Full premium theme for CMS
ফেইড্রা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
অনুবাদ: অসিত কুমার
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
(হিপোলিটাস, থেরামেনেস)
হিপোলিটাস
না, সম্মানীয় থেরামেনেস, ট্রোজেনের এই আনন্দোচ্ছল জীবন আর নয়। আমি মনস্থির করে ফেলেছি। আমাকে বেরিয়ে পড়তেই হচ্ছে। নিজের এই লজ্জাজনক আলস্য আমি ক্ষমা করতে পারছি না একেবারেই। পিতার অজ্ঞাতবাসের ছয় মাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে। নিদারুণ উৎকণ্ঠা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জানি না কোন অজানা উপকূলে অন্তরীণ হয়ে আছেন তিনি; কোন পরীক্ষার মুখোমুখি তাকে দাঁড় করিয়েছে জীবন।
থেরামেনেস
যুবরাজ, সত্যি আপনি তার সন্ধানে যেতে চান? কিন্তু কোথায়? আপনাকে আশ্বস্ত করতে আমি ইতোমধ্যেই ঘুরে এসেছি কোরিন্থের দুই ধারের বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট। নরকের নদী এ্যকিরনের দুই কূলের আদিবাসীদের কাছে জানতে চেয়েছি থিসিয়াসের খোঁজ। এলিস থেকে ট্যানারাসের সীমা ছাড়িয়ে আমি চলে গেছি সেই সমুদ্রে যেখানে ইকারুসের সলিল সমাধি হয়েছিল। তারপরও কী আশায় আপনি যেতে চান দূর অজানায়? কে জানে তার এই দীর্ঘ রহস্যঘন অনুপস্থিতির কী কারণ। এমনওতো হতে পারে, তার ভাবনায় এদিকে আমরা যখন হতবিহ্বল, তিনি তখন নতুন কোনো প্রণয়লীলায় মগ্ন; হয়তো প্রতারণার নতুন কোনো ফাঁদ পাতছেন।
হিপোলিটাস
যথেষ্ট হয়েছে থেরামেনেস। রাজা থিসিয়াসের দেহে যৌবনের শিখা আর জ্বলবার কথা নয়। স্থূলবাসনা তার প্রত্যাবর্তনের অন্তরায় হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বীর শঙ্কা আর নেই রানী ফেইড্রার। তার জন্যে রাজা অনেক আগেই পরকিয়া ছেড়েছেন। তাই আমার কর্তব্যের অংশ হিসেবেই আমার বেরিয়ে পড়া উচিত। তাছাড়া ভীতিকর এই স্থান থেকে আমাকে পালাতেই হবে।
থেরামেনেস
আপনার শৈশব স্মৃতি বিজড়িত এই শান্তিধাম ঠিক কবে থেকে আপনাকে ভীত করছে? বিশেষ করে যে স্থান আপনার কাছে স্পপন্দিত প্রাণ এথেন্সের চেয়েও প্রিয়, কিসের আশঙ্কা আপনাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়?
হিপোলিটাস
আনন্দের সেই দিনগুলো আর নেই। সব কিছু বদলে গেছে ঈশ্বর যেদিন মিনোস আর পেসিফির কন্যাকে এখানে পাঠালেন।
থেরামেনেস
আচ্ছা, তাহলে ফেইড্রার উপস্থিতি আপনাকে ভারাক্রান্ত করেছে। হ্যাঁ, রাজার সদ্যবিবাহীত সঙ্গী হয়ে এথেন্সে এসেই তিনি আপনার নির্বাসন কামনা করলেন। তার ইচ্ছা পূরণও করলেন রাজা। অথচ সংশয় হয় তার আগে তিনি আপনাকে ভালো করে দেখেছেন কি-না। তবে এতদিনে আপনার প্রতি তার প্রগাঢ় ঘৃণা প্রশমিত হয়েছে নিশ্চয়। তাছাড়া মৃত্যুই যার একমাত্র কাম্য তাকে আপনার কিসের ভয়? অব্যক্ত কোনো কারণে জীবনের ভার বইবার শক্তি যিনি হারিয়েছেন, দিনের আলো যে সইতে পারে না- রোগ শয্যায় শায়িত সেই নারী আপনার কোন ক্ষতি করতে পারে?
হিপোলিটাস
ফেইড্রার দুর্বোদ্ধ রোষ আমার উদ্বেগের কারণ নয়। বরং, বলতেই হচ্ছে, এর কারণ, আমার আরেক শত্রু। সে এরিসিয়া। এরিসিয়ার কাছ থেকে আমাকে পালাতেই হবে। শুনেছি, ওদের বংশের শেষ বীজ এই মেয়ে চেয়েছিল আমাদের নির্বংশ করতে।
থেরামেনেস
আপনিও হবেন তার শত্রু? হোক না সে পাল্লাসের বংশধর- ভ্রাতার ষড়যন্ত্রে এই সুভদ্রা কুমারীর কোনো দায় তো ছিল না। তবে কেন এই নিষ্পাপ রমনীর প্রতি এত ঘৃণা?
হিপোলিটাস
ঘৃণাই যদি কারণ হত, পালাবার কথা নয়, প্রতিশোধের কথাই উঠতো।
থেরামেনেস
তাহলে কি আপনার ট্রোজেন ত্যাগের কারণ অনুমান করে নিতে পারি? আপনি কি তবে আর সেই হিপোলিটাস নন যিনি অবজ্ঞাভরে এড়িয়ে গেছেন প্রণয়ের সব আহ্বান; যে হিপোলিটাস ঘৃণায় প্রত্যাখান করেছেন তা, যা তার পিতা করেছেন বরণ? অবশেষে দেবী ভেনাস কি প্রতিশোধ নিলেন দীর্ঘ অপমানের? একি তবে তার স্বর্গীয় শক্তির সপক্ষে আপনার স্বীকারোক্তি? তার মন্দিরে আনত আপনার মাঝে একি তবে থিসিয়াসের প্রতিধ্বনি? আপনি কি সত্যিই কোন রমনীর প্রতি অনুরক্ত?
হিপোলিটাস
আশৈশব আমাকে চিনেও কেন এই ভ্রম? কী করে আশা করেন আমার কৃচ্ছ্রতা, আমার সব অহঙ্কার এমন স্থূলতায় পর্যবসিত হোক? আপনি হয়তো ভাবছেন এক আমার্জনীয় মায়ের স্তন্যে কি-বা অহঙ্কার আমি পান করেছি । বীরত্বের নিবিড় অনুশীলনে আমি বড় হয়েছি। আপনিও মন-প্রাণ ঢেলে পিতা থিসিয়াসের গৌরব গাঁথায় আমাকে করেছেন দিক্ষীত। আপনার নিশ্চয় মনে পড়বে কি উৎসাহে আমি শুনেছি পিতার বীরগাঁথা। হারকিউলিসের অভাব ভুলিয়ে দেন এমন একজন পিতার কীর্তিবাহী প্রতিটি শব্দ আমার অন্তরে গেঁথে গেছে। দস্যু দমন থেকে শুরু করে রাক্ষসকূলের শিরচ্ছেদ; প্রোক্রাসটেস, স্কিরন, সিনিস, সারসিয়ন ইত্যাদি সব এপিডোরীয় দানোদের ছিন্নভিন্ন অস্থি, ক্রিটের পাথরে লেপ্টে থাকা মিনোটরের নষ্ট রক্ত- এসব বর্ণনা আমি বিস্ফারিত চোখে শিহরিত হয়ে শুনেছি আপনার কাছে। কিন্তু তার অজস্র প্রণয় প্রবঞ্চনার দীর্ঘ কাহিনীর মালা গাঁথতে গেলে আপনাকে থামিয়ে দিয়েছি। স্পার্টার অপহৃত কুমারী হেলেন, সালামিসে প্রতারিত বিষণ্ন পেরিবিয়া- মেকি দীর্ঘশ্বাস আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি সরল চিত্তে বিশ্বাস করে ঠকেছে যে নিষ্পাপ রমনীগণ- ব্যথিত এরিয়াড্নে যার বিলাপ প্রতিধ্বনি তুলেছে পাথরে পাথরে; সবশেষে শেকড় ছিঁড়ে তুলে আনা ফেইড্রা- এই সব হতভাগ্য নারীদের প্রতারণা সংবাদ আমি এড়িয়ে গেছি ঘৃণায়। বীর থিসিয়াসের জীবনের ধূসর অনুচ্ছেদ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে না পৌঁছুক সে ইচ্ছা আমি ব্যক্ত করেছি আপনার কাছে। যদি তাই হয়ে থাকে আমি কী করে পারি কারো অনুরক্ত হতে, দেবতার আক্রোশে এত ছোট হতে? রাক্ষসের রক্তে স্খলনের যে অধিকার আমার পিতা অর্জন করেছিলেন, আমি কি পারি ততটা জ্যেতিষ্মান না হয়ে তার চেয়ে বেশি কলঙ্ক গায়ে মাখতে? আমার অহম যদি অস্ত্র সম্বরণ করেওবা, আমি কি পারি এরিসিয়ার মাধুর্যে আত্মসমর্পণ করতে? আমার লক্ষ্যভেদী আবেগ কি করে পারবে তার দ্বার ভেদ করতে যার জন্য নিষিদ্ধ সব পুরুষের দ্বার? রাজা থিসিয়াস এরিসিয়ার শত্রু বৈ তো নয়। ভাইয়ের বিদ্রোহের বীজ তার মাঝে বেঁচে না থাকে সেই বিষয়ে তার সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়েছে। এরিসিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিষবৃক্ষে নব অঙ্কুর জাগরণের সব সম্ভাবনার মৃত্যুই থিসিয়াসের কাম্য। পরিণয়ের মশাল এরিসিয়ার ঘরে কোনোদিন জ্বলবে না। যার নিঃসঙ্গতার নিয়তি বেঁধে দিয়েছেন স্বয়ং রাজা, তার পক্ষ নিয়ে রাজার ক্রোধ আর চারিদিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়া- এইসব চিত্তবিভ্রমে আমি কেমন করে কলুষিত করবো আমার তারুণ্য?
থেরামেনেস
কিন্তু রাজন, ভালবাসার মাহেন্দ্রক্ষণ যদি এসে গিয়েই থাকে, যুক্তি দিয়ে তাকে পিছিয়ে দেবার কেন এ বৃথা চেষ্টা? নিয়তির সায় এতে মিলবে না। থিসিয়াসের নিষেধাজ্ঞা বরং আপনাকে করেছে আরো দুর্বার। এরিসিয়ার প্রতি তার ঘৃণা উষ্কে দিয়েছে আপনার ভিতর আগে থেকেই জ্বলতে থাকা শিখাগুলোকে। এত সত্য এত পবিত্র যে প্রেম তাকে ঘিরে কেন এত ভয়? জীবনের এত সুমিষ্ট যে ফল তার স্বাদ নিতে কেন এত দ্বিধা? তবে কি নির্র্র্র্র্জীব ভিরুতায় কঠিন হয়ে যাবে আপনার শোণিত? হারকিউলিসের অনুভূতি কেন আপনাকে স্পর্শ করে না? কেমন সে অন্তর ভেনাসের শক্তিকে যে এড়িয়ে যায়। ভেনাসের বিরুদ্ধাচারী প্রমত্তা এন্টিওপ যদি থিসিয়াসের বশ না মানতো, রাজন, আজ আপনি থাকতেন কোথায়? তাই বলছি, আসুন, থেমে থাকা নয়, তর্ক নয় কোন। বলুন আপনি বদলে গেছেন। আপনাকে আর একাকী বেলা ভূমিতে রথ চালিয়ে ছুটতে দেখা যায় না আগের মত। না দেখা যায় নেপচুনের যুদ্ধবিদ্যার গভীর অনুশীলনে বুনো অশ্বদের বশ মানাতে। আমাদের পদচারণায় বনভূমি আর আগের মত মুখরিত হয় না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই আপনার ভারাক্রান্ত চোখের মণিতে কি এক গোপন শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে। ভালবাসার জীবাণুতে আপনি আক্রান্ত। যে প্রচণ্ড আবেগ আপনাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় আপনি তাকে অবরুদ্ধ করে রাখতে চান? বলুন, এরিসিয়াই কি তাহলে জাগ্রত করেছে আপনার অনুরাগ?
হিপোলিটাস
আমি চললাম, থেরামেনেস, পিতার সন্ধানে আমাকে বেরিয়ে পড়তেই হচ্ছে।
থেরামেনেস
যাবার আগে কি একবার রানীর সাথে দেখা করে যেতে হয় না?
হিপোলিটাস
আমিও তাই ভাবছি। আপনি তাকে সংবাদ দিতে পারেন। ওহ্, ঐতো তার প্রিয় ইনোন, কিন্তু কোন নতুন বেদনায় তার চোখ অশ্রু সজল?
দ্বিতীয় দৃশ্য
(হিপোলিটাস, ইনোন, থেরামেনেস)
ইনোন
হায়, প্রভু, আমার দুঃখের কি কোন তুলনা আছে? রানীমার অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। অহর্নিশি তার শুশ্রুষা করেও বুঝি না কোন অজানা ব্যাধি তাকে টেনে নিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে। তার আবেগ আর ভাবনায় চরম অসংগতি বিরাজ করছে। কি এক অদম্য অস্থির যন্ত্রণায় তিনি তার শয্যা ছেড়ে উঠে এসেছেন; আলো দেখতে চান অথচ চান না চূড়ান্ত দুর্দশায় কেউ তাকে দেখে ফেলুক। ঐ যে তিনি আসছেন।
হিপোলিটাস
আমি চলি। আমার ঘৃণীত অবয়ব তার যন্ত্রণা বাড়াবেই কেবল।
তৃতীয় দৃশ্য
(ফেইড্রা, ইনোন)
ফেইড্রা
আর যে পারি না ইনোন, দাঁড়াও লক্ষ্মী। আমার দেহে এক বিন্দু বলও আর অবশিষ্ট নেই। ভয় হয় বুঝি সূর্যের তীক্ষ্ম রশ্মিতে আমি দৃষ্টি হারিয়ে ফেলবো। আমার কম্পিত জানুতে কি ভীষণ অবসাদ নেমে আসে, হায়!
ইনোন
হায় ঈশ্বর দূর কর এই দুর্দশা!
ফেইড্রা
কি ভীষণ বোঝা মনে হয় এই রাজ বসন। কে বেঁধেছে বিনুনি অবাঞ্ছিত হাতে? কে পড়িয়েছে কপালে জরির জমকালো সাজ?
ইনোন
তার ইচ্ছা গুলো এখনো মুখোমুখি। নিজের মুখশ্রীতে বিরক্ত হয়ে আপনিইনা একটু আগে সাজ পোশাকের কথা বললেন। নতুন করে সূর্যের মুখ দেখবেন বলে আপনি নিজেই তো শক্তি সঞ্চয় করলেন। অথচ সূর্যের কাছে আসতেই মুখ ফিরিয়ে আপনি পালাবার পথ খুঁজছেন।
ফেইড্রা
দুঃখী মানবজাতির স্রষ্টা, হে অগ্নিশ্বর, যাকে জনক ভাবার সাহস ছিল আমার মাতার, আমার দুর্দশায় আজ হয়তো আপনি ব্যথিত। তবে এই হোক আমার শেষ সূর্যদর্শন।
ইনোন
এই রুগ্ন বাসনা কি ঝেড়ে ফেলা যায় না? অনন্ত কাল ধরে কি আমাকে শুনতে হবে এমন মরণ কল্পনার কথা? মৃত্যুর সাথে এ কেমন ভাব পেতেছেন আপনি?
ফেইড্রা
অরণ্যের গভীর ছায়ে বসে কখন যে দেখতে পাব সোনালী ধূলো উড়িয়ে পথের উপর দিয়ে ছুটে যায় সেই রথ।
ইনোন
কি বলছেন?
ফেইড্রা
আমি কোথায়? এ যে উন্মাদনা! এ আমি কি বললাম? কোথায় আমি বলে দিলাম আমার গোপন বাসনার কথা? দেবতারা আমার বুদ্ধি হরণ করেছেন। লজ্জার ঢল আমায় রাঙিয়ে দিচ্ছে। আমার পাপক্লিষ্ট চিন্তা এমন সহজে প্রকাশিত হলো! বেদনার অশ্রুধারায় আমি ভেসে যাচ্ছি, ইনোন।
ইনোন
আপনার অসহ্য নীরবতার জন্যেই লজ্জিত হওয়া উচিত। কারণ, এই বিকৃত নীরবতা আপনাকে আরো বেশি অসুস্থ করে তুলছে। আমাদের এত সেবা এত অনুরোধ সব উপেক্ষা করে এ কেমন নির্মম মৃত্যু-নকশা আপনি এঁকে চলেছেন? এ কেমন উন্মত্ততা মাঝপথে থামিয়ে দিতে চায় আপনার জীবন? কোন বিষে এমন মৃত্যু সম্মোহন? আকাশ পেরিয়ে তিনরাত গত হল আপনার ঘুমের দেখা নেই। তিন তিনবার সূর্য গ্রাস করেছে অমানিশা। অথচ আপনি একবারও আহার গ্রহণ করেননি। কোন মহা অনিষ্টের পানে ধাবিত আপনার অন্তর? কোন অধিকারে আপনি আত্মহননের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? এভাবেই জীবনদায়ী দেবতাদের আপনি রুষ্ট করে চলেছেন। জীবনসঙ্গীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত আপনি নিজ সন্তানদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছেন বেদনার ভারী জোয়াল- তাদের মায়ের মৃত্যুতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে অন্য মায়ের সন্তানের অভিলাষ- আপনার এবং আপনার পরম্পরার মহাশত্রু সে হিপোলিটাস ...
ফেইড্রা
হা ঈশ্বর!
ইনোন
অবশেষে আমার কথা তাকে স্পর্শ করেছে মনে হয়।
ফেইড্রা
হায়রে হতভাগ্য নারী, এ কোন নাম তুমি উচ্চারণ করলে?
