Full premium theme for CMS
দর্শকের মুখোমুখি : নাট্যজনের অনিবার্যতা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
দর্শককে অবহেলা করে কোনো শিল্পীই শিল্প সৃষ্টি করতে পারে না। প্রত্যেকেরই মাথার মধ্যে ঘোরে যে দর্শক ছবিটিকে ভালোবাসবে কি না। কাজেই এটা মিথ্যা কথা বলা হবে যদি কোনো শিল্পী বলেন যে দর্শকদের কথা ভুলে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন। তবে আত্মপ্রেরণার একটা প্রশ্ন আছে, বিবেকের একটা প্রশ্ন আছে, শিল্পী সেইখানে হয়তো বাধা পেতে পারেন। সেখানে দর্শকেরা ছবি দেখতে না-ও চাইতে পারেন। সেখানে কিছু করার নেই। কারণ, শিল্পী সাময়িক প্রয়োজনের কাছে মাথা নিচু করতে প্রস্তুত নন।- ঋত্বিক কুমার ঘটক
শিল্পীর এ এক অনিবার্য অন্তর্দ্বন্দ্ব। অন্যের সাথে তো বটেই, নিজের সাথে কথা বলবার সময়ও সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না- দর্শক বুঝে নেবে, না দর্শককে বোঝানো হবে! থিয়েটারটা ‘দৃশ্যকাব্য’ নামে ভূষিত হওয়ায় এ মত্ স্পটই যে, দর্শক শিল্পকর্মটিকে কীভাবে গ্রহণ করলো এ ব্যাপারটিকে উড়িয়ে দেবার কোনোই অবকাশ থাকে না। কিন্তু একটা কথা যে প্রায়শই উচ্চারিত হয়,- দর্শক তৈরি করতে হবে বা সৃজনশীল নাটকের জন্য চাই সৃজনশীল দর্শক- সেখানে দর্শকের মতামতের বাইরেও তো তাহলে কথা থেকেই যায়। আর থেকে যায় বলেই যখন দর্শকের বাহবা মেলে কোনো নাটকের পর, তখন দর্শকের প্রতি জাগে শিল্পীদের শ্রদ্ধাবোধ আর বিপরীতে যখনই দর্শক হতাশ হয়, তখনই দর্শককে ভাবা হয় নিম্ন স্তরের। এ কথা এখন স্পর্ধাভরেই উচ্চারিত যে, আজকালকার দর্শকরা নাটক বোঝে না। কিন্তু সত্য কি এই নয় যে, আজকাল নাটক বুঝিয়েরা নাটক দেখেন না? যদি কিছুটাও সত্য হয় এই বিলাপ, তবে এই উপসংহার কি টানা যায় যে, নাটক বুঝিয়েদের মানের নাটক মঞ্চস্থ হয় না ইদানীংকালে? তাহলে দায় কার বেশি- দর্শকের না শিল্পস্রষ্টার?
