Full premium theme for CMS
তাপস সেনের সাথে আলাপচারিতা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[অগ্রজ নাট্যজন ঠাণ্ডু রায়হান কোনো একদিন একটি সাক্ষাৎকারের কিছু পাতার ফটোকপি আমার হাতে দেন। পাতা উল্টিয়ে বেশ আপ্লুত হয়ে পড়ি। এ যে বাংলা থিয়েটারের কিংবদন্তী আলোক পরিকল্পক তাপস সেনের সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কেশব মুখোপাধ্যায়। ঠাণ্ডুভাই বললেন থিয়েটারওয়ালা’য় ছাপবার জন্য। আমিতো রাজিই। জানতে চাইলাম কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো? পুনর্মুদ্রণ করতে গেলে নিদেনপক্ষে পত্রিকাটির নামটা জানা চাই। কৃতজ্ঞতা জানানোর একটা ব্যাপারতো থাকেই। কিন্তু ঠাণ্ডুভাই পত্রিকার নাম করতে পারলেন না। তারপরও সিদ্ধান্ত নিই ছাপবার। পরে না হয় প্রকাশকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো। কিন্তু মুশকিল হলো অন্য জায়গায়। আমার হাতে যেটুকু আছে, তা পুরো সাক্ষাৎকারটি না- বড়জোর অর্ধেক হতে পারে। ঠাণ্ডুভাই আশ্বাস দিলেন কিছুদিনের মধ্যে কোলকাতায় গিয়ে বাকিটুকু এনে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। ওনার কথায় আস্থা রেখেই থিয়েটারওয়ালার বর্তমান সংখ্যায় সাক্ষাৎকারটির প্রথম কিস্তি ছাপা হলো- সম্পাদক]
কেশব মুখোপাধ্যায়
আপনার জন্ম, বাল্য-কৈশোর কোথায় কীভাবে কেটেছে, এখান থেকেই শুরু করতে চাইছি আপনার সাক্ষাৎকার-
তাপস সেন
একথা অনেকবার অনেক জায়গায় লিখেছি বা বলেছি। আমাদের আদি বাড়ি ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। কিন্তু আমার ঠাকুরদা তাঁর যৌবনে কাজকর্মের সংস্থানে আসামে চলে আসেন। সেই সুবাদে আসামের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়িতে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ সালে আমার জন্ম। আমার এক বছর বয়সে বাবার (মতিলাল সেন) চাকরির সূত্রে দিল্লি চলে যাই। এবং এক বছর বয়স থেকে প্রবাসী বাঙালি হিসেবে দিল্লিতেই আমার শিক্ষাদীক্ষা। ১৯৪৬ এর শেষে ফিল্মের কাজে আমি বম্বে চলে যাই। তার আগে দিল্লিতে চাকরি করেছি। বোম্বে গিয়ে আমি বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান দিলীপ গুপ্তের সঙ্গে ফটোগ্রাফির কাজ করি। তার আগে দিল্লি থাকতেই রেডিও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আমার আগ্রহ ছিল। দিল্লিতে হবি হিসেবে রেডিও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আগ্রহের সূত্রে নাটকের প্রতিও আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল এবং সংস্কৃতির ওই মাধ্যমটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমার কিছু কিছু লেখায় তার পরিচয় পাওয়া যাবে। তাই এ বিষয়ে খুব বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। তারপর কোলকাতায় আসি ’৪৭-এর গোড়ায়। তার আগে ’৪৬-এ কোলকাতায় ঘটে গেছে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দ্য গ্রেট কোলকাতা কিলিং-এর সময় আমার মামারবাড়ি ময়মনসিংহে ছিলাম। তারপর সেখান থেকে যাই আসামে- ধুবড়িতে। ধুবড়ি হল বাংলা আর আসামের বর্ডার। ব্রহ্মপুত্র নদী এখান থেকে বাঁক নিয়ে পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশে) প্রবেশ করেছে। বাঁকের মুখে ছোট একটি শহর ধুবড়ি। ধুবড়ি আমার জন্মস্থান হলেও একটু আগেই বলেছি আমার শিক্ষা-দীক্ষা যতটুকু হয়েছে, তা হয়েছে দিল্লিতে। ১৯৪৭-এ কোলকাতায় চলে এসে কাজকর্ম শুরু করি। দিল্লিতে থাকার সময়, সেখানকার ভারতীয় গণনাট্য শাখায় যে-কয়েকজন ছিলেন, আমিও ছিলাম তাদের একজন। দিল্লিতে আই.পি.টি.এ-র পর কোলকাতায় এসে এখানকার নানা বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হই। এবং পরে ওই বামপন্থী দলের (এসইউসি) সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করি। এর বছর দুই-আড়াইয়ের মধ্যে নিউ থিয়েটার্স-এ একটা চাকরি পাই। নিউ থিয়েটার্স-এর তখন প্রায় শেষ অবস্থা। এককালের নামকরা শিল্প নির্দেশক সৌরেন সেন তখন একটা ছবি করছিলেন, তাঁর ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করি। ছবির নাম ছিল ‘রূপকথা’। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই ছবিতে আমি যুক্ত থাকতে পারিনি। নিউ থিয়েটার্স-এ চাকরির সময় সেখানে হৃষিকেশ মুখার্জির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। তিনি তখন ছিলেন সেখানকার এডিটার। হৃষিকেশের মধ্যস্থতায় আমার সঙ্গে আলাপ হলো বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরীদের সঙ্গে।
এইভাবে পরবর্তী পর্যায়ে তরুণ রায়ের জাতীয় নাট্য পরিষদ, যা পরে ‘থিয়েটার সেন্টার’ হয়, তার সঙ্গে যুক্ত হই। আরো পরে পাঁচ-এর দশকের গোড়ার দিকে শম্ভু মিত্র-র ‘বহুরূপী’ এবং উৎপল দত্ত’র লিটল থিয়েটার গ্রুপ-এর সঙ্গে যুক্ত হই। সেই সময়েই একাধিক রবীন্দ্রনৃত্য এবং সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত হই। যেমন ‘গীতবিতান’, ‘দক্ষিণী’, ‘রবিতীর্থ’ এবং প্রহ্লাদ দাশের ‘নৃত্য ভারতী’ ও অনাদী প্রসাদের ‘ইন্ডিয়ান প্রগ্রেসিভ ব্যালে’। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য এবং কোলকাতার একাধিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আলোর কাজ করতে শুরু করি। গোটা পাঁচের দশক জুড়েই এইভাবে চলে।
থিয়েটারে আমার আলোর কাজ শুরু হয়েছিল দিল্লিতে, স্কুল জীবনে সরস্বতী পূজার নাটকে আলোর কাজ করে। সেখান থেকেই আমার শুরু। কোলকাতায় এসে যেসব প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তরুণ রায়ের ‘প্রচেষ্টা’। তরুণ রায়ের সঙ্গে নাটক করার আগেই আমি ঋত্বিক ঘটকের ‘জ্বালা’ নাটকে কাজ করি। সেই নাটকের প্রথম অভিনয় হয় লেক টেম্পল রোডের কালচার ক্লাবে। কালচার ক্লাব ছিল স্যোশালিস্ট ইউনিটি সেন্টার-এর একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা। অস্থায়ী প্যান্ডেল করে সেই নাটক অভিনীত হয়েছিল। ঋত্বিকের ‘জ্বালা’ নাটক দিয়েই কোলকাতায় আমার কাজের সূচনা বলা চলে। তারপর মৃণাল, ঋত্বিক এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘ যাঁরা ছেড়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে জ্ঞান মজুমদার ছিলেন অন্যতম; সেই জ্ঞান মজুমদারের উদ্যোগে ‘নাট্যচক্র’ বলে একটি প্রতিষ্ঠান হয়। সেখানে দীনবন্ধু মিত্র’র ‘নীলদর্পন’ নাটকটি অভিনীত হয় বিজন ভট্টাচার্য’র সম্পাদনা এবং পরিচালনায়। সেই নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঋত্বিক ঘটক, শোভা সেন, সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও নবেন্দু ঘোষ। ‘বহুরূপী’ এবং উৎপল দত্ত’র ‘লিটল থিয়েটার’ গ্রুপের সঙ্গে আমার কাজ শুরু হয়ে গেছে, তবে সবার প্রথম ‘জ্বালা’ এবং তরুণ রায়ের জাতীয় নাট্য পরিষদ। এলগিন রোডে তরুণ রায়ের মামাবাড়িতে রিহার্সেল এবং ’শো হতো নিউ এম্পায়ার-এ। পঞ্চাশ-একান্নয় শুরু উৎপল দত্তের ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ তাদের প্রথম বাংলা নাটক করে ‘সাংবাদিক’। সরোজ দত্তের অনুবাদে উৎপল দত্তের পরিচালনায় কনস্ট্যান্টি সিমোনভ-এর ‘রাশিয়ান কোশ্চেন’-এর বাংলা রূপান্তর। আই-টি-এফ প্যাভিলিয়নে এক রাত্রির জন্য অভিনীত হয়। উৎপল দত্ত ছাড়াও প্রতাপ রায়, প্রেমাশিস সেন এবং রবি ঘোষ ছিলেন সেই নাটকে। উৎপল দত্তের সাথে আমার প্রথম কাজ ঐ ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়েই। বহুরূপী-র সঙ্গে প্রথম কাজ করি তুলসী লাহিড়ীর ‘পথিক’ নাটকে। তার কিছু দিনের মধ্যেই বহুরূপী (কোলকাতার) নিউ এম্পায়ারে নাটকের উৎসবে ‘পথিক’ ছাড়া আরো দু’টো নাটক করে। তুলসী লাহিড়ীর লেখা ‘ছেঁড়া তার’ এবং শম্ভু মিত্রের ছদ্মনাম শ্রী সঞ্জীব নামে লেখা ‘উলুখাগড়া’। এই তিনটি নাটক দিয়ে বহুরূপীর জয়যাত্রা শুরু হলো। অন্যদিকে লিটল থিয়েটার গ্রুপ ‘সাংবাদিক’ নাটকের পর আরো অনেক বাংলা নাটক করে। শেক্সপীয়রেরর ‘ম্যাকবেথ’, রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ এবং আরো অনেক নাটক। শুরুর সময় থেকেই আমি উৎপল দত্ত’র ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ এবং শম্ভু মিত্রের ‘বহুরূপী নাট্য সংস্থা’র সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম।
