Full premium theme for CMS
ঢাকার মঞ্চনাটক : দর্শক-সমালোচকের মুখোমুখি ১৯৭২-১৯৯০ [তৃতীয় ও শেষ কিস্তি]
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[লেখকের দু’একটি পূর্বকথন : সেই একদিন ছিল! নতুন নাটক নিয়ে ভাবনা-চিন্তা তর্ক-বিতর্কে উত্তাল দিন। স্বাধীনতারই যেন এক নান্দনিক উৎসারণ ছিল সেদিনের নাটক। সবসেরা ছেলে-মেয়েরা যুক্ত হতো নাটকে। রাজনীতি-শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে চুলচেরা আলোচনা, সমালোচনা হ’ত। নাটক কেন করা, উদ্দেশ্য কী তার, দেশ-সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক কী নাটকের? কী কাজে লাগে নাটক? কেবল কি একটা নাগরিক সৌখিন বিলাস মাত্র? ঢাকায় বসে নাটক করে কী হয়, ক’জন দেখে সে নাটক? দেশ বিশ্বের তাবৎ ভাবনা চিন্তা, সংকট-যন্ত্রণা, আতীব্র তার প্রকাশ- বিষয় ও রূপরীতির কত কত সর্ব মথিত সেই নাট্যদিন ছিল। আনন্দে উল্লাসে বিস্ময়ে মুগ্ধতায় প্রথম প্রেমেরই থরথর কম্পন বুঝিবা। নাটক দিয়ে যেন জয় করা যায় বিশ্ব- বাতাসে ফিরছিল এমনই ফিসফাস। আজ কিছুতেই আন্দাজ করা যাবে না সেদিনের সেই উন্মাতাল উল্লম্ফ, দিক্বিদিগ্ ছোটা- হৈ হৈ রৈ রৈ পাগলপারা দশা। একেক সময়ে একেক দেশে একেক বিষয় নিয়ে এমনই সব কাণ্ড বুঝি ঘটে। পরে কিছুতেই তার নাগাল পাওয়া যায় না। যাদু মন্ত্রের মতো, দৈব কোনো ভর করা ঘোর-বেঘোর এক দশা যেন ঘটেছিল। যৌবনের সেই পাগলাঘোড়া তারপর কবে কোথায় কখনযে উধাও হয়ে যায়, তার আর হদিস মেলে না। স্বপ্নতাড়িত চন্দ্রাহত মানুষ নিজের মধ্যে খুঁজে পায় না- কে যেন ছিল একদা, তারে ক্ষেপিয়ে মাতিয়ে দাপিয়ে নিয়ে ফিরেছিল। সোনার ফসল ফলিয়ে দিয়ে কখন যে চলে গেছে সেই নন্দননটী। কথাগুলো যতই ভাবের ঘোর, নাটুকে কাব্যিক লাগুক- অন্যভাবে যেন ঠিক ধরা যায় না সেদিনের সেই আশ্লেষ-স্পৃহা!
আজকের নবীণ নাট্যজন তার কিছু হদিস পাবে সেদিনকার একেকটি নাটক নিয়ে নাট্যদলের ভাবনা চিন্তা আর দর্শকজনের মুদ্রিত ভাষ্য-বিবরণ পড়লে পরে। ১৯৭২ সালে ডাকসু আয়োজিত আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতা থেকে ধারাবাহিকভাবে নাট্যকার-নির্দেশক-দর্শক-সমালোচকদের লিখিত মুদ্রিত বাকবিতণ্ডা একত্র করা হয়েছে। এটি একটি গবেষণাকর্ম হলেও উৎসাহী নাট্যজন এতে পেতে পারেন সেদিনকার নাট্যভাবনবিশ্ব! তাবৎ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সারাৎসার। বাস্তব অভিঘাতের সংহত স্বরূপ। আজকের এই নিরাবেগ, নির্মণন হতশ্রী দশায় তার ফলে মিলতেও পারে অন্যতর আস্পৃহা। গবেষণাকর্মটির অন্বিষ্ট অবশ্য একটু ভারী, গম্ভীর মেজাজের : বাংলা থিয়েটারে শিল্প নন্দন ও রাজনীতির সম্বন্ধসূত্র পর্যবেক্ষণ। সেটা দুই বাংলার প্রধান নাট্য প্রযোজনা ধরে করা।]
[থিয়েটারওয়ালা’য় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রযোজনাসমূহ ঘিরে যে নান্দনিক মনন বিতর্ক বিতণ্ডা হয়েছিল নাট্যকার-নির্দেশক-দর্শক-সমালোচকদের পারস্পরিক বিনিময়ে- সেই অংশটুকু। পাঠকদের জন্য এর তৃতীয় ও শেষ কিস্তি ছাপা হলো এ সংখ্যায়- সম্পাদক]
নূরলদীনের সারাজীবন
রচনা : সৈয়দ শামসুল হক
নির্দেশনা : আলী যাকের
প্রযোজনা : নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮২
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় কর্তৃক প্রকাশিত স্যুভেনিরে নাট্যকার বিস্তারিত করেন নূরলদীনের সারাজীবন বিষয়ে তাঁর রচনা-ভাবনা :
আজ থেকে দু'শো বছর আগে এক অগ্নিপুরুষের অভ্যুত্থান ঘটেছিল রংপুরে, গেরিলা নেতা বলতে এখন আমরা যা বুঝি তিনি ছিলেন তাই-ই, কিন্তু ‘নবাব’ অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষের কাছে।
... এই মানুষেরাই একদিন নূরলদীনের পেছনে সমবেত হয়েছিল, তাঁর ডাকে হাতিয়ার তুলে নিয়েছিল এবং তারা শাসক-শোষক-লুন্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল তাঁরই নেতৃত্বে। সেই গণবাহিনীর পরাজয় ঘটেছিল, তার নেতা নূরলদীন শহীদ হয়েছিলেন, যারা বেঁচেছিল তারা এই কাহিনী সন্তানদের কাছে বলেছে, সন্তান সে কাহিনী তার সন্তানদের বলে গেছে, এইভাবে আমিও আমার ছেলেবেলায় শুনেছি, শুনেছি রংপুরের এক সাধারণ কৃষক- তার নাম আর কারো ঠিক মনে পড়ে না- ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।
... সেই তথ্যের সন্ধানেই লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে যাই, সেখানে সমকালীন বেশ কিছু নথিপত্র, দলিল, পুরনো বই কয়েক বছর ঘাঁটবার পর নূরলদীন এবং তাঁর কাল সম্পর্কে একটা ছবি আমার মনের মধ্যে গড়ে ওঠে।
আমি আমার একটি পূর্ব-ধারণার সমর্থন পেয়ে যাই যে, বাংলার সাধারণ মানুষ - কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ঊনিশশো একাত্তরেই যে গেরিলা হয়েছে তা নয়, এই গেরিলা হয়ে যাবার একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, এটা উপলব্ধি করতে না পারলে আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে কেবল লঘুই করে যেতে থাকব।
আমি কৌতুহলের সঙ্গে লক্ষ্য করি যে, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে যাবার আগে সতেরো’শ বিরাশিতে নূরলদীন যেমন ইংরেজ শাসকের কাছে প্রতিকার চেয়ে দরখাস্ত করেছিলেন, একাত্তরের শেখ মুজিবর রহমানও তেমনি পাকিস্তানী সামরিক শাসকের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন।
আমি বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করি যে, নূরলদীনকে সাধারণ মানুষেরা ‘নবাব’ ঘোষণা করবার পরপরই তিনি ইংরেজ বাহিনীকে প্রথম সরাসরি আক্রমণ করেন এবং পরিণামে শহীদ হন। আমার কাছে মনে হতে থাকে - এ তাঁর আত্মহত্যাই বটে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর যিনি পেরিয়ে এসেছেন, নবাব-জমিদার মহাজনদের পৈশাচিক ভূমিকা যিনি লক্ষ্য করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ সিপাহীর মতো অস্ত্র ধরেছেন, তিনি নিশ্চয়ই ইংরেজ সৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ‘নবাব’-এর দম্ভ দেখাতে নয় - আরো একজন ‘নবাব’ তাঁর নিজেকেই, নির্মূল করবার জন্যে। অথবা তাই কি?
এই বিস্ময়, কৌতুহল এবং প্রশ্ন থেকেই আমার নূরলদীনের সারাজীবন লেখা।
... লক্ষ্য করা সম্ভব হবে- এই কাব্যনাট্য দুটি পট মিলে গড়ে উঠেছে, প্রথম ভাগ- কালের মানচিত্র, বিরতির পর দ্বিতীয় ভাগটি- মনের মানচিত্র। আমার অভিপ্রায় ছিল, কালের পটভূমি রচনা করে মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী ও অন্তঃস্থল তার প্রেক্ষিতে স্থাপন করা।১
নূরলদীনের সারাজীবন নাটকের ৭৫তম মঞ্চায়ন উপলক্ষে ‘নাগরিক’ প্রকাশিত পুস্তিকার নির্দেশক আলী যাকেরের নূরলদীনের বিষয়ে ভাষ্য :
‘নূরলদীনের সারাজীবন’ ইতিহাসনির্ভর একটি বীরগাথা। এই ধরনের বীরগাথা বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে এমনকি আমাদের দেশেও একাধিক লেখা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সিরাজদ্দৌলাহ্, তীতুমীর, সূর্যসেন এই নামগুলোর সাথে আমরা সবাই প্রায় ছেলে ভোলানো ছড়া শোনা কাল থেকেই বাস করে আসছি। এঁদের প্রত্যেকের জীবনের ওপরে অত্যন্ত মঞ্চসফল নাটকও লেখা হয়েছে। ঐ নাটক দেখে আমরা বংশপরম্পরায় রাত থেকে রাত চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঘরে ফিরে গেছি। নূরলদীন কি সেই সব নাটকের সমগোত্রীয়? নূরলদীন কি আমাদের সেইভাবে কাঁদায় হাসায়? নূরলদীন কি ইতিহাস-নির্ভর বীরগাথার নামের সারিতে একটি এবং নবতম সংযোজন কেবল?
বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তের মানুষ, উন্নততর যোগাযোগের কল্যাণে যে সারা বিশ্বেরই মানুষ, এই মানুষ বড় শক্ত প্রাণ। এর হৃদয়তন্ত্রীতে স্পন্দন তোলা বড় কষ্টসাধ্য কাজ। আমি এমন এক সময়ের মানুষ যখন হিরোশিমা আমার কাছে এসেছে ঘুম পাড়ানিয়া ভয় হিসেবে। অসউইজ বা বুখেনওয়ান্ড সভ্যতার (!) অবিসংবাদিত সত্য হিসেবে। মাই-লাই জলখাবারের সাথে উত্তেজক খবরের চাটনী হিসেবে। আর একাত্তরের বাংলাদেশ- হায়! একাত্তরের বাংলাদেশ একটা দুঃস্বপ্ন, একটা স্বর্গ; একটা দীর্ঘশ্বাস! এসবের সাথে এসবের মাঝে একেবারে একদেহে লীন হয়ে যার বাস, তার চোখ বড় সহজে ভিজে আসে না। অথচ নূরলদীন চোখ ভেজায়। অথচ নূরলদীন নিদ্রাহরণ করে। অথচ নূরলদীন এই নিশ্চিদ্র হতাশাগ্রস্ত ভুবনে আমার প্রত্যয় হিসেবে এসে দাঁড়ায়। কেন? কারণ নূরলদীনের সারাজীবন কোনো সনাতন সংজ্ঞাবদ্ধ বীরগাথা নয়; এই বীরগাথার নায়ক তাবৎ বীরগাথার নায়কদের মত প্রায় অতিমানবিক কোনো বীরশ্রেষ্ঠ নয়। নূরলদীনকে বড় কাছের মানুষ বলে মনে হয়। বড় বেশি চেতনাগ্রাহ্য বলে মনে হয় আর আর সব চরিত্রগুলোকে। বড় পরিচিত বলে মনে হয় ঘটনা পরম্পর। নাটকেরই সংলাপে আছে, ‘পাগল পাগল তারে বলিবে দুনিয়া’ যে সংলাপ হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত করে। আবার ‘এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়, হাজার নূরলদীন তবে আসিবে বাংলায়’- আশায় উদ্বেলিত করে আমাদের। এই রকম সব প্রাণের কথা। আবার নূরলদীনের প্রতিপক্ষকে যখন হাজির করানো হ’ল তার কথায় চমকে উঠে আবিষ্কার করলাম এতো আমার জানা চিরাচরিত ভিলেন নয়? এর জন্ম কেবল জন্ম থেকেই দুষ্কৃতি সাধনের জন্য নয়। এর, এই ঘৃণ্য বর্বর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লালিত ইংরাজেরও তো আত্মপক্ষ সমর্থনের বলিষ্ঠ যুক্তি রয়েছে। তাহলে সংঘাতটা কোথায়? সংঘাতটা শ্রেণীর। নাটকেরই সংলাপে রয়েছে ‘যে করিছে শোষণ হামাক শোষণকারী তাই ... আরেক জাতি হামরা হনু গরীব বলিয়াই।’ বাংলা ভাষায় রচিত কোনো বীরগাথা এতখানি বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে রচিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
... জীবন যদিও একটি সুগ্রথিত নাটক যাকে মঞ্চায়িত করা যায় ওয়েল মেড প্লে হিসেবে, এর নির্দেশনা ছিলো আমার জন্যে একটি পরীক্ষা। কারণ, এর গ্রন্থনায় যে ব্যাপ্তি (ল্যাটিচ্যুড) তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সত্যিই দুষ্কর। এই নাটকের শুরু ক্লাইম্যাক্স দিয়ে। তারপর প্রায় প্রতিদৃশ্যেই লোভ হয় ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছুতে অথচ নাট্যকার তা হতে দেন না। ঘটনার মধ্যে সম্পৃক্ত কোনো এলিয়েনেশন উত্তেজনাকে প্রশমিত করে। ঘটনার যখন হচ্ছে বিস্তার, চরিত্র তখন তাঁর আত্মগত সংঘাতে পৌঁছে গেছে ঝালায়। একপক্ষ যখন ভাবাবেগ মথিত, তার প্রতিপক্ষ তখন ধীর, স্থির। যখন নূরলদীনের গণবাহিনী সম্মুখ সমরের জন্য প্রস্তুত, কেবল ইংগিতের অপেক্ষায়, তখন নূরলদীনের সখা আব্বাস একান্তে দাঁড়িয়ে যুক্তি খুঁজে চলেছে, নিন্দা করছে এই হঠকারী সিদ্ধান্তের -এইভাবে এগিয়ে গেছে নাটক।২
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
একের পর এক সামরিক জান্তা-দলিত বাংলাদেশের, তাবৎ অর্জন-সুকৃতি বীর্যবত্তা, ইতিহাস বিস্মৃত ঘোর এক অকাল তখন।৩ এমতকালে নূরলদীন, নাম-না-জানা নূরলদীন, নব বীরবেশে মঞ্চে প্রবেশ করেন- উদ্বোধিয়া তোলেন জনমানস। ‘থিয়েটার’ পত্রিকায় সে কথা বলা হয় :
নাটকের অবতারণাকালে সূত্রধার যখন বলেন, ‘আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে/ নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/ যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়’ তখনই দর্শক যেন জেনে যান এ’কাহিনী দুইশত বৎসর আগের এক ব্যর্থ কৃষক বিদ্রোহের গাথা মাত্র নয়। যতদিন আমাদের স্বপ্ন লুট হয়ে যেতে থাকবে, কন্ঠ বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে এবং/ অথবা দেশ ছেয়ে যাবে দালালের আলখাল্লায় ততদিন নূরলদীন বারবার ফিরে আসবে বাংলায়। কিন্তু কেবল সূত্রধারের বিরতিসুলভ বয়ানে নয়, কাহিনীর অন্তর্গত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও বারংবার দর্শকের সামনে ভেসে ওঠে বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের লাঞ্ছিত নিপীড়িত দুঃখভরা বাংলার ছবি। নূরলদীন যেন কুঠিবাড়ী আক্রমণ করেনি, আঘাত করেছে ভিন্নকালে ভিন্ন পটভূমিকায় শোষণের দৃশ্যমান দৃশ্যাতীত যত রকম কুঠিবাড়ী আছে তার সব ক’টিকেই।
এবং রংপুরের এই লোক-আন্দোলনের নায়ক যখন তার স্বপ্নে ভাবাবেশ মেলে ধরেন আমাদের সামনে তখন সবার অন্তরে লালিত সুখী স্বদেশের ছবি যেন আবার মৃদুমন্দ হাওয়ার ছোঁয়া পেয়ে থিরথির করে কাঁপতে শুরু করে। ‘দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ’ বলে যে দীর্ঘ সংলাপে নূরলদীন তাঁর স্বপ্নের স্বদেশের ছবি আঁকতে থাকেন, সে স্বপ্ন তো আজো আমরা বহন করে চলেছি। ... পরিচালক অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবেই নাটকটিকে কোনো বিশেষকালে সীমিত রাখার চেষ্টা করেননি; অথচ অতীত বিস্মৃত হয়ে তিনি আধুনিক পটভূমিকায়ও নূরলদীনকে উপস্থাপন করেননি।৪
তানভীর মোকাম্মেল নূরুলদীনের সারাজীবন নাটকে এক দ্বন্দ্বময় প্রতিবেশ লক্ষ্য করেন। বীরগাথা- রহিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের ‘আইডেনটিটি ক্রাইসিস’ ঘুঁচাবার একটা উপায় হতে পারবে নূরলদীন- সমালোচক এতটাই মর্যাদাশীল বিবেচনা করেন নাটকটিকে :
সময়টা ১৭৮৩ সাল। এ বাংলার সেই দুঃসময় যখন সৃষ্টি পরমেশ্বরের, জমি বাদশাহর আর হুকুম কোম্পানীর। সেই দুঃসময় যখন পলাশীর যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, মসনদে আছেন ইংরেজের হাত ধরে বসা কোনো নবাব। এ সেই দুঃসময় যখন কোম্পানীর লাগামহীন শোষণের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মধ্য দিয়ে সবে মাত্র হেঁটে গেল দুঃখিনী বাংলা। কৃষকের অভিজ্ঞতায় এ সেই দুঃসময় যখন সিনার উপর নীল বুনে দেয় গোরা, গলায় রশি দিয়ে খাজনা তোলে দেবী সিং। এরই ফলশ্রুতিতে রংপুরে নূরলদীনের বিদ্রোহ যা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে দিনাজপুর ও কুচবিহারে। উত্তরবঙ্গের ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ যা মেদিনীপুরের চোয়াড় বিদ্রোহের খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল নূরলদীনের বিদ্রোহ। ...
যেকোনো নাটকেরই মূল ভিত্তিই দ্বন্দ্ব। সেদিক থেকে নাটক হিসেবে নূরলদীন অত্যন্ত ধনী। আছে সাদা ও কালোর দ্বন্দ্ব, আছে স্থিরমতি আব্বাস আর জনতার ভাবোচ্ছ্বাসের দ্বন্দ্ব, আছে আদর্শে মাতোয়ারা নূরলদীনের সঙ্গে বস্তুমুখী আম্বিয়ার দ্বন্দ্ব, আছে লিসবেথের দুই প্রণয়ী মরিস ও ম্যাকডোনাল্ডের দ্বন্দ্ব, আছে ‘নবাব’ ডাকে চমকে ওঠা, কৃষক-সন্তান নূরলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তবে সব দ্বন্দ্বকে ছাপিয়ে ওঠে যে দ্বন্দ্ব, তা হচ্ছে- শ্রেণীদ্বন্দ্ব। জাতিগত দ্বন্দ্ব নয় শ্রেণীগত দ্বন্দ্বই যে আসল কথা তা কত সহজ ভাষাতেই না তুলে ধরে নূরলদীন। ‘কালায় কালা, ধলায় ধলা, উপরতলায় এক, উপরতলায় এক যে জাতি খেয়াল করি দ্যাখ, খেয়াল করি দ্যাখ রে হামার লেঙ্গুটিয়া ভাই আর এক জাতি হামরা হনু গরীব বলিয়াই’। ...
একই সাথে ইংরেজ চরিত্রদের শ্রেণীগত দ্বন্দ্বটাও লেখক তুলে ধরেছেন। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধিকাংশ কর্মচারীর জন্ম দরিদ্র ঘরে। ঈশ্বরবর্জিত এ বঙ্গ দেশে গোক্ষুর আর বিদ্রোহী নেটিভদের মাঝে তারাই আসে, কোম্পানীর মালিক ব্যারন, ডিউক বা লর্ডেরা আসে না। আর এসব দরিদ্র কর্মচারী, যাদের দেহে নাই নীলরক্ত, তারাও স্বপ্ন দেখে ইয়র্কশায়ার কিম্বা সাসেক্স তাদের বাড়ীর আকাশে চিমনির ধোঁয়া, স্বপ্ন দেখে শৃগাল শিকার, লন্ডনের কাব, প্রাসাদের কন্যার নাচে নিমন্ত্রণের অর্থাৎ অভিজাত হওয়ার। তবে যে দ্বন্দ্বটি ফুটিয়ে তুলতে নাট্যকার তীক্ষ্ণ মনোবিশ্লেষণ আর ইতিহাস সচেতনার পরিচয় দিয়েছেন, তা হচ্ছে ভাবোচ্ছ্বাসী জনতার কাছ থেকে ‘নবাব’ উপাধি পাওয়া কৃষক সন্তান নূরলদীনের মনোযাতনা। তার উপর নূরলদীনের রয়েছে ‘পার্সোনালিটি কাল্ট’ এর সেই পুরনো সমস্যাটিও। তেত্রিশ কোটি দেবতার এ দেশের ‘মিথ’ তৈরি করার একটা স্বাভাবিক তাড়না আছে মানুষের। এদেশের মানুষ গণনায়কদের দেবতা বানায়। ...
