Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

ঢাকার মঞ্চনাটক : দর্শক-সমালোচকের মুখোমুখি ১৯৭২-১৯৯০ [দ্বিতীয় কিস্তি]

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

[লেখকের দুয়েকটি পূর্বকথন : সেই একদিন ছিল! নতুন নাটক নিয়ে ভাবনা-চিন্তা তর্ক-বিতর্কে উত্তাল দিন। স্বাধীনতারই যেন এক নান্দনিক উৎসারণ ছিল সেদিনের নাটক। সবসেরা ছেলে-মেয়েরা যুক্ত হতো নাটকে। রাজনীতি-শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে চুলচেরা আলোচনা, সমালোচনা হ’ত। নাটক কেন করা, উদ্দেশ্য কী তার, দেশ-সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক কি নাটকের? কী কাজে লাগে নাটক? কেবল কি একটা নাগরিক সৌখিন বিলাস মাত্র? ঢাকায় বসে নাটক করে কী হয়, ক’জন দেখে সে নাটক? দেশ বিশ্বের তাবৎ ভাবনা চিন্তা, সংকট-যন্ত্রণা, আতীব্র তার প্রকাশ- বিষয় ও রূপরীতির কত কত সর্ব মথিত সেই নাট্যদিন ছিল। আনন্দে উল্লাসে বিস্ময়ে মুগ্ধতায় প্রথম প্রেমেরই থরথর কম্পন বুঝিবা। নাটক দিয়ে যেন জয় করা যায় বিশ্ব- বাতাসে ফিরছিল এমনই ফিসফাস। আজ কিছুতেই আন্দাজ করা যাবে না সেদিনের সেই উন্মাতাল উল্লম্ফ, দিক্বিদিগ্ ছোটা- হৈ হৈ রৈ রৈ পাগলপারা দশা। একেক সময়ে একেক দেশে একেক বিষয় নিয়ে এমনই সব কান্ড বুঝি ঘটে। পরে কিছুতেই তার নাগাল পাওয়া যায় না। যাদু মন্ত্রের মতো, দৈব কোনো ভর করা ঘোর-বেঘোর এক দশা যেন ঘটেছিল। যৌবনের সেই পাগলাঘোড়া তারপর কবে কোথায় কখনযে উধাও হয়ে যায়, তার আর হদিস মেলে না। স্বপ্নতাড়িত চন্দ্রাহত মানুষ নিজের মধ্যে খুঁজে পায় না- কে যেন ছিল একদা, তারে ক্ষেপিয়ে মাতিয়ে দাপিয়ে নিয়ে ফিরেছিল। সোনার ফসল ফলিয়ে দিয়ে কখন যে চলে গেছে সেই নন্দননটী। কথাগুলো যতই ভাবের ঘোর, নাটুকে কাব্যিক লাগুক- অন্যভাবে যেন ঠিক ধরা যায় না সেদিনের সেই আশ্লেষ-স্পৃহা!

আজকের নবীণ নাট্যজন তার কিছু  হদিস পাবে সেদিনকার একেকটি নাটক নিয়ে নাট্যদলের ভাবনা চিন্তা আর দর্শকজনের মুদ্রিত ভাষ্য-বিবরণ পড়লে পরে। ১৯৭২ সালে ডাকসু আয়োজিত আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতা থেকে ধারাবাহিকভাবে নাট্যকার-নির্দেশক-দর্শক-সমালোচকদের লিখিত মুদ্রিত বাকবিতন্ডা একত্র করা হয়েছে। এটি একটি গবেষণাকর্ম হলেও উৎসাহী নাট্যজন এতে পেতে পারেন সেদিনকার নাট্যভাবনবিশ্ব! তাবৎ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সারাৎসার। বাস্তব অভিঘাতের সংহত স্বরূপ। আজকের এই নিরাবেগ, নির্মণন হতশ্রী দশায় তার ফলে মিলতেও পারে অন্যতর আস্পৃহা। গবেষণাকর্মটির অন্বিষ্ট অবশ্য একটু ভারী, গম্ভীর মেজাজের : বাংলা থিয়েটারে শিল্প নন্দন ও রাজনীতির সম্বন্ধসূত্র পর্যবেক্ষণ। সেটা দুই বাংলার প্রধান নাট্য প্রযোজনা ধরে করা।]

[থিয়েটারওয়ালায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রযোজনাসমূহ ঘিরে যে নান্দনিক মনন বিতর্ক বিতণ্ডা হয়েছিল নাট্যকার-নির্দেশক-দর্শক-সমালোচকদের পারস্পরিক বিনিময়ে- সেই অংশটুকু। পাঠকদের জন্য এর দ্বিতীয় কিস্তি ছাপা হলো এ সংখ্যায়।]

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়
রচনা : সৈয়দ শামসুল হক
নিদের্শনা : আবদুল্লাহ আল-মামুন
প্রযোজনা : থিয়েটার
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ :১৯৭৬

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের স্যুভেনিরে নাট্যকার জানান রচনার পরিপ্রেক্ষিত :

আমার মনে পড়ে এই কাব্যনাট্য লেখার পেছনে একটি দিনের কথা। বিবিসি’তে সংবাদে কক্ষে সেদিন দুপুর বেলায় আমি বাংলা বুলেটিন তৈরী করছিলাম। হঠাৎ একটি সংবাদে এসে থেমে গেলাম। সায়গনের প্রেসিডেন্ট থিউ আসন্ন পরাজয়ের মুখে ছুটির নাম করে দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ মনে হল ওই লোকটির অন্য এক পরিচয় আছে- সে কারো পিতা; কারো স্বামী, কারো পুত্র। আমার মনে হলো এ ধরনের চরিত্র আমাদেরও অচেনা নয়। সেই প্রেসিডেন্ট থিউকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই এবং আমার বাংলাদেশের নিকট অতীত ইতিহাস স্মরণ করেই আমি এই কাব্যনাট্য লেখায় হাত দেই।১

শুরুতে সমালোচনায় এই ভাষ্যে বিস্ময় প্রকাশ করা হয় :

থিউয়ের পলায়ন সংবাদে সঙ্গত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে মুক্তিসংগ্রামের বিজয়োল্লাস। অবশ্য ভিয়েতনামের বিজয় যাদের কাছে সায়গনের পতন তাদের কথা আলাদা। থিউকে ঘিরে সহানুভূতি উথলে ওঠার মধ্যে যে মানসিকতা প্রকাশ পায় তা এতই তরল ও বুদ্ধিবিবর্জিত আবেগসর্বস্ব যে শেষ বিচারে তা অমানবিকতার পর্যায়েই পড়ে। গোর্কী বলেছিলেন, ঘৃণা না করলে ভালবাসা যায় না। বস্তুত শ্রেণীবিভক্ত সামাজে নির্বিচার ভালবাসা কোনো ভালবাসাই নয়। আধুনিক জটিল জগতে জটিলতর শিল্পী মানসে এ ধরনের কাঁচা মানসিকতার প্রকাশ হাস্যকর। তবে পায়ের আওয়াজের চরিত্র নির্মাণে লেখকের যে দিশাহারা ভাব লক্ষ্য করা যায় তার মূল্য বোধ করি এখানেই নিহিত।২

লেখকের ঐ বক্তব্য বিস্মৃত হয়ে নাটক দেখা মঙ্গলজনক মনে করেন তাই সমালোচক। ভালবাসা ও ঘৃণার অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক বিষয়ক গোর্কির উক্তিটি উদ্ধৃত করায় সমালোচকের বিশেষ নান্দনিক মতি টের পাওয়া যায়।
নাট্যকার সমালোচকের মন্তব্যের জবাব দেন :

আমার মনে হয়, সমালোচক নাট্যাভিনয় পত্রে মুদ্রিত আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য সঠিক অর্থে গ্রহণ করেননি। আমি যখন সায়গনের পলাতক প্রেসিডেন্ট থিউয়ের উল্লেখ করি তখন তাঁকে একজন গণশত্রু বলে মনে রেখেই উল্লেখ করি। এই ব্যক্তিটির যে সন্তান আছে, এই ব্যক্তিটি যে নিজেই কারো সন্তান, এই কথাগুলো আমার মনে আসে এই জন্যে যে, আমার ধারণায় কেউ যদি এই কথাগুলো মনে রাখতো তাহলে পাশের মানুষটির ক্ষতি করা তার পক্ষে সম্ভব হত না। সেই প্রেসিডেন্ট থিউয়ের পাশাপাশি আমার দেশেও অনেক মানুষকে আমি সনাক্ত করতে পারি যাঁরা এই সহজ দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত। আর এ কারণেই প্রেসিডেন্ট থিউয়ের উল্লেখ। তাকে সমর্থন করে উল্লেখ নয়। আমার পক্ষ সমর্থন করবে আমারই নাটক, নাটকে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করা যায় যে মাতব্বর পিতা হয়েও কন্যাকে বিসর্জন দিয়েছে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে।৩

ভাষাবিভ্রাটের ঘটনাই তাহলে ঘটেছে। প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষাও যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমনকি ভিন্ন বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে বসে- সেটাও মূলত ভাষার নয় মানব মনেরই জটিলতর অক্ষমতা।

দর্শক-সমালোচকদের মতামত

দৈনিক ইত্তেফাক- এর সমালোচক বলেন :

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিয়ে রচিত একটি সার্থক নাটক ‘থিয়েটার’ তার দর্শকদের নিবেদন করবে এ প্রত্যাশা অনেকেরই ছিল। থিয়েটারের নতুন প্রযোজনা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় অনেকের প্রত্যাশা আর থিয়েটারের আন্তর আকাঙ্খা-এই দুই আবেগের যোগফল। ... এই কাব্য গীতিনাট্য আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোর সংকট, সমস্যা ও আশাকে ভাষা দিতে চেয়েছে। ... স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যখন একাংশের হতাশা, একাংশের ঋণাত্মক মানসিকতা আর আরোপিত জটিলতা প্রায় নাটককে গ্রাস করে ফেলেছে, তখন থিয়েটারের এ উদ্দীপনার নাটক বলিষ্ঠ ব্যতিক্রম। রক্তার্জিত স্বাধীনতার উপলব্ধিকে আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সঞ্চার করে দেয়া চাই। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এই দিকের পথিকৃৎ। এই নাটক নিয়ে মুক্তাঙ্গন অভিনয়ে সারা দেশে থিয়েটারের ছড়িয়ে পড়া চাই।৪

সমালোচকের এই নাটকের বিষয় এবং তাকে ব্যবহারের অভীপ্সা থেকে শিল্পের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর অভিপ্রায়ের ধরন বোঝা যায়-সরল আবেগে উচ্ছ্বসিত এই সমালোচক।

‘দৈনিক বাংলার’ সমালোচক জানাচ্ছেন অন্য কথা:

একজন দালালের জীবনের ট্র্যাজিক আখ্যান হল পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। এ দালাল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দখলদার বাহিনীর দালাল। নিজের সন্তান এবং জীবনের বিনিময়ে এ দালালির অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া গেল না। ... কিন্তু থিয়েটার আর একটি দৃশ্যের সংযোজন করে যেখানে পতাকা হাতে মুক্তিবাহিনী শপথ নেয়। এই শপথ স্বাধীনতা রক্ষার শপথ। আজ সীমান্তে সম্প্রসারণবাদী হামলা চলছে, দেশের অভ্যন্তরেও দেশদ্রোহীরা চক্রান্ত আঁটছে। মুক্তিবাহিনীর এই শপথ এই হামলা প্রতিরোধের শপথ। দেশদ্রোহীদের শায়েস্তা করার শপথ। নাটকের সঙ্গে সমসাময়িক ঘটনার একটি যৌক্তিক যোগসূত্র স্থাপন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।৫

সরকারনিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলা’ তৎকালীন (১৯৭৬) রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মুখপত্র হিসেবেই এ নাটককে দেখেছে- স্বভাবতই ১৯৭১ সালের দখলদার বাহিনীর কোনো পরিচয় দেওয়া হয়নি। নাটকটিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে ব্যবহার করবার এটা প্রচলিত এক ধরন-আরোপণের পরিচিত একটি চেহারাও এতে প্রকাশ পায়।

নাটকটি আমাদের অভিজ্ঞতারই ফসল। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এ চিত্র আমাদের সকলেরই জানা। প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জেই এ চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছি। নাটকের শেষে নিয়তির প্রতি আত্মসমর্পণ লক্ষ্য করেছি- মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রাম্য যুবক, গ্রামবাসী ও বাউলের শেষ সহায় হিসেবে চিহ্নিত। নিজেদের উন্নয়নের প্রচেষ্টা থাকলেও তারা উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। এখানে নাট্যকার ব্যর্থ হয়ে নিয়তিসর্বস্ব হয়ে পড়লেন। ৬

‘পূর্বাণী’ পত্রিকায় সমালোচক নাটকে এক নিয়তিনির্ভরতা প্রত্যক্ষ করেন মুক্তিযুদ্ধকালীন আখ্যান-পর্বে।

নাটকটির বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায় মাহমুদ আল জামানের লেখায়:

মুক্তিযুদ্ধের বৃহৎ পটভূমি, কাব্য-গীতি-নাট্যের সংবেদনশীলতা এবং গীতিময় পদ্যময়তা নাটকটির দেহে সঞ্চারিত হওয়ায় আমাদের নাট্য অঙ্গনের ধারায় এ প্রচেষ্টাটি ভিন্নতর অভিধায় চিহ্নিত করা চলে। ...পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যগীতি নাট্যে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গীতে মুক্তিযুদ্ধের অভ্যুদয়কে পটভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কাব্য-গীতি-নাট্য আমাদের জাতীয় জীবনে ইতিহাসের অন্তঃস্থিত বেদনা ও আনন্দেরই সমাচার। ... হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা এবং গ্রামের সরল মানুষের জিজ্ঞাসা, উৎকন্ঠার মধ্যে ক্লেদ ও গ্নানিতে এক মেয়ের আত্মহত্যা একাত্তরের বাংলাদেশের দগ্ধ চেতনাকে ধারণ করে আছে। এই দগ্ধ ক্ষতকে আমাদের জাতীয় মানসভ্রান্তির আলোছায়ায় নিক্ষেপ করেছে, সেখানে সৈয়দ শামসুল হক রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন নির্দেশিত এই নাটকের মঞ্চায়ন আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে একটি অনন্য সাধারণ ঘটনাই বটে। ... বাংলাদেশের নাট্য অঙ্গনে এই একটি নাটকই মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্বেদনাকে ধরে রেখেছে। নাট্য আবহে একাত্তরের জাতীয় বিপর্যয় শুধুমাত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিফলিত হয়নি, জাতীয় চরিত্রের সংকট এ নাটকে বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করেছে। ... মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি জনচেতনামূলক সার্থক নাটকের সফল মঞ্চায়ন সত্ত্বেও থিয়েটারের এ নাটকটি যেন সামগ্রিকভাবে শিল্পিত অভিধায় চিহ্নিত করা যায় না। ... কাব্য-গীতি-নাট্যের গীতিময়তা নাটকটির চেতনা আবেদন স্বভাবতই খর্ব না করে অন্তর্বেদনা ও মর্মকে প্রকাশিত করার জন্য সংলাপের এই দ্রুতগতি উচ্চারণ বারংবার একই ভঙ্গী ব্যবহার কিছুটা হলেও গীতিময় এই নাটকের আবেদনকে ব্যাহত করেছে। সংলাপ এবং বাচনে তীক্ষèতা ছিল বটে, কিন্তু তা যেন শুধুমাত্র তীক্ষèতা-তীব্রতা সৃষ্টির জন্যই। গ্রামের যুব সম্প্রদায় বারবার যখন মাতব্বরকে প্রশ্ন করছে সেখানে ভঙ্গী, বাচন এবং অভিনেতার সত্তার অভিক্ষেপণে কোনো আবেগই সৃষ্টি করে না। ভাষাকে ছাড়িয়ে ভাষা ব্যবহারের অর্থদ্যোতক কোনো বোধেই উজ্জীবিত করে না। এসব সত্ত্বেও ... এ নাটকটি বিশিষ্ট ও অনন্য ও সাংস্কৃতিক আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে উজ্জ্বল।৭

নাটকটির ঐতিহাসিক মূল্য ও কৃতিত্ব স্বীকার করেও সমালোচক প্রয়োগ পরিণতির, বিশেষ করে অভিনয় প্রকরণের সমালোচনা করেছেন- পৌনঃপুনিকতার অভিযোগ করেছেন বাচিক ও আঙ্গিক প্রকাশভঙ্গির, যাতে করে দর্শকের যথাবোধে উজ্জীবন ঘটে না। কেবল বিষয়ই যথেষ্ট নয়, তার প্রয়োগপ্রকাশ এবং দর্শককে-প্রণোদিত করাও মুখ্য বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়- সমালোচকের এহেন নান্দনিক বিবেচনা। রাজনীতি ও শিল্পের সম্পর্কে এটা নিশ্চয় একটি বড় সূত্রবিন্যাস।

নাটকটি সম্পর্কে মফিদুল হকের অভিমত হল :

সাহিত্যমূল ও নাট্যমূল্যে সমভাবে গুণান্বিত এমন আনকোরা নতুন নাটকের অভিনয় দর্শনের ভাগ্য সচরাচর হয় না ... পায়ের আওয়াজ প্রয়োজনা একটি দুরূহ ও দুঃসাহসী প্রচেষ্টা। নাটকের পাঠক-দর্শক মাত্রেই এটা স্বীকার করবেন। ... নাটকের কাহিনী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। নিকট অতীতের এই মহত্তম সংগ্রাম ও বর্বরতম পাশবিকতার স্মৃতি যখন দেশবাসীর একাংশে লোপ পেতে শুরু করেছে তখন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায রচনা-প্রযোজনা অত্যন্ত সময়োপযোগী বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু এই তাৎক্ষণিক লাভটুকুই সব নয়, শিল্পসিদ্ধির জোরেও পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকের শ্রেষ্ঠত্বের আসন দাবী করতে পারে। এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন আরেক কারণে সম্ভব হয়েছে, সেটি আমাদের জন্য গ্লানিকরও বটে। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা দেশের জনমানুষকে বিপুলভাবে আলোড়িত করলেও সাহিত্যে এর প্রতিফলন দৈন্য পীড়িত। এই দৈন্য নাটকের ক্ষেত্রে প্রায় শূন্যতার পর্যায়ে। সেক্ষেত্রে শক্তিমান কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক কাব্য নাটকের আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধের একটি পর্ব ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা নিয়ে সকলের সৎসঙ্গ সাধুবাদ লাভের পদক্ষেপ নিয়েছেন। ... আঞ্চলিক ভাষায় রচিত পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় সংলাপ কথ্যভঙ্গীর বিশিষ্টতা এবং লোক-জীবনভিত্তিক উপমার সার্থক প্রয়োগে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ গ্রামের সোঁদা মাটির গন্ধ-বহা এই সংলাপ-মাধুর্যের অজস্র উদাহরণ তুলে ধরা যায়।৮

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ‘মহত্তর সংগ্রাম ও বর্বরতম পাশবিকতার স্মৃতি’ বিস্মৃত হওয়ার এবং সাহিত্যে ও নাটকে তার প্রতিফলনের দৈন্যই পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটক রচনা ও মঞ্চায়নের বড় কৃতিত্ব- সমালোচকের এই বিবেচনা শিল্পের রাজনীতি ও দেশ-কাল সম্পর্কিত দায়বোধের নান্দনিক অবস্থান চিহ্নিত করছে; নাটকটির সাহিত্য ও শিল্পগুণ সেক্ষেত্রে অধিক গৌরববহ।
ইংরেজি দৈনিক 'OBSERVER'-এর সমালোচক বলেন :

The plot is a simple one, but very skillfully handled, There are only a few central characters, in fact, just there is a group of villagers who play a major role both structurally and thematically ... there's melodrama in the play but its convincing and theatrically effective. The situations and characters are true to life ... what distinguishes Haq's play in the combination of realistic manner with a certain degree of rich imaginative flavor ... 'The sound of foot steps' how ever, tells a realistic story with genuine poetic flashes in the dialogues. The similes and metaphors are drawn from the familiar would of the rural people and yet with touches of poetry that produces a telling effect. Had sometimes brings inallusions from folk literature, religious lures and myths that have a hint of the stirrings of the collective unconscious of the village people that feature in his play. ... For its poetry, its social content, its realism and for the high quality of acting. The sound of footsteps will, I am sure be widely acclaimed by the theatre-goes of Bangladesh. I wish it could be performed in open stage and not merely in Dacca but all over the country.

