Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

নিয়ম-নীতির কথা

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

অনুবাদ : অমিতাভ মহালদার

[জর্জি গ্রোটস্কি (১৯৩৩-১৯৯৯ ) : পোলিশ নাট্যনির্দেশক। ২০ শতকে অভিনয়-শিক্ষণের একটা নতুন ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য স্তানিস্লাভস্কি, ব্রেখ্ট এঁদের সঙ্গে তাঁকেও কৃতিত্ব দেয়া হয়। তাঁর কাজ বরাবরই যথেষ্ঠ ফিলসফিক্যাল। গ্রটস্কি তাঁর থিয়েটার অব থারটিন র’জ (১৯৫৯-৬২), পরবর্তীকালে যা ল্যবরেটরী থিয়েটারে (১৯৬২-৮৪) রূপান্তরিত হয়, এর মাধ্যমে অভিনয় শিল্পে এক বৈপ্লবিক মাত্রা যোগ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, অভিনয়শিল্পীই হবেন কোনো থিয়েটার প্রযোজনার মূল শক্তি এবং ভিত্তি। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সময়ে তিনি যে অনুশীলন পদ্ধতি ও বাচন কৌশল উদ্ভাবন করেন, তার স্বাক্ষর/প্রয়োগ রয়েছে করডিয়ন (১৯৪২), অ্যাক্রোপলিস (১৯৬২), ডক্টর ফস্টাস (১৯৬২) ইত্যাদি ইউরোপের বিশিষ্ট কিছু প্রযোজনায়।

১৯৬৮-১৯৬৯ সালে রচিত গ্রটস্কির এই নিবন্ধটির ইংরেজী অনুবাদ `Statement of Principles’ শিরোনামে `Towards a Poor Theatre’ -এ গ্রন্থভুক্ত হয়ে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়]

এক

আধুনিক সভ্যতায় জীবনের ছন্দ রূপায়িত হয় গতি (pace), , স্নায়ু-চাপ (tension), নিয়তিবোধ (feeling of doom), ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যসমূহ (personal motives) আড়াল করার ইচ্ছা এবং জীবনযাপনে আমাদের গৃহীত নানাবিধ ভূমিকা ও মুখোশ (পরিবার, কর্মস্থল, বন্ধুমহল, সমাজজীবন ইত্যাদি ভেদে যা ভিন্ন হয়)- এসবের বৈচিত্র্য দ্বারা। আমরা হতে চাই ‘সায়েন্টিফিক’- বিচিত্রমুখীনতা, আবেগগৌণ বুদ্ধিনির্ভরতা অর্থে। আসলে সভ্যতার ধারাই আমাদেরকে এ ধরনের প্রবণতার দিকে তাড়িত করে। আমরা কিন্তু সম্মান করতে চাই আমাদের জৈব-সত্তাকেও। একে বলা যেতে পারে শরীরবৃত্তীয় স্ফূর্তি (physical pleasures)। আমরা এই বৃত্তে আবদ্ধ থাকতে চাই না। এতে করে  আমরা প্রজ্ঞা ও প্রবৃত্তি, চিন্তা ও আবেগের এক দ্বৈত খেলা খেলে যাই। নিজেদেরকে শরীর ও আত্মায় কৃত্রিমভাবে বিভাজিত করার চেষ্টা করি। আর যখনই এ থেকে মুক্ত হতে চাই তখনই চিৎকার-চেঁচামেচি ও ধুপধাপ শুরু করি, ছন্দতালে উন্মাতাল হয়ে পড়ি। মুক্তির অন্বেষায় এক জৈব বিশৃঙ্খলায় উপনীত হই। নিজেদের পথচ্যুত করে, যথেচ্ছা খরচা করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা একটা সমগ্রতার অভাবে ভুগতে থাকি।

