Full premium theme for CMS
হাসতে হাসতে দেয়াল ভাঙ্গো দাদাঠাকুর
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[অনেকেরই জানার বাইরে আছে বোধ করি যে, ঢাকা থিয়েটার একটি মঞ্চ-নাট্য বিষয়ক ত্রৈমাসিক প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল ১৯৮১ সালে। নাসির উদ্দীন ইউসুফ সম্পাদিত ত্রৈমাসিকের প্রথম এবং একমাত্র সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় নভেম্বর ’৮১ তে। পত্রিকাটির একটি কপি, প্রকাশের মাত্র (!) ২৬-২৭ বছর পর নাট্যবন্ধু, থিয়েটার আর্ট ইউনিট সদস্য, তারেকুল ইসলামের কল্যাণে আমার হাতে এসে পৌঁছায়। এমন একটি সমৃদ্ধ প্রকাশনা যদি নিয়মিত বের হতো তাহলে আজকের মঞ্চনাটকের চর্চার ধরনটাই হয়তো পাল্টে যেত। বিশেষ করে মঞ্চনাট্য-সমালোচনার যে দুর্গতি প্রত্যক্ষ করি পত্রিকার পাতায় পাতায়, তার বদলে কী পেতে পারতো আমাদের থিয়েটার তা বোঝা যাবে সেদিনের সেই পত্রিকায় প্রকাশিত সদ্যপ্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীনের লেখা, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের প্রযোজনা অচলায়তন-র নাট্য-সমালোচনার ধরনটি খেয়াল করলে। পাঠকদের জন্য এই নাট্য-সমালোচনাটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো এই বিশেষ সংখ্যায়।- সম্পাদক]
প্রথম বৃত্ত
ক.
অচলায়তন-র চারজন দর্শক, দেশ কাল বিচার। রেস্তোরা ও রাজপথ।
সেই কালো কালো অতুলপ্রাণ আর শক্তিধারী শোনপাংশুগণ অচলায়তনের পাথুরে প্রাসাদটিকে, তার আত্মকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতার অসীম অহংকারকে ধূলিসমচূর্ণ করে দেয়। শিবের আঙ্গিকে দাদাঠাকুর অট্টহাসি আর প্রলয়কে ধারণ করেন। কাফুড় চাষী অন্ত্যজ মানুষগণের তিনি বন্ধুঠাকুর। তাঁর মন্ত্র মেঘের চিকুর হানাতে কড় কড় করে, কুরুবকের শাখায় সে মন্ত্র পাতা ও ফুলের পাশে। কালো কয়লার মধ্যে যখন একটি রোমশ ঘর্মাক্ত হাত অস্পৃশ্য লোহাকে তীব্র লাল করে তাকে রূপান্তরিত করে লাঙ্গলের ফালে, আর যে ধাতব রূপান্তরে হাতুড়ীর ঠুকঠাক ঠুকঠাক চলে সেই তো দাদাঠাকুরের মন্ত্রোচ্চারণ। অবশেষে স্থবিরক আর অন্ত্যজ মানুষের মিলিত রক্তের উপর তিনি নতুন নির্মাণের সংকল্প ঘোষণা করেন। অচলায়তন নাটকের যবনিকা পড়ে।
অচলায়তন নাটকের যবনিকা পড়ে। প্রেক্ষাগৃহের আলোগুলো জ্বলে উঠতেই আমরা দাঁড়িয়ে যাই। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের কুশীলবগণ মঞ্চে আসেন। তুমুল করতালি। তৃপ্ত মধ্যবিত্ত দর্শক এখন মূল দরোজার দিকে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যাবে। শ্যানেল-মদির মেয়েগুলোর হাতের চুড়ি টুং টাং করে বাজে। এই এতোক্ষণ ধরে নারী পুরুষের শরীরের ভাপে যে ঘরটিতে মধুর উষ্ণতা জমেছিল মূল দরোজার দিকে তারাও ছুটতে থাকে।
মূল দরোজার দিকে, তারাও ছুটতে থাকে। বাইরের শীত রাত্রির শোনপাংশু হাওয়া তখন প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে পড়ে। তার শরীরে চন্দ্রিমা ও শিশিরের স্পর্শ। আমরা চারজন- আমি, রইস, ফরিদী আর বাচ্চু। বাসা-প্রিয় মধ্যবিত্তদের চাপ সামলানো দায়। প্যাসেজটি মুহূর্তে আরিচার বাস হয়ে যায়। দু’জন দর্শক উর্দ্ধগ্রীব, ফরিদীর পা মাড়িয়ে দিয়ে ঠোঁট সূচালো করে বলে, ‘স্যরি’।
আতাউর ভাই, আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে দেখা হয়। কুশল বিনিময়। তারপর আমরা বেরিয়ে আসি রাস্তায়। বাচ্চু বলেঃ চল চা খাব। তারপর রিকশা নিয়ে বাসায়। ফরিদী সিগ্রেট ধরায়ঃ ‘শালারা শহরও বানিয়েছে, আর ডু ডু খেয়ে রাত সাড়ে আটটায় ঘুমিয়ে পড়ার নব্য পৌরনীতিও মেনে চলেছে।’
আমি যোগ করিঃ এই জঘন্য শহরটাতে দিনের বেলা সবার মুখে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার ছাপ। তৈলাক্ত মুখে উৎকন্ঠা। আত্মকেন্দ্রিক জিঘাংসা স্যুয়েরেজ সিস্টেমের মত অন্তঃসলিলা। তাই রাতের বেলা এরা শোকগ্রস্ত। এ শহরের সব রাত্রিই যেন শোকরাত্রি। বাচ্চু বলেঃ স্রেফ কেরাণী আর চাকুরীজীবীর শহর। আমরা নিঃশব্দে হাঁটতে থাকি সামনের রেস্তোরাটি লক্ষ্য করে।
রইস বলেঃ মনে আছে সেলিম ভাই? সেবার চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম এক সাথে? অরিন্দমের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ’৭৮ সালে, ‘ঢাকা থিয়েটার’ থেকে আমি আর রইস চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। রাত দুটোয় হাইলেভেল রোড থেকে বেরিয়ে শিশির দত্ত, নমি, হেলালদের নিয়ে স্কুটার চেপে চা খেতে গিয়েছিলাম।
হ্যাঁরে! ওর চেয়ে সুন্দর শহর আর কি হতে পারে’ আমার মনে পড়ে যায়। পাহাড়ের ওপরে চাঁদ। শেষ রাত্রির চাঁদ। বিষণ্ন কমলা রঙের। স্কুটারে বসে আমরা বেসুরো গান ধরলাম। ওপাশের চা দোকানে বাউলের গান, মাতাল কুলি। টলতে টলতে এসে আমাকে বলেছিলঃ স্লামুলাইকুম দারগা সাব।’ স্মৃতি স্মৃতি স্মৃতি। সেবার কয়েক রাত ধরে আমরা গ্রুপ থিয়েটার আর নাটকের আলাপ করে কাটিয়ে দিয়েছিলাম- ‘আজও তাই করব’ বাচ্চু বলে। আজ সারারাত ধরে অচলায়তন-র আলোচনা আর আড্ডা চলুক।
ফরিদী লাফিয়ে ওঠেঃ রাজী।
বাচ্চু বলেঃ ‘পেছনের দিকে তাকালে আমাদের যা কিছু উষ্ণ স্মৃতি, আনন্দ, বিষাদ, সবই তো গ্রুপ থিয়েটারকে কেন্দ্র করে। সিলেটগামী মাঝ রাত্রির ট্রেন, বেগুনী ফুল পাহাড়ের গায়ে গায়ে, লালচানের সানাই জানালার পাশে- সবই। বগুড়া, রাজশাহী, ঢাকা- সব জায়গাতে এভাবেই মঞ্চ ও মঞ্চের আশে পাশে আমাদের বয়স বাড়ছে।’
আমরা নিঃশব্দে বুকের ভিতরে অনেক দূর নেমে যেতে থাকি। আমাদের মধুর ভ্রান্তি, অপরিচিত উৎসুক জনতার চোখ, সকাল সন্ধ্যা সব কিছু মনে পড়ে যায়।
রেস্তোরায় ঢুকে ফরিদী চেঁচিয়ে বলেঃ ‘অই, চাইর কাপ চা লাগা।’ আমরা বসে পড়ি।
বাচ্চু বলেঃ ‘হ্যাঁ এবার বল, নাটকটি কেমন লাগল।’
আমি বললামঃ ‘অচলায়তন নাগরিকের একটি প্রশংসনীয় নির্বাচন। কথাটি আমি বলছি সময় ও শিল্পবোধের দিক থেকে বিবেচনা করে।’
বাচ্চু বারবার চিন্তা করতে গেলে যেভাবে করে, হাতের আঙ্গুলে কানের কাছের চুল টানেঃ ‘তুই ঠিকই বলেছিস। অচলায়তন নাগরিকের একটি প্রসংশনীয় নির্বাচন। এখন (১৯৮১) সারা দেশে পেট্রো মুদ্রার শাসন। রাজনৈতিকভাবে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু লেখক বলে নির্বাসিত করার পাকিস্তানী রীতির চেষ্টা হচ্ছে। দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের ঐতিহ্য চেতনা আবার বিভ্রান্ত হতে চলেছে। অগ্রগামী জনসাধারণের মধ্যে মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিষ ছড়ানো হচ্ছে।’
তাই এ মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়ন মানেই, একটি সুস্থ সামাজিক চেতনা সম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা জমাতে সাহায্য করে।
ফরিদী টেবিল থাপড়ে দেয়ঃ ‘রবীন্দ্র নাটক সম্পর্কে অসচেতন কোনো নাট্যকর্মীর উচিত দ্রুত ইনডেন্টিং বা অনুরূপ কোনো ব্যবসায় নেমে যাওয়া।’ আমরা হাসি। চা আসে ততোক্ষণে। কষটে স্বাদ। চুমুক দিয়ে মুখ বেজার হয়ে যাবার মত চা। বাচ্চু চায়ের কাপটি নামিয়ে রেখেঃ ‘যতদূর মনে পড়ে টাঙ্গাইলের একটি নাট্যগোষ্ঠী ‘চম্পক’ রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নিয়ে নেমেছিল। বেইলী রোড পর্যন্ত তারা এসে নাটকটি মঞ্চস্থও করেছিল। তারপর, এইবার অচলায়তন নিয়ে এল নাগরিক।’
কিন্তু এর আগে, অচলায়তন-র আগে অন্য একটি নাট্যগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথকে প্রথম মঞ্চে আনার দাবী করেছিল- রইস বলে। আমরা হো হো করে হেসে উঠিঃ ‘বটে বটে! সে নাটকে রবীন্দ্রনাথ কি সশরীরে মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন?’