OBSERVER-সমালোচকও সারাদেশে খোলা মঞ্চে এই নাটক অভিনয়ের কথা বলছেন। কাহিনীর বাস্তবিকতা প্রকাশে কাব্যরীতির শিল্পসম্পন্নতা, ভাষায়-প্রতীকে-রূপকে জনমানসের যৌথ অবচেতন ভাণ্ডার আহৃত অনুষঙ্গে এই নাটক সুপ্রযোজিত- সকলেই প্রায় কমবেশি একই রকম বলছেন। ‘সংবাদ’- পত্রিকায় ‘অনিরুদ্ধ’ বাংলাদেশের তৎসাময়িক সংকটবোধ থেকে লিখছেন:

স্বাধীনতা যুদ্ধে লাঞ্ছিত লাখ লাখ মা বোনের প্রতীক হিসেবে এই নাটকের মেয়ের চরিত্র প্রতিনিধিস্থানীয়। ... সমগ্র নাটকটিতে রয়েছে ইতিহাস চেতনার ধারা। ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতি ধিক্কার আর সাধারণ সরল-ধর্মভীরু মানুষের মানবতাবোধের উজ্জীবন। এ নাটকের সরল-সহজ বক্তব্যের মধ্যে ’৭১ সালের শেষদিকের অভিজ্ঞতাকে দর্শক আবার নতুন করে যাচাই করে নিতে পারবেন। কোনো পূর্ব পুরুষের অভিজ্ঞতার কাহিনী নয়, আপন মনের কাছে সংশয়দীর্ণ চেতনার কাছে নতুন উজ্জীবনমন্ত্র গ্রহণ; জীবনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার নামই ধর্ম। এই বিশ্বস্ততা বিসর্জন দিয়ে ধর্ম অন্তঃসারশূন্য বুলি। আত্মস্বার্থ উদ্ধারের সহজ সোপান। ঈমান শুধু গরীবের আর ধনসম্পদ বড়লোকের এখতিয়ার এমনটি নৈবনৈবচ।

রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় সমালোচকের অবস্থান গ্রহণ- শিল্পকর্মের এই অনাচার উৎসাদনে ভূমিকার রাখবার দায় আছে বলে মনে করেন তিনি। শিহাব সরকারের মতে :

Mr. Haq's play tells us of an universal issue, that of truth on the point of being engulfed by even advancing charm of the evil force. The playwright speaks this keeping the theme on a local perspective. For this purpose he made use of the people of Bangladesh their experiences during the war of liberation of 1971..১১

শিহাব সরকার দেখি একেবারে অন্য কথাই বলছেন- সর্বজনীন সত্য প্রকাশ করতেই নাট্যকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করেছেন; অথচ বেশিরভাগ সমালোচক তা মনে করেননি। অপসৃয়মান স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জীবন ঘটাতে এ নাট্যরচনা এমনই তাদের প্রতীতি- বর্তমান সমালোচকের নিকট যা অবলম্বন মাত্র, মৌল প্রণোদনা নয়। নাট্য প্রয়োগের সামান্য সমালোচনাও করেছেন তিনি :

Except the songs Mr. Mamun all through the play left marks of superb directorial capability. From the point of commercial success the songs may be excused but as the question is standard production, their effectiveness lies in dispute. Especially the prolonged dance (!) sequence in the final scene at times appears to be a threat to the plays unhindered flow retained so meticulously from the first dialogue. ১২

নানা দৃষ্টিভঙ্গিগত আলোচনা-সমালোচনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-প্রণোদিত নাটক হিসেবে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় একটা সর্বজনীন স্বীকৃতি পেয়ে যায়।

m~Î Drm: 1. w_‡qUvi, Ôcv‡qi AvIqvR cvIqv hvqÕ, my¨‡fwbi 1976, 2. gwd`yj nK, Ôw_‡qUv‡ii ¯§iYxq cÖ‡hvRbv cv‡qi AvIqvR cvIqv hvqÕ,wPÎvjx 14Rvbyqvwi 1977, 3. wPÎvjx, 11 †deªæqvwi 1977, 4.Ôw_‡qUv‡ii gyw³hy×wfwËK ewjô bvUK cv‡qi AvIqvR cvIqv hvq,ˆ`wbK B‡ËdvK, 9 wW‡m¤^i 1976, bMi ms, 5. ÔbvU¨ mgv‡jvPbvÕ,ˆ`wbK evsjv, 9 wW‡m¤^i 1976, bMi ms, 6. Kvq‡Kvev` wgjb, Ôw_‡qUv‡ii bvUK cv‡qi AvIqvR cvIqv hvqÕ, c~e©vYx, 30 b‡f¤^i 1976, 7. gvngy` Avj Rvgvb, Ôgyw³hy‡×i bvUK: cv‡qi AvIqvR cvIqv hvqÕ,ˆ`wbK msev`, 3 †cŠl 1383, bMi ms, 8. gwd`yj nK, Ôw_‡qUv‡ii ¯§iYxq cÖ‡hvRbv cv‡qi AvIqvR cvIqv hvqÕ,wPÎvjx 14Rvbyqvwi 1977, 9. `Bangladesh Observer’, 7 January 1977,10.ˆ`wbK msev`, 6 ‡deªæqvwi 1977, bMi ms, 11. `The Bangladesh Illustrated weekly’, 3 July 1977, 12. Ibid

দেওয়ান গাজীর কিস্সা
মূল রচনা : বের্টল্ট ব্রেশট
রূপান্তর ও নির্দেশনা : আসাদুজ্জামান নূর
প্রযোজনা : নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৭৭

‘নাগরিক’ কর্তৃক প্রকাশিত দেওয়ান গাজীর কিস্সা-র স্যুভেনিরে নাটকটি সম্বন্ধে জানানো হয়:

গল্প নয় ঘটনা প্রবাহ। একটি দরজার দুটো দিক। দরজার এধারে দেওয়ান গাজী, গাজীপুরের জোতদার, এন্তার টাকার মালিক, প্রচন্ড মদ্যাসক্ত। মাতাল অবস্থায় ভদ্দরলোক, নেশা ছুটে গেলে কুত্তার বাচ্চা। লাইলী- দেওয়ান গাজীর একমাত্র মেয়ে এবং দেওয়ান গাজীর বিত্তের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নিরঙ্কুশ স্বার্থপর। এখন এমন, তখন তেমন, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। নফর আলী দারোগা- গাজী নির্বাচিত হবু জামাই। বাহ্যতঃ ক্যাবলাকান্ত, দিনভর কেবল ফিলিমের গপ্পো আর টাকা পয়সার গন্ধে চুক্ চুক্। নিজ স্বার্থে বাপের গলায় ছুরি বসাতে দ্বিধাহীন।

মোক্তার- গাজীর গেলাসের ইয়ার এবং আপামর গাজীদের সকল ইয়ারদের মতই, গাজীর উচ্ছিষ্টতেই সন্তুষ্ট। এধারে আরো আছে চেয়ারম্যান আর কাজী। লোভ, বিত্ত, সংহারের জীবন্ত মূর্তি। দরজার ওধারে আছে মাখন। আগে রিক্সা চালাতো, এখন দেওয়ান গাজীর খাস বেয়ারা। ক্লাস থ্রি অবধি পড়েছে। চেহারা সুরত ভালো। মনটা ভালো, আর একটা খাঁটি মানুষের বাচ্চা।

সকিনা, দেওয়ান গাজীর বাড়ির কাজের ছুড়ি। মায়ের নাম কুলসুম। বাপের নাম কেউ জানে না। দেওয়ান গাজীও হতে পারে। ওর জীবনে কোনো সাধ আহ্লাদ নেই। কেবল মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে- সব বিছু ভেঙে চুরে গুঁড়িয়ে দেয়া যায় না?

চামেলী, লতা, কুসুম- শরীর বেঁচে পেট চালায়। ওদের চাওয়া নিতান্ত সহজ-সরল। পেট পুরে খেতে পাবো তো? একটু ভালো মন্দ কাপড়-চোপড় দেবে তো? শান্তিতে ঘুমুতে পারবো তো? আর আছে ঝান্ডা পার্টির আবেদ এবং মজুরের দল। ওদের জীবনের ফিলসফি- মরাকে মরার ভয় দেখিয়ে আপনাদের ফায়দা কি? এ ছাড়া এক গোঁয়ারগোবিন্দ সূত্রধর- মাঝে মধ্যেই মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে এমন সব কথা বলে যে, নিশ্চিন্তে- নির্বিঘেœ দুধে-ভাতে লালিত আমাদের পিলে চমকে দেয়।

মাঝের দরজাটা মাঝে মধ্যে একটু ফাঁক হয। তখন দেওয়ান গাজী নেশায় টই-টুম্বর। আর ঐ ফাঁক দিয়ে মাখন, সকিনা, চামেলী, লতা, কুসুম দেওয়ান গাজী নামে মানুষটার সাক্ষাৎ পায়। মনে আশা জাগে ... কিন্তু এ-তো হবার নয়। মাঝের দরজাটা যে বড্ড মজবুত আর দেওয়ান গাজীর নেশাটাও যে ক্ষণস্থায়ী।১

‘চিত্রালী’ পত্রিকায় নাটকের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন উপলক্ষে নির্দেশক ও রূপান্তরকারী এক সাক্ষাৎকারে নাটকটির পরিচ্ছন্ন বিনোদন ও জোরালো বক্তব্য বিষয়ে বলেন :

নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত নাটক দেওয়ান গাজীর কিস্সা’র নির্দেশক ও অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম পঞ্চাশতম প্রদর্শনীর প্রেক্ষিতে নাটকের কোন দিকটা দর্শককে বেশী আকর্ষণ করেছে?

উত্তর:
দেওয়ান গাজীর কিস্সা নাটকের মূল আকর্ষণ হলো এর বক্তব্য। সহজ উপস্থাপনা বিশেষ করে নাটকের বক্তব্য নির্মল হাস্যরসের মধ্যে দর্শকের কাছাকাছি চলে গেছে। পরিচ্ছন্ন বিনোদন আছে এ নাটকে। কিন্তু বিনোদনের মাঝে যে জোরালো বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা সমাজের চেনা চেহারাকে প্রতিফলিত করে। একটি ভাল ছবি যেমন দর্শক বার বার দেখে, তেমনি নাটকের বক্তব্য যদি দর্শককে আকৃষ্ট করে সে নাটকও একাধিকবার দর্শক দেখে। দেওয়ান গাজীর বেলায়ও তাই হয়েছে।২

নাটকটির দ্বিশততম মঞ্চায়ন অনুষ্ঠানে ‘নাগরিক’ মুদ্রিত স্মরণিকায় আতাউর রহমান দেওয়ান গাজীর কিস্সা’র নাট্যকার সম্বন্ধে লেখেন- ‘প্রধানত খাঁটি শিল্পী গভীর সমাজ ও রাজনীতি চেতনা জীবন ও শিল্প পরস্পর সম্পর্কিত তাঁর নাট্য বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য :

ব্রেশটের নাটক ও তাঁর উপস্থাপনা আঙ্গিক নিয়ে নানা বিতর্ক ও তত্ত্বের বুলি প্রায় শোনা যায়। তাঁর এপিক থিয়েটার, বিযুক্তিকরণ পদ্ধতি, মার্কস- লেনিন মনস্কতা, পোলিটিক্যাল থিয়েটারের প্রতি আনুগত্য, নাটকে জুড়ে দেয়া প্রস্তাবনা ও উপসংহার ইত্যাদি নিয়ে দেশে বিদেশে নাট্যকর্মীরা চায়ের কাপে তুফান তোলেন। ব্রেশটের নাটকের প্রযোজনা কতটুকু ব্রেশ্টীয় হল, তিনি কতখানি এ্যারিস্টোটলিয়ান থিয়েটারের বিরুদ্ধে, কতখানি স্তানিস্লাভস্কির পক্ষে- এসব নিয়েও বাগ- বিতন্ডার অন্ত নেই। এই সব তত্ত্ব কথা ও ব্যাকরণের বেড়াজাল ভেদ করে যে সত্যটি বড় হয়ে দাঁড়ায় তা হল- ব্রেশ্ট হলেন দেশ, কাল ও ভৌগলিক সীমারেখার ঊর্ধে বিশ্বমানবের শিল্পী। শিল্পীকে জীবন ও জগতকে জানতে ও জগত বিষয়ে ব্রেশ্ট ছিলেন অনেক বেশি অগ্রণী। তিনি বিশ্বাস করতেন গভীরভাবে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন না হলে কোনো শিল্পীই দেশের জন্যে, মানুষের জন্যে কোনো অর্থবহ কাজ করতে পারেন না। সেই কারণেই নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক হিসেবে ব্রেশ্টকে একেবারে আলাদা করে চেনা যায়। তবে গভীর সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে ব্রেশ্টের নাটক বা নাট্য প্রযোজনাকে প্রপাগান্ডা, পোস্টার বা বক্তৃতাধর্মী মনে করলে ভুল হবে। তিনি প্রথমত ও প্রধানত একজন খাঁটি শিল্পী এবং তাঁর সৃষ্টি হিসেবে ঋজুভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর নাটক ও প্রযোজনার বিশ্বজনীনতার কারণে।৩

দর্শক-সমালোচকের মতামত

বাংলাদেশের নাট্যভাবুক কবীর চৌধুরীর মতামতও মুদ্রিত হয় স্মরণিকায় :

আধুনিক নাটককে বের্টল্ট ব্রেশটের মত এত বিপুল উদ্দীপনাময় ও সৃষ্টিশীলভাবে আর কেউ প্রভাবিত করেননি। তাঁর নাট্যকর্মের বৈপ্লবিক সংগ্রামী উপাদান, জীবনঘনিষ্ঠতা, ইতিহাসবোধ ও মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ যেমন দর্শক- পাঠককে আকৃষ্ট করে, তেমনি আকৃষ্ট করে তাঁর ব্যতিক্রমী নাট্যতত্ত্ব, বিযুক্তিকরণ বা এলিয়েনেশন নামে যা সুপরিচিত, এবং তাঁর এপিক থিয়েটারের নাট্যকৌশল। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য উভয় নাট্যজগতেই তাঁর নাটক, মূলে কিম্বা অনুবাদে, শুধু ব্যাপক হারে পঠিতই হয় না, গভীর অনুসন্ধিৎসা ও উৎসাহের সঙ্গে অভিনীত ও আলোচিত-বিশ্লেষিতও হয়। স্বাধীনতা- উত্তর বাংলাদেশের নব নাট্যান্দোলনে ব্রেশটের সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে। এ প্রভাব যেমন তাঁর বেশ কয়েকটি রূপান্তরিত অনূদিত নাটকের সফল মঞ্চায়নের মধ্যে তেমনি আমাদের একাধিক নাটকের রচনা ও পরিবেশন কৌশলের মধ্যে লক্ষ্যণীয়। ...

অল্প বয়স থেকেই ব্রেশটের স্বাধীন চিন্তাশক্তি বিকশিত হয় এবং সমকালীন বৈপ্লবিক ডামাডোলের পরিবেশে তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, বিশ্লেষণপ্রবণ দৃষ্টিকোণ এবং দরদী চেতনা তাঁকে মার্কসসিজমের প্রতি আকৃষ্ট করে। তবে তিনি কখনোই নিজেকে কোনো গোঁড়া মতবাদের বজ্রকঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে দেননি, যদিও এজন্য তাঁকে মাঝে মাঝে কম্যুনিষ্ট ও অ-কম্যুনিষ্ট উভয় শিবির থেকেই তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হয়। ...

তিনি গোঁড়ামিকে কখনো প্রশ্রয় দেননি, না বক্তব্য উপস্থাপনের সময়, না প্রযোজনার ক্ষেত্রে আঙ্গিক- কৌশল প্রয়োগের সময়। তাঁর কল্পনার শক্তি ছিল যেমন বিস্তৃত, মঞ্চভাষার উপর নিয়ন্ত্রণও ছিল তেমনি নিপুন ও সহজাত। তাঁর নাট্যকর্মকে একই সঙ্গে শিল্পগুণ সমৃদ্ধ ও সমাজ পরিবর্তনে লক্ষ্যে ফলপ্রসূ হাতিয়ার পরিণত করার জন্য ব্রেশট বহু স্থান থেকে বহু কিছু গ্রহণ করেছেন, কিন্তু সবই তিনি আত্মস্থ করে নিয়েছেন অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে।৪

গোঁড়ামিমুক্ত, শিল্পসমৃদ্ধ ও সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে ফলপ্রসূ হাতিয়ার তাঁর নাটক- সমালোচকের এই হল বিবেচনা।

‘পূর্বাণী’ পত্রিকায় নাট্য সমালোচনায় বলা হয়:

মালিক যদি হতে চাও, নিজের মালিক নিজে হও, নইলে যে ভাই পাওনা তোমার মিলবে না। পাওনা যদি পেতে চাও পাওনা তোমার বুঝে নাও, নইলে যে ভাই পাওনা তোমার মিলবে না।

নাগরিকের প্রাক্তন ও বর্তমান প্রযোজনা যথাক্রমে সৎ মানুষের খোঁজে ও দেওয়ান গাজীর কিসসা’র মূল সুর এই-ই।

বলা যায়, দেওয়ান গাজীর কিসসা’য় প্রভাবশালীদের হাতে নির্ধনদের বঞ্চনার রূপটি যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বলে রাখা ভালো, আলোচ্য পল্পের পুরোপুরি বিস্তার না থাকলেও ঘটনাপ্রবাহ ও চরিত্রের বুনন- সব মিলে একটা কাহিনীর অবয়ব নিয়েছে- যেখানে ব্রেখ্ট বিশ্বস্ততার সাথে উঠে এসেছে- সাধারণ দর্শকরাও খুশী হয়েছে- নাগরিক নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে মাইলপোষ্ট হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে।

‘হলিডে’ পত্রিকায় শ্রেণী সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে নাটকটির বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। তাতে বিশেষ এক রাজনৈতিক শিল্পবিচার প্রত্যক্ষ করা যায়:

History reveals that the struggle for existence of mankind is two-fold-the struggle against natural calamities and the class struggle among themselves. Class struggle is the struggle between the contesting classes. These classes may be divided into two distinct clases- the oppressors and oppressed. In certain classics attempts were made and are being made to misinterpret the concept of class struggle by showing union of two distinct classes as a solution to this truggle. The only conclusion to the class struggle is the defeat or the oppressors and the establishment of the rule of the oppressed masses. Dewan Gazir Kissa (The Story of Dewan Gazi) that 10th production of Nagarik Natya Sampraday deals with class conflict and shows that there is an invisible barrier between two distinct classes which neither of the classes can cross. Gazi has a two fold character-remains stiff with all the qualities of an oppressor when normal and acts as a humanitarian in a drunken mood, this representing the universal character of pseudo-leaders of society.

The apparent behavior of pseudo-leaders has been shown in the gentle behavior of a drunk Gazi while the egocentric activity of the normal Gazi exposes their real face. The two faces of Dewan Gazi actually reprs 'sent the only face of an oppressor of all ages that appers with various looks. Makhon, the servant of Gazi, belongs to the class of oppressed. The oppressor with his two-fold behavior balances the impact of oppression and reduces the internal combustion of the oppressed. In this way the demands are suppressed, and radical change are delayed. But finally the conscience of the masses is inspired to rebellion.

We notice only the slogans and dialogues disclosing the desire of the oppressed class to change the system but no violence against the oppressors take places. The violence has not been taken into consideration because the playwright's object of interest is the pre-revolution perspective of society and therefore, he has simply indicated the forthcoming revolution.

Without visual violence the director has more or less successfully created the impression of forthecoming violence in the viewers' mind in the final sequence and as a result finally the viewers leave the hall with due seriousness and with-out any felling of perversity. Directly challenged are the normas of our existing social senses by the irrational dialogues thrown by the different characters of the play. The evaluation of the play in the context of society reveals that the play is actually a mirror which reflects the reaity, the typical characters belonging to two distinct class or our society and class struggle between two classes.