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’- স্বপ্ন দেখেছিল মধ্যযুগের এক কবি। বাঙালি মানসের এ এক চিরন্তন স্বপ্ন। নূরলদীনও স্বপ্ন দেখে-
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ
নবান্নের পিঠার সুঘ্রাণে দ্যাশ ভরি
উঠিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ
সোনার বাংলার সোনা বাংলাদেশে
আছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ
হামার পুত্রের হাতে ভবিষ্যৎ
আছে।
এ যুগে জন্মালে আব্বাস নির্ঘাত হোত পলিটিক্যাল কমিশনার। বাস্তববাদী সে। ভাবোচ্ছ্বাসে মাতে না মোটেই। আছে তার তীক্ষ্ণ সমাজ সচেতনতা।
‘গোরার কি শক্তি আছে যদি তার সঙ্গে নাই থাকে এই দেশীয় শুয়র’। আছে সংগঠন প্রতিভা ও বিপ্লবী আশাবাদ।
ধৈর্য সবে-ধৈর্য ধরি করো আন্দোলন লাগে না লাগুক বাহে, এক দুই তিন কিম্বা কয়েক জীবন। আমাদের যাত্রা- পালার ‘বিবেক’ এর ভূমিকা ছাড়াও নূরলের আবেগ তাড়নার পাশাপাশি আব্বাসের সংযত স্থিতধী ভূমিকাটি, নূরলের ‘অলটার-ইগো’ হিসেবে এনেছে এলিয়েনেশন এফেক্ট, তার বাক্যের বিদ্রুপ ছ’টা যুগিয়েছে হিউমার। ... চরিত্র হিসেবে আম্বিয়া স্মরণে আনে এযুগের মধ্যবিত্ত রাজনীতিবিদদের সেই সব স্ত্রীদের কথা, যাদের বস্তুসর্বস্বতার সঙ্গে স্বামীর বিত্তহীন আদর্শবাদিতার দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত ঘটাচ্ছে স্বামী প্রবরটির আদর্শ বিচ্যুতি যা আমাদের চারপাশে আমরা দেখি প্রায়শই। ...
নাট্যকার বেশ সচেতনভাবেই ভাষার আঞ্চলিকতা, যা লোকজ ঐতিহ্যে জারিত তার ওপর জোর দিতে চেয়েছেন। রংপুরের ভাষায় আঞ্চলিকতা এ নাটকটির এক বড় সম্পদ। ...
নূরলদীন হচ্ছে একটি বীরগাথা যে রকম শৌর্যময় বীরগাথা পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই রয়েছে। আমাদের নেই, অর্থাৎ মুসলমান মধ্যবিত্তের নেই যারা মহিলা সমিতির দর্শকের প্রায় ষোলো আনা। একটা ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এ ভোগে এ মধ্যবিত্ত। কৃষক ভোগে না। তার আছে হাজারো বছরের শোষণ, নিপীড়ন ও বিদ্রোহের ইতিহাস। নূরলদীন সে ইতিহাসেরই একটি পাতা। ‘নাগরিক’- এর এ নাটকটির এক বিশেষ সাফল্য হচ্ছে যে তা আমাদের বাকী পাতাগুলোও খুলে দেখতে আগ্রহী করে, অনুপ্রাণিত করে।৫
'The Bangladesh Observer' -এর সমালোচক নাটকটির প্রতিপদে সমকালীনতা প্রত্যক্ষ করেন। দু’শত বছরের একটা পর্যায়ক্রমিক সত্তাহারা তিতিক্ষা :
Syed Shamsul Huq, in selecting the life and struggle of Nuraldeen, a forgotten hero of this land, has evidently chosen a befitting subject for the creation of a contemporary classic. The elements were already there. A pervading appeal in the clarion call for uprising against the British colonialists and their cohorts. A landscape of post-famine north Bengal. A personal tragedy of a magnitude that has the intrinsic qualities reminiscent of any time-honoured tragedy. All these were there. But given the incompetence of a presumptuous playwright, the finished work could well have been reduced to a benign gibberish. That was not to be with Nuraldeen. For SSH has a penetrating pair of eyes that observe life without the trapings of despondency & a facile pen that exudes brilliance with each advancing line. ...
Nuraldeener Sharajibon (the life of Nuraldeen) is, as the name suggests, based on the life of Nuraldeen, a peasant rebel of Rangpur in 1782. He fought against the oppression of the local land-lords and by virtue of his integrity and forthright won for himself the undisputed leadership of the toiling peasants of Rangpur & the surrounding areas. Though he clearly identified the British the mentors of the local land-lords, as his prime enemies, he skillfully avoided a direct confrontation with the British for he realized that unless the quislings were uprooted a fight with the British could be devastating. His plan was immaculate and he was steadily inching towards a finality when for reasons unknown he decided to attack the British garison at Mughalhat. This battle proved fatal nuraldeen was killed alongwith a number of his compatriots.
The play of Syed Huq begins immediately after the death of Nuraldeen and through a dramatic flashback taken us to his prime. Syed Huq dedicates the first half of his play in establishing the time, the people and the events. Where each party on its own and through atleast one confrontation successfully takes us back by a couple of hundred years. And in the second half he digs deep into the inner-self of each of his major characters friends and foes alike. It is then that with an unflinching attention we discover the seeds of the characters' being.
Then there is the inner conflict of the protagonist. Is he or more accurately he is a victim of time or actions. He started off as a mere coordinator of an uprisal. But ended up being a Nawab. An imposed title that stink. A crown that hurts. A wanton bearing that smacks of expediency, cruelty and disgraced humanity. His tragedy is further aggravated when his friend Abbas hints at how ambition can destroy fortitude and destry the sense of purpose.
Through the events of Nuraldeen's life, past and present, the playwright tries to unearth the reasons behind his decision to directly involve the British in a prematured war. Is it the conflict in him of being called a Nawab & his not wanting to be one that goaded him to what transpired to be a suicidal adventure? These baffling intrigues as are wont by the playwright, bring the audience to the fore of their total commitment.
Conflicts aside the mere gusto of the events or message entwined in every line give it a contemporary relevance that is clear from the very word go. However enigmatic the personality the protagonist is not ambiguous in giving us a sense of direction that makes the history of Bengal replete with self-less sacrifices over the past two hundred years. ...
Be it as it may Nagorik's Nuraldeener Sharajibon is a comprehensive work of art. A clasic well made.6
কাব্যকে অক্ষুণ্ন রেখে বিদ্রোহগাথা রচনা সম্ভব- অনেকদিন পরে আবার যেন জানান দিল- দেবাশিস দাশগুপ্তের এমত মত:
শামসুল হক ইতিহাস থেকে আহরণ করে যে বিপ্লবের নাটক রচনা করেছেন সেই ধারার সঙ্গেও আমরা অপরিচিত। কাব্যকে অক্ষুণ্ন রেখেও যে বিদ্রোহের জন্য রক্তে টান ধরান যায়, সেটাও আমাদের বেশ কিছুদিন অজানা ছিল। প্রস্তাবনায় যখন ডাক দেওয়া হয় ‘আসুন আসুন তবে আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে/যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎøার সাথে ঝরে পড়ে/তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?/ কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্র“পাত করে?” সেই আহবান থেকেই আমরা একাত্ম। ... এই নাটকের পূর্ব বিভাগটি বিচিত্র। বিদ্রোহের নাটক শুধু যে দামামা বাজিয়েই হয় না- এই নাটক সেই শিক্ষা দেয়। প্রথম পর্বকালের মানচিত্র, দ্বিতীয় পর্ব মনের মানচিত্র।
সাধারণত এইসব নাটকে ঘটনার ঘনঘটায় মনের ঠিকানা হারিয়ে যায়। ... শেষ দিকে একটি তানপুরায় সুর মিলিয়ে যখন নূরলদীন নতজানু হয়ে দীর্ঘ স্বস্তিবাচন করেন, তখন আমরা রোমাঞ্চিত।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
সবার অন্তরে মোর অগ্নি জ্বলিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
হামার পুত্রের হাতে ভবিষ্যৎ আছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
হামার কন্যার চোখে সুস্বপন আছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
হামার ভাইয়ের মুখে ভাই ডাক আছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
হামার ভগ্নীর ঘর নিরাপদ আছে। সুখে দুঃখে অন্নপানে সকলেই একসাথে আছে।
সোনার বাংলার সোনা বাংলাদেশে আছে।
ওপারের এই প্রার্থনা এ পারেরও।৭
নবান্ন পরবর্তী এক সার্থক গণনাটক এটি। বাংলা ভাষার শক্তিমত্তার নমুনা :
ভেবেছি, বারে বারে ভেবেছি, একটি গণ-নাটকের আবেদন কেমন করে সার্থক নাট্যরস সৃষ্টির মাধ্যমে সহজ উপস্থাপনা ও জীবনধর্মী অভিনয়ের গুণে দর্শকদের হৃদয়বৃত্তির দুয়ারে পৌঁছে যেতে পারে। বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকের পর অনেক চড়াই উৎরাই ভেঙে এ বাংলার কতিপয় নাট্যগোষ্ঠী বর্তমানে যখন নিছক বুদ্ধিবৃত্তির প্যাঁচ কষাকষিতে পরিণত হয়েছে, ঠিক তখন নূরলদীনের সারাজীবন আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে সেই হারানো স্বাদ। সামন্ততন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেদিনের রংপুরের মাটিতে নূরলদীনের নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কৃষকের এক গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিকায় এই কাব্য নাট্যটির বিষয়বস্তু। ...
শেষ দৃশ্যে নূরুলের শান্ত বিনম্র ভঙ্গীতে বাংলা আর বাঙালির জন্যে সহজ প্রার্থনা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে দর্শকদের বুকে। এইভাবে যুগ ছাড়িয়ে যুগোত্তীর্ণ নূরলের কন্ঠস্বর নাটকটিকে স্বার্থক করে তুলেছে।
নাটকটি সম্পর্কে শেষ কথা, বাংলা ভাষা যে কত শক্তিশালী ওপার বাংলার নূরলদীনের সারাজীবন সেই সত্যটিকে এপার বাংলার মানুষের কাছে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে বারবার তুলে ধরলো। ডাইনী পূজোর ঢাক বাজান এপার বাংলার বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ এই নাটকটি দেখলে ‘মোহভঙ্গের কালরাত্রি’ পেরিয়ে আসতে পারতেন।৮
আশিসতরু মুখোপাধ্যায়ের কাছে নূরলদীন উদ্বোধনের দীক্ষাদাতা, অপহৃত মূল্যবোধ যেন ফিরে পাওয়া গেল:
বিশেষ করে এমন কাব্যনাটকেও যে জীবনকে সহজ করে ধরা যায় তার বিরল নজির রাখলেন নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক এবং নির্দেশক আলী যাকের। রিয়ালিটির সঙ্গে সঙ্গে এই কাব্যনাট্য হয়েছে লিরিক্যাল। কত কম আয়োজন। কিন্তু নাটক কত বড় মাপের। কী বক্তব্যে, কী গভীরতায়। জীবনের মূল্যবোধগুলো ফিরে পেতে আমরা নাটকে ফিরে গেছি সেই অতীত ঐতিহ্যে। নতুন করে যেন দীক্ষা নিতে চাইছি ওই অগ্নিপুরুষ নূরলদীনের কাছে- যেন নূরলদীনের মৃত্যু নেই। যদিও তিনি ইংরেজদের রিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই গৌরবের কাহিনী আজও বেঁচে আছে, থাকবে, যত দিন মানুষ বেঁচে থাকবে।৯
চিত্তরঞ্জন ঘোষ কাব্যনাটক হিসেবে নূরলদীনের সারাজীবন- এর শক্তিমত্তার কথা বলেন :
বাংলা কাব্যনাট্যে সাধারণত কাব্যের ভাগ বেশি পড়ে, নাট্যের ভাগ কম। হক সাহেবের চেষ্টা সমতা আনবার। বাংলা কাব্যনাট্যে ‘সারফেস’ রিয়ালিটি লুপ্ত করে দিয়ে একেবারে ভেতরের শাঁসটুকুকে আনার প্রয়াস থাকে। তাতে ‘বিশেষ’ বা ‘ব্যক্তিক’ চরিত্র লুপ্ত হয়ে সাধারণ একটা সত্য নিরবয়ব বা নিরক্তভাবে দেখা দেয়। অথবা কথার প্রেমে অন্ধ কবি কথা একটু বেশি বলেন, এসব হক সাহেবের একটুও নেই তা নয়। তবু অনেক কম। জন-ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক ভাষার শক্তিকে তিনি কাজে লাগাচ্ছেন, এই পরীক্ষাও বিশেষ প্রশংসনীয়।১০
নবাব-পীড়িত চাষীকুলের নিকট প্রতিরোধকারী নূরলদীনও হয়ে ওঠে নবাব- এই নিয়ে তাঁর যে মানসিক সংকট ঘটে সেটা নতুন মাত্রা দেয় নাটকে- ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’- সমালোচকের এই হল ভাষ্য :
Nuraldin fought against the native agents of the East India Company for its exploitation and genocide. He was elected not only the leader, but was given the title on Nawab by his followers. The play also touched upon Nuraldin's emotional and political crisis after being called 'Nawab' as he himself was the worst victim of the oppression and exploitation by the Nawabs, landlords and money lenders. This crisis developed into a tense dramatic sequence which added a new dimension to the play.
অতীতের বীরপ্রবর রচনা করেন ভবিষ্যতকেও- সমাজরাজনৈতিক এই নাটক নবধারার সূচনা করলো রামেশচন্দ্রের এমত মত :
The playwright Syed Shamsul Huq, who has already made a mark as a poet and novelist enfolds not only Nuraldin's life but what is more important highlights the role of the people in the fight against the exploiters and their allies. By reminding the nation of its past heroes the playwright shows the way to build the future. But on the whole this was indeed a most welcome production for it shows a new direction in sociopolitical theatre in Bangladesh of which we were not aware. ইতিহাসের জাতীয় এক বীরের উজ্জ্বল উদ্ধার হিসেবে নূরলদীনের সারাজীবন নানা অবস্থান থেকে বহুনন্দিত।
সূত্র তথ্য: ১. নাগরিক, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, স্যূভেনির ১৯৮২, ২. নাগরিক, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, স্যূভেনির (৭৫ তম মঞ্চায়ন উপলক্ষে মুদ্রিত), ৩. দ্র. ১৯৭৬ - ১৯৯০ সময়কালে মূলত সামরিক শাসনই চলে বাংরাদেশে - গণতন্ত্রের নানা ছদ্মবেশে হলেও, ৪. ‘থিয়েটার’, রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত, ৫.‘দৈনিক সংবাদ’, ১৭ এপ্রিল ১৯৮৩, নগর সং, ৬. ‘The Bangladesh Observer’, 23 June 1983, ৭. ‘দৈনিক আজকাল’, ২০ এপ্রিল ১৯৮৪, নগর সং, ৮. ‘দৈনিক সত্যযুগ’, ১৯ এপ্রিল ১৯৮৪, নগর সং, ৯. ‘দৈনিক যুগান্তর’, ১৯ এপ্রিল ১৯৮৪, নগর সং, ১০. ‘দেশ’ ১ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪, ১১. ‘Amrita Bazar Patrika’, 30 April 1989, 12. ‘Times of India’, 16 April 1984.
ইবলিশ
রচনা : মামুনুর রশীদ
নির্দেশনা : মামুনুর রশীদ
প্রযোজনা : আরণ্যক নাট্যদল
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮২
‘আরণ্যক’ নাট্যদলের পক্ষ থেকে ইবলিশ-এর স্যুভেনিরে ‘প্রসঙ্গ ইবলিশ’ শিরোনামে জানানো হয় :
বাংলাদেশ মূলত একটি বৃহৎ গ্রাম। আর এর এ যাবৎকালের ইতিহাস মুষ্টিমেয় ভূস্বামী, বণিক, রাজপুরুষ, মোল্লপুরুতের করতলগত। অর্থনৈতিক শ্রেণীবিন্যাসের দ্বারা সবকিছুই কুক্ষিগত করে রেখেছে তারা। বাদবাকী সাধারণ মানুষ গোয়ালে বাঁধা জন্তুর মতো বঞ্চিত জীবনের জাবর কেটে সেই অসাধারণ মুষ্টিমেয় মানুষের পুষ্টির যোগান দিয়ে এসেছে হাজার বছর ধরে। মাঝে মাঝে ক্রোধের দাহ ও দ্রোহ জ্বলে উঠেছে। যুদ্ধে বিপ্লবে সংগ্রামে পতাকার হাত বদল হয়েছে বহুবার। তবু সেই পাইক বরকন্দাজ ভুঁইয়া লস্কর-জায়গীরদার অধ্যুষিত বাংলার অসাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। হাতী ঘোড়ার পায়ের তলা থেকে এগিয়ে এসে পতিত হয়েছে বুট, বুলেট, বেয়নেটের তলায়। বিশাল প্রত্যন্ত এলাকা জুড়ে বসবাসরত এই বিরাট মানবগোষ্ঠীর এটি হলো একটি স্থিরচিত্র।
এই স্থির নিষ্পাপ নিসর্গে লেগেছে আজ ভাঙনের পালা। কৃষিনির্ভর পুরনো জীবনযাত্রার জোয়াল ভেঙে ফেলে গ্রামভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে চাইছে তারা। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জানে শিল্পকে শহরকেন্দ্রিক রাখতে হবে। সুপার টেকনোলোজির শোষণ তাহলেই সম্ভব, গ্রাম শুধুমাত্র হবে শোষণের যোগানদার। একটি দু’টি ঢেউ উঠেছে এই বিশাল জনসমুদ্রে। যে ঢেউয়ের সম্মিলিত জলোচ্ছ্বাসে একদিন ভেসে যাবে উদ্বৃত্তমূল্যে তৈরি কতিপয় মানুষের সুবর্ণ প্রাসাদ। ঢেউ উঠেছে একটি দু’টি তিনটি।১
দর্শক-সামলোচকদের মতামত
ইবলিশ নাটক বিষয়ে বিভাস চক্রবর্তী লেখেন :
মামুনুর রশীদের নাটকের শক্তি নিশ্চিতভাবে তার বিষয়বস্তু- কৃষি-নির্ভর ধর্ম- প্রভাবিত সনাতন জীবনযাত্রা, গ্রাম-ভিত্তিক উঠতি শিল্পেদ্যোগী, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-কেন্দ্র শহরের উদ্বৃত্ত সম্পদাধিকারী মুষ্টিমেয় মানুষ যারা এই ব্যবস্থাকে আরও শোষণমুখী করে তোলার জন্য সদাসচেষ্ট। এই ত্রিধা-দ্বন্দ্বের উপর নির্মিত এই নাটক। এই জটিল দ্বন্দ্ব কখনওই সরলীকৃত নয়। প্রযোজনাটি আমাদের ভাল লাগে তার সরলতা এবং সহজতার জন্য। ... ইবলিশ- এর রচয়িতা পরিচালক এবং মুখ্য অভিনেতা মামুনুর রশীদের ভাষায়- ‘সবক্ষেত্রেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে এদেশের ভাগ্যহত মানুষ আর তাদের নিয়ে যারা ক্রমাগত এক মরণপণ খেলায় মেতে উঠেছে তাদের কথা। তার মধ্যেই আবার ক্রমাগত মুখ্য হয়ে উঠছে সেই নাম-না-জানা চরিত্রগুলো যাদের আছে অন্তহীন শক্তি। এই শক্তির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই এই নাটক এগোবে ক্রমশ সামনের দিকে। জাগরণ থেকে উত্থান। তারপর প্রতিরোধ এবং বিজয়।
ঘটনাগুলো কোনও অলীক কল্পনা নয়। সাধারণ ঐতিহাসিক নিয়মে যা ঘটে থাকে। এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা এগোবো বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে মেজাজী এক নতুন ঢঙে শিল্পকলা সৃষ্টির মোহে। তাই আচ্ছন্ন না হয়ে অত্যন্ত সহজ সাধারণ স্বাভাবিক অভিব্যক্তি নিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া। প্রথম থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত নাটকটির টাটকা বা তাজা চরিত্রই আমাদের মুগ্ধ করে। তাই অন্তিমের সনাতনপন্থী সংগ্রামী নাটকের ধরনের সমাপ্তি ভাল লাগে না। মামুনভাই অন্য কিছু ভেবে দেখবেন কি? ... সাম্প্রতিককালে বাঙলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রযোজনা আমাদের হতাশ করছিল নানা কারণে। প্রতিবাদী বা সংগ্রামী নাটকের নামে কিছু চিৎকৃত খিস্তি-খেউড়-গান-বাজনার নাটক বিপরীত উদ্দেশ্য সাধন করছিল বলে এই প্রতিবেদকের ধারণা। সেখানে ইবলিশ অবশ্যই আশা সঞ্চার করে। বিশেষত, একটি ইসলামী রাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতাকে সরাসরি আক্রমণ করার যে দুঃসাহস আরণ্যক বা মামুনুর রশীদ দেখিয়েছেন। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ক’জনের তা আছে?২
সাধারণ মানুষকে উদ্বেজনের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পকলা বিকাশের এক যোগের ভাবনা মামুনুর রশীদের অর্থাৎ নাট্যক্রিয়া পরিণত হবে সামাজিক ক্রিয়ায়ই- যাতে উদ্বোধিত হবে মানব সাধারণ। বিভাস চক্রবর্তী, ‘প্রতিবাদী বা সংগ্রামী নাটকের নামে কিছু চিৎকৃত খিস্তি-খেউড়-গান-বাজনা’র নাটকের’ বিপরীতে আশা সঞ্চার করে ইবলিশ- এ কথা বলে ‘সংগ্রামী নাটকের ধরনের সমাপ্তিতে’ তাঁর আপত্তি জানিয়েছেন। এহেন সমাপ্তির ইচ্ছাপূরণ তাঁর কাম্য নয় তাহলে?