‘রবীন্দ্রনথকে প্রথম মঞ্চে আনা! হাহ।, ‘এই প্রথম’ ‘সর্ব প্রথম’ ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ এই-সব কাহিনী শব্দাবলী বাজারে পানির দরে বিক্রী হচ্ছে। ছোটবেলা শুনেছিলাম কমলাপুর স্টেশনও নাকি এশিয়ার বৃহত্তম। এইসব শব্দের যত্রতত্র ব্যবহার একটি জাতির বিচার-বিশ্লেষণ, বুদ্ধি-মেধা মননের অধঃপতনকে ইঙ্গিত করে।
কোনো দেশের একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে এসব সুপারলেটিভ ডিগ্রী ও রাজনীতি, শিল্প সাহিত্যেও অনুপ্রবেশ করে। রবীন্দ্রনাথের একটি নাটকও মঞ্চস্থ না করে কেউ যদি রবীন্দ্রনাথকে মঞ্চে আনার দাবী করে তাহলে তা হবে হাস্যকর- বাচ্চুু বলে।
আমি তখন উত্তেজিতভাবে বলিঃ বরীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপের আমি ঘোর বিরোধী। কারণ বরীন্দ্রনাথ নিজেই পঞ্চাশোর্ধ নাটকের মালিক। তিনি নিশ্চয়ই জানতেন গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু আর নাট্য বস্তুর ব্যবধানের কথা। আমি যদি উপন্যাস লিখি তা হলে কি আমার পবিত্র দায়িত্ব হবে রক্তকরবী'-কে একটি উপন্যাস বানানো?
ফরিদী বলেঃ ‘তাহলে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধার করবে কে?’
এ ধরনের উদ্ধারকার্যে তুমি যদি নিয়োজিত হও তাহলে ইনফার্ণোর ষষ্ঠ বৃত্তে তোমার গতি হবে, এপিকিউরিয়াদের সঙ্গে- আমি জবাব দেই।
বাচ্চুু অল্প অল্প হাসছিল।
- তবে কথা আছে! বিষয়টি এত সহজে নিস্পত্তি হবার নয়। রবীন্দ্রনাথের কোনো গল্প বা উপন্যাসের সঙ্গে কেউ যদি শিল্পী হিসেবে একাত্মতা অনুভব করে এবং সেই একাত্মতা যদি আবেগদীপ্ত হয়ে ভিন্নমুখী শিল্প মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাহলে তাকে দূষণীয় বলা যাবে না। আর যদি তা পূর্ণ সৃষ্টির গৌরব অর্জন করে তাহলে তো কথাই নেই।
আমি প্রতিবাদ করিঃ কিন্তু রবীন্দ্র উপন্যাসের নাট্যরূপ যদি একটি সর্বজন-বিদিত দুর্বল উপন্যাসের নাট্যরূপ হয়?
- সেটা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। অবশ্য মহৎ লেখকদের দুর্বল শিল্প কর্মে কেউ অনুপ্রাণিত হয়ে যদি জীবন ও আবেগকে পুনর্নির্মাণ করে, তবে সে ক্ষেত্রে নাট্যরূপ কথাটা থাকে না।
এ সময় দু’জন রিকশাঅলা এসে ঢুকলো। মাথায় মাফলার বাঁধা। আমাদের সামনের টেবিলে ওরা ধপ্ করে বসে পড়ে। ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত। তারা ভাত খাবে। দূরে রিকশা দু’টি। একজন নীল জামা পরা মেট্রোপলিটান পুলিশ আলো অন্ধকারে ঝুঁকে নম্বর প্লেট দেখে। তার চোখেও ক্ষুধা। শেষ চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখি। বাচ্চুঃ জাতীয় নাট্য-আঙ্গিক ও নাট্যবস্তুর একজন নির্মাতা বলেই রবীন্দ্রনাথের নাটক নির্বাচনে আমরা উল্লসিত। কারণ আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের নাটকে এখন দ্বিতীয় স্তরের বিকাশ ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্ষ। দ্বিতীয় স্তরের বিকাশ কী? রক্ষণশীল অথবা অন্ধদের নাট্যচর্চা এবং বিদেশী নাটকের অনুবাদ ভাবানুবাদের মাধ্যমে পরজীবী নাট্যচর্চা, এই দ্বিবিধ ধারা হচ্ছে এক নম্বর স্তর। জাতীয় আঙ্গিক ও দেশীয় নাট্যবস্তুর সমন্বয়ে যে নাট্যচর্চা সেটাই দ্বিতীয় স্তরের বিকাশ। এটাকে তুমি তৃতীয় ও মূল ধারাও বলতে পারো। কিন্তু এটা তৃতীয় স্তর কখনই নয়। কারণ তৃতীয় স্তর অনুশীলনী বা দর্শন খোঁজার স্তর নয়। সমৃদ্ধির স্তর। অবশ্যই জন্ম নেবে একজন মহৎ নাট্যকার, একদল অসাধারণ নাট্যকর্মী। চা পান শেষ হলে আমরা বেরিয়ে পড়ি পুরানা পল্টনের উদ্দেশ্যে।
প্রথম বৃত্ত
খ.
রাজপথে। ইঙ্গ-মার্কিন সংস্কৃতি, আমাদের জীবন দর্শন ও চারজন তরুণের ক্ষোভ।
রেস্তোরা থেকে আমরা বেরিয়ে পড়ি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
- এই মিয়া যাবা?
- কই?
- পুরানা পল্টন।
- না।
তারপর তিনটে রিকশা নাকের কাছ দিয়ে শূন্য চলে গেল। আমরা রেগেমেগে অবশেষে ঠিক করলাম হেঁটেই যাব। হাঁটতে হাঁটতে ট্রাফিক সিগন্যাল। গাড়ী ঘোড়া নেই। বাতিগুলো নিরন্তর জ্বলছে-নিবছে। সিগন্যাল মান্য করার জন্য আমরা সবাই থমকে দাঁড়িয়ে যাই। অতঃপর সবুজ বাতি জ্বলতেই আবার যাত্রা শুরু করি। বুদ্ধদের বসুর সাতাশ-আটাশের ঢাকার কথা মনে পড়ে যায়। শামসুর রাহমানের কবিতায় যে রকম, গাড়োয়ান ঘোড়া আর তার খুরের শব্দ-পিছনে টের পেয়ে যাই যেন।
বাচ্চু এবার পূর্ব প্রসঙ্গ টানে।
- জাতীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা পেট্রোমুদ্রা নির্ভরতা ও মধ্যযুগীয় বর্বরতার উল্লেখ করেছি। কিন্তু এদেশে ইঙ্গ-মার্কিন সংস্কৃতির প্রবহত অনু-কারক উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এরা মুখে বলে বটে জাতীয়তাবাদ, কিন্তু সেটা কী তারা তা জানে না। তাদের মুখে এটা একটা পপ-স্লোগান মাত্র। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের সংযোগ ব্যতীত জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক বুলি। যে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, রাজনীতি ও স্বৈরতন্ত্রের, আমলাতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের কলকাঠি তারাই নাড়ে এবং এদের স্তরেই শিল্পী-সুলভ চাতুর্যপূর্ণ বিভিন্ন স্লোগানের জন্ম হয়। পোস্টারে, বক্তৃতায়, বেতারে ও দূরদর্শন যন্ত্রে এইসব বাক্য রাজনৈতিক চাটুকারদের দ্বারা সর্বহারা শ্রেণীর ভাষার সারল্য ও চরিত্রকে প্রভাবিত করেছে। ইউটোপিয়ান বিপ্লবীগণ আগে দেখতাম দিন তারিখ দিয়ে বিপ্লব ঘোষণা করত। (‘রপ্তানী বৃদ্ধির বিপ্লব’ ‘খাল কাটা বিপ্লব’ এই ধরনের অজস্র বাক্য আছে যেগুলো উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত ও সম্প্রদায় নির্মিত চাতুর্যপূর্ণ বাক্যের উদাহরণ) ‘গুরুত্ব আরোপ করেছেন’ ‘সমৃদ্ধি কামনা করি’ ‘ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস’ ‘গণমানুষের কাছে যেতে হবে’- এ রকম কয়েকশ’ ট্রিকি শব্দ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এসে পড়েছে।
‘এ থেকেই ধারণা করা যেতে পারে দুরভিসন্ধিমূলক রাজনীতিতে প্রতিটি স্লোগান যেমন কার্যত বুলিমাত্র-তেমনি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতেও ‘জাতীয় সংহতি’ একটি পপ-স্লোগান।’
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের আকুল আগ্রহে আমাদের সমগ্র জনজীবনে প্রবেশ করেছে, ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের আধুনিক উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনের আত্মিক-শূন্যতা তাদের জীবনে পারদ রোগীর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। প্রাচীনকালে দূর্ধর্ষ জলদস্যুদের উপদংশ হলে পারা চিকিৎসা চলত। জীবানুঘটিত পাপকে মনুষ্য-শরীরের জন্য মারাত্মক এমন বিষ দিয়ে ঢাকতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবু চলছে পারা চিকিৎসা। ঐতিহ্য বোধহীন ও শোষণমুখী সমাজের ডাক্তার হচ্ছেন থিওফ্রাসটুস বমবাসটুস কনহোহেন হেইম সেলসাস।
বাচ্চুু থামে। আমরা হাঁটতে থাকি। ফরিদী ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলেঃ যে হাত দিয়ে একটা সুঁইও আবিস্কৃত হয় নি, সে হাত পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন-যাপন ও ফ্যাশন-বিলাসকে কীভাবে গ্রহণ করে? আমি বলি, এমনকি তাদের বিজ্ঞানকেও আমরা নিজেদের পদ্ধতিতে গ্রহণ করব।
বাচ্চুু যোগ করেঃ আমাদের দেশে যুদ্ধোত্তরকালের সদ্য গজানো উচ্চবিত্ত ও উচ্চাকাক্সক্ষী মধ্যবিত্তের চেহারা ক্রমশ মেতুসার মত ধারণ করেছে। লোভ হিংস্রতা ও পাশবিকতার প্রতিযোগিতা চলছে আজকাল সকাল-সন্ধ্যা। এরা রদ্দি সিনেমার দর্শক বেস্ট সেলার নভেলের পাঠক। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এরাও উদাসীন। রবীন্দ্রনাথ এদের ওয়েস্টার্ন ক্যাচ-আপ এর মধ্যে অসহায়ভাবে আছেন।
- ‘রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাড়াবাড়ি আমার একদম ভালোলাগে না। একথা ঠিক, কিন্তু তাঁকে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির চেতনা থেকে নির্বাসিত করে শেষমেষ গোল্লায়ও যেতে রাজী নই।’ বাচ্চুুর কথায় আমরা একযোগে সায় দিয়ে উঠি- অবশ্যই। তা হলে সেলিমের কথা দিয়েই শেষ করি অচলায়তন নাগরিকের একটি সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় নির্বাচন।
বিজয় নগরের মোড় ঘুরতেই আমরা একটি নারী কন্ঠের হাসিতে চমকে উঠি। অন্ধকারে তার চারপাশে জনাতিনেক ফুটপাতবাসী পুরুষ। বিপণী বিতানের বারান্দায় ওরা পরস্পরকে গালাগাল করে।
- অই, অই মাগী রং করতাছস ক্যান, চুপ থাক কইতাছি।
- আরে আমার মদ্দরে। লাথি মাইরা তর টেপা ফুটায়া ফালামু। মেয়েটি খিলখিল করে হাসে।
আমরা কতদূর এগিয়ে বাঁয়ে মোড় নেই। সরু পথ। এদিক-ওদিক করে সোনার বাংলা স্টোর ডানে রেখে বাচ্চুর বাসার সামনে এসে দাঁড়াই। এই এতোক্ষণ হেঁটে পা ধরে এসেছে। ঘড়িতে রাত পৌনে দশটা। বাচ্চুুর বউ হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে দেয়। এতোজনকে একসাথে দেখে সে-ও চেঁচিয়ে ওঠে।- গোল্লায় গেল আমার এত সুখের ঘুম।
দ্বিতীয় বৃত্ত
ক.