দেওয়ান গাজীর কিসসা’র হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে ‘পূর্বাণী’ পত্রিকায় নাগরিক- এর তৎকালীন সভাপতি জিয়া হায়দার এবং সম্পাদক আতাউর রহমান দলের শিল্পাদর্শ ও দায় সম্বন্ধে বলেন- নাগরিক নাটক প্রযোজনায় বিচিত্রতায় বিশ্বাসী। নাগরিক সভাপতি জিয়া হায়দার এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, যেকোনো ভাষাতে অথবা যেকোনো নাট্যকারের রচনা হোক না কেন- ভাল নাটক দেশ-কালের ঊর্ধে; নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। বিশেষ কোনো মতবাদ বা দর্শনে নাগরিক বিশ্বাসী নয় বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো বিশেষ ধরনের নাটকে আমাদের আগ্রহ শূন্য। আমাদের লক্ষ্য- দেশী বা বিদেশী ভাল নাটক এবং সেটা ভালভাবে উপস্থাপন করা।

নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় অব্যবসায়িক ভিত্তিতে সৎ ও সুস্থ নাট্যচর্চা গড়ে তোলায় বিশ্বাসী। নাগরিকের বিশ্বাস নাটক হল মানুষের জীবনের অত্যন্ত কাছাকাছি এক শক্তিশালী বেগবান জীবননিষ্ঠ ও মংগলময় শিল্পকর্ম এবং এই শিল্পের প্রতিষ্ঠায় ও প্রসারে নাগরিক আন্তরিকভাবে সচেষ্ট।

নাগরিক সম্পাদক জনাব আতাউর রহমান এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা লক্ষ্য রাখতে চেষ্টা করেছি, দর্শকরা যেন নাটকে আনন্দই লাভ না করেন, তাঁদের সংস্কারাবদ্ধ ও সীমিত রুচির যেন উন্নতি হয়। শখের দর্শক যেন উন্নীত হয় চিন্তাশীল দর্শকে। আতাউর রহমান বলেন, আমরা সচেষ্ট থাকি- যেন আমাদের নাটক হয় জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন। অবশ্য সে জীবনের স্বরূপও ব্যাখ্যা আমাদের নিজেদের অন্যের ধারণা বা ব্যাখ্যার সঙ্গে তা নাও মিলতে পারে। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের কার্যক্রমের মধ্যে ঢাকার বাইরে এবং বাংলাদেশের সর্বত্র গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।৭

বিশেষ কোনো মতবাদ- দর্শনে বিশ্বস্ত নন তাঁরা, দেশকাল ও ভৌগলিক সীমার বাইরে ভাল নাটক ভালভাবে অভিনয় করতে চান, তার ফলে রুচির প্রগতিতে শখের দর্শক পরিণত যেন হতে পারেন চিন্তাশীল দর্শকে। কেবল আনন্দদান লক্ষ্য নয় ‘নাগরিক’-এর। নান্দনিক অবস্থানের একটা চরিত্র স্পষ্ট হয় এভাবে।

দেওয়ান গাজীর কিসসা’-এর শততম মঞ্চায়ন উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নাটকটি নিয়ে একটি সেমিনার ও মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে নাগরিকের পক্ষ থেকে দেওয়ান গাজীর কিস্সা’র নির্দেশক আসাদুজ্জামান নূর ও অভিনেতা আলী যাকের প্রশ্নোত্তরে অংশ নেন। ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়- তাতে নাটকটি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নান্দনিক অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। বের্টল্ট ব্রেশট ছিলেন বিপ্লবী পরিবর্তনের সংগ্রামী সৈনিক। বিপ্লবের চারণ কবি। ব্রেশটীয় আঙ্গিক নিয়ে কলাকৌশল নিয়ে যতো কুয়াশাময় আলোচনা হয়েছে, বিষয়বস্তু নিয়ে ততটা নয়। ব্রেশটের পরিচয় তার নাট্যবস্তুতে। এই মূল কথা মনে রেখে নাগরিক ব্রেশটীয় নাটকের রূপান্তর দেওয়ান গাজীর কিস্সা’ মঞ্চায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। আধাসামন্তবাদী সমাজে লোভের বিশাল বিস্তার দেওয়ান গাজী। ... নাটকের পটভূমিও সামন্তবাদী সমাজ। চরিত্রগুলোও মূলানুগ। পারস্পরিক দ্বন্দ্বমুখর। ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিভূ। মঞ্চসজ্জায়, আলোকসজ্জাতে ও প্রয়োগ ব্যাপারে ব্রেশটীয় নির্দেশ অনুসরণ করা হয়েছে। ব্রেশটের নাট্যতত্ত্বের পরিচয় জানা থাকলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। নাট্য প্রযোজনা যদি বিষয়বস্তুর সঠিক রূপায়ন, তবে নাগরিকের দেওয়ান গাজীর কিস্সা’র প্রযোজনা ব্রেশটীয় নাট্যধর্মের অনুগত। গত সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত নাগরিকের দেওয়ান গাজীর কিসসা নাট্য প্রযোজনা সম্পর্কে একটি সেমিনারে এই নাটকের নির্দেশক ও অনুবাদক জনাব আসাদুজ্জামান নূর উপরের কথাগুলি বলেছেন। মূল আলোচনার পরে প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করেন সর্বজনাব আতিকুর হক চৌধুরী, ম. হামিদ, মাসুদ আলী খান, ও মুস্তাফা আনোয়ার। আলোচকদের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দেন নাগরিকের পক্ষ থেকে জনাব আলী যাকের।

জনাব আতিকুল হক চৌধুরী বলেন: স্বাধীনতার ভালো উপহারের অন্যতম মঞ্চের নাটক। দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখার প্রয়াসের উদ্যোক্তা নাগরিক ধন্যবাদার্হ। তবে, দেওয়ান গাজীকে মাঝে মাঝে পশ্চিমী কোনো কেতাদুরস্ত ক্যাপিটালিষ্ট মনে হয়, গাঁয়ের পরিচিত মানুষ নয়। বারবণিতার উপস্থাপনার ষ্টাইল আকর্ষণীয় তবে কোনো উদ্দেশ্য তাতে পরিষ্কার নয়। অনেকটা যেন চকোলেটের কোটিং- এ অ্যালকোহল লাগে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে সেক্স ও সোসিয়ালিজম একসাথে চলতে পারে না। চলা উচিত না। লাকী খানের নাচ ও সুকান্তের কবিতা যেমন এক সাথে চলতে পারে না। যা এই নাটকে আছে তা প্রোগ্রেসিভ কমার্শিয়াল টার্ম। নাগরিকের মতো উজ্জ্বল নাট্যকর্মীদের কাছে যা কাম্য নয়। কম্প্রোমাইজ নয়, টোটাল কমিটমেন্ট চাই।

দেওয়ান গাজী কিসসাতে বাঘের গর্জন আছে তার প্রতিবাদে সিংহের উপস্থিতি নেই। এই প্রসঙ্গে জনাব আলী যাকের বলেন : ব্রেশটের নাটকে বাঘ গর্জায়, নাট্যকার সিংহকে আহবান করেন দর্শকদের মধ্যে। সমাজের মধ্যে পোস্টার নাটক থেকে বাঘ-সিংহের সম্পর্কের ব্রেশটের নাটক আলাদা বলে আমরা মনে করি। সমাজতন্ত্র নির্বীর্ষ দর্শন নয়। সেক্স থাকবে না হয় সমাজতন্ত্র থাকবে এমন হতে পারে না। বারবণিতার উপস্থিতি প্রতীকী। তারাও মজুর। দেহ বিক্রি করে। আমরাও দেহ বিক্রি করি। শ্রম বেচি। এদেশে বারবণিতার অব্যক্ত। বিদেশে তাদের ফোরাম আছে। সমিতি আছে। প্রসঙ্গটি মূল নাটকেও আছে। এখানে অন্য প্রেক্ষিত। আমরাও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি টোটাল কমিটমেন্টে। তাছাড়া কোনো শিল্পই বাড়তে পারে না। আমরা অনেক বাধা-নিষেধের মধ্যে কাজ করি।

জনাব ম. হামিদ বলেন : ক্ষুধার জ্বালা বইয়ে পড়ে জানা, অনুভব করার মধ্যে পার্থক্য আছে। নাটকের প্রযোজনায় তা লক্ষ্য করা গেছে। অভিনয়ে শোষকদের কৌশল এসেছে শোষিতদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি পড়েছে। দেওয়ান গাজীর চরিত্রও বিপরীতধর্মী। মাতাল অবস্থায় ভাল মানুষ। সচেতন অবস্থায় দমনশীল। এটা বক্তব্য বিরোধী। সত্য বিরোধী। প্রযোজনায় বিশ্বাস ও প্রকাশের এই বৈপরীত্য দুর্বলতার দিক। যা বিশ্বাস করি না তাই নিয়ে নাটক করবো? নাগরিকের কাছে এই প্রশ্ন।

এই প্রসঙ্গে জনাব আলী যাকের বলেন : আমরা পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন। মঞ্চ সমাজের দর্পণ। সেই চিত্র দেখে সমাজ বদলাবার কাজ সমাজ সংস্কারকের নাট্যকর্মীর নয়। মূল নাটকে পন্টিলা মদ খেলে রঙ্গিন চশমা ধারণ করত। মানুষ সচেতন থাকলে আসল রূপ বেরিয়ে আসে। মদ এখানে রূপক। বর্তমানে আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নাটককে নিয়মিত শিল্প মাধ্যম করে তোলা। তারপরই এটি হাতিয়ার হয়ে উঠবে। অনিয়মিত হলেই এটি বিনোদন মাধ্যম।

জনাব মাসুদ আলী খান জানতে চান, দেওয়ান গাজীকে শারীরিকভাবে পঙ্গু দেখানো হয়েছে - এটি মূলে আছে কি না। পঙ্গু না দেখালেই ভালো হত। এই প্রসঙ্গে জনাব আলী যাকের বলেন- মূল নাটকে পন্টিলা পঙ্গু ছিলেন না। এটা নিজস্ব সংযোজন। অবক্ষয়ী সমাজকে পঙ্গু দেখানো হয়েছে।

জনাব মুস্তাফা আনোয়ার বলেন- কনটেন্টের দিক দিয়ে ব্রেশটের নাটক দুর্বল। এই কনটেন্ট নিয়ে প্রচুর নাটক হয়েছে। শিল্পের তিন দিক। কনটেন্ট। এক্সপ্রেশন। ডেকোরেশন। ব্রেশটে এই ত্রিভুজের সমন্বয় ঘটেছে। নাগরিকের প্রযোজনায় ডেকোরেশন কিছু অতিরিক্ত হয়েছে। সস্তা প্রশংসা পাবার জন্যে আঙ্গিক সম্পর্কে ভুল ধারণার জন্যেই এটা হয়েছে। মঞ্চে সিম্বলিক সেট। দরিদ্রতার লক্ষণ। সেটে, আলোয় বহু কিছু করার আছে। এখন যে পর্যায়ে নাটক এগুচ্ছে তাতে কোনোরকম ম্যানেজ করা আর চলবে না। জনাব আলী যাকের এ প্রসঙ্গে মঞ্চসজ্জার ব্যাপারে আর্থিক সংগতিহীনতার কথা মেনে নিয়ে বলেন যে শিল্পকলা একাডেমী সাহায্য না করলে মঞ্চায়নে সেটে আলোর ব্যবহারে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।

আলোচনাপর্বের শেষে প্রশ্নোত্তর পালায় উপস্থিত শ্রোতাদের প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাস্যের উত্তর দেন নাগরিকের পক্ষ থেকে দেওয়ান গাজীর কিস্সার নির্দেশক জনাব আসাদুজ্জামান নূর।৮

বিশিষ্ট সমালোচক ধরণী ঘোষ দেওয়ান গাজীর কিসসা’ নাটকে রূপান্তর ও নির্দেশনায় এক দ্বৈততা, দ্বৈধ প্রত্যক্ষ করেন- মূলের হুবহু অনুসরণ এবং স্বকীয়তার পুনর্বিন্যাস করার ক্ষেত্রে। তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন নাটকটির প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্বের চরিত্র ও ঘটনাক্রম অনুসারে :

One reason why major international directors like Peter Brook, Luca Ronconi or Jerzy Grotowski avoids Brecht is that his plays have to be staged on his own terms. The only other ‘Permissible’ (one of Brecht's favourite words) approach consists in doing the exact opposite of what he has done, a procedure exemplified by Brecht himself while transforming John Gay's . The Begger's Opera into The Three penny Opera. This is the secret of Jabbar Patel's (and P.L Deshpande's) success in the Theatre Academy's (Pone) Tin Paisacha Tamasha. In Dewan Gazir Kissa, Presented as part of the Bohurupee festival at the Academy of Fine Arts on May 2, Asaduzzaman Noor or Nagarik (Dhaka) falls between the two stools of acceptance and rejection.

This version of Mr. Puntila and his Man Matti is a rollicking farce till the intermission, comparing not unfavourably with Sekhar chatterjee's memorable Pontu Laha and making, as always happens when Brecht's text suffers very few distortions, all the necessary political points. Of course, the Mukhtiar (Judge) does not slip drunkenly off his chair or, waking up, rings a nonexistent bell. Dewan Gazi-Puntila is spared crashing his Studebaker into a telegraph pole. Chameli lacks the verve of Sly-Grog Emma, an inevitable consequence of cutting her lines Dewan Gazis two fiancees (The Telephonist has been serapped)- Lata (Chemist's Assistant) and Kusum (Milkmaid) - are not given rings off a curtain rod to serve as engagement rings. There is no ‘hiring fair’ skene to show Dewan Gazi outbidding a fat ‘capitalist’ over labourers' wages and mere narration of the event hardly sharpens the contrast with Dewan GAZI acting true to his class character when sober, Unlike Eva haughtily accespting suggestions from Mati to infuriate the Attache, Leili almost throws herself into Makhan's arms: neither do they play cards while making erotic noises for the police inspector's benefit. For all these debatable innovations, however, the basic fable emerges with commendable clarity and is what Brecht prizes most in theatre.

In the second half, Noor unaccountable introduces psychological motivation. The inspector threatens to kill Makhan and frame Dewan Gazi in a murder case if Leili declines to marry him, Noor does not seem to know the Brecht would not take his own daughter Barbara into the berliner Ensemble until she could cook meat broth well, or else Leili would not have been so casual about the tests to prove her eligibility as a poor man's wife. The rebuff to Dewan Gazi's fiancees, who wanted no more than a decent meal, is equally devoid of poignance. Noor gains little by sacrificing the strange poetry of Nocturne (Puntila and Matti making water in the yard at night) and by keeping Dewan Gazi on the groand while the old sozzler rhapsodizes about ‘the sky, the laks, the people and the forests’. Even if it would not have been practicable to kick a grandfather clock and a gun locker to pieces, and to use the wreckage together with a number of chairs to build Mount Hatelma on top of a big billiard table, surely Dewan Gazi could have stood on a chair on top of a table, the most devastating blow comes in the end when Sakina (a combination of the cook Laina and the parlourmaid Fina) delivers a Shen Testyle tirade against social oppression. Compared to this bit of politicization, the garrulous Sutradhar and the ‘Communist’ touch to Abed (Red Surkkala) are minor irritations.

Noor’s directorial vagaries are all the more regretable because Ali Zaker’s Dewan Gazi and Nima Rahman’s Leili (a marvellous contralto) vrovide object lessons in serious chowning, Abul Hayat’s poker face sets off Makhan’s dry wit. The dancing one the other hand, is rather amateurish and the incidental music appears to have been borrowed from Tin poisar pala.

ব্রেশ্ট নিয়ে প্রচলিত বিতন্ডা ও দৃষ্টিকোণ এবং নান্দনিক অবস্থানসমূহ দেওয়ান গাজীর কিসসা নাটকের সূত্রেও উঠে এসেছে। দেওয়ান গাজীকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশে ‘ব্রেশট’ নিয়ে নানা নান্দনিক অবস্থান প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।

m~Î Z_¨: 1. ÔbvMwiKÕ Ô‡`Iqvb MvRxi wKmmvÕ my¨‡fwbi 1977, 2. Avmv`y¾vgvb b~i, (mv¶vrKvi), wPÎvjx, 30 gvP© 1978, 3. AvZvDi ingvb, Ô‡eªkU †`‡k †`‡kÕ, Ô‡`Iqvb MvRxi wKm&mvÕ-wØkZZg gÂvqb ¯§iwYKv, 4. Kwei †PŠayix, Ô‡eªkUÕ c~‡e©v³, 5. Ô‡`Iqvb MvRxi wKmmvÕ, c~e©vYx 13 A‡±vei 1977, 6. Amit K. Bhattacharjee, `Portrait of Society’, `HOLIDAY’, 26 March 1978,7. Ô‡`Iqvb MvRxi nxiK Rqš—x Ges bvMwiKÕ, c~e©vYx 20 RyjvB 1978, 8. Ô‡m· I †mvkvwjRg GK m‡½ Pj‡Z cv‡i bvÕ, wPÎvjx 8 AvM÷ 1978, 9. Dharani Ghosh, ‘The Politics of boozing by’, The Statesman 18 March 1991.

শকুন্তলা
মূল রচনা : কালিদাস
রূপান্তর : সেলিম আল দীন
নির্দেশনা : নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুু
প্রযোজনা : ঢাকা থিয়েটার
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৭৮

শকুন্তলা নাটকের প্রচারপত্রে বলা হয় :

পৌরাণিক মহাভারতের শকুন্তলাকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থিত করা হয়েছে, সম্পূর্ণ নতুন সমস্যা, জটিলতা ও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে তাকে। ... সৌন্দর্য-বিলাসী সংস্কৃত সাহিত্যের কবি কালিদাস শকুন্তলাকে সহজেই বেছে নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কবি কালিদাস হয়তো ভেবেছিলেন, অপ্সরার কন্যা মানবিক অবয়বে কী অপূর্ব দৃষ্টান্ত হতে পারে সৌন্দর্যের!

কবিগুরু গ্যেটের জীবনে শকুন্তলা এনেছিলো আলোড়ন। শকুন্তলার প্রশস্তিতে লেখা একটি অবিস্মরণীয় কবিতাও আছে গ্যেটের। যাতে তিনি মর্ত্যরে ও স্বর্গের একীভূত এক অত্যাশ্চর্য রূপ দেখেছিলেন। কিন্তু স্বর্গ ও মর্ত্যরে মিলনের দৃষ্টান্ত শকুন্তলা কিভাবে হতে পারে? যার জন্ম বিশ্বামিত্রের তপস্যাভঙ্গে, স্বর্গ ও মর্ত্যরে বিরোধে, তার জীবন দ্বন্দ্বহীন গল্প হয় কি করে? কালিদাস আর গ্যেটে শকুন্তলার মধ্যে কেবল সৌন্দর্য আর মিলনই দেখেছেন, বিরোধকে নয়; আমরা এই বিরোধকে প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের শকুন্তলা এই বিরোধ প্রত্যক্ষকরণেরই ফল।১

পুরাণ-কহিনীকে নব তাৎপর্য দানের প্রণোদন থেকেই নির্মিত শকুন্তলা।

নাট্যকার সেলিম আল দীন শকুন্তলা বিষয়ে তাঁর অভিমত জানান :

শকুন্তলা নাটকে আমি শকুন্তলার জৈবিক সমস্যাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর এই মানুষ যে অমর সৌন্দর্যের সাধক তার দেহও নশ্বর। মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। তবু সে অমরতার সাধনা করে। এভাবেই মানুষের মনে গড়ে উঠেছে স্বর্গের ধারণা। এই ধারণাকেই আমি শকুন্তলার মধ্য দিয়ে উপস্থিত করার চেষ্টা করেছি। আমি আঙ্গিকে অধিকরতর ক্লাসিকনিষ্ঠ। শকুন্তলাও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। ... আমার মনে হয়, শকুন্তলা নাটকে ‘রিয়ালিজমকে’ ন্যাচারালিজম-এ বিস্তৃত করতে ব্যর্থ হয়েছি।২

নির্দেশকও স্পষ্ট করেন তাঁদের দৃষ্টিকোণ :

পুরানো শকুন্তলাকে আমরা বর্তমানকালের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। কালিদাস শকুন্তলার অলৌকিক লাবণ্য ও প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে এক করে দেখাতে চেয়েছেন। স্বর্গ ও মর্তের মিলনে যে শকুন্তলার জন্ম, সে কেবল অপরূপ সৌন্দর্যের দৃষ্টান্তই হতে পারে, তা নয়। বরং তার ভিতরে বিরোধই প্রধান হওয়া উচিত। এই বিরোধকে সেলিম প্রত্যক্ষ করেছেন।৩

দর্শক-সমালোচকদের মতামত

‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় সমালোচক মাহমুদ শফিক নাটকটির নব-অভিপ্রায় ব্যাখ্যা করেন। শকুন্তলার মানস- বিরোধের ভিতরকার দ্বন্দ্বময় ঐক্য অনুধাবন করতে পারেননি নাট্যকার বলে মত প্রকাশ করেন :

শকুন্তলাকে মহাভারতে যেভাবে অঙ্কন করা হয়েছে, সে শকুন্তলা কালিদাসে নেই। কালিদাসের শকুন্তলাকে আবার নবতর মূল্যবোধে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন তরুণ নাট্যকার সেলিম আল দীন। কালিদাস শকুন্তলাকে অঙ্কন করেছেন সৌন্দর্যের উপমা হিসেবে। আর সেলিম আল দীন শকুন্তলার জন্ম যন্ত্রণাকেই প্রবলভাবে দেখেছেন। কালিদাস শকুন্তলার ভেতরে যে ক্লাসিক সৌন্দর্য অঙ্কন করেছেন তা সেলিমের নাটকে নেই। না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ সমাজ ও সামাজিক মূল্যবোধ পাল্টিয়েছে। আর আধুনিককালে প্লটের স্থান অধিকার করে নিয়েছে পর্যায়ক্রমিক ভিশন। তাই কালিদাসের সময়ের ক্লাসিক শকুন্তলা এ যুগে অসম্ভব। শকুন্তলার খণ্ডিত এলোমেলা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সেলিম আল দীন যে মানুষের চেহারা মূর্ত করে তুলতে চেয়েছেন সে মানুষ একক মানুষ। একক বলেই আত্মবিচ্ছিন্নও বটে। শকুন্তলার আসল সংঘাত নিহিত তার আত্মদ্বন্দ্বের ভেতরেই।

