Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

আলাপনে সাঈদ আহমদ

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

[স্বাধীনতার পর নাট্যচর্চাটা আমাদের বেশ এগিয়ে নিয়ে গেছে, সুস্থ ভাবনা-চিন্তার আগ্রহ তৈরি করেছে। আর তৈরি করেছে ‘মানুষ’ হবার আকাঙ্ক্ষা। আমরা শিল্পের এক বড় কর্মকাণ্ড, কর্মযজ্ঞ- মঞ্চনাটকের নিয়মিত সাক্ষাৎ পেয়েছি। আমরা বেশি বেশি নাট্যকার পেয়েছি, পেয়েছি সৃজনশীল প্রতিভাসম্পন্ন নাট্যনির্দেশক, অনেক ভালো অভিনেতৃ। আর পেয়েছি অনেক সংগঠক, যারা ক্রমশই মঞ্চনাটকের পরিধি বিস্তৃত করেই চলেছেন। এক কথায় এঁরা সবাই আমাদের মঞ্চনাটকের পুরোধা। আমরা মনে করি আমরা এঁদের সব ভালো কাজের উত্তরাধিকারী। তাই এঁদের কাজ এবং কাজের প্রক্রিয়া জানতে আগ্রহী, হতে আগ্রহী তাঁদের মতো বা তাঁদের চেয়ে বড় কিছু।

এই প্রত্যাশায় থিয়েটারওয়ালা আলাপচারিতায় মগ্ন হয়েছে কয়েকজন নাট্যজনের। তাঁদের সাথে আলাপচারিতা অনুলিখন করে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে থিয়েটারওয়ালায়। আমাদের এমনি এক নাট্যজন সাঈদ আহমদ। সাক্ষাৎকার : শফি আহমেদ ও হাসান শাহরিয়ার আর অনুলিখন- সাইফ সুমন।]

শফি আহমেদ
সাঈদভাই, আপনার ছোটবেলায় ... আপনার মনে পড়ে কি ঢাকার তখনকার লোকজন এমনিতে নাটক সম্পর্কে কী ভাবতো? যাত্রা বা অন্যান্য ফর্ম বাদ দিয়ে মঞ্চনাটক নিয়ে কী ভাবতো?

সাঈদ আহমদ
যাত্রা হতো, যাত্রার দল ছিল। আর আমাদের নাটকের ব্যাপার হলো যে, লায়ন থিয়েটার সবচেয়ে পুরোনো ছিল। রেগুলার নাটক হতো, কোলকাতা থেকেও আসতো, অর্ধেন্দু মুস্তাফি এবং শিশির ভাদুড়ী ... ওনারা সবাই আসতো। এসে যার যার নাটক দেখিয়ে যেত।

শফি আহমেদ
ওগুলোর আয়োজন করতো কারা?

সাঈদ আহমদ
লায়ন থিয়েটার।

শফি আহমেদ
ওটা কি কোনো কমার্শিয়াল কোম্পানী ছিল?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, লায়ন থিয়েটার ওয়াজ কমার্শিয়াল কোম্পানী। পরে ওটা ডায়মন্ড থিয়েটার হলো, এ ছাড়াও আরো মঞ্চ ছিল, যেমন- ন্যাশনাল থিয়েটার।

শফি আহমেদ
হ্যাঁ, কিন্তু তাদেরতো কোনো অডিটোরিয়াম ছিল না।

সাঈদ আহমদ
ডায়মন্ড থিয়েটারের ছিল। ইসলামপুরে দু’টা থিয়েটার ছিল, হিন্দু বাবুরা চালাতো। মুসলমানের ছিল কেবল লায়ন থিয়েটার।

শফি আহমেদ
তো সেগুলোতে কি লোকে পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে দেখতো?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, বহুত পয়সা দিয়ে দেখতো। শিরি-ফরহাদ, লায়লী-মজনু, মিশর কুমারী ... এসব নাটক উর্দুতেও হতো।

শফি আহমেদ
উর্দুতেও হতো! কোত্থেকে আসতো সেসব দল?

সাঈদ আহমদ
কোলকাতা থেকে আসতো। এসেতো কেউ কেউ থেকেই গেলেন। মুস্তফা হোসেন, জোয়ালা প্রসাদ, ফটিক চন্দ্র নন্দী ... আরো অনেকে।

শফি আহমেদ
ফটিক চন্দ্র নন্দী ঢাকার না?

সাঈদ আহমদ
না কোলকাতার ছিলেন। আর্ট কলেজে পড়তেন আর নাটকের উদ্যোক্তা হলেন। যাত্রাও করতেন। তারপর পেইন্টিং করতেন। আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন। পরে ছেড়ে দিলেন আর্ট কলেজ। নাটকের নেশায় কোলকাতা থেকে চলে এলেন লায়ন থিয়েটারে। ওর কোনো ছেলে-পুলে ছিল না, বিয়েই করেননি ... সেই সময় একা একা থাকতেন। লায়ন থিয়েটারের অধিকারী ছিলেন মুস্তফা হোসেন।

শফি আহমেদ
মুস্তফা হোসেন কি কোনো জমিদারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ। উনি বোম্বেতে কাজ করতেন সোহরাব মোদীর সঙ্গে। সোহরাব মোদী আর রুস্তম মোদী দুইভাই ছিলেন। সেই সময় সোহরাব মোদীর সঙ্গে মুস্তফা হোসেন কাজ করতেন।

শফি আহমেদ
ঢাকার সাথে কীভাবে যোগাযোগ হলো জানেন কি?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ জানি, উনি ঘুরতে ঘুরতে বোম্বে থেকে চলে এলেন লক্ষ্মৌ, তারপর এলাহাবাদ। পরে Madan Theatre-এর সাথে সম্পৃক্ত হলেন কোলকাতায়। Madan Theatre উর্দু নাটক করতো। ঐ সময় তিনি Madan Theatre-এ চাকুরী করলেন দু’তিন বছর। তারপর সুযোগ পেলেন ঢাকায় আসার জন্য। Madan Theatre একবার ঢাকায় নাটক করতে এলো। এখানকার লোকদের সঙ্গে তখন হৃদ্যতা হলো, উনি তখন বললেন- আমি থাকবো ঢাকায়। পরে তিনি থেকেই গেলেন, লায়ন থিয়েটারের সঙ্গে।

শফি আহমেদ
লায়ন থিয়েটারের তখন যারা কর্ণধার ছিলেন, তারা কি সব জমিদারদের হিন্দু কর্মকর্তা ছিলেন, না মুসলমানও ছিলেন?

সাঈদ আহমদ
উভয় সম্প্রদায়েরই ছিলেন। ত্রিশ সালের পর লায়ন থিয়েটার উঠে গেল, সবাক চিত্র শুরু হলো। প্রথমে অবশ্য সাইলেন্ট পিকচার এলো, সবাকচিত্র কিছুটা পরে এলো। আমার জন্ম ১৯৩১ সালে। আমাকে দিয়ে সবাকচিত্রের ফাউন্ডেশন করানো হলো। এটা আমি জেনেছি অনেক পরে ... তো নাটক উঠে গেল, থিয়েটার উঠে গেল ... পরে লায়ন থিয়েটারে সবাকচিত্র শুরু হলো ... টকিজ ... পয়লাতো সাইলেন্ট পিকচার এক-দু’বছর হলো, তারপর সবাকচিত্র হলো। লায়ন থিয়েটারে সবাক চিত্রের সঙ্গে এক-দু’টা আইটেম গান বাজনা হতো ...

শফি আহমেদ
সিনেমা শুরু হওয়ার আগে?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, সেই সময় সবাকচিত্র হতো আর গান বাজনা হতো এবং নাচও হতো।

শফি আহমেদ
লায়ন থিয়েটারে নাটক কি একদম বন্ধ হয়ে গেল? মানে খুলনাতে যে সোসাইটি হল ছিল, ওখানে যেমনটি ছিল ... ওখানে শনিবার আর রোববার থিয়েটার হতো, আর বাকি পাঁচটা দিন সিনেমা হতো।

সাঈদ আহমদ
কিন্তু লায়ন থিয়েটারে রেগুলার সিনেমাই হতো। ম্যাটিনি শো-ও হতো।

হাসান শাহরিয়ার
ও, তার মানে থিয়েটার একদমই বন্ধ হয়ে গেল?

সাঈদ আহমদ
একদমই বন্ধ হয়ে গেল। সবাকচিত্রও চলতো আর নাচ-গানও চলতো ... লিভিং পারফরমেন্স ... তারপর লিভিং পারফরমেন্স বাদ দিয়ে দিল।

শফি আহমেদ
সাঈদভাই, এই যে থিয়েটার বাদ দিয়ে পুরো সিনেমায় চলে আসলেন, এটার কারণ কি এরকম কিছু যে, তখন থিয়েটারটা আর ভালো চলছিল না, লোকজন আর তেমন যাচ্ছিল না, টিকেট বিক্রি হচ্ছিল না?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাতো পরিষ্কার ব্যাপার। সবাকচিত্র করতে করতে আবার অনেকে বোম্বে চলে গেলেন। দু’জনের নাম বলতে পারি যারা লায়ন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে গেলেন ... মেহেদী রাজা, উনি বম্বেতে গিয়ে ঢুকে গেলেন ফিল্মে ... আরেকজন আফগান সেন্ডো তিনিও ঢুকে গেলেন বোম্বের ফিল্মে। বোম্বেতে বড় আখড়া ছিল। লায়ন থিয়েটার আস্তে আস্তে মরে গেল।

শফি আহমেদ
আচ্ছা, লায়ন থিয়েটার যে বন্ধ হয়ে গেল ... এসময় থিয়েটারের সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা প্রতিদিন না হোক মাঝে মাঝেও শো-টো করার কথা বা দল তৈরি করার কথা ভাবেননি?

সাঈদ আহমদ
না, তারা টকিজ চালাতো ... প্রচুর লাভ হতো। মুসলমানদের একটাই হল ছিল আর বাকী তিনটা হল- মতিলালবাবুর পিকচার হাউজ, মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুলবাবুর ছিল মুকুল হল, কোলকাতার মতিলাল চামাড়িয়ার রূপমহল। সে সময় আমার মনে পড়ে ১৯৪৩ সালে ফেমিন সিচুয়েশন হলো। তখন কমিশনারের কাছ থেকে আমার বাবা মির্জা এফ মোহাম্মদ আর চাচা মির্জা আব্দুল কাদেরের কাছে চিঠি এলো ... ওনারাই তখন লায়ন থিয়েটারে টকিজ চালাতেন ... চিঠি এলো যে চ্যারিটি শো করে দিতে হবে, দুর্গতদের জন্য। তো মুস্তফা হোসেনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল। উনি বিয়ে করেছিলেন বাঙালি মহিলা, ওনার এক ছেলে আছে ... তার সাথে কয়েকদিন আগে আমার দেখাও হয়েছিল ... তো তখন মুস্তফা হোসেন বললেন- আমি একটা নাটক করতে চাই। বাবা আর চাচা বললেন- করো। অনেকদিন পর নাটক হবে ... উদ্যোক্তরাও একসাইটেড। তো নাটক হলো। এ সময় লায়ন থিয়েটারে সাউন্ড সিস্টেম চালু করার জন্য বোম্বে থেকে ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসা হলো।

শফি আহমেদ
ঐ নাটকে অভিনেতা বা অন্যদের পাওয়া গেল কেমন করে?