পাঁচজন তরুণ-তরুণী। কবিদের বর্ণনাত্মক রীতির সমালোচনা ও অচলায়তন-র ভঙ্গী।
কার্পেটে বসে খাটে পিঠ ঠেকিয়ে বাচ্চুু একটি সিগ্রেট ধরায়। তারপর বলতে শুরু করে- সমগ্র অচলায়তন-এ বর্ণনাত্মক ভঙ্গীর সঙ্গে নাটকীয় উপাদানের একটি দুর্লভ মিশ্রণ দেখা যায়। আমি প্রথমেই বর্ণনাত্মক ভঙ্গীর কথা বলব। সালেক খান, আতাউর রহমান ও মাহমুদ হোসেনের সংলাপের রীতি ও বিস্তার স্মরণ কর।
সচরাচর কবিদের লেখা নাটকগুলোতে বর্ণনাত্মক ভঙ্গির প্রাধান্য থাকে। স্পন্দিত রক্ত-মাংসের গড়া মানুষেরা নিরন্তর সক্রিয়তার মাধ্যমে যে ঘটনাপুঞ্জের জন্ম দেয় তা যখন আত্মা ও চরিত্র থেকে অপৃথকযোগ্য হয়ে যায় তখন একটি সত্যিকার নাটকেরও সৃষ্টি হয়। সম্ভবত কবিরা যতটা-না অবিরল চিত্রকল্প ও শব্দচেতনার প্রমাণ দিতে পারেন, ততটা মঞ্চ ও বহির্জগত সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রমাণ দিতে পারেন না। নিতান্ত শব্দসূত্রে পাওয়া চরিত্রগুলো তাই স্বতঃস্ফূর্ত নয়। চরিত্রসূত্রে পাওয়া চরিত্রগুলোই নাটকে অধিকতর কাম্য। মূলত কবি এমন কেউ যদি কাব্য প্রেরণার বশে নাটক লেখেন, সে নাটক বর্ণনাত্মক ভঙ্গীর হতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে বর্ণনাত্মক ভঙ্গী আবার দু’রকমের। মূলত নাট্যকার এমন কেউ যদি বর্ণনাত্মক ভঙ্গীর নাটক লেখেন তার মধ্যে থাকে প্রচুর থিয়েট্রিক্যাল এলিমেন্ট। ব্রেখটের মাদার কারেজ বা অসবর্ণের লুথার এ ধরনের নাটক।
কিন্তু কাব্যের রীতিতে যে বর্ণনাত্মক ভঙ্গী তা একজন কবির নাটক রচনার অক্ষমতাজনিত কারণে। একে থিয়েট্রিক্যাল বর্ণনাত্মক ভঙ্গীর সঙ্গে একত্রিত করা যায় না।
- তাহলে সেদিন টেলিভিশনে একজন প্রথিতযশা কবিকে এনে তার কাছ থেকে কাব্যনাট্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সার্টিফিকেট নেয়া হল, আর সেই কবিকে দিয়ে একটি নাটক লেখারও যে প্রতিশ্রুতি চাওয়া হল?- রইস প্রশ্ন করে।
- হ্যাঁ আমিও দেখেছি অনুষ্ঠানটি। বাচ্চুু গলা ঝাঁকারী দেয়। এস্ট্রে থেকে প্রচুর ধোঁয়া উঠছিল। বাচ্চুুর বউ সেটি নিভাতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা খায়। বউ সামলে নিয়ে বসে। বাচ্চুু নড়েচড়ে ওঠে।
- ব্যাপারটি আমার কাছে খুবই হাস্যকর মনে হয়েছে। অনুরোধে পড়ে যে কবি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বা রচনারীতির দ্বারা আয়ত্বযোগ্য নয় এমন শিল্পকর্ম রচনার প্রতিশ্রুতি দেন, তা হলে তা কখনও সফলতা লাভ করতে পাবে না। কারণ, কারো অনুরোধ নয়, শিল্পের জন্ম মনের তাগিদ বা প্রেরণা থেকে। কাজেই অনুরোধে পড়ে ঐ কবি যদি নাটক রচনার প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে ধরে নিতে হবে এটা তার অসচেতন উক্তি। আর যদি তা না হয় তো বলব, তিনি নিজেকে অত্যধিক মূল্যবান মনে করেন। বাংলাদেশের সমকালীন নাটক ও তার উৎস সম্পর্কেও তার কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই। কিংবা অহমিকা বশত তিনি তা অনুভব করেন না।’
‘আজ আট বছরেরও বেশি সময় ধরে যখন বাংলাদেশের মঞ্চ-নিবেদিতপ্রাণ নাট্যকর্মীদের প্রাণান্তর পরিশ্রমে এগিয়ে যাচ্ছে, সে সময় একজন নামী ও মঞ্চবিমুখ কবির কাছে এ ধরনের আবেদন নিবেদন নিদারুণ পরিহাসের মতই শোনা যায়।’
‘আগেই যা বলেছি, নাটক লেখার প্রতিশ্রুতি ঐ কবির অজ্ঞতাপ্রসূত অহঙ্কার। সে কবি জানেন না ’৭২ সালে আমাদের তরুণরা যখন নতুন ধারার নাটক শুরু করল তাদের ভাগ্যে নিদ্রাহীন রাত, উপহাস ও লাঞ্ছনাই জুটেছিল। সে দুঃসময়ের দায়ভাগে না থেকে এবং আজকেও সারা দেশের ‘গ্রুপ থিয়েটার’ পদ্ধতি ও শত শত মঞ্চকর্মীর কষ্টক্লেশের সঙ্গে পরিচিত না হয়ে তাঁর কী অধিকার আছে নাটক লেখার দুর্লভ প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের কৃতার্থ করার? ভাগ্য ভালো যে আবেদনকারী একজন নাট্যকর্মী নন।- বাচ্চুুর কন্ঠে উত্তেজনা ঝরে পড়ে। যদিও সে সচরাচর কম উত্তেজিত হয়। অচলায়তন প্রসঙ্গে প্রবেশ করার আগে এ সম্পর্কে আমাদের শেষ কথাটি বলি। আজকের দিনে একজন নাট্যকার গ্রুপ থিয়েটারের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই পূর্ণতা লাভ করবে। এর বাইরে থেকে তুড়ি বাজিয়ে কেউ মঞ্চ মাৎ করতে পারবে না।’- বাচ্চু থামে।
আমরা এবার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করি। কতক্ষণ হাসি-ঠাট্টা, হৈ-চৈ। তারপর মূল প্রসঙ্গে প্রবেশ করি। ফরিদী বলেঃ ‘হ্যাঁ বাচ্চু ভাই, শুরু হোক।’ ‘বলেছিলাম, অচলায়তন-র আঙ্গিকে বর্ণনাত্মক ভাষার সঙ্গে নাটকীয় উপাদানের একটি অভূতপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে।’.. ‘দেখি’.. বলে সে বইয়ের গাদির দিকে হাত বাড়ায়। বউ উঠে গিয়ে একাদশ খণ্ড রচনাবলী বের করে আনে। সে দু’একটি সংলাপ পড়ে-
আচার্য
বাঁচালে প্রভু, আমাকে রক্ষা করলে, আমার সমস্ত চিত্ত শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে-আমাকে এই পাথরের বেড়া থেকে বের করে আনো। আমি কোনো সম্পদ চাইনে- আমাকে একটু রস দাও।
দাদাঠাকুর