অমৃতবাজার পত্রিকার ভাষ্য হল :
The varied forms of exploitation by landlords, politicians and religious leader, are thought to be exposed in a manner that turns out to be crude... Scattered episodes with loose ends add precious little to the condensation of the crises. The impact of immediacy gets lost up to a point, since the link is not perceptible ... yet, in its totality, the play sincerely projects a realistic rural way of life. Largely because of easy and spontaneous marments of the artistes.3
শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন :
মামুনুর রশীদ রচিত ও নির্দেশিত এই নাট্যটিতে অনেক জরুরি কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে সময়ের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কথা উঠে এসেছে এই নাটকে। ‘বিশাল প্রত্যন্ত এলাকা জুড়ে বসবাসরত এই বিরাট মানবগোষ্ঠীর’ যে স্থিরচিত্রটি এঁকেছেন নাট্যকার সেটি বড় ডুকমেন্টধর্মী। এমন কি নাটকটি সাজিয়েছেনও তিনি সেই ধরনে। নেহাতই ছোট ছোট দৃশ্যের অবিন্যস্ত বাঁধুনিতে নাট্যের মহিমা কথঞ্চিৎ ম্লান। বড়ই সরল গতিতে চলে নাটক, খুবই সহজে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন হওয়ায় শিল্পের সাম্যটি যেন টাল খায়। তবে গ্রামভিত্তিক শিল্প নিয়ে গড়ে ওঠে এই নাটকে প্রতিবাদের ধরনটিকে আরেক প্রতিবাদের ধরনে পড়ে নেওয়া যায়।৪
ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি নান্দনিক অবস্থান থেকে নাটকটিকে দেখেছেন সমালোচক; ইবলিশ নাট্যের ‘ডুকমেন্টধর্মী’তা, ‘শিল্পের সাম্যের’ টাল খাওয়া এবং তৎসত্ত্বেও ‘গ্রামভিত্তিক শিল্প নিয়ে গড়ে ওঠা প্রতিবাদের ধরনটিকে আরেক প্রতিবাদের ধরনে পড়ে নেওয়ায় তা বিন্যস্ত; শিল্পের সাম্য কথাটি কি শিল্পের ছন্দ বা শিল্পের সত্য বোঝাতে ব্যবহৃত ? সব মিলে জটিল এক নান্দনিক অবস্থানই যেন চিহ্নিত শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ক সূত্র বিবেচনার।
‘দি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় আনন্দলাল নাটকটিতে শেষ পর্যন্ত প্রথাবদ্ধ, সরল এক ইচ্ছাপূরণের ছকই প্রত্যক্ষ করেন :
Given such a credo, one can view the play politically as well as aesthetically does it work on its own term's as political theatre? Unfortunately, present international leftist realpolitik has outstripped conventional leftist theory, so that the whole concept of class struggle needs redefinition. The simplistic confrontation in Iblish where a Munshi, Member and Sikdar predictably, corruptly and represent the exploitative or reactionary power structure can no longer convinceinour complex modern society, although the principles they embody, surely deserve castigation. The battle lines are too clear-cut and the villagers win unbelievably easily. Artistically, the characters lack development and the plot moves stereo-typically. Iblish is not a great piece of dramatic writing.5
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া-পদ্ধতির নতুনতর বিন্যাস অবশ্যম্ভাবী; আজকের জটিল সামাজিক বাস্তবতায় সরল আখ্যান গঠন বিশ্বাসযোগ্য নয়। সহজ জয়ও অবিশ্বম্ভাবী; নাট্যের চরিত্র ও আখ্যান বিকাশ-রহিত প্রথাবদ্ধ-শিল্পরূপায়ণ তার ফলে দুর্বলগঠিত; শিল্প-রাজনীতির সম্পর্কসূত্রে এমত নাট্য বিবেচনা সমালোচকের-নান্দনিক অবস্থানের ধরন এতে স্পষ্ট।
‘যুগান্তর’ পত্রিকায় সোমেন ভুঁইয়াও ইবলিশ নাট্যে সরল বিন্যাসের ইচ্ছাপূরণই প্রত্যক্ষ করেন :
আরণ্যক-এর ইবলিশ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, অন্ধ ধর্মবিশ্বাস, সামন্ততান্ত্রিক শোষণের মাঝে এক শিক্ষিত যুবকের জেহাদের গল্প। রকিব তাঁর পিতা গ্রামের ধর্মগুরু মুন্সীর চোখে ইবলিশ। দোজখের শয়তান। তাঁর অপরাধ সে পিতার বুজরুকি মানে না। শহুরে শিক্ষার আলোয় সে দেখতে চায় গ্রামের সমস্যাকে। মানুষের রোগ শোক ভুলতে ভূমিহীন চাষীদের কাজের সুযোগ খুঁজতে সে সাহায্য চায় আধুনিক চিকিৎসা ও সমবায়ের। তাতে বাড়া ভাতে ছাই পড়ে গ্রাম্য মহাজন শিকদার ও ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার একাব্বরের। তারা হাত মেলায় মুন্সীর সঙ্গে। ওদিকে গ্রামের শোষিতরাও সংঘবদ্ধ হয় তাঁতিপাড়ায় রফিক, মজনুর নেতৃত্বে। তাঁদের পুরোভাগে আসে আতসী, নির্যাতিত নারী সমাজের প্রতিভূ হয়ে। সমস্ত প্রতিকূলতা প্রতিহত করে শেষ পর্যন্ত তাঁরা জেগেও ওঠে। বকুর মত নিষ্পাপ মৃত্যুর পাশাপাশি মুন্সীর সাগরের তালবেলেমের অন্ধকার আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার মাঝে একটা প্রগতির প্রতিধ্বনি শোনা যায়। নাটকের বিষয়বস্তুর নির্বাচন বাংলাদেশের সমকাল ও চিরকালকেই চিহ্নিত করে। মোল্লা মুন্সীরা ধর্মের দোহাই দিয়ে সেখানে দেশ ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখে নিজেদের প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য। সেই মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুর সামনে নাট্যকার মামুনুর রশীদের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু গোলমালটা নাট্যবিন্যাস ও নির্দেশনার ক্ষেত্রে। ... নাট্য ঘটনাগুলো দানা বাঁধে না। সংগ্রামের উত্তাপও তাতিয়ে তোলে না নাট্য চরিত্র ও দর্শকজনকে। শেষ অংশে কিছুটা আন্দোলিত হলেও শেষ সমাধানটা ইচ্ছাপূরক এবং নাট্যে এসেছেও আরোপিত ভঙ্গিতে। তবুও রঙ্গ রসিকতায়, কিছু সংলাপে নাট্যকার সচেতনভাবে আঘাত হেনেছেন ধর্মীয় অন্ধতায়। ইবলিশ-এ এটাও কম পাওয়া নয়।৬
ইচ্ছাপূরক ও আরোপিত ভঙ্গির নাট্যবিন্যাস বা শিল্পরূপায়ণের ফলে ‘নাট্যঘটনাগুলো দানা বাঁধে না, সংগ্রামের উত্তাপও তাতিয়ে তোলে না নাট্যচরিত্র ও দর্শকজনকে’- এই সমালোচনায় নাটকটিতে শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্কের অসম্পূর্ণতাকে চিহ্নিত করে। সমালোচকের নান্দনিক অবস্থানও ব্যক্ত হয়।
দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ইবলিশ নাটকে ‘গ্রামজীবনের দৈনন্দিন হাহাকার, আর্তি, পারস্পরিক ভালবাসা আর টানাপোড়েনের দ্বন্দ্বটির’ সার্থক উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন :
লড়াই চলছেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের। জীবনের সঙ্গে জীবনের। লড়াই চলছেই ...। একদল লড়ছে নুন-তেল-লাকড়ির জন্য। অন্য দল লড়ছে সমস্ত সম্পদকে কুক্ষিগত করে সাধারণ মানুষকে শোষণ করার স্থায়ী পথ খুঁজে বের করার জন্য। এ লড়াই চিরন্তন।
বাংলাদেশের গাঁ-গঞ্জ জুড়েও চলেছে এই একই খেলা। আপামর সাধারণ মানুষ দিনভর খেটে বেড়ায়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রক্ত জল করে ফলায় সোনার ফসল। আর সে ফসল চলে যায় একশ্রেণীর মুষ্টিমেয় ভূস্বামী আর বণিকের দখলে। নিরীহ, অজ্ঞ, অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের দল একমুঠো ভাত জোটাতে শেষ সম্বল মাথা গোঁজার ঠাইটুকুও তুলে দিতে বাধ্য হয় ঐসব জায়গীরদারদের হাতেই। এই সব বেচারা মানুষের দল গোয়ালে বাঁধা জন্তুর মতো বঞ্চিত জীবনের জাবর কেটে সেই অসাধারণ মুষ্টিমেয় মানুষের পুষ্টির যোগান দিতে বাধ্য হয় হাজার হাজার বছর ধরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় চরম এক ধরনের চরম মৌলবাদী কর্তৃত্ব। ...
গাঁযের দু’একজন শিক্ষিত মানুষের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ জাগে এসব অবহেলিত মানুষের মনে। ভূস্বামী, মেম্বার আর মোল্লা পুরুতের দল প্রতিবাদী শিক্ষিত মানুষদের তখন ইবলিশ বানানোর চেষ্টা করে। শুরু হয়ে যায় চক্রান্ত আর শয়তানি। কিন্তু একদিন সম্মিলিত মানুষের মিলিত জেহাদে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় জায়গীরদারের তাসের প্রাসাদ ...। জয় হয় মানুষের ... জয় হয় জীবনের ...। নাট্যকার মামুনুর রশীদ তাঁর ইবলিশ নাটকে এই মূল সত্যটিরই নান্দীপাঠ করেছেন। ইবলিশ নাটকে গ্রাম জীবনের দৈনন্দিন হাহাকার, আর্তি, পারস্পরিক ভালবাসা আর টানাপোড়েনের দ্বন্দ্বটিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন।৭
একঘেঁয়ে বিষয়বস্তু নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত না হওয়ায় নাটকের শেষের বক্তব্য কোনো নতুন দিক নির্দেশ করতে পারেনি- ঋজু দে’র অভিমত এমত :
দলগত অভিনয় ভালো হওয়া সত্ত্বেও নাটকের গতি ছিল তুলনামূলকভাবে শ্লথ। যা দর্শকের প্রত্যাশাকে স্পর্শ করতে কিছুটা ব্যর্থ।
সম্ভবত নাটকের বক্তব্য ও পটভূমিই এর জন্য দায়ী। গ্রামজীবনের বাস্তব চিত্র- যেখানে আজও সাধারণ মানুষ একদিকে ধর্মের ধ্বজাধারী স্বার্থান্বেষী মোল্লা পুরুত ও অন্যদিকে সুবিধাবাদী রাজনীতির বলে বলিয়ান ভূস্বামী ও রাজ রাজাদের শোষণের শিকার। এ বিষয়টির উপর ভিত্তি করে বিগত কয়েক বছরে বহু নাটক অভিনীত হয়েছে। বিষয়বস্তুর একঘেঁয়েমিই সম্ভবত ইবলিশ কে কোনো নতুন বৈচিত্র্যের স্পর্শ দিতে পারেনি। এই বক্তব্যকেই কোনো নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনার প্রয়াস থাকলে বোধহয় ভালো হতো। নাটকের শেষের বক্তব্যও কোনো নতুন দিক নির্দেশ করতে পারেনি।৮
মৌলবাদবিরোধী চেতনা সঞ্চারে এ অভিনয় সার্থক হবার সম্ভাবনা আছে বলে ধ্রুব গুপ্ত মনে করেন। নারী-নির্যাতনও সার্থকভাবে অন্বিত; আজকের দিনের প্রকৃত শয়তানকে নির্ভীকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে :
আমাদের (একেবারেই রাষ্ট্রীয় অর্থে) সঙ্গে ‘আরণ্যক’-এর নাট্যকর্মের সাক্ষাৎ পরিচয় নেই বলেই মনে হয় সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা কোরিওলেনাস এর বদলে এ যাত্রায় ইবলিশ আনাতে আমাদের একটা বিশেষ লাভ হয়েছে। আমরা প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ পেলাম কীভাবে নাট্যকর্মীরা তাদের নিকটতম সময়টার সঙ্গে বোঝাপড়া করছে তাদের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে। আমি আদৌ বলছি না যে শেক্সপীয়র অবলম্বনে নাট্যকর্মকে কোনো না কোনোভাবে সে ধরনের তাৎপর্য দেওয়া যায় না। কিন্তু আমার মনে হয় প্রাথমিকভাবেই জরুরী ছিল প্রত্যক্ষ বাস্তবকে নিয়ে আজকের বাংলাদেশী থিয়েটার কী করছেন সেটা প্রত্যক্ষ করা। সেখানে প্রথমেই যা দেখে অভিভূত হতে হয় তা হল এই বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় মৌলবাদের যুগে বাংলাদেশে বসে ধর্মীয় মৌলবাদকে এমন সরাসরি আক্রমণের সাহস। অবশ্য জানা চাই বাংলাদেশকে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ঘোষণা করার পরও তারা এ নাটকের অভিনয় সেখানে সম্ভব করতে পারছেন কিনা। সেটা না পারলেও, অতিথিরূপে বিদেশে এ নাটকের অভিনয় দেখিয়ে দেশে ফিরে যাবার সাহসও কম কথা নয়। স্বীকার করতেই হবে ঠিক এই সময়ে এ পারের বাংলা নাট্যকর্মে এই প্রত্যক্ষ সমাজসম্পৃক্তি বিরাজ করছে না- আমরা এখন আর নবান্ন-র যুগে স্থিত নই, বা সে যুগের ঐতিহ্যও তেমন করে বর্তায়নি, এখন, একমাত্র বাদল সরকার-এর কিছু নাট্যকর্মে ছাড়া।
মৌলবাদকে আলগোছে সমালোচনা করা সহজ, যেখানে একটু মধ্যযুগীয় সন্তদের বাণী ছিটিয়ে দিলেই চলে। এমনকি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে নাট্যকর্ম হিসাবে শুধু রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যের নির্জীব অভিনয় করেই দায়িত্ব পালন করেছি মনে করা যায়। আমি বলছি না চন্ডালিকা করা বন্ধ হোক, কিন্তু প্রতিবছর যদি শুধু চন্ডালিকাই করা হয় তা হলে উদ্দেশ্যের জোরটা কমে যায়। এরা মৌলবাদকে নাটকটিতে ধরেছেন নানা দিক থেকে। সেখানে জাতিভেদ, সমাজে নারীর স্থান, অর্থকৌলিন্য, কৃষি সমাজের স্থিতিস্থাপকতা রক্ষা করে ইতিহাসের গতিপথ অবরোধ, গ্রাম-শহর সম্পর্ক-একাধিক বিষয়কে গাঁথা হয়েছে, সঙ্গে প্রযুক্ত প্রজন্মভেদ প্রসঙ্গও। নাট্যকার/ পরিচালক মামুনুর রশীদ-এর প্রস্তুত নক্শাটিতে কিছুটা বিধৃত হয়েছে যার ফলে সাধারণ দর্শকের মধ্যে মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামের চেতনা সঞ্চারে এ অভিনয় সার্থক হবার সম্ভাবনা আছে। নির্যাতিত কৃষকের সীমিত আয়ত্তের মধ্যেই তাঁতকর্মে অংশগ্রহণ করে স্বাধীন শ্রমজীবী হবার প্রচেষ্টা এখানে মৌলবাদ সমর্থিত ‘জোলা'দের সমাজে অপাংক্তেয়ের বিবেচনার সঙ্গে অম্বিত করা এ নাটকের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ, বহু বিবাহ, বাল্য বিবাহ ও ঝাড়ফুঁকভিত্তিক নারী নির্যাতনকেও ঠিক তেমনি সার্থকভাবে অন্বিত করা হয়েছে- সেই তুলনায় গ্রাম-নগর সম্পর্কটি কোনো নাট্যমূল্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং সে ক্ষেত্রে কালো চশমা পরা জিন্সপরা মস্তানের উপস্থিতি নিদারুণ বিরক্তিকর- অকস্মাৎ সেখানে সস্তা প্রহসনকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে।৯
রাকীব হাসান ইবলিশ নাটকের শততম মঞ্চায়ন উপলক্ষে লিখিত প্রতিবেদনে নাটকটির অতিনাটকীয় দুর্বলতা নির্দেশ করেও ‘গ্রাম বাংলার শাশ্বত যে, রূপ তুলে ধরতে পেরেছেন’ নাট্যকার-নির্দেশক তার প্রশংসা করেন :
নাটকের শুরুতে যখন পর্দা দু’পাশে গুটিয়ে যায় তখনই মঞ্চে ভেসে ওঠে একটি সুন্দর দৃশ্য: গ্রামীণ পথ, পথের পাশে বাঁশ ঝাড়। গাঢ় অন্ধকারে চাঁদের আলো পড়েছে। তৈরি হয়েছে কিছু অদ্ভুত ছায়া, যা ভূত-প্রেতের ভ্রম সৃষ্টি করে। ইবলিশ নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনায় যথেষ্ট মুন্সীয়ানার পরিচয় আছে।
নাটক শুরু হলো একটি চমক সৃষ্টির আঙ্গিকে। কিন্তু শেষটায় তা আর রইলো না। আমরা যে প্রেক্ষাপট ইবলিশ নাটকে খুঁজে পাই তা যথার্থই আমাদের গ্রামের সহজ সরল দৃশ্যের বর্ণনা। গ্রামীণ মানুষের করুণ আহাজারী আমাদের মর্মস্পর্শ করে। কিন্তু তাদের বিদ্রোহ নাটকে কিছুটা আরোপিত মনে হয়েছে। হুজুরের তালবেলেম শেষ দৃশ্যে এসে যে বিদ্রোহের আহ্বান জানায় সেটা ওভাবে না করে অন্য কোনোভাবে হলে ভালো হতো। যে তালবেলেম হুজুরের আদেশ ভিন্ন পানি পান করা থেকেও বিরত থাকে তার কন্ঠ আচমকা সেই হুজুরের সম্মুখেই মেঘের স্বননে গর্জে উঠতে পারে কি? আর পারলেও ঐ চরিত্রের মধ্যে সুপ্ত সেই বিদ্রোহের চেতনাকে পরোক্ষভাবে বা প্রকারান্তরে আগেই দর্শকদের বুঝিয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিলো। সেটা করা হয়নি বলেই ব্যাপারটা অতি নাটকীয় হয়ে উঠেছে। ইবলিশ নাটকে গ্রামবাংলার শাশ্বত যে রূপ তুলে ধরতে পেরেছেন নাট্যকার তা হুবহু আমাদের গ্রামবাংলারই চিত্র। বিলে মাছ ধরা নিয়ে সংঘাত, জমির চাষাবাদ নিয়ে কৃষকের দুর্ভাবনা এবং চাষের জমির ধানের বড় অংশ চলে যায় ভূস্বামীর গোলায়। কৃষকরা অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটায়। এ সবকিছুই আমাদের বাংলাদেশের চিরন্তনরূপ।
হুজুরের পরামর্শ নিয়ে গ্রামের মেম্বার ও মাতব্বর গ্রাম শাসন করে। সাধারণ মানুষ ওষুধের বদলে হুজুরের ‘পড়া পানি’ খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা না করলে হুজুর তাকে ইবলিশ বলে আখ্যায়িত করে।
এ নাটকে আমরা দেখতে পাই মেম্বার ও মাতব্বারের যৌথ প্রচেষ্টায় কিভাবে ভিটেমাটি হারা হয় সাধারণ মানুষ। অথচ প্রকাশ্যে এই মেম্বার ও মাতব্বার একজন অন্যজনের শত্রু এরকমই সাধারণ মানুষকে বুঝানো হয়। গ্রামের মানুষ যখন কৃষি ছেড়ে তন্তুবায়ের কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করে, এবং এই অংশের নেতৃত্ব দেয় হুজুরের কলেজ-পড়ুয়া সচেতন ছেলে, তখন মেম্বার, মাতব্বর ও হুজুরের মূল আঘাত লাগে। মানুষ বুঝতে পারে শোষণের চেহারা। তারা সংগঠিত হয় বিদ্রোহ করে।১০
শততম মঞ্চায়ন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তাগণ সাম্প্রতিক সংকটকালে ইবলিশ-এর সাহসী ভূমিকাকে অভিনন্দিত করেন :
অজস্র খণ্ড-বিখণ্ড গ্রামের সমন্বয়ে এক বিশাল জনপদ গড়ে উঠেছে এখানে। যুদ্ধ, মহামারী, শোষণ ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে চিরদিন এই জনপদের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষেরা। এরাই ভিটেমাটি হারিয়ে এখন সর্বহারা বৃহৎ গোষ্ঠী। ভূস্বামী, বণিক, রাজপুরুষ ও মোল্লাদের কাছে এঁরা চিরবন্দী, কয়েদী। কালের বিবর্তনে এই ভূ-খণ্ডটি বিভিন্ন চেহারা ধারণ করেছে।