ইনোন
হ্যাঁ, এই তো! এতক্ষণে তেজোদ্দীপ্ত হয়ে উঠছেন! বেশ! সেই নাম শুনতেই আপনি চমকে উঠলেন এবং এমনইতো হওয়া উচিত। আপনাকে বাঁচতেই হবে। ভালবাসা আর কর্তব্যবোধে শাণিত হোক আপনার চেতনা। আপনাকে বাঁচতে হবে পাছে সিথীয় কোন রমনীর পুত্র আপনার সন্তানদের অধিকার বঞ্ছিত করে, পাছে সে পদদলীত করে গ্রীসের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও দেবতাদের। কিন্তু আর বিলম্ব নয়, আপনার জীবন রক্ষায় প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। হারানো শক্তি ফিরে পেতে হবে আপনাকে। ভেতরের নিভু নিভু শিখাগুলো উষ্কে দিতে সময় লাগবে না।
ফেইড্রা
হায়, আমার ভেতর গ্লানীর শিখা যে বড় বেশি দিন ধরে জ্বলছে।
ইনোন
বলুন, কি অনুশোচনা এমন বিদ্ধ করে আপনার অন্তর। কী এমন অপরাধে পিষ্ট আপনার বিবেক? নিশ্চয়ই কোনো নিষ্পাপ রক্তে হাত রাঙাননি আপনি?
ফেইড্রা
দেবতারা জানেন কী নিষ্পাপ আমার হস্ত যুগল। হায় ঈশ্বর! যদি তেমনই নিষ্পাপ হত আমার হৃদয়।
ইনোন
কবে কী ভয়াবহ ভাবনা আপনার বাসা বেঁধেছিলো যা আজো আপনার হৃদয়কে সংকুচিত করে?
ফেইড্রা
ঢের বলা হয়েছে, আর জানতে চেও না। সেই ভয়ানক ভাবনাকে অবরুদ্ধ রাখতেই আমি আজ মৃত্যুপথযাত্রী।
ইনোন
এমন নিষ্ঠুর নীরবতার চেয়ে বরং মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়াও ভাল। কিন্তু আপনার চোখের পাতা বন্ধ করে দেবার মত কেউ যে থাকবে না। যদিও আপনার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। কিন্তু আপনার আগে আমিই মৃত্যুপুরীর দিকে যাত্রা করবো। সেখানে যাবার হাজার পথ। আমি সব থেকে সংক্ষিপ্ত পথটিই বেছে নেবে। কিন্তু রানী, আমি কি কখনো আমার দায়িত্বে অবহেলা করেছি, নাকি আঘাত দিয়েছি আপনাকে? মনে পড়ে, আপনার জন্মের পর এই হাত দুটোই প্রথমে আপনাকে তুলে নিয়েছিল। আপনার জন্য আমার দেশ ছেড়েছি; সন্তান, আত্মীয় সব ছেড়েছি। এই কি আমার ত্যাগের পুরস্কার?
ফেইড্রা
তুমি কী চাও? কেন এই তিরষ্কার? যে সত্য তুমি আজ উদ্ঘাটন করতে চাও, সেই সত্য বড় ভয়ানক, তুমি সইতে পারবে না।
ইনোন
হায় দেবকূল! চোখের সামনে আপনাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু কি হতে পারে?
ফেইড্রা
মৃত্যু আমার হবেই। শুধু পার্থক্য এই, আমার নির্লজ্জতা, আমার পাপচিন্তা কেউ জানলে আমার মৃত্যু হবে অপরাধীর মৃত্যু।
ইনোন
দেবী, যে অশ্রুধারায় আমার মুখ প্লাবিত, আপনার যে কম্পিত জানু আমি জড়িয়ে আছি তার দোহাই দিয়ে বলছি, আমার সন্দেহ দূর করুন।
ফেইড্রা
দাঁড়াও, তুমি আমাকে বাধ্য করছো বলেই বলছি, শোন।
ইনোন
বলুন, আমি উৎকর্ণ হয়ে আছি।
ফেইড্রা
হায় দেবতা! ওকে আমি কী বলি, কোথায় শুরু করি?
ইনোন
আপনার দ্বিধা আমার অন্তর ক্ষত করে।
ফেইড্রা
হায়! আমাদের প্রতি দেবী ভেনাসের কী অসীম ঘৃণা! ভালবাসার কৃতদাসী হয়ে কী লজ্জাই না বয়ে এনেছিলেন আমাদের মাতা!
ইনোন
প্রিয় রানী, সেই কুৎসিত স্মৃতি নীরবতার অন্তরালে ঢাকা পড়ে থাকুক অনন্তকাল।
ফেইড্রা
হতভাগী বোন আমার, এরিয়াড্নে, তুমিও ভালবাসতে প্রাণ দিলে নিষ্ফলা বালু রাশিতে!
ইনোন
দেবী, একি হলো আপনার? কী ব্যথায় বংশের করুণ কাহিনী এমন করে হাতড়ে বেড়ানো?
ফেইড্রা
আর আজ অভিশপ্ত বংশের শেষ চিহ্ন আমিও যে কুড়ে কুড়ে মরি- সে তো ভেনাসেরই ইচ্ছা, না-কি ?
ইনোন
আপনি প্রেমে পড়েছেন ?
ফেইড্রা
ভালবাসার দুর্বার তৃষ্ণায় আমি কাতর !
ইনোন
কার জন্য?
ফেইড্রা
তুমি এমন কিছু শুনতে চলেছ যার চেয়ে ভয়াবহ কিছু হয় না। আমি ভালবাসি ... না না সেই নাম মুখে আনতে আমার শরীর অবশ হয়ে আসে ... আমি পারি না ... আমি ভালবাসি ...
ইনোন
কাকে ?
ফেইড্রা
ভাব কোনো এক সিথীয় রমনীর সন্তান, এক যুবরাজের কথা, যাকে কত মিথ্যে দোষের স্তুপের নিচে চাপা দিয়েছি কতবার।
ইনোন
হিপোলিটাস? হায় ঈশ্বর!
ফেইড্রা
আমি বলিনি, তুমিই উচ্চারণ করলে সেই নাম।
ইনোন
ন্যায়ের প্রতিভূ ঈশ্বর! আমার রক্ত যে হীম হয়ে যায়। একি অন্যায়, একি হতাশার কথা- এর চেয়ে বেশি অভিশপ্ত হয় কোন পরিবার! কেন যাত্রা করেছিলাম এই রাহুগ্রস্থ রাজ্যে? কেন পা রেখেছিলাম এই বিশ্বাসঘাতক সাগরকুলে?
ফেইড্রা
আমার দুর্দশার শুরু তারও অনেক আগে। এযিয়াসের পুত্রের সাথে বিয়ের মন্ত্র উচ্চারণের বিহ্বলতা নিয়ে এথেন্সে পা ফেলতেই আমি আমার ঘোরতর শত্রুর মুখ দেখি। তাকিয়ে থেকে লজ্জায় কখনো রাঙা হয়েছি, আবার কখনো সব রঙ হারিয়ে ফিকে হয়ে গেছি- হঠাৎ কী এক উথাল পাতাল ঘূর্ণিতে আমি শুন্যে সাঁতার দিলাম- তারপর আমার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে গেল, আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম, আমার শরীরে দাহ- অথচ বাইরে কেমন শীতল আর নিথর হয়ে গেলাম। আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমার উপর ভর করেছেন দেবী ভেনাস যিনি অগ্নিবানে ঝলসে দেন তার শিকার। অবিরাম প্রার্থনায় আমি তাকে প্রশমিত করতে চেয়েছি ; পরম যত্নে তার মন্দির গড়ে, অসংখ্য বলিদানে তাকে তুষ্ট করে আমি চেয়েছি শান্তি ফিরে পেতে। কিন্তু এমন প্রণয়কাতর নারীর কি উপশম আছে? বৃথাই আমি ধূপ পুড়িয়েছি ভেনাসের মন্দিরে: মুখে দেবতার নাম নিয়ে আমি উপাশনা করেছি প্রিয় পুরুষের; অহর্নিশি তারই ছবি ভেসেছে মনের পটে। আমি তাকে এড়িয়ে গেছি অথচ- ওহ, কী ঘৃণ্য, কী কলঙ্কময়- পিতার দিকে তাকালে আমি দেখেছি পুত্রের মুখ! অবশেষে আমি বুঝলাম শক্ত হতেই হবে; মনকে বোঝালাম- সে আমার শত্রু- শত্রুকে ভালবাসতে নেই। বিমাতার রূঢ় সাজ ধরে আমি তার নির্বাসন নিশ্চিত করেছিলাম। সে চলে আসার পর যেন আমি জীবন ফিরে পেলাম ; বিবেকের দংশন মুক্ত হয়ে বাঁচার নতুন স্বাদ যেন পেলাম। দুঃখ আড়ালে সরিয়ে সতীসাদ্ধী স্ত্রী হলাম; হতভাগ্য দাম্পত্যের ফসল হয়ে আমার একে একে সন্তানেরা এলো। অদৃষ্টের কী উৎকট বিদ্রুপ! কী ফল হল প্রেমের প্রতি সযতন অবহেলার? স্বয়ং স্বামী সহবাসে ট্রোজেনে এসে আমি আবার মুখোমুখি হলাম আমার নির্বাসিত শত্রুর। বুকের ভিতরের না শুকানো ঘা-টা আবার জেগে উঠলো। আর তো পারা যায় না, শিরায় শিরায় ভালবাসা লুকিয়ে রাখতে। প্রমত্ত ভেনাস এবার তার শিকার বেঁধেছেন কষে। আমি ভয়ে ভয়ে আমার পাপের দিকে তাকাই; আমি ঘৃণা করি আমার জীবনকে; আমার অনুরাগে আমার বিবমিষা জাগে। কামনার কালো শিখায় দিবালোক কলুষিত না করে, আমি মৃত্যু দিয়ে আমার সম্মান বাঁচাতে চেয়েছি। তোমার সঅশ্রু অনুনয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় আমি সবই বললাম। তাতে আমার অনুশোচনা নেই যদি আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত কারো কানে তিরষ্কারের বিষ ঢালতে না চাও, যদি নিভৃতে থাকা আগুন উষ্কে না দাও।
চতুর্থ দৃশ্য
(ফেইড্রা, ইনোন, পেনোপি)
পেনোপি
রানী মা, ভয়ানক দুঃসংবাদ- আমার সাধ্যে কুলালে এই সংবাদ আপনার কানে তুলতাম না- অথচ তা আমাকে বলতেই হবে- মৃত্যু কেড়ে নিয়েছে আপনার স্বামী আর আমাদের রাজার জীবন; মৃত্যু ছাড়া আর কোনো শত্রুকে যিনি ভয় করেননি। এই সংবাদ আর কারো জানা বাকি নেই।
ইনোন
তার মানে, পেনোপি, তুমি বলতে চাও ...
পেনোপি
হ্যাঁ, রাজা থিসিয়াসের প্রত্যাবর্তন কামনা করে রানী মা কে আর বৃথা প্রার্থনা করতে হবে না। বন্দরে আগত নাবিকদের কাছ থেকে হিপোলিটাস পিতার এই পরিণতির কথা জানতে পেরেছেন।
ফেইড্রা
ঈশ্বর!
পেনোপি
কে হবেন রাজা থিসিয়াসের উত্তরসূরী তা নিয়ে এথেন্সে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। সেখানে আপনার পুত্র যুবরাজ হিপোলিটাসের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা। প্রথার বিরুদ্ধে হলেও তার অনুসারীরা তাকেই সিংহাসনে দেখতে চায়। শোনা যাচ্ছে, এরিসিয়াকে সিংহাসনে বসাবার ষড়যন্ত্র করছে কেউ কেউ। আমার ধারণা ছিল, আপনি উভয় ষড়যন্ত্র সম্পর্কেই সচেতন। এদিকে শুনেছি হিপোলিটাসের জাহাজ প্রস্তুত। আমার ভয় হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি এথেন্সে গেলে, সেখানকার দোদুল্যমান জনগণ তার পক্ষই নেবে।
ইনোন
যথেষ্ট হয়েছে, রানী তোমার কথা শুনেছেন। তিনি নিশ্চয়ই এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে ভাববেন।
পঞ্চম দৃশ্য
(ফেইড্রা, ইনোন)
ইনোন
রানীমা, ভেবেছিলাম আপনার মৃত্যুপথযাত্রায় আর বাধ সাধবো না; আমার এত চেষ্টা ব্যর্থ হলে ভবেছিলাম আমিও আপনার সহযাত্রী হব। কিন্তু এই দুঃসংবাদে সব কিছু নতুন মোড় নিল। ভাগ্য দেবী আজ নতুন রূপে আবির্ভূত: রাজা থিসিয়াস এখন মৃত। তাই আপনাকেই নিতে হবে তার স্থান। তার রেখে যাওয়া একমাত্র পুত্র দাস বৈ তো নয়, যদি না সে আপনার প্রসারিত ডানায় আশ্রিত হয়। আপনি বেঁচে থাকলে সে রাজা। আপনি চলে গেলে কে মোছাবে তার অশ্রু জল? দয়া করে বলুন কে দেবে এই অনাথের বেদনার উপশম? তার নিষ্পাপ আর্তনাদ স্বর্গে প্রতিধ্বনিত হলে দেবতার রোষানলে পরতে হবে আপনাকেই। তাহলে ফিরে আসুন জীবনে। এখন তো আর আপনি কোনো দোষে দোষী নন। আপনার প্রেম এখন আর সব প্রেমেরই মতন স্বাভাবিক। থিসিয়াসের মৃত্যু আপনার প্রেমকে গ্লাণীমুক্ত করেছে। হিপোলিটাস এখন আর কোনো দ্বিধা-লজ্জার নাম নয়। এই প্রথম নিস্কলুষ দৃষ্টিতে তাকে দেখবেন আপনি। কিন্তু আপনাকে শত্রু ভেবে পাছে সে বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেয়, তার ভুল আপনাকেই ভাঙাতেই হবে। তাকে জয় করুন। আপনাকে এবং তাকে এক হতেই হবে, কারণ, এরিসিয়া উভয়েরই শত্রু।
ফেইড্রা
তবে তাই হোক। তোমার পরামর্শই হোক আমার পাথেয়। মৃত্যুপুরী থেকে প্রত্যাবর্তনের কোনো পথ যদি সত্যি থাকে, আমার মাতৃ চেতনার যদি অপমৃত্যু না হয়ে থাকে, তাহলে বাঁচতেই আমাকে হবে- সব ম্লানতা ঝেড়ে ফেলে আমাকে নতুন চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতেই হবে।
দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
(এরিসিয়া, ইসমিন)
এরিসিয়া
হিপোলিটাস আমার সাক্ষাৎ চান? এও কি সম্ভব? তিনি আমার কাছে বিদায় প্রার্থনা করছেন? তুমি কোন ভুল করছো না তো ইসমিন?
ইসমিন
একেবারেই নয়। এতে এও প্রমাণ হয় থিসিয়াসের মৃত্যুতে কতটা বদলে গেছে আপনার ভাগ্য। তার কারণে যে সম্মান থেকে আপনি বঞ্চিত ছিলেন আজ সবার কাছ থেকে সে সম্মান আপনি প্রত্যাশা করতেই পারেন। অবশেষে এরিসিয়া তার নিয়তির নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেন। সেই সময় আর দূরে নয় যখন সমগ্র গ্রীস তার পদাবনত হবে।
এরিসিয়া
তুমি বলছো এটা কোনো রটনা নয়? আমি তাহলে দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত? নিশ্চিত মৃত্যু হয়েছে নিষ্পেষকের?
ইসমিন
দেবতার দিব্যি, থিসিয়াস এখন যোগ দিয়েছেন পাতালবাসী আপনার ভাইদের সাথে।
এরিসিয়া
কিন্তু সে কোন দৈব তাকে নিয়ে গেছে এমন পরিণতির দিকে?
ইসমিন
অবিশ্বাস্য সব গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছে নতুন এক বণিতাকে অপহরণ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে তার সমুদ্রগ্রাস হয়েছে। অনেকে এমনও ভাবছে যে পিরিথৌসকে সঙ্গী করে সারি সারি অশরীরী আত্মার মাঝ দিয়ে ভ্রমণকালে তিনি বন্দী হন পাতালে যেখান থেকে কেউ কখনো ফেরে না। . . .
এরিসিয়া
এ-ও কি বিশ্বাস করা সম্ভব, জীবদ্দশায় কেউ মৃত্যু উপত্যকায় প্রবেশ করেছে? কোন মায়া তাকে টেনে নিয়ে গেল সেই বিভীষিকাময় রাজ্যে?
ইসমিন
সমগ্র গ্রীস শোক বিহ্বল। শুধু আপনিই সন্দিহান। থিসিয়াস মৃত। আর এই সংবাদ পৌঁছতে না পৌঁছতে ট্রোজেনবাসী সংহাসনে বসিয়েছে হিপোলিটাসকে। এদিকে সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন ফেইড্রা অকুলপাথারে।
এরিসিয়া
তোমার কি মনে হয় রাজা থিসিয়াসের তুলনায় হিপোলিটাস আমার প্রতি বেশি সদয় হবেন? তার দয়ায় আমার কি শৃঙ্খল ঘুচবে?
ইসমিন
আমার ঠিক তাই মনে হয়। ...