ভাবনা নেই, আচার্য ভাবনা নেই- আনন্দের বর্ষা নেমে এসেছে- তার ঝর ঝর শব্দে মন নৃত্য করছে আমার। বাইরে বেরিয়ে এলেই দেখতে পাবে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। ঘরে বসে ভয়ে কাঁপছে কারা। এ ঘনঘোর বর্ষার কালো মেঘে আনন্দ বজ্রের গর্জনে। আজ মাথার উষ্ণীষ যদি উড়ে যায় তো যাক, গায়ের উত্তরীয় যায় তো যাক, আজ দুর্যোগ একে বলে কে! আজ ঘরের ভিতর যদি ভেঙ্গে গিয়ে থাকে থাক না- আজ একেবারে বড়ো রাস্তার মাঝখানে হবে মিলন।
এই ভাষা সাবজেক্টিভ। এতে মনোজগতের আনন্দমুখর তীব্র কন্ঠস্বর ফেটে পড়েছে। মজার ব্যাপার এই যে, ভাষা যখন বাস্তব ঘটনাপুঞ্জ ও চরিত্রকে অতিক্রম করে তখনি সাবজেক্টিভ হয়ে যায়। এর অনিবার্য ফল স্বরূপ আবির্ভাব ঘটে বর্ণনাত্মক ভঙ্গীর। উপরন্তু অচলায়তন-র এই বিশেষ ভঙ্গীর পেছনে আরও একটি উপাদান কাজ করেছে। সেটি হচ্ছে গান।
সেটা কী রকম? ফরিদী প্রশ্ন করে।
‘এ নাটকে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ঘটনা ও মূল দ্বন্দ্বের ব্যাখ্যা হিসেবে গানের ব্যবহার লক্ষণীয়।
‘নাটকে গান ব্যবহারের আমি মোটেই পক্ষপাতী নই।’ আমি প্রতিবাদ করি।
‘ভাল কথা। কিন্তু কোন ধরনের নাটকে গানের ব্যবহার চলে, আর কোন ধরনের নাটকেই বা তা চলে না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। শিল্পে কী চলে আর কী চলে না- এ রকম নৈয়ায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনুচিত। চালিয়ে দেবার যোগ্যতাই অর্জন করতে হয় শিল্পীকে। কাজেই গানের ব্যবহার নাটকে থাকবে না’ একথা বলার আগে দেখতে হবে, কোনো নাটকে এই গান কি নাটকের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে অপরিহার্য অথবা তা অতি পৃথুল প্রথারীতি মাত্র? দ্বিতীয়টির দৃষ্টান্ত অপ্রয়োজনীয়। কারণ তা শিল্পনন্দনবাচ্য নয়। প্রথমটির দৃষ্টান্ত অচলায়তন।
- তাহলে তুই কি বলতে চাস্ যে, কোনো নাটকে গানকে আঙ্গিকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুললেই গান সে নাটকে সিদ্ধ হয়ে যাবে?- আমি বলি।
- অনেকটা তাই। তবে কোনো নাটকে যদি বাস্তব জীবনের চিত্ররূপ হয় এবং তাতে কালিক ও স্থানিক ঐক্যের প্রশ্নটি জরুরী হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে গানের পৌণঃপুনিক ব্যবহার কালিক ঐক্যকে নিদারুণভাবে পীড়িত করে। দশ বছরের বাস্তব জীবনকেন্দ্রীক ঘটনা যদি ঘটনার ঐক্য মেনে চলে দুই তিন ঘন্টার সীমার মধ্যে তাকে বৃত্ত রচনা করতে হয়। পাঁচটি গান সেক্ষেত্রে সময় যাবে পঁচিশ মিনিট। ঐ পাঁচটি গানের জন্য পাঁচ ইউনিট সময় দরকার, তাহলে পাঁচ ইউনিট সময় ইনটু গানের দৈর্ঘ্য, সমান পঁচিশ মিনিট। বিশেষত ঐসব গান যদি ঘটনার ব্যাখ্যা ও অগ্রগতির সাহায্য না করে তা হলে সেগুলো হৃদয়াবেগের প্রাবল্যে ঘটনার তীব্রতাকে শ্লথ করে দেয়। দু’ঘন্টার মধ্যে যে সময়ের ঐক্য রচিত হল তা ঘটনার ঐক্যের সাথে একীভূত না হয়ে ঐ পাঁচটি গানের মাধ্যমে সময় ঐক্যের চ্যুতি ঘটাল। ফলে নাটকটি পরিণত হল একটি দুর্বল নাটকে।
‘কিন্তু একটি রূপক নাটকে ঘটনার চেয়ে বক্তব্যের দাবী বেশি। তাতে সময়ের ঐক্যের কড়াকড়ি নেই। ভক্তিমূলক পৌরাণিক নাটকেও গানের আধিক্য বা বর্ণনাতীত ভঙ্গী দেখা যায়। সেও একই কারণে- যেমন আমাদের জাবেদ বলেছিল এক বন্ধুর কাছে বসে বাঁশী বাজানো শুনে তার এক পরিচিত ছাত্র আবেগ বশত কেঁদে ফেলেছিল। উপস্থিত দু’একজন তা দেখে হেসে ফেলল। বলল- সে-কিরে এই আধুনিককালের একজন বাঁশী শুনে কাঁদবে, এটা ভাবাই যায় না। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে উত্তর করল- ভাব কোনো শতাব্দী মানে নারে। ভক্তিমূলক পৌরাণিক নাটকও অনেকটা তাই। ভাবাবেগ কোনো নাট্যকলা মানে না।
যা বলছিলাম, রূপক নাটকে ঘটনার চেয়ে বক্তব্য বা আইডিয়ার দাবী বেশি, কাজেই সেখানে ঘটনার তীব্রতা নাট্যকারের কাছে অপরিহার্য্য নয়। অচলায়তন-এ গান তাই সে নাটকের আঙ্গিকেরই অন্তর্গত।’
নববর্ষা সমাগমে টুশটুশে কালোজাম- দর্ভক পল্লীতে মাষকালাই ডালের তীব্র সুগন্ধ, ঘরে পাতা দই, বাসি পিঠা কালো মেঘের শ্রাবণে যেন এক দেহে মিশে যায়। নীল অরণ্য শিউরে উঠেছে গুরু গর্জনে, বিজন পাহাড় থেকে নামছে বাঁধ-ভাঙ্গা জলস্রোত, ময়ুর তার পেখম মেলেছে, শিউরে উঠেছে ঘুগোল কদম। দর্ভক পল্লীতে গান উঠে উতল ধারা বাদল ঝরে। সকাল বেলা একা ঘরে। সজল হাওয়া বহে বেগে। পাগল নদী উঠে জেগে। আকাশ ঘোর কাজল মেঘে তমাল বন আঁধার করে।
অন্যত্র- ‘ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে, তারে আজ থামায় কেরে!’ কিংবা ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা’- এইসব গান নাটকের থিমের গভীরে প্রোথিত। একে বাদ দিলে নাটকের বহিরঙ্গের কোনো ক্ষতি হবে না হয়ত কিন্তু অন্তর্গতভাবে নাটকটি গীতল স্পর্শ বর্জিত হবে। উপরন্তু গানের সঙ্গে রবীন্দ্রমানসের একটি সুগভীর সম্পর্ক আছে।
‘নাগরিকের গানগুলো মধ্যে সূক্ষ্মতার অভাব ছিল। কিন্তু আন্তরিকতার অভাব ছিল না।’ ‘উতল ধারা বাদল ঝরে’-সম্ভবত নিমা গানটি গেয়েছিল। ভাল লেগেছে। নিরাভরন গলা কিন্তু স্নিগ্ধ’- রইস বলে।
বাচ্চুু বলে- হ্যাঁ আমারও তাই মনে হয়েছে। যা হোক আমরা অচলায়তন নাটকের ভঙ্গী, তার স্বরূপ, উৎস ও উপাদানগুলো নির্দেশ করলাম। এবার দেখতে হবে নাটকীয় গতি অচলায়তন-র বর্ণনাত্মক ভঙ্গীকে মনোরম স্পর্শ দান করেছে কিনা।
দ্বিতীয় বৃত্ত
খ.