নাটক ছাড়াও অনেক নৃত্যের অনুষ্ঠানে আলোর কাজ করেছি। এর মধ্যে অনাদি প্রসাদ, প্রহ্লাদ দাশ, জয়দেব চট্টোপাধ্যায়, বালকৃষ্ণ মেনন-এর নাম উল্লেখ করতে হয়। এছাড়া কোলকাতার বিভিন্ন কলেজ, যেমন, লেডি ব্যাবোর্ন কলেজ, বেথুন কলেজ, আশুতোষ কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও আমার ডাক পড়ত এবং সেইসব প্রতিষ্ঠানের হয়ে আমি কাজ করেছি বিভিন্ন সময়ে।
তরুণ রায়ের নাট্য উৎসবের মধ্য দিয়ে আমি হিন্দি নাট্য জগতের মধ্যে কিছুটা জড়িয়ে পড়েছিলাম। হিন্দি নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শ্যামানন্দ জালানের পরিচালনায় ‘নয়ে হাত’, সেই সূত্রে ‘অনামিকা’র অনেক নাটকে আলোর কাজ করেছি এবং কোলকাতার হিন্দিভাষী মানুষদের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল ‘সঙ্গীত শামলা’, প্রিটোরিয়া স্ট্রীটে তাদের অনেক নৃত্যনাট্যে কাজ করেছি। যেমন মহাদেবী ভার্মার ‘স্বপ্ন যামিনী’ এবং জয়শঙ্কর প্রসাদের ‘কাময়নী’। আর একাধিক হিন্দি স্কুলের বিভিন্ন নৃত্যনাট্য এবং শিশু নাটকে কাজ করেছি।
এই সূত্রে আমি উল্লেখ করবো সমর চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘শিশু রংমহল’-এর কথা, সেটা এক বড় অপূর্ব সংগঠন। ‘অবন মহল’ নামে আজকে যাদের স্থায়ী মঞ্চ হয়েছে। তাদের বাৎসরিক যে অনুষ্ঠান হতো তাতে আমি কাজ করতাম।
কেশব মুখোপাধ্যায়
বাংলায় নাট্যচর্চার এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য থাকলেও , আপনি আসার আগে পর্যন্ত নাটকে আলোর ব্যবহার সেই অর্থে আলোচিত হতো না। এই প্রেক্ষাপটে জানতে চাইছি আলো-অন্ধকারের রহস্য কিভাবে আপনাকে টানলো, কিভাবে গড়ে উঠলো আলোর সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক?
তাপস সেন
এমন প্রশ্ন আগেও কেউ কেউ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই অনেক বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল, যেমন কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, সাহিত্য চর্চা ইত্যাদি। দিল্লিতে আমি যেখানে থাকতাম সেখানে একটা লাইব্রেরী ছিল, নাম ছিল ‘দি বেঙ্গলী লাইব্রেরী এন্ড লিটারারি সোসাইটি’। সেই লাইব্রেরীতে যত রকম বই এবং পত্র-পত্রিকা আসতো সব গোগ্রাসে পড়তাম, সব বুঝতাম না হয়তো। সেই লাইব্রেরীর রাবার স্ট্যাম্পে লেখা থাকতো ই-এস-টি-ডি ১৯২৫, মানে আমার জন্মের এক বছর পর ওই লাইব্রেরীর জন্ম। এসটাব্লিশড্ কথাটা বুঝতে অবশ্য অনেক দিন সময় লেগেছে। সেই লাইব্রেরী থেকে অনেক বইপত্র পড়তাম। তার মধ্যে আমার আগ্রহ ছিল ‘শিশুভারতী’ বলে একট পত্রিকা। সেই পত্রিকায় জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং অন্য অনেক বিষয়ে লেখা থাকতো। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক। ওই পত্রিকাকে বাংলায় ‘বুক অফ নলেজ’ জাতীয় কিছু একটা বলা হতো। এছাড়া ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘বসুমতী’- এইসব পত্র-পত্রিকাও পড়তাম। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অন্য লেখকদের বইও পড়তাম। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে মনে আছে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় ও পরশুরাম-এর লেখা। এসব থেকে সাহিত্যের প্রতি, নাটকের প্রতি আমার অনুরাগ। এবং ড্রয়িং, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি নিয়েও ঘাঁটাঘাটি করতাম। কোনোটাই আয়ত্ব করতে পারিনি, কিন্তু এসব বিষয়ে আমার আগ্রহ এবং শখ ছিল। দিল্লির প্রবাসী বাঙালিরা যখন দূর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা উপলক্ষে থিয়েটার করতেন, সেসব সাগ্রহে দেখতাম। ওইসব থিয়েটার দেখে নাটকের প্রতি আগ্রহ বা আকর্ষণ অনুভব করতাম। আমার স্কুলে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে নাটক হতো। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা তাতে অংশ নিত। এমনি একবার সরস্বতী পূজা উপলক্ষে আমার স্কুল জীবনের শেষের দিকে ‘রাজপথ’ নাটক করা হবে, তো, সেই ‘রাজপথ’ নাটকে একটা রাস্তার দৃশ্য ছিল, তাতে একটা ল্যাম্পপোস্ট ছিল। সেই ল্যাম্পপোস্ট তৈরি করা দিয়েই আমার আলোর কাজ শুরু, এটা ১৯৩৯ সালের ঘটনা।
পরে স্কুলের অন্য ছাত্র এবং বন্ধুবান্ধবরা মিলে ম্যাট্রিক পাশ করার পর আমরা কিছু কিছু নাটক অভিনয়ের আয়োজন করেছি। এসব করার মূলে অনুপ্রেরণা ছিলেন আমার ড্রয়িং শিক্ষক প্রতাপ সেন। তিনি এখনও দিল্লিতে আছেন। প্রতাপদা’র উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় ছবি আঁকা এবং আলোর কাজের দিকে আমার আরো আকর্ষণ বাড়লো। আমি অভিনয় বা অন্যদিকে বিশেষ থাকতাম না। স্কুল থেকে বের হয়ে ১৯৪০-৪১ সালে বনফুলের ‘বিদ্যাসাগর’, প্রমথনাথ বিশির ‘মৌচাকে ঢিল’ এবং আরো কিছু নাটক করেছি। এমনকি একবার দূরূহ নাটক রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ করেছি দিল্লির তালকাটরা মঞ্চে। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি রবীন্দ্রনাথের ওই নাটকের সঙ্গে পরবর্তীকালে এভাবে জড়িত হবো। আমাদের বন্ধুবান্ধবদের সেইসব প্রচেষ্টার সঙ্গে প্রতাপ সেন এবং সুশীল রায়চৌধুরীও যুক্ত ছিলেন। সুশীল রায়চৌধুরী বনফুলের ‘বিদ্যাসাগর’ নাটকে বিদ্যাসাগরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সুশীল রায়চৌধুরী পরে কোলকাতার বিধাননগরে থাকতেন এবং ‘বিধাননগর’ পত্রিকা তিনি অনেকদিন সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন। কয়েক বছর আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। আর আমরা ড্রয়িং টিচার প্রতাপ সেন আমাদের সঙ্গে অভিনয় করতেন, সেট তৈরি করতেন, মেকআপ করতেন। আমার সত্যিকারের শিক্ষক এবং দীক্ষাগুরু হলেন প্রতাপদা। বলা যায়, প্রতাপদা’র উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণাতেই আমি এ কাজে যুক্ত হই। এই সূত্রে আমি উল্লেখ করবো ১৯৪৩-৪৪ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের দিল্লি শাখার সূত্রপাতে অন্যদের সঙ্গে আমিও যুক্ত ছিলাম। প্রায় ওই সময়েই পরশুরামের গল্প ‘ভূষণ্ডীর মাঠ’-এ যতীন সেনের আঁকা ছবি দেখে ওটা নাটকে করার কথা মনে হয়। প্রতাপদা’ এবং বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে ‘ভূষণ্ডীর মাঠ’ আমরা ছায়া নাটক করি। এর প্রথম অভিনয় হয় আমাদের স্কুলের মাঠে, পরে দিল্লির সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাবে। নাটকে আলো-ছায়ার প্রয়োগের যে ব্যাপার তার সত্যিকারের সূত্রপাত হয় পরশুরামের ওই ‘ভূষণ্ডীর মাঠ’ নাটক দিয়েই। তারপর থেকে আলো-ছায়া আমার চিন্তা ভাবনায় একটা নতুন মাত্রা নিয়ে এলো। এবং আলো নিয়ে আমার নতুন উদ্যম শুরু হল। নাটকে আমার যে আগ্রহ তার মূলে আছে- অন্যান্য বিষয়ের প্রতি আমার যে আকর্ষণ, যেমন আলো-ছায়া, ছবি আঁকা, কবিতা, নাটক ইত্যাদির সব সমন্বয় দেখলাম নাটকে। দিল্লি থাকতেই কোলকাতার থিয়েটার সম্পর্কে নানা কথা শুনতাম। আগ্রহ অনুভব করতাম। মাঝে মাঝে এসে দেখতাম কিছু কিছু নাটক।
কেশব মুখোপাধ্যায়
বাংলার লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি আপনার আগ্রহের সূত্রে জানতে চাইছি- লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ে আপনার অনুভব এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত (৯ জানুয়ারি থেকে ১৩ জানুয়ারী’৯৯) লিটল ম্যাগাজিন মেলার আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করে আপনি ওই আয়োজন সম্পর্কে উৎসাহ এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন...