সাঈদ আহমদ
ঢাকাতেই ছিল।

শফি আহমেদ
নাটক কি বাংলায় হলো?

সাঈদ আহমদ
না, উর্দুতে। ইন্দার ছভা ... মানে ইন্দ্র সভা, আগা হাসার কাশ্মেরী’র নাটক, গ্রেট নাট্যকার, উর্দু নাট্যকার। তাঁকে শেক্সপীয়ার অব উর্দু বলা হতো।

শফি আহমেদ
এরকম উর্দু নাটক কতগুলো দেখেছেন?

সাঈদ আহমদ
একটাই। ইন্দার ছভা। বহুত দর্শক হতো। উর্দুভাষী ঢাকাইয়া, হিন্দু সম্প্রদায়ও দেখতো। আর বাংলাভাষীরাও দেখতো। নাটকটার দুটা শো হলো, টিকেট দিয়ে।

শফি আহমেদ
মহড়া কোথায় হতো, লায়ন থিয়েটারেই?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, একমাসের মতো রিহার্সেল হয়েছিল। আমি অনেকদিন চুপি চুপি মহড়াও দেখেছি। লায়ন থিয়েটারে সবাকচিত্র শুরুর আগেই রিহার্সেল হতো, সকাল ১১টায় শুরু হতো রিহার্সেল। সেই দলের গুরু ছিলেন মুস্তফা হোসেন ... মাস্টার মুস্তফা হোসেন ... সব গুরুরা তখন মাস্টার টাইটেল পেতেন। জোয়ালা প্রসাদ বলে এক কমেডিয়ান ছিলেন, উনি বানারসের অধিবাসী ছিলেন। বানারস থেকে কোলকাতায় চলে এলেন। এলাহাবাদ-লক্ষ্মৌ-কোলকাতা। কোলকাতার সেন্টার ছিল বহুত বড় সেন্টার। ব্রিটিশ আমলেতো রাজধানীই ছিল ... তো তাকে বলা হতো কমেডিয়ান এটলার্জ জোয়ালা প্রসাদ। পরে আমি দেখেছি ওনার একটা দোকান ছিল ... ড্রেসের দোকান- ড্রেস, এপ্রোন, কস্টিউম ... ইসলামপুরে।

শফি আহমেদ
জোয়ালা প্রসাদের কোনো অভিনয় আপনি দেখেছেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, দেখেছি। তার সাথে পরেও আমার আলাপ হয়েছে। ১৯৬৫ সালে একদিন কবীরভাই (অধ্যাপক কবীর চৌধুরী) আমাকে ফোন করলেন, নাটকের জন্য এমন একটা ড্রেস লাগবে যা দিয়ে ইউরোপীয় চরিত্রের অভিনয় করা যাবে ... বলরুম ড্যান্সিং-এর মতো। স্যুট পড়তে হবে, আমার জানাশোনা কোনো দোকান আছে কিনা জানতে চাইলেন। আমি বললাম আছে। সেসময় ঢাকায় দুটো দোকান ছিল, ড্রেস বানিয়ে রাখতো। চন্দ্রগুপ্তের ড্রেস, শাহজাহানের ড্রেস ইত্যাদি ... ইসলামপুরেই ছিল। তো জোয়ালা প্রসাদের দোকানে নিয়ে গেলাম।

শফি আহমেদ
লায়ন থিয়েটারে যেসব নাটক হয়েছে আর তাতে যে কস্টিউম ছিল, সেগুলো কি কোম্পানী রেখে দিত?

সাঈদ আহমদ
রেখে দিত, ভাড়া দিত।

শফি আহমেদ
ভাড়া নিত কারা?

সাঈদ আহমদ
সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী। ঢাকাতে অনেক সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী ছিল।

শফি আহমেদ
তারা কোথায় নাটক করতো?

সাঈদ আহমদ
সূত্রাপুরে, মৈশুন্দিতে, ওয়ারীতে।

হাসান শাহরিয়ার
ওগুলোতো বার্ষিক নাটক বা উৎসবের নাটক, তাই না? ঈদ উপলক্ষে বা পুজো উপলক্ষে ...

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, তবে ঈদ উপলক্ষে নাটক হতো না। পুজো উপলক্ষে হতো। পাড়ায় পাড়ায় নাটক হতো। আমি দেখেছি আনন্দ রায় এর আরমানিটোলার বাড়িতে। আনন্দ রায় ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন ... জমিদার ছিলেন আর ল’ইয়ারও ছিলেন। তো ওনার বাড়িতে আমি নাটক দেখতে গেছি। আনন্দ রায়ের বাড়ির পাশে একটা বটগাছ ছিল। বটগাছের চত্বরে নাটকের সিন হতো ... রাম সীতা  ... ইত্যাদি।

শফি আহমেদ
আপনি কি তখনকার সময়কার গ্রেটদের মহড়া বা অভিনয় দেখেছেন? ধরুন, শিশিরকুমার ভাদুড়ী বা আরো যারা ছিলেন?

সাঈদ আহমদ
জায়েন্ট! শিশির ভাদুড়ী জায়েন্ট, অর্ধেন্দু শেখর জায়েন্ট, তোমার ... অহীন্দ্র চৌধুরী জায়েন্ট ... বহুত নামকরা অভিনেতা। শিশির ভাদুড়ীতো কলেজে পড়াতেন, পরে কলেজ ছেড়ে দিলেন অলটাইম থিয়েটার করার জন্য।

হাসান শাহরিয়ার
ওনারাতো কোলকাতায় করতেন। আপনাদের জানা ছিল যে কোলকাতায় এমন সব চর্চা হচ্ছে? গিয়ে দেখা হতো সেখানকার থিয়েটার?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, গিয়ে দেখেছি। রংমহল ছিল। আমার দূর সম্পর্কের ভাগ্নে ছিলেন রংমহলের পার্টনার। এই সময় আমি দেখেছিলাম রংমহলে রিভলবিং স্টেজ ছিল। বেশি নাটক হতো স্টার, মিনার্ভা এগুলোতে। তখন সিনেমার দৌরাত্ম্যে এগুলোর ভাটা পড়ে গেল ... দর্শকের ভাটা পড়ে গেল ... তবুও চলেছে। কতক বন্ধ হয়েছে ... আবার চলেছে।

শফি আহমেদ
একটা ব্যাপার সাঈদভাই আপনার কাছ থেকে জানতে চাই ... এই যে ধরুন গিরিশ ঘোষ, শিশির ভাদুড়ী ... এমন আরো অনেকের নাম বলা যায় যারা তখন মনপ্রাণ দিয়ে নাটকে চলে আসলেন, সংসার ছেড়ে দিলেন কেউ কেউ। দুঃখ-দুর্দশা, বাবা-মা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে ... তারপরও তারা নাটককে এমনভাবে ভালোবাসলেন। তো আপনার কী মনে, কী কারণে নাটকের প্রতি তাদের এমন আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল? আজকালতো এমনটি দেখা যায় না।

সাঈদ আহমদ
নাটকের উদ্যোক্তা নাট্যকাররা ছিলেন। গিরিশ ঘোষ অজস্র নাটক লিখেছেন। এখনো গিরিশ ঘোষের নাটক আমি পড়ি। মঞ্চ পরিকল্পনাতেও গিরিশ ঘোষের আইডিয়া ছিল। মনপ্রাণ দিয়ে নাটক করতেন। তারপর ... রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য ছিলেন। মদ খেয়ে আসলেও কাছে বসতে দিতেন রামকৃষ্ণ ... সমাজের তোয়াক্কা করতেন না। নাটক নিয়ে পাগল হতেন। কিন্তু এখন সমাজ বদলে গেছে। গিরিশ ঘোষের পরের কথা বলি ... শিশির ভাদুড়ীদের কথা ... উনিতো ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিলেন, চাকুরি ছেড়ে দিলেন। তো তখনকার দিনে নাটক করাটাকে ... মানে যারা করছেন তারা অন্তত ভাবতেন যে বড় কিছু করছেন। এবং সে জন্যই বোধহয় এ্যাতো ডেডিকেটেড হতে পেরেছিলেন।

হাসান শাহরিয়ার
তখন কোলকাতায় এ্যাতো থিয়েটার হতো ... সে হিসাবে ঢাকায় কি নাটক করা বাড়তে শুরু করলো? প্রফেশনাল থিয়েটার?

সাঈদ আহমদ
ঢাকায়ও নাটক হতো, তবে কোলকাতার মতো ছিল না। কিন্তু খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট অঞ্চলে নাটক হতো ... দু’দিন-তিনদিন নাটক করতো। যদ্দুর মনে পড়ে ঢাকায় at least লায়ন থিয়েটারে নাটক হতো।

শফি আহমেদ
এই নাটকগুলো কি কোনো সময় ধরে শুরু হতো? মানে সন্ধ্যা ছ’টা বা সাতটা ...

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, নির্দিষ্ট সময় ধরে হতো।

হাসান শাহরিয়ার
কারো জন্য অপেক্ষা করতো? ধরুন, জমিদার আসবে বা কোনো সরকারি কর্মকর্তা আসবে ...

সাঈদ আহমদ
না, কিন্তু এমন হয়েছে যে, হিরোইন বা হিরো আসেনি, সেজন্য ওয়েট করতে হতো।

শফি আহমেদ
নাটকে অভিনয় ছাড়াও যে অন্য বিষয়গুলো আছে ... যেমন ধরা যাক মিউজিক ... তো এই মিউজিক যারা করতেন তারা কি নাট্যদলের সাথেই থাকতেন নাকি শো’র দিন তাদের ভাড়া করে আনা হতো?

সাঈদ আহমদ
না না, নাটকের দলের সাথেই থাকতেন। পিয়ানো ছিল, হারমোনিয়াম ছিল, তবলা-ভায়োলিন-সেতার ছিল। বাঁশিও ছিল।

শফি আহমেদ
আমরা শুনেছি তখন মিউজিক কম্পোজার থাকলেও ডিরেক্টর সেটা কন্ট্রোল করতেন ... মানে ডিরেক্টরকে মিউজিকের উপর ভালো দখল থাকতে হতো। ... মিউজিক ভালো না বুঝলে কিন্তু থিয়েটার করা মুশকিল, তাই না?