অভিনেতার টেকনিক, তার আর্ট যাতে সজীব সত্তা এক উচ্চতর উদ্দেশ্যের জন্য সংগ্রাম করে- এসবের মাধ্যমে থিয়েটার আমাদের সামনে এমন কিছু উপস্থাপন করে যাকে বলা যেতে পারে মুখোশের উন্মোচনে প্রকৃত বস্তুর উদ্ঘাটন, শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার সমগ্রতায়। থিয়েটারের এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে সুশৃঙ্খল উপায়ে, সংশ্লিষ্ট দায়দায়িত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ থেকে। আজকের সভ্যতায় মানুষের জন্য থিয়েটারের একটা নিরাময়কারী ভূমিকাও এখানে আমরা প্রত্যক্ষ করি। একথাও সত্য যে, অভিনেতাই এ কাজটি সম্পাদন করেন। এবং এটি সম্ভব হয় দর্শকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ নিবিড় পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে; ক্যামেরাম্যান, ওয়ার্ড্রোব মিস্ট্রেস, স্টেজ ডিজাইনার, মেকআপ গার্ল এদের আড়ালে থেকে নয়। কিয়দংশ অনাবৃত করে, উদ্ঘাটিত করে, অবমুক্ত করে, নিজের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে অভিনেতার এই যে উপস্থাপন- তা দর্শকের জন্য আমন্ত্রণস্বরূপ। একে তুলনা করা চলে দু’জন মানব মানবীর মধ্যকার সুগভীর প্রকৃত প্রণয়ের সঙ্গে। এটা একটা তুলনামাত্র কারণ ‘নিজের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা’ এই ব্যাপারটিকে শুধু সাদৃশ্যের মাধ্যমেই বোঝানো সম্ভব। এই আপাত স্ববিরোধী চূড়ান্ত সম্পাদনটিকে আমরা বলতে পারি একটা ‘টোটাল অ্যাক্ট’। আমাদের ধারণায়, এতে অভিনেতার গভীরতম আকুতিই মূর্ত হয়।

দুই

কেন আমরা আর্টের জন্য এ্যাতো শ্রম ব্যয় করি? অন্যদের শেখাতে নয়, বরং (অন্যদের সঙ্গে) নিজেরাই আমাদের অস্তিত্বে, আমাদের প্রাণিসত্তায়, আমাদের ব্যক্তিগত অপুনরাবৃত্তীয় অভিজ্ঞতায় ধরা দেয় এমন কিছু শিখতে; আমাদের চারপাশের বাধাগুলো ছিন্ন করতে; আমাদের পিছুটান, নিজেদের সম্পর্কে মিথ্যাসমূহ যা আমরা প্রতিদিনই নিজের এবং অন্যের জন্য তৈরি করছি- এসব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে শিখতে;  আমাদের অজ্ঞতা, ভীরুতা থেকে উদ্ভূত সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, নিজেদের মধ্যকার শূন্যতাগুলো পূরণ করতে, নিজেদের সম্পূর্ণ করতে। আর্ট কোনো অতিন্দ্রীয় ব্যাপার নয় (কিছু অসাধারণ অননুমেয় প্রেরণার মুহূর্ত অর্থে), নয় কোনো মানবীয় ব্যাপারও (পেশাগত অথবা সামাজিক কর্মকাণ্ড অর্থে)। আর্ট হলো একটা পরিপক্কতা, একটা বিকাশ, একটা উৎকর্ষ যা আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যায়।