শেষাবধি অসংখ্য বিদ্রোহের এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। আলাদা মানচিত্র, আলাদা পতাকা পেলেও এই শ্রমজীবী মানুষের আজও স্বাভাবিক জীবনের সামান্যতম সুযোগ আসেনি। ইবলিশ নাটকের মূল বক্তব্যে রয়েছে এইসব সর্বহারা মানুষের আর্তনাদ ও খণ্ড খণ্ড বিদ্রোহ। আলোচকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইবলিশ নাটকের এই বিষয়বস্তুকেই তুলে ধরেন।
মূল আলোচক আলী যাকের তাঁর আলোচনায় উল্লেখ করেন- ইবলিশ আরণ্যকের একটি সফল প্রযোজনা। তাঁরা যতোগুলো নাটক প্রযোজনা করেছেন তার মধ্যে এ নাটকটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের। মাটি ও মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরণ্যক ১৯৭২ সালে যে যাত্রা শুরু করেছিলো আরণ্যকের অন্যসব নাটকের সাফল্য বাদ দিয়ে শুধু ইবলিশ-এর সফলতার দিকে তাকালেই সে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়েছে বলা যায়।
বদরুদ্দিন উমর বলেন- জনগণের মধ্যে সামাজিক ভাবনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে চলচ্চিত্র হচ্ছে প্রধান মাধ্যম। কিন্তু অত্যধিক ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে বহু ক্ষেত্রেই তা অসম্ভব। দ্বিতীয় প্রধান মাধ্যম টেলিভিশন তো একেবারেই সরকারের নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে গেছে। তাই নাট্যমঞ্চই এখন একমাত্র অবলম্বন। ইবলিশ-এর মতো বর্তমান সমাজের একটি খণ্ডচিত্র কেবল মঞ্চেই তুলে ধরা সম্ভব। আরণ্যককে তা সাফল্য ও নিষ্ঠার সঙ্গেই করতে পেরেছে।
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন- ধর্মব্যবসায়ী একাত্তরের পরাজিত শত্রু এবং প্রতিক্রিয়াশীলরা পুনরায় যখন আসন গেড়ে বসেছে। যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিটি কাঠামো ধর্ম ব্যবসায় জমজমাট, ঠিক সেই মুহূর্তে আরণ্যক ইবলিশ মঞ্চায়নকে প্রধান্য দিয়েছে। ইবলিশ শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে, ধর্মীয় শোষণের কথা বলে।
এস এম সোলায়মান আরণ্যকের ইবলিশ নাটকের শততম মঞ্চায়নকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন- অসম্ভব সংকটের মধ্যে প্রচণ্ড সাহস নিয়ে আরণ্যক ইবলিশ প্রযোজনা করে নাট্যকর্মীদের সাহসী ভূমিকাকে সমুন্নত রেখেছে।
ইবলিশ নাটকের রচয়িতা ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেন- এতো দীর্ঘ সময়ে শততম মঞ্চায়ন কোনো বিশেষ ঘটনাই নয়, কিন্তু আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে হয়তো নতুন কোনো অর্থ সংযোজন করবে সেই আশাতেই আমরা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এই দিনের সামাজিক বাস্তবতায় নাট্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যদি কোনো নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে তাহলেই আমাদের ভালোবাসার শ্রম সার্থক হবে।১১
বিষয় ও প্রকাশরীতির সমালোচনায় বহুমুখী নান্দনিক অবস্থান শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ক বিষয়ে নানা দৃষ্টিকোণ চিহ্নিত করে।
ইবলিশ নাট্য-সমালোচনা সূত্রে ঢাকা ও কলকাতার সমালোচকবৃন্দের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও নান্দনিক অবস্থান উঠে এলে।
সূত্র তথ্য: ১. ‘আরণ্যক’, ‘ইবলিশ’, স্যূভেনির, ১৯৮২, ২. বিভাস চক্রবর্তী, ‘ইবলিশ মেওলবাদ ও ধর্মন্ধতার বিরুদ্ধে’, ‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’, ২৩ জানুয়ারি ১৯৯০, নগর সং, ৩. C.P Ghosal, ‘Through a Looking glass’, ‘Amritabazar Patrika’, 4 March 1990, 5. Ananda Lal,’Stereotype plot’, ‘The Telegraph’, 24 February 1990, ৬. সোমেশ ভূঁইয়া, ‘ইবলিশ নাটকের শেষটা ইচ্ছাপূরক’, ‘যুগান্তর’, ৪ মার্চ ১৯৯০, নগর সং, ৭. দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যাধ্যায়, ‘বাস্তব জীবনের দলিল’, ‘দৈনিক বসুমতী’, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯০, নগর সং, ৮. ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯২, ৯. ধ্রুবগুপ্ত, ‘বাংলাদেশের থিয়েটার আরণ্যক সংস্থার ‘ইবলিশ’, ‘অনুষ্টপ’, চতুর্বিংশ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১০. রাকীব হাসান, ‘ইবলিশ’ নাটকের শততম মঞ্চায়ন’, ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’, ১১. পূর্বোক্ত।
কেরামতমঙ্গল
রচনা : সেলিম আল দীন
নির্দেশনা : নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু
প্রযোজনা : ঢাকা থিয়েটার
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮৬
ঢাকা থিয়েটার প্রকাশিত স্যুভেনিরে কেরামতমঙ্গল সম্বন্ধে বলা হয়েছিল :
সাম্প্রতিক প্রযোজনা কেরামতমঙ্গল-এর পটভূমি অধিকতর বিস্তৃত। এর কাহিনী ও চরিত্র ব্যাপ্তির দিক থেকে সমান্তরাল। নাটকের ব্যাপক পটভূমিতে পথিক কেরামত জীবনের কষ্ট দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে শেষ অবধি প্রায় যীশুর কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ক্রুশবিদ্ধ যীশু ফিরে আসেননি, কিন্তু অন্ধ এবং পরিণত কেরামত শেষ গণ্ডির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। হয়ত সেখানে শুধু দোজখের কপিশবর্ণ অগ্নিময় অন্ধকার। অভিজ্ঞতায় প্রৌঢ় কেরামত কাহিনীর ব্যাপ্তিকেও অনেক স্থানে অতিক্রম করেছে। অথচ কেরামত এদেশেরই সাধারণ মানুষ। লোকজ বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে তাকে জাতীয় চরিত্রের মর্যাদা দিয়েছে। কিত্তনখোলা’র ভাষা ও অভিনয়রীতির সঙ্গে কেরামতমঙ্গল নাটকে যোগ হয়েছে লোকজ জীবনের বিস্তৃত জীবন-ভাষ্য। হিন্দু, মুসলমান, গারো, হাজং, ক্যাথলিক খ্রীষ্টান, মুনি, ঋষি, হিজড়া, জমিদার, জেলে, মাঝি, জেল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর অবয় প্রভৃতি অজস্র জাতি, উপজাতি, ধর্ম, মানুষ ও প্রসঙ্গ নিয়ে গড়ে উঠেছে নাটকটির বিশাল আখ্যানভাগ। এর সাথে লোকজ উপাখ্যান, উপকথা, কিংবদন্তীর সমন্বয় ঘটেছে। লোকজ ভাষার দক্ষ প্রয়োগে নাটকটি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে একটি পুরো ভূখন্ডের অধিবাসীদের জীবনচিত্রকে তুলে ধরতে পেরেছে। আঞ্চলিক ভাষার চরম সংবেদনশীলতা এখানে পরীক্ষিত সত্য। লোকজ ভাষা-ভঙ্গীর প্রধান বৈশিষ্ট্য তার অন্তর্র্নিহিত সুরতরঙ্গ ও গতিশীলতা। এই দুটি গুণের সমন্বয়ে কেরামতমঙ্গল’র ভাষার স্থিতিস্থাপকতা বেড়েছে।১
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
সমালোচনায় এই ব্যাপ্তির কথা উঠে আসে- দীর্ঘ কালপর্বে নানা জনজীবনখণ্ড রূপায়িত হয় নাট্যে। সেই সঙ্গে বিচিত্র উপকথা কিংবদন্তী উপাখ্যান, জাতি ধর্ম সমন্বিত জনগোষ্ঠীর জীবনসমগ্রতা বিন্যস্ত হয়েছে। নাট্যরীতিতেও মহাকাব্যিকরীতি- ইউরোপীয় একটিমাত্র ঘটনাবৃত্তের একক-বিকাশের পরিবর্তে প্রতিটি অখণ্ড চলচ্ছবিমণ্ডিত। ভিন্ন আঙ্গিকের সঙ্গে সম্পর্কিত :
বাংলা নাটকের কাহিনী বহু ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল যাবৎ পঞ্চাঙ্করীতির ভয়াবহ অনুবর্তনে ক্লিষ্ট। কিন্তু কেরামতমঙ্গল নাটকে মধ্যযুগীয় বাংলা নাট্য আঙ্গিক ও সমৃদ্ধ উপাখ্যানের ধারা একীভূত। এই নাটকের বিষয়বস্তুর কোন তুলনা আধুনিক বাংলা নাটকে নেই। শুধু মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের বিস্তৃত কাহিনীর সঙ্গে অংশত তুলনা চলে। মঙ্গলকাব্যও তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষিতে লিখিত হয়েছে। মানুষের মঙ্গল কামনায় দেবতার জয়গান মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কেরামতমঙ্গল নাটকের দেবতা আদম সুরত। কেরামতকে পথের নিশানা দেয়। দশরথ তার অব্যক্ত কথা নেশার ঘোরে আদম সুরতকে শোনায়। অনেকটা দেবীর কাছে (চণ্ডীমঙ্গল) নির্যাতিত পশুসমাজের আর্তনাদের প্রতিধ্বণিত আধুনিক রূপায়ণ যেন। কেরামতমঙ্গল নাটকটি উপখণ্ড সহ মোট এগারোটি খণ্ডে বিভক্ত এবং বৃত্ত পরিকল্পনায় রচিত। আমরা এতে ইউরোপীয় নাটকের ঘটনা সংঘাতের রীতি থেকে কিত্তনখোলা’র মতই একটি ভিন্ন আবহ পাই। প্রতিটি কাহিনী আলাদা বৈশিষ্ট্যের হলেও ঘটনা ও কালগত ঐক্য বর্তমান। কেরামতের জন্ম থেকে অন্ধত্ব পর্যন্ত প্রায় সমগ্র জীবন কাহিনী এতে বিবৃত হয়েছে। ১৯৪৬ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী জনপদের মূল্যবোধের অবক্ষয় কাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে কেরামতমঙ্গল-এ। পান্থজন কেরামতের চোখ দেখে ক্লিষ্ট ক্রুর জীবন দোজখ একের পর এক। এ জীবনের শেষ কোথায়? কোথায় সত্য, মানুষের মঙ্গল? এগারো গণ্ডী, এগারোটি দোজখ অতিক্রম করেছে সে।
সমগ্র নাটকের মধ্যে যে হতাশা, বঞ্চনা, অস্থিরতা, মৃত্যুর চিত্র দেখা যায়, খুব ক্ষীণ হলেও ‘একটি মাত্র ভ্রুণের মধ্য দিয়ে জীবনের অনন্ত সম্ভাবনাকে’ নাট্যকার ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। নাটক শেষে সরাসরি মহাকবির মত অনিবর্চনীয় বাক্যে নাট্যকার সামাজিকগণের কাছে মানবমঙ্গল আহবান জানিয়েছেন এভাবে :
ক।। কেরামতমঙ্গল নাটকের সমাপ্তি এখানেই। সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, এই নাটক দর্শনে সামাজিকগণের কল্যাণ হোক। পুণ্য হোক। যে এই নাটক দেখে, সামাজিক মঙ্গল সাধনে সে যেন তৎপর হয়। অন্যায় অবিচার শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। যে এই নাটক দেখে সে যেন শমলার অপরিপুষ্ট ভ্রুণের নিরাপত্তা বিধান করে। পৃথিবীর সমস্ত ভ্রুণের জন্য যেন সে মমতার হাত বাড়ায়। এই নাটক দর্শনে বন্ধ্যা নারী যেন ফলবতী হয়।
খ।। এই নাটকের রচয়িতা কোরানের দোজখ বর্ণনাকে তার অতুলনীয় ভয়াবহ চিত্রকল্পের স্রষ্টাকে প্রণাম জানায়। এই নাটকের রচয়িতা আভূমি প্রণাম জানায় বাংলাকাব্যের মধ্যযুগের মহান কবিদের। এই নাটকের রচয়িতা মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গলের কবিদের প্রণাম করে। এই নাটকের রচয়িতা- সন্তকবি দান্তেকে প্রণাম জানায়। এই নাটকের রচয়িতা যীশুর ক্রুশকাঠকে প্রণাম জানায়। ইতি। কেরামতমঙ্গল নাটক।২
এই নাটকের প্রতিটি খণ্ড-পরিচয় নাটকের ব্যাপ্তি বৈচিত্র্যকে স্পষ্টতা দেয় :
এক।। সাম্প্রদায়িকতার দোজখ, নখলা খণ্ড : কেরামতের পরিচয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মুসলমান তালুকদার আর হিন্দু মহাজনের অত্যাচার, বহু মানুষের মৃত্যু, অতঃপর ঘরছাড়া হলো কেরামত।
দুই।। উম্মুল মানুষের দোজখ, চন্দ্রকোণা খণ্ড : খালার বাড়িতে নিরাশ্রয় কেরামতের আশ্রয় গ্রহণ, খালাতো বোন নওশাদীর ভ্রুণ বিনষ্টি, অভিজাত মানুষেরা মুচিদের অচ্ছুত ভেবে উচ্ছেদ করে, আবার কেরামত আশ্রয়চ্যুত হলো।
তিন।। সামন্তবাদীদের সৃষ্ট দোজখে জমিদার- প্রজা সবাই দগ্ধ, ফইট্যামারী খণ্ড : কলকাতা প্রবাসী জমিদার চুনু মিয়ার গ্রামে আগমন, জমিদারীর শেষ অবস্থা, জমিদার দর্শনাকাঙ্খী কেরামত নির্যাতিত হয়, তৃতীয়বার পথে নামলো কেরামত।
চার।। জন্ম ও সমাজবঞ্চনার দোজখ, হিজড়া খণ্ড : হিজড়াকে মেয়ে ভ্রম করে কেরামতের চোখ আবিস্কার করে জন্ম ও সমাজ বঞ্চনার কষ্টে করুণ অন্ধকারের রূপ। আশাভঙ্গ কেরামত নতুন করে বাঁচবে বলে যাত্রা করে হাজং দেশের উদ্দেশ্যে, তার ভাষায় ইছামতীর দেশ।
পাঁচ।। প্রতিবাদী যোদ্ধাদের দোজখ, হাজং খণ্ড : পাকিস্তানীদের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে বিদ্রোহী হাজংদের দেশে আসে কেরামত, অজস্র মৃত্যু ও ভ্রুণ বিনষ্টির সংবাদ, হাজং বিদ্রোহীদের সহযোগী হিসেবে কেরামত পাকিস্তানী পুলিশের হাতে ধৃত হয়।
ছয়।। হাজত দোজখ, হাজত খণ্ড : হাজং বিদ্রোহে ধৃত হয়ে বিনাবিচারে কেরামতের আট বছর হাজতবাস, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবয়ের চিত্র, আজমত ডাক্তার নামে এক হাজতবাসীর সঙ্গে পরিচয়, কেরামতের মুক্তি লাভ এবং গারোদের দেশ চিগাস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা।
সাত।। মিশনারীদের সৃষ্ট দোজখ। চিগাস্তান খণ্ড : গারোদের আদিম ধর্মমত ও ক্যাথলিক খৃষ্টান ধর্মের সঙ্গে বিরোধ, মিশনারীদের অভ্যন্তরীণ রূপ, মৃত্যু, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তেজনা, কেরামতের আরেক গণ্ডীতে যাত্রা।
আট।। রাষ্ট্রীয় মৌলবাদীদের সৃষ্ট দোজখ, রাজাকার খণ্ড : স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের ক্যাম্পে বন্দী কেরামতের গলা কাটার হুকুম। স্বাধীনতা লাভ, রাজাকারদের রূপ। স্বাধীনতার পর যন্ত্রণার সুড়ঙ্গপথে কেরামতের উপলব্ধি।
নয়।। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মানুষদের আশাভঙ্গের দোজখ ক. জলসুখা খণ্ড খ. বিবাহ খণ্ড : স্বাধীনতা-উত্তর অস্থিরতা- হত্যা, রাহাজানি, বীরাঙ্গনাদের চিত্র; ধর্ষিতা বীরাঙ্গনা নূরজাহানের সংগে কেরামতের বিয়ে, নববধূর বাসর সজ্জায় মৃত্যু, ভ্রুণ বিনষ্টি, স্ত্রীর লাশ নিয়ে নৌকাযোগে কেরামতের কুসুমপুর যাত্রা।
দশ।। আত্মদগ্ধ মানুষের আশাভঙ্গের দোজখ, কুসুমপুর খণ্ড।
এগারো।। সামাজিক বোধ-রহিত দুই মাসুম- শমলা ও বসিরের সহবাস এবং উন্মত্ত মানুষজন কর্তৃক কেরামত-এর যীশুতুল্য পরিণতি।৩
খণ্ডে খণ্ডে কেরামত দেখে যেতে থাকে বিড়ম্বিত স্বদেশের নিদারুণ অভিজ্ঞতারাজী :
কেরামতের মত সাধারণ মানুষেরা দেখে উঁচু স্তরের লোকদের চক্রান্ত, হিন্দু-মুসলিম হানাহানি, দেখে স্বজাতির দ্বারা বোন ধর্ষণ, সুবিধাভোগী মহলের পাঁয়তারা, দেখে প্রকৃতির হাতে সৃষ্ট অসহায় হিজড়া সম্প্রদায়কে এবং সেই সাথে মশালের মত জ্বলজ্বলে উপজাতি বিদ্রোহ এবং স্বাধীন হয়েও পরাধীনতা ভোগ করা। কেরামতরা নীরব সাক্ষী নোলকহারা নির্যাতিত শমলার, রায়টে সর্বহারা দশরথের, যে কেঁদে কেঁদে গেয়ে বেড়ায়- ‘বুকের মধ্যে বিচ্ছেদের শোক আর উচ্ছেদের কষ্ট’। কেরামতরা দেখে পবিত্র নওশাদীকে অপবিত্র হতে এবং ভ্রুণ কষ্ট করতে। এক সময় কেরামতও জ্বলে ওঠে। তার শক্তি আর ভক্তির প্রতীক আদম সুরতকে তাই চিৎকার করে বলে, ‘এত দুঃখ যে সংসারে, সে সংসারে আমি আগুন লাগায়া দিমু’। কিন্তু কেরামত অনেকের মতই পারে না। এক সময় নিজেই ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মত অন্ধত্ববরণ করে, লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে আসে তার নিজ গ্রামে।
এগারটি খণ্ডে কেরামত লাঞ্ছিত, বঞ্চিত আর নির্যাতিত হয়ে যেন এগারটি দোজখ অতিক্রম করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- কোথায় এ জীবনের সমাপ্তি?৪
বিশিষ্ট নির্দেশক আতাউর রহমান সংক্ষিপ্তভাবেও নাটকটির চরিত্র বিচার করেন একই ধরনে :
সারা নাটক জুড়ে মহাকাব্যের একটা আবহ বিরাজ করে। হিন্দু-মুসলমান গারো হাজং ক্যাথলিক খৃষ্টান মুনি-ঋষি হিজড়া জমিদার জেলে মাঝি জেল রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর অবক্ষয় অজস্র জাতি উপজাতি ধর্ম মানুষ ও প্রসঙ্গ নিয়ে গড়ে উঠেছে নাটকটির বিশাল আখ্যানভাগ। এর সাথে লোকজ উপাখ্যান রূপকথা কিংবদন্তীর সমন্বয় ঘটেছে। লোকজ ভাষার দক্ষ প্রয়োগ নাটকটিকে ধনী করেছে। এ নাটকে মধ্যযুঘীয় বাংলা নাট্য আঙ্গিক ও উপাখ্যানের ধারা লক্ষ্য করা যায়। কেরামতমঙ্গল নাটকটি উপখন্ডসহ মোট এগারোটি খন্ডে বিভক্ত এবং বৃত্ত পরিকল্পনায় রচিত। প্রতিটি উপকাহিনী আলাদা হলেও কালগত ঐক্যে একীভূত। এ নাটকের নায়ক কেরামত ১৯৪৬ থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যন্ত সময় অতিক্রম করে। দাঙ্গা দেশবিভাগ বন্যা দুর্ভিক্ষ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহে আকীর্ণ জীবনকে কেরামত দু’চোখ ভরে দেখে। এগারো খন্ডে বিভক্ত নাটকে সে যেন এগারোটি দোজখ অতিক্রম করে। দেখে হতাশা বঞ্চনা অস্থিরতা মৃত্যুর চিত্র এবং সব জায়গায় দেখে ভ্রুণের বিনাশ। একটি মাত্র ভ্রুণের মধ্য দিয়ে যেন নাট্যকার জীবনের অনন্ত সম্ভাবনাকে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন।৫
মননব্রতী আহমদ শরীফের মতে ‘এই মহানাটক’ বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে :
