Full premium theme for CMS
পিছিয়ে-পড়া লড়াই, লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়া
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
বাংলাদেশের জনগণ আরেকটি রুটিন মাফিক কাজ সেরে ফেললো। এই কাজটি একদশক আগেও রুটিন মাফিক হতো না। ইদানিং হচ্ছে। ১৯৯১ এর পূর্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো ঠিক ঠিকানা ছিলো না। হঠাৎ করেই ক্ষমতাসীন সরকার যখন নিজেকে খানিকা অবৈধ ভাবতো, তখনই একটি নির্বাচন দিয়ে নিজেকে বৈধ করে নিতো। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন বৈধ উপায়ে অবৈধতাকে বৈধ করা হয়। আগে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হতো না, এখন হয়। অশান্তিতে থাকা জনগণ শান্তি চায়, ‘সুষ্ঠু’ কিংবা ‘নিরপেক্ষ’ ব্যাপারে তাদের মাথা ব্যথা নেই। প্রার্থীর ‘নির্বাচনী ব্যয়’, ‘আদর্শ’ কিংবা ‘চেতনা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর, দেশে ‘শান্তি’ আসলেই হলো।
বাংলাদেশের জনগণ ‘সংগ্রাম প্রিয়’। তারা সংগ্রাম করতে ভালোবাসে। সংগ্রাম করে অনেক কিছু অর্জন করেছে। নিজস্ব ভাষা পেয়েছে, স্বাধীন একটা দেশ পেয়েছে, স্বৈরাচারকে নিপাত করেছে- আরো কত কী! কিন্তু এসব অর্জনের কোনোটাকেই দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখার ব্যাপারে সচেতনতা দেখাতে পারেনি। সচেতনতা যদি দেখাতেই পারতো, তাহলে ভাষার অধিকারের পর শাসক শ্রেণীকে বোঝানো গেলো না কেনো যে, আমাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটা নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে? তারপর আসলো স্বাধীনতা। স্বাধীনতার কিছুদিন পরই কেনো সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়া হলো? মুক্তিযুদ্ধে প্রাপ্ত স্বাধীন দেশে কেনো সামরিক শাসনকে ‘আমন্ত্রণ’ জানানো হলো এবং তাকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়া হলো? এক সামরিক সরকারকে জাতীয়তাবাদী বলে পরবর্তী সময়ে আরেক সামরিক সরকারকে কেনো স্বৈরাচারী বলে অভিহিত করা হলো? সেই স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাতের পর আস্থাভাজন অস্থায়ী সরকারকে স্বাগত জানিয়ে মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় কেনো আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় এতো ঘাম ঝরাতে হলো? আস্থাহীন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আনার জন্য ‘আস্থাবান’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিই বা এখন এতো অনাস্থা কেনো? এসব প্রশ্ন থেকে মনে হওয়াই স্বাভাবিক, আমরা আসলে ‘সংগ্রাম প্রিয়’ জাতি। ‘সংগ্রামী’ জাতি সংগ্রাম ক’রে জাতির উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটায়, আর ‘সংগ্রাম প্রিয়’ জাতি সংগ্রাম ক’রে ক’রে সময় কাটায়। বেকার যুবক শ্রেণী যেমন অলস আড্ডায় সময় কাটায়, স্বপ্নহীন বাংলাদেশের জনগণও তেমনি সংগ্রাম ক’রে ক’রে সময় কাটাচ্ছে। কয়েক বছর পর পর চক্রাকারে আমরা সংগ্রাম ক’রে ক’রে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি। তাই বলছি, আগামী পাঁচ বছর সময় কাটানোর জন্য আমরা রুটিন মাফিক একটি কাজ সেরে ফেললাম।
সরকার যখন দেশের জনগণকে আধুনিক সুযোগ সুবিধা তথা অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে অপারগ কিংবা ব্যর্থ হয়, তখন তারা চায় ক্লিশে হয়ে যাওয়া বিভিন্ন সমস্যা রাষ্ট্রে সতেজ থাকুক। ঐসব ক্লিশে সমস্যার সমাধানে অর্থনৈতিক মুক্তি নেই, কিন্তু সমস্যাগুলো জিইয়ে রাখতে পারলে জনগণকে একটি ভাবের মধ্যে রাখা যায় এবং ঐ ভাবের মধ্যে থেকে জনগণ শাসকের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে ব্যর্থ হয়, ফলে জনগণ শোষককে বন্ধু ভেবে ভুল করে। এ কথা সত্য, আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটিকে সবাই ‘মেনে’ নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু অনেকেই ‘মনে’ নিতে পারিনি। ‘মনে’ নিতে না পারাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরাজয় ‘মনে’ নেয়া কষ্টের বৈকি। এই কষ্ট অন্যের শান্তি বিঘ্নিত করতে উদ্বুদ্ধ করে। এজন্যেই প্রথম কর্তব্য দাঁড়ায়, ‘কষ্ট পাওয়া’ মানুষগুলোকে শাস্তি দিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদেরকে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যখন দেশীয় পরাজিত শক্রকে শাস্তি না দিয়ে বরং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হলো, তখনই ঘটলো বিপত্তি। শক্রই আমাদের চলার সাথী হয়ে রইলো। কিন্তু বিগত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে (অবশ্যই ’৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর থেকে) এই শত্রু-মিত্র খেলা খেলতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা, রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি শব্দগুলো বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে এই শব্দগুলো অত্যন্ত ক্লিশে হয়ে গেছে। ক্লিশে শব্দের প্রধান অসুবিধা হলো কথন ও শ্রবণে শব্দগুলোর যথার্থ অনুভূতি প্রকাশ পায় না। আর যথার্থ অনুভূতি প্রকাশ না পাওয়ায় আজ, স্বাধীনতার এই তিন দশক অতিক্রমের পর- স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি শব্দ ও বিষয়গুলো হাস্যকর হয়ে একাকার হয়ে গেছে। এবং এই একাকার হয়ে যাওয়ার সর্বশেষ বাস্তবতা হলো মুক্তিযুদ্ধের বীর বিক্রম আর ‘বীর’ শক্রদের একই মসনদে আসন গ্রহণ (এই আসন গ্রহণ কেবল ‘মেনে’ নেয়া হয়নি, ‘মনে’ও নেয়া হয়েছে)। এই বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ছাড়া অন্য কিছু নয়। এর জন্য দায়ী যেমন প্রত্যক্ষ মদদদানকারী, ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের ইসলামী উম্মাহর শক্তি এবং অতি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘ব্যবহারকারী’ স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি (মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘ব্যবহারকারীরা’ স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি হয় কি না, তা অবশ্য বিবেচনার দাবী রাখে), যারা বিগত পঁচিশটি বছর সচেতনভাবে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ সমস্যাটিকে জিইয়ে রেখেছে। এখন প্রসঙ্গ উঠছে এই বলে যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি বলে কিছু নেই। এসব হচ্ছে জাতিকে বিভক্ত করার পাঁয়তারা। খুবই সত্যি কথা, পক্ষ-বিপক্ষ দুই শক্তিতো আর এক সাথে মসনদে যাবে না। মসনদে যারা যাবে তারা একটিই শক্তি; তা পক্ষই হোক আর বিপক্ষই হোক। এই পক্ষ-বিপক্ষের সমস্যাটা যারা জিইয়ে রেখেছিলো, তাদের উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। সমস্যাটা না থাকলে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি হয় না। আর ইস্যু না থাকলে আন্দোলন হবে কী দিয়ে? জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তি না হয় নাই দিলাম, কিন্তু আন্দোলন উপহার দেব না, সংগ্রাম উপহার দেব না, তা কি হয়? তাহলে জনগণের সময় কাটবে কী নিয়ে? সময় কাটাতে কাটাতে বাস্তবতা এই পর্যায়ে এলো, ধর্ম নিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবমান একটি দেশ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি ধর্মীয় মৌলবাদী চেতনার রূপ নিলো।
আন্তর্জাতিক বিশ্বের অলিখিত প্রভু জানান দিয়েছে, অবশিষ্ট বিশ্বকে একটি পক্ষ বেছে নিতে হবে। হয় তাকে, নতুবা সন্ত্রাসকে। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র যখন ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে, তখন আমাদের মতো ‘ছা পোষা’ মানুষগুলো ভেবে পায় না কোন পক্ষে যাবে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে ছিন্ন ভিন্ন করার জন্য যে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটিয়েছিলো, তাকেই ধ্বংস করবার জন্য কী ভয়ঙ্কর বিলাপ শুরু করেছে সে। সন্ত্রাসকে দমন করবার জন্য যখন অসহায় শিশু আর বৃদ্ধদের উপর চলে বোমা হামলা, তখন এই উপলব্ধি কি আমাদের হয় যে, যার বা যাদের কর্মফলে এই হামলা, আর যে এই হামলাকারী তারা উভয়েই সন্ত্রাসবাদী? তাদের মধ্যে একদল সমাজ পরিবর্তনের ধারায় পুঁজিবাদের বিকাশের পর সাম্রাজ্যবাদের চেহারা নিয়েছে, আর অপরদল পরিবর্তনের ধারার সাথে সম্পর্কহীন এক মৌলবাদী যে কিনা ফিরে যেতে চায় কম করে হলেও চৌদ্দ’শ বছর আগের জমানায়। সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শোষিত বিপ্লবী জনতার সংগ্রাম চলতে পারে; সংগ্রাম করে সম্ভব নিজের অর্থনৈতিক হিস্যা বুঝে নেয়া, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে নিজেকে উদ্ধার করা। কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করবো কোন অর্থনৈতিক হিস্যা বুঝে নেবার জন্য? এই প্রশ্ন থেকে এটুকু বুঝে নেয়া সঙ্গত হবে যে, বাংলাদেশে আজ যে মৌলবাদী শক্তির সাংবিধানিক বিকাশ ঘটানো হলো এতে করে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের চলমান লড়াইটা গেলো পিছিয়ে। তেল গ্যাস রক্ষার জন্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ যখন আসবে ধর্মীয় সন্ত্রাস দমন করবার জন্য তখন আমরা যাবো কোন পক্ষে?
একবিংশ শতাব্দীর এই সূচনালগ্নে যখন বিশ্বে পুঁজিবাদ রূপ নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদে, তখন সমাজ পরিবর্তনের চেতনার পরিবর্তে বাংলাদেশে মৌলবাদের যে সাংবিধানিক বিকাশ ঘটানো তা প্রগতির পথে কত বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা দেখার অপেক্ষায় থাকা যাক।
হাসান শাহরিয়ার
সেপ্টেম্বর ২০০১
সোবহানবাগ, ঢাকা।