Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গোকুলে বাড়িছে নট-গোপালের দল

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

গ্রুপ থিয়েটারের নাট্যচর্চা যেমন চলছে, তা কি আর ঠিক এভাবে চালিয়ে নেওয়া যাবে?- এই আশঙ্কাটা করছে কেউ কেউ। অনেকেই অবশ্য আমল দিতে চাইছে না ভাবনাটা। তবুও থেকে থেকে উঠছেই কথাটা। মনে হয়, এটা না ভেবে আর উপায় নাই। উট পাখির মতো যতই কেন বালিতে মুখ গুঁজে থাকি : ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে’ ! চোখ খুলে তাই তাকাতেই হবে এবার। বাস্তববিশ্বের মুখোমুখি না হলে চলবে না আর। দিনে দিনে পায়ের নিচের মাটি যাচ্ছে যে সরে। বিশ্ববাজার আর মিডিয়ার এই তান্ডব ভেঙেচুরে দিচ্ছে এ-যাবৎকালের হিসাব নিকাশ যত। ভিতরে ভিতরে একেবারে দেউলিয়া করে ছাড়ছে তা আমাদেরকে। ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ’ তাড়ানোর মরিয়া সেই রোখ আর বুঝি রাখা যাবেই না। মনের সেই জোর নিঃশেষ হয়েই আসছে যেন। স্বপ্ন-কল্পনার কোনো আকাক্সক্ষা-আবেগই আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। জীবিকার বাইরে, উদ্বৃত্ত সময় বাঁচিয়ে এই যে এক জীবনকাজ করে চলছিল নাট্যজন-আদর্শের এক উন্মাদনায়, তার ভিতটাই যেন গেছে ধ্বসে। কিছুতেই আর যেন আসে যায় না কিছু আজ। কোনো কিছুরই আর কোনো মানে দেখি মিলছেই না। একটা কোনো ন্যায়নীতি, রুচির অবলম্বন আর থাকছে না বুঝি। তেমন কিছু হাতড়ে পাওয়া যাচ্ছে না, যা দিয়ে বাঁচার একটা অন্যতর আস্বাদ মেলে। কাজ করে যাওয়ার শক্তি-আনন্দ মেলে।- ‘গেলা গেল, সব গেল। এক এক করে সব যে শেষ হয়ে গেল’।- তাহলে উপায় কী বাঁচনের, নাট্যের? বাজারের, জীবিকার বাইরে কী করে আর চালিয়ে নেওয়া যাবে এই নাট্যচর্চা? কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই যখন অসম্ভব, অবাস্তব হয়ে উঠেছে? অ্যাবসার্ড নাট্যের বিষয় হয়ে উঠছে এই জীবন-অস্তিত্ব-এতদিনকার যত যা কিছু ছিল মানবিক সম্বল? এহেন জীবন ও বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে কী করে চলবে তবে নাট্যচর্চা? তরুণজন বলে কেউ : আবার চাই আরেক মরিয়া রোখ, পাগলামি- যা দিয়ে এতদিনের যা কিছু অর্জন নাট্যের। এই নাকি যৌবনের দায় : জিয়নকাঠির সন্ধান। অথচ, অবশিষ্ট আছে কি কোথাও কোনো যৌবনশক্তি- যে কিনা উদ্ধার করবে রাজকন্যা, প্রাণভোমরা মানবের, শিল্পের নাট্যের?

তবু, তবু বাঁচিতে হবে রে? সন্ধান করে যেতে হবে দুর্মর কোনো বীজকণা।- বাঁচনের উপায় যাতে মেলে।

নাট্যকর্ম হবে কি তার এক মস্ত অবলম্বন? আর তা করতে চাইবে কি অনাগত কোনো প্রজন্ম?

অজান্তে, গোপনে চলছে নাকি তারই সুলুক সন্ধান, আতি পাতি করে পথ-হাতড়ে ফেরা?- তবু বাঁচিতে হবে যে।

অজ্ঞাতবাসের কঠিন আস্তরণের আড়ালে, গোকুলে বাড়ছে হয়তো কোনো বাল-গোপালের দল : একদিন ফুকারি উঠিবে বেলালে! কে জানে কবে, কোন শুভক্ষণে!
জীবনেরে কে রুধিতে পারে!
ধন্য আশা কুহকিনী! তার মায়াজাল ছিন্ন করে সাধ্য কার!
‘তুব আশা, যেন মাতৃভাষা চিরায়ুষ্মতী তন্বী’।

