Full premium theme for CMS
ঢাকার মঞ্চনাটক : দর্শক-সমালোচকের মুখোমুখি ১৯৭২-১৯৯০ [প্রথম কিস্তি]
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[লেখকের দুয়েকটি পূর্বকথন : সেই একদিন ছিল! নতুন নাটক নিয়ে ভাবনা-চিন্তা তর্ক-বিতর্কে উত্তাল দিন। স্বাধীনতারই যেন এক নান্দনিক উৎসারণ ছিল সেদিনের নাটক। সবসেরা ছেলে-মেয়েরা যুক্ত হতো নাটকে। রাজনীতি-শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে চুলচেরা আলোচনা, সমালোচনা হ’ত। নাটক কেন করা, উদ্দেশ্য কী তার, দেশ-সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক কি নাটকের? কী কাজে লাগে নাটক? কেবল কি একটা নাগরিক সৌখিন বিলাস মাত্র? ঢাকায় বসে নাটক করে কী হয়, ক’জন দেখে সে নাটক? দেশ বিশ্বের তাবৎ ভাবনা চিন্তা, সংকট-যন্ত্রণা, আতীব্র তার প্রকাশ- বিষয় ও রূপরীতির কত কত সর্ব মথিত সেই নাট্যদিন ছিল। আনন্দে উল্লাসে বিস্ময়ে মুগ্ধতায় প্রথম প্রেমেরই থরথর কম্পন বুঝিবা। নাটক দিয়ে যেন জয় করা যায় বিশ্ব- বাতাসে ফিরছিল এমনই ফিসফাস। আজ কিছুতেই আন্দাজ করা যাবে না সেদিনের সেই উন্মাতাল উল্লম্ফ, দিক্বিদিগ্ ছোটা- হৈ হৈ রৈ রৈ পাগলপারা দশা। একেক সময়ে একেক দেশে একেক বিষয় নিয়ে এমনই সব কা- বুঝি ঘটে। পরে কিছুতেই তার নাগাল পাওয়া যায় না। যাদু মন্ত্রের মতো, দৈব কোনো ভর করা ঘোর-বেঘোর এক দশা যেন ঘটেছিল। যৌবনের সেই পাগলাঘোড়া তারপর কবে কোথায় কখনযে উধাও হয়ে যায়, তার আর হদিস মেলে না। স্বপ্নতাড়িত চন্দ্রাহত মানুষ নিজের মধ্যে খুঁজে পায় না- কে যেন ছিল একদা, তারে ক্ষেপিয়ে মাতিয়ে দাপিয়ে নিয়ে ফিরেছিল। সোনার ফসল ফলিয়ে দিয়ে কখন যে চলে গেছে সেই নন্দননটী। কথাগুলো যতই ভাবের ঘোর, নাটুকে কাব্যিক লাগুক- অন্যভাবে যেন ঠিক ধরা যায় না সেদিনের সেই আশ্লেষ-স্পৃহা!
আজকের নবীণ নাট্যজন তার কিছু হদিস পাবে সেদিনকার একেকটি নাটক নিয়ে নাট্যদলের ভাবনা চিন্তা আর দর্শকজনের মুদ্রিত ভাষ্য-বিবরণ পড়লে পরে। ১৯৭২ সালে ডাকসু আয়োজিত আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতা থেকে ধারাবাহিকভাবে নাট্যকার-নির্দেশক-দর্শক-সমালোচকদের লিখিত মুদ্রিত বাকবিতন্ডা একত্র করা হয়েছে। এটি একটি গবেষণাকর্ম হলেও উৎসাহী নাট্যজন এতে পেতে পারেন সেদিনকার নাট্যভাবনবিশ্ব! তাবৎ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সারাৎসার। বাস্তব অভিঘাতের সংহত স্বরূপ। আজকের এই নিরাবেগ, নির্মণন হতশ্রী দশায় তার ফলে মিলতেও পারে অন্যতর আস্পৃহা। গবেষণাকর্মটির অন্বিষ্ট অবশ্য একটু ভারী, গম্ভীর মেজাজের : বাংলা থিয়েটারে শিল্প নন্দন ও রাজনীতির সম্বন্ধসূত্র পর্যবেক্ষণ। সেটা দুই বাংলার প্রধান নাট্য প্রযোজনা ধরে করা।]
[থিয়েটারওয়ালায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রযোজনাসমূহ ঘিরে যে নান্দনিক মনন বিতর্ক বিতণ্ডা হয়েছিল নাট্যকার-নির্দেশক-দর্শক-সমালোচকদের পারস্পরিক বিনিময়ে- সেই অংশটুকু। পাঠকদের জন্য প্রথম কিস্তি ছাপা হলো এ সংখ্যায়।]
এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা
রচনা : সেলিম আল দীন
নির্দেশনা : ম. হামিদ
প্রযোজনা : নাট্যচক্র, ডাকসু
প্রথম মঞ্চায়ন বর্ষ : ১৯৭২
রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান
রচনা ও নির্দেশনা : আল- মনসুর
প্রযোজনা : নাট্যচক্র, ডাকসু
প্রথম মঞ্চায়ন বর্ষ : ১৯৭২
বাংলাদেশের বর্তমানকার নাট্যচর্চা ১৯৭১-এর স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জায়মান ঘটনা। পাকিস্তানি-পর্বে (১৯৪৭-১৯৭০) এহেন চরিত্রের নিয়মিত নাট্যচর্চা গঠিত হয়নি। অনিয়মিত বিচ্ছিন্ন প্রয়াস হিসেবে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদ, হলসমূহ এবং অস্থায়ী নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের নাট্যচর্চায় একরকম খন্ড সক্রিয়তা সচেষ্ট থাকলেও তেমন কোনো ধারাপাত তাতে ঘটেনি। এর বাইরে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে বাৎসরিক সৌখিন নাট্যাভ্যাস গয়ংগচ্ছ বিনোদন বিলাসে পর্যবসিত ছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক যাবতীয় কর্মোদ্যোগ বা আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-তরুণ কর্তৃক সূচিত- এটা প্রায় ঐতিহাসিকভাবেই নিরূপিত। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে নব নাট্যচর্চাধারার সূচনা ঘটে একই প্রক্রিয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-এর সাংস্কৃতিক বিভাগ ‘নাট্যচক্র’ ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২-এ ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে মঞ্চস্থ করে দুটি নাটক : সেলিম আল দীন রচিত এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা এবং আল-মনসুর প্রণীত রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান। ছাত্রছাত্রী এবং অতিথি, শিক্ষক ও সাংবাদিকগণ দর্শক হিসেবে ছিলেন। ইতোমধ্যে ‘নাট্যচক্র’ নাট্যবিষয়ক বিশেষ ক্লাসও চালু করে। নাটকদু’টি তার অভিনবত্বে আলোড়িত করে দর্শকসাধারণকে। ‘নাট্যচক্র’ কর্তৃক প্রকাশিত সুভেনিরে নাটকদু’টি বিষয়ে লেখা হয়:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) উদ্যোগে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্র’ গঠন করা হয়েছে।
সমগ্র দেশে স্বাধীনতার পরপরই নাটক মঞ্চায়নের গোষ্ঠী গঠনের প্রাবল্য অনুভূত হচ্ছে। এতদিন ধরে সাহিত্য এবং সংস্কৃতির এই বিশেষ শাখাটি ছিল অনাহুত, প্রায় অবহেলিত। মঞ্চ, উপযুক্ত নাটক আভিনৈয়িক অপোগন্ডতা, যন্ত্র এবং আলোক প্রক্রিয়ার দুর্বলতা এসবই ছিল আমাদের সামগ্রিক নাট্যান্দোলনের অনগ্রসরতার কারণ। অথচ স্বাধীনতার পরপরই যে ব্যাপক স্পন্দন সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে তার কারণ কি এই যে রাতারাতি আমাদের যাবতীয় অভাব ইতোমধ্যে নিস্পন্ন হয়ে গেছে। আসলে প্রাণপ্রাচুর্যই হচ্ছে নাট্যান্দোলনের মূল কথা।
বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাট্যাভিনয়ের যে সমস্ত সুযোগ বর্তমান, তাকে আশ্রয় করে বিশ্ববিদ্যালয় তারুণ্য সাম্প্রতিক নাট্যান্দোলনের বিপুলত্ব ও প্রাণপ্রবাহকে সমুন্নত রাখতে সক্রিয়।
আমরা জানি বাংলা নাট্যান্দোলনের জন্যে বড়ো প্রয়োজন এ মুহূর্তে একটি ভাল নাটক, একটি সাধারণ মঞ্চ, দলগত ঐকান্তিকতা এবং আপ্রাণ অভিনয়। ... আমাদের দু’টি নাটক এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা, রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান। দুটি নাটকেই স্পষ্টভাবে সাম্প্রতিক সময় এবং প্রেক্ষিত মূল্যায়নের প্রয়াস আছে।
এক্সপ্লোসিভ-এর মধ্যে নাট্যকার সময়গত প্রবাহে গ্রীক ফেইটের অবধারিত ফলশ্রুতিতে সমগ্র রাজনৈতিক কিংবা সাহিত্যিক বিপ্লবের আন্তরিকতার উপর জয়ী দেখতে পেয়েছেন। এই ব্যর্থতা মানবিক প্রয়াসের দুর্বলতার মধ্যে নয়- প্রেক্ষিতের অন্যমুখীতার জন্য। এ নাটকে মানবিক প্রয়াসের সমালোচনা করা হয়নি। অথচ ব্যর্থতার অবধারিত দিকটাকেও তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে রেভ্যুলিউশন-এ মানবিক সংগ্রাম এবং সংগ্রামের উপযুক্ততার মধ্যে-বিপ্লবের নিশ্চিত সাফল্যকে নির্দিষ্ট করবার প্রয়াস আছে। নাটকটিতে রূপকের গতানুপন্থাকে এড়িয়ে রূপক নাটকের অন্যতর সম্ভাবনাকে আবিস্কারের প্রয়াস আছে।
অন্যদিকে এক্সপ্লোসিভ-সাংকেতিক ও রূপকতার মিশ্রণ। এক্সপ্লোসিভ মঞ্চ অভিজ্ঞ অভিনেতা এবং রেভ্যুলিউশন সম্পূর্ণ মঞ্চ অনভিজ্ঞ অভিনেতা-নেত্রী অভিনীত।
আঙ্গিক, পরিবেশনায় প্রচন্ড কিছু করবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাবে না। যদিচ প্রচন্ড আন্তরিকতা, সদিচ্ছা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাবে।
‘নাট্যচক্র’ বাংলা নাটকে অতিক্ষুদ্র হলেও, একটি ভূমিকা স্থাপনে বিশ্বাসী।১
‘প্রাণপ্রাচুর্যই হচ্ছে নাট্যান্দোলনের মূলকথা’। ‘দুটি নাটকেই স্পষ্টভাবে সাম্প্রতিক সময় এবং প্রেক্ষিত মূল্যায়নের প্রয়াস আছে’; এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা নাটকে ‘মানবিক প্রয়াসের সমালোচনা করা হয়নি। অথচ ব্যর্থতার অবধারিত দিকটাকেও তুলে ধরা হয়েছে।’ এ নাটকে ‘সাংকেতিকতা ও রূপকতার মিশ্রণ’। রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান নাটকে মানবিক সংগ্রাম এবং ‘বিপ্লবের নিশ্চিত সাফল্যকে নির্দিষ্ট করবার প্রয়াস আছে’; ‘রূপক নাটকের অন্যতর সম্ভাবনাকে আবিষ্কারের প্রয়াস আছে’; ‘আঙ্গিক, পরিবেশনায় প্রচন্ড কিছু করবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাবে না। যদিচ প্রচন্ড আন্তরিকতা, সদিচ্ছা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাবে।’
বিষয় ও রীতিতে নান্দনিক অবস্থান নির্ণয়ের একটা সন্ধানোন্মুখ তীব্রতায় ‘নাট্যচক্র’ প্রণোদিত হয়।
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
‘চিত্রালী’ পত্রিকায় নাটকদুটির বিস্তারিত সমালোচনা হয়:
এক্সপ্লোসিভ মূলতঃ রূপকধর্মী নাটক। সাম্প্রতিক সময় ও মানসিকতা এ নাটকের উপজীব্য। তবে জটিল উপস্থাপনা ও প্রতীকী সংলাপের দরুণ নাটকের সঠিক ভাবনা বুঝে নেবার জন্যে দর্শকদের কষ্ট করতে হয়েছে। কতিপয় অস্থিরচিত্ত যুবক, সদা বিক্ষুদ্ধ, চঞ্চল, উত্তেজনায় অধীর। সমাজের প্রতীকরূপী এক মহিলার প্রতি তাদের অকারণ ক্ষোভ। একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অর্থহীন উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য একটা চমক লাগানোর জন্য, তাদের ব্যর্থ প্রয়াস। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে একটি উপযোগী নাটক। নাট্যকার দক্ষতার সঙ্গে কাহিনীর সমন্বয় সাধন করেছেন। সংযত পরিচালনার গুণে নাটকটি শিল্পগুণসম্পন্ন হয়েছে। ... দ্বিতীয় নাটক, রেভ্যুলিউশন ও খৃষ্টাব্দ সন্ধান- এ দর্শকবৃন্দ নতুনত্বের ছোঁয়াচ পেয়েছেন। এর কারণ হয়ত এই যে, দর্শকমন্ডলীর অধিকাংশ ছিলেন ছাত্র আর প্রতিটি দৃশ্য ছিল তাদের অত্যন্ত পরিচিত। ফলে নাটকের সঙ্গে তারা একাত্ম হতে পেরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদিনের পরিক্রমাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ নাটক। সমস্যায় বিভ্রান্ত ছাত্র, আনন্দ সুন্দর প্রেম, পডুয়া ছাত্রের ব্যস্ত পদচারণা, গম্ভীর শিক্ষকের ভাষণ নাটকে চিত্রিত হয়েছে নিটোলভাবে। আশা-হতাশা, দ্বন্দ্বে-ছন্দে দোলায়িত শিক্ষাজীবনের সমাপ্তিতে ছাত্রের সম্মুখে তার জীবনের নিষ্ঠুর সত্যটি উদঘাটিত হয়। উপযুক্ত হয়েও সে আজকের জগতে অচল। ঘুনে ধরা শিক্ষাব্যবস্থা আর সমাজের ফাঁকিটা ধরা পড়ে তার চোখে। বিপ্লব স্পন্দিত হয় বুকে। সংগ্রামী মিছিলের মশালের আগুনে মেলে ধরে সদ্য পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থহীন সার্টিফিকেট, আলোয় প্রজ্জ্বলিত হয় আরো নতুন কয়েকটি আলোর শিখা। এই মিছিলে মেহনতি মানুষ তার সংগ্রামী সাথী। সংলাপ কাব্যধর্মী মাঝে মাঝে তাই ভালো লাগে। নাটকটিতে রূপকের গতানুগতিক পন্থাকে এড়িয়ে রূপক নাটকে অন্যতর সম্ভবনাকে আবিষ্কারের প্রয়াসও লক্ষণীয়। ...
নাটকের দৃশ্যান্তর পদ্ধতি ও ক্লাশরুমের দৃশ্য অবতারণায় নতুনত্ব আছে। দৃশ্যসজ্জা অভিনব। আলো বক্তব্যের মতই জোড়ালো। এক ভিন্নধর্মী নাট্যপ্রয়াসের জন্য ডাকসুকে ধন্যবাদ। তবে বক্তব্যে, উপস্থাপনায় তারা যে স্তরে পৌঁছেছেন সাধারণ দর্শক তা থেকে এখনও অনেক পেছনে। আজ তাই দর্শক তৈরি করতে হবে। ডাকসু নাট্যচক্রের জন্যে এ দায়িত্ব রইল। তাই বলে পেছনে ফিরে যেতে বলছি না। ভালোটুকু নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে বলছি।২
এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা নাটকের ‘জটিল উপস্থাপনা ও প্রতীকী সংলাপ’ সত্ত্বেও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে একটি উপযোগী নাটক; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদিনের পরিক্রমাকে কেন্দ্র করে রেভ্যুলিউশন ও খৃষ্টাব্দ সন্ধান নাটক ঘুনে ধরা শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের ফাঁকি বিপ্লবে মুক্তি খোঁজে- সঙ্গে মেহনতি মানুষ মেলে। যেহেতু উপযুক্ত হয়েও আজকের জগতে অচল শিক্ষিতজন। আঙ্গিকের নবত্বও বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বীকৃত।
নাটক দু’টির ভিন্ন সমালোচনাও হয়:
যেহেতু সাম্প্রতিক সময় এবং প্রেক্ষিত মূল্যায়নের প্রয়াসের বিজ্ঞপ্তি দেখেছি, বলতেই হবে সাম্প্রতিক সময় কি? সাম্প্রতিক সময় বিপ্লবের। সাম্প্রতিক সময় ভেজালের। এবং সাম্প্রতিক সময় মূর্খের ‘ভেজাল বিপ্লবে’র ঘোষণার। সাম্প্রতিক সময়ে কি আছে? কিছু সংখ্যক বৈতালিক ভাগ্যবানের সাধের বিশ্ববিদ্যালয়। এবং রমণীর লাস্যাক্রান্ত তারুণ্য। আর কি কিছুই নেই?