সাঈদ আহমদ
মিউজিকের দল পারমানেন্ট থাকতো। আমি মিউজিক ভালোবাসতাম। চুক্তিভিত্তিতে মিউজিক দল আনা হতো। রাধাচরণ ভট্টাচার্যের দলকে ১৯২৮ সালে মাসিক ৯০ টাকা বেতনে আনা হয়েছিল এক বছরের চুক্তিতে। তখন মাসে ৯০ টাকা মানে তো অনেক টাকা। রাধাচরণ মিউজিক মাস্টার ছিলেন, উনি কম্পোজ করতে থাকতেন আর নির্দেশক ছিলেন মুস্তফা হোসেন ... তাঁকে কম্পোজ দেখাতে হতো। মুস্তফা হোসেন সন্তুষ্ট হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হতো। আর মুস্তফা হোসেন নিজেও সুর করতেন।

শফি আহমেদ
ঐসময় কোলকাতার নাটকে শুনেছি দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য কিছু ভোকাল থাকতেন। এই জন্য নায়িকাদের গান জানতেই হতো ...

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ হ্যাঁ, নায়িকাদের গান জানতেই হতো। নায়ককেও জানতে হতো। বোম্বেতে নেসার হোসেন ছিলেন ... তিনিতো লায়লা লায়লা পুকারু ম্যায় বানমে মেরা লায়লা বাসি মেরে মানমে ... ঐ গান গেয়ে সারা ভারত কাঁপিয়ে দিলেন। ১৯৬০ সালে ওনার সাথে করাচিতে দেখা হয়েছিল আমার।

শফি আহমেদ
আমাদের এখানে যারা অভিনয় করতেন তাদের গানের ট্রেনিং কে দিতেন? মুস্তফা হোসেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, এছাড়াও কোলকাতা-লক্ষ্মৌ-এলাহাবাদ থেকে আর্টিস্ট আসতেন ... লায়ন থিয়েটারে আসতেন, সক্রিয়ভাবে কাজ করতে আসতেন ... ওটা ওদের প্রফেশন ছিল।

হাসান শাহরিয়ার
স্যার, আপনার শৈশব থেকেই থিয়েটার দেখা শুরু, তো আপনার ইনভলবমেন্টটা তখন কি ছিল? মানে আপনিও কি ভেবেছেন যে আপনি নাটক বা থিয়েটার করবেন?

সাঈদ আহমদ
না না, আমি কেবল গান বাজনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম।

শফি আহমেদ
না, সেটাতো আপনার পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই আপনি গানের দেখা পেয়েছেন। আমরা জানতে চাইছি নাটকে আপনি ঢুকলেন কীভাবে?

সাঈদ আহমদ
আমি রিসাইট করতাম। দশ বছর পনের বছর বয়সে রিসাইট করতাম।

শফি আহমেদ
কী ধরনের কবিতা আপনি আবৃত্তি করতেন?

সাঈদ আহমদ
রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু। পলাতকা আবৃত্তি করে প্রথম পুরস্কার পেলাম ... সেটা দশ বছর বয়সের কথা। হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে আবৃত্তি করে মজা পেলাম। আর ওরাতো সব জায়গাতেই প্রথম হয় ... আমরাতো পিছিয়ে আছি। তো রিসাইট করতাম আর গান গাইতাম। আমার ভাই হামিদুর রাহমান (অনেকে হামিদুর রহমান লেখে, এটা সঠিক নয়। শামসুর রাহমান আগে ‘রহমান’ ছিলেন, হামিদভাইকে দেখে সে-ও ‘রাহমান’ লিখতে শুরু করলো), খান আতাউর রহমান, মনসুরুল করিম গান গাইতেন। স্কুলের অনুষ্ঠানে গানের জন্য আমাদের ডাক পড়তোই। মাখন লাল চক্রবর্তী আমাদের স্কুলে গানের টিচার ছিলেন।

হাসান শাহরিয়ার
খান আতাউর রহমানের সাথে আপনার কবে থেকে পরিচয়?

সাঈদ আহমদ
সেই ছোটবেলা থেকে। আমরা একই স্কুলে পড়তাম, কলেজিয়েট স্কুলে।

হাসান শাহরিয়ার
তখন থেকেই কি উনি এ্যাতো ভালো গান গাইতেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ হ্যাঁ, উনিতো খুব বড় শিল্পী ছিলেন, হামিদভাইও ভালো গান গাইতেন। আমিও মোটামুটি ভালো গান গাইতাম। ওদের কাছে যেতে দিত না আমাকে, চাপকে বের করে দিত ... বলতো তুই পরে আয় হাঃ হাঃ। হামিদভাই ছবি আঁকতে শুরু করলেন, নাজিরভাই (বড়ভাই) রেডিও-তে যোগ দিলেন, নাসিরভাই (বড়ভাই) ব্যবসা বাণিজ্য করতেন, তো আমি কলেজে পড়ার সময় ভাবলাম- আমি এখন কোন পথে যাব? তো আমি ঠিক করলাম আমি সেতার বাজাবো। আমার বন্ধু ছিলেন বাহাদুর হোসেন খাঁ। আমি সেতার শিখেছি খাদেম হোসেন খাঁর কাছে। সে সময় বাহাদুর রেডিওতে চাকুরি করতেন। আমার একটা নিজস্ব অর্কেস্ট্রা ছিল। আর বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে আমি অর্কেস্ট্রা গ্রুপ করলাম ১৯৫১ সালে।

শফি আহমেদ
তার মধ্যে কী কী ইন্সট্রুমেন্ট ছিল?

সাঈদ আহমদ
সেতার আমি বাজাতাম। সরোদ কামালউদ্দিন, ময়না বাঁশি বাজাতো, মোসলেউদ্দিন হারমোনিয়াম ... বোরহান গিটার বাজাতো, ওয়ারেস আলী ইলেক্ট্রিক গিটার বাজাতো। ওয়ারেস আলী খান আমার প্ররোচনায় গেল কোলকাতায় সুজিত নাথ-এর কাছে। সুজিত নাথ বেশ নামকরা গিটার বাদক ছিলেন। তারপর চিন চোরে জ্বী-র কাছে শান্তি নিকেতনে গিটার শিখল।  ... আমাদের আটটা ইন্সট্রুমেন্ট ছিল।

তখন শামসুর রাহমান স্ক্রীপ্ট লিখতো আর আমি সুর দিতাম। শামসুর রাহমানের সাথে কাজ করেছি দু’বছর। রেডিওতে অনেক কাজ করতাম তখন। এর মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি চলে গেল। করাচি থেকে আমাকে ডেকে পাঠনো হলো যে একটা প্রোগ্রাম করতে হবে। তখন প্রোগ্রাম অব দ্য উইক, প্রোগ্রাম অব দ্য মান্থ হতো। করাচি থেকে রিলে করে শোনানো হতো। আমি কম্পোজ করলাম, করে সাচ্চাভাইকে দিলাম, সাচ্চাভাই আর তার বড়ভাই আশরাফ-উজ-জামান, টেলিভিশনের ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন ... সাচ্চাভাইও পরে ডিজি হয়েছিলেন ... তো সাচ্চাভাই বললেন যে, তুমি স্টোরিটা লিখে দাও, আমি পাঠিয়ে দেব। লিখলাম, কিন্তু ওটা নাকচ হয়ে গেল। স্টোরিটা ছিল ভাষা আন্দোলনের উপর। তারপর আমাকে বলা হলো স্টোরিটা চেঞ্জ করতে হবে। আমি ভাবলাম এমনভাবে চেঞ্জ করতে হবে যেন ভাষা আন্দোলন থাকে আবার কর্তৃপক্ষ তা না বোঝে। চেঞ্জ করে শামসুর রাহমান আর হাসান হাফিজুর রহমানকে দেখালাম। ওটার নাম ছিল এরা নির্ভীক যাত্রী। চেঞ্জ করলাম এভাবে যে- মরুভূমির উপর দিয়ে এক কাফেলা যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তো ওরা ভাবলো মরুভূমি আছে কাফেলা আছে, মুসলমান মুসলমান ব্যাপার আছে, তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বক্তব্যে আমরা যা দেয়ার দিয়ে দিলাম। সবাই বুঝতে পারলো কী বলতে চাইলাম। ওটার কম্পোজিশন আর সুর ছিল আমার নির্দেশনায়। ওটা কিন্তু তখন একটা ল্যান্ডমার্ক ছিল।

হাসান শাহরিয়ার
আপনারা কি রেডিওতে চাকুরি করতেন না ফ্রিল্যান্স কাজ করতেন?

সাঈদ আহমদ
ফ্রিল্যান্স। তখন ইউনিভার্সিটিতে সামাজিক আমোদ প্রমোদ বলে একটা বিভাগ ছিল। সেখানে আমি রিসাইট করতে গেলাম। রিসাইট শুনলেন বিশ্বরঞ্জন ভাদুড়ী। শুনে বললেন- তুমি ইনক্লুডেড ইন আওয়ার গ্রুপ। আমি খুব আপ্লুত হলাম যে হিন্দুদের ভিড়েও আমি চান্স পেলাম।

শফি আহমেদ
আপনিতো নাটকে অভিনয় করেছেন ... প্রথম অভিনয় কি ‘শেষরক্ষা’‌?

সাঈদ আহমদ
না। বিশ্ববিদ্যালয়ে মোকসুদ আলীর ‘ইউরেকা’ নাটক করলাম পয়লা। তারপর ‘অবাক জলপান’ করলাম। তারপর শেষরক্ষা। শেষরক্ষা নাটকের সময় একটা গ্যাড়াকল হয়ে গিয়েছিল। রায়ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫০ এ। রায়টের সময় ধরপাকড় শুরু হয়ে গেল। পরে শুনলাম বিশ্বরঞ্জন ভাদুড়ী চলে গেছেন। তারপর আমরা আশরাফুজ্জামানকে আনলাম রেডিও থেকে। দুই জামান ছিলেন তখন ... আশরাফুজ্জামান আর আমিরুজ্জামান। তো বড় জামান আশরাফুজ্জামনের রিহার্সেল হলো, নাটক হলো। দু-তিন মাস পর বিশ্বরঞ্জন ভাদুড়ী ঢাকায় এসেছিলেন। এ্যাতো ভয় পেয়েছিলেন যে, পরে আর চাকুরি করেননি। চাকুরি ছেড়ে পরে চলেই গেলেন।

শফি আহমেদ?
শেষরক্ষা’র দর্শক কেমন হয়েছিল?

সাঈদ আহমদ
বহুত ভালো।

শফি আহমেদ
এটা কি লায়ন থিয়েটারে হয়েছিল?

সাঈদ আহমদ
না না, কার্জন হলে। কার্জন হলের ছাত্র-ছাত্রী সংসদের আয়োজনে।

শফি আহমেদ
তখন ঢাকায় কি নিয়মিত নাট্যচর্চা হতো?