কে জানে, এভাবে ভাবাটাও হয়তো এক ধরণের নাটুকে ভাবালুতাই। আর এমত নাটুকেপনাও কি নয় স্বেচ্ছারচিত এক ফাঁদ কি ফাঁকি- যার আবেশে মজে গড়ে তুলেছিলাম মঞ্চে রঙিন যত ফানুস, চোরাবালুর বাঁধ। ভেবেছিলাম চোখ বুজে এভাবে কাটবে চিরকাল- দায়হীন সহজিয়া রম্যসুখে। কতকগুলো, শব্দ-কল্পনা-বুলির খাঁচায় নিশ্চিন্তে চলবে জীবন। মঞ্চে মঞ্চে তাই বুঝি ইচ্ছাপূরণের এক সাজানো বাগান রচনা করে চলেছিলাম- যেমন কিনা করে সভা-সেমিনারে বক্তা বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ। বাস্তব থেকে চোখ বুজে চলার সেই রন্ধ্রপথে কখন যে কালনাগিনী প্রবেশিয়া সর্বস্বান্ত করে দিল! দেশ-সমাজ-মনেরে বিষে নীল করে ছাড়লো।- আর আমরা অসাড় আবেশ ঘোরে আউড়ে চললাম নাটুকে সংলাপ, না-কি প্রলাপ? কেবল ভুলে থাকতে আর ভোলাতে নিজেদের? লক্ষ্যই করিনি রঙ্গমঞ্চ ফাঁকা, কোনো দর্শক আর বসে নেই আমাদের সেই টিনের তলোয়ারে রাজা-উযির মারার পাতানো খেলা দেখতে। তাদের টেনে নিয়ে গেছে ততদিনে রঙ্গিলা বাজারসুন্দরীরা; মিডিয়া-মায়ায় আমরাও তো হয়েছি তার কৃতার্থ দোহার: সমানে করে চলেছি ছোট পর্দায় নর্তনকুর্দন- মুখে রঙকালিঝুলি মেখে। সারাদিন, সারামাস, কেউবা বছর শেষে ফিরেছি মঞ্চে- ততদিনে দর্শক আমাদেরই বাম হাতের চোরাপথে যোগানো মিডিয়া-চোলাই-মদে বেঁহুশ, দিশেহারা। মঞ্চের নান্দনিক বিপ্লবী ভানে আর ফিরছে না, মজছে না তারা। আর আমরা তাই রেগে টং- কেন দর্শক উজাড় হলো মিলনায়তন থেকে। একবারও নিজের দিকে ফিরে ভেবে দেখিনি, তার আগে যে উধাও উজাড় হয়েছে আমাদেরই প্রাণমনসত্তা, তার যত রুচিনীতি। মুখে দিয়েছি বটে জীবিকা বা গণমাধ্যমের হাজার অজুহাত।- খ্যাতি প্রতিপত্তি যার দৌলতে মিলেছে, যত-যা কিছু নাম যশ অর্থ। নুন খেয়ে তার গুণ গাওয়ার সাহসও কিন্তু কারোই হয়নি।- মনে নিশ্চয় এই জ্ঞান না মেনে উপায় ছিল না: মঞ্চই কিন্তু এসকল প্রাপ্তির ভিত্তিভূমি; তাকে সিঁড়ি করেই যা-কিছু অর্জন, লাভালাভ।- যেমন ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির পুঁজি ভাঙিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষমতাবাজির চক্রবৃদ্ধি মুনাফা; যেমন দারিদ্র ভাঙিয়ে বৈদেশিক ঋণ-ভিক্ষা। আর তা লুটপাটের স্বাধীনতালাভ। চরে বেড়ানোর দারুণ এক উপনিবেশভূমি মিলেছে যে- প্রতিযোগিতাহীন এক অভয় অরণ্য : কে বলে মুক্তিযুদ্ধে কোনো ফল ফলেনি, মওকা মেলেনি কত শত কত মতো? কেউ আর আজ তাই কারো মায়া কি মড়াকান্নায় কান দেবে না, কুমিরের কোনো মায়ের পুত্রশোকে।- ‘কে দেবে ধিক্কার কাকে আজ’? সারাদেশে, চতুর্দিকে যত অবান্তর, উন্মাদ বিলাসী খেলা/নরকেরও ব্যঙ্গচিত্র, মৃত্যুরও বিকার।’

‘আমরা নরকে আছি অথচ সে জ্ঞান নেই মনে।’

‘আশা নেই, অথবা তা এতই কম যে কোনো নিরাশাও নেই, চৈতন্যে মড়ক।’

তাহলে উপায়? এইবার কি বা করে নবনাট্যজন?

