Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

নাট্যকলাবিদ জর্জি গ্রটস্কি : উল্টোস্রোতের সাঁতারু

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

আধুনিকতম নাট্যতত্ত্ব ও নাট্যশিল্প ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও মহৎ নাম জর্জি গ্রটস্কি। তাঁর নাট্যচর্চার সমুদ্রসম গভীরতা বিবেচনা করেই হয়তো পিটার ব্রুক বলেছেন,- গ্রটস্কি অতুলনীয়। কিন্তু কেন তিনি তুলনাহীন? এই প্রশ্নোত্তরে ব্রুক বলেছেন,- স্তানিস্লাভস্কির পর একমাত্র গ্রটস্কিই অভিনয়ের উৎস ও উপসর্গ নিয়ে বৈজ্ঞানিক তদন্ত পরিচালনা করেছেন। গ্রটস্কি তাঁর থিয়েটারকে একটি গবেষণাগার হিসেবে গড়ে তুলেছেন। একজন অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীর ল্যাবরেটরির মতোই গ্রটস্কির থিয়েটারে যথার্থ ও প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক উপাদান ও শর্তাবলী বিদ্যমান ছিলো। গ্রটস্কির সঙ্গে দলগতভাবে দুই সপ্তাহ কাজ করার অসাধারণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পিটার ব্রুক বলেন,- তাঁর কাজকে বর্ণনা করা দুঃসাধ্য, অসম্ভব। আসলে গ্রটস্কির থিয়েটারকে শব্দে, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এ হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে অনুভবের শিল্প। তাঁর থিয়েটার অবাচনিক। এখানে সব কিছুই ঘটে মন ও শরীরের সাহায্যে। শেষ পর্যন্ত পিটার ব্রুক আত্মজিজ্ঞাসায় আকুল হয়েছেন। ব্রুক নিজেকে প্রশ্ন করেছেন এভাবে যে, গ্রটস্কির কাজটা কী ঘটায়, করে কী? প্রকৃতপক্ষে, তাঁর কাজ প্রতিটি অভিনেতার মধ্যে অসংখ্য কম্পন, আলোড়ন, উপলব্ধি ও চমক তৈরি করে। কেননা ব্যক্তি অভিনেতার মধ্যে সংগুপ্ত সহজ অথচ সাংঘাতিক সত্যের মুখোমুখি করে এই কম্পন, এই বোধ। এই যে এক বোধ তা তৈরি হয় গ্রটস্কির পদ্ধতির মাধ্যমে। তাঁর থিয়েটার শিল্পের শক্তি সম্পর্কে দৃষ্টান্ত হিসেবে পিটার ব্রুক নিজেকেই নির্বাচন করেন। ব্রুক বলেন, ইংলিশ থিয়েটারে গ্রটস্কি একটা নাড়া দিয়েছেন। আর তা হলো, থিয়েটার একটা সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ও অধ্যাবসায়ক্ষেত্র। গ্রটস্কি এমনভাবে প্রশ্ন তুলেছেন যাতে অভিনেতা ও দর্শক প্রথমে নিজের সঙ্গে তারপর দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়ায় মুখোমুখি হয়। গ্রটস্কি মনে করেছেন অভিনয় শিল্পটা হচ্ছে সন্নাসীর জীবনের মতো উৎসর্গীকরণ। আর এই উৎসর্গে, এই নিবেদনে কোনো ফাঁক থাকবে না। এজন্যই তাঁর থিয়েটার বাজারী ও বানিজ্যেক নয়। গ্রটস্কির থিয়েটার তাই পরিচর্যামূলক। পিটার ব্রুক তাঁর ভূমিকাটি শেষ করেন এভাবে যে, তীব্রতা, সততা, ত্রুটিহীনতা এই সবকিছু গ্রটস্কির কাজকে এগিয়ে দেয়। এই কর্মপ্রক্রিয়া একটা চ্যালেঞ্জ। গ্রটস্কির থিয়েটারে মোকাবিলা ঘটে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। কখনো কখনো নয়।