সবিনয়ে বলছি সাম্প্রতিকতা এক্সপ্লোসিভ এবং রেভ্যুলিউশনে সত্যি, রমণী এবং বৈতালিকতার আখড়ায় নয়। এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার যেমনি যথাস্থান ও যথাসময়ে আবশ্যক, তেমনি রেভ্যুলিউশন খৃষ্টাব্দের সন্ধান করে না। অবশ্য খৃষ্টাব্দের খোঁজ করেও ১৯৭১-৭২ এর পর প্রশ্নবোধক চিহ্নই পাওয়া গেছে।
দুটো নাটকেই ভাবনাকে সুন্দর করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। কিছু বলা হয়েছে, পুরোটা বলা হয়নি। যারা বলতে চেয়েছেন তাঁদের পক্ষে আর বলা সম্ভব কিনা সেটাও বিচারসাপেক্ষ। একটা বিষয় বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। যাদের জন্য বিষ্ফোরক ও বিপ্লব, তাদের বোঝার মতো করে নাটক লেখা হয়নি। বিষ্ফোরকের ব্যর্থ উপস্থাপনা ছাড়াও দুর্বল অভিনয়, সংলাপ রচনা ও উচ্চারণে জড়তা, আলোক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অসচেতনতা নাটকের বক্তব্যকে সুস্পষ্ট করতে পারেনি। অভিনেতাগণ যে বিস্ফোরক সম্পর্কে অভিজ্ঞ নন তার প্রমাণ পাওয়া যায় সিগারেট মুখে নিয়ে ফিউজসহ বিস্ফোরক পরীক্ষা করতে যাওয়ায়। ... বিপ্লবের উপসর্গস্বরূপ কিনা শান্তি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরই শুধু নয়, জীবন থেকেই নির্বাসিত। যোগ্যতাবলে (!) প্রাপ্ত সার্টিফিকেট পুড়িয়ে বিপ্লবের মশাল জ্বেলে জনতার সাথে একাত্ম হবার আহবানে মানুষ তখনই আস্থা নেবে যখন তথাকথিত ‘আঁতালেকচুয়া’ সম্প্রদায় ফাঁকা বুলি না আওড়িয়ে সত্যি সত্যি জনগণের কাতারে দাঁড়াবেন। তথাকথিত বলছি এজন্যে যে, একটি পঙ্গু হতাশগ্রস্থ মানসিকতা নিয়ে পাগল পার্টির জিন্দাবাদ দিয়ে বিপ্লবকে দলে ভেড়াবার অসুস্থ চিন্তা বিপ্লবের খৃষ্টাব্দ সন্ধান করবে না। বিপ্লব একটি সামগ্রিক ঘটনা পাগলামী নয়- আমাদের তরুণ আঁতালেকচুয়াদের এটুকু বোঝা উচিত। রেভ্যুলিউশন-এর প্রতীক চিন্তা প্রশংসাযোগ্য। এক্সপ্লোসিভ এ যে ফ্রীজ শটটা নেয়া হয়েছে সম্ভবত সেটি রেভ্যুলিউশন-এ যোগ্যতম সংযোজন করা যেতো।৩
এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার যথাস্থান ও যথাসময়ে আবশ্যক, রেভ্যুলিউশন খৃষ্টাব্দ সন্ধান করে না, যাদের জন্য বিস্ফোরক ও বিপ্লব তাদের বোঝার মত নয় নাটকদ্বয়, ফাঁকা বুলি না আউড়ে জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে আহবান করতে হয় বিপ্লবের, বিপ্লব একটি সামগ্রিক ঘটনা পাগলামি নয়- এসব সমালোচনা করেও রেভ্যুলিউশনের ‘প্রতীক চিন্তা’ প্রশংসিত, উদ্যোগেরও। এ সমালোচনায় থিয়েটারে শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ক বিষয়ে একটি নান্দনিক অবস্থান ব্যক্ত।
নাটক দুটিতে বিপ্লবী মানসিকতা নেপথ্যে রেখেও প্রতীকী বিপর্যয়ে কাহিনী বিস্রস্ত হয়নি; এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা নাটকে এষ্টাব্লিসমেন্টবিরোধ সাময়িক সমস্যার কাছে পরাজিত হওয়ায় নাটকের সামগ্রিক সমস্যা কিছু ক্ষুণœ হয়েছে- তবু ব্যতিক্রমী প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ্য; রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান নাটকে সামাজিক সংঘাত প্রতীকী ভাষ্যে উপস্থিত হলেও সমাধানের ইঙ্গিত স্পষ্ট - এমত সমালোচনা অসীম সাহার:
দুটি নাটকের মূল চেতনার সাযুজ্য স্বতন্ত্র উপস্থাপনার ভিন্নস্তরে সাম্প্রতিক সময় পরিপ্রেক্ষিতকে ধারণ করেও একটি বৃহত্তর পটভূমিকায় তাকে সংক্রামিত পটভূমিকায় তাকে সংক্রামিত করতে পেরেছেন। সময় সচেতন নাট্যভাবনা নাট্যকারকে একটি প্রতীক-ধর্মী আঙ্গিক গ্রহণে অনুপ্রাণিত করলেও বৃত্তাবৃত বোধের বিপর্যয়ে তা নাটকের প্রাজ্ঞ প্রকাশকে ক্ষুণœ করতে পারেনি বলেই দর্শকবৃন্দ সমস্ত সময় ধরে তাকে আলোড়িত উত্থানপতনে পভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। দু'টো নাটকের কাহিনীই সাম্প্রতিক বক্তব্য সংযুক্ত বিপ্লবী মানসিকতার আন্তরপ্রবাহকে নেপথ্য প্রক্রিয়ায় উপস্থাপিত করলেও প্রতীকী বিপর্যয়ে মূল কাহিনী বিস্রস্ত হয়নি বলেই তা স্পষ্ট উপলব্ধ হয়েছে।
সেলিম আল দীনের নাটকের বক্তব্য প্রচলিত সিদ্ধ ধারণাবিরোধী বা এস্টাব্লিসমেন্ট প্রতিরোধী সক্রিয় চেতনার বিপ্লবী মানসিকতা। এক্সপ্লোসিভ যেখানে প্রতীক উপাদানে তরুণ চেতনার ধারক। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বাণী উচ্চারণ কাহিনীর মৌল ধারায় কিছুটা দুর্বলতা স্মরণে সহযোগী হতে পারে, তা হলো নাটকের পরিণতি নাটকের সামগ্রীক চেতনাকে ধারণ করতে পেরেছে কিনা? যে সিদ্ধ ধারণাবিরোধী বক্তব্য কাহিনীকে একটি বিদ্রোহী আবহে উপস্থিত করার চেষ্টা হয়েছে, তা কি অবশেষে জয়ী হতে পেরেছে? ভেজাল এক্সপ্লোসিভ বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে নবীণ বোধের অপারেশন সার্থক হতে পারেনি। ফলে, এস্টাব্লিসমেন্টবিরোধ একটি সাময়িক সমস্যার কাছে পরাজিত হয়েছে। ফলে, নাটকের মূল সমস্যার সমাধানে বিদ্রোহী মানসিকতার ধারক এক্সপ্লোসিভের ভেজাল - নাট্যকারের মানসিকতাকে বিদ্ধ করেছে। এক্ষেত্রে নাটকের সামাজিক সচেতনতা তাই কিছুটা ক্ষুণœ হয়েছে। কিন্তু তবুও বাঙলাদেশের সুবিধাবাদী ‘স্বঘোষিত প্রাজ্ঞ’ নাট্যকারেরা যেখানে দর্শক মানসিকতাকে অবিরত ‘রদ্দিপঁচা’ নাটকের উপস্থাপনায় ছিন্নভিন্ন করেছেন, সেখানে সেলিম আল দীনের এ নাটক একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস হিসেবে স্পষ্টতই উল্লেখিত হতে পারে। ....
‘রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান’ - এ আল মনসুর যে কাহিনীকে বেছে নিয়েছেন, তা সময়োচিত এবং ব্যাপকতম চেতনাসংক্রামী বিধায় দর্শক-নন্দিত আপাত ‘ইমেজে’র প্রক্রিয়া প্রবাহিত। এক্ষেত্রে নাট্যকার যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তার নাটকের কাহিনীতে সামাজিক সংঘাতের পটভূমিকায় বিধৃত প্রতীকী ভাষ্য উপস্থিত হলেও একটি সমাধানিক ইঙ্গিত স্পষ্টতা লাভ করেছে। ফলে, প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর আওতায় বৃত্তাবৃত তরুণ মানসিকতা, সাম্প্রতিক সময়ের ক্ষোভ, যন্ত্রণা, সংঘাত প্রতিরোধী বৈপ্লবিক পরিণতি এ নাটকের মৌল চেতনা। আল মনসুরের নাট্যচেতনা বস্তুববাদী বোধ উদ্ভূত হলেও উপস্থাপনার মধ্যে একটি কাব্যিক প্রক্রিয়ার ব্যাপকতা- বিশেষত সংলাপে কাব্যধর্মীতার প্রাধান্য নাট্যিক গুণকে অবশ্যই ক্ষুণœ করেছে। তাছাড়া সংলাপ ব্যবহারে খণ্ডিত ধ্বনিরই প্রযুক্তি অব্যয়াক্রান্ত না হওয়ায় তা ছিন্ন ফুলের মালাতে পরিণত হয়েছে; একটি অখ- গ্রন্থনায় গ্রথিত হতে পারেনি। কাহিনীর মৌল চেতনা সম্পর্কে দর্শক মানসিকতা প্রস্তুত ছিল বলেই ‘রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান’ -সহজ গ্রাহ্য হয়েছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে সেলিম আল দীন যথেষ্ট সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সেলিম আল দীনের নাটক যেখানে শৈল্পিক প্রক্রিয়ায় নাট্যিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ; আল মনসুরের নাটক সেখানে স্পষ্টতার প্রাধান্যে দর্শক মানসিকতা নন্দিত প্রতিবেদনে ঋদ্ধ।৪
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর লেখেন:
দুটি নাটকেই স্পষ্টত সাম্প্রতিক সময়, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী মানসিকতা এবং মূল্যবোধ ছায়া ফেলেছে। এর বিষয়বস্তু এবং পরিবেশনা আধুনিক এবং সাম্প্রতিক সমস্যা আক্রান্ত কাহিনী। রূপকতার আশ্রয় নিয়েও নাটকের বক্তব্য সরাসরি দর্শকদের হৃদয়ে পৌঁছেছে। মনসুরের নাটকটিতে একটি বৈশিষ্ট্য হলো সম্পূর্ণ মঞ্চ অনভিজ্ঞ ছাত্রছাত্রীরা এতে অভিনয় করেছেন। নাটক কেমন হলো, কদ্দুর সার্থক, কদ্দুর ব্যর্থ বা নাট্যকারদের প্রতিশ্র“তি যথাযথ কিনা তা বিবেচনার ভার সেদিনকার দর্শকদের। এই প্রতিবেদনে শুধু নাটকের এই আধুনিক ধারাকে স্বাগত জানিয়েই এই প্রসঙ্গ শেষ করবো।৫
‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’ নাটকে প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তরুণ আন্দোলনের ব্যর্থতা শুধু কি বাংলাদেশের নিস্ফল স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করছে- এ রকম তীব্র প্রশ্ন তুলে বলা হয়, স্লোগান উচ্চারণ না করে নাট্যকার নাট্যমর্মিতায় শিল্পিত উচ্চারণ করেছেন; ‘রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান’ - নৈরাজ্যের বিপরীতে অভ্যুদয়ের পথে এগিয়ে গেছে।
স্বাধীনতা- উত্তর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষায় বিশেষত নাটকের মধ্য দিয়ে একটি সামগ্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সুপ্রকট। পর্যালোচনায় দেখা যায় ক্রমশ একটি তরুণ নাট্য মানসিকতা বাংলাদেশে গড়ে উঠছে। এ কথা আপাত অদৃশ্য মনে হলেও সত্য। ... তরুণ আবেগ, তীক্ষèভেদী দৃষ্টি, শালীন ব্যঙ্গ, সর্বোপরি নাট্য শিল্পের শৈলীগত অন্তরাভিধায় প্রখরতম কালাচারী সেলিম আল দীন তাঁর অল্পসংখ্যক নাটকের মধ্যে অমোঘ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত নির্মাণ করেছেন। তাঁর অতি সাম্প্রতিকতম ‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’। সমাজের ভেতর ঘাত-প্রতিঘাত তথা একটি অচলায়তন মানসপুষ্ট সমাজাংশের বিরুদ্ধে বৃহৎ খন্ডের আবহমান দ্বিধা, বিদ্রোহ, আন্দোলন ও বিপ্লবের বিপথগামী চরিত্রকে সেলিম আল দীন একটি অত্যন্ত সমসাময়িক সমস্যার পটভূমিতে জীবনময় করে তুলেছেন। যেখানে (মঞ্চ থেকে বাইরে জানালা দিয়ে নির্দেশ করেছে যে মহিলাকে) দুষ্ট গ্রহের মত সমাজের রক্তে রক্তে মিশে আছে তার বিরুদ্ধে একটি তরুণ আন্দোলনের ব্যর্থতা শুধু কি বাংলাদেশের নিষ্ফল স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করেছে? কিন্তু নাট্যকার কোথাও রাজনীতিবিদের মতো স্লোগান উচ্চারণ করেননি কিংবা বক্তৃতা দেননি। নাট্যধর্মিতাই শিল্পিত করেছেন। ... সেলিম আল দীন তাঁর নাটকে নৈরাশ্য মানে আমাদের আশা করবার কিছু নেই এমন শূন্যময়, বদরক্তময় লালকালো ধোঁয়ার ভেতরে নাটক শেষ করেছেন। তারপরেই আল মনসুর তার মশাল জ্বালিয়ে অভ্যুদয়ের পথে এগিয়ে গেছেন ‘রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান’ - নাটকে। জ্যামিতিক প্রক্রিয়ায় সময় এবং সমস্যাকে সঠিক গতিতে টেনে এনে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন। তাতে দর্শক নাট্যকারের পরিষ্কার এবং তীক্ষè মেধার পরিচয় পেয়েছে।৬
অভীক দাশ ‘নতুন রকমের নাটক মানে কি উদ্ভট নাটক’ শিরোনামে তীব্র সমালোচনা করেছেন:
নাট্য শাখাটি বাঙলাদেশে দীর্ঘদিন অনাদর আর অবহেলার ভারে প্রপীড়িত ছিলো। অধুনা কিছু কিছু নতুন নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। সে জন্যে অবশ্য বলা উচিত হবে না নাটকের প্রতি আমাদের শুভদৃষ্টির উদয় হয়েছে। বলতে হবে, নাটক মঞ্চায়নের প্রতি নাটক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর প্রতি আমাদের সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে একটা নতুন উদ্যম দেখা দিয়েছে মাত্র। এই নবোদ্যম হতোদ্যম না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোন মন্তব্য করবো না। শুধু বলবো হঠাৎ করে যারা সংস্কৃতিপ্রেমিক হয়ে পড়েছেন তাদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখতে পাচ্ছি নবজায়মান সংস্কৃতিসেবীরা নাটকের উন্নতি কোন পথে তা পভীরভাবে তলিয়ে দেখছেন না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে সব উদ্ভট নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছেন। নাট্যতত্ত্ব মীমাংসার নানা রকম থিওরী আওড়াচ্ছেন। যেসব নাটকের মধ্যে জীবনবোধের ছিটেফোঁটা চিহ্নেরও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এইসব বুলিসর্বস্ব নাট্যকর্মীদের দিয়ে কি নাটকের উন্নয়ন আশা করা যায়? ... এ দুটোকে পূর্ণাঙ্গ নাটক হিসেবে আখ্যায়িত না করে মিনি নাটক হিসেবে আখ্যায়িত করাই শ্রেয়। কারণ নাটক পদবাচ্যতার কোনো স্বাক্ষরই এই দুটো নাটকে বিদ্যমান নেই। উদ্যোক্তারা অবশ্য একে ‘নতুন রকমের নাটক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই নতুন রকম নাটক দেখার অভিজ্ঞতা থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা গর্বিত ভাবের সঞ্চার হয়েছে বলতে পারি। কিন্তু এতে আসলে নতুনত্বের পরিবর্তে একটি চমকই আমার কাছে প্রধান হয়ে উঠেছে। এ কথা তো অস্বীকার করে লাভ নেই, চমক এবং চটকদারিত্ব কোনদিনই স্থায়ী মূল্য পায় না। চমকের চকমকি একদিন না একদিন শূন্যে মিলিয়ে যাবেই। ডাকসুর নাট্যচক্রের আয়োজনও বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চায়নের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যেখানে সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবনের জন্যে জীবনবোধ সম্পন্ন বলিষ্ঠ নাটক নিয়ে উপস্থিত হবেন, সেখানে রূপক এবং সাংকেতিকতার মোড়কে এক উদ্ভট নাট্য প্রয়াস দেশের নাট্যামোদীদের কোনক্রমেই তুষ্ট করতে সক্ষম হবে না। এই পথে নাটকের উন্নয়ন সাধনের আশা দুরাশা মাত্র। ... এক্সপ্লোসিভ নামক ক্ষুদ্র নাটিকাটিতে নাট্যকার সেলিম আল দীন বর্তমান সমাজের একটি দুষ্ট ক্ষত ভেজাল সম্পর্কে প্রহসন করতে প্রয়াসী হয়েছেন। কিন্তু এতে ভেজাল সমস্যা প্রকট না হয়ে নাট্যকারের মানসিক বৈকল্যই প্রকটতর হয়েছে। ‘রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান’ -নাটকের বিষয়বস্তুতে সমকালীন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চিত্র স্বচ্ছভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বক্তব্যের দিক থেকে এ নাটকটি এক্সপ্লোসিভের চেয়ে অনেক বলিষ্ঠ এবং জীবনের আদল খুঁজে পাওয়া যায়।
