Full premium theme for CMS
পরিবেশ থিয়েটার
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
পদবাচ্যটি কানে বাজতেই কি মনে হয়? এ কি তাহলে পরিবেশ সংক্রান্ত নাটক? বিশ্বব্যাপী আজ যে পরিবেশ সচেতনতার জোয়ার তার উপর রচিত-নির্মিত-অভিনীত? মানুষকে পরিবেশ সচেতন করাই তার উদ্দেশ্য? এমন মনে হলে দোষের তো কিছু নেই। আপাত শ্রুতিতে তাই মনে হওয়াটা সঙ্গত নয়, এটি বলা যাবে না। আসলে বিশ্বব্যাপী নাটক সম্পর্কে যে সচেতনতার ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে তারই ফেনিল উৎপাদন পরিবেশ থিয়েটার। ধারণাটি ভ্রুণ থেকে বেরিয়ে আসে দ্বিতীয় মহাসমরের পর। যুদ্ধোত্তর জীবন জটিলতা অতিক্রমের জন্যই আবশ্যক হয়ে পড়ে নতুন আঙ্গিক ও উপস্থাপনরীতি। রিচার্ড শেফনার Environmental Theatre বা পরিবেশ নাটক বলতে যা বুঝিয়েছিলেন তাতে গড়পড়তায় বিষয়টি দাঁড়ায় প্রচলিত প্রেক্ষাগৃহের বাইরে অন্যত্র নাটক মঞ্চায়ন। এ পদ্ধতিতে যেকোনো ঝঢ়ধপব বা স্থানে নাটক মঞ্চায়ন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে তাতে নাট্য পরিবেশনা সম্ভব। সে কারণেই পুরোনো গ্যারেজ, পরিত্যাক্ত অস্ত্র কারখানা, অব্যবহৃত কসাইখানা, গীর্জা ইত্যাদি নাট্যকর্মীদের হাতে পড়ে রঙ্গালয়ের মাহাত্ম লাভ করেছে। বাংলাদেশে এ ধারণা একটি ভিন্ন মাত্রা পায়। যেখানকার ঘটনা, যে পরিবেশের কাহিনী ঠিক সেখানেই নাটকের অভিনয়ে পরিবেশ থিয়েটার প্রকৃত অর্থে পরিবেশবাদী হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, এর সাফল্য পুরোমাত্রায় নির্ভর করে টীমওয়ার্ক, নাট্যকর্মীদের কর্মতৎপরতার সমন্বয় ও যথাযথ গবেষণার উপর।
পরিবেশ থিয়েটার কেবলই অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া করে তা নয়। একটি সুনির্দিষ্ট স্থানের ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক ঘটনা, চরিত্রসমূহকে সমকালীন প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে নাট্যক্রিয়া নির্মাণই পরিবেশ থিয়েটার। নির্দেশক, গবেষক, লেখক, অভিনেতৃ ও প্রায়োগিক নাট্যকলার বিভিন্ন মেধার সমন্বয়ে Improvization Method- এ পরিবেশ নাটকের রূপকল্প নির্মিত হয়। এ নাট্যমাধ্যমটি বর্তমান দর্শক মনস্তত্ত্ব ও ঐতিহাসিক বিবর্তনের যোগসূত্র আবিষ্কার করে। সুনির্দিষ্ট স্থানকেন্দ্রীক হওয়ায় নাট্যমুহূর্তগুলোও উদ্ভূত হয় একটি নির্দিষ্ট উপসংস্কৃতি থেকে। তাতে পরিবেশভিত্তিক নাটক একটি যৌক্তিক গ্রহণযোগ্যতাও পায়। সমকালীন জীবনে পুরাণ ও নৃতত্ত্বের অবচেতন প্রভাব আবিষ্কারে এ নাট্যমাধ্যম বিজ্ঞানভিত্তিক সংশ্লেষণ করে থাকে।
কোনো শিল্প সৃষ্টিই উদ্দেশ্যবিহীন নয়। তেমনি পরিবেশ থিয়েটারও কিছু উদ্দেশ্যকে ধারণ করে অগ্রসর হতে চায়:
ক) মূল প্রযোজনাকে সামনে রেখে হাতেকলমে নাট্যকর্মীদের নাট্যশিল্পের বিভিন্ন বিভাগে প্রশিক্ষণ প্রদান করা। এগুলো হতে পারে নাট্যউপাদান সংগ্রহ, পান্ডুলিপি প্রস্তুতকরণ, মঞ্চস্থাপত্য, আলোক প্রক্ষেপন, শব্দ নিয়ন্ত্রণ, আবহসংগীত, পোশাক পরিকল্পনা, সাজ-সজ্জা ইত্যাদি;
খ) স্থান বা স্পেসকেন্দ্রীক সম্প্রদায়কে (Community) চলতি জীবনে ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা;
গ) স্থানের নন্দনতাত্বিক স্থাপত্যশৈলী সম্পর্কে জনগণের ভেতর আগ্রহ সৃষ্টি করা;
ঘ) স্থান বা স্পেসে ধারণকৃত জটিল ইতিহাসভিত্তিক কাহিনী এবং সমকালীন প্রেক্ষাপটে যা আরো জটিলতর হয়েছে তা নাট্যমুহূর্তের সরল ব্যাখ্যায় উপস্থাপন করা;
ঙ) ঐতিহ্য পুরাতন নয় তা বিশ্লেষণ করা;
চ) স্পেসের নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও লোক ঐতিহ্যকে নতুন আলোকে বিশ্লেষণ করে আত্মবিশ্বাসী ভবিষ্যত নির্মাণে উদ্দীপ্ত করা। এতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়;
ছ) ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে তাৎপর্যময় স্থানকে সংরক্ষণের বিষয়ে সাধারণের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ উজ্জীবিত করা।