সাঈদ আহমদ
না, মাঝে মাঝে হতো। নিয়মিত না।

হাসান শাহরিয়ার
শুনেছিলাম, ১৯৫৪ সালে আপনি লন্ডন চলে গেলেন। সেখানে কি কোনো নাটকে অভিনয় কিংবা কোনোভাবে জড়িত ছিলেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, সেখানে একটা প্লে-তে কাজ করলাম। ১৯৫৫ সালে একটা প্লে-তে কাজ করলাম A king is born. ম্যাজাই উপহার নিয়ে আসবে ... একজন ম্যাজাই আমি ছিলাম।

শফি আহমেদ
ইংরেজিতে?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, সব কাস্টও ইংরেজ। একমাত্র আমিই কালো চামড়ার মানুষ। সেটা অবশ্য মন্দের ভালো ছিল, কারণ, একজন ম্যাজাই-এর চামড়া ব্রাউন হতে হবে, তাই আমাকে নিল। তারপর সেখানে আমি মিউজিক স্কুলে ভর্তি হলাম। পার্ট টাইম, ইভিনিং ক্লাশ ... সেখানে আমি ওয়েস্টার্ন মিউজিক শিখতে লাগলাম।

শফি আহমেদ
ঐ সময় আপনি ওদের দেশের নাটক দেখতেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, বহুত নাটক দেখতাম ...

শফি আহমেদ
কেমন লাগতো সেগুলো?

সাঈদ আহমদ
মাই গড! বহুত ফার্স্টক্লাশ নাটক ... ৫০ এর দশকে নাটকের বন্যা হয়ে গেল লন্ডনে। নাটক আমি দেখতাম। আর নাটকের স্টেজে আমি কাজ করেছি। ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজ করেছি, গান-বাজনার সাথে ছিলাম।

শফি আহমেদ
ওসব নাটক দেখে সেগুলোর ডিজাইন আমাদের নাটকে লাগাবেন এমন কোনো ধারণা কি তখন করতেন?

সাঈদ আহমদ
না না। ওসব অনেক বড় বড় কাজ। কিছু কিছু নাটকতো কয়েকবার দেখেছি। কেবল দেখার জন্যই দেখা। আমি করবো টরবো এমন কিছু ভাবিনি। আর টিকিট কাটতেও তো হিমশিম খেতে হতো। বহুত দাম। সবসময় শেষ সারি-তে বসে দেখতাম। দেখতাম আর মিউজিকের কান খুলে রাখতাম। মিউজিকের কান খুলে যত পারি শিখে নিই। আমি বিবিসি রেডিওতে বাজালাম। উর্দু সার্ভিস, বাংলা সার্ভিস, ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্ভিস, শ্রীলংকা সার্ভিস ... এমন পাঁচটা সার্ভিসে বাজাতাম, সেতার এবং অর্কেস্ট্রা। আমার যন্ত্রপাতি ছিল। হীরেন চ্যাটার্জি আমার তবলচি ছিলেন ... হীরেন চ্যাটার্জি কিন্তু নামকরা তবলচি। এনসাইক্লোপিডিয়ায় তার নাম আছে, ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম আর প্রচুর টাকাও পেতাম। লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স-এ আমার স্যার ছিলেন প্রফেসর মেনিং। তখন ঠিক করলাম যে, স্যারকে বলবো যে আমি ক্লাশ কম করবো। ভাগ্যক্রমে তার ছেলে ছিল আমার দোস্ত। আমি জানতাম না। ক্রীসমাসের সময় তার বাসায় আমাকে দাওয়াত করলো আর আমি গিয়ে দেখি ওটা প্রফেসর মেনিং-এর বাসা। তো আমি বললাম যে- স্যার আমি একটা দোকানে কাজ নিয়েছি। বহুত পরিশ্রম, আমি ক্লাশ করতে পারবো না। প্রফেসর মেনিং-এর জুড়ি নেই। তিনি বললেন তুমি মাসে একটা টিউটোরিয়াল দিয়ে যাবে।

আমি যে শপে কাজ করতাম জন লুইস, সেখানে আমার লোডারের কাজ। আমরা চার-পাঁচজন ছিলাম কালো চামড়ার। খুব কঠিন কাজ ... ব্যাগটা ওঠাও, পাট্টি ওঠাও- এসব। আমি হামিদভাই লোডারের কাজ করতাম। তো আমি সুযোগ পেলে পত্রিকা পড়তাম। আমাকে একজন বললো- কী পত্রিকা পড়? বললাম- টাইমস। তো বললো- হায় হায় লোডারের কাজ করে টাইমস পড় কেন? বললাম- আমি তো সবসময়ই টাইমস পড়ি। বললো- এ্যাতো ফুটানি কেন? তোমার তো চাকুরি চলে যাবে। অন্য কাগজ পড়। মজা আছে যেগুলোতে ... তো সে ছোকড়া অবশ্য বাজনা বাজাতে পারতো, আমি তাকে একবার বিবিসিতে নিয়েও গিয়েছিলাম। সে মিউজিশিয়ান হতে পারতো ... যাক্, তো সে আমাকে ইন্সপেক্টর অব শপের কাছে নিয়ে গেল। আমি বললাম- আমার দোষ কি? বললো- টাইমস পড় কেন? আমি বললাম- আর পড়বো না। ব্যস আমার উন্নতি হলো। আমাকে বললো- আমাদের মাল ডেলিভারী করে যে ড্রাইভার তার সাথে একজন এটেন্ডেন্ট লাগবে। তুমি সেটা করো। ভাবলাম বেশ, বাইরে বাইরে ঘোরা যাবে। বহুত ভালো, এই-ই তো চাই। তারপর লন্ডনের অলিগলি সব জায়গায় গেছি। ড্রাইভারের নাম জন। জন আমার বন্ধু হয়ে গেল। ভাবলাম আমার পড়াশোনার সময়ও বের করা দরকার। জনকে বললাম- আমাকে একটা গার্ডেনে নামিয়ে দাও, আমি কিছু পড়বো, আবার ফেরার সময় আমাকে নিয়ে যাবে। সে রাজি হতো, কারণ, তাকে আমি বিয়ার ঘুষ দিতাম হাঃ হাঃ।

শফি আহমেদ
তখনও তো নাটক দেখতেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব।

শফি আহমেদ
পঞ্চাশের সময়টা তো একটা জোয়ার ... মানে এ্যাংরি জেনারেশন চলছে। এই এ্যাংরি জেনারেশন তো কেবল আমরা অসবর্নের নাটক থেকেই জানি ...

সাঈদ আহমদ
অসবর্নের নাটক আমি দেখেছি ...

শফি আহমেদ
অসবর্নকে দেখেছেন কখনো?

সাঈদ আহমদ
না অসবর্নকে দেখিনি। তার চেলা চামুণ্ডাদের দেখেছি। রয়্যাল কোর্টে দেখতে গেলাম ‘লুক ব্যাক ইন এ্যাঙ্গার’।  অসবর্নের এ্যাংরি জেনারেশন নিয়ে নাটক একেবারে মাত করে দিল। ঐ নাটক দেখতে গিয়ে ...

শফি আহমেদ
কিন্তু অনেক কনজারভেটিভ তো নাটকটা পছন্দ করছিল না ...

সাঈদ আহমদ
সমাজের উঁচু তলার মানুষজন স্বাভাবিকভাবেই এই নাটক পছন্দ করতে পারেনি। তখন আমি কয়েকবার এটা দেখেছি ... টিকেট সস্তা ছিল। বড় লোকেরা সেখানে যেত না। পরে আস্তে আস্তে যাওয়া শুরু করলো। বৃটেনে তখন ক্লাশ স্ট্রাগল শুরু হয়ে গেল। লেবার পার্টির উত্থান তখন। বেভান লেবার পার্টির উদ্যোক্তা ছিলেন। এটলি তো ছিলেন প্রাইম মিনিস্টার। বেভান ইংরেজী ভালো বলতেন না ... এটলি ভালো বলতেন, বেভান চাষাভূষার মতো কথা বলতেন। তো সেই সময়ই ‘লুক ব্যাক ইন এ্যাঙ্গার’ বহুত নাম করেছিল।

শফি আহমেদ
সাঈদভাই, লুক ব্যাক ইন এ্যাঙ্গার যখন হলো তখন নাটকের প্রেজেন্টেশনেও তো একটা পরিবর্তন আসলো। কস্টিউমটা সাধারণ হয়ে গেল ... তো এসব দেখে আপনার কি মনে হয়েছিল?

সাঈদ আহমদ
লুক ব্যাক ইন এ্যাঙ্গার এর পর এন্টারটেইনার দেখলাম, ওরই নাটক।
লরেন্স অলিভিয়ের করলো এন্টারটেইনার ... মাই গড! ওই যে আফ্রিকার সাহিত্যিক কী যেন নাম, নোবেল পেল ...

হাসান শাহরিয়ার
ওলে সোয়িঙ্কা?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, সে ওই সময় সেখানে ছিল, আমার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। তো সে সময় একটা জোয়ার ছিল ... লুক ব্যাক ইন এ্যাঙ্গার এর পর চিপস উইথ এভরিথিং নামে একটা প্লে ছিল। চিপস-তো ফেলে দেয়ার জিনিস, অথচ চিপস উইথ এভরিথিং ... মানেটা বুঝে দেখ ...

শফি আহমেদ
এই নাটকগুলোতে যে জিনিস ঘটছিল ... মানে নাটকটা একটা সোস্যল কমিটমেন্টের জায়গায় চলে আসছিল ... আর এন্টারটেইনমেন্ট সম্পর্কে যেটা জানি যে, সেখানে সবাই মিলে অভিনয় করার একটা জায়গা তৈরি হচ্ছিল ... তো সেসব নাটক দেখে আপনার কী মনে হলো ... মানে আপনার তখনকার অনুভূতি বিশ্লেষণ করে একটু বলুন।

সাঈদ আহমদ
ঐ সময়ে আমি রাডা-তে যেতে শুরু করি। রাডাতে অনেক ব্রিটিশ বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে ফেললাম।

শফি আহমেদ
রাডাতে যখন যেতেন তখন তো এটা একসাইটিং ... তখন কি আপনার মনে হলো যে নিজে নাটক লিখবেন বা এমন কিছু?

সাঈদ আহমদ
না না, আমিতো তখন এক্সক্লুসিভলি মিউজিকের রস সংগ্রহ করার জন্য রাডাতে যেতাম। রাডাতে কনসেশন রেটে টিকেট কাটতাম। রাডাতে আমি ওয়েটিং ফর গডো দেখেছি। ১৯৫৫ সালে ওয়েটিং ফর গডো দেখে আমার বন্ধু বান্ধবতো একেবারে ’থ ... কেউ কেউ বলে- এটা কী দেখলাম!

শফি আহমেদ
ওয়েটিং ফর গডো-র সেট সম্পর্কে আপনার কিছু মনে আছে কি?