এই যে এত বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত নাট্যজন তাদের তবে কি হবে? কোথায় কাজ করবে তারা, প্রয়োগ করবে আহৃত যত শিক্ষাজ্ঞান? কেবলি মিডিয়া-খাঁই মেটোনোই হবে কি তাদের অমোঘ অনিবার্য নিয়তি? তবে কজন আর সেই জুয়ায় লটারি জিতবে? সেখানে তো দরকারও নেই কোনো শিক্ষা চর্চা অনুশীলন। মডেলিং আর ফটোসুন্দরীই তো সর্বশিল্পপটিয়সী; মুখ আর শরীর ছাড়া অন্যকিছু না হলেও চলবে; বরং বাধা আর বিপত্তি ঘটাবে যদি থাকে কারো রুচিনীতিবুদ্ধি কিংবা নাট্যনন্দন শিক্ষাচর্চা। নারীর শরীর, ছেনালি আর নপুংশকের ভাঁড়ামি বিকার আজ একমাত্র কাঁচামাল বাজার বিশ্বের; চ্যানেলে চ্যানেলে মিডিয়ায় দোহন চলছে তাই ভোগের কামধেনু। অন্য কোনোরকম শিক্ষাদীক্ষার মার্কেটভ্যালু নাই যে তাই।

আর তাই নিয়ে এইসব লেখালেখির মানে কী? কুড়িয়ে কাড়িয়ে গাঁটের পয়সায় ‘থিয়েটাওয়ালা’ কেন করা? তা দিয়ে কী হয়, কে পড়ে এসব? নাট্যজনদের এসব পড়ার সময় কই? রিহার্সেলের সময় ম্যানেজ করতেই হিমসিম বেচারারা। কারো কাছে তাই মুখ রাখা যাচ্ছে না, চোখে চোখ রাখা যাচ্ছে না; কে আর কাকে কী আর বলবে! সেই মুখ কি আর আছে কারো অথবা সেই চোখ যে তাকাবে কেউ কারো দিকে: ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’।- তাই ন্যাংটার নেই আজ আর কোনোই বাটপারের ভয়।

তাই কেন এই থিয়েটারওয়ালা; স্পন্সর ছাড়া কতদিন চলবে উটকো এই পুরনো ফর্মের মেলোড্রামা? কে আর পুঁছে ব্যাকডেটেড এই সব বস্তাপচা বাতিক? এখন চাই হাইব্রিড কোনো ক্রসকালচারাল ফার্টিলাইজার- তার জন্য চাই ‘বাবু’, মাল্টিন্যাশনাল স্পন্সর। ইহা উত্তরাধুনিক যুগ। টেকনোলজি আর মার্কেটের এই বাজারবিশ্ব মুক্তমনুষ্যত্ব পণ্যপ্রজন্ম এক প্রজাতির জন্ম দিয়েছে; নতুন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। পুরনো কোনো ভাঙারেকর্ডের ঘ্যানঘ্যানানি আর চলবে না। এ্যাডফিল্ম আর ব্যান্ডমিউজিক এই হলো ট্রেন্ডমার্কার নবোদ্ভিন্ন এই মানসের। তার তো সর্বক্ষণ ভুলে থাকতে হয়, বিশ্বজোড়া সর্বস্বনাশা এই যে তান্ডব মাতম চলছে। মোকাবিলা করতে হয় কী করে হজম করবে, মাথা ঠিক রাখবে রোজকার পত্রপত্রিকা মিডিয়া মারফত প্রাপ্ত তাবৎ প্রলয়নিনাদ। এতদিনের বিবর্তনধারায় কতক মানববৃত্তি আজো যে অবশিষ্ট আছে- সেগুলোর একেবারে উন্মুলন উৎসাদন উৎপাটনের আগ পর্যন্ত নিস্তার নাই যে স্নাযুমণ্ডলী সম্পূর্ণ নিঃসাড়, বিবশ আজো যে নয়।

‘যদিও অভুক্ত, অসুস্থ, কাটা, পঙ্গু/শত শত স্নায়ু, স্নায়ুকোষ/’ মুণ্ডু কবন্ধের জনসংখ্যা যে হারে বেড়েই চলেছে, তাতে আশা হয় সংকটকাল আর বেশিদিন নেই; নির্বাণের চিরশান্তি পারাবার আসন্ন প্রায়: মানবিক কোনো সত্তাসংকট থেকে স্থায়ী নিষ্ক্রান্তি তাতে ঘটবে। ওম্ শান্তি ওম্ স্বস্তি, ওম্ নির্বেদ।