এরিসিয়া
মানুষটির শীতল স্বভাবের কথা তোমার জানা নেই? কী করে তুমি ভাবছো নারী বিদ্বেষী হয়েও তিনি আমার প্রতি সদয় হবেন, আমাকে সম্মান প্রদর্শন করবেন? আজ কতদিন তিনি আমাদের এড়িয়ে চলেন। শুধু সেখানেই তার পা পড়ে যেখানে আমরা যাই না।
ইসমিন
আমি জানি তিনি মিতাচারী হিসেবেই পরিচিত। তার কথিত গাম্ভির্যের প্রমাণ পেতে চেয়েছিলাম একবার। কিন্তু আড়াল থেকে আপনার মুখোমুখি যে হিপোলিটাসকে আমি দেখেছি তিনি এক ভিন্ন মানুষ। আপনার প্রথম দৃষ্টিপাতে রাঙা হয়ে তিনি থমকে গেলেন; আবেগ-অবরুদ্ধ চোখ সরিয়ে নিতে চাইলেন আপনার মুখ থেকে কিন্তু পারলেন না। প্রেম হয়তো তার কাছে অবজ্ঞার বিষয়, প্রেমের ভাষা হয়তো তার অজানা। কিন্তু তার চোখ দুটি প্রেমিকের।
এরিসিয়া
ইসমিন, তোমার কথা যে কতটা উদ্বেলিত করছে আমাকে! ভিত্তিহীন অথচ শ্রুতি মধুর। তমি তো জান দুর্মদ নিয়তির হাতে আমি এক অসহায় পুতুল। যুদ্ধের রোষ থেকে বেঁচে যাওয়া, চোখের জলের তিক্ততায় বেড়ে ওঠা এক রাজকন্যা আমি। ভালবাসার পাওয়া না পাওয়া আমাকে স্পর্শ করবে কেন? আমাদের দীর্ঘ বংশের ভবিষ্যত, মে মাসের ফুলের মত তাজা আমার ছয় ছয় জন ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে ধারালো তরবারীর ফলায়। ইরেকথিয়াসের উত্তরাধিকারীদের রক্ত পান করে ধরিত্রি লোহিত সিক্ত হয়েছে বারবার। তুমি তো জান, তাদের মৃত্যুর পর আমার প্রতি প্রেম নিবেদনে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে সকল গ্রীক নাগরিকের জন্য, পাছে আগামী প্রজন্মের মধ্য দিয়ে ভাতৃ-ভষ্মে নাড়া দেই আমি। এও তুমি জান কি ঘৃণায় আমি দিগি¦জয়ী সন্দিগ্ধ রাজার আজ্ঞা বহন করেছি। অবশ্য ঐ স্বৈরশাসকের প্রতি আমার কিছু কৃতজ্ঞতাও আছে। কারণ ভালবাসার চির শত্রু আমি; আমি যা সানন্দে পরিহার করি তাই তিনি নিষেধ করেছেন। কিন্তু তখনো আমি তার পুত্রের দর্শন পাইনি। তবে সুদর্শন অবয়বে মুগ্ধ হয়ে আমি তাকে ভালবাসিনি। প্রকৃতি যে বিশেষত্বে তাকে রূপায়ণ করেছে, যা নিয়ে তিনি উদাসিন বা অসচেতন, তার চেয়ে মহত্তর রূপে আমি তাকে দেখি। আমি ভালবাসি তার অনবনত অহঙ্কারী সত্ত্বাকে; থিসিয়াসের সদর দুয়ারের মত অরক্ষিত হৃদয়ের অতি কথিত প্রেম সংলাপে ফেইড্রার যৌবন কতটা আলোড়িত হয়েছিল জানি না; আমি ভালবাসি প্রস্তর কঠিন হৃদয়কে নাড়া দিতে, যে ব্যথা সে কোনোদিন জানেনি সে ব্যাথায় তাকে ব্যথিত করতে। মধুময় শৃঙ্খলে যে হতচকিত হয় তাকে শৃঙ্খলিত করায় যে আনন্দ-উত্তেজনা তা আমি হিপোলিটাসের মধ্যে পাই। হারকিউলিসের চেয়ে হিপোলিটাস বেশি দুর্জ্ঞেয়। কিন্তু, ইসমিন, আমি এসব কী বললাম! যার অহঙ্কারের স্তু‘তিতে আমি মুখর হলাম সেই যে আমার ভবিষ্যত বেদনাবিধুর করে তুলতে পারে। হিপোলিটাস কি ভালবাসতে পারে কখনো? ভাগ্যচক্রের কোনো মঙ্গল আবর্তনে এও কি সম্ভব?
ইসমিন
সে আপনি এক্ষুণি জানবেন। ঐ যে তিনি আসছেন।
দ্বিতীয় দৃশ্য
(হিপোলিটাস, এরিসিয়া, ইসমিন)
হিপোলিটাস
সম্মানীয় এরিসিয়া, এথেন্সের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বার আগে আপনার ভাগ্য পরিবর্তন সম্পর্কে অবহিত করার লক্ষ্যেই আমার এই সাক্ষাৎ। আমার পিতা পরলোকগত। তার দীর্ঘ অজ্ঞাতবাস যে শঙ্কা জাগিয়েছিল, দুর্ভাগ্যবশত তা সত্য হল। কেবল মৃত্যুই পারে বীরগাঁথার রচয়িতা এমন কোন মানুষকে এত দিন আড়াল করে রাখতে। অবশেষে অমোঘ নিয়তির কাছে হার মেনে হারকিউলিসের উত্তরাধিকারী, সখা ও সহযোদ্ধার জীবনাবসান ঘটালেন দেবতারা। তার প্রতি আপনার ঘৃণা নিশ্চয় তার প্রাপ্য বীরত্বের স্বীকৃতিকে ছাড়িয়ে যায় না। সে যাই হোক, অনেক কষ্টের মাঝে এইটুকু স্বস্তি- যে চরম অমানবিক নিষেধাজ্ঞার অধীন ছিল আপনার জীবন, তা থেকে আপনাকে মুক্ত করছি। আপনার মন প্রাণ আপনার পছন্দের মানুষের কাছে সপে দেবার অধিকার ফিরিয়ে দিচ্ছি। যে ট্রোজেন ছিল আমার পিতামহের রাজত্ব, যে ট্রোজেন আমাকে তার সিংহাসন দিতে সর্বসম্মত সেই ট্রোজেনে আজ থেকে আপনি আমারই সমান মুক্ত।
এরিসিয়া
মহাত্মন, আপনার মহানুভবতায় আমি চমকিত। তবে, আমার দুর্দশায় এই সীমাহীন সহানুভূতি দানে আপনি যে আমায় আরো বেশি করে শৃঙ্খলিত করলেন তা হয়তো আপনি ভাবতেও পারেননি।
হিপোলিটাস
এথেন্সের পরবর্তী শাসক কে হবে তা নিয়ে চরম মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। আপনার আর আমার পাশপাশি রাণীর পুত্রের কথাও তুলছে কেউ কেউ।
এরিসিয়া
তারা আমার কথাও বলছে?
হিপেলিটাস
আমি জানি আমি ভীনদেশী নারীর গর্ভজাত বলে এথেন্সের আইন আমার বিপক্ষে। সেইসব বর্বর আইন আমি বদলে দিতাম শুধু ফেইড্রার সন্তান যদি হতো আমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আমি সংযত আছি কারণ, এথেন্সের আধিকার আমার চেয়েও বেশি আরেকজনের, সে আপনি। এথেন্সের সিংহাসন ও রাজদন্ড আজ আমি আপনার কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছি। কারণ এই মর্ত্যলোকের এক মহান সন্তানের কাছ থেকে এর উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন আপনার পিতৃপুরুষেরা। তাদের পালিত পুত্র এজিয়াস এক সময় রাজমুকুট অধিকার করেন। তারই সন্তান থিসিয়াস শত্রু নিধনের মাধ্যমে এথেন্স রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়ে এথেনীয়দের চিত্ত জয় করেন। বঞ্চিত হয় আপনার সহোদরেরা। বংশগত কলহে এথেন্সের মৃত্তিকাজাত আপনার কত সজনের রক্তে কতবার স্নাত হয়েছে এথেন্সেরই মাটি। আজ এতকাল পর এথেন্স আপনাকে ফিরে চায় তার নিজ সীমানায়। তাহলে ট্রোজেন আমার। ফেইড্রার সন্তানের সমৃদ্ধ ভবিষ্যত ক্রীট রাজ্যে। আর এথেন্স আপনার। আপনার অধিকার নিশ্চিত করতে হলে এক হতে হবে আপনার ও আমার অনুসারীদের। সেই লক্ষ্যেই আমাকে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে।
এরিসিয়া
আপনার কথা বাস্তব না স্বপ্ন তাড়িত সৃতি-বিভ্রম আমি জানি না। আমি কি জাগ্রত? কোন্ দেবতার প্রেরণায় আপনি এমন পরিকল্পনার করেছেন? আপনার সুখ্যাতি কি ভীষণ অভ্রান্ত! নিজ স্বার্থের কথা না ভেবে আপনি আমার আধিকার সংরক্ষণে উদ্যোগী- এ যে নিজের সুনামকেও ছাড়িয়ে যাওয়া! আপনি এতটা মহানুভব যে পরম্পরাগত ঘৃণার সূত্র ছেড়ে আমার ঘরে আমার কাছে এলেন-
হিপোলিটাস
আপনাকে ঘৃণা করবো, রাজকুমারী? অন্তত আমি নই। আমাকে রুক্ষ আর অহংকারী ভাবে মানুষ। কিন্তু ভাববেন না কোন রাক্ষসীর গর্ভে আমার জন্ম। তাছাড়া ঘৃণাভরা এমন বন্যও কি আছে, আপনার মুখ দর্শনে যার মন গলে না? আমিই কি পেরেছি আপনার মায়াভরা মুখশ্রীর মায়াজাল এড়াতে?
এরিসিয়া
আপনি, আপনি এসব কি বলছেন, প্রভু?
হিপোলিটাস
হ্যাঁ ঝোঁকের বশে আমি হয়তো অনেক বেশি বলে ফেলেছি। মনে হচ্ছে বাস্তববোধ আমার আবেগের লাগাম হারিয়েছে। কিন্তু আমাকে বলতেই হবে। কারণ বহু দিন অবদমিত থাকা একটি অনুভূতি প্রকাশ করে আজ আমি ভারমুক্ত হতে চাই। আজ ভাবতে আমার হৃদপিণ্ড কুঁচকে যায় কি করে এতকাল আমি ভালবাসার সাথে শত্রুতা করেছি, কি করে ভালবাসার বন্ধন আর সেই বন্ধনে মায়ামুগ্ধ মানুষদের আমি তাচ্ছিল্য করেছি। যে আমি একদা প্রতিজ্ঞা করেছি প্রেম সরোবরের ঠিক মাঝখানে তুফানে পড়া মানুষদের তীরে বসে করুণা করবো, সেই আমি আমার সব অহংকার হারিয়ে, অতি সাধারণ মানুষের মত, আবেগের রুদ্র বাণের মুখোমুখি। অসহায়ের মত শুধু দেখলাম মুহূূর্তে আমার কঠিন রক্ষা প্রাচীর ধ্বসে পড়লো; আমার উদ্ধত সত্ত্বা আবেগ শৃঙ্খলে বাঁধা পড়লো। ভালবাসার বিদীর্ণ তীর বুকে বয়ে লজ্জায় হতাশায় আজ ছয় মাস আমি ঘুরে বেড়াই। নিজের সাথে কত লড়াই করে আপনাকে এড়িয়ে চলি-তবু আমার ছায়ার মত আপনি থাকেন সাথে সাথে, সর্বত্র। গভীর অরণ্যেও আপনার চিত্র প্রতিমা আমার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রাখে। কি রবিকরোজ্জল দিবসে, কি ছায়াময় রাত্রি নিশীথে সব সময়ে সব কিছুই আপনার মায়াময় রূপ স্মরণ করিয়ে দেয়; আর আমার বিদ্রোহী হৃদয়কে বলে আপনার অর্ঘ্য হতে। তাহলে কি ফল নিজের সাথে এত লড়ইয়ে? আমি আর আগের মত নেই। আমি পুরানো আমাকে কত খুঁজি, কিন্তু পাই না। তীর-ধনুক, বর্ষা, রথ- কোন কিছতেই আর মন নেই। সমুদ্র দেবতা নেপচুনের দীক্ষা বিস্মৃত হয়েছি আমি। আমার অশ্বদল ভুলতে বসেছে তাদের পরিচিত কন্ঠস্বর। আমার অনুযোগ প্রতিধ্বনি তোলে বনে বনে। আপনি অজান্তেই যে অনুরাগে অনুরক্ত করেছেন আমায়, তার এমন অমার্জিত প্রকাশে আপনি নিশ্চয় বিব্রত। ভালবাসার কি রুক্ষ প্রকাশই না আমি করছি। ... শুধু জানবেন, আজ যে ভাষায় আমি কথা বলছি তা আমার নিজের কাছেই অপরিচিত; আপনার অবজ্ঞার কারণ হলেও জানবেন আপনি না হলে এ ভাষাও আমার কখনো শেখা হতো না।
তৃতীয় দৃশ্য
(হিপোলিটাস, এরিসিয়া, থেরামেনেস, ইসমিন)
থেরামেনেস
প্রভু, ওরা বলছে রানী এই দিকেই আসছেন এবং তিনি আপনাকেই চান।
হিপোলিটাস
আমাকে?
থেরামেনেস
জানি না কেন, তবে ফেইড্রা আগেই সংবাদ পাঠিয়েছেন যে আপনি যাবার আগে তিনি আবশ্যই আপনার সাথে কথা বলতে চান।
হিপোলিটাস
আমি? কথা বলবো ফেইড্রার সাথে? কি বিষয়েই বা আমাদের কথা হওয়া সম্ভব?
এরিসিয়া
প্রভু, আপনি তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। আপনার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন রানী আজ স্বামীহারা, অত্রুসজল- আপনার করুণার প্রয়োজন তার হতেই পারে।
হিপোলিটাস
কিন্তু এখন আপনারা আমায় বিদায় দিন। যার পূজারী আমি, আমার হৃদয় যার কাছে রেখে যাচ্ছি, তার কাছে আমার ভাগ্য লিখন জানবার আগেই আমাকে পাল তুলতে হবে।
এরিসিয়া
তাই যান, যুবরাজ, আপনার মহানুভব পরিকল্পনার অনুসরণে যাত্রা করুন। এথেন্সে আমার রাজকীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুন। আপনার ঔদার্য আমায় যে গৌরবোজ্জল এথেন্স সাম্রাজ্য উপহার দিল তা আমি সানন্দে গ্রহণ করলাম। তবে এই এথেন্সও আপনার কাছে থেকে আমার সেরা প্রাপ্য নয়।
চতুর্থ দৃশ্য
(হিপোলিটাস, থেরামেনেস)
হিপোলিটাস
আমরা কি তাহলে প্রস্তুত? কিন্তু একি, ঐ যে শুনুন রানী এদিকেই আসছেন। যান, গিয়ে জাহাজ প্রস্তুত করুন। আমাদের এক্ষুণি উঠে পড়তে হবে। তাড়াতাড়ি করুন, হুকুম দিয়েই ফিরে এসে আমাকে রানীর সাথে সাক্ষাতের অস্বস্তি থেকে রক্ষা করুন।
পঞ্চম দৃশ্য
(ফেইড্রা, হিপোলিটাস, ইনোন)
ফেইড্রা
(মঞ্চের পিছনে ইনোনকে) এই তো সে! আমার হৃদপিন্ডে রক্তের জোয়ার আসে; আমার শরীর অবশ হয়ে আসে। কি যেন বলবো তাকে, স্মৃতি যে অক্ষম হল।
ইনোন
শুধু ভাবুন আপনার পুত্রের কথা- তার সব আশা আপনার উপর নিহিত।
ফেইড্রা
প্রভু, সবাই বলছে আপনি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন। আপনি যাবার আগে আমি এসেছি আপনার শোক আর আমার অশ্রুধারাকে এক সাথে মিলাতে। তাছাড়া একজন মাতার উৎকন্ঠার কথাও আমি বলতে এসেছি। আমার একমাত্র পুত্র এখন পিতৃহারা। সেই দিনও বেশি দূরে নয় যখন সে জানবে মৃত্যুর পালায় তার মাও চলে গেছে। অযুত শত্রু এখনই তার সব আশার শেষ দেখতে চায়। আপনিই কেবল তাকে রক্ষা করতে পারেন। যদিও আমার অপরাধবোধ আমাকে শঙ্কিত করে যে তার সাহায্যের আর্তি আপনার মর্ম স্পর্শ করবে না। এই ভেবে আমি সন্ত্রস্ত হই, না জানি আমার দোষে আপনার ক্রোধের শিকার হয় আমার সন্তান।
হিপোলিটাস
এমন নিচ চিন্তা আমার প্রশ্রয় পেতে পারে না।
ফেইড্রা
আপনি আমায় ঘৃণা করলে আমার কিছু বলবার নেই, প্রভু। আপনি দেখেছেন আপনাকে আঘাত দিতে আমি তৎপর। কিন্তু আমার মনে কি ছিল আপনি তা দেখেন নি। আমি আপনার সাথে শত্রুতা করেছি, একই স্থানে বসবাস করতে অস্বীকার করেছি। অপবাদ দিয়ে দীপান্তর না করেও আমার শান্তি ছিল না। এত দূর গিয়েছিলাম যে, আমার সামনে আপনার নাম উচ্চারণও নিষিদ্ধ ছিল।
হিপোলিটাস
এ তো অতি পরিচিত বিষয় যে নিজ সন্তানের অধিকার নিয়ে দুর্ভাবনায় সৎ সন্তানকে মানুষ ঘৃণা করে। এ ও জানি যে দ্বিতীয় স্ত্রীর শয্যায় উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার বসবাস। আপনার জায়গায় অন্য কোনো নারীও আমার অশুভ কামনা করতো বা আমার প্রতি আরো বেশি কঠিন হতো।
ফেইড্রা
হায় যুবরাজ! আমি সেই দেবতাদের দোহাই দিয়ে বলছি যে দেবতারা আমায় সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম করে গড়েছেন। কী ভিন্ন ধারায় যে আমায় তারা গড়েছেন!