সাঈদ আহমদ
মাই গড! আমি তিন-চারবার ওটা দেখেছি। সেটটা আমার মনে আছে ... ওপেন স্পেসই বেশি ছিল, গাছের গোড়া ছিল ...ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগন গাছের গোড়ায় আসতো, ওখান থেকেই ওরা ডায়লগ বলতো ... স্টেজের আগের পোর্শনে ডায়লগ হতো, লাইট জোন কেটে কেটে করতো। এটা কিন্তু খুব অদ্ভূত লাগতো ঐ সময়ে, লাইট জোন এভাবে কেটে কেটে করা ... খুবই দুঃসাহসিক কাজ।

শফি আহমেদ
আপনি এয়োনেস্কোর কোনো নাটক দেখেছেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ দেখেছি। লন্ডনেই দেখেছি। আর প্যারিসেও এয়োনেস্কোর নাটক দেখেছি। ওর পয়লা নাটক Ball Primadonna বা টেকো অভিনেত্রী। কিন্তু তখনও বুঝতে পারতাম না, কেবল তাকিয়ে থাকা ...

শফি আহমেদ
কিন্তু এয়োনেস্কোর সাথে তো আপনার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেটা কবে?

সাঈদ আহমদ
সেটা হলো ’৭৬ সালে। আমি তখন আইএমএফ- এ কাজ করতাম, পাশাপাশি জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির গেস্ট লেকচারার ছিলাম। এছাড়াও তখন আমি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ও ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির গেস্ট লেকচারার ছিলাম। তো সেই সময়ে এয়োনেস্কো লেকচার দিতে গিয়েছিলেন জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে। তখন আমাকে নিমন্ত্রণ করলো ডন এফ মার্ফি। ডন এফ মার্ফি ওয়াজ দ্য হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট ... ডন আমাকে বহুত ভালোবাসতো।  জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির নাটকের ডিপার্টমেন্ট খুব বড় ... তো এয়োনেস্কোর বিষয় ছিল ‘Why I write plays’. পরে আমরা মিলিত হলাম ডিপার্টমেন্টে। এয়োনেস্কোর সাথে বহুত কথা বার্তা হলো। ওঁর একটা স্বভাব ছিল যে সে গালি দিত। যাক্, এক পর্যায়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম- নতুন আর কিছু লিখছেন নাকি? তো তিনি হেসে জবাব দিলেন- হ্যাঁ, কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পাবেন। তবে নাটকের শেষ পর্যন্ত বোধহয় দু’জন দর্শকই উপস্থিত থাকবেন- আমি আর আমার স্ত্রী হাঃ হাঃ। ... আমার মুখ দিয়ে তখন বেরিয়ে গেল- ‘এ্যাবসার্ড’! ... উনি এ কথাটা বলেছেন কারণ, এর একটা ইতিহাস আছে। তাঁর টেকো অভিনেত্রী প্রথম যখন ১৯৫০ সালে প্যারিসে অভিনীত হয়, তখন নাটকের শেষ পর্যায়ে দর্শকের সংখ্যা ছিল মাত্র তিনজন হাঃ হাঃ।

ওয়াশিংটন ডিসিতে ESTA THEATRE-এ আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। The Indian Wants The Bronx- নাটকে আমি Spacial Consultant ছিলাম। নাটকটির ডিরেক্টর ছিলেন Jay Allison. একজন বাঙালি হিসেবে এটা আমাকে গর্বিত করে।

শফি আহমেদ
সাঈদভাই আমরা আবার একটু পিছিয়ে যাই, আপনি ১৯৫৪ সালে যে লন্ডন গেলেন তারপর ফিরলেন কখন?

সাঈদ আহমদ
১৯৫৬ সালের পরে আমি লাহোরে ফিরে এলাম। তখন আমার কাজে মন লাগতো না। লাহোরে এসে এক নতুন পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হলাম। সব হলো কেতাদুরস্ত ... ফার্স্টক্লাশ টাই পরতো। আমি বললাম- আমি কেতাদুরস্ত হবো না। কিন্তু এজন্য ডিরেক্টর আমাকে বকা দিতেন। বলতেন- সামলে চলো। ব্যস, সামলে চললাম। আমিও কোট-টাই পরা শুরু করলাম। কিন্তু নিজেকে যেন চিনতে পারছিলাম না। তো ১৯৫৭ সালে আমি একটা নাটক লিখলাম। নাটকের বিষয়বস্তু হলো নট আই, মানে ‘আমি না’ ... মানে আমি আমাকে চিনি না।

শফি আহমেদ
এটাই কি আপনার প্রথম নাটক?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, নট আই ওয়াজ মাই ফার্স্ট ড্রামা। সফদার মীর আমার বন্ধু ছিল ... সে বোম্বেতে নাটক করতো আর শম্ভু মিত্রের সাথে গণনাট্য সংঘ করতো। ১৯৪৮ এর পর সে চলে এলো লাহোরে। ও বললো যে- এটা কী লিখেছো, আমি বুঝি না। তবে এটা ভালোই হতে পারে। বললো- আমাদের বন্ধু সাকের আলীকে দেখাও। সাকের আলী was a great abstract painter,_ Maio কলেজের আর্টস-এর টিচার ছিলেন, সদ্য বিলেত ফেরত টিচার। তো সাকের আলীকে দেখালাম, তো বললেন যে- এটা ভালোই হয়েছে, কিন্তু মন্তব্য করবো না কারণ, আমি বুঝতে পারিনি। এরপর আমি একদিন এটা ছিঁড়ে ফেললাম ... স্ক্রীপ্টটা আবার শুরু করবো ... এ সময় আমি করাচিতে বদলী হয়ে গেলাম। কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না, কারণ বাঙ্গালিরা কোনঠাসা হয়ে পড়ছিল। তো ঐসময় একবার আমার কাছে জয়নুল আবেদীন স্যার (আমি ওনাকে স্যার ডাকতাম) আসলেন, বললেন- আমি আর যামু না ইস্ট পাকিস্তানে, অরা আমাকে বেইজ্জত করছে। আমি বললাম- ঠিক আছে আমার সাথেই থাকেন ...

শফি আহমেদ
উনি কি বলেছিলেন, কী কারণে জেদ করেছেন?

হাসান শাহরিয়ার
এটা কি বাঙালি-পাকিস্তানী এসব নিয়ে?

শফি আহমেদ
না না, এখানকার চারুকলা ইন্সটিটিউট নিয়ে বোধহয়। আমি একটু আধটু জানি ... এজন্যই জিজ্ঞাসা করছি...

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, এখানকার চারুকলা বিভাগ নিয়ে কার কার সাথে যেন রাগ করেছেন। যাক্, আমি বললাম- এখানে থাকেন, হামিদভাইও আইতাছে, সে-ও এখানে থাকবে, মুর্তজা বশীরও আইতাছে ... আপনিও থাকেন অসুবিধা নাই। তো জয়নুল আবেদীন স্যার দিনভর পেইন্টিং করতেন আর রাত্রে গোসল টোসল করে পরিপাটি হয়ে মদের আড্ডায় বসতেন। মদ খেতে পারতেন না বেশি, একটু খেলেই হয়ে যেত হাঃ হাঃ, আর এদিকে হামিদভাই আর মুর্তজা বশীর-

শফি আহমেদ
চালিয়েই যাচ্ছেন, নাকি?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, তারা চালিয়েই যাচ্ছেন হাঃ হাঃ। কিন্তু আমার অসুবিধা হচ্ছিল। অফিস থেকে আসি, হাঁটি, ঘুমিয়ে পড়ি ... আমার কোনো কাজ হচ্ছে না। তো একদিন আমি রেগে গেলাম। বললাম- আমি দরজা বন্ধ করে কাজ করবো, আপনারা হৈচৈ করবেন না। জয়নুল আবেদীন স্যার বললেন- ভিতরে জ্বালা অইতাছে? একটু নিবারণ করেন ... যাক্, আমি তারপর লিখে ফেললাম ‘দ্য থিং’ বা ‘কালবেলা’।

হাসান শাহরিয়ার
প্রথমেতো ইংরেজীতেই লিখলেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, Sintilla -পত্রিকায় এ নিয়ে একটি আর্টিকেল বেরিয়েছিল। সেটা অনেকটা এরকম যে- ... Poetry and the short story seem assured of a valuable and important future in Pakistan, and the novel seems to be following along. Although off and on one can come across many good Urdu plays, an English play by a Pakistani writer is still rare. The future of the English drama would seem remote, were it not for a remarkable young man, Sayeed Ahmad, whose The Thing is shortly to be followed into print with another even more provocative work Milepost. I had not intended to discuss the drama because I, like my Pakistani friends, feel that too little effective playwrite is being done and it will be done. However, one playwrite is not a tradition any more than Shakespeare was the Elizabethan theatre. Hopefully, however, given an audience and cultural acceptance the theatre can become what it should be in Pakistan.

তো আমি নাটকটি লিখে জয়নুল স্যার, হামিদভাই আর মুর্তজা বশীরকে শোনালাম। তারা বললেন  যে- প্লে কিছু বুঝি নাই, স্যার বললেন- তবে এর প্রচ্ছদটা আমি আঁকবো। বললাম- প্লে বোঝেননি, আবার প্রচ্ছদ আঁকবেন কীভাবে? বললেন- যা বলতে চেয়েছেন তা আমার শিরায় শিরায় আছে। আমিই প্রচ্ছদ আঁকবো। ... উনি এঁকেছিলেন কিন্তু প্রচ্ছদটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে ফ্রেঞ্চ ভাষায় যখন বই বেরুলো, তখন যে প্রচ্ছদ করবে তাকে জয়নুল স্যারের প্রচ্ছদের কথা বলেছিলাম ... তো সে অনেকটা ওভাবেই প্রচ্ছদটা করলো। দ্য থিং প্রথমে করাচিতে হলো ইংরেজিতে। আমেরিকা থেকে নাটকের দল আসলো। ইউজিন ’ও নীলের Ah Wildeness, Saryan এর My Hearts in the Highland, Dore Skery এর Sun Rise at Canpobello, Thontorn Wilder এর Skin of Her Teeth এই চারটি নাটক নিয়ে এসেছিল। Hazelman ছিলেন এই নাটকগুলোর Director বিখ্যাত ডিরেক্টর। তো Dr. Brayan ছিলেন USIS এর পরিচালক। তিনি তাদেরকে বললেন যে- আমাদের এখানে একজন নাট্যকার আছেন, ইংরেজিতে লিখেন, তার নাটকও তোমরা কর। তো তার আমার ‘দ্য থিং’ নাটকটি করলো। আমাকে তখন আমন্ত্রণ করলো যে- তুমি আমেরিকায় আমাদের সাথে কাজ কর। কিন্তু আমি বললাম যে- আমি তো সরকারি চাকুরি করি। আমি যেতে পারবো না। যাক্, পরে এটা নিয়ে গেল বজলুল করিম। বজলুল করিম প্রোডাকশন করলো।

হাসান শাহরিয়ার
বাংলায় অনুবাদটা প্রথম করলেন কি বজলুল করিম?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, আমিও ছিলাম, শামসুর রাহমানও ছিলেন ...

হাসান শাহরিয়ার
করাচি থেকে পাঠিয়ে দিলেন, নাকি উনি নিয়ে আসলেন?