তাই গ্রটস্কি থিয়েটারকে মনে করেছেন Confrontation বা যুদ্ধক্ষেত্র। থিয়েটারের মতো এই যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে হলে কোনো সমরসজ্জার দরকার নেই। দরকার শুধুমাত্র উৎসর্গীকরণ। কেননা গ্রটস্কির থিয়েটারে কোনো অবকাশ, কোনো বিরাম, কোনো ক্লান্তির অজুহাত তোলা যায় না। একজন অভিনেতা চূড়ান্ত ধরনের ত্যাগ ও ধ্যানের মানসিকতা নিয়ে এই লড়াইয়ে টিকে থাকে। গ্রটস্কি অভিনেতাকে কখনোই একজন সন্ত বা দরবেশ কিংবা একজন বাউলের মতো বিবাগী, সংসার উদাসীন নিমগ্ন মানুষের জীবনকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে বলেন না। গ্রটস্কির গবেষণাগারের অভিনেতা অবশ্যই ইহজাগতিক। জীবন ও জগৎ থেকে সে কখনোই নিজেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে না। গ্রটস্কি অভিনেতাকে একজন সন্তের নিমগ্নতা ও তপস্যার শক্তিটুকুই শুধুমাত্র সঞ্চয় করতে বলেন। অভিনেতার অভিনিবেশের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে শুধু অভিনয়। কেননা গ্রটস্কি প্রথমত এবং শেষ পর্যন্ত অভিনয়কেই থিয়েটারের মর্মবস্তু হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং নিজের নাট্যচর্চায় এই প্রত্যয়কেই সমস্ত কিছুর মাধ্যমে গ্রহণ করে নিয়েছেন। গ্রটস্কির নাট্যতত্ত্বে তাই যা অভিনয় তা-ই থিয়েটার। অভিনয় আর থিয়েটার এখানে একার্তক-সমার্থক। তাঁর তত্ত্ব ও প্রয়োগে প্রচলিত থিয়েটারের সমস্ত ঘরানাকে বাতিল করে দেবার এক সুন্দর দুঃসাহস তীব্রভাবে লক্ষণীয়। থিয়েটার এক সমন্বিত শিল্পকলা প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য এই ধারণায়, এই বক্তব্যে তিনি চলচ্চিত্র ও টিভি মাধ্যমের কাছে প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া ব্যর্থদের কন্ঠস্বর শুনতে পান। গ্রটস্কি তাই এই ধারণাকে অগভীর ও অগ্রহণযোগ্য মনে করেন। তাঁর মতে থিয়েটার একক ও সার্বভৌম শিল্পকলা।

