রাহ্য করার দিকে তার সাংঘাতিক ঝোঁক। কিন্তু আমি যেটা ভাবি সেটা হলো থিয়েট্রিক্যাল মোমেন্ট তৈরি করা। জয়জয়ন্তী-র কথাই ধরো, সেখানে প্রচুর সাইলেন্স আছে, সেটাও কিন্তু সাংঘাতিক নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করে, সেখানে আমার কালারফুল লাইট লাগবে না।
হাসান শাহরিয়ার
জয়জয়ন্তী-র সেট ডিজাইন কিন্তু পারফরমারদের জন্য ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিল বলে মনে হয়েছে। একটা ভার্টিক্যাল লাইন নেই, দাঁড়ালেই মনে হবে সব ফাঁকা ... রাঢ়াঙ-র অবস্থাও একই। আপনাদের এটা মনে হয়েছে?
মামুনুর রশীদ
কী বলো! মনে হবে না মানে। চিন্তা করো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কী পরিমান অসহায়, কোনো ভার্টিক্যাল সাপোর্ট নেই ... চারিদিক ফাঁকা ...
আজাদ আবুল কালাম
আপনার নাটকের চরিত্রগুলোকে নিয়ে একটু কথা বলি। আপনার লেখার ধরন যখন পাল্টাতে শুরু করলেন তখন দেখলাম যে, চরিত্রটা ইম্পোর্টেন্ট হয়ে যায়। যেমন ওরা কদম আলী-তে কদম আলী আর কদম আলী থাকে না, একটা সিম্বল হয়ে যায়। তেমনি যখন রাঢ়াঙ করতে আসেন, তখন যাকে নিয়ে আমরা প্রথম থেকেই ভাবতে থাকি যে এই প্রটাগনিস্টকে আমরা দেখবো ... এর আগে আমরা দেখেছি যে এতো অনায়াসে চরিত্রগুলো চলে আসতো কিন্তু রাঢ়াঙ দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে আলফ্রেড সরেণ ঐভাবে আসেনি। এই চরিত্রটার একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল ... এটা একটা ম্যাকবেথ হতে পারতো, এটা একটা ওথেলো হতে পারতো, হ্যামলেট হতে পারতো। কিন্তু তেমন কিছুই সে হলো না। আপনার কি মনে হয় চরিত্রটার প্রতি আপনি জাস্টিফাই করেছেন?
মামুনুর রশীদ
তার ঠিক উল্টো কথা বলেছে একটি পত্রিকা। লিখেছিল যে, আমার নাটক নাকি জনগোষ্ঠী নির্ভর না। নাটকে কিন্তু চরিত্রটাই মুখ্য হয়। তুমি সারা পৃথিবীর নাটকগুলো দেখ তাই দেখবে। রাঢ়াঙ- এ হয়েছে কী তোমার মতো দর্শকরা একটা এক্সপেক্টেশন নিয়ে ঢোকে,কারণ আলফ্রেড সরেণ সম্বন্ধে তোমরা জান, এর উপর অনেক লেখালেখি তোমরা পড়েছ। তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যেটা করতে চেয়েছি, জনগোষ্ঠীটাকে প্রাধান্য দিতে চেয়েছি। অনেক হিরো আমাদের সোসাইটিতে হঠাৎই হয়ে ওঠে। দেখা যায় ঐ জনগোষ্ঠী হারিয়ে যায় কিন্তু একজিস্ট করে ঐ হিরোই। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আগে শেখ মুজিব কিন্তু ঐ রকমভাবে খ্যাত ছিলেন না ... হি এপিয়ার্স সাডেনলি এন্ড বিকাম এ বিগ বিগ হিরো। তো আলফ্রেডও কিন্তু এখানে চলে আসে হিরো হিসেবেই। আমি আলফ্রেডকে নিয়েই নাটকটা লিখতে পারতাম এবং প্রথম খসড়াতে ছিলও তাই কিন্তু পরে মনে হলো যে আমি এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লিখি না কেন? সরেন তো ওদেরই হিরো, ওদের চলমান জীবনযাত্রার মধ্যেই তার আগমন।
আজাদ আবুল কালাম