হিপোলিটাস
এখনো ভেঙে পড়বার সময় আসেনি। আপনার স্বামী হয়তো আবারও সূর্যালোকে ফিরে আসবেন। আমাদের প্রার্থনায় দেবতারা হয়তো স্বদেশ অভিমুখে তার জাহাজের পথ নির্দেশ দেবেন। তার অনুনয়ে সমুদ্রদেব নেপচুন হয়তো তাকে রক্ষা করবেন।
ফেইড্রা
মৃত্যুপুরীতে কেউ দুইবার যায় না। এবং যেহেতু তিনি একবার সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পল্লী দর্শন করেছেন, কোন দেবতাই তাকে ফিরিয়ে আনবেন না। লোভী এ্যকিরনও শিকার হাতছাড়া করেন না। কিন্তু না! তার মৃত্যু হয়নি; আপনার মাঝেই তিনি বেঁচে আছেন। আমি এখনো আমার স্বামীকে দেখতে পাই। আমি তাকে দেখছি, তার সাথে কথা বলছি ... হা প্রভু, এমন এক আবেগে আমি উতলা যে তাকে সম্বরণ করা অসাধ্য।
হিপোলিটাস
আপনার ভালবাসায় কী এক বিস্ময়কর শক্তি নিহিত যে মৃত থিসিয়াস আপনার চোখে উদ্ভাসিত হন! তার প্রতি আপনার ভালবাসার আগুন যে এখনো অনির্বাণ!
ফেইড্রা
হ্যাঁ, যুবরাজ, তার প্রতি অভুক্ত বাসনায় আমার এই দেহদহন। যদিও পরিচিত জগতের অন্তরালে তিনি হাজার কুমারীর চপল পূজারী, তার লালসা পাতাল রানীর দেহ অবধি বিস্তৃত, কিন্তু দেবতাদের আমরা যেমন অহঙ্কারী, সজীব, মনোমুগ্ধকর, অপ্রতিরোধ্য অথচ লজ্জার রঙে চিত্রিত করি অথবা যে রূপে আমি আপনাকে দেখি- থিসিয়াসও ছিলেন তেমনই। দৃষ্টিতে, কণ্ঠস্বরে, পৌরুষদীপ্তিতে তিনি ছিলেন আপনারই মত। ঢেউয়ের কিরিটে চড়ে ক্রিটে এসে তিনি যখন মিনোস কুমারীদের হৃদয় কাঁপিয়ে দিলেন, তখন তার মুখম-লে মাখা ছিল আপনার মুখের এই সম্ভ্রান্ত সলাজ আভা। আপনি তখন কোথায় ছিলেন? গ্রীসের বাগান থেকে হিপোলিটাস নামের কোন ফুল তিনি কেন নিয়ে যাননি আমাদের জন্য? মিনোসের দেশে যে বীর দল তার সঙ্গী হয়েছিল, সেই দলে যোগ দেবার মত যুবক কেন হয়ে উঠেননি আপনি? অনেক দুর্গম পথের শেষে দৈত্যের ঘরে হানা দিয়ে আপনিই বিনাশ করতেন ক্রিটীয় দানোদের। সেই অমানিশার প্রান্ত থেকে তুলে আনতে আমার সহোদরা হয়তো আপনাকে অস্ত্র হিসেবে উপহার দিতে চাইতো সুতার মোচা। কিন্তু ভালবাসার প্রেরণায় তার আগে আমিই এই পরিকল্পনা নিতাম। যুবরাজ আমার, আমিই আপনাকে গোলক ধাঁধাঁ থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলে দিতাম। আপনাকে রক্ষা করতে কি-ই-না আমি করতাম! সেই দানোর চোরাগলি দিয়ে আমি নিজে আপনাকে নিয়ে যেতাম; বিজয়ীর বেশে ফিরে আসতাম দু’জন পাশপাশি; না হয় আপনার সাথে আমিও মরতাম।
হিপোলিটাস
হায় দেবগণ! আপনি কি বলছেন? আপনি কি ভুলে গেছেন যে থিসিয়াস আপনার স্বামী আর আমার পিতা?
ফেইড্রা
আপনি ভাবছেন আমি ভুলে গেছি এসব? ভাবছেন আমার সুনামের প্রতি আমি অবিচার করছি?
হিপোলিটাস
ক্ষমা করবেন রানী। আপনার কথার নিষ্পাপ সূত্র ধরতে পারিনি বলে আমি লজ্জিত। আসলে আপনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি বিব্রত বোধ করছি। আমাকে যেতে দিন।
ফেইড্রা
তবে শুনুন পাষাণ যুবরাজ! আপনি ভুল করেননি। বরং ঠিকই বুঝেছেন। কারণ, আমার কথায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তাই আপনার প্রেমে উন্মাদ ফেইড্রার স্বরূপ অবলোকন করুন। ভাববেন না একে নিষ্পাপ বলে মনে করেই আমি তুষ্ট। এও নয় যে নিতান্ত চিত্তের দুর্বলতাহেতু ভালবাসার মদিরায় আমি বেহুশ হয়েছি। আমি দেবতার অভিশাপের শিকার। আপনি আমাকে যতটা ঘৃণা করে থাকবেন, আমি নিজেকে তার চেয়ে বেশি করি। যে লেলিহান শিখায় ছাই হয়েছে আমার সারা বংশ, কী কারণে সেই শিখা আমার বুকেও জ্বাললেন তা দেবতারাই ভাল জানেন। অসহায় রমনীদের পথভ্রষ্ট করে দেবতারা অপার আনন্দ লাভ করেন। আপনি নিশ্চয় ভুলে জাননি, কীভাবে আমি আপনাকে এথেন্স ছাড়া করেছিলাম? আমি চেয়েছিলাম আপানার দৃষ্টিতে নিজেকে কদর্য করে তুলতে। নিজের প্রেমকে পরাহত করতে আমি আপনার মনে আমার প্রতি ঘৃণা জাগ্রত করতে চেয়েছি। কিন্তু এত কষ্টের কী ফল হয়েছে? আমার প্রতি আপনার ঘৃণা বেড়েছে, আপনার প্রতি আমার ভালবাসা কমেনি। বরং আপনার যন্ত্রণায় আমার প্রেম তীব্রতর হয়েছে আর আমি ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছি। শুধু একবার আমার চোখের দিকে তাকালে আপনি আমাকে বিশ্বাস করতেন। আপনার কি মনে হয় নিতান্ত অকারণে এমন লজ্জার কাহিনী আপনাকে শোনাতে এসেছি? একমাত্র পুত্রের ভবিষ্যত রক্ষায় ব্যর্থ হতে চাই না আমি। আপনি যেন আমার পুত্রকে ঘৃণা না করেন এই আর্জি নিয়ে আপনার কাছে আমি এসেছি। তুচ্ছ সে হৃদয়, ভালবাসা যাকে গ্রাস করে। হায়! আমি যে শুধু আপনার কথাই বললাম। প্রতিশোধ নিন; আমার জঘন্য বাসনাকে শাস্তি দিন। আসুন, পিতার বীরত্বের অনুসরণে পৃথিবী থেকে আরেকটি দানব উৎখাত করুন। কি করে থিসিয়াসের বিধবা স্ত্রী তার পুত্রকে ভালবাসে? এমন ঘৃণ্য রাক্ষুসীকে বাঁচতে দেয়া যায় না। এইতো এখানে আমার হৃদপি-। ঠিক এখানে আমাকে বিদ্ধ করুন। নষ্ট লালসার অবসানে আমার হৃদপি- আপনার প্রতিশোধের জন্য উন্মুখ। আঘাত করুন। আর আপনার অবজ্ঞা যদি এমন সুপ্রিয় আঘাতের অযোগ্য জ্ঞান করে আমাকে, যদি আমার ঘৃণ্য রক্তে আপনার হাত রাঙাতে না চান, দিন, আমার হাতেই তুলে দিন আপনার ধারালো তরবারী!
ইনোন
ঈশ্বর! একি করছেন রানী? কেউ এদিকে আসছে। এই অবস্থায় অবশ্যই আপনি ধরা পড়তে পারেন না। চলুন, তাড়াতাড়ি করুন, দেরি হলে লজ্জার অন্ত থাকবে না।
ষষ্ঠ দৃশ্য
(হিপোলিটাস, থেরামেনেস)
থেরামেনেস
আমি কি ফেইড্রাকে মিলিয়ে যেতে দেখলাম; কেউ তাকে টেনে নিয়ে গেল? আপনাকেই বা এমন ফিকে আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন? রাজন, আপনার তরবারী? আপনি এমন হতবাক হয়ে আছেন কেন?
হিপোলিটাস
থেরামেনেস, এক প্রচ- ধাক্কায় অমি বেসামাল হয়ে গেছি। চলুন তাড়াতাড়ি। নিজেকে কেমন অসুচি মনে হচ্ছে। ফেইড্রা... কিন্তু না, হায় মহান দেবতাগণ! এই কথা কাউকে বলা যাবে না, একে মাটি চাপা দিতে হবে, ভুলে যেতে হবে।
থেরামেনেস
আপনি যদি রওয়ানা হতে চান, জাহাজ প্রস্তুত। কিন্তু ইতোমধ্যেই এথেন্স তার পছন্দের মানুষের নাম ঘোষণা করেছে। সকল গোত্রের মানুষ এক হয়েছেন; তাদের নেতৃবৃন্দ আপনার ভ্রাতার নাম উল্লেখ করেছেন। ফেইড্রা তার অভিষ্ট অর্জন করেছেন।
হিপোলিটাস
ফেইড্রা?
থেরামেনেস
একজন দূত এসে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণভার অর্পণ করে গেছেন তার হাতে। তার পুত্র এখন এথেন্সের রাজা।
হিপোলিটাস
দেবতাগণ, আপনাদের তো অজানা নয় ফেইড্রার রূপ। একি তবে তার সততার পুরস্কার?
থেরামেনেস
এদিকে গুজব উঠেছে যে রাজা থিসিয়াসের মৃত্যু হয়নি এবং এপিরাসে তাকে দেখা গেছে। কিন্তু সে দেশ তল্লাশ করে আমি ভাল করেই জানি ...
হিপোলিটাস
অগ্রাহ্য না করে সব সূত্রকেই গুরুত্ব দেয়া উচিত। এবং এই সর্বশেষ তথ্যটিও আমরা খতিয়ে দেখবো। এটা যদি ভিত্তিহীন প্রমাণীত হয় তাহলে আমরা জাহাজে উঠবো এবং যে কোন মূল্যে মহান এথেন্স সাম্রাজ্যের রাজমুকুট ছিনিয়ে নিয়ে দেব তার মাথায়, যে দেশ শাসনের যোগ্য।
তৃতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
(ফেইড্রা, ইনোন)
ফেইড্রা
চুলোয় যাক সম্মান; রাজমুকুট গিয়ে উঠুক অন্য কারো শিরে। কেন এত বাড়াবাড়ি? এই অবস্থায় আমি কী করে দেখা দেই? তুমি কি ভাব তোমার মিথ্যে প্রবোধে আমার যন্ত্রণা প্রশমিত হবে? আমাকে বরং আড়াল দিয়ে রাখ। বড় বেশি বলে ফেলেছি আমি। উন্মত্ত প্রেম উথলে পড়েছে আমার শরীর ও মুখের ভাষায়। যে কথা কোনোদিন উচ্চারিত হবার নয় সে কথাই যে বলা হয়ে গেল। অসহায়ের মত ছটফট করতে করতে সে আমার সব কথা শুনেছে। অথচ দেখ কী পাষাণ- সে আমার কথা না বোঝার ভাণ করলো! কি মরিয়া হয়েইনা সে বারবার পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। তার সলাজ অবয়বে কি লজ্জাই না জেগেছে আমার মনে! তুমি কেন এসে দাঁড়ালে মৃত্যু আর আমার মাঝে? আচ্ছা, তার তরবারীর ফলা আমার বুকের খুব কাছে এসে পড়তেই তার মুখ কি রঙ হারিয়ে ছিল আতঙ্কে? সে কি ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয়েছিল তার তরবারী? না। তা নয়। কারণ আমার স্পর্শে তা মলিন হয়ে যেতে দেখেছে সে। পঙ্কিল সেই অস্ত্রের স্পর্শে অপবিত্র হতে পারে না তার হাত।
ইনোন
দুঃখের কারণ রোমন্থনে দুঃখের দহন কেবল বাড়েই। তাকে নির্বাপিত করাই শ্রেয়। কোনো মহৎ ভাবনায় শান্তি অন্বেষণ করাই কি রাজা মিনোসের কন্যার পক্ষে শোভন নয়? অকৃতজ্ঞের প্রতি অনর্থক প্রেম নিবেদনের চেয়ে রাজ্যভার গ্রহণ করে দেশ শাসনে মনোনিবেশ করাই কি আপনার দায়িত্ব নয়?
ফেইড্রা
দেশ শাসন করবো আমি? যুক্তি যখন আমার চৈতন্যের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, লজ্জাভারে আমার যখন শ্বাস রোধ হয়ে আসে, আমি যখন মরতে বসেছি তখন তুমি আমায় দাও দেশ শাসনের ভার?
ইনোন
তার কাছ থেকে পলায়ন করুন।
ফেইড্রা
কী করে সম্ভব? কী করে?
ইনোন
একদিন যাকে নির্বাসন দিয়েছেন তাকে আজ পরিত্যাগ করা যায় না?
ফেইড্রা
অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে তো জানে কি উন্মত্ত দহনে আমি দাহ্য। সম্ভ্র্রমের সীমা ছাড়িয়েছি আমি। আমাকে যে জয় করেছে সে শুনেছে আমার নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি। প্রত্যাশারা লতিয়ে উঠেছিল আমার বক্ষদেশে। এই তুমি, মরণের ছায়া যখন আমার জীবন স্পর্শ করে প্রায়, ক্ষীণ শ্বাস যখন উঠে এসেছে আমার অধর প্রান্তে, আমাকে মোহনীয় মিথ্যার মায়ায় ফিরিয়ে আনলে জীবনে। তুমি বলেছ আমার প্রেম তখন পাপমুক্ত।
ইনোন
আপনাকে বাঁচাতে কিইনা আমি করতাম? কিন্তু, মান-অপমান বোধ যদি থেকে থাকে, কি করে তার অসহনীয় অবজ্ঞা আপনি সইবেন? কি কঠিন শীতলতায় সে তাকিয়ে দেখলো আপনি তার পায়ের কাছে আনত হয়েছেন! তার মাঝে যে রূঢ় মানুষটিকে আমি দেখলাম, ফেইড্রা কেন তাকে দেখেনি?
ফেইড্রা
এমনও তো হতে পারে, তার যে রুক্ষতা তুমি সইতে পারো না, তা প্রশমিত হয়েছে এতক্ষণে। অরণ্যে বেড়ে উঠা এবং তারুণ্য থেকে কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া মানুষটির কানে হয়তো ভালবাসার কোমল স্বর প্রবেশ করেনি আজো। সন্দেহ থাকে না সে ভাষা হারিয়েছিল বিস্ময়ে। বন্য বলে তাকে শুধু অপবাদই দেয়া হয়।
ইনোন
ভুলে যাবেন না সে এক আমাজোনীয় নারীর গর্ভজাত।
ফেইড্রা
সে কথা সত্যি হলেও তিনি আর সব স্ত্রীদের মত ভালবাসতে শিখেছিলেন তার স্বামীকে।
ইনোন
নারী জাতির প্রতি তার রয়েছে এক আদিম ঘৃণা।
ফেইড্রা
তবে তো আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর শঙ্কা থাকে না। অনেক হয়েছে। তোমার পরামর্শ এখন কাম্য নয়। লক্ষ্মী ইনোন, হিসেবের নয়, আমার আবেগের দাস হও। খুঁজে বের করো তার সুরক্ষিত হৃদয়ের দুর্বল কোনো দ্বার। মনে হয় তখন তিনি সাম্রাজ্য শাসনের দুর্ভাবনাগ্রস্থ ছিলেন। তিনি যে এথেন্সের অধিকারী হতে চান তা আড়াল থাকেনি। তার জাহাজের গোলুই তখন এথেন্সের দিকেই ফেরানো। তাহলে যাও আমার হয়ে খুঁজে নাও সেই উচ্চাভিলাষী যুবাকে। এথেন্সের রাজমুকুট তার চোখের সামনে খেলনার মত করে দোলাও। এই পবিত্র তাজ হোক হিপোলিটাসের। যে ক্ষমতার ভার আমি বইতে পারবো না তা হিপোলিটাসের উপর অর্পণ করার সম্মানটুকুই শুধু আমি পেতে পারি। পিতার ভূমিকায় সে আমার সন্তানকে রাজ দীক্ষায় দীক্ষিত করবে। মাতা-পুত্র দু’জন আমরা তার কাছেই জীবন সমর্পণ করলাম। যাও ইনোন, যে কৌশলে পার তাকে রাজি করাও। আমার চেয়ে বরং তোমার কথাই তাকে তুষ্ট করবে। দীর্ঘশ্বাসে, আর্তীতে, বাগ্মীতায় তাকে কাবু কর; বল আমি মৃত্যুপথযাত্রী। কান্নায় অনুনয়ে তাকে বশ কর। যা চাও তাই পাবে। যাও। তোমার প্রত্যাবর্তনে আমার ভবিষ্যত বয়ে আন।
দ্বিতীয় দৃশ্য
(ফেইড্রা)
ফেইড্রা
অশাস্ত ভেনাস, আমার এত অধপতনেও কি তোমার প্রতিশোধ স্পৃহা পরিতৃপ্ত নয়? তোমার তীর লক্ষ্য ভেদ করেছে। বিজয়ের পরেও কেন বিজিতের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা? তোমার নিষ্করুুণ আঘাত যদি বিরাম না জানে তবে আঘাত করো তাকে, যে তোমার ঘোর শত্রু। অবজ্ঞায় অহঙ্কারে কোনোদিন সে তোমার মন্দিরে অবনত হয়নি। তোমার নাম তার অহঙ্কারী শ্রবনে উষ্মা জাগায়। প্রতিশোধ নাও দেবী। তোমার আমার লক্ষ্য আজ অভিন্ন। প্রেমাহত কর তাকে ... ইনোন! তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে? তবে তো সে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করেছে আমাকে।
তৃতীয় দৃশ্য
(ফেইড্রা, ইনোন)
ইনোন
রানী, আপনার এই হতভাগ্য প্রেম সম্বরণ করুন। একদা যে সততায় আপনি প্রতিশ্রুত ছিলেন সেই অবস্থানে আপনাকে ফিরে যেতে হবে। যাকে সকলে মৃত বলে ধরে নিয়েছিল সেই রাজা কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে এসে দাঁড়াবেন। থিসিয়াসের জাহাজ ঘাটে ভিড়েছে। থিসিয়াস ক্রমশ এগিয়ে আসছেন এদিকে। তাকে দেখতে উৎফুল্ল জনতা ভীড় করেছে। হিপোলিটাসের সন্ধানে বেরুতেই আমার কানে ভেসে এল কোলাহল...