আসলে থিয়েটারে চলে প্রতিনিয়ত নিজেকে তৈরির খেলা, যোগ্য করে তোলার খেলা। সেটা দর্শকের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি সত্য শিল্পীদের বেলায়ও। প্রতিনিয়তই এখানে চলে নিরীক্ষার খেলা। নিজেকে নিজে অতিক্রমের নিরীক্ষা। তাই, পূর্বের বোধ-চেতনার একধাপ অগ্রসর হয়েই কাজ করতে চাইবে শিল্পী, একটি নতুন পালক পড়বার বাসনা তার থাকতেই হবে। দর্শকও তখন কাজ দেখতে আসে একধাপ বেশি আশা নিয়ে, প্রত্যাশা নিয়ে। বোধকরি অনেকটা প্রস্তুতি নিয়েই আসে দর্শক নতুন পালক পড়াবার জন্য। সে জন্যই দর্শক ও শিল্পীর মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার প্রয়োজনটা বেশ জরুরি হয়ে দেখা দেয়। দু’জনকেই মুখোমুখি হতে হয় পরস্পরের- নিজেদের আর শিল্পের খাতিরে।
দর্শককে কোন স্তরে বিবেচনা করবে একটি নাট্যদল? কতটুকু জানার সাথে আরো কিছু জানাবে নাট্যদলটি? ধরাই যাকনা ইদানীংকার প্রযোজনা নাট্যত্রয়ী’র কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ণকুন্তী সংবাদ, বিদায় অভিশাপ আর গান্ধারীর আবেদন নিয়ে সাজানো হয়েছে এই নাট্যত্রয়ী। বাংলাদেশের একটি প্রধান দল ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’, যারা কিনা এর আগে রবীন্দ্রনাথের নাটক করে অভ্যস্ততার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে, তারা যে এই নাটক নির্বাচনে যোগ্য দল তা কি অস্বীকার করে পারা যাবে? অচলায়তন, বিসর্জন, মুক্তধারা, রথের রশি করার পর রক্তকরবী এখনও তাদের নিয়মিত প্রযোজনা। তো তাদের আরেকটি রবীন্দ্র প্রযোজনা যখন দর্শক দেখতে আসবে, তখন দর্শকের প্রস্তুতিটা কেমন হবে? আমার দর্শক যদি রবীন্দ্রনাথ না পড়–য়া হয়, সেই দায়তো আর নাগরিক কিংবা নির্দেশক আতাউর রহমান নিতে পারবেন না। এবং কেবল একটু আধটু রবীন্দ্রনাথ পড়া থাকলেইতো আর চলছে না। এই নাটক দেখতে হলে কী পরিমান মহাভারত আস্তস্থ থাকা উচিত তা কি দর্শক একবারও ভেবে দেখেছে? তিনটি নাটকই (নাট্যত্রয়ী) একেবারে নিরেট কাব্য। গদ্যে অনেক অজানা জিনিসও হজম হয়, কিন্তু কাব্যতো আমাদের কাছে অনেকটা বিদেশি ভাষা। সেই ভাষাতে মুসলমানের ছাওয়ালরা যখন মহাভারতের কাহিনী শোনবে তখন তার পূর্বপ্রস্তুতি কেমন থাকা উচিত? আমরা এখনকার দর্শকরা কয়জন জানি কর্ণ এবং কুন্তীর মধ্যকার আদি সম্পর্ক কি কিংবা ঠিক কোন পরিস্থিতিতে এবং কোন সময়ে এই মা-বেটার সাক্ষাৎ হয় কিংবা কচ কে, বা, দেবযানীই বা কে? কচ কেন এসেছিল দেবযানী বা তার বাবার কাছে, কোত্থেকেই বা এসেছিল? এসে কচ কী কী পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়েছিল এবং তা থেকে উদ্ধারে দেবযানীর ভূমিকা কী ছিল এবং কেন ছিল? গান্ধারীর আবেদন-এ দুর্যোধন একাধারে ‘জয়ী এবং একা’ হবার পেছনের ব্যাখ্যা কি কেবল নাটক দর্শনেই বোঝা যাবে? দর্শকের কোনোই পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন হবে না? এ সব কিছু তুচ্ছ করে যখন হুড়মুড় করে মঞ্চে ঢুকে যায় দর্শক, তখন কচ ও দেবযানীর মধ্যকার প্রণয়বাক্য কী বিরক্তই না করে তাকে! নির্দেশক কি এই তিনটি কবিতার অন্তত পূর্বপাঠও প্রত্যাশা করতে পারেন না দর্শকদের কাছে? তো দর্শকের এহেন অজ্ঞানতার দায় কি নাট্যদলের বা নির্দেশককেই নিতে হবে? দর্শকের দায় কি সবসময় প্রশ্নমুক্তই থেকে যাবে?