সৃষ্টিশীলতার দলগত নির্মাণ কৌশলই এ থিয়েটারের ভিত্তি। থিয়েটার নির্মাণের পূর্বে টীম সংশ্লিষ্ট সবাইকে কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। তাই সমাজের উপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারকারী একটি শিক্ষণ মাধ্যম হিসেবেও এ থিয়েটার ভূমিকা রাখে। যেমন:
১. স্পেসকেন্দ্রীক সামগ্রীক তথ্য আহরণে গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দলের প্রতিটি সদস্য নির্বাচিতস্থানের ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ও স্থাপনাশিল্পের নির্মাণশৈলী পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে নাট্য উপাদান সংগ্রহ, পাণ্ডুলিপি নির্মাণ এবং সুনির্দিষ্ট স্থানভিত্তিক উপসংস্কৃতি আবিষ্কারে নিয়োজিত হয়। তখন স্থান সংক্রান্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শিক্ষানবিশ নাট্যকর্মী ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। উভয়েই ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক বিবর্তন সম্পর্কিত মিথষ্ক্রিয়ায় রত হয়, যা নাট্যকর্মী ও এলাকাবাসী জনগণের মধ্যে সৃজনশীলতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে;
২. স্থানকেন্দ্রীক গড়ে ওঠা কমিউনিটি, স্থানের ইতিহাস ও নৃতাত্ত্বিক আচরণসমূহের বিষয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ প্রত্যক্ষ ধারণা এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাট্যকর্মীরা পেয়ে থাকে;
৩. ঘটনা প্রবাহের জন্য সমাজ বিকাশে ও বিবর্তনে যে দ্বন্দ্বমুহূর্ত তৈরি হয় সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে আধুনিক জীবনবোধের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এবং জনগণের ভিতর সামাজিক দায়িত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় এ নাট্যকৌশল সহায়ক শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে;
৪. ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বহিঃশক্তির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে হীনমন্যতা, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার কারণে চিন্তা চেতনার পশ্চাদপদতা থেকে উত্তরণে এ থিয়েটার প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সহায়তায় ১৯৯১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রত্ন নামের প্রথম পরিবেশ থিয়েটারটি পরিবেশিত হয়। এর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় ছিলেন বাংলাদেশে পরিবেশ থিয়েটারের পুরোধা ব্যক্তি আশীষ খন্দকার। বাঙলা ধ্রুপদ কবিতা, রাগ ছন্দে নাটকটির আঙ্গিক নির্মিত হয়েছিলো। ১৯৭১ এর বর্বরোচিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বধ্যভূমি রায়ের বাজারকে স্থানান্তর করে Re-constraction Method- এ একাডেমীর অভ্যন্তরে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
এরপর থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও একের পর এক পরিবেশ নাটক মঞ্চস্থ হতে থাকে। বোদ্ধা পাঠকের সম্যক ধারণা লাভের উদ্দেশ্যে এসব প্রযোজনা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা যেতে পারে।
ইটাবাড়ি
১৯৯১ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সহায়তায় আশীষ খন্দকারের নির্দেশনায় ঠাকুরগাঁওয়ে নাটকটি পরিবেশিত হয়। ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থিত লর্ড কর্ণওয়ালিশের সময় নির্মিত বাড়িকেন্দ্রীক এ নাটকটির আঙ্গিক লোকজসুর ও বচন সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছিলো।
কারখানা
১৯৯২ এর ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবন ও মিলনায়তনের ছাদে আশীষ খন্দকারের নির্দেশনায় এ নাটক মঞ্চস্থ হয়। এটি ছিলো মোঘল আমল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাবআমলকেন্দ্রীক বিবর্তিত ইতিহাসের সমকালীন রূপকল্প। নাট্যগবেষণার জন্য তথ্য সরবরাহ করেছিলেন ড. মুনতাসির মামুন। এ নাটকে স্পেসের এর স্থাপত্যের সাথে সংগতি রেখে মহাকাব্যিক ইতিহাসের শিল্পীত উপস্থাপনারীতি ব্যবহার করা হয়। নাটক মঞ্চায়নে সহায়তা করেছিলো ঢাকা স্কুল অব ড্রামা।