আপনার নাটকে ইবলিশের আতশী ছাড়া আর কোনো নাটকেরই নারী চরিত্র এত বলিষ্ঠভাবে আসেনি। অথচ কিছু কিছু নাটকে এই সম্ভাবনাটা ছিল। যেমন- সঙক্রান্তি-তে বেদানা’র চরিত্রটির সম্ভাবনা ছিল, এমনকি আতশীর চেয়ে বড় জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত। এমনকি বাংলা নাটকেও একটা বড় চরিত্র সেটা হতে পারতো বলে আমার মনে হয়েছে।
মামুনুর রশীদ
একটা সমস্যা কী নাট্যকাররা সব সময় রিস্কলেস থাকতে চায়, মূল চরিত্রের ব্যাপারে। আমার কাছে মনে হয়েছে গফুরকে সার্ভাইভ করানোটা আমার কাছে ইম্পোর্টেন্ট।
আজাদ আবুল কালাম
না, আমি জানতে চাচ্ছি, আপনার নাটকে নারী চরিত্রগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে আসতে পারতো ... যেমন ওরা কদম আলী-তে রাবেয়া বা মানুষ নাটকে পতিতা কর্মীটি। কিন্তু আলটিমেটলি তা বের হয়ে আসেনি। এখানে আপনি নাট্যকার হিসেবে ‘পুরুষ’ হয়ে যান কিনা?
মামুনুর রশীদ
না, আমি সচেতনভাবে কখনোই পুরুষ নাট্যকার হিসেবে লিখি না। কারণ নারীদের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে হাঃ হাঃ।
আজাদ আবুল কালাম
আপনি তো থিয়েটার পারপাসে অনেকবার বিদেশ গেছেন। আমেরিকায় গেলেন ভিজিটর ফেলোশীপে। হংকং থিয়েটারের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। আপনি কোরিয়াও কিছু কাজ করেছেন। কানাডায় গেছেন, জার্মানীতে গেছেন ... তো এ সবই গেছেন থিয়েটারের পারপাসে। অর্থাৎ বাইরের থিয়েটারের সাথে আপনার কানেকশন খুব ভালো। তো এগুলো আপনার নাট্যচিন্তায় কেমন প্রভাব ফেলেছে?
মামুনুর রশীদ
অনেক, অনেক প্রভাব ফেলেছে। যেমন ধরো, কোরিয়া থেকে ফিরে এসে আমার দলে একটি ওয়ার্কশপ করিয়েছিলাম- ইউজ অব বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ইউজ অব রিদম-র উপর। এবং থিয়েটারের যে পেস ও রিদম এটা বোঝার জন্য কোরিয়ার ওয়ার্কশপটা আমার কাছে আশির্বাদ স্বরূপ। এটার পর আরণ্যকের প্রযোজনাতেও এর প্রভাব পড়েছিল, কারণ ডিরেক্টরিয়াল কাজের মধ্যেও আমি এগুলো ঢুকিয়েছি। প্রথমবার কানাডায় যাওয়ার পর ইন্ডিজেনাস পিপলের সাথে যোগাযোগ হয়, সেটা ১৯৮২ সালের কথা। এই যে আদিবাসি, আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান, বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার বলিভিয়া, ইকোয়ডোর, এলসালভাদার .. এই যে জনগোষ্ঠীগুলোর সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, ফেলগরি ইউনিভার্সিটিতে, আল বার্তোতে, হেড মন্টনে ... আদিবাসিদের উপর নিপীড়ন, তাদের সংস্কৃতির যে শক্তি, এগুলো ঐ সময় অনুভব করতে পেরেছিলাম। ’৮৫ সালে জাপানে একটা ফেলোশীপ পেয়েছিলাম, ১৫ দিনের জন্য। সেখানে গিয়ে ওদের শত বছরের ঐতিহ্য কাবুকির সাথে পরিচয় হলো এবং দেখলাম যে কীভাবে তারা তাদের ঐতিহ্যটাকে ধরে রেখেছে। এবং সেখানে আমি সুযোকির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। সুযোকি একটা মেথড, মার্শাল আর্ট। এই মার্শাল আর্টটাকে ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে থিযেটারে। তারপর হংকং-এ গিয়ে চাইনিজদের পিকিং অপেরা দেখলাম। এটা দেখার পর আমি চমকিত হয়েছি ... এটা এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ, এতো সার্কাস্টিক এবং নানা রকম বডি মুভমেন্ট। ওরা নাকের একটা মুভমেন্ট করবে বা ঠোঁটের একটা মুভমেন্ট করবে যে চট করে আলাদা একটা ল্যাঙ্গুয়েজ তৈরি করে ফেলে। এগুলো পরবর্তী সময়ে আমি আমার কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করেছি। আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয় ... সেটা হলো আমি একবার ব্যাংককে গিয়েছিলাম ১৫ দিনের জন্য। ঐ সময় থাইল্যান্ডের প্রিন্সেসের ৩৬তম জন্মদিন উপলক্ষে একটা রামায়ণ উৎসব হয়েছিল। সেখানে সাতটা দেশের রামায়ণ অংশগ্রহণ করেছিল। লাউস, ভারতীয় রামায়ণ, বার্মা, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের রামায়ণ, আরেকটা দেশের নাম মনে করতে পারছি না ... তো সাতটা রামায়ণ সাতদিনে হলো। ভারতীয় রামায়ণ করেছিল কথাকলি, লাউস, থাইল্যান্ড করেছিল ড্যান্স দিয়ে ... এরকম নানাভাবে করেছিল এবং শেষদিন করল একটা কোলাজ ... সাতটা রামায়ণ নিয়ে একটা কোলাজ। এটা আমাকে নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছে। তারপর পিটার ব্র“কের ওয়ার্কশপ করলাম মহাভারতের উপর, ইন্ডিয়ায়। তাইওয়ানে গ্রটস্কির এক ছাত্রী আছে, সুসু, তার একটা থিয়েটার আছে ‘ট্যুরিং থিয়েটার’। এই ট্যুরিং থিয়েটারের সাথেও আমি ঘুরেছি, বিভিন্ন গ্রামে, শহরে ... ওটা ভীষণ একসাইটিং এক্সপেরিয়েন্স ছিল।
আজাদ আবুল কালাম
আপনি কি একজন কমিউনিস্ট?
মামুনুর রশীদ
না, আমি একজন মার্কসিস্ট। আমি মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী।
আজাদ আবুল কালাম
একটা সময় কেউ কেউ মাওবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতো আপনাকে। এখন বললেন মার্কসবাদী, তাহলে ঐ বিষয়টা তৈরি হয়েছিল কেন?
মামুনুর রশীদ
আমি চীনপন্থী ছিলাম। কিন্তু ’৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীন একটা বড় ধরনের ভ্রান্তি করে আমাদের বেকায়দায় ফেলে দিল। অবশ্য ’৭৩ সালে যখন কংগ্রেসের রিপোর্ট বের হলো সেখানে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল- আমাদের কোনো প্রেজুডিস ছিল না। কিন্তু ভারত, সোভিয়েট ইউনিয়ন যেহেতু ওখানে ইনভলব হয়ে গেছে, সেজন্য আমরা বিরোধীতা করেছি। ... তো ঐ সময় সোভিয়েট ইউনিয়নকে সুপার পাওয়ার মনে করা হতো। এবং স্ট্যালিনের অন্ধভক্ত ছিলাম আমি ... কিন্তু পরে এক সময় ভ্রান্তি দূর হলো যে স্ট্যালিন এমন কঠোরভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করলেও পারতেন। আবার পরবর্তী সময়ে এসে যেসব তথ্য পাই তাতে মনে হয়েছে যে, সে এমন না করলে সমাজতন্ত্র টিকতো না। স্ট্যালিনের সময়টাতে আবার আমরা দেখেছি চীন সাঁই সাঁই করে উপরে উঠে যাচ্ছে, চায়নাকে দেখতাম তখন পৃথিবীর বিভিন্ন গণযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে ... এটা সে দেশের প্রতি দুর্বল হওয়ার পেছনে কাজ করেছে। যে চীনে ১৯৪৮ সালে মেয়েরা একটুকরো রুটির জন্য দেহ বিক্রি করেছে, সেই জায়গা থেকে চীনকে কোথা নিয়ে যাওয়া হলো!