তবু তার আগে করার কি নেই কিছুই? কিছুই কি নেই বাকি? এমন কথাওতো বলছে নবীন প্রজন্মের কেউ কেউ: পূর্বপ্রজন্ম যা করার করেছে, নির্মাণ থেকে নাট্যচর্চা এই এতদূর নিয়ে এসেছে, কম তো নয় সে সাফল্য। এবার আমাদের তার দায় নিতে হবে, কেবল অভিযোগ করে আর পার মিলবে না।

হ্যাঁ, এই বুঝি বাঁচন পন্থা- নিজেদের দায় নিজেদেরই মাথায় নিতে হবে। নতুন দল, নবীন নাট্যজনদেরই তা করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত দল-নেতৃত্বের মুখ চেয়ে থাকলে আর চলবে না। সেই একাত্তরের মতই যার যা আছে তাই নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে ভিতরবাইরের বহুরূপী যত শত্রুর। কোনো আদর্শনীতির ঘোষণায় কেবল কাজ হবে না। ভাল নাটক আর তার দর্শক কী করে হাজির করা যায় কোন কোন মঞ্চে, আরো কোথায় কোথায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল মহিলা সমিতি বাঁচাতে পারবে না। মঞ্চ নাই, মঞ্চ চাই বলে নাকিকান্না ছাড়তে হবে। এযাবৎ যা কিছু করা হয়েছে তা কোনো আবেদন নিবেদনের ফল ছিল না। যৌবনটা চলে গিয়ে একটু প্রতিষ্ঠা পেলেই ওসব শুরু হয়; নিজের কাজ নিজের না করে অন্যের দুয়ারে দুয়ারে ধন্বা দেওয়া আর অন্য ধান্দা বাগানো; ক্ষমতার পরিচিত খেলায় নেমে পড়া; এসব অনেক দেখা গেছে।

এবার দেখা যাক কী কী সব চেষ্টা চলছে। তার সব খোঁজ তো রাখিও না, গোপন সংগ্রামের কথা তো ওভাবে চোখে পড়েও না, ফল ফললে তবে তার দেখা মেলে। নিশ্চয় কত কত সব হচ্ছে,- কিছু কিছু তার চোখেও পড়ে। কানেও আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলায় শিক্ষিত সাইদুর শুনেছি কিছুদিন ধরে যাচ্ছে আহসান মঞ্জিল আর লালবাগ কেল্লার কর্তাদের কাছে : ওখানে দর্শনার্থীদের সামনে কিছু করা যায় কিনা নিয়মিত। শিশুপার্কেও খোঁজ করছে। সঙ্গে তার নাট্যশিক্ষার্থীর দল: তাদের তো জীবনমরণের প্রশ্ন এটা- সৌখিন মেজাজ তো তাদের পোষাবে না। সাইদুর মিডিয়া বা অন্য কোনো চাকুরি চায় না। এখনও পর্যন্ত যাকে বলে লড়ে যাচ্ছে। ফেডারেশনের পক্ষ থেকে কর্মশালা আর প্রযোজনা করে চলেছে জেলায় জেলায়। এই হলো যৌবনের চেনা তাকদ।

চিরনবীন আশিস খন্দকার হয় নাই আজো রণক্লান্ত। সমানে চলছে তার ছোট দলের নানা রকম কাজ। অন্যদলেও করছে কাজ যদিও পরিবেশ থিয়েটার অনেকদিন করে উঠতে পারেনি। তবু তার রোখ মরিয়া, তাগড়া তরুণতুর্কী তেজে। দুঃখ এই, দর্শক তার তীব্র প্রবল জ্যান্ত অভিনয়ের দাপট দেখার সুযোগ পায় না সবসময়। এই তো সেদিন তবু গ্যেটে ইনস্টিটিউটে তার নতুন নাটকে খাপ-খোলা-তলোয়ারের মতো ঝলসানো অভিনয় দেখা গেল। মিডিয়া-মঞ্চের প্রচলিত নপুংশকতার মধ্যে এই বীর্যবত্তার জুড়ি মেলে না। সাবাস নওজোয়ান।