অচলায়তন-র কাহিনী বর্ণনা, ঘটনা সংঘাত বিচার ও দ্বিতীয় বৃত্তের সমাপ্তি।
বাচ্চুু অচলায়তন-র কাহিনী বর্ণনা করে।
একদা মন্থরগুপ্ত নামের এক রাজা ছিলেন। তার ছিল চারপাশে উচু পাঁচিল ঘেরা এক রাজ্য। রাজ্যের নাম ছিল স্থবির পত্তন। সে রাজ্যের শ্রীবিদ্যা নিকেতনের নাম ‘অচলায়তন’। কঠিন পাথরে গড়া সেই শ্রীবিদ্যা নিকেতনে দক্ষিণের উচ্ছ্বসিত বসন্ত বাতাসের প্রবেশ নিষেধ। সূর্যালোক? সেও-তো সরাসরি প্রবেশের পথ পায় না। অচলায়তনের জানালা আছে কিন্তু তা ব্যবহারের জন্য নয়। ঘরের ফরম হিসেবেই সেই জানালা। ছাত্রগণ বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক অন্ধ ধর্মাচরণে লিপ্ত। যেখানে পাপ-পুণ্যের হিসেব ছাড়া অন্য কিছু নেই। মন্ত্রের মাপে মুখ, দুকখ কিশোর পঞ্চক পারে না এই বদ্ধ বাতাসে থাকতে। কৈশোরের মুক্তি তার চার দেয়াল আটকে আছে। প্রশ্নের পর প্রশ্নে যে নিজেকে জর্জরিত করে, আচার্য আর মহাপঞ্চককে করে বিব্রত। এদিকে খবর রটে চাতুর্মাস্যায় গুরু আসবেন। অচলায়তনের লোকজন ধরে নেয় এই নিরেট ধর্মাচারণের তিনি একান্ত প্রতীক, সেই মতো আয়োজন চলে।
পঞ্চক বেরিয়ে আসে মুক্ত বনজ পরিবেশে। গাছের পাতায় পাতায় সেখানে আলো বাতাস খেলা করে। খেসারী ডাল ও কাঁকুড় চাষী শোনপাংশুগণের বন্ধু হয়। তাদের দাদাঠাকুর এক অদৃশ্য আকর্ষণে পঞ্চককে টানে। এদিকে এক বালক সুভদ্র একদিন অচলায়তনের উত্তরদিকের জানালা বালকসুলভ কৌতুহল-বশত খুলে দেখে এবং সেই শাস্তি কি হবে বালক জানতে চায়। বালকের মধ্যে এই পাপবোধ অসংগত। এ এক ধরনের বিকৃতি। তাও জানালা খুলে সে কোনো যৌনকর্মের স্বাক্ষী হয়নি। স্রেফ সবুজ মাঠে গরু চরা দেখেছে। মহাপঞ্চক তার মহা তামসব্রতের বিধান দেয়। আচার্য প্রতিবাদ করেন। ইতিমধ্যে শ্রাবণ আসি আসি করে। হঠাৎ করে একদিন খবর পাওয়া গেল মন্থরগুপ্তের লোকেরা কালঝন্টিদেবীর কাছে বলি দেবার জন্য দশজন শোনপাংশুকে ধরে নিয়ে গেছে। দাদাঠাকুর স্থবির পত্তনের উদ্দেশ্যে তখনই যাত্রা করেন। লড়াই শুরু হলে মন্থরগুপ্ত আচার্যের অদীনপুণ্যের কাছে আসেন। বিধান কি লড়াইয়ের। অবশেষে আচার্যের নিয়মভঙ্গের জন্য তাকে পদচ্যুত করে মহাপঞ্চককে মন্থরগুপ্ত আচার্যের পদে বসান। স্থবির পত্তনের দর্ভক পল্লীতে আচার্য অদীনপুণ্য ও পঞ্চক নির্বাসিত হয়।
দাদাঠাকুরের দল অবলীলাক্রমে স্থবির পত্তনে ঢুকে পড়ে। দর্ভক পল্লীতে তিনি গোসাই। তারপর তিনি অচলায়তনের দেয়াল ভাঙ্গেন- সবাই অবাক। এইতো তাদের গুরু।
সমস্ত প্রাচীর ধুলায় লুন্ঠিত হলে- তিনি স্থবিরকে আর দশজন শোনপাংশুর রক্তের উপর নতুন নির্মাণের কথা উচ্চারণ করেন।
বাচ্চুু এতোক্ষণ ধরে কথা বলে থামে। তারপর ফরিদী প্রশ্ন করে- ‘আপনি যে পরিণামের কথা বললেন অচলায়তন-এ, এটা ঘটনা প্রবাহের অনিবার্য ফল, নাকি এর অনেকখানি প্রকৃতিগত। অর্থাৎ এর নাটকীয় সংঘাত কি চরিত্রের বাহ্যিক কার্যাবলী দ্বারা পরিস্ফুটিত, নাকি তা শুধু অচলায়তনের দুইমুখী আদর্শের সংঘাত দ্বারা সৃষ্ট? প্রথমটি হলে তা হবে দুর্বল শিল্পকর্মের লক্ষণ।
‘না, এতে দুটি আইডিয়ার সংঘর্ষ থাকলেও তা শুধু প্রকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বলে বাচ্চু ভ্রু-কুঞ্চিত করে হাসে, বলে- ‘ও তুই বোধহয় বলতে চাইছিস যে অচলায়তনের পাথুরে নিয়ম-কানুনের মধ্যেই এর পতনের বীজ লুকিয়ে ছিল, দাদাঠাকুর বা শোনপাংশুদের কিংবা পঞ্চকের, চরিত্র হিসেবে কোনো ভূমিকাই ছিল না।
- হ্যাঁ।
- আসলে দুটোই সত্য। প্রকৃতিগত সংঘর্ষে আদর্শটাই বড়, মানুষ নয়। অচলায়তন-এ-ও তাই। কিন্তু দাদাঠাকুরের দলের নিরন্তর সক্রিয়তা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। ‘গুরু আসছেন’- আচার্য অদীনপুণ্য যে গুরুকে জানেন, তিনি দাদাঠাকুর দর্ভক পল্লীতে তিনিই গোঁসাই। দাদাঠাকুরের এই রূপ অচলায়তন-র নাটকীয় রহস্যের মূল উৎস। কালঝন্টি দেবীর কাছে বলি দেবার জন্য ধৃত দশজন শোনপাংশুর উদ্ধারের জন্য বিজয় অভিযান তুমুল নাটকীয় সংঘাত ও টেনশনের সৃষ্টি করেছে।
কিংবা যখন শোনপাংশুরা দেয়াল ভাঙ্গার পর বলে- ‘আর তো পারিনে। দেয়াল তো একটাও বাকি রাখিনি। এখন কি করবো? বসে বসে পা ধরে গেল যে।’ তখন বুঝতে পারি নাটকীয় সংঘাতকে রবীন্দ্রনাথ কৌশলে আদিম বন্যতা ও স্বাভাবিকতার সঙ্গে মিশ্রিত করেছেন। ফলে অচলায়তনের বাইরের চরিত্রগুলো স্বভাবে সক্রিয়তায় কোথাও অতি নাটকীয়তা সৃষ্টি করেনি। নাটকে অতি নাটকীয়তা না থাকা যে কত বড় গুণ সেটা এদেশের অনেক বয়েসী নাট্যকারও বুঝতে চান না।
চাতুর্মাস্য বা শ্রাবণে গুরু আসবেন, রবীন্দ্রনাথ এই কথাটাকে প্রকৃতি এবং চরিত্রের মাধ্যমে, অচলায়তনের গভীর সমস্যা, সুভদ্রের মহাতামস, আচার্যের প্রথানুগত ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ ও শোনপাংশুদের বলি হবার মুহূর্তের মুখোমুখি করেছেন। অচলায়তনের প্রকৃতির মধ্যে যে ধ্বংসের বীজ লুকানো ছিল তার পাশাপাশি বহিঃরসের ঘটনাগুলো স্পষ্টভাবে সংস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শ্রেষ্ঠনাটক মানেই তার অন্তর্গত পদধ্বনি বহির্জগতের ঘটনার সঙ্গে মার্চ করা।
তাহলে আলোচনার দ্বিতীয় প্রসঙ্গ অচলায়তন নাটকে বর্ণনাত্মক ভঙ্গীর সঙ্গে নাটকীয়তার সফল মিশ্রণ সম্পর্কিত আলোচনা এখানেই শেষ হল।
তৃতীয় বৃত্ত
পুলিশের হুইসেল ও আমি, ফরিদী এবং রইস।
অচলায়তন এর লোকজন সংলাপ রীতি ও ভাষা বিচার।
নাগরিকের সংলাপ উচ্চারণরীতি।
রাত বারোটা। সিগ্রেটের জন্য প্যাকেট হাতড়ে দেখি- একটিও নেই।
- এখন উপায়? আমি আঁতকে উঠি। ফরিদী বলল আমার প্যাকেটে আর মাত্র একটি! রইস বলে চলুন। মোড়ের দোকানটায়। চেঁচিয়ে তুলতে হবে দোকানীকে। আমরা তিনজন বাসার দেয়াল টপকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ি। ‘সোনার বাংলা’ স্টোরের মালিককে উদ্দীপণমূলক গানের বদলে তার টিনের ঝাঁপিতে তুমুল ড্রাম পিটিয়ে ঘুম থেকে তুলি। চারদিক থেকে হুইসেল। রাত বারোটায় কার্ফু। পুলিশ আতঙ্কিত। একে রাত্রি তার উপরে টিনপেটানো শব্দ। হুইসেল বাজিয়ে আসছে। আমরা সিগ্রেট নিয়েই চম্পট। দেয়াল চড়ে সোজা ওপাশে। আজও ঢাকার রাতগুলোতে বেশ গেরিলা গেরিলা গন্ধ! হেসে মরি আমরা।
গোল হয়ে বসতেই আবার জমজমাট হয়ে ওঠে আলোচনা, বাচ্চুু মূল কথক।
- তাঁর অন্য কোনো নাটকে এরকম ব্যঙ্গ ও বাগবৈদগ্ধ্যের ছড়াছড়ি নেই। অচলায়তনের দেয়াল ভাঙ্গার আগে পর্যন্ত যখনি এই বিদ্যানিকেতনের প্রসঙ্গ এসেছে, অবিরল ফেণাময় কৌতুক দৃশ্য পাত্রের চারপাশে গড়িয়ে পড়েছে। অথচ পাথুরের সেই দেয়ালের মধ্যে কিশোর পঞ্চক নীল পাখির পালকের খোঁজে সুগভীর চীৎকার ও প্রতিবাদের তুমুল তুফান তুলতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তা নেই। বরং দেখি পঞ্চক মুহূর্তে ব্যঙ্গে-বিদ্ধ করেছে তার পরিবেশকে।- এর কারণ কি?
- এটা ঠিক যে জীবনকে বাদ দিয়ে কোনো তত্ত্বই সম্পূর্ণ নয়। কিন্তু অচলায়তনে বেঁচে থাকা চলা-ফেরার তত্ত্ব জীবন ও যুক্তি বর্জিত। চিরকালই ধর্ম যেরকম মানুষের জীবনের উপর অসঙ্গত বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এসেছে, অচলায়তনে-ও তাই। মানুষের দিক থেকে তত্ত্বে যদি যাই তা হলে সেখানে গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্ন আসে, প্রশ্ন আসে তাকে মানবিক দিক থেকে মূল্যায়ন করার। কিন্তু তত্ত্বের সূত্রে যদি মানুষের কাছে আসি তাহলে সেখানে তর্ক চলে না। গ্রহণই সেখানে একমাত্র কাজ। বর্জনের প্রশ্ন অবান্তর। উপরন্তু হাজার বছর ধরে যে বিদ্যাপীঠে ধর্মীয় তত্ত্বের মাধ্যমে বিবেকবর্জিত পন্থায় জীবনচর্চা, সেখানে একটি অমল কিশোরের ক্রদ্ধ চীৎকার ঠাণ্ডা পাথরের গায়ে নিঃশ্বাসের কতটুকু ভাব জমা করতে পারত?