তাপস সেন
হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত প্রথম বছর লিটল ম্যাগাজিন মেলায় গিয়ে আমার অনেক পত্র-পত্রিকা দেখা ও কেনার সুযোগ হয়েছে। ওই মেলায় না গেলে আমার ওই সুযোগ হয়তো না। তবে লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ে আমার অনুভবের কথা জানাতে গিয়ে আমি উৎসাহ এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেছি। বাংলার লিটল ম্যাগাজিনগুলো তাদের নিজেদের মতো করেই ভাবছে, কাজ করছে, চিন্তা করছে, স্বাধীনভাবে পত্রিকা প্রকাশ করছে। সব পত্রিকাই যে মানের হচ্ছে তা নয়, তবে এসব পত্র-পত্রিকায় আমরা অনেক স্বাধীন ভাবনা চিন্তার প্রকাশ দেখছি। আমার আশঙ্কা হয়েছিলো, সরকার বা অন্য কোনো মহল থেকে এইসব পত্রিকাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয় কিনা।
তবে এর পজিটিভ দিকটা আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ে আমার যে আগ্রহ আছে সে বিষয়ে খোঁজখবর করার সুযোগ পেয়েছি ওই মেলায় গিয়ে এবং বহু লিটল ম্যাগাজিন দেখার সুযোগ পেয়েছি। অনেক পত্রিকাকে লিটল ম্যাগাজিন বলে কিনা, আমি জানতাম না, যেমন ‘বহুরূপী পত্রিকা’, ‘চতুস্কোণ’, ‘চতুরঙ্গ’ এই রকম নানান পত্রিকা। নানান লিটল ম্যাগাজিনের বিভিন্ন লেখার মধ্য দিয়ে জীবনানন্দ দাশকে নানাভাবে জানার এবং বোঝার একটা সুযোগ আমার হয়েছে। কবি জীবনানন্দ ১৮৯৯-এ জন্মেছিলেন, এবছর তাঁর জন্মের একশ বছর পূর্ণ হ’ল। সেই কারণেই হয়তো তাকে নিয়ে নানা লেখা বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হচ্ছে। আমরাও কবিকে নানভাবে জানতে পারছি। জীবনানন্দের ভাষা, তাঁর উপমা, উপলব্ধি ইত্যাদি জানতে পারছি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করবো বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার জীবনানন্দ দাশ বিশেষ সংখ্যার কথা। ‘কবিতা’ পত্রিকার ওই সংখ্যাটি আবার হুবহু ছেপেছেন বুদ্ধদেব বসুর কন্যা দয়মন্তী বসু সিং। সেই সূত্রে জীবনানন্দের প্রতি বুদ্ধদেব বসুর উৎসাহ, শ্রদ্ধা, বুদ্ধদেব বসুর লেখা, নরেশ গুহ-র লেখা এই রকম অনেক লেখা থেকে জানতে পারি জীবনানন্দের লেখার স্ট্রাকচার কেমন ছিল, তিনি রং নিয়ে বিভিন্ন রংয়ের অনুসঙ্গ, চোখের দেখা, কানের শোনা, নাকের ঘ্রাণ, জিহ্বার স্বাদ, ত্বকের স্পর্শ এই রকম সমস্ত অনুভূতি নিয়ে তিনি লিখেছেন। পঁচাত্তর বছর বয়সেও এসব আমার জানা ছিল না। আমি শুধু জানতাম রূপসী বাংলার কবি ‘নাটোরের বনলতা সেন’। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত ওই মেলায় ঘুরে ঘুরে অনেক পত্রিকা পেয়েছি, যা হয়তো ওই মেলা না হলে আমার পাওয়ার সুযোগ হতো না। এবং অবনীন্দ্রনাথ ও হ্যাভেল সাহেবের ভূমিকা। ওয়েস্টার্ন রিয়ালিস্টিক পেইন্টিং বা ওয়েস্টার্ন পেইন্টিং সম্পর্কে কার কতোটা ছুৎমার্গ ছিল। ইংরেজ শাসকদের একটা পরিকল্পিত ব্যাপার ছিল বাঙালিদের বা ভারতীয়দের বাহবা দিয়ে তাদের আধ্যাত্মিক ভারতীয়ত্ব খুঁজে বের করা। কিন্তু ছবির টেকনোলজি রং, রংয়ের প্রয়োগ, অয়েল পেইন্টিং, ডিমের কুসুম ফাটানো দিয়ে রং ছবি আকাঁ যায়, এসব থেকে ধ্যান-ধারণা অন্যদিকে চালিয়ে দেবার চেষ্টা। এসব কথা আমি জানলাম অতুল বসুর একাধিক প্রবন্ধের সমাবেশে একটি লিটল ম্যাগাজিন ‘চতুস্কোণ’ পেয়ে। ঐসব লেখায় অতুল বসু অবনীন্দ্র সম্পর্কে, রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে, গগনেন্দ্রনাথ সম্পর্কে, নিজের কাজ সম্পর্কে লিখেছেন। চতুস্কোণ-এর সম্পাদক শিবপ্রসাদ বাবু সম্পাদকীয়তে লিখেছেন অতুল বসু সেই সময় কী ছিলেন এবং অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে অতুল বসুর মধুর সম্পর্ক ছিল। যদিও দু’জনে আলাদা স্কুলে বিলং করতেন। অতুল বসুর ছবি দেখে, অবনীন্দ্রনাথ অতুল বসুকে বলেছিলেন তুমি বিধর্মী হতে পারো, কিন্তু অধার্মিক নও।
বাংলা আকাদেমি আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিনের ওই মেলায় গিয়ে আমি জীবনানন্দ দাশকে জানলাম, কিংবা কিছুটা জানতে পারলাম। আরো অনেক পত্রিকা পেলাম যেমন ‘জলার্ক’, আগে এদের দুটো শহীদ স্মৃতি সংখ্যা পড়েছিলাম। আশোক মিত্র মশাইকে আমি ওই সংখ্যা দুটো পড়তেও দিয়েছিলাম। ওই কাগজ এখন দুটো ভাগ হয়ে গেছে। চতুস্কোণ-এর অতুল বসু সংখ্যা পড়েই জানা যায়, ‘অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ কোলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে যা আজ নাটকের একটা তীর্থক্ষেত্র, সেই অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টন-এর সূত্রপাত বা উৎপত্তি কিভাবে হয়েছিলো। এই অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস এবং শিল্প আন্দোলনের নানা রকম গতি প্রকৃতি, যেমন হেমেন মজুমদার ছিলেন যামিনী রায়ের খুব ঘনিষ্ট। যামিণী রায়, অতুল বসু এবং হেমেন মজুমদার তিনজন তিন স্কুলে বিলং করতেন। লিটল ম্যাগাজিনের ওই মেলায় না গেলে অনেক পত্রিকাই আমার কেনা হত না, এবং অনেক কিছুই আমার অজানা থেকে যেত। কারণ, বিজ্ঞানে আমার আগ্রহ এবং চিন্তা চেতনা স্পেস এসব জীবনানন্দ দাশের কবিতায়, ভাবনায় অনেকখানি ছায়া ফেলেছে। এবং কবি আনন্দ ঘোষ হাজরা, যিনি একালে রবীন্দ্র সদনের এডমিনিসট্রেটিভ অফিসার ছিলেন, তিনি ‘জীবনানন্দ দাশ অন্য ভাবনা’ শিরোনামে একটি মনোজ্ঞ এবং সিরিয়াস প্রবন্ধ লিখেছেন, বিভিন্ন সময়ের বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান ভাবনা জীবনানন্দ দাশের চিন্তা এবং ভাবনার জগতে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ প্রভাব ফেলেছিল। যেমন রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনা, জীবনদর্শন নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে নানা সময়ে। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের জীবনদর্শনে বিজ্ঞান মনস্কতা অনেকটাই জুড়ে ছিল। এ বিষয়ে তাঁর বিশ্বপরিচয় একটা অন্যতম লেখা। তেমনি জীবনানন্দ দাশের এক্সপানডিং ইউনিভার্স এবং কোয়ানটাম ফিজিক্স এবং থিয়োরী অফ আনসার্টেনিটি এসব নিয়ে একাধিক লেখক চর্চা করেছেন। তার মধ্যে একজন হলেন আনন্দ ঘোষ হাজরা। লিটল ম্যাগাজিন উৎসব নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, অনেকে উৎসাহ প্রকাশ করেছেন, কেউ বা সন্দেহ। আমার কথা হলো এই লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে যেন কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা না করা হয়। এই সূত্রে আমি বলতে চাই, রাজ্য চারুকলা পর্যদ ১৬ থেকে ২৫ জানুয়ারি (‘৯৯) পর্যন্ত এক চারুকলা উৎসবের আয়োজন করেছে। সেখানে চারুকলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সেমিনার হবে, এবং ২০ জানুয়ারি চারুকলা-নাটক-চলচ্চিত্র বিষয়ে আমি (তাপস সেন), রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায় এবং অন্যরা বলবেন। এছাড়া সোমেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় একদিন বলবেন। যিনি খুব সিরিয়াস লেখক এবং আমার ব্যক্তিগত বন্ধু। আমি ওর গুণগ্রাহী, উনি রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা এবং সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে অনেক ভালো বই লিখেছেন। এই যে চারুকলা উৎসব হচ্ছে, এসব রবীন্দ্রভারতী বা বিশ্বভারতী কখনো কখনো করে থাকে। বছরখানেক আগে রবীন্দ্রভারতীতে এরকম একবার হয়েছিল, আমি গিয়েছিলাম সোমেনবাবুর বক্তব্য শুনতে। এসব আয়োজন যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা আকাদেমি বা রাজ্য চারুকলা পর্যদ না করতেন, তাহলে আমার মতো লোকের বা সাধারণ মানুষের আগ্রহ হতো না। চলচ্চিত্র, নাটক, দূরদর্শন এসবের প্রভাব সমাজে কতখানি, কত ভালো, কত খারাপ এ বিষয়ে আমারও কিছু উপলব্ধি আছে। এবং এ বিষয়ে জানতে এবং শুনতে আগ্রহী। লিটল ম্যাগাজিন মেলায় আমি একটু বক্রোক্তি করেই লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে ওই রকম প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। ওই মেলায় আমার পরিচিত অনেক পত্রিকা যায়নি। যেমন সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর ‘বিভাব’, ‘স্বাধন বাংলা’, ‘অনুষ্টুপ’- এই রকম আরো পত্রিকা যায়নি। অনুষ্টুপ এখন লিটল ম্যাগাজিন কিনা আমি জানি না। কত বিক্রি হলে, কত বেশি বিজ্ঞাপন পেলে লিটল ম্যাগাজিন তার চরিত্র হারায় এই নিয়ে বিভাস চক্রবর্তীও প্রশ্ন তুলেছিলেন। রবীন্দ্র সদন, বাংলা আকাদেমি, নন্দন চত্ত্বরে আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলায় ঘুরতে ঘুরতে এত মানুষের সঙ্গে আলাপ হল যাঁরা এই নিয়ে আছেন, নিজেদের সীমাবদ্ধ গ-ীর মধ্যে দাঁড়িয়ে পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। ওই মেলায় গিয়ে এত পত্র-পত্রিকা পেলাম, অনেক অজানা জিনিস জানলাম। আমার এই প্রাপ্তিটা বড় কম নয়।