নাটক মানে যদি জীবনের প্রতিচ্ছবি হয় তাহলে নাট্যচক্রকে আরো জীবনধর্মী আধুনিক নাটক নিয়ে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হতে হবে। নইলে নাট্য মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য শূন্যচারী হয়ে যেতে বাধ্য।৭
পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে উদ্ভট নাটক; জীবনবোধের ছিটেফোঁটা চিহ্ন নেই; নতুনত্বের পরিবর্তে চমক ও চটকই প্রধান, রূপকসাংকেতিকতার মোড়কে উদ্ভট নাট্যপ্রয়াসে নাটকের উন্নয়ন দুরাশামাত্র; জীবনধর্মী আধুনিক নাটকের উদ্দেশ্য শূন্যচারী হবে এর ফলে; - সমালোচনায় বিশেষ রাজনৈতিক নান্দনিক অবস্থান স্পষ্টতর। নাটকদু’টির সমালোচনায় নানা ভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত।
সূত্র উৎস: ১. নাট্যচক্র সুভেনির-১৯৭২, ২. ‘ডাকসু নাট্যচক্রের ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস’- চিত্রালী-৬ অক্টোবর-১৯৭২, ৩.‘ রেভ্যুলিউশন ও এক্সপ্লোসিভ প্রসঙ্গে’- বিচিত্রা-১৯ আশ্বিন-১৩৭৯, ৪. ‘ডাকসু নাটক : এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা এবং রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান’- কালস্রোত-আশ্বিন-১৩৭৯, ৫. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর- বিচিত্রা- ২৬ আশ্বিন-১৩৭৯, ৬. ‘নাট্যচক্রের নাটক’-দৈনিক জনপদ-২৫ আশ্বিন-১৩৭৯, অভীক দাশ-‘ নতুন রকমের নাটক মানে উদ্ভট নাটক’ -দৈনিক বাংলা- ২৭ আশ্বিন-১৩৭৯।
ডাকসু নাট্য প্রতিযোগিতা ১৯৭২
(সাতটি নাটক)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ১৯৭২ সালে ২-১১ ডিসেম্বর আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। মফিদুল হক এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন:
স্বাধীনতা-উত্তর বাঙলাদেশে নাটকের বলবান স্ফূরণের কার্যকারণ খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু নাটকের যাত্রা শুরু হয়েছিল বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘বিগ ব্যাং’ সেই বজ্রনিনাদে চারদিক কাঁপিয়েই। এই যাত্রাবিন্দু হিসেবে, সৃষ্টির উন্মেষের মাহেন্দ্রক্ষণরূপে আমরা চিহ্নিত করতে পারি ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নাট্যচক্র আয়োজিত আন্তঃহল নাট্য উৎসবকে। এই উৎসব এবং সদ্য স্বাধীন পটভূমিকায় একই বৎসর পূর্বে- পরে অভিনীত বিভিন্ন নাটকের নাম তালিকা তার চরিত্র-লক্ষণ কিছুটা প্রকাশ করে। নাটকগুলো ছিল ‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’ ‘রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান’, ‘অস্থির সুস্থিতি’, ‘সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ’, ‘কালো অশোক লাল ফুল’, ‘পেণ্ডুলামের খুন’, ‘জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘ রোলার এবং নিহত এল.এম.জি’, ‘উন্মোচন’, ‘দাঁড়াবো শুধুই’, ‘রংহীন সিগন্যাল’, ‘দানব’, ‘চাবির দুঃখ’, ‘করিম বাওয়ালীর শত্রু’, ‘মূল মুখ দেখা’, ‘ম্যাসাকার’, ‘সংবাদ শেষাংশ’, ‘উৎস থেকে সমুদ্দুর’ এবং ‘কিংশুক যে মরুতে’। উল্লেখ্য, আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার একটি শর্ত ছিল- প্রতিটি নাটক হতে হবে নতুন নাটক এবং ছাত্রদের দ্বারা রচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচর্চার নিকট অতীতে বিশেষ কোনোরূপ ভিত্তি ছাড়াই এমন একটি অভিনব ও সাহসী সিদ্ধান্ত যে গৃহীত হয়েছিল এবং তা’ যে এতটা ফলপ্রসূ হয়েছিল সেটা প্রমাণ করে, স্বাধীনতা সংগ্রামে মহৎ বিজয়ের মধ্য দিয়ে জাতির সাংস্কৃতিক মুক্তিপথ রচনার আকাঙ্খাও আকাশস্পর্শী হয়ে উঠেছিল এবং তা সব প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ও ছিল তীব্রভাবে আতœবিশ্বাসী। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নাট্য উৎসবও আলোড়ন তুলেছিল ব্যাপক।
এই নাটকগুলোর অধিকাংশ, বলতে গেলে সর্বাংশই, সমকালীন ভাবনা-তাড়িত। উপস্থাপনাতে প্রচলিত নাট্যরীতির কোনো পরোয়া করা হয়নি। যাঁরা নাটক রচনা করেছেন, পরিচালনা করেছেন, অভিনয় করেছেন তাঁদের নাট্য-অভিজ্ঞতা ছিল সামান্যই। কিন্তু তজ্জনিত জড়তা বা কুন্ঠার ছাপ ছিল না কোথায়ও। এই সব নাটকের শিল্পসিদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, বস্তুত অভিনীত এইসব নাটক থেকে দু’একটি বাদে অধিকাংশই নাট্যচর্চার অগ্রগতির সাথে সাথে খারিজ নাটকের কাতারবন্দী হয়েছিল, পুনরাভিনয় আর ঘটেনি। অথচ নাটকের এমন সগৌরব আত্মপ্রকাশের আর কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদও পরবর্তীকালে আর কখনই তুলনীয় শিল্পঘটনার জন্ম দিতে পারেনি। সেটা এই উৎসবের ঐতিহাসিক পটভূমিকার গুরুত্ব ও অবদানকেই নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে।
একটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমরা এখানে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তা’হল মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্র থেকেই যুদ্ধশেষের তরুণেরা পা রেখেছিল মঞ্চের সীমানায়। তবে প্রচলিত রীতি ভেঙে ফেলে তারুণ্য উদ্দীপিত নতুন কিছু করার তাগিদ তাদের মধ্যে ছিল প্রবল।১
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-এর নাটক বিভাগ ‘নাট্যচক্র’-মুদ্রিত সুভেনিরে বিস্তারিত জানায় তাদের অভিপ্রায়-অন্বিষ্ট:
আন্তঃহল নাট্য-প্রতিযোগিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রথম। অতীতে দেখেছি-হলগুলোয় বছরে হয়তো একটা নাটক মঞ্চায়ন করা হ’ত-তা’ও সে নাটক হলের কোনো ছেলের লেখা নয়-ধার করা বাইরের থেকে। ছাত্রদের মাঝে লিখবার হাত যাদের ছিল-কলমে যারা আঁচড় কাটতে পারতো-তাদের কলম তাই আর এগুবার উৎসাহ পায়নি। পরিচালনার বেলাতেও ডাক পড়তো বাইরের লোকের। আর তা’ছাড়া বছরে দায়-সারা গোছের নাটক করে নিছক স্ফূর্তি করাই ছিল মুল উদ্দেশ্য। এতে অনুশীলনীর অভাব ছিল-ছিল নতুন আঙ্গিকের নাটক নিয়ে পরীক্ষার অভাব-ছিল উপস্থাপনায় ব্যতিক্রমধর্মী কোনো প্রচেষ্টার অভাব। এই কারণেই প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও হয়তো নতুন নাট্যকার বের হয়নি, পরিচালনায় আসেনি। নতুন শক্তিশালী অভিনেতা মঞ্চ আলোকিত করেনি। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়-সমগ্র দেশের নাট্যাঙ্গনে একই অবস্থা বিরাজ করছিল।
স্বাধীনতার পর ঢাকা শহরের কয়েকটি নাট্যগোষ্ঠী নতুন আঙ্গিকের নাটক মঞ্চায়নের দিকে দৃষ্টি রেখে এগুচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ। তাই গঠন করা হয়েছে-নাট্যচক্র। বাইরের গোষ্ঠীগুলোর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হ’ল মঞ্চের অভাব। কিন্তু সে অসুবিধা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচক্রের নেই। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মঞ্চটি উন্নতমানের তুলনামূলকভাবে। কিন্তু এই মঞ্চটিরও সুষ্ঠু, পরিপূর্ণ ব্যবহার হয়নি। ‘নাট্যচক্র’ করবার উদ্দেশ্যই হচ্ছে-নাট্য উৎসাহী ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ করে দেয়া নতুন কিছু করবার। অভিনয় কলা-কৌশল প্রশিক্ষণের জন্য সপ্তাহে দু'টো ক্লাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ‘নাট্যচক্র’ গঠিত হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে চারটি নাটক মঞ্চায়ন করা হয়েছে। চারটি নাটকই গতানুগতিক নাটক ছিল না। উপস্থাপনা এবং বক্তব্য ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। নাট্য-ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি আমাদের উৎসাহ যোগাচ্ছে।
এই প্রতিযোগিতায় নাট্যকারের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে প্রচলিত বাংলা নাটকের ধারা যেন এতে পুরোনো খাতে বইছে না। সবাই চেষ্টা করছে নতুন কিছু দিতে। এদের সামগ্রিক প্রচেষ্টাতেই হয়তো একদিন গড়ে উঠবে সুষ্ঠু নাট্য আন্দোলন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও যাঁরা এগিয়ে এসেছেন তাঁদেরকে জানাই অভিনন্দন।
বিচারকমণ্ডলী অনেক কষ্টস্বীকার করে এসেছেন আমাদের মাঝে তাঁদের বাদ দিয়ে ভাবাই যায় না এই প্রতিযোগিতা। আমরা কৃতজ্ঞ তাঁদের কাছে। নাট্যচক্রের সদস্য-সদস্যাবৃন্দ ও শুভার্থীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার ফলেই সম্ভব হয়েছে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন।২
‘উপস্থাপনা এবং বক্তব্য ছিল ব্যতিক্রমধর্মী’, ‘সবাই চেষ্টা করছে নতুন কিছু দিতে। এদের সামগ্রিক চেষ্টাতেই হয়তো একদিন গড়ে উঠবে সুষ্ঠু নাট্য আন্দোলন’-প্রণোদনার ধরন এতে স্পষ্ট। প্রয়োজনাসমূহের বিষয়-ব্যাখ্যান থেকেও তৎসাময়িক নান্দনিক অবস্থানের নানা আয়তন টের পাওয়া যায়।
১
কালো অশোক লাল ফুল
রচনা: নিরঞ্জন অধিকারী
নির্দেশনা: প্রদীপ বণিক
প্রযোজনা: জগন্নাথ হল ছাত্র-সংসদ
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৭২
নাটক মানেই নাটকীয়তা নয়- একথা যেমন পরিপূর্ণ সামান্য সত্য নয়, তেমনি অভিধেয় আবেগস্পর্শী উদ্দীপক ভেষজও নির্বিচার গলাধঃকরণযোগ্য নয়। আমার নাটকে এ সিদ্ধান্তই শিল্পনীতি। প্রতীক-সংকেত-কাব্যসুরন্বিত নাট্যপ্রয়াস ঔপনিবেশিক শোষণে অবিকশিত ও বিকৃত মানসিকতার কাছে সমাদৃত নয় ততটা, অতিনাটকীয় উচ্ছ্বাসেই তাদের আকর্ষণ।
ছাত্রাবাস জীবনের খন্ডপরিসরে বৃহত্তর জীবনের চেতনাকে, যুদ্ধোত্তর যুব-মানসের প্রতিক্রিয়াকে প্রতীক বক্তব্যকে ঘটনার খাতে বইয়ে দেয়া হয়েছে। সংলাপগুলো জীবন থেকে উঠে এসেছে।
শুদ্ধ সাংকেতিকতার আর অতিনাটকীয় উচ্ছ্বাসের মাঝামাঝি একটা রাস্তা আমি বের করে নিয়েছি। প্রেমকে প্রচলিত মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে নিয়েছি। প্রচলিত মূল্যবোধের পজেটিভ দিক আকর্ষণ করে তার গ্রাসের মধ্যে নিয়ে যেতে চায়। একদিকে আকর্ষণ, অন্যদিকে তার গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছের সংঘর্ষে রক্তাক্ত মধ্যবিত্ত মানস।
মধ্যবিত্তের আভিজাত্যবোধ ও অন্তঃসারশূন্যতা, হতাশা, রাজনৈতিক অসুস্থতা-ভন্ডামী-হাজারো বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও প্রগতির পথই পথ, সামনের দিকে আমাদের চলতে হবে। জীবন তো মিছিল-এ সত্যকেই সবশেষে তুলে ধরা হয়েছে।৩
২
পেণ্ডুলামের খুন
রচনা: শাহনুর খান
নির্দেশনা: কামাল হায়দার
প্রযোজনা: জহুরুল হক হল ছাত্র-সংসদ
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৭২
একটা বিশাল বৃত্তের আবর্তে আমরা সবাই আবর্তিত। আমাদের জীবনের এই স্থবিরতা থেকে তাই বুঝি কোনো লক্ষ্যের দিকে যাত্রা করার মত আমাদের কোনো আয়োজন নেই-কোনো উৎসব নেই। কেবল একটি কৃত্রিম, বিকৃত, উপায়হীনতায় ক্রীতদাস আমরা। সময়ের উৎস থেকে অনন্তের লক্ষ্যের দিকে তাকাতে ভয় পাই। ভয় পাই বস্তুজগতের অনুভব, স্বাচ্ছন্দ্যের লীলাখেলা থেকে যদি নিক্ষিপ্ত হই।
কিন্তু কেউ না কেউ এই বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে যাবার আয়োজন করে। কেউ না কেউ শুনতে পায় সময়ের আহবান; অথচ অসুস্থ পরিপার্শ্বের হাতে বন্দী মানুষ সত্যি কি বেরিয়ে যেতে পারে? সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের সব আয়োজন কি সাফল্য পেয়েছে? মানুষের ট্র্যাজেডির রক্তাক্ত চীৎকার থেকে কি বস্তুবিশ্ব মুক্তি পেয়েছে?৪
৩
জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন
রচনা: সেলিম আল দীন
নির্দেশনা: নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুু
প্রযোজনা: মহসীন হল ছাত্র-সংসদ
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৭২
তিনজন যুবক দেশীয়, শৈল্পিক এবং আন্তর্জাতিক চলতি আবহাওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে ‘নিখিল নাস্তি’র মুখোমুখী হল। তারা দেখল মানুষ মূলত অগভীর হুজুগপ্রিয়। জণ্ডিসের প্রতিকারে তাদের অবলম্বন-ওষুধ নয়-বেলুন। প্রথম যুবক দেশীয় রাজনৈতিক শূন্যতার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত, দ্বিতীয়জন শিল্পে নব্যধ্রুপদীবাদের প্রবক্তা এবং তৃতীয়জন হল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্বে শান্তি অর্জিত হবে বলে বিশ্বাস করে।
এ পর্যায়ে স্বীয় মানসিকতা বিপ্লব, জীবন ও বিশ্বশান্তি সম্পর্কিত ধারণার বিপর্যয়ে তারা করুণ-কৌতুকে মেতে উঠল। মানুষকে অস্বীকার করে, তারা মানুষ এবং পৃথিবী নিয়ে যে ধ্রুব-ধরণা, তাকে ব্যঙ্গ করল।
বেলুন-পছন্দ একজন মানুষ সমস্ত অগভীর মানুষের প্রতীক। কিন্তু এই কৌতুক করুণ-কেননা এক যুবক বলছে: আমরা কি নিজেদের নিয়ে কৌতুক করলাম?