মেনকা স্বর্গের অপ্সরা। বিশ্বামিত্র মর্তের মানুষ। আর শকুন্তলা তাদেরই কন্যা। স্বর্গ একটি কনসেপ্ট। আর মর্ত হচ্ছে বাস্তব। বাস্তব পৃথিবীতে সেলিম শকুন্তলাকে উপস্থিত করেছেন একজন রুগ্ন মানুষ হিসেবে। তাই শকুন্তলার সঙ্গে পৃথিবীর যে বিরোধ, তার উৎস মানুষ নয়, তার জন্মগত যন্ত্রণা। জরাজীর্ণ নিঃসঙ্গ মানুষের উৎপ্রেক্ষা (হাইপোথেটিক্যাল মেটাফর)। নিঃসঙ্গ রোগীর পক্ষে নিজের আরোগ্য ভাবনা ছাড়া আর কিছু কাম্য হতে পারে না। শকুন্তলাও এর ব্যতিক্রম হতে পারেনি। শকুন্তলা পৃথিবীর যে দিকে তাকিয়েছে সেখানে শুধু রুগ্নতাই দেখেছে। উপলব্ধি করেছে নিজের যন্ত্রণাকে। আর অসহায় মূল্যবোধ মানুষের ভেতরে যে স্বর্গের ধারণার জন্ম দিয়েছে, শকুন্তলার কাছে তা উপস্থিত হয়েছে সত্য হিসেবে। বাস্তব পৃথিবী ও স্বর্গের কনসেপ্টকে শকুন্তলা এক সঙ্গে মেলাতে পারেনি। আর পারেনি বলেই মৃত্যু ছাড়া তার জন্য দ্বিতীয় কোনো আরোগ্য পথ ছিল না। শকুন্তলার ট্রাজেডীও এখানেই। আর এভাবেই মূর্ত হয়ে উঠেছে শকুন্তলা নাটকে স্বর্গ ও মর্তের বিরোধ। এই বিরোধের মধ্যে যে ঐক্য মূর্ত রয়েছে সেলিম তা অনুধাবন করতে পারেননি। তাই এ নাটকের বিষয়বস্তু দ্বান্দ্বিক হয়েও এন্টিথিসিসের কাজ করেছে।৪

দ্বন্দ্ব বিরোধের ঐক্যপ্রশ্নে একটি নান্দনিক অবস্থানই লক্ষিত উপর্যুক্ত সমালোচনায়। ‘সাপ্তাহিক রোববার’ পত্রিকার প্রতিবেদক অবশ্য শকুন্তলার নাট্যকার- নির্দেশক প্রদত্ত ‘স্বর্গ ও মর্তের এই অসীম বিরোধই শকুন্তলার ট্র্যাজেডি’ ৫ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন।

রাজা রহমানও ‘বিরোধের’ ব্যাখ্যান বিস্তারিত করেন আখ্যান বর্ণনে; পুরাণকে ধ্বংস করে নব পুরাণ সৃষ্টির জন্য অভিনন্দিত করেছেন নাট্যকারকে :

কালিদাস খুঁজে পেয়েছিলেন শকুন্তলার জীবনের পূর্ণতা। তার জীবনের মিলনমধুর রূপকে অপরূপ দেখেছেন তিনি। আর ঢাকা থিয়েটার শকুন্তলার জীবনের বিরোধকে আবিষ্কার করেছে। বিরোধ স্বর্গের সাথে পৃথিবীর। শকুন্তলার জন্ম স্বাভাবিক নয়। স্বর্গ আর মর্ত্যরে বিরোধে যার জন্ম তার জীবন নির্বিরোধ হয় কি করে। এই যুক্তিতে প্রায় হাজার বছরের শকুন্তলার জীবন কাহিনী বদলে গেল। অরণ্যে পাখী ডেকেছিল, ফুল ফুটেছিল। সে ফুলে মালা গাঁথা হয়েছিল-দুস্মন্ত আসেনি। জন্মটাই যার বানানো গল্পের মত তার জীবনে দুস্মন্ত না আসাটাই স্বাভাবিক। অনামিকা কিংবা কনিষ্ঠা আভরণহীন দেখে কোনো কথা কি তার মনে জেগে ছিল! না। মানুষকে ভালোবাসতে শেখেনি শকুন্তলা। ঘৃণার উচ্চারণে সে বলেছে- ‘মানুষ, ছিঃ ঘেণ্না! তারা এক পেট বমি নিয়ে স্বর্গের গান করে’। হরিণের ছিন্নভিন্ন লাশ তার কানে কানে এই কথা বলেছিল বুঝি।

... তার জনক সেই হতভাগ্য বিশ্বামিত্র একবারও কি ঋষির বিভা নিয়ে তাকে বলেনি- ভালোবাসতে শেখ মেয়ে, মানুষকে ভালোবাসো। বলেনি অথবা শুনতে পায়নি শকুন্তলা। স্বপ্নের ঘোরে ছিল। মেনকা স্বর্গের নীল নটী তার জননী, তাকে সাথে নেয়নি অথচ মিছেমিছি বারবার তাকে স্বর্গের লোভ দেখিয়েছে। তার ধমনীতে নীল রক্তস্রোত। এই কথা ভেবেছে সে। আকাশের দিকে মুখ তুলেছে, দুঃখ পেয়েছে আর দুঃখ দিয়েছে মানুষদের। বিশ্বামিত্র, হতভাগ্য গেরুয়াবসনধারী- তপস্যার জোরে যে স্বর্গ জয় করতে চেয়েছিল, স্বর্গের জল থেকে, তৃণ থেকে মানুষের মঙ্গল এনে দেবে বলেছিল। শকুন্তলার ঘৃণায়, ধিক্কারে সে অন্ধকার হয়ে গেলো। হায়- এই কি মানুষ জন্ম! ...

নাটকের সূত্রধার সেই দৃশ্যকল্পের পাশে এসে বললেন- স্বর্গের প্রতারণা বার বার এইভাবে মেনেছে মানুষ। নিদ্রা ও ক্ষুুধা ভুলে সে করেছে নক্ষত্রের গান। অবিনাশী শ্লোক গান শ্লেষ্মা গান হয়ে গেলো- তারপর কি বেঁচে থাকে মানুষের জন্যে।...

শকুন্তলার পুরাণ ধ্বংস ও পুরাণ নির্মাণের প্রশ্নটি জটিল। এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একটিও বাংলা নাটক সম্ভবত লেখা হয়নি। মেঘনাদবধ কাব্যের রাবণকে পুরাণ থেকে তুলে, ভেঙে নতুন নির্মাণ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন। সেলিম আল দীন শকুন্তলা রচনায় সেই পুরাণ ভাঙার ও নির্মাণের রীতি ফলো করেছেন।৬

শকুন্তলার নবজন্ম ঘটেছে বিংশ শতকে- এই অভিমত পোষণ করেও এক সমালোচক নাটকে শকুন্তলার মৃত্যু না দেখিয়ে তার বিদ্রোহী স্বরূপ প্রকাশ করলে যুক্তিযুক্ত হ’ত বলেছেন :

সেলিম আল দীন এখানে শকুন্তলার নতুন মূল্যায়ন করেছেন। মহাভারতের শকুন্তলা সেলিম আল দীনের লেখায় বিংশ শতাব্দীতে নবজন্ম লাভ করেছে। তার নাটকে দুটি পর্ব। প্রথম পর্বে শকুন্তলার জন্ম কাহিনী। এবং দ্বিতীয় পর্বে শকুন্তলার জীবন। প্রথম পর্বে নাট্যকারের ভাষায়, শকুন্তলার জন্ম অসময়োচিত। শকুন্তলার জন্মকে দেখানো হয়েছে স্বর্গের ষড়যন্ত্র হিসেবে। এই ষড়যন্ত্র পৃথিবীর মানুষকে প্রতারণার জন্যে। যড়যন্ত্রের ভেতরে যার জন্ম সে স্বাভাবিক এবং সুস্থ হতে পারে না দাবী করে শকুন্তলাকে ব্যাধিগ্রস্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে দ্বিতীয় পর্বে। কিন্তু নাটকের শেষে রয়েছে অপ্রত্যাশিত পরিণতি - শকুন্তলার মৃত্যু।

শকুন্তলাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি বিভিন্নভাবে দেখেছেন। এদের প্রায় সবাই শকুন্তলার সৌন্দর্যকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। শকুন্তলার সৌন্দর্যে কবিরা মুগ্ধ হয়েছেন। সেলিম আল দীন সে ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেছেন।

পৌরণিক কাহিনীর নবমূল্যায়ন সাহিত্যের ইতিহাসে নতুন ঘটনা নয়। নবমূল্যায়নের প্রেক্ষিতে চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ভিন্নতর করেছেন অনেকে। কিন্তু জীবিত ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করা বা মৃতকে জীবিত করা অযৌক্তিক বলে মনে করছেন অনেকে। এতে স্টান্ট থাকে কিন্তু সিনসিয়ারিটির অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শকুন্তলার মৃত্যু কাব্যিক সৌন্দর্য বিনষ্ট করেছে। যে মূল্যায়ন অর্থাৎ স্বর্গ মর্ত্যরে বিরোধ যাকে ওপরতলা আর নীচতলার দ্বন্দ্ব বলা হচ্ছে তাকে বোঝানোর জন্য
শকুন্তলার মৃত্যু অনিবার্য ছিল না। তাছাড়া এই মূল্যায়নকে স্পষ্ট করে তোলার জন্যে বিদ্রোহী শকুন্তলা দেখানোই হতো বেশি যুক্তিগ্রাহ্য।৭

নান্দনিক অবস্থানের ভিন্ন ধরন নবমূল্যায়নের ব্যাখ্যান- বিষয়ে স্পষ্ট।

‘হলিডে’ পত্রিকার সমালোচকের মতে- আত্মদ্বন্দ্বাতুর শকুন্তলার মৃত্যু দ্বন্দ্বের স্বাভাবিক বিকাশের পরম্পরারহিত, বেঁচে থাকলে ভিন্নতর দ্বন্দ্বের প্রাকৃতিক সম্ভাবনা থাকতো- একই দ্বন্দ্বের পুনরাবৃত্তির বিপরীতে। তিনি শকুন্তলার দ্বন্দ্বস্বরূপে বিংশ শতকের মধ্যবিত্তশ্রেণীর স্বভাব প্রত্যক্ষ করেন :

The story of Shakuntala has been handle since the age of "Mahabharat" by many poets, novelists and playwrights. The first successful adaptation was probably made by the great poet Kalidas and it was made in sanskrit. Later Shakuntala appeared in Bengali and also influenced foreign poets like Goethe. In this way Shakuntala crossed the barriers of time and territory and became international classic. This time, in Selim al-Deen's creation Shakuntla has come out of its traditional domain of early concepts as metaphor of beauty and tenderness. The plywright has directly challenged those early concepts and boldly attempts to establish the character of Shakuntala as the symbol of frustration resulting from irreconcilable contradictions ...

And Selim-al-Deen traces out the inherent in conflict of Shakuntala which, according to him, must be the reality. The playwright's logic is that the outcome of a conflict could never exist without a conflict in itself. Throughout the play he sincerely attempts to clarify and establish this logic ...

The birth of Shakuntala establishes the theory of natural dialectics. But the death of Shakuntala at the end of the play again contradicts such a theory. It seems that the play itself is an outcome of conflict of reciprocal thoughts. It seems that the play itself is an outcome of conflict of reciprocal thoughts. If Shakuntala would remain alive only then the possibility of the emergence of a new thing (may be a new problem which need not be shown) could flash the theory of natural dialectics.

The conflict of the heaven and the earth is eternal. What is this heaven and what is this earth? The playwright distinguishes the heaven and the earth into two distinct classes in the context of 20th century. Here is the basic difference between Shakuntala of Kalidas and the play under discussion. The character of Shakuntala has been established as an individual hanging in between the heaven and the earth, seeking the mercy of the heaven which she considers to be her own domain. This symbolizes the general characteristic of the middle class which is the cross product of upper and lower classes. In order to destroy the revolutionary spirit of the lower class and in between class emerged as a result of conssiracy of the upper class, the first part of the play produces such a philosophy. The second part shows how the in between class behaves. This in between class is termed as the middle class of 20th century. On the other hand Kalidas portrayed Shakuntala from a completely different angle. The evaluation of Shakuntala in the context of present age is worthwhile but it is unwise to overthrow the concept of Kalidas ... The new evaluation of Shakuntala has more or less sucessfully the claim that 'A myth is recreated to destroy a myth'.

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণের নান্দনিক দৃষ্টিকোণ সমালোচনায় সূচিত।

স্বর্গের চিরন্তন আধিপত্যকামিতায় মানুষের অসহায় ট্রাজেডি লক্ষ্য করেন আরেক সমালোচক :

অপ্সরা কন্যা শকুন্তলার মাঝে সৌন্দর্যপিপাসু কবি কালিদাস ও গ্যেটে দেখেছিলেন এক অত্যাশ্চর্য রূপ; কিন্তু মহিলা সমিতি মঞ্চে ঢাকা থিয়েটার শকুন্তলার মাঝে দেখেছে এক প্রচন্ড বিরোধ।

এ বিরোধ মূলত স্বর্গ ও মর্ত্যরে চিরন্তন বিরোধ। মহামুণি বিশ্বামিত্র তপস্যার বলে স্বর্গবাসীদের আধিপত্যকে পরাভূত করতে চেয়েছিলেন। সেই তপস্যা যখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে, তখন বিশ্বামিত্রকে পরাস্ত করতে বিচলিত দেবরাজ ইন্দ্র নারদকে দিয়ে ষড়যন্ত্র আঁটলেন। বিশ্বামিত্রের তপস্যাভঙ্গ করতে এলো স্বর্গের অপরূপ অপ্সরী মেনকা। স্বর্গের ষড়যন্ত্র সফল হলো- বিশ্বামিত্রের ঔরসে মেনকার গর্ভে জন্ম হলো শকুন্তলার।

মর্ত্যে ফেলে যাওয়া মেনকা- কন্যা শকুন্তলা বড় হলো গৌতমীর মাতৃস্নেহে এবং অনসূয়া, প্রিয়ংবদার সাহচর্যে। নাটকের কাহিনীতে এরপরই নাট্যকার প্রত্যক্ষ করেছেন মানব সমাজে প্রতিপালিত শকুন্তলার মাঝে বিরোধের। স্বর্গ ও মর্ত্যরে বিরোধে যার জন্ম তার জীবন দ্বন্দ্বহীন হতে পারে না। লাবণ্যময়ী সুন্দরী অপ্সরা কন্যা শকুন্তলার বয়ঃসন্ধিক্ষণে দেখা দেয় এক দুরারোগ্য ব্যাধি। মাথা ব্যথার সময় তার গা থেকে বের হয় স্বর্ণচাঁপার গন্ধ। এই ব্যাধি সূত্রেই শকুন্তলা নিজের জন্ম পরিচয় জানার পর তার মাঝে মূর্ত হয়ে ওঠে সেই বিরোধ। একটা নতুন চেতনা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে ঘৃণা করতে থাকে মর্ত্যরে মানব জীবন। তার ধিক্কার জাগে পচনশীল মানব জীবনবৃত্তের উপর। সে স্বর্গমুখী হয়ে পড়ে। নক্ষত্রের নেশায় সে স্বর্গের দিকে হাত বাড়ায়। মানবকুলের সমস্ত øেহ- মমতা অস্বীকার করে শকুন্তলা কল্পনার জাল বুনে তার জন্মদাত্রী তাকে উদ্ধার করবে এই নোংরা মর্ত্য থেকে। কিন্তু স্বর্গ থেকে কোনো নীল পাখা আসে না তাকে উদ্ধার করতে। ‘স্বর্গের প্রতারণা বারবার এই ভাবে মেনেছে মানুষ।’ তাই স্বর্গমুখী মানবী শকুন্তলার আর্তি শুধুই আর্তনাদ- ‘কেবলি কানামাছি, কেবলি অন্ধকার ...’।৯

চিন্ময় মুৎসুদ্দী শকুন্তলা নাট্যের পরিণতিকে গতানুগতিক বলেছেন; দ্বন্দ্বের বিকাশ অন্য মাত্রায় নিয়ে যায় না শকুন্তলাকে এই বলে। ‘প্রগতিশীল সাহিত্য’ সৃষ্টির জীবন-মূল্যবোধ অনুপস্থিত তাই। স্বর্গকে প্রত্যাখ্যান করে পরাজিত করার দৃঢ়তা অপ্রকাশিত :

কিন্তু শকুন্তলার দ্বন্দ্বে নতুন বস্তুর বিকাশ কই। দ্বন্দ্বের সংঘাতে জন্ম হয় নতুন বস্তুর। কিন্তু বস্তুর বিনাশ ঘটলে আর থাকে কি? গতিশীলতা আসবে কিভাবে? শকুন্তলা মরে গিয়ে একটি আখ্যানের পরিসমাপ্তি ঘটায়। স্বর্গের ষড়যন্ত্রে যার জন্ম, স্বর্গ যাকে উপেক্ষা করল, সেই শকুন্তলা স্বর্গের প্রত্যাশায়, স্বর্গের একজন হওয়ার বাসনা নিয়েই প্রাণত্যাগ করল। নাটকের বিষয় হিসেবে এতে অসঙ্গতি নেই। কিন্তু “প্রগতিশীল সাহিত্য” সৃষ্টির জন্যে যে জীবন ও মূল্যবোধ দরকার সে তো এখানে অনুপস্থিত। গৌতমীর একটি মাত্র সংলাপ (এই বুকে যা কিছু আছে ... সেইখানে ভালবাসা অমর) তার ইঙ্গিত থাকলেও শকুন্তলার ড্রামাটাইজেশনের মধ্যে সেটা স্পষ্ট নয়, তলিয়ে যায়।

আমরা দেখলাম এই নতুন শকুন্তলাও স্বর্গের মোহের কাছে পরাজিত। ‘উপরতলায়’ উঠে সে তৃপ্তি পেতে চায়। কালিদাসের নির্বিরোধ অপ্সরা শকুন্তলার সঙ্গে মৌলিক তফাতটাই কোথায়? সেই শকুন্তলা রাজা দুস্মন্তকে বিয়ে করে সব কিছু ভুলে সুখী হয়েছিল আর এই শকুন্তলা ব্যক্তি সুখের লোভে মৃত্যুর মাঝে নিজের বিনাশ ঘটালো। প্রাচীন পুরাণ থেকেই জানা যায়, পৃথিবীর প্রতি তার মানুষের প্রতি স্বর্গের এবং স্বর্গের বাসিন্দাদের ঘৃণা চিরকালের। পৃথিবী আর স্বর্গের সংঘাত তাই বহুকালের। ১৯৭৮ সালেও আমরা দেখলাম স্বর্গের প্রতি পরিহাস, ধিক্কার মাঝে মাঝে উঠলেও এই সংঘর্র্ষে জয় হল শেষ পর্যন্ত স্বর্গের। শকুন্তলা এবারও পৃথিবীকে ভালবেসে স্বর্গের মোহ পায়ে মাড়িয়ে তার প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ নিতে চাইল না।

ঢাকা থিয়েটার শকুন্তলা নাটক প্রযোজনা করে দুটো কারণে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। প্রথমত: প্রতিষ্ঠিত একটি ধারণাকে নাট্যকার সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন। দ্বিতীয়ত: ঢাকার মঞ্চে ক্লাসিকধর্মী নাটকের মঞ্চায়ন কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এছাড়া সম্প্রতি যেভাবে গালাগালি, গান ও বেশ্যার চরিত্র প্রাধান্য বিস্তার করছিল তার থেকে দর্শকদের একেবারে বিপরীতে নিয়ে গেল ঢাকা থিয়েটার। এটা প্রয়োজন ছিল। তাদের এজন্যে প্রশংসা করতে হয়।১০

শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্কের বিশেষ নান্দনিক দৃষ্টিকোণ লক্ষ্য করা যায় উপর্যুক্ত সমালোচনায়।

‘আযাদ’ পত্রিকায় বাংলাদেশি ইসলামি জোশ উদ্বেলিত- যার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্টতর :

জনাব কালিদাস যে শকুন্তলা পয়দা করিয়াছিলেন, তাহা হইতেছে একখানি ক্লাসিক। কাব্যমাধুর্যে, অনুভূতি প্রকাশের মুনশিয়ানায় এবং আওরত ও প্রকৃতির খুবছুরত বর্ণনার কারুকার্যে তাহার শায়েদ দুছরা কোনও মিছাল নাই। লেকিন জনাব সেলিম আল দীন উহার এইছা হাজামত করিয়াছেন যে, ঐ ক্লাসিক্যাল খাছিয়ত একেবারে আব্বাজান-আব্বাজান বলিয়া ডাক ছাড়িয়া পলাইয়া গিয়াছে। ঐ নাটকের দুছরা খাছিয়ত হইতেছে হিন্দু ধর্মবিশ্বাস, হিন্দু পৌরাণিক কারবার, হিন্দু পরিবেশ এবং হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান। জনাব সেলিম আল দীন এই খাছিয়তটি বহাল রাখিয়াছেন।

এবং এই নাটকগুলি অভিনয় করা হইতেছে বাংলাদেশে। যে দেশের অধিকাংশ বাসিন্দা হইতেছে তৌহিদবাদী মুসলমান। যাহারা এক আল্লাহ ছাড়া দুছরা কোনও দেব-দেবী অথবা মুনি অপ্সরা মানে না, এবং এই তৌহিদবাদ যাহাদের মুলুকের দস্তুরে ইজ্জতের সহিত লিখিয়া রাখা হইয়াছে। যাহাদের জিন্দেগানির সহিত কলিকাতা, গড়ের মাঠ, গঙ্গার ধার, অথবা বিশ্বামিত্র, মেনকা, তপোবন অথবা কোনও কিছুরই কোনও তায়াল্লুকাত নাই।