তবে এ-ও সত্য যে, দর্শক মানেইতো সবাই উপরে উল্লেখিত দর্শক না। জানা-শোনা কিংবা একটু আধটু বোদ্ধা দর্শকও দেখে থাকতে পারেন এই নাটক। তাদের বেলায় কী ঘটে? আমাদের থিয়েটার সংস্কৃতির বর্তমান ধারার কথা বিবেচনা করলে নির্ঘাৎ বলে দেয়া যায় যে, যাদের এই নাটক ভালো মনে হয়েছে, তারা টেলিফোনে কিংবা সংবাদপত্রে দু’কলম লিখে ধন্যবাদ দিয়েছেন নির্দেশককে বা/আর অভিনেতৃকে। কিন্তু যাদের ভালো লাগেনি তারা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করবেন না সমালোচনার জায়গাগুলো। করবেন কোন সাহসে? কে চায় বন্ধু হারাতে? বন্ধুর কাজের সমালোচনা করা যে বন্ধুকেই ঋদ্ধ করা, সেই সংস্কৃতিরতো কবেই মৃত্যু হয়েছে এই থিয়েটার পাড়ায়। ফলে যাদের মনে হয়েছে এই নাট্যত্রয়ী-তে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পুরো রিসোর্সকে কাজে লাগানো যায়নি, ফলে আশানুরূপ মানে পৌঁছয়নি প্রযোজনাটি, তারা কখনোই মুখ খুলবেন না। বা যারা কচের অভিনয় দেখতে দেখতে কেবল ভেবেছেন, একই দলে আসাদুজ্জামান নূর বা খালেদ খান থাকতে কচের ভূমিকায় অন্য কাউকে দেখতে হবে কেন? ঈর্ষা আর নূরলদীন দেখা দর্শকদের এমত প্রত্যাশা বা মন্তব্য তো থাকতেই পারে। কিংবা যারা ভেবেছেন ‘নন্দিনী’ না হয় পার পেয়ে গেছে কিন্তু দেবযানীকে মঞ্চে ধারণ করতে হলে অপি করিমকে আরও সময় পার করতে হবে,- তারা কিন্তু এক কলমও লিখবেন না কোথাও কিংবা টেলিফোনে বন্ধু বা বান্ধবীটিকে বলবেন না পর্যন্ত যে,- তোমার কাছে আমার প্রত্যাশা অনেক, আশা করি পরবর্তী প্রযোজনায় সেটা মিটিয়ে দেবে যেমন মিটিয়েছ অতীত প্রযোজনায়। এটা মনে রাখতে হবে, নাটকের সাফল্যের সিংহভাগের অংশীদার যদি হয় লাইট আর সেট ডিজাইনারের তাহলে সেটা খুব একটা সার্থক নাটক হয় না। অন্তত দর্শককে কমিউনিকেট করার ব্যাপারে।
দর্শকের জানা না জানার মাত্রা নিয়ে আসলে বিপদেই পড়ে গেছেন আমাদের নাট্যস্রষ্টারা। সাম্প্রতিককালে এমন একটা বিপদের মুখোমুখি হয়েছে আমাদের থিয়েটার অঙ্গনের অন্যতম ঋদ্ধ দল ‘ঢাকা থিয়েটার’ ও দেশের প্রধান নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ। তারা আমাদের মৌলিক নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের চর্চা করে আসছেন বহুদিন ধরে। এটা দায় হোক কিংবা দায়িত্ব হোক সবচেয়ে বড় কথা নিজেদের চিন্তা চেতনার উচ্চ স্তর থেকেই তাদের এই চর্চা। তো এবার তারা চলে গেলেন আরেক মৌলিক দায়ের জায়গায়। থিয়েটারের ইতিহাস বলতেতো আমরা যার যার জন্মের পর থেকেই ইতিহাস শুরু - এমনটা ভেবে নিয়েছি। ফলে নিজের জন্মের আগেও যে ইতিহাস থাকতে পারে সে বোধ আমাদের নেই বললেই চলে। সেজন্যই আমরা সবসময় ভাবি- আমরা ‘শূন্যের’ উত্তরাধিকার। আমাদের কোনো ‘পূর্ব’ নেই, যা আছে তা কেবলই ‘উত্তর’। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, সেই দর্শকের সামনে হাজির করেছেন তারা শতবর্ষ আগের মঞ্চপ্রেমী নটী বিনোদিনীকে। বিনোদিনীকে নিয়ে অনেক নাটক শুনেছি কোলকাতায় হয়েছে, আমাদের এখানে হয়নি। হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। আমরা তো ‘আমরা হয়ে উঠতে’ ব্যস্ত। রাজনৈতিক পূর্বপুরুষকে নিয়ে নাটক করা যায় কিন্তু সাংস্কৃতিক পুর্বপুরুষ নিয়ে আবার নাটক কি? কেবল একবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল- ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ মধুসূদনকে দেখিয়েছিল। তো এমন একটা থিয়েটার পরিমণ্ডলে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে আনলো ‘বিনোদিনী’। নাট্যকার নেই, বিনোদিনীরই নিজের ডায়েরী আর আত্মজীবনী। আমাদের অনেকেরই বোধহয় এটার পূর্বপাঠ ছিল না। একবার কেবল শম্ভু মিত্রের একটা লেখায় পড়েছিলাম যে, এটা নাট্যকর্মীদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। তো সেই অবশ্যপাঠ্য বইটি কোনোদিন দেখারও সৌভাগ্য যাদের হয়নি তাদের সামনে ‘বিনোদিনী’ করতে গিয়ে নির্দেশকের কী হাল হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
নটী বিনোদিনীকে ঢাকার মঞ্চে উপস্থিত করতে পারেন এমত স্পর্ধা যদি কারো থেকে থাকে তবে তিনি অবশ্যই শিমূল ইউসুফ। সেকারণেই ঢাকা থিয়েটারের অনেকদিনের পরিকল্পনা ছিল বিনোদিনী করার। বাংলাদেশের থিয়েটারে শিমূল ইউসুফের একটি একক অভিনয় এমনিতেই পাওনা হয়ে আছে দর্শকের কাছে। সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে বিনোদিনী’র মতো নাটক নির্বাচন যেকোনো অর্থেই শ্রেষ্ঠ নির্বাচন। কিন্তু ঐ যে বলা হলো দর্শকের জ্ঞানের বহরের কথা, সেই বহরের মাত্রার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে প্রথমেই নির্দেশক ‘বিনোদিনী’ নামের আগে ‘নটী’ ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছেন। নাটকের নামটি কতই না মধুর আর যৌক্তিক হতো যদি তা হতো ‘নটী বিনোদিনী’! কিন্তু কেন এই কর্তন? ছেঁটে ফেলার প্রথম কারণটি বোধকরি এই যে, ‘নটী’ শব্দের যে রগড় অর্থ বাংলার দর্শক তৈরি করবে, তার ফলে বিনোদিনীর প্রতি শ্রদ্ধা যাবে উবে। প্রত্রিকায় নটী বিনোদিনী’র বিজ্ঞাপন দেখে দর্শকরা ঠিক কী ধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যে হল ঘরে আসবেন সেই আশঙ্কাতেই বোধহয় নটী বিনোদিনীকে শুধুই বিনোদিনী করা হয়েছে। এমন একটি উদাহরণ তো দেয়াই যায়- আমার এক নাট্যবন্ধুর কাছ থেকে শোনা। তার এক পরিচিতজন এসেছিলেন ঢাকা থিয়েটারেরই আরেকটি প্রযোজনা ‘যৈবতি কন্যার মন’দেখতে। দেখে হতাশ হয়েছেন। হতাশার কারণ হলো, বিজ্ঞাপনের নিচে ছোট্ট করে লেখা ছিল - ‘শিশুদের সঙ্গে আনবেন না’। যেহেতু ‘যৈবতি’ কন্যার মন দেখার জন্য শিশুদের আনতে বারণ করা হয়েছে, তাই তার প্রত্যাশা ছিল অন্য কিছু দেখা যাবে। এধরনের দর্শককে