আমাদের মতো মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, লোকেরা রাজনীতির প্রতি কিছুটা আগ্রহী। বামফ্রন্ট সরকারের অনেক কাজকর্মের ব্যাপারে আমরা খুশি নই, এবং সমালোচনাও করি। আমি একাধিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত আছি, যেমন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, সেখানে যেসব কাজ ঠিকমতো হয় না, তার সমালোচনা করি- অনেক কথা বলি, এতে যে কোনো কাজ হয় তা অবশ্য নয়।
কেশব মুখোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি লিটল ম্যাগাজিনের ওই মেলায় দাঁড়িয়ে আপনি যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন সে বিষয়ে-
তাপস সেন
হ্যাঁ, আমায় আশঙ্কা হচ্ছে সরকারী বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে, কাদের দেওয়া হবে? নাটকের জন্য অনুদান এবং পুরস্কারেরও সমালোচনা আছে। সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক যে বিভাগেই পুরস্কার দেওয়া হোক তা সমালোচনা বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকে না। তার পাল্টা বিতর্ক হতেই পারে। আমি যাকে এক, দুই, তিন বললাম, অন্যরা তাকে সম্পূর্ণ বাতিল করে অন্য কোনো নাটককে এক, দুই, তিন বলতে পারেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়েও এই বিতর্ক থাকে।
আজকে রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, পশ্চিমবঙ্গ এবং সারা ভারতে যে নৈরাশ্যজনক চেহারা, সারা পৃথিবীতেও তাই, তার মধ্যে এই কাজগুলো আমার মতে পজেটিভ। এর অন্যদিকও আছে, ভালো দিকগুলো আমি বললাম।
কেশব মুখোপাধ্যায়
বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তার একজন মানুষ হিসেবে আপনাকে আমরা জানি। সেই সূত্রে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে মার্কসবাদী নন্দনতত্ব এবং বর্তমান সময়ে এ বিষয়ে আপনার অবস্থান-
তাপস সেন
এসব খুব জটিল বিষয়। উৎপল দত্তই বোধ হয় কথাটা কয়েন করেছিলেন, আমরা যেমন ঠাট্টা করে বলি উনি একজন প্রাইভেট মার্কসিস্ট। ‘প্রাইভেট মার্কসিস্ট’ কথাটা জীবনানন্দ দাশের স্ববিরোধী উপমার মতোই। মার্কসিস্ট কখনো প্রাইভেট হয় না। কিন্তু ওটা ঠাট্টা করে বলার মানে হচ্ছে, ব্যক্তিগত চিন্তায় ধ্যান-ধারণায় শ্রমিক শ্রেণী বা বামপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। প্রাইভেট মার্কসিস্ট বলতে বোঝায় কোনো সংগঠিত বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে দূর থেকে একটা পরোক্ষ সমর্থন। আমরা পার্টি কার্ড হোল্ডার নই। কোনো রাজনৈতিক দল আমার বা আামাদের মতো মানুষদের মতে ঠিক পথে চলছে না। এবং ঠিক মতো চললেও, একজন পেশাদার শিল্পী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যে ধরনের কাজকর্ম করি, যে ধরনের সম্মান মূল্য আশা করি, এবং আমার নাম, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠার সঙ্গে- পার্টি লাইনকে মনপ্রাণ দিয়ে অনুসরণ করা এবং পার্টি মেম্বারশিপ বজায় রাখা স্ববিরোধী হয়ে যায়। আমার অনেক কৃতি বন্ধুবান্ধব আছেন, যাঁদের নাম করলে দীর্ঘ তালিকা হবে- তাঁরা গণনাট্য সংঘ বা বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং হয়তো এখনো আছেন। আমিও ছিলাম। চার দশকের শেষ থেকে পাঁচ দশকের শুরুর কিছুদিন পর্যন্ত, মানে নাটকের ক্রিয়েটিভ কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক কর্মকা- এবং সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে আমার এবং আমাদের মতো মানুষদের ধারণা ছিল- ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক ফ্রন্ট, কৃষাণ আন্দোলন বা কৃষাণ ফ্রন্ট, ছাত্র ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা। পাঁচ দশকের শেষ দিকে শান্তি আন্দোলনের একটা ফ্যাশন শুরু হলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দগদগে ঘা, আণবিক বোমা, হিরোশিমা, এদের পর শান্তির স্বপক্ষে অনেক কিছু হলো। তখন বামপন্থীদের একটা প্রধান কাজ হলো শান্তি আন্দোলন, শান্তি উৎসব, শান্তি সম্মেলন করা। সেসবের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছি। এর সঙ্গে যুব আন্দোলন, তখন চার বছর পর পর রণজিৎ স্টেডিয়ামে যুব উৎসব হতো। তখনো কমিউনিস্ট পার্টি দু’ভাগে ভাগ হয়নি। আমাদের মতো তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বা শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীতের লোকরা সব শান্তি আন্দোলন এবং যুব উৎসবে মেতে গেলাম। এবং ক্রমে পাঁচের দশকের শেষ থেকে ছ’য়ের দশকের মধ্যে শান্তি আন্দোলন এবং নাটকের আন্দোলনের মধ্যে গ্রুপ থিয়েটার বলে একটা কথা আস্তে আস্তে তৈরি হলো। এটা কিন্তু হঠাৎ হয়নি। ‘গ্রুপ থিয়েটার’ কথাটা বিদেশ থেকেই এসেছে। যে নাটকের সংস্থা পেশাদার নয়, কমার্শিয়াল থিয়েটার করে না। আমাদের থিয়েটারের পরিচয় কী? কোলকাতায় দু’শ বছরের থিয়েটারের, লেবেদেফের অনেক পরে গিরিশ ঘোষ এঁরা নাটককে ব্যবসায়িক ভিত্তি করেন এবং টিকিট কেটে লোকে নাটক দেখতে আসেন। সেই থিয়েটার থেকেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষভাগে সমাজ সচেতন, রাজনীতি সচেতন নাটকের ধারা শুরু হল। তৈরি হল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। সেই দায়বদ্ধতার নাটক শুরু হল ‘নবান্ন’ দিয়ে কিংবা তারও আগে বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র এঁদের নেতৃত্বে। তারপর উৎপল দত্তের মতো মানুষ এসেছে, যে ইংরেজি থিয়েটার করতো নিউ এম্পেয়ারে তথাকথিত এলিটিস্টদের জন্য। সেও বুঝলো বাংলা নাটক করা দরকার। এর সঙ্গে আরো কিছু সমাজ সচেতন নাটকের দল এসেছে। যেমন আমাদের বন্ধু সলিল, সে উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে ‘নতুন ইহুদি’ নাটক লিখেছিলেন। আরএসপি-র সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট ‘ক্রান্তি শিল্পী সংঘ’ তার নেতৃত্বে ছিল। সলিল সেনের ‘নতুন ইহুদি’, ‘ডাউন ট্রেন’, ‘মৌ চোর’- একটা ধারা। তারপর উৎপল দত্ত, তারপর অজিতেশ এমন অনেক নাটকের দল এসেছে। সেইখানে আমার স্পষ্ট অনুভূতি হচ্ছে- আমরা নিজেদের ক্রিয়েটিভ কর্মকাণ্ডের মধ্যে যুক্ত থেকে আমরা কিন্তু অনেকখানি সরে এসেছি মূল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। এবং শুধু আমরা নই, মধ্যবিত্ত পরিচালিত এবং প্রভাবিত বামপন্থী রাজনীতি চলছে কোলকাতাকেন্দ্রিক, শহরকেন্দ্রিক, নগরকেন্দ্রিক। তাঁরা কলকারখানা এবং কৃষিক্ষেত্র থেকে দূরে সরে এসেছেন। এসবের বিকল্প হিসেবেই হয়তো ছ’য়ের দশকের