প্রচলিত ধারণায় পাণ্ডুলিপি, আলো, পোশাক, সঙ্গীত, দ্রব্যসামগ্রী ইত্যাদি হচ্ছে সমন্বিত নাট্যশিল্পের উদাহরণ। থিয়েটারের ক্ষেত্রে গ্রটস্কি এ সব কিছুকেই মনে করছেন অনাবশ্যক। কেননা এগুলো মেকি, মিথ্যা, আরোপিত। এই উপলব্ধি থেকে তিনি তাই থিয়েটার থেকে সমস্ত কৃত্রিম উপাদান অপসারণ করতে চান। তিনি বলেন, থিয়েটারে এগুলোর কোনোটাই প্রয়োজনীয় নয়। প্রয়োজনীয় একমাত্র অভিনেতা। থিয়েটার হবে তাই একমাত্র অভিনয় প্রধান। অভিনেতাই এখানে সার্বভৌম। অভিনয়প্রধান থিয়েটার তাই একক শিল্পকলা। সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, আলোকসজ্জা ও অভিনয়কলা জ্ঞানের এই বিচিত্র শাখা-প্রশাখার সমন্বয়ে সৃষ্ট প্রচলিত ধারার থিয়েটারকে গ্রটস্কি আখ্যা দেন, Synthetic Theatre বা কৃত্রিম থিয়েটার। একেই আবার বলা হয় Rich Theatre বা সমৃদ্ধ থিয়েটার। কিন্তু গ্রটস্কি বলেন, এধরনের থিয়েটার মূলত এক ধরনের শৈল্পিক চৌর্য প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে তৈরি হয়। তাঁর মতে এই থিয়েটার জ্ঞান বা শিল্পের শাখা-প্রশাখা থেকে বিচিত্র উপাদান আত্মসাৎ করে এক জোড়াতালির শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠে। ফলে থিয়েটার হয়ে ওঠে যান্ত্রিক কলাকৌশল নির্ভর। থিয়েটার তখন যেন একপ্রকার প্রযুক্তির রূপ পায়, যা অভিনেতার শক্তি ও সামর্থকে সঙ্কুচিত করে। এক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে একজন অভিনেতার অসীম সম্ভাবনার জলপ্রবাহ রুদ্ধ হয়ে যায়। অভিনেতা তখন আর আপনকে অবলম্বন করে না। অভিনেতা যেন তখন হয়ে ওঠে প্রবঞ্চক। নিজেকেই নিজে বঞ্চনা করে। অভিনেতা সনির্ভরতা থেকে পরনির্ভরতার দিকে বদল করে বাঁক। অভিনেতার এই বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতা আসলে অর্থহীন। গ্রটস্কি থিয়েটারে অনাবশ্যক। বলা যায় তাঁর থিয়েটারে তিনটি উপাদান অনিবার্য। তা হলো অভিনেতা, অভিনেতা এবং অভিনেতা। মানুষ হিসেবে অভিনেতা নিজেই সিনিক টেকনিক (Scenic Technique) অর্থাৎ দৃশ্যমানতার শক্তির অধিকারী। অভিনেতা একেবারে নিজে এবং নিজেকে দৃশ্যায়িত করার যে সম্ভাবনা ও সামর্থের অধিকারী সেই জিনিসটিকেই গ্রটস্কি নাট্যকলার প্রাণবস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে এখানেই আসে ‘মোকাবিলা’ (Encounter) প্রত্যয়টি। গ্রটস্কি নাট্যদর্শনের একটি প্রধান প্রত্যয় এই ‘মোকাবিলা’। অর্থাৎ অভিনেতা নিজের সাথে নিজে লড়াই করে, মুখোমুখি হয় নিজেকে উন্মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষায়। গ্রটস্কির থিয়েটারে অভিনেতা বিপুল দর্শককে টার্গেট করে না। এখানে দর্শক সুনির্বাচিত, স্বল্প সংখ্যক। এখানে অভিনেতা নিজেই নিজেকে টার্গেট করে। অভিনেতা এখানে আত্ম উন্মোচন ঘটায়। গ্রটস্কির থিয়েটার হলো ভান করা নয়, গোপন করা নয। খুলে ফেলো নিজেকে। প্রকাশ কর নিজের জীবনের সমস্ত ভান, ভণ্ডামি, ছলনা, মিথ্যা, শয়তান ও সুন্দরকে। ব্যক্তির ভিতরের সমস্ত সত্য-মিথ্যা নিয়ে গঠিত যে জীবনসত্য, সেই সত্যের উন্মোচন করে ব্যক্তি হিসেবে অভিনেতা। গ্রটস্কি একেই নিজের সঙ্গে নিজের মোকাবিলা বলেছেন। এই মোকাবিলা চরম মোকাবিলা। অভিনেতা কেবল তার চিন্তার সঙ্গেই মোকাবিলা করে না মোকাবিলা করে সমগ্র সত্তার সঙ্গে। এ আসলে একধরনের যোগাযোগ। অভিনেতার নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার পর সে দর্শকের সঙ্গে বোঝাপড়ায় বা মোকাবিলায় লিপ্ত হয়। দর্শকের সঙ্গে এই মোকাবিলায় অভিনেতা মূলত নিজেকে উপলব্ধি করার জন্য, অন্যের কাছে নিজের ভেতরের বহুস্তরায়িত গোপন অন্ধকারাচ্ছন্ন, মেঘে ঢাকা সূর্যালোকের মতো সত্যকে প্রকাশ করে। গ্রটস্কি অভিনেতা এবং দর্শকের পারস্পরিক সম্পর্ক এমনকি অবস্থানগত (আসন বিন্যাস) স্থাপত্য-কাঠামো নিয়েও জিজ্ঞাসু, নিরীক্ষাপ্রবণ এবং অভিনব বক্তব্য প্রদানে সক্ষম। গ্রটস্কির থিয়েটারে শুধু অভিনেতাই নিজেকে উন্মোচন করে না, দর্শকও উন্মোচনমুখর হয়ে ওঠে। তাঁর থিয়েটারে দর্শক কাঠের পুতুল নয়। দর্শক সেখানে সচল, সক্ষম, নিজের সত্য বলতে তৎপর, উন্মুখ। এখানেই গ্রটস্কির থিয়েটারের শক্তি। তিনি তাঁর থিয়েটারকে কখনো পণ্যসামগ্রী বিক্রয়ের মতো স্বার্থপর ভাবনায় বিচলিত হন না। থিয়েটারকে তিনি ক্রেতা-বিক্রেতার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষেত্র মনে করেন না। দর্শক কাঠের পুতুল নয় কিংবা কেবল নিতেই আসে না। থিয়েটারে দর্শক আসে একটা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে। পারস্পরিক উন্মোচনের মাধ্যমে অভিনেতা ও দর্শক  গড়ে তোলে দ্বিপাক্ষিক কিন্তু নিবিড়, অন্তরঙ্গ এক যোগাযোগ প্রক্রিয়া।