ফেইড্রা
আমি বুঝতে পেরেছি ইনোন, আমার স্বামী বেঁচে আছেন। যে প্রেম আমি প্রকাশ করেছি তা ঘৃণা জাগাবে তার মনে। তিনি বেঁচে আছেন। আমি তার সাথে প্রতারণা করেছি। না থামো, আর কোনো কথা বলো না।
ইনোন
তার মানে?
ফেইড্রা
আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে আমার পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছ; অশ্রুজলে তুমি ধুয়ে দিয়েছ আমার অনুতাপ। আজ সকালেই আমি মরতে পারতাম। সে মৃত্যু হতো একজন সতীর মৃত্যু, যে মৃত্যু মানুষকে শোকাহত করতো। কিন্তু তোমার অনুনয়ে ফিরে এসে নতুন যে মৃত্যুর দিকে আমি ধাবিত সে মৃত্যু পতিতের; কুৎসা ছড়াবে সে মৃত্যু।
ইনোন
আপনি মরবেন?
ফেইড্রা
হায় ন্যায়ের প্রতিভু দেবতাগণ! একি আমি করেছি! আমার স্বামী ফিরে আসছেন। সাথে থাকবে তার পুত্র। কী মুখ নিয়ে আমি তার পিতাকে স্বাগত জানাব? প্রত্যাখ্যানের দীর্ঘশ্বাসে আমার বুক যে এখনো ভারী হয়ে আছে। আমার চোখে লেগে আছে সেই অশ্রু, যে অশ্রু ব্যর্থ হয়েছে তার মন গলাতে। তোমার কি মনে হয় থিসিয়াসের সম্মানের কথা ভেবে সে আমার অন্যায় গোপন করবে? সে কি পিতা আর রাজা উভয়কেই প্রতারণা করবে? সে কি আমাকে ঘিরে তার বিবমিষার কথা গোপন করবে? সে নীরব থাকলেই বা কি। আমি তো জানি, ইনোন, আমি সেই সব নারীদের মত নই যারা অবলীলায় অপরাধ করে অথচ লজ্জার রঙ তাদের মুখে ধরে না। স্খলনের সব স্মৃতি যে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কেবলই মনে হচ্ছে এই প্রাসাদের সব দেয়াল মুখিয়ে আছে কখন তারা আমার বিশ্বস্ত সঙ্গীর কাছে ফাঁস করবে আমার অবিশ্বস্ততার কথা। মরে গেলেই কেবল আমি এই সব বিভীষিকার কাছ থেকে মুক্ত হবো। মৃত্যু কি খুব কষ্টের কিছু? না, বেদনাদগ্ধ মনে মৃত্যু ভয়ের স্থান নেই। আমার একমাত্র ভয় আমার রেখে যাওয়া কলঙ্কমাখা নাম। আমি কি উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছি আমার হতভাগ্য সন্তানদের জন্য! এদের প্রত্যেকের হৃদপিণ্ডে জোভের রক্ত। কিন্তু বংশ গৌরবের চেয়ে মাতৃ কলঙ্কের ভার অনেক বেশি। ভাবতেই আমার শরীর কুঁচকে উঠে- কোনোদিন হয়তো মায়ের আপরাধের জন্য তিরষ্কৃৃত হতে হবে তাদের; হয়তো আমার দুর্নামের ভারে তারা কেউ মাথা তুলে দাঁড়াবে না কোনোদিন।
ইনোন
আপনার উদ্বেগ যদি সত্য হয়ে থাকে, কেন তাদের এমন অপমানের মুখে নিক্ষেপ করা? কেন তবে নিজের বিরুদ্ধে নিজেই সাক্ষ প্রদান? আপনি না হয় মরবেন। সবাই বলবে পতি প্রতারক ফেইড্রা পালিয়েছে। হিপোলিটাস এই ভেবে উল্লাসিত হবে যে আত্মহননের মধ্য দিয়ে আপনি নিজেই তার অভিযোগ প্রমাণ করে গেলেন। এর কি জবাব আমি দেব? আমার কথা উড়িয়ে দিতে তার কোনো অসুবিধাই হবে না। আমি শুধু দেখবো সে উৎকট উল্লাসে মত্ত; শুনবো সবার কানে কানে সে আপনার কুৎসা ঢালছে। তার আগেই যেন দেবতাদের আগুন আমাকে গ্রাস করে। কিন্তু এখন আপনি মন খুলে বলুন- সে কি এখনো আপনার কাছে প্রিয়? এই অহঙ্কারী যুবরাজের মাঝে আপনি কী খুঁজে পান?
ফেইড্রা
তার মাঝে আমি দেখতে পাই একজন দানোকে, যার ভয়ে আমি ভীত।
ইনোন
তাহলে কেন তাকে জয়ী হতে দেয়া, যখন সব কিছু উল্টে দেবার সুযোগ আমাদের হাতের মুঠোয়? আপনার ভয়ের কারণ। যে অভিযোগে আজ সে আপনাকে অভিযুক্ত করতে যাচ্ছে, তার আগে সাহস করে আপনিই বরং সেই অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করুন। আপনার বিরুদ্ধে কী এমন প্রমাণ আছে? বরং সব কিছু তার দোষই ইঙ্গিত করবে- তার ফেলে যাওয়া তরবারী, তার প্রতি আপনার অতীত অবিশ্বাস, আপনার বর্তমান মানসিক অবস্থা, তার সম্পর্কে আপনার পুনঃসাবধান বাণীর দরুন তার নির্বাসন- এ সব কিছুই তার বিপক্ষে যাবে।
ফেইড্রা
একজন নিষ্পাপ মানুষের বিরুদ্ধে পাপের অভিযোগ করবো, আমি?
ইনোন
আমার উপর আস্থা রাখুন। আপনি শুধু অবিচল থাকুন। আপনার মত আমিও অনুতপ্ত। সহস্র মৃত্যুর শিকার হবো আমি আরো আগে। কিন্তু এই দুর্ভাগ্যজনক পন্থা ছাড়া আপনার রক্ষা নেই। আর আপনার জন্যই আমার জীবন। আমি থিসিয়াসের সাথে কথা বলবো। আপন পুত্রকে নির্বাসনের চেয়ে বড় কোনো শান্তি তিনি দেবেন না, ঠিক আগে যেমন করেছেন। আপন সন্তানের শাস্তি অপরিহার্য হলেও পিতা পিতাই থাকেন। নিতান্ত নির্জুরী শাস্তি প্রদানেই তার ক্রোধ প্রশমিত হবে। তার চেয়ে বড় কথা, আপনার সম্মানের মূল্য নিষ্পাপের রক্তপাতের চেয়েও বেশি। সেই সম্মান এতই আহ্লার্দে, এতই অমূল্য যে তাকে ত্যাগ করার কোনো ঝুঁকিই নিতে নেই। আপনার সম্মান আজ হুমকির মুখে। একে বাঁচাতে সব কিছু, এমনকি সততারও বিসর্জন দিতে হয়। ঐ তো রাজা থিসিয়াস আসছেন!
ফেইড্রা
এবং তার সাথে হিপোলিটাস। তার শীতল দৃষ্টিতে আমার পতন দেখতে পাচ্ছি। তুমি যা ভাল মনে করবে তাই করবে, তোমার হাতেই আমার ভাগ্য সমর্পণ করলাম। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো।
চতুর্থ দৃশ্য
(থিসিয়াস, হিপোলিটাস, ফেইড্রা, ইনোন, থেরামেনেস)
থিসিয়াস
দীর্ঘ প্রতিক্ষার পালা শেষ হলো যখন ভাগ্য দেবী মুখ তুললেন। তাহলে এসো প্রিয়তমা, তোমার বাহুতে আমায় ...
ফেইড্রা
দাঁড়ান থিসিয়াস, আপনার ভাষায় যে ভালবাসার প্রকাশ তাকে অপবিত্র করবেন না। আপনার ভালবাসার যোগ্য আমি নই। আপনি প্রতারিত হয়েছেন। ভাগ্য বা নিয়তি আপনার অনুপস্থিতিকালে আপনার সঙ্গিনীর সুরক্ষা দেয়নি। আপনার উপভোগের, এমন কি আপনার পাশে বসবাসের অযোগ্য আমি। তাই এখন থেকে নিজেকে লুকানোই হবে আমার একমাত্র ভাবনা।
পঞ্চম দৃশ্য
(থিসিয়াস, হিপোলিটাস, থেরামেনেস)
থিসিয়াস
কেন আমার এমন অদ্ভুত অভ্যর্থনা?
হিপোলিটাস
তা কেবল ফেইড্রাই ভাল জানেন, পিতা। কিন্তু আপনার অনুমতি পেলে আমি আর কোনোদিন তার দিকে দৃষ্টিপাত করবো না। আপনার স্ত্রীর বিচরণের সকল ক্ষেত্রকে বিদায় জানাবার অনুমতি দিন।
থিসিয়াস
তাহলে, প্রিয় পুত্র আমার, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চাও?
হিপোলিটাস
আমি নিজে কখনেই তার সান্নিধ্য কামনা করিনি। আপনিই তাকে সাথে করে ট্রোজেনে এলেন। হ্যাঁ, প্রভু, শেষ অভিযাত্রার আগে আপনি ফেইড্রা এবং এরিসিয়াকে এই ট্রোজেন উপকুলে রেখে গেলেন আমার অভিভাবকত্বে। আপনি ফিরেছেন। দায়িত্বের বন্ধন থেকে আমায় মুক্তি দিন। আজ কতদিন এই অরণ্যের তুচ্ছ বিষয়াদিতে মগ্ন হয়ে আমি যুদ্ধবিদ্যার অনুশীলন থেকে বিরত রয়েছি। আলস্যে দিনাতিপাত না করে আমার কি উচিত নয় যোগ্যতর প্রতিপক্ষের রক্তে আমার তরবারী আর বর্শার ফলা রাঙানো? আমার বয়সে পদার্পণের আগেই আপনি একাধিক স্বৈরশাসক কি দৈত্য-দানোকে আপনার পেশী দৃঢ়তা আর তরবারীর তীক্ষ্ণতায় পরাস্ত করেছেন। লুণ্ঠনকারীদের চাবকে তাড়িয়ে আপনি সমুদ্রের দুই প্রান্তের উপকুল পরিব্রাজকগণের জন্য ভয়মুক্ত করেছেন। আপনার খ্যাতির কথা হারকিউলিসের অজানা ছিল না। দুষ্টের বিরুদ্ধে দ্রোহে আপনার তৎপরতায় নিশ্চিন্ত হয়ে হারকিউলিস বিশ্রাম গ্রহণ করেন। এমন পিতার এক নামহীন পুত্র আমি। এমনকি মায়ের খ্যাতির প্রতিও আমি সুবিচার করিনি। তাই, দেরিতে হলেও, সাহসিকতার প্রমাণ দিতে আমাকে বেরিয়ে যেতে দিন। একটি দানোও যদি আপনার হাত থেকে পালিয়ে বেঁচে থাকে, তার চামড়া তুলে এনে আপনার পায়ের কাছে বিছিয়ে দিতে চাই। অথবা গৌরবময় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ হোক আমার জীবন, যে জীবন বিস্মরণের অতীত। সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে যেতে চাই যে, আমি ছিলাম আপনারই সুযোগ্য সন্তান।
থিসিয়াস
এ আমি কি দেখছি? এ কোন বিভীষিকায় আচ্ছন্ন এই রাজপুরী? আমার কাছ থেকে সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন? কেন হে ঈশ্বর আমায় কারামুক্ত করলে? আমার এক প্রিয় সাথীর চোখ পড়েছিল এপিরাসের রাজার স্ত্রীর দিকে। সে সুযোগ খুঁজছিল তাকে অপহরণ করবে বলে। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি তার ষড়যন্ত্রে যোগ দিলাম। কিন্তু ভাগ্যদেবীর রোষানলে দৃষ্টি হারিয়ে আমরা বন্দি হলাম। অশ্রুসজল নয়নে আমি চেয়ে দেখি স্বৈর এপিরাস পিরিথৌসকে নিক্ষেপ করেছে রক্ত পিপাসু রাক্ষস দঙ্গলের মুখে। আর আমাকে রাখা হলো মৃত্যুপুরীর কাছাকাছি এমন এক গুহায় যেখানে কোন দিন আলোর প্রবেশ ঘটে না। ছয় মাস পর আমার দুর্দশায় করুণা হলো দেবতাদের। সতর্ক প্রহরার ফাঁক গলে পৃথিবী থেকে আরো একটি শয়তান দূর করে তার রক্তাক্ত শব ছুঁড়ে দিই তারই পোষা জন্তুদের ভোগে। কিন্তু আজ আমি নির্ভার আনন্দচিত্তে ফিরে এসেছি দেবতার দান আমার সবচেয়ে কাঙ্খিত সবচেয়ে প্রিয় মুখচ্ছবি দেখবো বলে। কিন্তু দেখছি ভীত সন্ত্রস্ত মুখে সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ আমার আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে রাজি নয়। সব দেখে মনে হচ্ছে এপিরাসের কারাগারে বন্দি থাকাই ভাল ছিল। চুপ করে থেকো না, কথা বলো! ফেইড্রা বলছে আমি প্রতারিত। কিন্তু কার দ্বারা? যে দোষী তার শাস্তি কেন হয়নি এখনো? যে গ্রীস এতবার আমার বাহুবলে রক্ষা পেয়েছে সেকি তবে দোষীর প্রাণ রক্ষায় সচেষ্ট? তোমরা সবাই নীরব। তবে কি আমার শত্রুর সাথে কোনো যোগসূত্র রয়েছে নিজ পুত্রের? আমি ভিতরে যাচ্ছি। অসহ্য এই সন্দেহের অবসান আমাকে ঘটাতেই হবে। ফেইড্রাকেই বলতে হবে তার দুর্দশার কারণ। অপরাধ ও অপরাধী দুইয়েরই মূলোৎপাটন করতে হবে।
ষষ্ঠ দৃশ্য
(হিপোলিটাস, থেরামেনেস)
হিপোলিটাস
তার কথায় আমার শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল। কি ছিল তার মনে? উন্মত্তা ফেইড্রা কি নিজের দোষ স্বীকার করে পরিত্যাক্ত হবে? রাজাই বা কি বলবেন? হায় ঈশ্বর! তার অনুপস্থিতিতে সারা প্রাসাদ যে ভালবাসার বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। এদিকে এমন একজনের জন্য আমার দহন যার জন্য রাজার মনে অভিশাপ। আমি ভয়ঙ্কর অনিষ্টের ইঙ্গিত পাচ্ছি এবং তা ঘনিয়ে আসছে। যাই হোক, শিষ্টের কোনো শত্রু নেই- এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আসুন ভেবে দেখি কি উপায়ে পিতার মনে আমার হারানো স্থান ফিরে পাওয়া যায়; কি করে তাকে এমন প্রেমের কথা বলা যায় যে প্রেমে তার সায় নেই।
চতুর্থ অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
(থিসিয়াস, ইনোন)
থিসিয়াস
এ আমি কি শুনছি? এত সাহস তার, এত বড় প্রতারক সে! পিতার সম্মান ভূূলুণ্ঠিত করার ষড়যন্ত্রে সে লিপ্ত! হায় নিয়তি, কি বেপোরোয়া হয়েই না তুমি আমার পিছু নিয়েছ! আমি কোন দিকে যাব? স্নেহ মমতার একি প্রতিদান! এ তো এক নষ্ট মনের দুষ্ট ষড়যন্ত্র! এ তো পিশাচের মত বল প্রয়োগে লালসা চরিতার্থ করা। তার কামনার চিহ্ন এই তরবারী আমার পরিচিত। অনেক বীরত্বের স্মারক হবে আশা করে এই তরবারী আমি তাকে দিয়েছিলাম। তবু কেন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি আমাদের রক্তের বন্ধন? ফেইড্রাই বা কেন সাক্ষাতেই অভিযোগ করেনি? সে কি তবে দোষীকে বাচাঁতে?
ইনোন
না, বরং তিনি চেয়েছিলেন তার পিতাকে বাঁচাতে। লজ্জায় তিনি সব এড়িয়ে গেছেন। তিনি ভেবেছেন তারই অঙ্গ সৌষ্ঠব ঘৃণ্য আবেগ ও হিংস্রতা সঞ্চার করেছে। তবে রানী যে এখনো বেঁচে আছেন তার জন্য আপনি আমার কাছে ঋণী। কারণ নিজের হাতে নিজের জীবন নিতে তিনি যখন বিষন্ন চোখে কেবল তরবারী উঁচিয়ে ধরেছেন, আমি গিয়ে তাকে নিরস্ত্র করি। তার প্রতি করুণায় আর আপনার ভয়ে ভীত হয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় সব খুলে বললাম।
থিসিয়াস
বিশ্বাসঘাতক! সে যে আমায় দেখে বিবর্ণ হবে তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। আমার প্রথম দৃষ্টিতেই সে কেমন অসহায় বোধ করলো। তার সম্ভাষণহীন অবয়বে আর শীতল আলিঙ্গনে আমি হীম হয়ে যাই। কিন্তু এথেন্সেও কি তার এমন কদর্য আবেগ দৃষ্টিগোচর হয়েছিল?