শেষে এবং সাতের দশকের গোড়াতে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে একটা পাল্টা আন্দোলন হতে শুরু করলো যাকে বলা হয় নকশালবাড়ি আন্দোলন। সেই আন্দোলনের সঙ্গে আমরাও গোড়ার দিকে কিছুটা জড়িয়ে পড়েছিলাম। বলতে গেলে আমরা উৎপল দত্তের আগ্রহে-ই নকশালবাড়িও গিয়েছিলাম। এবং নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে উৎপল দত্ত মিনার্ভা থিয়েটারে ‘তীর’ নাটক করেছিলেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা যদি নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখি, একসময় সিপিআই যখন কংগ্রেসের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধলো সিপিএম-এর চোখে ছিল শোধণবাদ, সংশোধনবাদ। আবার নকশাল যখন হলো তারাও সিপিএমকে শোধনবাদ, সংশোধনবাদ বলতে লাগলো। আজকে সিপিএম এবং সিপিআই’র মধ্যে কি কোনো তফাৎ আছে? আজকে সিপিএম সোনিয়া গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য সাধাসাধি করছে। দেশের বামপন্থী রাজনীতি সংসদীয় রাজনীতির পথে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়েছে। আমাদের কাছে এই চিত্রটা খুব সুখের নয়। সলিল চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরী, জোছন দস্তিদার, এঁরা মারা গেছেন, এবং আমরা যারা জীবিত আছি আমি (তাপন সেন), মৃণাল সেন, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত- আমরা নাট্যচর্চা করছি এবং কিছুটা সমাজ মানুষের কথা কলার চেষ্টা করছি। পার্লামেন্টারি পলিটিক্সের ভিত্তিতে যে রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে, কী আমাদের দেশে, কী বিদেশে, সোভিয়েট ইউনিয়নের নামই নেই এখন। আমরা বাড়িতে বসে নিরুত্তাপভাবে খবরের কাগজের পাতায় পড়ছি, টেলিভিশনে এসব দেখছি, বা রেডিও-তে শুনছি। কিন্তু বিশাল ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্তরে-রাজ্যস্তরে যেভাবে জটাজাল বিস্তার করে আছে, তাতে আমাদের মতো মানুষের মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির যে গোড়ার কথা তার প্রতিফলন কোথাও দেখছি না। অটোমেশন, কম্পিউটার ইত্যাদি চালু করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে বামপন্থীরা। এখন কিন্তু সব পাল্টে গেছে। আধুনিক বিজ্ঞান এবং টেকনোলজিকে মানতে হবে, কিন্তু এসব মানতে গিয়ে আমরা যে জায়গায় গিয়ে পড়ছি, তাতে এসব আমাদের কন্ডিশন করছে, এবং মার্কসবাদী চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে ভাবতে পারি না। এবং কন্ট্রাডিকটারি মনে হয়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যখন আমি পার্টির জন্য অর্থ সংগ্রহ করতাম, কৌটো ঝাঁকিয়ে, রাতে মই নিয়ে পোস্টার মারতে বের হতাম, পার্টির কাগজ বিক্রি করতাম হাজরা, গড়িয়াহাট বা রাসবিহারী মোড়ে দাঁড়িয়ে, তখন মনে যে তেজ ছিল আজ কি তা আছে? এটা বয়সের কারণে নয়। আমার বন্ধু যাঁরা ছিলেন, কত লোক কত দুর্দশায় মারা গেছেন। পানু পাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সলিল চৌধুরী অবশ্য অর্থ, যশ, খ্যাতির মুখ দেখেছিলেন। যে সলিল চৌধুরী কবিতা গান লিখেছিলেন ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে...’ কিংবা কাকদ্বীপ নিয়ে ‘আজ হরতাল’ কবিতা লিখেছিলেন এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আস্তে আস্তে সরে গেছেন।
১৯৫২-৩৫ সালের যখন কল্যাণীতে কংগ্রেস অধিবেশনে কাজের প্রস্তাব আমার কাছে এলো, আমি তিন রাত্রি চিন্তা করলাম। কংগ্রেস দলের অধিবেশনে কাজ করবো কিনা এ নিয়ে। দু’জন আমাকে বললেন এটা তো তোমার প্রফেশন তুমি কেনো করবে না? আর কংগ্রেসের লোকরা বিধান রায়কে বললেন ও (তাপস সেন) কমিউনিস্ট, বিধান রায় বললেন তা হোক, আলোটা তো ভালো করে। সেই প্রথম বেশি টাকার কাজ করলাম কল্যাণী কংগ্রেস অধিবেশনে। তখন কংগ্রেসের সঙ্গে কিছু করার কথা ভাবা যেত না, বিবেকের দংশন সত্বেও আমি কাজ করেছিলাম। আমি মার্কবাদী চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে পারিবারিক জীবনে ভাবতে পারি না। আমি মার্কসিজম সম্পর্কে খুব বেশি পাড়াশুনা করিনি, যতটুকু পড়েছি তাতে আমার ধারণা সত্যিকারের আত্মানুসন্ধান করলে দেখবো যে, বইয়ের শিক্ষার বাইরে খুব বেশি যেতে পারিনি। স্বার্থ ত্যাগ করে, ব্যক্তিগত সুখ সুবিধা বর্জন করে ক’টা মানুষ শেষ পর্যন্ত থাকতে পেরেছেন? তবে এমন মানুষও দেখেছি। পূর্ব বাংলায় সত্যেন সেনকে দেখেছি, রণেশ দাশগুপ্তকে দেখেছি যিনি শেখ মুজিবের নৃশংস হত্যাকা-ের পর বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবাংলায় চলে আসেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত কোলকাতায় ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর দেহ বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া পান্নালাল দাশগুপ্তের মতো মানুষ দেখেছি, যিনি সি.আই.এ-র উগ্রতম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পান্নালাল দাশগুপ্তের সঙ্গে গোড়ার দিকে ব্যক্তিগত জীবনে কিছুটা যুক্ত হয়েছিলাম, ‘কম্পাস’ পত্রিকা যখন তিনি সম্পাদনা করতেন। সেই রকম মানুষ আজ ক’জন আছেন? সবক্ষেত্রেই আমরা জোড়াতালি দিয়ে চলছি। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে, ব্যক্তিগত জীবনে বাড়ি-গাড়ি টেলিফোন-ফ্রিজ আবশ্যকীয় হয়ে গেছে। সত্যিই হয়তো হয়েছে, সত্যিই হয়তো আজ আর ঘুঁটে-কয়লার উনুন চলে না। প্রতিদিন বাজার করার সময় নেই, ফ্রিজ দরকার। যোগাযোগের জন্য টেলিফোন দরকার। সারা ভারতবর্ষ, সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এস.টি.ডি এবং ফ্যাক্স, ই-মেইলের শরণাপন্ন হতে হয়। থিয়েটারের আলো ইত্যাদি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা কাগজপত্র আসে, সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও তার জবাব পাঠাতে হয়। আগে ফ্যাক্স করতাম, ই-মেইল, ফ্যাক্স থেকেও দ্রুত এবং খরচ কম। আধুনিক বিজ্ঞান টেকনোলজি এত দিচ্ছে, কিন্তু এত দেবার মধ্যে কন্ট্রাডিকশন যে আছে, তার চূড়ান্ত পরিচয় হচ্ছে হিরোশিমা নাগাসাকিতে বোমা বর্ষণ। এবং আণবিক অস্ত্রের বলীয়ান লোকদের গার্জেনগিরি। বি জে পি সরকারের পোখরানে বোমা বিস্ফোরণ, তার পাল্টা পাকিস্তানের বোমা ফাটানো। দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি এবং দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক সংগঠনের দৌরাত্ম বৃদ্ধি। ক্রিকেট খেলা, নাটক, চলচ্চিত্রে তারা হস্তক্ষেপ করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পালা বদল হয়, তার সন্ধিক্ষণে ১৯৬০ সালে মস্কো এবং পূর্ব র্জামানীতে যাবার সুযোগ হয়েছিল। তখন ক্রশ্চেভ এসে গেছেন এবং অনেকখানি ব্রড হয়েছে। সেই সময় অনেক জিনিস দেখে মুগ্ধ হয়েছি, লোকের বই পড়ার বই কেনার কী আগ্রহ! কিন্তু ইয়ং এবং ওল্ড ইন্টারপিটারদের থেকে আরম্ভ করে অফিসিয়ালদের কেউ কোনো রাজনীতির কথা বলতেন না। ওখান থেকে চিঠি আসতে গেলে লম্বা সময়, কারণ ওখান থেকে চিঠি সেন্সর হয়ে আসে। রাশিয়ার সাধারণ মানুষকেও রাজনীতির কথা বলতে শুুনিনি। যে বিপ্লব করে সব মানুষ এক হয়েছেন, সমান হয়েছেন তা নিয়ে কাউকে কোনো কথা বলতে শুনিনি। মস্কোতে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে-পি-এস মেননকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এখানে (রাশিয়ায়) অ্যান্টি রিলিজিয়াস ক্যাম্প আছে কিন্তু ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা নেই কেনো? উত্তরে মস্কোতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, আমাদের দেশের লোকদের ধর্মের স্বাধীনতা আছে, আর সোভিয়েত রাশিয়াতে সব