গ্রটস্কি অভিনেতার প্রস্তুতি পর্ব বা চরিত্রায়ণ প্রসঙ্গে একটি সূত্র সঞ্চারিত করে নিতে বলেন। এই সূত্রটি হলো ভায় নেগেটিভ (Via Negative)। এর অর্থ হলো, অভিনেতার দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ নয়, মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক সমস্ত বাধা বা দুর্বলতার সমূল উৎপাটন। প্রকৃতপক্ষে গ্রটস্কি অভিনেতাকে পূর্ব নিধারিত কিছু বিষয়ে দক্ষতা তৈরি কিংবা ঝুড়ি ভর্তি কৌশল শেখানোর কথা বলেন না। এখানে তিনি মনোযোগ নিবদ্ধ করতে চান অভিনেতার পরিপক্কতার দিকে। যে পরিপক্কতা অভিনেতাকে খুলে মেলে ধরার জন্য নিজের একান্ত আপনকে নিংড়ে নিয়ে আসে। অভিনেতা আসলে তখনই প্রস্তুত হয় যখন সে বিদ্যুচ্চমকের মতো এক প্রাকৃতিক গতিময়তা আয়ত্ব করতে পারে। তখন অভিনেতার Impulse বা স্পন্দন ও Action বা ক্রিয়া একই সঙ্গে ঘটে, যেন পরস্পর অবিচ্ছিন্ন ও একক। আর তখনই মনে হয় অভিনেতার যা অনুভূতি তাই প্রকাশ। আর যা প্রকাশ তাই  অনুভূতি। অভিনেতা কৃত্রিম উপাদান বর্জন করে নিজের অন্তর্গত ও সহজাত শক্তিকে, সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নিরন্তর নিজেকে বিবিধ আকৃতি, রূপ, চরিত্র, অবস্থা, চিত্র বা দৃশ্যে রূপান্তর ঘটায়। গ্রটস্কি সর্বদাই অভিনেতাকে এক অলৌকিক অতিপ্রাকৃত শক্তি সঞ্চয়ের দিকে নিয়ে যেতে চান। গ্রটস্কি বলেন অভিনেতা তাই নিজেই নিজের পান্ডুলিপি (Text) বা থিয়েটারের রচয়িতা।

প্রথমত Text বা লেখকের পাণ্ডুলিপি নির্ভর থিয়েটারকে গ্রটস্কি থিয়েটার হিসেবে বিবেচনা করেন না। তাঁর মতে এ ধরনের থিয়েটার প্রকৃতপক্ষে Literature বা সাহিত্য। এই থিয়েটারকে গ্রটস্কি মিথ্যা মনে করেন। এক্ষেত্রে থিয়েটার নিয়ম বা অনুশাসন দ্বারা চালিত হয়। কিন্তু শিল্প নিয়ম শাসিত নয়। মহৎ শিল্প সবসময়ই সমস্ত কিছু অতিক্রম করেই সৃষ্টি হয়। গ্রটস্কি সাহিত্য-শাসিত থিয়েটারের সীমানা ডিঙিয়ে চলে যেতে চান অন্য আঙ্গিনায়। গ্রটস্কি থিয়েটারে তাই সাহিত্যিক ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ ভালোবাসেন না। তিনি যা করেন তা হলো Theatrical Creation বা থিয়েটার সৃষ্টি। গ্রটস্কি থিয়েটার স্রষ্টা শব্দটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। এই শব্দটি কোথায়, কীভাবে, কখন ও কেন মানে (অর্থ) তৈরি করছে- এই প্রশ্নটিতেই প্রাধান্য দেন। তাঁর মতে মানবীয় জীবনস্পন্দন ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে যে প্রণালীর সূচনা হয় তাই থিয়েটার। আর এই থিয়েটার অবশ্যই মানুষের মধ্যে মানুষের যোগাযোগ। এই যোগাযোগটা (Impulses and Reactions) হলো জৈবিক (Biological) ও আধ্যাত্মিক (Spiritual) ক্রিয়া।