এই মুলুকের নাটকে এই মুলুকের তসবির থাকিবে, এই মুলুকের বাসিন্দাদের ঈমান-আকিদা সামাজিক পরিবেশ ও রোজানা জিন্দেগানির ইশারা আলামত থাকিবে, ইহাই তো হইতেছে মামুলি দস্তুর। লেকিন সেই দস্তুরের খেলাপ করিয়া গায়ের মুলুকের দুছরা কিছিমের ঈমান-আকিদার তসবির তুলিয়া ধরা হইতেছে কেন? কোন মতলবে? আমরা যখন বহুত রোজ আগে ঐগায়ের মুলুক এবং ঐ দুছরা তমদ্দুন হইতে ফারাগাত হইয়া নিজেদের একটি আলাহিদা তমদ্দুন-ওয়লো আজাদ কওম হিসাবে কায়েম হইয়াছে, তখন ফিলহাল আবার সেই দুছরা আকিদার তমদ্দুনকে আমাদের তমদ্দুন বলিয়া চালাইবার কোশেশ করা হইতেছে কেন? কাহাদের স্বার্থে? এই নাটক জামাতগুলি শায়েদ ধরিয়া লইয়াছেন যে, আমরা পাকিস্তান হইতে ফারাগত হইয়াছি বলিয়া সেই ১৯৪৭ সালে যে হিন্দুস্থান হইতে ফারাগত হইয়াছিলাম তাহাও এখন বাতিল-বরবাদ হইয়া গিয়াছে। লেহাজা এখন এক দেহে এক প্রাণ এসো গাই শামগান বলিয়া তান ধরিতে আর কোনই বাধা নাই। লেকিন এই কিছিমের চিন্তাভাবনা তাহারা যদি সত্যই করিয়া থাকেন, তাহা হইলে তাহারা বহুত গলত কাম করিয়াছেন।

বাংলাদেশ আজাদ হওয়ার পরপরই তৎকালীন মালিক মোখতারদের লেবাস-পোশাক, আখলাক-খাছিয়ত এবং খাসা করিয়া-ধর্মরিপেক্ষতা ইয়ানে ইসলাম-বিরোধিতার হালুম হুংকার হইতে গায়ের মুসলিম জাহানে তখন ঐ কিছিমের একটি ধারণা পয়দা হইয়া গিয়াছিল। ফলে কোনও মুসলিম মুলুকই তখন দুনিয়ার এই দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম মুলুকের প্রতি দোস্তির দস্ত বাড়ায় নাই। লেকিন সেই জামানা মা’আশাল্লাহ বদলাইয়া গিয়াছে। মুসলিম জাহানের সহিত এখন বাংলাদেশের জানের দোস্তি কায়েম হইয়াছে। হর মাহিনা এবং এমনকি হর হপ্তা একটি না একটি মুসলিম মুলুকের নোমায়েন্দাদল এখন বাংলাদেশ সফরে আসিতেছেন, এবং তাহাদের বাংলাদেশী ভাইদের তরক্কির রাহায় মদদ জোগাইতেছেন। ঠিক এই সময় শকুন্তলা ও দুইবোন- এই মাফিক নাটককে এই মুলুকের তমদ্দুন হিসাবে তাহাদের সামনে তুলিয়া ধরার পিছনে তাহা হইলে মতলব কাজ করিতেছে? ইয়াদ করা যাইতে পারে যে, ফিলহাল ঢাকায় যখন আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন চালিতেছিল, ঠিক সেই সময় বহুত শান-শওকতের সহিত সেখানে ঐ নাটক দুইটি অভিনয় করা হইতেছিল।

ইহা হইতে কি বুঝা যায়? ঢাকা থিয়েটার ও থিয়েটার তাহা হইলে হাওয়ার গতি কোন দিকে বদলাইয়া দিতে চায়? কেন? এবং কি মতলব?১১

তৎকালীন (১৯৭৮) রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া-স্বরূপ উদ্ঘাটিত সমালোচনায়।

শিহাব সরকার শকুন্তলার ব্যাখ্যানে হার্মনি ও বিরোধের সম্পর্কে খ- দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করেন। বিরোধ উপলক্ষ মাত্র, হার্মনিই লক্ষ্য- একথা বলেন তিনি। তাছাড়া মিথ ধ্বংসের জন্য তীব্র বৈপরীত্যের যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দরকার তা এই নাটকে নেই বলেও মত প্রকাশ করেন। তাই এটি ভিন্ন কোনো নাটক হয়ে ওঠে না শেষ পর্যন্ত। তবু তাঁর নাটকটিকে বাংলাদেশের পটভূমিতে অভিনব ও তুলনারহিতই মনে হয়েছে :

শকুন্তলা উপলক্ষে ঢাকা থিয়েটার যে স্যুভেনির বের করে, ওতে বলা হয়েছে ... প্রগতিশীল সাহিত্য ধারায় ‘মিথ’ ‘মিথ’ হিসেবে আসে না- মিথ রিক্রিয়েট করা হয়- শুধুমাত্র মিথকে ধ্বংস করার জন্যেই, ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলাও তেমনি ‘মিথ রিক্রিয়েটড টু ডেস্ট্রয় এ মিথ’। সেলিম আল-দীন, এর আগে দর্শকরা যাঁর বেশ ক’টি অসম্ভব ভালো ও উত্তেজক নাটক দেখেছেন- শকুন্তলা দিয়ে প্রচলিত মিথকেই এনেছেন মঞ্চে তবে একটু ভিন্নভাবে। কালিদাসের শকুন্তলা চিরন্তন সুন্দরের সাথে মিশে গিয়েছিলো। যাকে সেলিম বলেছেন ‘বিরোধ’ তা সংস্কৃত সাহিত্যের ঐ অমর শিল্পী দেখেছিলেন সুন্দর ও শুভ্রতার চূড়ান্ত প্রতিমা তৈরির পটভূমি হিসেবে। বিরোধ ও দ্বন্দ্বের নৈরাজ্য থেকে হার্মনির গোলাপি- শান্ত মুহূর্ত তৈরী হয় না, নাট্যকারের এই দাবী কতদূর গ্রহণযোগ্য তা ভাবনাসাপেক্ষ। শেক্সপীয়রের কমেডিতে শূন্যতাবোধ ও হার্মনির চেতনাপরিপ্লুত রেশ তৈরী হয়েছে কিন্ত কোনো না কোনো বিরোধকে ঘিরেই। হার্মনি জীবনের মূল শর্ত, বিরোধ উপলক্ষ মাত্র। গ্রীক বা অন্যান্য সংস্কৃত নাট্যকার তাই বলে এসেছেন, যতদূর জানি। তাছাড়া শকুন্তলা পুরাণে সেলিম যাকে বিরোধ হিসেবে দেখেছেন, তা আসলেই কি বিরোধ ? রূপ ও পবিত্রতার নিটোল উপমা শকুন্তলা মর্ত্যে এসেছে স্বর্গের অমোঘ ইঙ্গিতে, পুরাণ অনুযায়ী এর ওপর কোনো কথা চলে না। ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলার, ‘জন্মসূত্রে যে পেয়েছে কিছু অতি প্রাকৃত লক্ষণ এবং দূরারোগ্য অসুখ’ ভীতি-সংশয় ও ঘৃণাকণ্টকিত পরিণতি কালিদাস দেখলেও অস্বাভাবিক মনে হতো না। ওরকম একটা ভিন্নতর নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সংস্কৃতি নাট্যকার খুবই দিতে পারতেন। প্রচলিত মিথ ধ্বংসের জন্যে তীব্র বৈপরীত্যের যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দরকার হয়ে পড়ে তা ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলায় দেখিনি। যা দেখা যায় এমন-হলেও-চলতো জাতীয় শকুন্তলার একটা ব্যাখ্যা। নাটক শেষ হওয়ার পর, এক ভিন্ন শকুন্তলা দেখে এলাম-এমন মনে হয় না; ক্লাসিক্যাল ও প্রচলিত ধারণাটাই উজ্জ্বল হয়ে থাকে। এগুলো অবশ্য জরুরী কথা নয়। লেখকের কাছে নাটকটি বাংলাদেশের পটভূমিতে অভিনব ও তুলানাহীন মনে হয়েছে। তা এ জন্যে যে, এটি শকুন্তলার জন্মপর্ব ও ‘পরিণতি’কে পৌরাণিক আলো আঁধারে ঘেরা রহস্য নিয়ে শুধু মঞ্চেই নিয়ে আসেনি এ নাটক ঢাকার দর্শককে আগামীতে পৌরাণিক নাটকের জন্যেও সতৃষ্ণ রাখবে।১২

সমালোচকের নান্দনিক মাত্রাজ্ঞান লক্ষণীয়।

চিরায়ত সাহিত্যের ‘তরল ও একপেশে ব্যাখ্যারই পরিচায়ক’ মনে করেন মফিদুল হক ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলা -প্রযোজনাকে; তবু ‘অতীতের আলোয় বর্তমান-পাঠক’, ‘পুরাণের দিকে দৃষ্টি প্রক্ষেপণের নতুন ব্যাপ্তি সংযোগ’ কে অভিনন্দিত করেন :

সেলিম আল দীনকে ধন্যবাদ, বক্তব্য প্রকাশের জন্যে পৌরাণিক কাহিনীর কাঠামো বেছে নেওয়ার মতো সাহস ও ক্ষমতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন। ঈদৃশ সাহসের প্রসঙ্গ সাহিত্য বা শিল্প-বিচারে অবান্তর, কিন্তু আমাদের বর্তমান পারিপার্শ্বিকতা ও ক্ষমতাবানদের মানসিকতা বিস্মৃত না হলে এই প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করতেই হয়। ঢাকা থিয়েটার পরিবেশের কথা মনে রেখে নিশ্চয় ভূমিকাপত্রে লিখেছেন ‘মুসলমানদের হাতেই মধ্যযুগের বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। মহাভারত প্রভৃতি ভারতীয় ক্লাসিক গ্রন্থে সাহিত্যরস আস্বাদনের ইচ্ছাটাই ছিল মুসলমানদের। সেজন্য সংস্কৃতের অনুস্বার বিসর্গ ভেদ করে তাঁরা মহাভারতকে নিয়ে এলেন বাঙালীর লোকায়ত জীবনে’। নিজেদের বিশিষ্ট বলে উচ্চকণ্ঠ ঘোষণা ও সেইসাথে কালিদাস কিংবা আধুনিক পুরাণাশ্রিত নাট্যকর্মের চাইতে তাঁদের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণের উক্তিসমূহে বিনয়ের অভাব পীড়াদায়ক ঠেকে। ‘সৌন্দর্য্যবিলাসী সংস্কৃত সাহিত্যে কবি কালিদাস শকুন্তলাকে সহজেই বেছে নেবেন- এটাই স্বাভাবিক। কবি কালিদাস হয়তো ভেবেছিলেন অপ্সরার কন্যা মানবিক অবয়বে কী অপূর্ব দৃষ্টান্ত হতে পারে সৌন্দর্যের’, ‘কালিদাস আর গ্যেটে শকুন্তলার মধ্যে কেবল সৌন্দর্য আর মিলনই দেখেছেন- বিরোধকে নয়’ এমন উক্তিসমূহ চিরায়ত সাহিত্যের তরল ও একপেশে ব্যাখারই পরিচায়ক এবং নিজেদের কবন্ধ শিল্পবোধ ছাড়া আর কিছু প্রকাশ করে না। কালিদাসে যদি এটুকু বোধ কাজ করে থাকতো তবে অনেক আগেই তাঁর সৃষ্টি বিস্মৃতির কৃষ্ণগহবরে তলিয়ে যেতো, একটি সজীব সৃজনকর্ম হিসেবে আজো আমাদের আকর্ষণ করতো না। বস্তুতপক্ষে নিটোল গল্প বলার কোনো রকম চেষ্টা সেলিম আল দীন করেননি। পুরাণের আখ্যান বেছে নেয়ার তাৎপর্য, অতীতের আলোয় বর্তমানের পাঠোদ্ধার ছিল তাঁরও লক্ষ্য। এবং তিনি এখানে সার্থক, বর্তমানের দ্বন্দ্ব সংঘাতের আলোকে অতীত হয়ে উঠেছে অনতীত। পুরাণের দিকে দৃষ্টি প্রক্ষেপণে নতুন ব্যাপ্তি সংযোগ করেছেন তিনি।১৩
 
শিল্প বিচারের একটি ভারসাম্যময় অবস্থান স্পষ্টব্যক্ত।

রশীদ হায়দার শকুন্তলা নাট্য শ্রেণীদ্বন্দ্বের এক চিত্রনাট্য প্রত্যক্ষ করেন-শোষক ও শোষিতের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে; সাধারণ মানুষের ‘উচ্চবিত্ত’ হতে যাওয়ার যে ট্রাজেডি ঘনায় :

সেলিম আল দীন প্রচলিত কাহিনী বা ঘটনা অথবা কিংবদন্তীকে প্রচলিত ধারাতেই প্রবাহিত করতে যতœবান নন; তিনি তাকে নতুন অভিধা, নতুন বক্তব্যে উপস্থাপিত করতে বেশি আগ্রহশীল। রাজশেখর  বসু অনূদিত ‘মহাভারত’- এ ইন্দ্রের মেনকাকে পাঠানোর মধ্যে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত আছে, ব্যাখা নেই। সেলিম এই ভাইটাল পয়েন্টটিতে নাটকীয়তা দিতে গিয়ে সর্বজন পরিচিত নারদ ও তক্ষককে এনেছেন। সমসাময়িক চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে বলতে চাই-স্বর্গ ও মর্ত্যের ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবধান আসলে শোষক ও শোষিতেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ; আবহমান কাল ধরে যা চলে আসছে। এই বক্তব্যের পরিপূরক হিসেবেই বলা যায়, মানুষ শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করেছে সর্বত্র ও সর্বাগ্রে। ধর্মীয় আচরণ চিরকালই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির জটাজালে আবদ্ধ করে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বামিত্র মর্ত্যের বাসিন্দা, সাধারণ মানুষ সাধনায় যখনই ‘উচ্চবিত্তের’  কাছাকাছি যেতে চেয়েছে, তখনই এলো বিপর্যয়। বিষয়টিকে কি নতুন বলবো? না। কিন্তু ব্যবহারটি নতুন, কারণ ‘মীথ” ভেঙে নতুন পরিবেশনা যেমন নতুনত্বের স্বাদ দেয়, তেমনি একটি চিরন্তন বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। সেলিমের কৃতিত্ব এখানেই। দ্বিতীয় পর্বে শকুন্তলার দ্বন্দ্ব। শকুন্তলার যৌবনলগ্নে, ঋতুমতী হওয়ার সময় থেকে, জন্মসূত্রে, সে যে অস্বাভাবিক রোগের শিকার হয়েছে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রবল আকুতিই দ্বিতীয় পর্বে বর্ণিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, শকুন্তলা মুক্তি পায়নি। স্বর্গের দিকে হাত বাড়িয়ে সে মেনকার কাছে যেতে চায়, কিন্তু ‘কেবলই কানামাছি, কেবলই অন্ধকার।’ এখানেও ষড়যন্ত্রের ভয়াবহ পরিণামের আরেকটি নিদর্শন-একটি শ্রেণী চিরকালই ব্যবহৃত হয়, সামনের পরিচয় জানা থাকলেও যাওয়ার রাস্তা তার জানা নেই এবং এটাই মর্মান্তিক ট্রাজেডি। সেলিম আল দীন বক্তব্যটিকে তুলে ধরেছেন সুন্দরভাবে। সেলিমের শকুন্তলা সম্পর্কিত সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি শকুন্তলাকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছে, নতুন একটা দিক উন্মোচন করেছে। সেলিম আল দীনের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই।১৪

বহু ভিন্নতর নান্দনিক অবস্থান এভাবে তৈরি হয় শকুন্তলা নাট্যকে উপলক্ষ করে।

সূত্রতথ্য: ১. ঢাকা থিয়েটার , ‘শকুন্তলা’, স্যুভেনির ১৯৭৮, ২. ‘শকুন্তলার শততম মঞ্চায়ন’, বিচিত্রা ২৬ মার্চ ১৯৮০, ৩. পূর্বোক্ত, ৪. পূর্বোক্ত, ৫. ‘শকুন্তলার শততম মঞ্চায়ন’, রোববার ৩০ মার্চ ১৯৮০, ৬. ‘ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলা’, দৈনিক সংবাদ, ঢাকা ১৯৭৮ নগর সং, ৭. দৈনিক বাংলা, ২৮ মাঘ ১৩৮৪ নগর সং, ৮. Amit K . Bhattacharjee, ‘Between Heaven and Earth’, The Holiday 12 March 1978, ১০. চিন্ময় মুৎসুদ্দী, ‘শকুন্তরার নতুন জন্ম’, বিচিত্রা ৬ বর্স ৩৭ সংখ্যা, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮, ১১. ‘ফারাজি মুনশির হপ্তানামা’, আযাদ ১৪ এপ্রিল ১৯৭৮, নগর সং, ১২. ‘সচিত্র সন্ধানী’, ২৩ এপ্রিল ১৯৭৮, ১৩. মফিদুল হক, ‘থিয়েটার’ রামেন্দু মজুমদার (সম্পা), সেপ্টেম্বর ১৯৭৮, ১৪. রমীদ হায়দার, ‘রোববার’ ঢাকা ১৯৭৮।

অচলায়তন
রচনা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নির্দেশনা : আলী যাকের
প্রযোজনা : নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮০

‘নাগরিক’ প্রকাশিত স্যুভেনির-এ রবীন্দ্রনাথ ও অচলায়তন প্রযোজনা সর্ম্পকে তাদের ভাবনা জানান:

রবীন্দ্রনাথের চেহারা ও দেহসৌষ্ঠবের মতই তাঁর লেখা পৌরুষদীপ্ত, যেখানে দুর্বলতা বা রুগ্নতার নেই কোনো স্থান। চওড়া হাতের কব্জি আর সাহসবিস্তৃত বিশাল বক্ষের মানুষটির কলম দিয়ে নিঃসৃত হয়েছে বলশয়ীতায় দীপ্যমান লেখা। এই সপ্রাণ কর্মিষ্ঠ মানুষটি সুখ-দুঃখ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চেতনাকে একই সাথে ধারণ করেছিলেন আর সে জন্যেই জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে সকল দর্শন ও মতবাদের সব মানুষের কাছে তিনি সমানভাবে গ্রহণীয়। রবীন্দ্রনাথ এজন্যেই আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও দুর্যোগদিনের পরম সখা।

দুর্ভাগ্যবশত একদিকে নিবীর্য কিছু বাঙালির অধশিক্ষা, মূঢ়তা এবং অক্ষমতায় রবীন্দ্রনাথ নির্বাসিত অর্থহারা ভাবেভরা ভাষায়। আবার অন্যদিকে কিছু রাজনীতি ব্যবসায়ীর দুরভিসন্ধির ফলে রবীন্দ্রনাথ আজ নিজ বাসভূমে পরবাসী।

অচলায়তন-এ রয়েছে এক হৃদয়ের দ্বার রুদ্ধ করা কুসংস্কারপূর্ণ যাজক মহাপঞ্চক এবং তাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত উপাধ্যায়। এঁদের কর্তৃত্ব নিষ্পাপ সরল ছাত্রদের ওপর। এরা ছাত্রদের প্রাণে না মারলেও মনের দিক থেকে বিকলাঙ্গ করে দিয়েছে- আয়তনের উত্তর দিকের জানালা খুলে বাইরে দৃষ্টিপাত করার জন্যে কিশোর সুভদ্রকে পালন করতে হবে ছয় মাস মহাতামসব্রত, কেননা আলোকের দ্বারা যে অপরাধ অন্ধকারের দ্বারাই তার ক্ষালন। মহাপঞ্চক ও উপাধ্যায়ের প্রধান সহায় স্থবিরপত্তনের ভাঁড় ও বিকৃতমনা রাজা মন্থরগুপ্ত।

একমাত্র মহাপঞ্চকের ভাই, অচলায়তনের অন্যতম ছাত্র পঞ্চমক হলো বিদ্রোহী। দুর্বিনীত পঞ্চক এঁদের শাসন মানে না। সে গান গায়, হাসে, খেলে, নাচে এবং অচলায়তনের বাইরে গিয়ে অস্পৃশ্যদের সাথে মেশে যা অচলায়তনের নিয়মে প্রলয়ঙ্করী পাপ। অচলায়তনের আচার্য ছাত্রদের ভালবাসেন, বিশেষ করে পঞ্চকের প্রতি তার প্রাণের টান। কারণ সে ভুল করে সত্য জানবার অধিকার নিজেই অর্জন করেছে। মহাপঞ্চক ও উপাধ্যায়ের আচরণকে তিনি অন্যায় মনে করেন, কিন্তু সনাতন ধর্ম বিশ্বাস ভাঙার ভয়ে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারেন না।

অচলায়তনের বাইরে আছে ভূমিকর্ষক, স্বেদগন্ধযুক্ত কর্মিষ্ঠ মানুষ শোনপাংশুরা আর ভক্তি ও সৌন্দর্যের পূজারী দর্ভকেরা। এরা সবাই ম্লেচ্ছ।

একই সঙ্গে অচলায়তনের বাইরে ও ভেতরে আছেন একজন আশ্চর্য মানুষ। তিনি অচলায়তনের গুরু, শোনপাংশুদের দাদাঠাকুর এবং দর্ভকদের গোঁসাইঠাকুর। এই যোদ্ধা মানুষটি শোনপাংশুদের সঙ্গে মিলে অচলাতনের প্রাচীর ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে সেখানে আলো বাতাস ও পাখির ডাক শোনার পথ করে দেন। পঞ্চক তার দাদাঠাকুরের পাশে এসে দাঁড়ায়। দাদাঠাকুরের নির্দেশে পঞ্চক শোনপাংশুদের সঙ্গে মিলে মিশে পুরোনো ভিতের ওপর নতুন সৌধ গড়ার কাজে লেগে যায়।

নিষেধের বেড়ায় আবদ্ধ এক অচলায়তনে আমাদের বাস। আলো, হাওয়া এবং প্রাণস্পন্দন বিবর্জিত আরও নৃশংস এক অচলায়তন আমদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।

রবীন্দ্রনাথ- এর অচলায়তন থেকে উৎসারিত আহবান আজকের অচলায়তনকে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে এক মুক্ত, বিস্তৃত এবং কর্মময় পৃথিবী সৃষ্টিতে আমাদের আগ্রহী করুক এই আমাদের কামনা। অচলায়তন-এর মঞ্চায়ন রবীন্দ্রনাথ-এর কাছে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণ লাঘব করার অকিঞ্চিৎকর প্রচেষ্টায় নিবেদিত।

কিন্তু এদেশের জন্মলগ্নে যে সুর আমাদের জলে, স্থলে অন্তরীক্ষে মূক মূঢ় প্রাণে তুলেছে সেই ভাষা, আমার সোনার বাংলা, তার স্রষ্টা তো রবীন্দ্রনাথ।...

রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের ঋণ আমাদের মুক্তিতে আমাদের পথ চলায়, আমাদের অস্তিত্বে। তাই এই অস্তিত্বের বিপন্নতায় ঐ রবীন্দ্রনাথের কথাই হয় আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আহবান।

আমার অস্ত্র হল গড়া
আমার বর্ম হল পরা
এবার ছুটবে ঘোড়া পরম বেগে
করবে ভুবন জয়।১

দর্শক-সমালোচকদের মতামত

নাট্যকার সেলিম আল দীন ‘হাসতে হাসতে দেয়াল ভাঙ্গো দাদাঠাকুর’ শিরোনামে ঢাকা থিয়েটারের নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এবং অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী ও রইসের সঙ্গে আড্ডার মেজাজে নাগরিক প্রযোজিত অচলায়তন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন :

সেই কালো কালো অতুল প্রাণ আর শক্তিধারী শোনপাংশুগণ অচলায়তনের পাথুরে প্রাসাদটিকে, তার আত্মকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতার অসীম অহংকারকে ধূলিসম চূর্ণ করে দেয়। শিবের আঙ্গিকে দাদাঠাকুর অট্টহাসি আর প্রলয়কে ধারণ করেন। কাঁকুড় চাষী অন্ত্যজ মানুষগণের তিনি বন্ধু ঠাকুর। ... কালো কয়লার মধ্যে যখন একটি রোমশ ঘর্মাক্ত হাত অস্পৃশ্য লোহাকে তীব্র লাল করে তাকে রূপান্তরিত করে লাঙ্গলের ফালে। আর যে ধাতব রূপান্তরে হাতুড়ির ঠুকঠাক ঠুকঠাক চলে সেই তো দাদাঠাকুরের মন্ত্রোচ্চারণ। অবশেষে স্থবিরক আর অন্ত্যজ মানুষের, মিলিত রক্তের উপর তিনি নতুন নির্মাণের সংকল্প ঘোষণা করেন।২

সেলিম আল দীন বলেন, সময় ও শিল্পবোধের দিক থেকে বিবেচনা করে অচলায়তন নাগরিকের একটি প্রশংসনীয় নির্বাচন।৩

নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেন :

এখন (১৯৮১) সারাদেশে পেট্রো মুদ্রার শাসন। রাজনৈতিকভাবে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু লেখক বলে নির্বাসিত করার পাকিস্তানি রীতির চেষ্টা হচ্ছে। দেশের উগ্রসাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের ঐতিহ্য চেতনা আবার বিভ্রান্ত হতে চলেছে। অগ্রগামী জনসাধারণের মধ্যে মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিষ ছড়ানো হচ্ছে। তাই এ মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়ন মানেই একটি সুস্থ সামাজিক চেতনা সম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা জানাতে সাহায্য করে। ... জাতীয় নাট্য আঙ্গিক ও নাট্যাবস্থার একজন নির্মাতা বলেই রবীন্দ্রনাথের নাটক নির্বাচনে আমরা উল্লসিত। কারণ আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের নাটকে এখন দ্বিতীয় স্তরের বিকাশ ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য। দ্বিতীয় স্তরের বিকাশ কি? রক্ষণশীল অথবা অন্ধদের নাট্যচর্চা এবং বিদেশী নাটকের অনুবাদ ভাবানুবাদের মাধ্যমে পরজীবী নাট্যচর্চা, এই দ্বিবিধ ধারা হচ্ছে এক নম্বর স্তর। জাতীয় আঙ্গিক ও দেশীয় নাট্যবস্তুর সমন্বয়ে যে নাট্যচর্চা সেটাই দ্বিতীয় স্তরের বিকাশ। ... রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাড়াবাড়ি আমার একদম ভালো লাগে না একথা ঠিক, কিন্তু তাঁকে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির চেতনা থেকে নির্বাসিত করে শেষমেষ গোল্লায়ও যেতে রাজি নই। ... সমগ্র অচলায়তন-এ বর্ণনাত্মক ভঙ্গীর সঙ্গে নাটকীয় উপাদানের একটি দুর্লভ মিশ্রণ দেখা যায়। এ নাটকে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ঘটনা ও মূল দ্বন্দ্বের ব্যাখ্যা হিসেবে গানের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। ... অচলায়তনের বেঁচে থাকা চলা- ফেরার তত্ত্ব জীবন ও যুক্তি বর্জিত। চিরকালই ধর্ম যেরকম মানুষের জীবনের উপর অসঙ্গত বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এসেছে অচলায়তেনেরও তাই। ... অচলায়তনের মধ্যে মানুষকে পাপ ও পুণ্যের মূল্যে বিচার করা হয়। সেজন্য দেখি সেখানকার মানুষগুলো একেবারেই বৃত্তাবদ্ধ। এ ধরনের মানুষকে মানুষ না বলে বলা উচিত কার্টুন ... ‘নাগরিকের অভিনয় দেখে আমার মনে হয়েছিল, অচলায়তনের সংলাপের বিভিন্ন স্তর আছে। ... অচলায়তনের পরিবেশ অনুযায়ী ভাষা রীতির পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অতি সাধারণ ভাষার স্তর থেকে মহাপঞ্চকের তৎসমবহুল ভাষার স্তর পর্যন্ত আমি এভাবে ক্রমবিন্যস্ত করতে পারি :- ১। শোনপাংশু, ২। দর্ভক, ৩। পঞ্চক, ৪। দাদাঠাকুর, ৫। সুভদ্র ও অন্যান্য বালকগণ, ৬। উপাচার্য মহাপঞ্চক’।৪

সেলিম আল দীন বলেন :

কিন্তু নাগরিক শোনপাংশুদের ভাষাকে আঞ্চলিক রূপ দিয়েছে এবং এ কাজটি যথার্থ হয়নি।৫

রইস বলেন:

কেন তাতে বরং চরিত্রগুলিকে অধিকতর জীবন্ত মনে হয়েছে।৬

এ বিষয়ে সেলিম আল দীনের মত হল :

কোনো রূপক নাটকের কোনো বিশেষ অংশে বা চরিত্রে বাস্তবতার স্পর্শ থাকলে তা নাটকটার মূল প্রবাহকে ক্ষুণ্ন করে। কারণ ভাষা বাস্তব হলে চরিত্রও বাস্তব হয়ে যায়। কাজেই শুধু শোনপাংশুদের চরিত্র বাস্তব হলে অন্যান্য চরিত্রগুলির মধ্যে তাকে অসংগত মনে হবে। এর ফলে গোটা নাটকটাই হয়ে যেতে পারে বিপর্যস্ত।৭

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন :

... শোনপাংশুদের মধ্যে নারী চরিত্রের কোনো নির্দেশ ছিল না মূল নাটকে। ‘নাগরিক’ তা করেছে। এবং তা শোভনও হয়েছে। ... দাদাঠাকুর অচলায়তন নাটকের কেন্দ্রবিন্দু এই চরিত্রের মধ্যে আধুনিক মন ও গ্রাম্য বাউলের মুক্তচেতনার মিশ্রণ ঘটেছে। দাদাঠাকুরের মধ্যে প্রাণময়তার সঙ্গে গভীর বিশ্বাসের সংযোগ দেখতে পাই। প্রমত্ত পদ্মার মত তিনি ভাঙ্গন ও সৌন্দর্যের আধার। এই চরিত্রটি রূপায়ণে আলী যাকেরের সবচে বেশী যত্ন নেয়া উচিত ছিল। সালেক খানের উচিত ছিল গোড়া থেকেই চরিত্রটি নির্মাণ করা। দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্তিবাদী চেতনার মিশ্রণে বাক্যপ্রবাহের যে সম্ভাব্য রূপ হতে পারে তা পরীক্ষা করা। আমি রাবীন্দ্রিক উপস্থাপনাকে এ মুহূর্তে অনুমোদন করি না। কারণ অচলায়তন কে আমরা সময়োপযোগী নির্বাচন বলে মনে করি। কাজেই অচলায়তন-এর উপস্থাপনা আমাদের বর্তমান সমাজের মূল ভঙ্গীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। নাগরিক সার্বত্রিক না হোক আংশিকভাবে হলেও সমকালীন উপস্থাপনার কথা ভেবেছে নাটকটি দেখে তাই মনে হয়। ... এ নাটক বিশাল রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনদৃষ্টি ও শিল্প সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।৮

নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু আলোচনা শেষ করেছেন এভাবে :

নাগরিকের সাফল্য অন্যত্র। সেটা হয়ত মঞ্চের নিখুঁত সাজসজ্জা, পরিচালনা বা অভিনয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে সাফল্য সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে দেখতে হবে। দাদাঠাকুর হাসতে হাসতে দেয়াল ভেঙেছেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের সৃষ্ট সমকালীন অচলায়তন কে ভাঙবে? তাদের ত শুধু একশ বছর লেগেছে বুঝতে যে তাদের আদত মাতৃভাষা কোনটি। এই বাংলাদেশে কত রঙ্গের মহাপঞ্চক এল আর গেল। একেকটি অচলায়তন ভেঙে ফেলে অস্থির ও রাগী পঞ্চকেরা। তারপর আবার গড়ে ওঠে। কিন্তু সময় এসেছে। শ্রাবণের গরুড় মেঘ পাখা মেলেছে, অচলায়তন আবার ভাঙবে। শেষ ভাঙা। মহাপঞ্চক যতই ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করুক, বিদ্যুত গর্জাবে, পৃথিবী শ্যামল হবে। দ্রাবিড় রক্তে জাগবে শোনপাংশু-অধীরতা। দাদাঠাকুর এসে হাসতে হাসতে দেয়াল ভাঙ্গবেন।৯

বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাট্যের প্রাসঙ্গিকতা এবং ঢাকা থিয়েটারের ‘জাতীয় নাট্য আঙ্গিক’ আদর্শের বিবেচনা থেকেই উপর্যুক্ত ভাবন-সমালোচনের ধরনচারিত্র্য। সেই সঙ্গে থিয়েটারে শিল্প ও রাজনীতির বিশিষ্ট এক সম্বন্ধ নিরিখ তৈরি হয়েছে।

m~ÎZ_¨ : 1. bvMwiK, ÔAPjvqZbÕ, my¨‡fwbi 1980, 2. †mwjg Avj `xb, Ônvm‡Z nvm‡Z †`qvj fv‡½v `v`vVvKziÕ, ÔgÂÕ, XvKv w_‡qUvi cÖ_g msL¨v 1981, 3. c~‡e©v³, 4. c~‡e©v³, 5. c~‡e©v³, 6. c~‡e©v³, 7. c~‡e©v³, 8. c~‡e©v³, 9. c~‡e©v³|

কোপেনিকের ক্যাপ্টেন
নাট্যকার : কার্ল স্যুখমায়ার
রূপান্তর ও নির্দেশনা : আলী যাকের
প্রযোজনা : নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮১

নাটকটির প্রচারপত্রে নাগরিক বিস্তারিত জানায় কোপেনিকের ক্যাপ্টেন-এর লেখন-পরিপ্রেক্ষিতে, সেই সঙ্গে নাট্যকারের রচন-প্রণোদনার বাস্তব পরিস্থিতি :

এই নাটকের মূল ঘটনাটি সত্য। ঘটেছিল ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে। যখন জার্মানীর সম্রাট ছিলেন কাইজার উইলহেম। সেনাবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর পোষাকের প্রতি কাইজারের ছিল অসীম দুর্বলতা। এবং এই দুর্বলতার শিকার হয়েছিল তৎকালীন জার্মান জনগণ। তখনকার জার্মানীতে সেনাবাহিনীর পোষাক পরিহিত যে কেউ প্রায় যা খুশি তাই করতে পারতো। এই ঘটনার নায়ক, উইলহেম ভয়েগট নামে এক ব্যক্তি। বিভিন্নরকম অসামাজিক কাজে লিপ্ত হবার জন্যে সে একাধিকবার জেল খেটেছে। প্রতিবারই সে জেল থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে জীবন শুরু করবার কথা ভেবেছে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কারণ কাইজার উইলহেমের সামরিক শাসনাবৃত জার্মানীতে তখন যে কোনো শহরে বাস করতে হলে চাই একটি পারমিট। এ এক দুর্ভেদ্য চক্র। উইলহেম ভয়েগট এই চক্র ভেদ করতে অক্ষম। ফলে আবার জেল। ছাপান্ন বছর বয়সে এই শেষবার জেল থেকে বেরিয়ে এসে ভয়েগট’র বোধোদয় হল। সে আবিষ্কার করলো যে মহামান্য কাইজার উইলহেমের সরকারের কল্যাণে যে একটি শ্রেণী যা খুশি তাই করে বেড়াতে পারছে তা হল তৎকালীন জার্মান সামরিক বাহিনী। এই পরিস্থিতিতে ভয়েগট একটি ক্যাপ্টেনের পুরোনো ইউনিফর্ম কেনে এবং সেই ইউনিফর্ম পরে কিছু সৈনিকের নেতৃত্ব দিয়ে সে দখল করে বার্লিনের শহরতলী কোপেনিকের পৌরসভা। তার প্রয়োজন খুবই সামান্য। হয় দেশে বাস করবার জন্যে একটি পারমিট, নয়তো দেশ ছেড়ে চলে যাবার জন্যে একটি পাসপোর্ট।

নাট্যকার :

কার্ল স্যুখমায়র জার্মানীর প্রথমসারির নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম। জার্মানীর নাট্যগুরু বের্টল্ট ব্রেখটের মতই ক্ষুরধার সমাজ সচেতন নাটক রচনায় তিনি সিদ্ধ। ১৯১০ খৃষ্টাব্দে, স্যুখমায়ার উইলহেম ভয়েগটকে দেখেছিলেন মাইনজ শহরের মেলায়। তাঁর মনে আছে, ঐ মেলায় ভয়েগট তার সামরিক পোষাক পরা ছবি বিক্রি করছিল। তবে ভয়েগট’র এই ঘটনা স্যুখমায়ারকে নাটক রচনায় অনুপ্রাণিত করে আরও পরে।

১৯১৪ খৃষ্টাব্দে নাট্যকার স্যুখমায়ার প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর অসীম সাহসিকতার জন্য তিনি বিশেষ সম্মান খচিত পদকে ভূষিত হন। ঠিক এর পর থেকেই তিনি জার্মান জাতির ইউনিফর্ম এবং সামরিক বাহিনীর প্রতি অস্বাভাবিক দুর্বলতায় আশাহত হয়ে পড়েন। ১৯৩১-এ যখন হিটলার ক্ষমতা দখল করে তখন তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী বন্ধু ১ম মহাযুদ্ধে পাওয়া সম্মান এবং পদক প্রত্যাহার করেন। এই সময় জার্মানীতে এক অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল। ষাট লক্ষ লোক বেকার হয়ে পড়েছিল, ব্যাংকগুলো সব একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। অথচ জার্মান সেনাবাহিনী জার্মান জাতির তথাকথিত রক্ষক হিসেবে রাজত্ব করে চলেছিল মহাদাপটে। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্যুখমায়ার লিখলেন দা ক্যাপ্টেন অব কোপেনিক। ক্ষমতাসীন নাৎসী চক্রের কাছে এ এক অমার্জনীয় অপরাধ। ফলে, স্যুখমায়ারের ভাষায়, বুদ্ধি বিবেকহীন, অশিক্ষিত, আড়ম্বরসর্বস্ব হিটলার বন্ধ করে দিলেন এই নাটক। কিন্তু হিটলারের পতনের পর থেকে আজ অবধি কোপেনিকের ক্যাপ্টেন অভিনীত হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র- প্রশংসিত হচ্ছে মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন দর্শকদের দ্বারা।

প্রযোজনা:

আমরা এই নাটকটিকে প্রথাসিদ্ধ উপায়ে উপস্থাপন করছি না। কারণ, এই নাটকে এ্যাতো চরিত্র, এ্যাতো স্থান-কালের সমাবেশ যে তা দৃশ্যপট পরিবর্তন করে মঞ্চায়ন অসম্ভব। এ ছাড়া নাটককে দর্শকের মাঝে নিয়ে আসার একটা ইচ্ছে আমাদের সবসময়েই ছিল। এই প্রযোজনায় তা সফলভাবে সম্পাদিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। মূল নাটকে চরিত্র রয়েছে ৯০টি, আমাদের নাটকে চরিত্র রয়েছে ঊনপঞ্চাশটি। তবে ঊনপঞ্চাশটি চরিত্র অভিনীত হবে সতেরোজন কুশিলব দ্বারা। এ ছাড়া রয়েছে একজন একক কোরাস - দৃশ্য পরিচিতির জন্য। অর্থাৎ একজন অভিনেতা কি অভিনেত্রী একাধিক চরিত্রে অভিনয় করবেন দৃশ্য থেকে দৃশ্যে। নেপথ্যের সব কাজ, যেমন পরিচ্ছদ পরিবর্তন, আসবাব পরিবর্তন ইত্যাদি সংঘটিত হবে দর্শকদের সামনেই।১

১৯০৬ খৃস্টাব্দের একটি ঘটনা ১৯৩১-এ যে প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করে। ১৯৮১-এর বাংলাদেশে তার মঞ্চায়ন তাৎপর্য স্যুভেনিরে উল্লেখ করা হয়নি।

দর্শক-সমালোচকদের মতামত

পাকিস্তানি যুগের সামরিকীকরণের তিক্ত অভিজ্ঞতা ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে পুনরাবির্ভূত। তাই বুঝি নিজস্ব ইতিহাসে ফিরে আসে দূর কোপেনিকের শহর। নাটকের প্রতিবেশ ও চরিত্রমালা সবকিছু হয়ে ওঠে বাংলাদেশরই চেনাজানা জগতের আখ্যান, অভিজ্ঞতার পরিচয় লাভের দুর্লভ সুযোগ ঘটে এই নাট্য প্রযোজনায়-জানান সমালোচক :

একটি দুর্নামের দায়ভাগ প্রায়শই নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের উপর বর্তায়, তাঁদের দৃষ্টি বড় বেশি বিদেশের দিকে ফেরানো। দেশিয় নাটকের চাইতে বিদেশি নাটকের ভাষান্তর, রূপান্তর মঞ্চায়নেই তারা যেন অধিকতর আগ্রহী। এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা কিংবা অসাড়তা প্রমাণে আমরা অগ্রসর হচ্ছি না তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নাগরিকের সর্বশেষ প্রযোজনা জার্মান নাট্যকার কার্ল স্যুখমায়ার রচিত কোপেনিকের ক্যাপ্টেন দেখে স্বদেশি প্রশ্নে কেউ আলোড়িত হবেন না। নাটকটি নিঃসন্দেহে বিদেশি এবং সরাসরি অনুবাদই বটে, নাটকের পটভূমিও রয়েছে শতাব্দীর সূচনায় জার্মানীতে, তবু যে এই নাটকের সঙ্গে আমরা সহজেই একাকার হয়ে যাই, ভুলে যাই দেশ-কালের ভিন্নতা বা ব্যবধান তার মূল নিহিত রয়েছে নাটকের বক্তব্যের বলিষ্ঠতায় এবং তার কুশলী উপস্থাপনায়।