নাট্যকার সেলিম আল দীন এক বিরাট পটে বিস্তৃত কালের পরিসরে আমাদের দেশের মানুষের শাসন-শোষণ পীড়নে দৃঢ়, দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিক্ষত, বঞ্চনা-প্রতারণায় বিক্ষুব্ধ ও জীবন জীবিকা ক্ষেত্রে সংগ্রামমুখর জীবনের আলেখ্যদানের চেষ্টা করেছেন তাঁর কেরামতমঙ্গল নাটকে। উপখণ্ডসহ মোট এগারো খণ্ডে তিনি ১৯৪৩ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত সময় পরিসরে ঘটা প্রধান-প্রধান বিপর্যয়গুলো তুলে ধরার প্রায় সার্থক চেষ্টা করেছেন। বিস্তৃত পটে বহু বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমাবেশে রচিত হলেও নাট্যকারের মূল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে বলেই আমার মনে হয়। অজ্ঞ, অক্ষম, নিঃস্ব, নিরন্ন গণ-মানব যে এ যাবৎ গ্রাম থেকে শহরাবধি শাসক-প্রশাসকদের ও তাদের মুৎসুদ্দীদের মধ্যে যে গণহিতকামী ও গণসুখবাদী কোনো নেতাকে বা গোষ্ঠীকে বা শাসক-প্রশাসককে পায়নি তা দুষ্ট-দুর্জন-দুঃশাসক আকীর্ণ দেশে গণ-মানবের দুঃখ যন্ত্রণা ও নির্যাতনের এ খন্ড চিত্রগুলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে এই নাটকের লক্ষ্যে উত্তরণ ঘটেছে। কাজেই এ নাটক চিরকালের জন্যে এই সময়কার সার্থক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রইলো। বুদ্ধিজীবী ও নাট্যকার হিসেবে সেলিম আল দীন দেশের প্রতি এবং বিশেষ করে দেশের গণ-মানবের প্রতি প্রত্যাশিত দায়িত্বই পালন করেছেন তাঁর কেরামতমঙ্গল নামের এই মহানাটকে। অবশ্য তিনি তার প্রায় নাটকেই এই সমাজ মনস্কতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। গণ-মানবের দুঃখ মোচনের জন্যে, জীবনে, জীবিকায় এবং জীবনাচারে তাদের বন্ধনমুক্তির জন্যে আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির যে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন, তা ঘটাবার জন্যে যে বিপ্লব কাম্য তা ত্বরান্বিত ও আসন্ন করবার জন্য এই ধরনের নাটক রচনা ও প্রদর্শন আবশ্যক বলেই আমার ধারণা। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে আর যাঁর গণমানবের হয়ে, গণমানবের কথা নিয়ে নাটক লেখেন তাঁদেরও সেলিম আল দীনের সংগে অভিনন্দন জানাই।৬
আহমদ ছফা কতক নাটকীয় অসঙ্গতি নির্দেশ করেন :
আপনার নাটকটিতে মহাকাব্যের একটা ব্যাপ্তি আছে। কোনো বাংলা নাটকের এরকম প্রসর পাটাতন আছে এর আগে আমার নজরে পড়েনি। সেদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে, অন্যেরা কি বলবেন জানিনে, আমার তো মনে হয়- এটা একটা মহৎ-মহত্তম প্রয়াস। সে জন্য আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। এই নাটকটির মধ্যে অসঙ্গতিও রয়েছে। Internal current সর্বত্র সঠিকভাবে প্রবাহিত হ’তে পারেনি। নাটকীয় সংঘাতের চাপে বাস্তবের শিলা ফাটিয়ে নতুন যে দিগন্তের উন্মোচনের মধ্যে নাটকের নাটকীয়তা নিহিত-তা ঘটতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ইতিহাসকে আবিস্কার করার বদলে ইতিহাসের Flattery করা হয়েছে। কখনও যদি দীর্ঘ রচনা এ বিষয়ে লিখি বিশদ বয়ান করবো।
লোকভাষা ব্যবহার করছেন এটা খুবই আশার লক্ষণ। আমাদের সাহিত্যের নবজন্ম অনেকাংশে লোকভাষার সার্থক ব্যবহারের ওপর নির্ভর করছে। আমার মনে হয় আপনি অনেকটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন।৭
সমালোচনায় কেরামতমঙ্গল-এর বিশিষ্টতা নির্দেশ করতে চাওয়া হয়েছে বেশি করে :
নাটকের ব্যাপক পটভূমিতে পথিক ‘কেরামত’ জীবনের কষ্ট দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে শেষ অবধি অন্ধ ও পরিণত কেরামত শেষ গণ্ডির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। আর এখানেই মনে হয় আবহমান কাল প্রচলিত নাটকের ‘ষ্টাইলাইজড’ রূপ। তাই বলা যায় কেরামতমঙ্গল আর ৫টি নাটকের মত নয়। এখানে জীবনের যে ছবি তুলে ধরেছেন সেটা শুধু দেখার নয়, আমাদের ভাবায়ও। শেষে এক মর্মান্তিক পরিণতির দিকে মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় কেরামতকে।৮
সংস্কৃতিভাবুক অরুণ সেন নাট্যকারের বিশিষ্ট নন্দন অভিযান বিস্তারিত করেন :
কিত্তনখোলা থেকেই তাঁর নিজের সেই নাট্যভাবনা স্পষ্ট রূপ পেতে শুরু করেছিল। তিনি দেখলেন, পাশ্চাত্য নাটকে ঘটনাবহুল দ্বন্দ্বের যে প্রত্যক্ষ ধরন এবং তারই অনুসারী ক্রমোচ্চ গড়ন, সেই আদর্শের অন্ধ অনুকরণে সত্যিকারের কোন মৌলিক সৃজন ঘটছে না বাংলা নাটকে। হয়তো ঘটতে পারেও না। যামিনী রায় হলে বলতেন, যন্তরটা তো আমাদের প্রয়োজনে আবিস্কার করিনি, তাই আমরা সেটা চালাব কী করে? কীভাবে অবিকল ফুটে উঠবে বাঙালির অস্তিত্বের সুখদুঃখ ওই পরজীবী নাট্যচর্চায়? অন্তত ফোটেনি যে তা বাংলা নাটকের প্রায় আদ্যোপান্ত ইতিহাস প্রমাণ করেছে। সেলিম আল দীন এখানে দাঁড়িয়েই খোঁজ শুরু করলেন বাঙালির দূর ও নিকট অতীতে নাট্য-উপাদান যতটুকু আছে তার। কিন্তু, প্রশ্ন ওঠে, বাঙালির নাট্য-ঐতিহ্য কিংবা তার নাট্যবোধের স্বরূপটা ঠিক কী? ইওরোপীয় আদর্শকে মাপকাঠি ধরলে সেরকম কোনো নাটকই হয়তো ছিল না আমাদের। সেলিম অবশ্য সেই মাপকাঠিটাকেই চ্যালেঞ্জ করতে চাইছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, পাঁচালি, যাত্রা, কথকতা এবং আরো নানাবিধ লৌকিক ফর্মকে ঘিরে যে আত্মপ্রকাশের একটা ধরন আছে বাঙালির সংস্কৃতিতে, তার মধ্যেই তিনি খুঁজতে চেয়েছেন বাঙালির নিজস্ব নাটকের সম্ভাব্য রূপ। সেখানে ঘটনার সমাবেশ ও সমারোহ এবং তার দুর্বার গতিটা প্রধান নয়-নৃত্য ও সংগীতের সহযোগে, বর্ণনা ও সংলাপের মেশামেশিতে এমন এক অখন্ড ও ব্যাপ্ত রূপাবয়ব গড়ে ওঠে- যেখানে বাঙালির কাব্য, কাহিনী ও নাটকের পিপাসা একসঙ্গে চরিতার্থ হয়। এ কথাগুলো যে খুব নতুন তা হয়তো নয়- আমাদের প্রাচীন ও মধ্যযুগ বিষয়ক অনেক তত্ত্বালোচনায় তার ইঙ্গিত আগেই পেয়েছি।
কিন্তু সেলিম আল দীনের কাছে তা নিছক তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা নয়, কিংবা অতীতের দিকে ফিরে তাকানো নয়- এ হল তাঁর নাট্যভাবনার উৎস ও যাত্রাবিন্দু- যার একাত্মতায় তিনি সাম্প্রতিকের জটিল বাস্তবকে মুঠোয় ধরতে চাইছেন।৯
কেরামতমঙ্গল নাটকের ‘আকাশ ছোঁয়া অভিপ্রায়’ সম্পর্কে তিনি আরও লেখেন :
কেরামতমঙ্গল- এ সেলিম এই ব্যবধানকে অনেকখাটি কাটিয়ে উঠেছিলেন মনে হয়। এখানেও চরিত্রের সংখ্যা অগুণতি, বোধহয় আরো বেশি, দৃশ্যপট আরো ছড়ানো, লৌকিক উপাদানের ব্যবহার আরো ব্যাপক, আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগও আরো আপোসহীন। অর্থাৎ স্বভাব একটুও বদলায়নি, কিন্তু নিজস্ব একটা কেন্দ্র গড়ে নিয়েছেন তিনি। কেরামত চরিত্রটিই সুত্রের মতো কাজ করেছ বলে শুধু নয়, কতকগুলি জোরালো প্রতিমা ও রূপক নাটকটিকে গেঁথে রেখেছে, বিন্যাসে এনে দিয়েছে এমন সৌন্দর্য, যাকে ধরে অপ্রতিহত এগোনো যায়। কিত্তনখোলা’য় ছিল সর্গভাগ, কেরামতমঙ্গল বিন্যস্ত হয়েছে খন্ডে-খন্ডে। সেলিম আল দীন নাটকটির সূত্রে কোরানের দোজখ বর্ণনায় যে ভয়াবহ চিত্রকল্প আছে তার কথা স্মরণ করেছেন, স্মরণ করেছেন মঙ্গলকাব্যের কবিদের এবং সন্তকবি দান্তেকে একসঙ্গে। খন্ডগুলির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দুঃসহ অভিজ্ঞতারই বিস্তার-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিজড়ের প্রণয়, অত্যাচারিত হাজংবিদ্রোহী, হাজতবাস, জয় বাংলার প্রচার-অপপ্রচার, রাজাকারদের অত্যাচার, ধর্ষিত নারীর মৃত্যু, তালাক-পাওয়া হতভাগ্য নারীর সঙ্গে বোবা পাগলের মিলন ও ভ্রুণহত্যা-এই বেবাক নরক-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় কেরামতকে। এক ধর্ষিত নারীই ছিল কেরামতের দয়িতা, আবার আরেক ওই কন্যাসম হতভাগিনীর ভ্রুণরাই হয়ে উঠল তার দায়। কিন্তু শেষদৃশ্যে দেখি রক্তাক্ত ব্যর্থ অন্ধ কেরামত- ছোঁড়া জুতো তার গলায়। সেলিম আল দীন লাঞ্ছিত যিশুর ক্রুশকাঠকে প্রণাম জানান।
এতই বিস্তারিত এই নাটকের পট যে এর প্রযোজনাও সে-সময়ে অন্তত পশ্চিমবঙ্গে পুরোপুরি গ্রাহ্য হয়নি। কারণ, অনভ্যস্ততা তো বটেই, তার সঙ্গে এ নাটকের আকাশছোঁয়া অভিপ্রায়ই এমন যে প্রযোজনার প্রকরণগত সুবিধা-অসুবিধাগুলোও খুব বড় হয়ে ওঠে। নাটকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা সীমার লঙ্ঘন ঘটেছে এখানেও, বরং তাকে অতিক্রম করার পথে আরো দু’পা এগোনোও সম্ভব হয়েছে। হয়তো, কিন্তু তখনো ওই প্রগতি সম্পূর্ণ নয়। ফলে, লেখার পাঠে সেই টুকরো ও আপাত-বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতটা প্রোথিত হয়ে যায়, অভিনয়ের চটজলদি রূপে ততটা হতে পারে না। এতগুলো স্তর এই নাটকে-লোকায়ত জীবনের স্তর, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার স্তর, প্রকরণ ও উপকরণের নিজের-নিজের ভিন্ন-ভিন্ন স্তর-তাকে অনুধাবনের জন্য যে ধ্যানের প্রয়োজন অভিনয়ের সময়সীমায় তাকে ধরে রাখা খুবই দুরূহ। ফলে, মনে হতে পারে, প্রযোজনার বিচারে অন্তত, সেলিম আল দীন তাঁর অভিপ্রায়ের দিক থেকে এখনো কিছুটা মুশকিলেই আছেন।১০
এভাবেই দেশজ নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের প্রশ্নে কেরামতমঙ্গল একটি বিবেচ্য নাট্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে ওঠে বাংলা থিয়েটারে।
সূত্রতথ্য: ১. ঢাকা থিয়েটার, ‘কেরামত মঙ্গল’, স্যূভেনির, ১৯৮৬, ২. ‘সাপ্তাহিক পরিক্রমা’, ১৬ জানুয়ারি ১৯৮৬, ৩. ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’, ১৯৮৬, ৪. শহীদ ইকবাল এনাম, ‘সাপ্তাহিক অর্থনীতি’, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬, ৫. আতাউর রহমান, ‘যায় যায় দিন’, ১৪ জানুয়ারি ১৯৮৬, ৬. ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’, ১৯৮৬, ৮. দীপক চৌধুরী, ‘চিত্রালী’, ৭ জুলাই ১৯৮৮, ৯. অরুণ সেন, ‘প্রতিক্ষণ’, দ্বাদশ বর্ষ, আগস্ট ১৯৯৪, ১০. পূর্বোক্ত।
কবর দিয়ে দাও
মূল রচনা : আরউইন’শ
অনুবাদ : জামালউদ্দিন হোসেন
নির্দেশনা : আতাউর রহমান
প্রযোজনা : নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮৬
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় কর্তৃক প্রকাশিত কবর দিয়ে দাও প্রযোজনার স্যুভেনিরে বলা হয় :
১৯৩৬ সাল। বিশ্বজুড়ে দুঃসময়, মার্কিন মুলুকে তো বটেই। একদিকে যুদ্ধোন্মাদ হিটলারের রোষ-গর্জন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ইতিহাসের চরমতম অর্থনৈতিক মন্দার যাঁতাকলে পিষ্ট। এই ক্রান্তিকালে সম্ভবত সৃষ্টিশীলতা গৌরবের সুবর্ণশীর্ষে উন্নীত হয়। এই ক্রান্তিলগ্নেই জন্ম নেন বেরটোল্ট ব্রেশট, ক্লিফোর্ড ওদেত এবং আরউইন শ’-এর মত মানুষেরা। ইতিহাসে এধরনের ক্রান্তিকাল বিরল নয়। আর সে কারণেই আজও পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য, প্রতিনিয়ত ধ্বংসের হাত হানা দিলেও এভাবেই ধ্বংস্তুপের ওপর মানুষ প্রাণপণে গড়ে তোলে নতুন পৃথিবী। ...
কবল দিয়ে দাও গণকবর থেকে উঠে আসা ছয়জন তরুণ মৃত সৈনিকের কাহিনী, যারা সমাহিত হতে অস্বীকার করে। জেনারেল, উচ্চপদস্থ অফিসারবৃন্দ, তাদের প্রিয়া, বোন, জায়াজননীর বারংবার আবেদন ব্যর্থ হয়। তারা জীবনের গভীর থেকে সত্য প্রশ্নটি তুলে ধরে- কেন এই যুদ্ধ, ধ্বংস, মৃত্যু? নাটকের শেষদৃশ্যে ভীত জেনারেলরা যখন মরীয়া হতে নিহত সৈনিকদের আবারো হত্যা করতে উদ্যত হয় তখন মৃতরা ধীর পায়ে এগিয়ে আসে, ঘিরে ফেলে, দু’পায়ে তাদের পিষ্ট করে সেই উপরওয়ালাদের, যারা চিরকাল শুধু হুকুম দিয়ে এসেছে।
ঘটনার এই চকিত নাটকীয় মোড় আমাদের হতবাক করে দেয়। আমরা সভয়ে আবিস্কার করি মানুষে মানুষে সংঘাত কী অর্থহীন এবং অর্বাচীন এবং যারা এই সংঘাতের হোতা তাদের হাতের পুতুল এই আমরা কত অসহায়।১
কবল দিয়ে দাও প্রযোজনার প্রচার পুস্তিকায় নির্দেশক বলেন :
এ নাটকটি পড়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধ যারা ঘটায় তাদের বিরুদ্ধে আমরার ঘৃণা আরও প্রবল হল। অনেকদিন থেকে যে ধারণা মনের মধ্যে দানা বাঁধছিল তা দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হল- যুদ্ধবাজ প্রভুরা ও কায়েমী স্বার্থ নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই যুদ্ধ বাঁধায়, সাধারণ মানুষের এতে কোন ভূমিকা নেই। কখনও ধর্মের নামে, কখনও দেশের নামে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে দুর্নীতিপরায়ণ এ যুদ্ধবাজ প্রভুরা মানুষকে মানুষ মারার কাজে লেলিয়ে দেয়। মিলিটারী একাডেমীর সকল শিক্ষা একটি মাত্র উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে নিয়োজিত, তা হল মানুষ মারা। ... মনে পড়ল একটি অর্থনৈতিক সত্যের কথা-পরাশক্তির যুদ্ধ-যজ্ঞের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তার এক তৃতীয়াংশ অর্থ দিলে বিশ্বের নিরন্ন মানুষ খেয়ে বেঁচে যেত। নতুন করে মনকে ভারাক্রান্ত করল বাংলাদেশের ক্রম নিমজ্জমান অর্থনৈতিক অবস্থা। পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের বিলাস সামরিক ব্যয়ের যৌক্তিকতা মনকে প্রশ্ন করে বাংলাদেশ কার সাথে যুদ্ধকরবে? কেনই বা সামরিক বাহিনী পোষা? সারাদেশে মনে হল বিশ্ব শান্তি কি চিরকাল অলীক আকাঙ্খা হয়ে থাকবে মানুষের কাছে? দর্শক এ নাটক দর্শনে ... যদি যুদ্ধের ভয়াবহতা ও অর্থহীনতা সম্পর্কে সচেতন হন তাহলে ‘নাগরিক’র সকল কর্মীর পরিশ্রম সার্থক হবে।২
নাটকটি সম্পর্কে অনুবাদকের ভাষ্য :
বেরী দ্য ডেড্ এর প্রথম মঞ্চায়নের পর পঞ্চাশ বছর গত হয়েছে। এখনও মানুষ ভায়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কামুক্ত নয়। প্রতি মুহূর্তে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার ভয়ঙ্কর সম্ভাবনায় মানবজাতি এখনও আতঙ্কিত। আরউইন শ’-এর এই নাটকটি তাই এখনও অত্যন্ত সমকালীন এবং এখনও পর্যন্ত যুদ্ধের বিরুদ্ধে মঞ্চে তীব্রতম প্রতিবাদ। ...
নাটকটি প্রথমবার পড়ে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। নাটকের মূল প্রতিপাদ্য আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। যুদ্ধবলিদের প্রতি এক গভীর সহানুভূতি মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। পরবর্তীতে আমি ধীরে ধীরে নাটকটির অন্তর্নিহিত শক্তি ও সৌন্দর্য আবিস্কার করি। নাটকের শ্বাসরোধকারী গতি, চমকপ্রদ কাহিনী নির্মাণ, সুনিপুণ চরিত্র চিত্রায়ণ এবং সর্বোপরি মানুষের প্রতি নাট্যকারের প্রগাঢ় ভালোবাসা বেরী দ্য ডেড্ কে নিঃসন্দেহে এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটকের সারিতে দাঁড় করায়।
প্রথমে আমি দেশীয় পটভূমিতে নাটকটি রূপান্তরের চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু পরে সরাসরি অনুবাদ করতে মনস্থ করি এই কারণে যে, প্রযোজনার সুবিধা ছাড়াও এই বাংলা অনুবাদটি যদি পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেওয়া যায় তাহলে এদেশের সাধারণ পাঠক আরউইনশ’র মত একজন মহান শিল্পী ও তাঁর রচনার সঙ্গে অধিক পরিচিত হতে পারবেন।৩
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
সন্তোষ গুপ্ত নাটকটিতে বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্যের প্রতীকময়তা দেখেন :
ভালোবাসা জীবনের আর এক নাম। আর সেই জীবন হননে একশ্রেণীর লোক যুদ্ধ ও ধ্বংসের আয়োজন করে, যুদ্ধ বাঁধায় দেশের গৌরবের নামে জাতীয় স্বার্থের ধুয়া তুলে, আসলে তারা পৃথিবীর সব কিছু করায়ত্ত করতে চায় লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বিনিময়ে। তাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘৃণা মানুষের প্রতি ভালবাসাকে কতটা উজ্জ্বল করতে পারে মার্কিন নাট্যকার আরউইন শ’র বেরী দ্য ডেড্ নাটকে সে কথাটাই বলা হয়েছে। ... মৃতরা কবরে যাবে না- এই অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্য দিয়ে নাট্যকার এ যাবৎকাল সেই বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে যে, এক শ্রেণীর লোক অপরের উৎপাদিত ও সৃষ্ট সম্পদ ভোগ করবে এবং এর স্রষ্টারা আজ্ঞাবহ থাকবে চিরকাল- এই ঘটে আসা বিধানগুলো অপরিবর্তনীয়। এই অবাস্তবতার আবরণ ছিন্ন করে এক নতুন সত্যের দিকে নাট্যকার আমাদের চোখ ফিরিয়ে দিয়েছেন। ... যুদ্ধ অর্থহীন; তার ধ্বংসের নিষ্ঠুরতা কয়েকজনের পৃথিবীর সম্পদ ভোগ চক্রান্ত তাই এ ধরনের যুদ্ধে মৃত্যু গৌরবহীন। যুদ্ধ বিরোধী মনোভাব, যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং শান্তির জন্য যে আন্দোলন ও সংগ্রাম চলছে সেখানে নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী সচেতনভাবে তাদের স্বাক্ষর রেখেছে আরউইন শ’র বেরী দ্য ডেড্ নাটকের বাংলা অনুবাদ প্রথমবারের মত এদেশে মঞ্চস্থ করে। ... তবুও বলতে হয়, এ নাটকটির বিষয়ের অন্তর্লীন বক্তব্য, মানুষের প্রতি ভালবাসা, যুদ্ধের পিছনে ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধারের চক্রান্ত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য এবং তদুপযোগী সংলাপ এই নাটকের দৃশ্যযোগ্যতা ও পাঠযোগ্যতার সমন্বয়কে সার্থক করেছে। ...