এই বিশ্বাসহীনতার অবশ্যম্ভাবী ফল- আত্মহত্যা।
সবশেষে নৃত্যপরা যে মেয়েটি প্রবেশ করে-সে মৃত্যু কিংবা এই শতকের সার্বভৌম হতাশার প্রতীক। তীক্ষ্ণতার নখ যে ছোরাগুলো সেগুলো চিরদিনের মতো অবলীলাক্রমে সে উপড়ে ফেলে।
আগন্তকের মুখে এবং পরিপার্শ্বের অন্যান্য সংলাপে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-এর ‘যযাতি’ কবিতার অংশ বিশেষ একটু পরিবর্তিত আকারে তুলে দেয়া হয়েছে।
শেষ দৃশ্যেই এ নাটকে আবহ সংগীত রাখা হয়েছে। এবং ফ্যান্টাসির দৃশ্যে আবহসংহীতকে দৃশ্যমান মঞ্চে ধারণ করা হয়েছে। একটি বিরুদ্ধ চিত্রকল্পের প্রতিবেদনার্থে এই ব্যবহার।৫
৪
রোলার এবং নিহত এল.এম.জি
রচনা: আল-মনসুর
প্রযোজনা: সলিমুল্লাহ হল ছাত্র-সংসদ
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৭২
ক্ষুধা সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতীক। যা বিশাল চাকার মত বার বার এসে আমাদের পিষ্ট করে। এর বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র অস্ত্রহীন অনন্ত ক্ষমতার খিদে।৬
৫
উন্মোচন
রচনা: আজমিরী ওয়ারেস
নির্দেশনা: নিলুফার মতিন
প্রযোজনা: রোকেয়া হল ছাত্র-সংসদ
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৭২
আমরা কি? আমরা কে? আমরা কেন? মানুষের এই স্বাভাবিক আদিম প্রশ্নসমূহের উত্তর পাবার জন্যই পৃথিবীতে যাবতীয় শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের আবির্ভাব। এবং এই জিজ্ঞাসা সবচেয়ে উচ্চকিত নাটকের ক্ষেত্রে। বস্তুত সফোক্লিস থেকে আজকের স্যামুয়েল বেকেট্ সবার নাটকেই মানুষের অস্তিত্বের স্বভাবজ মৌলিক এই রূপটি নানাভাবে বিকাশমান।
আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজ ও জীবনযাত্রায় মেয়েদের স্থানটি কোথায়?-এ সমস্যা চিরকালের। মেয়েরা কি? তারা কে? এবং কেনই বা তাদের প্রয়োজন-এ জিজ্ঞাসাগুলো হঠাৎ একটি ঘটনার মাধ্যমে আক্রমণ করলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরতা পাঁচটি মেয়েকে-এরই বিশ্লেষিত রূপ হলো-উন্মোচন -রোকেয়া হলের নাটক।
উন্মোচন-সাম্প্রতিক নাটকসমূহের অতি আধুনিক আঙ্গিক ও প্রতীক ব্যবহারের স্টান্ট থেকে অনেক দূরে। একটি চকিত ঘটনার প্রভাবে বৃহত্তর একটি সমস্যাকে অবলোকন এবং তাকে সোজাসুজি তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যকে দর্শকেরা যথাযথভাবে গ্রহণ করলেই আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করবো।৭
৬
দাঁড়াবো শুধুই
রচনা: আনোয়ার তালুকদার
নির্দেশনা: মনজুর কাদের বাবুল
প্রযোজনা: শহীদুল্লাহ হল ছাত্র-সংসদ
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৭২
সমস্যার শেষ নেই-তাই ছায়া পড়ে মনে, থেকে থেকে।
কেউ বিদ্ধ-।
বলে বেড়ায়,-ডাক দিয়ে যায়।
কারো বুকে যন্ত্রণা-।
কথাগুলো জমে শুধু নীল হয়।
কিন্তু গতিই তো জীবন-থেমে যাওয়া মৃত্যু।
মৃত্যু তো কেউ চায় না।
তাই জীবনের সন্ধান।
গতিটাকে বদলিয়ে দেয়ার স্বপ্ন-।
তবু, সবাই তো সবকিছু পারে না। অনন্ত পথ-তাই আলাদা আলাদা আসতে হয়। চলতে চলতে কেউ হারিয়ে যায় পথে অন্ধকারে, সময়ের সিঁড়ি হতে। অনিকেত যন্ত্রণাটাকে সঙ্গী করে দাঁড়ায় জীবনের মুখোমুখি। কারণ সমস্যা থেকেই গতি, আর গতিই তো জীবন।৮
৭
দ্বিতীয় অনুভব
রচনা: আক্তার কামাল
নির্দেশনা: সৈয়দা মোর্শেদা খানম
প্রযোজনা: শামসুন্নাহার হল ছাত্র-সংসদ
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৭২
বৃত্ত থেকে আমি বারবার বেরিয়ে আসতে চেয়েছি। তাড়া করে ধূসর চাবুকের সপাং শব্দ। জননীর নির্বোধ অস্তিত্বতার ঠাণ্ডা হাত। ... নীল নীল স্মৃতি জমাট বেঁধে আছে। হাত যেন বিষুবিয়স।
কিন্তু আমার প্রচলিত অন্তরঙ্গ বন্ধুগণ তা বোঝে না, তারা বারবার আপোষ করায়। তারা আমাকে শাড়ীর দরদাম জানায়, প্রেম-পত্র লেখে। পরস্পরের জন্য প্রতীক্ষা করে, একের প্রত্যয়ে অন্যে পরগাছা হয়। কি ভয়াবহ গতানুগতিকতা, আমাকে ঘিরে আছে দম আটকে আসা অন্ধকার কুঠরীর আবহ নিঃশ্বাস। সে আবহ রচনা করেছে ওরা, ... কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। চোখের সামনে বিষুবিয়স জ্বলতে থাকে, তবুও না ... স্মৃতিলোকের প্রতি জনপদে ধ্বংস নামে, ওরা সেই এক একটা জনপদ। নিজের জটিলতাকে না বুঝেই আত্মসমর্পিতা। তাই-অপরিচিত আপন অস্তিত্ব।
একবার, দুইবার, তিনবার... লক্ষবার ফিরতে চেয়েছি। সময়ের কার্ণিশে পা হাত জ্বলতে থাকে। ... প্রথমে রং এর বাধা অতিক্রম। লাল এবং নীল এবং ধুসর...।
তারপর শাব্দিক উৎস খোঁজা। চশমার কাঁচভাঙ্গার। চাবুকের। সহজ হাসির। প্রবেশ করে বেরিয়ে যাবার মত অনায়াস গতির।
অতএব, রূপান্তর। জমাটের রূপান্তর গতিতে। কোন এক অবিনশ্বর মুহূর্তে যা গন্তব্যকে স্পর্শ করবে। কিন্তু গতির বয়লার বিস্ফোরিত হয়ে যায় বিষুবিয়সের মত। বারবার।৯
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
‘চিত্রালী’ পত্রিকায় নাট্য-প্রতিযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়-“বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের নিরীক্ষায় এ প্রতিযোগিতা নাট্যান্দোলনের ক্ষেত্রে এক দিকচিহ্ন হয়ে থাকবে” শিরোনামে: যদিও শিল্প-সাহিত্যকে প্রতিযোগিতায় টানা অনেকে উচিত নয় বলে মনে করেন তথাপি এর যে একটা সৃষ্টি গুণ রয়েছে তা অস্বীকার করার জো নেই। যার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নাট্য বিভাগ নাট্যচক্র আয়োজিত আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রত্যেকটি হলের ছাত্র অথবা ছাত্রী কর্তৃক রচিত ও পরিচালিত নাটকগুলোর মঞ্চায়ন।
আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই প্রথম, অতীতে দেখা গেছে হলগুলোয় বছরে হয়তো একটা নাটক মঞ্চায়ন করা হতো। তাও সে নাটক হলের কোনো ছেলের লেখা নয়। ধার করা বাইরের থেকে। ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে যাদের লেখার হাত ছিল কাগজে যারা কলম দিয়ে আঁচড় কাটতে চেষ্টা করতো তারা আর এগুবার উৎসাহ পেত না। ... ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সূতিকাগার বলা হয় তাহলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশে নাট্যাঙ্গনে যে বন্ধ্যাত্ব চলছে তার নিশ্চয়ই একটা মুখ্য কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যাঙ্গনের এ অচলাবস্থা। এই অচলাবস্থা দূর করে দেশব্যাপী সুষ্ঠু নাট্যান্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্র ঘোষণা করল আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি হলের নাটকই সে হলের ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক লিখিত এবং পরিচালিত হতে হবে এবং যা আগে কখনো কোথাও মঞ্চস্থ হয়নি এমন নাটক হতে হবে।
সাজ সাজ রব পড়ে গেল প্রত্যেকটি হলে। প্রত্যেকে চেষ্টা চালাল নতুন আঙ্গিকে, গতানুগতিকতার বেড়া ডিঙ্গিয়ে নতুন নাটক পরিবেশনার। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন মুখরিত হল আলোচনায়-কে পরবে বিজয়মালা। প্রত্যেক প্রতিযোগী হল পাঠিয়ে দিল তাদের নাটক ও নাট্যকারের নাম। ...
অবশেষে এলো ২রা ডিসেম্বর। প্রতিযোগিতার প্রথম দিন। উদ্বোধন করা হলো জগন্নাথ হলের নাটক কালো অশোক লাল ফুল দিয়ে।
নাটক রচনায় নাট্যকার দর্শকদের কথা ভুলে না গিয়ে শুদ্ধ সাংকেতিকতা আর অতিনাটকীয় উচ্ছ্বাসের মাঝামাঝি একটা পথ বেছে নিয়েছিলেন এবং সেখানেই নিরঞ্জন অধিকারী বেশি সফলতা লাভ করেছিলেন। যেহেতু প্রতীক-সংকেত-কাব্য সুমথিত নাট্যপ্রয়াস শোষণে অবিকশিত ও বিবৃত মানসিকতার কাছে সমাদৃত নয় ততটা, যতটা আকর্ষণীয় তাদের কাছে অতি নাটকীয় উচ্ছ্বাস। সাতটি নাটকেই দেখলাম প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে নাড়া দেবার প্রচন্ড একটা ইচ্ছা সবারই আছে। কেউ হয়তো সরাসরি কেউ বা পরোক্ষভাবে। বক্তব্যের দিক থেকে প্রায় সবগুলো নাটকই কাছাকাছি হলেও উপস্থাপনা ছিল সবারই ভিন্ন ধাঁচের। কোনো কোনো দল সেট ব্যবহারই করেনি আবার কেউ কেউ করেছে। ...
প্রতি বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ যদি এমনি আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতা করতো তাহলে বাংলাদেশে নাট্যান্দোলন গড়ে উঠতে অনেকটা সহায়তা করতো। এবারের ডাকসু সে উদ্যোগ নেওয়াতে তাকে ধন্যবাদ না দিলে অন্যায় করা হবে। ডাকসু’র এ প্রচেষ্টা বাংলাদেশের নাট্যান্দোলনকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যাবে।১০
নাটকগুলোকে সমালোচক ‘প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে নাড়া দেবার ইচ্ছা’- ‘সরাসরি বা পরোক্ষভাবে’, ‘কাছাকাছি বক্তব্য’ ‘ভিন্ন ধাঁচের উপস্থাপনা’, এভাবে চিহ্নিত করে বলেছেন-‘ডাকসুর এ প্রচেষ্টা বাংলাদেশের নাট্যান্দোলনকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যাবে’। বিষয় ও রীতির উভয় দিক থেকে নাটকগুলো অভিনব নান্দনিক অবস্থান তৈরি করেছিল সমালোচকের এমত অভিমত। পরবর্তী মাসে (জানুয়ারী’৭৩) চিত্রালী পত্রিকা আবারও মূল্যায়ন করে ডাকসু নাট্য প্রতিযোগিতার:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকেই সাহিত্য, সংস্কৃতির ও রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলো। কিন্তু সংস্কৃতির অন্যান্য দিকগুলো এগিয়ে গেলেও নাটক ঠিক তার সাথে পা মিলিয়ে এগুতে পারেনি। এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই নয় সারা দেশেও সুষ্ঠু নাট্যান্দোলন গড়ে উঠতে পারেনি। চলচ্চিত্রের পরই নাটক -যার মাধ্যমে সহজেই জনগণকে সচেতন করে তোলা যায়। তাই হয়তো তৎকালীন ঔপনিবেশিক সরকার শিল্প সাহিত্যের বিশেষ করে নাট্য শিল্পের টুটি টিপে ধরেছিলো। অসংখ্যবার এ দেশের মানুষের কাছ থেকে জাতীয় রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের দাবী উঠলেও টাল-বাহানা করে নানা অজুহাতে সে দাবী সযত্নে পরিহার করেছে। ১৯৬৬-৬৭ সালের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তন থাকলেও নাটক তেমন জমে উঠেনি। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের প্রভুদের খুশি করার জন্যে জমে উঠতে দেননি। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর হাওয়া উল্টো দিকে বয়ে গেল। যা স্বচ্ছন্দে চলছিল তাকে বাধা দেওয়া হল। ছাড়া পেয়ে তা আবার প্রচণ্ডতম গতিতে ছুটে চলল। নাটক পিছিয়ে থাকলে চলবে না। একে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অভিনীত হল প্রচুর নাটক। আগে দেখা যেত হলগুলোর বার্ষিক নাটকসহ বছরে মোট সাত কি আটটি নাটক হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এ বছর মাত্র দু'টো হল তাদের বার্ষিক নাটক করেছে। তাতেও ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫শে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২২ খানা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এ বছরে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ববর্তী যেকোনো বছরের চাইতেও বেশি। ...
গত বছরের নাটকগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমে চোখে পড়ে উৎপল দত্তের কাকদ্বীপের এক মা ও বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ ছাড়া আর কোন বিদেশী নাটক মঞ্চস্থ হয়নি। এবং আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার সাতটি নাটক তো বটেই, আন্যান্য নাটকগুলোর প্রায় সবগুলোই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অথবা ছাত্রীর লেখা। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা বাইরের কারো লেখা হতো। কিন্তু এবার আমরা প্রচুর নতুন নাট্যকার পেলাম এবং এদের নাটকগুলো পুরাতন নাটকের ধারার চাইতে অনেক ভিন্ন। এরা নাটকে আন্তর্জাতিকতাবাদ এনেছেন। যা বাংলাদেশে এই প্রথম। ...
আঙ্গিকের ক্ষেত্রে এবারের নাটক শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই নয় সারাদেশের নাট্যাঙ্গনে একটা বিস্ফোরণ ঘটাল। পরাজিত যন্ত্রণা এবং সোনার হরিণ সামগ্রিক পরিবেশনায় স্বার্থকতা লাভ না করলে আঙ্গিকে এরাই প্রথম পথ দেখিয়েছিলো। আঙ্গিকের ক্ষেত্রে প্রথম স্বার্থক নাটক রেভ্যুলিউশান ও খৃষ্টাব্দ সন্ধান।
পরবর্তী পর্যায়ে জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন এবং রোলার এবং নিহত এল.এম.জি নাটক দু’টি আঙ্গিকে চরম স্বার্থকতা লাভ করেছিল। ... এ বছরে আমরা বেশ কয়েকজন নতুন পরিচালকও পেয়েছি। এদের মধ্যে আল-মনসুর এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নতুন আঙ্গিকে পরিচালনা আমাদের আশা জোগায়।
এ বছরের নাটকগুলো বক্তব্য, আঙ্গিক, এবং উপস্থাপনা সবটাতেই এদ্দিন আমাদের দেশে নাটকের ধারা যে খাতে বইছিল তাকে পাল্টিয়ে দিয়েছে। ...
প্রত্যেকটি নাটকেই আঙ্গিকের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। কিন্তু আঙ্গিকের দিকে নজর দিতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অভিনয়ের মান অনেকটা কমে গেছে। পরিচালকরা অভিনয়কে নাটকের মুখ্য উপাদান হিসেবে নিচ্ছেন মনে হয় না। কিন্তু অভিনয়ের স্বার্থকতাই যে নাটকের চরম স্বার্থকতা সে কথা ভুললে চলবে কেন। ...
দুঃখের বিষয় স্বাধীনতা উত্তরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নাটক রচনা কিংবা মঞ্চায়নের ব্যাপারে যতটা উৎসাহ নিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ততটা উৎসাহ দেখাননি। তাঁদের সহযোগিতা পেলে হয়তো আরো মহৎ কিছু সৃষ্টি হতে পারতো। তাঁরা পুনর্গঠন করেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠী। যারা মঞ্চস্থ করেছে ষাট দশকের প্রথম দিকের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলো। এ মুহূর্তে শহীদ শিক্ষক মুনীর চৌধুরীর নাম বার বার মনে আসছে। যার পদচারণা ছিল এ অঙ্গনে সব চাইতে বেশি। যদিও স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর দু’ আগে থেকেই এ দিক থেকে তিনি কিছুটা সরে গিয়েছিলেন। মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে গেলেই বাধা আসতো। ফলেই হয়তো তাঁর এ স্বেচ্ছানির্বাসন ছিল। আজ স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বাংলাদেশের সুষ্ঠু নাট্যান্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়োজন ছিল সব চাইতে বেশি।...
এ বছর ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার প্রথম বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যাঙ্গনে মরা গাঙ্গে জোয়ার আসল। ১৯৬৫-৬৬ পর থেকে নাট্যাঙ্গনে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা আবার সচল হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যান্দোলন শুরু হল। এ আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালিত হবে কিনা জানি না। তবে শুরু হয়েছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়কেই দেশব্যাপী সুষ্ঠু নাট্যান্দোলন গড়ে তুলতে ও নেতৃত্ব দিতে হবে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে সীমাবদ্ধ না রেখে তার রেশ ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের সব মানুষের মাঝে। দর্শক সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শকই শুধু নয়। গোটা সমাজের নাট্যদর্শক। তবেই তো সার্থক হবে নাট্যান্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বজায় রাখবে তার ঐতিহ্য।১১
ঔপনিবেশিক কারণে নাট্যচর্চার অনুপস্থিতি, স্বাধীনতার পর অর্গল খুলে নাটকে আন্তর্জাতিকতা আনয়ন, আঙ্গিকের ক্ষেত্রে সারাদেশের নাট্যাঙ্গনে বিস্ফোরণ ঘটানো, নব পরিচালক-অভিনেতার আগমন, নাটকগুলোর ‘বক্তব্য, আঙ্গিক এবং উপস্থাপন’ প্রচলিত নাট্যধারা পাল্টে দিয়েছিল বলেই মনে করছেন সমালোচকগণ। আঙ্গিকের দিকে বিশেষ নজর দিতে গিয়ে অভিনয়ের মান কমেছে- একথাও বলা হয়েছে। শিক্ষকদের সহযোগ, বিশেষ করে বিশ্বদ্যিালয়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠীর উজ্জীবন করার কথা এবং সে প্রসঙ্গে শহীদ মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ- ‘তাঁর প্রয়োজন ছিল সবচাইতে বেশি’; ‘১৯৬৫-৬৬’ পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মরা গাঙ্গে জোয়ার এল এ বছর (৭২)’, সারাদেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেবার কথাও বলা হয়।
ডাকসু’র এই নাট্যপ্রতিযোগিতা মুক্তধারার সূচনা করে বাংলাদেশের নাটকের ক্ষেত্রে।
সূত্র তথ্য : ১. মফিদুল হক- ‘আমাদের মঞ্চনাটকে বিবর্তন’- সুন্দরম (মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত)- জ্যৈষ্ঠ-শ্রাবণ সংখ্যা-১৩৯৯, ২. ডাকসু আন্তঃহল নাট্যপ্রতিযোগিতা- সুভেনির-১৯৭২, ৩. পূর্বোক্ত, ৪. পূর্বোক্ত, ৫. পূর্বোক্ত, ৬. পূর্বোক্ত, ৭. পূর্বোক্ত, ৮. পূর্বোক্ত, ৯. পূর্বোক্ত, ১০. চিত্রালী- ১৬ ডিসেম্বর-১৯৭২, ১১. চিত্রালী- ৫ জানুয়ারি-১৯৭৩।
সংবাদ কার্টুন
রচনা : সেলিম আল দীন
প্রযোজনা : ঢাকা থিয়েটার
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৭৩
সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ
রচনা ও নির্দেশনা: হাবিবুল হাসান
নির্দেশনা : নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুু
প্রযোজনা : ঢাকা থিয়েটার
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ : ১৯৭৩
ঢাকা থিয়েটার প্রকাশিত সুভেনির-এ জানানো হয়:
বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাট্যান্দোলনকে স্থিতিশীল এবং পূর্ণাবয়বে প্রতিষ্ঠার জন্যে চাই সামগ্রিক জনপদে এই নবজাগৃতির খবর পৌঁছে দেয়া। এই সংকল্প থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা থিয়েটার।
ঢাকা থিয়েটার-এর অধিকাংশ কর্মীরা হয় বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করে বেরিয়ে আসা।
‘পূর্বদেশের’র এক সাক্ষাৎকারে আমাদের জনৈক মুখপাত্র বলেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অভিজ্ঞতাকে আমরা এখানে কাজে লাগাবো। কিন্তু বাংলা নাটকের সামগ্রিক নৈরাজ্যের মধ্যে পেশাদারী মঞ্চে নাটক উঠিয়ে তাকে ব্যবসাভিত্তিক চালিয়ে নেয়া যে কী কঠিন ব্যাপার সে কথা শুধু-বিনোদনকারীরা জানেন।
এদিকে সরকার সামান্য ব্যাপারে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করছেন কিন্তু সামান্য ক’টা টাকা খরচ করে একটা নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন।
এর ফল হচ্ছে এই-প্রতিভাবান কর্মীরা নাট্যজগতে কোনো স্থিতিশীলতা না পেয়ে বাধ্য হয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছে। আর এইভাবে স্তিমিত হচ্ছে সার্বিক একাগ্রতা ও সামগ্রিক প্রচেষ্টা।
আমাদের দুঃখ, আমাদের ক্লান্তি আমাদের ঘৃণা এই অব্যবস্থাকে।
ঢাকা থিয়েটার নাট্যান্দোলন-এর প্ল্যাকার্ড ব্যবহার করে জনতা থেকে যেমন বিচ্ছিন্ন হতে চায় না, তেমনি ব্যবসার নামে তার নিরীক্ষাকেও ক্ষুণ্ন করতে দিতে নারাজ।
এই প্রয়াস থেকে আমাদের নতুন একটি নাটক : সংবাদ কার্টুন।
অন্যটি বেশ ক’বার অভিনীত। তবু এক সঙ্গে দুটি নাটক নামানোর অসুবিধা থেকেই প্রায় বাধ্য হয়েই সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ'কে নির্বাচন করা হয়েছে।
আমাদের আহ্বান:
: পেশাদারী মঞ্চকে সার্বিক সহায়তা দান করুন।
: নিজে টিকিট কেটে নাটক দেখুন এবং অন্যকে দেখতে বলুন।১
বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাট্যান্দোলনকে স্থিতিশীল এবং পূর্ণাবয়বকে প্রতিষ্ঠার জন্য সামগ্রিক জনপদে এই নব-জাগৃতির খবর পৌঁছে দেওয়া; একাধারে জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া, অন্যদিকে নিরীক্ষাকেও ক্ষুণ্ন করতে দিতে নারাজ;- দলের নান্দনিক অবস্থান স্ফুটমান উপর্যুক্ত ঘোষণায়।
‘বিচিত্রা’ পত্রিকা সংবাদ কার্টুন এবং সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ নাটক মঞ্চায়নের পরে ঢাকা থিয়েটার-এর তিনজন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। তাতে নাট্যকর্ম ও নাটকদ্বয় সম্পর্কে ঢাকা থিয়েটারের অভিমত ব্যক্ত হয়:
একাত্তরের স্বাাধীনতাযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণের প্রথমে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয় এবং তাদের স্মৃতিতে ছিল আর্মি ক্র্যাকডাউনের নিষ্ঠুরতা। তাদের মুখোমুখি হতে হল এক নতুন ধরনের বাস্তবতার। যে বাস্তবতার উপকরণ কালো টাকা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। ফলে দেখা দেয় হতাশা। এই হতাশা এদেশের মধ্যবিত্তকে করলো বিচলিত, বিভ্রান্ত। কেউ কেউ মুক্তি চাইলো অন্যত্র, ভিন্নভাবে। মধ্যবিত্ত প্রধান এদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্দোলনে- রাজনৈতিক হউক সাংস্কৃতিক হউক মধ্যবিত্তেরই প্রধান্য। ’৪৮ আর ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-এ সবই মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর গৌরবময় ভূমিকা। অথচ এই মধ্যবিত্ত সমাজ হতাশায়, বিভ্রান্তিতে, অন্যত্র মুক্তির অন্বেষণে আজ যেন কক্ষচ্যুত। সাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র সর্বক্ষেত্রেই হতাশা আর নৈরাজ্য বিরাজ করছিল স্বাধীনতার পর থেকে। সে নৈরাজ্য থেকে আজও কি মুক্তি এসেছে? স্বাধীনতার পর থেকে যে নৈরাজ্য তার জন্যে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীকে দায়ী করে নিজের অক্ষমতাকে ঢাকার চেষ্টা করেছেন অনেকে আর স্বদায়িত্বের কথা হয়েছেন বিস্মৃত।
দায়িত্ব পালনের সদিচ্ছা নিয়ে ঢাকায় কয়েকটি নাট্যগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। ঢাকা থিয়েটার নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যময়। তাদের প্রথম দুটি নাটক সংবাদ কার্টুন, এবং সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ দেখে একথা বলা যায়। ঢাকা থিয়েটারের তিনজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এ বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে।
প্রশ্ন
আপনাদের প্রথম নাটক সংবাদ কার্টূন-কে শুধুমাত্র রিপোর্টাজ বললে এবং এটাকে স্টান্ট আখ্যা দিলে আপনারা কি বলবেন?