মানুষ খেতে এবং পরতে পারছে, শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে, ধর্ম চর্চা থেকে এটা কি বেশি জরুরি নয়? তার দশ বছর পরে গিয়ে দেখি সোভিয়েট ইউনিয়নে একটা ধর্ম সম্মেলন হল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিচিত্র সব পোশাকে ধর্মগুরুরা মস্কোতে এলেন। আমাদের এখান থেকেও রামকৃষ্ণ মিশনের কিছু স্বামীজীরা গিয়েছিলেন। এখন তো মস্কোতে সাঁইবাবা এবং আমাদের দেশের অন্য বাবারাও আছেন। সারা পৃথিবী জুড়েই নানা মূল্যবোধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আমরা যারা পাঁচের দশকের রাজনীতিতে এসেছি, সোভিয়েট দেশের চলচ্চিত্র, ব্যালে, অপেরা এসব নিয়ে মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম। রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ও আমাদের প্রেরণা দিত। হো-চি-মিন-এর ভিয়েনাৎনাম এবং মাও-এর চীন অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের প্রেরণা দিত। ‘রেড স্টার ওভার চায়না’ আমাদের অনুপ্রাণিত করতো। সেই চীনের সঙ্গেও আমেরিকার ভাব হয়ে গেল। সেখানেও মূল্যবোধের অনেক ওলট পালোট ঘটে গেল।
কেশব মুখোপাধ্যায়
বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তার মানুষ হয়ে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আপনারা যে অবদান রেখেছিলেন, একুশ বাইশ বছর ধরে পশ্চিমবাংলায় বামপন্থীদের একটা সরকার চলছে, কিন্তু শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বামপন্থীদের অবদান প্রায় শূন্য হয়ে যাচ্ছে। আমরা সম্পূর্ণভাবে মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছি। এ বিষয়ে-
তাপস সেন
এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হল, সব সময় সব কালের মানুষই মনে করেন কিছু হলো না, আগে ভালো ছিল, একটা ডিরেকশন ছিল। গেল গেল রব ওঠে। অহীন্দ্র চৌধুরী মশাই কোনো একটা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন- চিরকালই গেল গেল রব ওঠে, কিন্তু যায় না। এই মুহূর্তে আমাদের চারপাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে নৈরাশ্য, বিষণ্নতা, হতাশা ছাড়া কোনো আশার আলো কোথাও নেই। আমাদের সময় যতখানি হচ্ছিল এখন তা হচ্ছে না। ঠিকই, হচ্ছে না। কী চলচ্চিত্রে, কী সাহিত্যে, কী নাটকে, সংস্কৃতির কোনো ক্ষেত্রে, এমনকি রাজনীতিতে সমাজে সর্বত্র একটা হতাশা এবং আপোষের ভাব। মূল্যবোধ নেই। যে লালু প্রসাদকে আমরা ঘৃণা করি, সেই লালু প্রাসাদের সঙ্গেও পশ্চিমবাংলায় যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তারা আপোষ করছেন, আমরা ভাবতে পারি না। সোনিয়া গান্ধী এখন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। তাকে প্রধামন্ত্রী হিসেবে পেতে কংগ্রেস দলের থেকেও সিপিএম দলের আগ্রহ যেন আজ অনেক বেশি। এই আপোষ, এই সুবিধাবাদী রাজনীতি কারা করছেন? যাদের সঙ্গে আমরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছি, মিছিলে হেঁটেছি, ভেবেছি। তারা একুশ বছর ক্ষমতায় থেকে অনেক কিছুই করছেন, হয়তো ক্ষমতায় থাকার জন্যই করছেন। সেসবের প্রতি আমাদের যথেষ্ট অনাস্থা এবং অবিশ্বাস আছে। ডেসটিনেশন ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর নামে দেশি বিদেশি পুঁজিপতি, শিল্পপতিদের ডেকে এনে আমাদের বামপন্থী সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন- আপনাদের শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের দাবি দাওয়া ইত্যাদির কারণে আন্দোলন বা অশান্তি হবে না। যদি অশান্তি না হয়, যদি শ্রমিক আন্দোলনে ভাইয়োলেন্সকে বন্ধ করতে হয় তবে সেই নিরামিষ আন্দোলনের চেহারা কেমন হবে? এবং যারা মালিক পক্ষ তারা কি স্বেচ্ছায় সব ছেড়ে দেবে? একদিন যাঁরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলতেন, একুশ বছর ক্ষমতায় থেকে সেসব আজ তাঁরা ভুলেও আর উচ্চারণ করেন না। এবং যাদের বুর্জোয়া বলা হয়, সেই মালিক পক্ষের স্বার্থের জন্য শাসক বামপন্থীদের আজ কত রাত জাগা চিন্তা। কাজেই বিপ্লবের কথা আজ আর শুনতে পাই না। এখন শুধু ভোটের কথা। ভোটে কারা ক্ষমতায় আসে? যারা বেশি রংচঙে পোস্টার ছাপে, বেশি টাকা খরচ করে। এই টাকা এরা কোথা থেকে পান? যাদের টাকা আছে তারাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে মোটা টাকা দেন। এরা কেনো টাকা দেন? জনগণের কথা ভেবে না, দেন নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে। যারা এসব করে বেশি ভোট পেয়ে রাজত্ব করেন তারাই কি ঠিক? এই প্রসঙ্গে আমার ‘এন এনিমি অফ দ্যা পিপল’ নাটকের কথা মনে হয়।
এই সূত্রে ব্যক্তিগত কথা বলতে সংকোচ হয়, তবুও বলবো আমরা যখন রাজনীতিতে এসেছিলাম তখন আমরা যতটুকু পড়াশুনা করার চেষ্টা করতাম বা এ বিষয়ে ভাবতাম, আজকের ছেলে মেয়েরা তা করেন না। আমাদের সময় রাজনীতিতে জানা এবং পড়া অবশ্য কর্তব্য ছিল। তখন যেকোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরুণ যারা ছিলেন তারা পড়াশুনা করেই রাজনীতিতে আসতেন। আজকে কিন্তু রাজনীতিতে পড়াশুনার পাটটাই উঠে গেছে। আজকের তরুণ প্রজন্মের সামনে কোনো আদর্শ নেই, আছে ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার সর্বগ্রাসী কুপ্রভাব। ক্যারিয়ার এবং কনজুমারিজম। ফলে আরাম বিরামের প্রতি আমাদের আকর্ষণ বেড়েছে।
কেশব মুখোপাধ্যায়
কয়েক বছর আগে একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে ‘একুশ ফেব্রুয়ারি উদযাপন’ কমিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস- এ আপনি বলেছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে আমরাও একদিন কংগ্রেসী শাসনের বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং, লড়াই আন্দোলন করেছি। কিন্তু আজকে দিখছি পতাকার তফাৎ ছাড়া কংগ্রেস বামপন্থীদের মধ্যে আর কোনো তফাৎ নেই। আপনার ওই বক্তব্যটি যদি ব্যাখ্যা করে বলেন-
তাপস সেন
এ বিষয়ে আর কী বলবো। রাজনীতির অনেক কিছুই এখন বুঝতে পারি না, এবং পতাকা এবং বোলচালের তফাৎ ছাড়া আর কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। নানান দল, নানান পতাকা কিন্তু তফাৎ নেই। সবাই বিভ্রান্তির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সমাধান কী হবে, আমি জানি না। আমাদের মানসিকতার মধ্যেই গোলমাল। একাধিক বামপন্থী দলের লেফট ফ্রন্ট এখানে আছে। লেফট বলতে কী বোঝায়? একুশ বছরে লেফট ফ্রন্ট গভর্নমেন্টের কাজকর্মে লেফট এর সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। কংগ্রেস ছিল শাসকদল, তারা প্রতিক্রিয়াশীল, আর আজ? বি জে পি হলো সাম্প্রদায়িক, তারা আউট এন্ড আউট সাম্প্রদায়িক। পাওয়ারের করিডোরে ঘুরে ঘুরে আমাদের বামপন্থী মন্ত্রীরা জনগণের কথা ভাববার কতটুকু সময় পান? এবং চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সব জিনিস বেহাল হচ্ছে। বিদেশের কথা ছেড়েই দিলাম, ভারতবর্ষের অন্য শহরের থেকে কোলকাতার স্টেট বাস অনেক বেশি নোংরা এবং লরঝরে। আমাদের রাস্তাঘাট এত খারাপ ভাঙাচোরা, হাসপাতাল এত নোংরা , চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই, শিক্ষা ব্যবস্থা এত খারপ, একুশ বছরের বাম রাজত্বে আমরা আলাদা কী পেলাম? কিংবা ধরো তুমি যে দীর্ঘদিন ধরে একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বাংলা ভাষা নিয়ে লেগে আছো সেই বাংলা প্রশ্নেরই বা এঁরা (বামফ্রন্ট সরকার) কী করলেন? বাংলা ভাষার কতোটা মর্যাদা এঁরা দিতে পেরেছেন? এসব বিষয়ে কোনো ভাবনা চিন্তা বা আন্তরিকতা এঁদের নেই। শুধু দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো নয়, ভাষা প্রশ্নে পাশের ওড়িষ্যাও অনেক এগিয়ে আছে পশ্চিমবাংলা থেকে। দূরদর্শনের যে সর্বগ্রাসী হামলা তার বিরুদ্ধে তোমরা আন্দোলন করেছো, অন্যরা করেছেন, আমিও গেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। কারণ সেরকম আন্দোলন করা যায়নি যে আন্দোলনে দিল্লি নীতি পরিবর্তনে বাধ্য হত। এসব প্রশ্নেই বা শাসক বামফ্রন্টের ভূমিকা কী? পশ্চিমবাংলায় নাকি অপরাধের ঘটনা সবচেয়ে কম। আইন শৃঙ্খলা প্রশ্নে আমরা নাকি ভালো জায়গায় আছি। হতে পারে। কিন্তু তারপরেও অনেক নারকীয় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।