আজাদ আবুল কালাম
মানে ওদের কালচারাল রেভ্যুলেশন দ্বারা অনেক বেশি ইন্সপায়ার্ড ছিলেন?
মামুনুর রশীদ
দুটোই ছিল ... ইন্সপায়ার্ডও ছিলাম, হতাশাও ছিল। এখন তো আবার আমি দেখছি যে, চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির লিডাররা সবচেয়ে বেশি করাপটেড।
হাসান শাহরিয়ার
অন্য প্রসঙ্গে আসি, আরণ্যক তৈরি হলো ’৭২ সালে, নাটকও করলেন, কবর। কিন্তু নিয়মিত নাট্যচর্চাটা ’৭৬ সাল থেকে শুরু করলেন কেন?
মামুনুর রশীদ
’৭২ সালে আমরা বেশ কিছু নাট্য অভিযাত্রা করেছিলাম, সে সময়ে তা ছিল বেশ দুঃসাহসিক। কিন্তু ’৭৩ সাল থেকে নানা কারণে ভাটা পড়ে। সে সময় ছবি প্রযোজনা করতে গিয়ে বেশ একটা মার খাই। সেই ধকলটা সামলে নিতে সময় লাগলো। কিন্তু এ সময়টায় কিন্তু বসে ছিলাম না। নিজেদের তৈরি করছিলাম। শিক্ষার কাজটা হচ্ছিল। ঐ সময়টাকে সেজন্য আমি খুবই মূল্যবান মনে করি।
হাসান শাহরিয়ার
আপনিতো বিশ্বের অনেক নাট্যকারের নাটক পড়েছেন। আমাদের দেশেও তাদের নাটক হয়েছে। তো প্রশ্ন হলো বিশ্বের নাট্যকারদের সাথে তুলনায় আমাদের কোনো নাট্যকারকে আপনি বিশিষ্ট মনে করেন?
মামুনুর রশীদ
নাট্যকারদের মধ্যে তুলনামূলক বিচার করা আমার জন্যে সম্ভব নয়। অধিকাংশ নাট্যকারের নাটক আমরা পড়েছি ইংরেজি ভাষায়। আমাদের নাট্যকারদের নাটক খুব কমই ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে। নাটকে সারা পৃথিবইি পশ্চিমা শাসিত। এমনকি ইবসেনের নাটকও বহু পরে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। আমাদের নাট্যকারদের সে জন্যে অপেক্ষা করতেই হবে। নাটককে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার ব্যাপারটি নানা কিছুর উপর নির্ভর করে। এমনকি একই ভাষাভাষী দুই বাংলা, কিন্তু বিনিময় হচ্ছে কতটুকু? পশ্চিম বাংলার নাটক এখানে অভিনীত হলেও এ বাংলার কয়টা নাটক ওখানে অভিনীত হয়? আমাদের নাটকে এই অঞ্চলের ভাষা, মানুষের সংগ্রাম খুবই ইনটেনসিভলি প্রকাশিত হয়েছে। তার একটা বড় শক্তি আছে। হয়তো কালক্রমে আন্তর্জাতিক হবার বাধাটাও দূর হবে। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই। রবীন্দ্রনাথকেও বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিভূতি, মানিকের তো সে ভাগ্যও হলো না। এত শক্তিশালী আমাদের কাব্য, তারও আন্তর্জাতিক হবার বাধা দূর হয়নি। আমার ধারণা এখানেও সেই শক্তি নিয়ে নাটক দাঁড়িযে আছে। বিশেষ কারোর কথা বলার মতো সময় আসেনি।
হাসান শাহরিয়ার
ঢাকায় অনেক নাট্যকর্মী আছে যারা এক সময় আরণ্যক করতো, কিন্তু পরে দল থেকে বের হয়ে গেছে। এর পেছনের কারণগুলো কী ছিল?