রাষ্ট্রের মাধ্যমে যে নিয়ন্ত্রণ শাসক-শোষকগোষ্ঠী সমাজের উপর প্রতিষ্ঠা করে তার একটি নগ্ন প্রকাশ হচ্ছে সামরিকীকরণ। সমাজের সামরিকীকরণ ও সামরিক শাসন সমার্থ নয়, এর রূপ হতে পারে নানা ধরনেরই রাজতন্ত্র থেকে মায় গণতন্ত্র অবধি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পুঁজিবাদ যখন পরিণত হচ্ছিল সাম্রাজ্যবাদে সমাজের সামরিকীকরণের তীব্রতাও তখন থেকে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। জায়মান মার্কেন্টাইল ও ফিনান্স বুর্জোয়ার পেছনে ছিল উনিশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনের ভীতিকর অভিজ্ঞতা এবং সামনে ছিল বিশ্ব বাজারের দখলি-স্বত্ব নিয়ে জোর লড়াইয়ের সম্ভাবনা। এই পটভূমিতে যে সামরিকীকরণ ঘটতে থাকে সমাজে তার বর্বরতম প্রকাশ আমরা দেখেছি জার্মানীর দুই মহাযুদ্ধের ইতিহাসে।

প্রথম মহাযুদ্ধ পূর্ববর্তী এক ঘটনার সূত্রে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পূর্ববর্তীকালে, ১৯৩১ সালে, কার্ল স্যুখমায়ার রচনা করেন কোপেনিকের ক্যাপ্টেন। হিটলারের বিস্ময়কর উত্থান তখন অভিভূত করে রেখেছে গোটা জার্মান জাতিকে। ঘটে গেছে চ্যান্সেলর পদে হিটলারের অধিষ্ঠান, নুরেমবার্গের যন্ত্র-নিপুণ ঐতিহাসিক সমাবেশ ‘জিস হেইল’ ধ্বনি নিয়ে স্টর্মটুপারদের মিছিল, তাতে নারকীয় অভিজ্ঞতাটুকু তখনো ছিল সামনে, গ্যাস চেম্বার, বুখেনভাল্ড কিংবা অপারেশন বারবারোসা যে ভবিতব্যে নিহিত ছিল স্যুখমায়ার যেন দিব্যদৃষ্টিতে তা দেখতে পেয়েছিলেন। এবং এই অভিজ্ঞতার নির্যাসকে নিংড়ে নিয়েই রচিত হয়েছিল কোপেনিকের ক্যাপ্টেন।

হিটলারের পতন হলেও সামরিকীকরণের অভিশাপ থেকে সভ্যতার মুক্তি তো ঘটেনি, বরং তৃতীয় বিশ্বের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যায় অশ্বারূঢ় শাসকের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। পাকিস্তানি যুগের তিক্ত অভিজ্ঞতা তো আমাদের রয়েছে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী অভিজ্ঞতাও মোটেই সুখকর নয়। স্যুখমায়ারের নাটকের পাঠ নিতে গিয়ে আমাদের দৃষ্টি তাই বার বার ফিরে আসে নিজস্ব ইতিহাসে, দূর কোপেনিক শহর। বৃদ্ধ ইউলহেম ভয়েগট কিংবা ন্যূব্জ চরিত্র মালা সবকিছু হয়ে ওঠে আমাদের চেনাজানা জগতের।

আমাদের দেশে নাট্য প্রযোজনার সমস্যা সংকটের কথা আমরা ভালোভাবেই জানি। এর সমাধানও আমাদের কাম্য কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতাবানদের কাছে কোনো সমস্যাই যে আর সমস্যা থাকে না তার আরেক প্রমাণ মিললো নাগরিকের সর্বশেষ প্রযোজনায়। মহিলা সমিতির হল ঘরের মাঝখানে দুই স্তর বিশিষ্ট প্ল্যাটফর্ম দিয়ে নির্মিত হয়েছে, মঞ্চ, তিনদিক ঘিরে বসেছে দর্শক। এ যেন আমাদের যাত্রা মঞ্চেরই আধুনিকীকরণ। মঞ্চের উপর স্রোতের মতো ভেসে চলে চরিত্র-ধারা, দৃশ্য থেকে দৃশ্যন্তরে ঘটনার অবতারণা ঘটে। কাহিনীসূত্র এতে এগোয় না। অন্তত প্রথমার্ধে, নাট্যকারের উদ্দেশ্যও তা নয় বরং খণ্ড খণ্ড দৃশ্যে পটভূমিকার সঙ্গে আমাদের পরিচয়টুকু ঘটিয়ে দেয়া হয়, টুকরো-টুকরো ঘটনাগুলো দিয়ে গেঁথে তোলা হয় এক মালা। কারাবন্দীদের ড্রিল, তাদের উদ্দেশে কারা-কর্তার ভাষণ (এর চমৎকার অভিনয় করেছেন আতাউর রহমান); পাবের বেশ্যাদের মনোভঙ্গি ইত্যাদি দৃশ্যাবলি বিরাট তাৎপর্য নিয়েই উপস্থিত হয়। শিথিল দর্শকের জন্য তরল কাহিনী-স্রোতের নাটক এ নয়, প্রথম দৃশ্য থেকেই মেরুদণ্ড সোজা করে দেখতে হয় নাটক এবং ব্রেখট অনুরক্ত নাগরিকের পরিবেশনা গুণে দর্শকদের সামাজিক অভিজ্ঞতার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ভাবিত করে তোলা হয় তাঁদের।

সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপনের অবকাশ কখনোই ঘটেনি উইলহেম ভয়েগট’র, শাটল ককের মতো বার বার তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছে কারান্তরালে। ছাপ্পান্ন বছর বয়সে সর্বশেষ কারামুক্তির পর আবারো মানবজীবনকে নতুন করে গেঁথে তুলতে সচেষ্ট হয় ভয়েগট, কিন্তু পদদলন, নিগ্রহ ও অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই জোটে না তার কপালে। অবশেষে মরিয়া ভয়েগট পুরনো কাপড়ের দোকান থেকে ক্যাপ্টেনের পোশাক কিনে বার্লিন রেল ষ্টেশনের শৌচাগার থেকে কাপড় পাল্টে ক্যাপ্টেনের বেশে আর্বিভূত হয় (পাঠক লক্ষ্য করবেন এই ক্যাপ্টেনের উদ্ভব শৌচাগার থেকে)। ছোট মাপের মানুষটি উর্দিবান হয়ে হঠাৎ যেন অনেক বড় হয়ে উঠলো সকলের চোখে। রূপান্তরের এই দৃশ্যে স্মরণীয় অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। ক্যাপ্টেনের পোশাক পরে বেরিয়ে এসেছেন ভয়েগট, গলার স্বর হয়ে উঠেছে ভারী, চিবুক সামান্য উচানো। চোখ দুটো ঈষৎ কুঞ্চিত। যেন শ্লেষ, অবজ্ঞা বিদ্রুপের সঙ্গে তাকাচ্ছেন চারপাশের জগতের দিকে। চকিতে বুঝি বা সেই চোখে ধরা পড়ে বিষাদের ছায়া; কেননা জীবনের মুখে পদাঘাত করার এই আনন্দটুকু সে কিনেছে বড় চড়া দামে।

পরবর্তী নাটকীয় দৃশ্যগুলোতে আমরা দেখি উর্দিবান মানুষটির সামনে কী করে ন্যূব্জ হয়ে যায় মেয়র, কাউপ্সিলর, রাজনীতিক অভিজাত সকলেই। উর্দিবানের সামনে এমনি নতজানু হওয়ার দৃশ্য তো আমরা অনেক দেখেছি এখনো কি দেখছি না?

কোপেনিকের ক্যাপ্টেনের অপরূপ উত্থানের পতন ঘটলো হুড়মুড়িয়ে। কিন্তু চকিত বিদ্যুৎ আভায় তা উচ্ছ্বসিত করে গেল জীবন সত্য।

নাগরিকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত রইবে কোপেনিকের ক্যাপ্টেন। নাটক নির্বাচনে নাগরিক যে সর্বদা কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পেরেছে তা নয় কিন্তু এবার এমনি নাটক বাছাই ও তার সফল উপস্থাপনার জন্য নাগরিকের প্রতি জানাই তিন উল্লাস। তবু খেদ থেকে যায়, শ্লেষ ও বিদ্রুপে আগাগোড়া বাঁধা স্যুখমায়ারের নাটক, ছোট এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা আবর্তিত, কোনো কিছু বলার চেষ্টা মোটেই প্রকট নয় এখানে অথচ বলা হয়ে যায় অনেক কিছু। এমন নাটকে ঢাকাই কায়দায় ভাঁড়ামোতে লোক হাসানোর চেষ্টা পীড়াদায়ক বৈকি।

কোপেনিকের ক্যাপ্টেন যারা একবার দেখেছেন তাঁদের আবারও ফিরে আসতে হবে মহিলা সমিতি মিলনায়তনে এবং পুনদর্শনার অভিজ্ঞতা ফলপ্রসূই হবে কেননা স্যুখমায়ারের নাটক ছোট বড় অসংখ্য কারুকর্মে সমৃদ্ধ, দর্শক-দৃষ্টি যত, তীক্ষ্ণ হবে রসাস্বাদনের মাত্রা তত বৃদ্ধি পাবে। যাঁরা এখনো কোপেনিকের ক্যাপ্টেন দেখেননি তাঁদের উচিত প্রথম সুযোগেরই সদ্বব্যহার করা, কেননা সর্বকালীনতা সর্বজনীন জীবনাভিজ্ঞতার এমন পরিচয় লাভের সুযোগ দুর্লভই বটে।২
নাট্যদল ও নির্দেশকের নান্দনিক অবস্থান চিহ্নিত করে। পরোক্ষে দেশ-কাল-রাজনীতি এতটা ধারণক্ষম হতে যে পারে- নির্দিষ্ট নাট্য নির্বাচন ও উপস্থাপনের সিদ্ধি তাতে প্রত্যক্ষ হয়। শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্কেরই বিশিষ্ট চরিত্র দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। নন্দনরীতির বাস্তবোত্তর বিস্তার সম্ভাবনারও নিরিখ তৈরি করে কোপেনিকের ক্যাপ্টেন।

সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান পুলিশ পাঠিয়ে মঞ্চায়নকালে নাটকটি বন্ধ করে দেন- বহুপূর্বে রচিত বিদেশি এক নাটকের অনুবাদ সামর্থ্য এবং বাংলাদেশের নাট্য-ইতিহাসে শিল্প ও রাজনীতির মেলবন্ধনের এক নজির হয়ে আছে এই নাট্যটি।

m~ÎZ_¨: 1. bvMwiK, Ô‡Kv‡cwb‡Ki K¨v‡ÞbÕ, my¨‡fwbi 1981, 2. gwd`yj nK, ÔAvgv‡`i Kv‡ji bvqK †Kv‡cwb‡Ki K¨v‡ÞbÕ,ˆ`wbK msev`, 1981 bMi ms|

কিত্তনখোলা
রচনা : সেলিম আল দীন
নির্দেশনা : নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু
প্রযোজনা : ঢাকা থিয়েটার
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৮১

ঢাকা থিয়েটার মুদ্রিত স্যুভেনিরে দলের নাট্যাদর্শ ও কিত্তনখোলা’র আখ্যান-পরিপ্রেক্ষিত জানায় :

বাংলাদেশ একটি জাতির নাম। একটি সংগ্রামক্ষুব্ধ অকুতোভয় জনপদের নাম। যুদ্ধ, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে এই জনপদ সমুন্নত জীবনের আকাঙ্খাকে প্রজ্জ্বলিত করেছে তার সামুদ্রিক দুই চোখে। এই দেশ, তার ইতিহাস, সংগ্রাম, সংস্কৃতি সবকিছুকে আমরা সম্মান করি। পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, আত্রাই, ধবলার কুলে কুলে নামহীন গোত্রহীন মানুষের সংগ্রামী জীবন হোক আমাদের নাটকের বিষয়বস্তু।

সমকালীন নাট্যচর্চার দিকে তাকালেই যেকোনো সচেতন দর্শক এদেশের নাটকের দুটি ধারা স্পষ্টতই দেখতে পাবেন। একটি ধারা গতানুগতিক বাংলা নাটকের সোজা পথ ধরে বইছে, অন্যটি বিদেশি নাটকের অনুবাদ ভাবানুবাদ মঞ্চায়নের মাধ্যমে লক্ষ্যহীন ও বিভ্রান্ত ধারায় উচ্ছ্রিত হচ্ছে। ঢাকা থিয়েটার এদেশের নাটকের প্রকৃত প্রবাহটি সৃষ্টি করতে চায়।

আমরা দেশজ আঙ্গিকের স্পর্শে রচিত নিগূঢ় শিল্পবোধের দ্বারা সৃষ্ট নাটক ও নাট্যচর্চায় বিশ্বাসী।

মানিকগঞ্জ মহকুমার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল। টাঙ্গাইল জেলার কিয়দংশ ও যমুনার পূর্ব তীর ঘেঁসে বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ কিত্তনখোলা নাটকের পটভূমি। এই অঞ্চলের টপোগ্রাফি প্রায় একই রকম প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

এই নাটকের মনাই বয়াতি মূলত তালুকনগরের আজহার বয়াতি। তালুকনগরে এই সাধক শিল্পীর কবর আছে। প্রতি বছর তাঁর মাজারকে কেন্দ্র করে মাঘ মাসের ৬ তারিখে মেলা বসে তেরশ্রী, টুইটাম, ঘেওরকুল, দৌলতপুর, ভদ্রা, জালাই, দপ্তিয়ার নলসন্ধা, কৈজুরী ইত্যাদি প্রায় সবগুলি গ্রাম বাস্তবেই আছে। এই অঞ্চলে খুব কম বাড়িই আছে যে বাড়িতে বছরে দু’একবার গান বাজনা হয় না। জনগণের এই সঙ্গীতপ্রিয়তার জন্য এই অঞ্চল জুড়ে অসংখ্য গায়ক, সাধক ও বয়াতির জন্ম হয়েছে। এই এলাকার অনেক পরিবারই বহু বছর আগে ফরিদপুর, পাবনা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে এসে বসবাস করছে। ইতালীর কবি ওভিদের ‘মেটামরফোসিস’ কাব্যে যে পৌরাণিক রূপান্তরের কথা বলেছেন, আমরা তাকে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক পটভূমিতে প্রত্যক্ষ করেছি। এই নাটকের সোনাই বছির, বনশ্রী, ছায়ারঞ্জন, গোলাপ গাছি-প্রায় সবগুলি চরিত্রই জীবন জীবিকার সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়।

এই রূপান্তর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতই শুধু নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের মধ্যে, জীবনের অনিঃশেষ প্রক্রিয়ায় বিস্তৃত।

বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির সংগ্রামী রূপান্তরে এই জনপদের মানুষকে সাহায্য করে কিনা, কিত্তনখোলা নাটকে আমরা তা দেখতে চেয়েছি। কিন্তু বাস্তব জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রচলিত সংস্কৃতির প্রভাব একক ও সার্বভৌম নয়। একটু সচেতন হলেই আমরা দেখব সয়ফুল মুলুকের সমুদ্রযাত্রা ও সোনাইর দুখাইপুর যাত্রা সমান্তরাল হলেও বাস্তবে তা কত ভিন্ন।

সোনাইর জন্য কোনো পরী-কন্যা নয়- হয়তো বা বিবরবাসী শঙ্খচূড়ের ফণা অপেক্ষা করে। কিন্তু সোনাই যে দুখাইপুরে যাত্রা করে তার পেছনে সয়ফুল মুলুকের সমুদ্রযাত্রার প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। একে দ্বৈতাদ্বৈত সম্পর্কও বলা যায়। কিত্তনখোলা নাটকটি নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা সর্বদাই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমির কথা মনে রেখেছি।

নাটকটিতে একটি শোষণমুখী সমাজের রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে মঞ্চে উপস্থাপিত করার চেষ্ট করা হয়েছে। বাস্তব চিত্রগুলিকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এবং চরিত্র নির্মাণে সেই বাস্তবতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছি।১

বাংলাদেশ নামক জনপদের নদী তীরে তীরে নামহীন গোত্রহীন মানুষের জীবন - নাটকের বিষয়বস্তু - তার ইতিহাস সংগ্রাম-সংস্কৃতিসহ। দেশজ আঙ্গিকে সৃষ্ট তাদের নাটক বলেও ঘোষণা করা হয়। এই নাটকে জীবন জীবিকার সংগ্রামে রূপান্তরিত মানুষকে আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষ করা হয়েছে। সংস্কৃতি সংগ্রামী রূপান্তরে মানুষকে সাহায্য করে কি না তা দেখতে চাওয়ার কথা আছে। লোককথার সমান্তরাল রূপান্তর বাস্তবে কত ভিন্ন। তবু দুইয়ের ভিতর সম্পর্ক আছে। প্রভাব আছে। শোষণামুখী সমাজের রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে মঞ্চে উপস্থাপনের চেষ্টা হয়েছে। নাটকে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনাসৃষ্টির জন্য পৌরাণিক, অতিলৌকিক ঘটনার আমদানি করা হয়েছে- নাটকের চূড়ান্ত মহলায় একথা বলেন নাট্যকার:

দর্শক-সমালোচকদের মতামত

কিত্তনখোলা’র চূড়ান্ত মহড়ানুষ্ঠানের শেষে উপস্থিত সুধীদের কাছ থেকে নাটকটি সম্পর্কে মতামত আহবান করা হয়। এ পর্যায়ে বক্তব্য রাখেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শওকত আলী ও রশীদ হায়দার। এঁরা অভিমত ব্যক্ত করেন, আমাদের লোকজ ঐতিহ্যকে সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত করার চেষ্টা এ নাটকে নেয়া হয়েছে, এটি উদ্যোগের দিক থেকে অবশ্যই ব্যতিক্রম। এরা আরো বলেন নাটকটিতে কিছু-কিছু দৃশ্য অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। কিছু ঘটনা নাটকের অগ্রসরমানতার অপ্রত্যাশিত শৈথিল্যের সৃষ্টি করেছে। নাটকের রচয়িতা সেলিম আল দীন, এঁর বক্তব্যে অবশ্য এ নাটকে ঘটনার উপর্যুপরি উপস্থাপনার কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, কিত্তনখোলা নাটকে মহাকাব্যিক ইমেজ সৃষ্টি করার জন্য পৌরাণিক, অতিলৌকিক ঘটনার আমদানী করা হয়েছে। মহাকাব্যিক ব্যাপ্তির জন্য ঘটনাকে নানা প্রসঙ্গে ধাবিত করতে হয়, এ নাটকেও তা-ই করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কিত্তনখোলা নাটকে দেখা যাবে ‘অঙ্কের’ পরিবর্তে ‘সর্গ’ করা হয়েছে এবং তা করা হয়েছে মূলত মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টির জন্য।২

নাটকে তিন ধরনের পৃথক ও অভিন্ন দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করেন এক সমালোচক :

কিত্তনখোলা’র কাহিনী তিন ধরনের পৃথক, অথচ অভিন্ন দ্বন্দ্বের সমন্বয়-সোনাইয়ের জমির প্রতি ইঁদু কন্ট্রাক্টরের লোভ ও তাদের উভয়ের দ্বন্দ্ব; যাত্রাদলের কুশলীদের সুখ-দুঃখ, মানবিক আর্তি, নেশা ও পেশার দ্বন্দ্ব এবং মালিকের লোভের কাছে নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিসর্জন ও শোষণ; এবং লাউয়া শ্রেণীর অস্তিত্বগত সংগ্রামের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, জাত্যাভিমান ও পেশা বদলের প্রচেষ্টা-ইত্যাদি এই নাটকের কাহিনীসূত্র। আপাতদৃষ্টিতে এই কাহিনী সুত্রত্রয়কে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে, কিন্তু তারা বিচ্ছিন্ন নয়, বরং পরস্পর সম্পর্কিত। কিত্তনখোলা মেলার বর্ণাঢ্য ও আনন্দমুখর পরিবেশে নাট্যকার এই তিন শ্রেণীর রহহবৎ ঝড়ঁঃবৎ উভয় সংগ্রামকে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে উপস্থিত করেছেন। ফলে ঘটনা যত বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি বড় হয়েছে ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ। মেলার আবরণে নাট্যকার এসব কাহিনীসূত্র সংগ্রথিত করতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন রূপকাশ্রয়ী রীতির। কবির লড়াই, পুঁথি পাঠ ইত্যকার কিছুর ব্যবহার একারণেই এসেছে, প্রাথমিক বিচারে এগুলোর ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত ও বাণিজ্যিক প্রচেষ্টা বলে ভ্রম হতে পারে, তবে মেলার মূলভূমি কিত্তনখোলা’র অন্যতম আকর্ষণ মনাই বয়াতির মাজার- একথাটি স্মরণ রাখলেই সমস্যার সমাধান লাভ সম্ভব। মনসা কাহিনী ও আমলকি-কে রূপক হিসেবে নাট্যকারের ব্যবহার প্রশংসনীয়।৩

