Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

একটি শিরোনামহীন নাটক

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

স্পেস এ্যান্ড এ্যাকটিং রিসার্চ সেন্টার এর অন্যতম প্রযোজনা একটি শিরোনামহীন নাটক। তবে এটি ইম্প্রোভাইজড ড্রামা। এ ধরনের নাটকে সব সময়ই সংযুক্তি-বিযুক্তির সম্ভাবনা থাকে। এর মধ্যে হুট করে ঢুকে যায় কোনো একটি প্রয়োজনীয় নাট্যমুহূর্ত, আবার নাট্যকর্মীদের চৌকস পর্যবেক্ষণে এমন কোনো মেদ বাহুল্য যা নাটকীয়তাকে স্থূলতায় পর্যবসিত করে, তাকে গলা ধাক্কা খেয়ে বেরও হয়ে যেতে হয়। নাটকটি প্রথম পরিবেশিত হয়েছিলো বাঙলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এ ধরনের পরিবেশনা যেন এর অন্তর্নিহিত সত্তায় আগুন ধরিয়ে দেয়। স্বতন্ত্র আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার কি যোগ্যতা নেই কেবলি নাটক হিসেবে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে পরিবেশিত হওয়ার? ঐ দিকে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস সমাগত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নাটকটির ভেতরের শক্তিকে প্রতিবাদী মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে ছাব্বিশে মার্চে জাদুঘরের নির্ধারিত অনুষ্ঠানমালার ভেতর দিয়েই তার নতুন সত্তার উদ্বোধন ঘটে। বাঙালির উৎসবের দিন তো আর শেষ হয় না। পুরাতন বছর বিদায় হয়ে এলো নববর্ষ। সেদিন (১লা বৈশাখ, ১৪১১) থেকেও পরপর তিনদিন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাফে থিয়েটারে পরিবেশিত হয় এ নাটক। একটি বিষয়ভিত্তিক পারফর্মিং আর্ট স্থানানুগ পরিবেশিত হলে এটার দ্যোতনাই হয় আলাদা প্রকৃতির। মুক্তিযুদ্ধের নাটক মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে, ব্যাপরটিই অন্য রকম, যদিও এটি পরিবেশ থিয়েটার নয়। এভাবে একের পর এক নাটকটির উত্তরণ ঘটতে থাকে, একই সময়ের পরিসরে। মাত্র ৪৫ মিনিট। আর দর্শকরাও নাটক দেখে এক এক রকম অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরেন। নিজেরাই নিজেদের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন নামে নাটককে গ্রহণ করেন। এ প্রক্রিয়ায় এ নাটকের ‘একটি শিরোনামহীন নাটক’ নামটিও তার সার্থকতা খুঁজে পায়।

মঞ্চে তাকাতেই চোখে পড়ে আস্ত এক সুপোরী পাতা, একটি চুল্লি ও কিছু খড় ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। এদিকে তাকিয়ে কল্পনা প্রসারিত করতেই তা আমাদের নিয়ে যায় একাত্তর সালের তিনমাথার একটি মোড়ে। সংলগ্ন স্কুল ও বড়ো রাস্তায়। স্বাধীনতা অর্জনের শেষ মুহূর্ত।

পাকিস্তানী হানাদার আর্মির যুবক ইকবাল এবং ফজলুল হক ব্যাটেলিয়ানের সদস্য আলম দুঃসহ সময় অতিবাহিত করছে। বুলেট ও অস্ত্রশূন্য এ দু’জনের জামানত আছে একটি ওয়ারলেস সেট। মাঝে মধ্যে সচল হয়, আবার অকেজো হয়ে পড়ে। ক্যাম্প সংলগ্ন মসজিদের মোয়াজ্জিনের কন্যা ক্যাপ্টেনের নির্দেশে ক্যাম্পে রুটি বানানোর কাজ করে। হাফিজা স্বচক্ষে বাবা মায়ের মৃত্যুদৃশ্য অবলোকন করে, নির্লিপ্ত হয়ে যায়। জনতার আক্রমণের মাধ্যমে ক্যাম্প অধিকার যখন নিশ্চিত হয়ে যায় তখন ইকবাল জনতার হাতে নিজকে সমর্পনের নিয়তি- নির্দিষ্টতাকে মানসিকভাবে মেনে নিতে পারে না। যুদ্ধের শেষ সময় সমাগত। পরাজয়ের গ্লানিতে ক্লান্ত আর্মি যুবক তাকে মেরে ফেলার অনুরোধ জানায় তার সাথী আলমকে। আলম হেয়ালী ভাষায় তা’ প্রত্যাখ্যান করে। অসহ্য সময়। এরই মধ্যে রুটি খাওয়ার খেলাটি মাথায় আসে তার। এভাবে কিছুটা সময় হয়তো কাটবে। আলমের কাছে আর্মি যুবকটি প্রস্তাব রাখে রুটি খাওয়ার জন্যে। আলম পুনর্বার রুটি খেতে অস্বীকার করে। আর্মি যুবকটি আলমকে রুটি খেতে বাধ্য করে। সে জানায়, ‘এই রুটির জন্যই আমরা আলাদা হচ্ছি- খা’। আর্মি যুবক নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে আলমের কাছে পুনরায় প্রস্তাব রাখে যে, সে আলমকে আঘাত করবে শারীরিকভাবে, আলম আহত হলে আলমের ভেতর ক্রোধ জন্ম নেবে, তখন আর্মি যুবককে মারাটা তার জন্য সহজ হবে। আর্মি যুবক আলমের কাছে প্রতিশ্রুতি আদায় করে, আলমকে বেঁচে থাকতে হবে জনতার মাঝে একদম মিলেমিশে। ‘কেননা যুদ্ধটা এখানেই শেষ নয়, আমি ইকবাল চলে যাবো, আমার বদলে আর এক ইকবাল আসবে যাকে তুই পথ বাৎলে দিবি তাকে কি করতে হবে’। আলম রাজী হয়। আর্মি যুবক আলমকে আঘাত করে। আলম আঘাত করে আর্মি যুবককে। কিন্তু এই সমঝোতাপূর্ণ লড়াইয়ে ওরা কেউ মরে না। এ লড়াই শুধুমাত্র ক্লান্ত করে। আর্মি যুবকের মৃত্যু নিশ্চিত করে না।