আমরা সংগ্রাম করি আমাদের নিজেদের সম্পর্কে সত্যসমূহ আবিষ্কার করতে, উপলব্ধি করতে; যে মুখোশগুলোর আড়ালে আমরা প্রতিদিন নিজেদের লুকিয়ে রাখি, সেগুলোকে ছিন্ন করতে। আমরা থিয়েটারকে দেখে থাকি বিশেষ করে, তার বোধগম্য, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাপারগুলোর মধ্য দিয়েই- একটা উদ্দীপনাস্থল, একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে যেখানে অভিনেতা (এবং পরোক্ষভাবে অন্যরাও) নিজেকে স্থাপন করে। থিয়েটারের কেবল তখনই একটা অর্থ থাকতে পারে, যদি এটা আমাদের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের সনাতন বোধ ও অভ্যাস, আমাদের বিচার-বিবেচনার স্বরকে বদলাতে পারে। তা শুধু করার জন্যই করা নয়, বরং যাতে আমরা সব রকম দৈনন্দিন পলায়নপরতা ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত হয়ে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারি এবং পূর্ণ-শর্তহীন অবস্থায় নিজেদের নিরাভরণ-অর্পণ-আবিষ্কার করতে পারি। এভাবে আঘাতের মধ্য দিয়ে, দৈনন্দিন মুখোশ ও ম্যানারিজম ঝেড়ে ফেলা আলোড়নের মধ্য দিয়ে, কোনো কিছু আড়াল না করে আমরা এমন কিছুতে নিজেদের নিয়োজিত করতে সক্ষম হই যার (কোন নির্দিষ্ট নাম দিতে না পারলেও) মধ্যে নিহিত যাবতীয় শুভবোধ (Eros and Charitas)

তিন

আর্টকে বাঁধা যাবে না সাধারণ নীতি-নিয়ম অথবা কোনো পাঠ্যক্রম দিয়ে। অভিনেতা, অংশত হলেও, একীভূতভাবে স্রষ্টা, মডেল এবং সৃষ্টি। তিনি অবশ্যই এ্যাতোটা নির্লজ্জ হবেন না- যা মনে হতে পারে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা। তাকে হতে হবে সাহসী, কিন্তু এই সাহস মোটেই নিজেকে জাহির করার সাহস নয়, একটা পরোক্ষ সাহস, আমরা বলতে পারি নিরালম্বের (defenseless) সাহস, নিজেকে প্রকাশিত করার সাহস। যা অন্তর্লোককে স্পর্শ করে বা নিজেদেরকে অনাবৃত করে- এর কোনোটাকেই মন্দ বলা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বা নিষ্পন্ন কাজে কোনো সৃষ্টিশীল ভূমিকা রাখছে। তা যদি অনায়াশলব্ধ না হয় এবং তাতে আকস্মিক স্ফূরণ নয় বরং দক্ষতাজাত দখলের চিহ্ন থাকে, তখনই তা সৃষ্টিশীল; তা আমাদের প্রকাশিত/বিকশিত করে এবং পরিশুদ্ধ করে, যখন আমরা নিজেদেরকে অতিক্রম করতে চেষ্টা করি।
 
এ সমস্ত কারণে অভিনেতার অন্তরঙ্গ বিষয়সম্পৃক্ত কাজের প্রতিটি দিককে সুরক্ষিত হতে হবে বেফাঁস মন্তব্য, অসাবধানতা, ঔদাসীন্য, অলস কথাবার্তা, ঠাট্টা-মস্করা ইত্যাদি থেকে। ব্যক্তিজগৎ (আত্মিক এবং শারীরিক উভয়) অবশ্যই জীবনের তুচ্ছতা, জীর্ণতা, এবং নিজের ও অন্যের ব্যাপারে কুশলী না হওয়ার কারণে পর্যুদস্তু হবে না, অন্তত কাজের ক্ষেত্রে কিংবা কাজ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্রে। এই স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপারটিকে একটা বিমূর্ত নীতি-নির্দেশের মতো শোনাতে পারে। কিন্তু আদতে তা নয়। এটা অভিনেতার আকুতির মর্মের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। এই আকুতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বটে। অভিনেতা তার নিজের জীব-অস্তিত্ব দ্বারা একটি ‘এ্যাক্ট অব সোল’ নিষ্পন্ন করবেন, অবশ্যই তাতে অতিরিক্ত কারুকার্য যোগ না করে। এ অবস্থায় তার বেছে নেওয়ার জন্য দুটো বিকল্প থাকতে পারে; তিনি পারেন নিজেকে শৈল্পিক বেশ্যাবৃত্তির (artistic prostitution) একটি উপাদান বানিয়ে নিজের প্রকৃত মূর্তিমান সত্তাকে (real incarnate self) বিক্রি করতে, অবমাননা করতে; নতুবা পারেন নিজেকে সমর্পিত করতে, তার প্রকৃত মূর্তিমান সত্তাকে পরিশুদ্ধ করতে।