- অচলায়তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রীতিটা তাহলে কী হবে? উত্তর হচ্ছে যে, লড়াইটা অবশ্যই দাদাঠাকুরের রীতিতে হবে। দাদাঠাকুর রূপময়। প্রসন্নচিত্ত, মুক্তহাস্য ও তীক্ষ্ম সংবেদনশীলতার অধিকারী তিনি। তিনি প্রাবহতিক নিয়মেই হাসতে হাসতে দেয়াল ভাঙ্গেন। হয়ত কোনো ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে তিনি ভাঙ্গা তলোয়ার হাতে যুদ্ধে যান, কিন্তু তার পিছনে থাকে প্রাবহতিক শক্তি- যা ঘটনার চেয়েও বড় এবং অপ্রতিরোধ্য। বাচ্চু এবার পূর্ব প্রসঙ্গ টেনে বলে- অচলায়তন নাটকের রঙ্গব্যঙ্গের উৎস বিদ্যানিকেতনটির মধ্যেই খুঁজতে হবে।
- প্রবল বিপত্তির মুখে মানুষের প্রতিক্রিয়া দু’ভাবে ব্যক্ত হতে পারে (১) আর্তনাদে চীৎকারে, (২) সচেতন ব্যঙ্গ বা হতাশার মাধ্যমে। পঞ্চক সচেতন এবং সতর্ক। বিদ্রোহী, কিন্তু পরিশুদ্ধ চেতনার অধিকারী। অচলায়তনের ক্রিয়া আচারে কোনো মানবিক যুক্তি সে খুঁজে পায় না। সে নিজেই প্রশ্নে আহত। তাই প্রশ্নের পর প্রশ্নে অন্যদেরও জর্জরিত করে তুলে। এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বাইরের জগত। আর প্রশ্ন একটি সচেতন মনের ক্রিয়া।
- তারপর এসো. অচলায়তন-র মূল মানুষগুলোকে দেখা যাক। আগেই বলেছি, অচলায়তনের মধ্যে মানুষকে পাপ আর পুণ্যের মূল্যে বিচার করা হয়। সেজন্য দেখি সেখানকার মানুষগুলো একেবারেই বৃত্তাবদ্ধ। এ ধরনের মানুষকে মানুষ না বলে বলা উচিত কার্টুন। তাদের সকল পদক্ষেপ-চিন্তা-কর্ম যত বেশি নিয়ম-মাফিক হয় ততই তাদের কার্টুনভঙ্গী মানুষের স্বাভাবিক জীবন মুদ্রাকে ছাপিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অচলায়তনের মহাপঞ্চকেও তার ছাত্রগণ সবাই মানুষ নয়, মানুষের কার্টুন মাত্র। এমনকি সুভদ্র তার মহাতামসের ইচ্ছা শুনেও আমাদের ভেতরে করুণার সঙ্গে হাস্যরসের উদ্রেক হয়। আমি পড়ছি শোন।
পঞ্চক
তোর কোন ভয় নেই ভাই, কোন ভয় নেই। তুই আমার কাছে বল কি হয়েছে বল।
সুভদ্র
আমি পাপ করেছি।
পঞ্চক
পাপ করেছিস? কি পাপ?
সুভদ্র
সে আমি বলতে পারবো না। ভয়ানক পাপ। আমার কি হবে?
পঞ্চক
তোর সব পাপ আমি কেড়ে নেব, তুই বল।
সুভদ্র
আমি আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের-
পঞ্চক
উত্তর দিকের?
সুভদ্র
হ্যাঁ, উত্তর দিকের জানালা খুলে-
পঞ্চক
জানালা খুলে কী করলি?
সুভদ্র
বাইরেটা দেখে ফেলেছি।
পঞ্চক
দেখে ফেলেছিস? শুনে লোভ হচ্ছে যে।
সুভদ্র
হ্যাঁ পঞ্চক দাদা, কিন্তু বেশীক্ষণ না- একবার দেখেই তখনই বন্ধ করে ফেলেছি। কোন প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার পাপ যাবে?
পঞ্চক
ভুলে গেছি ভাই। প্রায়শ্চিত্ত পঁচিশ হাজার রকম আছে। আমি যদি এই আয়তনে না আসতুম তাহলে তার বারো আনাই কেবল পুঁথিতে লেখা থাকতো; আমি আসার পর প্রায় তার সব কটাই ব্যবহার লাগাতে পেরেছি, কিন্তু মনে রাখতে পারিনি।
অন্যত্র-
পঞ্চক
মাতৃহত্যা করলুম না অথচ মাতৃহত্যার পাপটা করলুম; সেই মজাটা কি রকম দেখতে আমার ভয়ানক কৌতুহল।
১ম বালক
তোমার ভয় করবে না?
পঞ্চক
কিছু না, ভাই সুভদ্র তুই কি দেখলি বল দেখি।
২য় বালক
না, না বলিসনে।
৩য় বালক
না, সে শুনতে পারবো না- কি ভয়ানক
১ম বালক
আচ্ছা, তুই একটু খুব একটুখানি বল ভাই।
সুভদ্র
আমি দেখলুম সেখানে পাহাড় গরু চরছে-
বালকগণ
(কানে আঙ্গুল দিয়া) ও বাবা! না, না আর শুনব না, আর বলো না সুভদ্র। ...
- তাহলে দেখা যাচ্ছে অচলায়তন নাটকের সংলাপে যে হাস্যরস তার উৎস অসঙ্গত ধর্মাচরণ, পাপ-পুণ্যের সংকীর্ণ নিয়মের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক চেতনার বিরোধ। কাজেই পঞ্চকের কৌতুহল আর নির্বোধ বালকদের ভীতি একটি চমৎকার কৌতুকরসের সৃষ্টি করেছে।
- তাহলে এবার ভাষা সম্পর্কে আলোচনা হোক। আমি বলি। ‘কারণ নাগরিকের অভিনয় দেখে আমার মনে হয়েছিল, অচলায়তন-র সংলাপের বিভিন্নস্তর আছে। উপরন্তু এ নাটকের কৌতুক যতটা না বাক্যাশ্রয়ী তারো চেয়ে বেশি ঘটনাশ্রয়ী। তার অর্থ অচলায়তন-র ঘটনা প্রক্রিয়া ভাষা প্রক্রিয়ার সমান্তরাল।’ বাচ্চু একটু চুপ করে। ম্যাচের উপর সিগারেট ঠুকতে ঠুকতে হঠাৎ থেমে যায়।- তুই ঠিক ধরেছিস। অচলায়তন-এ পরিবেশ অনুযায়ী ভাষা রীতিরও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অতি সাধারণ ভাষার স্তর থেকে মহাপঞ্চকের তৎসমবহুল ভাষার স্তর পর্যন্ত আমি এভাবে ক্রমবিন্যস্ত করতে পারি-
(১) শোনপাংশু (২) দর্ভক, (৩) পঞ্চক, (৪) দাদাঠাকুর, (৫) সুভদ্র ও অন্যান্য বালকগণ, (৬) উপাচার্য মহাপঞ্চক।
এক থেকে ছয় পর্যন্ত মোটামুটি অচলায়তন-র ভাষাকে দুটি বড় দাগে ভাগ করা যায়। প্রথম দাগের ভাষার নমুনা দিচ্ছি সবাই শোন-
পঞ্চক
কাঁকুড়! ছি-ছি খেসারী ডালের চাষ করিস বুঝি?
তৃতীয় শোনপাংশু
কেন করব না? এখান থেকেই তো কাঁকুড় খেসারি ডাল তোমাদের বাজারে যায়।
অথবা
দর্ভক
কেতনের মাসি পরশু পিঠে তৈরী করেছিল, তার কিছু বাকী আছে।
কিংবা-
প্রথম দর্ভক
আমরা আজ শুধু মাষকালাই আর ভাত চড়িয়েছি।
দাদাঠাকুর
আমার তাতেই হয়ে যাবে।
(মহাপঞ্চক যখন শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করে না তখন শোনপাংশুরা বলে)
প্রথম শোনপাংশু
ঠাকুর, এই লোকটাকে বন্দী করে নিয়ে যাই, আমাদের দেশের লোকের ভারী মজা লাগবে।’
দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাষা বিচারের আগে আমরা ঠিক মধ্যিখানে দাদাঠাকুরকে রাখতে চাই। তাঁর ভাষা শোনপাংশু, দুর্ভকগণ বা পঞ্চকের ভাষাশৈলীর একেবারে শেষ স্তরে। তাতে আদিবাসীর নির্বেদ সরলতা নেই, পঞ্চকের দ্বিধা কিংবা প্রশ্নের ধার নেই। অন্যদিকে অচলায়তনের শাস্ত্রীদের মত দাদাঠাকুরের ভাষায় তৎসম শব্দের অজস্র প্রয়োগও নেই। নেই তাতে অচলায়তনের ভাষার অনুবর্তনজনিত ক্লান্তি। কারণ তিনি লক্ষ্যে স্থির, বিচারে নির্ভুল-মুক্তির তীব্র ওঙ্কার, সমুদ্রশঙ্ক তিনি দাদাঠাকুর- ‘আমিও যে ওদের সঙ্গে মেলে বেড়াই যে খেলা আমার মস্ত খেলা। আমার মনে হয় আমি ঝরণার ধারার সাথে খেলছি, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে খেলছি।’ এ ভাষা অন্তর্গতভাবে সরল নয়- এ ভাষা উচ্চারণের প্রথম বৃত্তেই আবদ্ধ নয়।
‘এতে শব্দ প্রয়োগে জটিলতা নেই কিন্তু এর অন্তর্গত বাণীকে অচলায়তন নাটকের থীমের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয়।’ অন্যত্র দাদাঠাকুর বলছে- আমাদের রাজার আদেশে আছে ওদের পাপ যখন প্রাচীরের আকার ধারণ করে আকাশের জ্যোতি আচ্ছন্ন করতে উঠবে, তখন সেই প্রাচীর ধূলায় লুটায়ে দিতে হবে।
আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি- দাদাঠাকুরের ভাষায় প্রতিটি শব্দের সচেতন প্রয়োগ আছে। এ ভাষা প্রতি মুহূর্তেই সৃষ্টি হয়। মন্ত্রোচ্চারণের নির্দিষ্ট ভঙ্গীতে বাঁধা নয় এ-ভাষা। এ ভাষায় দাদাঠাকুরের নিশ্চিত বিশ্বাস ও অসীম সাহসের পরিচয় আছে।
বাচ্চুু পড়ে যায়-
মহাপঞ্চক
না আমি তোমাকে প্রণাম করব না।
দাদাঠাকুর
আমি তোমাকে প্রণত করব।
মহাপঞ্চক
তুমি আমাদের পূজা নিতে আসনি?