গ্রটস্কি একজন জিজ্ঞাসু শিল্পী। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, আমরা কেন শিল্প করি? অভিনেতা, প্রযোজক, দর্শক সকলেরই সীমাবদ্ধতার দেয়াল অতিক্রমের এক শিল্প মাধ্যম হলো থিয়েটার। একজন মানুষ তাই থিয়েটার বা শিল্পচর্চা করবে নিজের জন্য। নিজের শূন্যতাকে ভরিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ করবার জন্য। থিযেটার বা ব্যক্তির পূর্ণতার জন্য এগুলো আসলে শর্ত নয়, একটি প্রক্রিয়া। যে পক্রিয়ায় শিল্পীর অন্ধকারাচ্ছন্ন, গোপন ব্যক্তি ভুবনের সমস্ত অলিগলি, প্রান্তর আলোকিত হয়ে ওঠে। থিয়েটার হলো আসলে শিল্পী হিসেবে ব্যক্তির জীবনাচারের সমস্ত অস্বচ্ছতাকে স্বচ্ছ করার এক মাধ্যম। গ্রটস্কি নাট্যদর্শনের মূল কথা মোকাবিলাক্ষেত্র। থিয়েটারে শিল্পী তার জীবনের সমস্ত সত্যের মুখোমুখি হয় প্রকাশের প্রেরণায়। এ হলো নিজের সঙ্গে নিজের এক অসাধারণ যুদ্ধ প্রক্রিয়া। এই মোকাবিলা অন্তহীন, জীবনভর চলমান। এই অনন্ত মোকাবিলার একমাত্র লক্ষ্যই হলো প্রাত্যহিক প্রকাশের আড়ালে থাকা অপ্রকাশকে দৃশ্যমান করা, উদঘাটন করা। থিয়েটার অবসর উদযাপনের সস্তা বিনোদন মাধ্যম নয়। সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে ব্যক্তির মধ্যে যে সত্যের বাস তাকে থিয়েটার উন্মোচন করে তোলে। যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথাগত, গতানুগতিক, একঘেঁয়ে, সনাতন সংস্কার, বিশ্বাস-বিবেচনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনকে উপেক্ষা করে, উৎপাটিত করে এক নতুন বিচরণভূমিতে নিয়ে যায়।

গ্রটস্কি বলেন, অভিনেতাকে অবশ্যই মনোযোগী, মুক্ত ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। এই মোকাবিলাক্ষেত্র থিয়েটারে শিল্পের সমস্ত সম্ভাবনা ও প্রচেষ্টাকে বিনিয়োগ করতে হবে। থিয়েটারের মূল কথাই হলো উন্মোচন। থিয়েটারের মাধ্যমে দর্শককে কেবল এভাবে করো, এটা করো, ওটা করো না- এই ধরনের উপদেশ-নির্দেশ দেয়া নয়। দর্শককে খুলে দিতে হবে। অর্থাৎ দর্শকও উন্মোচন প্রক্রিয়ায় শতভাগ যুক্ত হবে। আর এ কাজের মাধ্যমে একজন অভিনেতা নয়, মানুষ হিসেবে সে পুনর্জন্ম লাভ করে। এই থিয়েটারে আসলে একজন আরেকজনের কাছ থেকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, মূল্যায়িত হয়, মানবিক মর্যাদার বিনিময় ঘটে।

এভাবেই পোলিশ নাট্যতাত্ত্বিক গ্রটস্কি এক মানবতাবাদী পৃথিবীর উদ্বোধনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি একটি বিপ্লব চেয়েছিলেন। তাঁর বিপ্লবের কর্মপন্থা রাজনীতি আশ্রিত নয়, যোগাযোগ-আশ্রিত। তাঁর বিপ্লবের মাধ্যম থিয়েটার। যে থিয়েটার বাজার সভ্যতা থেকে পৃথক ও উন্নত এবং আদিম, প্রাকৃত, বুনোগন্ধময়, সুস্বাদু কিন্তু সিরিয়াস। গ্রটস্কি এ কাজে তাঁর দুর্লভ প্রতিভা নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। কিন্তু বিপ্রতীপ বাতাসের ঝাপটায় অভিমানের প্রচন্ড পাতার আড়ালে চিরকালের জন্য তিনি মুখ লুকিয়ে নেন। গ্রটস্কির নাট্যচিন্তা ও চর্চা পৃথিবীর দেশে দেশে শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করে, মনের গভীর গোপনে তৈরি করে অভিনিবেশ ও অনুশীলন স্পৃহা। একইভাবে সমকালীন বাংলাদেশেও নাট্যকলা অধ্যয়ন ও অনুশীলনে মহামান্য জর্জি প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে তিনি তীব্র গতি সঞ্চারে সক্ষম। গ্রটস্কি তাই আমাদেরই একজন।

তথ্যসূত্র: Towerds a Poor Theatre : Jerzy Grotowski_ Methuen Ltd. London 1975

ড. ইস্রাফিল শাহীন : সহকারি অধ্যাপক, নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।