সাধারণ মানুষকে সমাজ ব্যবস্থার অপরিবর্তনীয়তা, উৎপাদন ব্যবস্থায় মুনাফা সৃষ্টির অলঙ্ঘনীয়তা মৃতদের কবরে শায়িত থাকার মতই স্বাভাবিক ও চিরন্তন সত্য। তাদের বিদ্রোহ বাস্তব ও প্রত্যক্ষরূপে উপস্থাপনটি আসলে প্রতীকধর্মী। মৃতদের এখানে উপেক্ষিত নির্যাতিত মানুষের অচেতনতা থেকে সচেতন হওয়ার কথাটাই উঠে এসেছে। কবর সেই সমাজের অচলায়তন দেয়ালের প্রতীক। দুঃখের ও মৃত্যুর আলোকে পথ খুঁজে পাওয়া মনুষ্যত্বের ও বঞ্চিত মানুষের চিত্তের উদ্বোধন হল। তাদের পুনরায় অচেতন অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার কূটকৌশল ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই সত্যের ঘোষণায় নাটকটি অনন্য। এখানে মৃতদের বিদ্রোহ ঘোষণার অর্থ তাই সচেতনতার উদ্বোধন। যা মানুষকে শেখাবে পৃথিবী থেকে স্বার্থের কুটিল দ্বন্দ্বে সৃষ্ট যুদ্ধকে নির্বাসিত করে মানুষ যুদ্ধ করবে নিজের জন্য, অধিকারের জন্য, বঞ্চনার বিরুদ্ধে। বঞ্চিত হওয়ার জন্য নয় আর পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য যেখানে কবরের অন্ধকারে ঘাসের শিকড়ের নিচে গলিত লাশ কুরে কুরে খাবে না উল্লাসিত কীট। পৃথিবীর উপরেই ঘাস জন্মে। তার সৌন্দর্যকে দেখবে পৃথিবীতেই চোখ মেলে সুখী মানুষরা। ... মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিসর্গ পরিবেশকে বাংলাদেশের সমতলে বেমানান মনে হয়নি এর সর্বজনীন আবেদনে। দেশ ও কালের সীমানা ছাড়িয়ে মানবজাতির সাধারণ স্বার্থ ও লক্ষ্যকে এনেছেন জীবনের অনুভূতির সমতলে। ... সত্যের কোন আভরণ প্রয়োজন পড়ে না। মানুষের প্রতি ভালবাসার চেয়ে সুন্দর কোন ভূষণ নেই, সেই কথাটা মঞ্চসজ্জায় প্রতিভাসিত হয়েছে। ‘নাগরিক’ এখানেও সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তির সদ্ব্যবহার করেছে।৪
সৈয়দ বোরহান কবীর নাটকে সমকালীনতা ও প্রগতিমুখীনতাকে মুখ্য বিবেচ্য করেন- তা সে নাটক অনুবাদ বা মৌলিক যাই হোক না কেন :
নাটকের, বিশেষত মঞ্চ নাটকের মূল লক্ষ্য যদি সমাজ মনস্কতা হয়, আর সমাজ মনস্কতার প্রথম শর্তই যদি হয় সময়োপযোগী মঞ্চায়ন তবে নাগরিক সমাজমনস্কতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতে পারে। যুদ্ধ মহড়া, যুদ্ধ উত্তেজনা এবং যুদ্ধ ভীতিই যখন সাম্রাজ্যবাদের শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যখন বিশ্বকে বাঁচিয়ে রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করছেন কোটি কোটি মানুষ, ঠিক তখনই যুদ্ধ বিরোধী শান্তিময় আশ্বাসের বাণী যখন হয় নাটকের মূল সুর তখন তা সমকালকেই স্পর্শ করে না, দেশ কালের ঊর্ধে সর্বজনীনতাও তাতে ভর করে।
নাটক অনুবাদ কিংবা মৌলিক যাই হোক না কেন এর বক্তব্য হওয়া উচিত সমকালীন ভাবনা এবং আকাঙ্খার সাথে সম্পৃক্ত এবং সমাজ প্রগতিমুখী- ‘নাগরিক’ তাদের প্রত্যেকটি নাটকে এই বক্তব্যের প্রতিই বিশ্বস্থ থেকেছেন। কবর দিয়ে দাও- সেই বিশ্বাসকেই আরো প্রগাঢ় করেছে। ... কাহিনী বিন্যাসে গ্রেভ দেম অল নাটকের মূল সুর থেকে সরে না এসেও তিনি বর্তমান কালের প্রেক্ষাপটে একে দেশীয় আদল দেবার চেষ্টা করেছেন। ... বর্তমান সময়ে বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের সামরিক কর্তৃত্ব, যুদ্ধের ভীতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এরকম একটি প্রযোজনা সাহসী কাজও বটে।৫
‘নিপুণ’ পত্রিকায় সমালোচক বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে নাটকটির প্রাসঙ্গিকতা নির্দেশ করেন :
“যুদ্ধোন্মত্ত বর্তমান বিশ্বের অস্থির পরিস্থিতিতে এই নাটক অত্যন্ত সময়োপযোগী। নাগরিক এই সময়ে নাটকটি নির্বাচন করে পক্ষান্তরে ঘটমান যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। উদ্যোগ সামান্য হলেও গুরুত্বপূর্ণ এবং মহান।”৬
‘এই নাটক বর্তমান অবস্থার সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত’- এক সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নে অনুবাদক বলেন :
এই নাটক বর্তমান অবস্থার সাথে কতটুকু সম্পৃক্ত? স্থুূলভাবে দেখলেও বোঝা যাবে কয়েকজন জেনারেলের ইচ্ছার কারণে অর্থহীনভাবে কিছু মানুষ মারা যাচ্ছে যুদ্ধে। বেশীরভাগ অনুন্নত দেশে এই জাতীয় সমস্যা রয়েছে। মানুষ তখনই সুখে মরতে পারে যখন সে নিজের জন্য যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করে। যে যুদ্ধে সে বিশ্বাস করে না, সেই যুদ্ধেই তাকে প্রাণ দিতে হচ্ছে- কিছু সংখ্যক মানুষের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে। আরেকটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে একটি দেশের সাধারণ মানুষ সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের অদৃশ্য সুতোর টানে ঘুরছে- প্রাণ দিচ্ছে। শুধু তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে সাধারণ মানুষকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। এ নাটকে সেই নিগৃহীত নিষ্পেষিত মানুষেরাই উঠে দাঁড়াতে চাইছে নিজের জন্য যুদ্ধ করতে।৭
নাটকের বক্তব্যকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে?- এই প্রশ্নে অনুবাদক বলেন : “কিছু ক্ষেত্রে আমরা বক্তব্য সরাসরি নিয়ে আসতে চেষ্টা করি। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে যে কথা যতটুকু বলা যায় ঠিক ততোটা বলতে চাই আমরা। যে কথাটা বলতে পারছি না, তার কিছুটা বলতে চেষ্টা করি। অবশ্য নাটকটি যাতে স্লোগানে পরিণত না হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা হয়।”৮
‘নিপুণ’- পত্রিকার পক্ষ থেকে নির্দেশককেও কতগুলো প্রশ্ন করা হয়- যা থেকে থিয়েটারে শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর মত ও অবস্থান স্পষ্ট হয় :
এটা মূলত যুদ্ধ বিরোধী নাটক। সিকোয়েন্সগুলো ছোট ছোট অংশে বিভক্ত। যে কারণে নাটকটির কিছু কিছু জায়গা এডিট করতে হয়েছে। নাটকটির নিজস্ব ছন্দ আছে যা’ আমরা হয়তো ঠিক ঠিক মেনটেইন করতে পারিনি। যে কারণে নাটকটি কিছুটা একঁেঘয়ে মনে হতে পারে। এছাড়া নাটকটি অনুবাদ, সে কারণেও হতে পারে। অন্যদিকে অভিনয়ের ক্ষেত্রেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা’নাহলে নাটকটি আরও সুন্দর হতে পারতো। অবশ্য এ নাটকে গ্রুপের নতুনদেরকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি।
নাটক নির্বাচনে আপনাদের আপাতত: লক্ষ্য কি থাকে? এমন প্রশ্নের জবাবে নির্দেশক বলেন- নাটক নির্বাচনে রুচির উন্নয়ন এবং সামাজিক সংকটকে সামনে তুলে আনা। -এক্ষেত্রে আপনারা কতটা সফল?- কিছুটাতো বটেই। কিন্তু সামাজিক সংকটের কারণকে চিহ্নিত করতে পারছি না। আমি বলবো- আমরা সমাজকে পাঠ করছি এবং কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছবার চেষ্টা করছি।
- সেই লক্ষ্য কি?
- বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে আমরা যা’ বলতে চাই। মহত্বর জীবনের স্বপ্ন, শান্তি, কল্যাণ ও সত্য- সুন্দরের ধারণা।৯
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির প্রাসঙ্গিকতা অন্বিত করার বিষয়টি নাট্যদল ও সমালোচক- কোনো দিক থেকে প্রাধান্য পায়নি- এটা বিস্ময়কর রূপে লক্ষ্যণীয়। কেবলই যুদ্ধ বিরোধী বিশ্বশান্তির প্রসঙ্গে সীমাবদ্ধ হয়েছে। এটা একটা বিশেষ অবস্থান বটে।
সূত্রতথ্য: ১.‘নাগরিক’, ‘কবর দিয়ে দাও’, স্যূভেনির, ১৯৮৬, ২. পূর্বোক্ত, ৩. পূর্বোক্ত, ৪. সন্তোষ গুপ্ত, ‘মৃত্যু হতে অবাধ স্রোতে বহিয়া যাক প্রাণ’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬, নগর সং, ৫. সৈয়দ বোরহান কবীর, ‘নাগরিকের কবর দিয়ে দাও’, সচিত্র সন্ধানী’, ১২ অক্টোবর ১৯৮৬, ৬. ‘নাগরিক-এর যুদ্ধবিরোধী নাটক : কবর দিয়ে দাও’, ‘নিপুণ’, ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ১৯৮৭, ৭. পূর্বোক্ত, ৮. পূর্বোক্ত, ৯. পূর্বোক্ত।
নানকার পালা
রচনা : আবদুল্লাহেল মাহমুদ
নির্দেশনা : মামুনুর রশীদ
প্রযোজনা : আরণ্যক নাট্যদল
প্রথম পঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮৬
‘আরণ্যক’ নাট্যদল কর্তৃক প্রকাশিত নানকার পালা নাট্যের প্রচারপত্রে জানানো হয় :
গাঙেয় অববাহিকার এ অঞ্চলের ইতিহাস দাহ ও দ্রোহের ইতিহাস। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির সমসাময়িক এ অঞ্চলের সভ্যতা, জলসেচনির্ভর ও কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। সেই প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই সুপেয় পানি আর ঊর্বর মৃত্তিকার লোভে ছুটে এসেছে বহু বিদেশী, বিভাষী আর বিজাতি। তাদের সে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ। তেমনি এক শতাব্দী প্রাচীন কৃষক বিদ্রোহের আবেগতাড়িত ইতিহাস নানকার পালা।
নান শব্দের অর্থ রুটি, আর নানকার হলো রুটি দিয়ে কেনা গোলাম। নানকার মূলত এক ধরনের ভূমিদাস। সামান্য একটুকরো জমির বিনিময়ে তারা সামন্ত প্রভুর আজ্ঞা পালনে বাধ্য থাকতো। নানকার সম্প্রদায় অতি প্রাচীন সম্প্রদায়। চলতি শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত নানকারী প্রথার প্রচণ্ড প্রকোপ ছিল বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব সীমান্তের সিলেট জেলায়। মধ্যযুগীয় বর্বর নানকার প্রথার বিরুদ্ধে সিলেট জেলা নানকারদের বিদ্রোহের সূচনা সেই মধ্যযুগেই। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে এক নাগাড়ে কয়েক শতাব্দী পার হয়ে অবশেষে তা আমাদের কালে এসে পৌঁছেছে। শতাব্দী প্রাচীন এ বিদ্রোহের ধারাটি এক প্রবাহমান অখণ্ড স্রোত। তাই একে নানকার পালার কাহিনীতে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়।
নানকার পালা নানকার বিদ্রোহের ইতিহাস নয়। ইতিহাসের কালপঞ্জী আর ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণের অবকাশ এখানে সীমিত। নানকার পালা তাই নানকার বিদ্রোহের ইতিহাস নয়, নানকার বিদ্রোহের জ্বালাযন্ত্রণা, ক্ষোভ, রক্তক্ষরণ, ভালোবাসা আর প্রতিরোধের দলিল।১
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
ঐতিহাসিক এক কৃষকবিদ্রোহ মঞ্চে রূপায়ণ করে এবং তাকে বর্তমানের সঙ্গে অন্বিত করে ‘আরণ্যক’ এক ঐতিহাসিক দায়পালন করেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক আন্দোলনে একদা সক্রিয় সংগঠক, সাংবাদিক সমালোচক সন্তোষ গুপ্ত :
নাট্যকার আবদুল্লাহেল মাহমুদ রচিত নানকার পালা নাটকের পরিচিতিতে বলা হয়েছে এ নাটক নানকার বিদ্রোহের ইতিহাস নয়। এদেশের ইতিহাস অচেতন মানুষ নানকার প্রথা ও তাদের বিদ্রোহের কথা জানে না, কিম্বা জানবার চেষ্টা করে না। ‘আরণ্যক’ নাট্যগোষ্ঠী নানকার বিদ্রোহের সেই ইতিহাসকে কেন্দ্র করে তাদের যন্ত্রণা, নির্যাতন ও প্রতিরোধের একটা ধারণা দর্শককে উপহার দিতে চেয়েছে।
নাটক সম্পর্কে কিছু বলার আগে নানকার পালা নাটক মঞ্চস্থ করার সপক্ষে যে কথা ‘আরণ্যক’ বলতে চেয়েছে তার সূত্র ধরে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এ প্রজন্মেরই ঘটনা। তা আমাদের প্রত্যক্ষ ঘটনা, অনেকের জীবনের আরক্ত দলিল, অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রণায় ধমনীর রক্তে মিশ্রিত তবুও কী আমাদের সচেতন রাখতে পেরেছে। বর্তমানের চেতনার যেখানে গ্রহণ লেগেছে, সেখানে অতীতের কাহিনী তো বেদনা বিলাস বলে অনেকের মনোরম সন্ধ্যা কিংবা নির্ঝঞ্ঝাট সকাল কাটানোর বাইরে মর্মে কী দোলা দিবে? ‘আরণ্যক’ স্বীকার করবেন এ ক্ষুব্ধ প্রশ্ন আমাদের রক্তে এখনও আর্তনাদ তোলে।
যাক সেকথা। নানকার পালা নাটকটি উপস্থাপনা করা হয়েছে পালাগানের ভঙ্গীতে এবং তার সাথে নানকারদের যন্ত্রণাময় জীবন, বিদ্রোহ আর জমিদারদের অত্যাচারের খণ্ড খণ্ড দৃশ্য সংযোজন করে দর্শককে ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার সাথে যুক্ত করা হয়েছে চলতিকালের কৃষক জীবনের বঞ্চনা সংগ্রাম ও প্রতিরোধের চেতনার স্ফুলিঙ্গকে। এখানেই নানকার পালা নাটকটি শুধুমাত্র ইতিহাসের প্রতিরোধের দলিল না হয়ে আজকের সংগ্রামের পথ নির্দেশক এবং জীবন সংগ্রামের আয়োজনের ব্যাপ্তিরও বাহন হয়েছে। সার্থকতাও এখানে।
সিলেটে মধ্যযুগীয় বর্বর নানকার প্রথার বৃটিশ আমলে সংঘবদ্ধ বিদ্রোহ দেখা দিলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও নানকারদের মুক্তি আসেনি দীর্ঘ দিন।
এই বর্বর প্রথা চালু রাখার পিছনে জমিদারদের স্বার্থের সাথে কংগ্রেস-লীগও অভিন্ন হতে বাধ্য। বৃটিশ আমলে আর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ সরকার এই নানকার প্রথা জিইয়ে রাখতে গিয়ে যে অত্যাচার দমননীতির আশ্রয় নিয়েছিল সে কাহিনী কার্যত তৎকালীন কোন পত্রিকায় স্থান পায়নি। কাজেই দেশের সাধারণ মানুষের নিকট এই অঞ্চলের নানকার প্রথা তথা অনুরূপভাবে জমিদারীতে বেগার খাটার নানা সম্প্রদায়ের লোকের মানবেতর জীবনযাপন ও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাহিনী অজানা রয়ে যায়। নানকার পালা নাটক সে অভাব মোচনে এগিয়ে এসেছে। নাটক যে সংগ্রামের হাতিয়ার এবং গণমানুষের প্রতিরোধের ভাষা সেই কথাটার সার্থকতা প্রমাণ করছে নানকার পালা।
নানকার পালা’র নানকারদের মাঠে জমিদারের ঘোড়া মেরে ফেলার দৃশ্যটি নানকার বিদ্রোহের অন্তর্গত একটি প্রকৃত কাহিনী। জমিদার ছয়াব মিঞা ও দারোগা করম আলী কোন কল্পিত চরিত্র নয়। মাহিষ্য দাস সম্প্রদায়ের একজন জমিদারের হাতের চাবুক কেড়ে নিয়েছিল, তাও প্রকৃত ঘটনা। কলা চুরিকে কেন্দ্র করে কিশোরকে পিটিয়ে মারার কাহিনীও সত্য ঘটনা।
অমানুষিক শোষণ-পীড়ন এবং অকথ্য ও বর্বর অত্যাচারে নানকারদের মধ্যে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে থাকে। আর সে বিদ্রোহ দমনের জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর চক্রান্তও ঐতিহাসিক তথ্য। জমিদারদের মধ্যে নরমপন্থী জমিদারও ছিল, তাদের যুগোপযোগী কৌশল পরিবর্তনের পরামর্শও ইতিহাস-সত্য।
কলা চুরির ঘটনাটি ১৯৪১ সালে ঘটেছিল। তখন আসামে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা। জমিদারের নির্যাতনে এ ধরনের মৃত্যুর কিনারা হত না তৎকালে। এর আগে ছিল কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা। তাদের সময়ে রায়ত কৃষক সমিতির আন্দোলনের ফলে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলে সিলেট জেলা প্রজাস্বত্ব আইনটি আসাম আইন পরিষদে গৃহীত হয়। তার আগে কৃষক সমিতি ‘শিলং অভিযান’ মিছিল সংগঠিত করেছিল। দেবপুর কৃষক আন্দোলনের দাবী ছিল ওই বিলের একটি নির্দিষ্ট ধারার বিরুদ্ধে। তা হল ফসলে খাজনার বদলে টাকায় খাজনা প্রথা চালুর দাবী। ১৯৪১ সালে গৃহীত আইনে সে দাবী গ্রাহ্য হয়নি। ভারত রক্ষা আইনের কারণে ওই দাবীতে কৃষকদের আন্দোলন সার্থক হতে পারেনি। আন্দোলন শুধু দেবপুরেই সীমিত ছিল।
নানকার আন্দোলনকে সংগঠিত রূপ দেওয়া ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতির বিরুদ্ধে সচেতন করার পথে কমিউনিষ্ট পার্টির পরিচালিত কৃষক সমিতির কর্মীরা এগিয়ে আসেন। নানকার পালা নাটকে হামিদালীর চরিত্রে মামুনুর রশীদ তা ফুটিয়ে তোলেন। নাটকে কৃষক সমিতির সাথে নানকারদের আন্দোলন যুক্ত করার সংলাপে অজয় দা অর্থাৎ নানকার আন্দোলনের অন্যতম নেতা অজয় ভট্টাচার্যকে বুঝানো হয়েছে। নাটকের অপর একটি দৃশ্যে দেখান হয়েছে যে জমিদার একজন নানকারকে তেড়ে মারতে গেলে কাছারি বাড়ীতে উপস্থিত নানকারদের কয়েকজন গর্জে ওঠে- ১৯৪৬ সালে বটরশি বিদ্রোহের ইতিহাস থেকে এ অংশ নেয়া হয়েছে বলে মনে হয়।
নানকার পালা নাটকে জিরাতি কাশেমালী নিজেদের জীবন ও জীবিকার সংগ্রামের ফাঁকে ফাঁকে পালা গানের আকারে নানকার বিদ্রোহের কাহিনী তুলে ধরলে আর এই কাহিনী জিরাতিদের শোষণের বিরুদ্ধে একজোট হবার চেতনা সঞ্চারিত করে জাগ্রত করে আত্মবিশ্বাস। জোতদার গেন্দু মিয়া, শামসু ও খলিলের শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দীক্ষা নেয় এভাবে ইতিহাস থেকে জিরাতিরা। জিরাতিদের একজনের দুর্বলতায় যখন তারা জোতদারদের দ্বারা নির্যাতিত হয় অসতর্কতার মুখে সেখানেই নানকার পালা নাটক শেষ হল এই ঘোষণা দিয়ে আজ দেশের সকল কৃষক সমাজ একই অবস্থার শিকার। নানকারদের প্রতিরোধ সংগ্রাম আজও শেষ হয়নি।