দাদাঠাকুর
আমি তোমাদের পূজা নিতে আসিনি, অপমান নিতে এসেছি।
- বাচ্চু থামে।
‘তাহলে বুঝতেই পারছ যে দুটো সাধারণ ভাগ করেছি অচলায়তন-র ভাষায় তার দ্বিতীয়টি মহাপঞ্চকদের ভাষা। অচলায়তনের বাসিন্দাদের ভাষা অনুবর্তন ও আবেগের ক্লান্তিতে ভরপুর। মনে হয় রবীন্দ্রনাথ অচলায়তনের বাসিন্দাদের ভাষার মধ্যেও অচলায়তনের ক্লান্তিকর জীবন যাপনের একটি প্রতীক নির্মাণ করতে পেরেছেন। এরা উচ্চস্বরে হাসে না। বড্ড সন্দেহপ্রবণ। কিছু হলেই মন্ত্রের উৎসে চলে যায়। আমি কিছু বিদঘুটে মন্ত্রের নাম বলছি শোন-
অমিতায়ুর্ধারিণী- শশ্রুভয় নাশক,
গৃহমাতৃকা- ঘরের ভয় নাশক,
অভয়ঙ্করী- বাইরের ভয় নাশক,
মহাময়ুরী- সাপের ভয় নাশক,
বত্রগন্ধারী- বজ্রের ভয় নাশক,
চন্ড ভট্টারিকা- ভূতের ভয় নাশক,
হরাহর হৃদয়- চোরের ভয় নাশক।
ওদের একজন মুনীর নাম- মহামহর্ষি জলধরগর্জিত সুস্বরনত্র শকুসুমিত। ব্যাস এ পর্যন্তই।- বাচ্চু থামে।
‘আমরা এবার নাগরিকের সংলাপ প্রয়োগরীতিতে আলোচনা করব।’
‘নাগরিক উপাচার্যের চরিত্রটি বাদ দিয়েছে। মহাপঞ্চকের চরিত্রে আতাউর রহমানের প্রলম্বিত উচ্চারণভঙ্গী আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু নাগরিক শোনপাংশুদের ভাষাকে আঞ্চলিক রূপ দিয়েছে এবং একাজটি যথার্থ হয়নি।’- আমি বলি।
‘কেন তাতে বরং চরিত্রগুলোকে অধিকতর জীবন্ত মনে হয়েছে।’- রইস উত্তর করে।
আমি প্রতিবাদ করি- ‘কোনো রূপক নাটকের কোনো বিশেষ অংশে বা চরিত্রে বাস্তবতার স্পর্শ থাকলে তা নাটকটার মূল প্রবাহকে ক্ষুণœ করে। কারণ ভাষা বাস্তব হলে চরিত্রও বাস্তব হয়ে যায়। কাজেই শুধু শোনপাংশুদের চরিত্র বাস্তব হলে অন্যান্য চরিত্রগুলোর মধ্যে তাকে অসঙ্গত মনে হবে। এর ফলে গোটা নাটকটাই হয়ে যেতে পারে বিপর্যস্ত।
তখন রইস বললঃ অর্থাৎ আপনি বলতে চান বিশেষ অংশে বাস্তবতার প্রয়োগের ফলে রূপক নাটকের প্রকৃতি বিনষ্ট হয়?
- অবিকল তাই বলতে চেয়েছি আমি।
বাচ্চুু এবার উপসংহার টানে।
- তোর যুক্তির আলোকে শোনপাংশুদের মুখে বাস্তব সংলাপের প্রয়োগকে আমারও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে। পঞ্চকের ভূমিকায় মাহমুদ হোসেনকে শোরিক চাপল্যের সঙ্গে বিপর্যয় আনয়নকারী প্রশ্নের সমন্বয় সাধনে সফলতা লাভ করতে পারেনি। আর আঙ্গিক উপস্থাপনাও দুর্বল। তবে দর্শকদের ঔৎসুক্য তার অভিনয় জাগ্রত ছিল। কিন্তু সুরেলা গদ্যের ভঙ্গী আমার মনঃপুত হয়নি। শোনপাংশুদের মধ্যে নারী চরিত্রের কোনো নির্দেশ ছিল না মূল নাটকে। নাগরিক তা করছে। এবং তা শোভনও হয়েছে।
‘আমার প্রিয় চরিত্র দাদাঠাকুর। এ চরিত্রটি অভিনয়ে খুব সতর্ক থাকা উচিত। দাদাঠাকুর অচলায়তন নাটকের কেন্দ্রবিন্দু। এই চরিত্রের মধ্যে আধুনিক মন ও গ্রাম্য বাউলের মুক্তচেতনার মিশ্রণ ঘটেছে। দাদাঠাকুরের মধ্যে প্রাণময়তার সঙ্গে গভীর বিশ্বাসের সংযোগ দেখতে পাই। প্রমত্ত পদ্মার মত তিনি ভাঙ্গন ও সৌন্দর্যের আধার। এই চরিত্রটি রূপায়ণে আলী যাকেরের সবচে বেশি যত্ন নেয়া উচিত ছিল। সালেক খানের উচিত ছিল গোড়া থেকেই চরিত্রটি নির্মাণ করা। দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্তিবাদী চেতনার মিশ্রণে বাক্যপ্রবাহের যে সম্ভাব্য রূপ হতে পারে তা পরীক্ষা করা।
আমি রাবিন্দ্রীক উপস্থাপনাকে এ মুহূর্তে অনুমোদন করি না। কারণ অচলায়তন-কে আমরা সময়োপযোগী নির্বাচন বলে মনে করি।
কাজেই অচলায়তন-র উপস্থাপনা আমাদের বর্তমান সমাজের মূল ভঙ্গীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। নাগরিক সার্বত্রিক না হোক আংশিকভাবে হলেও সমকালীন উপস্থাপনার কথা ভেবেছে নাটকটি দেখে তাই মনে হয়।’- বাচ্চু থামে। আমরা আবার বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলাপ শুরু করি। অতঃপর আলোচনার চতুর্থ বৃত্ত শুরু হয়।
চতুর্থ বৃত্ত
অচলায়তন মূলত একটি রূপক নাটক। গদ্য সংলাপ ও কাব্য নাট্যের ভবিষ্যৎ।
বাচ্চুু বললো- অচলায়তন মূলত একটি রূপক শ্রেণীর নাটক। আর রূপক শ্রেণীর নাটকে লেখকের আইডিয়া অতি পৃথুলভাবে মোটা মোটা লাল কালো দাগে চিহ্নিত হয় চরিত্রের মাধ্যমে। সেলিমকে একটা রূপক নাটক লিখতে বলে দেখ রইস! সে তোকে নির্ঘাত খুন করে ফেলবে।
‘মানুষের ভঙ্গীর টোকেন কখনও উচ্চশ্রেণীর নাট্যকর্ম হতে পারে না। রূপক নাটকের চরিত্র আমাদের বুদ্ধিকে নাড়া দেয়- ওফেলিয়ার কবর খননের মত সে কখনও মনকে নাড়া দেয় না। আমি এ কালের কোনো রূপক নাটক লিখিয়ের সঙ্গে এক টেবিলে বসে চাও খাব না কখনও।’- আমি বেশ উচ্চকন্ঠে বলি। কিন্তু রূপক নাটক সম্পর্কে এই মন্তব্য রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন-র ক্ষেত্রে যথার্থ কিনা তা দেখতে হবে। আমি স্বীকার করি রূপক নাটকে লেখকের ভেদবুদ্ধি যতটা কাজ করে শিল্পের সেই গূঢ়বোধ ততটা কাজ করে না। রূপক নাটক বক্তব্য প্রকাশের একটি কৌশল মাত্র এবং এই কৌশলটা অতি স্পষ্ট। তুই যে এক টেবিলে বসে কোনো রূপক নাটকের লেখকের সঙ্গে চা’ও খেতে রাজী নস, একথা খুব বাড়াবাড়ি হলেও আমি তোর শিল্প সচেতনতার প্রশংসা করি।’ ‘এদেশের অনেক লেখক আধুনিক নাট্যান্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত ভাবেন কিন্তু লেখার সময় ঐ রূপক নাটক। তাঁরা সেখানে তাঁদের পরিকল্পিত চরিত্রগুলোর কাঁধে চেপে কোন স্বর্গে যাত্রা করেন তা নরকই জানে।’
কিন্তু কথা হচ্ছে অচলায়তন নিয়ে। আজ থেকে সত্তর বছর আগে লেখা একটি নাটক নিয়ে। এ নাটকের লেখক এমন এক শিল্পী যিনি আমাদের চেতনাকে আজও পিতৃসুলভ স্নেহে সমৃদ্ধ করেন। তাই অচলায়তন সম্পর্কে আজকের দিনের ধারণা প্রযোজ্য নয়। কারণ এ নাটক বিশাল রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনদৃষ্টি ও শিল্প-সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কাজেই অচলায়তন-কে স্রেফ রূপক নাটক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কবিতায় তিনি যে কথা বলেছেন ছন্দে, গানে দেখি তারই বিস্তার। কবিতায় ও গানের যে-ধারা নাটকের সমুদ্র শঙ্কে তারই ওঙ্কার। তাই নাটকে মানুষের কার্টুন ভঙ্গীর জীবন-যাপনের মধ্যে মুক্ত প্রকৃতির ডাক- বিধিবদ্ধ নিয়মের সঙ্গে মুক্ত প্রকৃতির সংঘর্ষের কথা অন্য কোনোভাবে হয়ত বলা সম্ভব ছিল না। মানবজীবন সম্পর্কে এই নাটকে রবীন্দ্রচেতনা একটি দিব্য প্রেরণাজাত, যা অনায়াসেই হতে পারে কবিতারও বিষয়বস্তু।