মামুনুর রশীদ
সেই নাট্যকর্মীরা কি নাটক করছেন? আমি বলবো করছেন। তাতেই মনে হয় আরণ্যক তাদের নাট্যকর্মে বাধা নয় বরং প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। তবে চলে যাওয়ার কারণগুলো ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। কখনো কারো মনে হতেই পারে যে এই দলে তার একধরনের ডিজকমফোর্ট হচ্ছে, নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে অন্য প্ল্যাটকর্ম প্রয়োজন। তবে যেটা হয় অভিনয়, লেখা বা নির্দেশনার সুযোগ না পেয়ে তিক্ততা হয়, সেটা কিন্তু আরণ্যকের বেলায় হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস।
হাসান শাহরিয়ার
নবীণদের কাজগুলো কেমন দেখছেন? পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে তারা কী বংলাদেশের থিয়েটারকে এগিয়ে নেবে এমন আশার কিছু দেখেন?
মামুনুর রশীদ
অবশ্যই। নাটক নিয়ে আমার তো মনে হয় তরুণরাই অনেক বেশি ভাবছে। কারণ দিন দিন নাটক অনেক বড় চ্যালেঞ্জের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে আমাদের। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সুযোগ বাড়লেও মঞ্চনাটকে যে শ্রদ্ধার একটা জায়গা করে নেয়া যায় তা তারা বুঝতে পারে। ফাঁকির জায়গা কম, অনেক বেশি পরিশ্রম, অনেক বেশি অনুশীলন এবং সময় দাবী করে নাটক। আর মঞ্চনাটক জীবিকা হচ্ছে না। এই টানাপোড়েন অতিক্রম করেই তো দেখতে পাই বেশ কিছু ভালো নাটক নামছে যেগুলো রচনা, নির্দেশনা ও ডিজাইনের দিক থেকে অভিনবত্ব দাবী করতে পারে। তাই আশা তো দেখতেই পাই।
হাসান শাহরিয়ার
বাংলাদেশের আপনার প্রিয় নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতৃদের ব্যাপারে কিছু জানতে চাই।
মামুনুর রশীদ
আমার দুর্ভাগ্য যে আমার ওরকম আইডল নেই। আমার অনেক নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতাই প্রিয়। কেউ হয়তো শুধু একটি নাটকের জন্যে ভীষণ প্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু পরে যখন দেখি ঐ একই জায়গায় তিনি পড়ে থেকে কেবল রিপিট করছেন, তখন দুঃখ পাই। সেসব যদি এখন বলতে শুরু করি তাহলে কয়েক রাত চলে যাবে। পরে কখনো বলবো। শুধু তাদের কথাই বলবো।
হাসান শাহরিয়ার
আপনার বাঙলা থিয়েটার প্রফেশনাল উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি। নীলুভাই কিন্তু বলছে সিএটি-ই বাংলাদেশের একমাত্র প্রফেশনাল থিয়েটার। আপনার মত কী?
মামুনুর রশীদ
সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার প্রফেশনাল থিয়েটার। কিন্তু তার এই থিয়েটারের সম্পদ তো দর্শকের টাকায় হয়নি। সেখানে দাতা সংস্থা এসেছে। তাই বিপুল পরিমান অর্থ লগ্নি হচ্ছে সেখানে। কিন্তু বাঙলা থিয়েটারের সবটাই নিজস্ব উদ্যোগ। একেবারেই প্রফেশনাল, দর্শনীনির্ভর- যেটাও অবাস্তব। নীলু অবশ্য কাজগুলো প্রফেশনালী করতে পারছে। কর্মীরা টাকা পাচ্ছে। ভালো কাজও করছে। যদি বেশি পরিমান দর্শকের কাছে নাটকগুলো পৌঁছে দিতে পারে তাহলেই একটা জায়গা তৈরি হতে পারে।
হাসান শাহরিয়ার
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলার উপর বিভাগ খুলেছে, অনেকদিন হয়ে গেল। তার আউটপুট সম্বন্ধে কিছু ব্যাখ্যা করা যাবে?