চার

একজন অভিনেতা শুধু এমন কারো দ্বারাই নির্দেশিত ও প্রাণিত হতে পারেন যিনি সৃষ্টিশীল কাজে পূর্ণমগ্ন। একজন নির্দেশক যখন কোনো অভিনেতাকে নির্দেশিত করবেন, প্রাণিত করবেন, একই সময়ে সেই অভিনেতার দ্বারা নিজেও নির্দেশিত বা প্রাণিত হতে পারার মতো মানসিকতাও তার থাকা আবশ্যক। এখানে প্রশ্নটা স্বাধীনতার, অংশীদারীত্বের। এতে শৃঙ্খলার কোনো ঘাটতি নেই, আছে অন্যের স্বকীয়তা বা স্বশাসনের প্রতি সম্মান। অভিনেতার স্বশাসনের প্রতি সম্মান বলতে শৃঙ্খলাহীনতা, প্রত্যাশাহীনতা, অনিঃশেষ বাকবিতণ্ডা, কাজের স্থলে লাগাতার বাক্যব্যয় বোঝায় না; বরং বোঝায় ব্যাপক প্রত্যাশা, সর্বোচ্চ সৃষ্টিশীল কাজের জন্য এবং সর্বোচ্চ ব্যক্তিক উন্মেষের জন্য আকাঙ্ক্ষা। এ থেকে বোঝা গেল, ‘অভিনেতার স্বাধীনতা’র প্রতি সহমর্মিতা তৈরি হতে পারে শুধু গাইড/নির্দেশকের কর্মকাণ্ডের উদারতা থেকেই, এর ঘাটতি থেকে নয়। এর ঘাটতি থেকেই উদ্ভূত হয় চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা, স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, বাহ্যিক বাগাড়ম্বর।

পাঁচ

একটা সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে বাহ্যিক আরাম-আয়াশ বা প্রথাগত মনুষ্য ভব্যতার কোনো সম্পর্ক নেই; বলতে গেলে সকলেই ভালো রয়েছে- এমন একটা কাজের পরিবেশ। এটা দাবী করে সর্বোচ্চ নীরবতা ও স্বল্পতম কথাবার্তা। এই ধরনের সৃষ্টিশীলতায় আমাদের ফয়সালা হয়- প্রস্তাবনা (proposals), এ্যাকশন এবং জীব-অস্তিত্বের (living organisms) মাধ্যমে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে নয়। কোনো জটিল, কখনো কখনো প্রায় অবোধ্য কিছুর মুখোমুখি হলে আমাদের উচিত নয় তাকে তাচ্ছিল্য করে/খামখেয়ালী করে গুরুত্বহীনতায় হারিয়ে ফেলা। এমনকি বিরতির সময়, যার পরই আমরা আবার সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় চলতে শুরু করবো, আমরা বাধ্য আমাদের আচরণে কিছু স্বাভাবিক মৌনতা বজায় রাখতে, এমনকি আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়াদির ক্ষেত্রেও। এটা আমাদের নিজেদের কাজের বেলায় যতোটা, আমাদের সহকর্মীদের কাজের বেলায়ও ততটাই প্রযোজ্য। আমাদের উচিত নয় অন্যের কাজে নাক গলানো বা তাতে ঝামেলা করা, কারণ আমাদের তাড়া রয়েছে নিজেদের কাজ নিয়েই। আমরা অবশ্যই উঁকি-ঝুঁকি দেবো না, আড়ালে মন্তব্য করবো না বা ঠাট্টা-মস্করা করবো না। অভিনেতার কাজের ধারায় কোনো অবস্থাতেই ব্যক্তিগত ঠাট্টা-মস্করার কোনো স্থান নেই। সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি আমাদের যে এ্যাপ্রোচ, তাতে এমনকি থিমটা যদি একটা গেমও হয়, আমাদের অবশ্যই সপ্রতিভ (state of readiness) থাকতে হবে- এটাকে বলা যেতে পারে ‘সলেমনিটি’। আমাদের ওয়ার্কিং টার্মিনলজি (যা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, তা) অবশ্যই মূল কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না এবং প্রাইভেট কনটেক্সটে ব্যবহৃত হবে না।