ইনোন
আপনার নিশ্চয়ই স্মরণে আছে রানী তাকে সইতে পারতেন না। যুবরাজের কুরুচিপূর্ণ মনোভাবই রানীর ঘৃণার কারণ হয়েছিল।
থিসিয়াস
সেই প্রেমই তাহলে এই ট্রোজেনে এসে নতুন করে জ্বলে উঠেছিল?
ইনোন
প্রভু, সবই আমি আপনাকে খুলে বলেছি। বেদনাহত রানীমা অনেকক্ষণ একা। আপনি অনুমতি দিলে আমি বরং তার উপশমে সচেষ্ট হই।
দ্বিতীয় দৃশ্য
(থিসিয়াস, হিপোলিটাস)
থিসিয়াস
বাহ, ঐ তো তিনি আসছেন। ঈশ্বর! এমন বীরোচিত ভাবভঙ্গিতে কে না প্রতারিত হয়, যেমন আমি হয়েছি? অজাচারীর অবয়বে কেন এই পূতভাব? এতে এমন কোনো চিহ্ন কি পরিষ্ফুট নয় যা দিয়ে তার বিশ্বাসঘাতক অন্তর সনাক্ত হয়?
হিপোলিটাস
প্রভু, জানতে পারি কেন আপনার রাজকীয় মুখশ্রীতে এমন অশীনি মেঘের ছায়া? পুত্রের কাছেও কি এ রহস্য প্রকাশ্য নয়?
থিসিয়াস
বিশ্বাসঘাতক, আমার সামনে এসে দাঁড়াও, এত স্পর্ধা তোমার? তুমি এমন দানো যার উপর দেবোরাজের বজ্র নিক্ষিপ্ত হওয়া উচিত। তুমি সেই সব দস্যুদের মতন যাদের আমি পৃথিবী ছাড়া করেছি। তোমার অস্বাভাবিক ও উৎকট কামনা যখন পিতৃ শয্যা কলুষিত করে, তখন কি করে পার তোমার নষ্ট মুখ দেখাতে? চলে যাও সেই অজানা দেশে যেখানে আমার সুখ্যাতির বার্তা আজো পৌঁছেনি। পালাও হে হতভাগা! যে ঘৃণায় আমার অন্তর ছেয়ে আছে, যে ক্রোধ অবদমনে আমার যন্ত্রণা হয় তার জ্বালা মুখ খুলে দেবার সাহস তুমি করো না। তোমার মত নিচ সন্তানের জনক হয়ে যথেষ্ট অপমান আমি গায়ে মেখেছি। নিজের হাতে তোমায় হত্যা না করলে আমার কষ্টার্জিত বীরগাঁথা ভূলুন্ঠিত হবে। পালাও, যদি সেই সব দুবৃত্তদের দলভুক্ত না হতে চাও যারা আমার হাতে জীবন দিয়েছে। সাবধান, কোনোদিন যেন তোমার উদ্ধত পদক্ষেপ না পড়ে এই মাটিতে। যাও, এক্ষুণি বেরিয়ে পড়; তোমার বিদায়ে চিরতরে কলুষমুক্ত হোক আমার রাজ্য। আর সমুদ্রদেব নেপচুন - যদি কোন দিন দুঃসাহসিক অভিযানে তোমার দু’কূল শত্রু মুক্ত করে থাকি- আমার আর্তি শুনুন। মনে পড়ে নিশ্চয়ই- বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ আপনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমার প্রার্থনা আপনি মঞ্জুর করবেন। ঘোরতর প্রয়োজনের কথা ভেবে দীর্ঘ ও নির্মম কারাবাসেও আমি আপনার অমর শক্তির আনুকূল্য কামনা করিনি। আজ আমার সেই মুহূর্ত উপস্থিত। একজন প্রতারিত পিতার পক্ষে প্রতিশোধ নিন। আমার বিশ্বাসঘাতক পুত্রকে আপনার রোষানলে অবরুদ্ধ করুন। তার হীন লালসা ভেসে যাক তারই রক্ত প্লাবণে। আপনার ক্রোধেই নিশ্চিত হোক আমার পুরস্কার।
হিপোলিটাস
ফেইড্রা করে লাম্পট্যের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে? ভাবতেই আমার শরীর অবশ হয়ে আসে; আমি ভাষা হারিয়ে ফেলছি। এমন অকস্মাৎ অপবাদের হল্কায় আমি বিমূঢ়, হতবুদ্ধি, রুদ্ধবাক।
থিসিয়াস
পাপাত্মা তুমি, ভেবেছ ফেইড্রা বলতে ভয় করবে যে তুমি পাশবিক লোলুপতা নিয়ে হামলে পড়েছ তার উপর? ফেইড্রার হাতে ফেলে আসা তরবারীর ধারালো ফলা এখন তোমার অপরাধই ঈঙ্গিত করে। হয় সেই তরবারী, না হয় ফেইড্রার জীবন- একটা কিছু ছিনিয়ে নিলেই ভাল করতে।
হিপোলিটাস
এমন অশুভ অপবাদের বিপরীতে প্রকৃত সত্য উন্মোচনে উদ্যত আমার অহম। কিন্তু তা আমি করবো না, কারণ, সেটা হবে আপনার সহ্যের অতীত। আপনার প্রতি আমার ভালবাসা প্রসূত এই নীরবতা ক্ষমা করুন এবং আপনার পর্বত প্রমাণ ক্রোধ ও কষ্ট সম্বরণ করুন। একবার ফিরে দেখুন- আমার মাঝে যে সন্তানকে আপনি চিনতেন তার দিকে। বড় বড় অপরাধের মূলে থাকে ছোট ছোট অপরাধ। আজ যে সীমানা লঙ্ঘন করে, একদিন সে সকল পবিত্র বিধান অস্বীকার করবে। কারণ, মহত্বের মত অপরাধ প্রবণতাও পরিপক্ক হয়ে উঠে ক্রমে ক্রমে। কিন্তু শিষ্টকে এক নিমেষে নষ্ট হয়ে যেতে কে কবে দেখেছে? সময় পারে না একদিনে ধার্মিকেরে কামুকে পরিণত করতে। আমার সতীসাদ্ধী আমাজোনীয় মাতার রক্ত আমি কলুষিত করিনি কোনোদিন। মায়ের হাত ছেড়ে আমি যাই জ্ঞানশ্রেষ্ঠ পিট্টিয়াসের কাছে যার দীক্ষায় আমার কৈশোর কেটেছে। নিজের গুণকীর্তণ আমি করবো না। শুধু বলবো, ভাগ্যদেবী যদি একটি গুণও আমায় দিয়ে থাকেন তা হল কাম বিমুখতা, যার বিপরীত অভিযোগে আমি আজ অভিযুক্ত। প্রস্তরবৎ শীতলতা ও কঠোরতার জন্য গ্রীসময় আমার সুখ্যাতি। আমার নির্মোহতা ও সুকঠোর সংযম আমাকে ভিন্নতা দিয়েছে। সূর্যালোকের চেয়ে কম শুভ্র নয় আমার অন্তর। অথচ কিনা ইন্দ্রিয়পরায়নতার অভিযোগে আমি অভিযুক্ত।
থিসিয়াস
তোমার এই অহঙ্কার তোমার নিচতার পরিপন্থী। কিন্তু তোমার নিস্পৃহতার মর্ম আমি বেশ বুঝতে পারছি: শুধু ফেইড্রাই তোমার লোলুপ নজরে পড়েছিল। আর কোনো নারী তোমায় নাড়া দেয়নি; আর কেউ পারেনি তোমার বিদ্বেষী হৃদয়ে নিষ্পাপ বাসনা জাগাতে।
হিপোলিটাস
না। তবে শুনুন পিতা, বিশেষ একজনের নির্দোষ প্রেমে আমি যে বিদ্বেষ পোষণ করিনি সে কথা আপনাকে আগেই অবগত করা উচিত ছিল। আমার একমাত্র দুস্কৃতির কথা তাহলে শুনুন। আপনার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আমি ভালবেসেছি এরিসিয়াকে। তার প্রণয়ে আমি বিজীত। পাল্লাস কন্যা এরিসিয়া আমায় বশ করেছে। প্রভু, আপনার আদেশ অমান্য করেই আমি তার পূজারী। সে ছাড়া আর কারো জন্য আমার দহন বা দীর্ঘশ্বাস কোনোটাই নেই।
থিসিয়াস
তুমি তাকে ভালবাস? ঈশ্বর! কিন্তু না, আমি তোমার চাল বুঝে নিয়েছি। আপবাদ মুক্ত হতেই তোমার এই ছল।
হিপোলিটাস
আমার হৃদয় যাকে চায় তাকে আমি ছয় মাস এড়িয়ে চলেছি। এই প্রেম সম্পর্কে জানাতে আমি ভয়ে ভয়ে আপনার কাছে এসেছি, প্রভু। তবু কেন আপনি আপনার ভ্রান্ত মতে অনড়? কিসের দিব্যি দিয়ে আমি আপনাকে বোঝাব? স্বর্গ-মর্তের সকল কিছুর দোহাই দিয়ে বলছি...
থিসিয়াস
মিথ্যা হলফে শঠের ক্লান্তি নেই। সততার ভানে আর ঠক বচনে আমায় ক্লান্ত করো না।
হিপোলিটাস
আমার সততা আপনার কাছে ভান বা প্রতারণা মনে হতে পারে। কিন্তু ফেইড্রাই জানে এটা কতটা সত্য।
থিসিয়াস
তোমার ধৃষ্টতায় আমার ক্রোধ টগবগ করে ফুটছে!
হিপোলিটাস
আমি কতদিন নির্বাসিত থাকবো? কোন স্থানেই বা যাবো?
থিসিয়াস
তুমি এ্যলসিডেসের সীমা অতিক্রম করে গেলেও আমার মনে হবে কোনো এক খল চরিত্র আমার খুব কাছেই আছে।
হিপোলিটাস
এমন অভিযোগে অভিযুক্ত, এমন পিতা কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত জনের কে হবে বন্ধু?
থিসিয়াস
তাদের অনুসন্ধান করো যারা ব্যাভিচারীর সমাদর করে, অজাচারে যারা বাহবা দেয়। অকৃতজ্ঞ, বিশ্বাসঘাতকেরাই কেবল সহায় হবে তোমার মত দুর্জনের।
হিপোলিটাস
অজাচার! ব্যাভিচার! এখনো আপনি এসবই ভাবছেন? আমার তাহলে আর কিছু বলবার নেই। তবে মনে হয়, এই সব বিভীষিকাময় শব্দাবলীর সাথে আমার মায়ের চেয়ে ফেইড্রা বা তার বংশের আর সকলের পরিচয় বেশি ছিল।
থিসিয়াস
আচ্ছা! এত স্পর্ধা তোমার যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি আস্ফালন কর? শেষবারের মত বলছি এই স্থান তুমি ত্যাগ কর। বল প্রয়োগে অসম্মান করে তাড়িয়ে দেবার আগে নিস্ক্রান্ত হও।
তৃতীয় দৃশ্য
(থিসিয়াস)
থিসিয়াস
হায়রে হতভাগা, যে পথ তুমি নিয়েছ তার পরিসমাপ্তি তোমার রক্তে। যে স্টাইক্সের নামে দেবতারা পর্যন্ত কেঁপে উঠেন, পাতালের সেই অন্ধকার নদীর দিব্যি করে নেপচুন যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা তিনি নিশ্চয় পূরণ করবেন। আর দেবতারা যার পিছু নেন তার রক্ষা নেই। আমি তোমাকে ভালবাসতাম। তাই তোমার দুষ্কর্ম সত্ত্বেও তোমার আসন্ন বিপদের কথা ভেবে আমি ভারাক্রান্ত, পুত্র আমার। কিন্তু আমার অভিশাপ তোমার প্রাপ্য ছিল। এমন দুষ্ট সন্তানের জনক আমি কি করে হলাম?
চতুর্থ দৃশ্য
(ফেইড্রা, থিসিয়াস)
ফেইড্রা
প্রভু, আপনার উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে ভীত হয়ে আমি ছুটে এসেছি। দেবতার কৃপা, আশা করি আপনার হুঁশিয়ারী এখনো কার্যকর হয়নি। অনুনয় করি, এখনো যদি সময় থেকে থাকে আপনার পুত্রকে রক্ষা করুন। তার রক্ত যা কিনা আপনারই রক্ত- মাটিতে গড়িয়ে ভয়ার্ত আর্তনাদ করছে, এমন দৃশ্য আমার কল্পনাতীত। আমি চাই না আমার কারণে আপনার হাতে ঘটুক সেই রক্তপাত।
থিসিয়াস
না, রানী, আমার রক্ত আমার হাতে উঠে আসেনি। কিন্তু সেই অকৃতজ্ঞ মূঢ় আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না। এক তেজস্বী দেবতার হাতে ঘটবে তার পতন এবং তোমার প্রতিশোধ। নেপচুন আমার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ফেইড্রা
সমুদ্র দেব নেপচুন! এবং তিনি তোমার প্রার্থনায় সাড়া দেবেন?
থিসিয়াস
আশ্চর্য! তুমি কি এই ভেবে ভীত যে তিনি তার কথা রাখবেন? বরং আমার প্রার্থনায় যোগ দাও। আমার পুত্রের অশুভ ষড়যন্ত্রের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করে জাগিয়ে তোল আমার রোষ। তুমি জানো না এমন আপরাধও সে করেছে। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সে তোমার কুৎসা করছে। কত বড় সাহস, সে বলে তুমি মিথ্যাবাদী। সে জানিয়েছে সে তার প্রাণ মন সপে দিয়েছে এরিসিয়াকে।
ফেইড্রা
কি বললেন, প্রভু!
থিসিয়াস
তেমন দাবীই সে করেছে। কিন্তু আমি তার চাতুর্য ধরে ফেলেছি। আশা করি ন্যায় বিচারে নেপচুন বিলম্ব করবেন না। আমি যাচ্ছি; তার বেদীতে গিয়ে অনুনয় করে বলি তিনি যেন অতি শীঘ্র তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন।
পঞ্চম দৃশ্য
(ফেইড্রা)
ফেইড্রা
(সে চলে গেছে) এ কোন বার্তা আমার কানে এসে আঘাত করছে? কবেকার আধনেভা আগুন দপদপ করে জ্বলে উঠছে আমার বুকে? এ কেমন বজ্রাঘাতে আমি বিমূঢ়? অনুতাপের দহন সইতে না পেরে ইনোনের হাত ছিটকে আমি এলাম তার পুত্রের প্রাণ রক্ষা করবো বলে; জানি না কতটুকু কি পারতাম- অপরাধবোধ হয়তো আমার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে নিতো; হতবিহ্বলতায় কণ্ঠরুদ্ধ না হলে হয়তো নির্লিপ্তভাবে প্রকাশ পেত আমার কদর্যতার কাহিনী। হিপোলিটাস ভালবাসতে জানে, কিন্তু সে ভালবাসা আমার জন্য নয়! এরিসিয়া লাভ করেছে তার ভালবাসা, তার আনুগত্য! আমার মিনতিতে, তার অনঢ়তায়, ভ্রুকুটিতে আর অবজ্ঞায় মনে করেছি সকল নারীর বিরুদ্ধে তার হৃদয় সুরক্ষিত। অথচ একজন পেরেছে তার অহঙ্কারকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে, তার কঠিন দৃষ্টিতে আবেগ ঝরাতে। হয়তো খুব সহজেই বশ করা যায় তাকে। কেবল আমিই একমাত্র নারী যাকে সে সহ্য করতে পারে না! আমাকে যে চরম অবজ্ঞায় প্রত্যাখ্যান করে, আমি কি তাকে রক্ষা করবো?
ষষ্ঠ দৃশ্য
(ফেইড্রা, ইনোন)
ফেইড্রা
প্রিয় ইনোন, তুমি জানো আমি কি শুনে এলাম?
ইনোন
না, কিন্তু আপনি যে অস্থিরতা নিয়ে এদিকে ছুটে এলেন, তা দেখে মারাত্মক কিছুর আশঙ্কায় আমি এখনো কাঁপছি।
ফেইড্রা
আমার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। ভাবতে পার কে সে?
ইনোন
কী বললেন?
ফেইড্রা
হ্যাঁ, হিপোলিটাস প্রেমে পড়েছেন, একথা সত্য। যে বন্যকে কেউ বশে আনতে পারেনি, কোনো প্রণয়িনীর আর্তিতে যে কর্ণপাত করেনি, কম্পিত জানুতে আমি যার অনুকম্পা চেয়েছি সে এখন পোষ মেনেছে। সে এখন এক রমনীর ছলে ধরাশায়ী। এরিসিয়া খুঁজে পেয়েছে হিপোলিটাসের হৃদয়ের ঠিকানা।
ইনোন
এরিসিয়া?