‘পালাকার’ বলে নতুন এক দল ইস্কাটনের ছোট ঘরে প্রতি শুক্রবার নাটক করে চলেছে। এই দলের আমিনুর রহমান মুকুল তো নাট্যরচনা, নির্দেশনায় প্রায় মঞ্চতারকা। তার ‘তাইর আলীর বুকে মিজু মুন্সির পাও’ নাটকটি পথনাটকের প্রকৃত সংজ্ঞাই নির্মাণ করেছে যেন- কি রচনা কি রূপায়ণে। খিস্তি খেউর চটুলতার অসাধু অক্ষমতার নাম হয়ে উঠেছিল যেখানে পথনাটক তার চরিত্র পাল্টে দিয়ে একালের জটিল বাস্তবের যোগ্য নান্দনিকতায় উত্তীর্ণ করেছে। একে প্রায় ঐতিহাসিক কীর্তি বলা চলে। চট্টগ্রাম-সহ অন্যত্রও রূপায়ণ করে চলেছে সে প্রযোজনা। নাহিদও নাট্যকলা শিক্ষায় তার মেধাবী কৃতিত্বের মর্যাদা রক্ষা করে চলেছে নানা দলে নানা নাটকে। নাট্যকলায় শিক্ষিত আরেক নাট্যজন জসীম। পাশ করার পর থেকে বসে নেই। যখন যেখানে সুযোগ পাচ্ছে করে যাচ্ছে নাটক। শিল্পকলার চাকুরি করেও এখন কতটা কি করতে পারে দেখা যাক। হাল নিশ্চয় ছাড়েনি সে।

দলের কাজের বাইরেও আরো আরো প্রযোজনা করে চলেছে ফয়েজ জহির। ‘তীর্থঙ্কর’ নাটকের প্রয়োগ রূপায়ণ তার অক্ষুণ্ন যৌবনের সাক্ষ্য দেয়। নাট্যের পরিচ্ছন্ন নন্দন তার কাজে দেখা যায়। রাজশাহীর অনুশীলন প্রযোজিত ‘বহে প্রান্তজন নাটকেও তার এই সৃজনবেগ অমলিন।

কামালউদ্দিন কবিরের তারুণ্য আজো অটুট। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে ফিরছে সে। সৌম্যশান্ত মূর্তির আড়ালে রক্ষা করে চলেছে নান্দনিক সততার এক রোখ, স্পর্ধা। নানা দলে মঞ্চসজ্জা আর নির্দেশনার কাজ করছে দেশজুড়ে। ‘গল্প থিয়েটার’ নামে বর্ণনাত্মক পরিবেশনারীতির নবীননিরীক্ষায় একাগ্র সে। অথচ জীবিকার বেকারত্ব এতদিনেও পুরো ঘোচেনি তার। যদিও সে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অনার্স-মাষ্টার্সের সবচেয়ে মেধাবীজন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্বে অনার্স আর বরোদায় পিএইচডি-করা চঞ্চল নারায়ণগঞ্জের ‘ঐকিক থিয়েটার’- এ বছরখানেক ধরে অভিনব পদ্ধতিতে তৈরি করেছে ‘অন্তর্যাত্রা’। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় বড় বাস পাঠিয়েও জনাকয়েক মাত্র নাট্যজনকে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পেরেছে সে নাটক। সবাই রোমাঞ্চিত, অভিভূত। চঞ্চল, যেখানে যতজনকে পায় নিয়ে করে চলেছে নাটক। ঐকিক থিয়েটার-এর অসিত কুমার করেছে উৎপল দত্তের ‘ঠিকানা’। কামালউদ্দিন কবির এদলে করেছে বদরুজ্জামান আলমগীরের ‘পুণ্যাহ’। চট্টগ্রামের কুন্তল বড়য়ার ‘বৃত্তের বাইরে’ স্বাভাবিকরীতির অভিনয়ের সেরা এক প্রযোজনা। সে নাটকে উদাসের অভিনয়ের সমমান ঢাকার মঞ্চে তেমন দেখিনি। কুন্তলের ‘খেলাঘর’ অবশ্য রূপান্তর ও অভিনয়রীতিতে তার পূর্বকার অর্জন ধরে রাখতে পারেনি। তবু সে করে চলেছে একের পর এক কাজ। চট্টগ্রামের লিটনের সাম্পানওয়ালা ভালো প্রযোজনা। ইকবাল হায়দার ও তার দল আজ প্রতিষ্ঠিত, তাই তাঁদের কাজের কথা তুললাম না। অলোক বসু লিখে চলেছে একের পর এক নাটক। তার নিজের দলের নতুন নাটক ‘অতীশদীপঙ্কর সপর্যা’-নামেই তো সম্ভ্রম জাগায় এই নির্বাচন। রচনা আর নির্দেশনার মান কিংবা সাফল্য তো পরের কথা। এমন যে ভাবতে পেরেছে, করতে পেরেছে সেওকি কম কথা। যেমন কিনা দৃশ্যপটের ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’ রূপায়ণের সাহস। আর তাতে আলী মাহমুদের অভিনয়ও ছিল মরুভূমিতে জলছত্রের মতো। বিশ্বদার্শনিকের আর্কেটাইপকে মঞ্চে ঠিক এতটা রূপ দেওয়া বিস্ময়কর। যখন কিনা দেশ, সমাজ, বিশ্ব নির্মণন, মেধানাশে মরিয়া। আমাদের আরজ আলীও যেখানে ঢাকার মঞ্চে খ-িত ; নাট্যকার-নির্দেশকের ভয়ার্ত রূপায়ণে- মৌলবাদ এই মারে কি সেই মারে। তাহলে কেনই বা আরজ করা। রাজশাহীর মলয় ভৌমিক আর তার ‘অনুশীলন’ নিয়মিত আক্রান্ত- প্রহৃত হয়েও করে যাচ্ছে নাটক। এওকি কম কথা! যৌবন তার আজো নিঃশেষিত না- একথা জোর দিয়েই বলা যায়।