এধরনের মানসম্পন্ন সৃষ্টিশীল কাজ দলগতভাবেই সম্পন্ন হয়ে থাকে, এবং তাই কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের উচিত আমাদের সৃষ্টিশীল আত্মম্ভরীতাকে (creative egoism) দমিয়ে রাখা। একজন অভিনেতার কোনো অধিকার নেই, তার নিজের পারফরমেন্সের অধিকতর সম্ভাবনা নিশ্চিত করার জন্য সহ-অভিনেতাকে মাড়িয়ে দেওয়ার। অধিকার নেই, প্রযোজনা-কর্তা কর্তৃক আদিষ্ট না হলে সহ-অভিনেতার ভুল সংশোধন করে দেওয়ার। উচিত নয়, অন্যের কাজের খুব ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ দিক সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য করা, এমনকি তাদের অনুপস্থিতিতেও। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, ঝগড়াঝাটি, রাগ-অনুরাগ, শত্রুতা এসব কোনো মনুষ্যদলেই এড়ানো সম্ভব নয়। আমাদের কর্তব্য হলো যতোটা সম্ভব এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, যাতে কাজের প্রক্রিয়া ব্যাহত বা বিনষ্ট না হয়। আমরাতো নিজেদের উন্মুক্ত করতে বাধ্য, এমনকি শত্রুর সামনেও।

ছয়

ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার উল্লিখিত হলেও একটি বিষয় প্রায়ই গুরুত্বহীন ও অব্যাখ্যাত রয়ে যায়। আর তা হলো, আমাদের অবশ্যই উচিত নয় সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনোকিছু যেমন: লোকেশন, কস্টিউম, প্রপস, এ্যাকটিং স্কোরের কোনো একটা উপাদান, টেক্সটের একটি মেলোডিক থিম বা লাইন- এগুলোকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা। এই নিয়ম প্রযোজ্য একেবারে ছোট ডিটেলের কাজেও; কোথাও এর কোনো ব্যত্যয় নেই। আমরা এই নিয়মটি তৈরি করিনি শুধু একটি স্পেশাল আর্টিস্টিক ডিভোশনকে স্বীকৃতি দিতে। আমরা বড় বড় মহৎ বক্তব্যে আগ্রহী নই, আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বলে- এ ধরনের বিধানের প্রতি কঠোর আনুগত্যের অভাব অভিনেতার কাজকে ফিজিক মোটিভস ও রেডিয়েন্স থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণ ঘটায়।