সাঈদ আহমদ
নিয়ে আসলো ... তখন করাচি আর ঢাকায় প্রতিদিনই যোগাযোগ ছিল। তো এভাবেই আমার প্রথম নাটক হলো।

শফি আহমেদ
বজলুল করিমের সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল তো, তাই না?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, আড্ডায় বসতাম। বিদগ্ধ লোক এই বজলুল করিম। শামসুর রাহমানের সাথে বেশ ওঠাবসা ছিল। পরে ও লন্ডনে চলে গেল। সেখানে গিয়ে কিছুই করতে পারলো না, সময়ের অভাবে। তাছাড়া ও লন্ডনে গিয়ে কী করবে?

হাসান শাহরিয়ার
স্যার, আপনি যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন, তখন অনেক ঘরানার নাটক দেখেছেন ... তো সবচেয়ে কঠিন এই এ্যাবসার্ড নাটক আপনাকে কেন টানলো? বিশেষ করে মিউজিক ছাড়া কিছু করবেনই না, তো করলেন তো করলেন এমন শক্ত জিনিসে কীভাবে হাত দিলেন? মানে আপনার সমসাময়িক কেউ-ই বুঝতে পারছে না ... এমনকি জয়নুল আবেদীন-ও বুঝতে পারছেন না অথচ সেই জিনিস আপনার ভেতরে দাগ কাটলো কীভাবে?

সাঈদ আহমদ
আমি মিউজিক ভালো বুঝতাম। মিউজিক ইজ ভেরি ইমপর্টেন্ট ফর এ্যাবসার্ড নাটক। মিউজিক সংজ্ঞাহীন, মিউজিক কেন দাগ কাটে এটা কেউ বলতে পারবে না। ঠিক তেমনি মিউজিক বোঝার কারণেই আমি এ্যাবসার্ড ফর্মকে বেছে নিয়েছিলাম। মিউজিক যেমন কাটা কাটা, এ্যাবসার্ড নাটকের সংলাপও হয় কাটা কাটা। কোনো বড় সংলাপ নেই।

হাসান শাহরিয়ার
ঢাকার কালবেলা আপনি দেখেছিলেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ।

হাসান শাহরিয়ার
কেমন লাগলো?

সাঈদ আহমদ
বহুত খুব!

হাসান শাহরিয়ার
তখনকার দর্শকদের অনুভূতি কেমন ছিল? তারা কিছু কি বুঝলো?

সাঈদ আহমদ
একেবারে মাত হয়ে গেল। বুঝেছে।

হাসান শাহরিয়ার
আপনার কী মনে হয়? নির্দেশক হিসেবে বজলুল করিম কি আপনার বোধের কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ হ্যাঁ, নির্দেশক ভালো না হলে ঐ স্তরে যেতে পারে না। শামসুর রাহমানও এসেছিল ... সেগুনবাগিচায় হতো, আমেরিকান কালচারাল সেন্টারে, বর্তমান প্রেস ক্লাবের ঠিক উল্টো দিকের হলুদ বিল্ডিংটাতে ...

শফি আহমেদ
এই নাটকটাই পরে পাকিস্তানে হলো, তাই না?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, লাহোরে, পেশোয়ারে স্টেজড হলো, রাওলপিন্ডিতে স্টেজড হলো। করাচিতে হলো ...

শফি আহমেদ
সব জায়গাতে কি ড্রামা সার্কেলই করলো?

সাঈদ আহমদ
না না। পেশোয়ারে উর্দুতে হলো। পিন্ডিতে পাঞ্জাবীতে হলো ...

হাসান শাহরিয়ার
উর্দু অনুবাদ কার? ওখানকার কারো?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, অনুবাদক আমার বহুত দোস্ত মানুষ ছিল, নাম খাতের গজনবী। ও বেসিক্যালি পোয়েট ছিল।

হাসান শাহরিয়ার
আপনার পরের নাটক কি মাইলপোস্ট?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ।

হাসান শাহরিয়ার
মাইলপোস্ট কেন বা কীভাবে লিখলেন?

সাঈদ আহমদ
মাইলপোস্ট আমি লেখা শুরু করেছি লাহোরে। ১৯৬৩ সালে করাচি থেকে আবার লাহোরে ট্রান্সফার হলাম ... আর আমি ওখানে ওয়াপদায় চাকুরি করতাম। সেখানেই আমি মাইলপোস্ট লিখি। মাইলপোস্ট লেখার পর থিয়েটারে আমার বেশ নাম হলো। নিশান এ রা বলে উর্দুতে মাইলপোস্ট হলো। নিশান এ রা লাহোরেও হলো ... নাঈম তাহের অনুবাদ করলো। সে, ইমতেয়াজ আলী তাজ, ওরা মিলে পারফরম করলো।

শফি আহমেদ
এটার রিসেপশান তো ভালোই হলো ... এ্যাবসার্ড বলে কোনো ঝামেলা হলো না?

সাঈদ আহমদ
না না ...

হাসান শাহরিয়ার
কেন ঝামেলা হলো না? মানে দর্শক কি এ্যাবসার্ড নাটক দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল বলে আপনি মনে করেন?

সাঈদ আহমদ
এটা ফেমিনের উপর লেখা ছিল। মাইলপোস্ট যেহেতু পরিবারের কথা, তাই সবার মাথাতেই ছিল। তারপর আমার প্লে লাহোরেও চললো, করাচিতেও চললো। তারপর আতাউর রহমান অনুবাদ করলো ...

হাসান শাহরিয়ার
ড্রামা সার্কেলের জন্য?

সাঈদ আহমদ
না না। ইউনিভার্সিটির সাতরং নামে একটি গোষ্ঠী ছিল ... আসকার ইবনে শাইখ ছিল এর প্রধান ...

হাসান শাহরিয়ার
স্যার, যখন লাহোরে হলো, করাচিতে হলো, তখন সেগুলো কেমন নাট্যদল ছিল ... মানে ওরা কি ওখানে গ্রুপ থিয়েটারের মতই চর্চা করেতো নাকি প্রফেশনাল ...

সাঈদ আহমদ
না না, কোনোটাই না ... এ্যামেচার গ্রুপ ছিল ...

হাসান শাহরিয়ার
মানে আমাদের আদলেই নাকি অন্যরকম?

শফি আহমেদ
না না, আমাদের আদল তো আগে ছিল না ... কোলকাতাতেও ছিল না। গ্রুপ থিয়েটার আদল তো ’৬৫ সালের আগে ছিল না।

সাঈদ আহমদ
আমাদের দেশের থিয়েটার তো শুরু অনেকটা সাতরং শিল্পী গোষ্ঠী আর আসকার ইবনে শাইখের কারণে ... আতাউর রহমান, রামেন্দু মজুমদার, আবদুল্লাহ আল-মামুন ... সব ছেলে ছোকরারা ছিল ...

হাসান শাহরিয়ার
আর মুনীর চৌধুরী?

সাঈদ আহমদ
না, মুনীর চৌধুরী ওভাবে ইনভলবড ছিলেন না। ... যাক্, তারপর ১৯৬৭ সালে আমি আবার লাহোরে যাই। সেখানে আমি ‘তৃষ্ণায়’ লিখলাম। এটা বাংলা ভাষাতেই লিখেছি। তখন লাহোরে এক গোষ্ঠী বললো এটা পাঞ্জাবীতে করে দিতে। আমি বললাম- না, কারণ, তখন ইয়াহিয়া ছিল ... আমার কল্লাটা কেটে নিত ... হাঃ হাঃ

শফি আহমেদ
সাঈদভাই কিছু জায়গা একটু ভালোভাবে জানতে চাই ... নুরুল মোমেন, আনিস চৌধুরী, আসকার ইবনে শাইখ, এদের কথা তো এ প্রজ›ম তেমন কিছু জানে না ...

সাঈদ আহমদ
আমার হৃদ্যতা সবার সঙ্গে ছিল। কবীরভাই (অধ্যাপক কবীর চৌধুরী) নমস্য ব্যক্তি, মুনীরভাই নমস্য ব্যক্তি ... নুরুল মোমেন স্যার, এরা সবাই আমার বড় এবং নমস্য। মুনীরভাইকে দেখেছি স্কুলে পড়ার সময়, কলেজিয়েট স্কুলে পড়াতেন, কবীরভাইও কলেজিয়েট স্কুলে পড়াতেন। মুনীরভাইয়ের এ্যাকটিং ক্যারিয়ারও আমি দেখেছি। একটা নাটক ইংরেজিতে করেছিলেন, জন গিলপিন এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। পরে মুনীরভাই কৃষ্ণকুমারী করেছিলেন। আর ঐ যে দণ্ডকারণ্য ওটা আসলে প্লে হিসেবে তেমন কিছু হয়নি। আর নূরুল মোমেন স্যার নাটকের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী কাজ করলেন নেমেসিস। তারপর আর নাটক লিখলেন না। আর সাসটেইন করলেন না। মুনীরভাইও নাট্যকার হিসেবে সাসটেইন করলেন না। আসলে সাসটেইন এ্যাফোর্ট থাকতে হয়। ওনাদের এটা ছিল না। মুনীরভাই নমস্য ব্যক্তি, তাঁর ভাষা, বাচনভঙ্গি বহুত খুব ... আমি ইউনিভার্সিটিতে থাকার সময় ওঁর ছাত্র ছিলাম। মুনীরভাইয়ের সাথে আমাদের হৃদ্যতা ছোটকালের। কবর নাটক লিখলেন ... আরউইন শ’র ‘বেরী দ্য ডেড্’ নাটকের থীম ধরে লেখা ... একেবারে মৌলিক নাটক বলা যাবে না, কিন্তু বহুত ভালো নাটক। অনেক লাইন আছে বেরী দ্য ডেড্ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। যাক্, তবে ভালো নাটক বলতেই হবে। নূরুল মোমেন নেমেসিস লিখলেন, তার পরেরগুলো আর তেমন কিছু না। এমন হয়, অনেকের বেলাতেই হয় ... আর আনিস চৌধুরী আমার বন্ধু মানুষ ছিলেন। নাটক খুব ভালোবাসতো, ভালো নাটক লিখতো, তবে হাসি তামাশা করতে তেমন ভালোবাসতো না। ... আমাদের সাথে ফজলে লোহানীও নাটক করতো।

হাসান শাহরিয়ার
পরবর্তী সময়ের নাট্যকারদের ব্যাপারে কী বলবেন? ধরুন সৈয়দ শামসুল হক বা ...

সাঈদ আহমদ
পয়লা আমাকে স্ক্রীপ্টটা দেখালো শামসুল হক ...

হাসান শাহরিয়ার
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, লন্ডনে দেখালো। তখন আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম লেকচার দিতে। তো আমাকে বললো যে, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় লিখেছি। শীঘ্রই মঞ্চে আসবে, আবদুল্লাহ আল-মামুন নির্দেশনা দেবে।

শফি আহমেদ
জাকারিয়াভাই ছিলেন, দারুণ অভিনয় করতেন, দেখেছেন?