উত্তর
এ নাটক দেখলে মনে হবে প্রতিদিন খবরের কাগজ খুলে যে খবর আমরা পড়ি তারই কিছু অংশ। রিপোর্টাজ নিঃসন্দেহে কিন্তু শিল্পসম্মতভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। যেমন ধরুন হিরোশিমা মানআমুর অথবা ব্যালাড অব এ সোলজার যুদ্ধ ঘটনাভিত্তিক ছবি কিন্তু একে কি আপনি শুধুমাত্র ডকুমেন্টারী বলবেন? আর স্টান্ট এবং আমাদের জীবন ও সমাজ সচেতনতা এক করে ফেলা ভুল হবে।
প্রশ্ন
আপনাদের বিশেষ কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য আছে?
উত্তর
কোনো রাজনৈতিক স্লোগান আমাদের নেই। তাই বলে রাজনীতি অচেতনও আমরা নই। রাজনীতিকে আমরা সুস্থ ভবিষ্যতের সড়ক বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু ঢাকা থিয়েটারের নাটকের বক্তব্যে তথাকথিত রাজনীতির কোনো ছবি পাওয়া যাবে না।
প্রশ্ন
সাধারণত কোন ধরনের নাটক আপনারা পরিবেশন করবেন?
উত্তর
পরিবেশন করবো তাই-প্রথম শর্ত-তাকে নাটক হতে হবে। ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এজন্যে যেহেতু নাটক সম্পর্কে আমাদের মুখ্য এবং ভুল ধারণা ঐতিহ্যময়। হ্যামলেট এবং কুয়াশার কান্না- দুটোকেই আমরা নাটক বলে স্বীকার করার চেষ্টা করে থাকি। ঢাকা থিয়েটার কখনো ভুল করেও এমন ভুল করবে না। অন্যান্য শর্ত-নাটকে একটি সুস্থ বক্তব্য থাকতে হবে, শিল্পসম্মত হতে হবে বলাই বাহুল্য। ফ্যান্টাসী এবসার্ড কিংবা চূড়ান্ত সামাজিক যাই হউক না কেন নাটককে জীবনঘনিষ্ঠ হতে হবে। এবং সবচেয়ে প্রধান কথা যে, নাটক দর্শকের ভাল লাগবে।
প্রশ্ন
আপনারা কিসের ভিত্তিতে নাটক বাছাই করবেন?
উত্তর
আগেই বলেছি, বক্তব্য-সম্বলিত শিল্পসম্মত এবং এখানকার লেখকের হতে হবে। বর্তমান পর্যায়ে আমরা বিদেশের কোন নাটক মঞ্চস্থ করবো না। নাটকে বক্তব্য থাকবে, তবে বক্তব্য কখনও প্রধান হবে না, শিল্প হবে প্রধান। তবে কনক্লুশনে বক্তব্য থাকবে।
প্রশ্ন
সে বক্তব্য কি হবে?
উত্তর
আমরা সৎসমাজ চাই। নাটকেও আমরা সৎসমাজেরই বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করবো। দর্শকদের আমরা শিল্পের নাম করে এমন জগতে বিচরণ করাবো না যার ফলে তারা বিভ্রান্ত হবে।২
জীবন ও সমাজ সচেনতা এবং স্টান্ট এক নয়; রিপোর্টাজ শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপিত; নাটকের বক্তব্যে তথাকথিত রাজনীতির ছবি নেই; রাজনীতি হল সুস্থ ভবিষ্যতের সড়ক; রাজনৈতিক স্লোগান নেই তাদের যদিও রাজনীতি অচেতনও নয়; নাটকে একটি সুস্থ বক্তব্য থাকতে হবে, শিল্পসম্মত হতে হবে; নাটককে জীবনঘনিষ্ঠ হতে হবে- ফ্যান্টাসী অ্যাবসার্ড বা সামাজিক-রীতি যাই হোক না কেন; নাটকে বক্তব্য থাকবে, বক্তব্য কখনও প্রধান হবে না শিল্প হবে প্রধান, তবে কনক্লুশনে বক্তব্য থাকবে। শিল্প ও রাজনীতি সম্পর্কে নান্দনিক অবস্থানের প্রবণতা স্পষ্টতর।
‘বঙ্গবার্তা’ পত্রিকায় বিস্তারিত আলোচনা হয় নাটক দুটি সম্পর্কে:
একটি তীক্ষ্ণ খোঁচা। সুস্থ মানুষের সচেতন মন বিদীর্ণ হবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু মঞ্চের খোঁচা পাদপ্রদীপের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে সমাজের অসুস্থ মনোবিকার কতটুকু নাড়া দেয় তা ঢাকা থিয়েটার নিবেদিত সংবাদ কার্টুন নাটকের দর্শকগণ কি কখনো ভেবে দেখেছেন? ছোটগল্পের খন্ডিত নক্সায় আজকের বিপর্যস্ত মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যে ভীতি আর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে তার মঞ্চরূপদানে নাট্যকার সেলিম আল দীন সফল। ... নির্দিষ্ট আয়ের সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ জীবনগুলো কিছু সংখ্যক অবিমৃষ্যকারী আর লোভী মানুষের জন্যে যাচেছ। কিন্তু এটি যেন কেউই চায়নি এ দেশে। তবুও কেন এমন হয়ে গেল? কেন মুনাফাখোরের ‘কিছু না কিছু’ দেয়ার আত্মপ্রসাদের পটভূমিতে দাঁড়াতে পারছে, কেন অসাধু নকলবাজদের হাতের মোয়ায় শিশুদের দুধের কৌটায় ভেজাল মিশে একটি জাতির ভবিষ্যতকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার পরিকল্পনা মন ভরে রয়েছে? কেন সাধারণ মানুষ মরে গেলেও আজ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীর সাহায্য চাইতে শংকিত হয়ে কপাল ঠুকে?
এমনি অনেক ‘কেন’র টুকরো টুকরো কিছু ঘটনা সংবাদ কার্টুনে বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। যেন এর কোনো সমাধান নেই। যেন কেউ ইচ্ছে করলেই যা কিছু করে ফেলতে পারে, যেন খুব সহজেই দেশটা স্বার্থের আঘাতে দোল খেতে খেতে একেকজনের হাতের মুঠায় ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু সুযোগ্য পরিচালকের হাতে পড়ে দর্শকদের একটা যুৎসই বাড়ি মারতে পেরেছে সংবাদ কার্টুন। আমরা সবাই এ সবের শিকার হলেও সোচ্চার হতে পেরেছি ক’জন?... মাত্র তিরিশ মিনিটের সংবাদ কার্টুন বর্তমান জনজীবনের বিপর্যস্ত অবস্থা আর বিভিন্ন স্তরের মানুষের বিবিধ ভাবনা আর সমস্যাবলী ফুটিয়ে তুলতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীবৃন্দ সফল হতে পেরেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে শেষদৃশ্যের নিষ্ঠুর ইঙ্গিত ফাঁসির দড়ি বিক্রির ব্যবসাটা আর এদেশে জমবে না। কারণ, এখনো বিবেক এদেশে আকাশ খুঁজে ফেরে।...
জীবনের সঙ্গে নাটকের অন্বয় চিরকালীন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাটকের ভাষা, বক্তব্য, আঙ্গিক মঞ্চায়ন ইত্যাদি সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সামাজিক এবং ব্যাপক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাটক অধুনা বহুতর আঙ্গিকে পরিবেশিত হচ্ছে। নাটকে এসেছে পরিবর্তন।
ঢাকার নাট্যাঙ্গনে সম্প্রতি অ্যাব্সার্ড ড্রামা পরিবেশিত হচ্ছে। তরুণ ও প্রগতিশীল নাট্যকারগণ সাম্প্রতিক অবস্থার নিরিখে, বাস্তব অবস্থার অবলোকনে বিমূর্ত নাটকের রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন মঞ্চে।...
সাম্প্রতিক খবরের কাগজগুলোতে পরিবেশিত বিভিন্ন সমসাময়িক ঘটনা, স্বাধীনতা উত্তর জনজীবনের নানাবিধ সমস্যা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের ব্যর্থতাকে ভিত্তি করে রচিত সেলিম আল দীনের সংবাদ কার্টুন মূলত একটি প্রহসন জাতীয় নাটক। সমসাময়িক ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত নাটকটি আমার কাছে উপভোগ্য মনে হয়েছে একদিকে এজন্যে যে, সমাজের বর্তমান বাস্তব চিত্র এ নাটকের মাধ্যমে পরিস্ফুটিত হয়েছে। মূল্যবোধের সংকটে আমাদের নৈতিক চরিত্র, প্রেম-ভালবাসা সব কিছু একটা কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়েছে তারই রূপান্তর ছিল এ নাটকের ভিত্তি। তদুপরি মঞ্চে পর্দা উত্তোলনের সঙ্গে চোখে পড়ে এক বিরাট আকারের কার্টুন। একটি জীবন্ত কার্টুন হাতে ঢাকা শহরের মানচিত্র নিয়ে একজন মঞ্চে আসে। ... অন্যদিকে বাস্তবের সাথে খাপ-খাওয়াতে গিয়ে এর পরিবেশনাকে কিছুটা অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। ফলে দৃষ্টিকটু লেগেছে।...
সন্তানহন্তা জননী, আত্মজাহন্তা পিতা, বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে যাবার অপরাধে ধৃত জনৈক বাদুড়ঝোলা জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ নাগরিক ও সবশেষে সম্রাটকে হত্যা করার স্পর্ধা দেখানোর দায়ে ধৃত প্রজা- সবার কাছে তখন সম্রাট নিজেই কাঠগড়ার আসামী। কে কার জবাবদিহি করে! এক আশ্চর্য অনুভূতিতে ভরে উঠে দর্শকের মন যখন দেখতে পায় সাধারণ মানুষের ভূমিকায় অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সুজন পরিচালকের চলতি ডায়ালোগ বলতে অস্বীকার করছে। অসহ্য এ বিদ্রোহ নির্মূল করতে পরিচালকের হাতে ঝলসে উঠে তীক্ষ্ণ ছুরি। কিন্তু যে বিদ্রোহ বঞ্চনা আর নিষ্ঠুরতাকে দুমড়ে দিতে জন্ম নিয়েছে তার রক্তে তখন নতুনের ডাক। প্রচলিত গ্রাম্য সংস্কার আর সুবিধার রাজনীতি প্রতিহত করার জন্য মূর্তিমান প্রতিবাদ হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীগণের হাতেও ঝলসে উঠে সুতীক্ষ্ণ ছুরির ফলা। এ বিধি ভাঙ্গতে হবে-সুজনের ছুরি তাই জন্ম দিয়ে গেল এক নতুন চেতনার ইঙ্গিত। আর পরিচালক তার চিরদিনের ঔদ্ধত্য আর সুবিধের চেতনাকে বলী দিলেন বিদ্রোহের বেদীমূলে। যেন অসহ্য ঔদ্ধত্যের দিন বদলের পালা শুরু হয়েছে। এ বিদ্রোহ প্রচলিত বিধি-যা মানুষকে একাকী করে, অচেতন করে গ্রাম্যতা দেয়- তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চায় যেন।৩
‘যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাটকের ভাষা, বক্তব্য, আঙ্গিক মঞ্চায়ন পরিবর্তিত হচ্ছে, নাটক অধুনা বহুতর আঙ্গিকে পরিবেশিত হচ্ছে’; ‘সমাজের বর্তমান বাস্তবচিত্র এ নাটকের মাধ্যমে পরিস্ফুটিত হয়েছে’- সমালোচনায়ও একটা নান্দনিক অবস্থান সন্ধানের প্রণোদনা দেখা যাচ্ছে।
সংবাদ কার্টুন-এর পরিবেশন-পদ্ধতি সমালোচনায় প্রধান হয়ে এসেছে এবং সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ নাটকের আখ্যান- বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে; মানুষের সুপ্ত ও পঙ্গু মনকে, চিন্তাকে আবার সজীব করে তুলতে ঢাকা থিয়েটার পিছপা হবে না- এমত আশ্বাস দাবি করাও হচ্ছে একই সঙ্গে; ভিন্ন রীতির নাটকে ভিন্ন ভিন্নতর প্রতিক্রিয়াই সমালোচনায় পাওয়া যাচ্ছে:
তবে নাটকটির পরিবেশন পদ্ধতি নাটকের বক্তব্যকে প্রকাশ করতে বিশেষ সাহায্য করেছে। মঞ্চের পর্দা উত্তোলনের পর পাদপ্রদীপের আলোতে যেটি প্রথম চোখে পড়ে ত’হলো-একটি বিরাট আকারের কার্টুন। তারপর একটি জীবন্ত কার্টুন হাতে ঢাকা শহরের মানচিত্র নিয়ে মঞ্চে আসে। তারপর একজন ঘোষক।
সর্বপ্রথম ঢাকা শহরের আয়তন ও লোকসংখ্যা দিয়ে শুরু করেন। তারপর একে একে বলতে থাকেন,- ছিনতাই, হাইজ্যাক, নকল দ্রব্যের উৎপাদন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রদের বড় বড় বুলি আওড়ান, তারপর তাদের গুপ্তহত্যা, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, মুদ্রামূল্য হ্রাস, জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়া, সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়া এবং আত্মহত্যার মাধ্যমে সমস্যাজর্জরিত মানুষগুলোর মুক্তিলাভ। প্রতিটি ঘটনাই খবর। সংবাদের শিরোনাম। অতিবাস্তব। দেশের সর্বত্র আজ ঘটছে। আগেও ঘটেছে। হয়ত আরো ঘটবে।
নাট্যকার হয়ত এ ইঙ্গিতই দিতে চেয়েছেন।
নাটকের পরিবেশন পদ্ধতি প্রতিমুহূর্তেই দর্শককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, কতকগুলো কার্টুন মঞ্চে ঘোরাফেরা করছে।...
সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ নাটকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ছোট খাট সমস্যাগুলোকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এসব ছোট ছোট সমস্যার প্রতিক্রিয়া যে কত ভয়ানক এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ, তাই এ নাটকে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এসব সাধারণ ঘটনা থেকেই ঔষধ আর পথ্যের অভাবে মা তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে, পিতা কাপড় দিতে না পেরে যুবতী মেয়েকে হত্যা করতে পারে। রোজ রোজ বাসে বাদুড় ঝুলে অফিসে যেয়ে বসের বকুনি থেকে একমাত্র আত্মহত্যার মাধ্যমে মুক্তিলাভ সম্ভব। কিন্তু সম্রাট এগুলোর প্রতিকার না করে পাল্টা তাদের কর্মের শাস্তি দিতে চায়। শেষ পর্যন্ত পরিচালককে হত্যার মাধ্যমে এর থেকে পরিত্রাণ লাভ। সবটাই একটি নাটক। অথচ এর বক্তব্য খুবই সাধারণ, অন্তত পক্ষে বাংলাদেশে আজকাল। এটা নেই, ওটা নেই। বিশেষ এক শ্রেণীর হাতে পয়সা। অনেক সময় পয়সা থাকলেও পাওয়া যায় না। যাতায়াত সমস্যা, ঘন্টার পর ঘন্টা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠা সম্ভব নয়। অন্যান্য যানবাহনে যাতায়াত আকাশকুসুম কল্পনা। আবার অফিসে কড়াকড়ি। সমস্যাজর্জরিত লোকগুলোর জন্যই আইন-কানুন প্রতিনিয়ত খড়গহস্ত। কিন্তু প্রতিকারের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই এ থেকে মুক্তি আসে ভিন্ন পথে, এটাই হয়ত পরিচালক ও নাট্যকার এ নাটকে বলতে চেয়েছেন।
ঢাকা থিয়েটারকে ধন্যবাদ সমসাময়িক সমস্যানির্ভর দুটি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য। ভবিষ্যতেও এধরনের নাটক পরিবেশন করে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে বলে আশা করি। মানুষের সুপ্ত ও পঙ্গু মনকে, চিন্তাকে আবার সজীব করে তুলতে ঢাকা থিয়েটার কখনো পিছপা হবে না। এ বিশ্বাসের মূলে নিশ্চয়ই ছুরি মারা হবে না।৪
‘দীপ্ত বাংলা’ পত্রিকা আবেগদীপ্ত মূলত নাটক দুটির বিষয়-বক্তব্যে। মেহনতী মানুষের নিকটবর্তী হওয়ার বক্তব্য কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার, ঢাকা থিয়েটার গ্রামে যাবার সংগ্রামী প্রস্তুতি নিচ্ছে-এতে সমালোচকের সোৎসাহ তাঁর বিশেষ এক নান্দনিক অবস্থানকে চিত্রিত করছে:
সংবাদ কার্টুন স্লোগানমুখর একটা ভিন্ন স্বাদের নাটক যা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফুর্তই শোষিতদের চিরবিদ্রোহের আগুন জ্বালাবার কৌশলকে শিক্ষা দেয়।
একাত্তুরোত্তর এদেশে যে নাট্যান্দোলন গতিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জাবর কাটতে থাকেনি, গ্রামে যাবার সংগ্রামী প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা থিয়েটার। ভিন্নমুখী নাটক ও প্রকৃতির অকৃত্রিম প্রতিফলন যথার্থরূপে উপস্থাপনের প্রতিশ্র“তি দিচ্ছেন তারা। ...
সেলিম আল দীনের সংবাদ কার্টুনে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অবিকল কিছু অপ্রিয় সত্যচিত্র চোখ তুলে আছে। সংবাদ কার্টুন সত্যস্বাক্ষরিত জাতীয় নাটক হলেও সুন্দর কিছু ব্যাঙ্গাত্মক ধ্বনির ব্যঞ্জনা এতে সুসজ্জিত আছে। ঘোষকের বিভিন্ন পর্যায়ে স্থানকাল-পাত্রের বর্ণনা ও দর্শককুলের মাঝ থেকে স্লোগানে ফেটে পড়া জনতার মঞ্চে প্রবেশ দৃশ্যাবলী দর্শকদের ধৈর্যের উপর কোনো বাড়তি আঘাত হানেনি।
সাম্প্রতিক সাংকেতিক ও এ্যাবসার্ড ধর্মীয় কিছু নাটক দর্শকদের বিরক্তির কারণ হলেও আলোচ্য নাটক দু’টি সেদিক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত বলা চলে এবং গভীর দুর্বোধ্যতার কোনো ক্ষতচিহ্ন এর অঙ্গে দাঁত বসাতে পারেনি।
বাংলাদেশের ঘুনে ধরা ও ঝিম মারা নাট্যান্দোলনের প্রচলিত গতিধারা ভেঙ্গে গড়ার যে দুর্দম্য প্রচেষ্টা চলছে, ঢাকা থিয়েটার তাদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগ্রামী ভূমিকা পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের আরো প্রচার প্রয়োজন এবং মেহনতী মানুষের নিকটবর্তী হওয়ার বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ করা একান্ত দরকার। এছাড়া তাদের কর্মচিন্তায় জীবনবোধমুখী বিষয়ক ভাব-ভাবনার মূল্যায়ন হওয়া উচিত।৫
সংবাদ কার্টুন নাটকে ইংরেজি ডকুমেন্টারিরীতির সার্থক প্রয়োগের কথা কবির হুমায়ুনের আলোচনায় পাওয়া যায়:
মঞ্চের কথা বাদ দিলে এ দুটো নাটক বাংলাদেশের নাট্যান্দোলনে নতুনভাবে বিশ্লেষিত হবার মত।
সেলিম আল দীনের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। যা বিদেশী সাহিত্যে এর আগে লক্ষ্য করা গেছে। নাটকের নামে তা আঁচ করা যাচ্ছে। ইংরেজী ‘ডকুমেন্টারী’র সেলিম আল দীন সুন্দর বাংলা করেছেন সংবাদ কার্টুন। ফরাসীতে এ ধরনের নাটক প্রচুর লেখা হচ্ছে। এ সব নাটকের পটভূমিকা বিপ্লব যুদ্ধ এবং সমসাময়িক ঘটনা। যা কেবল ঘটনা প্রধান হবে না। ঘটনার মাধ্যমে একটা সত্য আবিষ্কার করবে। সেলিম আল দীন নাটকে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অবিকল কিছু সত্য চিত্র তুলে ধরেছেন। সংবাদ কার্টুন ডকুমেন্টারী থিয়েটারের অন্তর্গত হলেও এটাকে সুন্দর ব্যাঙ্গাত্মক করে সাজিয়ে নেয়া হয়েছে। ঘোষকের বিভিন্ন পর্যায় স্থান, কাল পাত্রের বর্ণনা, দর্শকের মধ্য থেকে স্লোগানমুখর জনতার মঞ্চে প্রবেশ একটুও বেখাপ্পা হয়নি। নাটকে এর প্রচলন বহু আগ থেকে। সাম্প্রতিক নাটকের সাংকেতিকতা এবং অ্যাবসার্ড বিষয়কে অনেকে নিন্দা করছেন। এ দুটো নাটকে তা মোটেও দুর্বোধ্য মনে হয়নি।৬
ঢাকা থিয়েটারের গ্রামে গমনের প্রতিশ্রুতি, গণমানুষের নৈকট্য অ্যাবসার্ড জীবনবোধমুখী ভাবনা; সাংকেতিকতা ও ... ধর্মীয় নাটকের দুর্বোধ্যতা না থাকা, ডকুমেন্টারির প্রয়োগ-এসবই সমালোচনায় অধিক প্রশংসিত। নাটক দুটির বিষয়ে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহের আগুন জ্বালানোর, উন্মুখতাও প্রত্যক্ষ করেন কেউ কেউ:
সংবাদ কার্টুন স্লোগানমুখর ভিন্নধর্মী নাটক যা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তই সর্বহারাদের চিরবিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে ভীষণ জেদী।
একাত্তুর উত্তরকালে বাংলাদেশে যে নাট্যান্দোলন গতি পেয়েছে তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। গ্রাম গ্রামান্তরে নব জাগৃতির এ খবর পৌঁছে দেবার প্রস্তুতি নিয়ে থিয়েটার তা পেশাদার মঞ্চে উপস্থিত করার জন্য ছুটে এলেন ভিন্ন স্বাদের নাটক পরিবেশনের জন্য নাটকের প্রকৃতি ও ইতিহাসকে যথার্থরূপে ধারণ করার গুরু দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ঢাকার থিয়েটার গোষ্ঠী। ...
মঞ্চে সঙ্কীর্ণ পরিধির কথা বাদ রেখে এদুটো নাটকই বাংলাদেশের নাট্যান্দোলনে নতুনভাবে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে।
সেলিম আল দীনের উল্লেখনীয় প্রচেষ্টা, যা ইউরোপীয় নাট্যসাহিত্যে ইতিপূর্বে লক্ষ্য করা গেছে। নাটকের নামও তাই ইংরেজী। ‘ডকুমেন্টারী’ সেলিম আল দীন যার নাম করেছেন সংবাদ কার্টুন। বিদেশে এ জাতীয় নাটকের পটভূমিকায় যুদ্ধবিগ্রহ ধ্বংস, বিপ্লব বিদ্রোহ ইত্যাদি ছাড়াও সমসাময়িক টাটকা ঘটনা থাকে। সেলিম আল দীন নাটকে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অবিকল কিছু অপ্রিয় সত্যচিত্র চোখ তুলেছে। সংবাদ কার্টুন ডকুমেন্টারী জাতীয় হলেও সুন্দর কিছু ব্যাঙ্গাত্মক উপাদান সাজিয়ে গুছিয়ে আছে।
সাংকেতিকতা ও অ্যাবসার্ড ধর্মীয় কিছু নাটক দর্শকমন্ডলীর বিরক্তির কারণ হলেও আলোচ্য নাটকদ্বয় সেদিক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত বলা চলে এবং দুর্বোধ্যতা অবোধ্যতাও এর অঙ্গে ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি করতে পারেনি। কেননা সহজে কথা বলা ও পথ চলার নিত্য দিনের চিত্রে যা এসেছে তাকে সুন্দর করে পরিবেশন করা হয়েছে সংবাদ কার্টুনে। ...
বাংলাদেশের ঘুনেধরা ও ঝিম মারা নাট্যান্দোলনের প্রচলিত প্রবাহকে পরিবর্তিত করার যে প্রচেষ্টা চলছে ঢাকা থিয়েটার তাদের ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত সংগ্রামী প্রতিশ্রুতি কার্যকরী করতে সচেষ্ট হলে কিছু হতে পারে। আরো প্রচার প্রয়োজন এবং গণমানুষের নৈকট্যে যেতে হলে চাই কর্মচঞ্চলতা, চাই সত্য জীবনবোধমুখী ভাব ভাবনা।৭
দিগি¦জয় চৌধুরী ‘ঢাকা থিয়েটারের বৈপ্লবিক বাঁক’ শিরোনামে নাটক দুটির ‘পরিণত সুস্থ জীবনঘনিষ্ঠ উপস্থাপনার’ প্রশংসা করেন; ‘নাট্য নিরীক্ষায় বাংলাদেশকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিল ঢাকা থিয়েটার’ বিশেষত সংবাদ কার্টুন নাটকের অভিনব উপস্থাপনার কথা এবং নাটকটি নিয়ে নানা বিতর্কের খবরও দেন:
শেষ দৃশ্যটি হলো এই রকম:
তবলা বাজছে এবং সমস্ত অভিনেতা অভিনেত্রী নৃত্যের তালে তালে গলায় দড়ি ঝুলিয়ে মৃত্যুর ভংগীতে এসে থেকে যাচ্ছে, ঘোষকের কন্ঠে শোনা যাচ্ছে: এটার জন্যেও রেশন কার্ড করতে হলে তবে তা সত্যিই মর্মান্তিক, কি বলেন? হাঃ হাঃ (ফ্রিজ)।
এক অপরূপ পটপরিবর্তনের শুভসূচনা হয়েছে বাংলাদেশের নাটকের ক্ষেত্রে। নাট্যনিরীক্ষায় আধুনিক বাংলাদেশকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে এল ঢাকা থিয়েটার। তাদের সাম্প্রতিক প্রযোজনা সংবাদ কার্টুন বাংলাদেশে নাট্যকৃতিদের এক পরিণত সুস্থ শিল্পসম্মত জীবনঘনিষ্ঠ উপস্থাপনা। উদ্ধৃত দৃশ্যপর্যায়টি সংবাদ কার্টুন-এর সমাপ্তিসূচক।...
বলা বাহুল্য প্রয়োগকুশলতা, পরিকল্পনা চাতুর্যে ঢাকা থিয়েটারের সাম্প্রতিক নাট্যনিবেদন বাংলাদেশের নাট্যজগতের একটা বৈপ্লবিক পথের দিশারী। বিশেষত সংবাদ কার্টুন নাটকটির উপস্থাপনার অভিনবত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। দৃশ্যরচনার এবং শব্দযোজনার যে অনাবিল চুমোচুমি এ নাটকের গতিকে স্বচ্ছন্দ করেছে তাকে স্মরণীয়তার উজ্জ্বল মণিকোঠায় পৌঁছে দিয়েছেন চরিত্রাভিনেতা-নেত্রীরা। তাদের সুষ্ঠু টিমওয়ার্কের গুণেই নাটকটি আসমাপ্তি দর্শকদের মোহাবিষ্ট করে রাখে।
সংবাদ কার্টুন কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে নাট্যামোদীদের মধ্যে এখন বহু বিতর্কের ঝড় উঠছে। কেউ কেউ একে স্টান্ট, নিছক রিপোর্টাজ অথবা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারক বলে আখ্যা দিতে চাইছেন।৮
‘প্রয়োগকুশলতা, পরিকল্পনার চাতুর্যে নাটকদুটি বাংলাদেশে নাট্যজগতের একটা বৈপ্লবিক পথের দিশারী’-রীতি পদ্ধতির অভিনবত্বের সঙ্গে সঙ্গে নাটক দুটির বিশেষত সংবাদ কার্টুন-এর জীবন খন্ডগুলির নিকটবাস্তবতা দর্শক ও সমালোচকদের নানা ভিন্ন ভিন্ন নান্দনিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছির। এটা স্পষ্ট গ্রাহ্য উপর্যুক্ত সমালোচনায়। দৈনন্দিন জীবনবাস্তবতা থিয়েটারে রূপায়ণের প্রশ্নে শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্কের নানা ধরন তৈরি হচ্ছিল যে তার হদিস পাওয়া গেল।
সূত্র তথ্য : ১. ঢাকা থিয়েটার সুভেনির (সেলিম আল দীন ও রুবেল চৌধুরী সম্পাদিত)-১৯৭৩, ২. সাপ্তাহিক বিচিত্রা- দ্বিতীয় বর্ষ-২৮ সংখ্যা- ২১ ডিসেম্বর-১৯৭৩, ৩. ‘ঢাকা থিয়েটারের দুটি ভিন্ন স্বাদ- নাটক’ বঙ্গবার্তা-৫ পৌষ ১৩৮০, ৪. ‘ঢাকা থিয়েটারের প্রথম প্রয়াস সাহসিকতায় উজ্জ্বল’- দৈনিক সংবাদ-১৯৭৩, ৫. ‘প্রতিশ্রুতিমুখর ঢাকা থিয়েটার’- দীপ্ত বাংলা-১৯ পৌষ- ১৩৮০, ৬. সাপ্তাহিক বিচিত্রা-৪ পৌষ ১৩৮০, ৭. ‘ঢাকা থিয়েটার - সমসাময়িক সমস্যাকে তুলে ধরছে’- জনমত-২৩ ডিসেম্বর ১৯৭৩, ৮. মাসান্তিক নাট্যপত্র- দ্বিতীয় বর্ষ- পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংখ্যা-১৯৭৩।
সুবচন নির্বাসনে
রচনা ও নিদের্শনা : আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রযোজনা : থিয়েটার
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ :১৯৭৪
[নাট্যকার ও নির্দেশকের কোনো মতামত সংগ্রহ করা যায়নি]
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
‘বেতার বাংলা’ পত্রিকার সমালোচক সুবচন নির্বাসনে নাটকটি সম্পর্কে বলেন :
সাম্প্রতিক সময়কে নাট্যকার নির্মমভাবে উপস্থাপিত করেছেন। চরিত্রগুলো নিদারুণ অস্থিরতায় কাঁপছে। আমাদের বর্তমান সমাজকে নানা দিক থেকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে এতে। ... তপু অস্থির তারুণ্যে এবং ভ্রান্ত মূল্যবোধের শিকার হয়ে বিনষ্ট হয়ে গেছে। তপু এ নাটকের বৃদ্ধ পিতার তুখোড়, ঝকঝকে সন্তান। ... তার গতিপ্রবাহ বিনষ্টির শেকড় থেকে রস নিয়ে অন্যখাতে বইছে। তপু আমাদের বড্ড চেনা চরিত্র। ... তপুর মতো যন্ত্রণাকাতর যুবকদের ভিড় আমাদের চারপাশে বেড়ে যাচ্ছে। ... সুবচনসমূহের মতো, তারা কি কোনোদিন নির্বাসনে যাবে না? এ নাটকের আরেক উল্লেখযোগ্য চরিত্র বৃদ্ধ পিতা। আদর্শবাদী একজন স্কুল শিক্ষক। জীবনের সুস্থ মূল্যবোধে বিশ্বাসী। যে সব বিশ্বাস ক্রমাগত আর্তনাদের মতো আমাদের চারপাশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ... সেই পিতা তার সন্তানদের মাঝে সঞ্চারিত করতে চান সেই সব অমল বিশ্বাসসমূহকে। কিন্তু তাঁর সন্তানেরা ক্রমবর্ধিত এক নষ্ট সময়ের মাঝে। এই সময় মানুষকে ক্রমশ পাপী করে তোলে। মানুষকে নিয়ে যায় অতল অন্ধকারের দিকে। কিন্তু পিতা আলোর জন্য তৃষ্ণার্ত। তিনি উপলব্ধি করেন, সাম্প্রতিক পৃথিবীতে তার বিশ্বাসগুলো নিদারুণভাবে মূল্যহীন। এই অবক্ষয় দেখে আর্তচীৎকার করে ওঠেন তিনি। তবে কি মানবিক বিশ্বাসের কোন মূল্য নেই। সেই প্রীতি, ভালবাসা এক অর্থহীন পটভূমির কম্পমান আর্তচীৎকার। পিতা প্রশ্নে বিদ্ধ। সন্তানদের তীব্র মুখোমুখি।