সেই নাটকই শ্রেষ্ঠ যার কোনো চরিত্র বা ঘটনা অথবা সেই নাটকের বিষয়বস্তুকে একটি অসাধারণ কবিতায় রূপান্তরিত করা যায়। কিংবা যে-নাটকের চরিত্র ঘটনা বা কোনো পংক্তি কারো মধ্যে যদি নতুন প্রেরণা ও উন্মাদনার সৃষ্টি করে, তাকে আমরা একটি সত্যিকার শিল্পকর্ম বলে আখ্যায়িত করতে পারি। শিল্পেও দ্বৈতাদ্বৈত সম্পর্ক আছে। আছে বলেই শেক্সপীয়রের হ্যামলেট নাটকের কবর খননের দৃশ্য অথবা ওনীলের এলম গাছের ছায়াতলে সাধ নাটকে ফসল সম্পর্কে এরফায়েম ক্যাবেট এর পাথুরে ঈশ্বরের অনুভূতি কারো কবিতার বিষয় হতে পারে। যেমন রিলকে তাঁর শিল্পবোধের শিক্ষা পান রঁদ্যার ভাস্কর্যকর্ম থেকে।
রবীন্দ্রনাথের সময়ে এবং তারও আগে বাংলা ভাষায় প্রচুর সামাজিক পৌরাণিক নাটক ও প্রহসন লেখা হয়েছিল। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে ঐসব নাটক শিল্পগুণের দিক থেকে এতই অকিঞ্চিতকর, বিষয়বস্তুর দিক থেকে এত স্থূল যে রবীন্দ্রনাথকে এসবের বিরুদ্ধে প্রায় একাকী লড়তে হয়েছে। তবে লড়াইতে তার সুবিধা ছিল অনেক। প্রথমত, গানে বা কবিতায় যে জীবন চেতনা, তাকে অনায়াসেই তিনি নাট্যবস্তুতে রূপান্তরিত করে- বাংলা নাটকে একটি পৃথক ও অনন্য নাট্যধারা জন্ম দিয়েছিলেন। আর ছিল তাঁর সোনালী ভাষা। তাঁর অমল আলখাল্লার মধ্যে ছিল একটি সোনালী মাকড়শার সংলাপ থেকে সংলাপ, যে শুধু বুনেছে তার সূক্ষ্ম সুতাতন্তু। ডাকঘর-র অমলের কথা, সুধার কথা- রক্তকরবী-র নন্দিনীর কথা- ভেবে দেখ।
‘তাহলে রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটক সম্পর্কে তোমার মন্তব্য প্রযোজ্য নয়। যদিও একালে অতিস্থূল পন্থায় রূপক নাটক লেখা হচ্ছে এবং ঐ সব নাটক লেখক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গ্রোপাগান্ডায় নাম লিখিয়ে নিজের কীর্তির চেয়ে নিজেই বেশি উল্লেখযোগ্য হয়ে গেছেন।’
‘টি এস এলিয়েট বা উইষ্টান অডেন’গন যখন কাব্যনাট্য লিখে কবিতার শক্তিমত্তা প্রমাণে ব্যস্ত- ঠিক সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ গদ্যেই তাঁর নাটক রচনা অব্যাহত রেখেছিলেন। অচলায়তন ছাপা হয় ১৯১১ সালে, রক্তকরবী ১৯৩০-এর দিকে সম্ভবত। রবীন্দ্রনাথ কি সচেতনভাবে অনুধাবন করেছিলেন যে অবশেষে একদিন গদ্যই হবে বিশ্বব্যাপী নাটকের জন্য উপর্যুক্ত ভাষা?’
‘এলিয়টরা কাব্যনাট্য নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিলেন সন্দেহ নেই। কারণ পদ্য তখন প্রাচীন মূল্যবোধ ছেড়ে গদ্যের শ্যামকে আলিঙ্গন দিয়ে বসেছে। সেইতো স্বাভাবিক। কতকাল আর বিরহ চলবে। গদ্য-পদ্যের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের উপমাটা যদ্ধুর মনে পড়ে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের।
এলিয়টদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল এইজন্যে যে তাতে পদ্য, পদ্যের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যুগধর্ম প্রতিফলিত হয়নি। থিয়েটারের বাস্তবতাবোধের বদল তাঁদের নাটকে কবির অহমিকাই প্রকাশিত হয়েছিল। গদ্য দিয়ে কবিতার নিগূঢ় সৌন্দর্যকে আবিস্কার করতে পেরেছিলেন বলেই নাটকে রবীন্দ্রনাথ দৃঢ়বিশ্বাসে গদ্যকেই ব্যবহার করেছিলেন।’- এতোক্ষণ ধরে কথা বলে বাচ্চুু। রাত একটা। বাচ্চুুর বউ উঠে যায় এবং অনতিবিলম্বে বিস্কিট আর উষ্ণ ধূমায়িত চা নিয়ে পুনঃপ্রবেশ করে। পাশের বাসা থেকে কুকুরের অবিরল কান্নার ধ্বনি শোনা যায়। বাচ্চুুর বউ ভয়ে বাচ্চুুর গা ঘে’সে বসে। অনেকদিন আগে ওই বাসাটায় কে যেন গলায় দড়ি দিয়েছিল। সেই থেকে প্রায়ই রাতে-কুকুর কাঁদে। একটানা অনেকক্ষণ।
‘এসো এবার আমরা পঞ্চম ও শেষ বৃত্তে প্রবেশ করি। বাচ্চুু একটু কেশে নিয়ে বলতে শুরু করে।’
পঞ্চম বৃত্ত
নাগরিকের মঞ্চ পরিকল্পনা। অচলায়তন-র সমকালীন ব্যাখ্যা ও আলোচনার সমাপ্তি।
‘এখন নাগরিকের মঞ্চ পরিকল্পনার কথা বলব।’- বাচ্চু একটু কেশে নিয়ে বলতে শুরু করে।
‘মহিলা সমিতির মঞ্চ এত সংকীর্ণ যে সেখানে একটা নাটকের সফল মঞ্চায়ন আদৌ সম্ভব নয়। সেখানকার আলোর উৎস ও ব্যবহার, পর্দা উঠানো নামানো ও উইংসগুলোর অবস্থান এতই সেকেলে আর অচল যে, দেখে যে কোনো নাট্যকর্মীর প্রথমেই নিরুৎসাাহিত হয়ে যাবার কথা।
নাটকটির নাম অচলায়তন হলেও তার জন্য এরকম অচল মঞ্চ যে অসুবিধাজনক সেটা আলী যাকের নিশ্চয়ই অনুভব করেছিলেন।
নিষেধের প্রতীক হিসেবে লালবাতির ব্যবহার সুন্দর হয়েছে। কিন্তু অন্যসব মঞ্চসজ্জায় যথেষ্ট সার্থকতা ছিল না বলে মনে হয়েছে। তবে সেটের সামগ্রিক বিস্তারের সঙ্গে কস্ট্যুমের সামঞ্জস্য ছিল। তবে এই আলোচনা যেন ভাল হত যদি আরও ভাল ‘হলে’র মত মনে না হয়। নাগরিকের সাফল্য অন্যত্র। সেটা হয়ত মঞ্চের নিখুঁত সাজসজ্জা, পরিচালনা বা অভিনয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে সাফল্য সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে দেখতে হবে।
‘দাদাঠাকুর হাসতে হাসতে দেয়াল ভেঙ্গেছেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের সৃষ্ট সমকালীন অচলায়তন কে ভাঙ্গবে? তাদের ত’ শুধু একশ বছর লেগেছে বুঝতে যে তাদের আদত মাতৃভাষা কোনটি। এই বাংলাদেশে কত রঙ্গের মহাপঞ্চক এল আর গেল। একেকটি অচলায়তন ভেঙ্গে ফেলে অস্থির ও রাগীপঞ্চকেরা। তারপর আবার গড়ে উঠে।
কিন্তু সময় এসেছে। শ্রাবণের গরুড় মেঘ পাখা মেলেছে, অচলায়তন আবার ভাঙ্গবে। শেষ ভাঙ্গা। মহাপঞ্চক যতই ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করুক, বিদ্যুৎ গর্জাবে, পৃথিবী শ্যামল হবে। দ্রাবিড় রক্তে জাগবে শোনপাংশু- অধীরতা। দাদাঠাকুর এসে হাসতে হাসতে দেয়াল ভাঙ্গবেন।
আলোচনা শেষ হল। রাত তিনটে। পঞ্চম বৃত্ত শেষ। পরদিন খুব ভোরে ঝুরতে ঝুরতে জাহাঙ্গীরনগরের বাস ধরে ক্যাম্পাসে। ক’দিন পরে আতাউর ভাই-এর সঙ্গে এ্যাডবেস্টে প্রায় দেড় ঘন্টার মত আলাপ হয়। বলা বাহুল্য আলোচনা খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল এবং অচলায়তনের অনেক বিষয়ে আমরা ঐক্যমতে পৌঁছেছিলাম।
সেলিম আল দীন : সদ্য-প্রয়াত নাট্যকার