মোহাম্মদ আমিন
পরিবেশ থিয়েটারের ইতিহাসে এটি হচ্ছে মাস্টারপিস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের সহায়তায় এরই অভ্যন্তরের শুকনো পুকুরে এ নাটক পরিবেশিত হয়। আড়াইঘন্টার নাটকে কলাকুশলীসহ পাত্র-পাত্রীর সংখ্যা ছিলো ১০৬। প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত পুকুর অভ্যন্তরের চিত্রকলার বিভিন্ন ক্যানভাসের সাথে চিত্রশিল্পীর আর্থ-সামাজিক, দ্বান্দ্বিক টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে নাটকটি নির্মিত হয়। নির্মাতা আশীষ খন্দকার এতে চিত্রকলার রং ও বিমূর্ত ইমেজ, বাস্তবতার অভিব্যক্তি এবং তৎসঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক নির্মাণে প্রয়াসী হন। কাব্যিক নাটকীয় কথপোকথন, ধ্র“পদ নাট্যআঙ্গিক ও লোকজ ধারার এক সমন্বিত রূপকল্প ছিলো এ নাটক। চারুকলার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দ্বিতীয়বার এ নাটক পরিবেশিত হয় ১৬ মার্চ, ১৯৯৯।
আকালী বাতাস
খুলনার লোকউন্নয়নকেন্দ্রের সহায়তায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বধ্যভূমিতে এ নাটক নির্মিত হয়। ১৯৯২ এর ১৮ মে অভিনীত এ নাটক ছিলো লোকজসুর সমন্বয়ে নির্মিত এক শোকগাথা। ১৯৭১ সালে খুলনা শহরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডই এ নাটকের উপজীব্য।
চন্দ্রবিন্দু
দু’পর্বে নির্মিত চন্দ্রবিন্দু নাটকের মূল গবেষক ওয়াহেদ মুরাদ। বাংলা একাডেমীর সার্বিক সহায়তায় বর্ধমান হাউজে ৯৩ এর ১১ থেকে ১৩ মার্চ একটানা এ নাটক পরিবেশিত হয়। তিন ঘন্টার এ নাটকের পর্ব দুটোর নাম খাজা নাজিমুদ্দিন ও নূরুল আমিন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনভিত্তিক ঐতিহাসিক বর্ধমান হাউজকে কেন্দ্র করে নাটকের পাণ্ডুলিপি রচিত হয়। নাটকটির নির্দেশক ছিলেন আশীষ খন্দকার।
ডেট লাইন জগন্নাথ হল
লোক নাট্যদল প্রযোজিত এ নাটকের মূল গবেষক দিল রওশন শিমু ও তথ্যদাতা ড. রতন লাল চক্রবর্তী। ৭১ এর ২৫ ও ২৬ মার্চে জগন্নাথ হলে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডভিত্তিক এ নাটক মহাকাব্যিক জাতীয় শোকগাথা যা পরিবেশিত হয় জগন্নাথ হলের গণকবর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মৃত্তিকার কম্পাস
১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনে অভিনীত এ নাটকের পাণ্ডুলিপি গবেষক মীর মাসরুর জামান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তহবিল এর অর্থ যোগান দিয়েছিলো। ক্যান্টিনের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক গুরুত্বের ভিত্তিতে নাটকটি নির্মিত হয়। এতে স্থাপত্যের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর মিশ্রণে নাট্যক্রিয়া তৈরি হয়।
মবিল
এটি ছিলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর স্পনসরশীপে একটি প্রযোজনাকেন্দ্রীক নাট্যনির্মাণ। একাডেমীর অভ্যন্তরস্থ পুরোনো মটর গ্যারেজকে নাট্যনির্মাণে ব্যবহার করা হয়। ওয়ার্কশপ-শ্রমিকদের জীবনগাথা, সুখ দুঃখ এ নাটকে প্রতিফলিত হয়েছিলো।
সেই সমতটে এই জনপদে
বিক্রমপুরের চারশত বছরের ইতিহাসের আলোকে ইদ্রাকপুর কেল্লাকে কেন্দ্র করে নির্মিত পরিবেশ থিয়েটার। অনিয়মিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর একটি প্রযোজনা। ১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাসে পরিবেশিত এ নাটকে অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যা ৫০ জন। গবেষণা ও পাণ্ডুলিপি নির্মাতার সংখ্যাও একাধিক। তাঁরা হলেন আশীষ খন্দকার, মেহেদী হাসান বাবু, আরিফুর রহমান খান, গুলনার ফেরদৌস সুলতানা, প্রণব সাহা ও শুভাশীষ রায়।
এ ঘরানার উদগাতা আশীষ খন্দকার ঢাকার লালবাগের কেল্লা, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের মুজিববাড়ি, সোনারগাঁও ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনায় পরিবেশ নাট্য নির্মাণের স্বপ্নকে আজো লালন করে চলেছেন।
গোলাম শফিক : নাট্যকার, নাটক বিষয়ক প্রবন্ধ লেখক।