কেশব মুখোপাধ্যায়
বাংলাদেশ সৃষ্টি হবার পর সেখানে যে পরিবর্তনটা এসেছে, বিশেষ করে সেখানকার নাট্য আন্দোলন বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন-
তাপস সেন
এ বিষয়ে খুব সন্তর্পনে বলবো। বাংলাদেশ হবার পরপরই আমি (তাপস সেন), উৎপল দত্ত, শোভা সেন গিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত তখনো শুকোয়নি। তারপর একাধিকবার গেছি, এবং বাংলাদেশ হবার আগে ১৯৫৬/৫৭ সালে বহুরূপীর সঙ্গে গিয়েছিলাম, তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আতাউর রহমান। আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার এক প্রধান ফসল বাংলাদেশের নাটকের আন্দোলন এবং নাটকের চর্চা। আমার বিবেচনায় এর প্রথম সূত্রপাত মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক দিয়ে। তারপর অনেক নাটকের দল, অনেক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে এবং তারা নিয়তিত নাট্যচর্চা করছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক নাটক হয়েছে। এবং বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দিয়ে অনেক দল তৈরি হয়েছে। আমাদের কোলকাতা শহরে আর যাই হোক নাটক করার অনেকগুলো মঞ্চ আছে। বামফ্রন্ট রাজত্বেও বেশ কিছু মঞ্চ তৈরি হয়েছে। যদিও তাতে চাহিদা মিটছে না। কিন্তু ঢাকায় নাটক করার জন্য মঞ্চের বড় অভাব। মহিলা সমিতি মঞ্চ এবং গাইড হাউস মিলনায়তন মঞ্চ আছে, সেখনেও নাটক করার আধুনিক ব্যবস্থা নেই এবং সংকীর্ণ মঞ্চ। শুনেছি শিল্পকলা আকাদেমিতে বড় আধুনিক মঞ্চ তৈরি হচ্ছে নাটকের জন্য। কিন্তু যেভানে এত নাটকের সংগঠন, সেখানে আরও অনেক মঞ্চ প্রয়োজন। বাংলাদেশে অনেক রকম ভাবনা চিন্তা নিয়ে নাটক হচ্ছে। সাম্প্রতিক যেসব নাটক দেখেছি তা খুব একটা ইমপ্রেস করেনি। যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র সেই কারণে, ওদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং সুযোগ সুবিধা অনেক অনেক বেশি, আমাদের পশ্চিমবাংলা থেকে। সম্প্রতি লন্ডনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আলোক শিল্পীদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার হলো, সেখানে বাংলাদেশের আলোকশিল্পী নির্দেশক আমার অনুজ প্রতিম স্নেহভাজন ঠাণ্ডু রায়হান গিয়েছিলেন। সেই সেমিনারে আমি তাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি, আমরা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করেছি। স্বাধীন রাষ্ট্র হবার কারণে, বাংলাদেশের নাট্য শিল্পীরা বা অন্যান্য মাধ্যমের লোকরা যে আন্তর্জাতিক সুযোগ সুবিধা পান, আমরা যারা পশ্চিবাংলায় বা কোলকাতায় নাট্যচর্চায় ব্রতী, তারা তা পাই না। পাবার সুযোগ নেই, কারণ ভারতবর্ষ একটা বিরাট বহুজাতিক দেশ। এখানে অনেকগুলো রাজ্য, আর রাজধানী দিল্লি থেকেই সব নিয়ন্ত্রিত হয়।
বাংলাদেশের নাটকের দলগুলোর সঙ্গে কোলকাতার নাটকের দলগুলোর খুব ভালো সম্পর্ক আছে। এখানকার গঙ্গা-পদ্মা উৎসবে বা অন্য নাট্য উৎসবে ওঁরা নাটক করতে আসেন, এবং বাংলাদেশের নাটকের প্রতি পশ্চিমবাংলার দর্শকদের গভীর আগ্রহ আছে। এখানকার নাটকের প্রতি পশ্চিমবাংলার দর্শকদের গভীর আগ্রহ আছে। এখানকার নাটকের দলগুলোও বাংলাদেশে যায়। কবি সাহিত্যিকরাও যান আসেন, এটা খুবই ভালো দিক, আশার দিক। তবে ওখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই জটিল এবং ঘোরালো, এক হিসেবে হয়তো আমাদের থেকেও খারাপ। সেই কারণেই হয়তো এতদিনও ঢাকায় কোনো স্থায়ী নাটকের মঞ্চ তৈরি হয়নি। এখন অবশ্য ঢাকার শিল্পকলা আকাদেমি চত্বরে বড় আধুনিক মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। আমি নিজে বাংলাদেশের নাট্যচর্চা বিষয়ে আশাবাদী। ওঁরাও পশ্চিমবাংলা এবং ভারতবর্ষের নাট্যচর্চা বিষয়ে খুব আগ্রহী। দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী পড়তে আসে। নাট্য আন্দোলনের যাঁরা নেতৃস্থানীয় তাঁদের সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। শুধু ঢাকায় নয়, চট্টগ্রামে, খুলনাতেও আমার যোগাযোগ আছে।
কেশব মুখোপাধ্যায়
দু’ বাংলায় নাট্যচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন-
তাপস সেন
এ বিষয়ে কিছু বলা মুশকিল। তবে আশাবাদী না হয়ে উপায় কী এই বয়সে? নাট্যচর্চা মানে একটা বা কয়েকটা মঞ্চ নয়। মঞ্চ তো প্রয়োজনই, মঞ্চ ছাড়া তো নাটক হয় না। কিন্তু সেই সঙ্গে আরো অনেক কিছু প্রয়োজন। ঢাকায় বা বাংলাদেশে মঞ্চের একটা অভাব আছে। একটা বড় মঞ্চ না করে প্রয়োজন ছোট ছোট তিনশ/চারশ দর্শকের জন্য অনেকগুলো মঞ্চ। এটা আমাদের এখানেও প্রয়োজন। আমার পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারি আমি আশাবাদী। আমি এখনো অনেক কিছু করার কথা ভাবি, আমার মনে অনেক কিছু করার ভাবনা-চিন্তা-পরিকল্পনা আছে। এসব ভাবনা পরিকল্পনা নিয়ে ভবিষ্যতে কিছু না কিছু করবো। ভবিষ্যৎ বিষয়ে পরিকল্পনা না থাকলে তো কিছুই করতে পারবো না, বসে থাকতে হবে। কী এ বাংলায় কী বাংলাদেশে, তরুণতম প্রজন্ম নাটক নিয়ে অনেক কিছু ভাবছে। কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে অনেক তরুণ পশ্চিমবঙ্গে নাটক করছে, আমি আলাদাভাবে কারো নাম উল্লেখ করতে চাই না। তাদের কাজ আশার সঞ্চার করছে। আর বাংলাদেশের নাটক যা দেখেছি, যতটুকু জানি, তাতে বাংলাদেশের নাটক বিষয়ে আমি আশাবাদী। এ প্রসঙ্গে বলবো যখন কেউ কিছু সৃষ্টি করেন, সে কবি, নাট্যকার যেই হোন, নিজের লেখার প্রতি মমতাবোধ থেকেই বোধহয় তা এডিট করতে চান না। নাটকের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়। নাট্যকার নাটক কাটতে দিতেই চান না। নাট্যকাররা তাদের প্রত্যেকটা কথা ভীষণ দরকারী মনে করেন, সে যেই নাট্যকারই হোন। তবু আমি বলবো প্রয়োগে, পরিকল্পনার অভিনবত্ব এবং নানা রকম চিন্তা ভাবনা আমাকে আকর্ষণ করছে। দু’বাংলার নাটক সম্পর্কেই কথাটা সমান সত্য। আর দু’চার বছরের মধ্যেই দু’বাংলার নাট্যচর্চা থেকে বড় কিছু পাবো বলে আমি আশাবাদী।
কেশব মুখোপাধ্যায়
বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বাংলা নাট্য সাহিত্য দুর্বল এবং বাংলায় ভালো নাটকের অভাবের কথাও শোনা যায়। এবং বাংলা সাহিত্যিকরা নাটক লিখতে উৎসাহী নন এমন অভিযোগও করে থাকেন কেউ কেউ। এই সূত্রে বাংলা নাট্যসাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন-
তাপস সেন