ফেইড্রা
হায়, এত যন্ত্রণা যে কোনোদিন ভোগ করিনি আগে! কত অজানা সুঁচালো কষ্ট যে রয়ে গিয়েছিল জমা! প্রণয় উন্মাদনা, ভয়-শঙ্কা, অনুতাপ, হৃদয়ের দহন, প্রত্যাখ্যানের অপমান- এসবই ছিল আজকের যন্ত্রণার ভূমিকা মাত্র। ওরা তাহলে পরস্পরকে ভালবাসে! কি যাদুবলে তবে ওরা আমায় ধোকা দিল? কখন কোথায় হত ওদের অভিসার? তুমি জানতে? কেন বলনি আমায়? কেন প্রবঞ্চিত করেছ ওদের গোপন প্রণয় সম্পর্কে? আচ্ছা, ওদের কি খুব দেখা যেত এক সাথে? দৃষ্টি এড়াতে ওরা কি গভীর অরণ্যে চলে যেত? হায়, কি স্বাধীন ছিল ওদের বিচরণ! এমন নিষ্পাপ ও সুমিষ্ট মিলনে স্বর্গের দেবতারাও যে স্মিত হাসি হেসেছেন। অনুতাপ অনুশোচনাহীন প্রেমের রস তারা আস্বাদন করেছে কি আনন্দে! তাদের প্রত্যেকটি ভোর ছিল স্বর্গীয় আলোয় উদ্ভাসিত। অথচ সৃষ্টিছাড়া এই আমি সূর্যদৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করেছি কেবল। মৃত্যু ছাড়া আর কোনো দেবতার নাম আমার মুখে ছিল না। তার জন্য আকুল হয়ে আমি বাঁচার ইচ্ছে হারিয়েছি। অশ্রুজলে তৃষ্ণা মিটিয়ে আমি গরল আহার করেছি। তবু লোকলজ্জার ভয়ে আমি কেঁদে হাল্কা হতে পারিনি। শুধু অগোচরে সেই তিক্ত সুধা পান করেছি। প্রশান্তির ছদ্মবেশে আমি বুকের যন্ত্রণা চোখ থেকে আড়াল করেছি।
ইনোন
কিইবা ফল হবে তাদের ভালবাসার? আর কোনোদিন তারা পারবে না মিলিত হতে।
ফেইড্রা
কিন্তু ওরা যে অনন্তকাল ধরে ভালবাসবে পরস্পর। ভাবতেও আমার মন বিষিয়ে ওঠে যে, আমার উন্মত্ত কামনা ও হতাশায় ওরা বিদ্রুপ করবে। তার নির্বাসনে তাদের আপাত বিচ্ছেদ হলেও অন্তরে তারা চিরদিন অভিন্ন থাকবে। অসম্ভব, তাদের এত আনন্দ আমি সইবো না। ইনোন, আমার ঈর্ষাকে করুণা কর। এরিসিয়াকে মরতেই হবে। আরেকবার তাদের কদর্য গৃহে আমার পতির ক্রোধের আগুন জ্বলবে। তার ভাইয়েদের চেয়ে তার অপরাধ বেশি আমার কাছে। তাই তার শাস্তি হবে আরো বেশি ভয়াবহ। আমার প্রমত্ত হিংসায় আমি রাজার মন বিষিয়ে তুলবো তার সম্পর্কে। কি করবো বললাম? আমার বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে? আমি তাহলে ঈর্ষালু! আমার স্বামী বেঁচে আছেন। তাহলে আর কাকে ঘিরে আমার মন এমন অস্থির? আর তারই প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ নিতে উত্যক্ত করবো আবার আমার স্বামীকেই! ভাবতেই আমার কেশাগ্র টান টান হয়! আমার অপরাধের অন্ত নেই। সজন-সংগমের কল্পনায় আমি বাতাস দূষিত করেছি। কিন্তু প্রতিশোধ আমার চাইই চাই। নিষ্পাপ রক্তে হাত রাঙাতে আমার ত্বর সইছে না। তারপরও আমি এই হতভাগী বাঁচবো কীভাবে? কীভাবে মুখোমুখি হব আমার পূর্বপুরুষ সূর্যদেবের? আমার পিতামহ ছিলেন সকল দেতার উপরে। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে আছে বংশের শাখা প্রশাখারা। আমি কোথায় লুকাবো নিজেকে? আমার শুধু পাতালপুরীর অমা রজনীর প্রতিক্ষা। কিন্তু না, সেখানে রয়েছেন আমার পিতা; হাতে তার ভাগ্যদেবীর সপে দেয়া ছাইপাত্র। আমাকে দেখে তিনি কেঁপে উঠবেন; আমার পাপের দীর্ঘ স্বীকারোক্তিনামা শুনে তিনি শিওরে উঠবেন! পিতা আমার, আপনি তখন কি বলবেন আমায়? স্বপ্নের মত আমি দেখতে পাই আপনার হাত থেকে খসে পড়লো সেই ভয়ঙ্কর ছাইপাত্র। তারপর শান্তির নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবন করে আপনি নিজেই হলেন নিজ কন্যার শাস্তিদাতা। এক নিষ্ঠুর দেবতা ধ্বংস করে দিল আপনার বংশ। আমায় ক্ষমা করুন পিতা; ভাববেন আমার সব উন্মদনায় ছিল সেই দেবীর হাত। মনের কদর্যতা একবারও স্পর্শ করেনি আমার দেহ। অথচ দুর্ভাগ্য হিংস্র পশুর মত পিছু নিয়েছে আমার। অনেক যন্ত্রণায় কাতর শেষ নিঃশ্বাসটুকু নিয়ে আমি চলেছি মৃত্যুর কাছে আমার করুণ জীবন সপে দিতে।
ইনোন
রানী, অযথা ত্রস্ত হবেন না। নতুন করে ভেবে দেখুন। আপনি যা করেছেন তা ক্ষমাযোগ্য ভুল মাত্র। আপনি প্রেমে পড়েছিলেন, এইতো। কিন্তু নিয়তিকে জয় করতে কেইবা পারে? এক মারাত্মক মন্ত্রে আপনি মুগ্ধ হয়েছিলেন মাত্র। এটাকি এমন যা আগে কেউ কখনো দেখেনি বা শোনেনি? আপনিই কি প্রথম ভালবাসার ফাঁদে পা দিলেন? দুর্বলতা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনি মরণশীল, তাই মরণশীলের পরিণতি আপনাকে মেনে নিতে হবে। মানবিক সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। এমনকি অলিম্পাস নিবাসী দেবতারা, যারা মানুষের দোষে বজ্র ছোড়েন তাদেরও অবৈধ কামনার অনেক ইতিহাস আছে।
ফেইড্রা
আহ, এ কেমন দুষ্ট পরামর্শের কথা শুনছি? হতভাগী, তুমি কি শেষ দিন পর্যন্ত এমন বিষ ঢালতে থাকবে আমার কানে? ভেবে দেখ একবার, কীভাবে শেষ করেছ আমায়। যা থেকে আমি পালাতে চেয়েছিলাম তার দিকে তুমি আমায় টেনে এনেছ। যে হিপোলিটাসকে আমি এড়িয়ে চলেছি, তুমি বলেছ তার সাথে সাক্ষাৎ করা পাপের নয়। কি মিশ্র চরিত্র তোমার! তোমার নষ্ট মুখে কেন বিষোদ্গার করেছিলে অমন বিশুদ্ধ এক তরুণের? সে হয়তো শেষ হয়ে যাবে, দেবতারা যদি তার দিশেহারা পিতার অপবিত্র প্রার্থনায় সাড়া দেয়। কিন্তু না, আর কোনো কথা নয়। তুমি একটা রাক্ষুসি। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। তুমি দূর হয়ে যাও। অবশেষে আমাকে আমার করুণ পরিণতির মুখোমুখি হতে দাও। তোমার কর্মের জন্য স্বর্গ থেকে তুমি পুরস্কৃত হবে বৈকি! এমন শাস্তি তোমার হোক যা চিরকাল আতঙ্ককিত করবে তাদের যারা তোমার মত ছলাকলায় যুবরাজেদের মন ভুলিয়ে নিয়ে যায় পাপের মিহি রাস্তায়। অভিশপ্ত চাটুকার যতসব স্বর্গের ঘৃণা হয়ে আসে রাজপদতলে!
ইনোন
যাকে আমার সমগ্র জীবন দিয়েছি, হা ঈশ্বর, কী কষ্ট তার এমন প্রতিদানে! হয়তো এই আমার প্রাপ্য ছিল।
পঞ্চম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
(হিপোলিটাস, এরিসিয়া)
এরিসিয়া
আসুন, এই মারাত্মক বিপদে আপনি কি আপনার পিতাকে বোঝাবেন না যে তিনি ভুল করছেন? আমার অশ্রু নদী পেরিয়ে আপনি যদি নির্বাসন মেনে নেন তাহলে এরিসিয়াকে তার নিজের মত থাকতে দিন। কিন্তু প্রথমে আপনার নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। বিশ্রী অপবাদ থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। এখনো সময় আছে, আপনার পিতাকে বাধ্য করুন তার প্রার্থনা ফিরিয়ে নিতে। দয়া করে বলবেন কি ফেইড্রার রটানো কুৎসার প্রতিবাদে কেন আপনার দ্বিধা? থিসিয়াসের কাছে সত্য উন্মোচন করুন।
হিপেলিটাস
তাকে যা বলেছি তার চেয়ে বেশি আর কিইবা বলতে পারতাম? বলতাম ফেইড্রার ব্যভিচারের কথা? কি করে পারতাম সব কিছু বলে দিয়ে আমার পিতা আর দেশের রাজার মর্যাদাহানী করতে? বুকের ভিতর জমাট বাধা সব কথা আমি বলেছি শুধু তোমাকে আর দেবতাদের যারা আমার ভালবাসার স্বাক্ষী। নিজের কাছ থেকেও আমি লুকাতে চেয়েছি যেসব বিভীষিকার কথা, তা হয় চিরদিন গোপন রাখবে, না হয় ভুলে যাবে। তোমার পবিত্র ওষ্ঠাধার যেন কোনোদিন এই নোংরা ঘটনার স্বাক্ষ বহন না করে। আমরা বরং ঈশ্বরের সুবিচারে আস্থাশীল হই। নির্দোষের পক্ষ অবলম্বনে দেবতারা দায়বদ্ধ। আজ হোক কাল হোক ফেইড্রা তার প্রাপ্য বুঝে পাবে; কৃত কর্মের জন্য তাকে লজ্জিত হতে হবে। আমার অহ্বানে সাড়া দাও। দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে পড়ো আমার সাথে। পালাও সে দেশ থেকে, যেখানে সততার গায়ে লেগেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস। আমাকে ঘিরে যে উত্তেজনা তার আড়ালে দ্রুত সরে পড়ো। আমি তোমার নিরাপদ পলায়ন নিশ্চিত করতে পারি। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো আমাদের সাহায্য করবে। আমাদের পাশে রয়েছে স্পার্টা; আর্গোস তার দুই বাহু প্রসারিত করে অপেক্ষা করছে। চলো, এই সব বন্ধুদের কাছে গিয়ে আমরা আমাদের বঞ্চনার কথা বলি, পাছে ফেইড্রা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমার এবং তোমার উত্তরাধিকার তুলে দেয় তার পুত্রের হাতে। আসো আপেক্ষা না করে আমরা সময়কে কাজে লাগাই। মনে হচ্ছে তুমি ইতস্তত; কিন্তু কিইবা আছে তোমার পিছুটান? অথচ আজ তুমিই হলে আমার দৃঢ়তার অনুপ্রেরণা। আমার সমগ্র সত্তায় যখন আগুন জ্বলছে, তখন তোমার কেন এই শীতলতা? তুমি কি নির্বাসিতের সঙ্গী হতে শঙ্কিত?
এরিসিয়া
কী বলছেন প্রভু! কিযে মধুর হবে এই নির্বাসনের অংশীদার! কী গভীর আনন্দ আপনার সাহচার্যে, সবার অগোচরে আপনার সহবাসে! ভাবনা শুধু এই যে, শাস্ত্রমতে আবদ্ধ না হয়ে আপনার সাথে এই দেশ ত্যাগ অসম্মানের কি-না। আমি জানি, আপনার পিতার সাথে আমার বন্ধন ছিন্ন করার অধিকার হরণ করে না কোনো বিধানই। এই ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে আর যাই হোক, আপন পিতা মাতাকে কষ্ট দেবার সুযোগ নেই। আমি মুক্ত। স্বৈরশাসনের কবল থেকে পালাবার অধিকার আর সবার মত আমারও আছে। কিন্তু আপনি আমাকে ভালবাসেন অথচ লজ্জার ভয়ে ...
হিপোলিটাস
তোমার সুনাম রক্ষায় আমি কার্পণ্য করবো এমন সন্দেহ রেখো না। তবে তোমার জন্য স্বস্তিকর একটি পরিকল্পনার কথা বলছি: আমাদের উভয়ের শত্রু থিসিয়াস; তার কাছ থেকে তোমার পলায়ন হোক স্বামী সহযোগে। যেহেতু দেবতার ইচ্ছায় নিতান্ত দুর্বিপাকে আমরা মুক্ত হয়েছি, আমাদের বন্ধনে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সম্মতির প্রয়োজন নেই। হোম ছাড়াও শুভ পরিণয় সম্ভব। ট্রোজেনের প্রবেশ দ্বারের কাছে আমাদের রাজপুরুষগণের সমাধিস্থলের পাশেই রয়েছে একটি মন্দির। হলপ করেও মিথ্যাচারে অভ্যস্ত যারা, তারা এড়িয়ে চলে সেই মন্দির। সেই মন্দিরে গিয়ে মিথ্যা শপথ করে বা বিশ্বাস ভঙ্গ করে এমন সাহস কারো নেই। মৃত্যু ভয়ে চরম প্রতারকেরাও সেখানে মিথ্যা বলে না। তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করে থাক, তাহলে আমরা সেখানে যাব এবং কারো মধ্যস্ততা ছাড়াই অনন্ত প্রেমের প্রতিজ্ঞা করবো; আমাদের শপথের স্বাক্ষী হবেন মন্দিরের দেবতা স্বয়ং। আমরা প্রার্থনা করবো যেন তিনি নিজেই হন আমাদের দুজনের সম্প্রদানকারী পিতা। সকল সত্য ও শুদ্ধ দেবতার আবাহন করবো আমি। আমার সততার স্বাক্ষী সতীসাদ্ধী ডায়না, মহান জুনো সহ সকল দেবতা তোমার প্রতি আমার প্রতিশ্রুতির জামিনদার হয়ে থাকবেন।
এরিসিয়া
রাজা এদিকেই আসছেন। যুবরাজ, আর দেরি নয়। দ্রুত বেরিয়ে পড়ুন। আমার পরিকল্পনা গোপন করতে আমি বরং এখানে কিছুক্ষণ থাকছি। যান, বেরিয়ে পড়ুন। আর বিশ্বস্ত একজন রেখে যান যে আমাকে আপনার কাছে নিয়ে যাবে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
(থিসিয়াস, এরিসিয়া, ইসমিন)
থিসিয়াস
হা দেবতাগণ, আমার অস্থির মনে আলো দিন; দিন সত্যের সন্ধান যার জন্য আমি এখানে এসেছি।
এরিসিয়া
পলায়নের জন্য প্রস্তুত হও প্রিয় ইসমিন।
তৃতীয় দৃশ্য
(থিসিয়াস, এরিসিয়া)
থিসিয়াস
তোমার মুখের রং বদল এবং মনে দ্বিধা স্পষ্ট। হিপোলিটাস কেন এসেছিল?
এরিসিয়া
প্রভু, তিনি এসেছিলেন শেষ বিদায় জানাতে।
থিসিয়াস
ও, আচ্ছা। যা আর কেউ পারেনি তুমি তা পেরেছো। তাকে বাগে এনেছো এবং শিখিয়েছ কীভাবে ধারালো চোয়ালে আশা নিরাশার মিশেল দিয়ে কথা বলতে হয়।
এরিসিয়া
আপনার কথার সত্যতা অস্বীকার করবো না। তিনি কোনোভাবেই তার পিতার বিদ্বেষী মনোভাব উত্তরাধিকার করেননি। আপনার মত তিনি আমাকে অপরাধী জ্ঞান করেননি।
থিসিয়াস
আচ্ছা। সন্দেহ নেই সে তোমাকে অন্তহীন প্রেমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, এমন চঞ্চলমতী যুবকের কথায় বিশ্বাস করো না। তোমার মত অনেককেই সে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এরিসিয়া
হিপোলিটাসের কথা বলছেন, প্রভু?
থিসিয়াস
তোমার উচিত ছিল তাকে পথভ্রষ্ট না হবার পরামর্শ দেয়া। কি করে পারলে এমন নিচ একজনের সাথে সম্পর্ক গড়তে?
এরিসিয়া
আপনি কি করে পারলেন তার সফেদ যৌবনের উপর মিথ্যা কালিমা ছিটিয়ে দিতে? আপনি কি এতই অজ্ঞ তার অন্তকরণ সম্পর্কে? আপনার কাছে কি শুভাশুভের কোনো পার্থক্য নেই? আমি নিশ্চিত, কোনো এক কালো মেঘ আপনার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কারণ, আপনার সন্তান যে চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্যের জন্য খ্যাত, তা কেবল আপনার চোখেই ধরা পড়ে না। মিথ্যা আপবাদেই কি তার ধ্বংস অনিবার্য? তাই যদি হয়, সেটা সহ্যের অতীত। আপনি ফিরে আসুন। আপনার মারাত্মক প্রার্থনা প্রত্যাহার করুন। অনুতাপ করুন, ভীত হন, না হয় রুদ্র দেবতাগণ ঘৃণায় মঞ্জুর করে বসবেন আপনার প্রার্থনা। কখনো কখনো ত্যাগের অর্ঘ্যে দেবতারা রুষ্ট হন; তখন তাদের বর আমাদের শাপ হয়ে দাঁড়ায়।
থিসিয়াস
তোমার কোনো কথাতেই তার পাপ মোচন হবার নয়। সে কতটা পাপিষ্ঠ তা তুমি দেখতে পাও না কারণ তার প্রতি ভালবাসায় তুমি অন্ধ। কিন্তু আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে। যে অশ্রু আমি দেখেছি তা মিথ্যা হতে পারে না।
এরিসিয়া
প্রভু, আপনি সাবধান হোন। নাম না জানা কত স্থানে কত অসংখ্য রাক্ষস আপনি নিধন করেছেন। কিন্তু একটি রাক্ষস এখনো বেঁচে আছে যে কি-না ... না, আমি আপনার পুত্রের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি ... আপনার সম্মান রক্ষার্থে তিনি যে সত্য গোপন করেছেন তা আমি প্রকাশ করবো না। আমি আপনার কাছ থেকে পালাতে বাধ্য হচ্ছি পাছে আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়।
চতুর্থ দৃশ্য
(থিসিয়াস)
থিসিয়াস
কি বলতে চায় সে? কি যেন বলতে চেয়ে সে থেমে গেল- আমার কাছ থেকে সবাই কি লুকাচ্ছে? নাকি আমাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পিষ্ট করার ফন্দি এটেছে দুইজনে? কিন্তু আমি যে আমার নিজের অন্তর আত্মায় কার এক করুণ কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। অব্যক্ত এক যন্ত্রণা জমে উঠছে আমার বুকে। ইনোনকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। আরো স্পষ্ট করে সব জানতে হবে, সব জানা হয়নি। প্রহরী, যাও, গিয়ে ইনোনকে এখানে নিয়ে আস, একা।
পঞ্চম দৃশ্য
(থিসিয়াস, পেনোপি)
পেনোপি
প্রভু, আমি জানি না রানী মা কি নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত ভীতিকর অবস্থায় রয়েছেন। তার চোখে মুখে মারাত্মক নিরাশা, গালে মৃতের বিবর্ণতা। তার কাছে অপমানিত হয়ে ইনোন সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছেন।
থিসিয়াস
এ তুমি আমায় কি শোনাচ্ছ?