জাহিদ রিপন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যতত্ত্বে এমএ করে ফরিদপুর থিয়েটারে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকায় করেছে ‘স্বপ্নদল’ নামে আরেকটি নাট্যদল। বর্ণনাত্মক দেশজরীতির এক আধুনিকতার সন্ধান করছে সে। ‘কাজলরেখা’, ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ তাদের ভালো কাজ। দেশের নানা জায়গায় তার অভিনয় হয়েছে।

দেশজুড়ে আরো কত যে কাজ চলছে নতুন-পুরাতন দলের তার সবতো জানিও না। তাছাড়া প্রতিষ্ঠিতদের নাম তো করতে চাইছিও না। তারা ভালোমন্দে তবুতো করেই চলেছেন নাটক-উৎসব। তারও ম্যূল্য তো আছেই।

বরিশালের ‘শব্দাবলী’ ছোট এক গুদামঘরে স্টুডিও থিয়েটার করে। বাইরে থেকে নির্দেশক নিয়ে গিয়ে একের পর এক কাজ করে চলেছে। ‘গুনাইবিবি’, ‘শিলারি’ আমরা ঢাকায়ও দেখেছি।

বগুড়া থিয়েটার আর তার নির্দেশক-নাট্যকার ময়নার ‘কথা পুন্ড্রবর্ধন’ তো বলবার মতো উচ্চাভিলাষী প্রযোজনা- যদিও তার নির্দেশক স্বয়ং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। তবুওতো লিখেছে-ভেবেছে ময়না, তবেই না বাচ্চুভাই রাজি হয়েছেন তার রূপায়ণে।

কুষ্টিয়ার ‘বোধন’ আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। নবীন নাট্যকার সাইমন জাকারিয়া আর আর নির্দেশকজুটি সাইদুর ‘শুরু করি ভূমির নামে’ করে আমাদের মুগ্ধ করেছেন। ‘কমলারাণীর সাগরদীঘি’র নাগরিক নবীন গায়েন লিপন তো আজ মঞ্চতারকা বিশেষ। পদকের পর পদক পেয়ে চলেছে। ইসলামউদ্দিন পালাকার আর জামিল আহমেদের শিক্ষা কি আর ব্যর্থ হতে পারে। দুইগুরুর নাম রেখেছে সে। কুষ্টিয়ার বয়োজ্যেষ্ঠ আলী আফরোজ পিনু অনেকদিন পরে তার দল ‘বোধন’ এ নতুন নাটক করেছে, শুনেছি ভালো করেছে। কচি খন্দকার নড়াইলে দশক ধরে করে চলেছে নাটক। তাদের ‘ঐতিহ্য ও কিছু প্রশ্ন’ ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগরে দেখেছি। সবমিলে ভিন্ন এক মেজাজ। দেশনাটক আর মাসুম রেজা তো প্রতিষ্ঠিত দল, নাট্যকার; তবু বলতে হয় ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকে দীলিপের অভিনয়, রচনা-কুশলতার সমমানসম্পন্ন। মঞ্চে করেই তারকা সে আজ।