মামুনুর রশীদ
খুব ভালো কাজ। এসবই আমাদের গত কয়েক যুগের আকাঙ্ক্ষা এবং আন্দোলনের ফসল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে শুরু হয়েছিল। শিক্ষকের অভাবে তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ষড়যন্ত্রের শিকার। জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে। কিন্তু কোথায় যেন প্র্যাকটিশনাদের সাথে যোগসূত্র গড়ে উঠছে না। আমি বহু আগে ইন্টারনিশীপ চালু করার কথা বলেছিলাম। সেটাও কেন যেন চালু হলো না। থিয়েটারের কাজটাও বিস্তৃত করা প্রয়োজন। না হলে দেখা যাবে মাস্টার্স ডিগ্রীটাকে নিয়ে অড যব করতে বাধ্য হচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। শিক্ষার ক্ষেত্রেও বেশি করে ভিজিটিং টিচার নিয়োগ প্রয়োজন। এরকম খোলামেলা পরিবেশ না হলে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার কাজটা হবে না।
হাসান শাহরিয়ার
আপনার অভিজ্ঞতা আছে, আপনার চেয়ে জুনিয়র একাধিক নাট্যনির্দেশকের অধীনে অভিনয় করার। এই অনুভূতিটা একটু ব্যাখ্যা করুন।
মামুনুর রশীদ
চমৎকার! ওদের সাথে কাজ করলে নতুন কিছু শেখা যায়। পুরনো ধ্যান-ধারণার জায়গাটায় আঘাত লাগে। একটা তারুণ্য ফিরে আসে। নিশ্চিন্তে নির্বিবাদে নিজের কাজটা করতে পারি।
আজাদ আবুল কালাম
ফর্ম এবং কনটেন্ট নিয়ে এই যে এত সব কথাবার্তা হচ্ছে- আপনার ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রযোজনায় ফর্ম নিয়ে এক্সপেরিমেন্টেশন আছে, কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে নেই- আপনার মতামত কী?
মামুনুর রশীদ
আমি এটার সাথে একমত নই। আমার সাম্প্রতিক নাটক রাঢ়াঙ এবং চে’র সাইকেল-র ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়।
আজাদ আবুল কালাম
শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের শিল্পীদের সাথে আপনার বন্ধুত্ব আছে। গান, নাচ, পেইন্টিং ... যেমন রণবী। তো অন্যান্য মাধ্যমের প্রভাব সচেতনভাবে নাট্যে প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন কি?
মামুনুর রশীদ
অবশ্যই। এটা আমার জীবনের এক মস্ত বড় সম্পদ। প্রভাব তো আছেই ... জয়নুল আবেদীন, শফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরী থেকে শুরু করে শাহাবুদ্দিন, এমনকি একেবারে আজকের শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হই।
আজাদ আবুল কালাম
বাংলা কথাসাহিত্যের তুলনায় নাট্যসাহিত্য অনগ্রসর- আপনার কী মনে হয়?
মামুনুর রশীদ
এটা সচরাচর বলা হয়ে থাকে। হয়তো সত্যতাও আছে। তবে এটাও ভাবতে হবে- থিয়েটার হচ্ছে পারফরর্মিং আর্ট। প্রিন্টিং ওয়ার্ডের সুবিধা হচ্ছে- ছাপাখানা থেকে সরাসরি চলে যায় পাঠকের কাছে। কিন্তু থিয়েটারকে সেক্ষেত্রে অনেক ঘাট পার হতে হয়। দর্শকের কাছে যাওয়ার পর নাট্যসাহিত্যের প্রশ্নটা ওঠে। তবে আমি মনে করি সাহিত্য তারপরও প্রশ্নাতীত নয়।
আজাদ আবুল কালাম
রবীন্দ্রনাথের নাটক কেন করেননি? এক সময় কেউ কেউ আপনাকে রবীন্দ্র বিদ্বেষীও ভাবতো- একটু খুলে বলবেন?