পেনোপি
এই মৃত্যু রানী মাকে আরো অশান্ত করে তুলেছে; তার উন্মাদনা আরো স্পষ্ট হয়েছে। কখনো কখনো অস্থিরতা কমাতে তিনি তার শিশু সন্তানদের বুকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছেন। কখনো আবার নির্মমভাবে তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারী করছেন। তার শূন্য দৃষ্টিতে তিনি আর আমাদের চিনতে পারছেন না। একটি কাগজে তিনবার কিছু লিখে তিনবারই ছিঁড়ে ফেললেন। আমরা তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, পিতা, অনুনয় করি যদি আপনি চেষ্টা করে দেখেন।
থিসিয়াস
ইনোন মারা গেছে? ফেইড্রাও মরতে চায়? কে আছ, আমার পুত্রকে ফিরিয়ে আন; সে কলঙ্কমুক্ত হোক! সে যদি কথা বলতে চায়, আমি শুনবো। সমুদ্রদেব নেপচুন, বর প্রদানে কোনো তাড়া করবেন না। আমার প্রার্থনায় আপনি নীরব থাকুন। যা সত্য নয় তাতেই আমি বিশ্বাস করেছি। বড় বেশি তাড়াতাড়ি আমি হাত তুলেছি আপনার কাছে। এই প্রার্থনা মঞ্জুর হলে আমার যে দুঃখের শেষ থাকবে না!
ষষ্ঠ দৃশ্য
(থিসিয়াস, থেরামেনেস)
থিসিয়াস
থেরামেনেস, আপনি? আমার পুত্র কোথায়? আশৈশব আপনার পরামর্শে বড় হয়েছে সে। কিন্তু আজ কেন আপনাকে অশ্রুসিক্ত দেখি? কোথায় আমার প্রিয় পুত্র?
থেরামেনেস
বড় দেরি করে আজ আপনি সন্তানের প্রতি সদয় হচ্ছেন, মহারাজ, যখন হিপোলিটাস আর নেই।
থিসিয়াস
ঈশ্বর!
থেরামেনেস
প্রভু, আজ মৃত্যু ঘটেছে আমার দেখা সেরা মানবের, যার অপরাধ ছিল নগণ্য।
থিসিয়াস
আমার পুত্র মারা গেছে? কি বলছেন! ঠিক যখন আমি তাকে বুকে টেনে নিতে চাইলাম, তখন দেবতাদের আর ত্বর সইলো না? কোন বজ্রাঘাতে আমি নিঃস্ব হলাম? কি ঘটেছিল তার ভাগ্যে?
থেরামেনেস
আমরা ট্রোজেনের তোরণে পৌঁছতেই দেখি তার রথ চলতে শুরু করেছে। তাকে ঘিরে তারই মত নির্বাক ও গম্ভীর মুখে চলছিল তার সহযোদ্ধারা। চিন্তামগ্ন হয়ে তিনি চলছিলেন মাইসিনা অভিমুখে। তার হাতের লাগাম শিথিল হয়ে পড়েছিল অশ্বদলের পিঠে। প্রভুর কণ্ঠ নিনাদে একদা যে ক্ষিপ্র প্রাণীগুলো বিদ্যুৎ চমকের মত ছুট দিত, আজ তাদের চোখে মুখে ছিল প্রভুর বিষন্ন হৃদয়ের প্রতিফলন। ঠিক তখনই হঠাৎ সমুদ্রের তল থেকে উঠে আসা এক প্রচণ্ড চিৎকারে আকাশের নীরবতা খণ্ড বিখণ্ড হয়; অচিরেই সেই ভয়ানক শব্দের পত্যুত্তরে প্রতিধ্বনী ওঠে পাতালের গভীর থেকে; শব্দের প্রচণ্ডতায় ধমনীতে রক্ত জমাট বেঁধে আমাদের হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়; অশ্বদলের কেশর দাঁড়িয়ে যায়। ঠিক তখনই সমুদ্রের শান্ত বক্ষ থেকে উঠে আসে ফুটন্ত এক তরল পাহাড়। মুহূর্তে শুরু হয়ে যায় প্রকাণ্ড সব ঢেউয়ের তোলপাড়। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মাঝ থেকে উঠে আসে এক রাক্ষস, ঘৃণ্য ক্রোধোন্মত্ত। তার প্রশস্ত কপাল থেকে বেরিয়ে এসেছে মারণাস্ত্রের মত দুই শিং। জলের ঝাটকায় বেরিয়ে আসে আপাদমস্তক হলুদ আঁশে আবৃত একটি দেহ। অর্ধেক ষাঁঢ় আর অর্ধেক ড্রাগনের দেহধারী সেই জন্তু ভয়ানক উগ্র আর আগ্রাসী। রোষের ঘোরে সে তার দীর্ঘ লেজ কুণ্ডলীর পর কুণ্ডলী পাকায়। প্রচণ্ড গর্জনে সে সমগ্র তল্লাট কাঁপিয়ে তোলে; আকাশের বিস্ময় কাটে না; মাটি ভয়ে কাঁপতে থাকে। তার দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাসে বাতাস অবরুদ্ধ হয়ে আসে। বুঝতে কারো দেরি হয় না যে, এর বিরুদ্ধে লড়াই করা বৃথা; ছুটতে ছুটতে এক মন্দিরে গিয়ে সবাই প্রাণে বাঁচে। শুধু হিপেলিটাস সাহস করে তার মুখোমুখি দাঁড়াবার। সে তার অশ্বদলের লাগাম টেনে ধরে এবং লক্ষ্য স্থির করে হাতের বর্শায় পিশাচের সানুদেশ বিদীর্ণ করে। প্রচণ্ড যখমের যন্ত্রণায় আর ক্রোধে প্রকাণ্ড এক লাফে অশ্বদলের ঠিক পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়ে সে; গর্জনে গর্জনে গড়াতে গড়াতে সে তাদের আরো কাছে যায়। তার গলদেশ থেকে বেরিয়ে আসা রক্তে ধোঁয়ায় আর আগুনে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে অশ্বদল। দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে তারা ছুটতে শুরু করে উর্দ্ধশ্বাসে। হিপোলিটাসের আদেশ বা অনুনয়ে তারা তখন বধির। হিপোলিটাস তবু আপ্রাণ চেষ্টা করে তাদের থামাবার। কিন্তু কোনো ফল হয় না। শুধু লাগামের টানে তুপিনের চোটে রক্ত শ্লেষা ঝড়তে থাকে তাদের নাক থেকে। চরম উত্তেজনার মাঝে কেউ কেউ নাকি দেখেছে, কোনো এক দেবতা সানুদেশে আঘাত করে করে অশ্বদলকে আরো বেশি উত্তেজিত করে তুলছিল; ত্রাসে দিশাহারা হয়ে তারা ছুটতে শুরু করে পাথরের উপর দিয়ে। হিপোলিটাস অসহায়ের মত দেখে পাথরের সাথে আঘাতে আঘাতে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায় তার রথ। লাগামের সাথে জড়িয়ে পেচিয়ে সে পড়ে যায়। আমায় ক্ষমা করবেন রাজা। সেই নির্মম দৃশ্য হয়ে থাকলো আমার অশ্রুধারার শেষহীন উৎস। এ আমি কি দেখলাম প্রভু। আপনার ঔরসজাত বীর পুত্রকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই অশ্বেরা যাদের মুখে সে নিজ হাতে আহার দিয়েছে। তার চিৎকারে আশ্বস্ত না হয়ে তারা বরং আরো বেশি করে আতঙ্কিত হয়ে আরো জোরে ছুটতে থাকে। নিমেষেই যেন পুরো দেহটি হয়ে উঠে একটি বড় ক্ষত। আমাদের হাহাকার এখনো প্রতিধ্বনি তুলছে সমগ্র অঞ্চলে। অবশেষে শান্ত হতে হতে অশ্বদল গিয়ে থামে সমাধি স্থলের কাছে যেখানে তার পূর্বপরুষেরা শীতল শয্যায় শায়িত। অশ্রুসিক্ত নয়নে আমি ছুটে যাই তার কাছে। পাথরের গায়ে গায়ে তার রাজকীয় রক্ত স্রোত অনুসরণ করে তার প্রহরীরাও সেখানে আসে। কাছে গিয়ে আমি তার নাম ধরে ডাকি। তার হাত আমার হাত খোঁজে। এক মুহূর্তের জন্য চোখের তার পাতা খুলে আবার বন্ধ হয়ে যায়। সে বলে, “দেবতারা আমার অপাপবিদ্ধ জীবন ছিনিয়ে নিচ্ছেন। আমার প্রিয় ভাগ্যহীনা এরিসিয়াকে রক্ষা করবেন, এই আমার শেষ অনুরোধ। মিত্র আমার, যদি কোনোদিন আমার মিথ্যা অভিযোগকারী পিতা তার ভুল বোঝেন আর পুত্রশোক অনুভব করেন, তাকে বলবেন, অবরুদ্ধ কুমারী এরিসিয়ার প্রতি সদয় হলে আমি আমার বিষন্ন পাতালবাসে একটু স্বস্তি পাব। তিনি যেন ... ” এরপর আর কিছু শোনা যায়নি। আমার হাতে পড়ে থাকে দেবতার রোষে বিদ্ধস্ত এমন একটি দেহ যা তার জন্মদাতা পিতাও চিনতে পারবে না।
থিসিয়াস
হায়, প্রিয় পুত্র আমার, কি নির্বুদ্ধিতায় আমি তোমার জীবন নাশ করলাম! কি নিষ্ঠুরতায় দেবকুল আমার প্রার্থনায় সাড়া দিলেন! আমার চেয়ে বেশি হতভাগ্য আর কে হবে।
থেরামেনেস
তারপর সেখানে আসে সলাজ এরিসিয়া। আপনার ক্রোধানল থেকে বাঁচতে, দেবতাকে স্বাক্ষী মেনে সে চলেছিল হিপোলিটাসের সঙ্গী হতে। সে এলো, এসে দেখলো রক্তে ভাসা তপ্ত ঘাসের প্রান্তরে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে থাকা বিকৃত বিবর্ণ একটি দেহ। তখনো সে জানে না তার কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রিয় পুরুষের প্রিয় দেহ সে চিনে নিতে পারে না। এদিক সেদিক তাকিয়ে সে জানতে চায় হিপোলিটাস কোথায়। অবশেষে সে চিনে ফেলে পড়ে থাকা বস্তুটিকে। শুধু একবার আকাশের দিকে মুখ তুলে সে করুণ অভিযোগের দৃষ্টি হানে দেবগণের উদ্দেশ্যে। তারপর তার মুখ থেকে অসহায় আর্তির শব্দ বেরিয়ে আসতেই সে মূর্চ্ছা যায়; সুমিষ্ট কুমারীর নিষ্প্রাণ দেহ লুটিয়ে পড়ে মৃত প্রেমিকের পায়ে। ইসমিনের চেষ্টায় সে ফিরে আসে জীবনে- যে জীবন শুধু যন্ত্রণার। আর আমি ফিরে এসেছি জীবনের প্রতি পরম বিতৃষ্ণা নিয়ে শুধু একজন বীরের শেষ অনুরোধ পৌঁছে দিতে। কিন্তু দেখুন এদিকেই আসছে সেই বীরের ঘোরতর শত্রু।
সপ্তম দৃশ্য
(থিসিয়াস, ফেইড্রা, থেরামেনেস, পেনোপি, প্রহরীরা)
থিসিয়াস
আচ্ছা তাহলে, রানী, খেলাটায় তুমিই জিতলে; আমার পুত্র এখন আর নেই! কিন্তু হায়, কি যে এক সন্দিগ্ধতায় কাতর আমার বিবেক! সংশয় তোলপাড় করছে আমার হৃদপি- এবং কেবলই মনে হচ্ছে সে ছিল নির্দোষ! কিন্তু, রানী, তোমার শিকার দাবী কর। যেভাবেই হোক, সে তো মৃত। উদ্যাপন কর তার মৃত্যু। আমি আজীবন প্রবঞ্চিত হতে প্রস্তুত। তোমার অভিযোগই সত্য বলে ধরে নেয়া হোক যে, সে ছিল দোষী। তার শোকের ভার এত বেশি যে, তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করার শক্তি আমাতে অবশিষ্ট নেই। এতে আমার কষ্ট শুধু বাড়বেই; সে ফিরে আসবে না। প্রিয় সন্তানের ছিন্ন ভিন্ন দেহের রক্তাক্ত স্মৃতি ভুলতে হলে আমাকে পালাতে হবে ট্রোজেন আর তোমার কাছ থেকে। জানি এই স্মৃতি অভিশাপের মত আমার পিছু নেবে। আমি যদি এই বিশ্বব্রহ্মা- থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম! সব কিছু যেন আমায় আঙুল উঁচিয়ে বলছে তোমার ক্রোধোন্মত্ততাই দায়ী। আমার সুখ্যাতি আমার দুঃখ বয়ে আনলো। বিশ্বজোড়া খ্যাতি যার সে লুকাবে কোথায়? এমনকি দেবগণের আনুকূল্যও আমি ঘৃণা করি। আমার উপর তাদের হন্তারক উপহারের দায় বহন করতে আমি বেরিয়ে পড়বো। আর কোনোদিন বর চেয়ে বিরক্ত করবো না তাদের। তাদের বরে যা আমি হারিয়েছি, তা আর কিছুতেই ফিরে পাওয়া হবে না আমার ।
ফেইড্রা
থিসিয়াস, আমার অনিষ্টকর নীরবতা ভাঙতেই হবে। আপনার নিষ্পাপ পুত্রের পক্ষে বলতেই হচ্ছে যে সে ছিল নির্দোষ।
থিসিয়াস
আহ্, কি অভিশপ্ত এক জনক আমি! তোমার নির্মম মিথ্যাচারে বিশ্বাস করে আমি তার জীবন নাশ করেছি! এমন অপরাধে অপরাধী তোমার কি ক্ষমা হয়?
ফেইড্রা
আমার কথা শুনুন, প্রভু। আমার হাতে সময় খুব কম। আমিই প্রকৃত আপনার রাজকীয় অথচ নির্মোহ পুত্রের প্রতি বাসনা ব্যাকুল হয়েছিলাম। দেবতারা আমার বুকের ভিতর কামনার এক সর্বগ্রাসী আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন। বাকিটুকু করেছে ঘৃণ্য ইনোন। পাছে হিপোলিটাস আমার কদর্য বাসনার কথা আপনাকে জানায়, এই ভেবে, আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, চাতুরী করে সে নিজেই হতে চাইলো প্রথম অভিযোগকারী। এর মূল্য তাকে দিতে হয়েছে। আমার হাত থেকে রক্ষা পেতে সে সাগরের বুকে ঝাঁপ দিল। আমি চেয়েছিলাম সেই তরবারীতে মৃত্যু যে তরবারী আপনার পুত্রের সুচিতার প্রতীক। কিন্তু আমার অনুশোচনার কথা প্রকাশ করে যেতে আমি বেছে নিয়েছি মৃত্যুর অনেক ধীর পথ। মিডিয়া যে বিষ নিয়ে এসেছিল গ্রীসে, আমার জলন্ত শিরাগুলোকে একটু স্বস্তি দিতে আমি পান করেছি সেই বিষ। অদ্ভুত অপরিচিত এক শৈত্য প্রবাহে অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা করেছে আমার হৃদপি-। দৃশ্যমান সব কিছু বর্ণ হারিয়ে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে- আকাশ, পৃথিবী, সঙ্গী সব কিছু ম্রিয়মান; মৃত্যু এসে মাটি ছিটিয়ে আমার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে ...
পেনোপি
প্রভু! তিনি আর নেই।
থিসিয়াস
আহ, আমি যদি পারতাম তার মনের কৃষ্ণ গহ্বরে প্রবেশ করতে! ভুল ভেঙ্গে আমার দৃষ্টি এখন সম্পূর্ণ স্বচ্ছ। আমার অশ্রুধারা মিলিত হোক প্রিয় পুত্রের রক্তধারার সাথে। তাই চলুন, তার খণ্ডিত দেহাবশেষ বুকে তুলে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করি সেই বিভীষিকাময় প্রার্থনার। তার উপযুক্ত সম্মান নিশ্চিত করা হবে। হিপেলিটাসের শান্তিপূর্ণ পাতালবাস কামনায়, আজ এই মুহূর্ত থেকে এরিসিয়াকে নিজ কন্যা বলে গ্রহণ করলাম।
অসিত কুমার : নাট্যজন ও অনুবাদক। সদস্য- ঐকি থিয়েটার, নারায়ণগঞ্জ।