বিপ্লবে জয়ী হওয়ার কোন স্বস্তি বাণী নয়, দেশের বর্তমান অবস্থার নির্মম চিত্র তুলে ধরার সাথে নানকার বিদ্রোহের সফল উত্তরাধিকারের গর্ব ও শপথ উচ্চারিত। নানকার পালা নাটক প্রকৃত অর্থেই তাই গণমুখীন একটি নাটক।
দর্শকদের মধ্যে মন্তব্য শুনেছি এ রকম ঘটেছিল তা তো জানতাম না। আবার ২/১ জনকে হতাশ হয়ে উঠে যেতে দেখেছি নাটকের মধ্যপথে। সহজেই বোঝা যায় এরা এসেছিলেন প্রণয় বা চড়ালয়ে বাঁধা বিপ্লবের রোমান্টিক শব্দাবলী শুনে শিহরিত হতে। এ দুটোই মধ্যবিত্ত মনের উত্তেজনার খোরাক। আশাভঙ্গ হয়ে তারা চলে গেছেন। নাটকের সার্থকতা এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রমাণ করেছে।২
ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে সংগঠিত নানকার প্রথাবিরোধী আন্দোলনের খণ্ডচিত্রের সঙ্গে দেশের বর্তমান অবস্থার নিমর্ম চিত্র তুলে ধরার সাথে নানকার বিদ্রোহের সফল উত্তরাধিকারের গর্ব ও শপথ উচ্চারিত নাটকে। সাধারণ জনের বিদ্রোহ গাথা আজকের তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন সংস্কৃতিজনেরও মনে ক্রমবিস্মৃত।
আলোচক দর্শক- প্রতিক্রিয়ার যে’কটি নমুনা উল্লেখ করেছেন- তাতে তাদের শিল্প আকাঙ্খার স্বরূপ প্রকাশিত। বিশেষত এই মন্তব্যটি- ‘এরা এসেছিলেন প্রণয় বা চড়ালয়ে বাঁধা বিপ্লবের রোমান্টিক শব্দাবলী শুনে শিহরিত হতে। এ দুটোই মধ্যবিত্ত মনের উত্তেজনার খোরাক। আশাভঙ্গ হয়ে তারা চলে গেছে। নাটকের সার্থকতা এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রমাণ করেছে।’ এ নাটকে পালাগানের ভঙ্গিতে নানকারদের জীবন ও বিদ্রোহ এবং জমিদারদের অত্যাচারকে খণ্ডে খণ্ডে দৃশ্য যোজনার সঙ্গে সঙ্গে ‘চলতি কালের কৃষক জীবনের বঞ্চনা সংগ্রাম এবং প্রতিরোধের চেতনার স্ফুলিঙ্গকে’ যুক্ত করেছে। তাতে নাটকটি ‘ইতিহাসের প্রতিরোধের দলিলমাত্র না হয়ে আজকে সংগ্রামের পথনির্দেশক এবং জীবন সংগ্রামের আয়োজনের ব্যাপ্তিরও বাহন হয়েছে’। চড়ালয়ে বাঁধা বিপ্লবের রোমান্টিকতার বিপরীতে এক শিল্পরূপায়ণ যে ঘটেছে বলে মনে করছেন সমালোচক- তার থেকেই শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্কের প্রশ্নে বিশিষ্ট এক নান্দনিক অবস্থানকে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ এই বিষয়ের নাটকে যার অন্যথা হওয়াই প্রচলিত ধরন- প্রযোজনা ও সমালোচনা- দুই ক্ষেত্রেই।
সূত্র তথ্য: ১. ‘আরণ্যক’, ‘নানকার পালা’, স্যূভেনির, ১৯৮৬, ২. সন্তোষ গুপ্ত, ‘আরণ্যক- এর নানকার পালা- উত্তরাধিকারের গর্বিত পংতিমালা’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ৪ মে ১৯৮৬, নগর সং।
গ্যালিলিও
মূল রচনা : বের্টল্ট ব্রেশ্ট
অনুবাদ : আবদুস সেলিম
নির্দেশনা : আতাউর রহমান
প্রযোজনা : নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮৯
স্যুভেনিরে গ্যালিলিও সম্পর্কে বলা হয় :
তবুও গ্যালিলিও প্রযোজনার চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করলাম এই বিবেচনায় যে গ্যালিলিও আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে গভীরভাবে অর্থবহ। গ্যালিলিও নাটকে আমরা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কুপমণ্ডুকতা ও মৌলবাদের আগল ভেঙ্গে নবযুগের সোচ্চার আহ্বান শুনতে পাই, যে নবযুগ নির্মাণ করবে কর্মজীবী সাধারণ মানুষেরা। নাটকের শেষ দৃশ্যে গ্যালিলিও’র কন্ঠে আমরা শুনতে পাই বিজ্ঞান সাধারণ মানুষের জন্যে, সবার জন্যে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যদি শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাসীনদের ভয়ে তাঁদের জ্ঞানের চর্চা করে তৃপ্ত হয়, তবে বিজ্ঞান হবে একটা অর্থহীন বিষয় আর নব আবিস্কৃত যন্ত্রপাতি শুধুমাত্র অত্যাচারের নতুন যন্ত্ররূপে ব্যবহার হবে মাত্র। ফলে বিজ্ঞানী আর সাধারণ মানুষের মাঝের ফাঁকটা একদিন এমন বেড়ে যাবে যে নতুন কোন আবিস্কারের আনন্দধ্বনি ভীতির সঞ্চার করবে। গ্যালিলিও’র কন্ঠে উচ্চারিত এ সংলাপ আজকের বিশ্বের বিদ্যমান সত্য।১
‘উদ্যোক্তাদের কথা’ শিরোনামে স্যুভেনিরের ভাষ্য হল :
গ্যালিলিও নামের মানুষটি সত্য অনুসন্ধানকারী বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর নিজস্ব সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ব্রেশ্ট তিন তিনবার নাটকটির শেষাংশ পরিবর্তন করেছিলেন। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের প্রেক্ষাপটে সত্য উচ্চারণ না করে চার্চের প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্যে ব্রেশ্ট গ্যালিলিওকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছেন। আজকের বিশ্ব যেখানে পারমাণবিক সমর অস্ত্রের বিধ্বংসী শক্তির ভয়ে কম্পমান, সেক্ষেত্রে এ নাটকের প্রাসঙ্গিকতা কোন বিশেষ দেশ ও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর মর্মবাণী যথার্থই বিশ্বজনীন।২
নাটকটির বিষয়ে অনুবাদকের বিশেষ এক অনুভাবন দেখা যায়- নাটকে New time বা age অর্থাৎ নবযুগ কথাটি নিয়ে- কর্তৃত্বের, ক্ষমতা-কাঠামোর স্বরূপ উন্মোচন করাই নবযুগের কাজ বলে :
প্রসঙ্গত, এই নাটক সম্বন্ধে আমার নিজস্ব একটি অভিমত জ্ঞাত না করলে বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গ্যালিলিও নাটকে একাধিকবার 'new time বা age অর্থাৎ ‘নবযুগ’- এর উল্লেখ আছে। ব্রেখ্ট-এর এই নবযুগের মূল চেতনা হলো সেই সত্যের উপলদ্ধি যা মানুষের মুক্তি বয়ে আনবে। অথচ আদিকাল থেকে 'authority' অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ অজ্ঞ সাধারণ জন-মানুষকে স্বীয় স্বার্থসাধনে ব্যবহার করে আসছে। নবযুগের মূল চেতনা হলো এই বদভ্যাসকে মানবজাতির কাছে উন্মোচিত করা। যুগে-যুগে, দেশে-দেশে এই কর্তৃপক্ষের রূপ ভিন্নতর। কখনও সে ধর্ম-প্রতিষ্ঠান, কখনও সামরিক জানতা, কখনও রাজনীতিজ্ঞ, কখনও আমলা, কখনও ব্যবসায়ী আবার কখনও এইসব মিলে এক সর্বশক্তিমান দুর্ভেদ্য অশুভ আবর্ত-চক্র। চার্চ এই নাটকে একটি রূপক মাত্র। বিজ্ঞানকে বা প্রকৃত জ্ঞানকে নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থে ঠিক এই মুহূর্তেও ব্যবহার করে চলেছে এইসব কর্তৃপক্ষ; আর সেই বহুপ্রতীতি ‘নবযুগ’-এর দেখা এখনও মেলেনি। তবুও মানুষের আশা আছে- নাটকের শেষ দৃশ্য তাই প্রতিফলিত করে। সমগ্র নাটকের কাঠামোতে আকীর্ণ হয়ে আছে দারুণ সব ঘটনাবলী, যা প্রতিটি পাঠক-দর্শকের চেতনাকে প্রবুদ্ধ করে মুহুর্মুহু।৩
নির্দেশক নাটকটিকে দেশে ও বিশ্বে নিদারুণ প্রাসঙ্গিক মনে করেন :
আমাদের বিবেচনায় গ্যালিলিও আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভীষণভাবে অর্থবহ। গ্যালিলিও নাটকে আমরা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কুপমন্ডুকতা ও মৌলবাদের আগল ভেঙ্গে নবযুগের সোচ্চার আহবান শুনতে পাই যে নবযুগ নির্মাণ করবে কর্মজীবী সাধারণ মানুষেরা। নাটকের শেষ দৃশ্যে গ্যালিলিও’র কন্ঠে আমরা শুনতে পাই- বিজ্ঞান সাধারণ মানুষের জন্যে, সবার জন্যে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যদি শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাসীনদের ভয়ে তাঁদের জ্ঞানের চর্চা করে তৃপ্ত হয়, তবে বিজ্ঞান হবে একটা অর্থহীন বিষয় আর নব আবিস্কৃত যন্ত্রপাতি শুধুমাত্র অত্যাচারের নতুন যন্ত্ররূপে ব্যবহার হবে মাত্র। ফলে বিজ্ঞানী আর সাধারণ মানুষের মাঝের ফাঁকটা একদিন এমন বেড়ে যাবে যে নতুন কোন আবিস্কারের আনন্দধ্বনি ভীতির সঞ্চার করবে। গ্যালিলিওর কন্ঠে উচ্চারিত এ সংলাপ আজকের বিশ্বের বিদ্যামান সত্য।৪
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
রিশিত খান নাটকের প্রাসঙ্গিকতা নির্দেশ করতে গ্যালিলিও’র সংলাপ উদ্ধৃত করেন :
নাটকে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা এবং মৌলবাদের আগল ভেঙ্গে এক নতুন সমাজের সোচ্চার আহবান শুনতে পাই আমরা। সে সমাজ নির্মাণ করবে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষেরা। নাটকের শেষ দৃশ্যে তাই গ্যালিলিও’র কন্ঠে শুনতে পাই- ‘বিজ্ঞান সাধারণ মানুষের জন্য, সবার জন্য। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যদি শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাসীনদের জন্য তাঁদের জ্ঞানের চর্চা করে তৃপ্ত হন, তবে বিজ্ঞান হবে একটি অর্থহীন বিষয় আর নব আবিস্কৃত যন্ত্রপাতি শুধুমাত্র অত্যাচারের যন্ত্ররূপে ব্যবহার হবে মাত্র। ফলে বিজ্ঞান আর সাধারণ মানুষের মাঝের ফাঁকটা একদিন এমন বেড়ে যাবে যে, নতুন কোন আবিস্কারের আনন্দধ্বনি ভীতির সঞ্চার করবে।৫
‘থিয়েটার’ পত্রিকার সমালোচক বিস্তারিত করেন ব্রেশট ও গ্যালিলিও পরিচয় :
ব্রেখ্ট গ্যালিলিওকে ইতিহাসভিত্তিক নাটকের গতানুগতিক নায়কের মত উপস্থাপন করেননি। তাঁর নাটকে গ্যালিলিও যেমন নিবেদিত-প্রাণ বিজ্ঞানী, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ মানুষের মতই দৈহিক নির্যাতনের প্রতি ভীত। বিজ্ঞানের নবতর দ্বার উন্মোচনের প্রতি তিনি যেমন আকৃষ্ট, তেমনি ভাল আহার্যের প্রতিও তাঁর সমান আকর্ষণ। এই শারীরিক ও মানসিক চাহিদা পূরণের আকাঙ্খার মধ্যে দিয়ে তাঁর চরিত্রের স্ববিরোধিতাই তুলে ধরেছেন ব্রেখট্। কারো কারো মতে তিনি ভুল করেছিলেন, বিশুদ্ধ এক বিজ্ঞান সৃষ্টি করতে গিয়ে বিজ্ঞানের সামাজিক তাৎপর্যকে উপেক্ষা করেছিলেন। এ কারণে বিজ্ঞানীদের মধ্যেই বিভক্তির সৃষ্টি হয়। ব্রেখট তাঁর এই নাটকের সমালোচনায় অবশ্য বলেছেন, এই নাটকের মূল বক্তব্য হচ্ছে সমাজ ব্যক্তি থেকে কি আহরণ করে বা করা উচিত।
তবে নাটকটির নিগূঢ় একটি অর্থও আছে। গ্যালিলিও নাটকে আমরা বারবার নবযুগ (NEW AGE)- এর উল্লেখ পাই। এই নবযুগ কুসংস্কারের ওপর যুক্তি আর সত্যের জয়, পুরাতনকে স্থলাভিষিক্ত করে নতুনের আগমন। গ্যালিলিওকে আমরা বলতে শুনি, ‘সত্য সময়ের সন্তান, কর্তৃত্বের নয়।’ ব্রেখটের নবযুগ হ’ল সেই সময়, যখন সত্যের উপলব্ধি জনমানুষের মুক্তি বয়ে আনবে। অথচ আদিযুগ থেকে ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ (AUTHORITY) সেই মুক্তির পথ রোধ করে রেখেছে। ক্রমশঃ প্রাচীন অর্বাচীনরাই সবল হয়ে উঠেছে আর নবীন নিমজ্জিত হয়েছে হতাশায়। এই পুরাতনই নতুন বেশে এক সারশূন্য ‘নবযুগের’ অবতারণা করেছে। ... অনুবাদে সাবলীলতা রয়েছে, সেই সাথে ভাষার সরলতা দর্শকবৃন্দের কাছে নাটকটি সহজবোধ্য করেছে। প্রতি দৃশ্যের কোরাসে তিনি যেমন ছন্দময়তা রক্ষা করেছেন, তেমনি প্রয়োজনবোধে দেশীয় উপাদানে সহজবোধ্য প্রেক্ষাপট রচনা করেছেন। অতিরিক্ত জটিল অংশ প্রয়োজনানুযায়ী সংক্ষিপ্ত করেছেন। ...
বিশ্বে আজও এই গোষ্ঠী সক্রিয়। সর্বত্র, এমন কি এদেশেও কখনো কুসংস্কারের প্রলেপে, কখনো ধর্মের আড়ালে, কখনো সামরিক পোশাকে, আবার কখনো রাজনীতির ফাঁকা বুলির আচ্ছাদনে বারবার এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত ও বঞ্চিত করেছে। স্বার্থ ও ক্ষমতার লোভে বিজ্ঞান তথা প্রকৃত জ্ঞানকে এরা ব্যবহার করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এই প্রাচীনপন্থী ক্ষমতাসীনদের নবীন সম্প্রদায় উচ্ছেদ করতে পারলেই ব্রেখটের সেই নবযুগের অবতারণা হ’তে পারে। ৬
বাংলাদেশে মৌলবাদী পশ্চাদ্পদ সমাজ-রাষ্ট্রের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে গ্যালিলিও ভিন্ন রাজনৈতিক তাৎপর্য অর্জন করে। গ্যালিলিও একটা প্রতীকী চরিত্রই পেয়ে যায় যার ফলে এর প্রাসঙ্গিকতা অটুট- নানা সমালোচক ও নাট্যকার নির্দেশক প্রায় একই ভাষ্য করেন।
সূত্র তথ্য: ১. নাগরিক, ‘গ্যালিলিও’ স্যূভেনির, ১৯৮৯, ২. পূর্বোক্ত, ৩. পূর্বোক্ত, ৪. ‘থিয়েটার’, ৪ মার্চ ১৯৮৯, ৫. ‘বিচিত্রা’, ২৫ আগস্ট ১৯৮৯, ৬. ‘থিয়েটার’, পূর্বোক্ত।
সাতঘাটের কানাকড়ি
রচনা ও নির্দেশনা : মমতাজউদদীন আহমদ
প্রযোজনা : থিয়েটার (আরামবাগ)
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮৯
সাতঘাটের কানাকড়ি নাটকটি সম্পর্কে নাট্যকার জানান -
বাংলাদেশ প্রচণ্ড আবেগের দেশ। সত্য ও সততাকে অবিরাম আহ্বান করার দেশ। কিন্তু অহরহ এ দেশকে, যার যেমন ইচ্ছা মিথ্য ভূষণে নিন্দিত করে চলেছেন। অবচেতনবাবে তাঁদের মনের মধ্যে যে হীনমন্যতা দীর্ঘদিন ধরে বসে আছে, দেশের নামে, জাতির নামে তাই প্রকাশ করে তাঁরা বাহাদুরি ঘোষণা করেন। এ কাজটি প্রধানত করছেন উচ্চাভিলাষী মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোক যাঁদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় অতি সামান্য এবং সৌখিন।
সে পরিচয়ের সূত্র ধরে আমি বাংলাদেশকে চিনতে চাই না। আমার দেশের সম্ভাবনা ও শক্তির জন্য আমি নিরপরাধ, সরল এবং খেটে-খাওয়া মানুষকে বেশি গণ্য করি। এরা কখনোই বাংলাদেশকে এবং দেশের পরিচয় ও শক্তিকে খাটো করেন না।
সাতঘাটের কানাকড়ি রচনার সময় আমার মধ্যে এই খাটো-না-করার গৌরব বোধটি কাজ করছিলো। সে বিশ্বাসের জোরেই আমি বাংলাদেশকে দেখেছি। সেভাবেই আমার নাটকে আমার দেশের সত্য ও শক্তি উৎসারিত হয়েছে।
নাটক সাতঘাটের কানাকড়ি মঞ্চে খুব জনপ্রিয় হয়েছে। বিপুল সংখ্যক দর্শক উৎসাহ নিয়ে সাতঘাটের কানাকড়ি দেখেছেন।
কিন্তু এমন কিছু দর্শক আমি পেয়েছি যাঁরা এ নাটক দেখে অ-খুশি হয়েছেন। তাঁদের মতে সাতগাটের কানাকড়ি শিল্পসম্মত সাহিত্য হয়নি। আমিও তাঁদের হতাশা ও উদ্বেগের সহোদর। না, আমি শিল্পকর্মের সূক্ষ্ম ও সচেতন অভিলাষ নিয়ে সাতঘাটের কানাকড়ি রচনা বা নির্দেশনা করিনি। আমার সেদিকে লক্ষ্যই ছিলো না। তবুও নাটকের দেহে ও প্রাণে যেটুকু স্বাভাবিক সুধা এসেছে তা অভিজ্ঞতার সাধারণ সূত্র ধরেই এসেছে। সাতঘাটের কানাকড়ি নাটকটি রচনার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য, আমার কালের দগ্ধীভূত উত্তপ্ত কথাগুলো বলা এবং কালের মানুষের ক্রোধ বা দহনকে প্রকাশ করা।
বলেছিতো, আমি স্বৈরাচার শাসিত একটি অসহনীয় কুৎসিত সময়ের কিছু নষ্ট লোককে এ নাটকে প্রতিপক্ষ হিসেবে এনেছি আর তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সহজ, সচেতন, নির্ভীক মানুষের আত্মত্যাগকে আহ্বান করেছি। বিদেশী কোন চমকপ্রদ কায়দাকাুনকে সাফল্যের জন্য সংস্থাপন করিনি।
যা বিশ্বাস করি নাটকে তাই বলেছি। যা দেখেছি তাই দেখাতে চেয়েছি, যা জানি তাই জানিয়েছি। মুখ বাড়িয়ে বড় কথা, বড় তত্ত্ব বলার অনন্য কাজ করিনি। সে কাজ খুব দুরূহ ছিলো না। কিন্তু বিষয়ানুসারে কাজের নিয়মে আমার চলা। তাই এ নাটক।১
নাটকটির রচনা ও প্রযোজনার অভিপ্রায় এবং পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে স্পষ্টভাষ নাট্যকার ও নির্দেশকের। ‘শিল্পকর্মে সূক্ষ ও সচেতন অভিলাষ নিয়ে’ রচিত না হলেও এর ‘দেহে ও প্রাণে যেটুকু সুধা এসেছে তা অভিজ্ঞতার সাধারণ সূত্র ধরেই এসেছে’,২ ‘কালের দগ্ধীভূত উত্তপ্ত, কথাগুলো বলা এবং কালের মানুষের ক্রোধ ও দহনকে প্রকাশ করা’৩ নাট্যকারের মৌল অভিপ্রায়। এমত ভাষ্য তাঁর।
দর্শক-সমালোচক, নাটকটিতে নষ্টকালে সামাজিক বাস্তব, আখ্যানের রূপক প্রতীকের সহায়তায় উপস্থাপিত হয়েছে বলে মতপ্রকাশ করেছেন। তবে নাটকের ‘জনপ্রিয়তার উপাদান সনাক্ত করার চেষ্টা করে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যর্থ হলাম’৪ বলেও মত প্রকাশ করেন জনৈক সমালোচক। সত্যের তীব্র শিল্প প্রকাশের সাহস হিসেবে নাটকটিকে অধিকাংশ দর্শক দেখেছেন। সমূহ এক পতন-বিকার-দশা থেকে জাগরণের পন্থা মনে করেছেন অনেকেই সাতঘাটের কানাকড়িকে।
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