সাত

শৃঙ্খলা ও সাযুজ্য (harmony) হলো প্রত্যেক অভিনেতার কাজের আবশ্যকীয় শর্ত যার অভাবে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ নিষ্পন্ন হতে পারে না। আমরা এখানে প্রত্যাশা করি দৃঢ়তা। প্রত্যাশাটা সেই অভিনেতাদের কাছে যারা সচেতনভাবেই থিয়েটারে আসেন আমাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে পূর্ণ সাড়া আদায় করার চূড়ান্ত লক্ষ্যে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে। তারা এমন নির্দিষ্ট কিছুতে নিজেদের যাচাই করতে আসেন যা সীমাবদ্ধ নয় থিয়েটারের শাব্দিক অর্থের মধ্যে, যার মিল অনেকটাই জীবনাচরণের, অস্তিত্বের ধারার সঙ্গে। এই আউটলাইনটাকে অস্পষ্ট মনে হতে পারে। এটাকে থিয়োরিটিক্যালি ব্যাখ্যা করলে আমরা বলতে পারি, থিয়েটার এবং এ্যাক্টিং হলো একটা বাহন যার উপর ভর করে আমরা নিজেদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। পাড়ি দিতে পারি একটা দীর্ঘ পথ। যাই হোক,  ট্রায়াল-পিরিয়ডেরও বেশি সময় এখানে থাকলে যে কেউ পুরোপুরি অবগত হবেন, আমরা যা নিয়ে আলোচনা করছি তা আয়ত্ব করতে হবে- বড় বড় কথায় নয়, ডিটেল, ডিমান্ড, প্রচণ্ড পরিশ্রম -এর সকল ক্ষেত্রে। যিনি এই মূল এলিমেন্টকে ডিসটার্ব করেন, উদাহরণস্বরূপ, নিজের এবং অন্যের এ্যাক্টিং স্কোরকে সম্মান করেন না, এর স্ট্রাকচারকে ধ্বংস করেন ভান/প্রতারণা/মিথ্যা (shamming) বা অবলীলাক্রমে পুনরাবৃত্তি (automatic reproduction) দ্বারা, তিনিই আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসের এই অসংজ্ঞায়িত উচ্চতর উদ্দেশ্যকে (undefinable higher motive of our common activity) বাধাগ্রস্থ করেন। একইভাবে, ব্যাকগ্রাউন্ডের ছোট ডিটেল, যেগুলোর ওপর ভর করেই মৌলিক প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হয়, যেমন- কাজের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আবিষ্কৃত বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব। আমরা আমাদের স্মৃতির ওপর নির্ভর করবো না, যদি না আমরা মনে করি যে আমাদের কাজের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এমনকি তখনো আমাদের উচিত আংশিক রেকর্ড রাখা। নাটকের পুরো টেক্সট মুখস্থ রাখা- এসব কড়াকড়ি নিয়মের মতো এটাও একটা বেসিক রুল। কারো কাজে যেকোনো ধরনের ভাণ (shamming) সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। কখনো কখনো এরকম হয় যে, একজন অভিনেতাকে একটা দৃশ্য অভিনয় করতে হচ্ছে- তিনি শুধু আউটলাইনটাই করছেন, দৃশ্যটির গঠন (organisation) এবং তার সহশিল্পীদের এ্যাকশনের এলিমেন্টগুলো বোঝার জন্য, কিন্তু সেখানেও তাকে অবশ্যই এ্যাকশনগুলো যত্নের সঙ্গে ফলো করতে হবে অন্যদের বিপরীতে তার নিজের কাজটা মেপে মেপে, তাদের মোটিভগুলো অনুধাবনের লক্ষ্যে। এটাই হচ্ছে আউটলাইনিং এবং শেমিং-এর মধ্যে পার্থক্য।

একজন অভিনেতা অবশ্যই দল কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে সৃষ্টিশীল কাজে যোগ দিতে প্রস্তুত থাকবেন । এ ক্ষেত্রে তার স্বাস্থ্য, শারীরিক অবস্থা এবং সমুদয় ব্যক্তিগত বিষয় একান্তই তার নিজের ব্যাপার। এমন মানের একটি সৃষ্টিশীল কাজ বের হয়ে আসতে পারে শুধু জীব-অস্তিত্বের (শরীর) যথাযথ পূর্ণ ব্যবহারের নিশ্চয়তায়ই। সুতরাং আমরা আমাদের শরীরের নৈমিত্তিক যত্ন নিতে বাধ্য। তাহলেই পারবো সবসময় কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতে।