এসবই তবু সত্যের খণ্ড বয়ান- আরো কত কত না থাকলে একনিঃশ্বাসে এতসব কাজের কথা মনে পড়ে গেল কেন লিখতে বসেই। আরো সব খবর অন্যেরা লিখুন। বাজারী পত্রিকায় সে সব না ছাপা হলেও থিয়েটারওয়ালা’ কী ‘থিয়েটার ফ্রন্টলাইন’ নিশ্চয় ছাপবে। তাদের তো আর বাজার ধরতে হয় না; পয়সা খরচা করে অনিয়মিত হলেও বের করে চলেছে পত্রিকা। থিয়েটার ফ্রন্টলাইন তো একের পর এক সেমিনার আয়োজন করে চলেছে দুই বাংলার নাট্যজনদের এনে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর সিলেট, ঢাকা কলকাতায়ও তারা করতে চায় নাট্যচর্চার এহেন দশার সুলুক সন্ধান।

সিলেটের ছেলে রতন দেব ঢাকার উদীচীর অভিনেতা। ‘বৌ বসন্তি’ নাটকে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ফরিদপুর কর্মশালা-প্রযোজনায় তার নাটক ‘হন্তারক’ রূপায়ণ করেছে কামালউদ্দিন কবির। মঞ্চে কোরিওগ্রাফির ক্যারিশমা ছেড়ে কবির স্বল্প উপকরণ অভিনেতৃদের পারস্পরিক চলাফেরা, বাচনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় নাট্যক্রিয়ার চলচ্ছবিতে গড়ে তুলেছে এ নাট্যের ভাষা ও তার ভাষ্য। রূপায়িত হয়েছে তাতে নাট্যবস্তুর নানা স্তর-মাত্রা। নবীন নাট্যকার তার প্রথম নাটকেই রিয়ালিটির কয়েক স্তর-মাত্রা যেভাবে ধরেছে তাতে আশা জাগে : হয়তো এভাবে ক্রমে অভিনেতৃ ও দর্শক দুদল মিলে একত্রে মুখোমুখি হবে জীবনের জটিলজালের। কীভাবে কেমন করে বাঁচছি আমরা আর হয়ে উঠছি কেমনতর প্রাণি-প্রজাতি বিশেষ তার আত্মরূপদর্শন ঘটতে থাকবে তাতে। কেবলি পালিয়ে, লুকিয়ে, ভুলিয়ে বেড়াবো না মঞ্চের সাজানো বানানো নান্দনিক ঘেরাটোপে। দেখবো জীবন খুলে খুলে মুখোশ, খুঁড়ে তুলবো হারানো খোয়ানো মানব মুখছবি। এপথেই নাট্য রূপায়ণ করে চলবে বিশ্বরূপ বিরূপ দর্শন। অনেকান্ত ক্রমসৃজ্যমান সত্যের সমগ্র আদল।

সত্যি বটে ‘মরিয়াও মরে না রাম’- কেউ তাদের দাবায় রাখতে পারে না শেষ পর্যন্ত। কংসের অন্ধকারাগৃহে গোকুলে বাড়তেই থাকে নবপ্রাণবীজ, প্রাণভোমরা।- জিয়নকাঠির সন্ধান তাহলে চিরঅফুরান- যতক্ষণ জ্ঞান জান ততক্ষণ গান।- ইহা মানব ইহা যৌবন।- রঞ্জনের প্রতীক্ষায় তাই চির নন্দিনী।

তবু ঘোর এই অমানিশা কাটে না যে। সহজ কোনো পথ নেইও নিশ্চয়। গোটা দেশ-বিশ্বের ইতিহাসের সঙ্গেই সম্পর্কিত বিষয়টি। কেবল কোনো সদিচ্ছা বা ভাবাবেগ ভাবালুতা বাঁচাবে না। যা হবার হবে। হয়ে উঠবে। বাড়তি কোনো স্বপ্নকল্পনায় ফল নেই। কাজ যে যতটা যেভাবে করতে পারে করবে, পারবে। কোনো ঔচিত্য বা নীতিকথায় ফল হবে না। তাতে কেবল নিজেকে আর অপরকে হয়তো ভোলানো যাবে। শেষ পর্যন্ত তাতে শক্তিক্ষয়ই হবে। কোনো কাজে ঠিক লাগবে না। যাতে কেবল হতে থাকবো, হয়ে উঠবো, ছোট যত করতে থাকবো একে অপরকে।