সাঈদ আহমদ
জাকারিয়া বহুত টেলেন্টেড ... আমাদের মতো না ... কোলকাতায় এ্যাকটিং করতেন, কোলকাতায় মুসলমান ছেলে হয়ে টিকে থাকা কিন্তু বড় ব্যাপার। তো হকের আরেকটা নাটক দেখেছি নূরলদীনের সারাজীবন। এটা কিছুটা ঝুলে গেছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আর দেখি নাই ...

হাসান শাহরিয়ার
অন্যরা? যেমন ধরুন, সেলিম আল দীন, মামুনুর রশীদ ...

শফি আহমেদ
আমার ধারণা যে, সেলিম ‘জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ যে লিখলো সেটার কন্টিনিউশন ছিল মুনতাসির ফ্যান্টাসি পর্যন্ত। পরে একেবারে নতুন জায়গায় চলে আসলো ...

সাঈদ আহমদ
ড্রামা বদলায়। ড্রামার চরিত্রই হলো বদলানো। এক জায়গায় থেমে থাকলে ড্রামা হয় না। সেজন্যই সেলিমের এই পরিবর্তনগুলো হলো।

হাসান শাহরিয়ার
তৃষ্ণায়-র পর কী লিখলেন স্যার?

সাঈদ আহমদ
শেষ নবাব। ওটা কিন্তু এ্যাবসার্ডধর্মী না।

শফি আহমেদ
আচ্ছা, বাংলা ভাষায় যে এ্যাবসার্ড নাটক হলো ... এই যে, আতাউরভাই করলো ওয়েটিং ফর গডো, এপ্রজন্মের একটি প্রমিজিং নাট্যদল প্রাচ্যনাট করলো গণ্ডার ... তো ...

হাসান শাহরিয়ার
মাইলপোস্ট করলো নাগরিক ...

শফি আহমেদ
হ্যাঁ, তো এ সব মিলিয়ে আপনার অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া কী?

সাঈদ আহমদ
আমি ওয়েটিং ফর গডো দেখেছিলাম। আমার ভালো লেগেছিল। গণ্ডার দেখিনি, স্ক্রীপ্ট পড়েছি। ড. জহুরুল হক আমাকে দিয়েছিল।

হাসান শাহরিয়ার
আপনার মাইলপোস্ট দেখেননি?

সাঈদ আহমদ
না, আমি তখন আমেরিকায়।

শফি আহমেদ
আমাদের দেশে কিন্তু আর কেউ এ্যাবসার্ড নাটক লিখলো না, কেন বলে মনে হয় আপনার?

সাঈদ আহমদ
নাট্যকার কোথায়? ঘুরে ফিরে এক সৈয়দ শামসুল হক, এক সেলিম আল দীন, এক মামুনুর রশীদ দিয়ে কি দেশ চলে? নাট্যকার থাকতে হয় ভুরি ভুরি। নাট্যকারে গিজগিজ করলে তো বিভিন্ন ধরনের নাটক আসবে।

হাসান শাহরিয়ার
এ্যাবসার্ড নাটকের প্রসঙ্গ ধরে বলতে হয় যে, আমরা কিন্তু একজন বড় মাপের নাট্যকার পেয়েছিলাম- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তাঁর নাটক আপনাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে কিনা?

সাঈদ আহমদ
উনি খুব বড় মাপের নাট্যকার, নমস্য ব্যক্তি। কেবল নাট্যকার নন, বড় মাপের সাহিত্যিক। কিন্তু তাঁর নাটক আমাকে প্রভাবিত করেনি, কারণ, আমি যখন নাটক লেখা শুরু করি তখন ওনার কোনো নাটক আমি পড়িনি। পরে পড়েছি। ওনার সাথে প্যারিসে দেখাও করেছি।

হাসান শাহরিয়ার
তাঁর নাটকগুলোর একটু চুলচেরা বিশ্লেষণ আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। মানে যেহেতু আপনারা দুজন একই ঘরানার নাট্যকার, আপনার বিশ্লেষণটা আমাদের জন্য জরুরি, অন্তত ওয়ালীউল্লাহকে বোঝার জন্য।

সাঈদ আহমদ
আসলে নাটকগুলো অনেক পূর্বের পড়া। চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যাবে না। এভাবে নাটকের বিশ্লেষণ করা যায়ও না। তাঁর নাটক দেখেছি, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় করেছিল ‘বহিপীর’। খুব ভালো নাটক। তরঙ্গভঙ্গ, উজানে মৃত্যু, সুড়ঙ্গ ... সবই ভালো নাটক। ওনার নাটকগুলোকে কিন্তু এ্যাবসার্ডধর্মী বলা যাবে না, Existentialism ওনার নাটকে আছে।

হাসান শাহরিয়ার
ওনার সাথে কখন দেখা হয়েছিল?

সাঈদ আহমদ
প্যারিসে, ১৯৬৯ সালে। আমি ওনাকে ফোনে জানালাম যে, আমি দেখা করতে চাই ... উনি বললেন ঠিক আছে ৭টার সময় আসো। আমি তাঁর বাসার কাছে পৌঁছে গেলাম ৬টায়। কিন্তু ভয়ে ঢুকলাম না। যদি বলে তোমাকে তো ৭টায় সময় দিয়েছি, এখন আসলে কেন? বড় মানুষ, বেশ স্মার্ট, কথা বলতেই তো ভয় হয়। পরে আমি কাছেই শপিং-এ গেলাম। কিন্তু শপিং করতে করতে দেরি করে ফেললাম। তাঁর বাসায় গেলাম ১৫/২০ মিনিট দেরি করে। দরজা খোলার পর একটা মিথ্যা কথা বললাম ... বললাম যে- বাসা খুঁজতে খুঁজতে দেরি হয়ে গেল, আমাকে ক্ষমা করে দিন। ... তো উনি আমার চালাকি ধরে ফেললেন, বললেন- তুমিতো প্যারিসে আছো অনেকদিন। এ এলাকার বাসা খুঁজতে হয় না। খুব সোজা পথ। তোমার তো ভুল হবার কথা না। ... কিন্তু আমাকে সরাসরি কিছু বললেন না, বললেন- ঠিক আছে ভেতরে আস। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত আমরা সময় কাটালাম। সারাক্ষণ আমার ‘তৃষ্ণায়’ নাটক নিয়ে কথা বললেন। বললেন যে- এ্যাতো ভালো নাটক খুব কম হয়। ... খুব প্রশংসা করলেন। তারপর গভীর রাতে আমরা রাস্তা ধরে হাঁটলাম আর গল্প করলাম। খুব চোস্ত লোক। শিক্ষিত, স্মার্ট বলতে যা বোঝায় উনি ছিলেন তা-ই, এক কথায় মডার্ন ম্যান। আমাদের দেশের আর কারো সাথে তুলনা দিয়ে দেখানো যাবে না যে উনি কেমন চোস্ত লোক ছিলেন।

হাসান শাহরিয়ার
স্যামুয়েল বেকেটের সাথে কি তখনই দেখা হয়েছিল, প্যারিসে?

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ। আমি যখন করাচিতে ছিলাম, তখন তাঁর ওয়েটিং ফর গডো নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম Sintilla- পত্রিকায়। সেই প্রবন্ধ Gillmard-প্রকাশনার পক্ষ থেকে ওনার কাছে পাঠানো হয়। Gillmard ইংল্যান্ডের খুব বড় প্রকাশনা সংস্থা। তো তখন এই প্রবন্ধ পড়ে বেকেট আমাকে চিঠি লিখলেন। উনি তাঁর Happy Days-বইটিতে একটি শুভেচ্ছা বাণী লিখে পাঠালেন। বাণীটি ছিল এরকম- For Sayeed Ahmad, Many Thanks for your article which I have read with great pleasure. With best wishes, yours cordially_ Sam. Beckett, Paris 1960. তারপর আমিও চিঠি লিখেছি। তারপর যখন প্যারিসে যাই, তখন ওনার বাসায় গিয়ে দেখা করি। ওনার সাথে ওয়েটিং ফর গডো নিয়ে অনেক কথা বললাম। আমাদের দেশের সূফিজম সম্বন্ধে বললাম, তাঁর কথাও শুনলাম। এভাবে আমরা তাঁর এই নাটক নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ করলাম। ... বেকেট কিন্তু এক সময় সাহিত্যিক জেমস জয়েসের ব্যক্তিগত সহকারি ছিলেন।

হাসান শাহরিয়ার
আপনি বাংলাদেশের বর্তমানের কোনো নাটক দেখেছেন?

সাঈদ আহমদ
সিএটি’র ব্র্যান্ড দেখেছি।

শফি আহমেদ
কেমন লাগলো? আমি তো এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কথা তুলেছি। যা নিয়ে মঞ্জুরে মওলার সাথে ঝগড়া লেগে গেল। উনি যেহেতু এই নাটক অনুবাদ করেছেন, তাই তিনি ডিফেন্ড করতে চাইলেন যে, এই নাটক ঠিক আছে। অনুবাদ নিয়ে না, আমার কথা হলো এই নাটকের কোনো দরকারই নেই আমাদের দেশে। অত পরিশ্রম করে এ্যাতো টাকা খরচ করে নাটক করবো, তাতে কোনো একটা প্রাসঙ্গিকতা থাকতে হবে তো ... আমার তো মনে হয় সাইবেরিয়ার দর্শকও এটা কমিউনিকেট করতে পারবে না।

হাসান শাহরিয়ার
স্যার, আপনার কী মত?

সাঈদ আহমদ
আমার ভালো লাগেনি। আমি এটা টেলিভিশনে করেছিলাম। বিশ্বনাটক অনুষ্ঠানে। আমি জামালউদ্দিন হোসেনদের ‘আমি নই’ দেখেছি। মন্তব্য করতে বলেছিল, কিছু বলিনি।

হাসান শাহরিয়ার
আপনার বিশ্বনাটক প্রোগ্রাম কি পারপাস সার্ভ করেছিল?

সাঈদ আহমদ
অনেকখানি সফল হয়েছে। সৌখিন দর্শক-নাট্যকাররা রস পেয়েছে। ইবসেন, এয়োনেস্কোসহ বহু নাট্যকারের নাটক করেছি ... প্রায় ১০০টি নাটক নিয়ে কাজ করেছি, বিশ্লেষণ করেছি ... অংশবিশেষ অভিনয় করে দেখানোও হয়েছে ...

হাসান শাহরিয়ার
সিএটি’র মেটামরফসিস দেখেছেন?

সাঈদ আহমদ
দেখেছি।

হাসান শাহরিয়ার
কেমন লাগলো? বিশেষ করে এই যে ইংরেজি বাংলার মিশেল বা দর্শকের মধ্যে ঢুকে যাওয়া ...

সাঈদ আহমদ
এটার দরকার ছিল না। মোটামুটি ভালো লেগেছে। কিন্তু তেমন ভালো কিছু করতে পারেনি। আমি মেটামরফসিস ইস্ট জার্মানিতে দেখেছি। কাফকার নাতি ছিল ডিরেক্টর।

শফি আহমেদ
একটু অন্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করি। সাঈদভাই, আপনাদের সময়ে মেয়েরা যে নাটকে এসেছে, সে জায়গাটা একটু বলুন। কারা কারা নাটক করতো?