আমরা অবশ্যই ব্যক্তিগত আমোদ-উপভোগের খাতিরে ঘুম-স্বল্পতায় যাবো না যাতে করে অবসাদ বা শৈথিল্য নিয়ে কাজে আসতে হয়। মনসংযোগে অক্ষম এমন অবস্থায় আসা মোটেই উচিত নয়। নিয়মটা শুধু একজনের নিয়মিত কাজে উপস্থিতিই নয়, সৃষ্টিশীল কাজের জন্য শারিরীক প্রস্তুতি নিশ্চিত করাও।

আট

সৃষ্টিশীলতা, বিশেষত যা অভিনয়সম্পৃক্ত, দাবি করে সীমাহীন নিষ্ঠা ও সুশৃঙ্খলতা: যা মূর্ত হয় সংকেতে (signs)। সুতরাং অভিনেতার উচিত নয় তার উপকরণকে এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক বিবেচনা করা। এবং অভিনেতার শরীরটাই যেখানে তার উপকরণ, সেখানে এটাকে প্রশিক্ষিত হতে হবে- নমনীয় হতে, আত্মিক (psychic) উদ্দীপনায় পরোক্ষভাবে সাড়া দিতে, যেনবা সৃষ্টিমুহূর্তে এটা একেবারেই অস্তিত্বহীন। অর্থাৎ আমরা বোঝাতে চাচ্ছি শরীরটা যেন কোনোভাবেই প্রতিবন্ধক না হয়। স্বতস্ফূর্ততা ও নিয়মানুবর্তিতা হচ্ছে একজন অভিনেতার কাজের মূল বিষয় যা দাবী করে একটা পদ্ধতিগত উপায় (methodical key)

কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যে কাউকেই তার একটা ‘পয়েন্ট অব অরিয়েন্টেশন’ ঠিক করে নিতে হয় এবং সে অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কাজ করে যেতে হয়। এই পয়েন্ট অব অরিয়েন্টেশনটা হতে হবে তার কাছে খুবই স্পষ্ট- জীবনাচরণের স্বাভাবিক বিশ্বাস/আস্থা, প্রাক-পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার ফল। এই পদ্ধতির মূল ভিত্তি থেকেই আমাদের দলের এই পয়েন্ট অব অরিয়েন্টেশন তৈরি। এই পয়েন্ট অব অরিয়েন্টেশনের ফলাফল নিরীক্ষা করতে/যাচাই করতে আমাদের প্রতিষ্ঠান উৎসাহী। সুতরাং, যারা এখানে আসছেন এবং থাকছেন তাদের কেউই দলের পদ্ধতিগত কাজে জ্ঞানের/জানাশোনার অভাব আছে, এমন অভিযোগ তুলতে পারবেন না। যারা এখানে আসেন, কাজ করেন আবার একই সঙ্গে দূরত্বও বজায় রাখেন, তারা আসলে ভুলভাবে তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে উপস্থাপন করতে চান। ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের’ (individuality) ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো ‘অবিভাজ্যতা’ (indivisibility) যার মানে কোনোকিছুতে পূর্ণ উপস্থিতি; ইনডিভিজুয়ালিটি হচ্ছে হাফ-হার্টেডনেস-এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা খেয়াল রাখি, যারা এখানে আসেন এবং থাকেন তারা যেন আমাদের মেথডের মধ্যে এমন কিছু পান যা তাদের নিজের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত, তাদের জীবন ও অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভুত। যেহেতু তারা এটা সচেতনভাবে গ্রহণ করেন, আমরা মনে করি, প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীই সন্তুষ্টবোধ করেন- সৃষ্টিশীলভাবে প্রশিক্ষিত হতে, আবিষ্কার করতে তার স্বাতন্ত্র্য যা নিজের থেকে অবিভাজ্য, এবং নির্মাণ করতে তার নিজের অরিয়েন্টেশন যা ঝুঁকি ও সন্ধানের পথে উন্মুক্ত। যে কারণে আমরা এখানে বলছি, ‘মেথড’ হচ্ছে যেকোনো ধরনের প্রেসক্রিপশনের ঠিক বিপরীত।