এ বিষয়ে আমার পক্ষে বলা খুব মুশকিল। কারণ এ বিষয়ে বলার যোগ্য লোক আমি নই। তবু আমি জানি শম্ভু মিত্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং অনেক সাহিত্যিককে নাটক লিখতে বলেছিলেন। তবে লিখিত নাটক যদি মঞ্চস্থ বা অভিনীত না হয়, তবে নাট্যকারের আক্ষেপ থাকে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা পাঠকরা সরাসরি পাঠ করেন। কিন্তু নাটক তা নয়। বাংলা সাহিত্যের লেখকদের মধ্যে নাট্য সাহিত্যের প্রতি প্রীতি তেমন নেই। তবে এখন পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে আমরা ভালো নাটক পাচ্ছি। জেলার লোকরা নাটক লিখছেন। এটা আগে ছিল না। আগে কোলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে যে নাটক হতো তাই অনুকরণ করে কোলকাতার বাইরে এবং জেলায় নাট্যচর্চা হতো। এখন সেদিন বদলেছে। এটা বদলানো খুব জরুরি ছিল। সাহিত্যিকরা নাটক লেখায় উৎসাহী হচ্ছেন না, একথা বলার আগে বলতে হয়, যাঁরা নাটক লেখেন তারাই অন্য দলের জন্য নাটক লেখার উৎসাহী হচ্ছেন না। একমাত্র মনোজ মিত্র অন্য দলের জন্য কিছু কিছু নাটক লেখেন, তরুণ রায়, উৎপল দত্ত নিজের দলের জন্যই নাটক লিখতেন। অজিতেশও তাই। পুরানো কোলকাতার পাবলিক থিয়েটারে বিধায়ক ভট্টাচার্য, জলধর চট্টোপাধ্যায়, শচীন সেনগুপ্ত, মন্মথ রায়, পরে দেবনারায়ণ গুপ্ত- এঁরা নাটক লিখেছেন। যদিও একথাও সত্যি যে পরবর্তী পর্যায়ে যে নাট্য আন্দোলন তার সঙ্গে তাঁরা যুক্ত ছিলেন না। এককালে উত্তর কোলকাতার থিয়েটারে একটা রমরমা জমজমাট দিনকাল ছিল। কিন্তু আজকে সেই উত্তর কোলকাতার নাট্য চিত্র খুব দুঃখের এবং মর্মান্তিক। আক্ষরিক অর্থে ‘স্টার’ ছাই হয়ে গেছে। ‘বিশ্বরূপা’ বন্ধ। কোলকাতার বাইরে থেকেও অনেক দর্শক কোলকতায় নাটক দেখতে আসতেন। আজকে টিভি আছে এবং ওয়ান ওয়াল থিয়েটার এবং অনেক দল নানা জায়গায় নাটক করতে যায়। ফলে উত্তরে কোলকাতার নাটকের প্রতি তাদের আকর্ষণ কমে গেছে। যে বাঁধুনি তখন প্রফেশনাল থিয়েটারে ছিলো, আজকে তা আর নেই। পাঁচ ছয়েক দশকে আমি কোলকাতার সমস্ত প্রফেশনাল থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং চোখের সামনে সব আলো নিবে গেল, ‘স্টার থিয়েটার’, ‘বিশ্বরূপা’, ‘রঙ্গমহল’, ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ’, একটার পর একটা থিয়েটারের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আজকে ‘রঙ্গনা’ এবং ‘সারকারিনা’ কেনো রকমে চলেছে। মিনার্ভা থিয়েটারও না চলার মতো। যে মিনার্ভা থিয়েটারের একটা ঐতিহ্য ছিল, গৌরবের একটা ইতিহাস ছিল- উৎপল দত্তের পরিচালনায় এলটিজি দশ বছর ঐ থিয়েটার চালিয়েছে, সেই মিনার্ভা থিয়েটারও আজ আর নেই। কোলকাতায় থিয়েটার বলতে আজকে অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্রসদন, শিশির মঞ্চ, মুক্তাঙ্গন-কেন্দ্রিক গ্রুপ থিয়েটারকে বোঝায়। কোলকাতার থিয়েটার দেখতে এককালে পূর্ব বাংলার ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ থেকে লোক এসে উত্তর কোলকাতায় ভীড় করতেন। আমাদের আগের জেনারেশনে সেই মানুষেরাও নেই, সেই থিয়েটার পাড়াও আজ আর নেই। আজ সেখানে অন্ধকার এবং শূন্য পরিবেশ। এর পিছনে অনেক কিছুর সঙ্গে বাড়িতে বসে টি.ভি দেখাও একটা কারণ এবং আগের সেই রুচি ও মন বদলে গেছে।
কেশব মুখোপাধ্যায়
উত্তর কোলকাতার থিয়েটার পাড়া যে ধ্বংস হয়ে গেল, একে বাঁচিয়ে তোলার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কি কোনো ভূমিকা নিতে পারে?
তাপস সেন
খুব শক্ত, কী করে বাঁচাবে মিনার্ভা থিয়েটারকে, একটা ব্যক্তিগত ব্যবসার জায়গাকে? স্টার থিয়েটারের মালিক একজন, লিজ আরেকজনের। একজন ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীকে সহায়তা করার জন্য সরকার কী করে আসে? এত আইনের জটিলতা, এত রকম মামলা মোকাদ্দমা, এত ফ্যাকরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কিছু করা উচিত ছিল। বুদ্ধদেব বাবু একাধিকবার বলেছেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই। অনেক কিছু ভাবা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয় না, এবং যে ধরনের ব্যাপারকে অবলম্বন করে ব্যবসায়িক থিয়েটার চলতো, আজকে সেই সিসটেমটাই পাল্টে গেছে অনেকগুলো কারণে।
কেশব মুখোপাধ্যায়
উত্তর কোলাকাতার বাণিজ্যিক থিয়েটারে ‘সেতু’ এবং উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’, ‘কল্লোল’ এই সব নাটকে আপনার আলো যাদু সৃষ্টি করেছিল। এবং খুব সামান্য উপকরণ নিয়ে আপনি একাজ করেছিলেন। ওই বিষয়ে যদি কিছু বলেন-
তাপস সেন
এ বিষয়ে কিছু বলতে আমার সংকোচ হবে এই কারণে যে নিজের কাজকে সাতকাহন করে বলা। তবু এইটে বলি ১৯৫৬ সালে যখন প্রথম কোলকাতার থিয়েটারে আসি, তার আগে অনেকদিন ধরে ভেবেছি কোলকাতার পাবলিক থিয়েটারে কাজ করবো। প্রথম ‘বিশ্বরূপা’ থিয়েটারে কাজ করি। তার আগে অনেকবার কথা হয়েছে, কিন্তু হয়নি। বিশ্বরূপায় প্রথম কাজ করি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’ নাটকে। পরিচালক ছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। তারপর ‘ক্ষুধা’। ‘সেতু’ নাটকে একটা রেলের দৃশ্য করেছিলাম। যা দর্শকের মনে সাড়া জাগিয়েছিল এবং ওই নাটকেই কমল চৌধুরী, প্রভাত হাজরার সহায়তায় প্রথম টেপ রেকর্ডারের ব্যবহার করেছিলাম। টেপ রেকর্ডারে রেলের শব্দ এবং আলো ছায়ায় রেলের দৃশ্য তৈরি করি। রিয়ালিস্টিক বা বাস্তবধর্মী নয়। নায়িকা তৃপ্তি মিত্র আত্মহত্যা করতে যাবে। ‘বহুরূপী’র খ্যাতিমান অভিনেত্রী পেশাদার নাটকে এলেন। ওই নাটক আরম্ভ হয় ১৯৫৯ সালের সপ্তমী পূজোর দিন। ‘সেতু’ ভীষণ সাড়া ফেলে এবং পাঁচ বছর চলে। ট্রেনের ওই দৃশ্যটা ছিল দেড় মিনিটের। আর উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’ আরম্ভ হয় তার দু’মাসের মধ্যে, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫৯-এ মিনার্ভা থিয়েটারে। কয়লাখনিকে কেন্দ্র করে একটা স্পেক্টাকুলার নাটক করার জন্য ‘অঙ্গার’ নাটকের কথা ভাবা হয়। কয়লাখনিতে শোষণ, ইংরেজ মালিক কয়লাখনি ডুবিয়ে দিলেন, কারণ তাদের প্রোপার্টি বাঁচাতে হবে। কয়েকজন শ্রমিক খনির নিচে গেছে, তাতে কী! কয়লা খনির নিচে যাওয়া শ্রমিকদের সুদ্ধ কয়লাখনি ডুবিয়ে দাও। আলো, ছায়া, সঙ্গীত, কম্পোজিশন সব কিছু নিয়ে কোন জায়গায় যাওয়া যায় উৎপল দত্ত তা বুক ঠুকে দেখিয়ে দিয়েছেন ‘অঙ্গার’ নাটকে। বিশ্বরূপা-র দক্ষিণেশ্বর সরকার আমাকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, নিমতলা ঘাটে লোকে বল হরি, বল হরি বোল করতে যায়, ওখানে কী করতে যাচ্ছেন? কিন্তু সেই নিমতলা ঘাটের রাস্তা জনসমাগম দেখলো মিনার্ভায় ‘অঙ্গার’ নাটককে কেন্দ্র করে। এবং ‘অঙ্গার’ নাটক মফস্বলের দর্শককেও আকৃষ্ট করলো। এইখানে দত্তের একটা বড় ভূমিকা আছে। সমাজ সচেতন, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা দিয়ে নাটক করা। উৎপল একটার পর একটা নাটকে সেই প্রমাণ যোগ্যতার সঙ্গে রেখেছে। সামান্য উপকরণ নিয়ে আমাকে ‘অঙ্গার’ নাটকে কাজ করতে হয়। লিটল থিয়েটার গ্রুপ তখন আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। আলোর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের জন্য কিছু উপকরণ আমদানি করার প্রয়োজন হয়েছিলো। কিন্তু আর্থিক সংকটে পড়া লিটল থিয়েটার গ্রুপের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া বাইরে থেকে ওইসব যন্ত্রপাতি আনতে ছ’মাস সময় লাগতো। প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা মানুষকে ভাবায়, উপায় অনুসন্ধানে প্রেরণা দেয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। লজেনস এবং বিস্কুটের ভাঙা টিন ইত্যাদি দিয়ে ‘অঙ্গার’ নাটকে আলোর কাজ করেছিলাম, জলোচ্ছ্বাসের দৃশ্য তৈরি করেছিলাম।
আগামী সংখ্যায় সমাপ্য
[বি.দ্র. সাক্ষাৎকারের বাকি অংশটুকু অগ্রজ নাট্যজন ঠাণ্ডু রায়হান আর সংগ্রহ করতে পারেননি। তাই ‘আগামী সংখ্যায় সমাপ্য’ উল্লেখ করলেও সাক্ষাৎকারটির বাকি অংশটুকু আমরা আর পুনমুর্দ্রণ করতে পারিনি। ফলে বঞ্চিত হয়েছে ‘থিয়েটারওয়ালা’, বঞ্চিত হয়েছে আমাদের পাঠক। তারপরও থিয়েটারের আলোর কিংবদন্তী শিল্পী তাপস সেনের কাজ ও ভাবনা নিয়ে যতটুকু জানা গেলো, তার জন্য তাপস সেন, কেশব মুখোপাধ্যায়, সাক্ষাৎকারটির প্রকাশক ও ঠাণ্ডুভাইয়ের কাছে আমরা ঋণী হয়ে রইলাম- সম্পাদক]