সাঈদ আহমদ
কালবেলা-য় নিবেদিতার একটা পাঠ ছিল, ঐ রোলটা নাজমা হক করতো, তারপর মুনীরভাইয়ের বউ লিলি ছিল ... আমাদের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের হেড ছিল, সে করলো মার্চেন্ট অব ভেনিস ... খুবই ভালো একটা প্রোডাকশন হলো ... আর এখনতো অনেক মেয়ে আসছে ... সাধু সাধু ...

শফি আহমেদ
সাঈদভাই, আপনিইতো আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ... আপনার কী মনে হয়, যখন আপনারা ষাটের দশকে নাটক করেছেন, তখন কি ভাবতে পেরেছেন যে, এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকের ডিপার্টমেন্ট হবে, সেখানে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে তারপর নাটক করবে?

সাঈদ আহমদ
এটাতো বহুত বড় কাজ হয়েছে। আমরা ভাবিনি, কিন্তু এটা যে হলো সেটা একটা বড় কাজ হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের জানার অভাব খুব বেশি। কেবল যে এ প্রজন্ম তেমন কিছু জানে না, তা নয়, তোমাদের জানার পরিধিই বা কতটুকু। কেবল নিজের দেশ নিয়ে আছ, এমনকি ভারতের কার কতদূর খবর তোমরা জান। বিশ্বে কোথায় কতটুকু কাজ হচ্ছে সে বিষয় যদি জানার ব্যাপারটা তোমাদের সিলেবাসে থাকে তবেই কিন্তু এসব ডিপার্টমেন্ট চালু করাটা সার্থক হবে। যদিও আমি মনে করি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব ভালো জানাশোনা লোক আছে। যেমন- সৈয়দ জামিল আহমেদ খুব শিক্ষিত ছেলে। সে অনেক জানে, সৈয়দ শামসুল হক জানে, আলী যাকেরও জানে। তো এমন হাতে গোনা শিক্ষিত লোক দিয়ে কি হয়? আর থিয়েটারের প্রতি ডিভোশন আছে এমন লোকদের মধ্যে রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদের নাম করা যেতে পারে। আর নির্দেশক হিসেবে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বা আতাউর রহমানের নাম বলা যেতে পারে। তো ভালো কিছু করতে হলে জানাশোনা লোকের সংখ্যা বেশি হতে হয়।

হাসান শাহরিয়ার
আপনার তো অনেক দেশেই নাটক দেখার অভিজ্ঞতা আছে। তো সেই সব নাট্যব্যক্তিত্বদের মধ্যে কার কার নাম মনে আসে?

সাঈদ আহমদ
অনেক, অনেক নাম মনে আসে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা পেশোয়ার থেকে পালিয়ে গেলাম কাবুলে। সেখানে পরিচয় ঘটে হাবিব তানভীরের সাথে। সে তখন কাবুল রেডিওতে পরামর্শক পদে ছিলেন। সাজ্জাদ জহিরের সাথেও তখন সাক্ষাৎ হয়। সে তখন আইপিটিএ’র প্রধান ছিলেন। পরে চলে এলাম দিল্লিতে। হাবিব তানভীরও সপ্তাহখানেক পর চলে এলেন দিল্লিতে। ওঁনার মাধ্যমেই আমার পরিচয় ঘটে সফদার হাশমীর সাথে। খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার সাথে। আমি দেশে ফিরি ১৯৭২ সালে অক্টোবর মাসে। পরে একবার বোম্বেতে গেলাম। সেখানে বন্ধুত্ব হয়ে গেল খুশবন্ত সিং-এর সাথে। সে তখন ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’-র সম্পাদক ছিলেন। এরা যে কী মাপের জ্ঞানী ব্যক্তি তা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। বহুত বড় মানুষ। পরে ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁকে আমার বাসায় দাওয়াত করলাম। তিনি বললেন, আমি তো যাব, কিন্তু আমাদের হাই কমিশনারও আসতে চাচ্ছেন, কিন্তু তুমি দাওয়াত না করলে তো আসতে পারছেন না। তখন আমি হাই কমিশনার, ওনার নাম ছিল মেনন, তাকেও আমন্ত্রণ করলাম। আমার বন্ধুদের মধ্যে শামসুর রাহমান ছিলেন, ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন, মুর্তজা বশীর ছিলেন ... তো এসে মেনন জানালেন যে, খুশবন্ত সিং হলেন তার বাবার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু। এ জন্যই তার সাথে আমার বাসায় আসা দরকার ছিল। ... দেশ পান্ডে খুব বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন। পুনায় তার সাথে আমার পরিচয় হয়। পরে তিনি বোম্বেতে পারফরমিং আর্টস একাডেমির চেয়ারম্যান ছিলেন। উনি বাংলা খুব ভালো জানতেন আর রবীন্দ্রনাথে উপর ভালো দখল ছিল।

Richard Popp- আমেরিকার ব্রড ওয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। আমার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল, সেটা ১৯৭৭ সালের কথা। Ruiz Pipo- ফ্রান্সের প্রথম সারির পেইন্টার ছিলেন। তুমি আন্দাজ করতে পারবে না কত বড় মাপের মানুষ। আমার সাথে আলাপ হতো। আমি অনেক কিছু জেনেছি ওনার কাছ থেকে। আমি একবার চিন দেশে গিয়েছিলাম। ব্রেখট-এর গুরু Meilan-fang, যার কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ব্রেখট এলিয়েনেশন থিওরী করলেন, তার ছেলে-মেয়ের সাথে পরিচয় হলো। তাদের নাম হলো Mei Baoyne (বিখ্যাত অভিনেত্রী), Mei Baajui (বিখ্যাত অভিনেতা)। জাপানের বিশ্ব নন্দিত ডিরেক্টর কাম এক্টর Jukichi Uno তার কাজ দেখেছি, তার সাথে আলাপ করেছি।  বহুত বড় শিল্পী।

হাসান শাহরিয়ার
স্যার, আমরা জানি যে, ওয়াশিংটন ডিসিতে Arena Stage-এর গ্যালারীর একটি সারি আপনার নামে উৎসর্গীকৃত। সে ব্যাপারে আমাদের কিছু বলুন।

সাঈদ আহমদ
আমেরিকার বিভিন্ন সিটিতে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রচুর লেকচার দিয়েছি। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দিয়েছি। একটু আগে বললাম যে ASTA Theatre-র সাথেও জড়িত ছিলাম। তো সেটা ১৯৭৬ সালের কথা। সেখানে একটি নাটকের Special Consultant ছিলাম। তো Zelda Fichandler ছিলেন Arena Stage-এর সর্বেসর্বা। সে আমার কাজের মূল্যায়ন করে বললেন- আমরা আমাদের গ্যালারীর একটি সারি তোমার নামে উৎসর্গ করতে চাই। Arena Stage- এর গ্যালারীর একেকটি সারি বিশ্বের সেরা নাট্যব্যক্তিত্বদের নামে উৎসর্গ করা হয়। তো আমি শুনে খুব খুশি। এটা তো আমার জন্য বিশাল সম্মানের। এভাবেই একটি সারি এখন আমার নামে উৎসর্গীকৃত হয়ে আছে।

শফি আহমেদ
সাঈদভাই, একটা আলাদা প্রসঙ্গে আসি ... আমরা জানি যে, আমাদের দেশের আপনি ধরতে গেলে প্রথম আর্ট ক্রিটিক। এর আগে কেউ চিত্রকলার তেমন একটা সমালোচনা করেনি। আপনি কীভাবে এ মাধ্যমে এসেছিলেন।

সাঈদ আহমদ
এটা হলো আমি যখন ১৯৫৪ সালে লন্ডনে গেলাম, সেখানে হামিদভাই আর্ট কলেজে পড়তেন ... আর আমিও সেখানে যেতাম। ইন্ডিয়ান ক্রাউডের সাথে আড্ডা দিতাম। তো একবার ওরা বললো যে- তুমি একটা কোর্স করে নাও, চিত্রকলার উপর। আমিও ভাবলাম ভালোই হয়। তো আমি তিন মাসের একটা কোর্স করলাম, আর্টের উপর, ১৯৫৫ সালে। সেখান থেকেই আমার হাতেখড়ি, আমি আর্ট বুঝতাম ... বহু চিত্রকর্ম দেখেছি, আর্ট গ্যালারী বিনে পয়সায় ঘুরে ঘুরে দেখতাম। তখন পয়সা লাগতো না। এই দেখাটার পর আবার হামিদভাইয়ের সাথে আলোচনা করতাম যে- এই পেইটিংটা ভালো লাগলো বা ওটা খারাপ লাগলো ... কেন ভালো বা খারাপ লাগে এগুলো বুঝতে চেষ্টা করলাম। আমার বাড়িতেই তো পরিবেশ ছিল ... আমার বড়ভাই, নাজিরভাই কিন্তু খুব ভালো আঁকতেন। তো একটা পরিবেশ আমি নিজের বাড়িতেই পেয়েছিলাম আর আগ্রহও ছিল, সব মিলিয়েই আর্টের উপর সমালোচনা লিখতে শুরু করলাম। পরে অবশ্য বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরও লিখেছে।

শফি আহমেদ
ইউরোপে কিন্তু সব নাট্যকারদেরই ভালো বন্ধু ছিলেন বড় বড় পেইন্টাররা এবং তারা নাটকের সাথে জড়িত ছিলেন, ফলে নাটকের সেট ডিজাইন ইত্যাদিতে কিন্তু খুব বড় ধরনের যৌথ কাজ হয়েছিল। আমাদের দেশে কিন্তু সেটা হলো না।

সাঈদ আহমদ
হ্যাঁ, আমাদের দেশের পেইন্টাররা নাটকের সাথে যায়নি। কেউই কারো সাথে যায় না, একা একা সব করতে চায় হাঃ হাঃ। আসলে এই আদান প্রদানের জন্য এক ধরনের মানসিক Sophistication প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে ওসব Sophistication নেই।

শফি আহমেদ
সাঈদভাই, আমরা আপনার সাথে অনেক কথা বললাম। আপনি অসুস্থ, তারপরও আমাদের যে সময় দিয়েছেন কয়েকদিন ধরে, এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আপনাকে সকল নাট্যপ্রেমীদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

সাঈদ আহমদ
তোমাদেরকেও ধন্যবাদ। আমার কথা বলতে কষ্ট হয়, সব গুছিয়ে বলতে পারি না। অনেক কথা মনেও নেই। তবুও তোমরা অনেকদিন এসে ধৈর্য ধরেছ ... তোমাদের অনেকদিন আসতে হলো ... এর জন্য আমি দুঃখিত। তোমাদের সবাইকে বহুত বহুত ধন্যবাদ।