নয়

মোদ্দাকথায়, একজন অভিনেতা চেষ্টা করবেন না কোনো ধরনের ‘রেসিপি’ বা কোনো ‘ট্রিকস্ বক্স’ লাভ করতে। তাবৎ এক্সপ্রেশন-পদ্ধতি সংগ্রহ করার কোনো জায়গা নয় এটা। অভিনেতার কাজের মধ্যকার ‘ফোর্স অব গ্র্যাভিটি’-ই তাকে নিয়ে যায় এক অন্তর্গত পরিপক্কতার দিকে, যা প্রকাশ পায়- গণ্ডি পেরোনোর একটা তাগিদ, একটা ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’, একটা ‘সম্পূর্ণতা’র সন্ধানের ভিতর দিয়ে।

অভিনেতার প্রথম কাজ হলো এটা অনুধাবন করা যে, এখানে কেউ তাকে কিছু দেওয়ার জন্য বসে নেই, বরং সবার ধান্ধাই তার কাছ থেকে নেওয়ার, সেইসব কিছু- যার সঙ্গে স্বভাবতই সে খুব সম্পৃক্ত- তার প্রতিরোধ, সৌম্য, মুখোশের আড়াল হওয়ার আগ্রহ, তার ঔদাসীন্য, সৃষ্টিশীল কাজের পথে তার শরীরসৃষ্ট বিপত্তি, তার অভ্যাস এমনকি সহজাত ‘সৌজন্যবোধ’ পর্যন্ত।

দশ

একটা ‘টোটাল এ্যাক্ট’ নিষ্পন্ন করতে সক্ষম হওয়ার জন্য একজন অভিনেতাকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়, যেগুলো কথায় প্রকাশ বেশ দূরূহ হলেও বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ সরল। তবে, যে বিষয়গুলোর কারণে একটা টোটাল এ্যাক্ট নিষ্পন্ন করা সম্ভব হয় না, বা অভিনেতার যেসব কাজ (এ্যাকশন) তাকে অসম্ভব করে তোলে সেগুলো সনাক্ত করা সহজতর।

এই টোটাল এ্যাক্ট সম্ভবপর হবে না, যদি অভিনেতা, প্রকৃষ্টতম আঙ্গিকে বোধগম্য যে সৃষ্টি- এর চেয়ে ভোগ-বিলাস, ব্যক্তিগত সাফল্য, যশ এবং সম্মানীর প্রতি অধিকতর মনোযোগী হন; যদি অভিনেতা তার পার্টের ব্যাপ্তি, পারফর্মেন্সে তার অবস্থান, দিন-ক্ষণ অথবা দর্শকের ধরন ইত্যাদি বিষয়ে শর্ত আরোপ করেন। টোটাল এ্যাক্ট পাওয়া সম্ভব হবে না, এমনকি থিয়েটারের বাইরেও যদি অভিনেতা তার সৃষ্টিশীল উদ্যমকে শিথিল/অসংগঠিত রাখেন এবং তাকে হেয় করেন, রুদ্ধ করেন- বিশেষ করে স্বভাবস্থিত সন্দেহ প্রবণতাকে আকস্মিক প্রশ্রয়দানের মাধ্যমে বা সৃষ্টিশীল কাজকে নিজের ক্যারিয়ার প্রশস্ত করার একটি মাধ্যম হিসেবে পরিকল্পিত ব্যবহারের মধ্য দিয়ে।

অমিতাভ মহালদার : নাট্যকর্মী, সদস্য- উদীচী।