প্রভাত অনুভূত হলো। অন্ধকার পিছনে চলে যায়। মানুষের আওয়াজ ওদের কানে পৌঁছে। কেউ জয়ের আনন্দে আন্দোলিত, কেউ বা আতংকিত। হঠাৎ করেই ওয়ারলেস সেটটি সচল হয়ে ওঠে। খবর আসে তিন মাথার যেকোনো এক মাথা দিয়ে একটি লোক প্রবেশ করেছে। লোকটির আচরণে কোনো অসামঞ্জস্যতা নেই। তথাপি লোকটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। এরপর আর্মি যুবকটি নিজ সম্পর্কে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পরিচয়ের প্রথম মুহূর্ত কাটিয়ে ওঠার পরেই আর্মি যুবক মানুষটি সম্পর্কে মনোযোগী হয়ে পড়ে। আলমের সহযোগিতায় আর্মি যুবকটির ধারণা লোকটি অসাধারণ। হঠাৎ করে আর্মি যুবকের ব্ল্যাক লিস্টের কথা মনে পড়ে। ব্ল্যাক লিস্টে তার নাম নেই। সৈনিকটি অবহিত হয় লোকটি একজন স্বাপ্নিক মানুষ। তার স্বপ্নই বাস্তবতা।

যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে এই লোকটি নেতৃত্বের একজন। গোলা বারুদশূন্য যুবকটি লোকটিকে হত্যা করার জন্যে নিজের মৃত্যুকে নিশ্চিত করে। হাফিজা তার দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতায় লোকটির গুরুত্ব বুঝতে পারে। সে লোকটিকে জানিয়ে দেয়, লোকটি যেন তার স্বপ্নের কথা এদেরকে না বলে। আলমের কাছে আর্মি যুবক দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি নেয়, ‘যে মুহূর্তে আমি মেইন সুইচে হাত রাখবো ঠিক তখনই তোর দায়িত্ব হবে ওকে আমার শরীরের উপর ছুঁড়ে ফেলা।’ এ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে আলম তার অস্তিত্ব ও স্বপ্নকে বাস্তবতা দিতে পারে। তা’ না হলে ভবিষ্যতে এ লোকটি হবে আলমের জন্য ভয়াবহ। হাফিজা তার সর্বশক্তি দিয়ে আলমকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়। আলম মানুষটির মৃতদেহকে নিজের পোশাকে সাজিয়ে মানুষটির চাদর পরে জনতার নিঃশ্বাসের শব্দ যে দিক দিয়ে আসছিলো সে দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আহত হাফিজা তা পর্যবেক্ষণ করে এবং দর্শকদের জানায় আকস্মিকভাবে সে বেঁচে গেছে। আর সে দেখেছে আলমকে মিশে যেতে, সে ভাবে আরো অসংখ্য স্বাধীনতা বিরোধী আলম বহাল তবিয়তে মিশে আছে আমাদের অস্তিত্বে।

স্বাপ্নিক মানুষের চরিত্রে মোহাম্মদ আমিন-এর অভিনয় আমাদেরও স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে (সম্প্রতি বউদের পাঠশালা নাটকেও তার অভিনয় দর্শকদের চমৎকৃত করেছে)। আহা স্বপ্ন! স্বপ্নই তো দেখে চলেছে বাংলাদেশের মানুষ, নিরন্তর। আলম চরিত্রে রফিকুল ইসলাম, আর্মি যুবক হিসেবে সাইদুল ইসলাম স্বপন এবং হাফিজারূপী রওশন শিমু চরিত্রানুগ চাহিদা মিটাতে সক্ষম ছিলেন। আর তাদের যথাযথ সহযোগিতা পেয়ে নির্দেশক হিসেবে আশীষ খন্দকারও মুন্সিয়ানার ছাপ রেখে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আশীষ খন্দকার এমন একজন নাট্য নির্মাতা যিনি দেশীয় নিবিড় নাট্য নির্মাণের পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্যের কালজয়ী নাটকগুলোরও ফলিত দিক উন্মোচন করেছেন। আশীষ যেমন নির্মাণ করেছেন উম্মে কুলসুম এর মতো একান্ত দেশীয় নাটক, তেমনি নির্দেশনা দিয়েছেন জাঁ জিরাদু, ব্রায়ান ফ্রেইল, দারিও ফো, মলিয়ের ও গিরিশ কারনাড সহ আরো অনেকের নাটক।

এটুকু পরিসরে শব্দ ও আলোর ব্যবস্থা থাকায় জয়-পরাজয় ও জীবন-মৃত্যুর আলো আঁধারীর খেলাটি মূর্ত হয়েছে ষোল আনা। আগাম সুসংবাদ ছিলো যে, একজন আলম ও তার যাপিত জীবন নামে নাটকটির দ্বিতীয় পর্ব নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। একটি শিরোনামহীন নাটক এর সহৃদয় পৃষ্ঠপোষকতা কামনা করি।  

গোলাম শফিক : নাট্যকার, নাটক বিষয়ক প্রবন্ধ লেখক।