হতাশা থেকে আশার আলো দেখানো একজন নির্দেশকের পক্ষে কঠিনই বৈকি। নাটকটিতে আরেকটি ছোটখাট কম্প্রোমাইজের ছোঁয়া আছে, নাটকের প্রারম্ভে নির্দেশক নাটকের ডিজাইনের বাইরে গিয়ে সয়ং উপস্থিত হয়ে বিনোদিনী মঞ্চস্থ করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন এবং তার সাথে বিনোদিনীকে খানিকটা পরিচিতও করিয়ে দেন দর্শকের কাছে। এসবই করতে হয়েছে দর্শকের ‘মেধাস্তরের’ কথা চিন্তা করে। পশ্চিমবঙ্গে হলে হয়তো এই সমস্যাটা থাকতো না।
দেড় ঘন্টার এই নাটকে সম্পূর্ণ সাধুভাষায় সংলাপ, নৃত্য আর গীত গেয়ে কঠিন কাজকে সরলভাবে উপস্থাপন করে দর্শককে মুগ্ধ করেছেন শিমূল ইউসুফ। অনেক নাট্যবোদ্ধার প্রশংসা ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছেন তিনি। নাটকে নীলদর্পণ বা মেঘনাদ বধ থেকে নাট্যাভিনয়ের মধ্য দিয়ে যখন বিনোদিনীর উজ্জ্বল-করুণ-বর্ণাঢ্য জীবন ভেসে আসে তখন দর্শক মোহিত না হয়ে পারে না। তার উপর যখন সংগীতের আগমন ঘটে, তখন এই মোহময় আবেশী ছোঁয়া যেন অন্য এক রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়। হবে না-ই বা কেন, শিমূল ইউসুফ, যিনি অভিনেত্রী না হয়ে কেবলি গায়িকা হয়েই টিকে থাকতে পারতেন শ্রোতা-দর্শকের মাঝে, তাঁর গানে পাগল না হয়ে উপায়ই বা কি- এমত মন্তব্য অনেকেরই। শুনেছি নাটক শেষে কোনো একজন নিজের আংটি দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এই মঞ্চকুসুমকে। নাট্যজন আতাউর রহমান বিনোদিনী-তে উচ্ছ্বসিত হয়ে পত্রিকায় নাট্যালোচনা লিখেছেন। অভিনেত্রীর বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিনয়তো বটেই এমনকি প্রপস ব্যবহারের নিপুণতায়ও মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। এই ভালোলাগা প্রকাশে কোনো ভাণ বা কৃপণতা ছিল না তাঁর লেখায়। এমন উচ্ছ্বাস দেখেছি আরেক নাট্যবোদ্ধা মামুনুর রশীদের কণ্ঠেও। শুনেছি তিনি নাটক শেষে গ্রীণরুমে গিয়ে শিমূল ইউসুফকে বলে এসেছেন- তোর আর বেঁচে না থাকলেও চলবে। এসবই নাসির উদ্দিন ইউসুফ আর শিমূল ইউসুফের প্রাপ্য বলেই আমরা ধরে নিতে পারি। ঢাকার থিয়েটার আরো ঋদ্ধ হোক এই আমাদের প্রত্যাশা।
কিন্তু যারা কোলকাতায় বিনোদিনীর উপর অনেক নাটক দেখেছেন কিংবা বিনোদিনীকে নিয়ে ভেবেছেন, নিজে নিজেও, তাঁরা যখন খুব একটা তৃপ্ত হন না নাটক দেখে, তাদের এই অনুভূতি বা সমালোচনা কি পৌঁছয় নির্দেশক আর অভিনেত্রীর কাছে? তারা যে বলেন যে, মেঘনাদ বধ’র অংশটুকু না করাই ভালো, কারণ গৌতম হালদারের অভিনয় দেখার পর ওটুকু আর টানে না তাদের, কিংবা ঐ অংশটুকু দেখার সময় শিমূল ইউসুফের পারঙ্গমতাই চোখে পড়ে, বিনোদিনীর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না কিছুতেই- এই কথাগুলো কি নির্দেশক আর অভিনেত্রীর সাথে শেয়ার করা যায় না? নাকি এর উত্তরে নির্দেশকের বক্তব্য শোনার