মামুনুর রশীদ
রবীন্দ্রবিদ্বেষী যারা বলে, তারা ব্যক্তিগত ঈর্ষা ও অক্ষমতা থেকে বলে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্য ও সমাজে বাতাসের মতো। সে তো অক্সিজেন। তাঁকে ছাড়া কিছু চলে? জীবনকে প্রকাশ করা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া হয়? রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের অভিভাবক, বন্ধু। তাঁর নাটক করার স্পর্ধা আমার হয়নি। তাঁর বহুমাত্রিক সংলাপ, অত্যন্ত উঁচুমানের নাট্যভাবনা বোঝার ক্ষমতা যখন হবে, তখন অবশ্যই করবো। সেই স্বপ্নের দিনটির জন্য অপেক্ষা করছি।
আজাদ আবুল কালাম
বিশ্ববাসী ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থানেরকালে ধর্ম নিয়ে আপনার কী ভাবনা- যেহেতু বাংলাদেশে মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের আপনি নিজেও একজন যোদ্ধা।
মামুনুর রশীদ
ধর্ম তো এক সময় মানুষের কল্যাণের জন্যই এসেছিল। কিন্তু পুঁজিবাদ ধর্মের সাথে ধর্মের বিরোধ লাগিয়ে দিল। ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগুলোকেও কেটেকুটে ভাগ করে দিল। মানুষ রক্তাক্ত হলো ধর্ম বিদ্বেষের কারণে। এখন আবার যেকোনো ঘটনায়ই মুসলমানদের দায়ী করা হচ্ছে। এটাও এক ধরনের উষ্কে দেয়া। ইরাকে যে ধার্মিক নিরীহ মানুষটি, যে কোনোদিন অস্ত্র হাতে নেয়ার কথা কল্পনাও করেনি, সে-ও বাধ্য হচ্ছে যুদ্ধে যেতে। কাশ্মিরেও তাই, প্যালেস্টাইনেও একই অবস্থা। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং মৌলবাদী জঙ্গিদের আমিও বিরোধী। কিন্তু তাই বলে সকল ধার্মিক মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মপালন ও বিশ্বাসকে অকারণে আগাত করে জঙ্গিদের দিকে ঠেলে দেয়ারও আমি ঘোর বিরোধী। পৃথিবীতে মানুষ নানা বিশ্বাস নিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ধরা যাক একজন অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় ধার্মিক মানুষ হলো একজন আদিবাসী। একদিন তার বোনকে ধর্ষণ করা হলো। সব জায়গায় সে বিচার খুঁজলো শান্তিপূর্ণভাবে। পেলো না। নির্দোষ বোনটির জীবনটা চোখের সামনে অকারণে নষ্ট হয়ে গেল। তখন ঐ আদিবাসীর কাঁধে যদি একটা রাইফেল শোভা পায়, তাহলে অপরাধটা কার?
আজাদ আবুল কালাম
আপনি এক সময়, মানে স্বাধীনতার পরপর চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, এখন নেই। ভবিষ্যতে যুক্ত হওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে?
মামুনুর রশীদ
আমি চলচ্চিত্রে যুক্ত হয়েছিলাম প্রযোজক হিসেবে, এখন নেই। কিন্তু টেলিভিশনে অনেক কাজ করেছি। এখন আর ভালো লাগছে না। হয়তো ভবিষ্যতে চলচ্চিত্রই আমার জায়গা হবে। ইতোমধ্যে অচেনা বন্দর নামে একটি ছবির কাজও শুরু করেছি।
হাসান শাহরিয়ার
মামুনভাই, আমরা কয়েকদিন আপনার সাথে বসলাম, অনেক কথা হলো। আশা করি নাট্যকর্মীরা এতে উপকৃত হবে। সব নাট্যকর্মীদের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
মামুনুর রশীদ
আমারও অনেক ভালো সময় কাটলো। বিপ্লব বালা, আজাদ আবুল কালাম, তোমাকে এবং সব নাট্যকর্মীদের আমার পক্ষ থেকেও জানাই ধন্যবাদ।