সমালোচক সুবচন নির্বাসনে নাটকে প্রত্যক্ষ করেন- ‘পরতে পরতে এই সাম্প্রতিকতা। এই সমকালীনতা। মূলত সমকালীনতাই এ নাটকের মূলভূমি। বৃদ্ধ পিতার বিশ্বাস এবং প্রশ্নসমূহ আমাদের আঘাত করে। আমরা উদ্বেলিত হয়ে উঠি”। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী নৈতিক এক সংকট-দীর্ণ জিজ্ঞাসা সরল প্রত্যক্ষতায় উপস্থাপিত এ নাট্যে।
চিন্ময় মুৎসুদ্দী বিস্তারিত ভাষ্য করেছেন নাটকটির :
সুবচন নির্বাসনে নামের এই নাটক আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের যে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে তা-ই দেখানো হয়েছে। তারা প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। উত্তর চেয়েছেন আমি, আপনি, সবার কাছে। থিয়েটারগোষ্ঠী সত্যের সাধককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাকে অপরাধী বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তার অপরাধ তিনি সত্যের পূজারী, তার অপরাধ তিনি নিজের সন্তানদের শিখিয়েছেন-কখনো মিথ্যা কথা বলবে না, অন্যায় কাজ করবে না। লেখাপড়া করে যে গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। যিনি সত্যের সাধক তার সন্তান তিনজনই তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ... পিতা সব অপরাধ স্বীকার করে বলেছেন: ‘আমি সব অভিযোগ স্বীকার করছি, আমাকে শাস্তি দিন প্রভু’। থিয়েটারের জজ কিন্তু রায় দেননি। তিনি সমবেত দর্শকদের কাছে রায় দেয়ার ভার ছেড়ে দিয়েছেন। থিয়েটার প্রশ্ন করেছেন তবে কি-‘সত্য অচল হয়ে গেছে? জ্বলছে শুধু মিথ্যার হুতাশন? ... মুহূর্তের জন্যে হলেও সমবেত দর্শকরা সমসাময়িক জাতীয় জরুরী একটা সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন। থিয়েটারের এ এক বিরাট সাফল্য।৩
ত্রুটিও নির্দেশ করেছেন তিনি:
“কিছু সংলাপ সহজে বাদ দেয়া যেতে পারে। যাতে মনে হবে না ‘বিদ্যাসাগরীয়’ নীতিবাক্য আওড়ানো হচ্ছে। সত্যের সাধককে সত্য বলার অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মধ্যেই তো মূল বক্তব্য ধরা পড়বে। নীতিবাক্যের পুনঃপুনঃ উচ্চারণ তাই ভারসাম্যহীন মনে হয়”।৪
‘দৈনিক জনপদে’ লেখা হয় :
“বাঙালির সাধারণ কতিপয় মূল্যবোধই প্রশ্নাতুর হয়ে পড়েছিল তীব্রভাবে- “যুগ যুগ ধরে চরিত্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে যা কাজ করেছে আজ কি তা প্রহসনে পরিণত হতে চলেছে? সততা গুণ নয়, সততা নির্বুদ্ধিতা”?৫
‘দৈনিক সংবাদে’ আবুল হাসনাত লেখেন :
সুবচন নির্বাসনে নাটক ইঙ্গিতময়, রূপক আশ্রিত। কিন্তু সমাজের বর্তমান অবক্ষয় আশ্চর্য এক চেতনায় পরিস্ফুট। সমাজ-জীবনে নৈতিকতার অনুপস্থিতি আমাদের পীড়িত করছে, এ যেন তারই ছবি, তারই দৃশ্য। ... নাটকটিকে যথাযথভাবে সমাজ-জীবনের দর্শন বলা যায়। ... সমাজ-জীবনের মূল সমস্যা বিশেষভাবে বিধৃত। যুব সমস্যায় নাটকটি ভারাক্রান্ত।
‘The Bangladesh Observer’ লেখে :
'Shubachon Nirbashone' is a play on decaying moral values of our society. Good saying like 'Honesty is a noble virtue', 'Success in life depends on education' or 'A woman can make a family happy' are soon becoming obsolute in our society today. ... The playwrite unfolds three stories of the three children to show that these good old saying do not work in our society today. ... why is this crisis of morality in our society today? The playwrite successfully injects these questions in the thoughts of the audience.৭
‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় লেখা হয় :
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম নানা মূল্যবোধের সংঘাতের মাঝ দিয়ে এসেছে। বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত নানা করুণ পটভূমিতে সমর্পিত। এমন এক বৈরী সময়ে এদের অবস্থান যখন বলা যেতে পারে আমাদের শুধু ভান রয়েছে। সুবচন নির্বাসনে মধ্যবিত্ত পরিবারের নানা প্রচলিত দ্বন্দ্বসমূহ আধুনিক আঙ্গিকে উপস্থাপিত করেছে। ... বৃদ্ধ পিতা সম্ভবত জানতেন না আমাদের ভিত্তিভূমিতে কতো বড় বিপর্যয় সংঘটিত হয়ে গেছে। পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন। আমাদের বিশ্বাসসমূহে ধরেছে চিড়। প্রাক্তন মূল্যবোধসমূহ নির্মমভাবে অবসিত। কোনো রকম সততার মূল্য নেই।৮
নাট্যকার সেলিম আল দীন লেখেন :
গভীর জীবনবোধ হয়ত এতে নেই। নেই চরিত্রের তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিচয় কিংবা মন্ডনকলার পরিশীলিত নির্যাস মঞ্চ থেকে নাকে এসে লাগে না বটে, তবু সাধারণ অনুভূতিকে এ নাটক প্রচ-ভাবে দোলা দেয়, প্রশ্নাতুর করে, যুগ এবং মূল্যবোধের পরিবর্তনের গন্ধ ছড়ায় এ নাটক। ... নাটকটিতে ব্রেশটীয় রীতির মিশ্রণ দেখা যায়। সরাসরি দর্শককে মঞ্চ থেকে প্রভাবিত করার যে প্রয়াস এ নাটকে দেখা যায় তা খুবই ফলপ্রসু।৯
অনেক বেশি বিশ্লেষণ, সমালোচনা করেছে নাটকটিকে ‘চিত্রালী’ :
কথাগুলো আদৌ সুবচন কিনা তা তর্ক সাপেক্ষ। এক ‘সততাই মহত্ব’। ... এই বচনটি অবশ্যই আপেক্ষিক। বক্তব্যের নয়- প্রয়োগে অবশ্যই আপেক্ষিক, কারণ সন্ধানে ব্যাপৃত হলে সমাজের অর্থনৈতিক সামাজিক ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে হয়। ... দুই ‘লেখা-পড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’ - এই বচনটি কি সুবচন? আমার তো মনে হয় এই ধরনের উদ্দেশ্য প্রণোদিত বচন শেখাতে এখনও যেসব শিক্ষকরা ব্যাপৃত আছেন তাঁদের চাকুরি যাওয়া উচিত। তিন, “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে” ... আজকের সমাজে অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই এই মূল্যবোধটিকে পরিহার করা হয়েছে। সংসার একক প্রচেষ্টায় সুখী হতে পারে না। এ হল সামন্ততান্ত্রিক সমাজের রান্নাঘরে নির্বাসিত রমণীকে পিঠ চাপড়ে দেয়ার স্লোগান। ফলে মধ্যযুগীয় এ বচনগুলির ওপর ভিত্তি করে যে গল্প গড়েছেন নাট্যকার তার ভিত্তিও অত্যন্ত দুর্বল। ... এবং সবচেয়ে বড় কথা সম্পূর্ণ ঘটনাটাই বিগতযুগীয়। ফলে ক্লিশে শ্রেণীভুক্ত। আসলে, সময়ের আবর্তে এই গতিশীল পৃথিবীতে সব বচনই পুরোনো হয়ে যায়। সব মূল্যবোধই নতুন উপলব্ধি আলোকে নতুনভাবে মূল্যায়িত হয়। তবে কিছু মূল্যবোধ ঠিক শাশ্বত না হলেও সময়ের ধোপে টিকে যায়। ... সেই রকম সুবচন বেছে নিলে নাটকটি সার্থক হত।১০
বেশ যুক্তিযুক্ত সমালোচনাই বটে। যুক্তিতে বাতিল মূল্যবোধগুলো অচল ত হবেই- তাতে নৈতিক সংকট তত গ্রাহ্য হয় না; যুক্তিবুদ্ধি সম্মত মূল্যবোধ বাতিল হলে ট্র্যাজেডি সত্য হয়।
আরো নানা ভিন্নতর দিক থেকেও সমালোচনা হয়- কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র আরেক সমালোচককে জানায় নাটকের বিষয়ের সঙ্গে সে একমত- তারও মনে হয় ‘মাইট (পিস্তল) ইজ রাইট, এটাই আজ সত্য অন্য সব মিথ্যা’; সমালোচকের তাই আর্ত প্রশ্ন- “সত্যিই কি নীতি, আদর্শ সত্যের নির্বাসন হয়ে গেছে? অথবা হয়ে যাবে? ... আপনারা শেষবার ভাবুন আমাদের রানারা কি তবে পিস্তলকেই যোগ্যতার মাপকাঠি বলে ধরে নেবে”?১১
যে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে মানুষ ত্যাগ স্বীকার করল অনেক, সেই মনুষ্যত্বের মহিমাই আজ ম্লান। স্বাধীনতা-উত্তর যুগে ‘মানুষ’ হয়ে গেছে গৌণ আর প্রাপ্তিটাই হয়েছে প্রধান। তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি নিয়ে এল সমাজের অধঃপতন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বেকার ও বিভ্রান্ত শিক্ষিত তরুণের জীবন যন্ত্রণা ও সততায় নিবেদিত প্রাণে হতাশার আর্তনাদে। মিথ্যার হুতাশনে অহর্নিশ জ্বলছে আজ সমস্ত নীতিকথা। বর্তমান সমাজ জীবনের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এক মর্মন্তুদ চিত্রই প্রতিফলিত এই নাটকে। প্রশ্ন জাগে- সমাজের সমস্যা তুলে ধরেছেন নাট্যকার কিন্তু নির্বাসিত ‘সুবচনের’ প্রত্যাগমনের আশার আলো কোথায়? সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার দায়িত্ব হয়ত নাট্যকার ছেড়ে দিয়েছেন তাঁদের উপর যাঁরা নিয়ন্ত্রিত করছেন আজকের সমাজ ব্যবস্থাকে।১২
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে নাটকটিকে বিচার করেছেন সমালোচক আর.এ. খান মজলিস। তবে তিনি নাটকে আশার আলো কোথাও দেখতে চেয়েছিলেন। শিল্পের কাছ থেকে চাহিদার একটা সরল ধরন এতে পাওয়া যাচ্ছে। তবু তিনি নবনাট্য আন্দোলনের এক নিটোল উত্তরণ সুবচন নির্বাসনে নাটকটিকে এই বলে আখ্যায়িত করেছেন :
নাট্যঘটনা বা নাট্যক্রিয়াকে অহেতুক গুরুত্ব না দিয়ে কিংবা দর্শককে অবাক করে দেওয়ার মত কোনো চটকদার প্রয়োগ- কৌশল অবলম্বন না করে আজকের ‘এ্যাটমসফিয়ারে’ সৃষ্ট প্রধান কয়েকটি চরিত্রের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব ঘটনা প্রয়োগ করে চরিত্রের ভাঁজগুলিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়েছেন নাট্যকার। ... নাটক দেখার পরে হয়ত বুদ্ধিদীপ্ত দর্শকের মনে নাটকের লক্ষ্যবস্তু বা মূল বক্তব্য নিয়ে নানা কথার উদয় হবে।১৩
নাটকের বিষয় ও প্রকরণের তীব্র সমালোচনা করেন কে, জামান :
But it is a pity that their maiden venture (Abdullah Al Mamoon's SHUBACHAN NIRBASHANAY) could hardly quence that thirst of the intellectual audience ... Theatre seems to be yet confined within the barrier of conventionalism in dramatic arts. Themetically Mamoon's SHUBACHAN NIRBASHANAY can hardly be called an experimental play. It is rather an aged conventional plot carefully cast to suit the fancy of a contemporary audience ... These sorts of moral conflicts by our conventional playwrites to earn cheap clamps from common audience. The only difference is that the author, instead of drawing a conclusion for himself tactfully passed it on to audience and thus avoided controversy that might arise out of the themes. The set of SHUBACHAN NIRBASHANAY has been a peculiar combination of symbols and realism. ... The set has been used to symbolize a home, an office as well as a court. In that case, it would perhaps be better if the set designer would either choose realistic sets or totally depend on a completely symbolic one. The combination of some real and some symbolic stage properties has, as I think it, weakend the gravity of the play to great extent. ১৪
সমালোচক নাটকের বিষয়ের ক্ষেত্রে নিরীক্ষাপ্রবণ হলেও মঞ্চসজ্জায় হয় বাস্তববাদিতা নয় প্রতীকী প্রয়োগের পক্ষপাতী। অথচ দুই রীতির মিশ্রণ তাঁর সমর্থন পাবারই কথা ছিল। বিষয় ও রীতি বিচারে একটা স্ববিরোধিতাই প্রকাশ পাচ্ছে না? ঢাকা থিয়েটার ও নাগরিকের নিরীক্ষা-প্রবণতার তিনি প্রশংসা করছেন।১৫
তবে এই নাটকের বিষয়ে পরীক্ষা- প্রবণতা আখ্যান- বিষয়ে কি করে হতে পারতো তা অবশ্য বলেননি। তবু বিষয়ের ক্ষেত্রেই তার পরীক্ষা- প্রবণতার ঝোঁক মঞ্চ বা প্রয়োগকলায় নয়।
সূত্র তথ্য : ১. ‘সমকালীন সুবচন নির্বাসনে’- বেতার বাংলা- তৃতীয় বর্ষ- অষ্টাদশ সংখ্যা- মে ১৯৭৪, ২. পূর্বোক্ত, ৩. চিন্ময় মুৎসুদ্দী- ‘জ্বলছে শুধু মিথ্যার হুতাশন?’- দৈনিক বাংলা-১০ মে- ১৯৭৪, ৪. পূর্বোক্ত, ৫. ‘সুবচন নির্বাসনে’- দৈনিক জনপদ- ৭ মে ১৯৭৪ (নগর সংস্করণ), ৬. আবুল হাসনাত ‘সুবচন নির্বাসনে নতুন নাটক : নতুন ছবি’ - দৈনিক সংবাদ- ১২ মে ১৯৭৪ (নগর সংস্করণ), ৭. The Bangladesh Observer -27 July- 1974, ৮. ‘সুবচন নির্বাসনে থিয়েটারের বলিষ্ঠ নিবেদন’-- দৈনিক ইত্তেফাক- ৭ মে- ১৯৭৪ (নগর সংস্করণ), ৯. সেলিম আল দীন- ‘সুবচন নির্বাসনে ও কতিপয় ধারণা’- পূর্বানী- ২২ মে- ১৯৭৪, ১০. ‘থিয়েটার নিবেদিত সুবচন নির্বাসনে’- চিত্রালী- ১০ মে- ১৯৭৪, ১১. জিয়াউল হক- ‘কাল ছিল রবিবার?’- দৈনিক জনপদ- ১৫ মে ১৯৭৪ (নগর সংস্করণ), ১২. আর এ খান মজলিস- ‘নবনাট্য আন্দোলনের এক নিটোল উত্তরণ সুবচন নির্বাসনে’- দৈনিক সংবাদ- ২১ মে- ১৯৭৪ (নগর সংস্করণ), ১৩. পূর্বোক্ত, ১৪. K Zaman ‘Stage reviews’ ‘SCREENFARE’ 10 May 1974, 15. Ibid.