‘যুগের যন্ত্রণা সেই যুগের মানুষকে সহ্য করতে হয়, সমস্যার সমাধান দিতে হয়। এই শিক্ষা যেন এখানে আছে। আমরা যা করতে পারছি না আপনারা তা সমাধান করার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসুন।’৫
স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি আবার চোখের সামনে ভেসে গেল, আবার দেশ জাগছে, আবার শপথ, সত্যের জয় হবেই হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’৬
নাট্যকার বাঙালি জাতির যন্ত্রণাকে তাঁর নাটকে প্রকাশ করেছেন। তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে যন্ত্রণাকাতর বাঙালি জাতির নতুন শপথ, মুক্তি সংগ্রামের নব অঙ্গীকার। নাট্যকুশলী এবং শিল্পীরা অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে এই যন্ত্রণা এবং অঙ্গীকারকে অভিনয়ে এবং ব্যবস্থাপনায় মূর্ত করে তুলছেন। সকলকে রক্তিম অভিনন্দন।৭
এটি একদিকে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের একটি দর্পণের মতো। বাস্তবে যা ঘটছে তার প্রতিফলন দেখছি নাটকে। অন্যদিকে এতে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, যে মূল্যবোধ ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে সর্বত্র। এ নাটক যত বেশি মানুষ দেখবে ততই মঙ্গল। এর দর্শকেরা আশ্বাস পাবে, আস্থা ফিরে পাবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রেরণা পাবে।৮
‘বাংলাদেশ সম্বন্ধে যারাই ভাবেন, বলেন বা চিন্তা করেন তাদেরকে বিবেকবিদ্ধ করার জন্য নাট্যকার, পরিচালক, কুশলীবৃন্দের এটা একটা অভূতপূর্ব প্রচেষ্টা। আমিও বিবেকবিদ্ধ। অভিনন্দন।’৯
সাতঘাটের কানাকড়ি আমাদের বর্তমান বিদীর্ণ বাস্তবকে তুলে ধরেছে। এ নাটক দেখে সবাই আবার আমরা গর্জে উঠব, এই আশা।’১০
বাংলার দুঃখিনী মায়ের আর্ত কান্না শুনলাম। আর দেখলাম পরগাছা, দেশ জাতির কলঙ্ক, ধূর্ত, লোভী, ভন্ডের ভন্ডামী। স্বনির্বাচিত স্বেচ্ছাচারী দেশনায়ক পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার চাতুর্য। তারপর দেখলাম সে ভন্ডামীর মুখোশ খুলে দিতে সাহসী, সংগ্রামী, সত্যনিষ্ঠ বাংলার সন্তানদের দৃঢ় শপথভরা মুখ। আশা আছে, প্রত্যাশায় রয়েছি, বলিষ্ঠবাহুর শক্তিতে কানাকড়ি সংকট সিন্ধু পার হওয়ার পাথেয় যোগাবে। থিয়েটারকে, নাট্যকারকে বাংলার মানুষ মনে রাখবে।১১
‘এ নাটক অনন্য, অসামান্য। জ্ঞানের সঙ্গে বুদ্ধির, সাহসের সঙ্গে শক্তির, অঙ্গীকারের সঙ্গে উদ্যোগ ও আয়োজনের এমন সমাবেশ, সমাজ, রাজনীতি এবং দুষ্ট, দুর্জন, দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃতির এমন বাস্তব, সামগ্রীক, সামষ্টিক ও সাময়িক চালচিত্র একাধারে ও যুগপৎ আর কখনো দেখেছি বলে এ মুহূর্তে মনে পড়ে না।১২
মমতাজউদদীন আহমদ রচিত ও পরিচালিত সাতঘাটের কানাকড়ি নাটকটি দেখলে বোঝা যায় যে, এ ধরনের বিশেষ সীমাবদ্ধতার মধ্যেই নাটককে শত্রুপক্ষের ওপর আক্রমণের একটি হাতিয়ার বা উপায় হিসেবে ব্যবহার প্রচেষ্টা সেখানে বেশ খোলাখুলিভাবেই বিদ্যমান। যদিও সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা কোথাও নেই। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অধীনস্থ সমাজে আমরা কীভাবে রয়েছি, কত ধরনের অপরাধ, ধর্মীয় ভণ্ডামী, শ্রেণী শোষণ ও সেই সঙ্গে প্রতিরোধের পরিস্থিতিতে জনগণের জীবনধারা কীভাবে প্রবাহিত হচ্ছে তারই একটি চিত্র এবং বেশ সজীব চিত্র হল আলোচ্য নাটকটি।
সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এক স্বৈরতন্ত্রী শাসকের নানা কর্মকাণ্ড নাটকটিতে একের পর এক প্রদর্শিত হতে থাকলেও আলীজাঁ হিসেবে উল্লিখিত সেই শাসককে রক্তমাংসের শরীরে নাটকের কোনো জায়গায় উপস্থিত করা হয়নি। করলে নাটকের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ন হতো। কিন্তু সেইভাবে উপস্থিত ও প্রত্যক্ষ না হলেও তার সর্বগামী নিয়ন্ত্রণ দর্শককে নাটকটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার কথা ভুলতে দেয় না।১৩
আমার জানা ছিলো না, ভেবেছিলাম প্রহসন বুঝি। গিয়ে দেখি আমাদের এই কালের ছবি, হাস্যকর ঘটনা ও চরিত্ররা রয়েছে, যেমন রয়েছে তারা জীবনে। কিন্তু মূল বিষয়টা বড় করুণ ও গভীর।
মায়ের বুক কাঁপে। তাঁর সাত ছেলে। ছেলেদের পিতা নেই, প্রাণ গেছে তাঁর স্বাধীনতা যুদ্ধে। সাতটি ছেলে, বড় ভাল তারা। স্বাধীন দেশে তাদের চলার কথা বুক ফুলিয়ে। কিন্তু আটকা পড়ে গেছে সাতজনই একটি জালে, ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে একজন, দুজন খুনের আসামী, অন্যরাও হতাশ, ব্যর্থ, জীবনমৃত। এরি মধ্যে মায়ের কাছে প্রস্তাব আসে আপোষের। একদা হারাধনের দশটি ছেলের নয়টি গেছিল হারিয়ে, দশমটি গেছে বনে, কাঁদতে কাঁদতে। রইল না বাকি কেউ। এ নাটকেও তেমনি ঘটনা ঘটতে পারত।
কিন্তু ঘটল না। মা বললেন, তাঁর ভাঙা গলায় সবটা শক্তি একত্র করে- আপোষের বুকে আমি লাথি মারি। কোনো সাজানো কথা নয়।
এ তাঁর একার কথা নয়। এ কথা যৌবনের এবং ভবিষ্যতের। সেই যৌবন যে আত্মসমর্পন করেনি, মাদকাসক্ত হয়নি। কিন্তু মার একার সাধ্য কি ওই জাল ছিন্ন করেন। এ মা ভিন্ন মা, তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগুনে পুড়েছেন, পুড়ে দগ্ধ নয় শক্ত হয়েছেন। কিন্তু তবু তার কথায় কি কাজ হবে? কাজ হবে কি একজনের শপথে?
না, হবে না। মা যদি এক হতেন তাহলে আমাদের তেমন কিছু আশা করবার থাকত না। কিন্তু তিনি এক নন, তার সাত ছেলে গর্জে ওঠে একত্রে, তারা মরেনি। তারা মরবে না, তারা ছিন্ন করবে এই জাল। আশা সেইখানেই।১৪
শ্লেষ, বিদ্রুপ, ক্ষোভ ও হাহাকারময় যে বাস্তবতার শিল্পরূপ সাতঘাটের কানাকড়িতে দেখা যায়, তা সমকালীন বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থারই জোরালো প্রতিফলন। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ভণ্ডামি, শঠতা ও তোষামোদ মানুষের জীবনকে বিপর্যয়ের কোন সীমানায় নিক্ষেপ করেছে তার এমন বিশ্বস্ত রূপায়ন খুব বেশি চোখে পড়ে না। ভবিষ্যতের বাঙালির কাছে সাতঘাটের কানাকড়ি সামাজিক ইতিহাসের উজ্জ্বল উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে আমার ধারনা।১৫
যে আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অনুপ্রাণিত করেছিলো, সেখান থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। সে কাহিনী যেমন প্রতারণার তেমনি তিক্ততার। এই প্রতারণা ও প্রতিসারণের জটিল পর্যায়গুলোকে একটি নাটকের কাঠামোর মধ্যে ধরা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। এই দুঃসাধ্য কাজটি অনায়াস দক্ষতায় সম্পন্ন করেছেন মমতাজউদদীন আহমদ তাঁর সাতঘাটের কানাকড়িতে। সংবেদনা ও ব্যঙ্গের, ক্রোধ ও দ্রোহিতার এ অনন্য শিল্পরূপকে দর্শকরা অনেকদিন স্মৃতিতে ধারণ করবেন। দীর্ঘকাল তা তাঁদের চেতনাকে উজ্জীবিত করবে। নাট্যকার ও থিয়েটারকে অভিনন্দন।১৬
মমতাজউদদীন আহমদের সাতঘাটের কানাকড়ি নাটকটির প্রদর্শন যারা দেখেছেন, তারা জানেন, এ নাটক বাংলাদেশের সমকালীন ইতিহাসের কত বিশ্বস্ত একটি দলিল। নাট্যকার নিশ্চয়ই এমন দাবি করবেন না যে, সমকাল ও সমকালীন ইতিহাসকে তিনি মৌলিকভাবে উপলব্ধি করেছেন। যেসব অতি পরিচিত মানুষ, দৃশ্যাবলীকে আমরা অতি পরিচয়ের কারণে এড়িয়ে যাই বা অবহেলা করি, তাদের এক ধরনের তাৎক্ষণিক অনিবার্যতার সামনে নিয়ে আনা হয়। আমরা চমকে উঠি, বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হই, আক্রান্ত হই নিদারুণ ক্রোধে। যেন আমাদের ঘরেই আছে চোর। দেখেও দেখছি না এবং সে সর্বস্ব নিয়ে নিচ্ছে আমাদের। হঠাৎ বুঝতে পেরে প্রথমে হতবাক, পরে রুষ্ট হই আমরা। চোরটিকে ধরতে তৎপর হই অতঃপর। সাতঘাটের কানাকড়ির মূল কেন্দ্রে এর গার্হস্থ্য দর্শন। একটি ঘরের গল্পই নাটকটি। মায়ের ঘর, সাত ছেলে, স্বামী, আবার ঘরটি বাংলাদেশও। অন্যদিকে লোকায়ত দর্শনের এলাকায়- বাংলাদেশের সাত ছেলে হারানো মায়ের গল্পটা প্রধান বিবেচনা। নাটকটির আগাগোরা প্রভাব যাঁরা অনুভব করেছেন, তাঁরা বলতে পারবেন, মমতাজউদদীন আহমদ ঐ লোকায়ত চেতনা ও ইতিহাসবোধের কাছেই গিয়েছেন বিষয়বস্তুর জন্য।
সাতঘাটের কানাকড়ি এতই সমসাময়িক যে এর স্থান-কাল-পাত্র নির্ভর কোনো বিশেষ গল্পও যেন নেই। একটি কাহিনী-কাঠামো আছে, ঐ মায়ের স্বামী সন্তান হারানো কিন্তু তাও না থাকার মত। সাত না হয়ে সাতাশটি সন্তান হলেও, দর্শক বুঝতে পারে, গল্পটি একই হত। এ জন্য, নাটকের শেষে, জ্যেষ্ঠ ভাইটি যখন দর্শককে বলে, নাটক শেষ হল, না শুরু হল তখন মনে হয় এই অতলাচক্রের বুঝি শেষ নেই। কিন্তু একদিকে মায়ের প্রচণ্ড আবির্ভাব, অন্যদিকে সাত ছেলের পুনরুত্থান, দর্শককে সজোরে বাস্তবের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ম্যাক্সিম গোর্কির মায়ের মতো এই মা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। তখন বুঝতে হয়, এইভাবে একদিন বাংলাদেশ জেগে উঠবে। একাত্তরের লক্ষ লক্ষ শহীদ পুনরুত্থিত হবে। অজান্তে কাহিনী প্রতীকের দিকে তা গড়ায়। অনিবার্যভাবে প্রতীকধর্মী হয়ে ওঠে তা। তখন আলীজাঁ আর ভণ্ড পীর, ঘুষখোর আমলা আর কেতাবি কবি এক হয়ে যায়। একটি মুখ শুধু জেগে ওঠে, বীভৎস জানোয়ার, যার দিকে মায়েযর ও সন্তানের উদ্যত হাতিয়ার ক্রমে বিস্তৃত হয়।
সাতঘাটের কানাকড়ি বড় কোনো নাটক নয়, কিন্তু এই প্রতীকায়ন যখন অবধারিত হয়, মনে হয়, এর শক্তি অনেক। অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও এ যেন আমাদের তীব্র আকাঙ্খাকে ভাষা দিতে পারছে। অনেক নাটক যেখানে পিছলে যেতে পারে, ছাপানো সাহিত্য যেখানে পা দিতে চায় না সাহস নেই বলে নয়, সাহসের প্রকাশটি রপ্ত হয়নি বলে, সেখানে সাতঘাটের কানাকড়ি সদর্পে হেঁটে যায়।১৭
সাতঘাটের কানাকড়ি নাটকটি আমাদের সবলতা ও দুর্বলতার পাশাপাশি অপরাজেয় অন্য এক কথা তুলে ধরেছে। জীবন মানেই সংগ্রামের অবিচল প্রবাহ- মুক্তির দিকে, ভালবাসার দিকে। এ নাটক আমাদের বিবেকের উজ্জ্বল পথের দিশারী। আমাদের উদ্দীপ্ত করে চারদিকের হতাশা ও বেদনার মধ্যে। এ নাটক সার্থকতার পথে আমাদের চালিত করুক।১৮
সাতঘাটের কানাকড়ি সোজাসুজিভাবে একেবারে কাঠকোট্টা ধরনের রাজনৈতিক নাটক হতে পারত। তাতে নানান রকমের স্লোগান-টোগান জুড়ে দিয়ে একটা কিছু হৈ চৈ লাগিয়ে দেওয়া যেত। আমার ধারনা তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হোত বেশি। ইঙ্গিত বা প্রতীকের একটা প্রচণ্ড ক্ষমতা আছে, যা কিনা সরাসরি মানুষের বুকের মাঝে এসে বাজে। সাতঘাটের কানাকড়ি প্রতীকধর্মী নাটক হিসেবেই এসেছে। নাটকের শুরুতে ছোট্ট একটা নৃত্যনাট্য জুড়ে দেওয়ার মানে তো তা-ই। তাতেই বলা হয়েছে, বুঝহ সুজন যাহা বুঝিবার।১৯
এই নাটকে আমাদের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সব কিছুরই চিত্র স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, অতি পরিচিত সমাজের ঘৃণ্য ধিকৃত মানুষগুলোকে যেমন এই নাটকে দেখা যায়, তেমনি ভাল সজ্জনদেরও দেখা পাওয়া যায়। এক কথায় এই নাটকটি আমাদের দেশেরই চিত্র, টপিক্যাল ও পলিটিক্যাল। এত কিছুর পরেও নাটকটি দেখে ম্রিয়মান হয়ে ঘরে ফিরলাম, মন ভারাক্রান্ত হল, দুঃখে নয় হতাশায়, একজন সমালোচক নয়, নিছক দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নাটকটির ভাল দিক খুঁজতে লাগলাম কিন্তু খুঁজে কিছুই পেলাম না। নাটকের কাহিনী, বক্তব্যের উপস্থাপনা, অভিনয় কোনটির সাথেই মন সায় দিল না, তবুও নিবিষ্ট হয়ে মনের গভীরে সন্ধান চালালাম, প্রাপ্তির অকিঞ্চিৎতকরতায় নিরাশ হলাম, এতে আরো বিপদগ্রস্ত বোধ করলাম, কারণ প্রযোজনাটি ভীষণ জনপ্রিয়। এই সূত্র ধরে নাটকটির জনপ্রিয়তার প্রশ্নে মনে ধন্ধও লাগল। জনপ্রিয়তার উপাদান সনাক্ত করার চেষ্টা করে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যর্থ হলাম।২০
নাটকটির সামাজিক ও রাজনৈতিক উপাঙ্গগুলো এসেছে একেবারে যাকে বলে রানিং থিম থেকে। এই রানিং থীমগুলো মমতাজউদদীন আহমদ মঞ্চে ব্যক্ত করেছেন কোন রাখঢাক না রেখে, আপোসহীনভাবে। ঢাকার অন্যন্য মঞ্চ নাটকের মতো সাতঘাটের কানাকড়িতেও স্যাটারিক্যাল এলিমেন্ট অনেক। পার্থক্য এই যে এই নাটকে মমতাজউদদীন আহমদ দর্শকদের সঙ্গে কেবল হাসি ঠাট্টা, তামাশা করতে চাননি। গভীর মমতায় স্পর্শ করতে চেয়েছেন মানুষের মানবিক আর শ্রেয়বোধকে। এ জন্য এ নাটকে মা হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার প্রতীক, আরো খোলাখুলিভাবে বললে জন্মভূমির প্রতীক। মার ছোঁয়ায় তার সাত ছেলে যখন রুদ্র রোষে রুখে ওঠে, আ্যারিস্টটলে ক্যাথারসিস তখন আর দর্শকদের এক কঠিন নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। যেখানে দর্শকদের এক ধরনের আত্মোপলব্ধি ঘটে, তার চর্চাহীন মানবিক বোধ জাগ্রত হওয়ার অবকাশ পায়।২১
এই নাটকে দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে পচনধরা সমকালীন সমাজের চেহারা। এই চেহারা দেখে শিউরে উঠতে হয়। দোদুল্যমান দ্বন্দ্ব পীড়িত বুদ্ধিজীবী বিপথগামী অথচ প্রতিবাদী যুবক, ভ্রষ্ট শিক্ষাবিদ, নষ্ট সুবিধাবাদী ষড়যন্ত্রপরায়ন প্রবীণ কবি, দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মচারী, ভন্ডপীর, বীরাঙ্গনা মা এবং সমাজের হর্তাকর্তা বিধাতা আলীজাঁ, যিনি সর্বক্ষণ আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়েন- এরাই হলেন নাটকের কুশীলব। নাটকটি দেখার সময় আমাদের দৃষ্টিপথে ভেসে ওঠে কয়েকটি চেনামুখ। দর্শকদের প্রতিক্রিয় দেখে বুঝতে পেরেছি তারা নাটকের কুশীলবদের সহজেই সনাক্ত করতে পেরেছেন। মমতাজউদদীন আহমদ এই নাটকটি লিখে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন বলা যায়। এই প্রতিবাদী নাট্যকার হয়তো বিশ্বাস করেন- ক্ষমতার দুর্গকে আক্রমণ না করা পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তি তার পরিপূর্ণ শক্তি লাভ করে না। ডারা বুদ্ধিচর্চাকে আত্মবিকাশের উৎস বলে মনে করেন, মানব মুক্তির প্রেরণা বলে স্বীকার করেন- আপোষকামিতার পথ তাদের জন্য নয়। যত বিপদই আসুক পরিপূর্ণ বিকাশের পথ তারা কিছুতেই রুদ্ধ হতে দিতে পারেন না। এজন্যেই তারা আক্রমণ করেন ক্ষমতার পরাক্রান্ত দুর্গটিকে। কারণ, সেই দুর্গ থেকেই উদ্ভূত হয় নানা অন্যায় অবিচার, উৎপীড়ন, নিষ্পেষণ।
সূত্রতথ্য: ১.মমতাজউদদীন আহমদ, ‘নাট্যকারের কথা’, ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’, মুক্তধারা ১৯৯১, ২. পূর্বোক্ত, ৩. পূর্বোক্ত, ৪. আতাউর রহমান, ‘খবরের কাগজ’, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০, ৫. আব্দুল মান্নান, ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’, মুক্তধারা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯১, ৬. আব্দুস সামাদ আজাদ, পূর্বোক্ত, ৭. গাজীউল হক, পূর্বোক্ত, ৮. ড. কামাল হোসেন, পূর্বোক্ত, ৯. ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, পূর্বোক্ত, ১০. রাশেদ খান মেনন, পূর্বোক্ত, ১১. বেগম সুফিয়া কামাল, পূর্বোক্ত, ১২. ড. আহমদ শরীফ, পূর্বোক্ত, ১৩. বদরুদ্দিন উমর, আগামী ২৬ জুন ’৮৯, ১৪. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ‘গাছপাথর’- দৈনিক সংবাদ, ১১ জুলাই ’৮৯, ১৫. শওকত আলী, মুক্তধারা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯১, ১৬. আলী আনোয়ার, পূর্বোক্ত, ১৭. ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, সুন্দরম, ৪র্থ বর্ষ ১ম সংক্যা, ১৮. সন্তোষ গুপ্ত, মুক্তধারা, ফেব্রুয়ারী ১৯৯১, ১৯. আজিজ মিসির, পূর্বোক্ত, ২০. আতাউর রহমান ‘খবরের কাগজ’, ৬ ডিসেম্বর’৯০, ২১. কাউসার খান, ‘বিচিত্রা’, ১৮ বর্ষ, ৩০ সংখ্যা, ২২. শামসুর রাহমান, মুক্তধারা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯১।
বিপ্লব বালা : নাট্যকার, নির্দেশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের শিক্ষক।