ইঙ্গিতময় মঞ্চে উপস্থিত এক মেলাজীবন, বিশেষ কোনো কাহিনী ছাড়িয়ে যায়। মাধ্যবিত্তের স্থবির জীবন ছাড়িয়ে জনজীবনে পৌঁছে যায়- শিকড় ও শিরদাঁড়া ফিরে পাওয়ার আবেগ বোধ করেন হাবিব হাসান এ নাটকে :

চলো যাই কিত্তনখোলা ... গীত দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ। মঞ্চের মেলাটিকে যেন লোকায়ত বাংলাদেশ থেকে কেটে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে পোড়া কাঠ, আলো-ছায়া অন্ধকার, বিগতপত্র কাঁটাগাছে হঠাৎ কাটা কোনো ঘুড়ি, কেবল অনেক দূরে পেছনে একটি মাত্র একাকী সবুজ, অপ্রস্তুত বৃক্ষ। যেন এই টানাপোড়েন, জীবনের পাক, আশ্চর্য আবর্তের বিরুদ্ধে অকৃত্রিম সবুজ আলোর রেখা, অনিঃশেষ প্রাণময়তা। শুরুতেই দর্শককে এভাবে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে কিত্তনখোলা’র মঞ্চ।

বিশেষ ও প্রতিষ্ঠিত কোনো কাহিনী নাটকটিতে আছে বলে মনে হয় না। যা আছে, সেগুলো দর্শকের নিকট কিছু উপকাহিনী মাত্র। কিছু উপকাহিনীর মাঝ দিয়ে নাটকটিতে একটি শোষণমুখী সমাজের রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে মঞ্চে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যে কারণে এসেছে মেলায় আসা যাত্রাদল, যাত্রাদলের কুশীলবদের দিয়ে মানব-মানবীর সম্পর্কের রহস্য উন্মোচনের প্রচেষ্টা, অর্থগৃধু অধিকারী, সমাজ থেকে বিতাড়িত ছিন্নমূল ‘ইঁদু-র’ অপ্রকৃতিস্থ ছেলে ছায়া, সমাজব্যবস্থার সুবিশাল থাবার সুচতুর ও পরিকল্পিত শিকার সোনাই, বছির রুস্তম, ডালিমন, মালকা-এরা। গোটা নাটক জুড়ে একটি নির্দিষ্ট কাহিনীকে ছাড়িয়ে নেওয়ার নাট্যকারের অব্যাহত প্রচেষ্টা বারংবার চোখে ঠেকে। এবং এমনও মনে হয়, আদৌ কি কোনো কাহিনী নির্মাণের দরকার রয়েছে? যে কারণে, সবকিছু ছাপিয়ে একটি মেলাজীবন, যা এই মানব জীবনেরই প্রতীকী প্রতিভাস মাত্র, তা অপরূপ সততা ও খুঁটিনাটিসহ দর্শকের হৃদয়ে খুব সহজেই স্থান করে নেয়। সোনাই, ইঁদু কিংবা ডালিমন নিয়ে যে অন্তর্গত কাহিনী নাট্যকার তৈরি করতে চান তাকে ঠেলে দিয়ে একটি নির্বিশেষ মানবজীবন দর্শককে স্পর্শ করে। এতে ব্যঞ্জনা আনে শামসল বয়াতীর পুঁথি (সয়ফুল মুলুকের সমুদ্রযাত্রা), বনশ্রীর মনসা-রূপ, কখনো বা ছায়া কিংবা সোনাইর রক্তে দোলা জীবনজিজ্ঞাসা। মঞ্চ ও আলো, সংগীত ও স্বচ্ছন্দ অভিনয়ে নাটকটি একটি সম্পূর্ণ আলাদা, মানবিক জগৎ নির্মাণ করে।

নাট্যকারের এ্যাম্বিশন নাটকটিকে কি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে? এ জাতীয় প্রশ্ন উঠতে পারে। নাট্যকার একটি মহাকাব্য নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মহাকাব্যের যে বিশালত্ব, ব্যাপ্তি, ব্যঞ্জনা অথবা গূঢ়ার্থ তা নাটকটিতে নেই। যে কারণে কিত্তনখোলা’র কিছু কিছু দৃশ্য কেবল বিপজ্জনকভাবে অর্থহীন ও বিনোদনমূলক বলে সন্দেহ হয়। এ্যাম্বিশনের কারণেই নাট্যকার কোনো কোনো কুশীলবের মুখে তুলে দেন তাঁরই রচিত জীবনজিজ্ঞাসা, তারা ছন্দ গেঁথে গেঁথে অদ্ভুত সব জীবনজিজ্ঞাসু প্রশ্ন করে চলে। লাফিয়ে উঠে আসে কোনো চরিত্র, দু’একটা আঁচড়ে তাদেরকে আঁকার চেষ্টা করা হয়, কেউ কেউ তাদের বিকশিত হবার আগেই শেষ হয়ে যায়। বলতে চাইছি নাটকটি যেনো বা একটু তাড়াহুড়ো করেই শেষ করে দেয়া হয়েছে। যার ফলে যে সম্ভাবনাময় শুরু ছিলো নাটকটিতে, শেষাবধি তা টেকে না, শেষ দৃশ্যটি হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়, দর্শক তখনো অপেক্ষা করে, কিন্তু দ্রুত আলো জ্বলে এবং নাটক শেষের বাঁশী বেজে ওঠে।

গতিময়তা নাটকটির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। নাট্যকার অত্যন্ত সচেতনতার সংগে কিত্তনখোলাকে মানবজীবনের প্রতীক করে তুলেছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর শক্তি নিশ্চয়ই স্বীকার্য। বলাবাহুল্য, এ জীবন মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের স্থবির, একঘেঁয়ে জীবন নয়, বরং নিচু, অন্ত্যজ শ্রেণীর বিশাল, গতিশীল মানবজীবন, যেকানো ক্রোধ-হিংসা-প্রতিশোধ প্রেম ও অনুরাগ মুখোসহীন উঠে আসে। নাটকের সাহিত্যগুণও অগ্রাহ্যের নয়। সেলিম আল দীনের কিত্তনখোলা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ...

কিত্তনখোলা আমাদের একটি সম্পূর্ণ আলাদা অভিজ্ঞতা দান করে। আমাদের শূন্যস্থিত, শহুরে পা জোড়া পুনরায় মাটিতে নেমে আসতে চায়, হঠাৎ যেন ঝলসে উঠতে দেখি হারানো দিগন্ত, যেন আবার ফিরে পেতে চাই নিজেদের শেকড় ও শিরদাঁড়া। সয়ফুল মুল্লুকের সমুদ্রযাত্রা তখন কেবল রূপকথা থাকে না, কিন্তু সোনাই কেবলমাত্র কিত্তনখোলা’র কোনো কুশীলব নয় : মুহূর্তে আমাদের রক্তোজ্জ্বল চেতনার সাথী হয়ে যায়।৪

শোষক আর শোষিতের দ্বন্দ্ব সংঘাত এবং পরিশেষে সামগ্রিক জনতার ক্রোধ প্রকাশের প্রচলিত কাঠামো নাটকে পুরোপুরি না পেয়ে সমালোচনা হয়েছে :

চরিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় ইঁদু কন্ট্রাক্টার আর সোনাই দুই তীরের দুই মানুষ। ইঁদু শোষকের প্রতীক আর সোনাই শোষিতের প্রতীক। শোষিত সোনাইকে ঘিরেই নাটকের কাহিনী-বিস্তার। শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সোনাই যেন মৃগীরোগী। ইঁদু-র শোষণের কৌশলে সোনাই ভীত সন্ত্রস্ত। ইঁদু এমন একটি রূপান্তরিত শোষক যে পরের জমি করায়ত্ত করে। আবার টাকার বিনিময়ে বনশ্রীর নাচও দেখে। নাটকের বনশ্রী ছায়ারঞ্জন রবিদাশ বছির এদের উপরও ইঁদু কন্ট্রাক্টার তার শোষণের হাত বিস্তার করেছে। শোষণের প্রয়োগকৌশল ভিন্ন ভিন্নভাবে এলেও পুরো সমাজ জীবনে নাড়া লেগেছে। যেমন নাড়া লেগেছে সোনাইয়ের জীবনে তেমনি লেগেছে বনশ্রী ও ছায়ারঞ্জনের জীবনে। বনশ্রীর নাচ দেখে ভাল লাগায় ইঁদু কন্ট্রাক্টার যখন বলে, ‘আমি সাইঝের বেলায় বনশ্রীর ঘরে যাবো’- ভাল লাগার এই যে অশ্লীল কামনা যার প্রতিক্রিয়া পড়েছে ছায়ারঞ্জন ও রবিদাশের উপরে। যা আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন লেখক বনশ্রীর মুখে মনসার সংলাপ জুড়ে দিয়ে; আবার বিপরীতে টেনেছেন জীবনের প্রতীকী আমলকীর স্বাদ বিলিয়ে। একদিকে ইঁদু কন্ট্র্রাক্টারের ইন্দ্রিয়ের লালসা আর অপরদিকে প্রিয়জনের আত্মপীড়ন জীবনের টানাপোড়েনে বনশ্রী কাতর। পরিশেষে লেখক জীবনযুদ্ধে পরাজিত করে বনশ্রীকে এন্ড্রিন পানে আত্মহত্যা করিয়েছেন। এই মৃত্যু দর্শকদের চিন্তা ও চিন্তনে আঘাত করেছে। ভাবতে শিখিয়েছে, ইঁদুদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছে।

ইঁদুকে হত্যা করে সোনাই সমাজ পরিবর্তনের কোনো গন্তব্য বা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পারেনি বরং তার পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। সে একা নিঃসঙ্গ। কাজেই এ হত্যাকান্ডকে স্বীকার করা যায় না। কেননা এ হত্যাকান্ড সামগ্রিক জনতার ক্রোধ হয়ে উঠেনি। ইঁদু-র প্রতি ঘৃণাবোধের সৃষ্টি করেছে।৫

শহুরে দর্শকের মানসিকতা এ নাটক উন্নত করবে, গ্রামের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে- একথাও এক সমালোচনায় বলা হয় :

আজ তাই ঊনিশ শতকের প্রান্তে এসে নগর সভ্যতার মুহ্যমান এবং বাংলাদেশের মত একটা গ্রাম সম্পর্কে যাদের ধারণা অস্পষ্ট গল্পের মত অথবা ছাড়িয়ে যাওয়া স্মৃতি, তাদের মানসিকতা উন্নত করার প্রয়াসে ঢাকা থিয়েটার এর নাটক কিত্তনখোলা, অর্থাৎ গ্রামের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ার একটা সুন্দর বাহন এ নাটক। ৬
প্রথাবদ্ধ গ্রামজীবন নাটকে না আসায় তারিফ করেও, সামাজিক বঞ্চনার প্রতিকার সামাজিকভাবে না হওয়ায় মধ্যবিত্তের বিপ্লব-বিলাসিতা প্রত্যক্ষ করেছেন এ সমালোচক :

তবে কিত্তনখোলা যেখানে মধ্যবিত্তের বিপ্লব-বিলাসে রূপান্তরিক হয়েছে, ভাসানী হুজুর, ক্ষেতমজুর হয়ে যাওয়া চাষীর দুঃখ, গ্রাম্য ধনীকের সামাজিক নিষ্পেষণ ইত্যাদি সব কিছু এনেও নাটক যেখানে অর্থহীন পরিণতিতে মাথা কুটে মরে সেখানে পরিচালকের কিছু করার ছিল না। জীবনের মোটাদাগের রূঢ় ছবির চাইতে প্রেমকাহিনী ফাঁদার টানেও নাট্যকার অনেকটা ভেসে গেছেন।

বাংলাদেশের গ্রামজনসংখ্যার অধিকাংশ আজ ভূমিহীন কিন্তু ভূমিহারানো এই সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষীর ছবি শিল্প-সাহিত্যে খুব একটা তো লক্ষ্য করা যায় না। সেদিক দিয়ে কিত্তনখোলা-ও প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় ও সাহসিক। তদুপরি এখানে ক্রুর জমিদার, জোতদার ও দরিদ্র-চাষীর সেই চির পরিচিত মঞ্চক্লান্ত কিন্তু বাস্তবে অনুপস্থিত কাঠামোটি অবলম্বন করা হয়নি। কিন্তু এটুকু কৃতিত্বেই একটি নাটক সফল হয়ে ওঠে না। যেহেতু বঞ্চনার প্রকৃতিটি সামাজিক তাই এর প্রতিকারের প্রচেষ্টাও হবে সামাজিক অর্থাৎ মিলিত ও যৌথ। কিন্তু নাট্যকারের মধ্যবিত্ত-সুলভ বিচ্ছিন্ন বিপ্লব-বিলাসের কারণেই বোধহয় সমস্ত ক্ষোভ ও বঞ্চনার জ্বালা নিয়ে সোনাই শেষ পর্যন্ত একক ঘাতক কি ডাকাতেই রূপান্তরিত হয়, সোনাইয়ের দুঃখ-বেদনাকে সামাজিক চরিত্র প্রদানের চাইতে লেখক বরং দুঃখমোচনের একক পথেই তাঁকে ঠেলে দেন এবং কন্ট্রাক্টরকে দায়ের আঘাতে হত্যার পর জায়মান লাল সূর্য পটভূমিতে রেখে যেভাবে সোনাই মঞ্চ ত্যাগ করে তা কোনো গভীর চেতনার পরিচয় বহন না করে বরং বাহাদুরিকেই প্রকাশ করেন বেশি। বস্তুত নাটকের অবতারণা সুন্দর হলেও যতই কাহিনী অগ্রসর হয় ততই সব এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। বাংলায় মৌলিক নাটকের মস্তঅভাবটুকু খুব সহজে পূরণ হবে বলে বোধ হচ্ছে না।৭

তবে নাটকটি নানা মাধ্যমের বিশিষ্টজনকে আলোড়িত করে। শিল্পী কামরুল হাসান এই নাটকে মাটির গন্ধ পেয়ে আপ্লুত :

অত্যন্ত শংকিত ছিলাম এতাদিন। আজ কিত্তনখোলা দেখে অনেক স্বস্তি পাচ্ছি। ভাবতাম আমাদের লোকজ সংস্কৃতি যা কি-না একেবারেই আমাদের নিজস্ব সম্পদ-সেটা ক্রমশ আমরা হারিয়ে ফেলছি, আমদানী করা বিদেশি সংস্কৃতি সেটা আমাদেরকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। ঠিক তখনই এই কিত্তনখোলা দেখে-এই মেলা, মেলার মানুষ, মানুষের ভাষা, সেট ডিজাইন, সঙ্গীত সবকিছু আমাকে আমার মাটির কাছে নিয়ে গিয়েছে। আমি আমার মাটির গন্ধ পাচ্ছি। আর শংকা নেই আমার। আমি এখন শান্তিতে মরতে পারবো।৮

শিক্ষাব্রতী জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এই নাটকে লোকসংস্কৃতির নবমাত্রিক প্রয়োগ লক্ষ্য করেন :

মেলার আয়নায় আমরা দেখি একই সঙ্গে শাশ্বত বাংলা ও সমকালীন বাংলার এক চেহারা, যা আমাদের নাগরিক স্বস্তিকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়। যাত্রা, জারী, পুঁথি ও কেচ্ছার আবেদন কেন ও কেমন- তার উত্তর পাওয়া যায় লোকসংস্কৃতির এই উপাদানগুলোর নাট্যসম্মত ব্যবহারে। প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা বেশি জায়গা এরা নিলেও, এগুলোর উপস্থাপনার সৌন্দর্য দর্শককে বাধ্য করে এই আপত্তিকে ভুলে যেতে। জীবনের কোমলতা ও কঠোরতা, পবিত্রতা ও পশুত্বকে তুলে ধরতে গিয়ে যে পরিস্থিতিগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোকে মামুলী বলে মেনে নিয়েও, সেগুলোর যথার্থতা অস্বীকার করা যায় না। সমাজ সম্পর্কে নাট্যকারের একটা বক্তব্য আছে। কিন্তু কিত্তনখোলা’র সেই বক্তব্যের চেয়ে যেটা মূল্যবান সেটা হলো নাট্যকল্পনায় একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হলো- এই কথাটা। এই পথে আরও নতুন, আরও সার্থক নাট্যকর্মের ইশারা আছে। ঢাকা থিয়েটারের শিল্পীদল নাট্যকারের কল্পনাকে শুধু নৈপুণ্য দিয়ে নয়, প্রাণের দরদ দিয়ে এগিয়ে দিয়েছেন। দর্শকের অনুভূতির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তারা সবাই একটু চড়া গলায়, একটু ঊর্ধ্বশ্বাসে কথা বলেছেন; কন্ঠস্বরের ব্যবহার বিষয়ে যদি আরও মনোযোগী হন, তাহলে মানুষের মুখের কথা, উচ্চারিত সংলাপ, আরও নাটকীয় মর্যাদা পাবে। কিত্তনখোলা শুধু একটি পরীক্ষা নয়, একটা অভিজ্ঞতাও।৯

কবি ও মননব্রতী আবু হেনা মোস্তফা কামালের ভাষ্য মতে অভিনব এই নাটক নিয়ে যায় ‘স্বদেশের হৃদয়ের কাছে’ :

কিত্তনখোলা, এক কথায় ব্যতিক্রমী স্বাদের নাটক। ঢাকায় আমরা সাধারণত যেসব নাটক দেখি- কখনো মঞ্চে, কখনো টেলিভিশনে- তার সাথে কিত্তনখোলা’র কোনো মিল নেই। শহুরে জীবনের সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকে এই নাটক আমাদের নিয়ে যায় একেবারে স্বদেশের হৃদয়ের কাছে। তথাকথিত নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা অন্তত আড়াই ঘন্টার জন্যে আমরা সবাই ভুলে যেতে পারি। কিত্তনখোলা’র মেলায় আসে সোনাই, বসির, রবিদাস, বনশ্রী, শামসল বয়াতী, ছায়ারঞ্জন, গোলাপ গাছি- আরো কতো বিচিত্র পেশা ও পরিচয়ের মানুষ। এদের জীবনের নেপথ্য- বেদনা নাট্যকারের চোখ এড়ায়নি। গ্রাম- বাংলার সংস্কৃতির সহজ উৎসারণ আর ব্যবসায়ী অধিকারীর বণিকবুদ্ধির দ্বৈরথে শেষ পর্যন্ত অশুভ ব্যক্তিই জয়ী হয়। বনশ্রীর আত্মহত্যার ভেতর দিয়ে তারই প্রতীতী উল্লেখ পাই। কিন্তু গ্রাম্য ঠিকাদার ইঁদুর পরিণাম যে- সামাজিক শক্তির উত্থানের সঙ্কেত দেয়- সম্ভবত তাকে নিয়েই রচিত হবে কিত্তনখোলা’র উত্তরকাব্য।

কিত্তনখোলা আমার অপরিসীম ভালো লেগেছে, কারণ এই নাটকে এতোটুকুও নাটুকেপনা নেই।১০

কিত্তনখোলা নাটকের আখ্যানব্যাপ্তি, বিশিষ্ট বিন্যাস ও তার মঞ্চরূপায়ণের সিদ্ধি দর্শক- সমালোচককে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। কাহিনীর অভিনব জটিল বিন্যাস, মহাকাব্যিক চারিত্র্য প্রদান প্রচেষ্টার মধ্যে কতক অসঙ্গতি এবং পরিণতির প্রতিকার পন্থা নিয়ে বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শগত আপত্তি উঠেছে। সেটা যদিও নাটকটির বিশিষ্ট ধরনের সামর্র্থ্য বিচার করে ততটা নয়। নাটকটির সমূহ অভিনবত্ব বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করে। বিশিষ্ট এক রাজনৈতিক নান্দনিকতা এভাবে ওঠে থিয়েটারে শিল্প ও রাজনীতি সম্পর্কের প্রশ্নে।

m~ÎZ_¨: 1. XvKv w_‡qUvi, ÔwKËb‡LvjvÕ, my¨‡fwbi 1981, 2. ÔmwPÎ ¯^‡`kÕ, 10 wW‡m¤^i 1981, 3. ÔmvßvwnK Le‡ii KvMRÕ, 6 wW‡m¤^i 1981, 4. ÔmwPÎ mÜvbxÕ, 31 Rvbyqvwi 1982, 5. Ô‰`wbK msev`Õ, 17 A‡±vei 1981, bMi ms, 6. Ô‰`wbK †`kÕ, 17 Ryb 1982, bMi ms, 7. ÔmvßvwnK wecøeÕ, 24 Ryb 1982, 8. c~‡e©v³, 9. c~‡e©v³, 10. c~‡e©v³,|

[তৃতীয় ও শেষ কিস্তি আগামী সংখ্যায় ছাপা হবে। তৃতীয় কিস্তিতে থাকছে- নূরলদীনের সারাজীবন, ইবলিশ, কেরামত মঙ্গল, কবর দিয়ে দাও, নানকার পালা, গ্যালিলিও এবং সাতঘাটের কানাকড়ি। ]

wecøe evjv : bvU¨Kvi, wb‡`©kK| XvKv wek¦we`¨vj‡qi bvUK I msMxZ wefv‡Mi wkÿK