বাস্তবের, সত্যের সমগ্রতার মুখোমুখি হওয়া চাই দিনে দিনে শান্ত মনে। তাকেই তো রূপায়ণ করতে হবে নাট্যে। পালিয়ে কোনো খণ্ড সত্যের কল্পলোক তৈরি করায় মাহাত্ম্য নেই। সত্য তাতে থাকেও না। মিথ্যার চোরাগলিতে নিয়ে ছাড়ে। কতকগুলো অভ্যস্ত নীতিকথার আদর্শে দেশসমাজ বিচার করলে ভুল হবে, মহাভুল। তাই কিন্তু করে চলেছিলাম নীতি, রাজনীতি সততার নামে। সেটা অবশ্য ছিল বিপ্লবী বুলি মাত্র। যা কেবল মঞ্চে ঘোষণা দেয়া যায় কিছু করতে হয় না। তাই ছিল।

তবু আমরা যা, যা করতে পেরেছি, করছি বা করতে চাই তার মর্যাদাটা বুঝে নেওয়া চাই। এই যে, বিদেশীরা বুঝেই উঠতে পারে না, অর্থ বা জীবিকা ছাড়া কেউ কিছু করে কী করে! এতদিন ধরে, এতজন মিলে কী করে তা করে চলে! এখানেই আমাদের সভ্যতার, সমাজ-সংস্কৃতির তুলনারহিত মাহাত্ম্য। এই যে প্রাচ্য বা ভারতমহাদেশীয় বলে একটি ব্যাপারকে অন্যেরা সমীহ করে, সেটা এজন্যই। একটা ধ্যানের, সাধনার, কৃচ্ছ্রতার ত্যাগময় ব্রত সেই কতকাল ধরে আমাদের জীবনধর্ম। মহত্তম মানবকৃতি। সমাজ রাজনীতি, শিল্পে-সংস্কৃতিতে আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে রক্তে বহন করে চলেছি তা। সেই আমাদের পরম ধন, প্রজ্ঞাপারমিতা। ব্যক্তি সর্বস্বতা উত্তীর্ণ হয়ে সমাজ-সমগ্রে, মানবে উত্তীর্ণ হওয়া যার মৌল অভীপ্সা, অন্বিষ্ট।

অথচ উপনিবেশসূত্রে এমন এক রাষ্ট্র-দেশ আমাদের ওপর চেপে বসেছে তাতে নাস্তানাবুদ আমাদের সেই মানস সত্তাস্বরূপ। কিছুতেই রক্ষা করা যাচ্ছে না সেই আমাদের নিজস্ব, একান্ত স্বভাবধন, মানস-এষণা। জীবনের নীতিদর্শন এই বিরূপ বিশ্বে, ক্ষমতার নীতি- বাজারের দোর্দণ্ড প্রতাপে, কেবলি ভেঙেচুড়ে ধ্বসে যাচ্ছে। একে ছাড়তে পারছি না আবার ধরে রাখতেও ঠিক পারছি না। একেবারে ছেড়ে দিলে আমরা যে আর আমরা থাকি না। আবার তা ধরে রাখার, এগিয়ে নেয়ার বাস্তববুদ্ধি করে ওঠা যাচ্ছে না। সেটা নিশ্চয় দিনে দিনে আজ অসম্ভব হয়ে উঠছে। এই ন্যায়নীতি, স্বপ্নআদর্শহীন বাজারবিশ্বে মানবের শ্রেষ্ঠতর শ্রেয়োনীতি, জীবনের দর্শন-নন্দনের পরাকাষ্ঠা, তার অমন আমলধবল মহিমা কী করে যে রক্ষা পাবে! মনুষ্যত্বের, সভ্যতার আজ এই এক মৌলসংকট। মানবের এযাবৎকালের শ্রেষ্ঠঅর্জন আর ধরে রাখা যাচ্ছেই না।

আবিশ্বগ্রাসী এই সর্বনাশা তাণ্ডবনাট্যের মুখোমুখি নবীন নাট্যজন অভিমন্যুর মতই উদভ্রান্ত, দিশাহারা। ট্র্যাজিক বীরের মর্যাদা যেন সে রাখতে পারে ; হারজিৎও যেখানে তুচ্ছ হয়ে যায়।

বিপ্লব বালা : নাট্যকার, নির্দেশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সংগীত বিভাগের শিক্ষক