এখন দুঃসময়
রচনা ও নিদের্শনা : আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রযোজনা : থিয়েটার
প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ :১৯৭৪
‘থিয়েটার’ এখন দুঃসময় নাটকের সুভেনিরে জানায় “কালো চরিত্রগুলোকে আপত দৃষ্টিতে শক্তিমান মনে হলেও পরিণতি এদের বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সুখের নয়- এটা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তাই আমাদের নাটকের শেষেও রয়েছে নবজীবনের আহবান, নতুন করে বাঁচার গান।”১
স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৪-এর বন্যাবিধ্বস্ত বাংলাদেশ নিয়ে এই নাটক এখন দুঃসময়। পরিপার্শ্বের ভয়াবহ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ত্বরিত প্রতিক্রিয়ায় নাট্যনির্মাণের এই ধরন নবান্ন নাট্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। সুভেনিরে উল্লিখিত ভাষ্যেও তারই প্রতিধ্বনি; বাংলাদেশের আশার এক সরল আবেগ নাট্য বিন্যাসে বিধৃত- নবান্ন প্রায় তার বিশ্বাসের ঘরানা।
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
‘চিত্রালী’ পত্রিকার সমালোচক বলেন :
এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে ‘থিয়েটার’ ভীষণরকম যুগসচেতন নাট্যগোষ্ঠী। তাদের প্রথম নাটকটি যেমন, তেমনি এই দ্বিতীয় নাটকটিও দেশীয় সমস্যা, যন্ত্রণা, নৈতিক দুর্নীতি ইত্যাদির প্রচন্ড প্রকাশমুখর। আমরা অবাক হয়ে দেখি যখন বন্যা দুর্দশাক্রান্ত, ক্লান্ত - যে বন্যা কমে এলেও এখনও চলে যায়নি। আর যে বন্যা কমার সাথে সাথে বিভিন্ন অন্তহীন সমস্যা সর্বগ্রাসী লোলনেত্রে আমাদের ছুঁয়েছে। আমরা ভারাক্রান্ত। ঠিক তখনই ‘থিয়েটার’ এতো তাড়াতাড়ি আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই সমস্যাবলী তুলে ধরে আমাদেরকে বিমূঢ় বিস্ময়াভিভূত করে দিয়েছে। ... নাট্যকার তার নাটকে জীবনের সমস্যাগুলোর উপরে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন আমাদেরকেই আমাদের চরিত্রের স্বরূপ। আর এ ক্ষেত্রে শুধু সার্থকই নন, তিনি অতিক্রম করে গেছেন অনেক যুগ সচেতন লেখককে।২
‘আমাদেরই সমস্যাবলী তুলে ধরে আমাদেরকে বিমূঢ় করে দেয়া’, ‘চোখে আঙুল দিয়ে’ আমাদের চরিত্রের স্বরূপ আমাদেরকেই দেখাতে চাওয়া- সমালোচকের এই প্রতিক্রিয়ায় এখন দুঃসময় নাট্যের অভিপ্রায় স্পষ্টবোধ্য হয়, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমর্থনও। এতে প্রত্যক্ষ বাস্তবতার সঙ্গে থিয়েটারের সরাসরি যোগেরও একটা ধরন বোঝা যায়। নাটকের প্রথম দৃশ্যের বর্ণনা করেন সমালোচক :
এ নাটকে সবচেয়ে উল্লেখনীয় যে বিষয়টি সেটা হল প্রথম দৃশ্য। যেখানে ব্যাপক সমাজের অস্থির বিপর্যয়ের একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আমরা বিমূঢ়! বিস্ময়ে প্রথমটায় স্তব্ধ, পরে উল্লসিত হয়ে উঠছি। যে সময়ে আবহ সঙ্গীতের সাথে সাথে আমরা অপেক্ষা করছি কখন পর্দা উঠবে, আর কি দেখবো সেই কৌতুহলে। ঠিক তখনই দর্শকদের মাঝ থেকে শিল্পীরা মঞ্চে পর্দার সামনে অল্প পরিসরে এসে আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে দেখিয়ে গেলো প্রথম দৃশ্য। নগরজীবনের বিপর্যয়- প্রতিক্রিয়া।৩
প্রয়োগের অভিনবত্বে দর্শকের সঙ্গে একাত্মতাবোধ ঘটে যায়- ভিন্ন একটা অভিঘাতের সৃষ্টি হয়।
‘সংবাদ’- সমালোচক জানান :
গোষ্ঠীর বক্তব্য অনুযায়ী এটা দ্বিতীয় নাটক হবার কথা ছিল না। কিন্তু আকস্মিকভাবে দেশে ভয়াবহ বন্যা হওয়ার ফলে বন্যার পটভূমিতেও যে জীবন্ত নাটক আমাদের চারপাশে অভিনীত হয় ... সে নাটক তুলে ধরে ‘সৎ নাট্যকর্মী হিসেবে’ থিয়েটার গোষ্ঠী তাঁদের কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। এবং তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষরক্ষা প্রহসনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও তারা এখন দুঃসময় আগে মঞ্চস্থ করেছেন।৪
এ থেকে ‘থিয়েটার’- এর দায়বোধের একটা মুদ্রা স্পষ্ট হয়।
সর্বগ্রাসী বন্যার শিকার জরিনা। জরিনার মতো অসংখ্য মানুষ। তাদের ঘর বাড়ি ডুবে যায়, ক্ষেতের ফসল তলিয়ে যায়। মাচাঙে দিনের পর দিন বসে থাকতে হয়। তাদের কোলের সন্তান বন্যার পানিতে ডুবে যায়। তিন দিন তিন রাত না খেয়ে অসহ্য জ্বালায় জ্বলতে হয়। তবু তারা বাঁচতে চায়, বাঁচতে স্বপ্ন দেখে। আর এই সুযোগে যারা টাকার গদি বানাতে চায় তাদের লোভ আর লালসার শিকার হয় এরা। থই থই পানিতে সামান্য যে মাটিটুকু জেগে থাকে সেটুকু হরণ করে বেপারী। ... পেশাদার ত্রাণকর্মীরা আসে বুকে কাঁধে ঝোলানো তাদের ক্যাসেট। ক্যামেরা ফ্লাস্ক তাদের কন্ঠে আছে আবেগ। কিন্তু বুকে নেই দরদ। বন্যার্ত মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে তারা দাঁড়ায়। তবু এরাই সব নয়। কালো চরিত্রেরও পতন হয়। সাঁতার না জানা বেপারীকে তাই সর্বগ্রাসী বন্যার পানিতে গ্রাস করে। বুকের রক্ত বন্যার পানিতে মিশিয়ে সোনা তাই বাঁচার মন্ত্র শিখিয়ে যায়। জরিনার সামনে রেখে যায় ‘নবজীবনের আহবান, নতুন করে বাঁচার গান।৫
সমালোচক জানান :
“এসবই ঘটে, ঘটছে। এই ছবিই থিয়েটার গোষ্ঠী দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন এখন দুঃসময়-এ”।৬
তবে সমালোচক আঁকা দৃশ্যপটের বিরোধিতা করেন :
বেড়াটা আঁকা না দিয়ে একটা সত্যিকারের বেড়া যোগাড় করা কি খুব কঠিন ছিল। ... ছোট ছোট চারাগাছ গোছের গাছগুলো জোগাড় করা তো তেমন অনায়াসসাধ্য ছিল না। ... আজকাল এই আঁকা দৃশ্য বড় চোখে লাগে।৭ বাস্তবতার একটা বাড়তি ঝোঁক বা চাহিদা বিষয়ের প্ররোচনায় এসে যায়।- এটাও বিশেষ এক নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি। নাটকটি জনপ্রিয় হয় তার সময়োপযোগিতার কারণেই- “বিষয়ই তার মুখ্য কারণ। চটুল গানের স্রোতে বন্যাকে ভাসিয়ে না দিয়ে তাঁরা বন্যার ছবিতেই বন্যার কথা মনে করেছেন”।৮
‘দৈনিক বাংলা’- পত্রিকায় সমালোচক চিন্ময় মুৎসুদ্দি থিয়েটার গোষ্ঠীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নাটকে দেশ-কাল-পাত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। তাঁর মতে :
কালোত্তীর্ণ শিল্প না হউক, সমসাময়িক জীবনের সার্থক প্রতিচ্ছবি এখন দুঃসময়। ঘটনা সাম্প্রতিক, সংলাপ তীক্ষèè, চরিত্র আরো চেনা। পরিণতি শেক্সপীয়রীয়ান, পরিবেশনা আধুনিক ... এই নাটক সমাজের সেইসব বর্ণচোরাদের গায়ে কাঁটা হয়ে বিধবে। ... বন্যাদুর্গতদের তথাকথিত দরদীদের মুখোশও এখানে উন্মোচন করা হয়েছে। ... আর দ্বিতীয় দৃশ্যে একজন চরিত্রের সেই প্রশ্ন- তবে ক্ষুধা লাগে কেন? আজ বাংলাদেশের হাজার হাজার দুর্গত মানুষের প্রশ্ন। মেঘনার চর থেকে ঢাকার রাজপথ, সিলেটের গনু থেকে উত্তরের জনপদ সর্বত্র সেই একই জ্বালা। ক্ষ ুধার জ্বালা একই প্রশ্ন- তবে ক্ষুধা লাগে কেন?৯
জীবনের সার্থক প্রতিচ্ছবি হলেও কালোত্তীর্ণ শিল্প নয় এ নাটক- বলেছেন সমালোচক; অথচ কেন তা নয় বলেননি। সাময়িক জীবনের প্রতিচ্ছবি হলেই কালোত্তীর্ণ হবে না এটা নিশ্চয় বলছেন না। কি করে হয় তাহলে শিল্প বা নাট্য কালোত্তীর্ণ?
তবে নাটকের দুর্বলতা অন্য সমালোচনায় পাওয়া যাচ্ছে :
থিয়েটার ঠিক জেনে নিয়েছেন দর্শকই আসল কথা। দর্শক যাতে বিগড়ে না যায় এবং সারাক্ষণ দর্শকের কথা মনে রেখেই তারা তাদের দ্বিতীয় নাটক এখন দুঃসময় নিয়ে মঞ্চে এসেছেন। ... কিন্তু বিষয়বস্তুর সৎ গাম্ভীর্যতার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে জীবনভিত্তিক প্রামাণ্য পরিবেশে নাট্যকাহিনীর বিস্তার ঘটেনি। কেবল চমক আর নাটক সৃষ্টিতেই আগ্রহ বেশী থাকায় নাট্যকার নির্দেশক বক্তব্য ধারণ করতে পারেননি অনেক ক্ষেত্রে। যথেষ্ট মনোরঞ্জক উপায়ে নাটকটি পরিবেশনের যে চেষ্টা তাতে মনে হতে পারে ব্যঙ্গ-ভঙ্গিমার আশ্রয়ে সমগ্র নাট্য-কাহিনী বিস্তার লাভ করেছে। বাকী সব কিছু অর্থাৎ- ক্লান্ত মানুষ এবং তাদের প্রতিবাদ ইত্যাদি তিনি পরোক্ষে সেরেছেন। জরিনার গৃহত্যাগ থেকে বেপারীর দেহত্যাগ সব কিছু তাই একটা সাজানো গোছানো নাটক বলে মনে হয়েছে।১০
‘চমক আর নাটক সৃষ্টিতেই আগ্রহ বেশী থাকায়’ বক্তব্য ধারণে ব্যর্থতা অনেক ক্ষেত্রে, ‘মনোরঞ্জক উপায়ে নাটক পরিবেশন, সাজানো গোছানো নাটক’ মনে হওয়া প্রভৃতি গুরুতর অভিযোগ সমালোচকের। সর্বক্ষণ দর্শকের কথা মনে রাখার ফলে, যেন তারা বিগড়ে না যায়, এমন ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি। নিজেদের সৎনাট্যকর্মী বলে পরিচয় দেবার পরেও একটা অসততার জায়গা থেকে গেছে- সমালোচকের এমন ভাষ্য। শিল্পের দায়বদ্ধতার স্বরূপ সম্পর্কে একটা দৃষ্টিভঙ্গি এতে স্পষ্ট হচ্ছে।
‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসের পরিবর্তিত অনুকরণের কথাও তুলেছেন সমালোচক- ছুটকির অনঙ্গবৌয়ের কাছে আত্মসমর্পণের সেই যে সংলাপ ছিল-‘ক্ষিধে পেলে মাথা ঠিক থাকে না।’ তবে এটা নাট্যকারের ‘অন্যমনষ্ক-অবচেতনার প্রকাশ’ বলেই মনে করছেন তিনি। তবু সমালোচক শেষাবধি বলছেন-“এখন দুঃসময় শিল্পীদের প্রচন্ড নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমের ঐকান্তিকতায় উজ্জ্বল”।১১
এভাবে তিনি একটা স্ববিরোধী অবস্থানই যেন নিয়ে নেন।
বুলবন ওসমান নাটকের সমূহ তারিফ করেন :
এখন দুঃসময় দেখে মনে হলো আবদুল্লাহ আল-মামুন সমাজতান্ত্রিক বাস্তবাদের মর্ম অনুধাবন করেছেন। ... নাট্য ও মঞ্চ জগতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যা আমাদের রাজনৈতিক মঞ্চে অনুপস্থিত। সেখানে শুধু সস্তা স্লোগান সর্বস্বতা এবং সংশোধনবাদিতা।১২
সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের মর্ম কী সেটা অবশ্য বলছেন না সমালোচক। তিনি নাটকটির ত্রুটি নির্দেশ করেও এর ভিন্ন কৃতিত্বের কথা বলেছেন :
বন্যা তার ফলাফলকে কেন্দ্র করে যারা দু’পয়সা কামাই করে নেয় মামুন সেই ব্যবসায়ী শ্রেণীর মুখোশ উন্মোচন করেছেন ... রাজনৈতিক নেতারাও এসব কুকর্মে যথেষ্ট জড়িত থাকেন সেদিকটা মামুন এড়িয়ে গেছেন। একটা দেশের সমাজব্যবস্থার সামনে থাকে রাজনীতিকরা, কিন্তু পেছনের বণিকরা আসল নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা (অসমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়)। তাই সেই মূল ক্ষমতাকে ধরে মামুন যথেষ্ট সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন ... তাছাড়া নাটকে শুধু শ্রেণী সংগ্রামের ইশারা নয়, এ্যাকশান বিদ্যমান। ... শ্রেণী সংগ্রাম যে একমাত্র পথ যা আমাদের মত দারিদ্র পীড়িত সমাজকে রক্ষা করতে পারে এ সম্বন্ধে কোনো দ্বিমত নেই। নাট্যকার মামুন সেই অমোঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার দিক নির্দেশ করেছেন।১৩
বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শেই বুঝি তিনি সমালোচনা করেছেন বাস্তববাদী নাটকের মধ্যে প্রতীকধর্মী অভিনয়ের প্রয়োগকে- “যা নাটকের মূল চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না”।১৪
বাস্তববাদিতার একটি বিশেষ চাহিদার ধরন এতে স্পষ্ট হয়। বাস্তববাদী নাটকে প্রতীকধর্মীতা থাকলেই তা খাপ খায় না- একথায় বাস্তববাদী নাটকে যে প্রতীকের সম্ভাবনা থাকতেও পারে - একথা সরাসরি নাকচ করেই দেওয়া হ’ল।
শিহাব সরকার ভিন্ন প্রসঙ্গে সমালোচনা করেছেন :
কালোবাজারী মহাজনের পাহারাদার ও প্রেমিক চরিত্রটিতে যথার্থ সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার কি খুব প্রয়োজন ছিল? না-কি দুষ্টের দমন দেখাতেই হবে। এই হিতবাদী চেতনা থেকে নাট্যকার তাকে শেষপর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছেন। তার মৃত্যু ও মৃত্যুপূর্ব আত্মরক্ষামূলক ভঙ্গীগুলো সাম্প্রতিক বাংলা ছবির ‘মেলোড্রামা’কেই আরেকবার মনে করিয়ে দেয়।১৫
‘পূর্বদেশ’- সমালোচক যে দর্শক- মনোরঞ্জনের কথা বলেছিলেন শিহাব সরকার তাকেই কি বলেছেন হিতবাদী চেতনা? বুলবন ওসমানের ভাষ্যমতে যা হল ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’। - ভিন্ন কতগুলো নান্দনিক অবস্থান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সমালোচনায় এভাবে। ‘হিতবাদী চেতনা’ ব্যাখ্যানে নাটকে এক ধরনের ইচ্ছাপূরণ প্রবণতার ইঙ্গিতই করা হয়েছে।
বাস্তববাদী এই নাটকের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানায় ‘বেতার-বাংলা’- সমালোচক :
বাস্তববাদী এই নাটক নতুন দিক নির্দেশক হবার ক্ষমতা রাখে। বাস্তববাদের নতুন হাওয়া বইছে এখন আমাদের শিল্পাঙ্গনে। এই সজীবতা শিল্পের বিভিন্ন শাখাকে পুষ্ট করে তুলবে। ... সমস্যাগুলো হয়েছে খোলাখুলিভাবে আলোচিত। সম্ভবত এখন আমাদের চারপার্শ্বে এমন সময় প্রবাহিত হচ্ছে যখন স্পষ্টভাষায় না বললে আমরা চিহ্নিত হবো অপরাধী হিসেবে।১৬
শিল্পের সামাজিক উপযোগিতার,- তার নৈতিক ভূমিকার কথাই বলছেন সমালোচক। এরপর আরো বিস্তারিত করেছেন তার আকুতি :
সাম্প্রতিক সামাজিক সমস্যাগুলো প্রকট অবয়ব নিয়ে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের। ক্রমশ রক্তহীন যেন হয়ে যাচ্ছি। এখন বুঝি সত্যিকার অর্থেই করুণ সময় নেমে এসেছে আমাদের চারদিকে। থিয়েটারের নতুন নাটক সেই সময়কে ধারণ করেছে। ... যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি হলেই আমাদের অনেকের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়। তার নগ্ন, বীভৎস কদর্যতা তখন সচেতনতার মর্মমূলে আঘাত করে। পীড়িত করে। বন্যা আমাদের জীবনের সার্বিকতাকে কতো প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে তা এতে উপস্থাপিত।১৭
ত্বরিত প্রতিক্রিয়ায় সমকালীন বিষয়ে প্রযোজিত বাস্তববাদী নাট্য এখন দুঃসময় বিষয়ে সমালোচনায় তিনটি ভিন্ন- অবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হল- থিয়েটারে শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্কসূত্রে নাট্যের সামাজিক নৈতিক ভূমিকার প্রশ্নে। দর্শক-মনোরঞ্জন, হিতবাদী চেতনা ও সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ- এই তিনটি মতাদর্শ- নিরিখে বিশ্লেষিত হয়েছে মূলত এখন দুঃসময়।
সূত্র তথ্য : ১. থিয়েটার ‘এখন দুঃসময়’ সুভেনির-১৯৭৪, ২. মনোজ কুমার দেবনাথ- ‘থিয়েটার, তার দুঃসাহসী নিবেদন এখন দুঃসময়’- চিত্রালী- ১৩ সেপ্টেম্বর- ১৯৭৪, ৩. পূর্বোক্ত, ৪. দৈনিক সংবাদ -১২ সেপ্টেম্বর- ১৯৭৪ (নগর সংস্করণ), ৫. পূর্বোক্ত, ৬. পূর্বোক্ত, ৭. পূর্বোক্ত, ৮. পূর্বোক্ত, ৯. চিন্ময় মুৎসুদ্দী ‘ক্ষুধা লাগে কেন?’- দৈনিক বাংলা- ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ (নগর সংস্করণ), ১০. ‘থিয়েটারের এখন দুঃসময়’ - দৈনিক পূর্বদেশ- ৩ অক্টোবর- ১৯৭৪ (নগর সংস্করণ), ১১. পূর্বোক্ত, ১২. বুলবন ওসমান- ‘এখন দুঃসময়’- ‘থিয়েটার প্রযোজিত তৃতীয় নাটক’- দৈনিক ইত্তেফাক- ১৯৭৪ (নগর সংস্করণ), ১৩. পূর্বোক্ত, ১৪. পূর্বোক্ত, ১৫. শিহাব সরকার -‘থিয়েটার এর এখন দুঃসময়’- সিনেমা- ১৯৭৪, ১৬. ‘সমকালীন নাটক এখন দুঃসময়’- সিনেমা- ১৯৭৪, ১৭. পূর্বোক্ত।
[দ্বিতীয় কিস্তি আগামী সংখ্যায়। দ্বিতীয় কিস্তিতে থাকছে- পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, দেওয়ান গাজীর কিসসা, শকুন্তলা, অচলায়তন, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, কিত্তনখোলা, নূরলদীনের সারাজীবন]
বিপ্লব বালা : নাট্যকার, নির্দেশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সংগীত বিভাগের শিক্ষক