সাহস নিজেরা পান না বলেই বলেন না? এমন অনেক ভাষ্যও কানে আসে যে, বিনোদিনীর ব্যক্তিজীবন আর শিল্পীজীবন যে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গেছে, যে ত্যাগের ভেতর দিয়ে গেছে, তার ছিঁটে-ফোঁটা জীবনসংগ্রাম বা শিল্পসংগ্রাম যদি শিমূল ইউসুফের থাকতো তবেই না আমরা মঞ্চে বিনোদিনীকে পেতাম। সেই সংগ্রাম নেই বলেই মঞ্চে আমরা শিমূল ইউসুফের নান্দনিক উপস্থাপনা পেলেও বিনোদিনীর উপস্থিতি অধরাই থেকে যায়।- এসব সমালোচনাও অধরা থেকে যাচ্ছে নাসির উদ্দিন ইউসুফ আর শিমূল ইউসুফের কাছে, দর্শকের মুখোমুখি না হবার কারণে। তাই বিনোদিনী’র অনেক প্রশংসাও কিন্তু ঋদ্ধ করতে পারছে না তাদের।
সব প্রশংসায় আপ্লুত হওয়া যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার। বিনোদিনী দেখার পর নাট্যজন মামুনুর রশীদের তৃপ্তির কথা আগেই জানিয়েছি। তবে তাঁর তৃপ্তি সেখানেই শেষ নয়। তিনি জানিয়েছেন, বিনোদিনী দেখে তাঁর মনে হয়েছে- এ্যাতোদিন নাসির উদ্দিন ইউসুফ কী করেছে জানি না, তবে বিনোদিনী নির্দেশনা দেবার পর সত্যিকার অর্থেই বলতে হয় বাচ্চু নির্দেশক হিসেবে উঁচুমানের। মামুনুর রশীদের এহেন বক্তব্যে কিন্তু ভাবিত না হয়ে পারি না। দেশজ নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে যিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির যিনি একের পর এক মঞ্চপ্রয়োগ করে চলেছেন, এমনকি অতীতের সব সাফল্যকে বাদ দিয়েও সাম্প্রকিতককালে যিনি বনপাংশুল আর প্রাচ্য নির্দেশনা দিয়ে আমাদের ঋদ্ধ করেছেন, তাঁকে উঁচুমানের নির্দেশক ভাবার জন্য বিনোদিনী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো? মামুনভাই জানিয়েছেন, তাঁর এই আপ্লুত হওয়ার কথা নাসির উদ্দিন ইউসুফকে টেলিফোনে জানিয়েছেন।
এমত আরো ক’টি নাটক ইতোমধ্যে মঞ্চে এসে গেছে। বাঙলা থিয়েটারের চে’র সাইকেল, প্রাঙ্গনে মোর’র শ্যামা প্রেম, সি এ টি’র মেটামরফোসিস নিয়েও ভালো মন্দ অনেক কথা থাকতে পারে। আগেই বলা হয়েছে শিল্পচর্চা সবসময়ই নিরীক্ষাধর্মী, চূড়ান্ত বলে এর কিছু নেই, থাকতে নেই। আসলে শিল্পের প্রকৃত সমালোচনার জায়গাটিতে আমাদের যেতে হবে। আমাদের পরস্পরের মুখোমুখি হওয়াটা বেশ জরুরি হয়ে উঠেছে আজ। সৃজনশীল সমালোচনা সবাইকে ঋদ্ধ করে, শিল্পী-দর্শক এমনকি সমালোচককেও। নিজেকে জানার জন্যই অন্যের জানাকে শ্রদ্ধা করতে হয়। দর্শকের সাথে তাই শিল্পীর মুখোমুখি হওয়া আজ এক অনিবার্যতা। মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা শুধরে নেব নিজেদের কাজকে। দর্শকের মুখোমুখি না হলে আত্মতৃপ্তি আর অহংবোধ বেড়ে যায়। আত্মতৃপ্তি আর অহংবোধ নিজেকে যেমন ক্ষতি করে, তেমনি ক্ষতি করে শিল্পকেও। নিজেকে ক্ষতি করার অধিকার থাকলেও শিল্পকে ক্ষতি করার অধিকার না থাকাই ভালো।
বিনীত
হাসান শাহরিয়ার
১ মে ২০০৫
মিরপুর, ঢাকা।